শনিবার, ৩১ অক্টোবর, ২০০৯

কবি বিজয় আহমেদের কবিতা

ম্যাজিক


এই যে লাল পাখিটা নীল হয়ে গেল।
একরাশ ধুলো এই যে হঠাৎ
হয়ে গেল মায়া;
আর সেই মায়ার নদীতে, এই যে একদল জাদুকর
নিজের নাম ভুলে, মুহূর্তেই
হয়ে উঠছে, লাল রঙের এক মাছের হাতে ধরা দুর্দান্ত রুমাল!

বলি, কি বলে একে, জাদু-অলক্ষ্যের গান,
পাখির বুকে লুকিয়ে থাকা বট- বীজের
খিলখিল হাসি?

এসব কিচ্ছু জানি না আমি, শুধু জানি চোখ মেললেই
-সিনেমাহলের গান হয়ে উঠে জালালি কবুতর
-গমক্ষেতের বাদামি রঙ হয়ে উঠে নীলচে প্রেমপত্র

আর একদল ধুলো হয়ে উঠে মায়া
আর মায়া হয়ে উঠে, নীলচে চিঠি, মায়ের ফটোগ্রাফ


২.
ধরো তুমি ধূলির গায়ে,
নীলচে নাকফুল আর ঘাসের পাশে
এঁকে দিলে দুষ্টুমতন একটা গায়ক চড়াই
বলতে পারো, কি করবে তার শালিক-চিলে?

আর শোনো, যদি দেখো অঙ্কিত ক্যানভাস থেকে হঠাৎ করে
সেই উড়ু মনের গায়ক চড়াই, উড়তে থাকে আচ্ছা
তখন তাকে বলো তুমি, শাবাশ বাঘের বাচ্চা?


৩.
বলি কেন যে এমন হয়
নদীরাও রাগী যুবকের শহর ছেড়ে এসে, আমার বাড়ির
পাশ ঘেঁষে চলে যায়;

আর আমি ব্যাকরণবীদ, নদীদের জন্যে
সোনার অক্ষরে লিখি
ডুবসাঁতারের নিয়ম-নীতি আর রূপ-অরূপের মায়া

আর নদী, সেও ইঙ্গিতপ্রবণ
বলে যে নাকফুলেই নাকি সবচেয়ে সুন্দর হয়ে ফোটে
মৃতদের শাদা শাদা হাসি


শীতের কবিতা

শুনছো তো এ শীতকালে, খেজুরবাগানের উষ্ণতা হতে
উড়ে আসা বেপেরোয়া গন্ধের মায়ার সাথে
ঝগড়া করছে তোমার বউ

তোমার বউ,
যে মূর্খ-সুন্দরী এবং কামগন্ধময়
যে কফিতে ঠোঁট ডুবিয়েই ভুলে যায় গ্রাম- রঙধনুর স্মৃতি

বলো তার কেন এতো মিহিন-মুগ্ধ
ঝগড়া আর বিবাদ
খেজুর বাগানের উষ্ণতার সাথে?


দস্যু মোহন

এখানে তুমিই দস্যু মোহন। দেবদারু বনের একান্ত ঝিরঝিরে গোপনে
কেনো যে ছড়িয়ে দিচ্ছো,
বিচিত্র সব মশলা ও লবঙ্গের ঝাঁঝ, রহস্য আর আবেগহীন উত্তেজনা,
সত্যি আমি কানা বাদক, এসবের মানে বুঝি না!

শুধু বুঝি অজস্র পুলিশ ও গোয়েন্দাবাহিনীর চোখ এড়িয়ে, এই যে শহরতলীর মাটি থেকে
তুলে আনছো সিনেমা হলের অতিপ্রাকৃত গান, তা আসলেই ধাঁধাঁ,
তা আসলেই যৌনভাষাময় একপ্রকার মায়ার জাদু।

আমি এমন গানের ভিতরে ঢুকে যেতে চাই, অন্ধ এক ডুবুরির মতন
আর ছোট্টবেলার কানিজ আপার কাছে, এক অতিকায় ট্রেনের লালচে বগী করে পাঠাতে চাই
তার প্রিয় ঘুমকাতুড়ে ও অদ্ভূত ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর মিউজিক।

এখানে তুমিই দস্যু মোহন, বলি, তুমিই জানো সোনাখনির লাল-নীল লোভে
কোন সে বিদেশি
ব্যাপক উন্মাদ ইদানিং!


আয়ুর জীবনী

আয়ু, প্রিয়তম বালক ভাইটি আমার
তোমাকে নিয়েই আমার মা লিখেছে এক হাসাহাসির উপন্যাস;
সেই গ্রন্থের পাতায় পাতায় সোনার হরফ আর আশ্চর্য মুগ্ধতা;
আমি সেইসব হরফের গায়ে হাত বুলাই
আর শুনি তাদের গায়ে একপ্রকার মিউজিক বাজতে থাকে!
আমি সেই মিহিন মিউজিকে দেখি দৌড়াচ্ছে এক ম্যারি গো রাউন্ড
এবং তার পিছু পিছু এক বৃষ্টি কাতর উন্মাদ;
মহাসড়কের পাশ দিয়ে আগন্তুক বোঝাই লরী থেকে আখ পেড়ে নিয়ে
হেঁটে যেতে যেতে রাংতা বালক আমি
ভাবি আমার মা তাইলে এমন প্রখর মেধাবী।
আয়ু আমাদের একঘেঁয়ে রান্নাঘরে তোর জীবনী আঁকা হলো যেদিন
সেদিন থেকেই জগতের সকল নদীর বাঁকে হারিয়ে যাওয়া অথবা পায়ের নিচে চাপাপড়া
রাস্তাগুলোর পুনরায় জন্ম হল মশলার ঝাঁঝ ও গুমোট গরমে।

ভাবি যদি এবার
সমুদ্রগ্রামের তলদেশ থেকে টাইটানিকের সাথেই উঠে আসে খোয়াজ খিজির
তবে কেমন হবে?

যাই হোক, বলি মা আমাকে গতকাল দিয়েছে আগুনের নৃত্য গুঁজে দেয়া
এক উলের স্যুয়েটার। আমি যেই মুখ ডুবিয়ে দেই সেই ম্যাজিক ভুবনে
তখনি যেন আকাশগ্রামে
আরো একটা উল্কাপতন ঘটে।
আর সেইসব উল্কারা তাদের ব্যক্তিগত যে স্মৃতিগুলো জমা রেখেছিল কফিনের
জাদুঘরে, তারা হুটহাট জীবন্ত হয়ে উঠে এবং চড়ে বসে এক ফ্লাইংসসারে,
আর ভাড়া করা মাইকে ‘হ্যালো মাইক্রোফোন টেস্টিং বলতে বলতে’ শোনায়
-এই যে ঘুড়ি, এরাই তারাদের দূতিয়ালি করে
-এই যে পায়রাগুলো এরাই আকাশগ্রামের সেইসব আউট ল যারা
রাজ্যের বিদ্রোহী ছিল
-এই যে শালিখেরা, টিয়েপাখিরা এরাই ছিল বৃদ্ধ রাজার দুই তরুণী-স্ত্রী,
যারা পালিয়েছিল একদা এক মেঘ ঝিরঝিরে বিকেলে সুপুরুষ
সেনানায়কের হাত ধরে, একই সাথে
আমি মাকে বলেছি মাগো একটা উড়ন্ত বাইসাইকেলের খুব লোভ
কেননা সাইকেল এমন মোহন জাদুকর, যে বাদ্যি বাজায় আর বলে অজস্র বিলুপ্তপ্রায় জোক্স
শুনে মা বলে বাবা রে, তুই যখন খুব ছোট, তখন এক শীতসকালে
খেজুরের রস আনতে গিয়ে চোরাকাঁটায় যখন কেটে গেল পা
আর বেরুল গলগল করে নীল-রক্ত
তখনি বুঝলাম তুইই হবি সেই মহত্তম পুরুষ
যে ইচ্ছে করলেই নিলীমাকে করতল বানিয়ে লুকিয়ে ফেলতে পারবি
সমুদ্র-বণিকের ম্যাপ!

বলি কী হবে হয়ে মহত্ত্বম পুরুষ
আমি জানি রেলট্র্যাকের পাশেই মুখ লুকিয়ে থাকে যে লজ্জাবতী ও ঘাসফুলের দঙ্গল
তাদের নিরন্তর ঝগড়াধ্বনিতেই আরো ইশারাকাতর আরো ইঙ্গিতবাহী
হয়ে উঠে এ পৃথিবী;
এ ঝগড়াধ্বনির চেয়ে সুরেলা আর কোনো গান নেই
এ সৌন্দর্যের চেয়েও অধিক কোনো সৌন্দর্য নেই ঘোড়ার কেশরও

জেনো মা, শুয়ে থাকা রেল-ট্র্যাক যে ভাষা শিখিয়েছে আমাকে
তার চেয়ে ধুঁয়া-ধূসর, উচ্ছ্বল ও স্বর্ণ-উজ্জ্বল আর কোনো ভাষাই নেই, এ পৃথিবীর দুপুরবেলা নামক পুস্তকে;
শোনে, মা হাসে আর বলে
-পায়রারাই দূত, ম্যাসেন্জার জানিস?
জানি
-মেঘেরাই রঙের দোকানদার, জানিস
জানি
-যৌনতাই সবচেয়ে উজ্জ্বলতম লাল রঙের ফুল এ পৃথিবীতে, জানিস?
জানি
-সমুদ্রই ঘুড়ি, আকাশে এঁকে দিচ্ছে হাওয়াদের শিস, জানিস?
জানি
-ধুলোই পৃথিবীর একমাত্র মায়াপ্রবণ প্রবন্ধ-গ্রন্থ, জানিস
জানি
-গ্রুপফটোতেই রচিত হয় জগতের সকল মৃত্যুকাতরতা, জানিস?
জানি
-আয়ুই হলো সেই গোঁয়ার মহিষ, যে দুপুরবেলায় ঘাসের বনে ছিটিয়ে
দিচ্ছে মায়ার ঔজ্জ্বল্য, জানিস?
জানি
-প্রতিটি গাছই কালিকালবিহীন নীলচে কালির কলম, তারাই ফলাচ্ছে
সোনার খনি নক্ষত্রম্যাপ, আর লিখছে আমার আদেশে আয়ুর জীবনী,
জানিস?
জানি না।

এই জানি না উচ্চারণের সাথে সাথেই কালহারা এক অসাধারণ হাসি ফুটে ওঠে
এক চিরায়ত ভঙ্গিতে, মা তোমার মুখে;
আমি খুব সাধারণ দর্শক হয়ে এ মধুর ঘটনা ও অবাক দৃশ্যপঞ্জি মুখস্থ করতে থাকি
আর বড় হয়ে উঠতে থাকি



আমার মেধাবি মা পছন্দ করেন, তাই

-খেজুরগাছকেই ডেকেছি উস্তাদ
-বাঘের গায়ে ছিটিয়ে দিচ্ছি কাতুকুতুর গল্প
-প্রবালের গায়ে এঁকে দিচ্ছি ভাস্কো ডা গামার টুপি
-বন্ধু-প্রেমিকার নাকফুলে গোপনে লিখেছি আমার নাম
-শত্রুদের দলে এনে দিচ্ছি রহস্যরঙ, মুচকিহাসির খেলা
-জন্মগ্রামে পুঁতে দিচ্ছি বাঁশফুলের ন্যায় উজ্জ্বল স্মারক




হেই আয়ু, দুষ্টু বালক, দুপুরগুলো খুব যৌনকাতরতায় ভোগে
তুমি কি তাকে একটিবারের জন্যে, হরতালের দিনে শহুরে সেলুনে পারো বসিয়ে দিতে
আর বলতে পারো, কবরফলকে বসেই সবচেয়ে ভালো গায় গ্রাম-গঞ্জের অখ্যাত দোয়েল;
আয়ু আসো, আউট ল হবার কায়দাকানুন জেনে নিয়ে, যাই রেস্তোরাঁয় আর আনন্দ করি
কেননা তোমার জীবনী হতে পারত আরো বর্ণাঢ্য, রঙচঙে, ও উদাহারণযোগ্য;
তুমি কি জানো না কৈ মাছেরাই সবচেয়ে বড় পর্যটক,
তাহলে কেন এত ডুবে থাকা প্রেমিকার ঘামগন্ধময় ঘাড়ে।
বরং চলো বেলুন কিনি, চা খাই এক কাপ, উঠি অবৈধ পাহাড়ে, নিজের ছেলেকে কিনে দেই ঘাসের সবুজ,
আর আরেকটু বিষণ্ন হই;
কেননা বিখ্যাত জীবনীতে থাকা লাগে একটু আধটু মন খারাপ, একটু আধটু কথা না রাখা,
একটু আধটু মন ভেঙে দেয়া, আর হঠাৎ হারিয়ে যাবার গাল-গপ্প



বিখ্যাত ছোট ভাইটি আমার, অনাগত বৃষ্টিময় বিকেলে, তোকেই
বিক্রি করে দিব, অন্য কোনো মায়ায় দঙ্গলে
তারপর সেই মানুষ অথবা মানুষীর দিকে তাকাব খুব ঈর্ষাকাতর চোখে;
আর আমি ও মা মিলে কাঁদব, অনেকক্ষণ ধরে, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে,
জাগতিক ব্যাকরণ ভুলে, আর হাত তোলে আকাশগ্রামের সেই মহৎ পুরুষের উদ্দেশে
বলব, আয়ু তো ডাংগুলিবালক, হাসতে হাসতে সে যেন ভালোই থাকে।

সে যেন পায় অনেকদিন পর ডুবোজাহাজের পেট থেকে বেরিয়ে আসা বেখেয়াল
রংধনু-বন্ধু, যেন চাইলেই, যার-তার আলখেল্লা করে দিতে পারে রঙিন

সে যেন পায় এমন এক বান্ধবী যার কাম-দক্ষতায় এ জগতের অনেক ডাকটিকিটই
হঠাৎ প্রাণ ফিরে পাবে আর ভুলে যাওয়া কোনো জেলা বা উপজেলা শহরের অলি-গলি ঘুরে শোনাবে
শাদাকালো বায়োস্কোপের সেই রহস্য-গল্প, যেখানে মরে যাওয়া নায়ক-নায়িকারা জীবন্ত হয়ে ওঠে
কোনো এক নাম না জানা অবাক কারিগরের কুশলী হাতের ছোঁয়ায়!

আমি আরো বলি, আয়ু এ পৃথিবীর সকল মুগ্ধতাকে তুই আগলে রাখিস পিতৃ-স্নেহে
আর ওদের কানে কানে বলিস আমার মেধাবি মায়ের কথা, যে মহিয়সী উলের স্যুয়েটার বুনতে বুনতে
হঠাৎ একদিন ইউরেকা বলে চিৎকার করে উঠেছিল আর নিজের বানানো হরফে লিখে ফেলেছিল তোর
জীবনী-পুস্তক, যে পুস্তক পৃথিবীর অনেক মহান মহান পুস্তকের চেয়েও অধিক সুরেলা, অধিক প্রাণোচ্ছল!
যে পুস্তকের পাতায় পাতায় ছড়ানো থাকে হাসিখুশি নামক দুই ভাই-বোনের গল্প, যারা
আমাদের ঘরে আসে অনেক অপ্রকাশ্যে, ভিনদেশি গোয়েন্দাদের মতন খুব অতর্কিতে!

শনিবার, ২৪ অক্টোবর, ২০০৯

কবি হেলাল হাফিজের কবিতা

অচল প্রেমের পদ্য - ০১

আছি।
বড্ড জানান দিতে ইচ্ছে করে, - আছি,
মনে ও মগজে
গুন্‌ গুন্‌ করে
প্রণয়ের মৌমাছি।



অচল প্রেমের পদ্য - ০২

কোনদিন, আচমকা একদিন
ভালোবাসা এসে যদি হুট করে বলে বসে,-
‘চলো যেদিকে দুচোখ যায় চলে যাই’,
যাবে?



অচল প্রেমের পদ্য - ০৩

তোমার জন্য সকাল, দুপুর
তোমার জন্য সন্ধ্যা
তোমার জন্য সকল গোলাপ
এবং রজনীগন্ধা।



অচল প্রেমের পদ্য - ০৪

ভালোবেসেই নাম দিয়েছি ‘তনা’
মন না দিলে
ছোবল দিও তুলে বিষের ফনা



অচল প্রেমের পদ্য - ০৫

তোমার হাতে দিয়েছিলাম অথৈ সম্ভাবনা
তুমি কি আর অসাধারণ? তোমার যে যন্ত্রনা
খুব মামুলী, বেশ করেছো চতুর সুদর্শনা
আমার সাথে চুকিয়ে ফেলে চিকন বিড়ম্বনা



অচল প্রেমের পদ্য - ০৬

যদি যেতে চাও, যাও
আমি পথ হবো চরণের তলে
না ছুঁয়ে তোমাকে ছোঁব
ফেরাবো না, পোড়াবোই হিমেল অনলে।



অচল প্রেমের পদ্য - ০৭

আমাকে উস্টা মেরে দিব্যি যাচ্ছো চলে,
দেখি দেখি
বাঁ পায়ের চারু নখে চোট লাগেনি তো;
ইস্‌! করছো কি? বসো না লক্ষ্মীটি,
ক্ষমার রুমালে মুছে সজীব ক্ষতেই
এন্টিসেপটিক দুটো চুমু দিয়ে দেই।



অচল প্রেমের পদ্য - ০৮

তুমি কি জুলেখা, শিরী, সাবিত্রী, নাকি রজকিনী?
চিনি, খুব জানি
তুমি যার তার, যে কেউ তোমার,
তোমাকে দিলাম না - ভালোবাসার অপূর্ব অধিকার।



অচল প্রেমের পদ্য - ০৯

আজন্ম মানুষ আমাকে পোড়াতে পোড়াতে কবি করে তুলেছে
মানুষের কাছে এওতো আমার এক ধরনের ঝণ।
এমনই কপাল আমার
অপরিশোধ্য এই ঝণ ক্রমাগত বেড়েই চলেছে।



অচল প্রেমের পদ্য - ১০

হয়তো তোমাকে হারিয়ে দিয়েছি
নয় তো গিয়েছি হেরে
থাক না ধ্রুপদী অস্পষ্টতা
কে কাকে গেলাম ছেড়ে।

হেলাল হাফিজের যে জলে আগুন জ্বলে

প্রিয় কবিতা গুচ্ছ - ১: হেলাল হাফিজের যে জলে আগুন জ্বলে
.........................................
বাংলাদেশের স্বাধীনতোত্তর কালে সামরিক পট পরিবর্তনের অস্থির সময়ে প্রতিবাদী লেখনী নিয়ে রুখে দাড়ানো কবিদের এক জন হেলাল হাফিজ । তার কাব্যের প্রধান উপকরণ যৌবন এবং বিদ্রোহ। যে জলে আগুন জ্বলে কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় আশির দশকে। দুই যুগের বেশি সময় পরে প্রযুক্তির সহস্র আবিস্কার আর জ্ঞান বিজ্ঞানের চরম উত্‍কর্ষতা সত্ত্বেও মানব সভ্যতা যেন প্রশ্নের সম্মুখিন । অর্থলোভী ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের হাতে বিশ্বের মানবতা বিপন্ন, মারণাস্ত্রের নির্লজ্জ যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় ধনী দেশ গুলো অধিকতর ব্যস্ত , নৈতিকতা এবং বিবেক বোধ ক্ষতবিক্ষত । হেলাল হাফিজের যুদ্ধমিশ্রিত প্রেমের কবিতাগুলোকে ভিন্ন প্রেক্ষাপটে এখনও সমানভাবে প্রযোজ্য মনে হয়। এখানে এক পাতায় যে জলে আগুন জ্বলে কাব্যগ্রন্হের ৫৬ টি কবিতাই সংকলিত হ'ল ।



যে জলে আগুন জ্বলে
হেলাল হাফিজ
..................................................

১. অগ্ন্যুৎসব

ছিল তা এক অগ্ন্যুৎসব, সেদিন আমি
সবটুকু বুক রেখেছিলাম স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্রে
জীবন বাজি ধরেছিলাম প্রেমের নামে
রক্ত ঋণে স্বদেশ হলো,
তোমার দিকে চোখ ছিলো না
জন্মভূমি সেদিন তোমার সতীন ছিলো।

আজকে আবার জীবন আমার ভিন্ন স্বপ্নে অংকুরিত অগ্ন্যুৎসবে
তোমাকে চায় শুধুই তোমায়।

রঙিন শাড়ির হলুদ পাড়ে ঋতুর প্লাবন নষ্ট করে
ভর দুপুরে শুধুই কেন হাত বেঁধেছো বুক ঢেকেছো
যুঁই চামেলী বেলীর মালায়,
আমার বুকে সেদিন যেমন আগুন ছিলো
ভিন্নভাবে জ্বলছে আজও,
তবু সবই ব্যর্থ হবে
তুমি কেবল যুঁই চামেলী বেলী ফুলেই মগ্ন হলে।

তার চেয়ে আজ এসো দু’জন জাহিদুরের গানের মতন
হৃদয় দিয়ে বোশেখ ডাকি, দু’জীবনেই বোশেখ আনি।
জানো হেলেন, আগুন দিয়ে হোলি খেলায় দারুন আরাম
খেলবো দু’জন এই শপথে
এসো স্ব-কাল শুদ্ধ করি দুর্বিনীত যৌবনেরে।

৮.১২.৭২

২. অনির্ণীত নারী

নারী কি নদীর মতো
নারী কি পুতুল,
নারী কি নীড়ের নাম
টবে ভুল ফুল।

নারী কি বৃক্ষ কোনো
না কোমল শিলা,
নারী কি চৈত্রের চিতা
নিমীলিত নীলা।

১৫.৬.৮০

৩. অন্যরকম সংসার

এই তো আবার যুদ্ধে যাবার সময় এলো
আবার আমার যুদ্ধে খেলার সময় হলো
এবার রানা তোমায় নিয়ে আবার আমি যুদ্ধে যাবো
এবার যুদ্ধে জয়ী হলে গোলাপ বাগান তৈরী হবে।

হয় তো দু’জন হারিয়ে যাবো ফুরিয়ে যাবো
তবুও আমি যুদ্ধে যাবো তবু তোমায় যুদ্ধে নেবো
অন্যরকম সংসারেতে গোলাপ বাগান তৈরী করে
হারিয়ে যাবো আমরা দু’জন ফুরিয়ে যাবো।

স্বদেশ জুড়ে গোলাপ বাগান তৈরী করে
লাল গোলাপে রক্ত রেখে গোলাপ কাঁটায় আগুন রেখে
আমরা দু’জন হয় তো রানা মিশেই যাবো মাটির সাথে।

মাটির সথে মিশে গিয়ে জৈবসারে গাছ বাড়াবো
ফুল ফোটাবো, গোলাপ গোলাপ স্বদেশ হবে
তোমার আমার জৈবসারে। তুমি আমি থাকবো তখন
অনেক দূরে অন্ধকারে, অন্যরকম সংসারেতে।

২০.১২.৭৩

৪. অমিমাংসিত সন্ধি

তোমাকে শুধু তোমাকে চাই, পাবো?
পাই বা না পাই এক জীবনে তোমার কাছেই যাবো।

ইচ্ছে হলে দেখতে দিও, দেখো
হাত বাড়িয়ে হাত চেয়েছি রাখতে দিও, রেখো

অপূণতায় নষ্টে-কষ্টে গেলো
এতোটা কাল, আজকে যদি মাতাল জোয়ার এলো
এসো দু’জন প্লাবিত হই প্রেমে
নিরাভরণ সখ্য হবে যুগল-স্নানে নেমে।

থাকবো ব্যাকুল শর্তবিহীন নত
পরস্পরের বুকের কাছে মুগ্ধ অভিভূত।

১০.৩.৮২

৫. অশ্লীল সভ্যতা

নিউট্রন বোমা বোঝ
মানুষ বোঝ না !

২৮.৬.৮০

৬. অস্ত্র সমর্পণ

মারণাস্ত্র মনে রেখো ভালোবাসা তোমার আমার।
নয় মাস বন্ধু বলে জেনেছি তোমাকে, কেবল তোমাকে।
বিরোধী নিধন শেষে কতোদিন অকারণে
তাঁবুর ভেতরে ঢুকে দেখেছি তোমাকে বারবার কতোবার।

মনে আছে, আমার জ্বালার বুক
তোমার কঠিন বুকে লাগাতেই গর্জে উঠে তুমি
বিস্ফোরণে প্রকম্পিত করতে আকাশ, আমাদের ভালবাসা
মুহূর্তেই লুফে নিত অত্যাচারী শত্রুর নি:শ্বাস।

মনে পড়ে তোমার কঠিন নলে তন্দ্রাতুর কপালের
মধ্যভাগ রেখে, বুকে রেখে হাত
কেটে গেছে আমাদের জঙ্গলের কতো কালো রাত!
মনে আছে, মনে রেখো
আমাদের সেই সব প্রেম-ইতিহাস।

অথচ তোমাকে আজ সেই আমি কারাগারে
সমর্পণ করে, ফিরে যাচ্ছি ঘরে
মানুষকে ভালোবাসা ভালোবাসি বলে।

যদি কোনোদিন আসে আবার দুর্দিন,
যেদিন ফুরাবে প্রেম অথবা হবে না প্রেম মানুষে মানুষে
ভেঙে সেই কালো কারাগার
আবার প্রণয় হবে মারণাস্ত্র তোমার আমার।

১৫.২.৭২

৭. অহংকার

বুকের সীমান্ত বন্ধ তুমিই করেছো
খুলে রেখেছিলাম অর্গল,
আমার যুগল চোখে ছিলো মানবিক খেলা
তুমি শুধু দেখেছো অনল।

তুমি এসেছিলে কাছে, দূরেও গিয়েছো যেচে
ফ্রিজ শটে স্থির হয়ে আছি,
তুমি দিয়েছিলে কথা, অপারগতার ব্যথা
সব কিছু বুকে নিয়ে বাঁচি।

উথাল পাথাল করে সব কিছু ছুঁয়ে যাই
কোনো কিছু ছোঁয় না আমাকে,
তোলপাড় নিজে তুলে নিদারুণ খেলাচ্ছলে
দিয়ে যাই বিজয় তোমাকে।

১৩.১০.৮০

৮. আমার কী এসে যাবে

আমি কি নিজেই কোন দূর দ্বীপবাসী এক আলাদা মানুষ?
নাকি বাধ্যতামূলক আজ আমার প্রস্থান,
তবে কি বিজয়ী হবে সভ্যতার অশ্লীল স্লোগান?

আমি তো গিয়েছি জেনে প্রণয়ের দারুণ আকালে
নীল নীল বনভূমি ভেতরে জন্মালে
কেউ কেউ চলে যায়, চলে যেতে হয়
অবলীলাক্রমে কেউ বেছে নেয় পৃথক প্লাবন,
কেউ কেউ এইভাবে চলে যায় বুকে নিয়ে ব্যাকুল আগুন।

আমার কী এসে যাবে, কিছু মৌল ব্যবধান ভালোবেসে
জীবন উড়ালে একা প্রিয়তম দ্বীপের উদ্দেশ্যে।

নষ্ট লগ্ন গেলে তুমিই তো দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে
সুকঠিন কংক্রিটে জীবনের বাকি পথ হেঁটে যেতে যেতে
বারবার থেমে যাবে জানি
‘আমি’ ভেবে একে-তাকে দেখে।
তুমিই তো অসময়ে অন্ধকারে
অন্তরের আরতির ঘৃতের আগুনে পুড়বে নির্জনে।

আমাকে পাবে না খুঁজে, কেঁদে-কেটে, মামুলী ফাল্‌গুনে।

৪.৮.৮০

৯. আমার সকল আয়োজন

আমাকে দুঃখের শ্লোক কে শোনাবে?
কে দেখাবে আমাকে দুঃখের চিহ্ন কী এমন,
দুঃখ তো আমার সেই জন্ম থেকে জীবনের
একমাত্র মৌলিক কাহিনী।

আমার শৈশব বলে কিছু নেই
আমার কৈশোর বলে কিছু নেই,
আছে শুধু বিষাদের গহীন বিস্তার।
দুঃখ তো আমার হাত–হাতের আঙুন–আঙুলের নখ
দুঃখের নিখুঁত চিত্র এ কবির আপাদমস্তক।

আমার দুঃখ আছে কিন্তু আমি দুখী নই,
দুঃখ তো সুখের মতো নীচ নয়, যে আমাকে দুঃখ দেবে।
আমার একেকটি দুঃখ একেকটি দেশলাই কাঠির মতন,
অবয়ব সাজিয়েছে ভয়ঙ্কর সুন্দরের কালো কালো অগ্নিতিলকে,
পাঁজরের নাম করে ওসব সংগোপনে
সাজিয়ে রেখেছি আমি সেফ্‌টি-ম্যাচের মতো বুকে।

৯.২.৭৪

১০. ইচ্ছে ছিলো

ইচ্ছে ছিলো তোমাকে সম্রাজ্ঞী করে সাম্রাজ্য বাড়াবো
ইচ্ছে ছিলো তোমাকেই সুখের পতাকা করে
শান্তির কপোত করে হৃদয়ে উড়াবো।

ইচ্ছে ছিলো সুনিপূণ মেকআপ-ম্যানের মতো
সূর্যালোকে কেবল সাজাবো তিমিরের সারাবেলা
পৌরুষের প্রেম দিয়ে তোমাকে বাজাবো, আহা তুমুল বাজাবো।

ইচ্ছে ছিলো নদীর বক্ষ থেকে জলে জলে শব্দ তুলে
রাখবো তোমার লাজুক চঞ্চুতে,
জন্মাবধি আমার শীতল চোখ
তাপ নেবে তোমার দু’চোখে।

ইচ্ছে ছিল রাজা হবো
তোমাকে সাম্রাজ্ঞী করে সাম্রাজ্য বাড়াবো,
আজ দেখি রাজ্য আছে
রাজা আছে
ইচ্ছে আছে,
শুধু তুমি অন্য ঘরে।

৭.২.৭৩

১১. ইদানিং জীবন যাপন

আমার কষ্টেরা বেশ ভালোই আছেন,
প্রাত্যহিক সব কাজ ঠিক-ঠাক করে চলেছেন
খাচ্ছেন-দাচ্ছেন, অফিসে যাচ্ছেন,
প্রেসক্লাবে আড্ডাও দিচ্ছেন।

মাঝে মাঝে কষ্টেরা আমার
সারাটা বিকেল বসে দেখেন মৌসুমী খেলা,
গোল স্টেডিয়াম যেন হয়ে যায় নিজেই কবিতা।

আজকাল আমার কষ্টেরা বেশ ভালোই থাকেন,
অঙ্কুরোদ্‌গম প্রিয় এলোমেলো যুবকের
অতৃপ্ত মানুষের শুশ্রূষা করেন। বিরোধী দলের ভুল
মিছিলের শোভা দেখে হাসেন তুমুল,
ক্লান্তিতে গভীর রাতে ঘরহীন ঘরেও ফেরেন,
নির্জন নগরে তারা কতিপয় নাগরিক যেন
কতো কথোপকথনে কাটান বাকিটা রাত,
অবশেষে কিশোরীর বুকের মতন সাদা ভোরবেলা
অধিক ক্লান্তিতে সব ঘুমিয়ে পড়েন।

আমার কষ্টেরা বেশ ভালোই আছেন, মোটামুটি সুখেই আছেন।
প্রিয় দেশবাসী;
আপনারা কেমন আছেন?

২.১০.৮০

১২. উপসংহার

আমার যত শুভ্রতা সব দেবো,
আমি নিপুণ ব্লটিং পেপার
সব কালিমা, সকল ব্যথা ক্ষত শুষেই নেবো।

২৪.৭.৮০

১৩. উৎসর্গ

আমার কবিতা আমি দিয়ে যাবো
আপনাকে, তোমাকে ও তোকে।

কবিতা কি কেবল শব্দের মেলা, সংগীতের লীলা?
কবিতা কি ছেলেখেলা, অবহেলা রঙিন বেলুন?
কবিতা কি নোটবই, টু-ইন-ওয়ান, অভিজাত মহিলা -সেলুন?

কবিতা তো অবিকল মানুষের মতো
চোখ-মুখ-মন আছে, সেও বিবেক শাসিত,
তারও আছে বিরহে পুষ্পিত কিছু লাল নীল ক্ষত।

কবিতা তো রূপান্তরিত শিলা, গবেষণাগারে নিয়ে
খুলে দেখো তার সব অণু-পরমাণু জুড়ে
কেবলি জড়িয়ে আছে মানুষের মৌলিক কাহিনী।
মানুষের মতো সেও সভ্যতার চাষাবাদ করে,
সেও চায় শিল্প আর স্লোগানের শৈল্পিক মিলন,
তার তা ভূমিকা চায় যতোটুকু যার উৎপাদন।

কবিতা তো কেঁদে ওঠে মানুষের যে কোনো অ-সুখে,
নষ্ট সময় এলে উঠানে দাঁড়িয়ে বলে,–
পথিক এ পথে নয়
‘ভালোবাসা এই পথে গেছে’।

আমার কবিতা আমি দিয়ে যাবো
আপনাকে, তোমাকে ও তোকে।

১৭.৩.৮১

১৪. একটি পতাকা পেলে

কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে
আমি আর লিখবো না বেদনার অঙ্কুরিত কষ্টের কবিতা

কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে
ভজন গায়িকা সেই সন্ন্যাসিনী সবিতা মিস্ট্রেস
ব্যর্থ চল্লিশে বসে বলবেন,–’পেয়েছি, পেয়েছি’।

কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে
পাতা কুড়োনির মেয়ে শীতের সকালে
ওম নেবে জাতীয় সংগীত শুনে পাতার মর্মরে।

কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে
ভূমিহীন মনুমিয়া গাইবে তৃপ্তির গান জ্যৈষ্ঠে-বোশেখে,
বাঁচবে যুদ্ধের শিশু সসন্মানে সাদা দুতে-ভাতে।

কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে
আমাদের সব দুঃখ জমা দেবো যৌথ-খামারে,
সম্মিলিত বৈজ্ঞানিক চাষাবাদে সমান সুখের ভাগ
সকলেই নিয়ে যাবো নিজের সংসারে।

১৩.১২.৮০

১৫. কবি ও কবিতা

কবির জীবন খেয়ে জীবন ধারণ করে
কবিতা এমন এক পিতৃঘাতী শব্দের শরীর,
কবি তবু সযত্নে কবিতাকে লালন করেন,
যেমন যত্নে রাখে তীর
জেনে-শুনে সব জল ভয়াল নদীর।

সর্বভূক এ কবিতা কবির প্রভাত খায়
দুপুর সন্ধ্যা খায়, অবশেষে
নিশীথে তাকায় যেন বয়ঃসন্ধিকালের কিশোরী,
কবিকে মাতাল করে
শুরু হয় চারু তোলপাড়,
যেন এক নির্জন বনের কোনো হরিণের লন্ডভন্ড খেলা
নিজেরই ভিতরে নিয়ে সুবাসের শুদ্ধ কস্তুরী।

কবির কষ্ট দিয়ে কবিতা পুষ্ট হয়
উজ্জ্বলতা বাড়ায় বিবেক,
মানুষের নামে বাড়ে কবিতার পরমায়ু
অমরতা উভয়ের অনুগত হয়।

১০.২.৮১

১৬. কবিতার কসম খেলাম

আমি আর আহত হবো না,
কোনো কিছুতেই আমি শুধু আর আহত হবো না।

যে নদী জলের ভারে হারাতো প্লাবনে
এখন শ্রাবণে সেই জলের নদীর বুকে
জলাভাবে হাহাকার দেখে আমি আহত হবো না।

সবুজ সবুজ মাঠ চিরে চিরে
কৃষকের রাখালের পায়ে গড়া দু’পায়া পথের বুকে
আজ সেই সরল সুন্দর সব মানুষের চিতা দেখে
আহত হবো না, আর শুধু আহত হবো না।

বৃক্ষ হারালে তার সবুজ পিরান, মৃত্তিকার ফুরালে সুঘ্রাণ,
কষ্টের ইস্কুল হলে পুষ্পিত বাগান, আমি আহত হবো না।

পাখি যদি না দেয় উড়াল, না পোড়ে আগুন,
অদ্ভুত বন্ধ্যা হলে উর্বরা ফাগুন, আমি আহত হবো না।

মানুষ না বোঝে যদি আরেক মানুষ
আমি আহত হবো না, আহত হবো না।
কবিতার কসম খেলাম আমি শোধ নেবো সুদে ও আসলে,
এবার নিহত হবো
ওসবের কোনো কিছুতেই তবু শুধু আর আহত হবো না।

১৭.৭.৮০

১৭. কবুতর

প্রতীক্ষায় থেকো না আমার
আমি আসবো না, থাকলো কথার কবুতর
কখনো বাইষ্যা মাসে পেয়ে অবসর
নিতান্তই জানতে ইচ্ছে হলে আমার খবর
পাখিকে জিজ্ঞেস করো নিরিবিলি,
পক্ষপাতহীন পাখি বিস্তারিত সংবাদ জানাবে
কী কী ব্যথা এবং আর্দ্রতা
রেখেছে দখল করে আশৈশব আমার একালা,
আমি কতো একা,
কতোখানি ক্ষত আর ক্ষতি নিয়ে
বেদনার অনুকূলে প্রবাহিত আমার জীবন।

নিপুণ সন্ধান করো
পাখির চঞ্চুতে-চোখে-কোমল পালকে
আমার বিস্তার আর বিন্যাসের কারুকাজ পাবে,
কী আমার আকাঙ্ক্ষিত গঠন প্রণালী আর
আমার কী রাজনীতি কবুতর জানে।

জীবন যাপনে কতো মানবিক,
কবিতায় কতোটা মানুষ,
পরিপাটি নির্দোষ সন্ত্রাস নিয়ে
আমি কতো বিনীত বিদ্রোহী,
পাখিকে জিজ্ঞেস করো সব জেনে যাবে
অবিকল আমার মতন করে কবুতর নির্ভুল জানাবে।

১৯.১১.৮১

১৮. কে

বেরিয়ে যে আসে সে তো এভাবেই আসে,
দুর্বিনীত ধ্রুপদী টংকার তুলে
লন্ডভন্ড করে চলে আসে মৌলিক ভ্রমণে, পথে
প্রচলিত রীতি-নীতি কিচ্ছু মানে না।

আমি এক সেরকম উত্থানের অনুপম কাহিনী শুনেছি।

এমন অনমনীয় পৃথক ভ্রমণে সেই পরিব্রাজকের
অনেক অবর্ণনীয় অভিমান থাকে,
টসটসে রসাল ফলের মতো ক্ষত আর
ব্যক্তিগত ক্ষয়-ক্ষতি থাকে। তাকে তুমুল শাসায়
মূলচ্যুত মানুষের ভুল ভালোবাসা, রাজনীতি,
পক্ষপাতদুষ্ট এক স্টাফ রিপোর্টার। আর তার সহগামী
সব পাখিদের ঈর্ষার আকাশে ভাসে ব্যর্থতার কিচির-মিচির।

এতো প্রতিকূলতায় গতি পায় নিষ্ঠাবান প্রেমিক শ্রমিক,
আমি এক সে রকম পথিকের প্রতিকৃতি নির্ভূল দেখেছি।

ইদানিং চারদিকে সমস্বরে এক প্রশ্ন,–কে? কে? কে?
বেরিয়ে যে আসে সে তো এই পথে এইভাবে আসে, নিপুণ ভঙ্গিতে।

১৫.২.৮২

১৯. কোমল কংক্রিট

জলের আগুনে পুড়ে হয়েছি কমল,
কী দিয়ে মুছবে বলো আগুনের জল।

১৫.১১.৮০

২০. ক্যাকটাস

দারুন আলাদা একা অভিমানী এই ক্যাকটাস।
যেন কোন বোবা রমণীর সখী ছিলো দীর্ঘকাল
কিংবা আজন্ম শুধু দেখেছে আকাল
এরকম ভাব-ভঙ্গি তার।
ধ্রুপদী আঙিনা ব্যাপী
কন্টকিত হাহাকার আর অবহেলা,
যেন সে উদ্ভিদ নয়
তাকালেই মনে হয় বিরান কারবালা।

হয় তো কেটেছে তার মায়া ও মমতাহীন সজল শৈশব
অথবা গিয়েছে দিন
এলোমেলো পরিচর্যাহীন এক রঙিন কৈশোর,
নাকি সে আমার মত খুব ভালোবেসে
পুড়েছে কপাল তার আকালের এই বাংলাদেশে।

বোকা উদ্ভিদ তবে কি
মানুষের কাছে প্রেম চেয়েছিলো?
চেয়েছিলো আরো কিছু বেশি।

৩০.৬.৮২

২১. ঘরোয়া রাজনীতি

ব্যর্থ হয়ে থাকে যদি প্রণয়ের এতো আয়োজন,
আগামী মিছিলে এসো
স্লোগানে স্লোগানে হবে কথোপকথন।

আকালের এই কালে সাধ হলে পথে ভালোবেসো,
ধ্রুপদী পিপাসা নিয়ে আসো যদি
লাল শাড়িটা তোমার পড়ে এসো।

১৬.২.৮৪

২২. ডাকাত

তুমি কে হ?
সোনালী ছনের বাড়ি তছনছ করে রাতে
নির্বিচারে ঢুকে গেলে অন্দর-মহলে
বেগানা পুরুষ, লাজ-শরমের মাথা খেয়ে
তুমি কে হে?

তোমাকে তো কখনো দেখিনি আগে এ তল্লাটে
মারী ও মড়কে, ঝড়ে, কাঙ্ক্ষিত বিদ্রোহে।
আমাদের যুদ্ধের বছরে
ভিন্‌ গেরামের কতো মানুষের পদচারণায়
এ বাড়ি মুখর ছিলো, তোমাকে দেখিনি ত্রি-সীমায়।

চতুর বণিক তুমি আঁধারে নেমেছো এই বানিজ্য ভ্রমণে,
কে জানে কী আছে পাড়া-পড়শীর মনে!
লোভে আর লালসায় অবশেষে আগন্তুক সর্বস্ব হারাবে,
কেন না প্রভাত হলে চারদিকে মানুষের ঢল নেমে যাবে।

২.৩.৮৫

২৩. তীর্থ

কেন নাড়া দিলে?
নাড়ালেই নড়ে না অনেক কিছু
তবু কেন এমন নাড়ালে?
পৃথিবীর তিন ভাগ সমান দু’চোখ যার
তাকে কেন একমাস শ্রাবণ দেখালে!

এক ওভাবে নাড়ালে?
যেটুকু নড়ে না তুমুলভাবে ভেতরে বাহিরে
কেন তাকে সেটুকু নাড়ালে?

ভয় দেখালেই ভয় পায় না অনেকে,
তবু তাকে সে ভয় দেখালে?
যে মানুষ জীবনের সব ক’টি শোক-দ্বীপে গেছে,
সব কিছু হারিয়েই সে মানুষ
হারাবার ভয় হারিয়েছে,
তার পর তীর্থ হয়েছে।

৩.৬.৮০

২৪. তুমি ডাক দিলে

একবার ডাক দিয়ে দেখো আমি কতোটা কাঙাল,
কতো হুলুস্থূল অনটন আজম্ন ভেতরে আমার।

তুমি ডাক দিলে
নষ্ঠ কষ্ঠ সব নিমিষেই ঝেড়ে মুছে
শব্দের অধিক দ্রুত গতিতে পৌছুবো
পরিণত প্রণয়ের উৎসমূল ছোঁব
পথে এতোটুকু দেরিও করবো না।
তুমি ডাক দিলে
সীমাহীন খাঁ খাঁ নিয়ে মরোদ্যান হবো,
তুমি রাজি হলে
যুগল আহলাদে এক মনোরম আশ্রম বানাবো।

একবার আমন্রণ পেলে
সব কিছু ফেলে
তোমার উদ্দেশে দেবো উজাড় উড়াল,
অভয়ারণ্য হবে কথা দিলে
লোকালয়ে থাকবো না আর
আমরণ পাখি হয়ে যাবো, -খাবো মৌনতা তোমার

২৫. তৃষ্ণা

কোনো প্রাপ্তিই পূর্ণ প্রাপ্তি নয়
কোনো প্রাপ্তির দেয় না পূর্ণ তৃপ্তি
সব প্রাপ্তি ও তৃপ্তি লালন করে
গোপনে গহীনে তৃষ্ণা তৃষ্ণা তৃষ্ণা।

আমার তো ছিলো কিছু না কিছু যে প্রাপ্য
আমার তো ছিলো কাম্য স্বল্প তৃপ্তি
অথচ এ পোড়া কপালের ক্যানভাসে
আজন্ম শুধু শুন্য শুন্য শুন্য।

তবে বেঁচে আছি একা নিদারুণ সুখে
অনাবিষ্কৃত আকাঙ্ক্ষা নিয়ে বুকে
অবর্ণনীয় শুশ্রূষাহীন কষ্টে
যায় যায় দিন ক্লান্ত ক্লান্ত ক্লান্ত।

৪.৭.৮২

২৬. তোমাকেই চাই

আমি এখন অন্য মানুষ ভিন্ন ভাবে কথা বলি
কথার ভেতর অকথিত অনেক কথা জড়িয়ে ফেলি
এবং চলি পথ বেপথে যখন তখন।

আমি এখন ভিন্ন মানুষ অন্যভাবে কথা বলি
কথার ভেতর অনেক কথা লুকিয়ে ফেলি,
কথার সাথে আমার এখন তুমুল খেলা
উপযুক্ত সংযোজনে জীর্ণ-শীর্ণ শব্দমালা
ব্যঞ্জনা পায় আমার হাতে অবলীলায়,
ঠিক জানি না পারস্পরিক খেলাধূলায়
কখন কে যে কাকে খেলায়।

অপুষ্টিতে নষ্ট প্রাচীন প্রেমের কথা যত্রতত্র কীর্তন আমার
মাঝে মধ্যে প্রণয় বিহীন সভ্যতাকে কচি প্রেমের পত্র লিখি
যেমন লেখে বয়ঃসন্ধি-কালের মানুষ নিশীথ জেগে।

আমি এখন অন্য মানুষ ভিন্নভাবে চোখ তুলে চাই
খুব আলাদা ভাবে তাকাই
জন্মাবধি জলের যুগল কলস দেখাই,
ভেতরে এক তৃতীয় চোখ রঞ্জনালোয় কর্মরত
সব কিছু সে সঠিকভাবে সবটা দেখে এবং দারুণ প্রণয় কাতর।

আমি এখন আমার ভেতর অন্য মানুষ গঠন করে সংগঠিত,
বীর্যবান এক ভিন্ন গোলাপ এখন কসম খুব প্রয়োজন।

১০.১১.৮১

২৭. দুঃখের আরেক নাম

আমাকে স্পর্শ করো, নিবিড় স্পর্শ করো নারী।
অলৌকিক কিছু নয়,
নিতান্তই মানবিক যাদুর মালিক তুমি
তোমার স্পর্শেই শুধু আমার উদ্ধার।

আমাকে উদ্ধার করো পাপ থেকে,
পঙ্কিলতা থেকে, নিশ্চিত পতন থেকে।
নারী তুমি আমার ভিতরে হও প্রবাহিত দুর্বিনীত নদীর মতন,
মিলেমিশে একাকার হয়ে এসো বাঁচি
নিদারুণ দুঃসময়ে বড়ো বেশি অসহায় একা পড়ে আছি।
তুমুল ফাল্‌গুন যায়, ডাকে না কোকিল কোনো ডালে,
আকস্মিক দু’একটা কুহু কুহু আর্তনাদ
পৃথিবীকে উপহাস করে।
একদিন কোকিলেরো সুসময় ছিলো, আজ তারা
আমার মতোই বেশ দুঃসময়ে আছে
পাখিদের নীলাকাশ বিষাক্ত হয়ে গেছে সভ্যতার অশ্লীল বাতাসে।

এখন তুমিই বলো নারী
তোমার উদ্যান ছাড়া আমি আর কোথায় দাঁড়াবো।
আমাকে দাঁড়াতে দাও বিশুদ্ধ পরিপূর্ণতায়,
ব্যাকুল শুশ্রুষা দিয়ে আমাকে উদ্ধার করো
নারী তুমি শৈল্পিক তাবিজ,
এতোদিন নারী ও রমনীহীন ছিলাম বলেই ছিলো
দুঃখের আরেক নাম হেলাল হাফিজ।

৩.৩.৭৪

২৮. দুঃসময়ে আমার যৌবন

মানব জন্মের নামে হবে কলঙ্ক হবে
এরকম দুঃসময়ে আমি যদি মিছিলে না যাই,
উত্তর পুরুষে ভীরু কাপুরুষের উপমা হবো
আমার যৌবন দিয়ে এমন দুর্দিনে আজ
শুধু যদি নারীকে সাজাই।

১৪.২.৭১

২৯. নাম ভূমিকায়

তাকানোর মতো করে তাকালেই চিনবে আমাকে।

আমি মানুষের ব্যকরণ
জীবনের পুষ্পিত বিজ্ঞান
আমি সভ্যতার শুভ্রতার মৌল উপাদান,
আমাকে চিনতেই হবে
তাকালেই চিনবে আমাকে।

আমাকে না চেনা মানে
মাটি আর মানুষের প্রেমের উপমা সেই
অনুপম যুদ্ধকে না চেনা।

আমাকে না চেনা মানে
সকালের শিশির না চেনা,
ঘাসফুল, রাজহাঁস, উদ্ভিত না চেনা।

গাভিন ক্ষেতের ঘ্রাণ, জলের কসম, কাক
পলিমাটি চেনা মানে আমাকেই চেনা।
আমাকে চেনো না?
আমি তোমাদের ডাক নাম, উজাড় যমুনা।

৫.১২.৮০

৩০. নিখুঁত স্ট্র্যাটেজী

পতন দিয়েই আমি পতন ফেরাবো বলে
মনে পড়ে একদিন জীবনের সবুজ সকালে
নদীর উলটো জলে সাঁতার দিয়েছিলাম।

পতন দিয়েই আমি পতন ফেরাবো বলে
একদিন যৌবনের শৈশবেই
যৌবনকে বাজি ধরে
জীবনের অসাধারণ স্কেচ এঁকেছিলাম।

শরীরের শিরা ও ধমনী থেকে লোহিত কণিকা দিয়ে আঁকা
মারাত্মক উজ্জ্বল রঙের সেই স্কেচে
এখনো আমার দেখো কী নিখুঁত নিটোল স্ট্র্যাটেজী।

অথচ পালটে গেলো কতো কিছু,–রাজনীতি,
সিংহাসন, সড়কের নাম, কবিতার কারুকাজ,
কিশোরী হেলেন।

কেবল মানুষ কিছু এখনো মিছিলে, যেন পথে-পায়ে
নিবিড় বন্ধনে তারা ফুরাবে জীবন।

তবে কি মানুষ আজ আমার মতন
নদীর উলটো জলে দিয়েছে সাঁতার,
তবে কি তাদের সব লোহিত কণিকা
এঁকেছে আমার মতো স্কেচ,
তবে কি মানুষ চোখে মেখেছে স্বপন
পতন দিয়েই আজ ফেরাবে পতন।

৪.১.৭৪

৩১. নিরাশ্রয় পাচঁটি আঙুল

নিরাশ্রয় পাচঁটি আঙুল তুমি নির্দ্বিধায়
অলংকার করে নাও, এ আঙুল ছলনা জানে না।
একবার তোমার নোলক, দুল, হাতে চুড়ি
কটিদেশে বিছা করে অলংকৃত হতে দিলে
বুঝবে হেলেন, এ আঙুল সহজে বাজে না।

একদিন একটি বেহালা নিজেকে বাজাবে বলে
আমার আঙুলে এসে দেখেছিলো
তার বিষাদের চেয়ে বিশাল বিস্তৃতি,
আমি তাকে চলে যেতে বলিনি তবুও
ফিরে গিয়েছিলো সেই বেহালা সলাজে।

অসহায় একটি অঙ্গুরী
কনিষ্ঠা আঙুলে এসেই বলেছিলো ঘর,
অবশেষে সেও গেছে সভয়ে সলাজে।

ওরা যাক, ওরা তো যাবেই
ওদের আর দুঃখ কতোটুকু? ওরা কি মানুষ?

২.৪.৭০

৩২. নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়

এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়
এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়
মিছিলের সব হাত
কন্ঠ
পা এক নয় ।

সেখানে সংসারী থাকে, সংসার বিরাগী থাকে,
কেউ আসে রাজপথে সাজাতে সংসার ।
কেউ আসে জ্বালিয়ে বা জ্বালাতে সংসার
শাশ্বত শান্তির যারা তারাও যুদ্ধে আসে
অবশ্য আসতে হয় মাঝে মধ্যে
অস্তিত্বের প্রগাঢ় আহ্বানে,
কেউ আবার যুদ্ধবাজ হয়ে যায় মোহরের প্রিয় প্রলোভনে
কোনো কোনো প্রেম আছে প্রেমিককে খুনী হতে হয় ।

যদি কেউ ভালোবেসে খুনী হতে চান
তাই হয়ে যান
উৎকৃষ্ট সময় কিন্তু আজ বয়ে যায় ।

এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়
এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময় ।

১.২.৬৯

৩৩. নেত্রকোনা

কতো দিন তোমাকে দেখি না
তুমি ভালো আছো? সুখে আছো? বোন নেত্রকোনা।

আমাকে কি চিনতে পেরেছো? আমি
ছিলাম তোমার এক আদরের নাগরিক নিকট-আত্মীয়
আমাদের বড়ো বেশি মাখামাখি ছিলো,
তারপর কী থেকে কী হলো
আভাইগা কপাল শুধু বিচ্ছেদের বিষে নীল হলো।

দোহাই লক্ষ্মী মেয়ে কোন দিন জিজ্ঞেস করো না
আমি কেন এমন হলাম জানতে চেয়ো না
কী এমন অভিমানে আমাদের এতো ব্যবধান,
কতোটা বিশৃংখলা নিয়ে আমি ছিমছাম সন্নাসী হলাম।

কিছু কথা অকথিত থেকে যায়
বেদনার সব কথা মানুষ বলে না, রমনী-কাতর
সবিতা সেনের সূতী শাড়িও জানে না
সোনালী অনল আর কতো জল দিদির ভেতর।

কেউ কি তাকিয়ে থাকে নিষ্পলক দাঁড়িয়ে প্রাঙ্গণে?
কারো কি তোলপাড় ওঠে ট্রেনের হুইসেল শুনে মনে?
তোমার মাটির রসে পরিপুষ্ট বৃক্ষ ফুল।
মগড়ার ক্ষীণ কলরোল
অমল কোমল এক মানুষের প্রতীক্ষায় থাক বা না থাক,
তুমি আছো আমার মজ্জায় আর মগজের কোষে অনুক্ষণ,
যে রকম ক্যামোফ্লাজ করে খুব ওতোপ্রোতভাবে থাকে
জীবনের পাশাপাশি অদ্ভুত মরণ।

২৫.১১.৮১

৩৪. পরানের পাখি

পরানের পাখি তুমি একবার সেই কথা কও,
আমার সূর্যের কথা, কাঙ্খিত দিনের কথা,
সুশোভন স্বপ্নের কথাটা বলো,–শুনুক মানুষ।

পরানের পাখি তুমি একবার সেই কথা কও,
অলক্ষ্যে কবে থেকে কোমল পাহাড়ে বসে
এতোদিন খুঁটে খুঁটে খেয়েছো আমাকে আর
কতো কোটি দিয়েছো ঠোকর,
বিষে বিষে নীল হয়ে গেছি, শুশ্রূষায়
এখনো কী ভাবে তবু শুভ্রতা পুষেছি তুমি দেখাও না
পাখি তুমি তোমাকে দেখাও,–দেখুক মানুষ।

পরানের পাখি তুমি একবার সেই কথা কও,
সময় পাবে না বেশি চতুর্দিক বড়ো টলোমলো
পরানের পাখি তুমি শেষবার শেষ কথা বলো,
আমার ভেতরে থেকে আমার জীবন খেয়ে কতোটুকু
যোগ্য হয়েছো, ভূ-ভাগ কাঁপিয়ে বেসামাল
কবে পাখি দেবেই উড়াল, দাও,–শিখুক মানুষ।

২১.৭.৮০

৩৫. পৃথক পাহাড়

আমি আর কতোটুকু পারি ?

কতোটুকু দিলে বলো মনে হবে দিয়েছি তোমায়,
আপাতত তাই নাও যতোটুকু তোমাকে মানায়।

ওইটুকু নিয়ে তুমি বড় হও,
বড় হতে হতে কিছু নত হও
নত হতে হতে হবে পৃথক পাহাড়,
মাটি ও মানুষ পাবে, পেয়ে যাবে ধ্রুপদী আকাশ।

আমি আর কতোটুকু পারি ?
এর বেশি পারেনি মানুষ।

৯.১০.৮০

৩৬. প্রতিমা

প্রেমের প্রতিমা তুমি, প্রণয়ের তীর্থ আমার।

বেদনার করুণ কৈশোর থেকে তোমাকে সাজাবো বলে
ভেঙেছি নিজেকে কী যে তুমুল উল্লাসে অবিরাম
তুমি তার কিছু কি দেখেছো?

একদিন এই পথে নির্লোভ ভ্রমণে
মৌলিক নির্মাণ চেয়ে কী ব্যাকুল স্থপতি ছিলাম,
কেন কালিমা না ছুঁয়ে শুধু তোমাকেই ছুঁলাম
ওসবের কতোটা জেনেছো?

শুনেছি সুখেই বেশ আছো, কিছু ভাঙচুর আর
তোলপাড় নিয়ে আজ আমিও সচ্ছল, টলমল
অনেক কষ্টের দামে জীবন গিয়েছে জেনে
মূলতই ভালোবাসা মিলনে মলিন হয়, বিরহে উজ্জ্বল।

এ আমার মোহ বলো, খেলা বলো
অবৈধ মুদ্রার মতো অচল আকাঙ্ক্ষা কিংবা
যা খুশী তা বলো,
সে আমার সোনালি গৌরব
নারী, সে আমার অনুপম প্রেম।

তুমি জানো, পাড়া-প্রতিবেশী জানে পাইনি তোমাকে,
অথচ রয়েছো তুমি এই কবি সন্নাসীর ভোগে আর ত্যাগে।

১১.৩.৭৩

৩৭. প্রত্যাবর্তন

প্রত্যাবর্তনের পথে
কিছু কিছু ‘কস্ট্‌লি’ অতীত থেকে যায়।
কেউ ফেরে, কেউ কেউ কখনো ফেরে না।
কেউ ফিরে এসে কিছু পায়,
মৌলিক প্রেমিক আর কবি হলে অধিক হারায়।

তবু ফেরে, কেউ তো ফেরেই,
আর জীবনের পক্ষে দাঁড়ায়,
ভালোবাসা যাকে খায় এইভাবে সবটুকু খায়।

প্রত্যাবর্তনের প্তহে
পিতার প্রস্থান থেকে,
থাকে প্রণয়ের প্রাথমিক স্কুল,
মাতার মলিন স্মৃতি ফোটায় ধ্রুপদী হুল,
যুদ্ধোত্তর মানুষের মূল্যবোধ পালটায় তুমুল,
নেতা ভুল,
বাগানে নষ্ট ফুল,
অকথিত কথার বকুল
বছর পাঁচেক বেশ এ্যানাটমিক ক্লাশ করে বুকে।

প্রত্যাবর্তনের পথে
ভেতরে ক্ষরণ থাকে লাল-নীল প্রতিনিয়তই,
তাহকে প্রেসক্লাব–কার্ডরুম, রঙিন জামার শোক,
থাকে সুখী স্টেডিয়াম,
উদ্‌গ্রীব হয়ে থাকে অভিজাত বিপনী বিতান,
বাথরুম, নগরীর নিয়ন্ত্রিত আঁধারের বার,
থাকে অসুস্থ সচ্ছলতা, দীর্ঘ রজনী
থাকে কোমল কিশোর,
প্রত্যাবর্তনের পথে দুঃসময়ে এইভাবে
মূলত বিদ্রোহ করে বেহালার সুর।

তারপর ফেরে, তবু ফেরে, কেউ তো ফেরেই,
আর জীবনের পক্ষে দাঁড়ায়,
ভালোবাসা যাকে খায় এইভাবে সবটুকু খায়।

১২.৫.৮০

৩৮. প্রস্থান

এখন তুমি কোথায় আছো কেমন আছো, পত্র দিয়ো৷
এক বিকেলে মেলায় কেনা খামখেয়ালী তাল পাখাটা
খুব নিশীথে তোমার হাতে কেমন আছে, পত্র দিয়ো৷
ক্যালেন্ডারের কোন পাতাটা আমার মতো খুব ব্যথিত
ডাগর চোখে তাকিয়ে থাকে তোমার দিকে, পত্র দিয়ো৷
কোন কথাটা অষ্টপ্রহর কেবল বাজে মনের কানে
কোন স্মৃতিটা উস্কানি দেয় ভাসতে বলে প্রেমের বানে
পত্র দিয়ো, পত্র দিয়ো৷

আর না হলে যত্ন করে ভুলেই যেয়ো, আপত্তি নেই৷
গিয়ে থাকলে আমার গেছে, কার কী তাতে?
আমি না হয় ভালোবেসেই ভুল করেছি ভুল করেছি,
নষ্ট ফুলের পরাগ মেখে
পাঁচ দুপুরের নির্জনতা খুন করেছি, কী আসে যায়?

এক জীবনে কতোটা আর নষ্ট হবে,
এক মানবী কতোটা আর কষ্ট দেবে!

৭.৮০


৩৯. ফেরীঅলা

কষ্ট নেবে কষ্ট
হরেক রকম কষ্ট আছে
কষ্ট নেবে কষ্ট !

লাল কষ্ট নীল কষ্ট কাঁচা হলুদ রঙের কষ্ট
পাথর চাপা সবুজ ঘাসের সাদা কষ্ট,
আলোর মাঝে কালোর কষ্ট
‘মালটি-কালার’ কষ্ট আছে
কষ্ট নেবে কষ্ট ।

ঘরের কষ্ট পরেরর কষ্ট পাখি এবং পাতার কষ্ট
দাড়ির কষ্ট
চোখের বুকের নখের কষ্ট,
একটি মানুষ খুব নীরবে নষ্ট হবার কষ্ট আছে
কষ্ট নেবে কষ্ট ।

প্রেমের কষ্ট ঘৃণার কষ্ট নদী এবং নারীর কষ্ট
অনাদর ও অবহেলার তুমুল কষ্ট,
ভুল রমণী ভালোবাসার
ভুল নেতাদের জনসভার
হাইড্রোজনে দুইটি জোকার নষ্ট হবার কষ্ট আছে
কষ্ট নেবে কষ্ট ।

দিনের কষ্ট রাতের কষ্ট
পথের এবং পায়ের কষ্ট
অসাধারণ করুণ চারু কষ্ট ফেরীঅলার কষ্ট
কষ্ট নেবে কষ্ট ।

আর কে দেবে আমি ছাড়া
আসল শোভন কষ্ট,
কার পুড়েছে জন্ম থেকে কপাল এমন
আমার মত ক’জনের আর
সব হয়েছে নষ্ট,
আর কে দেবে আমার মতো হৃষ্টপুষ্ট কষ্ট ।

৭.৮০

৪০. বাম হাত তোমাকে দিলাম

এই নাও বাম হাত তোমাকে দিলাম।
একটু আদর করে রেখো, চৈত্রে বোশেখে
খরা আর ঝড়ের রাত্রিতে মমতায় সেবা ওশুশ্রূষা দিয়ে
বুকে রেখো, ঢেকে রেখো, দুর্দিনে যত্ন নিও
সুখী হবে তোমার সন্তান।

এই নাও বাম হাত তোমাকে দিলাম।
ও বড়ো কষ্টের হাত, দেখো দেখো অনাদরে কী রকম
শীর্ণ হয়েছে, ভুল আদরের ক্ষত সারা গায়ে
লেপ্টে রয়েছে, পোড়া কপালের হাত
মাটির মমতা চেয়ে
সম্পদের সুষম বন্টন চেয়ে
মানুষের ত্রাণ চেয়ে
জন্মাবধি কপাল পুড়েছে,
ওকে আর আহত করো না, কষ্ট দিও না
ওর সুখে সুখী হবে তোমার সন্তান।

কিছুই পারিনি দিতে, এই নাও বাম হাত তোমাকে দিলাম।

২৩.৭.৮০

৪১. বেদনা বোনের মত

একদিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখলাম
শুধু আমাকেই দেখা যায়,
আলোর প্রতিফলন প্রতিসরণের নিয়ম না জানা আমি
সেই থেকে আর কোনদিন আয়না দেখি না।

জননীর জৈবসারে বর্ধিত বৃক্ষের নিচে
কাঁদতাম যখন দাঁড়িয়ে
সজল শৈশবে, বড়ো সাধ হতো
আমিও কবর হয়ে যাই,
বহুদিন হলো আমি সেরকম কবর দেখি না
কবরে স্পর্ধিত সেই একই বৃক্ষ আমাকে দেখে না।

কারুকার্যময় চারু ঘরের নমুনা দিয়ে
একদিন ভরা ছিল আমার দু’রেটিনার সীমিত সীমানা,
অথচ তেমন কোনো সীমাবদ্ধতাকে আর কখন মানি না।

কী দারুণ বেদনা আমাকে তড়িতাহতের মতো কাঁপালো তুমুল
ক্ষরণের লাল স্রোত আজন্ম পুরোটা ভেতর উল্টে পাল্টে খেলো,
নাকি অলক্ষ্যে এভাবেই
এলোমেলো আমাকে পাল্টালো, নিপুণ নিষ্ঠায়
বেদনার নাম করে বোন তার শুশ্রূষায়
যেন আমাকেই সংগোপনে যোগ্য করে গেলো।

১৬.১.৭৩

৪২. ভূমিহীন কৃষকের গান

দুই ইঞ্চি জায়গা হবে?
বহুদিন চাষাবাদ করিনা সুখের।

মাত্র ইঞ্চি দুই জমি চাই
এর বেশী কখনো চাবো না,
যুক্তিসঙ্গত এই জৈবনিক দাবি খুব বিজ্ঞানসম্মত
তবু ওটুকু পাবো না
এমন কী অপরাধ কখন করেছি!

ততোটা উর্বর আর সুমসৃণ না হলেও ক্ষতি নেই
ক্ষোভ নেই লাবন্যের পুষ্টিহীনতায়,
যাবতীয় সার ও সোহাগ দিয়ে
একনিষ্ঠ পরিচর্যা দিয়ে
যোগ্য করে নেবো তাকে কর্মিষ্ঠ কৃষকের মত।

একদিন দিন চলে যাবে মৌসুম ফুরাবে,
জরা আর খরায় পীড়িত খাঁ খাঁ
অকর্ষিত ওলো জমি
কেঁদে-কেটে কৃষক পাবে না।

১২.১১.৮১

৪৩. মানবানল

আগুন আর কতোটুকু পোড়ে ?
সীমাবদ্ধ ক্ষয় তার সীমিত বিনাশ,
মানুষের মতো আর অতো নয় আগুনের সোনালি সন্ত্রাস।

আগুন পোড়ালে তবু কিছু রাখে
কিছু থাকে,
হোক না তা শ্যামল রঙ ছাই,
মানুষে পোড়ালে আর কিছুই রাখে না
কিচ্ছু থাকে না,
খাঁ খাঁ বিরান, আমার কিছু নাই।

৭.২.৮১

৪৪. যাতায়াত

কেউ জানে না আমার কেন এমন হলো।

কেন আমার দিন কাটে না রাত কাটে না
রাত কাটে তো ভোর দেখি না
কেন আমার হাতের মাঝে হাত থাকে না কেউ জানেনা।

নষ্ট রাখীর কষ্ট নিয়ে অতোটা পথ একলা এলাম
পেছন থেকে কেউ বলেনি করুণ পথিক
দুপুর রোদে গাছের নিচে একটু বসে জিরিয়ে নিও,
কেই বলেনি ভালো থেকো সুখেই থেকো
যুগল চোখে জলের ভাষায় আসার সময় কেউ বলেনি
মাথার কসম আবার এসো

জন্মাবধি ভেতরে এক রঙিন পাখি কেঁদেই গেলো
শুনলো না কেউ ধ্রুপদী ডাক,
চৈত্রাগুনে জ্বলে গেলো আমার বুকের গেরস্থালি
বললো না কেউ তরুন তাপস এই নে চারু শীতল কলস।

লন্ডভন্ড হয়ে গেলাম তবু এলাম।

ক্যাঙ্গারু তার শাবক নিয়ে যেমন করে বিপদ পেরোয়
আমিও ঠিক তেমনি করে সভ্যতা আর শুভ্রতাকে বুকে নিয়েই দুঃসময়ে এতোটা পথ একলা এলাম শুশ্রূষাহীন।

কেউ ডাকেনি তবু এলাম, বলতে এলাম ভালোবাসি।

১০.৪.৮১

৪৫. যার যেখানে জায়গা

ভোলায়া ভালায়া আর কথা দিয়া কতোদিন ঠাগাইবেন মানুষ
ভাবছেন অহনো তাদের অয় নাই হুঁশ।
গোছায়া গাছায়া লন বেশি দিন পাইবেন না সময়
আলামত দেখতাছি মানুষের অইবোই জয়।

কলিমুদ্দিনের পোলা চিডি দিয়া জানাইছে,–’ভাই
আইতাছি টাউন দেখতে একসাথে আমরা সবাই,
নগরের ধাপ্‌পাবাজ মানুষেরে কইও রেডি অইতে
বেদম মাইরের মুখে কতোক্ষণ পারবো দাঁড়াইতে।’

টিকেট ঘরের ছাদে বিকালে দাঁড়ায়ে যখন যা খুশি যারা কন
কোনো দিন খোঁজ লইছেন গ্রামের লোকের সোজা মন
কী কী চায়, কতোখানি চায়
কয়দিন খায় আর কয়বেলা না খায়া কাটায়।

রাইত অইলে অমুক ভবনে বেশ আনাগোনা, খুব কানাকানি,
আমিও গ্রামের পোলা চুত্‌মারানি গাইল দিতে জানি।

৯.২.৮১

৪৬. যুগল জীবনী

আমি ছেড়ে যেতে চাই, কবিতা ছাড়ে না।
বলে,–’কি নাগর
এতো সহজেই যদি চলে যাবে
তবে কেন ঘর বেঁধেছিলে উদ্ধাস্তু ঘর,
কেন করেছিলে চারু বেদনার এতো আয়োজন।
শৈশব কৈশোর থেকে যৌবনের কতো প্রয়োজন
উপেক্ষার ‘ডাস্টবিনে’ ফেলে
মনে আছে সে-ই কবে
চাদরের মতো করে নির্দ্বিধায় আমাকে জড়ালে,
আমি বাল্য-বিবাহিতা বালিকার মতো
অস্পষ্ট দু’চোখ তুলে নির্নিমেষে তাকিয়েছিলাম
অপরিপক্ক তবু সন্মতি সূচক মাথা নাড়িয়েছিলাম
অতোশতো না বুঝেই বিশ্বাসের দুই হাত বাড়িয়েছিলাম,
ছেলেখেলাচ্ছলে
সেই থেকে অনাদরে, এলোমেলো
তোমার কষ্টের সাথে শর্তহীন সখ্য হয়েছিলো,
তোমার হয়েছে কাজ, আজ প্রয়োজন আমার ফুরালো’?

আমি ছেড়ে যেতে চাই, কবিতা ছাড়ে না।
দুরারোগ্য ক্যান্সারের মতো
কবিতা আমার কোষে নিরাপদ আশ্রম গড়েছে
সংগোপনে বলেছে,–’হে কবি
দেখো চারদিকে মানুষের মারাত্মক দুঃসময়
এমন দুর্দিনে আমি পরিপুষ্ট প্রেমিক আর প্রতিবাদী তোমাকেই চাই’।

কষ্টে-সৃষ্টে আছি
কবিতা সুখেই আছে,–থাক,
এতো দিন-রাত যদি গিয়ে থাকে
যাক তবে জীবনের আরো কিছু যাক।

২৬.১০.৮১

৪৭. যেভাবে সে এলো

অসম্ভব ক্ষুধা ও তৃষ্ণা ছিলো,
সামনে যা পেলো খেলো,
যেন মন্বন্তরে কেটে যাওয়া রজতজয়ন্তী শেষে
এসেছে সে, সবকিছু উপাদেয় মুখে।

গাভিন ক্ষেতের সব ঘ্রাণ টেনে নিলো,
করুণ কার্নিশ ঘেঁষে বেড়ে ওঠা লকলকে লতাটিও খেলো,
দুধাল গাভীটি খেলো
খেলো সব জলের কলস।

শানে বাধা ঘাট খেলো
সবুজের বনভূমি খেলো
উদাস আকাশ খেলো
কবিতার পান্ডুলিপি খেলো।

দু’পায়া পথের বুক, বিদ্যালয়
উপাসনালয় আর কারখানার চিমনি খেলো
মতিঝিলে স্টেটব্যাংক খেলো।

রাখালের অনুপম বাঁশিটিকে খেলো,
মগড়ার তীরে বসে চাল ধোয়া হাতটিকে খেলো

স্বাধীনতা সব খেলো, মানুষের দুঃখ খেলো না।

১৮.৩.৮১

৪৮. খাল

আমি কোনো পোষা পাখি নাকি?
যেমন শেখাবে বুলি
সেভাবেই ঠোঁট নেড়ে যাবো, অথবা প্রত্যহ
মনোরঞ্জনের গান ব্যাকুল আগ্রহে গেয়ে
অনুগত ভঙ্গিমায় অনুকূলে খেলাবো আকাশ,
আমি কোনো সে রকম পোষা পাখি নাকি?

আমার তেমন কিছু বাণিজ্যিক ঋণ নেই,
কিংবা সজ্ঞানে এ বাগানে নির্মোহ ভ্রমণে
কোনোদিন ভণিতা করিনি। নির্লোভ প্রার্থনা
শর্ত সাপেক্ষে কারো পক্ষপাত কখনো চাবো না।

তিনি, শুধু তিনি
নাড়ীর আত্মীয় এক সংগঠিত আর অসহায় কৃষক আছেন
ভেতরে থাকেন, যখন যেভাবে তিনি আমাকে বলেন
হয়ে যাই শর্তাহীন তেমন রাখাল বিনা বাক্য ব্যয়ে।

কাঙাল কৃষক তিনি, জীবনে প্রথম তাকে যখন বুঝেছি
স্বেচ্ছায় বিবেক আমি তার কাছে শর্তাহীন বন্ধক রেখেছি।

৮.২.৮২

৪৯. রাডার

একটা কিছু করুন।

এভাবে আর কদিন চলে দিন ফুরালে হাসবে লোকে
দুঃসময়ে আপনি কিছু বলুন
একটা কিছু করুন।

চতুর্দিকে ভালোবাসার দারুণ আকাল
খেলছে সবাই বেসুর-বেতাল
কালো-কঠিন-মর্মান্তিক নষ্ট খেলা,
আত্মঘাতী অবহেলো নগর ও গ্রাম গেরস্থালি
বনভূমি পাখপাখালি সব পোড়াবে,
সময় বড়ো দ্রুত যাচ্ছে
ভাল্লাগে না ভাবটা ছেড়ে সত্যি এবার উঠুন
একটা কিছু করুন।

দিন থাকে না দিন তো যাবেই
প্রেমিক যারা পথ তো পাবেই
একটা কিছু সন্নিকটে, আত বাড়িয়ে ধরুন
দোহাই লাগে একটা কিছু করুন।

২২.৩.৮১

৫০. লাবণ্যের লতা

দুরভিসন্ধির খেলা শেষ হয়ে কোনোদিন
দিন যদি আসে,
এই দেশে ভালোবেসে বলবে মানুষ,
অনন্বিত অসন্তোষ অজারকতার কালে এসে
লাবন্যের লকলকে লতা এক খুব কায়ক্লেশে
একদিন তুলেছিলো বিনয়াবনত মাথা
এতোটুকু ছিলো না দীনতা।

অকুলীন এই দিন শেষ হয়ে কোনোদিন
দিন যদি আসে,
শুভ্রতায় স্নিগ্ধতায় সমুজ্জল মানুষ এদেশে
বলবে সূর্যের দিকে ছিলো সেই লতাটির মুখ
বলবে মাটির সাথে ছিলো তার গাঢ় যোগাযোগ,
কিছু অক্সিজেন সেও দিয়েছিলো
নিয়েছিলো বিষ
বলবে পুষ্পিত কিছু করেছিলো ধূসর কার্নিশ।

ভালোবাসাবাসিহীন এই দিন সব নয়– শেষ নয়
আরো দিন আছে,
ততো বেশি দূরে নয়
বারান্দার মতো ঠিক দরোজার কাছে।

৩০.১০.৮১

৫১. শামুক

‘অদ্ভুত, অদ্ভুত’ বলে
সমস্বরে চিৎকার করে উঠলেন কিছু লোক।
আমি নগরের জ্যেষ্ঠ শামুক
একবার একটু নড়েই নতুন ভঙ্গিতে ঠিক গুটিয়ে গেলাম,
জলে দ্রাঘিমা জুড়ে
যে রকম গুটানো ছিলাম,
ছিমছাম একা একা ভেতরে ছিলাম,
মানুষের কাছে এসে
নতুন মুদ্রায় আমি নির্জন হলাম,
একাই ছিলাম আমি পুনরায় একলা হলাম।

২৯.৭.৮০

৫২. সম্প্রদান

ভাদ্রের বর্ধিত আষাঢ়ে সখ্য হয়েছিলো।
সে প্রথম, সে আমার শেষ।

পথে ও প্রান্তরে, ঘরে,
দিতে রাতে, মাসে ও বছরে
সমস্ত সাম্রাজ্য জুড়ে
সে আষাঢ় অতোটা ভেজাবে আমি ভাবিনি কসম।

আমার সকল শ্রমে, মেধা ও মননে
নিদারুণ নম্র খননে
কী নিপুণ ক্ষত দেখো বানিয়েছে চতুর আষাঢ়।

একদিন
সব কিছু
ছিলো তোর
ডাক নামে,
পোড়ামুখী
তবু তোর
ভরলো না মন,—
এই নে হারামজাদী একটা জীবন।

৭.১২.৮০


৫৩. হিজলতলীর সুখ

বলাই বাহুল্য আমি রাজনীতিবিদ নই, সুবক্তাও নই
তবু আজ এই সমাবেশে বলবো কয়েক কথা
সকলের অনুমতি পেলে।
–’বলুন, বলুন’।
রঙিন বেলুন দিয়ে মন ভোলানোর কোনো ইচ্ছে আমার নেই,
উপস্থিত সুধী, কেউ ভুলে মনেও করবেন না আমি
পারমিট, পেঁয়াজ আর পারফিউম ন্যায্যমূল্যে দেবো।
–’পেঁয়াজটা পেলে ভালো হত’।
আর কতো? যারা দিতো তারা আর দেবে না বলেছে।
–’কী হবে? কী হবে এখন উপায়’?
হেলায় খেলায় হয়েছে অনেক বেলা ফুরিয়েছে দিন
অবহেলা প্রপীড়িত মানুষেরা শোধ চায় ঋণ,
তবু দেবে, ভাত দেবে–ভোট দেবে, তবে
সামান্য তক্‌লিফ করে মাঝে মধ্যে গ্রামে যেতে হবে।
–’তবে কি সত্যি সব যা কিছু রটেছে’?
ঘটনা ঘটেছে এক মারাত্মক স্বাধীনতা-উত্তর এদেশে
প্রাপক দিয়েছে জেনে কারা ভদ্রবেশে
হিজলতলীর সুখ জবর-দখল করে রেখেছে এদ্দিন,
একটা কিছু তো আজ যথার্থই খুব সমীচীন।

৪.১২.৮১

৫৪. হিরণবালা

হিরণবালা তোমার কাছে দারুন ঋণী সারা জীবন
যেমন ঋণী আব্বা এবং মায়ের কাছে।

ফুলের কাছে মৌমাছিরা
বায়ুর কাছে নদীর বুকে জলের খেলা যেমন ঋণী
খোদার কসম হিরণবালা
তোমার কাছে আমিও ঠিক তেমনি ঋণী।

তোমার বুকে বুক রেখেছি বলেই আমি পবিত্র আজ
তোমার জলে স্নান করেছি বলেই আমি বিশুদ্ধ আজ
যৌবনে এই তৃষ্ণা কাতর লকলকে জিভ
এক নিশীথে কুসুম গরম তোমার মুখে
কিছু সময় ছিলো বলেই সভ্য হলো
মোহান্ধ মন এবং জীবন মুক্তি পেলো।

আঙুল দিয়ে তোমার আঙুল ছুঁয়েছিলাম বলেই আমার
আঙুলে আজ সুর এসেছে,
নারী-খেলার অভিজ্ঞতার প্রথম এবং পবিত্র ঋণ
তোমাকে নিয়ে কবিতা লিখে সত্যি কি আর শোধ হয়েছে?

১২.৮১


৫৫. হৃদয়ের ঋণ

আমার জীবন ভালোবাসাহীন গেলে
কলঙ্ক হবে কলঙ্ক হবে তোর,
খুব সামান্য হৃদয়ের ঋণ পেলে
বেদনাকে নিয়ে সচ্ছলতার ঘর

বাঁধবো নিমেষে। শর্তবিহীন হাত
গচ্ছিত রেখে লাজুক দু’হাতে আমি
কাটাবো উজাড় যুগলবন্দী হাত
অযুত স্বপ্নে। শুনেছি জীবন দামী,

একবার আসে, তাকে ভালোবেসে যদি
অমার্জনীয় অপরাধ হয় হোক,
ইতিহাস দেবে অমরতা নিরবধি
আয় মেয়ে গড়ি চারু আনন্দলোক।

দেখবো দেখাবো পরস্পরকে খুলে
যতো সুখ আর দুঃখের সব দাগ,
আয় না পাষাণী একবার পথ ভুলে
পরীক্ষা হোক কার কতো অনুরাগ।

২২.৬.৮৩

৫৬. ব্যবধান

অতো বেশ নিকটে এসো না, তুমি পুড়ে যাবে,
কিছুটা আড়াল কিছু ব্যবধান থাকা খুব ভালো।
বিদ্যুত সুপারিবাহী দু’টি তার
বিজ্ঞানসম্মত ভাবে যতোটুকু দূরে থাকে
তুমি ঠিক ততোখানি নিরাপদ কাছাকাছি থেকো,
সমূহ বিপদ হবে এর বেশী নিকটে এসো না।

মানুষ গিয়েছে ভূলে কী কী তার মৌল উপাদান।
তাদের ভেতরে আজ বৃক্ষের মতন সেই সহনশীলতা নেই,
ধ্রুপদী স্নিগ্ধতা নেই, নদীর মৌনতা নিয়ে মুগ্ধ মানুষ
কল্যাণের দিকে আর প্রবাহিত হয় না এখন।

আজকাল অধঃপতনের দিকে সুপারসনিক গতি মানুষের
সঙ্গত সীমানা ছেড়ে অদ্ভুত নগরে যেন হিজরতের প্রতিযোগিতা।

তবু তুমি কাছে যেতে চাও? কার কাছে যাবে?
পশু-পাখিদের কিছু নিতে তুমুল উল্লাসে যেন
বসবাস করে আজ কুলীন মানুষ।

১০.২.৮২

শুক্রবার, ২৩ অক্টোবর, ২০০৯

শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা

অবনী বাড়ি আছো
...................
দুয়ার এঁটে ঘুমিয়ে আছে পাড়া
কেবল শুনি রাতের কড়ানাড়া
‘অবনী বাড়ি আছো?’

বৃষ্টি পড়ে এখানে বারোমাস
এখানে মেঘ গাভীর মতো চরে
পরাঙ্মুখ সবুজ নালিঘাস
দুয়ার চেপে ধরে–
‘অবনী বাড়ি আছো?’

আধেকলীন হৃদয়ে দূরগামী
ব্যথার মাঝে ঘুমিয় পড়ি আমি
সহসা শুনি রাতের কড়ানাড়া
‘অবনী বাড়ি আছ


যেতে পারি, কিন্তু কেন যাবো?
....................
ভাবছি, ঘুরে দাঁড়ানোই ভালো।
এতো কালো মেখেছি দু হাতে
এতোকাল ধরে!
কখনো তোমার ক’রে, তোমাকে ভাবিনি।

এখন খাদের পাশে রাত্তিরে দাঁড়ালে
চাঁদ ডাকে : আয় আয় আয়
এখন গঙ্গার তীরে ঘুমন্ত দাঁড়ালে
চিতাকাঠ ডাকে : আয় আয়
যেতে পারি
যে-কোন দিকেই আমি চলে যেতে পারি
কিন্তু, কেন যাবো?
সন্তানের মুখ ধরে একটি চুমো খাবো

যাবো
কিন্তু, এখনি যাবো না
একাকী যাবো না অসময়ে।।



আমি যাই
......
যেখানেই থাকো
এপথে আসতেই হবে
ছাড়ান্ নেই
সম্বল বলতে সেই
দিন কয়েকের গল্প
অল্প অল্পই
আমি যাই
তোমরা পরে এসো
ঘড়ি-ঘন্টা মিলিয়ে
শাক-সবজি বিলিয়ে
তোমরা এসো



কিছু মায়া রয়ে গেলো
..................
সকল প্রতাপ হল প্রায় অবসিত…
জ্বালাহীন হৃদয়ের একান্ত নিভৃতে
কিছু মায়া রয়ে গেলো দিনান্তের,
শুধু এই –
কোনোভাবে বেঁচে থেকে প্রণাম জানানো
পৃথিবীকে।
মূঢ়তার অপনোদনের শান্তি,
শুধু এই –
ঘৃনা নেই, নেই তঞ্চকতা,
জীবনজাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু।



এক অসুখে দুজন অন্ধ
................
আজ বাতাসের সঙ্গে ওঠে, সমুদ্র, তোর আমিষ গন্ধ
দীর্ঘ দাঁতের করাত ও ঢেউ নীল দিগন্ত সমান করে
বালিতে আধ-কোমর বন্ধ
এই আনন্দময় কবরে
আজ বাতাসের সঙ্গে ওঠে, সমুদ্র, তোর আমিষ গন্ধ |
হাত দুখানি জড়ায় গলা, সাঁড়াশি সেই সোনার অধিক
উজ্জ্বলতায় প্রখর কিন্তু উষ্ণ এবং রোমাঞ্চকর
আলিঙ্গনের মধেযে আমার হৃদয় কি পায় পুচ্ছে শিকড়
আঁকড়ে ধরে মাটির মতন চিবুক থেকে নখ অবধি ?
সঙ্গে আছেই
রুপোর গুঁড়ো, উড়ন্ত নুন, হল্লা হাওয়ার মধ্যে, কাছে
সঙ্গে আছে
হয়নি পাগল
এই বাতাসে পাল্লা আগল
বন্ধ ক’রে
সঙ্গে আছে …
এক অসুখে দুজন অন্ধ !
আজ বাতাসের সঙ্গে ওঠে, সমুদ্র, তোর আমিষ গন্ধ ।



আতাচোরা
.........
আতাচোরা পাখিরে
কোন তুলিতে আঁকি রে
হলুদ ?
বাঁশ বাগানে যইনে
ফুল তুলিতে পাইনে
কলুদ
হলুদ বনের কলুদ ফুল
বটের শিরা জবার মূল
পাইতে
দুধের পাহাড় কুলের বন
পেরিয়ে গিরি গোবর্ধন
নাইতে
ঝুমরি তিলাইয়ার কাছে
যে নদিটি থমকে আছে
তাইতে
আতাচোরা পাখিরে
কোন তুলিতে আঁকি রে
—হলুদ ?



একবার তুমি
..........
একবার তুমি ভালোবাসতে চেষ্টা কর –
দেখবে, নদির ভিতরে, মাছের বুক থেকে পাথর ঝরে পড়ছে
পাথর পাথর পাথর আর নদী-সমুদ্রের জল
নীল পাথর লাল হচ্ছে, লাল পাথর নীল
একবার তুমি ভাল বাসতে চেষ্টা কর |
বুকের ভেতরে কিছু পাথর থাকা ভাল - ধ্বনি দিলে প্রতিধ্বনি পাওয়া যায়
সমস্ত পায়ে-হাঁটা পথই যখন পিচ্ছিল, তখন ওই পাথরের পাল একের পর এক বিছিয়ে
যেন কবিতার নগ্ন ব্যবহার, যেন ঢেউ, যেন কুমোরটুলির সলমা-চুমকি-জরি-মাখা প্রতিমা
বহুদূর হেমন্তের পাঁশুটেনক্ষত্রের দরোজা পর্যন্ত দেখে আসতে পারি |
বুকের ভেতরে কিছু পাথর থাকা ভাল
চিঠি-পত্রের বাক্স বলতে তো কিছু নেই - পাথরের ফাঁক-ফোকরে রেখে এলেই কাজ হাসিল -
অনেক সময় তো ঘর গড়তেও মন চায় |
মাছের বুকের পাথর ক্রমেই আমাদের বুকে এসে জায়গা করে নিচ্ছে
আমাদের সবই দরকার | আমরা ঘরবাড়ি গড়বো - সভ্যতার একটা স্থায়ী স্তম্ভ তুলে ধরবো |
রূপোলি মাছ পাথর ঝরাতে ঝরাতে চলে গেলে
একবার তুমি ভালবাসতে চেষ্টা করো |



এবার হয়েছে সন্ধ্যা
.............
এবার হয়েছে সন্ধ্যা। সারাদিন ভেঙেছো পাথর
পাহাড়ের কোলে
আষাঢ়ের বৃষ্টি শেষ হয়ে গেলো শালের জঙ্গলে
তোমারও তো শ্রান্ত হলো মুঠি
অন্যায় হবে না - নাও ছুটি
বিদেশেই চলো
যে কথা বলনি আগে, এ-বছর সেই কথা বলো।
শ্রাবনের মেঘ কি মন্থর!
তোমার সর্বাঙ্গ জুড়ে জ্বর
ছলোছলো
যে কথা বলনি আগে, এ-বছর সেই কথা বলো।
এবার হয়েছে সন্ধ্যা, দিনের ব্যস্ততা গেছে চুকে
নির্বাক মাথাটি পাতি, এলায়ে পড়িব তব বুকে
কিশলয়, সবুজ পারুল
পৃথিবীতে ঘটনার ভুল
চিরদিন হবে
এবার সন্ধ্যায় তাকে শুদ্ধ করে নেওয়া কি সম্ভবে?
তুমি ভালোবেসেছিলে সব
বিরহে বিখ্যাত অনুভব
তিলপরিমাণ
স্মৃতির গুঞ্জন - নাকি গান
আমার সর্বাঙ্গ করে ভর?
সারাদিন ভেঙ্গেছো পাথর
পাহাড়ের কোলে
আষাঢ়ের বৃষ্টি শেষ হয়ে গেলো শালের জঙ্গলে
তবু নও ব্যথায় রাতুল
আমার সর্বাংশে হলো ভুল
একে একে শ্রান্তিতে পড়েছি নুয়ে। সকলে বিদ্রূপভরে দ্যাখে।



চাবি
.....
আমার কাছে এখনো পড়ে আছে
তোমার প্রিয় হারিয়ে যাওয়া চাবি
কেমন করে তোরংগ আজ খোলো?
থুতনিপরে তিল তো তোমার আছে
এখন? ও মন নতুন দেশে যাবি?
চিঠি তোমায় হঠাত্ লিখতে হলো ।
চাবি তোমার পরম যত্নে কাছে
রেখেছিলাম, আজই সময় হলো -
লিখিও, উহা ফিরত্ চাহো কিনা?
অবান্তর স্মৃতির ভিতর আছে
তোমার মুখ অশ্রু-ঝলোমলো
লিখিও, উহা ফিরত্ চাহো কি না?



দিন যায়
..........
সুখের বারান্দা জুড়ে রোদ পড়ে আছে
শীতের বারান্দা জুড়ে রোদ পড়ে আছে
অর্ধেক কপাল জুড়ে রোদ পড়ে আছে
শুধু ঝড় থমকে আছে গাছের মাথায়
আকাশমনির ।
ঝড় মানে ঝোড়ো হাওয়া, বাদ্ লা হাওয়া নয়
ক্রন্দনরঙের মত নয় ফুলগুলি
চন্দ্রমল্লিকার ।
জয়দেবের মেলা থেকে গান ভেসে আসে
সঙ্গে ওড়ে ধুলোবালি, পায়ের নূপুর
সুখের চট্ কা ভাঙে গৈরিক আবাসে
দিন যায় রে বিষাদে, ষাদে, মিছে দিন যায় …



পাবো প্রেম কান পেতে রেখে
..................
বড় দীর্ঘতম বৃক্ষে ব’সে আছো, দেবতা আমার |
শিকড়ে, বিহ্বল প্রান্তে, কান পেতে আছি নিশিদিন
সম্ভ্রমের মূল কোথা এ-মাটির নিথর বিস্তারে ;
সেইখানে শুয়ে আছি মনে পড়ে, তার মনে পড়ে ?
যেখানে শুইয়ে গেলে ধিরে-ধিরে কত দূরে আজ !
স্মারক বাগানখনি গাছ হ’য়ে আমার ভিতরে
শুধু স্বপ্ন দীর্ঘকায়, তার ফুল-পাতা-ফল-শাখা
তোমাদের খোঁডা-বাসা শূন্য ক’রে পলাতক হলো |
আপনারে খুঁজি আর খুঁজি তারে সঞ্চারে আমার
পুরানো স্পর্শের মগ্ন কোথা আছো ? বুঝি ভুলে গেলে |
নীলিমা ঔদাস্তে মনে পড়ে নাকো গোষ্ঠের সংকেত ;
দেবতা সুদূর বৃক্ষে, পাবো প্রেম কান পেতে রেখে |



ভিতর-বাইরে বিষম যুদ্ধ
...............
ইচ্ছে ছিলো তোমার কাছে ঘুরতে-ঘুরতে যাবোই
আমার পুবের হাওয়া।
কিন্তু এখন যাবার কথায়
কলম খোঁজে অস্ত্র কোথায়
এবং এখন তোমার পাশে দাঁড়িয়ে-থাকা কুঞ্জলতায়
রক্তমাখা চাঁদ ঢেকেছে
আকুল চোখ ও মুখের মলিন
আজকে তোমার ভিতর-বাইরে বিষম যুদ্ধ পুবের হাওয়া।।
মনে মনে বহুদূর চলে গেছি
মনে মনে বহুদূর চলে গেছি - যেখান থেকে ফিরতে হলে আরো একবার জন্মাতে হয়
জন্মেই হাঁটতে হয়
হাঁটতে-হাঁটতে হাঁটতে-হাঁটতে
একসময় যেখান থেকে শুরু করেছিলাম সেখানে পৌঁছুতে পারি
পথ তো একটা নয় –
তবু, সবগুলোই ঘুরে ফিরে ঘুরে ফিরে শুরু আর শেষের কাছে বাঁধা
নদীর দু - প্রান্তের মূল
একপ্রান্তে জনপদ অন্যপ্রান্ত জনশূণ্য
দুদিকেই কূল, দুদিকেই এপার-ওপার, আসা-যাওয়া, টানাপোরেন –
দুটো জন্মই লাগে
মনে মনে দুটো জন্মই লাগে

(কবির ৩২ তম জন্ম দিনে (২৬/১১/১৯৬৫) লেখা এই কবিতাটি কবিপত্নি শ্রীমতী মীনাক্ষী চট্টোপাধ্যায়ের
সৌজন্যে প্রাপ্ত।)



শিশিরভেজা শুকনো খড়
.................
শিশিরভেজা শুকনো খড় শিকড়বাকড় টানছে
মিছুবাড়ির জনলা দোর ভিতের দিকে টানছে
প্রশাখাছাড় হৃদয় আজ মূলের দিকে টানছে
ভাল ছিলুম জীর্ণ দিন আলোর ছিল তৃষ্ণা
শ্বেতবিধুর পাথর কুঁদে গড়েছিলুম কৃষ্ণা
নিরবয়ব মূর্তি তার, নদীর কোলে জলাপাহার …
বনতলের মাটির ঘরে জাতক ধান ভানছে
শুভশাঁখের আওয়াজ মেলে জাতক ধান ভানছে
করুণাময় ঊষার কোলে জাতক ধান ভানছে
অপরিসীম দুঃখসুখ ফিরিয়েছিলো তার মুখ
প্রসারণের উদাসীনতা কোথাও ব’সে কাঁদছে
প্রশাখাছাড় হৃদয় আজ মূলের দিকে টানছে

(কবির ৫০ তম জন্ম দিনে (২৬/১১/১৯৮৩) লেখা এই কবিতাটি কবিপত্নি শ্রীমতী মীনাক্ষী চট্টোপাধ্যায়ের
সৌজন্যে প্রাপ্ত।)



স্টেশন ভাসিয়ে বৃষ্টি
..............
মনে পড়ে স্টেশন ভাসিয়ে বৃষ্টি রাজপথ ধ’রে ক্রমাগত
সাইকেল ঘন্টির মতো চলে গেছে, পথিক সাবধান…
শুধু স্বেচ্ছাচারী আমি, হাওয়া আর ভিক্ষুকের ঝুলি
যেতে-যেতে ফিরে চায়, কুড়োতে-কুড়োতে দেয় ফেলে
যেন তুমি, আলস্যে এলে না কাছে, নিছক সুদূর
হয়ে থাকলে নিরাত্মীয় ; কিন্তু কেন? কেন, তা জানো না।
মনে পড়বার জন্য? হবেও বা । স্বাধীনতাপ্রিয়
ব’লে কি আক্ষেপ? কিন্তু বন্দী হয়ে আমি ভালো আছি।
তবু কোনো খর রৌদ্রে, পাটকিলে কাকের চেরা ঠোঁটে
তৃষ্ণার চেহারা দেখে কষ্ট পাই, বুঝে নিতে পারি
জলের অভাবে নয়, কোন টক লালার কান্নায়
তার মর্মছেঁড়া ডাক; কাক যেন তোমারই প্রতীক
রূপে নয়, বরং স্বভাবে - মনে পড়ে, মনে পড়ে যায়
কোথায় বিমূঢ় হয়ে বসে আছো হাঁ-করা তৃষ্ণায়!

কচি রেজা'র কবিতা

হাত হুঁকোয় লুকিয়ে টান দিয়ে শৈশবে পৌঁছাতে চাই
...............................

এভাবেই শেকড় এগিয়ে যায় শেকড়ের কাছে শোনায় পুরানো গল্প
বিশ্বাস বাড়ির বউ সান্ত্বনার কান্না, সন্তানহীন ভিটায় কালো জাম গাছ
ছাড়াও ওলোটকম্বলের পাতা রোদে মেলে রাখা,
পান খেয়ে ঠোঁটের চূণ না মুছলে নাকি ঝগড়া হয়, আজই তো ছড়ানো
রোদে শালিকের ঝগড়া শুনে ঘুম ভাঙে, ঠোঁটের চুনের দাগ তখনও
মোছেনি শালিক, এভাবেই শেকড়কে এগিয়ে যেতে দেখি শেকড়ের কাছে,
এভাবেই হাত হুঁকোয় লুকিয়ে টান দিয়ে শৈশবে পৌঁছাতে চাই, আবার
বড়ুখালাকে ছিনে জোঁকের ভয় দেখিয়ে কালো তেতুঁলের মতো পুরানো
গল্পগুলো শুনতে চাই, মা বলেন, উল্লুগুল্লু হাওয়া বইলে নিজের বুকে থুতু দিস,
ভাইটিকেও দিস, গায়ের তামাক জলের গন্ধ এখনও মুছিনি, তেতুঁলের টক
এখনও আমার জিহ্বায়, এই জিহ্বা আমার কন্যাকে দিয়ে যাব, দিয়ে যাব
মানকচুর ছাতা, আর বলবো, হলুদ পাতাগুলো গাছ থেকে ঝরে যাচ্ছে দেখলে
নিজের চুল হাওয়ায় উড়ে যাচ্ছে দেখলে থুতু দিস.......মা।

সোমবার, ১৯ অক্টোবর, ২০০৯

কবিতা হলো ব্যক্তির বিরুদ্ধে সক্রিয়

কবিতা হলো ব্যক্তির বিরুদ্ধে সক্রিয়
অন্যসব ক্ষমতা মোকাবেলার শক্তি চার্লস সিমিক

মার্ক ফোর্ড : আপনার বাল্যকাল কেটেছে বেলগ্রেডে। বলবেন কি দিনগুলো তখন কেমন ছিল? আপনার বাবা-মা সম্পর্কেও জানতে চাই। তারা কেমন ছিলেন, কী করে তাদের সাক্ষাৎ হয় এসব আর কী।
চার্লস সিমিক : বাবা ছিলেন অভিজাত বংশোদ্ভূত। তার পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বাবাই প্রথম বিশ^বিদ্যালয়ে পড়তে যান। অন্যদিকে মা ছিলেন বেলগ্রেডের ঐতিহ্যবাহী পরিবার থেকে আসা। মায়ের পূর্বপুরুষরা অন্তত ২০০ বছর ধরে বেলগ্রেডে বসবাস করছিলেন। উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকেও তাদের প্রাচুর্য ছিল, পরে সর্বস্বান্ত হন। আমার নানা ছিলেন সেনাবাহিনীর লোক। অবসরে যাওয়ার পর তিনি জুয়া খেলে সব অর্থবিত্ত ছাইয়ের মতো উড়িয়ে দেন।
আপনার পরিবারের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা একত্রিত হলো কী করে?
চার্লস সিমিক : সত্যি কথা বলতে কী, তারা পরস্পরকে বরং ঘৃণাই করতেন। বাবার আত্মীয়দের পছন্দ করতেন না মা। চোখ পাকিয়ে, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতেন। এ কাজে বাবার জ্ঞাতিরা ছিলেন আরো সরাসরি। তারা আকণ্ঠ পান করতেন, হৈ-হল্লার মাস্টার ছিলেন একেকজন। আমার পরিচয় তাদের সঙ্গেই মিলে যায় বেশি।
মায়ের পরিবার ছিল অনেকটা ভীতু টাইপের, কেমন যেন অপ্রকৃতস্থ, গূঢ়চারী। তাদের সব শৌর্যবীর্য, বিত্ত-বৈভব হারিয়ে গেছে, অস্তিত্ব সংকটে সদা আতঙ্কিত। লোকগুলোর মধ্যে রসবোধ বলে কিছু ছিল না। সব বিষয়ই তাদের কাছে ঠেকতো রসকসহীন। বাবার আত্মীয়রা ছিলেন শিল্প-সাহিত্যের বিশেষ অনুরাগী, সদা প্রফুল্ল, খাবার টেবিলে জড়ো হলে তাদের মুখে খই ফুটতো। তাদের সঙ্গ আমার মায়ের কেমন লাগতো আশা করি কল্পনা করতে বেগ পেতে হবে না।
নাৎসি ও কমিউনিস্ট মতবাদের ™^›™^ সম্পর্কে ওই বয়সে কতটা সজাগ ছিলেন?
চার্লস সিমিক : যথার্থ। তাত্ত্বিক বিবেচনায় নয়, আমি সচেতন ছিলাম এই অর্থে যে, আমার চারপাশের সবাই তখন প্রায় সবসময়ই রাজনীতি নিয়ে তোলপাড় করতেন। বাবার দরদ ছিল রাজা-রানীর পক্ষে।
প্রথম বিশ^যুদ্ধে নানা ছিলেন শীর্ষ সেনা কর্মকর্তার দায়িত্বে। এই সেই ভদ্রলোকÑ যিনি তার পারিবারিক ধনসম্পদ জুয়া খেলে শেষ করেনÑ বিশ^াস করতেন, আমাদের যুদ্ধ থেকে তফাতে থাকাই উচিত ছিল। যতক্ষণ না মিত্ররা ইয়াল্টা কনফারেন্সের মতো আমাদের মুক্তির সনদ নিয়ে হাজির হয়।
মা সারাজীবন বিশ^াস করতেনÑ তিনি তার বিশ^াসের ঢোল প্রকাশ্যে পিটাতেন সব সময়Ñ যে সার্বীয়রা মূঢ়। রাজনৈতিক বুদ্ধিশুদ্ধি তাদের নেই বললেই চলে। অতএব তারা যে সিদ্ধান্তই নিক না কেন ভুল হবে, তাতে মা শতভাগ নিশ্চিত।
বাবার পরিবারের দিক থেকে, অপেক্ষাকৃত তরুণরা সবাই ছিলেন বামপন্থী, কমিউনিস্টদের প্রতি অনুরক্ত। তারা বলতেন, আমাদের মুক্ত করতে রাশিয়ার বীর সেনানিরা আসছে। মায়ের পরিবারের মতো লোকদের কচুকাটা করবে। একবার ভেবে দেখলেই পরিষ্কার হবে, এরপর অনেক চিৎকার-চেচামেচি হতো, গড়াতো অশ্রু, দড়াম করে দরোজা বন্ধের আওয়াজ শোনা যেত।
বছরগুলো আপনার জন্য কতটা দুঃসহ ছিল?
চার্লস সিমিক : আমাদের পরিবারে একটা গল্প চালু ছিল। ১৯৪৫ সালের ৯ মে বিশ^যুদ্ধ শেষ হয়, দিনটি ছিল আমার জš§ দিন। আমি সেদিন রাস্তায় খেলছিলাম। যাহোক, আমাদের অ্যাপার্টমেন্টে মা ও তার প্রতিবেশীরা রেডিও শুনছিলেন। একটু পানি পান করতে সেখানে ঢুকলাম, তারা সমস্বরে চিৎকার করে উঠলো, যুদ্ধ শেষ। তাদের মুখ কেমন পা-ুর মনে হলো। আমি বললাম, ‘মজা করার দিন ফুরালো!’ যুদ্ধের সময় বাবাদের খবরদারি ছিল না। বড়রা তাদের জীবন বাঁচাতে ছিল সদা ব্যস্ত। সেই সুযোগে শিশুরা ইচ্ছে মতো যেদিক খুশি ছুটে বেড়াতে পারতো। কয়েক বছর আগে, দুটি বই পাই, যেগুলো ঠাসা ছিল বসনিয়ার যুদ্ধের ছবিতে। ছবির মুখগুলো কী অসুখী। সারজেভোর কয়েকটি শিশুর ছবি চোখে পড়লো, ওদের চোখেমুখে হাসির স্ফুরণ। যেন শিশুরা বলছেÑ এটাই কি মহৎ নয়, আর ওইটা ভয়ানক! হাসিখুশি মুখগুলো দেখে মনে হলো, এগুলো আমি ও আমার বন্ধুদের মুখচ্ছবি।
যুদ্ধ শেষে আমাদের মজা কিন্তু ফুরোয়নি, চলতেই থাকে। হ্যাঁ, আমাদের দরিদ্রতা ছিল, ছিল কমিউনিস্ট অনুশাসন, কিছু মার্কিন চলচ্চিত্রও ছিল, মার্কিন সেনাদের রেডিও থেকে প্রচার করা জাজ সংগীত, আর ছিল রাস্তাজুড়ে দুরন্ত শিশুর দঙ্গল। আমরা তখন থাকতাম বেলগ্রেডের কেন্দ্রবিন্দুতে, প্রতিবেশী বেষ্টিত। ফলে আমাদের দিনগুলো বিষণœতায় ভরে ওঠেনি, বরং আনন্দে কেটেছে। ইশকুলে প্রত্যেকটি ব্ল্যাকবোর্ডের ওপরে টানানো থাকতো টিটো, স্ট্যালিন ও লেনিনের ছবি। ছবিগুলো আমাদের স্কুলের পাঠের দিকে তাকিয়ে থাকতো।
স্কুল টিচাররা বলতেন, ছবির লোকগুলো খুবই জ্ঞানী, তারা সারা দুনিয়ার তোমাদের মতো শিশুদের জন্য আনন্দ বয়ে আনছেন। আমি পড়ি মুশকিলে। কার কথা বিশ^াস করি? বাড়ির লোকেরা বলেন, অন্য কথা। তারা বলেন, ছবির তিন লোক বদের হাড্ডি, তাদের জন্যই তোমার বাবাকে পরিবার পরিজন ছেড়ে দূরে দূরে থাকতে হচ্ছে।
আপনি ফ্রান্সে পৌঁছলে, ফরাসি কর্তৃপক্ষ আপনাকে উ™^াস্তু শ্রেণীতে বিবেচনা করে। বাস্তুচ্যুতি, নির্বাসনের একটি নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল?
চার্লস সিমিক : হ্যাঁ, আমি মনে করি তা ছিল। ফরাসিদের আমার পছন্দ হয়ে যায়; কিন্তু ফরাসিরা কী করতো, আমাদের অপমান করে মজা পেত। কয়েক মাস পর পর আমাদের পারমিট নবায়ন করতে হতো। নবায়ন করতে গিয়ে দেখা যেত ঘণ্টার পর ঘণ্টা লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর কর্তৃপক্ষ বললো, তোমার ওই কাগজটা কোথায়, ধরা যাক আমার নানীর মায়ের জš§ সনদ নেই। যুগোসøাভিয়া থেকে অনেক চেষ্টা করে তা জোটানো গেল, তখন হয়তো কর্তৃপক্ষ বলে বসলো, ওইটার আদৌ দরকার ছিল না। আমরা এক বছর প্যারিসের একটা হোটেলে ছিলাম। তখন বাবা ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে। তার পাঠানো অর্থে আমাদের খাওয়া খরচ চলতো। আমরা জানতাম না ভিসা পেতে আর কতকাল তীর্থের কাকের মতো তাকিয়ে থাকতে হবে। ওই সময় আমরা প্যারিসের পথে পায়ে হেঁটে চক্কর দিতাম। ছবি দেখতাম আর শিখতাম ইংরেজি। মা কিনে আনতেন ‘লাইফ’, ‘লুক’ ধরনের ম্যাগাজিন। আমার ভাই আর আমি ম্যাগাজিনের পাতা উল্টেপাল্টে দেখতাম স্নানের পোশাক পরা নারী মডেল, বাহারি রঙের নতুন মডেলের গাড়ি আর খাবার ভর্তি রেফ্রিজারেটরের ছবি। এ কাহিনী করতাম প্যারিসের স্কুলে যাওয়ার দিনগুলোতে। ওই সময়ই কিন্তু প্রথম মজি কবিতায়। ইশকুলে যা হয় আর কীÑ বোদলেয়ার, ভার্লিন, র‌্যাবোর কবিতা মুখস্থ করো, ক্লাস ভর্তি ছেলেমেয়ে আবৃত্তি করে শোনাও। ভেবে দেখ কী দশা আমার হতো তখন। ফরাসি উচ্চারণ কতটা কঠিন ছিল। তারপরও কবিতাগুলো পড়তে পড়তে আমার চোখে জল এসে যেতো।
আপনি প্রায়ই বলেন, নিউইয়র্ক আপনার পছন্দের শহরÑ প্রথম দর্শনেই কী শহরটির প্রেমে পড়ে যান?
চার্লস সিমিক : ঠিক তাই। নিউইয়র্কে প্রথম পা রাখি ১৯৫৪ সালে। তখন ইউরোপ ছিল একেবারে ধূসর আর নিউইয়র্ক ঝকমারিÑ বাহারি রঙের ছড়াছড়ি, চোখ তাতানো বিজ্ঞাপন, হলুদ ট্যাক্সিক্যাব। তখন ফ্রান্স থেকে জাহাজে চড়ে নিউইয়র্ক আসতে সময় লাগতো মাত্র ৫ দিন। কিন্তু তখন মনে হতো বহু দূরের পথ। আজকাল চীনকে যতটা দূরের ঠেকে। নিউইয়র্ককে তখন মনে হতো, কার্নিভাল উৎসবেÑ যেখানে রয়েছে দাড়ি লাগানো রমণী, তলোয়ারবাজ কিংবা সাপুড়ের পোশাক পরা লোকজন আর জাদুকরেরাÑ সুসজ্জিত।
দশ বছর পর আপনার বাবার সঙ্গে দেখা হলো, তখন ক্যামন অনুভূতির জš§ হয় আপনার মনে?
চার্লস সিমিক : অবিশ^াস্য। বাবা আর দশজনের মতো ছিলেন না। তথাকথিত পিতা-পুত্রের সম্পর্কে তার আস্থা ছিল না, যদিও ব্যাপার মোটেও অতটা সহজ ছিল না। তিনি আমাদের নিয়ে বাইরে বেরুতে পছন্দ করতেন, যেতেন বারে, রেস্তোরাঁয়, জাজ ক্লাবে। নিউইয়র্কে আমার প্রথম জাজ ক্লাবে যাওয়া বাবার সঙ্গেই। বাবা ভালো ভালো অনেক গল্প জানতেন। তাই তার সঙ্গে আলাপ করে খুব মজা পেতাম, সবসময়ই দারুণ লাগতো। উপরি পাওনা হতো, বাবার পাঠ। ইতিহাস, সাহিত্য, রাজনীতি, প্রাচ্যের ধর্মতত্ত্ব, দর্শন, মিস্টিসিজম, রহস্য গল্প, পত্রিকায় খেলার পাতা এমনকি গসিপের কলামে তার উৎসাহে কমতি ছিল না, বিপুল আয়োজনে মনোনিবেশ করতে পারতেন তিনি, পড়তেন সবকিছুই। তার আরেকটা গুণ ছিল। তিনি শুনতেও পছন্দ করতেন। কেউ কিছু বললে বাবা আগ্রহ ভরে শুনতেন, কাজেই তার সঙ্গ সহজ হয়ে উঠতো, ভালো লাগতো। অনেক বছর পর আমার কবি বন্ধু জেমস ট্যাইট এবং মার্ক স্ট্রান্ডের সঙ্গে বাবার সাক্ষাৎ হওয়ার পর আমার বন্ধুরা নিশ্চিত করে, বাবার সঙ্গে কথা বলে তাদের ভালো লেগেছে। তারাও সাক্ষ্য দিল বাবার সঙ্গ উপভোগ্য।
কিন্তু আপনার মায়ের সঙ্গে তার খুব একটা বনিবনা হয়নি, তাদের ভালো কাটেনি?
চার্লস সিমিক : না। তাদের পুনরোকেত্রীকরণের দুই বছর যেতে না যেতেই ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। দশ বছরের দীর্ঘ বিচ্ছেদের পর তাদের দেখা। ছোটবেলা থেকেই আমি দেখে এসেছি, তাদের মধ্যে কোনো ধরনের সাযুজ্য ছিল না। কিচ্ছু না। দুজন ছিলেন দুই ভুবনের বাসিন্দা। মা ছিলেন অবিশ^াস্য রকমের সাহসী ও সৎ ব্যক্তি। তার রাজনৈতিক দৃৃষ্টিভঙ্গি ছিল বাবার চেয়ে বেশি স্বচ্ছ। হলে কী হবে, দিনকে দিন তিনি রস হারাতে থাকলেন। হয়ে উঠলেন শঙ্কাগ্রস্ত। আমাকে হয়তো বাসার খুব কাছের মুদির দোকানে পাঠালেন কোনো সদাই কিনতে, আমাকে পাঠিয়ে দিয়ে রাজ্যের যত খারাপ কল্পনা তার মাথায় ভিড় করলো, দুর্ভাবনায় কাতর হলেন তিনি, আমি সহিসালামতেই ফিরে এলাম, মা বলে ডাকও দিলাম, তার ঘোর তখনো কাটে নাÑ তিনি অবাক হয়ে আমার প্রত্যাবর্তন দেখেন। যুদ্ধের বীভৎসতা আমাদের কারো ওপরই মায়ের মতো এমন প্রকটভাবে পড়েনি। তিনি প্রায়ই অভিযোগ তোলেন, তোমার বাবা সিরিয়াস লোক নন। তিনি বুঝতেই চেষ্টা করছেন না আমাদের ওপর দিয়ে কী ঝড় বয়ে গেছে। মা নিজেকে পরাস্ত সাব্যস্ত করলেন; কিন্তু তিনি কিছুতেই পরাজয় মানতে প্রস্তুত ছিলেন না; তিনি ভাবতে শুরু করলেন, ইতিহাস তাদের জীবনকে অর্থহীন করে দিয়ে গেছে।
আর আপনি? কখনো কি ভেবেছেন ইতিহাস আপনাকে নিপীড়ন করেছে?
চার্লস সিমিক : ছোটবেলায় এরকম কখনো ভাবিনি; কিন্তু এখন আমি নিশ্চিত নই। শৈশবে যেধরনের ক্ষেপাটেরা পৃথিবীকে বিষিয়ে তুলেছিল, তারা এখনো আমাদের চারপাশে রয়েছে। তারা আরো যুদ্ধ চায়, চায় আরো আরো লোককে বন্দি করতে, হত্যা করতে। এসব ভয়ানকভাবেই পরিচিত, ক্লান্ত করে আমাদের, সন্ত্রস্ত তো করেই।
শিকাগো কেমন লাগলো?
চার্লস সিমিক : শিকাগোকে মনে হলো, কমিউনিস্ট ইস্তেহারের কফি-টেবিল সংস্করণ, যার বাইরেটা চকচকে, হ্রদমুখো বাহারি ভবন; কিন্তু শহরের ভেতরে বস্তি। এর একপাশে মিশিগান এভিনিউ, যেখানে বিলাসী হোটেল আর ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, কয়েকটা অ্যাপার্টমেন্ট দূরে দেখা যায়, কারখানার ধোঁয়া কু-লি পাকিয়ে উঠছে আকাশে, আর রাস্তায় ঝুলকালি মাখানো শ্রমিকরা বাসের প্রতীক্ষা করছে। শিকাগোকে বলতে পারেন, অভিবাসীদের স্বর্গ। বহু কারখানা দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা সরগরম থাকে। সেখানে সবারই কাজ জুটে। ধারে-কাছেই রয়েছে চমৎকার সব সমুদ্র সৈকত, যেখানে সুন্দর যুগলেরা বালুর ওপর বসে কামু ও সাত্রের লেখা পড়ে। সুইডিশ, জার্মান, ইতালীয়, ইহুদি, কালো সব ধরনের বন্ধু জুটেছিল, তারা নিজ নিজ দৃষ্টিকোণ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাখ্যা করে আমাকে শোনাতো। আমি শিকাগো ছিলাম মাত্র ৩ বছর। শিকাগোই আমাকে প্রথমবারের মতো মার্কিন নাগরিকত্ব দেয়। তাই ওখানের সব ঘটনাই আমার কাছে বেশ চিত্তাকর্ষক ছিল।
সেটা কিরকম?
চার্লস সিমিক : সেখানকার সব কিছুই আমার কাছে ছিল অভিনব। কাজ খুঁজতে যাওয়া, কাজে গিয়ে প্রতিদিন নতুন নতুন মুখের দেখা পাওয়া, তাদের সঙ্গে বন্ধুতা, সব কিছুই
ছিল একেবারে নতুন। নতুন মুখগুলোর অধিকাংশই কিন্তু বয়সে আমার বড় ছিলেন। তারপরও চুটিয়ে গল্প করতাম, প্রত্যেক রাতে দল বেঁধে যেতাম বারে, মদমাতাল হয়ে তারা তাদের জীবনের বিচিত্র সব গল্প বলে যেত।
সেখানেই কী প্রথম কবিতা লিখতে শুরু করেন?
চার্লস সিমিক : প্রথমত আমার কিন্তু গোপন অভিলাষ ছিল চিত্রশিল্পী হওয়ার।
কী ধরনের চিত্রশিল্পী হতে চেয়েছিলেন?
চার্লস সিমিক : পোস্ট ইম্প্রেসনিস্টদের অনুকরণ করে যাত্রা শুরু। পরে জার্মান এক্সপ্রেশনিস্টদের দিকে ঝুঁকি।
আঁকাআঁকি ছেড়ে দিই আমার ৩০ বছর বয়সে। ততদিনে আমি হয়ে উঠেছি পুরোদস্তুর বিমূর্ত এক্সপ্রেশনিস্ট। সত্যি কথা বলতে কী, চিত্রশিল্পী হওয়ার মতো প্রতিভা আমার সামান্যই ছিল।
আপনি সিরিয়াসলি লিখতে শুরু করেন কখন?
চার্লস সিমিক : ওক পার্ক হাইস্কুলের শেষ বছরে আমি লিখতে শুরু করি, সিরিয়াসলি বলা ঠিক হবে না। তখন মাঝে মধ্যেই কবিতা রচনায় বসি। আগ্রহ কিন্তু তখনো পেইন্টিংয়ের প্রতিই বেশি।
ওক পার্কে স্নাতক ডিগ্রি লাভের পর শিকাগো সান-টাইমসে অফিস বয়ের চাকরি পান। এরপর পড়াশোনা চালানোর ব্যাপারে কী কথা হয়েছিল?
চার্লস সিমিক : অনেক কথা হয়েছে। নিউইয়র্ক বিশ^বিদ্যালয় ও শিকাগো বিশ^বিদ্যালয় আমার ভর্তির আবেদন গ্রহণ করে; কিন্তু আমার দিক থেকে পড়া চালিয়ে যাওয়ার পথ রুদ্ধ হয়ে পড়ে। খরচ জোগানোর প্রশ্নে বাবার ওপর আর নির্ভরের সুযোগ থাকে না। তখন তার আয় কমে এসেছিল, স্যালারি যা পেতেন নিমেষেই ফুরিয়ে যেত।
বাড়ি ছাড়েন কবে?
চার্লস সিমিক : আমার ১৮ বছর বয়সে। লিংকন পার্কের একটা এপার্টমেন্টে উঠি। আমার প্রতিবেশী ছিলেন সান-টাইমসের এক সহকর্মী। তিনি তখন শিকাগো বিশ^বিদ্যালয় থেকে দর্শনের ওপর একটা ডিগ্রি শেষ করছিলেন। তিনিই হয়ে ওঠেন আমার কবিতার প্রথম সিরিয়াস পাঠক। কল্পনাকে তিনি সন্দেহের চোখে দেখতেন। জোর দিতেন যুক্তির ওপর, অধিবিদ্যায় নয়। মিশিগান লেকের তীরে বসে আমি তাকে ‘প্রুফ্রক’ ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করি, তিনি জিজ্ঞেস করেন, সন্ধ্যাকে কি করে টেবিলে শোয়া অক্সিজেন লাগানো রোগীর সঙ্গে তুলনা করা যায়? আমি যুক্তি দিতাম তিনি পাল্টা যুক্তি দিয়ে তা খ-নের চেষ্টা করতেন। কবিতা সম্পর্কে গভীরভাবে ভাবতে তিনি বল প্রয়োগ করতেন। তখন তিনি আমার জীবনের খুব গুরুত্বপূর্ণ এক ব্যক্তি হয়ে ওঠেন। আমরা ৪৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে ভালো বন্ধু ছিলাম।
তখন কোন ধরনের কবিদের কবিতা পড়ছিলেন?
চার্লস সিমিক : আধুনিকতাবাদী, ইউরোপীয় ও মার্কিন কবিদের কবিতা। এলিয়ট, পাউন্ড, উইলিয়ামস, স্টিভেন্স, অ্যাপলিনেয়ার, ব্রেতো, রিলকে, প্রমুখের কবিতা। ঔপন্যাসিকদের মধ্যে নেলসন আলগ্রেন, শিকাগোতে তার সঙ্গে পরিচয় হয়। একদিন রবার্ট লয়েলের একটা বই পড়তে দেখে তিনি বললেন, সিমিক এসব ভুষিমাল পড়া ছাড়ো! নিজেকে শিশু বানিয়ে রেখো না। বরং পড়ে ফেলো কার্ল স্যান্ডবার্গ ও ভ্যাশেল লিন্ডসের রচনাগুলো!
মধ্য-পশ্চিমাঞ্চলে একটা জনপ্রিয় চল ছিল তখন, পূর্বাঞ্চলের এলিট বুদ্ধিজীবীদের দেখা হতো সন্দেহের চোখে, খুব একটা পছন্দও করা হতো না তাদের।
যতদূর মনে পড়ে, হার্ট ত্রেক্রনকে কবি হিসেবে আমার প্রথমে খুবই মনে ধরে। তিনি ছিলেন অনেকটা গুপ্ত, তাই আমার মধ্যে তার আবেদন লক্ষ্য করি। তার দুর্ভেদ্য কবিতাগুলোর সুর তখন অনেকটা উত্তুঙ্গ বলে মনে হতো।
ক্রেনের অল্প অনুকরণ করে তখন বহু কবিতা আমি লিখেছি। একেবারে তার শব্দ বন্ধ হুবহু উঠিয়ে এনেছি আমার কবিতায়, সেসব কবিতা পাঠক তো দূরে থাক, আমি নিজেই মর্ম উদ্ধারে প্রায়ই হিমশিম খেতাম। আমার সৌভাগ্য যে, ওই ধরনের লেখা সব নষ্ট হয়ে গেছে।
আপনার অধিকাংশ কবিতা অকর্মা, নৈঃসঙ্গ্যপীড়িত লোক, বেপরোয়া দুর্বৃত্ত, পথে ঘুরে বেড়ানো মরমি, সস্তা নোংরা হোটেলের স্থায়ী বাসিন্দাদের... জীবনযাপনকে উপজীব্য করে লেখা। আপনার কুড়ি বছর বয়সে নিউইয়র্কে দেখা লোকজনের জীবনালেখ্যর সঙ্গে এদের একটা যোগসাজশ আছে, তাই না?
চার্লস সিমিক : ঠিক বলেছেন। আমি নিউইয়র্ক আসি ১৯৫৮ সালের গ্রীষ্মকালে। তখন খুব নিঃসঙ্গ বোধ করি।
অথচ শিকাগোতে আমার বহু বন্ধু ছিল, যারা বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করেÑ কোন দুঃখে তুমি নিউইয়র্ক যেতে চাও বন্ধু? শিকাগোতে অনেক কিছুই ছিল আমার পছন্দেরÑ সিনেমা, জাজ ক্লাব, বইয়ের দোকান। রাতের বেলা ক্লাসে যেতাম, দিনে কাজে। ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে শার্ট বিক্রি করেছি, ঘর রঙ করেছি, বই বিক্রেতাও ছিলাম, কেরানিগিরি করেছি এই টাইপের কত কাজ যে তখন করতে হয়েছে! কাজ কিংবা ক্লাস না থাকলে যেতাম মদ খেতে কিংবা সিনেমা দেখতে। সেই সময়টায় ঘুমাতাম কম, পড়তাম অনেক বেশি, আর প্রায়ই প্রেমে পড়তাম।
যতদূর মনে পড়ে, তখন খুব একটা সুখী কিংবা বিষাদগ্রস্ত কোনোটাই ছিলাম না। স্কুলে যাওয়ার পথে মানুষকে ল্যামপোস্টে ঝুলে মরে থাকতে দেখে যে লোকগুলো বেড়ে ওঠে তাদের দশ সুবিধার একটা হলো, জীবন সম্পর্কে তাদের নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়।
আপনার প্রথম দিকের অপ্রকাশিত সব লেখা নষ্ট করে ফেলেছিলেন বলে জেনেছি। কিন্তু এ কাজ আপনি কেন করলেন?
চার্লস সিমিক : ঘটনা ১৯৬১ সালের। তখন আমি সেনাবাহিনীর দায়িত্ব পালন করতে ফ্রান্সে গেলাম। বছর খানেক পর আমার ভাই জুতার বাক্সে ভরে আমার প্রথম দিকের কবিতাগুলো পাঠায়। পড়ে মাথা বিগড়ে যায়। কী সব রদ্দিমাল। আমি এতদিন ভুষিমালের কারবারি করেছি! নিজের সৃষ্টির কাছে জীবনে আর এত লজ্জায় পড়িনি আমি। রাতে বাক্স ভর্তি কবিতা বগলদাবা করে ব্যারাক থেকে বেরিয়ে পড়লাম। ছুড়ে মারলাম সেগুলো।
স্নায়ুযুদ্ধের সময় বসবাসরত সবাই এক ধরনের যুদ্ধের মধ্য দিয়ে অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। কিউবার ক্ষেপণাস্ত্র সংকট শুরু হলে নিশ্চয়ই আপনারা সম্মুখ সমরের জন্য প্রস্তুত হয়ে পড়েন?
চার্লস সিমিক : হ্যাঁ। আমরা তখন সদা সতর্ক অবস্থায় ছিলাম। কারণ আশঙ্কা করছিলাম যেকোনো সময় যুদ্ধ বাধবে, এমনকি পারমাণবিক যুদ্ধও ছড়িয়ে পড়তে পারে। কিউবা সংকট তখন প্রকট হয়ে উঠেছে। আমাদের কমান্ডিং অফিসাররা সতর্ক করে দিলেন। যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব বিরাজ করছে, অফিসারদের মুখ থেকেও কথা সরে না। এমন একটা অবস্থা। আমরা সশস্ত্র ছিলাম। অস্ত্রটা যেকোনো মুহূর্তেই গর্জাতে পারতো। ভাগ্যিস সংকট মোচন হলো, আমাকে মানুষ খুন করতে হয়নি।
এ সময় কি কবিতা লিখছিলেন? এমন যুদ্ধাবস্থায় কি লেখা চালানো সম্ভব?
চার্লস সিমিক : সম্ভব ছিল, কিন্তু আমার নিজেরই তখন কবিতা লেখার মতো কোনো ইচ্ছা ছিল না। ওই অবস্থায় একটা নোট খাতায় কিছু মন্তব্য লিখে রাখি, তখনকার সময়ে পড়া বইগুলোর সম্পর্কে আমার মতামত টুকে রাখি, এসব কয়েক মাস চালিয়ে যাই, এর বাইরে আর তেমন কাজ নেই।
আপনার নির্বাচিত কবিতার সংস্করণে শুরুতেই দেখা যায় ‘কসাইয়ের দোকান’ কবিতাটা প্রথমেই রাখেন, আপনি কি মনে করেন এই কবিতাতেই নিজের কণ্ঠস্বর প্রথম ফোটে, এ কবিতা আপনার কাব্যসৃষ্টির তোরণ™^ার?
চার্লস সিমিক : আমার লেখা প্রথমদিকের কবিতাগুলোর মধ্যে এটাকেই প্রথম সংরক্ষণের কথা মনে হয়। কবিতা লিখে ফেলি সেই ১৯৬৩, তখন থাকতাম ইস্ট থার্টিন্থ স্ট্রিটে। আমার আস্তানার আশ পাশে তখন বেশ কটা পোল্যা-ীয় ও ইতালীয় কসাইয়ের দোকান ছিল, যেগুলোতে শূকর, ভেড়া, হাঁস-মুরগি মেরে চমৎকার করে ঝুলিয়ে রাখা হতো। কসাইখানার সামনে গিয়ে একটুখানি থামি, দোল খাওয়া গোস্তের দিকে তাকাই, এটা আমার একটা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে যায়। কসাইখানার সামনে দিয়ে যেতে যেতে আমি আমার শৈশবে প্রত্যাবর্তন করি, ইউরোপে। সেই ছেলেবেলায়, আমি কিনা কসাইদের মতো হাঁস-মুরগির গলা কেটেছি কত! তারপর শূকর...। স্মৃতির মধ্যে ডুব দিই।
যদি বলি আপনার এই কবিতার মূল সুরে সৃষ্টিশীলতা ও সহিংসতার কোথাও একটা যোগসূত্র আছে, ভুল বলা হবে কি?
‘সেখানে রয়েছে প্রকা- এক গাছের গুঁড়ি আর ভাঙা হাড়গোড়
রগড়ানোÑ আর একটা নদী মরে পড়ে আছে বিছানায়
সেখানে খাবার খাই
গভীর রাতে অচেনা ডাক শুনতে পাই।’
চার্লস সিমিক : আমারো তাই মনে হয়, কিন্তু কবিতাটি লেখবার সময় এ ব্যাপারে সচেতন ছিলাম কিনা আজ আর মনে পড়ে না। আমি যে একটা কসাইখানায় বেড়ে উঠি ব্যাপারটা বুঝে উঠতে অনেক বছর গড়িয়ে যায়, আমার বেলগ্রেডবাসী শৈশবের বন্ধুদের সঙ্গে কয়েক বছর পর দেখা হলেই তা পরিষ্কার হয়। আমাদের ভূসম্পত্তি শুধু যে দখল করা হয় তাই নয়, আমার শৈশবে গৃহযুদ্ধ বাধে, নানান গোষ্ঠীর মধ্যে চলে সংঘর্ষ। রাস্তায় রাস্তায় রক্ত গড়াগড়ি খায় আমি কতবার যে এদৃশ্য দেখেছি! নিরীহ নিরপরাধ মানুষকে খুন হতে হয়Ñ এটাই ছিল আমার প্রথম পাঠ। ‘স্রেফ যুদ্ধের’ কোনো ঘটনা পড়তে গিয়ে টের পাই, হাজার হাজার নিষ্পাপ লোক মারা পড়ছে এবং তারা মরতেই থাকবে, আমার অন্তরাত্মা চামড়া ছিঁড়ে লাফিয়ে বেরিয়ে আসতে চায়।
আপনার বহু কবিতায়Ñ ‘কোকরোচেস’-এর কথাই ধরি না কেন, দেখা যায় এমন সব লোকের আনাগোনা, যাদের কোনোমতেই কাব্যিক বলা যায় না।
চার্লস সিমিক : এই কবিতাটাও প্রথম দিকে লেখা। নিউইয়র্কে থাকার সময় আমার চারপাশে তেলাপোকারা গিজ গিজ করতো। তেলাপোকাদের সঙ্গে আমার উঠবস ছিল নিত্যদিনের। এরাই ছিল আমার একমাত্র সম্মানিত মেহমান, যারা সারাক্ষণ ঘুরঘুর করতো। আমিও ভদ্র আচরণ করতাম, সতর্ক থাকতাম, যাতে আমার মাননীয় অতিথিদের স্বাস্থ্য হানি, অঙ্গহানিও বলা যায়Ñ না ঘটে।
পোকামাকড়ের চরিত্র আপনার কবিতায় ঘুরেফিরে এসেছে। পিঁপড়ার প্রতিও আপনি বেশ অনুরক্ত, বিশেষ করে ‘জ্যাকস্ট্রস’-কাব্যে এ ধরনের মন্তব্যের পক্ষে নজির পাওয়া যায়।
চার্লস সিমিক : জানি আমার বন্ধুরা কাব্যগ্রন্থটি পাঠ করার সময় বলে, সিমিক তুমি কি আজকাল মদ একটু বেশিমাত্রায় গিলছো? সব দেখি ছারপোকা! আসলে আমি কিন্তু বরাবরই ক্ষুদে সব পোকামাকড়ের কাজ-কারবার বিপুল আগ্রহের সঙ্গে লক্ষ্য করি। ওরা সব দল বেঁধে বরযাত্রী যাচ্ছে, নানা কাজে সদা ব্যস্তÑ তা তাদের কাজ যাই হোক না কেন। মাছিরা শঙ্কাগ্রস্ত, বিভিন্ন ধরনের পতঙ্গ আছে যেগুলো ক্ষেপাটে, কিন্তু প্রজাপতি কী সুন্দর, নকশা করা ডানা তাদের, ওদের সৌন্দর্য কিন্তু তাদের প্রতি তোমাকে সদয় করে তুলবে, তুমি কোনোভাবেই প্রজাপতি মারতে উদ্ধত হবে না। পিঁপড়েরাও কিন্তু দেখতে চমৎকার। ছোটবেলায় খেলার ছলে পিঁপড়েদের পায়ে পিষতাম; কিন্তু আজ এই বয়সে, কোনো ভিমরুল যদি আমাকে হুল ফোটাতে থাকে, আমি ওই বেটাকেও মারতে পারি না।
অনেক সমালোচক মন্তব্য করেছেন, আপনার কাব্যসৃষ্টিতে ইউরোপ ও আমেরিকার প্রভাবের ঘুটমিশেল আছে। আপনিও কি আদৌ তাদের মতো করে বিবেচনা করেন?
চার্লস সিমিক : এ প্রশ্নের উত্তর কীভাবে দেয়া যায় আমার ঠিক জানা নেই। ইউরোপীয় কবিদের বিপুল কবিতা পড়েছি আমি; আমার সাময়িক মার্কিন কাব্যের কোনোটাও বাদ দিইনি। আমার ব্যাকগ্রাউন্ডের কারণে পাঠাভ্যাস আর দশজনের মতো ছিল না।
অনেকে হয়তো বলবেন সিমিকের কবিতার সুর কেমন বিদেশি। এখানে অনেককে রাগ আর হতাশা মেশানো অনুযোগ করতে শুনেছি, ‘সিমিক আমাদের একজন নয়।’ টের পাই আমার কেইসটা জটিল, আমাকে শ্রেণীকরণে বেশ সমস্যা, আমি না নির্বাসিত, না অভিবাসী; কিন্তু এ ব্যাপারে আমার সত্যি কোনো মাথাব্যথা নেই। আমি ইচ্ছে করে এ জীবনে চলে আসিনি কিংবা এমনতর কবি হতে চাইনি। বলা যায় ঘটনাটা এভাবেই ঘটে গেছে।
আপনার মাতৃভাষা নয়, ছোটবেলায় এ ভাষায় কথা বলেননি, এমন একটা ভাষায় লিখতে কেমন বোধ করেন?
চার্লস সিমিক : জানি না এ প্রশ্নের কী জবাব হয়। আমি কখনোই মাতৃভাষায় কবিতা লিখিনি। আমার ভেতরে ভাষা নিয়ে কোনো লড়াই ছিল না।
কবিতা লেখার প্রস্তুতির জন্য কোনো কিছু পড়ার পরামর্শ আছে কি?
চার্লস সিমিক : কবিতা লিখতে কোনো প্রস্তুতির দরকার নেই। খুব ভালো একটা কবিতার সংকলন কিংবা দর্শনের বই পকেটে নিয়ে ৪ বছর ঘুরে বেড়ালে, তা তন্ন তন্ন করে পাঠ করলে, বিশ^বিদ্যালয় পাসের জন্য হয়তো কাজে দেয়; কিন্তু কবিতা রচনায় নয়।
আপনার কবিতাকে ঐতিহ্যবাহী এবং নিরীক্ষাধর্মী দুই-ই আখ্যা দিয়ে সমালোচক ও কবিরা প্রশংসা করেন। এই যে ™ি^ধারার লড়াই, এ ব্যাপারে আপনি কতটা সজাগ ছিলেন?
চার্লস সিমিক : এতক্ষণ ধরে তো একথাই বলছিলাম। বিটস ও চার্লস ওলসনের প্রকল্প কবিতা তো ছিলই, আবার দেখ রবার্ট ব্লাই তার ‘দ্য সিক্সটিস’ ম্যাগাজিনে মার্কিন কবিদের উদ্দেশ্যে নিয়মিত প্রেসক্রিপশন দিতেন। আমার ঝোঁক ডব্লিউ এস মারউইন, জ্যামস রিট ও ব্লাইয়ের প্রতিই একটু বেশি ছিল। কারণ তাদের কবিতাগুলো ছিল অনেকটা পরাবাস্তববাদী। তারপরও কাব্যশৈলী এবং কবিতার আইডিয়া খুঁজে ফিরেছি অন্য কোথাও। কোন গুণ কবিতাকে মহত্তর করে এ রহস্য উদ্ঘাটন আমার কাছে বরাবরই কঠিন মনে হয়েছে। গত একশ বছরের সাহিত্যের ইতিহাস যদি কিছু প্রমাণ করে, তাহলে এ সত্যকেই সমর্থন করে। রবার্ট ফ্রস্ট, রবার্ট ক্রিলি, গেরট্রুড স্টেইন এবং ডোনাল্ড জাস্টিসের কবিতা আমার ভালো লাগে। তথাকথিত ভাষাবাদী কবির দল আর নতুন প্রজšে§র কবিরা যারা কবিতার শরীর নির্মাণের ব্যাপারে মোচড়া-মুচড়ি করেন, আজকাল মনে হয় তাতে সময়ের অপচয় ছাড়া কাজের কাজ কিছুই হয় না।
আপনার কবিতায় গল্প বলার ভঙ্গির সঙ্গে অসম্ভব শক্তিশালী চিত্রকল্পের অদ্ভুত সমন্বয় লক্ষ্য করা যায়। এটা আপনার কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্যের একটি। আগে থেকে কল্পনা করা যায় না এমন সব চিত্রকল্পে থাকে গল্পের সারকথা, প্রচ্ছন্নভাবে হাজির হয় সময়, এক ধরনের টানটান উত্তেজনা; কীভাবে এসব কবিতায় ছড়িয়ে দেন?
চার্লস সিমিক : কার্লোস উইলিয়াম কার্লোস আমার ওপর বেশ মুগ্ধতা তৈরি করেন। আর আমার রচনাশৈলী গড়ার ক্ষেত্রে শুরুর দিকে ক্র্যান ও স্টিভেনস-এর অনুকরণে কাব্যচর্চাও অংশত একটা ভূমিকা রাখে। পাঠকদের চমকে দেয়ার একটা চেষ্টা আমার মধ্যে তখন ছিল। অন্য কথায় বলি আমি চাইতাম আমার কবিতা একটা কুকুরও বুঝতে পারুক। এখনো তাই, কিছু অচেনা অদ্ভুত শব্দ কবিতায় চালান করি, বিস্ময়কর চিত্রকল্প নির্মাণের প্রয়াস রাখি, চমক সৃষ্টিকারী অধিবিদ্যার ™^ারস্থ হই। এক সন্ন্যাসীকে ঢুকিয়ে দিই বেশ্যার ঘরে। মদ্যপানরত কিংবা অন্তর্বাস পরা নারীদের কুচকাওয়াজ দেখতে দেখতে কেউ একজন শুকনো রুটিতে অনবরত কামড় বসাচ্ছে অতি অনায়াসে লিখে দিই।
যুদ্ধোত্তর মার্কিন কবিতার মানচিত্রে আপনার সমগোত্রীয়দের শনাক্ত করতে বললে আপনি নিশ্চয়ই চার্লস রিট এবং জ্যামস ট্যাইটের নাম বলবেন। ঠিক বলেছি?
চার্লস সিমিক : নিশ্চয়ই। তাদের আমি চিরকালের মতো চিনি। চার্লস রিটের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয় ১৯৬৩ সালে ফ্রান্সে, তখন আমি সেনাবাহিনীতে ছিলাম। তারপর আমরা বন্ধু হয়ে যাই, এখনো আছি। আজ থেকে ৩০ বছর আগে আমাদের গায়ে নয়াপরাবাস্তববাদী কবির লেবেল এঁটে দেয়া হয়, আমাদের কবিতা আত্মপ্রচারণামূলক, অর্থহীন শব্দের ফুলঝুরিতে ভরা, প্রতি-বুদ্ধিজীবীবাদী বলে আক্রমণ চালানো হয়, সত্যি বলতে কী, ওই ধরনের লেবেল ছিল শূন্যগর্ভ। পরাবাস্তববাদী কবিতার এক সময় জাঁকজমক ছিল, কিন্তু সে তো অনেক বছর আগের কাহিনী এত দিনে মরে গেছে, সেই কবে গত হয়েছে। স্বীকার করি আমাদের কবিতায় চিত্রকল্পের ছড়াছড়ি ছিল, ছিল অননুমেয় উল্লম্ফন, সেটাই শেষ কথা ছিল না। ১৯৬৩-১৯৬৪ সালে নিউইয়র্ক লাইব্রেরিতে আমি মার্কিন লোকসাহিত্য খুব মনোযোগ সহকারে পড়েছি, বহু। তখন জাদুকরি ভাষায় কথা বলার প্রতি আমার আগ্রহ জšে§, আগ্রহী হয়ে উঠি ছন্দোবদ্ধ লম্ফঝম্ফে, প্রবাদ বাক্যে। আমাদের লোকসাহিত্যে পরাবাস্তববাদী চিত্রকল্পের উপস্থিতি নেহায়েৎ কম নেই। একবার তো নোট নিতে শুরু করি, ওইসব চিত্রকল্প সংগ্রহ করে একটা বই প্রকাশের চিন্তা-ভাবনা করি।
বহির্বিশ^কে দেখানোর কথা ভাবি। শেষ পর্যন্ত অবশ্য রণে ভঙ্গ দিই। নোটবইটা কানায় কানায় ভরে গেলে একদিন তা হারিয়ে যায়। ব্যাপারটা হয়তো কাউকে প্রমাণ করতে পারতাম না, কিন্তু নিজের জন্যই একটা বড় দলিল ছিল।
আপনার কবিতায় চলচ্চিত্র, নগর জীবন ঘুরে ফিরে আসে। কবে চলচ্চিত্রের প্রেমে পড়েন?
চার্লস সিমিক : আমার ১০ কী ১১ বছর বয়স। বেলগ্রেডে, যেখানে আমার শৈশব কেটেছে, ভয়াল অন্ধকার ছিল, যুদ্ধের বছরগুলো তারও পরের কয়েক বছর ছিল বিপজ্জনক। তখনকার আমার বিনিদ্র রাত কাটানোর সঙ্গী ছিল চলচ্চিত্র। বিশেষ করে মার্কিন চলচ্চিত্র আমার মনে কবিতার রস সঞ্চার করে, বৃষ্টিঝরা রাতে জানালার পর্দা তোলার সাহস জোগায়, আমি দেখি রাস্তা শুয়ে আছ, স্নান করছে। আমার বন্ধুদের অনেকেই ওইসব চলচ্চিত্র পছন্দ করতো না, বিষয়টি আমাকে আহত করতো, ভাবতাম এও সম্ভব!
একবার সাক্ষাৎকারে অ্যালেন গিন্সবার্গকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তিনি কেন তার মতো লেখেন, উত্তরে তিনি বলেন, ‘একমাত্র কারণ হলো আমি লিখি!’ কেন কবিরা তাদের মতোই লিখেন, এর বাইরে কি কিছু বলার নেই?
চার্লস সিমিক : সম্ভবত নেই। আমি লিখি ঈশ^রকে রাগাতে আর মৃত্যুকে হাসাতে। আমি লিখি কারণ আমি তা ঠিকভাবে পাই না।
আমি লিখি কারণ আমি চাই এই পৃথিবীর সব নারী আমার প্রেমে পড়ুক। কেউ হয়তো এরকম চালাকি করতে পারেন, কিন্তু শেষমেষ গিন্সবার্গের কথাই সত্য হয়ে যায়।
গত ৪০ বছরে আপনার কবিতাশৈলী, নিজস্ব স্টাইল, কিভাবে রূপান্তরিত হলো?
চার্লস সিমিক : আমার শুরুর দিকের কবিতায় জোর দিতাম চিত্রকল্পের ওপর, শ্রুতির প্রতি যতœবান ছিলাম না, আটপৌরে শব্দ ব্যবহার করতাম। ইতিমধ্যে আমার কবিতার ভাষা ও সংগীতের ব্যবহারের প্রতি সচেতন হয়ে উঠেছি। আরো আত্মজীবনীমূলক উপাদান, আরো বর্ণনাধর্মিতার ব্যবহার করছি। আমি হয়ে উঠেছি লোক ও নাগরিক কবি। আমার আছে আবিষ্টতা, বাজে স্বভাব ও অন্ধ খুঁত। এতদিন ধরে যে কবিরা লিখে চলেছেন তাদের দশজনের মতোই আমার কবিতায় পুনরাবৃত্তি আছে। উত্তরণের চেষ্টা করি না এমন নয়, তারপরও রাতের পর রাত একই আচ্ছন্নতা পেয়ে বসে, পুরনো আমাতেই দোল খাই।
আপনি সরাসরি ইতিহাস লিখতে না চাইলেও এটা নিশ্চিত যে, ৯০-এর দশকের গোড়ার দিকে লেখা আপনার ‘রিডিং হিস্টরি’ কিংবা ‘এম্পায়ার্স’ কবিতায় বলকান যুদ্ধের ইতিহাস কথা কয়।
চার্লস সিমিক : ব্যাকগ্রাউন্ড তাই ছিল, আমি নিশ্চিত। ভারতীয় এবং চীনের ইতিহাসের ওপর বেশ কয়েকটি বই পড়ার পর আমি লিখে ফেলি রিডিং হিস্টরি। কয়েকটা পাতার মধ্যেই, অবশ্যই গণহত্যার কথা থাকতো, সংঘর্ষের কথা, হাজার হাজার লোকের মৃত্যু বার্তা। তাতে আমার চিন্তা ঘুরপাক খেত। এম্পায়ার্স কবিতাটি আমার নানিকে উপজীব্য করে লেখা। তিনি ১৯৪৮ সালে আমার বয়স যখন ১০ বছর, মারা যান তিনি। আমার শিশুবেলাটা কিন্তু তার নিবিড় সান্নিধ্যে। বাবা-মা কাজে চলে গেলে নানিই আমার দেখাশোনা করতেন। নানি তখন রেডিওতে হিটলার, স্ট্যালিন, মুসোলিনির বক্তব্য শুনতেন। নানি কিন্তু বেশ কয়েকটা ভাষা জানতেন। কাজেই হতাশ হতেন। মিথ্যা ভাষণের ওপর আস্থা রাখতে পারছিলেন না তিনি। পৃথিবীর সংকটটা কী? এ প্রশ্ন তিনি জনে জনে জিজ্ঞেস করতেন। ভালো প্রশ্ন, যার উত্তর আমার এখনো জানা হয়নি। আমার এই বয়সেই কত যুদ্ধ হলো, কত কত মানুষের প্রাণহানি! আমিও নানির মতোই হতাশ। মানুষ হত্যা আমাকে বিচলিত করে, বিস্মিত হই। মানুষ খুন করে পৃথিবীর উন্নয়ন সম্ভব, মার্কিন বুদ্ধিজীবী মহলে এ ধারণা বেশ জনপ্রিয়; কিন্তু ইতিহাস এর পক্ষে সাক্ষ্য দেয় না। এ ব্যাপারে আমি সব সময় ভাবি।
অডেন ১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর তার ‘টু আনডু দ্য ফোল্ডেড লাই’ কবিতায় লিখলেন, সর্বসাকুল্যে আমার আছে একটা কণ্ঠস্বর। অডেন অবশ্য পরে এ কবিতাটি অগ্রাহ্য করেন... কিন্তু আমার মনে হয়, এ কবিতার অন্তর্নিহিত আহ্বানের সঙ্গে আপনার কবিতার কোথাও সাযুজ্য রয়েছে। অন্তত রাজনীতিবিদ ও প-িতদের নানা ভড়ংবাজির মুখোশ উšে§াচনের ক্ষেত্রে আপনার কবিতা তৎপর।
চার্লস সিমিক : আমার বিবেচনায় কবিতা হলো কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে সক্রিয় অন্য সব ক্ষমতা মোকাবেলার শক্তি। প্রত্যেকটা ধর্ম, আদর্শ এবং চিন্তার প্রথা ও পন্থা ব্যক্তি মানুষটাকে পুনঃশিক্ষা দিতে চায়, তাকে ভিন্ন একটা মানুষে রূপান্তর করতে চায়। একজন সত্যিকারের দেশপ্রেমিক নিজের জন্য ভাবেন না, তারা তোমাকে এ কথাই বলবে। আমি লক্ষ্য করেছি, কবিতার একটা দীর্ঘ ঐতিহ্য হলো, ক্ষমতা সম্পর্কে সত্য কথা বলতে বিরত থাকা। আমার মধ্যে এই ধারণাকে লালন করতে চাইনি।
অন্যদিকে আপনার কবিতার একটা বড় আনন্দদায়ক বৈশিষ্ট্য হলো, আমার বিবেচনায় অন্তত, জীবনের সবধরনের সাদামাটা আনন্দ উপভোগে আপনার কবিতা আমন্ত্রণ জানায়। এমনকি চিংড়ি ভাজা, টমেটো, রোস্ট, রেড ওয়াইন...
চার্লস সিমিক : সস নিতে ভুলে যেও না, আলু আর পিঁয়াজও নিও! দুই-একজন দার্শনিককেও হাতে নিয়ে নেয়ার বিশেষ উপদেশ রইলো। এক বোল স্পাগেটি খেতে খেতে প্ল্যাটোর কয়েকটা পৃষ্ঠা ও ভিটগেনস্টাইনের ‘ট্র্যাকট্যাটাস’।
বিপরীতধর্মী দুটি বস্তুর সম্মিলনকে আমরা সেরা মনে করি, সবকিছুকে বাস্তব বলে মানি, একের ভিতর আরেক, কোনো না কোনোভাবে সম্পৃক্ত। এভাবেই কবিতা ও দর্শনের সহাবস্থান আমাদের মনে বিস্ময় জাগায়। আমার বিবেচনায়, আটপৌরে জীবনের আনন্দ থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো ‘সত্য’ মূল্যহীন। প্রত্যেকটি মহা থিওরি ও সেন্টিম্যান্টকে প্রথমে রান্না ঘরে এবং পরে বিছানায় পরীক্ষা করে দেখতে হবে।

মানুষ

খো ন্দ কা র আ শ রা ফ হো সে ন




মানুষ

মানুষকে কেউ ধারণ করতে পারে না
না নিসর্গ না ঈশ্বর না প্রেম না ঘৃণা
মানুষের হাতে নীল বেলুন তার চোখে দুই কালো মাছি
মানুষকে কেউ ধারণ করতে পারে না, মানুষের
কোনো জন্মদাতা নেই, তার কটির উত্তাল যৌবন কারো
উত্তরাধিকার নয়।

মানুষকে কেউ ধারণ করতে পারে না
না নিসর্গ না ঈশ্বরের দিগন্ত-প্রসারী আলখাল্ল¬া
না নদী না জন্মভূমি।
মানুষের কোনো উপমা নেই, রূপকল্প নেই, ব্যতিহার
বহুব্রীহি নেই, স্বরলিপি ব্যাকরণ নেই
শাসনতন্ত্র, অর্থ-অভিধান চর্যাচর্য নেই।
মানুষ আত্মভেদী, আত্মনাশী নীল পতঙ্গ
একদির সে পাঁজরের হাড় দিয়ে গড়েছিল এ পৃথিবী
একদিন মানুষই ধ্বংস করবে তাকে।
না ঈশ্বর না দেবতা না পাষাণ মৃদঙ্গ না প্রভাত না
মধ্যরাতে নিমগ্ন বালিশ না ফোয়ারা না যোনী না
কবন্ধ রাত্রির ঘুম কোনো কিছু না।
শুধু মানুষই পারে কোনো কিছু ভাঙতে। যেমন সাজাতে।
আমি সেই ভঙ্গুর ভঙ্গপ্রিয় ত্রিভঙ্গ মুরারির জন্যে
আমার কবিতা রেখে যাই।
আর কেউ নয়, আর কারো জন্যে আমার
দীর্ঘশ্বাস নেই, না গ্রন্থ না সুহৃদ না পলাতক
ভ্রমর গুঞ্জন না নারী না নিশ্চল বসন্ত বাহার ...

আমি মানুষকে ভালবাসি কেননা সে একদিন
নিজহাতে নিজেকে পোড়াবে।

নিজের কবিতা নিয়ে কথা বলা খানিকটা অশোভন এবং অনেকটা বিপজ্জনকও বটে। কারণ একে আত্মপ্রচারণা ভাবতে পারে কেউ, আবার কোনো-কোনো সমালোচক-ইতিহাসকার একে ভবিষ্যতে ব্যবহার করতে পারে সহজ-খেয়া হিসেবে, অনুধাবনের শ্রম বাঁচাবার জন্য। কিন্তু আমি মনে করি, কবিকে তাঁর কিছু কথা বলতে দেওয়া উচিত, কেননা প্রায়শ অপসমালোচক ও নির্বোধ ব্যাখ্যাকাররা ক্ষতি করে থাকে কবি ও কবিতার। আর আমি রোলাঁ বার্তের কথার সাথেও পুরোপুরি একমত নই, আমি মনে করি না কবিতা রচনার সাথে সাথে রচয়িতা-কবির মৃত্যু ঘটে।
আমার নিজের প্রিয়তম কাব্যগ্রন্থ জীবনের সমান চুমুক। প্রথম কবিতা ‘মানুষ’ পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে, কিন্তু কী আশ্চর্য, আমি তাকে পরিহার্য ভেবেছিলাম- গ্রন্থপ্রকাশের সময় ওকে স্থানই দিতে চাইনি। জীবনের সমান চুমুক -এর পাণ্ডুলিপি সাজাচ্ছিলাম যখন, কবিতাটি তাতে দেব কি দেব না এ নিয়ে দ্বিধা ছিল। পাশে বসা ছিলেন তখনকার তরুণ কবি, একবিংশ-র প্রথম সহকারী সম্পাদক বদরুল হায়দার। তিনি বললেন, ‘মানুষ’ কবিতাটি শুধু গ্রন্থভুক্ত করবেন তা নয়, ওটিকে দিতে হবে প্রথমে। আমি তার কথা মেনে নিই। আজ বুঝি, যথার্থ পাঠকের অন্তর্দৃষ্টি তার ছিল বলে কবিতাটি রক্ষা পেয়েছে। প্রসঙ্গত, কবি সবসময় নিজের কবিতার শ্রেষ্ঠ বিচারক না-ও হতে পারেন, তার সেই নির্মোহতার দূরত্ব না-ও থাকতে পারে।
কী আছে ঐ কবিতায়? প্রথমবার পড়লে মনে হবে কিছু স্টেটমেন্টের সমাহার, মানুষকে সংজ্ঞায়নের প্রচেষ্টা, কিছু মর্মবস্তুর সমাপতন যার মাধ্যমে মানুষ নামের প্রাণীটি সম্পর্কে আমার প্রতীতি বিধৃত। কিন্তু কী এমন নতুন কথা তাতে আছে যা আগে কেউ বলেনি? মানুষ নামের এক রহস্যময়তার সামনে অভিভূত লালন ফকির গান বেঁধেছিলেন- ‘সহজ মানুষ ভেবে দেখ না, যাবে অচেনারে চেনা।’ শেক্সপীয়রের হ্যামলেটের উক্তি : ÔWhat a piece of work is man! How noble in reason, how infinite in faculty... ’কিন্তু মানুষকে কেউ পুরোপুরি বোঝেননি। মানুষ নামক অপরিজ্ঞাত ও অপরিজ্ঞেয় রহস্য আমাকে উদ্দীপিত করেছে সবসময়। তবে কবিতাটি কোনো সচেতন মানবপ্রশস্তি নয়, বরং আমার অবচেতনা থেকে উঠে-আসা একটি অবাঙমানসগোচর অনুভূতি। মনে আছে, এক ঝকঝকে সকালবেলা একরকম ঘোরের মধ্যে কবিতাটি লিখেছিলাম, অথবা আমার ভেতরের অন্য কেউ আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছিল। আমি আজো জানি না কার অদৃশ্য হাত বেজে উঠেছিল শব্দ হয়ে। আমার ভেতর-বাসিন্দা হয়তো তিনি, আমার কাব্যনিয়ন্তা। ‘আমি মানুষকে ভালবাসি কেননা সে একদিন নিজ হাতে নিজেকে পোড়াবে’-এ কথাকে এ্যাপক্যালিপ্টিক বা প্রফেটিক যাই মনে হোক না কেন, মানুষের অবিনশ্বরতায় আমার আস্থা অপরিসীম। একে মানবতান্ত্রিকতার পুরোনো বাচনও ভাবতে পারে কেউ, কিন্তু মানুষের বিধ্বংসী প্রবণতার নান্দীপাঠ আর কেউ করেছে বলে আমার জানা নেই।
মানুষকে কেউ ধারণ করতে পারে না, কেননা মানুষ মানুষের কল্পনাসীমাকেও স্ফারিত করে দিয়ে যায়। কিছুটা ধরতে পেরেছিলেন ওঅল্ট হুইটম্যান : তার বিশ্বাতিক্রমী চেতনায় মানুষের আত্মার যে বিপুল-বিশালতার জয়গান তার তুলনা পাওয়া ভার।

Do I contradict myself?
Well then I contradict myself.
I contain multitudes.


এই বিপুল মহাবিশ্ব, এই অন্তহীন কালপরিধি এই স্তবকের পর স্তবক সজ্জিত নীহারিকাপুঞ্জ সব কিছু আমাকে-মানুষকে-জন্ম দিয়েছে লক্ষ কোটি বছরের সাধনায়, আমারই ভ্রƒণকে লালন করেছে পরম মমতায়, যাতে অতি-শৈত্য অতি-আতপে নষ্ট না হয়ে যায়, অমিতকায় সরোয়েডরা মুখে করে বহন করেছে সে-ভ্রƒণ, আমি আসব বলে লক্ষ কোটি বছর তপস্যা করেছে মহাপৃথিবী। একমাত্র হুইটম্যানের প্রচণ্ড রোমান্টিক কল্পনায়ই মূর্ত হতে পেরেছিল মানুষের সেই অধিজাগতিক রূপমহিমা। বাংলা কবিতায় নজরুল ইসলামের ‘মানুষ’ কবিতাটির পেছনে দূরবর্তী প্রভাব হুইটম্যানের, নিকট প্রণোদনা মার্কস। সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই-চণ্ডীদাসের এই মহৎ উচ্চারণের নবায়ন নজরুলের কবিতায় : ‘গাহি সাম্যের গান/মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।’ আমার কবিতা তার পাশে সামান্যই; তবে কবিতাটি পাঠকের মনোযোগ পেয়েছে জেনে আমি আনন্দিত। কোনো কোনো অপরিণতমনস্ক পাঠক এর ভিন্নরকম পাঠের চেষ্টাও করেন বলে শুনেছি। ঈশ্বরের আলখাল্ল¬াও মানুষকে ধারণ করতে পারে না-এ উচ্চারণ বিব্রতকর ঠেকে তাদের কাছে যারা মরমিয়াতত্ত্বের আস্বাদ কখনো পায়নি, জানে না স্রষ্টাও এক অর্থে সৃষ্টির ওপর নির্ভরশীল-কারণ সৃষ্টিই তাকে সংজ্ঞায়িত করে। তবে সুফিতত্ত্ব আমজনতার জন্য নয়।

শনিবার, ১৭ অক্টোবর, ২০০৯

কবি জুয়েল মোস্তাফিজের কবিতা

জুয়ার আসরে কোনো আঙুলই মিথ্যা নয়

যেখানে ঘুমোতে হয় না ঠিক সেখানেই ঘুমানো গ্যালো। একটি কাগজের বাক্স, বাক্সের চার কোনায় চারটা নল, প্রত্যেক নলে গাঢ় অক্সিজেন ঢাললেই ঘুম আসে, খেটে খাওয়া ঘুমের বাড়ি গাড়ি নাই, ঘুমকেও অতি যতনে বাঁচতে হয়। আমাদের মতো জাগরী ঘুমের মানুষেরা সেই ঘুম পুষে রাখতে পারে না। দুঃখী মানুষেরা যেখানে ঘুমায়, সেখানেই চাঁদমারির বিছানা।
গল্পটা ফাঁদা যাক এবার, দরগাতলার আগুনে মানুষ পোড়ানো ভোর, প্রতিদিনের ভোর যথাসাধ্য বেলুন, বেলুনের উল্টো সোজা নেই, শুধুমাত্র ফুলে থাকা বেলুন। সুখী মানুষের অন্ধকারে দুঃখী মানুষের কোনো ঘুম আসবে না, আমরা তেলচিটে মানুষ পেটের খাবার জোটাতে গিয়ে রক্ত কালো হতে চলেছে, ঘুমের খরচ কোথায় জোটে; আর তাই তো আমরা ঘুমাতে যাই না চোখ বন্ধ করি, যারা সারারাত ঘুমাবে না বলে কৈবর্তপাড়ায় যৌনচক্রে পড়েছে, কেবল তাদের তালগাছের মতো ঘুম, আমরা বাকিতে কিনি।
গল্পটার শেষ অংশ কিন্তু এই রকম, ঘুমের ঘোড়া মারা যাবার পরই ঘুমের পাখি। নইলে কি স্বপ্ন দেখে এখান সেখান যাওয়া আসা? ঘুমের কল্যাণে তোমার বাড়িও যাওয়া যায়; কিন্তু ঘুমের ঘোড়ার আত্মার কথা ভেবে ঘুমের পাখি উড়ে যায় কুয়াশা গাছের ডালে, চাঁদ মাঠের জালে, এই জন্য ঘুমের গুরুত্ব পানসে। যাব না যাব না করে কতকাল গ্যালো, এটা কি কোনো গল্পের শেষ? আছে হয়তো রহস্য কিছু... ঘুমের ব্লেড ঘেমে উঠেছে এখন।



২.
মাটির ভেতর মাটিরা কি আরামে আছে! গাছের ভেতর একটা অদ্ভুত ফোঁকর থাকলেও আমরা দুঃখেই থাকি। আমাদের মাথার ভেতর হঠাৎ উদ্ভাবিত মৃত্যু। আমরা দৌড়াতে পারি না, কারণ আমাদের পা টুপি পরে থাকে। যাত্রার কিংবা সাকার্সের স্টেজের কাছে আমাদের মানায় ভালো, কিন্তু যাত্রা কিংবা স্টেজের বাঁশ খুঁটি আমাদের মানিয়ে নিতে পারে না। আমরা বড় বেশি হজম করতে যাই না, ফলে কবুতরের ভালোবাসা আমাদের পাঁজরে বাজিয়েছে অসময়ের ঘণ্টা। এই যে ধরুন, এত বছর ধরে সময় ব্যাপারটা আমরা বুঝতে পারছি না, এই ভেবে যে বসে আছি তা কিন্তু নয়, আমরা শাদা ঘড়ি, কালো ঘড়ি, কিংবা ইতিহাসের বিভিন্ন লাল ঘড়ির কাছে গিয়েছি, ভাঙা ঘড়ির পদতলে পূজো দিয়েছি তথাপি সময় ব্যাপারটা বুঝতে পারছি না। আমাদের সাথে প্রায়শ কথা বলতো সময়ঘাতী লোকজন। তখন দেখতাম সময়ের সাথে ধুতুরা গাছের কথা হতো, আমরা জ্যামিতি বক্সের কাঠি দিয়ে ফোড়া ফাটিয়ে ছিলাম বলে জীবনের সকল দাগই বাঁকা; আচ্ছা বলুন তো দাগ বাঁকা হলে কি বাঁচা যায়? বাঁচার জন্য অন্তত সময়ের সোজা সোজা দাগ লাগে...



৩.
সব গল্পই তো শেষ। রাতের গল্পটা, দিনের গল্পটা, এমনকি শেষ গল্পটাও। ভুল গল্পটা শেষ হবে না জানতাম কিন্তু সে গল্পটাও শেষ। শেষ গল্পটা বেশ মজা করে বলছিল পানু কাকা, সে গল্পও শেষ। মৃত্যুর গল্প ধরেছিল সরেন ডোম, মরার বাড় বেড়েছে উত্তর পক্ষে গল্প নয় সত্যি, সত্যিটুকুও শেষ হয়েছে গতরাতে। দেখুন, সব শেষ বলে আপনার পাগলা চুলগুলো আর বাড়তে দেবেন না প্লিজ! বারো মণ গালি কিনতে গিয়েছিল ওই কার্তিকের পাগল, সেই গালির কিছু অংশ শেষ হয়ে গিয়েছে কিছুক্ষণ আগে। গতরাতে পাগলনামা পড়তে পড়তে আমার মাথা ঘুরে গিয়েছিল, ঘুরবে না বলুন? এত ঘোড়া কীভাবে সামলানো যায়, ইতিহাস থেকে ঘোড়াগুলো পালিয়ে যাচ্ছে পালাতে পালাতে নিভে যাচ্ছে। বলে রাখলাম; আগামী বর্ষা থেকে ইতিহাসে আর কোনো ঘোড়া পাওয়া যাবে না। সব ঘোড়া পালিয়েছে ইতিহাসের পাতা থেকে, যুগের রক্ত থেকে। কী আশ্চর্য! শেষ হয়ে আসছে পুরনো রক্ত, নতুন রক্ত। আমি যদি ডাহুক কিংবা পরিত্যক্ত নারীর কথা বলি তবে আপনাদের মন কাঁদবে নিশ্চয়ই? তবে কাঁদুন একবার, ভিজে যান দ্রুতগামী নোঙর কিংবা ইঁদুরের মতো। শেষ হয়ে আসছে সকল গল্প, খালের গল্প, কালের গল্প। না না কালের ভেতর কোনো সাপ ঢুকেনি, দিব্যচোখের সরল দৃষ্টি আছে কালের পথে, দিব্যলোকের দৃষ্টি দেখতে অনেকখানি সাপের মতো, চেতনা বলতে যে ঝুমঝুমি বাজে আসলে তা কিছু নয় মেয়েটি পাগল হয়ে গিয়েছিল মাত্র; তার কান্নার গল্পটাও শেষ, তার কান্না থেকে তার কবর পর্যন্ত দৌড়াদৌড়ি কবে নাগাদ শেষ হবে এই ভেবে বসে আছি, বসে আছি আহত চাঁদ...



৪.
কতবেল গাছের ডালে ফাঁসি দিয়েছিল সরাইখানার শ্রমিক। ওই শ্রমিকের প্রাণে বাঁধা ছিল একটা নীল পাথর, তার মৃত্যুর পর অবশিষ্ট পাথর নিয়েই এবারের কাব্য। কাব্য ঠিক নয়; ওই পাথরের অর্ধ অংশ অন্ধকার হয়েছিল তারই গল্প হয়তো। আমাদের জীবন থেকে পশ্চিম দিকে যে পথ চলে গেছে, একটু লক্ষ করলেই পাওয়া যাবে কতগুলো দ্রুতগামী শিশু আর তাদের কান্না, সেই কান্না শুনতে শুনতে আমরা কালান্তর পাড়ি দিই। সরাইখানার শ্রমিকের কবর আছে জীবনের পশ্চিম পথে। মৃত্যুর জন্য কতবেল গাছই আদর্শ গাছ; সরাই শ্রমিকের এপিটাফে লেখা ছিল বলে আমরা পড়তে পেরেছিলাম। কতবেল গাছ স্বপ্নের ভেতর বড় হয়, ঘুমের ভেতর বড় হয়, বেশ্যার শাড়িতে বড় হয়। কতবেল গাছের ডালে মৃত্যুর আহ্বান আছে। একটু ভেবে নিলে ভালোভাবে বোঝা যাবে সরাইখানার মাঠে অনেক কতবেল গড়াগড়ি করে।
বাদ দিই এসব কথা; কতবেল গাছের রাগ হলে বাঁচান থাকবে না। সেদিন পোস্ট অফিসে দেখে এলাম প্রতিটি চিঠিই সরাইখানার, বেশ্যাবাড়ির আর কতবেল গাছের। ভয়ে দৌড়ে এসে দেখি সকল মানুষই কতবেল গাছের নিচে, বেশ্যাবাড়ির ছায়ায়, সরাইখানার ভেতর। মানুষেরা মৃত্যুগামী কখনোই ছিলো না, মৃত্যুরা মানুষগামী বলেই বেলগাছের পাতা সবুজ।



৫.
তোমাদের মতো গোছালো মাছের ঘর আমার নেই, পৃথিবীর প্রথম গান যেদিকে বেঁকে গেছে সেই দিকে আমার ভাঙা খাট আর ভাঙা বিছানা। তাই তো পথে পথে মাছওয়ালাদের দেখলেই আমি গোছালো শব্দের অর্থ বুঝি। অন্তত, যে মাছগুলো গান করে সে মাছের সময় বুঝি। বুঝতে বুঝতে মাছওয়ালা বেঁকে যায় ঘন গ্রামের দিকে, আমি বেঁকে যাই বাদুড়খানার দিকে। সাঁঝের বেলা বাদুড়ের ছেলেমেয়েরা মাদুর পেতে বসে, আমি কলাগাছের দিকে চেয়ে থাকি। কলাগাছের দুঃখটা শুনেছিলাম আইনাল হকের কাছে... যাক এসব, অনন্তের পথে তোমার কালো ব্লাউজই উজ্জ্বল... আমি গরিব মানুষ আমার ঘর বারো পথের বারোমাথায়।



৬.
পাখির ভালোবাসা দেখলাম আর কাঁদলাম। পাখিরা ভালোবাসবে এটা তো পূর্ব শর্ত ছিল? তবুও কাঁদলাম। আমি গরিব মানুষ দৌড় দিতে পারি না, তাই তো সাপ আমার আগে যায়, চুনারীপাড়া আমার আগে যায়, আগে চলে যায় মাটিবন্দি ঘুম। আরো পাখি পাখি করলে আরো কান্না আসে, পাখির আরো ভালোবাসা হয়। আমি কি পথের ভেতর করুণ বাঁশি, নইলে যে একটাই ঘুমে, ঘুম গ্যালো আগে আমি থাকলাম পিছে, বলুন দেখি এভাবে ঘুম হয়? এভাবে কি রাতের সন্ন্যাস বাঁচতে পারে? এইজন্য সব মিলিয়ে যা দাঁড়ায় তা হলো একপক্ষ মৃত্যু অন্যপক্ষে পাখির ভালোবাসা। একদিন সমস্ত অন্ধকার দাঁড়িয়ে গ্যালো রাতের বিরুদ্ধে। ধার করেছি নিঃশ্বাস, তা দিয়ে বেঁচেও আছি, কিন্তু ছোট ছোট হাতগুলো মৃত্যুর প্রসঙ্গ আনলো, মরতে পারাটা সত্যের মতো কিছু নয়, মিথ্যার মতো কিছু নয়। স্বপনে বপনে আমরা অনেক দেখি, হরেক রকম মৃত্যু আছে রাতের গভীরে। ছোট ছোট মৃত্যু দিয়েও বেঁচে থাকা যায়...
কোনটা বেশি জরুরি? বাঁচতে পারা নাকি পাখির ভালোবাসা। জরুরি আইন খুঁজে পাওয়া গ্যালো না। তাই তো অন্তিম অন্ধকারের কাছে রেখেছি জমা কোনটা জরুরি। জানি, তুমিই এই প্রশ্নের উত্তর জানো কিন্তু তোমাকে তো এই প্রশ্ন করিনি? যাই হোক, যা হোক, স্বপ্নগুলো আগে চলুক, আমি পরে যাবো...



৭.
হাসবো না আমি? আমার বাম পাঁজর ভেঙে গেছে গুনটানা প্রেমিকের পায়ে বেধে, প্রেমিকের পা দিয়ে বেকুব মাঝি এদিক ওদিক যায়... ভাঙলো তো রাতের পাটাতন? একটা সেপ্টিপিন আটকা পড়ে আছে মাংসের ভেতর, তোমরা তো সবাই জানো কতদিন লাল ময়ূরের স্বপ্ন আমি দেখি না, তবুও ভেঙে গ্যালো কাচ, এত মৃত্যু এত ভাঙা আর আমি হাসবো না? হেসে তো আর পার পাওয়া যাবে না তাই তো পথে নেমে খুঁজতে বেরুনো গ্যালো প্রেমিক। প্রেমিকের তো পাঁচ পা থাকে, প্রেমিকের তো পাঁচটা মৃত্যু এক পাত্রেই থাকে। পাত্রগুলো এখন উল্টে আছে পৃথিবীর পথে। আর কোনো প্রেমিক বেঁচে নেই মাটি কিংবা কাচের মতো। সেদিন দৌড়ে গেলাম পেছনে, দেখলাম ঘুঘু আর সর্বনাশ। মনটা খারাপ হলো; তারপর দৌড়ে গেলাম সামনে, দেখলাম সহস্র চোখ মারবেলের মতো পড়ে আছে পথেঘাটে। মনটা খারাপ হলো। এত খারাপ দিয়ে তো আর খুশি হবে না তুমি। তাই বর্ষার এক কোণে বসে থাকি। জানি চুল শুকানোর কোনো বাতিক নেই তোমার, বর্ষায় কোনো রোদও ওঠে না। ভুলেশ্বর তুমিই বলো, আমি তো সর্বনাশের আমি হাসবো না? খুব করে হাসবো, হেসে হেসে শ্মশানে যাবো, হেসে হেসে মাথা ফাটাবো, হেসে হেসে দেখে নেবো বেড়ালের মিছিল। হাসি ব্যাপারটা কেন জানি তোমাদের ভালো লাগে, তাই তো আমি হাসি, ভাঙনের চূড়ান্ত দিনেও আমি হাসি...



ঈশ্বরের ভাটিয়ালী

ভুবনের বাকল পুড়ছে আর আমরা জল হাতে দৌড় দিয়েছি আগুনের দিকে। আগুনের ভেতর এক অন্ধ ঈশ্বর বেলুন মুখে বসে আছে। আমাদের ভুবন পুড়ে যাচ্ছে জেনেও ঈশ্বরের মুখের একী কাণ্ড! আমরা ঈশ্বরের মুখে যতই জল ছুঁড়ে মারি ঈশ্বর ততই ভুবনের দিকে বেলুন ছুঁড়ে মারে। তাই তো উড়ন্ত বেলুন দেখি আর মনে হয় বেলুনের ভেতর হাওয়াটুকুই আমাদের সর্বনাশের কারণ। ধরে নেয়া যাক ভুবনের সকল ভেদ জেনে গেছে এক অন্ধ ঈশ্বরের চোখ। আর আমরা সমস্ত আগুন জলাঞ্জলি দিয়ে বসে আছি একটা বাঁশির কাছে। আমরা বাঁশির আশ্রয় নিয়েছি বলে ঈশ্বর হয়েছে ভাবের মানুষ। কী ভেবে যেন বসে আছে মৃত কচ্ছপের পাশে...
বন্ধু, রাতের কোলে আলো দেখে আর কোনো মরণ নয়, এবার আমরা জোনাকির প্রতারণা বুঝে গেছি। তাই তো দেহ থেকে রাতগুলো ঝরে যাওয়ার আগে আমরা আরো একবার দেহের ভেতর আজান নামাই। কারণ যে রাতে আমরা স্বপ্ন দেখিনি সে রাতের স্বপ্নগুলো আমাদের দেখে ফেলেছে। দেখনি গতরাতে একটা হারানো সংবাদ, তুমুল অন্ধকার হতে এক নবীন স্বপ্ন হারিয়ে গিয়েছে, গায়ের রঙ পৃথিবীর মতো, পরনে ছিলো শাদা শাদা ভ্রমর। সেই স্বপ্নটাকে দেখা গিয়েছিলো কদমের মাথায় বসে বিশ্রাম নিতে। আমাদের হাত নেই, পা নেই, আয়ু নেই, মৃত্যু নেই, এমন এক ভেজা মরা কালে আমাদের জীবনের ওপর তোমরা করেছ ঈশ্বরের আয়োজন?



২.
তুমি বর্ষা থেকে এসেছো বলে কি আমরা দায়ে পড়ে গেছি? আমাদের দায় পড়ে আছে, সময় ঘোড়ার পায়ে পায়ে। আমরা কেউ কখনো নিজেদের ওপর কোনো অধিকার রাখি না। তোমরা সারারাত আলকাপের হাড় বাজাও, আর আমরা থেকে থেকে কেঁপে উঠি। পৃথিবীর অভয় নিয়ে এত দিন গেলো, তবুও পৃথিবীর ভয় গ্যালো না। অনন্তের পথে আর কোনো বটগাছ জন্মালো না, না বাবা এবার ঘরে আর কোনো বর্ষা তুলতে পারবো না। গতকাল কত কাকে কবর দিলাম, তোমরা বুঝতেও পারো না। কী সব তোমার দাবি। কত আর কবর খুঁড়বো আমি। তোমরা সবাই কবর-বন্দি মানুষ। কেউ বাঁচতে চাও না। দাঁড়াও ওখানেই দাঁড়াও। আর গল্পটা শোনো। সেবার বর্ষা আসবে আসবে এরই মধ্যে ধীবর পাড়ায় মরার ধুম। এক হাতে কত আর কবর খোঁড়া যায়? তবুও মাটির আকাক্সক্ষা নিয়ে? কোদাল কুপিয়ে কুপিয়ে কবর খুঁড়ি আমি। যে মরা মাটির ভেতরে যায়, তারাই রাজহাঁস হবার সাধ জাগে। ওই রাজহাঁসের সাথে গোপন আলাপ করে দেখেছি। তাই তো বর্ষা এলেই আমি আর কবর খুঁড়তে কেয়ার করি না। জানি তো, বর্ষায় যারা যারা মরবে তারাই মাটির পূর্ব দিক দিয়ে উড়ে যাবে রাজহাঁসের মতো।



৩.
তুমি বাঁকা বলে আমার আঁকা সহজ হবে কেন? তাই তো আমি এই ছুরিটা নিয়ে দৌড় দিয়েছি মরাউড়ার বাঁকে... এখানে কত কার রক্ত কত রকমের ছুরি দিনরাত খেলা করে। আর খেলার ভেতর কারা যেন খালি পায়ে হেঁটে যায়। আচ্ছা তুমিই বলো, পথগুলো কি অতখানি বাঁকা ছিলো যতখানি বেঁকে ছিলো আমাদের পা? তাই তো বাঁকা পায়ের আঁকা পথে হরেক রকম ছুরি পড়ে আছে। এই ধরো এই পৃথিবীতে প্রথম গলা কাটা ছুরিটির কথা। ওই ছুরিটির হাসি শুনতে পাচ্ছো? কী দারুণ হাসি তাই না? কিংবা কবে বলে তো? মনে পড়েছে, পাড়ার কদম যেদিন প্রথম আদমের গল্প ধরলো। কী সব গল্প, ওই গল্পে কি আর মন মজে, তাই তো সোজা চলে গিয়েছিলাম জাদুঘরে, জাদুঘরের ছুরিগুলো কী অসহায়, সব যাদু ভুলে গিয়ে পড়ে আছে আমাদের হত্যা আকাঙ্ক্ষার ভেতর। এই তো কী বেফাঁস রকমের বেলা করে ওঠো তুমি, অথচ ভোরের তলপেটে শাদা শাদা ছুরিগুলো খেমটা তুলে নাচে, আর আমি ঠিকই বুক পেতে দিই ছুরির মুখে, ছুরিগুলো তোমার মতো রক্তের ভেতর এঁকেবেঁকে যায়। কিন্তু কখনো রক্তের চিহ্ন রাখে না তার গায়। তুমি বাঁকা বলে আমার আঁকা সহজ হবে, এমন দাবি কবে ভুলে যাবে তুমি?



৪.
তোমার মৃত্যুর প্রতি তোমাকেই সমবেদনা জানাতে হবে বন্ধু, নইলে পৃথিবীর সব পাখি মরে যাবে। এইজন্য বেছে নাও এমন এক মুহূর্ত যখন বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছে কুলীন পাখি।
ওই পাখিকে পরাণপাখি মনে করে আর ভুল নয়, বরং বৃষ্টির কাছে জেনে নাও কীভাবে নিজের মৃত্যুতে নিজে সমব্যথিত হবে। এই যে ধরো কেউ মরলে শাদা কাপড় কিনে আনো তোমরা, মাটিকে এত মুর্খ ভাবলে? সেই অবধি কত মানুষ মারা গ্যালো, কত পাখি ভিজে গ্যালো আর তোমরা মৃত্যুর শাদা কাপড়ে মৃত্যুর শিরোনাম লিখতে ভুলে গেলে। তোমরা তো কেউ জানলে না মাটিগুলো কীভাবে শীতে কাতরায় আর মাটির শীত তৈরি করে শিরোনামহীন মৃত ব্যক্তিরা। শীতের উত্তর দক্ষিণ নেই বলেই কি তোমরা মরার জন্য শাদা কাপড়ের সাহস পাও, কিন্তু তুমুল বৃষ্টিতে যখন পাখি ভিজে যায়, তখন সে বৃষ্টির ভেতর মরাগুলোকে দেখি নিজের মৃত্যুর জন্য নিজেরায় সমবেদনার কোরাস তুলে। তাই তো নিজের মৃত্যুর জন্য নিজের সমবেদনার ভাষা শিখে নিতে হবে বন্ধু। বেছে নিতে হবে সেই মুহূর্ত, যখন পাখিরা ভিজে যাবে আর সেই ভিজে যাওয়া বৃষ্টির শব্দগুলোই নিজের মৃত্যুর প্রতি নিজের সমবেদনার ভাষা।



৫.
না খেয়ে আছো বলে পৃথিবীর দিকে অমন করে তাকাচ্ছো কেন? পৃথিবীও না খেয়ে আছে। বাহ্! সংবাদটা শুনে কী দারুণ খুশি হয়ে গেলে। পৃথিবীও খুশি হয়েছে। ভেবো না বন্ধু, তুমি না খেয়ে মরে গেলে পৃথিবীও না খেয়ে মরে যাবে। আর ক্ষুধার কথা বলবে তো? আরে ওটা তো একটা প্ররোচনা। জীবন জীবন করে দিনরাত যে আয়ুবাদী চিৎকার শুনা যায় সেই চিৎকারকে বাঁচানোর জন্যই তো পৃথিবীতে ক্ষুধার জন্ম। এই যে এতদিন আয়ুর সংজ্ঞা জানলে তাতে কি ক্ষুধার কোনো কদর দেখতে পাও? একবার কী ভেবে দেখেছ, আয়ু কী প্রতারক। বাতাসের মতো আচরণ যার থান বেঁধেছো দেহে? বাদ দাও বন্ধু ওটা কিছু নয়, ওটা প্ররোচনা, দ্যাখো না পৃথিবীকে কতকাল না খেয়ে আছে। কতকাল আয়ুর বিরুদ্ধে হেলান দিয়ে আছে জীবনের পাহাড়ে।

বুধবার, ১৪ অক্টোবর, ২০০৯

ফরাসি ঔপন্যাসিক লো ক্লেজিওর নোবেল প্রাপ্তি

সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ ও সম্মানীয়। ১৯০১ সাল থেকে ডিনামাইট আবিষ্কারক আলফ্রেড নোবেলের নামে এই পুরস্কার চালু হওয়ার পর বিশ্বের খ্যাতিমান কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, দার্শনিক এ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। খ্যাতিমান যারা এ পুরস্কার পেয়েছেন তারা হলেন- রুডইয়ার্ড কিপলিং, পল হাইসে, টোমাস মান, গাব্রিয়েলা মিস্ত্রাল, হারম্যান হেস, আদ্রেজিঁদ, উইলিয়াম ফকনার, বার্ট্রান্ড রাসেল, উইনস্টন চার্চিল, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, আলবেয়ার কামু, বরিস পাস্তেরনাক, জন স্টেইনবেক, ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা, স্যামুয়েল বেকেট, আলেকজান্ডার সলঝেনিতসিন, পাবলো নেরুদা, সল বেলো, আইজ্যাক বাশেভিস সিঙ্গার, গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ, উইলিয়াম গোল্ডিং, ওলে সোয়িংকা, জোসেফ ব্রডস্কি, নাগিব মাহফুজ, অক্টাভিও পাজ, নাডিম গোর্ডিমার, ডেরেক ওয়ালকট, টনি মরিসন, কেনজাবুরো ওয়ে, সিমাশ হিনি, হোসে সারামাগো, গুন্টার গ্রাস, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ভিএস নাইপল, হ্যারল্ড প্রিন্টার, ওরহান পামুক ও ডোরেস লেসিং।
আর এ বছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন ফরাসি ঔপন্যাসিক জ্যঁ-মাহি গুস্তাভ লো ক্লেজিও। গতকাল সন্ধ্যায় সুইডিশ একাডেমি এ কথা জানিয়েছে। তিনি কেবল উপন্যাসই লিখেননি, একাধারে লিখেছেন গল্প, প্রবন্ধ। ভারতীয় মিথলজির ওপর দুটি গ্রন্থ অনুবাদ করেছেন তিনি।
গতকাল নোবেল প্রাইজ ঘোষণার সময় সুইডিশ একাডেমি লো ক্লেজিও সম্পর্কে বলেছে, author of new departures, poetic adventure
and sensual ecstasy, explorer of a humanity beyond and below the
reigning civilization.
প্রকৃত অর্থেই তিনি তার উপন্যাসে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেছেন। তিনি তার উপন্যাসে কেবল কাব্যিক দ্যোতনারই সৃষ্টি করেননি, মানুষের ইন্দ্রিয় অনুভূতি, সভ্যতা ও মানবতার জয়গান তিনি এমনভাবে গেয়েছেন যা সভ্যতা ও মানবিকতাকে ছাপিয়ে এক নতুন জগতের সন্ধান দিয়েছে।
পুরস্কার হিসেবে তিনি এক কোটি ক্রোনারের (১৪ লাখ ডলার) চেক, একটি সোনার মেডাল পাবেন। এছাড়া সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমের ‘ওল্ড টাউন’-এ অবস্থিত একাডেমির হেডকোয়ার্টার্সে বক্তৃতাও করবেন তিনি।
ফরাসি ঔপন্যাসিক জ্যঁ-মাহি গুস্তাভ লো ক্লেজিও ১৯৪০ সালের ১৩ এপ্রিল ফ্রান্সের নিস শহরে জন্ম গ্রহণ করেছেন। এ বছর (২০০৮ সাল) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার আগে ১৯৬৩ সালে তিনি চৎরী Renaudot পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন।
১৮ শতকে তার পরিবার ব্রিটানি থেকে মরিশাসে চলে যায়। এ দেশটি বৃটিশ শাসনের অধীনে আসে ১৮১০ সালে। এরপরও এখানকার অধিবাসীরা তাদের সহায়-সম্পদ ভোগ করতে পারতো এবং বৃটিশ ন্যাশনালিটি ভোগ করা সত্ত্বেও ফরাসি ভাষা ব্যবহার করতো। তার বাবা বৃটিশ আর্মিতে সার্জন হিসেবে কাজ করেছেন। তখন এই পরিবারটি কিছু সময়ের জন্য আফ্রিকায় বসবাস করেছে। তার মা ছিল বোবাকালা/মূকবধির। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পরিবারের সদস্যরা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, পরিবারের সদস্যরা সবাই তখন নিস শহরে ছিল; কিন্তু তার বাবা ছিল তাদের থেকে অনেক দূরে। এই নিসেই তিনি স্নাতক হয়েছেন। এরপর তিনি যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষকতার চাকরি নিয়ে চলে যান।
জ্যঁ-মাহি গুস্তাভ লো ক্লেজিও (সংক্ষেপে জে.এম.জি. লো ক্লেজিও) একজন পর্যটকও বটে। মাত্র সাত-আট বছর বয়স থেকেই তিনি লেখালেখির জগতে প্রবেশ করেন। ফরাসি সাহিত্যে পড়াশোনার পর তিনি মাত্র ২৩ বছর বয়সেই খ্যাতিমান হন তার প্রথম উপন্যাস দি ডিপোজিশন-এর জন্য। এটি ফরাসি ভাষায় লিখিত। এর জন্যই তিনি ১৯৬৩ সালে চৎরী জবহধঁফড়ঃ পুরস্কার লাভ করেন।
এরপর থেকে এ পর্যন্ত তিনি প্রায় ত্রিশটি বই লিখেছেন। এর মধ্যে রয়েছে ছোট গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ এবং ভারতীয় মিথলজির ওপর দুটি অনুবাদগ্রন্থ। এছাড়া অগণিত বইয়ের ভূমিকা ও পর্যালোচনাও লিখে দিয়েছেন তিনি।
তার লেখক-জীবনকে মূলত দুই ভাগে ভাগ করা যায় :
১৯৬৩-১৯৭৫
এ সময়টিতে তিনি বাতুলতা, ভাষা ইত্যাদি থিম নিয়ে কাজ করেছেন। তার এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষার সঙ্গে তার সমসাময়িক জর্জ পারেক বা মাইকেল বাটোর-এর সাদৃশ্য দেখা যায়। তখন মানুষের দৃষ্টিতে তিনি নতুন কিছু করতে আগ্রহী ও একটু বিদ্রোহী টাইপের ইমেজ কুড়িয়েছিলেন। তবে এসবের ফলে মিশেল ফুকোর প্রশংসাও লাভ করেছেন তিনি।
১৯৭০-এর দশকের শেষের দিকে লো ক্লেজিওর লেখার স্টাইলে বড় ধরনের পরিবর্তন চলে আসে। তিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষার অভ্যাস পরিত্যাগ করেন। তার রচনার উপজীব্য হয়ে ওঠে শৈশব, বয়োঃসন্ধি, ভ্রমণ ইত্যাদি, যা পাঠকগোষ্ঠীর একটি বড় অংশের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়। তিনি জনপ্রিয়তা লাভ করেন এবং ডেজার্ট উপন্যাসের জন্য ১৯৮০ সালে তিনি ফ্রেঞ্চ একাডেমি থেকে পুরস্কার পান।
১৯৯৪ সালে ফরাসি সাহিত্য বিষয়ক ম্যাগাজিন লিরার একটি জরিপে ১৩ শতাংশ পাঠক তাকে জীবিত ফরাসি লেখকদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলে রায় দেয়।
১৯৮৫ সালে ঔপন্যাসিক ক্লাউড সিমনের পর তিনিই ফরাসি ঔপন্যাসিকদের মধ্যে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করলেন। তিনি নিজ দেশে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করলেও এই উপমহাদেশে তার গ্রন্থ তেমন পঠিত নয়। তার পরিচিতিও এই অর্থে নেই। যেমন নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির আগে গুন্টার গ্রাস, টনি মরিসন, ভি এস নাইপল, হেরাল্ড প্রিন্টার, ওরহান পামুক প্রমুখ লেখক যেভাবে পরিচিতি লাভ করেছিলেন।
তার উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম
দি ডিপোজিশন (১৯৬৩), ফিভার, দি ফ্লাড (১৯৬৬), ম্যাটেরিয়াল এক্সটাসি (১৯৬৭), বিলাভড আর্থ (১৯৬৭), দি বুক অফ এসকেপস ওয়্যার, হেই (১৯৭৩), দি জায়ান্টস (১৯৭৩), জার্নিস বিওন্ড (১৯৭৫), চিলাম বালাম প্রফেসিস (১৯৭৬), টু দি আইসবার্গস, এন এসেই অন হেনরি মাইচক্স (১৯৭৮), মনডো অ্যান্ড আদার স্টোরিস (১৯৭৮), দি স্ট্র্যাঞ্জার অন দি আর্থ (১৯৭৮), থ্রি হলি সিটিস, ডেজার্ট (১৯৮০), দি রাউন্ড অ্যান্ড আদার কোল্ড হার্ড ফ্যাক্টস, দি প্রসপেক্টর, ডিয়েগো রিভেরা অ্যান্ড ফ্রিডা কাহলো, জার্নি টু রড্রিগোজ, দি মেক্সিকান ড্রিম অর ব্রোকেন থট, স্প্রিং অ্যান্ড আদার সিজনস, এ রেফারেন্স টু দি আফ্রিকান সিটি অফ ওনিটশা, ওয়ান্ডারিং স্টার, পাওয়ানা, কোয়ারান্টাইন, দি গোল্ডেন ফিশ, দি ক্লাউড পিপল, সাং সেলিব্রেশন, সেরেনডিপিটি, বার্নট হার্ট অ্যান্ড আদার রোমান্সেস এবং দি আফ্রিকান (২০০৪)।
বিগত দুই দশকের বেশি সময়ে কোনো ফরাসি লেখক সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাননি। লো ক্লেজিওর পুরস্কার প্রাপ্তির মধ্য দিয়ে এই দীর্ঘ শূন্যতা পূরণ হলো। আধুনিক ফরাসিদের জীবন-যন্ত্রণা, শূন্যতা, মানবতাবোধ ও সংগ্রামের ভিন্নমাত্রিক উপস্থাপন বাংলা ভাষাভাষী মানুষ এবার তার সম্পর্কে জানার সুযোগ পাবে তার মূল্যবান রচনা পাঠের মাধ্যমে। লো ক্লেজিওর চিন্তার জগৎ, কল্পনার বিস্তার ও সৃষ্টিশীলতার বহুমাত্রিক দিকটিও উন্মোচিত হবে।