শনিবার, ৭ নভেম্বর, ২০০৯

কবি তাপস গায়েন-এর অপ্রকাশিত পদ্য

(এক)

প্রগাঢ় ভালোবাসায় বেঁধে রাখি তাকে
তবু কেন মিছে এতো ধূলো ওড়াওড়ি
আমি তো জন্মান্ধ কবি, বালিয়াড়ি জুড়ে
মগ্ন আমি, কেন খুঁজি সেতু পারাপার

বুয়েট, ঢাকা ; জুলাই ৮, ১৯৮৯


(দুই)

বীর্যহীন রাত নামে হীম কুয়াশায়
চাঁদ শিশুর হাড়ের লাবণ্য ছড়ায়
জেনেছি আমার চুল ঈশ্বর-বিহীন
তবে কেন এতো রাতে নিয়ন-প্রণয়

বুয়েট, ঢাকা ; জুলাই ২৮, ১৯৮৯


(তিন)

রঙ ও রেখায় আঁকি সমুদ্র তুমুল
তবু হাতে রয়ে যায় বিষণ্ন লেগুন
নীল রঙে আঁকি যদি নম্র জল, তবে
শঙ্খের গভীরে ঝরে জলের অনল

বুয়েট, ঢাকা ; জুলাই ৩০, ১৯৮৯


(চার)

অন্ধ আত্নমগ্নতায় খুঁজে ফিরি নারীর শরীর
সুবাতাস ফিরে যায় ; ব্যর্থ হয়ে ফিরে ফিরে যায়
থির গাঙের শুশুক ব্যাকুল ভাদ্রের ভরা জলে
এ কী অস্থির কৌতুক নিরন্তর আমাকে ভাবায়

বুয়েট, ঢাকা ; জানুয়ারি, ১৯৮৯


(পাঁচ)

শুধু ব্যর্থ দগ্ধ সিগারেট । এ কী দাহ না উৎসব
না কী রঙধনু ছুঁয়ে ক্রমাগত স্মৃতি পারাপার
তোমার নিশ্চুপ হাতে ঝরেছিল আলোর সরণী
দেহ আর দ্রোহ নিয়ে নিঃশব্দ আমার করতালি

বুয়েট, ঢাকা ; জুন- ১৯৮৯


(ছয়)

কোথাও ঠিকানা নেই, নম্র নীল নিরাবেগ জল
তবে কিসের সংসার গড়ে তুলে মানুষে মানুষ
ফিরে আসি স্মৃতির উৎসবে, কোন মানুষের ভ্রমে
দর্পণে চিত্রিত নই, স্বপ্নে শুধু নিরাবেগ জল

বুয়েট, ঢাকা ; আগস্ট ৩- ১৯৮৯


(সাত)

জলের প্রবাহে আছি । এই নগ্ন-রূপে বহুদিন
শূণ্যে ভেসে গেছে ঘুড়ি । এইভাবে কে কী নিয়ে যায়
যৌবন মেধাবী জানি । জলে শুধু নিরন্তর ঢেউ
দেহের পূরাণ আছে । কেন আমি নিশ্চল পাথর

বুয়েট, ঢাকা ; আগস্ট ১০, ১৯৮৯


(আট)

বরফ হয়েছ তুমি ? কেন, তরল দেখোনি বলে
এসো, ভাসি অবেলায় । এইভাবে হাত রাখো হাতে
জলে ঠোঁট রেখে বুঝি আমি নই সহজ সরল
খুব বৃষ্টি শেষে বলে ওঠো তুমি - হয়েছি তরল

বুয়েট, ঢাকা ; আগস্ট ১৫, ১৯৮৯


(নয়)

শব্দের কিনারে আছি । দূর সমুদ্রে জাহাজের ভোঁ
ফাৎনায় মুহূর্ত কাঁপে । ঝরে পড়ে অস্থির সময়
ব্যর্থ বায়ু ফিরে যায় । খুঁজে যায় ব্যথিত বলয়
প্রবল বাতাসে ঈশ্বর কী কাঁপে ফাৎনার ডগায়

বুয়েট, ঢাকা ; সেÌটম্বর, ১৯৮৯


(দশ)

ইতিহাসের মূঢ়তা শিখেছে কি একাকী মানুষ
তবে জটিল জল্পনা কেন বুনো জলের সারল্যে
বুর্জোয়া স্বভাবে নেই কোন জলজ বৃত্তের ভঙ্গী
মুক্তির আনন্দ লিখে রেখো দেহের গোপন ভাঁজে

বুয়েট, ঢাকা ; জুলাই ২৭, ১৯৮৯


(এগারো)
দেহ নিয়ে খেলা; আছি এইভাবে লুপ্ত বহুদিন
স্তন যোনি জানু ছুঁয়ে আজ এই উন্মুল জীবনে
অনতি অতীত থেকে উঠে আসে সাহসী মানুষ
আর আমি পোড়াকাঠ; ভেসেছি দূরতর অতীতে

বুয়েট, ঢাকা ; আগষ্ট, ১৯৮৯


(বারো)

লিখো নাম অবিরাম সহজ জলের কলস্বরে
দাও উড়িয়ে বুদ্বুদে জরা, দাহ, দেহের সন্তাপ
ছোট বড় ঢেউ সব মুছে দেয় নাম অবিরাম
খুব বেশী নগ্ন হয়ে ভাবি - শৈশব কী শুধু স্মৃতি

বুয়েট, ঢাকা ; সেপ্টেম্বর ৮, ১৯৮৯


(তেরো)

তছ্নছ করেছো ছায়া; নিগুঢ়-ও তার প্রতিশ্রুতি
ঈশ্বর-বিহীন তুমি দাঁড়াবে কোথায়, ভেবেছ কী
প্রবল মাধ্যাকর্ষণ টানে আছো আজ মানুষের
ভীড়ে । তবু জেনেছ কী তুমি নিজে কতোটা ঈশ্বর

বুয়েট, ঢাকা ; সেপ্টেম্বর ৯, ১৯৮৯


(চৌদ্দ)

কোথায় দাঁড়াব আমি, অনাসক্ত এক মুঠো জল
সমস্ত পৃথিবী জুড়ে একই বিদায় সম্ভাষণ
মানুষের পায়ে পায়ে খুব বেশী মগ্ন আমি ; তবু
রঙধনু ছুঁয়ে বুঝি - এই নয় আমার জীবন

বুয়েট, ঢাকা ; সেপ্টেম্বর ১৪, ১৯৮৯


(পনের)

বৃষ্টি হয়েছিল । তাই সারাদিন আনমনে খুব
স্মৃতির শিকড় ছুঁয়েছিল বুঝি সরব প্রপাত
উঠোনের জলে মৃদু দুলেছিল শীর্ণকায় চাঁদ
বস্তু কেন ভেঙ্গে যায় ঘন নীল মনের ছোঁয়ায়

বুয়েট, ঢাকা ; সেপ্টেম্বর ২৭, ১৯৮৯


(ষোল)

শব্দের সীমানা ভেঙে চলে যাব দূর কোন দেশে
ত্রস্ত বিকালের রোদ মেখে নিও শাড়ির আঁচলে
খুব ধূলো যদি ওড়ে, কান রেখো জলের আভাষে
বুঝে নিও এ জীবন শুধু মিছে ধূলো ওড়াওড়ি

বুয়েট, ঢাকা ; সেপ্টেম্বর ২৮, ১৯৮৯


(সতের)

নৌকা ছেড়ে গেলে বুঝি - একদিন আমিও ছিলাম
কার আঁচল ছায়ায়, কবে কার দ্রাবিত যৌবনে
পড়ে আছে ভাঙ্গা সাঁকো, বহু অর্থহীন প্রতিশ্রুতি
আজ চারিদিকে জল । সাঁকোহীন, শুধু এলোমেলো

বুয়েট, ঢাকা ; অক্টোবর ৫, ১৯৮৯


(আঠারো)

শব্দের আদলে নারী; ভাঙ্গি তার জটিল যৌবন
অজস্র শব্দের মুখোমুখি ফেরারী আসামী আমি
মেঘ-বৃষ্টি-জল আনে অবিরল শব্দ কোলাহল
শব্দ ভেঙ্গে দেখি শুয়ে আছে নারী, বিমুগ্ধ নয়ন

বুয়েট, ঢাকা ; অক্টোবর ১০, ১৯৮৯


(উনিশ)

ঘাসে ঘাসে বেজেছিল বিচূর্ণ সূর্যের গান, আর
লুদ্ধক নক্ষত্র ঘিরে মানুষের নিঃসঙ্গ জীবন
গভীর রাতের শেষে মন্থর শরীর ঘিরে থাকে
নিহিত কুয়াশা আর বাদুড়ের ঘরে ফেরা তান

বুয়েট, ঢাকা ; অক্টোবর ২০, ১৯৮৯


(কুড়ি)

রাতের জরায়ু ছিড়ে পৌঁছে যাই পৃথিবীর পথে
ভাঙ্গে বার্লিন প্রাচীর । ফেরারী যৌবন কিছু জানে
দেহের পরিধি জুড়ে জাগে আজ অলীক প্রণয়
নগরী নিয়ন ছেড়ে অকারণ কে আর হারায়

বুয়েট, ঢাকা ; নভেম্বর ৪, ১৯৮৯


(একুশ)

পড়ে আছি শব্দহীন, চৌরাস্তায় মোড়ে ক্রুশবিদ্ধ
সারারাত খুব আলো কুড়ালেন নগ্নপ্রায় যীশু
দেহের প্রতিভা নিয়ে আমি এক ঈশ্বর সাধক
নগ্ন হতে গিয়ে ভাবি- যীশু আজ কতোটা উন্মুল

বুয়েট, ঢাকা ; নভেম্বর ৪, ১৯৮৯


(বাইশ)

অসম্পূর্ণ বৃত্ত । কেন খুঁজি আমি একান্ত ঈশ্বর
রঙ ও রেখায় আঁকি নদী, তার লীলায়িত ভঙ্গী
মুছে গেলে রঙধনু হারায় নদীর সব বাঁক
ধূলোয় দেখেছি আমি নগ্নপ্রায় আদিম ঈশ্বর

বুয়েট, ঢাকা ; নভেম্বর ২৫, ১৯৮৯


(তেইশ)

ঠোঁট ও পালক, ইভা- ঠোঁট ও পালক, ছায়া কই
আগুন দিয়েছ খড়ে । নগ্ন হয়ে দেখেছ আগুন
পথে পথে ধূলো বালি । কেন আমি শুধু মিছে ঘুরি
ডাল কেঁটে ছায়া খুঁজি । বোধি-বৃক্ষে পাখি, কই তুমি

বুয়েট, ঢাকা ; নভেম্বর ২৫, ১৯৮৯


(চব্বিশ)

ছিল ভাঙ্গা গড়া, নিজ অবয়বে জলের উত্থান
তোমার আঙ্গুল ছুঁয়ে প্রতারক দেখেছি ঈশ্বর
নিগুঢ় বিন্যাসে জল তদুপরি নিজের ভাস্কর
আজ রাতে শূণ্য করতলে জেগেছে গোপন ত্রাস

বুয়েট, ঢাকা ; ডিসেম্বর ৩, ১৯৮৯


(পচিশ)

কতো হাত জল মাপি ? মাছ কতো জলের গভীরে
বেলা জুড়ে ছায়া খুঁজি । মেলা ভেঙ্গে গেলে তবু থাকি
অদৃশ্য সঙ্গীত রেখা । ফিরে যাব কার কাছে, ইভা
তোমার চিবুকে সাঁকো । স্তদ্ধ আমি সেতু পারাপার

বুয়েট, ঢাকা ; দিসেম্বর ৯, ১৯৮৯


(ছাব্বিশ)

অসম সঙ্গম আর নিজ বৃত্তে স্বপ্ন ব্যভিচার
বড় পথে গুঢ় টান, ভেঙ্গে ফেলি স্মৃতির ভূগোল
শব্দের মন্থন আনে অবিরল স্মৃতি পারাপার
হঠাৎ তুমুল তালি । চেয়ে দেখি বৃষ্টি অনাচার

বুয়েট, ঢাকা ; ডিসেম্বর ১২, ১৯৮৯


(সাতাশ)
পাথরে প্রহৃত জল । প্রজাপতি জলের বিক্ষোভে
নগ্ন হয়ে উন্মাতাল, আমি কোন উর্ব্বশী যৌবনে
আছি অদৃশ্য প্রবাহে । তবু জন্মান্তর জেনে যাই
এই জলে ও পাথরে, প্রতারিত স্মৃতির ভূগোলে

বুয়েট, ঢাকা ; ডিসেম্বর ১২, ১৯৮৯


(আটাশ)

পালকে আনন্দ জাগে । কেঁপে ওঠে স্মৃতির ভূগোল
ছায়াবৃত্তে ভেঙ্গে যাই; ভেসে যাই বিপ্রতীপ জলে
যুথবদ্ধ শব্দ আনে অবিরল শব্দ ব্যভিচার
রাতের আঁধার জানি ভেঙ্গে যায় শুশুক মায়ায়

বুয়েট, ঢাকা ; জানুয়ারি ৫, ১৯৮৯


(উনত্রিশ)

লুদ্ধক আনন্দে রোদ ঘিরে রাখে বরফ শরীর
করতলে উথ্লে ওঠে বেহুলার পায়ে ভাঙ্গা জল
শরীর কী ছুঁয়েছিল কুমারীর নগ্ন স্তন, তবে
বেহালার ছড় ভেঙ্গে কেন আমি নম্র চুলে থির

বুয়েট, ঢাকা ; জানুয়ারি, ১৯৯০


(ত্রিশ)

উঠোন পেরিয়ে চাঁদ । ঋতুবতী জলের প্রবাহ
বায়ু এসে ভেঙ্গে দেয় জল, শুধু জল অবিরল
হৃদে তবে কেন জাগে অর্থহীন স্মৃতির ভূগোল
রমণীর নাভিমূলে শান্ত হয়ে আসে ঘূর্ণিজল

বুয়েট, ঢাকা ; ফেব্রুয়ারি ১৯৯০


(একত্রিশ)

মৌলের স্বভাবে আছো । আজ তার রূপান্তর জেনো
অজস্র ভাঙ্গনে অণু । উথ্লে ওঠো কিসে, নম্র তুমি
জলের কাঁপনে, নতুন বিন্যাসে, যদি তুমি ভাঙ্গো
অণুর স্বভাবে তবে জানি, মৌলিক মানুষ আমি

বুয়েট, ঢাকা ; ফেব্রুয়ারি ১৯৯০


(বত্রিশ)

হেঁটে যাই আনমনে, নিজের ছায়াকে জানি সঙ্গী
শেষ বিকালের আলো নিভে; ঝরে পাতা অবেলায়
নিয়ন পেরিয়ে ভাঙ্গি বৃত্ত, ক্রমাগত হেঁটে চলি
কাকে যেন খুঁজে ফিরি । নিজেই নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী

বুয়েট, ঢাকা ; মার্চ ১৯৯০


(তেত্রিশ)

ভাঙ্গনের আনন্দে ভেঙ্গেছ । বিপুল ভেঙ্গেছ তুমি
হাত-পা ছুড়ে শুধু কী বাতাসের মগ্নতা কেড়েছ
উৎসব আনন্দে তুমি থৈ থৈ রমণী ভেঙ্গেছ, তবে
আজ চোরা-বালি জুড়ে শুধু কেন নিজেকেই খুঁজছো

বুয়েট, ঢাকা ; মার্চ ১১, ১৯৯০


(চৌত্রিশ)

বেভুল মানুষ তুমি । তবে কেন এমন মেতেছ
উস্কো খুস্কো চুলে তুমি কতোটুকু আকাশ ধরেছ
বাদুড়ের সাথে তুমি এলোমেলো অনেক ঘুরেছো
উন্মুল হয়ে কী আজ রাজধানী নিয়নে মজেছো

বুয়েট, ঢাকা ; মার্চ ১৫, ১৯৯০


(পয়ত্রিশ)

থাকা না থাকার দ্বন্দ্বে ভেসে যায় ছইহীন নৌকা
লেগে থাকে নারীর শরীরে তার বেগ ও বিস্তার
রঙধনু ছুঁয়ে নগ্ন আমি ক্রন্দনহীন, উন্মাতাল
আকাঙ্খায় বীজপত্র দেখি ছায়াপথ হতে চায়

বুয়েট, ঢাকা ; ফেব্রুয়ারী ১৯৯০


(ছত্রিশ)

মেঘ, মাটি, ও শূণ্যতা । হয়েছে বৃষ্টিতে একাকার
ভিজেছি আমূল আমি; আছি তবু বৃক্ষের স্বভাবে
থিতিয়ে এসেছে তাপ যদি মাটির গভীরে, তবে
দেহের পরিধি জুড়ে জল কেন বাষ্প হয়ে ভাসে

বুয়েট, ঢাকা ; মার্চ ১৯৯০


(সাইত্রিশ)

ঘুম- দেহের আবেগ । লগি মেরে আর কতোদূর
স্বপ্ন- পাল তোলা নৌকা । ভেসে যায় অনিকেত জলে
জাগরণ- শব্দের আদলে জাগে রাতের নিয়ন
ঘুম-স্বপ্ন-জাগরণ : বাতাসে হিল্লোল তুলে থির

বুয়েট, ঢাকা ; মার্চ ২০, ১৯৯০


(আটত্রিশ)

পলি- নারীর শরীর । গুঢ় অভিমানে খুব গাঢ়
শিলা- শরীরের ভার । নগ্ন শরীরের রূপান্তর
পালক- দেহের ছায়া । পলি ও পাথরে কোন ভেদ
পলি-শিলা-পালক : জেনে যাই প্রকৃতি অভেদ

বুয়েট, ঢাকা ; মার্চ ৩০, ১৯৯০


(উনচল্লিশ)

এই মেয়ে রোজ তুমি জল নিয়ে ফিরে গেছো বাড়ি
তবু কখনো বুঝোনি, কলসের কাঁধ ছুঁয়ে ঢের
হয়েছো বয়সী । আজ কলস ভরে না । খুব ব্যর্থ
তুমি । বিংশ-শতাব্দীর মেয়ে, কেন ছেনালি শিখোনি

বুয়েট, ঢাকা ; এপ্রিল ৮, ১৯৯০


(চল্লিশ)

দর্পণ তো নই আমি; নই কোন এলেমী পাথর
আলো তবু খেলে যায় দেহের ভিতরে অবিরল
পৃথিবীর অক্ষ ঘুরে যদি আসে কালো রাত, তবে
নারীর শরীরে খুঁজি দর্পণের বিচূর্ণ উৎসব

বুয়েট, ঢাকা ; মে ৬, ১৯৯০


(একচল্লিশ)

ইভা, আজ তুমি শুশুক আনন্দে ডুবে আছো খুব
দেহের গভীরে লুফে নাও জলে ভরা মেঘ, কিন্তু
নিয়নের রেণু মেখে যেই আমি নদীর কিনারে
দেখি, আকাঙ্খায় ভেঙ্গে ভেঙ্গে তুমি অজস্র অনেক

বুয়েট, ঢাকা ; এপ্রিল ২২, ১৯৯০


(বিয়াল্লিশ)

সত্তার গভীরে ঘুম । তবু ঝিলে ছুঁড়ে দেই ঢিল
জলে জেগে ওঠে বৃত্ত । বৃত্তে শুধু ভাঙ্গনের ধুম
স্বপ্নের নেশায় নেমে পড়ি শান্ত ঝিলের গভীরে
জলের বিভঙ্গে- ইভা, তুমি আজ কামুকী শুশুক

বুয়েট, ঢাকা ; মে ১৯৯০


(তেতাল্লিশ)

খুব নুয়ে আসে জলে ভরা মেঘ, আরও কাছে এলে
আল্তো ঠোঁট রেখে বলি - মেঘ তুমি, অবোধ কিশোরী
সবুজের কাছে এসে ভাবি- আমিও পেয়েছি নারী
অলীক ঈথারে দেখি- মেঘ ও সবুজে জড়াজড়ি

বুয়েট, ঢাকা ; মে ১৫, ১৯৯০


(চুয়াল্লিশ)

জরায়ু ছিঁড়েই জানি- পৃথিবীতে আমি একা, তবু
পালকের খোঁজে কেটে গেছে আমার সময়, আজ
আমার এ দেহ ঝরে পড়ে তুলসী পাতায়, শুধু
পূজা আয়োজনে নারী একবার আমাকে ধোয়ায়

বুয়েট, ঢাকা ; জুন ১, ১৯৯০


(পয়তাল্লিশ)

ভেসে যাবে মেঘ, তার মেদুর ছায়ার প্রতিশ্রুতি
মেঘের মণ্ডনে তবু আছি । লতা, গুল্মে কিছু স্মৃতি
নীরব প্রশ্রয়ে তাকে রাখি । ইভা, তুমি যদি ভাসো
নগ্ন হয়ে ভাসমান শুধু তোমাকেই আমি দেখি

বুয়েট, ঢাকা ; জুন ১৬, ১৯৯০


(ছিচ্ল্লিশ)

কোলাহল শূণ্য জল । তাতে ধরা পড়িয়াছে ছায়া
তবু ছায়া কেন কাঁপা কাঁপা ? নগ্ন দেহে শুধু মায়া
রাত বুঝি অন্ধ কায়া ? দর্পণে বিম্বিত হয়ে দেখি
জলমগ্ন স্মৃতির মুকুরে সেতুহীন আসা-যাওয়া

বুয়েট, ঢাকা ; জুন ২৭, ১৯৯০


(সাতচ্ল্লিশ)

চাঁদে মুখ ঘষে মেঘ চলে যায় দূর অজানায়
ভূগোলে বাহিত মেঘ কোন টানে ফিরে ফিরে যায়
আমার এ দেহ ভাঙ্গে, ভাসে; ব্যাপ্ত মেঘের ছায়ায়
দেহের সীমানা ছুঁয়ে মেঘ আর কতোদূরে যায়

বুয়েট, ঢাকা ; জুলাই ২৩, ১৯৯০


(আটচ্ল্লিশ)

পথিক ছিলাম । গভীর পরিখা ছিল পথে । শত্রু
ফিরে গেছে কবে । ধ্বংসস্তুপে আজ প্রেতাত্মারা ঘুরে
নির্জন একাকী চাঁদ । তার পাশে এসে অনুক্ষণ
ভাবি, পরিখার কাছে মানুষ কতোটা আর ঋণী

বুয়েট, ঢাকা ; জুলাই ২৭, ১৯৯০


(উনপঞ্চাশ)

ফিরে গেছে নদী । পদমূলে রয়ে গেছে তার চুমু । ঢের
ঝরেছে শেফালি । ফেরারী যৌবন আজো খুঁজে নদী
স্রোতে স্রোতে বয়ে গেছে বেলা । দেখি শুধু তার ক্ষয়
সময় হারিয়ে বুঝি, জলস্রোত সেও আজ বাঁকা

বুয়েট, ঢাকা ; আগষ্ট ২৯, ১৯৯০


(পঞ্চাশ)

বর্ষায় প্লাবিত গ্রাম । দশদিক ঘন অন্ধকার
গরুর গাড়ীতে মরা । তাকে দূরে নিয়ে যায় চাষা
ঘিরে থাকে অন্ধ ভয় শরীরের মগ্ন চারিধার
রাতের গভীরে আজো বেজে যায় গান বেহুলার

বুয়েট, ঢাকা ; সেপ্টেম্বর ২৭, ১৯৯০


(একান্ন)

কেউ এসে ফিরে গেছে । কেউ কেন ফিরে ফিরে আসে
জোয়ার ভাটায় সেই গান আজো বারে বারে বাজে
রঙ ও তুলির টানে গোল-গাল রমনীরা সাজে
রাত শেষে শরীর কী আর শরীরকে ধরে রাখে

বুয়েট, ঢাকা ; অক্টোবর ৩০, ১৯৯০


(বায়ান্ন)

বৃক্ষকে ভেবেছি ছায়া । আজীবন স্মৃতি স্বপ্নে ভুল
চলো সাঁচীস্তুপে ডেকে যান বুদ্ধ- ভীষণ বেভুল
কিশোরী তুমি তো কেটে যাওয়া ঘুড়ি দূর অজানায়
ছায়াপথ জুড়ে অশান্ত স্বপ্নের নদী বয়ে যায়

বুয়েট, ঢাকা ; নভেম্বর ৭, ১৯৯০


(তেপ্পান্ন)

জলের অতলে জল পতনের শব্দ । খুব ঘুম
জরায়ু গভীরে । জাগে পরী-নাচ জলের ভঙ্গীতে
শুশুক শরীর ছুঁয়ে ছুঁয়ে মগ্ন জল উতরোল
রাত জুড়ে দেহ কোষে মন্দ্রিত সঙ্গীত অবিরল

বুয়েট, ঢাকা ; ডিসেম্বর ১৮, ১৯৯০


(চুয়ান্ন)

শূণ্য দশদিক । দিগন্ত ব্যথিয়ে ডাকে ঘন ছায়া
রোদের গভীরে স্বপ্ন হয়ে কালো দেহে খুঁজি মায়া
সীমানা ডিঙ্গিয়ে ডাগর কিশোরী আজ ভরা নদী
অনিকেত জলে লিখি নাম- যাযাবর খেয়া তরী

বুয়েট, ঢাকা ; ডিসেম্বর ২৯, ১৯৯০


(পঞ্চান্ন)

ছিল কোন পরিচিত গাছ, চক-খড়ি দিয়ে আঁকা
কোন নারী ? তুমুল বৃষ্টিতে আজো রয়ে গেলে
ভ্রমন বিলাসী । বৃত্তের পরিধি চক্রমণ শেষে
দেহ জুড়ে বেজে ওঠে নাম গান সংকীর্তন ধ্বনি

বুয়েট, ঢাকা ; জানুয়ারি ১২, ১৯৯১


(ছাপান্ন)

আমার অশান্ত ভগিনীরা কী আমারই ছিল, তবে
শৈশব হারিয়ে কেন আজ ছায়াপথ খুঁজি
উজ্জ্বল রোদের মাঝে ওরা দেহ নিয়ে চলে গেলে
অনাদরে নিজেকেই ক্রমাগত ভেসে যেতে দেখি

হবোকেন, নিউজার্সি; জানুয়ারি ২১, ১৯৯২

(সাতান্ন)
শূন্য হতে চাই যতোক্ষন পর্যন্ত না আছি
অবয়ব খুঁজে দেখেছি সময় অশ্বগামী
ছিল যারা কাছে তারাও উধাও ছায়াপথে
বোধি-বৃক্ষ তলে দোতারাটি ভগ্ন পড়ে আছে

হবোকেন, নিউজার্সি; এপ্রিল ২৬, ১৯৯২


(আটান্ন)

প্রকৃতির মূলে হাত রাখি, নিজেকে গুটাই আর
ভাবি- পাখি কি বৃক্ষের মতো আলো অভিসারী
গোধূলির সীমারেখা ধরে পিতা-পুত্রী চলে গেলে
জলের জরায়ু জুড়ে মানুষের যাওয়া-আসা দেখি

পাথ-ট্রেন, নিউজার্সি; জুন ২০, ১৯৯২


(উনষাট)

প্রবাহের দিকে গিয়ে স্তদ্ধ, অখণ্ড পাথর যেন
শূন্য সময়ের দেহ জুড়ে নগ্ন-প্রায় যীশু আমি
আমার স্বপ্নের অবয়বে কোন এক বৃক্ষ আজ
পাতা ধরে, যদিও এখন সাদা বরফের দিন

মার্লবোরো, নিউজার্সি; মার্চ ১৯, ১৯৯৩


(ষাট)
কোন অভিষেক নেই, দিনগুলো শুধু পুড়ে যায়
প্রজাপতি মৃত, বল্গাহীন সময়ের এই শুরু
রঙধনু বিভ্রম নিয়ে কোন দেহ নেই, আছে দ্রুতি
এই স্বাভাবিক, গাধার কানের মতো ঝুলে আছি

মার্লবোরো, নিউজার্সি; মে ২০, ১৯৯৩


(একষট্টি)
নিরালম্ব পাতা, আঁকো বনভূমি শূন্য এই দেহে
লালা, শুক্ররস ধরে রাখে সময়ের বীজকণা
উঠে গেছি টাওয়ারের শীর্ষে, পারদ প্রবাহ যেন
জলের প্রবাহে সময়ের সিড়িগুলো দেখি লুপ্ত

নিউজার্সি-নিউইয়র্ক ট্রানসিট; মে ২৫, ১৯৯৩


(বাষট্টি)
দূরত্বে উধাও এ পৃথিবী । স্বভাবের পিপীলিকা
মৃত । দ্রুতযানে ছায়ার আতঙ্ক নামে এই দেহে
নির্বাক ছবির মতো মানুষেরা থম্কে আছে, তবু
শিশ্নের আনন্দে আত্মহারা শিশু আজ ফিরছে ঘরে

অপ্টিক্যাল ওয়েভ-গাইড ল্যাব, এন-জে-আই-টি; মে ২৭, ১৯৯৩


(তেষট্টি)

নিবিড় জলের তলে আর কতোকাল
রোদের পিপাসা নিয়ে পাড়ে উঠে দেখি
গভীর আঁধার । নিবিড় বৃষ্টির মাঝে
সৃষ্টির বেদনা, হাতে হাত অনুপম

কলাবাগান, ঢাকা; জুন ১৫, ১৯৮৯


(চৌষট্টি)

প্রতিটি সকাল পৃথিবীর ভরকেন্দ্র ধরে
রাতের আঁধার তাকে করে নিরালম্ব পাতা
নির্বাক ছবির দৃশ্যে এইভাবে বহুদিন
যদিও পাথর ভেঙ্গে আজ জলের প্রবাহ

মার্লবোরো, নিউজার্সি; মে ২৮, ১৯৯৩



(রচনাকালঃ ১৯৮৯-১৯৯৩)

শুক্রবার, ৬ নভেম্বর, ২০০৯

সেতু বাঁধবেন কী করে এবং কী ভাবে ?

রবি চক্রবর্তী


ভারতীয় উপমহাদেশের সংস্কৃতির বা বঙ্গসংস্কৃতির অনন্যতা কেন নিশ্চিতভাবে প্রমাণ হয়ে গেল না, তার কারণ কি কখনো ভেবে দেখেছেন ?
একটা সভ্যতা বা সংস্কৃতির মধ্যে অনেক রকমের কলা, বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস ইত্যাদি থাকে। কিন্তু সেই সভ্যতার মর্মমূলে যদি যেতে হয়, তবে যেতে হয় তার বিশ্ববীক্ষায় ; যেমন কিনা কোনো ব্যক্তির ভিতরের সত্য বুঝতে হলে যেতে হয় সেই মানুষের ভাবনাচিন্তার গভীরে।
প্রাচীন গ্রীসের স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের মধ্যে যে আড়ম্বরহীন ঋজুতা ও সুষমা, তার পিছনে অবশ্যই রয়েছে একটি বিশেষ বিশ্ববীক্ষা বা জীবনবোধ। কিন্তু সেই বিশেষ বিশ্ববীক্ষা বা জীবনবোধ আমরা কোথায় খোঁজ করব ? অবশ্যই প্রাচীন গ্রীসের কাব্য, সাহিত্য ও দর্শনে। সেজন্য তাদের কাব্য ও সাহিত্যের মধ্যে যে রচনাশৈলী ফুটে উঠেছে, সেটিকে ভাল করে অনুধাবন করতে হয়; উপরন্তু বুঝতে হয় কী মানসিকতা স্পষ্টভাবে ব্যক্ত হয়ে আছে তাদের, অর্থাৎ প্রাচীন গ্রীকদের, গদ্যরচনা. ইতিহাস ও দর্শন জাতীয় নানান রচনার মধ্যে। গ্রীকরা নিজেরা কী ভাবত সেটা জানাটাই আমাদের অন্তিম লক্ষ্য এমন অবশ্য নয়, কিন্তু সেটা না জানলে কোনোক্রমেই সম্যক আলোচনা হয় না। অভিজ্ঞ ব্যক্তি মাত্রই জানেন অ্যারিস্টটলের Catharsis তত্ত্ব নিয়ে কত হিমশিম খেতে হয় গ্রীকভাষায় শব্দটির কতটা ব্যাপ্তি ছিল সে সম্বন্ধে নিশ্চিত ধারণা না থাকায়। ট্র্যাজেডি সম্বন্ধে আলোচনায় Hubris,১ Hamartia,২ Sophrosyne,৩ Nemesis৪ এ ধারণাগুলির গুরুত্বও কম নয়। এ জন্যই গ্রীক ট্র্যাজেডি বা গ্রীক দর্শন সম্বন্ধে সুষ্ঠু আলোচনার স্বার্থে প্রাচীন গ্রীক ভাষায় কিছুটা ব্যুৎপত্তির প্রয়োজন। যে কোনো সভ্যতাকে বুঝতে গেলে সেই সভ্যতার আধার ছিল যে-ভাষা, অর্থাৎ যে-ভাষাকে অবলম্বন করে সে-সভ্যতা আত্মপ্রকাশ করেছিল, সেই ভাষায় অধিকার অর্জন করে তবে সেই সভ্যতাকে ঠিক বোঝা যায়। কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশের বেলায় কী জিনিস ঘটল ? পশ্চিমী পণ্ডিতরা, প্রধানত যাদের কাছে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত আমরা আধুনিক ভারতীয়রা পাঠ নিয়েছি, সকল বিদ্যার ক্ষেত্রে তাঁরা কি ভারত-সংস্কৃতির ওপর সুবিচার করেছেন ? না, তাঁরা তা করেননি। অথবা এ-কথা বলাই ভাল যে, তাঁরা তা করতে পারেননি। আমরা ইংরেজি-শিক্ষিত বাঙালিরা তা করিনি। কিন্তু কোন্ কার্যকারণে এমন জিনিস ঘটল ?

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমাদের হাজার বছর পিছিয়ে গিয়ে নিজেদের দিকে দেখা শুরু করতে হয়। একাদশ শতাব্দীতে মহান ইরানী পণ্ডিত আল বিরুনি (৯৭৩-১০৪৮ খ্রীষ্টাব্দ) সংস্কৃতভাষা সম্বন্ধে দু’টি গুরুতর অভিযোগ এনেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, বহুরকমের সমৃদ্ধি সত্ত্বেও এই ভাষার বড় ত্র“টি এই যে, এই ভাষায় একদিকে একটি শব্দ দিয়ে বহু জিনিসকে বোঝানো হয়, আবার অন্যদিকে একই জিনিস বোঝানোর জন্য বিভিন্ন শব্দের ব্যবহার হয়। দ্বিতীয় অভিযোগ সত্যি হলে বুঝতে হবে এ-ভাষায় বহু অপ্রয়োজনীয় শব্দ আছে। কিন্তু প্রথম অভিযোগটি আরও গুরুতর। এটি যথার্থ হলে বুঝতে হবে এই ভাষায় রচিত গ্রন্থের মর্মোদ্ধার সুকঠিন কাজ। উপরন্তু শব্দার্থের ক্ষেত্রে এমন নৈরাজ্যের কারণে এই ভাষায় কোনো বড় সৃষ্টি সম্ভব নয়। অথচ ঋগ্বেদ সহ পুরাণাদি ও রামায়ণ-মহাভারতের মতো বড় সৃষ্টি তো এই ভাষায় বহু আগেই হয়েছে ! কী করে হল ?

না, সে প্রশ্নের উত্তর জানার চেষ্টা করা হল না। আল বিরুনির আনা অভিযোগের কোনো নিষ্পত্তি হল না, সে-কাজ মুলতবি রইল শতাব্দীর পর শতাব্দী। এই পরিস্থিতির মধ্যেই পশ্চিমী দেশের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা হয়ে গেল পৃথিবীর দিকে দিকে, আমাদের দেশেও। সেই সূত্রে পশ্চিমের পণ্ডিতরাও এলেন এ-প্রাঙ্গণে, আর নিজেদের মতো করে বোঝার চেষ্টা করলেন ভারতীয় উপমহাদেশের সাহত্যি-ইতিহাস-সংস্কৃতিকে। আমাদের কিছু কিছু পণ্ডিতদের সহযোগিতা অবশ্য তাঁরা পেলেন, কিন্তু তাতে খুব কিছু লাভ হল না। প্রথমত তাঁদের সহযোগী এ-দেশীয় পণ্ডিতরা ততদিনে নিজেদের ঐতিহ্যকে পুরো না বুঝে তার বোঝাটাই বহন করে চলছিলেন, আল বিরুনির অভিযোগের নিরসন তাঁরা করতে পারেননি। তার ওপর পশ্চিমী পণ্ডিতরা তাঁদের বিদ্যাচর্চার অভ্যস্ত ছকের মধ্যে বিচরণ করতে চাইবেন, এটাই ছিল স্বাভাবিক। প্রসঙ্গভেদে শব্দার্থের ভিন্নতা হওয়ার সম্ভাবনাকে তাঁরা বিচারের মধ্যেই আনলেন না। সব শব্দের মধ্যে বিশেষ বিশেষ ক্রিয়ার দ্যোতনাটা যে সবচেয়ে প্রধান কাজ এ-কথা তাঁরা বুঝলেন না। এর ওপর পশ্চিমী Mythology সম্বন্ধে তাঁদের চর্চা যতদূর এগিয়েছিল তার ভিত্তিতে তাঁরা এদেশের বেদ-পুরাণাদির ব্যাখ্যা দিতে লাগলেন। বেদ-পুরাণাদির কাহিনীগুলি সামাজিক ইতিহাসেরও বয়ান হতে পারে সে সম্ভাবনা তাঁদের মনেই এল না। অথচ নানাবিধ পুরাণকাহিনীর বহু পাত্রপাত্রীর নামের মধ্যেই নির্দেশ আছে কাহিনীগুলি কি-জাতীয় সামাজিক সত্যের উপস্থাপনা করছে। পুরাণাদির কাহিনীর পাত্রপাত্রীদের সুস্পষ্ট ব্যঞ্জনাবাহী নামগুলির সঙ্গে তাদের আচরণগুলির যে যথেষ্ট সঙ্গতি আছে এ-সত্যাটি তাঁরা ধরতেই পারলেন না। একবার দেখুন না - ধৃতরাষ্ট্র, বিভীষণ, যুধিষ্ঠির, রতি, মদন, শিব - এই নামগুলির সঙ্গে তাদের আচরণগুলির কতখানি মিল পাওয়া যায। আবার দেখুন, দুর্যোধন, দুঃশাসন - এগুলো কি কখনো পিতৃদত্ত নাম হয় ? উপরন্তু, পুরাণাদিতে এমন কথা বলা আছে যে, দক্ষ, ব্যাসদেব প্রভৃতি চরিত্র বারে বারে জন্মাবে, এবং দেখানো হচ্ছে যে বশিষ্ঠমুনি পিতা-পুত্র-পৌত্রাদি ক্রমে পৌরহিত্য করেই যাচ্ছেন। অথচ পুরাণের বিভিন্ন চরিত্রকে ‘ঐতিহাসিক ব্যক্তি’ মনে করে তাদের কাল নিরূপণের চেষ্টায় কত না পণ্ডশ্রম করেছেন আমাদের দেশের জিজ্ঞাসু গবেষকরা। যদিও সবচেয়ে সহজে যা করা যেতে পারত, তা হল সেগুলিকে ‘ব্যক্তি’ না-ভেবে ‘সামাজিক সত্তা’ ভেবে নেওয়া; আর সেটা করার মতো জ্ঞান তখনকার ইউরোপীয় পণ্ডিতদের ছিল। কেননা ইউরোপের মধ্যযুগের Morality নাটকে Knowledge, Mercy, Pleasure, Beauty, Kinship - এই রকম নানান নামের চরিত্র থাকত। অথচ সেরকম সত্তাদের সঙ্গে সাদৃশ্য খুঁজে এদেশের অতীতের সত্যান্বেষণ শুরু হল না। শাসকের গর্বে তাঁরা সেভাবে ভাবতেই পারলেন না। তাঁরা বুঝিবা ভাবলেন, শাসিতের সংস্কৃতিতে অত উচ্চমার্গের ভাবনা থাকবে কি করে। সম্ভবত এই ছিল তাঁদের বিশ্বাস।

মোটকথা, এদেশে পশ্চিমী লেখাপড়ার সূত্রপাত হয়ে যাওয়ার পর, বেদ-পুরাণ-রামায়ণ-মহাভারতাদির ভেতর যে ভাবসম্পদ নিহিত আছে তা ধরতে পারার যে অক্ষমতা আগে থেকেই ছিল তা ক্রমে বেড়েই চলল। কিন্তু তার থেকেও বড় ক্ষতি হল এই যে, আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত বাঙালি বাংলাভাষার সৃজনশীল ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। প্রাচীন ভারতীয় ভাষা থেকে পাওয়া উত্তরাধিকারের জোরে বাংলাভাষায় ক্ষমতা ছিল অসীম  অনেক আপাত বিভিন্ন বস্তু বা সত্তাকে একই নামে চিহ্নিত করা যেত, সমস্ত সত্তাকে দেখা হত বিশেষ বিশেষ ক্রিয়ার আধার হিসেবে এবং সে-জন্যই বাইরের দিকের পার্থক্য সত্ত্বেও একই নামে বহু আপাত পৃথক সত্তার উল্লেখ করা যেত। বলা বাহুল্য, সংস্কৃত ভাষার এ-রীতি হিন্দু ধর্মের সূত্রপাতের আগেই মৃতপ্রায় হয়ে পড়েছিল। হিন্দু ধর্মের সূত্রপাত (৭৫০ খ্রীষ্টাব্দে) তার মৃত্যুঘণ্টা বাজিয়ে দেয়। কিন্তু তাই বলে সেই রীতি কিন্তু হারিয়ে যায় না। মধ্যযুগে (১৩০০ খ্রীষ্টাব্দে) পাঠান রাজত্বের ছত্রছায়ায় তা নবজীবন লাভ করে বাংলাভাষায় আর সেই রীতি অনুসরণ করেই সেকালের বাংলাভাষা জন্ম দিয়েছিল বিশাল মঙ্গলকাব্যের, বৈষ্ণবসাহিত্যের, আউল-বাউল সাহিত্যের এবং সর্বোপরি বাংলা রামায়ণ-মহাভারতের। যদিও ১৮০০ খ্রীষ্টাব্দে পৌঁছে বাংলাভাষায় এ রীতির অনেকটাই হয়ে পড়েছিল অভ্যাসগত এবং বাংলাভাষীর তরফে তাত্ত্বিক সচেতনতা ততদিনে খুবই দুর্বল হয়ে পড়েছিল।

তবুও চেষ্টা থাকলে সেই অবস্থা থেকেও মানবজাতির এই মহত্তম অর্জনকে তখনই উদ্ধার করা যেত, যদি ইউরোপের শাসকসুলভ-দৃষ্টিভঙ্গী সংশ্লিষ্ট পণ্ডিতদের দৃষ্টিকে কলুষিত করে না দিত। কারণ বাংলাভাষায় তখনও পর্যন্ত সবকিছু কমবেশি জীবন্তই ছিল। ছিল বাঙালির নিত্যনৈমিত্তিক ভাষা ব্যবহারে, বাঙালির দৃষ্টিভঙ্গীতে। এখনও তো প্রায় সেই অবস্থা থেকেই আমরা (কলিমখান ও আমি) আমাদের সেই মহত্তম অর্জন সাধ্যমতো পুনরুদ্ধার করছি।৫ পার্থক্য শুধু এই যে, তখনকার পণ্ডিত বিশ্বাস করে ফেলেছিলেন ইউরোপের চেয়ে কোনো বিষয়েই বেশি কেউ জানে না, জানতে পারে না, আমাদের কারও উপরই সেরকম কোনো অন্ধ বিশ্বাস নেই। চেষ্টা করলে বাঙালির সেই অর্জনকে যে-কেউ চিহ্নিত করতে পারেন।
আলোচনার পরবর্তী পর্যায়ে যাওয়ার আগে কিছু অন্য কথায় বোধ করি যাওয়া দরকার। বাংলার সম্পদ দেখাতে গিয়ে মাঝেমধ্যে সংস্কৃতের উল্লেখ করেছি। আজকের পরিস্থিতির কারণে হয়তো অনেকের এটা অসঙ্গত ঠেকছে। বিশেষ করে, পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশ  বাংলা ভাষার দুই ভুবনেই এখন সরকারি পণ্ডিতদের একান্ত চেষ্টা সংস্কৃত থেকে বাংলাকে আরও দূরে সরিয়ে নেওয়ার। দু’জায়গাতেই এই চেষ্টার মূলে আছে হিন্দুত্বের ভূত দেখা এবং হিন্দুত্বের সঙ্গে সংস্কৃতকে মিলিয়ে দেখার অভ্যেস। তফাৎটা এইখানে  বাংলাদেশে আছে আরবি-ফারসি দিয়ে শূন্যতা পূরণের কল্পনা, আর পশ্চিম বাংলার অবস্থা আরও বিপজ্জনক  তাঁরাও বাংলাভাষার মূলে সংস্কৃতকে সক্রিয় থাকতে দিতে চান না, কিন্তু যাবেন কোথায় তাও জানেন না, ফলত তাঁদের এক দিশেহারা অবস্থা। তবে এই সংস্কৃত-উচ্ছেদ-আগ্রহীদের মনে করিয়ে দিতে চাই  মাইকেল-এর ‘হে বঙ্গ ভাণ্ডারে তব’ কবিতাটির কথা। মাইকেল বলছেন, তিনি মণিজালে পূর্ণ মাতৃভাষা পেয়ে গেছেন এবং তিনি তাতে সুখী। ভেবে দেখবেন, এটি গ্রামবাংলার বাংলা ভাষা বা কাব্য নয়, এবং কোনো মতে তা হতে পারে না। মাইকেলের কাছে বাংলা আর সংস্কৃতের ঐশ্বর্য যেন যৌথ সম্পদ। এবং এর মূলে রয়েছে ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থবিধি, যা কিনা সংস্কৃত ও বাংলা ভাষার প্রায় প্রতিটি শব্দের মূলে আজও সক্রিয়। তাই, এর পর থেকে নিবন্ধে বাংলা-সংস্কৃত ঐশ্বর্য বোঝাতে ‘আমাদের ক্রিয়াভিত্তিক (বাংলা বা সংস্কৃত) ভাষা’ শব্দটি ব্যবহার করব, এই দুই ভাষার মিলিত রাজ্যকে বোঝাবার জন্য।


আমাদের বাংলাভাষার সম্পদস্বরূপ তার মহত্তম অর্জন রয়েছে তার শব্দ তৈরির নিয়মে। সে-নিয়মের কথা এখন থাক, কেবল উদাহরণ দিয়ে দেখাব সেই সূত্রে আমরা কি পেয়েছি। পদ শব্দটি দিয়েই foot, position, বাক্যের ভিতরের শব্দ, কবিতার পঙ্ক্তি, কবিতা, এমনকি রন্ধনের ফরংয পর্যন্ত বোঝানের মধ্যে কোনো অসঙ্গতি কোনোদিন বাংলা ভাষীর চোখে পড়ত না এবং বলা যায় এখনও এদেশের বাঙালি সমাজের মধ্যে চলাফেরা করেন এমন বাঙালির চোখে পড়ে না (একটু বিশ্লেষণ করলেই দেখিয়ে দেওয়া যায়, এখানে শব্দ সৃজনের ক্ষেত্রে কোনো মূলগত ত্রুটি নেই)। অথবা সিদ্ধডিম আর সিদ্ধপুরুষ নিয়েও কোনো অস্বস্তি বোধ করেন না বাংলাভাষীরা, যদিও এমন হওয়ার কারণ জানেন না আধুনিক বাঙালিরা প্রায় কেউই।
কিন্তু মনের দিক থেকে আগের শব্দার্থতত্ত্ব থেকে চ্যুত হয়ে যাওয়ার ফলে ইংরেজি- লেখাপড়া-শেখা বাঙালি প্রতিটি বাংলা শব্দের সমর্থন খুঁজতে লাগলেন ইংরেজিতে। ধর্ম শব্দটি হয়ে গেল Religion-এর প্রতিশব্দ, অর্থ শব্দটি হল Money বা Meaning-এর, পদ শব্দটির প্রতিশব্দ হল foot বা position-এর| Religion, Money / Meaning, Foot / Position ইত্যাদি ছাপিয়ে আরও অনেক কিছু বোঝানো যে-ক্ষমতা ছিল যথাক্রমে ধর্ম, অর্থ. পদ ইত্যাদি শব্দের, সে-ক্ষমতা কার্যক্ষেত্রে এই শব্দগুলি হারিয়ে ফেলল। অগণিত শব্দের ক্ষেত্রে এমন ঘটায় সমগ্রভাবে বাংলা শব্দভাণ্ডারের ব্যাপকভাবে অর্থহানি ঘটে গেল, এবং বহুক্ষেত্রে সূক্ষ্ম ও মারাত্মকভাবে। ভাব শব্দটিকে যখন idea বা urge-এর সমার্থক করা হয়, প্রকৃতিকে nature-এর, আকাশকে sky-এর, বস্তুকে matter-এর, যুক্তিকে reason বা argument-এর (এরকম অগুনতি উদাহরণ দেওয়া যায়), তখন সমগ্রভাবে আমাদের চিন্তাকাঠামোই পঙ্গু হয়ে যায়।৭

এইরকম করে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত বাঙালি বেশি করে আশ্রয় খুঁজল ইংরেজি ভাষায়, কোথাও দাঁড়ানোর একটি নিশ্চিত জায়গা পাবার আশায়। তার নিজস্ব যে অর্জন ছিল, শ্রেণীগতভাবে মধ্যযুগের ব্রাহ্মণ তাকে অনাদর করলেও পাঠানরাজা তাকে যথেষ্ট সম্মান দিয়েছিলেন। কিন্তু ১৭৫৭ খ্রীষ্টাব্দে ইংরেজ এসে তার আকাশটাকেই অস্বীকার করে বসল। কিন্তু মাথার উপরে আকাশটা তো চাই। ভাষা-সংস্কৃতি-দর্শনই তো মানুষের মাথার উপরের প্রকৃত ছাদ, তার আকাশ।৮ দেশের শাসক যদি সেই আকাশকে দেখতে না-পেয়ে অস্বীকার করে, শাসিতের মাথায় তার ‘আকাশ ভেঙে পড়ে।’ সে দিশাহারা হয়ে যায়। এই অবস্থাতেই প্রায় একশো বছর কাটিয়ে দিশাহারা বাঙালি একদিন বিদ্যাসাগর রামমোহনের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিল নিজস্ব সংস্কৃতির আকাশটি যদি আমাদের সুরক্ষা দিতে না পারে তবে বরং ইউরোপের ‘আধুনিকতা’র আকাশটিই দিক। শিক্ষিত বাঙালিদের মাথা থেকে বাঙ্গালির নিজস্ব পরম্পরাগত আকাশটি সরে গিয়ে তার স্থানে দেখা দিল ইউরোপীয় আকাশের ছায়া। এর পর থেকে বাঙালির নিজস্ব আকাশের স্থান হল গ্রামবাংলায়, তথাকথিত অশিক্ষিতদের মধ্যে, ক্ষয়িষ্ণু হয়েও সেখানেই টিকে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা চালাতে লাগল সে। কার্যত আমাদের ভাষা-সংস্কৃতি থেকে ইউরোপের ভাষা-সংস্কৃতির বড় পার্থক্য এই যে, আমাদের শব্দসমূহে ইঙ্গিত থেকে যত ক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে, হচ্ছে বা হবে, তাদের দিকে পশ্চিমী ভাষায় শব্দের উদ্দেশ্য হল ক্রিয়ার কর্তা কর্ম প্রভৃতিকে সুস্থিত এবং বাহ্য রূপে সুনির্দিষ্ট সত্তার অধিকারী হিসেবে দেখানো।

এর ফল হল মারাত্মক। শিক্ষিত বাঙালির মাথার উপর সক্রিয় হল ইউরোপের আকাশ, সেই শিক্ষিত বাঙালি হল তার জাতির পথপ্রদর্শক পরিচালক, যে-জাতির মাথার উপরের আকাশটিই ভিন্ন স্বভাবের। তার ভাষায়, অভ্যাসে, রক্তে পরম্পরাগত আকাশের তলায় বাস করবার আচরণ পুরো মাত্রায় সক্রিয়। শুরু হল ইউরোপের আকাশ কর্তৃক বাংলাভাষীর মনোলোকের আকাশ দখলের লড়াই।

বাংলা শব্দসমূহের যে ব্যাপ্তি ও দ্যোতনক্ষমতা ছিল, যদিও তার অনেকটাই অব্যবহৃত হয়ে পড়ে থাকতে, আধুনিকতার সূত্রপাতের পর এবার তা বলতে গেলে এক কোপেই হারিয়ে গেল। বাংলা হয়ে গেল যেন একটি রক্তাল্পতাগ্রস্ত ভাষা। ধাতুর আগে উপসর্গ ও পরে প্রত্যয় জুড়ে যে-বিশাল শব্দরাজ্য বাংলায় সৃষ্টি করা যায়, সেখানে সৃজনশীল ভাবে বিচরণ করার অধিকার হারিয়ে ফেলল আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত বাঙালি। এমনকি তার মনে হতে লাগল আমার ভাষা দরিদ্র, ইংরেজির তুলনায় শব্দসম্ভারে অনেক হীন। সত্যি কথাটা এই, এইরকমের হীনমন্যতা নিয়েই পশ্চিমের সংস্কৃতিজগতে প্রবেশ ঘটেছে আমাদের এযুগের বাংলাভাষীদের।


কিন্তু সত্যিই কি আপনার-আমার ভাষা দরিদ্র বা হীন ?
...................................
এই প্রশ্নের আলোচনার সূচনায় ভাষাসম্পদ বললে আসলে কী বোঝাতে পারে তার দিকে একটু নজর দেওয়া প্রয়োজন। কোনো বিশেষ ভাষার অভিধানে কত শব্দ দেখানো আছে তা দিয়ে নিশ্চয় এ প্রশ্নের মীমাংসা হয় না। ভাষায় যে সম্পদ আছে, তা দিয়ে ঐ ভাষাভাষীদের কতটা সুবিধা হচ্ছে ভাবপ্রকাশ ও ভাববিনিময়ের ক্ষেত্রে, সেটিই আসল বিচার্য। এ প্রসঙ্গে আর একটি জিনিসও মনে রাখতে হয়। যে-শব্দগুলি চোখে-দেখা, কানে-শোনা ইত্যাদি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জিনিসকে সূচিত করে, তাদের নামের বেলায় আমাদের দাবি একটাই  শব্দগুলি যেন আমাদের পক্ষে সহজে ব্যবহারযোগ্য হয়। কিন্তু যে শব্দগুলি নানান বিমূর্ত ভাবকে ব্যক্ত করে, তাদের একটি বিশেষ গুরুত্ব আছে। তারা আমাদের ভাবনাচিন্তার সহায়ক এবং উদ্দীপক হতে পারে, আবার তারা আমাদের প্রকৃত ভাবনাচিন্তার অন্তরায়ও হতে পারে। বুঝবার সুবিধার জন্য একটি পশ্চিমী উদাহরণই টানা যাক। বাংলা আমাদের জননী হলেও, ইংরেজিই যে এখন আমাদের পালিকা-মা ! ইউরোপের আকাশের তলাতেই যে আমরা আধুনিক বাঙালিরা বড়ো হয়ে উঠেছি। সুতরাং একবার ইংরেজি, ফরাসি ও জার্মান ভাষার পরিভাষার দিকে নজর দেওয়া যাক।
মাটি, জল, হাওয়া প্রভৃতি জড়জগতের জিনিস, সুদূর অতীত থেকে চলে-আসা পারিবারিক সম্পর্ক, এমনকি সপ্তাহের সাতদিন ইত্যাদির বেলায় যেসব নাম ইংরেজিতে পাই, সেগুলি ইংরেজির জ্ঞাতি-ভাষাসমূহে (অর্থাৎ ডাচ, জার্মান, ডেনিশ প্রমুখ জার্মানিক ভাষায়) ব্যবহৃত শব্দসমূহের অনুরূপ। কিন্তু উচ্চাঙ্গের মানসিক চর্চার ক্ষেত্রে, নানান ঐতিহাসিক কারণে ইংরেজি শব্দভাণ্ডারের চরিত্র অন্যরকম। সেই এলাকায় ইংরেজির শব্দভাণ্ডার ল্যাটিন, ল্যাটিন-উদ্ভূতা ফরাসি, অথবা (সরাসরি কিংবা ঘুরপথে) গ্রীক থেকে ধার-করা। এই রকমের শব্দভাণ্ডার ইংরেজি বা এমনকি ফরাসির পক্ষেও শুভ হয়েছিল, তা বলা চলে না। কিছু উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে এ প্রসঙ্গে। ইংরেজ বা ফরাসি কোনো ইধৎসধরফ (পানশালার পরিচারিকা)-কে যদি জিজ্ঞেস করা যায় ঈড়হংঃবষষধঃরড়হ অথবা ঈড়হংপরবহপব বললে কি জাতের জিনিস বেঝাতে পারে, তবে কোনো সন্তোষজনক উত্তর পাওয়া যাবে না। অথচ ঠিক এক পর্যায়ের কোনো জার্মান নারীকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় এবংঃরৎহ (= ঈড়হংঃবষষধঃরড়হ) অথবা এবরিংংবহ (= ঈড়হংপরবহপব) শব্দের কি রকমের মানে হতে পারে, তবে সঠিকের ধারে-কাছে আসে এমন উত্তর পাওয়ারই সম্ভাবনা। কেননা ঝঃবৎহ (নক্ষত্র), ডরংংবহ (= শহড়)ি হল জার্মান ভাষায় নিত্য-ব্যবহৃত শব্দ, এবং সমষ্টিগত ব্যাপ্তি বোঝাতে এব নিত্য-ব্যবহৃত উপসর্গ। এমন অবস্থা রাতারাতি হয়নি। রেনেসাঁস এবং পরবর্তীকালে ইংরেজ যেখান তত্ত্বালোচনার ক্ষেত্রে ল্যাটিন (এবং গ্রীক) থেকে অনর্গল শব্দ আমদানি করতে লাগল, জার্মানরা প্রথমে তা করলেও অল্প পরেই স্বাবলম্বনের রাস্তা ধরল। অর্থাৎ নিজের ভাষার উপাদান নিয়ে পরিভাষা তৈরি করে নিতে লাগল। ফলে দর্শন ও বিজ্ঞানের পরিভাষা জার্মানের কাছে অনেক স্বচ্ছ, যে সম্পদটি ইংরেজের ঘটল না। ফরাসির ভাগ্যও এদিক থেকে বিশেষ ভাল না; ল্যাটিন-জাত ভাষা হলেও ফরাসিভাষার মধ্যে ল্যাটিনের যথেষ্ট সৃজনশীল উপস্থিতি নেই। অষ্টাদশ, ঊনবিংশ, এমনকি বিংশ শতাব্দীতেও উচ্চাঙ্গের তত্ত্বের সৃষ্টি ও বিকাশের ক্ষেত্রে ইংরেজ বা ফরাসির তুলনায় জার্মানরা যে অনেক বেশি কৃতী, তার মূলে আছে তাদের পরিভাষার স্বচ্ছতা ও সহজ ব্যবহারযোগ্যতা। স্মরণ করা যায় যে, কাণ্ট হেগেল মার্কস আইনস্টাইন ফ্রয়েড  সকলেই তাঁদের অসামান্য মৌলিকতার বনিয়াদ সৃষ্টি করেছিলেন জার্মান ভাষায়। পাণ্ডিত্য, স্বচ্ছ দৃষ্টি, প্রজ্ঞা ও সৃজনশীলতার একত্র সম্মিলনে সমগ্র ইংরেজি সাহিত্যে যাঁর জুড়ি নেই সেই কোলরিজ বলেছিলেন তাঁর জানা মোট দু’টি ভাষায় গভীর আলোচনা করা যায়  একটি গ্রীক, আর একটি জার্মান।
যাই হোক, ইংরেজির তুলনায় বাংলাভাষা হীন কি না, এটিই আমাদের আলোচ্য। সেই প্রসঙ্গে ফিরে আসছি।
ব্যাকরণ, সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শন  প্রথমেই কয়েকটি অতি প্রচলিত শব্দ নিচ্ছি। অল্প চেষ্টাতেই বোঝা যায়, ইংরেজি প্রতিশব্দ  যেগুলি আবার গ্রীক বা ল্যাটিন থেকে আসা সাধারণ ইউরোপীয় উত্তরাধিকার  তাদের তুলনায় বাংলা শব্দগুলি কত বেশি যথাযথ এবং ব্যাপক। এৎধসসধৎ বললে বোঝায় খোদাই করে বা আঁচড় টেনে লেখালিখি সংক্রান্ত বিদ্যা; সেখানে ব্যাকরণ শব্দটিতে বোঝায় ভাষাকে বিশেষ আকারে এনে তার বিশ্লেষণ। খরঃবৎধঃঁৎব বললে বোঝাতে পারে ষবঃঃবৎং বা বর্ণ সংক্রান্ত কিছু, বা বর্ণাকারে লিখিত কিছু ভাষা; আর সাহিত্য শব্দ থেকে বোঝা যায় এটি মানুষকে মানুষের নিকটে আনে। তেমনি ঐরংঃড়ৎু (= যরংঃড়ৎ বা জ্ঞানী লোকের জ্ঞান) অথবা ঢ়যরষড়ংড়ঢ়যু (= ঝড়ঢ়যরধ বা প্রজ্ঞার প্রতি আকর্ষণ) শব্দের পাশে কত বেশি যথাযথ ও সমৃদ্ধ (ইতি হ আস = এইরূপ ছিল) বা দর্শন শব্দটি। আর, আমাদের ‘অধ্যাত্মবিদ্যা’কে বোঝানোর মতো কোনো শব্দই নেই ইংরেজিতে। তাছাড়া, পশ্চিমের শব্দগুলির তাৎপর্য খুঁজতে হয় অভিধানে, বা বেশির ভাগ মানুষ ঐ শব্দ দিয়ে কি বুঝছে তা বুঝে অনুমানে। আর বাংলা বা সংস্কৃত শব্দের তাৎপর্য তার উপাদান থেকেই পরিস্ফুট।
এরকম অনেক পারিভাষিক শব্দ দেওয়া যায়, যেখানে আমাদের ভারতীয় শব্দ পশ্চিমী শব্দের তুলনায় অনেক বেশি সমৃদ্ধ। ঝঃধঃঁং-এর জ্ঞাতি ঝঃধঃব শব্দটিতে বোঝায় যা দাঁড়িয়ে আছে, আর রাষ্ট্র বললে বোঝায় যার সাহায্যে ‘রাজ’ (= রাজ্যশাসন) করা যায় (রাজ্ + ত্র) যেমন মননের জন্য মন্ত্র, শাসনের জন্য শাস্ত্র, পান বা পালনের জন্য পাত্র, সেইরকম। ঞৎড়ঃয শব্দের জাতি ঃৎঁঃয-এর আদি মানে চুক্তিতে বিশ্বস্ততা অথবা কথা রাখা, আর সত্য বললে বোঝায় সৎ (অর্থাৎ যা আছে, যা বিদ্যমান)-এর গুণ বা তার প্রতি আকর্ষণ বা নিষ্ঠা।
পশ্চিমের ভাষাগুলির শব্দভাণ্ডারের বড় অংশই নানা ঘটনা-সমাবেশের ফলে ভাষার মধ্যে জায়গা পেয়েছে। রাজকোষকে ঊীপযবয়ঁবৎ, পার্লামেণ্টের সভাপতিকে ঝঢ়বধশবৎ, ফটোকপিকে ঢবৎড়ী, সামাজিক বর্জনকে ইড়ুপড়ঃঃ ; এমনকি মহান নাটসৃষ্টিকে ঞৎধমবফু (= ছাগগীতি)  সর্বত্র এই তাৎক্ষণিকতার মনোভাব ফুটে ওঠে। আর আমাদের দেশের পরিভাষার সর্বত্রই প্রতিটি সত্তাকে তার ক্রিয়ার পরিচয়ে চিহ্নিত করার চেষ্টা। এ প্রসঙ্গে বিশেষ সত্যকথা এই যে, ক্রিয়াভিত্তিকতা যদি ভাষার সাধারণ চরিত্র না হত, তবে শুধু পরিভাষার শব্দে এই বৈশিষ্ট্য দেখা যেত না। ভাষার সাধারণ শব্দই তো বারেবারে প্রয়োগের মধ্য দিয়ে পারিভাষিক শব্দ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে যায়।
ক্রিয়াভিক্তিকতাই আমাদের দেশের প্রাচীন ভাষার শব্দার্থতত্ত্বের মূল নীতি। কলিম খান-এর ভাষাতাত্ত্বিক উদ্যোগের গৌরব ঠিক এইখানে, এই শব্দার্থতত্ত্বের পুনঃপ্রতিষ্ঠায়। তিনি দেখালেন, প্রতিটি প্রাতিপদিক (বা বিশেষ্য শব্দ) কোনো ধাতু (বা ক্রিয়ার নাম) অবলম্বন করে সৃষ্টি হয়েছে  যাস্কমুনির এই প্রাচীন তত্ত্বটি একটি ব্যাকরণের কেতাবি তত্ত্ব মাত্র নয়। এ তত্ত্বটিকে যথোচিত গুরুত্ব দিয়ে ভাষাবিচারে এগোলে পর, আমাদের দেশের প্রাচীন সাহিত্য ও ঐতিহ্যের নানা রহস্য একটার পর একটা উন্মোচিত হতে থাকে। আর সেই সঙ্গেই বোঝা যায় আমাদের ভাষার কী বিপুল শক্তি, আর কী সম্পদ ধরা আছে নিছক ভাষাটির মধ্যে।
মোটকথা, আমাদের শব্দসম্ভার যে ইংরেজি বা পশ্চিমী শব্দসম্ভাবের তুলনায় অনেক বেশি যথাযথ এবং ব্যাপক, সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। এর কারণ আমাদের বাক্য নির্মাণের কৃৎকৌশল  বিস্তার, স্বল্প উপকরণে অধিক কার্যসিদ্ধির ক্ষমতা, উদ্ভাবনী সৃজনশীলতা, স্বচ্ছতা এবং অন্তর্নিহিত প্রজ্ঞাদৃষ্টি। এইসব ক’টি গুণের মূলে আছে আমাদের ভাষায় শব্দগঠন ও শব্দ-ব্যবহারে ক্রিয়াভিত্তিকতার নীতি। এই নীতি পালনের মধ্যে কোনো জটিলতা নেই। ধাতুর সংখ্যা ইংরেজি াবৎন-এর সংখ্যার তুলনায় অনেক অনেক কম। কিন্তু প্রয়োজন মতো ধাতুর শেষে আসে প্রত্যয় আর বিভক্তি এবং আগে বসে যায় উপসর্গ। সেই প্রত্যয়-বিভক্তি-উপসর্গের সংখ্যাই বা কত ? সব মিলিয়ে দাঁড়ার প্রায় ৩২০টি মূল ধাতু, তার ৭ বিভক্তি, ৩ বচন, প্রায় ২০০ প্রত্যয় ও ২০টি উপসর্গ। লিঙ্গ সন্ধি সমাসের কথা বাদ দিয়ে দিলেও কত শব্দের প্রজনন-ক্ষমতা ধরে আমাদের এই ভাষা ? ৩২০ গুণ ৭ গুণ ৩ গুণ ৩০০ গুণ ২০ = ২৬৮৮০০০০। এত বেশি অবশ্য হয় না, কারণ প্রত্যয়-উপসর্গ সর্বত্র ব্যবহৃত হয় না। সংখ্যাটিই তাই খানিকটা কমে যায়। তা সত্ত্বেও তা ইংরেজির তুলনায় বহু গুণ বেশি। অর্থাৎ আমাদের ভাষায় দৃশ্যত এই স্বল্প উপকরণের সাহায্যে, নানারকম সংযোজনের জোরে, অর্থের এক বিশাল এলাকায় আমাদের দখল কায়েম হয়ে যেত। ভাষার এই নীতি চালু রাখার জন্য প্রয়োজন হত পরিলক্ষিত জগতের যাবতীয় ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার চরিত্র বিচার  যার ফলে বহু অসদৃশ প্রাণী বা বস্তুর মধ্যে ক্রিয়াগত সমধর্মিতা সহজেই চোখে এসে যেত। ফলে বিশাল এলাকার যাবতীয় ক্রিয়ার যথাযথ বর্ণনা দেওয়া যেত। ভাষার উদ্ভাবনী সৃজনশীলতা অব্যাহত থাকত। এবং অবশ্যই শব্দসম্ভারের স্বচ্ছতা মানুষকে দিতে পারত ভাব ও চিন্তার জগতে বিরাট মুক্তি।
এই বক্তব্যের সমর্থনে কৃ (= র্ক = করা) ধাতু থেকে তৈরি বাংলায় নিত্যব্যবহার্য কিছু শব্দ তুলে ধরছি ঃ আবিষ্কার, পুরস্কার, তিরস্কার, বহিষ্কার, পরিষ্কার, সংস্কার, আকার, প্রকার, বিকার, উপকার, অপকার. অধিকার, সৎকার, চমৎকার, ধিক্কার, ন্যক্কার, অহঙ্কার, অলঙ্কার, স্বীকার, অঙ্গীকার, চিৎকার ফুৎকার ইত্যাদি। আকৃতি, বিকৃতি, প্রকৃতি কিংবা কর্তব্য, করণীয়, কৃতার্থ ... এসব এখন থাক। তালিকাটি আরও অনেক বড় করা যায় স্বচ্ছন্দেই। তবে লক্ষণীয় এই যে শব্দগুলি এদের ইংরেজি প্রতিশব্দসমূহের তুলনায় কত বেশি সুসংবদ্ধ, স্বচ্ছ, সহজবোধ্য, এবং সহজে ব্যবহারযোগ্য; অথচ শব্দগুলি একই ক্রিয়াজাত বলে তাদের পৃথক শব্দ হিসেবে ধরা হয় না, যদিও একেবারে পৃথক ভাব বা বস্তুকে তারা শনাক্ত করে। বিপরীতে ইংরেজি প্রতিশব্দগুলি পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কহীন, এবং সেকারণেই গুনতিতে সংখ্যায় বেশি। বলে রাখা যাক, -কার-এর যে শব্দখণ্ডটি জোড়া আছে, তারা ভাষার নানান ক্ষেত্রে এত ব্যবহৃত হয় যে, বাংলাভাষী সহজেই শব্দটির অর্থ অনুমান করে নিতে পারেন। পরিশেষে আপনাদের মনে করাই যে, শেষকালের -কার-এর বদলে -কর, -র্ক, -কারণ, -কারক, -কৃত, -কৃতি ইত্যাদি যোগ করে আরও কত কত নিত্যপ্রয়োজনীয় শব্দ বাংলায় ব্যবহার হয়, তার হিসাব করে নিন। এর পরেও বাংলা শব্দের সংখ্যা কম কেন ? দশগুচ্ছ আঙুরকে দশটি ফল বলে ধরলে এবং তার সঙ্গে একশোটি কুলকে তুলনা করলে আঙুরের সংখ্যা কম তো হবেই। তাই ইংরেজির তুলনায় বাংলা শব্দের সংখ্যা কম।
এখন স্বল্প কয়েকটি ধাতু দিয়ে দেখাতে চেষ্টা করব কত কম উপকরণের সাহায্যে কত বেশি ভাব আমাদের ভাষায় প্রকাশ করা হয়। ধরা যাক, কোনো একটি সম্মেলনের ব্যবস্থা হচ্ছে। প্রস্তুতিপর্বে এমন বাক্য যে কেউ লিখতে পারেন ঃ
প্রায় এক যুগ পরে যে সম্মেলনের উদ্যোগ (= উৎ + যোগ) নেওয়া হয়েছে, সেখানে কত লোক যোগ দিচ্ছেন, কত আয়োজন করতে হবে, এবং যোগ্যতা অনুযায়ী কত লোককে কাজে নিযুক্ত করার প্রয়োজন হবে, সে বিষয়ে এখন যুক্তি পরামর্শ হচ্ছে, এবং নানারকম যোগাযোগ চলছে।
লক্ষ্য করুন, মাঝারি দৈর্ঘ্যরে এই বাক্যে যুজ্ ধাতু থেকে তৈরি শব্দ কতবার ব্যবহৃত হয়েছে; বাক্যটির ইংরেজি অনুবাদ করে দেখুন, দেখবেন পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কহীন ক’টি ইংরেজি হড়ঁহ বা াবৎন ৎড়ড়ঃ-এর সাহায্য নিতে হয়, সেটিও একবার মিলিয়ে দেখুন। যে কোনো রকমের যোগ ঘটলে, জুড়ে (= যুড়ে) দেওয়া, যুতে দেওয়া, বা যুক্ত হওয়ার অথবা যুক্ত করার ব্যাপার হলেই  তা সে জড়বস্তু-প্রাণী বা কোনোরকমের ভাব, যাই হোক না কেন  যুজ্ ধাতুটির ব্যবহার সম্ভব। অর্থাৎ যদি বিভিন্ন কাজের মধ্যে কোনো মূলগত ঐক্য থাকে, তবে একটি ধাতু দিয়েই অনেক বিভিন্ন কাজকে বোঝানো যাবে। সেই ঐক্যটি বুঝে নিয়ে ধাতু এবং ক্রিয়াপদের সৃষ্টি এবং ব্যবহারেই বাংলা (বা সংস্কৃত) ভাষার কৃতিত্ব। ধরা যাক মন ধাতুটি (= মনে করা)। এই ধাতু থেকে নিষ্পন্ন শব্দগুলি কত ভিন্ন কাজকে সূচিত করে, কিন্তু একটি মূলগত ঐক্যের জোরে উপসর্গটির সাহায্যে স্পষ্ট অর্থের সৃষ্টি হয় প্রতিটি ক্ষেত্রে ঃ প্রমাণ (= ঢ়ৎড়ড়ভ), অনুমান (= মঁবংং, রহভবৎ), সম্মান (= যড়হড়ঁৎ), উপমান (= ংরসরষব? ), অভিমান (?), অপমান (?), বিমান (= বিশেষ মান, যেটা উঁচুতে অধিষ্ঠানেই সম্ভব)। দিশানির্দেশ বা দিশ্ ধাতু থেকেও কি শৃঙ্খলার সঙ্গে তৈরি হচ্ছে এই সব শব্দ ঃ দেশ, প্রদেশ, উদ্দেশ, নির্দেশ, আদেশ, সন্দেশ (= হবংি), উপদেশ।
তাৎপর্যময় নতুন শব্দসৃষ্টিতে উপসর্গ (ঢ়ৎবভরী) এবং প্রত্যয় (ংঁভভরী)-এর ভূমিকা কম নয়। শুধু উৎ (= উপরের অভিমুখে) উপসর্গের সাহায্যে তৈরি শব্দাবলীর কিছু নমুনা দিচ্ছি ঃ উদাহারণ (= উৎ + আহরণ), উদ্দেশ্য, উত্থাপন (= উৎ + স্থাপন), উদয় (= উৎ + অয় = উপরে আসা), উদ্যোগ (= উৎ + যোগ), উদ্যম (= উৎ + যম), উত্তেজনা, উৎপাত, উচ্ছ্বাস (= উৎ + শ্বাস), উৎসর্গ (= উৎ + সর্গ), উল্লেখ, উদ্ভিদ (= যা উপরের দিকে ভেদ করে ওঠে), উৎপত্তি, ইত্যাদি। প্রত্যয়ের উপযোগিতা দেখানোর জন্য মাত্র দু’টি প্রত্যয়ের ব্যবহার থেকে কিছু উদাহরণ উল্লেখ করছি। যার সাহায্যে কোনো ক্রিয়া নিষ্পন্ন হয়, সেই বস্তু বা সত্তাটি চিহ্নিত হয় ধাতুর সঙ্গে ‘ত্র’ প্রত্যয় ব্যবহার করে; যথা মন্ত্র (মন্ + ত্র), যন্ত্র (নিয়ন্ত্রণ বা নিয়ম বা যম্ + ত্র), পাত্র (পান / পালন = পা + ত্র), শাস্ত্র (শাস্ + ত্র), রাষ্ট্র (রাজ্ +ত্র), নেত্র (নী + ত্র বা কাছে নিয়ে আসা)। আবার, শব্দের শেষে -র এর অবস্থান থেকে বুঝি কোনো গুণের উপস্থিতি ঘটেছে. যথা ভঙ্গুর, স্থবির, স্থির, ছিদ্র (যেখানে ছেদনকার্য সম্ভব), বিদুর (জ্ঞানী, বিদ্), মেদুর, কম্প্র, নম্র (নম্ = নত হওয়া), ধীর, ইত্যাদি।
বাংলাভাষার মূলে সংস্কৃত ভাষার যে ঐশ্বর্য রয়েছে যাঁরা খোঁজখবর রাখেন তাঁদের পক্ষে এত উদাহরণ অপ্রয়োজনীয় সন্দেহ নাই। কিন্তু যাঁরা তা আদৌ জানেন না, তাঁদের কথা ভেবেই এই উদাহরণ কয়টি দিতে হল। কারণ আমি নিজেকে দিয়েই বুঝি। আমরা এ-যুগের লেখাপড়ায় শিক্ষিত বাঙালিরা ইংরেজি ভাষার ছটায় মুগ্ধ, এবং আমাদের অভ্যাস হল আমাদের ভাষাকে ইংরেজির তুলনায় শক্তিহীন মনে করা। মানসিক চর্চার বেলায় আমরা দাঁড়ানোর মতো শক্ত জায়গা খুঁজি ইংরেজির ভাবনার জগতে। আর ওদের নানান ঃবৎস বা প্রত্যয়বাহী শব্দের প্রতিশব্দ খুঁজতে আসি বাংলায়। তারপর ওদের শব্দের  ধঢ়ঢ়বধৎধহপব, ৎবধষরঃু, সধঃঃবৎ, হধঃঁৎব, ংঁনংঃধহপব, ফরধষবপঃরপং, পধঢ়রঃধষ, বঢ়রপ, ফরংপড়ঁৎংব প্রভৃতির  যথাযথ প্রতিশব্দ আমাদের ভাষায় খুঁজে না পেয়ে ভাবতে থাকি আমাদের ভাষাতেই আছে খামতি। এ সম্ভাবনাটা খতিয়ে দেখি না যে, ওদের ভাষা এবং আমাদের ভাষা, দুই ভাষাতে ছক সাজানোর পদ্ধতি (= ফরংপড়ঁৎংব) তো আলাদা হতে পারে। আমরা ভুলে যাই ইংরেজির তথাকথিত বিশাল শব্দভাণ্ডার (যথা, হঠাৎ-মনে-আসা কিছু নমুনা উদাহরণ ঢবৎড়ী, ঝধহফরিপয, ঈধৎফরমধহ, ইঁহশঁস, ঔঁমমবৎহধঁঃ, ঝঢ়বধশবৎ, ইড়ষড়হবু, গড়ষষুপড়ফফষব, গরংযসধংয, ঐঁহশু-ফড়ৎু, ঝপৎরননষব, ঝঃধমমবৎ ইত্যাদি) গড়ে উঠেছে একটা বিশেষ নীতিতে  তা হল, ভাবগত বনিয়াদকে গুরুত্ব না দিয়ে তাৎক্ষণিক সুবিধার ভিত্তিতে প্রায় নির্বিচারে শব্দ তৈরি ও শব্দ আমদানি। ইংরেজিতে গড়ে উঠেছে স্বয়ংভর, অসংলগ্ন, ও অসম্পৃক্ত শব্দের বিপুল সমাবেশ।৯ তার ওপর দুই শতাব্দীর বেশি কাল ধরে বিশ্ব রাজনীতিতে ইঙ্গ-মার্কিন দাপটের ছায়ায় ইংরেজি ভাষার অবিরাম ঢক্কানিনাদ এবং বাণিজ্য, উপনিবেশ ও সাম্রাজ্যের সুবাদে ইংরেজির ক্রমান্বয় প্রসার, সব মিলিয়ে সৃষ্টি হয়েছে ইংরেজি ভাষার অবিসংবাদিত শ্রেষ্ঠত্বের কিংবদন্তী। নিজস্ব সৃজনশীলতার গুণে রবীন্দ্রনাথ (এবং তাঁর আগে মাইকেল ও বঙ্কিম) অবশ্যই বুঝেছিলেন সংস্কৃতপুষ্ট বাংলার শক্তি। কিন্তু এই শক্তির কোনো সহজ যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা তাঁরা দিয়ে যেতে পারেননি ; সময় তার পক্ষে অনুকূল ছিল না বলে। রবীন্দ্রনাথ যে ভাল করেই উপলব্ধি করেছিলেন সংস্কৃত ভাষা থেকে আসা উপাদানের অসীম গুরুত্ব, তার অকাট্য প্রমাণ হল এই যে হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ গ্রন্থটির সৃষ্টির মূলে আছে রবীন্দ্রনাথের অকৃপণ প্রেরণা।
এই প্রসঙ্গে এ কথাও মানতে হবে যে  বঙ্গভূমিতে বাংলাকে বিদ্যাচর্চার বাহন করাতে রবীন্দ্রনাথের যে বিপুল সমর্থন ছিল তার মূলে আছে দেশের সকল মানুষকে নিয়ে মুক্তির সাধনা এবং আধুনিক বিদ্যাচর্চার আঙ্গিনায় দাঁড়ানোর ঐকান্তিক আগ্রহ। সেখানে বাংলাভাষার শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে কোনো তত্ত্বঘোষণা ছিল না। তা যদি থাকত, তাহলে ইংরেজির তুলনায় বাংলার শব্দভাণ্ডারের দৈন্যের কল্পনা করে তা নিয়ে খেদ করতেন না ভাষাচার্য সুনীতিকুমার তাঁর পরিণত বয়সের সৃষ্টি ‘ভাষাপ্রকাশ বাঙ্গালা ব্যাকরণ’ গ্রন্থে।১০ এ বিষয়ে একেবারে কঠিন সত্য এই যে, বাংলা তথা সংস্কৃতের শব্দভাণ্ডারের ক্রিয়াভিত্তিক উৎপত্তিকে যথোচিত গুরুত্ব না দিলে বাংলা এবং সংস্কৃতের বিপুল কার্যকারিতাকে কিছুতে উপলব্ধি করা যায় না। উল্টো পক্ষে সেই পদ্ধতি নিয়ে এগোলে  যে-কাজ পশ্চিমবঙ্গের অ্যাকাডেমির চোখে ঃধনড়ড় লেখক কলিম খান গত দুই দশক ধরে করেছেন, করছেন  বহু যুগ ধরে আগলে রাখা ‘যকের ধন’ যেন চলে আসে আমাদের সকলের হাতের মুঠোয়।
আরও কিছু কথা আপনাদের মনে করিয়ে দিয়ে ভাবের বাহন হিসেবে আমাদের ‘ক্রিয়াভিত্তিক বাংলাভাষা’র অসামান্যতার প্রসঙ্গে ইতি টানব। বিশ্বসংসারের চলমানতা বা পরিবর্তনশীলতার তত্ত্ব আমাদের ভাষার ছত্রে ছত্রে পরিস্ফুট। জগৎ, সংসার, চরাচর  এই শব্দ তিনটির মধ্যে গতির দ্যোতনা মাঝারি শিক্ষিত বাঙালিও অনুভব করেন। এর পাশে ড়িৎষফ, ঁহরাবৎংব, পড়ংসড়ং ইত্যাদি শব্দে এমন কিছু ভাব খুঁজে পাওয়া যায় না। এই চলমান বিশ্বে যে কোনো রকমের অস্তিত্বের মধ্যে আবর্তন যে আছে, তার স্বীকৃতি রয়েছে আবর্তন, পরিবর্তন, বর্তমান, বৃত্তি, বার্তা (= য ঘটছে তার খবর) প্রভৃতি শব্দে, এমনকি বেঁচে-বর্তে থাকার মতো গ্রাম্য শব্দমেল-এর মধ্যেও। ইংরেজি লেখক ঞরসব, ঃযব জবভৎবংযরহম জরাবৎ নামে বই লিখলে, ফরাসি পরিচালক ঞযব জরাবৎ নামে ছবি তুললে আমরা তার মধ্যে মনীষার প্রকাশ দেখি, কিন্তু আমাদের ভাষায় এইরকম ধারার কল্পনা ও মাহাত্ম্য বর্ণনা তো চারিদিকে ছড়ানো। জগৎসংসার, চরাচর ছেড়ে একবার গঙ্গার কথাটিই ভাবুন না কেন। শ্রেষ্ঠ ধারা গঙ্গা (গম্ + গ + আ = নিত্যগমনশীলতা) এবং তার নানা রকমের মাহাত্ম্য বর্ণনার মধ্যে তার পরিচয় পাই।১১ ওদের দেশের ভাষায়, ঈশ্বরপুত্র (ঝড়হ ড়ভ এড়ফ) মানবকায়া পরিগ্রহণ (রহপধৎহধঃরড়হ) করেন। আমাদের ভাষায় ঈশ্বর অবতীর্ণ হন ধরার মধ্যে বা ধরায় অবতরণ করেন, তাই আমরা পাই ঈশ্বরের অবতার। নানা ক্ষেত্রেই আমরা উত্তরণের কথা ভাবি  পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হই, রসোত্তীর্ণ সাহিত্যের কথা ভাবি। বিদ্যার তীর্থে সতীর্থ পাই, সম্পদের বিতরণকে মর্যাদা দিই। সচরাচর আমরা কাজকর্মের যে চৌহদ্দির মধ্যে বিচরণ করি, সেটি হল আচার। সেই রীতিনীতির সীমা লঙ্ঘন করা বা অতিক্রম করা হল অত্যাচার। একটু জানা থাকলে, আর একটু ভাবলে পরই আমাদের ভাষা প্রাণময় হয়ে ওঠে। কোনো কিছু হওয়া বা হওনের জন্য আছে ভূ ধাতু, যার থেকে নিষ্পন্ন হচ্ছে ভব, ভাব, ভাবনা, সম্ভাবনা, ভূমি, ভূত, ভূতি, বিভূতি ইত্যাদি। যেটা মনের মধ্যে আসছে সেটাকে ভাব বলা যায়, আর হওয়ার প্রত্যাশা সত্ত্বেও কিছু না-হওয়াটা হল অভাব। যেখানে কিছু হচ্ছে সেটি ভূমি (ভূ + মি); সুতরাং কোনো কথা বলার প্রস্তুতি হল ভূমিকা। আবার দেখুন হৃদ্ (হৃ + দ) শব্দটি কত যথাযথ; হৃদ হল সে, যে হরণ (হৃ) করে, এবং দান (দা  দ) করে। সেভাবে শব্দটি যবধৎঃ এবং পবহঃৎব দুইকেই বোঝায় ; আর ইংরেজিতে যবধৎঃ যদি পবহঃৎব-কে বোঝায় তবে তা কেবল তুলনা হিসেবে। কিন্তু আমাদের ভাষা বোঝায় সরাসরি, একেবারে তার কার্যকারিতার উল্লেখ করে। মোট কথা আমাদের ভাষার ভাবপ্রকাশের ক্ষমতার যে উদাহরণ দেওয়া যায়, তার যেন সীমা নেই।
আমাদের ভাষার ভিতর প্রজ্ঞাদৃষ্টি যে কতটা সক্রিয় তার আরও কিছু দৃষ্টান্ত দিচ্ছি। আমাদের ভাষায় ক্ষমতা-র সঙ্গে ক্ষমা-র, শ্বাস-এর সঙ্গে বিশ্বাস-এর, স্বচ্ছ-র (অর্থাৎ ঃৎধহংঢ়ধৎবহঃ-এর) সঙ্গে ‘আচ্ছা’-র, আকাশ-এর সঙ্গে প্রকাশ প্রভৃতির শব্দগত নৈকট্য বিস্ময়কর। ক্ষমতা না থাকলে ক্ষমার অর্থ হয় না। বিশ্বাসের অভাবে শ্বাসগ্রহণ অর্থাৎ প্রাণধারণ হয় না, স্বচ্ছতার অভাবে সন্তোষ (‘আচ্ছা’ বলে যা আমরা প্রকাশ করি) আসে না, আকাশ না পেলে কোনো কিছুর প্রকাশ হয় না  এ সবই যেন জানা। এই শব্দগুলির ইংরেজি প্রতিশব্দগুলি যদি মিলিয়ে দেখেন, দেখবেন সেখানে কোনো রকমের সংলগ্নতাই খুঁজে পাবেন না। আমাদের বাসি শব্দটি দেখিয়ে দেয়, এক বাসস্থানে ‘বাসি’ হয়ে গেলে বা আটকে গেলেই চলিষ্ণু মানুষ তার টাটকা, সতেজ ভাব হারিয়ে ফেলে। আবার কোনো কিছুকে রেখে দেওয়া বা রক্ষণ করা মানেই তার শক্তিকে নষ্ট করে দেওয়া। অত্যন্ত সঙ্গত কারণেই রক্ষা আর রাক্ষস শব্দের ধ্বনিগত নৈকট্য।
আমাদের ভাষা থেকে এত উদাহরণ দেওয়ার আর একটি কারণ আছে। দেশের ভাষাকে উপেক্ষা করেও স্বাদেশিকতার কল্পনা বা চেষ্টা সম্ভব। ইংরেজির মধ্যে দিয়েই ভারতকে বুঝে নেবো, এমন চিন্তা অনেক ভারতীয়ের মনেই উঁকি মারে। তাঁদের মনে হয় এ-কাজটি করতে পারলে এক ঢিলে দু’-পাখি মারা যাবে; ভারত আয়ত্তে থাকবে, আবার দুনিয়াদারিও চলতে থাকবে। তাঁরা ভাবেন, প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য  বেদ, উপনিষদ, রামায়ণ, মহাভারত ইত্যাদি সব দরকারি বইয়ের ইংরেজি অনুবাদ তো হয়েই গেছে। অতএব ইংরেজির মধ্যে দিয়ে ভারতকে বুঝতে অসুবিধে হবে কেন ? এ-রকম চিন্তা বিরাট সংখ্যক পদস্থ মানুষের মাথায় নিশ্চয় খেলে। না হলে রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ-নিবেদিতা বা অরবিন্দের নামে এত ইংলিশ-মিডিয়াম স্কুল গজিয়ে ওঠে কেন ? যাঁদের অবশ্য কোনো ভারতীয় ভাষাই জানা নেই তাঁদের পক্ষে ইংরেজি অনুবাদে পড়ে নেওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। কিন্তু ভাবপ্রকাশের আকাশটাই বদলে দিলে অনুবাদের মধ্যে দিয়ে কতটুকু বোঝা যাবে ? এমনিতেই অনুষঙ্গগত কারণে ভাষান্তর ঘটলে শব্দের সূক্ষ্ম ব্যঞ্জনা হারিয়ে যায়। ঊঃরয়ঁবঃঃব বা রাজনীতি সংক্রান্ত বহু বিশেষ শব্দ এই কারণেই ফরাসি থেকে টেনে আনতে হয় ঃ যথা, ৎধরংড়হ ফ’বঃৎব, ধাধহঃ-মধৎফব, পড়ঁঢ় ফ’বঃধঃ, ঢ়ৎড়ঃড়পড়ষ, বহপড়ৎব, ারাধ াড়পব, ষধরংংবু-ভধরৎব, নড়ঁৎমবড়রং ইত্যাদি। তার ওপর ক্রিয়াভিত্তিক হওয়ার কারণে বাংলা বা সংস্কৃত শব্দের পশ্চিমী ভাষায় অনুবাদ বিশেষ কঠিন। অর্থ, ধর্ম, পদ, অধিকার, ক্ষেত্র, ভাব, যোগ, যোগী, সম্পদ, বিষয়, বিষয়ী, সমাধি, পক্ষ, পুরুষ, প্রকৃদি ... প্রভৃতি শব্দের এক এক রকম তাৎপর্য। সে-কারণে অনুবাদ করতে গেলে পদে পদে ভ্রান্তির সম্ভাবনা। এবং সেই ভুল হয়েছেও অতি বিশাল মাত্রায়।
সন্দেহ নেই, বাংলাভাষা সংস্কৃতভাষা থেকে অনেক ব্যাপারে সরে এসেছে। বলতে কি, সংস্কৃতভাষা তার প্রাণসম্পদ হারিয়ে ফেলেছে হিন্দুযুগের সূত্রপাতের (৭৫০ খ্রীষ্টাব্দের) আগেই, কিন্তু মধ্যযুগের (১২০০ খ্রীষ্টাব্দ পরবর্তী) বাংলায় তা নবজীবন লাভ করে কৃত্তিবাস-কাশীরাম-বৈষ্ণবসাহিত্য-মঙ্গলকাব্যের হাত ধরে। তাই, বাংলার মধ্যে অনেক কিছু আছে যা ধরে প্রাচীন সংস্কৃত ভাষার অর্থের জগতে সহজেই প্রবেশ করা যায়, এবং যেগুলি এখনও বাংলাভাষায় ফল ধরানোর ক্ষমতা রাখে। এ-অবস্থায় ইংরেজি ভাষা সম্বল করে আমাদের দেশকে বুঝে নেবো  এই ইংলিশ-মিডিয়ামী হিন্দুত্বের আত্মাভিমান কোনো কাজের কথা নয়। যাঁর বাংলা ভাষায় পা রাখার ক্ষমতা আছে তাঁর পক্ষে এটা নেহাৎই আত্মঘাতী পরিকল্পনা।
বাংলা ভাষার দৈন্য সম্বন্ধে আমাদের ইত্যাকার কল্পনা কতটা অসার তা দেখানোর জন্য আর একটি প্রসঙ্গ আনছি। আমাদের ভাষার মূল থেকে আমরা যত বিচ্ছিন্ন হই, তত আমাদের প্রবণতা বাড়ে ইংরেজির মাপে বাংলা শব্দের অর্থকে ছেঁটে নেওয়ার। আর, তারপর ভাবতে থাকি যে, আমাদের বাংলাভাষা শব্দসম্ভারের সংখ্যার দিক থেকে দীন। কিছু উদাহরণ দিচ্ছি। আমরা ফরংপড়াবৎ-এর বাংলা করলাম আবিষ্কার, কিন্তু রহাবহঃ-এর বেলায় অতি যথাযথ এবং আরো ব্যাপক শব্দ উদ্ভাবন আমাদের মনে পড়ল না। ফলে রহাবহঃ-এরও বাংলা করলাম আকিষ্কার, আর মনে মনে বাংলাভাষার খুঁত ধরলাম। ‘দৈব বনাম পুরুষকার’ (যে-পুরুষকার স্ত্রীলোকেরও থাকে)  এই শব্দসমষ্টি আমাদের মনেই এল না। আর, অর্থ বললে লক্ষ্য, অভীষ্ট প্রভৃতি বুঝায় তাও মনে করলাম না। ফলে ংবহংব ড়ভ াধষঁবং-এর বাংলা করলাম ‘মূল্যবোধ’; অথচ এর থেকে অনেক ভাল প্রতিশব্দ হত পুরুষার্থ বিচার। ব্যুৎপত্তি (সূ = ত্র) থেকে তো বটেই, এমনকি প্রয়োগ থেকেও বোঝা যায় ভড়ৎসঁষধ-র চেয়ে সূত্র অনেক ব্যাপক শব্দ। ঝবপঁষধৎ-এর চেয়ে ‘ঐহিকতাবাদী’ বেশি সঠিক শব্দ, কিন্তু আমরা চালু করে দিয়েছি পঙ্গু ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দটি। গবফরঁস ড়ভ রহংঃৎঁপঃরড়হ-এর বাংলা করি ‘শিক্ষার মাধ্যম’, কিন্তু ‘শিক্ষার বাহন’ হত অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ, এবং রবীন্দ্রনাথ এই শব্দটিই ব্যবহার করতেন। মনে পড়ছে, এক বাংলার অধ্যাপক দুঃখ করছিলেন  বাংলায় শব্দের বড় অভাব;  যধহফংড়সব, ঢ়ৎবঃঃু, নবধঁঃরভঁষ, হরপব সকলেরই প্রতিশব্দ দিতে হয় ‘সুন্দর’। তাঁর মনে পড়ে না সুষমামণ্ডিত, লাবণ্যময়, নয়নাভিরাম, মনোমোহন, মনোমুগ্ধকর, চিত্তরঞ্জন, কান্ত, সুশোভন, দীপ্ত, শ্রীযুক্ত, শ্রীল, শ্লীল, রুচির ইত্যাদি এ-রকম অগনতি শব্দের কথা, যেগুলোর প্রতিশব্দ ইংরেজিতেই পাওয়া কঠিন। ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ যতটা আয়াসসাধ্য, বাংলা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ তার চেয়ে অনেক বেশি কঠিন।
ইংরেজি তথা পশ্চিম দেশের ভাষার তুলনামূলক খামতির কথা বলছিলাম। এ-কথা কিন্তু বলিনি যে ওদের সাহিত্য দীনতাগ্রস্ত। বরং বহু শতাব্দী ধরে যে-সৃষ্টিশীলতার প্রকাশ হয়ে চলেছে ওদের সাহিত্যে, তার তুলনা অন্যত্র দেখতে পাই না। ৮০০ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ১৯০০ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত ইউরোপের যে সাহিত্য তার তুলনা সমকালীন বিশ্বসাহিত্যে বিরল। মধ্যযুগের বাংলাসাহিত্যের হয়তো কিছুটা তুলনা চলে তার সঙ্গে। মনুষ্যজীবনে সার্থকতা কোথায় তার অন্বেষণে নিরলসভাবে তৎপর গ্রীক ট্র্যাজেডি, দান্তের কাব্য, শেক্সপীয়ারের নাটক প্রভৃতি। দীর্ঘকাল ধরে যে খণ্ডবাদী ভাবনা  সবকিছুকে আলাদা করে দেখার অভ্যাস  মানুষের চেতনাকে আকার দিয়ে আসছে পৃথিবীর সব দেশে, তাকে অনেকবার ছাড়িয়ে উঠেছেন ওদের দেশের কবি, শিল্পী প্রভৃতি। ইংরেজ কবি ব্লেক (১৭৫৭-১৮২৭) পারতেন, অন্তত কল্পনায়, ‘ঃড় ংবব ঃযব ঁহরাবৎংব রহ ধ মৎধরহ ড়ভ ংধহফ’। কোলরিজ বলতে পেরেছিলেন, ‘ডব ৎবপবরাব নঁঃ যিধঃ বি মরাব / অহফ রহ ড়ঁৎ ষরভব ধষড়হব ফড়বং ঘধঃঁৎব ষরাব.’।১২ ওয়ার্ডসওয়ার্থ নিজের অভিজ্ঞতায় জেনেছিলেন  এবং পরে তা কবিতায় প্রকাশ করতে পেরেছিলেন  ভাবের অতলে তলিয়ে গিয়ে ভাবসমাধিতে পৌঁছে যাওয়ার কথা। আধুনিক জীবনের রিক্ততা যেমন তিনি দেখেছিলেন, তেমনি তাঁর কবিদৃষ্টিতে দেখেছিলেন চরাচরকে উদ্ভাসিত করে আছে ‘ঃযব ষরমযঃ ঃযধঃ হবাবৎ ধিং, ড়হ ংবধ ড়ৎ ষধহফ’।১৩ শেক্সপীয়ার বলতে পেরেছিলেন, ‘ডব ধৎব ংঁপয ংঃঁভভ / অং ফৎবধসং ধৎব সধফব ড়হ ধহফ ড়ঁৎ ষরঃঃষব ষরভব / ওং ৎড়ঁহফবফ রিঃয ধ ংষববঢ়’।১৪ পাশ্চাত্যের কবিদের গৌরব এই যে, তাঁরা ত্র“টিপূর্ণ ভাষা দিয়েই উচ্চমানের সত্য প্রকাশ করে গিয়েছেন। আর আমাদের দেশের বেলায় কি হয়েছে ? ৭৫০ খ্রীষ্টাব্দের আগে যা সৃষ্টি হয়েছিল সেগুলি অর্থবিস্মৃতির কারণে আজ মৃত, এমনকি মধ্যযুগে বাংলায় যে-বিপুল সৃষ্টির বান ডেকেছিল, তাও অর্থ হারিয়ে মৃতপ্রায় হয়ে রয়েছে। অথচ আমাদের ভারতীয় পূর্বপুরুষদের হাতে অতি সমৃদ্ধ ভাষা তৈরি হয়ে গিয়েছিল খ্রীষ্টজন্মের আগেই। সে পর্যায়ের সৃষ্টিগুলিকে  যথা বেদ, উপনিষদ, রামায়ণ. মহাভারত ইত্যাদিকে আমরা এখন আর ঠিক বুঝে উঠতে পারি না, এমনকি বুঝতে পারছি না মধ্যযুগের বাংলা সৃষ্টিগুলিকেও। ইতিহাসের মারে সেই সমৃদ্ধ ভাষার যথেষ্ট ব্যবহার হয়ে উঠল না আমাদের দেশে। এই ভাষার শক্ত বনিয়াদের মূল কথাটা (সর্বস্তরে ক্রিয়াভিত্তিক শব্দগঠন) যেন ভুলেই গেল দেশের মানুষ। না হলে আল্ বিরুনির অভিযোগ সম্ভব হল কি করে ?
আর একটি কথাও এখানে প্রাসঙ্গিক। বিশ্বভাষা আবির্ভাবের পথে ইংরেজি ভাষার সম্ভাব্য ভূমিকা কি হতে পারে তা নিয়ে কোনো বক্তব্য রাখছি না। কোনো ভাষার বিস্তার নির্ভর করে সেই ভাষা যারা ব্যবহার করে তাদের প্রতিপত্তির ওপর। ব্যবহারকারীর সংখ্যা হিসেবে ১৬০০ সালেও ফরাসি, জার্মান, স্প্যানিশ  প্রতিটি ভাষা ছিল ইংরেজির চেয়ে এগিয়ে। অথচ ১৯০০ সালে এদের মধ্যে ইংরেজি চলে এল এক নম্বরে। প্রতিপত্তির সূত্রেই ইংরেজি আজ বিশ্বভাষা-মঞ্চে প্রথম আসনে, সেই একই সূত্রে কোনোদিন তা নেমেও যেতে পারে। এখন তা নিয়ে অনুমানভিক্তিক আলোচনা নিরর্থক।
কিন্তু চিন্তার বাহন হিসেবে ভাষার গুরুত্বের বিচার একটু অন্য রকমের। তাতে ভাষাটি কে ব্যবহার করছেন তার চেয়ে সেই ভাষার ভিতরে মানবজাতির অর্জন কতখানি রয়েছে সেই সত্যের বিচার হয়। প্রথম শতাব্দীতে ভূমধ্যসাগর অঞ্চলে গ্রীক ভাষা আর (রোমের ভাষা) ল্যাটিনের সমান গুরুত্ব যেন। সেই দুই ভাষার উত্তরাধিকারীদের বর্তমানের অবস্থান কোথায় ? ফ্রান্স, স্পেন, পর্তুগাল, ইতালি, রুমানিয়া, গোটা ল্যাটিন আমেরিকা  এ-সবই এখন ল্যাটিন-উদ্ভুত ভাষার এলাকা। আর গ্রীক-উদ্ভুত ভাষার এলাকা শুধু আজকের গ্রীস দেশ। তবু শিল্প, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির দুনিয়ায় পথনির্দেশ পেতে আজকের মানুষ ল্যাটিনের চেয়ে অনেক বেশি করে যায় গ্রীক ভাষায় ও সাহিত্যে।
এবার মূল আলোচনায় ফেরা যাক। ক্রিয়াভিত্তিক বাংলা ভাষার চলনসই জ্ঞানও যদি থাকে, ইংরেজি ভাষা তথা পশ্চিমী ভাষা ও সংস্কৃতির অনেক জটিলতার সমাধান আমাদের উদ্যোগেই হয়ে যায়। আপনাদের জানা থাকতে পারে, অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর সূচনায় সংস্কৃত ভাষার আবিষ্কার কী উদ্দীপনা এনেছিল ইউরোপের, বিশেষ করে জার্মানির পণ্ডিতদের জগতে। পশ্চিমের রাজনৈতিক স্বার্থ ও মজ্জাগত কুসংস্কার সেই আলোড়নকে নি®প্রভ করে দেওয়ার চেষ্টা কম করেনি। তবু ভাষাবিজ্ঞানের জগতে সকল পণ্ডিত প্রায় একবাক্যে স্বীকার করেন যে (১) ভারতের ভাষাবিজ্ঞানের কাছে প্রথম তালিম নিয়েই ঢ়যড়হবঃরপং বা ধ্বনিবিজ্ঞান নামের বিদ্যাটির পত্তন হয় ঊনবিংশ শতাব্দীতে ; (২) পাণিনির ব্যাকরণ হল মানববুদ্ধির মহত্তম সৃষ্টিগুলির অন্যতম ; (৩) ভারতীয় ব্যাকরণের কারক, সমাস প্রভৃতি তত্ত্বের কাছে এখনও অনেক কিছু শেখবার আছে। ক্রিয়ার দিক থেকে বিচার করায় ভারতীয় ব্যাকরণের কারকতত্ত্ব পশ্চিমী ব্যাকরণের (বিশেষ্যের আকার নির্ভর) পধংব-তত্ত্বের থেকে অনেক উঁচু মানের। সে রকম, সমাসের বিচারে ভারতীয় সূক্ষ্মতা আসলে উচ্চাঙ্গ চিন্তারই প্রস্তুতি।১৫
বলে রাখা ভালো, এই পণ্ডিতেরা এখনও পর্যন্ত আমাদের ক্রিয়াভিত্তিক শব্দগঠন পদ্ধতি ও ক্রিয়াভিত্তিক ভাষার খবর পর্যন্ত জানেন না, বা তাঁরা আমাদের যাস্কমুনির নাম শোনেননি, কিংবা তাঁর ‘নিরুক্ত’ গ্রন্থটির কথা জানেন না, এমন নয়। কিন্তু গ্রন্থটির অর্থই তাঁরা বুঝতে পারেননি, কিংবা বলা ভালো, একেবারেই ভুল বুঝেছেন। অথচ এই ‘নিরুক্ত’ই মানবজাতির শব্দার্থতত্ত্বের সবচেয়ে প্রাচীন গ্রন্থ। সেই শব্দার্থতত্ত্ব যখন তাঁরা বুঝতেই পারলেন না, তখন সেই শব্দার্থতত্ত্ব অনুসরণ করে লেখা বেদ-পুরাণ-রামায়ণ-মহাভারতের অর্থও বুঝতে পারলেন না তাঁরা, ফলে সমগ্র ইউরোপই তা বুঝতে পারল না। সবই তাঁদের কাছে মনে হল রূপকথার রাজ্য, গুঃযড়ষড়মু। আমাদের ভাষাতত্ত্বের মূল অর্জনটিই তাঁদের হাতে গেল না, ফলে গেল না আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠত্বের কথাও এবং সর্বোপরি তাঁদের সেই না-বোঝা দিয়েই তাঁরা শিক্ষিত বাঙালিদেরও কলুষিত করে দিলেন। আমরা নিজেদের আকাশ ছেড়ে তাঁদের মনোলোকের আকাশের তলায় গিয়ে আমাদের নিজেদের অতীত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম।
অথচ একেবারে বিপরীত ফলও ফলতে পারত। আমাদের ভাষার ক্রিয়াভিত্তিক তত্ত্ব যদি তাঁরা বুঝতে পারতেন, তাহলে তা দিয়ে তাঁর কেবল আমাদেরই বুঝতে পারতেন এমন নয় ; অনেক ভালোভাবে বুঝতে পারতেন তাঁদের নিজেদের বর্তমান ও অতীতটাকেও। কেননা, আজ আমরা দেখতে পাচ্ছি সেই ক্রিয়াভিত্তিকতার তত্ত্ব দিয়ে পশ্চিমের ভাষাচর্চা ও ইতিহাসের অনেক অসম্পূর্ণতার ওপর আলো ফেলা যায়।
ভাষার ক্ষেত্রে বুঝতে পারি যে, প্রকৃত প্রস্তাবে সমার্থক শব্দ কোনো ভাষায় থাকে না। তথাকথিত সমার্থক শব্দ চালু হয় একই সত্তার আধারে ভিন্ন ভিন্ন ক্রিয়া বোঝানোর জন্য। সচেতন মানুষের উদ্যোগে ‘সংস্কৃত’ হয়ে যাওয়ায় আমাদের দেশের ভাষায় সেই সব শব্দের উৎপত্তি উদ্ধার করা যায়, কিন্তু অন্য ভাষাগুলি সেই সব উৎপত্তি ভুলে গেছে। তথাকথিত সমার্থক শব্দগুলোর স্বাতন্ত্র্যকে তারা মনে রাখে প্রয়োগক্ষেত্রের অনুষঙ্গের জোরে। অশ্বের গতি বোঝাতে ইংরেজিতে চারটি স্বতন্ত্র শব্দ ব্যবহার করা হয়  ধসনষব, ঃৎড়ঃ, পধহঃবৎ, মধষষড়ঢ়। কিন্তু সেগুলোর একটি আরেকটির সমার্থক নয়। আমাদের ক্রিয়াভিত্তিক (বাংলা-সংস্কৃত) ভাষায় যে-সব সমার্থক তুল্য শব্দ পাই, সেগুলো স্পষ্টতই ভিন্ন ক্রিয়ার হিসাবে তৈরি। নেহাৎই নমুনা হিসেবে কয়েকটি শব্দগুচ্ছ তুলে ধরছি ঃ পৃথিবী, বসুমতী, ধরিত্রী ইত্যাদি ; সূর্য, রবি, তপন, দিবাকর, অর্ক প্রভৃতি; নারী, মানবী, স্ত্রী, কামিনী, ললনা ইত্যাদি ; অগ্নি, অনল, হুতাশন প্রভৃতি। এই শব্দগুলি ভাঙলে পরই বোঝা যায় কোথায় কোন্ ক্রিয়ার উল্লেখ হচ্ছে। আগেই বলেছি, আমাদের এই শব্দার্থতত্ত্ব এখনও বিশ্বের হাতে পৌঁছায়নি, পৌঁছায়নি পাণিনি-পূর্ববর্তী আদি শব্দার্থতাত্ত্বিক রচনা (নিরুক্ত)-টি। কারণ যাস্কমুনির নিরুক্ত এতদিন কেউই সঠিক ভাবে বুঝতে পারেননি। আমাদের এই শব্দার্থতত্ত্ব পশ্চিমী ভাষাগুলিকে তো বটেই, এমনকি তাদের অলঙ্কারশাস্ত্রের অনেক কিছুকে নতুন আলোয় উদ্ভাসিত করে দেওয়ার যোগ্যতা ধরে। গবঃধঢ়যড়ৎ, গবঃড়হুসু  দু’টি ক্ষেত্রেই দেখি কোনো বস্তু বা সত্তাকে তার প্রচলিত নাম থেকে সরিয়ে এনে অন্য বস্তুর বা সত্তার সঙ্গে জুড়ে দেখা হয়। পাঠক বা শ্রোতা এইরকম অলঙ্কারের ব্যবহারে কি-রকম আনন্দ বা তৃপ্তি পান ? প্রকৃতপক্ষে তা হল অনেকটা এইরকম ঃ গবঃধঢ়যড়ৎ-এর বেলায় বাইরের দিক থেকে দু’টি ভিন্ন রকমের বস্তু বা সত্তার ক্রিয়াগত সাদৃশ্য লক্ষ্য করা, আর গবঃড়হুসু-র বেলায় ক্রিয়া এবং ক্রিয়ার আধারের অভেদ আনার চেষ্টা। অর্থাৎ বস্তু বা সত্তার ভিতরের ক্রিয়াটির দিকে নজর তাঁদের পড়েছে, আর তার ব্যাখ্যা খুঁজছেন তাঁরা তাঁদের অলঙ্কারশাস্ত্রের সহায়তা নিয়ে। তবে কিনা, এ-চেষ্টা তো কার্যত উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত মানবজাতির আদি ক্রিয়াভিত্তিক শব্দকে প্রাণে মেরে দিয়ে তারপর তাকে জীবন্ত করে তোলার জন্য শবসাধনা  মড়ার হাত-পায়ে ¯িপ্রং লাগিয়ে তাকে সচল করে দেখানোর জাদুকরী চেষ্টা। সেই চেষ্টাকেই তাঁরা বড় গলায় ঘোষণা করেন  গবঃধঢ়যড়ৎ ড়ভ ঃযব ংড়ঁষ ড়ভ ঢ়ড়বঃৎু। দোষ তাঁদের নয়। দোষ তাঁদের উপর ইতিহাসের যে মার পড়েছে, তার। বরং তাঁদের গৌরব এই যে, আদি মানবজাতির ভাষায় ক্রিয়াভিত্তিক স্বভারে অধিকাংশ উত্তরাধিকার হারিয়েও তাঁরা নিজেদের একান্ত চেষ্টায় দেখে ফেলেছেন শব্দের ভিতরে প্রাণ ছিল এবং এখনও তার চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। তাই গবঃধঢ়যড়ৎ নিয়ে নানা চপল মন্তব্য করে বসেন। কেউ কেউ এমনও বলে বসেন যে, সব ভাষাই আসলে ‘সবঃধঢ়যড়ৎরপ’। আমাদের ক্রিয়াভিত্তিক ভাষার ‘লিঙ্গ’-কে যেদিন তাঁরা তাঁদের ‘ষরহমঁধ’-র সঙ্গে সমার্থক বুঝবেন, সেদিন তাঁদের গবঃধঢ়যড়ৎ-এর মরূদ্যানের সামনেই এক স্বর্গোদ্যানের নতুন দিগন্ত খুলে যাবে।
হ্যাঁ, ইংরেজি ভাষা অনেক বৈশিষ্ট্যকে গভীরতর তাৎপর্যে বোঝা যায় ক্রিয়াভিত্তিক ভাষার প্রেক্ষিতে। ইংরেজির ঢ়ধংঃ ঃবহংব এবং ঢ়ধংঃ ঢ়ধৎঃরপরঢ়ষব-এ যা সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় সেই -ফ, -বফ, -ঃ এর মধ্যে আমরা দেখতে পাই -ক্ত প্রত্যয়ের জ্ঞাতি। সংস্কৃতের সঙ্গে ইংরেজি একই ভাষা-পরিবার, যথা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা-পরিবারের সদস্য হওয়ার সুবাদে, দুইয়ের মধ্যে আমরা অনেক সাদৃশ্য লক্ষ্য করি। একটি ছোট মিলের কথা উল্লেখ করছি। সংস্কৃত শব্দের শেষে -ইন্ (যথা যার ভিতরে গুণ আছে = গুণ + ইন্ = গুণিন্ ; কামিন্ = কামী ; গামিন্ = গামী ; প্রার্থন = প্রার্থী ইত্যাদি) ইংরেজি রহ শব্দের সঙ্গে এক তাৎপর্যের। তবে বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয় হল, ইংরেজি মৎড়ঁঢ় াবৎন-এর জনপ্রিয়তা। সংস্কৃতে ধাতুর আগে উপসর্গ যোগ করার উপায়ে কম উপকরণে বেশি ভাব স্বচ্ছতার সঙ্গে প্রকাশ করা যায়। ইংরেজিতে ঠিক সেই কাজ হয় মৎড়ঁঢ় াবৎন দিয়ে। অনড়ষরংয, পড়সঢ়বহংধঃব, ফড়সরহধঃব, ফরিহফষব, ধমমৎধাধঃব ইত্যাদিতে অস্বচ্ছ এবং দীর্ঘ শব্দের ব্যবহার এ-যুগের গতিবাদী ইঙ্গ-মার্কিনের ‘না-পসন্দ্’। এড়, সধশব, পঁঃ, ংবঃ, ৎঁহ, ঢ়ঁঃ, মরাব, ঃধশব, যরঃ প্রভৃতি একাক্ষরী (সড়হড়ংুষষধনরপ) াবৎন-এর ড়ভভ, ঁঢ়, ড়ঁঃ, রহ, ধঃ, ঃড় প্রভৃতিকে অনুসর্গ হিসেবে ব্যবহার করায় আধুনিক ইংরেজিভাষী পায় সহজিয়া ভাষা-ব্যবহারের আনন্দ। তবে সংস্কৃততে উপসর্গ আসে আগে, প্রত্যয় আসে পরে  সেই পদ্ধতিতে সংস্কৃততে যথাযথ ভাবপ্রকাশের সুযোগ অনেক বেশি। উপরন্তু উপসর্গ আর প্রত্যয় যোগ বিষয়ে এক সুশৃঙ্খল ও বিশাল ব্যবস্থা রয়েছে সংস্কৃতের ব্যাকরণে। তাই ইংরেজি ভাষার জগতে অধিকার কায়েম করতে আমাদের ক্রিয়াভিত্তিক ভাষার জ্ঞান অবশ্যই সাহায্য করে।
এক ভাষা পরিবারের সদস্য হওয়ায় ইংরেজির বহু শব্দের জ্ঞাতিশব্দকে পাওয়া যায় বাংলার মধ্যে এ-কথা আপনাদের জানা। যেখানে সে সব শব্দের সাদৃশ্য অতি স্পষ্ট, সেখানে তাদের উল্লেখের কোনো প্রয়োজন নেই। যেখানে রয়েছে আবছা সাদৃশ্য, সেখানে বোধহয় কিছু শব্দের উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে ঃ যথা  ভষড়,ি প্লব ; ৎড়ঃধ, রথ ; পুপষব, শঁশষড়ং, চক্র ; ফরপঃরড়হ, দিশ্ ; ুড়শব, যুগ ; ৎবরহ, ঋণ ; ৎরমযঃ, ঋত ; ৎরপয, ঋচ্ ; ধহমবৎ, অঙ্গার ; ঢ়ড়ঁৎ, পূর্ণ ; ড়িসন, অম্বা ; ঃধী, তক্ষণ ইত্যাদি আরও অনেক শব্দ। কিন্তু বেশ কিছু শব্দ ও শব্দন্যাস (ঢ়যৎধংব) আছে ইংরেজিতে, যাদের গহনলোকে প্রবেশ সম্ভব হয় কেবলমাত্র আমাদের ভাষার ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থতত্ত্বের রাস্তায় (যে পথে কাটাই ও বাঁধাইয়ের কাজে আজ ছয়-সাত বছর আমি কলিম খানে-এর সহব্রতী)। কিছু উদাহারণ দিলে বক্তব্যটি স্পষ্ট হবে।
পশ্চিমী ভাষাবিজ্ঞান অনুসারে ইংরেজি জার্মান প্রমুখ জরমানিক বা টিউটনিক ভাষাগোষ্ঠীর এলাকায় ধহফ একটি ভুঁইফোঁড় শব্দ। আমরা কিন্তু শব্দটির জ্ঞাতি পাচ্ছি আমাদের ভাষার ‘অণ্ড’ শব্দে, ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ অনুসারে যার মানে হল ‘যাহার দ্বারা অবয়ব সংযোগপ্রাপ্ত হয়।’ আণ্ডা (= বমম), অণ্ডকোষ, এবং ধহফ শব্দটি  সবকিছুর যোগসূত্র ধরিয়ে দিচ্ছে আমাদের অভিধান। শুধু তাই নয়, ক্রিয়াভিত্তিক ভাষায় শব্দের শেষে ‘র’-এর অবস্থান প্রায়ই বিশেষ কোনো গুণের উপস্থিতি নির্দেশ করে। এই নিয়মের প্রয়োগেই বোঝা যাবে কেন গ্রীক ভাষায় পুরুষ বা সধষব অর্থে অহফৎড় শব্দের ব্যবহার হয়। প্রকৃত ঘটনা এই যে, আদি ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষায় কোন্ শব্দ কিভাবে গঠিত হল, বা কিভাবে গঠিত হয়, অন্যান্য দেশ তা ভুলে গেছে, কিন্তু তার স্মৃতি বহন করছে আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতি। যে কারণে ‘নেহাৎ প্রথার মধ্যে মানবভাষার উৎপত্তি’  এ তত্ত্ব ভারতীয় উপমহাদেশের ঐতিহ্যে বিশেষ আমল পেতে পারে না।
বঙ্গীয় শব্দকোষে লিঙ্গ শব্দের একটি ক্রিয়াভিত্তিক অর্থ দিচ্ছে  ‘জ্ঞান সাধনের উপায়।’ এটি জানলে পর বুঝি কেন ল্যাটিনের ষরহমঁধ শব্দ (যে শব্দ থেকে ষধহমঁধমব, ষরহমঁরংঃরপং ইত্যাদি কয়েকটি শব্দ নিষ্পন্ন) দিয়ে বোঝানো হবে মানুষের ভাষাকে (এবং ভাষার যেখানে উদ্ভব সেই জিহ্বাকে)। কিংবা দেখুন রহাবংঃ কথাটিকে। আমাদের দেশে কোনো ব্যক্তিকে দায়িত্ব, ক্ষমতা ও মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করতে গেলে তার সাথে চাদর বা কিছু আবরণ দিয়ে তাকে বরণ ( = বৃ) করে নিতে হয়  সে বধূ, জামাতা, পুরোহিত, সভাপতি, প্রধান অতিথি যাই হোক না কেন। কোনো ব্যক্তিকে ক্ষমতা অর্পণ করলে ইংরেজিতে গায়ে াবংঃ বা জামা চড়ানো বা রহাবংঃ ংড়সবনড়ফু রিঃয ধঁঃযড়ৎরঃু কেন বলা তা ভাল করে বোঝা যায় আমাদের বরণ কথাটির সূত্রে। পশ্চিমী ভাষার অনেক উপাদানকে পশ্চিমী পণ্ডিতরা ব্যাখ্যা করে দেন সাদৃশ্য বা সবঃধঢ়যড়ৎ-এর তত্ত্ব দিয়ে। কিন্তু আমাদের ভাষায় শব্দরাই ধরিয়ে দেয় কি বোঝানো হচ্ছে। আমাদের ভাষায় যে প্রক্রিয়াটি হল পিতার পদে অধিষ্ঠিত হওয়া সেটি ওদের ভাষায় সবঃধঢ়যড়ৎ হয়ে বজায় থাকছে ‘ংঃবঢ় রহঃড় ঃযব ংযড়বং ড়ভ যরং ভধঃযবৎ’ আকারে। কুমারীর কৌমার্যহরণ অর্থে ফবভষড়বিৎ শব্দটি কেন ব্যবহার হয় সেটি বুঝতে পারি যখন জানি যে আমাদের দেশে কোনো কুমারী ঋতুমতী (অর্থাৎ বিবাহযোগ্যা) হলে বলা হত এবং এখনও গ্রামের লোকে বলে থাকেন ‘অমুক মেয়েটি পুষ্পবতী হয়েছে।’ সেই কথাটি সাধারণের ভাষায় ‘বিয়ের ফুল ফুটেছে’ আকারে এখনও কথায় কথায় বলা হয়ে থাকে।
ওদের দেশের বহু শব্দের ব্যাখ্যা আমাদের দেশের জ্ঞানসম্পদ দিয়েই সম্ভব। ইঁষষ রহ ধ পযরহধ ংযড়ঢ়  এই শব্দন্যাসের নিশ্চয় সবঃধঢ়যড়ৎ হিসেবে অর্থ করা যায়। কিন্তু অনেক ভাল ব্যাখ্যা আমরা দিতে পারি। চীনামাটির শিল্পে প্রায়শই দেখি দক্ষতার পরাকাষ্ঠা ; সেই দক্ষতা আসে শ্রমবিভাজনে, অর্থাৎ বারে বারে এক কাজ করে যাওয়ায়। অথচ পুনরাবৃত্তির একঘেয়েমি হল মানবপ্রকৃতি বিরোধী। স্বভাবতই দক্ষতার নীতির বিরোধী হলেন মানুষের আদিদেব শিব, যাঁর আবির্ভাব ঘটে দক্ষতার নীতিতে চালিত সামাজিক কর্মযজ্ঞকে ভণ্ডুল করার জন্য। আর শিবের বাহন এবং প্রতীক দুই’ই হল বৃষ বা নঁষষ। সুতরাং নঁষষ রহ ধ পযরহধ ংযড়ঢ় শিবের আক্রমণে দক্ষযজ্ঞ পণ্ড হওয়ার স্মৃতি বহন করছে। এরকম নঁষষংযরঃ-এও পাই ‘ষাঁড়ের গোবর’, যা কিনা আমাদের কোনো কাজে লাগে না। (ষাঁড়ের গোবরের ব্যাখ্যা ? মার্জনা করবেন, এ-আলাপে অত অবকাশ নেই; আজ থাক)।
শব্দের অর্থগত পূর্ণতার স্মৃতিকে আমাদের ভাষাই বহন করে নিয়ে যাচ্ছে। এর খুব ভাল উদাহরণ হল ‘লোক’ শব্দটি। এই শব্দখণ্ডটি দিয়ে তৈরি আমাদের ভাষার নানান শব্দকে তাদের পশ্চিমী, বিশেষ করে ইংরেজি প্রতিশব্দ সমেত নীচে তুলি ধরছি।
লোক ঃ সধহ
লোক ঃ ংঢ়যবৎব; ল্যাটিন ষড়পঁং (= স্থান) যার থেকে ষড়পধষ, ষড়পধঃরড়হ
আলোক ঃ ষরমযঃ, ল্যাটিন ষীঁ (উচ্চারণ লুক্স্)
লোক ঃ ষড়ড়শ
লোকন / লোচন ঃ বুব
আলোকন / আলোচন ঃ ফরংপঁংং, ঃযৎড়ি ষরমযঃ ; ল্যাটিন ষড়য়ঁবৎব (যার থেকে বষড়য়ঁবহঃ, ষড়য়ঁধপরঃু, ড়নষড়য়ুঁ) ; গ্রীক ষড়মড়ং (যার থেকে ষড়মরপ এবং - ষড়মু)
খড়পঁং, ষীঁ, ষড়য়ঁবৎব, ষড়মড়ং, ষড়ড়শ  এদের ভিতর জ্ঞাতিত্ব পশ্চিমী পণ্ডিতরা সন্দেহ করেন না। কিন্তু ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থতত্ত্ব এদের ভিতরকার যোগসূত্র আমাদের দেখিয়ে দেয়। যিনি দেখছেন, যাকে তিনি দেখছেন, যার সাহায্যে তিনি দেখছেন এবং দেখা কাজটি  সব মিলেই তো এক অখণ্ডতা। আমরা কেউ ভাবব না যে বিভিন্ন ভাষা থেকে টুকরো অর্থগুলি এনে আমাদের দেশে জোড়া হয়েছিল। বরং মানুষের পূর্বপুরুষের অখণ্ড বোধই কেউ পেয়েছে খণ্ডভাবে, কেউ পেয়েছে অখণ্ডভাবেই ; কোনো দেশের ভাষায় সেই বোধ রয়েছে টুকরো টুকরো হয়ে, কোথাও-বা রয়েছে খানিকটা অখণ্ডভাবেই  এটা ভাবাই যুক্তিসঙ্গত। আমাদের সৌভাগ্য যে, আমরা বাংলাভাষীরা অখণ্ডের উত্তরাধিকারী।
ভাষার ক্ষেত্রে যেমন, তেমন পশ্চিমী পুরাণ ও ঐতিহ্যের অনেক কিছু বোধগম্য হয় আমাদের ঐতিহ্য বোঝার পর। ভারতের ব্রাহ্মণের মাথায় যে-শিখা দেখি, সে-শিখা আসলে মাথার ভিতর বাহিত জ্ঞানের অগ্নিশিখার সূচক তথা বহিরঙ্গ সহযোগী। জ্ঞানের এই শিখা বহন যিনি শুরু করেছিলেন তিনি আদিদেব আদি-শিখা-বহনকারী শিব, ইন্দ্র প্রমুখ দেবতাদের সঙ্গে যাঁর মৌল বিরোধিতা। এদিকে দেখুন গ্রীক পুরাণ কি বলছে। ঙষুসঢ়ঁং পাহাড়বাসী তবঁং প্রমুখ দেবতাদের অগ্রজ ঞরঃধহ-দের অন্যতম চৎড়সবঃযবঁং মানবকল্যাণের জন্য স্বর্গ থেকে চুরি করে আনেন আগুন। আর সেই মানবহিতৈষী মহৎ কাজের জন্য প্রমিথিউস নিত্য নিপীড়িত দেবরাজ তবঁং-এর হাতে। আবার শিবের সঙ্গে তাঁর বাহন বৃষের অচ্ছেদ্য বন্ধন বা অভিন্নতা যদি মনে রাখি তবে বুঝব গ্রীক পুরাণের ‘মন্দ’ রাজা গরহড়ং-এর সন্তান কেন বৃষদেহী, কেন চতুর তবঁং-কে বারে বারে বৃষের আকার নিতে হত বিভিন্ন প্রকৃতিরূপা বা নারীর সঙ্গে মিলিত হতে, আর কেনই বা আজও বৃষের সঙ্গে লড়াই ইউরোপে, বিশেষত স্পেন দেশে, ৎরঃঁধষ-তুল্য অতি প্রিয় বিনোদন। আবার পশ্চিমের গ্রীসীয়, স্ক্যাণ্ডিনেভীয়, কেলটীয় পুরাণে অশ্ব, অশ্বমানব (আমাদের কিম্পুরুষ ও কিন্নর) প্রভৃতি নিয়ে যে-সব উপকথা আছে তাদেরও বেশি করে বোঝা যায় আমাদের ঐতিহ্যের অশ্বমেধ, এমনকি  পাঠক বিস্মিত হবেন না  অশ্বত্থবৃক্ষের পূজা ইত্যাদির সম্যক ব্যাখ্যার আলোয়। (অন্যত্র১৬ সে ব্যাখ্যা করেছি, স্থানাভাবে এখানে সে-ব্যাখ্যা করতে পারলাম না বলে পাঠকের মার্জনা চাইছি)।
একটি চরম বিস্ময়ের কথা বলি। নাচ আর গান সহযোগে বিনোদনের যোগান দেওয়ার জন্য গ্রীক নাটকে ঈযড়ৎঁং-কে রাখা হয়নি, এটি আগে থেকেই বুঝতাম। তবে আমাদের ‘কুরু’ শব্দের সঙ্গে গ্রীক ঈযড়ৎঁং-এর সমত্ব (পুরু-র সঙ্গে চড়ৎঁং-এর যেমন সমত্ব) যখন আমার নজরে এল, তখন এক ঝলকে বুঝে গেলাম গ্রীক নাটকে ঈযড়ৎঁং-এর প্রকৃত ভূমিকা। আমাদের দেশে যুদ্ধের ক্ষেত্র বলা হয়েছে কুরুক্ষেত্রকে। কেননা সেখানেই ‘কি করা উচিত’ (মা কুরু = করিয়ো না, করা উচিত নয়) অর্থাৎ কর্তব্য কি তার নিরূপণ হয়। বুঝলাম, ঈযড়ৎঁং কেন কর্তব্য আর অকর্তব্যের তর্কটাকে নাটকের আগাগোড়া জিইয়ে রাখে।
প্রথমত, যে আলোচনা করেছি তাতে নিশ্চয় দেখেছেন ক্রিয়াভিত্তিকতায় গেলে বাংলা ভাষা কত জীবন্ত হয়ে ওঠে আপনার, আমার এবং সকলের ব্যবহারে। দ্বিতীয়ত, ইংরেজির মাপে বাংলাকে ছেঁটে নেওয়ার অভ্যাস ছাড়ার পর আপনার যে চোখ খুলবে তার সঙ্গে একটু ক্রিয়াভিত্তিক বিশ্লেষণ মেলালে আপনি বাংলা ভাষার সঙ্গে বেশি করে যুক্ত হতে পারবেন। আপনি যে কত শব্দ ব্যবহার করতে পারেন তার সামান্য কিছু নমুনা এখানে দিচ্ছি ঃ যথা, বিন্দুবিসর্গ (= বিন্দুতে আরম্ভ থেকে বিসর্গতে শেষ পর্যন্ত), হস্তীমূর্খ (= বড় রকমের মূর্খ), পূর্বাশ্রমের নাম (= ব্রহ্মচারী, গৃহী, অথবা বানপ্রস্থী অবস্থার নাম), দিকপাল / দিগ্গজ (= এক এক দিকের পালনকারী), জাতধম্মো (= জাতি বা নরৎঃয অনুযায়ী ধর্ম বা পেশা), পারানির কড়ি (= সংসারনদী বা ভবনদী পার হওয়ার জন্য মাঝিকে দেয় পয়সা), অপদার্থ (= পদ বা ঢ়ড়ংরঃরড়হ-এর যোগ্যতাহীন), দায়সারা (= দেয় পড়ে আইনের এলাকায়, দায় পড়ে আদি সমাজের ন্যায়ের এলাকায়  অতএব দায়সারা = অবহেলায় করা)। এ-রকম অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়, যেগুলি অতীতকে না বুঝে তার বোঝা বয়ে বেড়ানো টুলো পণ্ডিদেতরা দেখতে বা দেখতে পারিননি, আর ইংরেজির মাপে যাঁরা বাংলা পড়েন, তাঁদেরও নজর এড়িয়ে গেছে।
তৃতীয়ত, ক্রিয়াভিত্তিকতার পথে এগোলে আমাদের প্রাচীন গ্রন্থাদির মধ্যে পাওয়া যাবে মাত্র একটি দৃষ্টিভঙ্গী বা জীবনদর্শন, তা নয়। সেখানে ধরা আছে সমাজ-বিবর্তনের দীর্ঘকালের ইতিহাস। সে ইতিহাসে স্বতন্ত্র ব্যক্তিদের নাম থাকে না, সেখানে থাকে সত্তার নাম, যেমন দেখি রবীন্দ্রনাথের লেখায় ‘বণিকের মানদণ্ড পোহালে শর্বরী দেখা দিল রাজদণ্ড রূপে।’ আমরা দেখতে পাই বিষ্ণু বা নারায়ণের দশাবতারের কাহিনীর মধ্যে পুঁজির বিবর্তনের ইতিহাস। লক্ষ্য করবেন যে বাঙালির মুখের কথার মধ্যে ধরা আছে নগদ নারায়ণের নাম, ধান্য বা মুদ্রার মধ্যে নারায়ণ-পতœী লক্ষ্মীর অবস্থান। আরও খেয়াল করবেন যে সংস্কৃত ভাষা না-শিখে তখন কেবল ইংরেজিতে পাওয়া যায় এমন জিনিস পড়েই ঊনবিংশ শতাব্দীতে বিদেশী মনীষী কার্ল মার্কস পুঁজিপতিকে বলেছেলেন ‘ঃযব সড়ফবৎহ ঢ়বহরঃবহঃ ড়ভ ঠরংযহঁ’। সেই রীতিতে ভাষাবিচারে কিঞ্চিৎ রপ্ত হলে দেখবেন নদী বললে শুধু জলধারা বা ৎরাবৎ বোঝায় না, নদ শব্দটিও নিছক ব্যাকরণের চাহিদা মেটানোর জন্য তৈরি শব্দ নয়। নদনদী বললে বোঝায় মানুষকে ন (= বিত্তন আ সম্পদ) দান করে এমন জ্ঞানধারা বা কর্মধারা। ব্যুৎপত্তি অনুসারে গঙ্গা বললে বোঝায় নিত্যগমনশীলতা ; অতএব অবাধ পণ্যপ্রবাহ সহ যে-কোনো পর্যায়ের অবাধ ধারাকে বোঝাতে গঙ্গা শব্দ ব্যবহার করা যায়। মনে করিয়ে দিই, শান্তনুর ঔরসে গঙ্গার গর্ভে জন্মাচ্ছে অষ্টবসু, এবং বসু মানে সম্পদ, যে কারণে পৃথিবী হল বসুমতী, বুসন্ধরা, বা বসুধা। পুরাণের সব কাহিনীর মধ্যেই পাব সামাজিক সত্য এবং অন্য নানা স্তরের সত্য। ঠিক পথে পুরাণের চর্চায় এগোলে অনেক কিছু ধরা যায়। পুরাণের ভাষায় সূর্যবংশ মানে সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় পুঁজির সমর্থক, আর চন্দ্রবংশ বললে বোঝায় ব্যক্তিগত পুঁজির সমর্থক। দেবতার বর মানে বিশেষ (সামাজিক) শক্তির হাতে নির্বাচন বা বরণ, যার মানে এক সঙ্গে বেশ কিছু দায়িত্ব ও ক্ষমতা লাভ। সে-রকম ধনু মানে হল ষধ।ি অতএব হরধনু, ইন্দ্রঘনু, রামধনু বললে বোঝায় যথাক্রমে হর (বা মহাদেব), ইন্দ্র, এবং রামের আইন। লক্ষ্য করবেন রামধনুই সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করে মানুষকে। দেবাসুরের মিলিতভাবে সমুদ্রমন্থন মানে রাষ্ট্রীয় পুঁজি (অসুর) আর ব্যক্তিগত পুঁজি (দেবতা)  দুই মিলিতভাবে জনগণ (সমুদ্র)-কে দিয়ে ধন (= লক্ষ্মী ) উৎপাদন করছে। ব্যক্তিপুঁজির সঙ্গে মিলিয়ে দেখবেন সমুদ্রমন্থন কালে শত চাতুরী করছে দেবতারা। এবং দেবগুরু বৃহস্পতির পুত্র কচের তরফেই কি কম চাতুরী !
আমার অনেক অসম্পূর্ণতা সত্ত্বেও একটি জিনিস এতক্ষণ ধরে আপনাদের হাতে তুলে দিতে চেষ্টা করেছিলাম তা হল আমাদের ভাষা এবং সংস্কৃতি সম্বন্ধে যুক্তিগ্রাহ্য কিছু তত্ত্ব ও তথ্য। আশা করি আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতির অনন্যতা তথা আজকের দিনে এর উপযোগিতা নিয়ে মনে সংশয় থাকলে তা কিছুটা কেটে যাবে। ক্রিয়াভিত্তিক (বাংলা-সংস্কৃত) ভাষাকে বোঝার জন্য চাই ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থতত্ত্ব আর সেই তত্ত্বের প্রয়োগকে যাচাই করে নেওয়ার জন্য আমাদের ক্রিয়াভিত্তিক (বাংলা-সংস্কৃত) ভাষার চর্চা। কিন্তু তারপর ? একেবারে প্রথমেই আসে বিচ্ছিন্ন শব্দসমূহের প্রকৃত অর্থ উদ্ধার করা, আর তার পরেই আসে পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারত প্রভৃতির কাহিনীগুলির মর্মার্থ উদ্ধার করা। এই দু’টি কাজে হাত লাগানো এখনও বিপুল পরিমাণে বাকি আছে, এবং এর প্রতি পদক্ষেপে নানান অন্তরায়। বলে রাখা ভালো, বর্তমান পশ্চিমবঙ্গে, বিশেষত সরকারি জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রগুলেতি নতুন কথা শোনার লোক এখন খুবই কম। অধিকাংশই জাবর কাটায় বিশ্বাসী। বাংলাভাষীর হৃতগৌরব পুনরুদ্ধার করার কথা তাঁরা ভাবতে পারেন না।
সে যাই হোক, আরও যে-সব কাজ তার কথা বলছি। প্রথম, আমাদের যত প্রাচীন গ্রন্থ তার প্রতিটিকে ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থতত্ত্বের আলোয় নতুন করে অনুবাদ করে দেওয়ার প্রয়োজন। এটা আমাদের কাছে মানবসভ্যতার দাবি। এতদিন যে অনুবাদ চলছিল তা প্রায় সম্পূর্ণতই ভুল। যেমন জ্যেতিষশাস্ত্রের রাহু কেতুকে আক্ষরিক অর্থে দু’টি সড়হংঃবৎ বলে কল্পনার করা হত। এবং এই কারণেই আল বিরুনী খেদ করেছিলেন যে, হিন্দুস্থানের বিজ্ঞানীদের অসামান্য তত্ত্বজ্ঞানের সঙ্গে আজগুবি গল্প মিশিয়ে দেওয়ার দুর্বুদ্ধি যে কেন হয় ! এখানেও আল বিরুনীর অভিযোগরে নিষ্পত্তি করতে হবে তো ! তার ওপর আমাদের পুরাণকাহিনী তথা ভাষার থেকে কি নির্দেশ পেতে পারি সেটাও দেখা দরকার। সমাজের অবতরণের পথ জানা থাকলে উত্তরণের হদিশ মিলবে, এমন তো আশা করা যায়। একটা উদাহরণ দিতে ইচ্ছে হয়। ওদের ঢ়যরষড়ংড়ঢ়যু (ষড়াব ড়ভ রিংফড়স) থেকে আমাদের ‘দর্শন’ শব্দটি সমৃদ্ধতর, কিন্তু আমাদের ‘অধ্যাত্মবিদ্যা’ তো আরও মহান। অধ্যাত্মবিদ্যায় সব কর্ম, এবং সব জ্ঞানের আদিতে এবং অন্তে যে ‘আত্ম’কে আনে, এটা বৃথা নয়। গীতার ‘আত্মানং বিদ্ধি’ আর প্রাচীন গ্রীসের ‘কহড়ি ঞযুংবষভ’  দু’জায়গাতেই পাচ্ছি প্রকৃষ্ট প্রজ্ঞার নির্দেশ। এটির সমর্থন বিজ্ঞানের শীর্ষদেশেও পাই।
যে শব্দার্থতত্ত্বের চাবি দিয়ে আমাদের ভাষাসম্পদের অতি অল্প কিছুটা উদ্ঘাটন করলাম, তা দিয়ে অনেক বিদ্যাতেই নতুন সৃষ্টি সম্ভব হয় এবং হয়তো-বা সভ্যতার রূপান্তরে তারা পরিণতি পায়। তবে সব কাজেরই সমাপ্তি আছে, এ আলাপ-সংলাপেরও ইতি টানতে হয়। বিদায় নেওয়ার আগে পত্রপ্রবন্ধের শিরোনামের দিকে আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করি। আর কোনো কারণে ণয়, শুধু আমাদের ভাষার সূক্ষ্মতার কথা আর একবার দেখাবার জন্য।
শিরোনামে আছে ‘কী করে’ এবং ‘কী ভাবে’। জানি না, এ দু’টিকে আপনার সমার্থক মনে হয় কি না, ইংরেজি যড়ি এবং রহ যিধঃ সধহহবৎ-এর মতো। কিন্তু প্রকৃতই এ শব্দগুলো তা নয়। ‘ভাবে’ শব্দটিতে বোঝায় ভবের (বা হওয়নের) নিয়ম বা রীতিনীতি, আপনি নিজে কেমন হয়েছেন, আপনার নিজেকে কেমন হতে হবে ইত্যাদি  সেজন্য আমরা বলি ‘ধীরস্থিরভাবে’, ‘অস্থিরভাবে’, ‘গম্ভীরভাবে’, ‘শুদ্ধভাবে’ ইত্যাদি। কিন্তু ‘কী করে’ বললে বোঝায় কি কি কাজ সম্পন্ন করে, কি কি কাজের মধ্য দিয়ে ইত্যাদি। এখানে দু’টোর কথাই বললাম। যে কোনো কাজ করতে গেলেই তো আগে কিছু কিছু কাজ করে নিতে হয়, আর সেই সঙ্গে নিজেকেও তো কাজের জন্য তৈরি করে নিতে হয়।



পাদটীকা
১। ঐঁনৎরং = সাফল্যজাত বেপরোয়া ভাব, রহংড়ষবহপব ড়ভ ঃৎরঁসঢ়য.
২। ঐধসধৎঃরধ = ঃৎধমরপ বৎৎড়ৎ, ট্র্যাজেডি-সংঘটক সীমালঙ্ঘন।
৩। ঝড়ঢ়যৎড়ংুহব = অপ্রমাদী ন্যায়চরণ।
৪। ঘবসবংরং = প্রত্যাবৃত্ত ন্যায়দণ্ড।
৫। এ-বিষয়ে আমাদের বেশ কয়েকটি গ্রন্থ ও অনেকগুলি নিবন্ধ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছ। আগ্রহী পাঠক তা দেখে নিতে পারেন।
৬। জল, নীর বা কর (= ঃধী) দানকারীকে বলা হয় যথাক্রমে জলদ, নীরদ, করদ। আবার ‘প’ সূচীত করে পান/পানকারী অথবা পালন/পালনকারীকে। সেই সূত্রে ‘ভূ’ ও ‘নৃ’ পালসকারী যথাক্রমে ভূপ এবং নৃপ, আর মধুপানকারী হল মধুপ। সুতরাং যে বা যাহা পান/পালন করে, তাকেই পদ বলা যায়। এ-বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা নীচের ৭ নম্বর পাদটীকায় উল্লেখিত গ্রন্থের বিভিন্ন প্রবন্ধে রয়েছে।
৭। কলিম খান ও আমার লেখা যৌথ গ্রন্থ ‘বাংলাভাষা ঃ প্রাচ্যের সম্পদ ও রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থে এ-বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
৮। কাশ-এর, অর্থাৎ আমরা যত কথা বলি তার, আধার হল আকাশ। মানুষের চিন্তার সকল প্র‘কাশ’ গিয়ে গড়ে তোলে মানবমনের আকাশ বা চিদাকাশ। এক-কথায় একে সংস্কৃতিও বলা যায়। এই ‘আকাশ’ তাই দৃশ্য ংশুটিকে যেমন বোঝায়, তেমনি মানুষের মনোলোকের আচ্ছাদনটিকেও বোঝায়। এবং বলতে কি, সেকালে প্রধানত সেই চিদাকাশকে বোঝাতেই বাংলায় ‘আকাশ’ শব্দের ব্যবহার হত। আর সেজন্যই আজও ‘আকাশ ভেঙে পড়া’ শব্দবদ্ধটি বাংলাভাষায় নির্বিবাদে প্রচলিত আছে। কারণ মূর্খেও জানে, ংশু কখনো মানুষের মাথায় ভেঙে পড়ে না। যেটা কখনো কখনো ভেঙে পড়ে সেটা মানুষের চিদাকাশ। বলে রাখা ভালো, ইসলাম যখন এদেশে আসে তখন আমাদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েনি, কারণ তাঁরা আমাদের একই আকাশের অন্য দিগন্তের বাসিন্দা ছিলেন। তাই তাঁরাও আমাদের বুঝতে খুব বেশি অসুবিধা বোধ করেননি, আমাদেরও অসুবিধা হয়নি। কিন্তু ইউরোপ ছিল ইসলামী আকাশের শেষ দিগন্তের বাসিন্দা। তাকে আরব-প্রভাবিত ইসলাম খানিকটা বুঝলেও আমাদের বাংলাভাষী হিন্দু-মুসলিমের পক্ষে সে ছিল একেবারেই অন্য জগতের লোক। তাই সেও যেমন আমাদের বুঝতে পারেনি, আমাদের নিজস্ব আকাশের তলায় বাস করে আমাদের পক্ষেও তাকে বোঝা দুঃসাধ্য ছিল। একমাত্র উপায় ছিল আমাদের নিজেদের আকাশটিকেই জলাঞ্জলি দেওয়া। রামমোহনের হাত ধরে আধুনিক বাঙালি তাই করেছিল।
৯। পরিস্থিতিটি অনেকটা মুদ্রাস্ফীতির মতন। বাজারে বেশি মুদ্রা বা হড়ঃব ছাড়া আছে, কিন্তু তাদের ক্রয়ক্ষমতা ক্ষীয়মান।
১০। দ্রষ্টব্য ঃ ঐ গ্রন্থের রূপতত্ত্ব ৩.০৯২ [৩]
১১। উপরোক্ত ‘বাংলাভাষা ঃ প্রাচ্যের সম্পদ ও রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থটিতে এ-বিষয়ের বিস্তারিত ব্যাখ্যা রয়েছে।
১২। উবলবপঃরড়হ: ধহ ঙফব.
১৩। ঊষবমরধপ ঝঃধহুধং, ংঁমমবংঃবফ নু ধ চরপঃঁৎব ড়ভ চববষব ঈধংঃষব.
১৪। ঞবসঢ়বংঃ ওঠ.র.১৪৮ .
১৫। অ ঝযড়ৎঃ ঐরংঃড়ৎু ড়ভ খরহমঁরংঃরপং: ঈযধঢ়ঃবৎ ংরী : জ. ঐ. জড়নরহং.
১৬। ‘ভাষাতত্ত্বের নতুন দিগন্ত ও প্রকল্পিত আর্য-আগমনতত্ত্ব / বাংলাভাষা ঃ প্রাচ্যের সম্পদ ও রবীন্দ্রনাথ / কলিম খান ও রবি চক্রবর্তী।

রবিবার, ১ নভেম্বর, ২০০৯

একটি সারস ও কতিপয় ডেভোলাপার

আহমদ মিনহাজ

সেকালের একাল

ঘটনার সূত্রপাত এক অতি উষ্ণ ও দীর্ঘ শরৎকালে; ব্যস্ত শহরের মাঝখানে জলা-জঙ্গলা ও ডোবা নিয়ে দলছুট এক পুরনো বাড়িতে। বাড়ির একমাত্র স্থায়ী বাসিন্দা বলতে ছিলো একজন কেয়াটেকার। নদীভাঙনে সর্বস্বান্ত কেয়ারটেকার কবে এ-বাড়ির পত্তনীদারের কাছে আশ্রয় ভিক্ষা করে তার সঠিক দিনক্ষণ আজ আর উদ্ধারের উপায় নেই। নদী-খাল-জলা-জঙ্গলা ঠেলে চুন-সুড়কির এই বাড়িটি যেদিন আবিভূর্ত হয় সেদিন অনেকে অবাক হয়েছিলেন। এরকম অনাবাসিক জায়গায় আবাসিক দর-দালান সেকালের রুচিবোধে অবাক-করা খামখেয়াল-ই বটে। মানুষের হাতে ছিল অঢেল অবসর আর শহরটি ছিল নিরিবিলি। নিরিবিলি শহরে সময়ের একটি মাত্রাহীন ছন্দ বা প্রসারণ থাকে। বাইরে থেকে দেখলে মনে হয় সবকিছু স্থবির হয়ে আছে, কিছু যেন এগুচ্ছে না! কিন্তু দৃশ্যমান সে স্থবিরতার মাঝে শহর তার নিজস্ব ছন্দ-তালে জাগে বা ঘুমায়। এই কাহিনীর শহর সেদিক থেকে ব্যতিক্রম ছিল না। ময়লাটানার ছ্যাকরাগাড়ির শব্দে ঘুম ভাঙতো তার। অতঃপর সারা সকাল শহরটির বুক জুড়ে চলতো অফিসমুখী কেরানি, ভুঁষিমালের আড়তদার আর গৃহিনীদের ব্যস্ত কলরব। সেই কলরব ছাপিয়ে কাকের কর্কশ চিৎকার কানে এলে বোঝা যেতো দুপুর পার হতে চলেছে। দিনের সাংসারিক কাজকর্মে সাময়িক ছেদ টেনে মহিলারা বালিশে মাথা এলিয়ে দিতেন। আধো তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় বিমল মিত্রের নভেল খুলে বসতেন অনেকে। কেউ-বা রেডিওয় শ্র“তিনাটক শুনতে-শুনতে উদাস হয়ে যেতেন, ভাতঘুমের আলস্যে তাদের চোখ বুজে আসতো। অলস-মন্থর প্রবাহে ছেদ ঘটতো ফেরিওয়ালার আবির্ভাবে। ‘লেইসফিতা লেইস’-এর আকস্মিক হাকডাকে চোখের ঘুম কচলে গৃহিনীরা সবাক হয়ে উঠতেন। শাড়ি ও রঙিন চুড়ির বাহারে দুপুরকে রঙিন করে ফেরিওয়ালারা বিদায় নেবার পর বাচ্চাবয়সী ছেলেছোকরার দল নেমে পড়তো খেলার মাঠে। অবসরী বৃদ্ধ ও বাড়ির বয়স্ক মহিলারা দল বেঁধে বৈকালিক ভ্রমণে বেরোতেন। সংসারের রকমারি গল্পগাছার মধ্যে কর্তার আগমন টের পেলে বাড়ির পথ ধরতেন তারা। ম্যাজিক ল্যাম্পের মতো রাস্তার আলোগুলো জ্বলতে শুরু করতো! ঘরের মহিলারা বাচ্চাদের নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়তেন কিংবা দুপুরের বাসি রান্নার মেরামতি চলতো খাবারঘরে। শহরটি তার অবসরী বৃদ্ধের দলকে বৈঠকখানায় আরো কিছুটা সময় তাস পেটানো ও দেশ-দুনিয়ার হাল-হকিকত যাচাইয়ে ব্যস্ত রাখতো। রাত ক্রমে নিবিড় হলে বোঝা যেতো খাবারঘরে জড়ো হওয়ার সময় হলো বটে। বাড়ির-পর-বাড়ি নিভতে আরম্ভ করলে রাস্তার বাতিগুলো ন্যাংটো চাঁদের সাথে পাল্লা দিয়ে জুল-জুল চোখে রাত্রি শেষের অপেক্ষা করতো।
মানুষ ঘুমিয়ে গেলে শহর নাকি ঘুমিয়ে পড়ে। এই নিয়মকে গাঢ় করার জন্য নিরিবিলি শহরটি রাস্তায় বিচরণরত নেড়ি কুকুর ও ভাসমান রাতপাখিদের হাতে শহর পাহারার দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে ঘুমের দেশে তলিয়ে যেতো। সেকালের শহর একালের মহানগরীর মতো নির্ঘুম রাত কাটাতে অভ্যস্ত ছিল না। যখন-তখন তার ঘুম পেতো! পঞ্চমীর চাঁদ মেঘকালো আকাশে ডুবে যাবার আগে ঘুমের তোড়জোর শুরু করে দিতো সে। নেড়ি কুকর ও রাতপাখির ইতঃস্তত সঞ্চালনের মধ্য ধীরলয়ে চলতো সেই ছন্দহীন প্রসারণ। একালের মহানগরীর দূরবীন দিয়ে দেখলে সেকালের ছন্দহীন প্রসারণকে স্থবিরতার কুম্ভীপাকে জারিত মনে হওয়া স্বাভাবিক, কিন্তু যারা এর ভেতরে বসে দিন গুজরান করতেন তারা সেটি টের পেতেন না। সেকালে শহুরে জীবন ছিল স্রোতহীন নদীর মতো,-নিস্তরঙ্গ প্রবাহে তার জলরাশিকে বইতে দিতো সে।

ছন্দহীন এই প্রসারণের মাঝে চুন-সুড়কির বাড়িটি ছিল বেখাপ্পারকম বিদঘুটে। নিঃসঙ্গ প্রহরীর মতো একা জেগে থাকতো সারাদিন। বুনো গাছ-গাছালি ও পশুপক্ষির ভিড় ঠেলে তার পথে যাওয়া-আসা সহজ ছিল না। অনেকে ভয় পেতো। ডানপিঠে বালকের দলে বাড়িটি নিয়ে ভীতি ও রোমাঞ্চের শেষ ছিল না। রূপকথার বোতলবন্দি রাক্ষসের মতো এই বাড়ি তাদের সম্মোহিত করে রেখেছিল। যতোদিন-না তাদের মুখে দাড়ি-গোঁফ গজায়, তারা ভেবেছিল বাড়ির মালিক হচ্ছে বোতলবন্দি রাক্ষসের সহোদর; যে দিনের বেলা মায়াবী বেশ ধরে থাকে আর রাতে মানুষের নরম হাড় চিবিয়ে পেটের খিদে মেটায়! দাড়ি-গোঁফ গজালে পরে বাল্যকালের কল্পনার বহর মনে করে হাসি পেলেও তাদের গোঁফের রেখায় অজানা সব ভীতির রেশ অবিরাম উঁকি মেরে যেতো। সন্ধ্যা নামলে বয়স্ক পথচারীরা বুনো পশু-পক্ষীতে ভরা চিড়িয়াখানাটিকে তাই সযতনে এড়িয়ে চলতেন।

শহরের বুড়োধারী বাসিন্দাদের দিনলিপিতে বাড়ির পত্তনীদারকে নিয়ে জল্পনা-কল্পনার বিরাম ছিল না। আজগুবি কেচ্ছা-কাহিনীর রাজত্বে বাচ্চাদের সাথে বড়োরাও সমানতালে পাল্লা দিতেন বলে প্রেতের মতো নিজেকে পাহারা দিয়ে রাখা ছাড়া অতিকায় বাড়িটির বিশেষ কোনো সামাজিক স্বীকৃতি ছিল না। পত্তনীদার অবশ্য একে আমলে নিতেন না। সামাজিকতার শর্ত উপেক্ষা করার মতো কব্জি ও মনের জোর তার ছিল। কব্জির জোরকে মানুষ ভয় পায় আর মনের জোরকে সমীহ করে। তবে এ হলো বাইরের ঘটনা। ভেতরে কিন্তু অন্য খেলা চলে। শর্ত অম্যানকারীর প্রতি মন নিজের অজান্তে বিরূপ হয়ে ওঠে। তার সম্পর্কে সুশীল কিছু ভাবতে পারে না সে আর জল্পনা-কল্পনার পরিধি বাড়তেই থাকে। যে-কারণে পত্তনীদারের ওপর শহরের বাসিন্দারা মোটেও প্রসন্ন ছিলেন না। জল্পনা চালু ছিল যে লোকটি তার পূর্ব-পুরুষদের মতো ছিটগ্রস্ত, তার ওপর জিনের আছর আছে এবং রাত হলে বাড়িটি জিনের আড্ডাখানায় পরিণত হয়। নদী ও জঙ্গলে প্যাঁচ খাওয়া বাড়ির অতীত স্মরণ করে শহরের বাসিন্দারা শিহরিত হতেন। ভীতি ও আক্রোশের দমবন্ধ অনুভূতি তাদের চেতনাকে অসাড় করে দিতো। তারা তখন পত্তনীদারকে ভুলে যেতে চাইতেন। এইসব গালগল্পের সত্যমিথ্যা নিয়ে কারো কোনো মাথাব্যথা ছিল না। অ-নিরীক্ষিত গালগল্প মনে যেসব ভীতি সঞ্চার করে তা কাটিয়ে উঠার মতো সাহসী মানুষের আকাল সে-যুগেও ছিল! সাপ-বেজির দৌরাত্ম খতম করে বাড়ির চারধার আবাদ করার সাহস তাই সেকালে কারোর হয়নি।

‘অনাবাদি বনে নলখাগড়া সম্রাট’,-এই রীতি বজায় ছিল, যতোদিন-না জানা গেলো যে পৃথিবীতে দুর্গম বলে কিছু নেই! কিন্তু সে অনেক পরের কাহিনী! অদূর ভবিষ্যতে এই বাড়ি আবাদ করার জন্য যারা উঠেপড়ে লাগবেন তারা তখনো মা’য়ের কোলে বসে দোল খাচ্ছেন। আমরা যে-সময়ের বিবরণ লিখতে বসেছি তখন পৃথিবীর দুর্গমতা নিয়ে মানুষের মনের বিস্ময় কাটেনি। মনের দিক দিয়ে সে তখনো খানিকটা আদিম ও যাযাবর ছিল। সেকালের শহুরে লোকজন চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে নিমিষে আদিম ও অপ্রাকৃত হয়ে উঠতে পারতেন। তাদের চোখের কোণে লেগে থাকতো ভয় ও অভিশাপের বিভূতি। তারা বিশ্বাস করতেন :-

পৃথিবী একটি দুর্গম বনাঞ্চল! ঈশ্বর এই বনাঞ্চলকে আলো-অন্ধকার মিশিয়ে তৈরি করেছেন। রবিকিরণ সেখানে সমভাবে কিংবা আদৌ পৌঁছতে পারে না। আর আলো যেখানে পৌঁছায় না সেখানে সরীসৃপরা বসত করে,-মানুষ নয়। মানুষ আলো ও অমৃতের সন্তান। কিন্তু সরীসৃপের জন্ম অমানিশা বা রাত্রির গর্ভে। বসতির অর্থ-ই হচ্ছে বনাঞ্চলকে অদৃশ্য করে মানুষ যেখানে জন্ম নিবে,-যা তাকে আলো ও শহরের দিকে প্রসারিত করবে। রবিকিরণের আশীর্বাদ-বঞ্চিত বনাঞ্চল তাই ঈশ্বরের বিধানে পতিত বা অনাবাদি গণ্য হয়। এই পতিতকে যে আবাদ করেছে সে সরীসৃপের নিয়তি গ্রহণ করেছে! হয়তো-বা সে কোনো প্রেত! সময় হলে ঈশ্বর যাকে তার পাওনা বুঝিয়ে দেবেন!

আমরা যে পত্তনীদারের বিবরণ লিখছি তিনি এমন এক অন্ধকারকে আবাদ করেছিলেন যার প্রতি লোকের বিশ্বাস দৃঢ় ছিল না। শহরের নাভিমূলে নদী, বন-জঙ্গলে ঘেরা চরটিকে সেকালের লোকজন ভীতিকর এক অমাবস্যা হিসাবে ভাবতে সুখ বোধ বোধ করতো। চরের দুর্গম মাটিকে ভবিষ্যতের মস্ত সুযোগ হিসাবে মাপজোক করার দূরদৃষ্টি তাদের ছিল না। শহরটি তখনো বিস্তর খালি জায়গা-জমি নিয়ে পতিত পড়ে ছিল। পতিত মাটির টুকরোগুলি সূর্যকিরণের আশীর্বাদে আলোকিত ছিল বটে। সহজে আবাদ করার মতো ভূমি সুলভ হলে দুর্গম নিয়ে কে আর ভাবে! সুতরাং পত্তনীদার ঠিক কী ভেবে খাল-নদী সাঁতরে দুর্গম চরে উঠে এলেন তার ইতিহাস উদ্ঘাটনের ইচ্ছা কারো হয়নি। পতিত চরটি আসলে প্রয়োজনীয় মুহূর্তের অপেক্ষায় ছিল। কারণ মানুষ প্রয়োজন ও খেয়ালী পশুর সহোদর। আজ যাকে অনাবাদি গণ্য করে সে মুখ ফিরিয়ে আছে, প্রয়োজন ও খেয়ালের তাড়নায় সেখানে তার পা পড়বে না এমন দিব্যি কেউ দিতে পারে না। সুতরাং চুন-সুড়কির বাড়িটি নিশ্চিন্ত মনে তার মালিককে নিয়ে একটি উর্বর আবাদের অপেক্ষায় জাবর কাটছিল।
সেকাল

২.
সেকালে মুরুব্বিরা বলতেন ‘আবাদে পত্তনী’। সঙ্গে অবশ্য এ-কথাটি জুড়ে দিতেন,-‘আবাদের মতো আবাদ যদি হয় সন্ততির দুঃখ ঘুচে বিধাতার আলোয়’। অর্থাৎ তারা বুঝাতে চাইতেন যেনোতেনোভাবে আবাদ করলেই হয় না। ভাগ্যবিধাতার সুদৃষ্টি-বঞ্চিত আবাদকারী আসলে অভিশপ্ত। আবাদ তাকে সাময়িক মেনে নিলেও তা চিরস্থায়ী হতে পারে না। কারণ আবাদকারীর সন্ততি সে-মাটির ভাগ পায় না। আবাদকারীর হাত ঘুরে সন্ততি যেদিন মাটির ভাগ পায়, তার করতল গলে মাটিরা বেরিয়ে যায়। সেকালের প্রবীণরা একে বিধাতার অভিশাপ বলে মানতেন। অতীতের রাজা-রাজড়া ও জমিদারের উদাহরণ টেনে তারা বুঝাতে চাইতেন মাটি কোনো চিরস্থায়ী সামগ্রী নয়, তার হাত-বদল হয় এবং সে অবিরাম স্থানান্তরিত হয়ে চলে। যে-মাটি জন-থেকে-পরিজনে ঘুরে সন্ততির দাবি পূরণ করে সেই মাটি বিশ্বাসী। আবাদকারীর বংশধরকে সে ছেড়ে যেতে চায় না। সেকালে প্রবীণরা বিশ্বাস করতেন মানুষের মতো মাটির-ও নানা স্বভাব-চরিত্র রয়েছে। কিছু মাটি বিশ্বাসী, কারণ তারা পোষ মানে এবং জন্ম-জন্ম ধরে আবাদ হয়ে চলে; কিছু বন্য ও অবিশ্বাসী, কেননা তা আবাদি থেকে ফের অনাবাদি বা পতিত হয়ে পড়ে; আর এমন মাটি রয়েছে যাকে আবাদ করার কথা এক শয়তান ছাড়া অন্য কেউ ভাবে না, কেননা ঐ মাটি বৃক্ষ ও পশুকুলের ঝাড় নিয়ে জন্মাবধি হিংস্র ও অন্ধকার রয়ে যায়। ইতিহাসের খেরো খাতা অসংখ্য মাটি আবাদের বিবরণ প্রদান করলেও আমরা যে বাড়ির বিবরণ লিপিবদ্ধ করছি সেকালে তাকে শয়তানের স্বগোত্র ভাবতেন সবাই।

শুভ-অশুভের এইসব সেকেলে টানাপোড়েন থেকে বোঝা যায় মানুষের ইতিবৃত্ত লেখা হয় তার মাটির ইতিবৃত্ত দিয়ে। মায়ের গর্ভে বসে সে মাটি খায়। গর্ভ থেকে বেরিয়ে ওই মাটির গন্ধ শুঁকে তার দিন কাটে এবং অবশেষে একদিন কবরের স্থবির মাটির তালে তার সমাধি হয়। প্রবীণরা মনে করতেন পত্তনীদার যেহেতু শয়তানের সাথে হাত মিলিয়েছেন অন্তিমকালে তার এই আবাদকরা মাটি তাকে গছবে না, যদি-বা গ্রহণ করে পরিণাম সুখকর হবে না। মনের মাঝে ভয়, সমীহ ও বিরূপতার এক মিশ্র আবহ নিয়ে তার সেই পরিণতি দেখবার জন্য সকলে প্রতীক্ষা করতেন।

৩.
আবাদি মাটি কেবল বসতির পত্তন করে না, বসতিকে ঘিরে নতুন গ্রাম-নগর ওঠায়; এভাবে অজপাড়াগাঁ থেকে মফস্বল কিংবা মফস্বল থেকে মহানগরের পত্তন হয়। তবে এই সিঁড়ি বেয়ে ওঠার জন্য বিশ্বাসী বা পোষমানা মাটি চাই। ভূগোলে নাকি লেখে পৃথিবীর তিন ভাগ জল আর এক ভাগ স্থল। জলের সাগর গ্রাস করে ডাঙ্গার বিস্তার ঘটাতে হলে এমন মাটি চাই বন-জঙ্গল অদৃশ্য করে যাকে আলোকিত করা সম্ভব; এবং যে-মাটি কোনো শর্ত ছাড়া তার আবাদকারীর বশীভূত হবে। আমরা যে শহরের কাহিনী বয়ান করছি তার বুক চিরে নদী-হাওরের উত্তাল তরঙ্গ বইলেও নরম মাটির পাহাড় ঠেলে অধিক বাড়েনি সে। স্বভাব-চরিত্রে খানিক অবাধ্য ওই শহরের মাটি তার সোদর-আত্মীয়দের মতো পোষমানা পায়রা নয়। ইতিহাস বলে গঙ্গা নদী সাঁতরে জোব চার্নক একদিন এক খণ্ড ডাঙ্গা পেয়েছিল। গুটিকয় বসতি নিয়ে সুতানটি নামের ডাঙ্গাটি পোষ মানবে বলে সাহসী আগন্তুকের অপেক্ষায় ছিল। সুতানটি আজ কলকাতা নামে বিদিত বটে! বিলের সাগর ঢাকা একদিন কোনো এক জোব চার্নকের অপেক্ষায় ছিল নিশ্চয়। নদী-বিলের বেষ্টনি ঠেলে যে আসবে তাকে অভ্যর্থনা করার মতো মানব কি ছিল তখন? নাকি সে বা তার সঙ্গী-সাথীরাই ছিল প্রথম মানব? বুড়িগঙ্গার জলরাশি কি তাদের বিপাকে ফেলেছিল? নাকি ওই জলপ্রবাহের তোড়ে ভেসে তারা ঢুকে পড়েছিল আরো ভেতরে,-খাল-বিল-জঙ্গলার অথই সায়রে? এইসব কৌতূহলের জবাব শীতলক্ষ্যা, বুড়িগঙ্গার ম্রিয়মান জলরাশি গুনে কেউ দিয়েছে হয়তো। খানিক দূরবর্তী রাক্ষুসী পদ্মা এবং অথই জলের সায়রে বিস্তীর্ণ যমুনা ও মেঘনার অতল তরঙ্গরাশি হয়তো-বা ধরে রেখেছে ডাকাবুকো সেইসব আবাদির ইতিকথা!

নরম মাটির শহরটি দীর্ঘদিন তার নিজের ভেতরে দুর্ভেদ্য ও সুরক্ষিত ছিল। দীর্ঘতমা নদী ও ঘন অরণ্যানির ফাঁক গলে দাপুটে রাজা-রাজড়া সেখানে উঁকিঝুকি মারলেও নিজেকে সুরক্ষিত রাখার জাদুপ্রবাহে তার কিংবদন্তির কোনো শেষ ছিল না। বসতীটি একদা কামরূপ-কামাখ্যা নামে বিদিত ছিল বটে। সর্পিল জাদুপ্রবাহের রহস্যময় প্রহেলিকা দিয়ে পুরো নগরীকে বশীভূত করে রেখেছিল সে। ভিনদেশী আগন্তুকের কাছে অপার উৎকণ্ঠা ও রোমাঞ্চের দেশ হিসাবে তার কিংবদন্তি সেদিন অব্দি অক্ষুণœ ছিল। কোনো কিংবদন্তি চিরস্থায়ী হয় না! মানুষের অভিযান ও আবিষ্কার কিংবদন্তিকে নগ্ন করে ফ্যালে। শহরটির খ্যাতি সেদিন ফুরিয়ে এলো যেদিন একদল সাদা জোব্বাধারী বহিরাগত অতর্কিতভাবে তার ভেতরে ঢুকে পড়লেন। শরৎকালের এক অতি উষ্ণ ও দীর্ঘ দিনে বহিরাগতরা কামাখ্যা নগরীতে ঢুকলেন। বৃষ্টির অভাবে নগরটি তখন রুখু-সুখু হয়ে পড়েছে। উষ্ণতার কারণে রাস্তাঘাট ছিল একদম ফাঁকা। সুদৃশ্য একটি প্রস্তরখণ্ডের সামনে জোব্বাধারীদের আরবি ঘোড়াগুলি দম নিলো সেদিন। প্রস্তরখণ্ডটি ছিল নগরে ঢোকার প্রধান প্রবেশচিহ্ন। এটিকে ঘিরে চৌরাস্তার মতো আবর্ত তৈরি হওয়ায় ঘোড়াগুলো ঠিক কোনদিকে এগুনো সমীচীন হবে তা বুঝে উঠতে পারছিল না। জোব্বাধারী বহিরাগতদের দলপতি চটপট তার ঘোড়া থেকে নামলেন এবং ‘হট যাও’ বলে প্রস্তরখণ্ডে পদাঘাত করলেন। মাটির গভীরে ডেবে বসা পাথর এতে নড়ে উঠলো। দলপতি পুনরায় আরেকটি লাথি কষাতেই প্রস্তরখণ্ড নগরীর বসতি ও অট্টালিকারা যেদিকে সারি বেঁধে এগিয়েছে সেদিকপানে গড়াতে শুরু করলো। বহিরাগত অশ্বারোহীরা অগত্যা পাথরের বিরাট চাঙরটিকে অনুসরণ উত্তম বিবেচনা করে তাদের ঘোড়ায় চাবুক পেটালেন।

পাথর গড়ানোর গরগর আওয়াজে নগরটি তখন রীতিমতো কাঁপছে। উষ্ণতার কারণে ঘোড়াগুলোর শরীর থেকে ঘাম ঝরছিল। তাদের ঘাম-চিকচিক শরীরে সূর্যকিরণ ঠিকরে পড়ে অতিকায় সব দ্যুতি দিচ্ছিলো। প্রস্তরখণ্ডটি একটি বিরাট অট্টালিকার সমুখে এসে স্থির হলো। ‘ঠেরো’-জলদগম্ভীর স্বরে কে যেন চিৎকার দিয়ে উঠলো সে-সময়। অতঃপর জোব্বাধারী বহিরাগতদের চোখমুখ ধাঁধিয়ে দিয়ে সুদর্শন এক রাজপুরুষ বেরিয়ে এলেন। জড়ি-চুমকি বসানো পোশাকের সাথে টকটকে লাল মুখমণ্ডলে তাকে দারুণ জাদুকরী লাগছিল। বহিরাগত জোব্বাধারীরা বুঝতে পারলেন এই জাদুকরটিকে শায়েস্তা করার জন্য দুর্গম এই পথ তারা পাড়ি দিয়ে এসেছেন। একটি বিষধর সর্প রাজপুরুষের হাতটিকে স্বর্ণলতার মতো প্যাঁচিয়ে রয়েছে দেখে অশ্বারোহী অগন্তুকরা ক্ষণিক বিস্ময়ে বোবা হয়ে গেলেন। সাপটি তার সরু জিহ্বা বের করে নবাগত অতিথিদের নিরিখ করছিল। এই অঞ্চলের বিষধর সাপের খ্যাতি সম্পর্কে বহিরাগতরা আগে থাকতে-ই অবগত। রাজপুরুষ কালবিলম্ব না করে সাপটি মাটিতে ছেড়ে দিলেন। জোব্বাধারীরা বাকহীন বিস্ময়ে লক্ষ করলো শুধু রাজপুরুষ নয়, তাকে ঘিরে দাঁড়ানো আমত্য-পরিষদ থেকে শুরু করে তীর-ধনুকে সজ্জিত পদাতিক প্রত্যেকের হাতে একটি করে সাপের ঝুড়ি ও গলায় বিষধর সাপ ঝুলছে। রাজকেউটে মাটিতে নামার পর বাকিরা তাকে অনুসরণ করলো। অট্টালিকার বাইরের চওড়া রাস্তা, তার পাশের বিরাট ময়দান নিমেষে সাপ, ঘোড়া ও অশ্বারোহী জোব্বাধারীদের রণক্ষেত্রে পরিণত হলো। রাজপুরুষের অভিনব ব্যুহ ভেদ করার জন্য বহিরাগতরা ততক্ষণে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। তেজি অশ্বের লাগাম টেনে তারা মাটিতে নেমে পড়লেন। ওদিকে রাজপুরুষের অনুগত সৈন্যবাহিনী বৃষ্টির মতো তীর ছুঁড়ছিল। সাপের হিসহিসানি ও বিষমাখা তীরের অবিরাম বর্ষণ পুরো যুদ্ধক্ষেত্রটিকে নারকীয় করে তুলেছিল। হাতের ঢাল দিয়ে তীরের আক্রমণ ঠেকানো গেলেও জোব্বাধারীদের অনেকে কেউটের ছোবল খেয়ে মাটিতে শুয়ে পড়লেন। সাপ তাদের জোব্বা গলে শরীরের ভেতরে ঢুকে বিষ ঢালছিল। আরবি ঘোড়াগুলো সাপের তাড়া সইতে না-পেরে দিকহারা উদভ্রান্তের মতো গগনবিদারী আওয়াজ ছাড়তে লাগলো।

সাপ ও তীরের অভিনব এই আক্রমণ সামাল দেয়ার কালে জোব্বাধারী বহিরাগতদের দলপতি দেখলেন রাজপুরুষ তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসছেন। দলপতির কাছে হাসিটিকে বড়ো রহস্যময় মনে হলো। কারণ সেখানে শত্র“র প্রতি দাক্ষিণ্য বা আক্রোশের পরিবর্তে গভীর এক বিষাদ লেপ্টানো ছিল। দলপতিকে অবাক করে দিয়ে হাসির মালিক এইবার মাটিতে লুটিয়ে পড়ে কাতরাতে আরম্ভ করলেন। নারকীয় বিশৃঙ্খলার মধ্যে দলপতি নিজের ঘোড়াটিকে রাজপুরুষের অভিমুখে ছুটালেন। ছুটন্ত অশ্বে বসে তীর ও কেউটের আক্রমণ সামাল দিতে-দিতে তিনি দেখলেন রাজপুরুষের পা থেকে কোমর অবধি লেজের মতো সরু ও পিচ্ছিল আর কোমর থেকে মাথা অবধি অংশটি চাকা-চাকা দাগে ছেয়ে যেতে শুরু করেছে, তার উন্নত নাসিকা ও আয়াত চক্ষু সরু হয়ে মুখমণ্ডলকে প্রায় গ্রাস করে এনেছিল। দলপতি যখন অশ্বের লাগাম ধরে টান দিলেন, অতিকায় এক বিষধর নিজের সরু জিহ্বাটি বের করে ছোবল তোলার অপেক্ষায় ফণা নাচাচ্ছে। দলপতি বিদ্যুৎগতিতে তার দক্ষিণ বাহুটি প্রসারিত করে বিষধরের গলা চেপে ধরলেন। তার হাতের কঠিন চাপে বিষধরের শ্বাসরোধ হওয়ার উপক্রম হলো। প্রচণ্ড আক্রোশে মাটিতে লেজ আছড়াতে শুরু করলো সে। দলপতি কম্পিত হলেন না, বরং ‘হট যাও’ বলে আবারো হুংকার ছাড়লেন। যুদ্ধরত সৈন্যরা সেই হুংকারের গমকে কেঁপে উঠলো। সৈন্যকুলকে কয়েক মুহূর্তের জন্য বিমূঢ় করে দিয়ে তিনি তার পায়ের কাছে পড়ে থাকা অতিকায় লোহার খাঁচাটি খুললেন। বিষধর তখনো তীব্র আক্রোশে মাটিতে লেজ আছড়েই চলেছে। বিষধরটিকে খাঁচার মধ্যে পুরে এর ঢাকনাটি বন্ধ করে দিলেন তিনি। একটা গগনবিদারী আওয়াজ উঠলো চারদিকে। মনে হলো মাটি দু’ফাঁক হয়ে যাবে। আরবি ঘোড়ার ক্ষুরের চাপে বিষধর কেউটেরা তাদের থ্যাঁতলানো ফণা নিয়ে সর্পিল গতিতে রাস্তা ও ময়দানের চারধারে ছড়িয়ে যেতে লাগলো।

সূর্য ডোবার আগে জোব্বাধারী বহিরাগতের দল পুরো অট্টালিকার দখল নিয়ে নিলো। দলপতি এইবার সাপেকাটা সঙ্গীদের শুশ্রƒষায় মন দিলেন। বিষের তীব্রতায় মৃত সঙ্গীদের সাদা জোব্বা দিয়ে একে-একে ঢেকে দিলেন আর আহত সঙ্গীদের ক্ষতস্থানে পট্টি বেঁধে দিলেন। আহত সঙ্গীরা উঠে দাঁড়ালে বিচিত্র ভাষায় আবারো হুংকার ছাড়লেন তিনি। সেই হুংকারে কামরূপী জাদুনগরীর রহস্যভেদের উল্লাস যেমন ছিল, সুরক্ষিত নগরী দখলের ঘোষণাও ছিল বৈকি। দলপতি তার প্রিয় সঙ্গীটিকে ডাক দিলেন এবং তার হাতে লোহার খাঁচাটি ধরিয়ে দিয়ে কানে-কানে কী যেন বললেন। সঙ্গীটি লোহার খাঁচা নিয়ে দ্রুতগতিতে ছুটতে আরম্ভ করলেন। এই ঘটনা ঘটার অনেকদিন পরে জলা-জঙ্গলা ঘেরা যে-চরে চুন-সুড়কির বাড়িটি উঠবে দলপতির সঙ্গী সেই চরে গিয়ে ঢুকলেন। সাপ-বেজি ও বানরের তীব্র হাকডাকের মধ্যে বুনো হাতির সোরগোল কানে এলো তার। দলপতির প্রিয় সঙ্গী অতিকায় এক কাঁঠাল গাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে কেমরে বাঁধা ছুরি বের করলেন এবং চরের নরোম মাটি কোঁপাতে লাগলেন। ঘামের স্রোত তার জোব্বা ভিজিয়ে দিয়ে মাটিতে টপটপ করে ঝরে পড়ছিল। গর্ত খোঁড়া শেষ হলে খাঁচাটি ওই গর্তের ভেতরে রেখে মাটি দিয়ে সেটি বুজিয়ে দেয়া হলো। তার চোখে-মুখে তৃপ্তির ঢেউ খেলে গেলো। দলপতির প্রিয় সঙ্গী যখন কামাখ্যার জাদুকরী রাজপুরুষকে মাটির গর্ভে সমাধিস্থ করছিলেন তখন কাঁঠাল গাছের নুয়ে পড়া ডালে একটি সারস বসে ছিল। ছাইরঙা সারসটি পার্শ্ববর্তী জলাশয়ে মাছের বুজকুড়ি তোলার আশায় সেই সকাল থেকে একঠাঁয় বসেই ছিল। ধ্যানস্থ পক্ষিটি ছাড়া রাজপুরুষের সমাধিকর্মের আর কোনো সাক্ষী রইলো না।

জাদুপ্রবাহিত কামাখ্যা সাদা জোব্বাধারী বহিরাগতদের হাতে বিজিত হয়েছে দেখে নগরীর অধিবাসীরা নতুন দলপতির কাছে আত্মসমর্পণ করলো। দলপতি তাদেরকে ছাগদুগ্ধ ও খর্জুর ফলে আপ্যায়িত করলেন। তার সাদা জোব্বায় পাথুরে মাটি ও খর্জুর ফলের ঘ্রাণ পেয়ে গাছগাছালি আর বুনো হাতির দল ক্রমাগত পিছু হটতে লাগলো। বিষাক্ত সরীসৃপরা নিজেকে ঘন অরণ্য ও মাটির আরো গভীরে গুটিয়ে নিলো। কামরূপ-কামাখ্যার দেশে এক নয়া বসতির পত্তনী ঘটলো এইবার। জোব্বাধারী বহিরাগতরা নদী-খাল ও মাটির পাহাড়ে এলোমেলো নগরটিকে শৃঙ্খলা দিতে চাইছিলেন। নতুন শহর-কুতুব নির্বাচন করা হয়েছিল; সেইসঙ্গে দলপতি পুরো এলাকাটিকে তার সফরসঙ্গীদের মাঝে বিলিবণ্টন করে দিলেন। রাজপুরুষের অট্টালিকা ও সমাধি-অঞ্চলকে বণ্টনের বাইরে রাখা হলো। শহর-কুতুব দলপতির হয়ে অঞ্চল দুটিকে পরিত্যক্ত ও অভিশপ্ত ঘোষণা দিলেন। কিংবদন্তি দিয়ে সুরক্ষিত নগরীটি ক্রমশ তার আদি চেহারা হারিয়ে শান্ত এক মফস্বলী শহরে বদলে যেতে লাগলো। রাজপুরুষের পরিত্যক্ত অট্টালিকা নিজের জৌলুস হারিয়ে ইঁদুর-প্যাঁচা ও বাস্তুসাপের আস্তানায় পরিণত হয়েছিল। তবে রাজপুরষের সমাধি-অঞ্চলটি বুনো হাতি ও সাপ-বেজির দাপটে আগের মতো দুর্গম রয়ে গেলো। সেকালের ত্রিকালদর্শীরা বলতেন, ‘মানুষ নিজেকে ঘটনার নিয়ন্ত্রক মনে করে, অথচ ঘটনা যখন মানুষকে তাড়া করে তাকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা মানুষের থাকে না। মাটির পৃথিবীতে ঘটনা তার নিজস্ব গতিতে এগোয় মানুষকে তার পরিণতি দেখাবে বলে।’ ত্রিকালদর্শীরা যে মিথ্যে বলেন না, তার প্রমাণ ছিল এই ঘটনাটি। রাজপুরুষ যাকে আবাদি করেছিলেন তা ফের পতিত হলো আর বরাবরের অনাবাদি ভূখণ্ডটি খাঁচাবন্দি এক রাজন্যের হিংস্র প্রতিহিংসা বুকে নিয়ে মাটির গর্ভে তোলপাড় তুলতে লাগলো!

৪.
একালে সময় গড়িয়ে চলে ঘটনার নিজস্ব স্রোতে। সেকালেও এর ব্যতিক্রম ছিল না। ঘটনার স্রোতধারায় মাটি হাত-বদল হয়, মাটিখেকো মানুষ একে অপরকে স্থানান্তরিত বা বিতাড়িত করে, কিন্তু অন্তিমে সবাই মিলে ওই মাটির গর্ভে শুয়ে কঙ্কাল হয়। মাটি তখন মানুষকে খায়। কামরূপ নগরী সেদিক দিয়ে আলাদা ছিল না। ইতিহাসের খেরো খাতা জোব্বাধারী বহিরাগতদের বিস্তর বিবরণ প্রদান করেছে। এই অঞ্চলের আনাচ-কানাচে তারা ছড়িয়ে পড়লেও তাদের দলপতি কামাখ্যা নগরীর ছেড়ে অন্য কোথাও হিজরত করেননি। পূর্ব চুক্তি মোতাবেক অত্র এলাকার প্রশাসনিক দায়-দায়িত্ব ভারত মহাবর্ষের রাজকর্মচারীদের হাতে ছেড়ে দিয়ে উঁচু ঢিবির মতো দেখতে একটি গোলাকার পাহাড়কে তিনি তার আস্তানা হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন। ইচ্ছে করলে ওই আস্তানায় বড়ো অট্টালিকা উঠানো যেতো। কিন্তু তিনি তার ধারকাছ দিয়ে গেলেন না। গোলাকার পাহাড়কে মাপমতো কেটে একটি ছোটখাটো গুহায় পরিণত করা হলো এবং দলপতি সেখানে বসবাস করতে লাগলেন। গুহাকন্দরে বসে মানুষের আসন্ন নিয়তির কথা তিনি ভাবতেন। যে-মাটি মানুষকে প্রসব ও পালন করে সেই মাটির খাদ্য হবে বলে সে একদিন পৃথিবী থেকে মুছে যায়,-এই ভাবনাটি তাকে সারাক্ষণ তাতিয়ে রাখতো। ভাগ্যবিধাতাকে মাটির পৃথিবী নিয়ে এভাবে খেলা করতে দেখে তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন-‘মাটির বুকে দণ্ডায়মান অট্টালিকার অহংকারে বাস্তুসাপের খাদ্য হওয়ার চেয়ে গুহাকন্দরে বসে ছাগদুগ্ধ দোহন অনেক বেশি নিরাপদ ও সম্মানের কাজ।’

জোব্বাধারী বহিরাগতদের দলপতি সম্মানিত পুরুষ ছিলেন। নিজের সম্মানকে ধরে রাখার জন্য অট্টালিকার পরিবর্তে মাটির ঢিবিকে তাই উত্তম গণ্য করলেন। তার শরীর পাকানো দড়ির মতো শীর্ণ হয়ে এসেছিল। ছাগদুগ্ধ দোহনকারী কোনো শীর্ণ মানুষের জীবন পানসে হতে বাধ্য। ত্রিকালদর্শী কতিপয় ভাবনা ছাড়া তার জীবনে রঙদার বলে বিবেচনা করার মতো অবশিষ্ট কিছু থাকে না। গুহার নিরানন্দ খাঁচায় দিনের-পর-দিন ছাগদুগ্ধ দোহন ও খর্জুর ফলে আহার সমাধা করার কারণে দলপতির গায়ের রঙ গুহাকন্দরের মাটির মতো ধূসর হয়ে গিয়েছিল। অচিন কোনো আগন্তুকের পক্ষে গুহাগাত্রের মাটি ও তার ভেতরের বাসিন্দাকে আলাদা করা সম্ভবপর ছিল না। একমাত্র শহর-কুতুব তাকে শনাক্ত করতে সক্ষম ছিলেন। দিনের কাজ শেষে তিনি গুহাকন্দরে গিয়ে ঢুকতেন এবং মাটির সাথে মিশে থাকা দলপতিকে নীরবে নিরীক্ষণ শেষে মাঝরাতের ভেরী বাজাতেন। ভেরীর শব্দ নগরবাসীকে দলপতির জীবিত থাকার আশ্বাস যোগাতো। পৃথিবীতে মাটি ছাড়া কোনো কিছু দীর্ঘদিন তার অস্তিত্ব বজায় রাখতে পারে না। শহর-কুতুবের ভেরী বাজানোর কর্মসূচীর মধ্যে-ও একদিন ছেদ দেখা দিলো। টানা বর্ষণের ওই দিনে শহর-কুতুব গুহাকন্দরের নিকটবর্তী হলেন, একটা প্রচণ্ড আওয়াজে মাটির পাহাড় ধসে পড়ার শব্দ তার কানে এলো। গুহাকন্দরের ভেতরে দলপতি জীবিত কিনা তা নিশ্চিত হওয়ার আগে উঁচু মাটির পাহাড়টি গুহামুখকে চিরতরে বুজিয়ে দিলো। প্রবল বর্ষণে ভিজে শহর-কুতুব অবশেষে বুঝতে পারলেন মাটি তার নিজস্ব নিয়মে মানুষকে ধসিয়ে দিলো! মাটিধসা সে-ভিটেয় একটি সুদৃশ্য ইমারত তৈরির সংকল্প নিয়ে তিনি শেষবারের মতো তার ভেরী বাজালেন।

পাহাড়ধসা মাটি দলপতিকে গ্রাস করার পর আদৌ কোনো ইমারত তৈরি হয়েছিল কিনা সে-বিবরণ কেউ দিয়ে যায়নি। ইমারত হয়তো উঠেছিল অথবা মাটির পাহাড়ের বিপজ্জনক স্বভাবের কারণে সংকল্পটি পরিত্যক্ত ঘোষিত হয়েছিল। ঘটনা যাই হোক, মৃত্যুর পর দলপতি অত্র অঞ্চলে কিংবদন্তির মর্যাদা পেলেন। সেই কিংবদন্তি আজোবধি বহমান। দলপতি তার নিজ কওমের কাছে সম্মান আকাক্সক্ষা করেছিলেন। ঘটনার গতিবিধি তাকে সেই প্রাপ্য প্রদানে কোনো কৃপণতা করেনি। ত্রিকালদর্শীরা বলেন, ‘মানুষ যায়-আসে কিন্তু ঘটনা বেঁচে থাকে। ঘটনারা হলো মাটির বুকে হেঁটে বেড়ানো মানুষের অন্তিম পরিণতি। একমাত্র ঘটনার শরীরে প্রবহমান থেকে সে সত্য বা মিথ্যা, স্মরিত বা বিস্মরিত হয়।’ দলপতি ভাগ্যবান ছিলেন। রাজপুরুষের মতো মাটির গর্ভে জ্যান্ত সমাধির নিয়তি তাকে সহ্য করতে হয়নি। তিনি সত্য বলে স্বীকৃত ও পুজ্য হিসাবে স্মরিত হতে পেরেছেন। দুইজন মানুষের এমন পৃথক পরিণতি আবারো পত্তনীদারের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। দীর্ঘ দিন পরে পত্তনীদার এমন এক মাটি আবাদে নামেন যা জোব্বাধারী দলপতির আদেশে অভিশপ্ত বা পরিত্যক্ত গণ্য হয়েছিল। অভিশপ্ত মাটিকে শাপমুক্ত করার যথেষ্ট যুক্তি ও প্রয়োজন থাকতে পারে, কিন্তু অভিজ্ঞতা অন্য কথা বলে। অভিশপ্ত মাটি হলো আতঙ্ক ও বিতৃষ্ণার অন্য নাম; মনুষ্যজীবন একে বিস্মরিত হতে পারে না! সুখকর ঘটনার স্মৃতি মানুষ একসময় ভুলে যায়, কিন্তু ঘৃণা বা আতঙ্ককে বিস্মরিত হওয়া তার পক্ষে একপ্রকার অসম্ভব। অভিশাপের আতঙ্ক মানুষকে কবর অবধি তাড়া করে ফেরে। বহু যুগের তাপ-সিঞ্চনে এর উপশম হয় না। চুন-সুড়কির বাড়ি তুলবার কালে পত্তনীদার এই সরল-অংকটি ভুলে গেছিলেন। তার পূর্ব পুরুষরা যখন বন্দি নাগিনীর হিংস্র গর্জনে পরিপ্লুত মাটির দখল নিচ্ছেন ইতিহাস তখন নির্বিকার মহাজনের মতো এর আসন্ন পরিণাম হিসেব করতে বসে গেছে। ‘মানুষ খেয়াল ও প্রয়োজনের সন্তান’-প্রবচনের সত্যকে প্রমাণ করে চারদিকে এক নতুন যুগের কলরব চলছে তখন। তবে রক্তের চাইবাঁধা বরফখণ্ড গলাবার পক্ষে সেটি যথেষ্ট ছিল না। কাজেই মাটির খাঁচায় সমাধিস্থ রাজার বিষগর্জন উপেক্ষা করে পত্তনীদারের পূর্ব পুরুষ যেদিন দুর্গম চরাঞ্চল অধিকার করলেন, নয়া যুগের আভাস পেয়ে ঘটনারা ততোদিনে অন্যদিকে মোড় নিতে শুরু করেছে।

৫.
সেকালের নয়া জামানা এলো রেলে চড়ে। মন্থর গতির মফস্বলে রেল নামের মত্ত হাতি ঢুকলো দেখে মাকুবোনা তাঁতের থান এবং আংটির ভেতর দিয়ে গলে যেতে পারঙ্গম মসলিন শরমে লাটে উঠলো। বাজার ছেয়ে গেলো শস্তা ফিরিঙ্গি থানে। কথকঠাকুর ছড়া কাটলেন, ‘আইকম বাইকম তাড়াতাড়ি/যদু মাস্টার শ্বশুরবাড়ি/রেলগাড়ি ঝমাঝম/পা পিছলে আলুর দম।’ রেলের গতির সাথে পাল্লা দিতে না-পেরে গতায়ু যুগের অনেক যদু মাস্টার ছাতু হয়ে গেলেও কোট-প্যান্ট পরা সায়েব-সুবো ও শস্তা থানের ধুতি পরিহিত কেরানিগণ রেলের পেটে বসে শহর দাপিয়ে বেড়াতে লাগলেন। যুগটি ছিল সমতা ও অসমতায় ভরা। রেশমী সুতোর কারুকাজের জায়গায় এলো মোটা সুতোর মিলের ছাট। ধানের জমি নীলে ছেয়ে গেলো। টিকিধারী বামুন পণ্ডিতের টোল টপকে ছেলেপুলেরা ইংরাজি শিখতে চললো শহরে। হুক্কার আয়েসী টানে নতুন মাদকতা নিয়ে এলো দুধে গোলা আফিম। আফিমে ঢুলুঢুলু বয়সীদের চোখ গলে শহুরে যুবকের হাতে উঠে এলো হাইহিলের মতো সরু সিগার। খাজনার শ্বাসরোধী চাপে এরিমধ্যে মৃত ভাগচাষীর গলার শেষ-রক্ত উঠিয়ে জমিদার-তনয় আকাশপানে পায়রা ও বুলবুলি উড়ালেন। বিদ্যাসাগরী চটিকে ম্লান করে দিলো গ্লচেস্টারের জুতো। নয়াযুগ এলো নয়াযুগের মতো। সে এলো ফিরিঙ্গি সায়েব হয়ে; ধানখেতে রেলের ভেপু ও স্টিমারের সিটি বাজিয়ে উড়ালো তার বিজয় নিশান। পাল্কি-বেহারার উ...হু...ম...না’র তানবাজিতে ক্লান্ত জনপদে হাইড্রলিক হর্নের মোটরকার নিয়ে এলো নতুন বিলাস। আর শহর-কুতুবকে খেদিয়ে রাতের দখল নিলো নাইট সেন্ট্রিরা। খালিসা আদায়কারী মনসবদার বিতাড়িত হচ্ছে বুঝে বিগতকালের শেষ নবাব কবিতার ছন্দে শের আওরালেন :-

‘হায় আমার ভাগ্য
কী দুর্ভাগা গ্রহণ লেখে কাল!

মদির রাত্তিরে চাঁদ দেখে ভাবি
আমার নিয়তিতে লেগেছে গ্রহণ।
দুর্ভাগা গ্রহণের কাল
বুঝি না বাইজির ঘুঙুর আজো কেন
মদিরা বিলায়!
বুঝি না কীসের এতো টান
হাতের পেয়ালা ভরে
ওঠে হাহাকার!

জাফর
কী বদনসিব তুমি!

যে মাটি একদিন বিলিয়েছো অকাতরে
ফকির গোলামের ভাগে জেনো,
তার এক গজ জুটাবে না কেউ!

শেরপাগল জাহাপানার আক্ষেপ শুনার মতো অবসর কারো ছিল না। নতুন যুগের সায়েব তাই এলো মাথায় টোপর দিয়ে। খাল-বিল-হাওরের দেশে সায়েব এলো বেনিয়া হতে। প্রবাদে আছে নিজের ভেতরে দুর্ভেদ্য ও সুরক্ষিত দেশে বহিরাগতের জায়গা হয় না। নয়া মাটি দখলের লোভে সে যদি-বা ঢুকে পড়ে,-অনুপ্রবেশকারীর বদনামে তাকে কলঙ্কিত হতে হয়। আর ভাগ্যান্বেষণে যে এখানে ঢোকে ও থিতু হয় তার কপালে অভিবাসীর ছাপ্পা আমৃত্যু লেগে রয়! একালের শাস্ত্রে যা জাতীয়তা ও দেশিকতা নামে বিদিত, সেকালে তাকে স্বকিয়তা নামে চিনতো সবাই। বিজ্ঞজনরা বলেন অনুপ্রবেশের বাড়াবাড়ি থেকে নাকি জাতি ও দেশ-বৈরিতা জন্ম লয়। মাটি হচ্ছে গৃহপালিত মার্জার। পরিচিত মনিব ছেড়ে অচিন মনিবকে খোঁজে না সে। মানুষ জন্মাবধি স্বভাব-যাযাবর হলেও যে-মাটির ওম পেয়ে তার ভবঘুরে স্বভাবে থিতু আসে কালে-কালে সে-মাটি তার দেশ নামে গণ্য হয়। কবিরা উপমা করে বলে ‘দেশ হলো কাকের বাসা। সে-বাসায় কাকের ওমে চতুর ও ছন্নছাড়া কোকিলের ছানা ফুটে বেরুলেই তা কোকিলের হয়ে যায় না।’ উপমাটি কাকে-কোকিলে একাকার হওয়ার কালে যেমন পুরোপুরি মিথ্যে হয়নি, সেকালেও মিথ্যে ছিল না। অতর্কিত অনুপ্রবেশে দুর্ভেদ্যকে অরক্ষিত করার বিধান একালের শাস্ত্র অনুমোদন করে না, ছি ছি ধিক্কারের রব ওঠে চারদিকে; সেকালেও করতো না। অনুপ্রবেশকারী অথবা অভিবাসী-উভয়ের পরিণাম এই হয় যে আদালত তাকে কাকের ছানা গণ্য করলেও বায়সকুলের কাছে সে কোকিল রয়ে যায়। এটি রয়ে যায়, যতোদিন-না এই স্মৃতি-বিলোপন ঘটে যে একদা কাকের বাসায় কোকিল ডিম পেড়েছিল! কোকিল-স্বভাবে কাকের সংক্রাম বিবর্তনশাস্ত্রে ইতিহাসলুপ্তির সন্ধিক্ষণ নামে প্রচারিত হয়ে থাকে; যেখানে পুরনোরা লুপ্ত হয় আর নতুনের আবির্ভাব ঘটে।

বাস্তুশাস্ত্রে লেখে ‘কেউ আবাদি করে বাকিরা বাড়ায়।’ আমরা যে-শহরের গল্প করি সে এভাবেই বেড়েছে বৈকি। যুগে-যুগে শিকারি ও যাযাবরের স্রোত মিশে এর মাটি মাটি আবাদি ও দেশি হয়েছে। মাটি আবাদের স্মৃতি তাই অতি মূল্যবান। সে-স্মৃতি অনিঃশেষ ঝর্ণাধারার মতো মাটির বুকে লেগে থাকে। কামাখ্যার মাটি অযুত স্মৃতি বহন করে একদিন কামাখ্যা-কামরূপ নামে পরিচিতি পেয়েছিল। সেই কবে বাঘছাল পরিহিত ভগবান পশুপতি হিমালয়ের কন্যা উমা আর দেবী গঙ্গার প্রেমে পড়েছিলেন। উমাকে ঘিরে পশুপতির কামনা প্রচণ্ড হলেও গঙ্গার জন্য তার হৃদয় বিদীর্ণ হতো বৈকি। প্রলয়সুন্দর ভগবান তাই বে করলন উমাকে আর মাথার জটাজঙ্গলে প্রবাহিত করলেন দেবী গঙ্গাকে। রুদ্রপতি ভগবানের জটা থেকে দেবী ওই যে নেমেছিলেন, তারপর থেকে কেবল বয়েই চলেছেন। জলপ্রবাহের ফেনিল তোড়ে গঙ্গা স্নিগ্ধকায়া হয়ে বইছেন দেখে পশুপতির বোধহয় ভ্রামণিক হওয়ার লোভ জেগেছিল। প্রিয়াকে একা বইতে দিলেন না তিনি, বিভক্ত হলেন এইবার। কৈলাশের শুভ্র বরফপিণ্ডে সুন্দরী উমার আলিঙ্গনে নিজের তেজ গচ্ছিত রেখে দেবী গঙ্গার সলিলপ্রবাহে ভেলা ভাসালেন। ফিরে যেতে চাইলেন সৃষ্টির গোঁড়ায়, যখন অনন্ত জলের সাগরে মাটির চিন্মাত্র ছিল না। অগাধ জলরাশির মাঝে শয়ানরত ভগবানের নাভিতে পদ্ম হয়ে ফুটেছিলেন প্রলয়সুন্দর। গঙ্গার ফেনিল জলরাশির তোড়ে আজ আবার স্মশানচারী ভগবান নাম-ধাম পাল্টে কামাখ্যায় পৌঁছে গেলেন। নিষাদ-কিরাতের দেশে ঠায়-ঠিকানা ভুলে আলাভোলা যে-ঠাকুর ঢুকলেন, কামাখ্যার মাটি তাকে শক্তির আধার বলে চিনে নিতে ভুল করেনি। নিরীহ ঠাকুরের অন্তরালে প্রবাহিত শক্তিধারা শোষণ করবে বলে ত্রিকালপতি নীলকণ্ঠের বাধ্য হলো সে। শক্তির উচ্ছ্রিত ফেনা শোষণ করে মাটিরা দুর্ভেদ্য হয়,-কামাখ্যা তা হয়েছিল বৈকি।

মাটির ইতিহাস তাই শক্তি শোষণের ইতিহাস। শক্তির প্রকারভেদ অনুসারে মাটিকে বুঝতে হয় কে কল্যাণী আর কোন্টা অকল্যাণের রাষ্ট্রদূত। শক্তি নির্ণয়ের এই রকমফেরে মাটি আবাদি বা দুর্গম হয়। আবাদি মাটির বুক চিরে দেশ-জাতিরা জন্ম লয় আর অনাবাদি মাটি বন্ধ্যা রমণীর মতো দেশকালহীন পতিত পড়ে থাকে। কামাখ্যার বেলা তার অন্যথা ঘটেনি। আলাভোলা ঠাকুরবেশী নীলকণ্ঠকে কল্যাণী বলে চিনে নিতে পেরেছিল সে; অতর্কিত অনুপ্রবেশের দিনে সাদা জোব্বাধারী বহিরাগতদের দলপতিকে দেখে যেমন চিনেছিল। দলপতিকে অনুপ্রবেশ করতে দেখে নিশ্চয় চমক লেগেছিল তার। তিনি যখন বিষনাগিনীর গলা টিপে ধরলেন কামাখ্যা বুঝে গেলো শক্তির আরেকটি বিদ্যুৎ প্রবাহিত হলো আজ। অতঃপর খাঁচাবন্দি রাজপুরুষকে মাটির গর্ভে পুঁতে দিয়ে পাহাড়কাটা গুহায় ঢুকলেন তিনি এবং ছাগদুগ্ধে দিনাতিপাত করতে লাগলেন। শক্তি এবার শান্তির আহবান হয়ে কামাখ্যা শাসন করতে লাগলো।

মাটির চাহিদা জানতেন বলে ভগবান পশুপতি পূর্ব-পরিচয় বিলোপ করে স্বদেশি হয়েছিলেন। জোব্বাধারী দলপতি গুহার কুটিরে ছাগদুগ্ধ দোহন ও নিরাসক্তি অনুশীলনে মধ্য দিয়ে স্বদেশি হলেন। কিন্তু নয়া যুগের যে ফিরিঙ্গি সায়েব কামাখ্যায় এলো, নিজেকে বিলোপ করার কথা ভাবে না সে। তার কাছে মাটি মানে আবাদি,-যাকে আবাদ করা যায় ও যেখানে বসতি পত্তন করা যায়! এই ফিরিঙ্গি ‘মাটি টাকা, টাকা মাটি’র মারিফতি বুঝে না। তার পিঙ্গল চোখে মাটি হচ্ছে টাকার খনি। মাটিতে রাজস্ব ফলে আর সে রাজস্বে সরকার চলে। ফিরিঙ্গি সায়েব আলাভোলা শিব ঠাকুর কিংবা জোব্বাধারী দলপতি ছিল না, রেলের খাঁচায় বসে মাটি দোহন করতো সে। কামাখ্যার জন্য এ এক নতুন অভিজ্ঞতা এলো, যার জন্য প্রস্তুত ছিল না সে।

৬.
শিব ঠাকুরের তিন কন্যার দেশে নয়াযুগের সায়েব এলো স্টিমারে করে, রেলের ভেপু বাজিয়ে। দেশে তখনো তিন কন্যার কাল বহাল বটে। ঠাকুরের ‘এক কন্যা রাধেন-বাড়েন/আরেক কন্যা খান/আরেক কন্যা গোস্বা করে বাপের বাড়ি যান’। অথই জলে সিনানরতা কন্যার মান ভাঙাতে যতো বেনে এখানে আসে তাকে উদ্দেশ করে কন্যা তখনো ঝঙ্কার দিয়ে ওঠে,-‘লজ্জা নাইরে নিলাজ ঠাকুর/লজ্জা নাইরে তোর/গলায় কলসি বাইন্ধা গাঙে ডুইব্যা মর।’ নিলাজ ঠাকুর ডোবে না, উল্টে ভরাট কণ্ঠে গমক তোলে,-‘কোথা পাইবাম কলসি কন্যা/কোথা পাইবাম দড়ি/তুমি অও গহীন গাঙ/আমি ডুইব্যা মরি’। সত্য-ত্রেতা-দ্বাপর-কলির নটরাজ বেনে ও যৈবতীর লীলা দেখে হাসেন। নদী-বিল-হাওরের দেশে পা রাখবার কালে প্রলয় নৃত্যের নটরাজ ত্রিভঙ্গ মুরারীর বাঁশি শুনেছিলেন। সে-বাঁশির লহরে তার প্রলয়ঙ্কারী নৃত্য কবে ভেসে গেছে! নটরাজন শিব হয়েছেন আলাভোলা বোম ভোলানাথ! ঘর-স্মশানে একাকার এই ভোলানাথকে সামাল দিতে উমার না-এসে উপায় কী? রাজ-রাজত্বের গরিমা ছেড়ে হিমালয়কন্যা উমাকে তাই কল্যাণী কিংবা নৃশংস মহিষাসুর বধিনী দশভূজা দুর্গা হতে হয়! কখনো তিনি ছিন্নমস্তা চণ্ডি কিংবা সাপখোপ-বনজঙ্গলার রাজত্বে মা মনসা ও বনবিবি হয়ে ওঠেন। আবার কখনো-বা তিনি ন্যাংটো কালী। জোব্বাধারী দলপতি কামাখ্যায় আসবার কালে রুদ্র-কোমলের এইসব বিবরণ শুনে বিমোহিত উক্তি করেছিলেন, ‘কামাখ্যা বড়ো বিচিত্র হে। তরবারি ও ফকিরির সন্ধি ছাড়া এর মাটি পোষ মানে না কখনো।’ দলপতি তরবারি কোষমুক্ত করে রুদ্র হয়েছিলেন আর ফকিরের নিরাসক্তি দিয়ে জনবসতির মনোহরণ করেছিলেন। নয়া যুগে তা আশা করার বাস্তবিক কোনো কারণ ছিল না।

ফিরিঙ্গি সায়েবের কাছে ‘ন্যাংটা কালী ও ফকিরি-এর সবখানি বড়ো আজব কুদরতি! কেননা সায়েব আসে দূর দেশ থেকে; মিল-কারখানার কালিঝুলি মেখে, রেলের ধোঁয়ায় চুরুট ফুঁকে সে আসে কামাখ্যা নগরে। সায়েব তাই বদলায় না! মিলশাস্ত্রে নাকি কয়, ‘সায়েব বদলালে সায়েব থাকে না’। অথই জলে সিনানরত কন্যাকে দেখে তার লোভের দরিয়ায় নয়া তুফান ওঠে। ত্রিভঙ্গ মুরারীর বাঁশি সায়েবের হাতে ফিরিঙ্গি চাবুক হয়ে রোদে ঝলসায়। এই চাবুকের মুখে হাসি অন্তরে বিদ্বেষ। নয়াযুগ এক নয়া পালাবদল আনে বটে! সেই পালাবদলের তোড়ে কামাখ্যার মাটি অবিরত ছারখার হয়। ফিরিঙ্গি লাভ-ক্ষতি বুঝে শিবের থানে তার নমস্কার যেমন পড়ে, দলপতির সমাধি-অঞ্চলকে সে এক লহমায় নিস্কর ঘোষণা করে বসে। আর ওদিকে নতুন বসতি আবাদের অছিলায় জুড়ে দেয় বাড়তি খাজনার তবিলদারী। নয়া যুগের সায়েব খাজনা ও রাজস্বের চাষ করতে আসে কামাখ্যায়, শিব-দলপতির ঐতিহাসিক সন্ধির ঘোরপ্যাঁচ সে বুঝে না। তার হাতে কৃষ্ণের বাঁশি তাই ‘হার ম্যাজেস্টি’র অজুহাত মাত্র হয়।

জমিদারী ও মহাজনী দাদনের গোলচক্করে ঘুরে কামাখ্যা নিজেকে অরক্ষিত রাখতে পারে না। তাকে পাল্টাতে হয় এবং সে পাল্টায়। বিগতকালের শানদার নবাবজাদা আগতকালে এসে ফকির হয়। গতকালের সুযোগসন্ধানী মোসাহেব বরাতজোরে তালুকদার বনে যেতে থাকে এবং নব্য জমিদারির দাপটে প্রজার তালুক-মুলুক গ্রাস করতে লাগে। সময়ের নিয়মে পত্তনীদারের পূর্ব পুরুষের ইতিহাসটিও পাল্টে গেছিল। তার এক পূর্ব পুরুষ জোব্বাধারী দলপতির প্রিয় সঙ্গী ছিলেন। নিজেকে বিষধর কাল কেউটে পরিণতিকারী রাজপুরুষকে কামাখ্যার জনবিরল দুর্গম চরে তিনি সমাধিস্থ করেছিলেন। দলপতির মতো সম্মান অর্জনের বাসনা তার ছিল না। ভাগ্যান্বেষী পরবাসী হয়ে এই কামাখ্যায় তার পর্যটন ঘটেছিল। মনে হয়তো আশা ছিল মরুর বালুঝড়ে সমাধি হওয়ার চাইতে জাদু-প্রভাবে সম্মোহিত এই দেশে তার অন্ন-বস্ত্রের নিশ্চিন্ত সুরাহা হবে। সর্পরূপী রাজপুরুষকে মাটিতে পুঁতবার কালে মনে এ-আকাক্সক্ষা জেগে থাকবে হয়তো,-অতিকায় এই চর আবাদের সুবাদে একদিন তিনি ধনে-জনে ফুলে-ফেঁপে উঠবেন। কিন্তু দলপতির মনোভাবে কামাখ্যার চর ঘৃণিত ও পরিত্যক্ত গণ্য হওয়ায় আবাদি হওয়ার সুযোগ তার কপালে জোটেনি। দলপতির নির্দেশে তাকে নগরীর অন্য আরেকটি অঞ্চলে শান্তির বাণীবাহক হতে হয়েছিল। উড়োকথার খেরোখাতা থেকে জানা যায় আশাভঙ্গের এই বেদনা তার নাকি সহ্য হয়নি। আত্মসম্মানে ঘা লেগেছিল। মনে হয়েছিল দলপতি তার ভেতরের গোপন বাসনাটি পড়ে ফেলেছেন এবং লোভী ঠাওরে তাকে তাচ্ছিল্যই করলেন।

সেকালে মান-অপমানের বোধটি বড়ো তীব্র ছিল। দলপতির প্রিয়পাত্র হবার পরে তার কাছে ছোট হওয়ার যাতনা যতোখানি চক্ষুলজ্জা সম্ভব করে, পত্তনীদারের পূর্ব-পুরুষ সে-লজ্জায় অপমানিত বোধ করেছিলেন। অপমানবশতঃ নিজেকে গুটিয়ে নিলেও তার স্বপ্নে কামাখ্যা নগরের দুর্গম চরটি অবিরাম উঁকি দিয়ে যেতো। নিষিদ্ধ কামনার মতো সকলের চোখ এড়িয়ে দুর্গম সেই চরে গিয়ে তিনি ঢুকতেন। কাঁঠাল গাছের ডালে বসা সারস পাখিটিকে অপলক দেখতে-দেখতে তার শরীর মাটি আবাদের নিষিদ্ধ উত্তেজনায় শিরশির করে উঠতো। একদিকে নিষিদ্ধ কামনা, অপরদিকে দলপতির ত্রিকালজ্ঞ চোখে ধরা পড়ার ভয় ও উত্তেজনায় পত্তনীদারের পূর্ব পুরুষের হৃদয় বিদীর্ণ হয়েছিল। তিনি শিরঃপীড়ায় ভুগতে শুরু করেন। সত্য-মিথ্যা নির্ণয় আজ দুরূহ বটে, তবে উড়োকথার খনি ঘাটলে পাওয়া যায় পত্তনীদারের পূর্ব-পুরুষ নাকি এই চর আবাদের বাসনায় এতোদূর বেপোরোয়া হয়ে উঠেছিলেন,-চরের মাটি তাকে গিলে নিতে বাধ্য হয়েছিল। কামাখ্যায় বসতি গাড়বার পর স্থানীয় এক রমণীর পানিগ্রহণ করেন তিনি। ভীরু ও লজ্জাশীলা রমণীটিকে এই বলে শপথ করান, অদূর ভবিষ্যতে তার সন্তানরা যেন এই চরের আবাদকারী হিসাবে স্বীকৃতি পায়। রমণী যেন সেভাবে তাদেরকে মানুষ করে তোলেন।

লজ্জাশীলা স্ত্রী’র কাছে পূর্ব-পুরুষের যুক্তি ছিল, ‘দুর্গমকে পতিত ফেলে রাখার মধ্যে কোনো মানবত্ব নেই। যে-লোক দুর্ভেদ্যকে আবাদ করে সে আসলে ভয় ও সংস্কারের জড়কে উৎপাটন করে। ইহজগৎ-পরজগতের রাজমুকুট একমাত্র তাকে মানায়।’ জোব্বাধারী দলপতিকে ভয় বা সমীহ করলেও অতীত-বিশ্বাসে টান লেগেছিল। দলপতিকে তিনি মনে-মনে কাপুরুষ ভাবতেন। তবে রাজকীয় যে-সম্মান দলপতি তখন পাচ্ছেন এর ভয়ে রা কাড়তেন না। ইতিহাসের উড়োভাষ্য বলে এভাবে বহুদিন গত হওয়ার পর, লোকে যাকে শাহ পীর নামে ভক্তি করতো, এক গভীর রাতে স্ত্রী-সন্ততি ও পড়শিদের চোখ ফাঁকি দিয়ে নিরুদ্দেশ হলেন। তার আকস্মিক অন্তর্ধান সকলের মনে এই সন্দেহ জাগিয়ে তুলে যে তিনি হয়তো সাপ-বেজি ও মাটিবন্দি রাজন্যের ডেরায় গিয়ে উঠেছেন। উপদ্রুত সে-উপকূলে ঢোকার সাহস কারো ছিল না। পড়শিরা পীরের বিলাপরত স্ত্রী ও নাবালক কিশোরকে সান্ত্বনা দিলেন। গুহায় বসে শহর-কুতুবের মাধ্যমে সব শ্রবণ করার পর দলপতি স্মিত কণ্ঠে মন্তব্য করেছিলেন :-

‘খোদার দুনিয়ায় মাটি দুই প্রকার হয়,-জাহেরী ও বাতেনী। দুই ধরনের মাটি গুলে খোদা ইনসান তৈরি করেন ও সেখানে রূহ ফুকে দেন। এর মধ্যে জাহেরী পরিমাণে কম হলেও তার শক্তি অধিক। জাহেরীর ঘোরে লোকেরা সংসারী ও বিষয়াসক্ত হয় এবং ইবলিশের খপ্পরে পড়ে জান খোয়ায়। বাতেনীরা পরিমাণে বেশি, কিন্তু কম লোকে তার নাগাল পায় না। বাতেনী যার শরীরে ভর করে সেই লোক মজুব পীর-ফকির হয়ে মাটির মায়া ত্যাগ করে। লেবাসে ফকির হয়ে জাহেরীর ঘোর যার এখনো কাটেনি তাকে পীর সাহেব নামে ডাকা ফকিরি নিয়মের বরখেলাপ। শাহ পীরকে ওই নামে ডেকো না। ইবিলিশ তার চেতনাকে হরণ করেছে। এখন তার পরিণতি তাকে ভোগ করতে দাও।’

শোনা যায় দলপতির এই মন্তব্যের পর শাহ পীর নামে স্বীকৃত পত্তনীদারের পূর্ব পুরুষের নামধাম পাল্টে যায়। লোকে তাকে ‘শেরালি’ বলে ডাকতে শুরু করে। ‘শের-এ-আলী’র কথ্যান্তর এই ‘শেরালি’। এরূপ নামকরণের পেছনে ছোট্ট একটি কিংবদন্তি রয়েছে। উড়োকথার খনি থেকে জানা যায় দুর্গম চরে ঢুকবার কালে শাহ পীর এক বাঘের সাক্ষাৎ লাভ করেন। সাদা-কালোয় ডোরাকাটা অতিকায় বাঘটি বনতল অঙ্গার করে জ্বলছিল। আগুনের স্ফুলিঙ্গটি আক্রমণ করতে পারে ভেবে শাহ পীর তখন বাঘের সঙ্গে লড়াই শুরু করেন। তার মুখ দিয়ে অবিরত ‘ইয়া আলী’ উচ্চারণটি নির্গত হতে থাকে। হযরত আলীর বীরত্বের সাথে সম্পর্কিত চিহ্নের এই ঘন-ঘন উল্লেখে ঘুমন্ত কামাখ্যা বারবার কেঁপে উঠছিল। বাঘটিকে পরাস্ত ও অভিভূত করে তিনি যখন বন থেকে বেরিয়ে এলেন তখন তার দেহ থেকে স্ফুলিঙ্গ ছুটছে! দলপতির মন্তব্যের জের ধরে নাম পাল্টাবার মুহূর্তে নগরীর লোকজন বহু পুরাতন সেই স্মৃতি পুনরায় স্মরণ করেছিল। অনভ্যস্ততার কারণে ‘ইয়া আলী’ উচ্চারণটি তাদের কণ্ঠস্বরে ‘শেরালি’ নামে প্রকাশ পায়। নামটি অবশ্য বেশিদিন স্থায়ী হতে পারেনি। নয়া যুগের ফিরিঙ্গি সায়েব এদেশে পা রাখার অনেক আগে থেকে ‘শেরালি’র বংশধর ‘শিরালি’ নামে লোকজনের কাছে পরিচিত হয়ে উঠতে থাকেন।

এতদঅঞ্চলে ‘শিরালি’ নামটি বিশেষ কারণে আগ্রহ জাগানিয়া। স্থানীয় লোকজন ‘শিরালি’কে সাধারণত গুণিন হিসাবে বিবেচনা করে। কুহকী শক্তি দিয়ে বজ্র ও শিলাবৃষ্টি থেকে তারা খেতের ফসল রক্ষা করতে পারে বলে লোকের বিশ্বাস। সেকালে ‘শিরালি’ শুধু ধানখেতের রক্ষক কাকতাড়–য়ার মতো ছদ্ম-জাদুকর ছিল না, জাদুবিস্তীর্ণ কামাখ্যার মাটিতে অভিশপ্ত জাদুকর হওয়ার ঝুঁকি নিতে সক্ষম লোকেরা ‘শিরালি’ হওয়ার পথে পা বাড়াতো। শাহ পীরের বংশধর সেই মন্ত্রে দীক্ষা নিয়েছিল। তাদের খ্যাতি পুরো কামাখ্যা জুড়ে রাষ্ট্র হয়ে গিয়েছিল। নয়াযুগের ফিরিঙ্গি সায়েব এখানে পা রাখার পর শুনতে পেলো কামাখ্যায় এক জবরদস্ত ‘শিরালি’ বাস করে, যে কিনা বুক পেতে আকাশের বাজ ও শিলাবৃষ্টি ঠেকায়। সায়েব আগমনের কালে শাহ পীরের যে-বংশধরটি ‘শিরালি’ বলে নাম কিনেছিল তাকে ঘিরে নগরীর লোকজনের মনে অজানা সব ভয়-ভীতি বিরাজ করতো। বুনো গাছ-গাছালির ঔষধি গুণাগুণ সম্পর্কে লোকটির গভীর জ্ঞান ছিল। এছাড়া সাপের বিষ থেকে রোগ প্রতিষেধক ঔষধ তৈরির জন্য কবিরাজ হিসাবে তাকে সমীহ করতো সবাই। লোকজন মনে করতো নগরীর মধ্যাঞ্চলে অবস্থিত দুর্গম চরাঞ্চলটি হচ্ছে ‘শিরালি’র জাদুকরি শক্তির উৎস। কামাখ্যায় অনুপ্রবেশের পর ফিরিঙ্গির কানে নিষিদ্ধ চরাঞ্চলের সাথে ‘শিরালি’ নামের মাহাত্ম্য সংক্রান্ত খবর পৌঁছতে তাই দেরি হয়নি। সায়েব তখন সরীসৃপের আস্তানাকে আবাদ করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। নগরীর মধ্যিখানে নদী-খাল ও নলখাগড়ায় আচ্ছাদিত অতিকায় এই অনাবাদি ভূখণ্ডে ‘হার ম্যাজেস্টি’র নিশান উড়ানোর নেশায় তাকে পেয়ে বসেছিল।

৭.
গুলি-কামান ও রেল নামের পাগলা জগাই যার বশীভূত তার পক্ষে নলখাগড়া ও সরীসৃপ আচ্ছাদিত ঘন বন আবাদ করা দুরূহ কোনো কাজ নয়। কিন্তু আশ্চর্য হলেও সত্য অনাবাদি ভূখণ্ডটি দখলের জন্য গুলি-কামানে বাহাদুরি প্রদর্শনের গরজ সায়েব করেনি! ভূখণ্ডটি নিয়ে তার পরিকল্পনা ছিল একেবারেই অন্যরকম। ব্রাণ্টলি নামের এই ফিরিঙ্গি সায়েবটি একজন উভকামী ছিল। পিঙ্গল চোখের ইশারায় যুবতীগণের মাথা ঘুরিয়ে দিলেও নওল কিশোর বা যুবা পুরুষের প্রতি তার দুর্বলতার কারণে স্ব-জাতির অনেকে তাকে এড়িয়ে চলতেন ও মনে-মনে ঘৃণা পোষণ করতেন। দিনের জবরদস্ত আমলাটি সূর্য অস্ত যাওয়া মাত্র মাংস ও মদিরার জন্যে ব্যাকুল হয়ে উঠতো। প্রমোদ দিতে সমর্থ নারী কামাখ্যায় দুর্লভ না-হলেও নওল কিশোর বাগানোর কাজটি এতো সহজ ছিল না। লোকজনের চোখ ফাঁকি দিয়ে সেটি সমাধা করা এক অসম্ভব ব্যাপার হয়ে উঠতো। একান্ত গোপনীয়ভাবে কাজটি সারা হতো যাতে লোকজন বিগড়ে না যায়। ‘হার ম্যাজেস্টি’র রাজত্বে প্রজারা পড়ে-পড়ে চাবুকের মার খেলেও পায়ুকামিতার মতো ঘটনার বাড়াবাড়ি একবার প্রমাণ হতে পারলে তাদের অবরুদ্ধ ক্ষোভ পুরো কামাখ্যায় দাবানলের মতো ছড়িয়ে যেতে পারে এ-জ্ঞানটুকু সায়েবের ছিল। সুতরাং নিষিদ্ধ মাংস নিয়ে তার কাজকারবার যাতে গোপন থাকে সে-ব্যাপারে ব্রাণ্টলির চেষ্টার কোনো ত্র“টি ছিল না। নলখাগড়ার অতি-বৃহৎ চরটিকে আবাদি করে সেখানে মনোরম প্যানারোমা স্থাপনের অভিলাষ তার বুকে প্রকট আকারে দানা বাঁধছিল।

দুর্গম চরের দখল নিতে পারলে সায়েবের পক্ষে দুটো দিক দিয়ে লাভবান হওয়ার সুযোগ ছিল। প্রথমত মনোরম এই প্যানারোমায় নির্বিঘেœ সে তার ব্যক্তিগত অজাচার চালিয়ে যেতে পারবে, সেইসঙ্গে ঈর্ষনীয়ভাবে বিরাট ভূখণ্ডটিকে ‘হার ম্যাজেস্টি’র নাম করে নিজের সম্পত্তি বানিয়ে নেয়া যাবে। সুদূর ইংলন্ডে বসে ভারতবর্ষের রাজা-রাজড়াদের দাপট ও বিলাসিতার গল্প সে শুনতে পেয়েছিল। কামাখ্যা প্রবেশের কালে কোম্পানি ও ‘হার ম্যাজেস্টি’র সহায়ক শক্তি জমিদারদের দাপট এবং বিলাসিতার নমুনা পেয়ে গল্পকথার সত্যতা সম্পর্কে তার মনের শেষ সন্দেহটুকু ঘুচে গেলো। কর-খাজনা বা জবরদখল প্রথা দিয়ে গরিবকে রায়তে পরিণতকারী এইসব জমিদারের সঙ্গে ইংলন্ডের অভিজাত লর্ড সায়েবদের তুলনা করে ব্রান্টলি পরিষ্কার বুঝতে পেরেছিল উঁচু ও নিচু জাতে বিভক্ত এই সাম্রাজ্যে ক্ষমতাবানের ‘খেয়াল বা প্রয়োজন হলো শেষ কথা’। সে বুঝতে পেরেছিল এই সাম্রাজ্য ভাগ্যবিধাতার হুকুমে চলে। সেই হিকামতির জোরে ক্ষমতাশালীরা প্রজাদের রক্তহীন করে দিতে দ্বিধা করে না। মাঝেমধ্যে বিধির লিখনে অনিয়ম অবশ্য ঘটে। খেয়াল ও প্রয়োজনের মাত্রাছাড়া দাপটে শ্বাস বন্ধ হবে বুঝে প্রজা খানিক গা ঝাড়া দেয় এবং রাজাকে নিকেশ করার জন্য খেপে ওঠে। এতে বড়জোর লাঠি-গুলির খরচা হয়, হুকুমের লিখনে খানিক সংযম ঘটে,-বিধির নিয়মরা কিন্তু বদলায় না। ‘রাজা যায়, রাজা আসে’ আর ওদিকে কর-খাজনা ও রাজস্ব মেটানোর চাপে প্রজারা মহাজনী দাদনের খপ্পরে নিঃস্ব হয়।

ভারতবর্ষীয় ক্ষমতাছকের নিয়ম বুঝে ফেলার পর ভাগ্যান্বেষী বৈদেশী সচরাচর যা করে থাকে, ব্রান্টলি সায়েবের বেলায় তার অন্যথা ঘটেনি। হাজার বছর ধরে বিদ্যমান ক্ষমতাছকে কিছুদিন সাপ-লুডো খেলার পর সায়েব বুঝে গেলো খেলার নিয়মে যেটুকু অনিয়ম রয়েছে তাকে পরিবর্তন করা জরুরি নয়, বরং অনিয়মকে নিয়ম গণ্য করে সমঝে চলা-ই বুদ্ধিমানের লক্ষণ। প্রজারা এখনো এই সংস্কারে বশীভূত যে ‘ভাগ্যের লিখন বদলায় না। প্রজা মাটি আবাদ করে বা সীমানা বাড়ায় আর রাজা সে-মাটির কর্তা হয়ে নিজের খেয়াল মেটায়!’ মাটির আধিপত্য লাভের খেলাটি এখানে অতি সহজ; তবে খেয়াল রাখা দরকার মাটি আবাদ নিয়ে প্রজার মনে যদি কোনো বদ্ধমূল কুসংস্কার দানা বাঁধে তাহলে সেটি আবাদের আগে বুঝেশুনে পা বাড়ানো প্রয়োজন। নচেৎ প্রজা তার স্থান-কাল-পাত্র ভুলে রাজার একশেষ করে ছাড়ে।

পায়ুকামিতার মতো চর দখলের ঘটনায় কামাখ্যার বদ্ধমূল সংস্কারে গুরুতর আঘাত লাগার আশঙ্কা সায়েব করছিল। অজাচারে উৎসাহী হলেও সে গলায় ক্রুশ ঝুলাতো এবং রবিবারের প্রার্থনা সভায় পাদ্রী সাহেবকে সাক্ষী রেখে সৎ খ্রিস্টান হওয়ার শপথ নিতো। মানুষের বদ্ধমূল বিশ্বাসে আঘাত লাগার প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে সচেতন হওয়ার কারণে নলখাগড়ার রাজত্ব সাফ করার একটি মোক্ষম উপায় খুঁজছিল সে। দুর্গম ওই চরে ‘হার ম্যাজেস্টি’র নিশান উড়াবার আগে চরের অন্ধিসন্ধি জানার তাগিদ সায়েবের মনে তাই চাগা দিয়ে উঠলো। অনুচরদের দিয়ে কাজ হবে না বুঝে সে যখন হতাশ হয়ে পড়েছে,-‘শিরালি’র কথা তার মনে এলো। কামাখ্যায় ‘শিরালি’ একমাত্র লোক যে কিনা দুর্গম এই ভূগোলের আগাগোড়া চষে বেড়িয়েছে। অনুচর মারফত সায়েব খবর পেলো বিগত পূর্ব-পুরুষদের মতো লোকের নজর এড়িয়ে আজো সেখানে গিয়ে ঢোকে সে। রহস্যঘেরা ওই বনে একটি বয়স্ক সারস বাস করে, যার সঙ্গে বহু আরাধ্য এ-মাটির ইতিহাস নিয়ে ‘শিরালি’র নিয়মিত বাৎচিত হয়। নগরে গুজব ছিল ‘শিরালি’ হচ্ছে নিশাচর। রাত গভীর হলে ওই বনে গিয়ে ঢোকে সে এবং সর্পরূপী বন্দি রাজপুরুষের সমাধিপিঠে বসে সাপ-বেজি ও বন্য ভালুকের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অশীরীরী চিৎকার করে। সায়েব ক্রমে এটিও জানতে পেলো দুর্ভেদ্য চরের মাটিকে ‘শিরালি’ তার বাপ-দাদার ভিটে জ্ঞান করে, জোব্বাধারী দলপতির কামাখ্যায় আগমনের দিন থেকে যার পত্তনী ঘটে বলে লোকে বিশ্বাস করে। ‘শিরালি’ খোদা নাকি ইবলিশের চর তা-নিয়ে সেকালে বিস্তর গবেষণা করতো লোকে। তবে বুনো হাতিকে খেদায় ফেলে পোষ মানাবার ক্ষেত্রে তার কুশলতা এবং কবিরাজি ও ধানখেতের অলৌকিক রক্ষক হওয়ার কারণে কামাখ্যায় তাকে ঘাটাতে সাহস পেতো না কেউ।

ব্রাণ্টলি সায়েবের কালে পরিমাণে কমে গেলেও অত্র অঞ্চলে তখনো বেশুমার বুনো হাতির অস্তিত্ব ছিল। বিপজ্জনক বুনো হাতির দঙ্গল রাতবিরেতে কামাখ্যার ফসলি খেতে নেমে কৃষকের ফসল তছনছ করে দিতো। মাঝেমধ্যে নগরীর ভিতরে ঢুকে জনবসতিতে হামলা চালাতো তারা। বুনো হাতিকে পোষ মানাবার জন্য কামাখ্যায় মাটির সুড়ঙ বা খেদা তৈরির একটি প্রথা লোকে আবিষ্কার করেছিল। যেখানে গর্ত খুঁড়ে সুড়ঙ তৈরি হতো। সুড়ঙের প্রবেশমুখ লতাপাতা দিয়ে এমনভাবে ঢেকে দেয়া হতো যে হাতি তাকে রাস্তা-পারাপারের সেতু ভেবে সোজা ওই খাদের ভিতরে গিয়ে পড়তো। খেদায় আটকানো হাতির গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করার জন্য সুড়ঙের পাশে একজন মাহুতকে পাহারায় বসিয়ে রাখার প্রথা ছিল। হাতির তেজ কমাবার জন্য তাকে কিছু খেতে দেওয়া হতো না। হাতিটি দুর্বল হয়ে পড়লে কোনো পোষমানা হাতিকে ওই খেদায় নামিয়ে দেয়া হতো। অতঃপর মাহুত ও পোষমানা হাতির সাহায্যে কমজোর বুনো হাতিকে খেদা থেকে বের করে পোষ মানানোর পালা শুরু হতো।
খেদা-বিদ্যায় হাতিকে বশ করার কাজে ‘শিরালি’-র তুলনা ছিল না। তৎকালের জমিদারগণ তাকে এই কাজে নিয়োগ করতেন। খেদা দিয়ে হাতি ধরা ও পোষ মানানো তার রুজি-রোজগারের একটি অন্যতম উৎসে পরিণত হয়েছিল। সে যাহোক, ব্রান্টলি সায়েব পাকা জহুরি। ‘শিরালি’র কাজ-কারবার শুনে তাকে বাজিয়ে দেখার লোভ সামলাতে পারছিলো না সে। এক ঘনঘোর আষাঢ়ে মেঘের দিনে বাজ ও হাতির সর্দারটির আষাঢ়ে গপ্পো শুনার জন্য তার মন তেতে উঠলো। নিজের অভিলাষ গোপন করে সায়েব তাই একদিন ‘শিরালি’কে ডেকে পাঠালো। মাটিরঙা জোব্বা পরিহিত ‘শিরালি’ অতিকায় এক হাতির পিঠে চড়ে সায়েবের থানে এসে নামলো। তার গা থেকে বন ও সরীসৃপের উৎকট গন্ধ পাওয়া যাচ্ছিলো। সে-গন্ধের ধকল সইতে না-পেরে সায়েবের আঁতভুঁড়ি নড়ে উঠলো। লোকটি খুব উঁচু-লম্বা নয়, দীর্ঘদেহী সায়েবের পাশে তাকে আরো বেঁটে লাগছিল। তার মুখমণ্ডল গাছের বাকলের মতো খসখসে, যেন এখুনি সে-বাকল ফুঁড়ে নতুন কাণ্ড গজাবে! শরীরের তুলনায় হাত দুটি অস্বাভাবিক দীর্ঘ এবং পেশির শক্ত গিঁট লেগে এমনভাবে পাকানো যে প্রথমদৃষ্টে কুণ্ডলিপাকানো সাপ বলে ভ্রম হয়। লোকটির আঙুল দেখে সায়েবের মনে হলো আঙুলের প্রতিটি গিঁটে বন্য লাতাপাতা তাদের জাল বিস্তার করে আছে। আর মাংসপেশী ঠেলে বেরুনো চোখ দুটি ভাটার আগুনের মতো ধিকিধিকি জ্বলছে, যেন অতিকায় কোনো নিশাচর ভুল করে দিনকে রাত ভেবে শিকার খুঁজতে বেরিয়েছে। কদাকার চেহারার এই উদ্ভিদ পিণ্ডটিকে দেখে সুদর্শন ফিরিঙ্গির গা শিউরে উঠলো। ‘হার ম্যাজেস্টি’র রাজত্বে চোখ-নামানো নিরীহ প্রজা দেখে অভ্যস্ত সায়েব বন-জঙ্গলের দুর্বিনীত পিণ্ডটিকে দেখে অস্বস্তি বোধ করছিল। মনে হচ্ছিলো নিশাচরটি সুযোগ পেলে ঝাপ দিয়ে পড়বে এবং দীর্ঘ হাতের চাপে ফিরিঙ্গিকে পিষে মারবে। কোমরে বাঁধা রিভলবারের বাটে চাপ দিয়ে ফিরিঙ্গি নিজেকে প্রতিরক্ষার অস্তিত্ব যাচাই করে নিলো। চোখে চোখ রেখে সতর্ক সম্ভাষণের পর কথা শুরু করলো দু’জন :-


: ‘তুমি-ই ‘শিরালি’ বটে?

- ‘হা সায়েব। আমি শিরালি।’

: ‘তুমার গায়ে বিকট গন্ধ কেন? উহা কি বন হইতে আসিলো?’

- ‘না, এই গন্ধ আমার মায়ের শরীরে ছিল। লোকে তাকে গন্ধকালী নামে ডাকতো।’

: ‘গনডোকালী! বুঝিলাম না।’

- ‘ওসব বুঝে তুমার কাজ নেই। কেন ডেকেছো বলো!’

: ‘শুনিয়াছি তুমি নাকি বাজ ফিরাইয়া দিতে পারো?’

- ‘ঠিকই শুনেছো। তবে সব বাজ আমি ফিরাই না। লোকের অপকার করে বা ফসলের ক্ষতি করে এমন বাজ শুধু ফিরাই।’
: ‘কোন বাজ কী করিবে উহা কেমন করিয়া বুঝো!’

- ‘বাজের ডাক শুনলে বোঝা যায় কোনটি কেমন।’

: ‘হুম! এই হাতি কি তুমি ধরিয়াছো?’

- ‘না, বনের রাজার হাতি এটি। আমায় তিনি দান করে দিয়েছেন।’

: ‘বনের রাজা! বুঝিলাম না!’

- ‘এই মাটির বনে একজন রাজা থাকেন। আমরা সবাই তার প্রজা। রাজার জয় হোক।’

: ‘রাজা হইলে উনি বনে থাকিবে কেন?!’

- ‘ও তুমি বুঝবে না। রাজা বনে থেকে সব দেখেন-শুনেন। আমাদের পালন করেন।’

: ‘হাউ সিলি! তুমার কথা শুনিয়া হাসি পাইতেছে। তুমরা ইন্ডিয়ানরা বড়োই অদ্ভুত!’

- ‘আমি হাসির কথা কিছু বলিনি সায়েব। রাজা সবার কাছে দেখা দেন না, আবার অনেকে দেখা পেয়েও তাকে চিনতে পারে না।’

:‘হুম! আমি কে উহা কি জানো তুমি?’

- ‘জানি;-ফিরিঙ্গি সায়েব।’

: ‘আর কিছু জানো না?’

- ‘কী জানবো! তোমার গায়ের রঙ ফরসা। চোখ গেরিমাটির মতো আর তুমি খুব মদ খাও। আঙুর দিয়ে তৈরি মদ।’

: ‘আর কিছু?’

- ‘দাঁড়াও ভেবে নিই। হুঁ, তুমি লোক সুবিধার না। তোমার মন লোভে ভরা। মেয়েছেলের দিকে তোমার নজর ভালো নয়। বনের রাজা তোমায় ভালো লোক ভাবতে সবাইকে মানা করে দিয়েছেন।’

: ‘হুম! আমি ইচ্ছা করিলে তুমার করিতে পারি উহা বুঝো কি?’

- ‘কী আর করবে! মেরে ফেলবে তো? ও তুমি পারবে না সয়েব। ‘শিরালি’-কে তুমি মারতে পারবে না।’

: ‘তুমার মতো ভণ্ড সাধুকে মারিবার জন্য আমার বন্দুকের একটি গুলি যথেষ্ট মনে হইতেছে।’

- ‘চেষ্টা করে দেখতে পারো। ‘শিরালি’ আকাশের বাজ ঠেকায়। তুমার বন্দুকের গুলি তার কাছে পিঁপড়ের কামড়ের চেয়ে বেশি কিছু নয়।’

: ‘তুমি গুল মারিতে ওস্তাদ মনে হইতেছে। তুমরা বড়ো বেশি বাজে বকিয়া থাকো।’

- ‘বললাম তো। চেষ্টা করে দেখো আমায় মারতে পারো কিনা।’
: ‘থাক, আর বকিতে হইবে না। উহার চাইতে কাজের কথায় আসি। বাজে বকিলেও তুমায় ভালো লাগিয়াছে। অন্যদের মতন ডরাও নাই দেখিয়া তুমার কথা আর ধরিবো না ভাবিয়াছি।’

- ‘ভালো! তা আমায় ডেকেছো কেন বলো?’

: ‘তুমি তো শিরালি। আকাশে বাজের ডাক শুনিয়া সব বুঝিতে পারো। অনুমান করো দেখি...।’

- ‘আকাশের বাজ আর মানুষের মন এক নয় সায়েব। বাজের ডাক শুনে তার স্বভাব বুঝা যায়। মানুষের স্বভাব বাজের মতো না। তার মধ্যে অনেক প্যাঁচ পোরা থাকে। সায়েব, তুমি লোক ভালো না।’

: ‘হুম! তুমার মতো ভণ্ড সাধু আমার চেনা হইয়াছে। অনুমান করিতে পারো নাই তাই কথা ঘুরাইতেছো।’

- ‘রাগ করিও না সায়েব। আমরা ‘শিরালি’ কোনো বিষয়ে নিশ্চিত না-হয়ে কথা বাড়াই না। মনে হচ্ছে অন্তরে কোনো বদ মতলব পুরে তুমি আমায় এখানে ডেকেছো।’

: ‘বদ মতলব বলিতেছো কেন? ভালোও তো হইতে পারে।’

- ‘ঠিক আছে ধরে নিচ্ছি ভালো। এখন বলো কেন ডেকেছো?’

: ‘এই শহরে একটি জায়গা রহিয়াছে যেখানে লোকে যাইতে ভয় পায় ...!’

- ‘হু বুঝতে পারছি, ওখানে তোমার চোখ পড়েছে তাহলে!’

: ‘তুমি বুড্ডিমান আছো।’

- ‘কিন্তু ওটা তোমার জন্য নয় সায়েব। কামাখ্যায় বনরাজার মাটিকে কেউ নিজের
বলে ভাবে না।’

: ‘তুমি কি সত্য বলিলে? আমি শুনিয়াছি তুমি ওই মাটির মালিক বলিয়া দাবি করো।’

- ‘তুমি ভুল শুনেছো। মাটি নিজ থেকে না-চাইলে কেউ এর মালিক হতে পারে না। তবে হ্যাঁ, বনের রাজা যদি ইচ্ছে করেন তাহলে আমি এর মালিক হলেও হতে পারি।’

: ‘তুমি ‘হার ম্যাজেস্টি’র নাম শুনিয়াছো?’

- ‘রানীর দোহাই দিয়া ওই মাটি তুমি পাবে না সায়েব।’

: ‘তুমি বোধহয় ভুলিয়া গেছো ‘হার ম্যাজেস্টি’ ইচ্ছা না করিলে কেউ নিজেরে মালিক বলিয়া দাবি করিতে পারে না। দেশে উনার শাসন চলিতেছে। উনি অনুমতি না-করিলে কেউ মাটির মালিক হইতে পারে না। আমি অভিযোগ পাইয়াছি লোকের মনে ভয় তৈয়ার করিয়া তুমি ওই মাটি লাভ করিবার ইচ্ছা করিতেছো।’

- ‘তোমার কথা বিলকুল মিছে সায়েব। এই মাটি বনরাজার মাটি। তার অনুমতি ছাড়া কেউ এখানে ঢুকতে পারে না। মাটি তাকে গিলে নেয়।’

: ‘ঠিক আছে মানিয়া লইলাম ওই মাটি বনরাজা না কী যেন বলিলে, আমি মানিলাম মাটি তাহার। তুমার ওই বনরাজার সহিত আমি দেখা করিতে চাহি।’

- ‘মতলব!’

: ‘উনাকে জানাইয়া দিতে চাহি ‘হার ম্যাজেস্টি’ দেশে বিরাজ করিতেছেন। উহার অনুমতি ছাড়া কেউ নিজেকে রাজা ঘোষণা করিলে ‘হার ম্যাজেস্টি’ ব্যবস্থা নিতে কালবিলম্ব করিবেন না। আগামীকল্য আমি ওই বনে গিয়া ঢুকিবো। তুমি আমায় লইয়া যাইবে।’

- ‘যদি না যাই?’

: ‘দেখো ‘শিরালি’ নেটিভের সহিত বেশিক্ষণ কথা কওয়ার অভ্যাস আমার নাই। ‘হার ম্যাজেস্টি’র কর্মচারী নেটিভকে নির্দেশ করে, উহার সহিত বসিয়া বাজে কথায় সময় নষ্ট করে না। তুমি লইয়া না গেলে না যাইবে। আমরা বন চরিয়া খাই। ওই বনে ঢুকিতে আমার অসুবিধে হইবে না। তবে এরপর তুমার কী হইবে ভাবিয়া আফসোস লাগিতেছে।’

- ‘ভয় দেখিও না সায়েব। রানীর ভয় আমি করি না। তোমাকেও ভয় পাই না। মাটির দেহ সময় হলে মাটি গিলে নেবে। সে সময় যদি আগামীকাল হয় ‘শিরালি’ তাকে ভয় করে না। আমার বরং তোমার জন্য খারাপ লাগছে। একটা অনুরোধ করি তোমায়,-জেদ করে কিছু করতে যেও না। খামোখা জানটা খোয়াবে।’

: ‘ওইটা নিয়া তুমায় ভবিতে হইবে না। রাত্রি গত হইলে আমি ওই বনে ঢুকিতে ইচ্ছা করি। বনটি অনেক বড়ো হওয়ায় পথ-ঘাট জানি না। তুমি সঙ্গী হইলে সুবিধা হয়,-ঘুরিতে কম সময় লাগিবে। যদি না যাও বেশি ঘুরিতে হইবে, হয়তো বের হইতে রাত্রি পার হইয়া যাইবে। এর বেশি ঝুঁকির ভয় করি না। শেষবারের মতন জানিতে চাই-যাইবে কি না?’

- ‘সায়েব তুমি পাগলাটে লোক। অহংকারে অন্ধ হয়ে আছো। তোমার জন্য আমার মায়া হচ্ছে।’

: ‘নাটক করিও না। ইন্ডিয়ায় সাধু-ফকিররা খালি নাটক আর ম্যাজিক করে। তুমি যাইবে কিনা বলো।’

- ‘ঠিক আছে যাবো। কিন্তু একটা কথা জানতে চাই...’

: ‘ঝটপট কহ।’

- ‘তোমায় নিয়ে ওই বনে ঢুকে আমার কী লাভ?’

: ‘সাবাশ! এই তো লাইনে আসিয়াছো। তুমার লাভ এই যে ওই বন আবাদি হইলে ‘হার ম্যাজেস্টি’র হইয়া তুমি উহা শাসন করিতে পারিবে। বিনিময়ে ‘হার ম্যাজেস্টি’ আবাদি বাবদ খাজনা ও রাজস্ব পাইবেন। ওই বনে নতুন বসতি হইবে, লোকে ঘর-সংসার, চাষবাস করিবে। ‘হার ম্যাজেস্টি’র রাজ্য আরো প্রসারিত হইবে। নিশ্চয় শুনিয়াছো উনার রাজত্বে সূর্য অস্ত যায় না।’ পৃথিবীর সব দেশে উহার রাজ চলিতেছে। সবাই উনারে মানিয়া লইয়াছে। ওই বনটি এর বাহিরে ছিল। এইবার সে ‘ম্যাজেস্টি’র অধীন হইবে দেখিও।’

- ‘হুঁ। সব বুঝতে পেরেছি। ঠিক আছে, তুমি তৈরি থেকো। আজ মাঝরাতে আমি আসবো।’

: ‘মাঝরাত! কেন, ভোরে রওয়ানা দিলে অসুবিধা কি?’

- ‘না সায়েব, তা হয় না। ভোরে লোকজন জেগে যাবে। তোমার সাথে আমায় দেখলে তারা ঝামেলা করতে পারে।’

: ‘হুম!’
- ‘কী হলো সায়েব। মাঝরাতের কথা শুনে তুমি দেখি দমে গেলে। ভয় পাচ্ছো?’

: ‘আরে না। আমাদের অভিধানে বলে, ‘নেটিভকে বিশ্বাস করিও না। সুযোগ পাইলে বুকে চাকু বসাইয়া দিবে।’ কিছু মনে করিও না, নেটিভ হইয়া তুমি যে উহা করিবে না এইটা ভাবিতে পারিতেছি না।’

- ‘ভয় পেয়ো না সায়েব। আমি খুনি না। ‘শিরালি’রা কখনো মানুষ খুন করে না। ওতে আমাদের পাপ হয়। দেখো সায়েব, মাটির মাঝে দম ফুঁকে খোদা যাকে তৈয়ার করেন তার জান কবজ করতে হলে তিনি করবেন। আমার সে ক্ষমতা নাই। ‘শিরালি’ বাজ ঠেকাতে পারে, মানুষের জান কবজ করতে পারে না। তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারো।’

: ‘হুম! সাধু-ফকিরের এইসব কাহিনী আমি শুনিয়াছি। দেখো, বনের পশু-পক্ষিদিগকে আমি ভয় করি না, কিন্তু নেটিভ উহার চাইতে ভয়ংকর হইয়া থাকে। যিশুর দিব্বি দিয়া কহ তুমি সুযোগ লইবে না!’

-‘সায়েব, তুমার কথা শুনে রাগ উঠার কথা। কিন্তু রাগ আসছে না। বরং মায়া হচ্ছে। তুমি আসলে স্বার্থপর একটা লোক। নিজেকে ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারো না। কামাখ্যায় লোকে তোমায় কেন এতো ভয় পায় কে জানে!’

: ‘দেখো ‘শিরালি’, তুমার সহিত বকবক করিতে ভালো লাগিতেছে না। তুমি যিশুকে বিশ্বাস করো না, আমি করি। উহার দিব্বি দিতে না-পারো, যাহাকে তুমি খোদা মানো উহার দিব্বি দিয়া কহ ‘সুযোগ লইবার চেষ্টা করিবে না।’

- ‘হায়রে ফিরিঙ্গি সায়েব! ঠিক আছে তোমার ওই ‘যিশুর দিব্বি’ দিয়ে বলছি আমায় নিয়ে ভয় পেতে হবে না। সুযোগ পেলে আমি কিছু করবো না। যাক, এখন আসি। মনে রেখো ‘মাঝরাত’ হলে আমরা বেরুবো।’

: ‘হুম! তাহাই হোক তবে। তুমার জন্য আমি এখানে অপেক্ষা করিবো।’
৮.
আষাঢ়ের ওই দিনে ‘শিরালি’-কে বিদেয় করার পর ব্রান্টলি সায়েব তার দাপ্তরিক কাজকর্মে ডুবে গিয়েছিল। কবেকার সেই আষাঢ়ে মেঘের দিন! ইতিহাসের ধুলো-ময়লা ঘেটে তার সামান্য যেটুকু আভাস পাওয়া যায় তা দিয়ে মাটি আবাদের সঠিক দিকনির্ণয় হয় না। সেকালের সরকারি পরিসংখ্যান ও দলিল-দস্তাবেজে নদী-বন শাসিত কামাখ্যার ওই চরটি ‘হার ম্যাজেস্টি’র অন্তর্গত বিবেচিত হলেও জনবসতির ইতিকথায় এর নিশ্চিত কোনো সাক্ষ্য মেলে না। ব্রান্টলি সায়েবের শতচ্ছিন্ন দিনলিপির টুকরো-টাকরা জড়ো করে বোঝা অসম্ভব ‘শিরালি’র সাথে তার বন-ভ্রমণের পরিকল্পনাটি সাফল্য পেয়েছিল কিনা! দিনলিপির এক জায়গায় সায়েব লিখেছে :-

‘অত্র অঞ্চলে ইলিশ মাছের ডিম দিয়ে এক প্রকার কারি হয়। ইলিশ মাছ ইংলন্ডের স্যামনের চেয়ে অধিক সুস্বাদু। বর্ষার ভরা মওসুমে ডিম পাড়িবার জন্য উহারা সাগরের লোনা জল পার হইয়া নদীর মিঠা পানিতে চলিয়া আসে। জেলেদিগের জালে ডিমওয়ালা বড়ো-বড়ো ইলিশ যখন ধরা পড়ে চারদিকে তখন অপূর্ব এক শোভা হয়। ইলিশ মাছের ডিম দিয়ে তৈয়ার কারি যেমন সুস্বাদু, ‘শিরালি’র সহিত নগরীর দুর্গম মাটিতে প্রবেশের উত্তেজনা আমার কাছে তদরূপ বোধ হইতেছে! ‘শিরালি’র জন্য অপেক্ষায় রহিয়াছি। কখন যে মধ্যরাত হইবে আর ‘শিরালি’ আসিয়া ডাক দিবে সেই উত্তেজনায় শরীর কাঁপিতেছে। জেসাস করুন, উহা যেন অতি সত্বর হয়। এই বিলম্ব আর প্রাণে সহিতেছে না!’

দিনলিপি থেকে বুঝতে অসুবিধে হয় না ‘শিরালি’র জন্য সায়েব অধীরচিত্তে অপেক্ষমান ছিল। সেই অপেক্ষার পরিসমাপ্তি নিশ্চয় ঘটেছিল। কিন্তু তার পরের ইতিহাস ঝাপসা এবং তথ্যলুপ্তির কারণে ঘোলাটে। উড়োকথার খনি অবশ্য এই ঘটনার ওপর আলোকপাতের চেষ্টা করেছে। লোকস্মৃতির জটাজাল পেরিয়ে তা এক ভীতিকর কাহিনীকে উন্মোচিত করে এবং আজো লোকের মনে ওই বন সম্পর্কে অজানা শিহরণের জন্ম দেয়। সেকালের কথক-ঠাকুরদের বয়ান থেকে জানা যায় ‘শিরালি’ ঠিক মাঝরাতে ব্রান্টলি সায়েবের ঘরে এসে টোকা দেয়। অধীর ও রোমাঞ্চিত সায়েব ‘শিরালি’র সাথে হাতির পিঠে গিয়ে উঠে। অতিকায় সেই গজ মন্থর চালে পিঠের সওয়ারিদের নিয়ে নদী-খাল ঘেরা চরের বনে ঢুকে পড়ে। তারা যখন চরে প্রবেশ করে তখন অঝোরধারায় বৃষ্টি শুরু হয়েছে। কোলা ব্যঙের একটানা শব্দপ্রবাহ ও বনের অদ্ভুতুড়ে পরিবেশ সইতে না পেরে অস্থিরচিত্ত ফিরিঙ্গি সায়েব ‘শিরালি’-র সাথে ভাব জমাবার চেষ্টা করে। এই বনের সীমানা কোথায় গিয়ে শেষ হয়েছে তা জানবার বাসনা সায়েবের মনে তীব্র হয়। ‘শিরালি’ হাতের আঙুলের ইশারায় তাকে কথা বলতে মানা করে। বন-জঙ্গলার ঘন বেড়া ভেদ করে উঁচু একটি ঢিবির পাশে এসে হাতিটি হাটু গেঁড়ে বসে পড়েছিল। অতিকায় সে গজের ওজন সইতে না-পেরে চারপাশের ডালপালা মচমচ করে ওঠে। অবিরাম বৃষ্টিধারার মাঝে ব্যাঙ-প্যাঁচা ও শেয়ালের চিৎকারের সাথে পাল্লা দিয়ে হাতির চিৎকারে সায়েবের কানে তালা লাগার উপক্রম করে। ঢিবির পাশে কাঁঠাল গাছের গুঁড়িতে সে তাই হেলান দিয়ে বসে পড়ে। ‘শিরালি’ তখন একটি মশাল জ্বালায়। মশালের আলোয় কাঁঠাল গাছের ডালে একটি ছাইরঙা সারস পাখিকে বৃষ্টিতে ভিজতে দেখে সায়েবের অবাক লাগে। ভ্রƒক্ষেপহীন ‘শিরালি’ এবার ‘ইয়া আলী, বান্দা হাজির’ বলে চিৎকার করে ওঠে। তার এই উদ্ভট চিৎকার বনের চারপাশে তরঙ্গ উঠালে বৃষ্টির ধারা মন্থর হয়ে আসে আর কোলা ব্যঙের একঘেয়ে শব্দপ্রবাহে ক্ষণিক বিরতি ঘটে। রাতের আকাশ তখন বেশ ফর্সা হয়ে এসেছে। ‘শিরালি’ হাতের ইশারায় ফিরিঙ্গি সায়েবকে হাতির পিঠে চড়ে বসবার নির্দেশ দেয়। সায়েব নীরবে সে আদেশ পালন করে। নির্দেশ পালনের ভঙ্গি দেখে মনে হয় এই ঘন বন, তার গাছ-গাছালি ও মাটিরঙের জোব্বা পরিহিত ‘শিরালি’ তাকে সম্মোহিত করে ফেলেছে। সম্মোহন কাটানোর মতো মনের জোর যেন অবশিষ্ট নেই আর!

সায়েব হাতির পিঠে চড়ে বসার পর আজব এক দৃশ্যের অবতারণা ঘটে বনে। মাটির উঁচু ঢিবিটি দু’পাশে ধস-ধস শব্দে ভেঙে পড়তে শুরু করে এবং ঢিবির মাঝখান ফুঁড়ে একটি চকড়া-বকড়া রঙের সাপের আবির্ভাব ঘটে। ধসে-যাওয়া মাটির ওপর গুঁড়ি মেরে বসা সাপটি ‘শিরালি’র কপাল বরাবর লকলকে ফণা তোলে শরীর দোলায়। সায়েব তার কোমরের বাট থেকে বন্দুক বের করে সাপের ফণা লক্ষ করে গুলি ছুঁড়তে গেলে ‘খবররদার! বনের রাজার গায়ে হাত তুলো না। সর্বনাশ হবে তোমার।’ বলে ‘শিরালি’ হাত নেড়ে তাকে গুলি ছুঁড়তে নিষেধ করে। ‘শিরালি’র নিষেধবাক্য শুনে সায়েবের মনে ওই দিন সকালবেলার স্মৃতি উদিত হয়। ‘তাহলে এই সেই বন রাজা!’-বিস্ময় ও কৌতুকের ধকল সইতে না-পেরে ফিরিঙ্গি হো হো করে হেসে ওঠে। হাসির ধারাটি অবশ্য বেশিক্ষণ বজায় রাখতে পারেনি সে। কেননা তার চোখের সমুখে ‘শিরালি’-র জ্যান্ত দেহ ভোজবাজির মতো হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। জ্যান্ত মানব-শরীরের পরিবর্তে সেখানে একটি বেজির আবির্ভাব ঘটে। সাপ ও বেজির আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণে পুরো বন প্রকম্পিত হলে সায়েবের মনে অজানা আশঙ্কা উঁকি দিতে শুরু করে। ‘শিরালি’র আকস্মিক অন্তর্ধান এবং তার জায়গায় একটি বেজির আবির্ভাব তাকে এতোদূর বিভ্রান্ত করে ফেলে যে সে জেগে আছে নাকি দুঃস্বপ্ন দেখছে তা ঠাহর করে উঠতে পারে না। লড়াই-মত্ত সরীসৃপের হিস হিস শব্দকে বধির করে দিয়ে আকাশ ফাটিয়ে বিদ্যুতের লহর মাটিতে এসে ধাক্কা মারে। কাঁঠাল গাছের গুঁড়িতে রাখা মশালটি দপ করে নিভে যায়। বাজের আগ্রাসী গর্জনে হাতির পিঠে বসা সায়েব দু’এক বার ‘হোয়াটস হেল’ বলে চিৎকার দিয়ে ওঠে। পুরো বন ভাসিয়ে মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয় আর সায়েবের মনে হতে থাকে সাপ, বেজি ও বুনো গাছপালা মিলে তাকে তাড়া করবে এবার। চারপাশে নাগিনীর বিষাক্ত নিঃশ্বাস ও গাছপালার শক্ত চাপ অনুভব করে সে। হাতির পিঠে জোরে চাপড় মেরে সায়েব তার বন্দুকে এলোপাতাড়ি গুলি ফোটায়। পাগলামিভরা এইসব হট্টগোলের মাঝখানে পড়ে হতচকিত হাতিটি তার বৃহৎ শুঁড় নাড়িয়ে বন-বাদাড় ভেঙে ছুটতে শুরু করে। হাতির পিঠে বসা সায়েব তখন জ্ঞান হারিয়েছে। জ্ঞান তার ফিরেছিল কিনা সেই বিবরণ কথক ঠাকুরের বয়ান থেকে বিশেষ পাওয়া যায় না। পরিশেষ হিসাবে এটুকু শুধু উল্লেখিত হয় যে দুর্যোভরা ওই আষাঢ় রাতের পর থেকে সায়েবকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি!

৯.
‘হার ম্যাজেস্টি’র বিশ্বস্ত আমলার নিরুদ্দেশ হবার চাঞ্চল্যকর কাহিনী সেকালে দারুণ তোলপাড় তুলেছিল। কামাখ্যার ইতিহাসে প্রথমবারের মতো দুর্গম ওই চরে ইংলন্ডের দক্ষ সৈন্যবাহিনীর অনুপ্রবেশ ঘটে। প্রকাশ্য দিবালোকে নগরবাসীর ক্ষোভ-শঙ্কা পায়ে দলে রানীর সৈন্যবাহিনী গুলি-কামানের লাটবহর নিয়ে দুর্গম চরে গিয়ে ঢোকে। সারা বন তন্নতন্ন করে সন্ধ্যা নাগাদ তরা ফেরত আসে। সৈন্যদের মুখ দেখে মনে হচ্ছিলো তারা সম্মোহিত হয়ে পড়েছে এবং সম্মোহনটি কখনো কাটবে না। ব্রান্টলিকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। সেকালের বিবরণ থেকে জানা যায় দিনের অভিযান শেষে একটি অতিকায় বিষধর কেউটে ও ধূসর রঙ বেজির মৃতদেহ ছাড়া দুর্গম ওই চরে আর কোনো মৃতদেহ উদ্ধার করা সৈন্যদের পক্ষে সম্ভব হয়নি।

ব্যর্থ এই অভিযানের পর কামাখ্যার দৈনন্দিন প্রবাহে ছন্দপতন ঘটতে শুরু করে। কোনোকিছু আগের মতো ধারাবাহিক রইলো না। দুর্গম চরটিকে জনবসতির পক্ষে আরেকবার পরিত্যক্ত ঘোষণা করে সরকার-রাজ ভারতব্যাপী চাগিয়ে ওঠা সহিংসতা সামাল দেবার কাজে মন দিয়েছিলেন। মানুষ ঘটনার নিয়ন্ত্রক নয়, সে এর ক্রীতদাস মাত্র হয়,-ঘটনার তোড়ে ভেসে যায় বলে অতীত তার কাছে ক্রমশ ঝাপসা বা বাসি হয়ে ওঠে। ঘটনার স্রোতে ব্রান্টলি সায়েবকে মানুষ একসময় ভুলে যেতে লাগলো। কিন্তু জেগে রইলো ইতিহাস। অসংখ্য ঘটনা বুকে নিয়ে বহমান সেই নীরব নদীটি সাঁতরে কামাখ্যা একদিন টের পেলো ‘হার ম্যাজেস্টি’র রাজত্বে কখন-কীভাবে জানি সে ভাগ হয়ে গেছে!

দেশ ভাগ হলে জমি ভাগ হয়, আর জমি বিভক্ত হলে মানুষের ভাগ না হয়ে উপায় থাকে না। কামাখ্যা নগরীও একদিন এভাবে ভাগ হয়ে গেলো! শরতের এক অতি উষ্ণ দিবসে নিস্তরঙ্গ নগরটি মানুষের মিছিল ও হট্টগোলে গমগম করে উঠলো। মিছিলের সারি অদ্ভুতভাবে নগরের মাটিকে দু’ভাগ করে দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিলো। তার এক ভাগ দিয়ে বিদ্যমান জনবসতিকে পেছনে রেখে লোকেরা সরে যাচ্ছিলো; অন্যভাগ দিয়ে অচেনা সব লোকজন এসে পুরনো বসতি দখল এবং নতুন বসতি পত্তন করতে লাগলো। আবারো নয়া যুগের পদধ্বনি পাওয়া গেলো।

প্রবেশ-নির্গমনের এই আকস্মিকতায় চঞ্চল কামাখ্যা ভারতবর্ষব্যাপী চলমান উদ্বাস্তু-মিছিলে যোগ দিয়ে টের পেলো তার মাটি পরিষ্কার দুটো ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। মনখারাপ সেই দিনে সে আরো দেখতে পেলো নগরীর কেন্দ্রস্থল ঘিরে বিরাজমান দুর্গম চরটি অচিহ্নিত সীমানার মতো পতিত পড়ে আছে। সে কার ভাগে যাবে তা নিয়ে ভাগকরনেওয়ালাদের মধ্যে জোর তর্ক-বিতর্ক শুরু হলো। তর্ক-বিতর্ক অবশেষে হাতাহাতি অব্দি গড়ালো। সংকটময় সে-মুহূর্তে চরের গাছপালা ঘেরা ঘন বন থেকে একটি অদ্ভুত লোককে বের হতে দেখলো সবাই। তার সঙ্গে তারুণ্যে দীপ্যমান এক কিশোর ও একজন মধ্যবয়সী রমণীও ছিলেন। লোকটির কাঁধের ওপর ছাইরঙা সারস পাখি বসে আছে দেখে সবাই একটু অবাক হলেন। নিজেকে সে ‘শিরালি’র বংশধর বলে পরিচয় দিলো। উদ্বাস্তু মিছিলের তাড়াহুড়ার মধ্যে তার এই আবির্ভাব এতো অভাবিত ছিল যে কিছুক্ষণের জন্য সবাই স্থাণু হয়ে পড়েছিলেন। লোকটি বক্তৃতার ঢঙে তার কথা শুরু করলো, ‘কিছু মনে করবেন না। আমার মনে হয় আপনারা খামোখা উত্তেজিত হচ্ছেন। আপনাদের সমস্যার সমাধান আমি এখুনি করে দিচ্ছি। তবে তার আগে জানিয়ে রাখি দুর্গম এই চর একদিন অবশ্যই আবাদ হবে। আমার বংশধরের হক যেন তখন কেউ কেড়ে না নেয়।’ ভাগকরনেওয়ালাদের একজন বলে উঠলেন, ‘সে তো বুঝলাম। কিন্তু কী দিয়ে সমস্যার সুরাহা হবে শুনি।’ লোকটি বক্তৃতা থামিয়ে আঙুল দিয়ে তুড়ি বাজাতেই কাঁধে বসা সারসটি জোরসে পাখা ঝাপটে উড়ার ইঙ্গিত দিলো। পাখা ঝাপটানো বলাকার দিকে তাকিয়ে তার মুখ হাসিতে স্ফারিত হলো, ‘আপনারা শোনেন, কামাখ্যার মাটি পুব ও পশ্চিমে দু’ভাগ হয়ে গেছে। এই পাখিটি পুব-পশ্চিম সব দিকে উড়াল দিতে পারে। পাখিটি মোট ছয় বার পুব-পশ্চিম বরাবর আকাশে পাক খাবে। যে-দিকে সে চারবার বা বেশি পাক খাবে চরের মাটি সেই ভাগে পড়বে। আপনারা এই সমাধানে রাজি আছেন?’

উদ্বাস্তু-মিছিলের তোড়ে জাদুবিস্তীর্ণ কামাখ্যায় জাদু ও কিংবদন্তির আবেদন ম্রিয়মান হয়ে এসেছিল। ‘শিরালি’র উত্তরসূরি বলে দাবিদার লোকটির খসখসে মুখমণ্ডল এবং ঠোঁটের রেখায় বিলীয়মান জাদুলহরির আভাস পেয়ে লোকজন আবার চঞ্চল হয়ে উঠলো। ভাগকরনেওয়ালারা এই প্রস্তাবে সম্মতি জানালেন। হয়তো-বা তাদের মনে হলো রাজনীতির দুর্বিপাকে হাবুডুবু খাওয়ার চাইতে সারস পাখির চক্কর অনেক সহজ সমাধান। যদিও এই আশঙ্কা সমানে উঁকি দিয়ে যাচ্ছিলো যে সারস যদি উভয় দিকে সমান তিন চক্কর দেয় তাহলে কী হবে! জাদুকর নাকি মানুষের মন পড়তে পারে। ‘শিরালি’র বংশধর তার প্রমাণ হিসাবে হাসিতে মুখ ভরিয়ে জানান দিলো, ‘ভয় পাবেন না। এই সারস দুই দিকে তিন চক্কর দেবে না।’ সারসের ডানায় আস্তে টোকা দিলো সে। পাখিটি তার পাখা ঝাপটে নিমিষে অনেক উপরে উঠে গেলো। নগরীর ঠিক মধ্যবিন্দু অর্থাৎ যেখান থেকে পুরো নগরটি পুব-পশ্চিমে ভাগ হয়ে গেছে সেই বিন্দুর চারধার ঘিরে খানিকক্ষণ পাক খেলো সে। জনতা তখন আকাশে চোখ তুলে উড়ন্ত বলাকার গতিবিধি নিরীক্ষণ করছে। এবার তারা পুব-পশ্চিম এ দুটো ভাগে ভাগ হয়ে গেলো। সারস প্রথম তিনবার জোব্বাধারী দলপতির সমাধি বরাবর পুবে পাক খাওয়ার পর মধ্যবিন্দুতে এসে তার গতি মন্থর করে দিলো। জনতার মধ্যে উত্তেজনার তরঙ্গ বইতে শুরু করেছিল। পুব-পক্ষের লোকজন জাদুকরের অভয়বাণীর ওপর আস্থা রেখে নিশ্চিন্তমনে আকাশের দিকে তাকিয়েছিলো। তাদেরকে হতাশ করে দিয়ে সারসটি এবার পশ্চিমে দুই পাক ঘুরে ফের মধ্যবিন্দুতে এসে তার ডানা গুটিয়ে নিলো। অপেক্ষমান জনতার মাঝে শ্বাসরোধী চাঞ্চল্যের তীব্র ঢেউ বইতে শুরু করেছে তখন। চারদিকে মৃদু গুঞ্জন বইতে লাগলো।

ভাগকরনেওয়ালারা মনে-মনে জাদুকরের ওপর বিরূপ হয়ে উঠলেন। কেননা সারসের হাবভাব দেখে বোঝা যাচ্ছিলো সে এবার পশ্চিমে উড়াল দেবে। তার মানে সমস্যার সমাধান ঘটছে না, মাঝখানে অনেকটা সময় নষ্ট হয়েছে। তাদের আশঙ্কাকে সত্য প্রমাণ করে সারস এবার পশ্চিমে ডানা ঘুরালো। উপস্থিত জনতার মাঝে ক্ষোভ ও হাতাশার তরঙ্গটি কেবল বইতে শুরু করেছে, তখন সবাইকে অবাক করে দিয়ে উড়ন্ত বলাকাটি সোজা দুর্গম চরের ভেতরে সেঁধিয়ে যেতে লাগলো। এই অদ্ভুত উপহাস যে হাহাকার সম্ভব করতে পারে জনতার মাঝে তার একটি কলরব শুরু হয়ে গেলো। ভাগকরনেওয়ালারা সারসবাহী জাদুকরকে ঘিরে ধরলেন। তাদের মারমুখো আক্রমণের মধ্যে জাদুকর প্রশান্ত কণ্ঠে গমক দিয়ে উঠলো :-

‘ভাইসব, আপনেরা এতো বিচলিত হচ্ছেন কেন! এই দুর্গম চর নিয়ে এতো হল্লা করার কী আছে বলুন? কামাখ্যা ভাগ হওয়ার আগে ফিরিঙ্গি সায়েব ও আমার বংশধর ছাড়া অন্য কেউ এ-মাটি আবাদ করার কথা স্বপ্নেও ভাবেনি। আপনাদের কাছে তা বরাবর দুর্গম ও পরিত্যক্ত গণ্য হয়েছে। তবে আজ এর ভাগাভাগি নিয়ে সবাই এতো অস্থির হয়ে পড়ছেন কেন!’

তার বক্তৃতায় উপস্থিত ভিড় শান্ত হয়ে এসেছে অনুভব করে লোকটি আবার কথা শুরু করে :-

‘দেখুন, আবাদি মাটি ভাগ হয় কিন্তু অনাবাদিকে ভাগ করার কথা কারো মনে পড়ে না। চরের এই অনাবাদি মাটি ভাগ হলেও অখণ্ড রয়ে যাবে। কারণ, আবাদির লাঙ্গল ছাড়া ফসল ও বসতির পত্তন হয় না, আর তা না-হলে অনাবাদি মাটি পতিত ও পরিত্যক্ত পড়ে রয়! আমি আপনাদের বলছি, নদী-খাল ও জঙ্গলে ভরা এই মাটি কখনো ভাগ হবে না। ভাগ্যবিধাতা করুণা না-করলে অনাবাদিকে আবাদি করা যায় না। যদি-বা করেন তা ফের পতিত হতে চায়। তাই বলি এই মাটির দাবি আপনারা ছেড়ে দিন। একে এভাবে পতিত ও পরিত্যক্ত পড়ে থাকতে দিন।’

বক্তৃতার এই পর্যায়ে ভাগকরনেওয়ালারা হাত নেড়ে চিৎকার করে উঠে :-

‘বুজরুকি থামাও। তোমাকে আমরা ভালো করে চিনে গেছি। কথার মারপ্যাঁচ দিয়ে চরের মাটি নিজের দখলে নিতে চাইছো তুমি। সেটি হবে না। এই মাটিকে অবশ্যই ভাগ হতে হবে। এখানে কেউ আবাদ করুক বা না-করুক তাতে কিছু যায় আসে না। আমরা নিয়মমাফিক সব করতে চাই। তুমি মাঝখানে এসে বাগাড়া দিয়ো না। যাও, ভাগো এখান থেকে।’
মারমুখো জনতার দিকে একপলক তাকিয়ে ‘শিরালি’র বংশধর মৃদু হাসিতে মুখ ভরিয়ে তোলে :-

‘গোস্তাখি মাফ করবেন। আমি মাটির স্বভাবের কথা বলছিলাম। আপনারা উত্তেজিত হবেন না। ঠাণ্ডা মাথায় একবার ভেবে দেখুন ফিরিঙ্গি সায়েব ও আমার পূর্ব পুরুষরা ছাড়া আজ পর্যন্ত দুর্গম এই চরের মাটিতে আপনারা কেউ ঢুকেছেন কিনা। আপনারা নিশ্চয় স্বীকার করবেন অবাধ্য বুনো মাটি আবাদ করার জন্য যে সাহস প্রয়োজন, পাপী বলে স্বীকৃতি লাভের যে ঝুঁকি এখানে থাকে তা বহন করার মতো শক্তি আপনাদের কারো কি ছিল? সুতরাং আমি যদি এই মাটিকে নিজের দাবি করে তা কি খুব বড়ো কোনো অন্যায়? আপনারা-ই বলুন?’

লোকটির প্রশ্নাতুর মুখের দিকে তাকিয়ে জনতা নির্বাক হয়ে পড়ে। নিশ্চল কিছু মুহূর্ত অতিক্রান্ত হওয়ার পর সে তার মুখে স্মিত হাসির ঢেউ তোলে :-

‘আপনারা শোনেন, এই মাটি ভাগ ভাগ করা যাবে না। দেশের সীমানা বদল হয় বটে, কিন্তু মাটি মাটি-ই থেকে যায়। তাই আমার আবেদন, আসুন এই মাটিকে সমান দু’ভাগে চিন্ দিয়ে পুব-পশ্চিমে ভাগ করে নেওয়া যাক। আগামীতে আমরা যখন পুবে বসে পশ্চিমের জন্য এবং পশ্চিমে বসে পুবের জন্য হাহাকার করবো তখন এই মাটির টুকরো আমাদের সান্ত্বনা যোগাবে। কেননা তখন আমাদের মনে হবে অনাবাদি এই মাটি আজো অবিকল আছে! চারদিকে নতুন সব বসতি ও ফসলি খেতের মাঝখানে চরের দুর্গম মাটি পুব-পশ্চিমের স্মৃতি ও ঐক্যের বাহন হয়ে রইবে। আমরা এই ভেবে স্বস্তি পাবো,-সব ভাগ হয়ে গেলেও দুর্গম চরের মাটি দুটো ভাগে সমান ও অখণ্ড রয়ে গেছে। আপনারা আমার কথা যদি গভীরভাবে বিবেচনা করেন তাহলে চর নিয়ে আর কোনো ঝামেলা থাকে না।’

লোকটি তার কথা শেষে দ্রুত পদে জনতার ভিড় ঠেলে চরের পুবমুখো মাটির গভীরে মিলিয়ে যেতে থাকে। সঙ্গী রমণী ও কিশোর তাকে অনুসরণ করে। আজব এই লোকটির অপসৃয়মান দেহের দিকে তাকিয়ে উদ্বাস্তু-মিছিল আবার সবাক হয়। ভাগকরনেওয়ালারা সারসবাহী আগন্তুকের কূটনীতিজ্ঞানের প্রশংসায় মুখর হয়ে ওঠেন। চরের মাটিকে পুব-পশ্চিমে সমান দু’ভাগ করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন তারা। আর ওদিকে সময় তার নিজের নিয়মে ঘুরে চলে।

একালের সেকাল

১০.
নতুন সময় নতুন বিন্যাস আনে কামাখ্যায়। তার নাম পাল্টে যায়। নগরীর গঠন ভেঙে শান্ত মফস্বলের দিকে আবার অগ্রযাত্রা করে সে। তবে পরিধি আগের মতো সঙ্কুচিত থেকে যায়, যেন এর অধিক কোনো প্রসারণ তার পক্ষে সম্ভব নয় আর! শহরটি মাটিবন্দি রাজপুরুষের দুর্গ বা ‘হার ম্যাজেস্টি’র নগরী থেকে মহানগরীতে পরিণত হতে পারতো, কিন্তু তার ভৌগলিক অবস্থান পরিষ্কার বুঝিয়ে দেয় অদূর ভবিষ্যতে জনবসতি বাড়লেও একটি ব্যস্ত শহরের অধিক কোনো নিয়তি বিধাতা তার কপালে লিখে রাখেননি। নতুন সময়ের পালাবদলের মাঝে শহরটি তাই দুর্গ ও নগরীর প্রাচীনত্ব সাথে করে মোটের ওপর শুনশান মফস্বলী শহর হিসাবে ক্রমাগত নির্দিষ্টতা পেতে থাকে।

আমরা যে পত্তনীদারের গল্প করি তিনি এই প্রসারণহীন প্রসারণের মাঝখানে বসে পরিত্যক্ত মাটির বুকে তার চুন-সুড়কির বাড়িটি তুলতে শুরু করেন। ‘শিরালি’র উত্তর-পুরুষ হিসাবে এই কাণ্ড লোকজনের মনে ভয় ধরিয়ে দিলেও একপলের জন্য তার হাত কিন্তু থেমে থাকে না। শহরের বুকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের নিয়তি মেনে নিয়ে সেকালের ব্যবসায়ী পত্তনীদার পূর্ব-পুরুষের অবশিষ্ট জাদুশক্তিকে বাড়ি তৈরির কাজে ব্যবহার করেছিলেন। তার ক্ষেত্রে জাদুশক্তিটি ছিল টাকা ও ক্ষমতা। মানুষ বিত্তবানের ক্ষমতাকে ভয় পায়। নতুন সময়ের পত্তনীদার আকাশের বাজ ঠেকানোর পরিবর্তে পাক্কা ও হিসাবী আড়তদার হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা দিতে পেরেছিলেন। টাকার শক্তি মারাত্মক। তার জাদুটোনায় বনের বাঘ পর্যন্ত নাকি বশ হয়! প্রচীনরা তাই কাব্য করে বলেন, ‘টাকায় বাঘের চোখ মেলে’। প্রবাদের সত্যতা প্রমাণ করে দুর্গম চরে পত্তনীদারের বাড়িটি তাই তরতরিয়ে উঠতে শুরু করেছিল। সংস্কার ও অতিকথার প্রভাবে শহরের লোকজন বাড়িটিকে এড়িয়ে চললেও তিনি একে নিজের ঘর-সংসারে পরিণত করেন। দুর্গমকে আবাদের নেশায় এতো বছর ধরে লেগে থাকার সার্থকতা হিসাবে লোকে তার এই গোয়ার্তুমিকে মেনে নিয়েছিল। তারা মনে করতো এর পরিণতি ভালো না-হলেও পত্তনীদারকে এটা মানায়। তার দাদা-পর দাদারা যে-জমি আবাদের জন্য নিজেকে নিঃস্ব করেছেন, এবার সেখানে পত্তনীদারের সাফল্য ইতিহাসের নিয়মে সিদ্ধ হয় বৈকি। অবশ্য তার ওয়ারিশানরা পিতার গোয়ার্তুমিকে ভালোভাবে নিতে পারেনি। পরিবর্তিত সময়ের কারণে দুর্গমকে আবাদি করার এই জেদ তাদের চোখে বাড়াবাড়ি মনে হতো। কিন্তু পিতৃধনে লালিত বলে রা কাড়তো না। এমনকি রুজি-রোজগারে লায়েক হয়ে ওঠার পরে চুন-সুড়কির পুরনো বাড়ি ভেঙে হালফ্যাশানের নতুন বাড়ি আবাদের বাসনা জনকের কাছে উত্থাপনের সাহস তারা করতে পারেনি। পত্তনীদার অবশ্য টের পাচ্ছিলেন যে তিনি চোখ বোজার পর কাঠবেড়ালি, বানর ও সারসের উৎপাতে অতিষ্ট বাড়িটি ধুলায় মিশে যাবে এবং সেখানে দেখা দিবে হাল ফ্যাশানের কোনো ত্বন্বী যৈবতী!

পত্তনীদারের বয়সের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ির বাজারদাম তাই বাড়ছিল। লোভের সঙ্গে মানুষ নাকি এঁটে উঠতে পারে না। পত্তনীদারের বয়স তখন আশি পেরিয়েছে। শরীর জীর্ণ হয়ে এলেও তার শ্রবণশক্তি প্রশংসনীয় ছিল। চোখে ঝাপসা দেখতেন, কিন্তু মস্তিষ্কের বোধশক্তি ছিল অটুট। সেই বোধশক্তিকে আরো কিছুদিন ব্যবহারের ইচ্ছা তার ছিল। বাড়ির পেছনদিকে জায়গা দখল করে রাখা না-ডোবা না-পুষ্কুরনির ধারে গিয়ে তিনি যখন বসতেন ইচ্ছেটা ভীষণ চাগা দিয়ে উঠতো। জলাজঙ্গলা আচ্ছাদিত ওই ক্ষুদ্র জলাশয়ের পাড়ে অতিকায় কাঁঠাল গাছটি অনেক বছর ধরে কাঁঠাল পাকিয়ে আসছে; তার নিচু ডালে মাছের প্রতীক্ষায় ধ্যানস্থ সারসকুলের সঙ্গে তিনি তাই রঙ্গে মেতে উঠতেন। পক্ষীর সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক তখনো এতোটা জল-অচল হয়ে ওঠেনি। তারা পরস্পরের ভাষা-ভঙ্গি বুঝতে পারতো এবং সেখানে ঠাট্টা-তামাশার কোনো বিরাম ছিল না। এমনি এক মন্থর সকালে পত্তনীদার কাঁঠালগাছের ডালে বসা জ্ঞানবৃদ্ধ গোছের এক সারসের সঙ্গে রঙ্গ-তামাশায় মেতে উঠেছিলেন। সেই তামাশার সাক্ষী বলতে ছিলো তার বৃদ্ধা স্ত্রী ও দীর্ঘদিনের আশ্রয়প্রার্থী সেই বানভাসী লোকটি। দাড়িতে মোলায়েম হাত বুলিয়ে মাছের বুজকুরির অপেক্ষায় ধ্যানস্থ সারসটিকে তিনি জিজ্ঞেস করলেন :-

‘কীরে ব্যাটা সারসের পো, বাড়িখানা তো এবার নিলামে উঠবে মনে হয়। ভাবছি এবার তোকে খেদিয়ে দিয়ে চোখ বুজবো।’

সারস তার লম্বা ঠোঁট দিয়ে গাছের ডালে ছোট্ট ঠোক্কর মেরে প্রত্যুত্তর করে :-

‘ওইডা আপনার ইচ্ছা মালিক। কিন্তুক এইডা তো ভাববেন যে আমগো সারস বংশ আপনে এই জমি পত্তনী লইবার আগের থন এইহানে বাস করত্যাছি। আর দখল লইবার পর থাইক্যা আপনারে খাজনা দিতাছি।’


সারসের কথা প্রায় কেড়ে নিয়ে পত্তনীদার ঘুষি পাকানোর ভঙ্গি করেন :-

‘তাই বুঝি! তা কী খাজনা তোরা দিচ্ছিস শুনি।’

সারস জবাব করে :-
‘এই ধরেন, আমগো মাংস আপনাগো পছন্দ। জলের মাছ যেমুন আমগো পেডের খাজনা দিয়া থাহে, আমরা আপনেগো সারসের মাংস খাওনের খাজনা দিয়া আসতাছি। আমার বাপ-পরদাদাগো আমল হইতে আমগো কাল পর্যুন্ত খাজনা দেওনের নিয়ম চলতাছে। আমি মাছেরে ঠোক্কর মাইর‌্যা বশ করি, আপনে ও বিবিজান তেল-মসল্লার খুশবু দিয়া আমগোরে আপনাগো পেডের বশ করেন। আর আমগোর কাণ্ডকারখানা দিয়া আপনেগো যি আমুদ যুগাই হেইডা তো খাজনার চ্যায়া কম না!’

এইসব সরস বাতচিতের মধ্যে সারসটি এক মুহূর্তের জন্য জলের ওপর মাছের বুজকুড়ি তোলার আশা ছাড়েনি। বাতচিতের এই পর্যায়ে বুজকুড়ির আভাস পেয়ে সে বাড়তি তৎপর হয়ে ওঠে,-

‘একডু খাড়ান মালিক। মনে লয় মাছ চাঙড়ি দিয়া উডতাছে। জলের মইদ্যে একডা ডুব দিয়া লই।’

সারসটি ক্ষীপ্র গতিতে ডানা ঝাপটে জলে ডুব দিয়ে ওঠে। তার লম্বা ঠোঁটের মাঝখানে একটি নাদুস-নুদুস মৎস ঠোঁটের চাপে ছটফটায়। সারসের ঠোঁটে মৎসের এই কাতরতা পরিবেশকে থমথমে করে দিলেও পাখিটির মজাদার তৎপরতায় তা নিমিষে কেটে যায়। একটি লঘু খুশির হাওয়া চারদিকে বইতে শুরু করে। সময়টা ছিল জ্যৈষ্ঠ মাস। রসালো ফলের মওসুমে জলা-জঙ্গলা ভেদ করে সুপক্ক ফলের আঘ্রাণ বইতে শুরু করেছিল। গেছো কাঠবেড়ালিরা পাকা কাঁঠালের চামড়া ঠুকে তার রসে মুখ ডুবিয়ে জ্যৈাষ্ঠের মধু পানে ব্যস্ত তখন। সারস, কাঠবেড়ালি আর থির জলে মাছের বুজকুড়ির সঙ্গে তাল মিলিয়ে পত্তনীদার আম-কাঁঠাল পাড়ার জন্য বানভাসিকে তাই তাগাদা দিলেন। মানুষ ও পশু-পক্ষীর ফল-আহরণের যৌথ উৎসবের মধ্যে বছর গড়িয়ে যায়। প্রকৃতির এইসব মায়ামধুর ছলনার জালে ধরা খাওয়া পত্তনীদার বাড়িটিকে বিক্রি করে উঠতে পারেন না। তার পিঠের ওপর ওয়ারিশানদের দাবির ভাঁপ তিনি টের পান, কিন্তু উইলে হাত ওঠে না। দিন বয়ে চলে এবং এভাবে আরো অনেক দিন বয়ে যায়।

কালের অমোঘ নিয়মে আশীবর্ষি পত্তনীদার বিছানায় শয্যাগত হয়ে পড়েন। মানবজন্মের ইতিহাস বলে জন্মলগ্নে সে অশক্ত ও পরনির্ভর থাকে আর অন্তিমের ভেরী বাজবার ক্ষণে আবারো সেই অশক্ত দশা তাকে পেয়ে বসে। প্রথমবার সে সকলের অশেষ আনন্দের কারণ হয়। অথচ দ্বিতীয়বারের দশাটি এক বিড়ম্বনা মাত্র! পত্তনীদার সে-দশায় পৌঁছে অনুভব করেন এতদিন যা-কিছু আঁকড়ে ধরে দেনা-পাওনার হিসাব কষেছেন তারা এখন তার হাত থেকে কেবল ছুটে-ছুটে যায়। শয্যায় শুয়ে দিকচক্রবালে সূর্যের উদয়-অস্তাচল দেখে যাওয়া ছাড়া অন্য কোনো নিয়তি তার নেই। ওয়ারিশানদের যোয়ানকির দাপটে ম্রিয়মান বৃদ্ধ বিছানায় শুয়ে জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকেন। তার প্রায়-নিশ্চল চোখে কাঁঠাল গাছের ডালে বসা সারস পাখি ও গাছের বাকল খুবলে খাওয়া কাঠবেড়ালিরা সমার্থক ত্রিভূজের মতো দূর অতিতে হারিয়ে যেতে চায়। ডাকাবুকো ওয়ারিশানরা বাড়িঘর কাঁপিয়ে শয্যাগত জনকের ঘরে আসে-যায়, কিন্তু তাদের সঙ্গে বৃদ্ধের কোনো গল্প জমে না। ভবিষ্যত সন্ততি নাতি-নাতনিরা বিছানার ধার ঘেষে হল্লা ও বাঁদরামিতে মাতে। বৃদ্ধ পত্তনীদারের চোখ সেইসব হল্লা ছাপিয়ে কাঁঠাল গাছে ধ্যানস্থ সারস ও গাছের ডালে ঝুলন্ত বানরের রঙ্গ-তামাশার মধ্যে দুর্গম এই মাটি আবাদের ইতিহাস খোঁজে সারাদিন।

সারসরা নিয়মিত মৎস শিকার করলেও সময়ে-অসময়ে ঘরের চালা বা গাছ-গাছালির ওপর হামলে পড়া বাঁদরের দল আগের মতো নিয়মিত নয় আর। কিছুদিন আগেও তাদের দাপটে এখানে কেউ ঢোকার সাহস পেতো না। এখন তা বিগত দিনের জেল্লাদার গল্প মাত্র! বানরের দলবল মাঝেমধ্যে দেখা দেয় এবং বাড়ির বালক-বালিকাদের এক লহমার উল্লাস ও উত্তেজনার অবসান ঘটিয়ে লেজ তুলে চম্পট মারে। বানরের ডাল আছড়ানোর শব্দ কিংবা ঘরের ছাদে ওই অতি চঞ্চল বন্য প্রাণীর হুটোপুটি বৃদ্ধকে কিছু একটা বলবার জন্য ব্যাকুল করে তুললেও শক্তিতে কুলোয় না। বানর আসে-যায়, কাঠবেড়ালি দিনভর গাছের খোলস ঠোকরায়, সারস তার ক্ষীপ্র চাঞ্চল্যে বাতাসে ডানা ঝাপটায় নতুবা দুপুরের খরাতপ সয়ে মাছের আশায় বসে বেকার ঝিমোয়,...ধারাবাহিক এইসব চলচ্ছবির মধ্যে একদিন পত্তনীদারের দিন ঘনিয়ে আসে। সকলের অগোচরে তিনি নিঃশব্দে চোখ বোজেন। চোখ বুজবার কালে তার ঠোঁটের কোণে নাকি হালকা হাসির আভা লেগে ছিল। সে-হাসির সাক্ষী বলতে তার স্ত্রী ও বানভাসি ছাড়া আর কেউ ছিল না। ভবিষ্যতে যে এই বাড়ির পাহারাদারে পরিণত হবে সেই বানভাসী লোকটি পত্তনীদারকে নীরবে খাটিয়ায় উঠায়। মুর্দাকে শেষ গোসল করানো অশেষ সওয়াবের কাজ। নাপাক পত্তনীদারকে শেষ গোসলে পাক করার কাজে মোল্লা সায়েবের সাথে সে হাত লাগায়। সাবানগোলা পানির ডুশ পত্তনীদারের এরিমধ্যে ঠাণ্ডা হয়ে আসা মৃত শরীর থেকে সকল বর্জ্য নিষ্কাশন করে। মৃত শরীর থেকে নিষ্কাশিত বর্জ্যে বানভাসি লোকটি সারস পাখির মাংসের দুর্গন্ধ পায়; তার মনে হয় মানুষ যতোবড়ো পত্তনীদার হোক পচা-গলা মাংসে পরিণত হওয়া ছাড়া তার অন্য কোনো পরিণতি নেই। পত্তনীদারের কাছে শোনা মাটি আবাদের বিচিত্র ইতিহাস স্মরণ করে নীরবে চোখ মুছে সে।

বিজ্ঞান বলে মৃত মানুষের রক্তকণিকা দ্রুত ভেঙে পড়ে; তার পায়ুদেশের শিথিল ত্বক ফুঁড়ে বেরুনো জলীয় রক্তধারা কাফনের কাপড় ভিজিয়ে শেষবারের মতো মৃত্তিকায় গড়িয়ে পড়তে চায়, যেন তা পুনরায় জমাট হয়ে নতুন মানব আনবে পৃথিবীতে। মায়ের গর্ভ থেকে রক্ত-পানিতে দলাপাকানো যে-পিণ্ড একদিন বেরিয়ে আসে ও অতঃপর জমাট বা সচল কান্না করে, রক্তকণিকার ভাঙনে সেই পিণ্ড আবার বরফখণ্ডের মতো শক্ত হয়ে সাড়ে তিনফুট মাটির গর্তে নগ্ন কঙ্কালের বিভীষিকা জাগায়। পত্তনীদারের জেদ ও একরোখামির ফসল বাড়িটি বিজ্ঞানের সত্য মেনে একদিন ঝুরঝুরে হবে নিশ্চয়। বস্তু পদার্থের আবির্ভাব ও অবক্ষয়ের কথা মনে করে পত্তনীদারের ওয়ারিশানরা কপাল কুঁচকে ভাবতে বসে। দিন-বদলের ফেরে পড়ে পতিত বলে কোনোকিছুর অস্তিত্ব তখন বিলীন হতে শুরু করেছে। দরদাম ও প্রয়োজনের সংসারে বাড়িটি ‘সোনার ডিম পাড়া’ হাসে পরিণত হলো দেখে তাদের মনে পুলকের ঢেউ খেলে যায়। এমন একটি শানদার জলা-জঙ্গলাকে পতিত রেখে দিতে তাদের তাই পা’ ওঠে না। পত্তনীদারের জামানায় যা কালেভদ্রে ঘটতো, ওয়ারিশানদের কালে এসে তা নিয়মিত হয়ে দাঁড়ায়। চুন-সুড়কির বাড়িটি সহ ‘সোনার ডিম পাড়া’ ভূখণ্ডটি পকেটে পোরার জন্য ক্রেতার আনাগোনা বেড়ে চলে। দরদামের মানুষ আসে-যায়; ওদিকে বানর-কাঠবেড়ালি এবং সারস বা জল-সন্তরণে পটু মৎস্যের ঝলকানি ক্ষণিক বিস্ময় জাগালেও এটা একরকম স্থির হতে থাকে যে এই জলা-জঙ্গলায় অচিরে পুরনো বাড়ি ভেঙে নতুন বাড়ির আবাদ হবে।

১১.
পত্তনীদারের স্ত্রী’র আদেশ উপেক্ষা করতে চক্ষুলজ্জা বাধা হয়ে দাঁড়ালো বুঝে ওয়ারিশানরা দলিলনামা পাকাপোক্ত কিনা তা পরীক্ষা করে চলে এবং বাড়িটিকে জলা-জঙ্গলার মাঝে আরো কিছুদিন মুলতবি রাখার সিদ্ধান্ত নিয়ে বিদেশ পাড়ি জমায়। দূরদেশ সফরে জননী তাদের সঙ্গী হন। পরগাছা স্বর্ণলতার মতো বানভাসি মানুষটি শুধু একা পড়ে থাকে সেখানে। জীবনের বৃহৎ উচ্চাকাক্সক্ষায় কেউ যখন ভিন দেশে পাড়ি জমায়, তার পক্ষে সহজে ফেরা মুশকিল। ওয়ারিশানরা ফিরবো-ফিরছি করে কেবল দেরি করতে থাকে। তাদের শরীরে অসংখ্য সারস পাখির মাংস একদা যে উষ্ণতার জন্ম দিয়েছিল, ভিন দেশের বরফঠাণ্ডা হাওয়ার ঝাপটে সে-উষ্ণতা বারবার নিভে যেতে চায়। সময়-সুযোগে পুরাতন ক্ষুধা অবশ্য বারবার জেগে ওঠে। বাড়ি ও পতিত জঙ্গলার একটা হেস্থনেস্থ করার জন্য তারা তখন উঠেপড়ে লাগে। দেশ থেকে অবিরত খবর ও প্রলোভন আসে। জমি বেদখলের আশঙ্কা পত্তনীদারের সন্তানদের মাঝেমধ্যে বেকাবু করে ফেলে। বাড়ি বিক্রির ব্যাপারে জননীর জেদ টের পেয়ে তারা কিছুটা বিরক্তই বোধ করে হয়তো। স্ত্রী এবং আত্মজের প্ররোচনায় তারা তখন ভাবে, ‘নাহ! আর দেরি করা যায় না। বাড়িটাকে এইবার বাটোয়ারার দাড়িপাল্লায় তুলতে হবে।’ কিন্তু বরফগলা রাতের সর্পিল মহানগরে সেই পণ অধিক স্থায়ীত্ব পায় না; বরং দিনক্ষণ বুঝে আবারো জাগবে বলে শীতনিদ্রায় গমন করে।

নিদ্রা ও জাগরণের চক্রাকার বর্তুল ওয়ারিশানদের ভাগ্যে কোনো ফল বয়ে আনছে না দেখে জলা-জঙ্গলায় পতিত বাড়িটি দরদামের দুনিয়ায় সকলের চোখের সমুখে আশ্চর্য সুঠামতা নিয়ে বহাল রয়ে যায়। ঋতু থেকে ঋতু এভাবে ঘুরে চলে আর জলা-জঙ্গলারা মিলে বাড়িটির দফারফা করে। না-ডোবা না-পুষ্কুরনিটি ততদিনে নিরেট ডোবায় পরিণত হয়েছে। আবাদের অভিধানে বলে, ‘মানুষ যেখানে পা রাখে না সেখানে বন-বাদার হচ্ছে স্রমাট।’ বন-বাদারের দঙ্গলে একমাত্র মানুষটি, নদী যাকে অনেক কাল আগে নিঃস্ব করে দিয়েছে, সেই লোকটি ততোদিনে প্রায় বুনো হয়ে উঠেছে! যুগবদলের হাওয়ায় বানভাসী বনচরটিকে মানুষ গণ্য করা যায় কিনা সে-তর্ক তাই অনায়াসে চলতে পারে! বাড়ি থেকে কিছু দূর হাঁটলে শহরকে পড়া যায়। মোটরকার আসে-যায়, চওড়া দর-দালানে পালিশকরা সায়েব-মেম এলিভেটর বেয়ে ওঠে-নামে, সিনেমার নায়িকা তার বিরাট নিতম্বের আলোড়নে যোয়ানমর্দ বালেগদের কামনায় বধির করে, আর উড়োজাহাজের সাঁই-সাঁই শব্দে চকিত কাকেদের দল প্রতিটি বাড়ির ছাদ ও ময়লা-ফেলার ড্রামে তাদের কর্কশ ঠোঁট ঠোকরায়..., এইসব দৃশ্যচিত্রের মধ্যে বাড়িটি মেরুবিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো একলা পড়ে থাকে সারাদিন।

দ্বীপের একমাত্র রবিনসন ক্রুসো হচ্ছে বানভাসি পাহারাদার। প্রতিদিনের খাই-খরচার বাইরে এইসব প্রলোভনের সঙ্গে তার কোনো সংযোগ যেন নেই। ওয়ারিশনরা বিদেশ থেকে যে খোরাকি পাঠায় তাতে তার দিন চলে না, পুরনো প্রতিবেশীরা মাঝেমধ্যে এটা-ওটা সাহায্য করে, কিন্তু তা দু’বেলা স্বচ্ছল হবার মতো নিয়মিত নয়। দিনযাপনের টানাটানি তাকে বিশেষ বিচলিত করে উঠতে পারে না। এই আকালের বাজারে ইচ্ছে করলে এখনো ডোবা থেকে সে মাছ উঠাতে পারে, সারসের মাংসে মুখগহ্বরকে সুপক্ক ঘ্রাণের মদিরা দিতে পারে,-কিন্তু মাছ সে ওঠায় না, সারসকুলের দঙ্গলে গুলতির ঢিল ছোঁড়ে না। জীবনের যে-দশায় পেয়ে বসলে মানুষ অক্রিয়তাকে জীবন গণ্য করে, পাহারাদার সেভাবে দিন গুনে চলে ও পাকানো দড়ির মতো শীর্ণ হয়। আশ্চর্যই বটে!
প্রবাদে বলে গতির ধাক্কা যেখানে লাগে স্থিরতা সেখানে ঠাঁই করে নিতে পারে না। নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটিয়ে পত্তনীদারের সাধের পত্তনীর বেঁচে-বর্তে থাকা রহস্যজনক বৈকি। এতে মনুষ্যকুলের কোনো উপকার সাধিত না-হলেও বৃক্ষ বা পশু-পক্ষীর জন্য পত্তনীটি হয়ে উঠেছে এক স্বাধীন অভয়ারণ্য, যেখানে মানুষ ও মোটরকারের তোয়াক্কা না-করে আজোবধি স্বেচ্ছাচারিতা সম্ভব। নারকেল গাছের সারির মাঝখানে ভীমরুল অনায়াসে চাক বাঁধে এখনো। এই মৌচাকে ঘাই দেবার সাধ্যি ভাল্লুক ও মানুষ ছাড়া আর কারো নেই। বাড়িটি যেহেতু অনেক দিন ধরে মনুষ্য ও ভাল্লুক শূন্য, চাকগুলো তাই অবাধে মধুপুষ্পে ভরে উঠতে পেরেছে। আধুনিক পদ্ধতি ছাড়া মধুর নহর বইবার জন্য যে অবসর ও নির্জনতা লাগে, একমাত্র নিবিড়ঘন নিরালায় প্রকৃতি যা সম্ভব করে, বাড়িটি তার আদর্শ ঠিকানা বটে! তবে গতির হল্লা যখন আছড়ে পড়ে তখন চাক রচনাকারী ভীমরুলের আগ্রাসী আক্রমণকে তা অবলীলায় পর্যদুস্ত করে ফেলে। আমরা যে বাড়ি ও শহরকে বর্ণনা করি তার বেলা কথাটি খুব খাটে। পত্তনীদারের মৃত্যু পর্যন্ত সবকিছু যেন একটি আবর্তের মাঝে স্থির হয়ে ঘুরছিল। দুর্গম চরের খ্যাতি চুকিয়ে দেশ ভাগ অব্দি সেই আবর্তে বড়ো কোনো ছন্দপতন ঘটেনি। কেননা তখন পর্যন্ত চরটি আবাদি হয়ে উঠতে পারছিল না। পত্তনীদারের হাতে তার সে-দুর্নাম যখন ঘুচলো, আরেকটি আবর্তে গিয়ে পড়লো সে। অতঃপর আবাদকারীরর মৃত্যু পর্যন্ত ছিল অপেক্ষার পালা। গতির হল্লা তার অস্ত্রে শান দিচ্ছিলো এই ভেবে যে অপেক্ষার পালা একদিন ফুরাবেই; তখন চাক ভেঙে মধুপানের উল্লাসে পুরনো বাড়িটি মানুষের হট্টগোল ও মোটরকারের ধোঁয়ায় গমগম করে উঠবে। সুতরাং আমরা কতিপয় উন্নয়নকর্মী মিলে যেদিন ওয়ারিশানদের কাছ থেকে বাড়িটি ভাড়া নিলাম, এটা পরিষ্কার হয়ে গেল,-অভয়ারণ্যের যুগ শেষ হতে চলেছে! এই কাহিনীর বিবরণ প্রদানের কালে ঘটনা ও সময়ের অতীতচারী একটি ভূমিকা সবাই খেয়াল করছেন নিশ্চয়? অতীতের আবর্ত ছেড়ে বর্তমানে পা দিতে তার অনীহা যেন শেষ হতে চাইছে না। কিন্তু সব কাহিনীর একটি শুরু যেমন থাকে, ঘটনাধারার ভেতর দিয়ে তার সমাপ্তি ঘটা প্রয়োজন। মনে হচ্ছে এখন তা সম্ভব। উন্নয়নকর্মী হিসাবে পত্তনীদারের বাড়ির সাথে আমাদের ঘটমান সংযোগ বোধহয় সেই অবকাশটি তৈরি করে দিয়েছে। কাজেই অতীতচারী বিবরণে দাঁড়ি টেনে আমরা এবার প্রবেশ করতে পারি একালে।

একাল
১২.
একালে এটি আর গোপন কিছু নয় যে গরিব-গুর্বোর দেশে উন্নয়নকর্মের মহতী লক্ষ্য সিদ্ধির জন্য নানাবিধ প্রকল্পের মহড়া ও দান-খয়রাতির যোগাড়-যন্তর চলে। প্রকল্পের দাতা ও কর্তাব্যক্তিরা খয়রাতির টাকায় গরিব-গুর্বোরা কেমন আছে তা আবিষ্কারের জন্য মিটিং-সেমিনার করেন বা লেক্সাস-পাজেরো দৌড়ান। পুরো ঘটনাটির মধ্যে সত্য ও কৌতুকের বাড়াবাড়ি রয়েছে নিশ্চয়। খয়রাতির টাকায় গরিব-গুর্বোর দিন যদিও বদলায় না, কিন্তু ঘরে বসে মুফ্তে ভিক্ষে পেলে কে ছাড়ে? আবার ভিক্ষে প্রদানের বিপরীতে ছাপোষা মাঠকর্মীরা দিন গুজরানের একটা অবলম্বন পেয়ে বর্তে যায়। এই আদান-প্রদানে আসল লাভ যে কার হয় সেটা যদিও প্রহেলিকার মতো লাগে, তবে খয়রাতিকর্মের কর্তাব্যক্তিরা লেক্সাস ও পাজেরো চড়ে গরিব দেখতে যান বলে তাদেরকে তখন বেশ নেতা-নেতা মনে হয়।

উন্নয়নকর্ম একটি নেতৃত্বই বটে এবং উন্নয়নকর্মের পরিকল্পকরা একাধারে নেতা ও ব্যবসায়ী হন বটে! শাস্ত্রে কয় চ্যারিটি বিগিনস অ্যাট হোম। উন্নয়নের কর্তাব্যক্তি হিসাবে আমরা গরিব-গুর্বোকে নিজের ঘরের লোক ঠাওরে চ্যারিটি করি বিধায় আমাদের কাজের ঘরটিতে প্রায়শ একটি গৃহ বা পরিবারসুলভ ব্যাপার-স্যাপার থাকে। মনে হয় অফিস নয়, বাড়ির মধ্যে, ফ্যামিলির লোকজনের মধ্যে আছি। আমাদের কেসটি অবশ্য ব্যতিক্রম ছিল। উন্নয়নকর্মে নিবিড় হওয়ার জন্য সাজানো-গোছানো আবাসিকে অফিস ভাড়া নেওয়ার প্রতি আমরা সায় জানিয়েছিলাম। কিন্তু দাতা সায়েবদের কোনো এক বিচিত্র খেয়ালের বশে খয়রাতির বাজেটে ওই খাতে অধিক ব্যয়ের সুযোগ ছিল না। অন্য খাত থেকে বাড়তি খরচের সমন্বয়, যেটা এই ধরনের প্রকল্পে আকছার ঘটে, অন্তত এই প্রকল্পে তা সম্ভব ছিল না। বাড়ি বরাদ্দের খাতে ব্যয়ঘাটতি কর্তাব্যক্তিদের মনে খানিকটা অসন্তোষের জন্ম দিয়েছিল। দায়িত্ব নিলে সেটা পালন করতে হবে,-মনুর বিধানের মতো অনড় সে-নিয়মের চক্করে পড়ে অবশেষে আমাদের ঠাঁই হলো সাপ-বেজি ও ভীমরুলে ভরা পত্তনীদারের বাড়ির মৌচাকে।

গৃহপ্রবেশের দিনে আমাদের অভিজ্ঞতা বিশেষ সুখকর ছিল না। অর্থনীতি শাস্ত্রে লেখে গরিব-গুর্বোরা নাকি তাদের জীবনমানের কারণে দিনরাত মশার কামড় খায় ও ম্যালেরিয়া বাঁধায়। তাদের ঘন-ঘন ম্যালেরিয়া না-হলে উন্নয়নকর্মের খয়রাতি নিশ্চয় চার তারকা হোটেলে কিংবা মোটরকারের পেছনে বিনিয়োগ হতো না। কিন্তু নতুন গৃহপ্রবেশের দিনে মরিয়া হয়ে তারা যে আক্রমণ শানিয়েছিল তার দাপটে তটস্থ হয়ে আমরা ভেবেছিলাম, ‘মশা ও ভীমরুলের বিষ-কামড় সইবার চেয়ে অকালমৃত্যু অনেক শ্রেয়তর। গরিব-গুর্বোরা ওটা সইতে পারে, কারণ তাদের বংশগতির ইতিহাসে তা সইবার প্রতিরোধ জন্মে গেছে। আমাদের জিনের গঠন এখনো বংশগতির নিয়ম মেনে অতোটা চোয়াড় নয় যেহেতু, উন্নয়নকর্মী হলেও মশা বা ভীমরুলের বিষকামড় সইবার মতো স্নায়ুশক্তি আমাদের নেই।’ জৈবিক বিবর্তনের মানচিত্র অবশ্য অন্য কথা বলে,-সইবার স্নায়ুশক্তি বাড়ানোই মানুষের ধর্ম; প্রকৃতি তার ভেতরকার কলকব্জাগুলোকে এমন নমনীয় করে গড়েছে যাতে মানুষ আজ যা সইতে পারে না, কাল তা বইবার অলৌকিক ক্ষমতা তার মধ্যে জন্ম নিতে বাধ্য। উন্নয়নকর্মের অভিধানে একটি মুনিবাক্য আছে, ‘ব্যারিয়ার ইজ দ্যা ট্রু আউটকাম অফ টোটাল সাকসেস’। বাধা যতো দুরূহ সাফল্য ততো নিবিড়,-নির্বিকার হওয়ার মন্ত্রে মনকে দৃঢ় করা ছাড়া পথ নেই বুঝে ওই দড়ি পাকানো শীর্ণ বাড়িটিকে তার জীবজন্তু সহ মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলাম আমরা। মনের ভেতরে একটি গোপন আশা অবশ্য ছিল,-‘একালের দুনিয়া সেকালের মতো জলা-জঙ্গলে ভরা নয়। মানুষের রক্তের গন্ধ ও পায়ের আওয়াজের কাছে প্রকৃতির হার মানার দিনকাল এখন শুরু হয়েছে। যতো চেষ্টা করুক, বাড়িটিতে মশা-ভীমরুল আদৌ টিকতে পারবে না। আমরা যখন এসেই পড়েছি, অচিরে তা মানুষের অভয়ারণ্য হয়ে উঠবে!’

এই সাস্ত¡নার জোরে পত্তনীদারের শতচ্ছিন্ন বাড়িটিকে সাফসুতরো করার কাজে আমরা নেমে পড়েছিলাম। কিন্তু গেছো কাঠবেড়ালি ও সহিংস ভীমরুলের চাকে ভরা বাড়িটির জলা-জঙ্গলা মারাত্মক বেয়াড়া হওয়ার কারণে এগুলোকে বশে আনার প্রাথমিক উদ্যমে ভাটা পড়তে দেরি হলো না। আমরা অবাক হয়ে লক্ষ করলাম একধার সাফসুতরো করতে-করতে অন্যধার জলা-জঙ্গলায় ক্রমাগত ভরে উঠছে! গাছপালা ও তৃণলতার এই দ্রুত বর্ধনের ক্ষমতাটি আমাদের অশেষ বিস্ময় ও হতাশার কারণ হয়ে উঠেছিল। বয়সের ভারে কিছুটা ন্যুব্জ কাঁঠাল গাছ, বিশালাকৃতির শিরিষ-মেহগনি বা রেইনট্রি এতো গভীরে তাদের শিকড় পুঁতে দিয়েছে যে মাঝেমধ্যে মনে হয় চুনসুড়কির এই বাড়িটাকে অতিকায় কোনো অজগর তার সকল শক্তি দিয়ে একটু-একটু করে গিলে খাচ্ছে। মজে যাওয়া ডোবার চারধার জুড়ে লম্বা মুথা ঘাস ও আগাছার লাগামহীন বিস্তার বুঝিয়ে দেয় এ-জমির মাটি স্বভাব-চরিত্রে ভীষণ বন্য ও অবাধ্য! ক্রমে আমরা বুঝতে পারলাম বানভাসি লোকটি কেন বাড়িটিকে এভাবে বয়ে যেতে দিয়েছে, কেন এর জলা-জংলায় হাত লাগায়নি সে। আসলে পত্তনীদার ছিলেন একমাত্র পুরুষ যার কিনা এর ওপর দখলি কায়েমের মতো ব্যক্তিত্ব ছিল, যেমন সব পত্তনীদারের থাকে তাদের নিজ মাটির ওপর। পত্তনীদার ছাড়া ওয়ারিশান অথবা বানভাসি,-তাদের কাউকে গ্রহণের রুচি এ-মাটির হয়নি। ওয়ারিশানরা আজো তাকে নিলামে তুলতে পারেনি, উল্টো নিজেরা দেশান্তরী হয়েছে। বানভাসি লোকটি তাই হলদে দাঁত বের করে বিগতকালের কেচ্ছা ফাঁদে :-

‘বুঝলেন সাব, এইডারে কয় মাডির হক। নদী যেমুন পাড় ভাইঙ্গা মাডিরে খায়, জঙ্গলার বেড়া দিয়া বাড়িডা নিজেরে খাইতে আছে। এই খাওনের কুনু শেস নাই। শেস অইবার পারবো না। কতো মানু হেরে কিননের লাইগ্যা বেচইন অইলো, কিন্তুক কী অইলো? হেষমেশ হেই বেডাগোরে মাডি তার চাক ভাইঙ্গা মধুর ফোডাডাও দিল না!’

পাহারাদারের ঝিমধরা প্রলাপ শুনে আমাদের গা শিউরে ওঠে। বুঝতে অসুবিধে হয় না কেন এই মাটি তার পত্তনীদারকে খাওয়ার পর থেকে আর কারো বশ হবে না বলে পণ করেছে। একালের বাসিন্দা হলেও অমূলক সংস্কারের তাড়নায় আমাদের গা তাই ছমছম করে। অদূরে বেজির সঙ্গে যুদ্ধরত সাপের হিসহিসানি কানে আসতে মহিলা কলিগরা উন্নয়নের দায় ভুলে আতঙ্কে ডুকরে উঠেন। আমরা তাদের সান্ত্বনার ভাষা দিতে ভুলে যাই। বানভাসির গলা আবার গমক দিয়ে উঠে। সেখানে তখন সাপের হিসহিসানি :-
‘বুঝলেন সাব, এই মাডি তামাম দুনিয়ার মাডিথন্ আলগ অইবার চায়। বেজিডা যেমুন একডু পর সাপডারে গাইথ্যা লইবো, এই মাডি একদিন মালিকরে এমুন কইর‌্যা গাইথ্যা লইছিলো। উই যে সারসডারে কাডাল গাছের ডালে রোজ বইস্যা থাকতে দেহেন, হের বয়সের গাছ-পাথর হে নিজেই জানে না। মাডির হক যুদিন কারো থাহে, হেইডা অই সারসগো, কটাগো, ডোবার মাছেগো। দলিল কইর‌্যা আপনে মালিক বদলাইবার পারবেন, কিন্তুক মাডি তারে মাইন্যা লইতে আইবো। মাডি যুদিন বশ অয় তাইলে হেরে মালিক কওন যায়। হেইডা না অইলে দলিলের মালিক আর মুই,-আমগো মইদ্যে কীয়ের তফাত কন? গাওগেরামের লোকে হেরে তহন বেওয়ারিশ কইয়া ডাক পাড়ে।’

বানভাসি পাহারাদার যে এখনো তার মাটির জ্বালা ভুলতে পারেনি সেটা বুঝে আমরা ক্ষণিক চুপ হয়ে গিয়েছিলাম। বাড়িটির সাথে-সাথে এই লোকটির প্রতি এক প্রকার সম্ভ্রমবোধ জেগেছিল সেদিন। বাড়িটির অস্তিত্বের সাথে আমাদের অস্তিত্ব এভাবে ক্রমাগত জট পাকাতে শুরু করে। প্রতিদিনের কাজকম্মোর মাঝে বাড়িটিকে ঘিরে আমাদের মনে বিচিত্র স্মৃতির লহর বইতে থাকে। মনের গহীন কোণে সেকালের পত্তনীদারদের দাপুটে মুখের ছবি উঁকি দিয়ে ফের মিলিয়ে যায়। সত্যি, সে এক যুগ গেছে বটে। আজকালকার জমির মালিক-ঠিকাদারদের সাথে এইসব পত্তনীদারের তুলনা চলে না। তারা সাপ-বেজির সঙ্গে মিল-মহব্বতের কায়দা জানতেন, আমরা সেটা জানি না। এতে লাভ-না-ক্ষতি সে তর্কে জড়াতে মন অনিচ্ছুক হয়। বাইরের অবিশ্রাম কলরবের মাঝে চুন-সুড়কির বাড়িটির মাথা তুলে দাঁড়ানোর ভঙ্গির মধ্যে স্পর্ধা রয়েছে বুঝে বিনয়ে নত হই আমরা।

১৩.
উন্নয়নকর্মের অন্যতম মন্ত্র হলো পুরনোকে ভেঙে নবীনের আবাহন। ‘ওরে সবুজ ওরে আমার কাঁচা/আধ মরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা।’-এখানে কে আধ মরা আর কারাই-বা সবুজ তা থির করতে না-পেরে আমরা হতবিহ্বল হই। আমাদের উন্নয়নকর্মের দৈনিক উদ্যোগের মধ্যে বানভাসি লোক ও সারস পাখির গল্পকথা অবিরত যাওয়া-আসা করে। রাতে ঘুমের মধ্যে নিজেকে আমরা একেকজন পত্তনীদার ঠাওরাই। তেল-মশলায় পরিপক্ক সারস পাখির ঠ্যাং চিবানোর আস্বাদে আমাদের জিভ তিরতির করে। অতঃপর কাঁচা ঘুম থেকে জেগে ওঠে দেখি বালিশ ভিজে গেছে ঘামে। আমাদের রসনায় জবরদস্ত কোনো পত্তনীদার হওয়ার লোভ তাই বারবার চাগা দিয়ে ওঠে। কিন্তু বানভাসি পাহারাদারের দড়ি পাকানো শীর্ণ শরীরের গাঁটে মাংসপেশীর ঠেলাঠেলি ভিড় দেখে আকাক্সক্ষাটি ফের চুপসে যায়। মনে-মনে ভাবি, ‘বাপরে কচু-গেচু খাওয়া লোকটি কী সাপের মতো হিলহিলে! দাঁতের সকল শক্তি জড়ো করে এখুনি কামড় বসাবে!’

আমাদের ভয়কে তীব্র করার জন্যই বোধহয় পুরনো বাড়িটিতে মাঝেমধ্যে বানরকুলের আবির্ভাব ঘটে। গাছপালার ডালে তীব্র আলোড়ন তুলে ওরা আসে। বাড়ির ছাদ ও কার্নিশে তুমুল হল্লা পাকায়। বেজি ও ভীমরুলের চাক এতে ক্ষণিকের জন্য চঞ্চল হয় বটে, কিন্তু বানরদল যেমন অকস্মাৎ আসে তেমনি কিছু বুঝে ওঠার আগে প্রস্থান করে। এই আবির্ভাব এক অশনি ইঙ্গিত হয়ে আমাদের বুকে কাঁপন ধরায়। পত্তনীদার হওয়ার জবরদস্ত লোভটিকে দমন করে মনে-মনে ভাবি ‘যে-মাটি বনবাদারের গ্রাসে লাগে তাকে আবাদ করার মতো বুকের পাটা আমাদের নেই। গরিব-গুর্বোর ঝুপড়িঘরে ঋণ শোধের তাগাদা দিতে আমরা সিদ্ধহস্ত হতে পারি কিন্তু এই বন্য মাটির বুকে দখলিস্বত্ব কায়েম আমাদের কম্মো নয়। বুনো মাটির অনাবাদি পিণ্ডরা চাষা ও জমিদারের অপেক্ষা করে। নিদেনপক্ষে সে এমন কোনো পত্তনীদারের বশীভূত হয় যার কাছে মাটি হচ্ছে সন্তানের চেয়ে খাঁটি। সন্তান বিশ্বাসঘাতক হতে পারে, কিন্তু মাটি অবিশ্বাসী হয় না। সে তার মনিবের লাঙলের গোলাম।’ যেহেতু তা নই, শুকনো মরিচ দিয়ে বানানো মাতুয়ার ভর্তায় জিভ ও টাকরার সুরসুরি চুকিয়ে ফল-সঞ্চয়ী কাঠবেড়ালি ও সারস পাখির পাখা ঝাপটানোর দর্শক হওয়ার মাঝে নিজের বাসনাকে সীমাবদ্ধ রাখি আমরা।

এইসব বিচিত্র অনুভবের মধ্য দিয়ে কখন-কীভাবে বছর কেটে যায় তা বুঝে উঠতে পারি না কেউ। আমাদের রোমাঞ্চ ও বাসনার সলতেটি মাস মাইনের উন্নয়নকর্মের ছকে এরিমধ্যে মরতে বসেছে। বাড়িটিকে আমরা মোটের ওপর মেনে নিয়েছি। এটাকে ঘিরে অযুত গালগল্প যদিও শহরে বেশ চাউর এখন, কিন্তু তা ওই পর্যন্ত! মোটরকারে লোকজন আসে-যায়, পিওনরা খাম বিলি করে, পরিদর্শকদল হুটহাট কাজের হিসাব মেলাতে আসে। জলা-জঙ্গলাঘেরা বাড়িটি নিয়ে বিস্ময়সুচক সব ধ্বনি ও বচন আমাদের বিশেষ বিচলিত করে না আর। স্মিত হেসে নিজের কাজে দিব্যি মন বসাতে পারি এখন। ক্ষণিক-অতিথিদের কেউ-কেউ সারসের পাল দেখে রসনাবিলাসী হয়ে ওঠে, তবে সাপ ও ভীমরুলে সুরক্ষিত ওই সারসদলকে ঘাটানো অনিরাপদ বুঝে রসনায় লাগাম টানে তারা।

সারসের মাংস কেমন সেটা পত্তনীদার বা বানভাসি জানলেও আমরা সেখানে ব্রাত্য। মাঝেমধ্যে জায়গাজমির প্রমোটার ও ডেভোলাপাররা চলে আসে। তাদের চোখ-মুখ বিস্ময়ে খাবি খায় এটা ভেবে যে আধুনিক দরদালানের ভিড়ে এরকম প্রাগৈতিহাসিক বন্যতা আজো থাকে কী করে! তাদের বিস্ময়কে আমলে না-নিয়ে আমরা মৃদু হেসে বাড়ির ওয়ারিশানদের ঠিকানা ধরিয়ে দিই কিংবা বানভাসি লোকটির বিজ্ঞাপন করি। জমির খোঁজে হন্য এসব ফ্ল্যাটওয়ালারা নিমিষে বুঝে যায় প্রকৃতির খামখেয়ালির কাছে জীবনের অঙ্ক মাঝেমধ্যে খাপছাড়া হয় বটে! তাদের সাফারি ও সানগ্লাসে কোনো-এক মৃত পত্তনীদার ও তার পূর্ব-পুরুষের গল্পগাছা টুকে নিয়ে তারা ওঠে পড়ে আর ঋতুচক্রের নিয়মে দিন ঘুরে চলে।

উন্নয়নকর্মে দাতা সায়েবদের একটি প্রবচন আছে ‘সাসটেইনেবিলিটি ইজ বেটার দেন আনস্ট্যাবিলিটি।’ স্থিরত্বের নীতি নাকি উন্নয়ন-পরিমাপের যোগ্য মাপকাঠি। অভিজ্ঞতা অবশ্য তা বলে না। আমরা দেখি প্রকল্প স্থির হওয়ার আগে খয়রাতির চালান শেষ হয়, অতঃপর নয়া প্রকল্পের যোগার-যন্তর চলে। আমরা এক প্রকল্পের মগডাল ধরতে-না-ধরতে অন্য প্রকল্পের আগ-ডাল ধরে ফেলি। ধরাধরির অন্তহীন খেলার ভেতরে মজে থেকে হঠাৎ এই বোধোদয় ঘটে যে উন্নয়নকর্ম হলো কদাপি কোনো উন্নয়ন না-হওয়ার পরিকল্পন। ‘না-হওয়ার’ শক্তিকে শোষণ করে এর অর্থনীতি বেঁচে থাকে ও যুগপৎ আমাদেরকে বাঁচিয়ে রাখে। স্থিরত্বের এইসব চমৎকার উপমার ভিড়ে পত্তনীদারের পুরনো বাড়ি আজো কী করে দাঁড়িয়ে রয়েছে সেটা ভেবে মাঝেমধ্যে ধন্ধ লাগে। আমাদের মনঃসংযোগের তার বারবার ছিঁড়ে যেতে চায়। কাজে মন বসাতে পারি না আমরা। এভাবে আরো কতো হাজার-লক্ষ দিন চুন-সুড়কি ঠাসা সর্পিল টানেলে ঘুরতাম জানি না। কিন্তু শরতের এক অতি উষ্ণ ও দীর্ঘ দিবস গৎবাঁধা সেই প্রবাহে ছেদ টানার উপক্রম করে। ছেদের বিবরণটি প্রকাশ করে এই কাহিনীতে ছেদ টানবো এবার। অবশ্য শরতের অতি উষ্ণ ও দীর্ঘ দিবসটি কাহিনীপ্রবাহে প্রবাহে ছেদ টানার পক্ষে যথেষ্ট কিনা তা পাঠকরা বিবেচনা করবেন। যদি যথেষ্ট মনে না-হয়, সংযোজনের স্বাধীনতা আপনাদের রইলো।

১৪.
তৃতীয়বারের মতো বলা যাক শরতের ওই দিনটি ছিল অতি উষ্ণ ও দীর্ঘ। দিনের শুরুটা বুঝিয়ে দিচ্ছিলো প্রচণ্ড উত্তাপের উদ্গীরণে আজ সব কিছু ঝলসে-পুড়ে যাবে। চুন-সুড়কির শীর্ণ বাড়ির প্রতিটি আনাচ-কানাচ রোদের তেজে ঘামতে শুরু করেছিল। প্রচণ্ড তাপদাহের মধ্যে গাছপালা আন্দেলিত করা বাতাসের কোনো বিরাম ছিল না, তবে সেই বাতাস শ্রান্তি দূর করার পরিবর্তে খইয়ের মতো ফুটছিল। আকাশে মেঘের আনাগোনা থাকলেও আলোককণা তেজী অশ্বের মতো ছিন্নকায় সব মেঘ ফুঁড়ে আমাদের চোখে-মুখ ঝলসে দিচ্ছে তখন। বাড়ির পেছনকার মজা ডোবা রোদের তেজে শামুকপচার মতো ভ্যাপসা গন্ধ ছড়াচ্ছিলো। পচা গন্ধটি আমাদের নাক-মুখ ঠেলে পাকস্থলির ভেতরে সেঁধিয়ে গিয়েছিল। দিনের প্রথম প্রহরে এরকম অস্বস্তিকর সূচনা মানুষকে খানিকটা ক্লান্ত ও অলস করে তোলে। কাজ শুরু করার দম পাচ্ছিলাম না কেউ। অলস চোখে তাই জানালার বাইরে তাকিয়েছিলাম সবাই। আমাদের একজন কলিগ কাঁঠাল গাছের ডালে বসা সারসকুলের দিকে তাকিয়ে থাকতে-থাকতে বলে ওঠে :-

‘আচ্ছা, এই সারসদের মধ্যে নাকি পত্তনীদারের সারসটিও রয়েছে। কিন্তু কোনটা?’

কৌতুহল এক সংক্রামক ব্যাধি। কলিগের অহেতুক কৌতুহলের সাথে তাল মিলিয়ে কিছুক্ষণ বয়স্ক ও প্রাচীন সারসটির অন্বেষণ চলে। আতিপাতি করে খোঁজার পর সারস-দঙ্গলের মাঝে ঈষৎ ছাইরঙা এক অতিকায় রোমশ পাখিকে প্রাচীন সারস হিসাবে শনাক্ত করতে সমর্থ হই আমরা। বানভাসির বিবরণের সাথে সাদৃশ্য প্রমাণ করে ছাইরঙা সারসটি হলো এদের মধ্যে সবচেয়ে প্রবীণ। তার হাবভাব ও আচরণে এক অলস কিন্তু সতর্ক নির্লিপ্তি বুঝিয়ে দেয় এই ডোবায় তার বহুকাল কেটেছে এবং প্রকৃতির নিয়মে আশ্চর্য ব্যতিক্রম ঘটিয়ে বংশ পরম্পরা ধরে সে এখানে টিকে আছে।
সারসটির সাথে কথা বলার ইচ্ছে তীব্র হয়, কিন্তু উপযুক্ত ভাষা ও ইঙ্গিতের অভাবে সেটা হয়ে ওঠে না। সারস-ভাবনায় বেশিক্ষণ থিতু হওয়ার মতো মন-মেজাজ একালের লোকজনের ধাতে নেই, কারণ আমরা কেউ শিকারি বা মাংসভোজের লোভে সারসটিকে দেখছিলাম না। সুতরাং সারস-প্রসঙ্গ ছেড়ে দিনের সালতামামি ঠিক কীভাবে শুরু করা যায় সেদিকে মনোনিবেশের টান অনুভব করি। আগুনে হলকা তখন আরো গরম হয়ে উঠেছে। আমাদের ঘরের জানালায় কয়েকজন টেকো মাথার মানুষের ছায়া এসে পড়ে। আমরা ঘাড় ঘুরাই। টেকো মাথার লোকগুলো হচ্ছে সেই ডেভোলাপারের দল। এর আগে একাধিকবার তারা এখানে এসেছে। কিছুদিন ধরে কানকথা শুনতে পাচ্ছিলাম বাড়িটির দখলিস্বত্ব নাকি ফয়সালা হয়ে গেছে। ওয়ারিশানরা তাদের অশতিপর মা’কে প্রভাবিত করে বাড়ির বিলি-বন্টন চূড়ান্ত করে ফেলেছে।

শরতের অস্বাভাবিক উষ্ণ দিনে দখলিস্বত্বের আসন্ন মালিকপক্ষকে দেখে আমরা তাই কিঞ্চিৎ বিব্রত বোধ করি। আসন্ন মালিকপক্ষের দল জানালা দিয়ে পুরো বাড়ির চৌহদ্দী জরিপ করতে-করতে আমাদের সাথে অনর্গল কথার তুবড়ি ছোটায়। তাদের কথায় এই প্রসঙ্গটি মুখ্য হয়,-ওয়ারিশানদের সাথে আনুষ্ঠানিকতা শেষ হওয়ার পর বাড়ি ও তার জলা-জঙ্গলা নিয়ে তারা কাজে নেমে পড়বে। ডেভোলাপারদের বাইবেলে নাকি লেখে :-

‘মাটিকে কখনো পতিত ফেলে রাখতে নেই। যা-কিছু পতিত বা অ-ব্যবহারযোগ্য তার মধ্যে সভ্যতা চাষ করার নাম হলো প্রগতি। পতিতকে সচল-সক্রিয় না-করলে সে তার জড়ত্বের অভিশাপে প্রথমে মানুষকে খায়, তারপর নিজেকে খায়। আর মাটি গ্রাস হলে সভ্যতা থমকে যায়। মানুষের প্রগতি থেমে থাকে। প্রগতি থেমে গেলে নতুন মানুষরা তখন জন্ম নিতে পারে না।’

মানুেষর জন্ম সুরক্ষণে নিয়োজিত ডেভোলাপারগণ তাই তাপমাত্রার অসহনীয় বাড়াবাড়ি উপেক্ষা করে জানালার শিক গলে বাড়ির পেছনদিকে নেমে পড়ে। আমরা তাদের অনুগমন করতে বাধ্য হই। কেননা আমাদের এরকম মনে হতে থাকে তাপভারে জর্জরিত দিনটি অসহ্য এবং সনাতন বিশ্বাস আঁকড়ে জড়প্রতিমার মতো স্থবির বাড়িটির সংস্কার ব্যতীত আজকের এই দুঃসহ উত্তাপের প্রশমন ঘটবে না। শাস্ত্রে বলে ‘মানুষ ঘটনার দাস। ঘটনা তাকে এক অবস্থান থেকে অন্য অবস্থানের দিকে নিয়ে যায় এবং এভাবে একদিন সে তার মোক্ষ বা পরিণামকে বুঝে ফেলে।’ এই শাস্ত্র-বচনের ওপর আস্থা রেখে আমরা ডেভোলাপারদের অনুসরণ করি ...

আমাদের সমুখে ঘটনা বলতে তখন শরতের স্বভাব-চরিত্রের সাথে বেমানান অসহ্য খরতাপ আর টেকো মাথার একদল ডেভোলাপার, যারা হয়তো-বা অচিরাৎ এই পতিত জমি চষে আগামী দিনের পত্তন করবে। তাদের হাবভাব বহুশ্র“ত গানের কলি হয়ে আমাদের মগজে গুঞ্জন তোলে। আমরা গুনগুনিয়ে গাইতে শুরু করি, ‘এই দিন দিন নয়, আরো দিন আছে/ এই দিনেরে নিয়ে যাবো সেই দিনেরো কাছে...’ আমাদের গানের তালে তাল মিলিয়ে লোকগুলো মজে যাওয়া ডোবার ধার ঘেঁষে হাঁটে এবং বাড়ির চারধার পরখ করে চলে। এতে করে হুলের বিষকামড়ে সশস্ত্র ভীমরুলের চাক চঞ্চল হতে পারে সে বোধ যেন তাদের নেই। আমরা দূর থেকে গোপন আশঙ্কা বুকে পুরে তাদের তৎপরতা নিরীক্ষণ করি। ডেভোলাপারদের মধ্যে যার টাক কপাল ঠেলে বেরিয়ে এসেছে সেই লোকটি কী উদ্দেশ্যে জানি না, পিঁপড়েয় খাওয়া একতাল শক্ত কাদামাটি হাতে তুলে নেয়। রোদের প্রচণ্ডতায় কাদামাটির নরম তাল এরিমধ্যে ইটের মতো শক্ত হতে শুরু করেছে। লোকটি একমনে সেই মাটির তাল হাতে নিয়ে ডলা দিতে থাকে। তার করতলের চাপে মাটির তাল বেয়ে জল ঝরে যায় এবং অচিরাৎ তা শক্ত গুলতির ঢিলে রূপ নেয়। টেকো লোকটি তার ছোটোখাটো শরীর ধনুকের মতো বাঁকা করে ফেলে। তার যে-হাত গুলতির ঢিল ধরে রেখছিল তা এবার মুঠিবদ্ধ ও টানটান হয়ে ওঠে। বাতাস কিছুটা মন্থর হতেই মুঠিবদ্ধ ঢিলটি তার হাত থেকে জ্যা-মুক্ত তীরের ন্যায় নির্গত হয় ও কাঁঠালগাছ লক্ষ্য করে ছুটে চলে। একটা প্রচণ্ড আলোড়ন তুলে সারসের দঙ্গল পাখা ঝাপটে দূরে উড়ে গেলে আমরা বিস্মিত হয়ে এটা লক্ষ করি যে ছাইরঙা প্রাচীন সারসটি গাছের ডালে গলা প্যাঁচানো আবস্থায় লটকে পড়েছে।

গুলতির ঢিল মোক্ষম নিশানা হয়ে সারসটিকে মৃত ও রক্তাক্ত করলো দেখে ডেভোলাপারদের মধ্যে অট্টহাসির কলরোল ওঠে। কাঁচ ভাঙার ঝনঝন আওয়াজের মতো তীক্ষè সে-হাসির গমক শেষ হওয়ার আগে বাতাসের বেগ প্রবল আক্রোশে গাছপালার ওপর ঝাপিয়ে পড়ে। মজা ডোবার গভীর থেকে গমগম শব্দে পচা কাদাপনির স্রোত ডোবার পাড় উপচে আমাদের পায়ের গোড়ালিতে গিয়ে ধাক্কা মারে। পায়ের নিচের মাটি টালমাটাল স্বরে কাঁপতে থাকে। ‘ভূমিকম্প! পালাও।’-ডেভোলাপারদের আর্ত কিচিরমিচিরে আমাদের এই সম্বিৎ হয় যে মাটি ও জলের এইসব আকস্মিক পাগলামি ভূকম্পন হতে পারে বটে!

আমাদের পায়ের সামনে মাটি গরগর আওয়াজে ফাটতে শুরু করলে আমরা পেছন ফিরে বাড়ির সমুখে ছুট লাগাই। কতক্ষণ বা কতোটা প্রহর এভাবে ছুটেছিলাম জানি না। বাঁধাভাঙা উচ্ছাসের শেষে দুষ্টু বালকের দল যেমন পরিশ্রান্ত ও নিথর হয়ে আসে, আমরা অনুভব করি প্রকৃতি এখন সেরকম পরিশ্রান্ত। তার খেলাটি শেষ হয়েছে এবং এখন সে ঘুমোবে। বাতাস থির, উপড়ানো গাছের ডালপালা ও ডোবার কাদাপানি পর্যন্ত নিথর। সেই থির কাদাপানির মধ্যে প্রবীণ ও মৃত সারসের সাথে টেকো মাথার ডেভোলাপাররা চমৎকার সিলুয়েট হয়ে ঘুমিয়ে পড়লো দেখে আমরা নিশ্চল হয়ে পড়ি। ডোবার অদূরে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ ধরে দৃশ্যটির দর্শক হওয়ার ক্লান্তিতে আমাদের ঘুম পায়। অতঃপর আমরা মন্থর পায়ে ডোবায় নামি এবং ঘুমন্ত সারস ও ডেভোলাপারদের পাশে চুপচাপ শুয়ে পড়ি।
...