শুক্রবার, ১৫ জানুয়ারী, ২০১০

সঙ্গীতের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ

সঙ্গীতের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ

সঞ্জীব কুমার দেবনাথ

সঙ্গীত সাধনায় ব্যবহারিক প্রক্রিয়া মুখ্য হলেও শাস্ত্রীয় জ্ঞানের অভাবে তা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। তাই সঙ্গীতের ব্যাকরণ, বিজ্ঞান, দর্শনসহ ব্যবহারিক অনুশীলনের পাশাপাশি এর উৎপত্তি, ক্রমবিকাশ এবং উৎকর্ষ সাধনের ইতিহাস সংক্রান্ত তথ্যাদির সঙ্গে পরিচয় থাকা বাঞ্ছনীয়। কারণ_ বিষয়টি শাস্ত্রীয় জ্ঞানেরই একটি উল্লেখযোগ্য অংশ। প্রত্যেক শিল্পকলার উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশের পেছনে একটি সুদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে, যা আলো-আঁধারের বিচিত্র বিবর্তন নিয়ে রচিত। সঙ্গীতকলার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। সঙ্গীতের উৎস সন্ধানে ইতিহাসবিদ, সঙ্গীতশাস্ত্রবিদ, দার্শনিক, প-িত ও নৃবিজ্ঞানীরা যুগ যুগ ধরে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু এর উৎপত্তি সংক্রান্ত সর্বজনীন গ্রহণযোগ্য কোন মতবাদ তারা অদ্যাবধি প্রদান করতে পারেননি। তাই সঙ্গীতের উৎপত্তির বিষয়টি আজও মূলত লৌকিক উপাখ্যান ও ধর্মীয় কল্প-কাহিনীর সঙ্গে সম্পৃক্ত, যা যুগের পর যুগ মানুষ বিশ্বাস করে আসছে।

হিন্দু-ধর্ম বিশ্বাসে সঙ্গীতের ছয়টি আদিরাগের পাঁচটিই শিব বা মহাদেবের মুখ থেকে নির্গত হয়েছে। অবশিষ্ট একটি রাগ জন্মেছে শিবের স্ত্রী পার্বতীর মুখ থেকে। অপরদিকে পাশ্চাত্যদেশে সঙ্গীতের প্রথম সৃষ্টি সংক্রান্ত চমকপ্রদ কাহিনীটি হলো, হার্মেস-এর গাথায় পাওয়া যায়, জন্মের পর হোমার কিল্লেনি পর্বতের উপর গুহার পাশে একটি কচ্ছপ দেখতে পান। তিনি কচ্ছপটিকে মেরে তার খোলে (ঝযবষষ) গরুর চামড়া ও ভেড়ার অন্ত্রে তৈরি সাতটি তার দিয়ে বাদ্যযন্ত্র সৃষ্টি করেন। সঙ্গীত উৎপত্তির এমন বহু গল্প রয়েছে। এসব ধর্মীয় বিশ্বাসে ও লৌকিক উপখ্যানের উপর আঘাত হেনে সঙ্গীতের উৎস সংক্রান্ত বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা প্রাচ্যে সম্ভব হয়নি। তবে পাশ্চাত্যে কিছু কিছু হয়েছে। যেমন : কাটসাকস, এ. ডানিয়েল, এইচ.জি ফারমার প্রমুখ পাশ্চাত্য লেখক এই উপ-মহাদেশীয় সঙ্গীত নিয়ে ব্যাপক কাজ করেছেন। তাঁরা সবাই একমত পোষণ করেছেন যে, প্রাচীনকালে সমগ্র বিশ্বের অসংখ্য জাতি ও দেশের মধ্যে সঙ্গীতের প্রচলন ছিল এবং তা বিকাশ লাভ করেছে স্ব স্ব দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মজীবনের ভিতর দিয়ে।

উল্লেখ্য, প্রাচীন পারস্যের রাজদরবারে সঙ্গীত পরিবেশন করা হতো। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া তথা তাজিয়ার সময়ে তাদের অপরিহার্য উপাদান ছিল সঙ্গীত। সঙ্গীতের অনুষ্ঠান হতো ইমাম হাসান ও হোসেনের উদ্দেশে। সামগান, নাথগীতি, চর্যাগীতি প্রভৃতি প্রকীর্ণ শ্রেণীর প্রবন্ধসঙ্গীত গীত হতো এই উপ-মহাদেশীয় সঙ্গীত উৎপত্তির প্রারম্ভিক লগনে। তবে সঙ্গীতের অনুশীলন হতো মূলত মন্দির ও চার্চে উপাসনার মাধ্যমে। অর্থাৎ সঙ্গীতের রূপ ছিল তখন ধর্মীয় প্রার্থনার সঙ্গে সম্পৃক্ত। এ বিষয়টি সঙ্গীতের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ সংক্রান্ত প্রাচীন সংহিতা, আরণ্যক ও ব্রাহ্মণ সাহিত্যগুলোর আলোচনায়ও লক্ষ্য করা যায়। তবে সঙ্গীতের কাঠামোগত পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও পরিমার্জনের মাধ্যমে জনসাধারণের কাছে এর আকর্ষণ ও গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পাওয়ার জন্য তখন বিভিন্নভাবে প্রচেষ্টা চালানো হতো। যেমন : বৈদিক সঙ্গীতের সঙ্গে যুক্ত করা হয় নৃত্য এবং গণমুখী লৌকিক সঙ্গীত যদিও গ্রীস ও পারস্য প্রভাবে পরবর্তীতে নৃত্য একটি আলাদা কলা হিসেবে আবির্ভূত হয়।

সঙ্গীতের প্রচার, প্রসার ও উন্নতির জন্য প্রাচ্যের হিন্দু সন্ন্যাসী ও বৌদ্ধ ভিক্ষুরা রাজকীয় অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিবেশন করতেন। এ রেওয়াজ পাশ্চাত্যের ধর্মযাজকরাও চালু করেছিলেন। সুতরাং এ থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়, সঙ্গীতের উৎস এবং বিকাশের গতিধারায় প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের মধ্যে মৌলিক কোন পার্থক্য ছিল না। স্বাভাবিক কারণেই সঙ্গীতের উৎপত্তি বিষয়ক পাশ্চাত্য দেশীয় সংজ্ঞা প্রাচ্যের ক্ষেত্রেও সমভাবে প্রযোজ্য। তবে সে ঐতিহাসিক পটভূমির আলোচনায় মনে রাখতে হবে, শুধুমাত্র বাস্তব ঘটনা পর্যালোচনা করে ইতিহাসের সার্থক রূপ সৃষ্টি করা যায় না; এর জন্য প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট ঘটনাসমূহ কখন, কোথায় এবং কিভাবে বিকাশ লাভ করেছিল, সেগুলোর প্রমাণযোগ্য তথ্য সংগ্রহ করে তা বর্তমান দর্পণে প্রতিফলন করা।

সঙ্গীতের উন্নয়ন সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য ও তত্ত্ব বিশ্লেষণ করতে গিয়ে অনেকে মনে করেন, গ্রীকরাই সঙ্গীতের প্রচার ও প্রসারের একচ্ছত্র কৃতিত্বের অধিকারী। তাদের মতে, গ্রীকরা রোম নগরী আক্রমণ করার সময় গ্রীসের সৈনিক ও দাসরা যে সঙ্গীতচর্চা করত তা দেখে রোমের অধিবাসীদের মনে সঙ্গীত শিক্ষার আকাঙ্ক্ষা জাগে এবং পরবর্তীতে গ্রীস সঙ্গীতের দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। কিন্তু সঙ্গীতের যে রূপ আজ আমরা দেখছি, সে রূপের পশ্চাতে রয়েছে শত-সহস্র সঙ্গীতজ্ঞ, সাধক, জ্ঞানী-গুণীদের যত্নশীল উদ্যম; রয়েছে তাদের পারস্পরিক নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের আদান-প্রদান। এই উপ-মহাদেশসহ তুরস্ক, বেলজিয়াম, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্স, স্কটল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, আমেরিকা এবং অন্যান্য পাশ্চাত্য দেশে সঙ্গীতের ক্রমবিকাশ হয়েছে মোটামুটি একই আদলে। এই সঙ্গীতের মাধ্যমেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষ নিজেদের মধ্যে সাংস্কৃতিক ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ স্থাপন করেছে বলে প্লিনি, স্ট্রাবো, মেগান্থিনিস প্রমুখ প্রাচীন বিদেশী ঐতিহাসিকগণও মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করেছেন। সুতরাং সঙ্গীতের সমৃদ্ধি ও সার্বিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে পৃথিবীর সব সুসভ্য দেশই একে অন্যের কাছে ঋণী। এতে বিভিন্ন জাতি বা জনগোষ্ঠীর একক কোন কৃতিত্ব নেই। অপরদিকে বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা অনুযায়ী সঙ্গীতের সৃষ্টি জীবজন্তুর চিৎকার নকল করার প্রবণতা থেকে, যদিও চার্লস ডারউইনের মতে, বিপরীত লিঙ্গের প্রাণীকে যৌনাসক্ত করার প্রচেষ্টা থেকেই সঙ্গীতের সৃষ্টি। তবে ফরাসী দেশের জ্যাঁ জাক রুশো, ইংল্যান্ডের হারবার্ট স্পেনসার প্রমুখ দার্শনিকদের মতে, উচ্চকণ্ঠে কথা বলা থেকে সঙ্গীতের শুরু। এদিকে ওয়ালাসেচক তার ুচৎরসরঃরাব গঁংরপচ্ নামক গ্রন্থে সঙ্গীতের উৎপত্তির ক্ষেত্রে তাল, লয় বা মাত্রার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। জার্মান লেখক কার্ল বুকার ্তুঅৎনবরঃ ধহফ জযুঃযসঁং্থ গ্রন্থে সমষ্টিগত কাজের সুবিধার জন্য সঙ্গীতের সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করেন। ফাদার ডবিস্নও স্মিথ এবং কার্ল স্টাম্ফ-এর মতে প্রাচীন মানুষ তাদের প্রয়োজনের তাগিদেই ভাষার মতো সঙ্গীতের জন্ম দিয়েছে।

তবে উলি্লখিত গবেষণামূলক তত্ত্ব ও তথ্যের মধ্যেও একচেটিয়া সত্যের অভাব রয়েছে বলে অনেক সঙ্গীত-বিশারদ যে ধারণা পোষণ করেন, তাও কিন্তু অমূলক নয়। তাদের মতে, মানুষ যেমন তার নিজের প্রয়োজনে ভাষা সৃষ্টি করেছে, সঙ্গীতও তারা নিজের প্রয়োজনেই সৃষ্টি করেছে। আদিম মানুষ তাদের আনন্দ উল্লাস বিভিন্ন শব্দ, আওয়াজ বা ধ্বনির মাধ্যমে প্রকাশ করতো। পরবর্তীকালে সঙ্গীত শাস্ত্রবিদগণ সেই শব্দ, আওয়াজ বা ধ্বনিকে 'নাদ' নাম দিয়ে একে সঙ্গীতের আদি উৎস হিসেবে অভিহিত করেছেন। নাদ থেকে স্বর, স্বর থেকে সুরের উৎপত্তি। সুরের সঙ্গে কথা, তাল ও লয়ের সমন্বয়ে গীত বা সঙ্গীতের উৎপত্তি। উল্লেখ্য, এ তত্ত্বটি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য উভয় সঙ্গীতের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য বলে সঙ্গীত তত্ত্ববিদগণ মনে করেন।

পাশ্চাত্য-সঙ্গীত উৎপত্তির বিষয়ে অনেকে মনে করেন ২৩৪৮ খ্রীস্টপূর্বাব্দে মহাপ্লাবনের (উবষঁমব) পূর্বে জুবল (ঔঁনষব) সঙ্গীতের সৃষ্টি করেন (উদ্ধৃতি : ভারতীয় সঙ্গীতের ইতিহাস, স্বামীজি প্রজ্ঞানানন্দ, পৃষ্ঠা-২৮)। ৬০০ অব্দে পীথাগোরাস গ্রীসীয় সঙ্গীত পদ্ধতিকে এগিয়ে নিয়ে যান। তবে ইংল্যান্ডের আদিম অধিবাসী বৃটনরা এবং ইংল্যান্ডে বসবাসকারী স্যাক্সনরা খ্রীস্টধর্মে অভিষিক্ত হবার পর চার্চসহ বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সঙ্গীতধারার প্রবর্তন করেন। খ্রীস্টপূর্ব (৬৭২-৭৩৫) অব্দের মাঝামাঝি সময়ে ইংরেজ সন্ন্যাসী ও ঐতিহাসিক বিডি (ইবফব) সুপ্রসিদ্ধ শিল্পী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তৃতীয় হেনরীর রাজত্বকালে ওয়ালটার ওডিংটন সাতটি অক্ষরের সাহায্যে স্বরলিখনের (ঘড়ঃধঃরড়হ) প্রবর্তন করেন। এই সাঙ্গীতিক স্বরলিপি প্রথার ক্রমবিকাশ ও উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে কণ্ঠ ও যন্ত্রসঙ্গীতের বিস্তৃতি ঘটে। মোটামুটিভাবে ১৪০০ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ড, নেদারল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি প্রভৃতি দেশে সঙ্গীত রচনার কাজ বিশেষভাবে প্রসার লাভ করে। এরপর গেব্রিয়েল (১৫৩০-১৬১২) নামে একজন ইতালীয় সঙ্গীত শিল্পী অকেস্ট্রা-সঙ্গীত এবং জার্মানির গুক (১৭১৪-১৮৮৭) ও মোজার্ট (১৭৫৬-১৭৯১) অপেরা সঙ্গীতের মাধ্যমে পাশ্চাত্য সঙ্গীতের যথেষ্ট উৎকর্ষ সাধন করে গেছেন। এই অপেরার মাধ্যমে রাশিয়ায় সঙ্গীত নবজীবনের সূচনা করে। পাশ্চাত্য-সঙ্গীতের উন্নয়নে হ্যান্ডেল-এর ভূমিকাও অনস্বীকার্য। প্রখ্যাত জার্মান সঙ্গীত রচয়িতা হ্যান্ডেল অধিকাংশ সময়ই ইংল্যান্ড-এ বসবাস করতেন। তিনি বাইবেলের কিছু কিছু অংশে সুর বসিয়েছিলেন। এগুলো শত শত কণ্ঠে এবং শত শত যন্ত্রে 'হ্যান্ডেল' উৎসবে গাওয়া হয়ে থাকে। একবার রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং ঐ উৎসবে উপস্থিত ছিলেন বলে তিনি তাঁর 'সঙ্গীত' প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন।

প্রাচ্যসঙ্গীত-এর সূতিকাগার হলো আমাদের এই ভারতীয় উপ-মহাদেশ। কারণ প্রাচ্যের দেশগুলো বিশেষ করে চীন, জাপান, কম্বোডিয়া প্রভৃতি দেশের সঙ্গীত সমৃদ্ধি লাভ করেছিল ভারতবর্ষের স্বরগ্রাম ব্যবহারের মাধ্যমে। এখানে সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের প্রাথমিক নিদর্শন পাওয়া গেছে হিমবাহ যুগে (৪ লক্ষ-২ লক্ষ খ্রীস্টপূর্ব)। সেই হিমবাহ যুগ থেকেই ক্রমবিবর্তনের ধারায় জন্ম নেয় প্রস্তর যুগ এবংি পরবর্তীতে সিন্ধু সভ্যতা (খ্রীস্টপূর্ব ৩০০০-২০০০)। এই যুগে প্রাপ্ত নৃত্যরতা নারীমূর্তি, বিভিন্ন সীলমোহর, মৃৎপাত্রের গায়ে নকশা, শিলালিপি, গুহাচিত্র এবং অন্যান্য প্রত্নতাত্তি্বক নিদর্শন অবলোকন করে সিন্ধু সভ্যতাকেই এই উপ-মহাদেশীয় সঙ্গীতের প্রারম্ভিক কাল এবং গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। কারণ এর পূর্বে সঙ্গীতের প্রমাণযোগ্য কোন ইতিহাস পাওয়া যায় না।

তবে খ্রীষ্টপূর্ব দু'হাজার বছরের পর থেকে সিন্ধুসভ্যতা ধীরে ধীরে পতনের দিকে এগিয়ে যায়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দার কারণে সিন্ধুর অধিবাসীরা বাধ্য হয়ে সুকুমার বৃত্তিগুলো ছেড়ে বাঁচার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এ সময় আফগানিস্তান ও ইরানের মালভূমিতে বসবাসরত কৃষিজীবী আর্যরা হিন্দুকুশ গিরিপথের ভিতর দিয়ে এ উপমহাদেশে প্রবেশ করে। নাগরিক সভ্যতার সঙ্গে পরিচয় না থাকায় তারা মৃতপ্রায় সিন্ধুসভ্যতাকে আঘাতের পর আঘাত করে আস্তে আস্তে সনাতনী গ্রাম্য সভ্যতার দিকে এগিয়ে যায়। তারপর একে একে আসে পারসী, গ্রীক, আরব, পাঠান, মোঘল এবং একাধিক ইউরোপীয় জনগোষ্ঠী। এদেশের মানুষের সঙ্গে; জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশে তারা একটি উন্নত ধরনের নিয়মতান্ত্রিক সঙ্গীত পদ্ধতির জন্ম দেয়। তাঁদের সৌন্দর্যবোধ বা নন্দনরুচি ছিল প্রশংসনীয়। বৈদিক যুগে (যীশু খ্রিস্টের জন্মের আনুমানিক ২০০০ বছর পূর্ববর্তীকাল) সৃষ্ট ঋগ্বেদের শ্লোকগুলো তারা তখন সংগৃহীত ও কণ্ঠস্থ করে। সুরারোপিত ঋগ্বেদের শ্লোকগুলোই পরবর্তিতে সামবেদ তথা সামগান নামে পরিচিতি লাভ করে। সামগানে বাদ্যের মাধ্যমে গানের সুর ধারাকে অনুসরণ করার রীতি প্রচলিত ছিল। প্রাথমিক পর্যায়ে সামগানে স্বরের সংখ্যা তিন বা চার হলেও ধীরে ধীরে তা সপ্তসুরে বিকাশ লাভ করে। এজন্যই হয়ত সামবেদকে সঙ্গীত পদ্ধতির প্রাথমিক পদক্ষেপ বলে মনে করা হয়। স্বামী প্রজ্ঞানানন্দের মতে, এই সামগান বিশ্ব সঙ্গীতের মূল উৎস। উল্লেখ্য, আর্যদের এই সামগান পরবর্তীতে মার্গ সঙ্গীত নামে পরিচিতি লাভ করে এবং সেই মার্গ শ্রেণীভুক্ত গানগুলো খ্রীস্টপূর্ব ৫ম শতক পর্যন্ত প্রচলন ছিল।

পঞ্চম শতাব্দীর পরই আসে বাংলাভাষার প্রথম নিদর্শন নাথগীতি এবং চর্যাগীতি নামে এক প্রকার প্রকীর্ণ শ্রেণীর প্রবন্ধসঙ্গীত। স্ত্রোত্র আকারে গেয় এই প্রবন্ধসঙ্গীত থেকে উদ্ভব লৌকিক সঙ্গীত। আবার এই লৌকিক সঙ্গীত থেকেই জন্ম নেয় ক্লাসিক্যাল বা রাগসঙ্গীত। ঋগ্বেদের প্রখ্যাত ভাষ্যকার কালীনাথ মনে করেন, মার্গ সঙ্গীত, গান্ধর্ব সঙ্গীত ও ক্লাসিক্যাল সঙ্গীত একই সূত্রে গাঁথা। স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ 'যতি'কে রাগের পূর্বসূরি বলে আখ্যায়িত করেছেন। এই যতির কথা নাটক সম্বন্ধীয় ভরত মুনির 'নাট্যশাস্ত্রে' উল্লেখ রয়েছে, যা ক্রমবিবর্তনের ধারায় উপমহাদেশীয় সঙ্গীতকে মাতিয়ে রাখে প্রায় সাত শ' বছর। এই যতি যুগের প্রথম দিকে স্বরের সংখ্যা অনুযায়ী রাগের শ্রেণী বিন্যাস করা হতো। পরবর্তীতে শুদ্ধ, শংকর ও ছায়ালগ এই তিন শ্রেণীতে বিন্যাস করে শেষ পর্যন্ত ছয় রাগ ছত্রিশ রাগিনীতে বিভক্ত করা হয়।

এরপর অর্থাৎ দ্বাদশ শতকে সঙ্গীত শৈলীর অন্যতম নিদর্শন হিসেবে আবির্ভূত হয় জয়দেবের গীতগোবিন্দ। জয়দেব ছিলেন রাজা লক্ষণ সেনের সভাকবি এবং সংস্কৃত সাহিত্যের শেষ শিল্পী। মূলত রাধাকৃষ্ণের লীলাকে কেন্দ্র করে রচিত গীতগোবিন্দ সঙ্গীত জগতে এক নবতরঙ্গের সূচনা করে। এ সময় সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বিশেষ করে সঙ্গীতের ক্ষেত্রে মুসলমান সম্প্রদায়ও বেশ অগ্রগামী ছিলেন। হিন্দু ও বৌদ্ধদের মতো তারাও ধর্মাচরণে সঙ্গীত ব্যবহার করেছেন। খাজা মঈনউদ্দিন চিশতী (১১৪২-১২৩৬) ভারতবর্ষে ইসলাম প্রচারকালে মুরিদগণকে নিয়ে সামা নামক গান গেয়ে খোদার প্রেমে তন্ময় হয়ে যেতেন। উপ-মহাদেশের বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত মুসলিম পীর, আউলিয়া, সুফি, দরবেশ, ফকিরদের মাজার শরীফে, হুজুরায় ও খানকা শরীফে আধ্যাত্মিক ধর্মসাধনায় সঙ্গীত অনুশীলন হতো, যা এখনও প্রচলিত আছে। তবে ত্রয়োদশ শতাব্দীতে সম্রাট আলাউদ্দিন খিলজীর শাসনামলে (১২৯৫-১৩১৬) মুসলিম সঙ্গীতজ্ঞরা সর্বপ্রথম এ উপ-মহাদেশীয় সঙ্গীতকে ধর্মীয় বলয় থেকে মুক্ত করে সাধারণ মানুষের কাছে নিয়ে আসার প্রচেষ্টা চালায়। সে প্রচেষ্টায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন কবি শেখ সাদী (১১৭৫-১২৯৫)। তাছাড়া কবি ও সঙ্গীতজ্ঞ আমীর খসরু (১২৫৩-১৩২৫) অতিমাত্রিক বৈকরণিক শাসনে অতিশয় নিরস ও স্থবির হয়ে থাকা নিয়ম-নীতি ও গায়ন-শৈলীকে ভেঙ্গে সহজ-সরল রূপ দিয়ে সর্বপ্রথম 'খেয়াল' রীতির প্রবর্তন করেন এবং গজল বচনায় মনোনিবেশ করেন। তাছাড়া তিনি কাওয়াল নামক এক প্রকার গানেরও প্রচলন করেন।

বাংলা সঙ্গীতের আরও একটি উল্লেখযোগ্য উপাদান হলো কীর্তন। পঞ্চদশ শতকে ৪১৮টি পদ সম্বলিত বড়ু চ-ীদাসের (১৩২৫-১৪০২) শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন যেমন শ্রীচৈতন্যের (১৪৮৬-১৫৩৩) হাতে বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে, ঠিক তেমনি শেখ সাদীর 'খেয়াল' জৌনপুরের শেষ সুলতান হোসেন শাহ শারকী (?) কর্তৃক সংস্কার হয়ে বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। তবে, মোগল সম্রাজ্য পতনের পর খেয়াল বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয় এবং এর শক্তিমান আপন বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলে। পরবর্তীতে মঙ্গলকাব্য থেকে উদ্ভব হয় মঙ্গলগীতি। এ গানের মূল বিষয় হলো মঙ্গলোচ্চারণ অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশে প্রার্থনা। তবে, এসব কাব্যে বাঙালির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও আচার-আচরণের প্রতিচ্ছবিও বর্ণিত হয়েছে। ষোড়শ শতকে লোচন দাসের (?) ধামালি এবং অষ্টাদশ শতকে রামপ্রসাদ (১৭২০-১৭৮১) তার গানের মাধ্যমে আধ্যাত্মিক সাধনার জগতে বৈচিত্র্য আনেন।

অষ্টাদশ শতকের শেষভাগে পাঞ্জাব অঞ্চলের লোকগীতি টপ্পা গানের প্রচলন শুরু হয়। প্রধানত উটের গাড়ি চালকের মুখেই টপ্পা গান বেশি শোনা যেত। শোরী মিয়া (১৭৪২-১৭৯২) নামে একজন সঙ্গীতজ্ঞ টপ্পা গানগুলোকে সাঙ্গিতিক আদর্শে সাজিয়ে সম্পূর্ণ আলাদা একটি গায়ন পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। এ পদ্ধতি অনুসরণ করে রামনিধি গুপ্ত বা নিধু বাবু (১৭৪১-১৮৩৯) বাংলা টপ্পা রচনা করেন। এখানেই ভারতীয় বা হিন্দুস্থানী রাগসঙ্গীতের ধারার সঙ্গে বাংলা রাগসঙ্গীত চর্চা যুক্ত হয়। পরবর্তীতে টপ্পাকার কালীমির্জা (১৭৫০-১৮২০), বাংলা ভাষায় ধ্রুপদ রীতির প্রবর্তক রামশংকর ভট্টাচার্য (১৭৬১-১৮৫৩) এবং বাংলা ভাষায় খেয়াল রচয়িতা রঘুনাথ রায় (১৭৫০-১৮৩৬) বাংলা গানকে আরও সমৃদ্ধ করে হিন্দুস্থানী রাগসঙ্গীতের ধারার সঙ্গে যুক্ত করেন। উনিশ শতকের প্রথম দিকে আসে বাউল গানের যুগ। লালন ফকির (১৭৭৪-১৮৯০), কাঙাল হরিনাথ মজুমদার (১৮৩৩-১৮৯৬), গগন হরকরা (?), রাধারমন (?), হাছন রাজা (১৮৫৪-১৯২২) প্রমুখ মরমিয়া সাধকদের গান বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে। বাউল গানের পাশাপাশি লোকগীত, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, পল্লীগীতি প্রভৃতি মাটি ও মানুষের গানে এদেশের মানুষ তাদের শেকড়ের সন্ধান খুঁজে পায়। এর পরবর্তী পর্যায়ে বাংলা গানের বিকাশ সাধিত হয়েছে মূলত ব্রাহ্মধর্মান্দোলন, দেশোদ্দীপনা ও নাট্যমঞ্চ-এ ত্রিধারায়। যেমন : প্রথমত দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪০-১৯২৬) এবং সঙ্গীতবিজ্ঞানী কৃঞ্চধন বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৪৬-১৯২৬) কর্তৃক বাংলা গানের স্বরলিপির পদ্ধতি প্রণয়ন করার পর বিষ্ণুপুরের ধ্রুপদকে ব্যবহার করে সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে প্রণয়োচ্ছ্বাসিত হালকা বাংলা গানে ভাব ও বন্দিশের গাম্ভীর্য আনতে উদ্যোগ নিয়েছিল ব্রাহ্মসমাজ। দ্বিতীয়ত, ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গরোধ আন্দোলনকালে রাখিবন্ধন উৎসবকে কেন্দ্র করে রচিত হলো অসংখ্য স্বদেশী গান, জেগে উঠে বাংলা গানে দেশভাবনার অনচ্চ ইঙ্গিত, সূত্রপাত হয় স্বদেশী আন্দোলন। তৃতীয়ত গিরিশচন্দ্র (১৮৪৯-১৯১২), দ্বিজেন্দ্রলাল রায় (১৮৬৩-১৯১৩), নজরুল (১৮৯৯-১৯৭৬) প্রমুখ বাংলা নাটকে ব্যবহার করতে থাকেন সমসাময়িক কালের চাহিদা অনুযায়ী প্রাণবন্ত বাংলা গান।

মোটামুটিভাবে বলা যায়, ঊনবিংশ শতাব্দীর সত্তর দশক থেকে বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশ দশকের সেই ত্রিধারার সঙ্গীতরীতিই সতর্ক অনুধাবনে সমীকৃত হয়েছে নতুন ভাবনা রূপায়ণে এবং এই চলমান প্রক্রিয়া পরিপূর্ণ রূপ পরিগ্রহ করে পঞ্চপ্রদীপ খ্যাত রবীন্দ্র (১৮৬১-১৯৪১) দ্বিজেন্দ্র-রজনী (১৮৬৫-১৯১০), অতুল (১৮৭১-১৯৩৪) এবং নজরুল-এর মাধ্যমে। তাঁরা তাদের ব্যক্তিগত অনুভূতিকে নিজের মতো করে প্রকাশ করেছেন নিজেদের বাণী ও সুরসৃজনে। কিন্তু নজরুল পরবর্তী বাংলা গানে সুরের চলনে ও গীত রচনায় আসে নানা বিভাজন। গীতিকার গান লেখেন, সুরকার সুর দেন, আবার কণ্ঠে রূপায়ণ করেন আরেকজন। এগুলো সমন্বয়ের জন্য তথা গানের পরিপূর্ণ রূপ প্রকাশ করার জন্য থাকে এ্যারেঞ্জার নামে এক নতুন ব্যক্তি। একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, স্বদেশী আন্দোলনে, ৫২-এর ভাষা আন্দোলনে, ৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে এবং আমাদের মহান স্বাধীনতা আন্দোলনে দেশের গান এদেশের সংগ্রামী মানুষকে নিরন্তর প্রেরণা যুগিয়েছিল। তবে পঞ্চাশ কিংবা ষাট দশকে বাংলা গান যেভাবে শ্রোতাদের মন জয় করেছিল আজ তা পারছে না। তাই চলছে পেছনের দিকে যাবার পালা। এরকম বাধ্য হয়েই রেকর্ডিং কোম্পানিগুলো প্রকাশ করে চলেছে পুরনো হিট গান বা তার রিমেক। তারা মূলত ক্যাসেট বের করে চলেছে চলি্লশ থেকে সত্তর দশকে গাওয়া শিল্পীদের আধুনিক গান। ১ বৈশাখ, বর্ষামঙ্গল, বসন্ত উৎসব, ঈদ কিংবা পূজা উপলক্ষে এখন আর গান রচনা হয় না। পঞ্চপ্রদীপের গানেই সে কাজ মিটে যায়। এর পরও বলতে হয় বাংলা গান থেমে নেই। যুগ যুগ ধরে চলছে এবং চলবে সেই চিরায়ত সারস্বত সাধনা।

মঙ্গলবার, ৫ জানুয়ারী, ২০১০

ওবায়েদ আকাশের কবিতা /২

উৎসর্গ

আমি কম করে হলেও রাতে দশবার ঘুমুতে যাই। প্রথমবার ঘুমুতে গেলে মাত্র এক ঘুমেই সমস্ত রাত কাবাড় করে দিতে পারি। আর দ্বিতীয়বার তোমার কথা ভাবতে ভাবতে মাত্র এক ঘুমেই পাড়ি দিতে পারি তোমাদের প্রতিবেশী নদী। এরপর প্রতিবার ঘুমুতে গেলেই লেখা হয়ে যায় তোমার প্রিয় কবিতার দীর্ঘ দীর্ঘ বই। আর এর যে কোনো একটি বই তোমাকে উৎসর্গের কথা ভুলে গেলে কবি হয়ে ওঠো ততোধিক




শীতের প্রকার

এই চৈত্রে তুমি জ্বরগ্রস্ত হলে

তীব্র জ্বরের ঘোরে বিদ্যুৎ বাতির দিকে রেখেছো চোখ
আলনায় বসেছে কালো কাক
এবার জানালার পাশে, চৈত্রের কিছু ভালোবাসা ছাড়া
আর কোনো কূজন ওড়েনি

আমি ও সেবিকা তোমার-- অসুখের পাশে
ভররাত বসে থেকে
দক্ষিণে বারান্দায় বসে কাঁদি

এবার শীত চলে গেল হঠাৎ বিদ্যুচ্চমকের মতো--

বিশুদ্ধ জলের বোতলে লালনীল পথ্যগুলো
পচে-গলে ঝাঁঝিয়ে উঠেছে

তোমার মুখভর্তি আলো
চোখের গড়ান ধরে বয়ে যাওয়া রোগগুলো
তারা অবিকল দেখে--

আমি ও সেবিকা তোমার-- আলনার কাঁধে
কালো কাক দেখে
দূর থেকে ডেকে আনি
দক্ষ এক পাখিবধকারী

শূন্যতার রাত্রিদিন

নাইলন সুতোয় ঝুলে কাতরাচ্ছে শূন্যতার অনন্ত আকাশ; এরপর, সমস্ত বিমানপথে উড়ে যাবে দুরন্ত রেলগাড়ি। শূন্যতার যান্ত্রিক পাঁজরে কিছু নড়ে উঠে আবার মিলিয়ে যায়।... চারপাশে সারি সারি গোটানো বাথরুম, সুবিন্যস্ত শয্যাকক্ষে সঙ্গমকালীন শব্দকলায় মিলিয়ে যায় ট্রেনের ঝিকঝাক। তবু শূন্যতার বুক জুড়ে ঢেউ। আবার কিছু নড়েচড়ে টের পায় নাইলন সুতোয় প্যাঁচানো শরীরের ক্ষত। কেউ আবার স্মিত হাসে। পান খেয়ে ঠোঁট লাল করে মেলে দেয় গাঢ় রঙধনু। আজ উৎসব-- আকাশের বিস্তৃত পেটে, অধরে; আজ শূন্যতার প্রাত্যহিক দৃশ্যগুলোয় শুভ জন্মদিন। প্রেমিকার ঠোঁট কেটে গড়ানো সমুদ্রের ভেতর কতকালের রতিগন্ধ থাকে-- আজ তার চিরুনি অভিযান

শূন্যতার নদীপথে বিবাহিত যুদ্ধবিমান। পরস্পর বিরহকালের পাঁজরের ব্যথা নিয়ে অগত্যা ঘোষণা করে কতিপয় শাসকের পশুজন্মকথা। তারপর মেঘ; মেঘের দারিদ্র্য কিছু বিবেচনা করে ধরা যাক শুভ বৃষ্টিদিন।... আরও ধরা যাক, আজকাল মাছি নেই পচাগন্ধ বিরান ভাগাড়ে; তবু কিছু আঁস্তাকুড় অবিকল টিকে যাচ্ছে কতিপয় মনুষ্য আধারে। যারা প্রভু, পোড়াগন্ধ শূন্যতার গভীর আড়ালে থেকে, নগরযান্ত্রিক কলে দুই হাতে তুলে দেয় সবুজাভ নিসর্গের জন্মগল্পকথা-- বৃষ্টির শরীর না হয় নাইলন সুতোয় ঝুলে শূন্যতার ফাঁসি চায় কাম-রতি-জ্বরে। শাসকের সুশোভন বাড়ি, রক্তের রঙধনু হয়ে গড়ে ওঠে শূন্যতার সুশীল চাদরে









ঘুমনির্ঘুম কথা

প্রতিদিন তুমি অজস্র কাজ করে একটি সুচিন্তিত আদর্শের সেতুপথ ধরে ঘরে ফিরে আসো। ফিরে এসে, শয়নকক্ষের মাছিগুলি মেরে যতোই নিশ্চিন্ত হও ঘুমের জন্য, তখন তোমার একটার পর একটা প্রয়োজনীয় করণীয় থাকে, যা তুমি অনিচ্ছায় ঘুষ গ্রহণের মতো কখনো এড়াতে পারো না; যেভাবে এড়াতে পারো না কানের ভেতর সামান্য সুড়সুড়ি পেলে কখনো দেয়াশলাইয়ের কাঠি আর কখনো-বা কটন টিপস দিয়ে কান চুলকানোর কাজ। একবার তুমি ভাঙা সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে থেকে নদীজুড়ে দেখেছিলে ভয়ঙ্কর চক্র-ঘূর্ণি স্রোত। লাফিয়ে পড়ে মরে যাবার ভয়াবহ দৃশ্যের কথা কল্পনা করেছিলে তুমি। সেই থেকে ঘরে ফিরেই ঐ এক কৃত-কল্পনা অন্তত প্রতিদিন একবার হলেও তোমাকে তো ঘুম-নিবৃত করে। আর একবার তুমি কতিপয় পরাজিত বীরের অলঙ্ঘ্য আদর্শের পাশে নতজানু হয়ে, যদিও-বা ভেবেছিলে জীবনের নিতান্তই সংগোপন কিছু গ্লানিময় মুহূর্তের পর ভাঙাবুক অতীতের কথা, ঘুমের ক্লান্তির অধিক খুব বেশি ক্লান্ত হয়ে ভররাত জেগেছিলে তুমি

তুমি দেখো, বাজারের গমগম ধ্বনি এফোঁড়-ওফোঁড় করে মহাকাশ তাড়িয়ে গেলেও, প্রাণিকুল যত্রতত্র নিশ্চিন্ত ঘুমায়; মেঘাবৃত আকাশে যেভাবে প্রাণান্ত ঘুমায় অনর্গল বজ্রনাদে উজ্জ্বল তারকারাশি। আর দেখো, আমগ্ন নিভৃতবাসে শীতল শয্যায় শুয়ে প্রায়ই ঘুমুতে পারো না তুমি



বালিকার প্রাচীন অসুখ

রোগগ্রস্ত বালিকার জিহ্বার উচ্চতায় বসে নেমে আসে বৃষ্টির প্রস্রবণ। এই ধারা অহিংস কালের। একদা মেঘের আড়ালে অলজ্জ অন্ধকার ফুঁড়ে উড়েছিল পৃথিবীতে ব্যবহৃত অজস্র আলোর কঙ্কাল। আর তার অভিন্ন নাচের মুদ্রায় যারা যারা দীর্ঘায়ু ভ্রুণের আস্তরে পৃথিবীকে উর্বর করে ফিরে গেল অনন্তের জরায়ু সড়কে; কিছু ভুল, কিছুবা জন্মান্ধ শিশু পড়ে থাকা পৃথিবীতে বেঁচে যায় আরোগ্য দোষে। আর কিছু বিজ্ঞাপন বলো ভাড়া করে আনা হলো রোগগ্রস্ত বালিকার দু’ঠোঁটের অনঙ্গ আলোয়। মৃত এক পরিখায় আরো যারা লাশ হয়ে বেঁচে আছে ভয়ার্ত স্রোতবতী নদী, আজো যারা মাটির আর্দ্রতা হয়ে ঘরে ঘরে তুলে দেয় শস্যের ব্যাপক সম্ভার, আর কিছু কৃতিকথা মেঘের ওপারে বসে ছুড়ে দেয় মেয়েটির নাচের ব্যাখ্যায় : তাই বলো পাহাড়ের কান ফুঁড়ে ঝুলে আছে একক আকাশে। নক্ষত্রের প্রথম প্রাচীর ধসে ইতিহাসে শকুনেরা প্রথমত খেয়ে গেছে প্রাচীন সভ্যতার কিছু ভুল স্বীকৃতি; আশরীর বহতা রঙে আজো তাই বয়ে যাই দু’চোখের সফল আধার; এই কিছু কালো সাবলীল উড়ে এসে আলোচ্য জিহ্বার লালায়, আমাদের সামন্ত অসুখ আজো নাকি গেঁথে আছে দু’চোখের দর্পিত রথে। আমাদের বিভাজ্য মুখ, একক ইশারা কিছু উড়ে আসা শীতের পাখিরা দেখো তুলে নেয় বিস্তৃত ডিমের খোসায়। প্রজন্মের ভাষা তাই কখনো অবোধ্য হলে উঠে আসে নাতিশীত শরীরের রোগে। একদা উদাসী বাউল তারস্বরে জুড়েছিল পৃথিবীতে বালিকার প্রাচীন অসুখ



বৃষ্টির আঙুল

যেমন এক্ষুণি পালাল বৃষ্টিদৃশ্য, ফাঁকি দিয়ে
তার পিঠভর্তি মেঘ, অনন্য আঙুলের ক্রাচ
দেখো, উড়ন্ত নীল, অসীমে--

বলেছি আগুনের ঘোড়া
আজ নমস্য বৃষ্টির দিনে পালাতে চেয়েছে--
আজ, উৎসব তাই--

আমরা বিস্তৃত অরণ্যের ঘুমে
আগুনের ঘোড়াগুলো উড়ে যেতে দেখি

বিগত ঋতুর হিসেব লিখে রাখে
প্রকৃতিতে উৎসবের কাল--
যারা ঘুমে, মনে মনে আগুনের সমুদ্রে নেমেছে
তাদের ভূখণ্ড জুড়ে বর্ষণের অজস্র আঙুল

নিঃসীম শূন্যতা হতে কেবল পাতালে চলেছে



সিঁড়ি

অনেক বছর হাতের তালুতে জল ভরে
তার উড়ে যাবার পদ্ধতিগুলো ভুলে গেছি

আগুনের সেঁক দিয়ে বাঁকানো কঞ্চির সাথে
বেঁকে গেছে স্বপ্নের আলম্ব গতি

আজকাল ব্রিজের ওপর দাঁড়ালে শহরের মানুষেরা
মাথার ছাদের ওপারে
অনায়াসে ভুলে যায় এই মুখ
এই ভালো : আরেকবার ডানা মেলে
কথা হবে নক্ষত্র সকাশে

যেখানে নদীরা থাকে-- পায়ে নূপুর
চোখে জাঁকালো অন্ধকার মেখে--
কেউ দেখে, আবার, অন্ধকালা স্রোতস্বিনী
ছুটে যায় কেউ

ব্রিজে ওঠা রীতিগুলো
অশিষ্ট স্বপ্নের ভেতর
আজকাল ঢুকে গেছে খুব





সন্ধ্যাতারা

শীতের প্রকার জেনে জেগেছিল সন্ধ্যাতারা
অনন্ত আকাশে
শীত, বহুদূর প্রবাসে বসে ফাল্গুনের গল্প বলে
উড়ে যায় নিকট পরিজনে

কাতরতা, মূলত শীতের অন্য নাম
অসংখ্য প্রকার তার পৃথিবীতে প্রচলিত আছে
কোনো এক শীতের শীতল বারান্দায় বসে
গুনে দেখি মেঘবর্তী ঝরাপাতাগুলি
সন্ধ্যাতারা ভেসে থাকে তারও বহু পরে

কাতর মুহূর্তগুলো চিনে রাখে
রোগশয্যায় শ্বেতাভ চাদর, আর
চিকিৎসক বলে দেন শীতের প্রকৃত প্রকার
ঘুম নেই, সন্ধ্যাতারা মিশে থাকে আলোকমালায়




একটি মিছিলের প্রস্তুতি ছিল, বৃষ্টিতে

দীর্ঘকায় কাঁধ থেকে সরে যাচ্ছে সুন্দর মুখের কিছু
কদাকার বিজ্ঞাপন

আমাদের চোখভর্তি ধুলো; অন্ধকার সেমিনার ফেলে
উড়ে আসা এই ধুলো-ময়লা
প্রাগৈতিহাসিক

কাঁধভর্তি সাম্প্রতিক কিছু অন্ধকার নিয়ে
দাঁড়িয়েছি ঘোরলাগা বৃষ্টির ছাঁদে
তারপরে মেঘ, গাছপালা, সুন্দর মুখের মেয়েরা
পরে আছে কলাপাতা শাড়ি

আজ বৃষ্টি আজ অন্ধকার আজ ধুলোময়লায় আধডুবো চাঁদ
ভেসে যাচ্ছে আষাঢ়ের ঢলে
আজ, অন্তত একটি মিছিলের প্রস্তুতি ছিল, বৃষ্টিতে--
এই প্রতিশ্রুতি
আমরা কিছু পতঙ্গ সকাশে সবিনয় নিবেদন করি--

দাউ দাউ আগুনের ফেস্টুন হাতে, পরস্পর ডাকাডাকি করে
আমাদের মিছিলের প্রস্তুতি থাকে

আজ কিছু স্তাবকতা খসে পড়ে অন্ধকার থেকে

আমাদের গ্রীবাভর্তি কালো, প্রিয় রাজপথ নয়
মেঠোপথে অভাবিত মেঘের গর্জন শুনে তামাশা মস্করা আর
ঢলাঢলি চলে
আর কিছু পতঙ্গ জানে
আজ সবিনয় নিবেদন থেকে বলাবলি করে
আগুনের বৃষ্টি ঝরেছিল
একটি মিছিলের প্রস্তুতি ছিল, বৃষ্টিতে--
স্তব্ধ ওড়ার প্রকৃতি

আজন্মই মানুষ তার কররেখাগুলো এলোমেলো বয়ে যেতে যেতে একদিন স্থির হতে দেখে। আমিও দেখেছি। দেখেছি যে, মানুষের ভেতরের ওড়ার প্রবৃত্তিগুলো একদিন স্থির হয়ে গেছে। এই ধরো, কেউ কেউ শুয়েবসে শিলাবৃষ্টি গুনেছিল সারাদিন ভরে; পাখির পালক গুঁজে ঘরের বন্ধন ছিঁড়ে উড়ে যেতে চেয়েছিল কেউ।... কিছু কিছু পাখি আজ প্রায় বিলুপ্ত বলে, ভাবি, ভুলক্রমে দেখা যায় পুরনো আকাশে

পাখিদের বিলুপ্তি আর ওড়ার প্রবৃত্তি জানি এক কথা নয়; আমার কল্পনা তবু : যে কোনো ওড়ার বিস্তৃতি ঠিক বেঁচে আছে সীমিত প্রকারে


সমুদ্রদর্শন

অর্ধেক বেলায় আমি সমুদ্রের যতটুকু দেখি, মৃত বন্ধুরা মিলে পাঠিয়েছে তারও চেয়ে দীর্ঘ উপহার। সেইখানে সাঁতারের ছবি, কাঠ-কয়লায় অঙ্কিত অজগর-গাছ আর কিছু মৃতদের নমনীয় আচার স্বভাব

আর তাই পাল্টে নিচ্ছি প্রতিদিনের দাড়ি কামানোর শাশ্বত রীতি, ঘুড়ি ওড়ানোর সরল কৌশল, আর ঘষে দেখি বেঁচে থাকার আসল প্রতিভা

আর একদিন শাপলাফুল তুলতে গিয়ে জলে নেমে দেখি প্রতিবিম্বে কারো ছবি চোখেই পড়ে না। সুতরাং মৃত বলে স্বীকৃতি পাবার এ এক পদ্ধতি বটে

প্রিয় বন্ধুরা, অথৈ সমুদ্রের চেয়ে দীর্ঘ যে জলচ্ছবি পাঠিয়েছো আজ, তাতে ভারি রাগ-ক্ষোভ-বিবৃতি কিছু নেই

সুতরাং একা একা অনুভূতিগুলো কেবল সমুদ্র দেখতেই বুঝি শেষ হয়ে গেল





পেশাদার খুনির পকেটে

এবার খুনিকে কী বলবে তুমি

পেশাদার খুনির পকেটে
ভবিষ্য সংসারটুকু জমা রেখে সেবার জামতলায় ঘুরতে গিয়েছিলে
আর দেখো, ধবধবে ত্বকের সুষমা
ঝঞ্ঝা বাতাসে পড়ে, পাকা জামে খুন হয়ে গেল

প্রতিবার খুনিকে কী বলবে তুমি

এই সব চিহ্নিত শিকার খুনিরাও ভালোবেসে থাকে :
এই ভাবে ধারণা করো তুমি। অন্যথা
তার হাতে দ্বিতীয় তৃতীয় কিংবা ততোবার খুন হতে তোমার
সরল সম্মতির কথা সহজে জানিয়ে দিয়েছো




স্বপ্নবিভ্রম

জালে আটকেছে ভোররাতে দেখা
তুমুল স্বপ্নের কিছু এলোমেলো কথা
ভোরে ক’টি মেয়ে
ভররাত গান করে
গলা নিয়ে ভ্রমণে এসেছে। জালে আটকেছে
রাতভর গাওয়া গীতবিতানের
অজস্র কবিতা

কেউ দেখে, আরো কিছু পাখি
হ্রদে নেমে খায়
জালে আটকানো মাছ
হেঁটে হেঁটে দেখা হলে কোনো ভোরে
তারা পরিচিত কিছু গাছ
তারা অনন্ত মৌনতা



পত্রিকায় বসে সাহিত্য সম্পাদনা করছি

একদিন বিষ্যুদবার আমার পাতা বের হলে চারদিকে হইচই পড়ে যায়। আমার প্রাণান্ত শ্রম আর জিনিয়াস এডিটিং নিয়ে জনে জনে কথা হতে থাকে বেশ। বিশেষত আমি যে কবিতাবলি নির্বাচন করে থাকি, দেখি তার হেয়ার-স্টাইল থেকে জুতার কালার অবধি কে কত আপডেট হতে পেরেছে। অতঃপর তাদের অগ্রজ কবিতার প্রভাব কিংবা সান্ধ্যকালীন পরকীয়া বিষয়ে দীর্ঘায়ু খোঁজখবর করে মুদ্রণে পাঠিয়ে থাকি। আর যারা যারা আমাকে চুতিয়া বানচোত কিংবা মাগিখোর বলে যে কোনো আড্ডায় বসে গালাগাল করে থাকে, খুঁজে দেখি তারাও তো পাঠিয়েছে কিছু সুন্দর কবিতা। আর দেখি করুণ আকুতি কিছু : তাদের সদ্য মুদ্রিত বইয়ের পাঠসূত্রাবলি অথবা ব্যাপকই পরিচিতি যেন তুলে ধরি এই বয়সী পাতায়। তবে ভেবে দেখি, এইসব অজ্ঞাতে গালাগাল আর তাদের মনের ভাষাটা কিংবা কবিতাই ধরো-- কখনোই একাত্ম নয় মোটে। কেউ আবার জিনিয়াস বলে আমাকে যে গালিই দিয়ে থাকে-- তা-ও আমার অজানা নয় আর। তাদের কবিতাবলি আরও কিছু বুঝেসুঝে ছাপি এই প্রবীণ কাগজে। আর ভাবি, চুতিয়া বানচোত কিংবা জিনিয়াস কিছু হওয়ার গভীরে যে মাহাত্ম্য থাকে, কবি হওয়ার গভীরে সেই মাহাত্ম্য খুব বেশি থাকে কিনা



বংশের বাতি

তোমার বাদুড়-স্বভাব দিনগুলো আখের জঙ্গলের নিচে ঘুমাতে দেখে ফিরে এলো আমাদের আত্মীয়-বেড়াল। আমরা যার কথামতো কখনো ধূমপান কিংবা যে কোনো বদভ্যাস থেকে এ যাবত বিরত থেকেছি, তিনি একদা ঐ বিড়াল-বংশের হয়ে আজো ধরে আছেন এই বংশের বাতি। তার ক’টিমাত্র গোফ, সাদা চুল কখনো খাবার প্লেটে উড়ে এলে, আর কখনো তা অসাবধানে যারা যারা খেয়ে ফেলেছিল বংশের মানুষ, তারা আজ কেবলই তো স্মৃতি। এই মহাত্মা বেড়ালের চোখে তোমার যে দিনগুলি না হয় ঘুমাতে যেয়ে ধরা পড়ে গেল, তার কিছু পূর্বাপর ভেবে চিকন চিন্তার রেখা ফুটে ওঠে বেড়ালের চোখে
তোমাদের বংশের বলে যারা যারা নাম কিনেছিল খুব, কোনো কোনো রাতে তারা এই বেড়ালের চোখে নিশ্চিত জ্বলে উঠেছিল। আর তোমার বাদুড়-স্বভাব দিনগুলো হাজার বছরের এক প্রাচীন বয়সের রেখা বেড়ালের চোখেমুখে উজ্জ্বল করে তোলে






জাতিসংঘ

গণনাকৃত হাত তার বিষয় কোড ভুলে
পড়ে আছে নিথর পাথরে
মানুষের ব্যবহৃত প্রত্যঙ্গের কোনো
জাতিসংঘ থাকে না তাই
দীর্ঘকাল অনির্দেশ ব্যবস্থাপত্রে আজ
দুরারোগ্য তিনি

যে কোনো প্রত্যঙ্গ হতে মানুষের
দীর্ঘ দূরত্বের কথা প্রচারিত হলে
নিতান্ত বদলাতে পারে হাত-পায়ের
জীবন-প্রণালী
আর সব পরিত্যক্ত হাত
ব্যাকুল বিশ্রাম ছেড়ে ফিরে পেত
প্রকৃত বিপ্লবের ভাষা

তবু আজকাল যতটা না
বিপ্লবী হাত-পা আছে
সে মতো একজনও নেই
বিপ্লবী হৃদয়
যারা জাতিসংঘ ও
মানুষের অধিকার বিষয়ে
এদিক-ওদিক নিতান্ত সোচ্চার





একরাত্রির ট্রেন

পাথর বসাও কিছু একরাতের ভালোবাসা ঘিরে। হিংসাটুকু থাক। আনো প্রবাল, মুক্তো বা সাপের মাথার মণি। তুমি চাও থেমে যাক ট্রেন। এই অরণ্য বনানী তাকে ঘিরে চলুক উৎসব। আর যার একমাত্র মানবী তুমি। ভ্রমণের একটিই দীর্ঘ রাত। তুমি তার নাগপাশ ছেঁড়ো। দুই হাতে ধরো, প্রত্যুষায়, ঘুমজর্জর সূর্যচূড়ামণি। আর ভররাত শুধু সহ্য করো তাকে। মুখোমুখি আগুন উঠেছে ফুঁসে, তাকে দাও টাওয়েলের ভার, তরল সাবান, সিঁড়ি, বাথরুম-- এই সব সুনির্দেশ করো। পাহাড় থেকে নেমে আসা ধারা, পৃথিবীর হিংসাকাতর জ্বরে ভররাত ব্যবহার করো। হিংসাটুকু থাক। পূর্বাপর ঋতুবদলের হাওয়া

একরাত্রির ট্রেন এবার প্রবাল কুড়াতে চলো












বর্ষার সম্ভাব্য আকরে

বোঝা গেল, আমাদের ভবিষ্যৎ আকরে বর্ষার কদম্বের কাঁটায় রক্তাক্ত হবে না আর একজনও প্রেমিক। বা কোনো খোলা চুলের মেয়ে ভাঙা ঘাট পারাপারের কালে, যদি ভিজে ওঠে আঁচলের তলে-- তুমুল বর্ষণে, আর কোনো খরস্রোতা মেঘ, এই নিয়ে মেতে ওঠে পৃথিবীতে সম্ভাব্য শ্রাবণে; এই সমতলে ভেসে আসা অজস্র নগর-পর্যটক, তাদের আগামী ভ্রমণের দিনে ফিরে পাবে নব নব পলিমাটির দেশ, যা তাকে হাজার রাতের সোনার কাঠি, রুপার কাঠি বদল করে অজস্র স্বপ্নের ভেতর মেঘমর্মর শৈশব সেচে তুলে এনে দেবো। কিশোরীর নাকফুল খুলে তার হাতে তুলে দেবো কলমিফুল, লাল শাপলার বঙ্কিম নোলক; দুই বেণী চুলে জলডুমুরের মালা।... পোনামাছ পানাফুল ডলে ডলে যে অজস্র যন্ত্রের ডানা আমাদের সম্ভাব্য আকরের পাতায় মুদ্রিত বলে জানি; বর্ষার নিতান্ত ফোঁটায় গাঁয়ে গাঁয়ে রক্তাক্ত প্রেমিক, অথৈ সিন্ধুর পিঠে ভ্রামণিক সভ্যতা জুড়ে তুলে দেবে তারা, প্লাবনে প্লাবনে আজো লাঙলের স্মৃতি





প্রতিদ্বন্দ্বী

দেখছো যে শ্যামলা মেয়েটি, আমাদের পুকুর ঘাটলায় শুয়ে কিছুটা জল আর শীতের রৌদ্র খেয়ে এখন গর্ভবতী আছে। আর তার মায়ের কাছ থেকে আসা সাবধানপত্রে বলা হয়, আবার বছর পেরিয়ে আসা শীতে কলঙ্কিনী মেয়েটির মুখ আর দেখবেন না তিনি। পোড়ামুখী মেয়েটি তবু বৃদ্ধ মায়ের জন্য প্রার্থনায় বসে পুনর্বার গর্ভবতী হয়। এবার মা তার উর্বরা মেয়েটিকে একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবে নিজের তলপেট ছুঁয়ে বিভোরে ঘুমিয়ে যায়। উভয়ের সন্তানেরা পরস্পর মা মা ডেকে ভারি করে তোলে রাতের পৃথিবী

আকাশে তারারা ফোটে। তলপেটের ঔজ্জ্বল্য পেয়ে আকাশের তারকামালা খুব দ্রুত আলোকিত হয়



সূর্যাস্তের বাড়ি

মেঘের মিহি নীল আস্তর থেকে দেখা যায় সূর্যাস্তের বাড়ি। শনবাতার ছাউনির নিচে সূর্যাস্ত নিশ্চিন্ত ঘুমায়। ফুলের বাগান থেকে যে সকল সাপের শিশুরা এইমাত্র ভূমিষ্ঠ হলো-- তারা ভাবে, এমনই অন্ধকার বুঝি দৃশ্যত নতুন পৃথিবী। আর যখন শীত নিবৃতির কালে গাছে গাছে ছড়ানো আগুনের রক্তিমা থেকে বুঝে নিল প্রথম নিশ্বাস-- ভেবে দেখে আর আর কী কী তাদের পড়ে আছে আপাত স্পর্শবিহীন, অদূর আড়ালে। একটি লাল টিমটিমে ভূগোলের নিচে শ্রমক্লান্ত সূর্যালোক ছায়ায় আবৃত হয়ে নিশ্চিন্ত আছে। মানুষের ব্যবহারে ছেঁড়াখোঁড়া সূর্যালোক ধুলোময় পড়ে থাকে পথে পথে বিরান শহরে। তারই কিছু রসিকতা শনবাতার ঘরে শুয়ে যদিও নিশ্চিন্ত ঘুমায়, শাপের শিশুরা জানে, কতকাল ধরে এইমতো রসিকতা কেবল দেখেছে পৃথিবী




নানান প্রকার মানে

বহুক্ষণ উড়তে পারার মানে এই নয়-- শঙ্খচিল, সাদাবক
গৃহপোষা পারাবতগুলো বহুদূর নির্বাসিত হওয়া

হয় এ-তো হয়, অজস্র পঙ্ক্তির ভেতর, যে
দগ্ধনীল স্রোতস্বিনী বয়ে চলে গেল
তাতে øান করে বহুদূর ভেসে গেছে কেউ

তোমার ঋতুরঙ চকচকে ত্বক ধুয়েমুছে দেখ
অজস্র ভ্রমণের কিছু ইতিহাসরেখা
ভেসে ওঠে তাতে

প্রজাপতি পাখা পেলে অভাবিত দিকচিহ্ন আঁকা--
জানো, এ-সত্য জানো-- পৃথিবীতে ভালোবাসা
শাশ্বত ভ্রমণের ভেতর
হঠাৎই অদৃশ্য হওয়া



পলায়ন

যদি আলো থেকে মুখ তুলতে
সামনে সজনেগাছ, কচুরিপানার জল
ছোট্ট জলধারা ধরে পালিয়ে যাওয়া মাছগুলো
তোমাকে দেখাতাম

আর তা পারিনি তাই
জলপড়া রৌদ্রের পাশে, বসে বসে
তোমার মুখ তুলে তাকাবার রীতি
এই গভীর আলোর নহর থেকে
কিঞ্চিতই নির্মাণ করেছি

আজো আছি ঘুমে, আছি--
মেঘমুক্ত দিনগুলো এই করে কাটাতে শিখেছি
খরতপ্ত বাণিজ্য নগরে তুমি
থরে থরে সাজিয়ে বসো বৃষ্টির ঝুরি
স্বপ্ন বা দুঃস্বপ্নে তাতে সামান্য ভিজেছি

সেবাব্রত পাখি, কখনো পালিয়ে গেলে
বাতাস তবু নড়ে


বিনয় মজুমদার

দুঃখ করো না বিনয়দা
চোখ থাকলে তার ব্যবহার
সর্বত্র চলে না
দেখো কোনো কোনো চাকা
ঘোরামাত্রই স্থবির পড়ে থাকে
দেশলাই কিংবা ব্রোথেলের গিরিখাত জ্বেলে
এ সত্য জেনেছো জানি

তবু কথা থাকে
যে কথা সর্বত্র ফলে না

দুঃখ করো না বিনয়দা
আমাদের মরে যাবার ফাঁকগুলো
ক্রমশ জাজ্বল্য হলেও
অভাব্য গোপনে গোপনে
তুমি তাকে খুন করে ফেলো




পাহাড়ে ভ্রমণের পরে

অবিশ্বাস্য দিনগুলি সুউচ্চ পাহাড় থেকে
ফিকেরঙ হয়ে ফিরে আসে
গোধূলিবেলায়

পাহাড়ে ভ্রমণের মতো নিরাপদ আনন্দ
অনেকে পেয়েছে জানি

কখনো মেঘের কোমর ধরে
চাঁদের গ্রীবায় চড়ে
ক্রোড়পত্র লেখা হয় দীর্ঘ ভ্রমণের পরে

আমার প্রীতিমুগ্ধ দিন আলোকোজ্জ্বল রাত্রি হতে
ফিরে এলে গোধূলি বেলায়
আলোকের অতীব কাছে, তোমাকে কী ভাবা হবে
তাই ভেবে সময় গড়িয়ে যায়





অরুণ মিত্রের গদ্য-কবিতা

অরুণ মিত্রের কাব্যকথা ঘরভর্তি নক্ষত্রের রঙে আলোকিত হয়। বিশেষত, কোনো কবির মৃত্যুর পরে যেভাবে রঙচঙে হয়ে সত্য-মিথ্যায় বিবৃত হন দীর্ঘ দীর্ঘ কাল, আমাদের অরুণ-দা তার কতটুকু হলেন বা না হলেন, তার চেয়ে বড় কথা, তার চমৎকার গদ্য-কবিতার ভেতর যে সকল বিপন্ন পৃথিবী শাশ্বত অন্ধকার গিলে ফুলেফেঁপে লাশ হয়ে যায়, তার কিছু দুঃখিত পঙ্ক্তির মতো রোগে-শোকে কাৎ হয়ে পড়ে থাকে পৃথিবীতে অগণ্য জীবন। আর তার গদ্যের সাবলীল বর্ণগুলো মাঝে মাঝে শিং তুলে দাঁড়িয়ে গেলে, মেঘগুলো উড়ে যায় নিজ-জন্মগ্রামে। কতিপয় ছান্দসিক এই দৃশ্য দেখে নিয়ে কোনো কোনো গবেষণাগারে বাংলা কবিতা আর অরুণ মিত্রের কিছু কাব্য-পদ্ধতি তালিকাভুক্ত করে কিছুকাল হলো নির্ঘুমই আছেন




ক্রমশ জাতিসংঘ

ধানক্ষেতের পাশে জাতিসংঘের সদর দফতর দেখে
আকাশ থেকে নেমে আসছে শত শত উর্দিপরা কাক

এমন দর্শনীয় তীর্থকে এভাবে আবিষ্কার করে
সম্মানে ভূষিত হয় কতিপয় শ্রমিক-কৃষক

আমাদের ছোট্ট এক নদী, ছোট্ট এক ধারা
জলধারা বয়ে গেলে ফি-বর্ষের মৌসুমি হাওয়ায়
ধানক্ষেত সেজেগুঁজে
জোছনা গুলিয়ে রাখে সবুজ পাতায়

আজ রাতে জোছনার প্রবৃত্তি কিছু উড়ে গেল
জাতিসংঘ নির্দেশিত কাকের কর্কশে
আর ধানক্ষেত পাথুরে বৃষ্টির তলে
ক্রমেই বিস্মৃত হয় জলের প্রবাহধারা

কাকের কর্কশ জুড়ে গেঁথে গেলে কোকিলের
স্নিগ্ধ কুহু রব
ঘাসজমি গিলে খায় ব্যবহৃত ধাতব খোসা


নির্জনতা

নির্জন ঘর থেকে বাতাস গড়িয়ে পড়ে
ভেসে গেল সমস্ত সংসার
নারী-শিশু, বয়োবৃদ্ধ-- ওপড়ানো উদ্ভিদের মতো
কাত হয়ে পড়ে রইল
চারদিকে অযোগ্য আবাসে

অদূরের বনভূমি নির্জনতা পাঠিয়েছে
আশ্রমের সুরম্য আয়াসে

হে প্রিয় আশ্রমবাসী, যদি তীর্থে যাও
সূর্যালোক ফাঁকি দিয়ে দুই হাতে তুলে নিও
আদি-অন্ত নির্জনতাটুকু

যেহেতু প্রার্থনাকালে
প্রথমত নির্জনতাই জরুরি ভীষণ



প্রস্থান

যখন আমি থাকব না, প্রতিদিন
কতবার তুমি দেখবে আমার মুখ?

যেমন প্রজাপতি, একবার মাত্র উড়ে গেলে
একবার মাত্র নড়ে কি গাছের অনন্ত পাতা?
নাকি উড়ে উড়ে, অজস্র চিত্রের ভেতর
ঘুরেফিরে আসে রঙিন প্রজাপতি

এখন বৃষ্টির ভেতর পৃথিবীর সকল বৃক্ষ
অনাবিল নড়ে
আর কিছু বর্ষণের প্রচ্ছদ ছিঁড়ে
উড়ে যাওয়া প্রজাপতিগুলো
নিরন্তর কেঁদে যায় গোপনে গোপনে!




বাবার পাশে, শিশুটির নিজের শরীর

নিদ্রামগ্ন শিশুটি শুয়ে আছে
তার বাবার দেয়া শয়নভঙ্গি উপেক্ষা করে
তার ক্ষুদ্রতম হাত কিংবা নিঃশ্বাসের আসাযাওয়াগুলো
সারাঘর পইপই করে খুঁজে দেখে তার
নিজের শরীর

শিশুটির শরীর থেকে যেসব জন্মকালীন উপসর্গ
ধাত্রীগণ তুলে নিয়ে গেছে
তারা কেউ কেউ ঘরময় পায়চারি করে
পৃথিবীকে জব্দ করে রাখে

বাবা বলেন--
ভবিষ্য পৃথিবীটা বিশ্বস্ত আগুনের মতো স্নিগ্ধ
আর তাই শরীরের উত্তাপ জেনে
ভ্রাম্যমাণ উপসর্গরাশি
মাতৃক্রোড় পিতৃক্রোড় ফাঁকি দিয়ে
শিশুটিকে ছুড়ে দেয় নিরাপদ আগুনের লালে

মুহূর্ত উত্তাপ বুঝে শিশুটির মনে পড়ে
সে তার বাবার শরীরের পাশে চুপচাপ শুয়ে আছে
নিজের শরীরের হয়ে



ওপারের কথা

চুপ করে ভাবো, সমুদ্রের ওপারে কী আছে
তার আগে, হাতের কররেখা গুনে
সফল বা অসফল জীবনের
লক্ষ্য করো চুরি

জ্যোতির্ময় জলরেখা যে কোনো বর্ষায় দেখো
পারাপারে এলোমেলো চলে
বাতাসের হৃৎপিণ্ডে সুমসাম কান পেতে যদি
লেখা হয় ভবিষ্য বর্ষা রচনা
শস্যের নিতান্ত শাপে
ভেসে যায় তবু কৃষকের গূঢ় সম্ভাবনা

স্মৃতিরক্তমদে কেউ কেউ এমনও তো ভাবো
সমুদ্রের প্রারম্ভে যা ছিল--
কাল কিংবা আজ সমূহ সঙ্কেত শুনে
কতটা দূরত্বে রাখো
সমুদ্রের ভাইয়েদের, মায়েদের জীবন!



বাংলাদেশ

ধান-শালিখের দেশ
কয়েকটি ঋতুর সংঘর্ষকালে
ফেঁসে গেছে অনড় মামলায়

এদিক ওদিক প্লাবনের ধারায়
আমরা নিয়েছি বর্ষার দায়

যারা ফলমূল খেলো, শাকসবজি কিংবা
সাদা মেঘে নিজেকে ঝুলিয়ে নিয়ে বেড়ালো ঘুরে
তারা কেউ প্রতিপক্ষ নয়

ধান-শালিখের দেশ
ষড়ঋতুর সংঘর্ষকালে বিবাহিত হলো
সারা দেশে ফসল জন্মেছে খুব




স্বভাব

প্রিয় স্বভাব ছেড়ে যিনি চলে গেলেন
আমরা রয়ে গেলাম তার স্বভাবের কিছু
স্বাভাবিকতা হয়ে

উজ্জ্বল আকাশে তারাদের স্মৃতিকেন্দ্রগুলো
কতগুলো বেলুনের মতো নির্ভার, আর বেলুন
ক্ষণিকের গুমোট বাতাসের মতো দুঃসহ

তিনি বললেন, মনে করো
এ মতো স্বভাবের হয়ে এইসব প্রিয়তাই তার
থেকে যেত স্বভাবে স্বভাবে
কিংবা, যা কিছু স্বভাবতাড়িত
যেমন-- আমরা ও বিস্তৃত নিথর সামগ্রী
মূলত এইসবই তার
প্রিয়তর স্বভাবের মধ্যে
কতিপয় কিছু



নিঃসঙ্গতা

নিঃসঙ্গতা বাড়ির দক্ষিণ ঘরে শুয়ে বসে
আজ বিবৃতি দেবে আকাশে, নক্ষত্র সমীপে--

নেমন্তন্ন পেয়ে গেলে
অন্তত পৃথিবী জুড়ে প্রত্যাখ্যাত হয়ে
সলজ্জই ছেড়ে দেবে বাড়ির দক্ষিণ আঙিনা

নিঃসঙ্গতা-- কখনো পুকুরের নামে
উঠোনের নামে
নদীদের নামে
বারবার আশ্রিত হয়ে বাড়ির একমাত্র প্রভুর
পরমাত্মীয় সে
যদি বলি : তারাদের ঘরবাড়িগুলো নিতান্ত মানিয়ে গেলে
কখনো কি থেকে যাবে
ও-মতো অনন্ত উঁচুতে?
আমার উত্তরে সবুজ, পশ্চিমে কালো
অথবা গভীর অরণ্যই বলো
দু’হাতে আঁকড়ে ধরে এই এক নিঃসঙ্গতা




দৃশ্য অদৃশ্য মতান্তর

হ্রদের কিনারে কিছু তালগাছ আজকাল নেই। শহরের রাজবাড়িটিতো আজকাল চোখেই পড়ে না। আমরা তা সকলে জানি। অথচ হ্রদের অদূরে বসে দৃশ্যত ঘটনা-সকল কেবলই রাজকীয় মনে হয়। যেমন, তোমরা যাকে হর্সরেস বলো, আর যা হ্রদের সমীপে প্রত্যহ নিবেদন করা হয়, একবার ঐ ঘোড়াটিকে নাম ধরে ডেকে উঠি বলে তার রাজকীয় বিদ্রোহ কিছু স্বভাবত প্রদর্শন করে বসে। আর একদিন এই সব ঘোড়ার আগেই নিজেকে পৌঁছাবো বলে নিয়মিত দৌড়ঝাপ একপ্রকার অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গেল। এই মতো অভ্যাসকালে একদিন দেখি রাজার সেপাহী এসে চোখঅন্ধ বুটজুতো পায়ে ধরে নিয়ে গেল কালো হিম অজ্ঞাত ঘরে। সেই থেকে বুঝি-- দৃশ্যমান পৃথিবীতে আজও কিছু অদৃশ্য সত্যের কাছে বার বার হেরে যেতে হয়




অভ্যাস

একদিন আমার অভ্যাসগুলো পরাজিত কুকুরের মতো
লেজ নেড়ে নেড়ে
তারপর গুটিয়ে নিল মৃত্যুর ভেতর

তোমরা ভাবছো, আমি কেন রান্নার ভেতর
বিশুদ্ধ জল কিংবা প্রসিদ্ধ মসলাগুলো
একদমই পছন্দ করি না

একদিন আমার শরীর থেকে সমস্ত কৃমিগুলো
বের করে দেখি
সকলে তারা আমার শরীরের কিছু উচ্ছিষ্ট খেতে
প্রায়শই অনিহা করে থাকে

আমি পুনর্বার তাদের শরীরের দিকে
ফিরে যেতে বলে
যতটা নিশ্চিন্ত থাকি
ব্যক্তিগত সুপ্রিয় আচার বিষয়ে
ততটা নিশ্চিত হতে কখনো পারি না

শতবর্ষী বৃক্ষ নাকি পৃথিবীতে
অজস্র দুঃখের স্মারক
অথচ অভ্যাসবশত
আজকাল বৃক্ষের ছায়ায়
দুঃখেরা নিতান্ত ভেড়ে না




অর্ধেক জীবন

আকাশ পাতাল বৃষ্টি হলে নিজের ঘর সামলে নিয়ে যে কোনো পিচ্ছিল পথে ছুটে যেতে পারি। আর আমার পেছন থেকে এ-মতো বর্ষার দিনে চমৎকার সূর্যোদয় দেখা যায় বলে যে নানান ঘোষণা এসেছে, কিংবা তার ক্রীড়নক হলে আমার যা অনিবার্য হারাতে হতে পারে, তা দিয়েই সামলানো যায় যে কোনো প্রাচীন সংসার; কিংবা গাছ যদি হই, এ মতো বৃষ্টির দিনে খুব বেশি নেয়ে উঠি অঘোর বর্ষায়, আর আমার ওপর থেকে অনর্গল বর্ষিত হয় থৈ থৈ রৌদ্রের তুমুল ধারাবিবরণী, আর তার নটরাজ হলে যা আমার যথার্থই প্রাপ্য বলে ধরা যেতে পারে-- বিবর্ণ অর্ধেক জীবন তা দিয়েই কাটানো তো যায় প্রিয় পৃথিবীতে



পাখির চোখে চোখ রেখে

পাখির চোখে চোখ রেখে
আকাশ ভ্রমণের কথা ভাবছো
অথচ পাখি তার খরকুটোর নিতান্ত বাসায়
গহীন অরণ্যের ভেতর
গড়ে তোলে সমস্ত সংসার

আর ভাবো পালকের দৈর্ঘ্যরে দিকে
ঝুঁকে পড়ে সূর্যের শরীর
তোমাকে উষ্ণতা দেবে মহাপৃথিবীর রোদ

অথচ বনশিকারীর মেয়ে
দাবানল ঠোঁটে করে
জ্বেলে দেয় অরণ্যের সুখের মর্মর

পাখির চোখে চোখ রেখে
বিস্তৃত হাওড়ের কথা ভাবো
ব্যাপক বর্ষায় কিংবা অভাব্য খরতায় তারা
কতটা যাযাবর হয়ে যায়



ব্যবধান

মাত্র সামান্য ব্যত্যয় হলেই পুরুষের হাতেও পরানো যেত ডজন ডজন নানা ধাতুর চুড়ি-- এই সব বুঝেছি আমি। তা’বলে এমন নয় যে, পুরুষেরা নিতান্তই বর্জন করেছে চুরি কিংবা এ জাতীয় শখের সামগ্রী। আমি যখন ঘর থেকে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ি, দেখা হলে, বাবাকে সালাম দিয়ে, আর-হাতে ঢেকে রাখি বাঁ-হাতের শখের চুড়িটি। কথা হলো, আমরা যখন বাজার থেকে গরুর কাঁচা মাংস নিয়ে ঘরে ফিরে যাই, গাভী বা ষাঁড়ের কথা না ভেবেই দেখো, নারী পুরুষ দুইয়ে মিলে গপ গপ সেই মাংস খাই; অথচ পোশাক বা সাজগোজের ধরন বিষয়ে নারীপুরুষ ভেদাভেদ সহজে ঘোচাতে পারি না




পৃথিবীতে ক্ষুধার্ত বালক

আকাশ ফেটে গড়ানো বৃষ্টি
কখনো জুতোর তলায় মেপে নেয়া যায়
একদিন লাল আপেলের রোদে যেটুকু উষ্ণতা ছিল
মেপে নিতে চেয়েছিল ক্ষুধার্ত বালক

কেউ তার মুখের দুর্গন্ধ আর শরীরের অন্ধকার জুড়ে
যেটুকু দূরত্ব ছিল, কখনো ঘোচাতে আসেনি--

আজ আবার বিস্তৃত হলো ধূসর কালো মেঘ
তবু বৃষ্টি হলো না

নক্ষত্রের অভিমান হলো
চন্দ্রভুক পৃথিবীটা কালো রোদ মুড়ি দিয়ে
ঠিক ঠিক ফিরে গেল ভোরের দরজায়



ইতিহাসের সাদাত্বক

নিগূঢ় সত্য হতে আড়ালের সাদাত্বক
কখনো খোলেনি ইতিহাস
হতে পারে, একটি পরিত্যক্ত বাদামের খোসাই
পৃথিবীতে সমস্ত সত্যের আধার, অথবা
একটিমাত্র শাশ্বত পদ্যের
অগভীর স্পেসগুলোই
পৃথিবীতে তাবৎ রহস্যের ঘন
যা কেবল ইতিহাস জানে

প্রতিদিন ঘুম ভেঙে অভাবিত সত্যের
মুখোমুখি হই
উড়ে-যাওয়া পাখির পালক ধরে, ঝুলে-পড়ে দেখি
আকাশের শূন্যতা হতে বায়বীয় সত্যগুলো
আপাত নিরাপদ কিনা
তবু ভুল করে থাকি
আমাদের ভুলগুলো পৃথিবী ও সত্যের
ঠিক মাঝামাঝি থাকে চিরকাল



কদিন অরণ্য সড়কে

সুশোভন বেশবাস ধরে এই পথে থেকে যায় কেউ

এবার ভাল্লুক এসে
তার কিছু সমাচার জেনে নেবে
স্বর ভেঙে চেয়ে দেখি
আমাকেও ডাকা হলো এই পথে বিচরণকালে
আমি কি জানি?
আমিও ভাল্লুক ভীষণ ভালোবাসি বলে
বাজারের থলেটাকে তার কাঁধে তুলে দিয়ে
পাশ ধরে হাঁটি

মানুষ কি আসে ভাই, সুমসাম এ অরণ্য সড়কে?
চাঁদ ওঠে ঝিঁঝিঁ ডাকে
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে সিংহের ডাকে

মানুষ কী ভালোবাসে তালগোল পাকিয়ে গেল আজ

বুনোফুল পাখিডাকা সাপেদের খোলস পাল্টানো আজ
সরাসরি চোখে পড়ে গেল

মানুষ কী ভালোবাসে-- একদিন জানা যাবে
প্রাচীন নগরের এক ভাল্লুক থেকে



ক্লান্ত বাক্য

আমার কিছু বিষণ্ন কথা ওরা
যদি গাছের কাছে বলি
অম্নি গুটিয়ে নেবে ডালপালা
লতাগুল্ম, কুড়ি
আর আগুনের কাছে অবিকল ব্যবহৃত এই
ক্লান্ত বাক্যের কাছে, বোঝা গেল--
আগুনের মা যেভাবে গর্ভবতী হয়ে চিৎকার জুড়েছিল
ঐ মতো শোনা যাবে
দীর্ঘসূত্র মর্মঘাতী বাণী
আর এই কথা কখনো যে মানুষের কাছে ব্যক্ত হতে পারে
আমার সদ্যকৃত এই পরিকল্পনা
তোমার কাছে খুলে বলতেই--
-তুমি গাছ হয়ে দাঁড়িয়ে গেলে আমার মুখোমুখি
-তুমি আগুন হয়ে দাঁড়িয়ে গেলে আমার মুখোমুখি
আর একদিন অন্ধকারে দেশলাই জ্বেলে
আমাদের রাষ্ট্রীয় ইশতেহার হতে
নিরপেক্ষ রীতিগুলি জ্বালিয়ে দিয়ে
তুমি আমার কথা শুনতে চেয়েছিলে




পরদিন পাণ্ডুর চাঁদ

ধাতব মূর্তির কিছু নিভৃত সংলাপ নিয়ে
ধ্যানমগ্ন আছো পৃথিবীর ধর্মগ্রন্থে
মানুষের মতো তোমার আচরণগুলো
চুরি হয়ে যায় আপাত করুণাকণায়

এ মতো সিদ্ধান্ত তোমার
কখনো নির্দিষ্ট ছিল না জানি
তবু ভোরের গোলাপের মতো
সুদীর্ঘ জীবনেও তোমার জানা হলো
দৈব মন্ত্রাবলি

যে কোনো নক্ষত্রহীন রাতে
তুমি ও ধাতব সংলাপ
মুখোমুখি দেখা করেছিলে
আর তুমি হাই তুলে ঘুমুতে যাবার আগে
কী করে বিবর্ণ হয়ে রঙগুলো নীল হয়ে যায়
এই কথা বোঝা হয়ে গেল

পরদিন পাণ্ডুর চাঁদ তোমাকে শনাক্ত করেছিল







বিড়ালনৃত্য, প্রেতের মস্করা


হালখাতা

সুদীর্ঘ বর্ষায় দেখো
তোমার মাথার নিচে গজিয়েছে শামুকের চারা
তারা সব ঝুলে ঝুলে
বেবাক নিয়েছে বুঝে চুলের ব্যাপার

আমি এক মৃত নগরের শব
কাঁধে করে নিয়ে যাই পারস্য নগরে
যেতে যেতে কেউ দেখে, হালখাতা এসে গেছে
আমারও রয়েছে কিছু কারবারি দেনা

শবখানা নড়েচড়ে দেখে
পারস্য নগরে কিছু গজিয়েছে মাঠ
কেউ তার বোঝে না ব্যাপার

তোমার মাথার নিচে ছোটবড় শামুকের চারা
তারা সব প্রাচীন শহরে এসে
খুলে খুলে জলে নেমে যায়

হালখাতা এসে গেছে, এমন বিস্তৃত মাঠে
শবখানা ভাসাও ডোবাও



অভিলাষ

আমি সাহস করে একটি আপেল ছুঁতে যাবার
অভিলাষ করেছি
দীর্ঘদিন তরমুজের লালে বসবাস করে
তার বাকল কেটে নৌকো বানিয়ে
আর তরমুজের জলে সমুদ্র বানিয়ে
দীর্ঘ জলভ্রমণের শেষে
দেখা হলো এই সুউচ্চ আপেল বাগান

আমার সঙ্গে আরো অনেকে রয়েছেন, যারা
কেউ কেউ জানেন
এই সব আপেল বাগানে যারা দীর্ঘদিন বসবাস করে
স্বাস্থ্যবান-স্বাস্থ্যবতী হয়ে নির্মাণ করেছে তাদের
রৌদ্রজ্জ্বল কোমল ত্বকের সুষমা

আর এই ত্বকের রৌদ্রে যে-সকল মৌমাছি
উড়ে এসে বসে রোজ
সে-সব নিয়ে প্রচলিত নানা ইতিহাস শুনে
গাছের সুউচ্চ শাখায় ঝুলে থাকা
এই আপেল ছোঁবার অভিলাষ হলো মনে



মৃত্যু

আজ মাত্র একদিন আগেই আমি
সুদৃশ্য মৃত্যুর পোস্টার
বাতাসে ঝুলিয়ে দিয়েছি
কাল মৃত্যু আসবে
যেমন গতকাল তারা কেউ কেউ
স্নান সেরে, শেভ করে, পরিষ্কার কোটটাই পরে
বসেছিল বিয়ের পিঁড়িতে
তারা কেউ কেউ লবঙ্গ খায় পানে
ভালো প্রজনন জানে

এ-মতো প্রজননজ্ঞানে অভিভূত হয়ে
আমিও তাই বলি : পৃথিবীতে অজস্র মৃত্যুর একদিন
জীবন ফুরিয়ে গেলেও
পোস্টারে অঙ্কিত মৃত্যুই আমাকে
দেখাশোনা করে যাবে




বাড়ি বলতে

দিন বদল হয়
তার মুখে উড়ে এসে বসে অগণন মাছি
সে একটি বাসের জন্য অপেক্ষা করে
নিজেকে মাছিমুক্ত দেখার জন্য অপেক্ষা করে সে

সে তার ঐতিহ্যিক পোশাকগুলো খুলে ফেলে
নিজেকে নিরাভরণ করে

বাসের ছাদে কতগুলো মোমবাতি জ্বালিয়ে নিয়ে
ছুটে যেতে দেখে ঝড়ের গতিতে

আর যখন একের পর এক
এই রকম ঘটে সারাদিন
তার শরীরের কাদামাটি ফুঁড়ে গজিয়ে ওঠে
অগণ্য লাল সবুজের গাছ
তার ঐতিহ্যের কথা মনে হয়
সন্ধে হলে বাড়ির কথা মনে পড়ে যায়

বাড়ি বলতে তার কাছে
বাগানের পান খেয়ে মাথা ঝিম ঝিম
এক মাতাল অনুভূতির সংকলন মাত্র





চাঁদের দিকে তাকাতে ভালোবাসি

চাঁদের কাছে কিছু চেয়ো না
প্রকৃত ইলিশের যেমন স্রোতের কাছে
কোনোই প্রত্যাশা থাকে না

মানুষের দুঃখের কোনো সসীম এলাকা নেই
চাঁদের দিকে তাকাবার মতো সহজতা জানি
পৃথিবীতে সকল দুঃখের আধার

কেবল বিষাদ সঙ্গীতগুলোই পৃথিবীতে চিরকাল বেঁচে থাকে বলে
এই কথা ধরে নেয়া যায়
পতিত ইলিশের মতো আমরা সকলে
চাঁদের দিকেই তাকাতে ভালোবাসি




পরস্পর সম্বন্ধ নির্মাণে

স্নানের পর আমরা মেয়েটিকে
আপেলের সৌন্দর্যের নিচে লুকিয়ে ফেলে
বলব, আজ
চাঁদ উঠবে পশ্চিম আকাশে
এই ফাঁকে আমরা শীত ঋতুর অনুষঙ্গগুলো
সবই তার তুলে ধরব চুলে
যা আমরা আপেলের সৌন্দর্যের নিচে
চাপা দিয়ে রাখি

সূর্যাস্তের অন্ধকারে
সুস্বাদু আপেলগুলো আকাশে ওড়ে
আর আমরা সাদাত্বক মেয়েটিকে
আপেলের সৌন্দর্যের ত্বকে উড়ে যেতে দেখি

আজ চাঁদ ডুবছে পূর্ব আকাশে
আপেল ও মেয়েটির ত্বকের ঐশ্বর্যে
পরস্পর অভিমান ছাড়া
আর কোনো দূরত্ব দেখি না

পরস্পর সম্বন্ধ নির্মাণে
আপেল ও মানুষের ত্বকে
অন্তত ব্যবধান ঘোচানো জরুরি





ছুরিদের হৃদয়ের কথা

এইবার পাথর খুলে আমরা মেলে ধরব তাদের
হৃদয়ের কথাগুলি
আমাদের চালচুলো নেই, আছে
আমাদের সম্বন্ধকেন্দ্রিক খবরের কাগজভর্তি
হঠাৎ চমকানো হেডিং

তোমরা যা ভাবো আমরা তার কানাকড়ি নই
ঐসব পাথরের হৃদয়ের কথা
একবার জানা হয়ে গেলে
ঝলকানো ছুরিতে যদি শান দিয়ে বলো
আরো কত পদ্ধতি আছে
মানুষের হৃদয়ের কথা অবিকল জেনে নেয়া যায়

অন্যথা, ছুরিদের হৃদয়ের কথা
কখনো নেজেছে মানুষ
যতই রক্তাক্ত তারা হয়?




ভাবগম্ভীর নগর ও মেয়েটি

ভাবগম্ভীর নগর তার প্রতিবেশী মেয়েটির দিকে
হঠাৎ তাকিয়েছে একা বিষবড়ি খেয়ে
মেয়েটি তার চুল খুলল, দুল খুলল
খুলল নাকফুল

এক নদী দূরে হঠাৎ মিলল দেখা
জীর্ণ এক পল্লী আরোগ্যালয়
ভাবগম্ভীর নগর মুখে ফেনা উঠে মরে
মেয়েটি তার পেট টিপছে, গাল টিপছে
হাত রাখছে চুলে

এই কি প্রথম
মেয়েটি তার মনের কথা
মৃত নগরের কাছে বলে?




কুকুর-বেড়ালের মতো ধাওয়া খেয়ে

আমরা আজ এই দক্ষিণ দুয়ার দিয়ে
বেরিয়ে যাওয়া মানুষগুলোর পিছু নিয়েছি
তাদের হাতে দীর্ঘদিনের জমানো
চিঠির বাক্স
মিঠাইয়ের হাঁড়ি

যারা আমাদের দীর্ঘদিনের খবরাখবর
সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের ঋণ
লোহার সিন্ধুক ভরে রেখেছিল তালাবদ্ধ করে
এবার দক্ষিণ দুয়ার ভেঙে
তারা বেরিয়ে পড়েছে

আমাদের সমৃদ্ধ ইতিবৃত্ত নিয়ে
তাদের এই বাড়ি বদলানোর কারসাজি
কুকুর-বেড়ালের মতো ধাওয়া খেয়ে
এদিক-ওদিক আপাত গেলেও
বাড়ির চারপাশ ছেড়ে কোথাও পালাতে পারে না




বহুদিন পর হঠাৎ বটের ছায়ায়

অদূরে বাতাসের গুঞ্জন খোলা প্রান্তরে
আমরা বটগাছের শেকড় ধরে ঝুলছি
তখন রৌদ্রের প্রহর
আমরা ছায়ার ভেতর
বাতাসের ক্যানভাসে আঁকা
মৃত শিল্পীদের কলাকীর্তি জুড়ে
এঁকে দিচ্ছি বিভাজন রেখা

ধানের গন্ধ নাকে এসে লাগে
আরো কত ফসলের ঘ্রাণে
এই সমবেত ক’জন মানুষের প্রাণ
মাতোয়ারা হয়ে সুর তোলে মুখে

অথচ মানুষের প্রাণের এমন কোনো গন্ধ নেই যে
ধান-ফসলেরা মাতোয়ারা হতে পারে

এ বিষয়ক এক সম্ভাব্য প্রদর্শনীর
প্রস্তুতি চলছে শুনেছি

আমরা কিছুদিন এই নির্জন বটের ছায়ায় বসে
এ ব্যাপারে পাখিদের ধারণা বিষয়ক
কিছু ছড়া-পদ্য লিখে যাবো কি?




অসাধু বণিক বাণিজ্যিক ভবিষ্যৎ খুঁজে পেয়েছিল

আমাকে পায়নি খুঁজে সোনার মোহর খুঁজতে আসা
অসাধু বণিক
পৃথিবীতে অজস্র মাথার মূল্যে তারা এই
সোনার মোহর ক্রয়ের কথা ভেবে থাকতে পারে
আমি যখন গাছের কোটর, জঙ্গল থেকে
সোনার মোহর মাথায় করে লোকালয়ে আসি
অচল ধাতব ভেবে
বণিকেরা ঢুকেছিল গভীর অরণ্যে তখন

এতকাল যত্রতত্র বাঁশের ঝুড়িতে ছিল
সোনার মহার্ঘ মোহর
আজকাল নেই

আমাকে খুঁজতে এসে অসাধু বণিক
বাঁশের ঝুড়িতে কিছু ছিন্ন মাথা
খুঁজে পেয়েছিল



স্কুলগামী অভিভাবকগণ

স্কুল থেকে বাড়ি ফিরবার পথে
বাচ্চাদের ক’জন অভিভাবক
আমাকে কিছু প্রশ্ন করেছিল

আমি কালো আলখাল্লায় মুখ লুকিয়ে বলি :
আমি রোলকলকালে ঘুমিয়ে পড়া বাচ্চাদের
সশব্দ উপস্থিতি নিশ্চিত করে থাকি

আমাকে তারা নানা কথা বলতে বলতে
যেই তাদের শুরু হয় ডায়বেটিস প্রসঙ্গ কিংবা মেদভুঁড়ি
আমি তাদের শিশুদের কথা জোর করে ঢুকিয়ে দিই তাতে

আর বলি, আজকাল শিশুদের ডায়বেটিস বিষয়ে
মোটা মোটা বইগুলো বাজারে উঠেছে

পরদিন স্কুলগামী অভিভাবকগণ
নিজ নিজ শিশুদের মতো মন দেয় পাঠে




সত্য ও সমুদ্রের মাঝামাঝি

যারা আমাকে সত্য আর সমুদ্রের
মাঝামাঝি দেখে ফেলেছিল
আমি তাদের দিকে কয়েকটি কাগুজে টাকা
বকুল ফুল
বিলেতি খেজুর
আর গত বসন্তে প্রিয় বন্ধুকে যে
কলাপাতা-উত্তরীয় উপহার দিয়েছি
মধ্যাহ্নের রোদে তার ঝলসানো রূপ
হঠাৎ আজ পাঠিয়ে দিতে হলো

জেনেছি, বসন্ত শেষ হয়ে যাবে আজই
সমুদ্রের গর্জন বাড়ছে
জাহাজ উঠছে-নামছে দ্রুত
বালি ভিজছে, শুকোচ্ছে আর উড়ছে আকাশে
সঙ্গে তো এও উড়ছে ঝড়ে
আমার সততাই তাতে প্রভাবিত হয়

আর এতে আমার সত্য ও সমুদ্রের মাঝামাঝি থাকা
যদি প্রচারিত হয়, তখন?



বাঘের হায়ের ভেতর

বাঘের হায়ের ভেতর একটি জলাধার
তার দিকে তাকাতে যাবার মতো
ধৃষ্টতা তোমার নেই

বাঘের হায়ের ভেতর একটি সবুজ বাগান
উজ্জ্বল জলাধার থেকে
সাজিয়েছে তার সমস্ত সবুজ

তোমার নীল রঙের স্থাপত্যে
সবুজের প্রশাখাগুলো গড়িয়ে চলেছে
তোমার অনন্য পৃথিবী
বাঘের হায়ের ভেতর চিরকাল বিশ্বস্ত আছে




বধ্যভূমি

হালুম হালুম
ভূতের মুখের এমন শব্দের মানে
অনেকে বোঝে না

যেমন বধ্যভূমিতে বেয়নেটে বিকৃত
লাশের চেহারা
প্রায়শই থেকে যায় অনুদ্ধারিত

গভীরতর রাতে
পুত্রশোকে জ্ঞানশূন্য মা
ছুটে যান প্রিয় পুত্রের লাশের মিছিলে
নির্জন অন্ধকারে
তখন চারিদিকে
হালুম হালুম শুরু হয় প্রেতের মস্করা






এপিসৌড : একটি জামা

উত্তরবঙ্গে প্রচণ্ড শীতে কয়েকটি মানুষের মৃতমুখ দেখেছি আমি গণমাধ্যমে

অনেক দিনের গুঞ্জন আজ থেমে গেল। তিলে তিলে পাই-পয়সায় কেনা শীতের জামাটি একজন প্রাজ্ঞ আবহাওয়াবিদ নেড়েচেড়ে বলে, শুকোতে দেবার আগে জামাটির যত্রতত্র যথেষ্টই ছড়িয়ে ছিল মৃত্যুর উপাদান

রঙ নেই অভিলাষ নেই-- এমন মন্তব্য করে একজন সেলাইবিদ হাতে নিয়ে বলে, এ-গাঢ় মৃত্যুময় হিমে প্রথম রৌদ্রের আঁচেই আমাদের রাজনৈতিক কিংবা মানবিক প্রপাগাণ্ডাগুলো মুহূর্তে ভাসিয়ে নেবে ব্যবহৃত সমগ্র তাঁতের কারুকাজ

আজ যার মুখাগ্নির চেয়ে বড় প্রয়োজন হলো চারিদিকে নাড়ার আগুনে নির্ণেয় হিংস্র উত্তাপ, অনন্য তার নীল-কালো মুখে মাছিগুলো চুমু খেতে এসে খুইয়েছিল নিজ নিজ ডানা

কাল নেই ব্যাখ্যা নেই-- এমন মন্তব্য করে একজন সুশীল পরিবেশবিদ জামাটিকে নাড়ার আগুনে ছুঁড়ে দিয়ে বলে, প্রাকৃতিক ভারসাম্য ধারণে আমাদের যতটুকু উষ্ণতার প্রয়োজন পড়েছে তার যথেষ্টই লুক্কায়িত আছে যুগ যুগ ধরে ব্যবহৃত এই সুতার সামগ্রীতে



এপার-ওপার

আলতা পায়ে হেঁটে যাওয়া মেয়েটি
এক্কাদোক্কা খেলতে যেয়ে
পড়ে যাবার ভয় তাকে পেয়ে বসেছে

সংগ্রহের বেলুন থেকে এবার সে আকাশে
উড়িয়ে দিয়েছে কিছু
এ-কাজে যে একদমই মানাচ্ছে না তাকে
এই কথা বলেছে কেউ কেউ

কেননা তার বয়োবৃদ্ধ পিতা
চাষ করে মাছি
মাছিদের চুরি-যাওয়া ডিমে
কাদাজলে ফুটবল খেলে
প্রতিবেশী দুষ্টু বালক

আলতা পায়ে হেঁটে যাওয়া মেয়ে
এবার বেলুন ফেলে মাছিদের ডিমে মনোযোগী হলে
দুষ্টু ছেলেরা মিলে
কাদাজলে এক্কাদোক্কা খেলে
আর মনে মনে বলে--
তুমিও নদীর মতো মেয়ে
সকল দ্বিধা ঝর্ণাজলে ছুটতে দিয়েছিলে






আরোপণ

একটি হাতের ওপর আর একটি হাত আমি সহ্য করতে পারছি না

আমার সারা-গা ঘেমে তাই জানান দিচ্ছে, আর
তোমরা মোমবাতি জ্বালিয়ে ধরেছো শিয়রের কাছে
লোকটি অচেতন কি-না

তোমাদের এই মতো ভুলের প্রত্যাঘাত আমি জানি--
সে-বছর শীতে চাষের জমিতে মই দিতে গিয়ে
বিশুষ্ক মাটির ঢেলারা যেভাবে অব্যাহত
আছড়ে পড়েছে দুপায়ে আমার

আমি জানি ফসল ফলানোর আগে এই কিছু অত্যাচার
শরীরের ত্বকে সয়ে যেতে হয়
যেমন দুধ দোহানোর আগে গাভীদের ক্ষুদ্র পদাঘাত
কিংবা, ফুল তুলতে কাঁটার যন্ত্রণা

কিন্তু তোমাদের প্রত্যাদেশপ্রাপ্ত যে হাত আমার হাতের ওপর বসে
নিশ্চিন্তে খায়দায়, খেলা করে, আর রাত্রি হলে
বেঘোরে ঘুমিয়ে পড়ে হাই তুলে তুলে--
তার কিছু পরিণতি ভেবে যথার্থই উন্মাদ আমি। সুতরাং
আজ তার প্রশান্ত করস্পর্শ বেড়ালের গলায় ঘণ্টি করে
পাঠিয়ে দিয়েছি মহামান্য হিমালয় বরাবর



চোখ

ভোটযুদ্ধের দমকা বাতাসে
দেয়ালে সাঁটানো একটি নির্বাচনী পোস্টার থেকে
সুপ্রাচীন কালো চশমাটি হঠাৎই খুলে পড়ে যায়

আর সব ছড়ানো কাঁচের ভগ্নংশগুলি, যখন বৃষ্টি শুরু হয়--
না, এ চাতক নয়, মাতাল নয়--
যখন প্রচণ্ড তৃষ্ণায় লোকটি আঁজলা ভরে জলপানে উদ্যত হয়
কাঁচের ভগ্নাংশগুলি আঁজলার গভীর থেকে মাথা তুলে ওঠে

আর তাতে, যখন ওই পোস্টারের মুখটির কথা মনে পড়ে তার
ক্ষুব্ধ ও অতিশয় রাগান্বিত লোকটি
একটি নতুন ফ্রেমের চশমা বাজার থেকে কিনে এনে
সোজাসুজি সেঁটে দেন পোস্টারে অঙ্কিত প্রায়ান্ধ প্রার্থীর চোখে

আর তাতে তিনি যখন আরো ভালো করে দেখতে পান
বোকা লোকটির অদ্ভুত কারসাজি সব-- একেই মহত্ত্ব ভেবে
তিনি আর কখ্খোনো ভুলতে পারেন না এই প্রজাটির কথা

আর তাই পরদিন লোকটি দুই হাতে বৃষ্টির ধারা পানের প্রাক্কালে
তার জন্য সবিশেষ সম্মাননা হেতু, কতিপয় শীতার্ত আঙুল
তার চোখ দুটো তুলে নিয়ে যায়




তুমি শীতের নাকি গ্রীষ্মের

তোমাকে শীতের দেশ থেকে কুড়িয়ে এনেছি
তুমি, নিতান্ত জল পান করো, তাও
ক্ষুদ্রাতি ওষুধের শিশি পেলে
তোমার যা যা শারীরিক উপসর্গ আছে--
স্বাভাবিক

ধরো, নিতান্ত শীতেই তুমি জড়োসড়ো হয়ে
মা মা ডেকে চিৎকার করে ওঠো
হাসতে উদ্যত হলেই ঠকঠক করে কেঁপে ওঠে তোমার
সুমসৃণ যত দাঁত
স্বাভাবিক
তুমি সুপুরিতে খাও পান, অথচ
আহারে সবজির কথায়
শীতের অঞ্চল ভেঙে আনা হতে পারে-- ভেবে
যেন তড়িঘড়ি বমি করে ফেল তুমি
স্বাভাবিক

আর যা যা স্বভাবতই স্বাভাবিক কিছু নয়--
তুমি এই গ্রীষ্মমণ্ডলীর হাওয়ায়
সমুদ্রে শুকোতে দিয়েছো শাড়ি
খরতপ্ত রৌদ্র-সকাশে ঘনিয়ে ধরেছো তোমার
ঘামজর্জর দেহ

আর এই অতিনাগরিক উপকূলে বসে
বহুতল ভবনের যত প্রাযুক্তিক জানালা খুলে
দুই হাতে শুধু পত্র রচনা করো

সুতরাং তুমি শীতের নাকি গ্রীষ্মের
পৃথিবীতে অজস্র ঋতু পরিক্রমণের পর
আমার এই জিজ্ঞাসাও জানি
পরিত্যক্ত ওষুধের ত্বকের মতো
ক্লিশে হয়ে যাবে একদিন


নর্দমার জীবন প্রণালী

পেটিকোট পরে দাঁড়িয়ে থাকা নর্দমায়
বসে আছে আলোকোজ্জ্বল মৌমাছি
ভ্রমরের জীবন পেয়ে সুদীর্ঘ প্রতীক্ষা শেষে
তাকে দেখা গেল এই অবগাহিত আনন্দের
অবশিষ্ট জীবনে

আরো ঢের সেজেগুঁজে দাঁড়াবার কালে ভাঁগাড়ের হাড়মজ্জাগুলো
পুনর্নির্মাণের মতো ভরে ওঠে উজ্জ্বল ত্বকে, আর ত্বক
অসংখ্য লক্ষ্যের হয়ে ভরে ওঠে বর্ষার উদ্ভিদে

আজো পৃথিবীতে ত্বকের লাবণ্য বিষয়ে গবেষণাগারে
অসামান্য মানুষেরা বেড়ালের জীবন পেয়ে
ফিরে গেছে নিতান্ত আরণ্যক সন্ন্যাসে

নর্দমার জীবন প্রণালী তাই
ব্যবহৃত জীবনের মতো বিভিন্ন-বর্ণিল হলেও--
দূর থেকে ভেসে আসা রাগ-ভৈরবী মুহূর্ত দাঁড়াতে চেয়ে
বরাবর ফিরে যায় অরণ্যের রোদে



বেড়ালের দৃষ্টির মতো নির্ভীক

বেড়ালটিকে দেখে নিসপিস করে উঠছে আমার হাত
যদি তার কোমল পেলব লোমে
একবার হাত বোলাতে পারতাম!

আমি বেড়ালের দিকে এগুতে থাকি--
আর একদিক থেকে ভেসে আসে
ভয়ার্ত পাহাড় ধ্বসের গীত
আর, একদিকে পুনর্নির্মিত ভবন
পুনর্বার ধ্বসে যাওয়ার করুণ মর্মর

কোনো কোনো হাত বেড়ালের
গভীর লোমের ভেতর ডুবে যেতে দেখে
কেউ একজন চাঁদটাকে ছিঁড়ে এনে
তার পায়ে পরিয়ে দিয়েছে
নাচের ঘুঙুর

এই দৃশ্য পড়ে আছে মধ্যরাতের রাজপথে
নিরাপদ নিষিদ্ধ সড়কে
আর আমি প্রতিবার তাকে ডিঙোতে গেলে
অজস্র বেড়াল তাদের পুনর্জন্মের কিছু ব্যবস্থাদি
প্রার্থনা করে বসে

যা তাদের জ্বলজ্বলে দৃষ্টির মতো নির্ভীক



তার স্পর্শ

তার স্পর্শ আমি ভুল করে
বিছিয়ে দিয়েছি
স্যাঁতসেঁতে ভেজা মাটির ওপরে

এখনও রাত্রি আসে প্রতিদিনের মতো--
গোলাকৃতি চেহারায় লালটিপ দেখে
অনেকের মতো আমাকেও ভর করে
বিনীত দুঃখের শিরা

হলুদ পুঁজের মতো নেমে আসে
নির্ভরতার কত রাত্রিদিন
কতদিন এইভাবে দিনরাত্রি আসে

আসে, ঘাসের শরীরের মতো ক্ষুদ্রকায়
জীবনের নিমীলিত আলোর প্ররোচনা

আর সব বিবিধ ঘটনা যাপনে
একদিন গহীন অরণ্যে আমার
লেখা হলে পৃথিবীর আশ্চর্য রচনা--

বেতঝাড়, বাঁশবাগান, ডুমুরফলের ধারে
কেটে কেটে ভাগ হলো-- গোলমুখ, লালটিপ

মূলত কিছুই যার কখনো আশ্চর্য ছিল না




ভাষাহারা

আমাদের ভাষা কেউ কেড়ে নিয়ে গেছে

তবে চলো, অন্যত্র যাও চলে--
বংশের মেয়েরা যেমন
সিঁদুর মেখে চলে গেছে

তোমার চারপাশ ঘিরে বড় হচ্ছে
মোমের বাগান
এই সকল আগুনের শুভেচ্ছা
প্রার্থনা করেছিলে তুমি

গভীর অরণ্যের ভেতর হেঁটে হেঁটে
কতবার আগুন দিয়েছিলে
শুকনো মরা গাছে

ভাষার বন্ধনের মতো পৃথিবীতে
ধর্মেও নাকি অথৈ সম্বন্ধ থাকে না
এই কথা বলেছিলেন প্রিয় লেখক
হুমায়ুন আজাদ

ভাষাহার হলে পৃথিবীতে
সকল সম্পর্ক অর্থহীন
আমাদের ভাষা কেউ কেড়ে নিয়ে গেছে
যদিও জন্মত ভাষা
কখনো ভোলে না মানুষ




চুল

যে যেমন দীর্ঘ ছিল
মাথার চুলের ভারে হয়ে গেল আকাশ কুসুম

তোমার দিঘল চুলে
বহুবার উঠে গেছি দৈর্ঘ্যে তোমার
অপার মহত্ত্ব জ্ঞানে তাকে কেউ করেছে আড়াল

নদীর শরীরে নেমে যারা যারা খুঁজে পেল
ভাসমান চুল
আলো হাতে ছুটে গেল উৎসে এবার




একটি বটগাছের আত্মকাহিনী

আজ সকালেই দেখি, একটি প্রকাণ্ড বটগাছ তার
ঝুলে পড়া শেকড়গুলো ক্রমাগত ছাড়ছে আর গুটিয়ে নিচ্ছে
ছোট ছোট হায়ের ভেতর

একটি বনবেড়াল-কামুক কিংবা খরগোসের বিস্তৃত গতি
এই দৃশ্য দেখে নিতে বলে আমাকে

আমি পত্রিকা থেকে মুখ তুলে, গভীর অরণ্যের ভেতর
যতই বটগাছের দিখে ছুটে যাই
দেবদারু, পাকুড়, বাবলার মতো প্রসিদ্ধ গাছেরা বলে--
প্রথমত তোমার করণীয় হলো পড়ে ফেলা কাগজের
বাকি পৃষ্ঠাগুলি
আমি এক এক করে বাংলাদেশ ও পৃথিবীর
রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক অঞ্চলগুলো উল্টেপাল্টে দেখি--
ঐ একমাত্র বৃক্ষই, মানে, বটগাছটি তার শেকড়বাকড়
নেড়েচেড়ে উল্টেপাল্টে তছনছ করছে সমস্ত পত্রিকা

আর যে ছোটখাটো কলামগুলো, মানে, যেখানে
বটের ছায়ারা একদমই মাড়াতে পারেনি

পৃথিবীতে জ্যোৎস্নার স্নিগ্ধতাটুকু সেখানে হামলে পড়েছে




সন্দেহ

জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকা মেয়েটি আমার
পরম আত্মীয়া হন
আমি হাসপাতালে তার জন্য পথ্য নিয়ে যাই
আমাকে দেখেই আর কোনো প্রলাপ বকেন না বলে
স্বভাবত সন্দেহগুলো আমাকে গ্রেফতার করে বসে

আর সরে যেতেই, চোখগুলো ঢুকে পড়ে
জ্বরগ্রস্ত মেয়েটির উত্তপ্ত ত্বকে

আজ দেখি, পাছে দেয়া পথ্যগুলো ডাক্তার এসে
দুই হাতে তুলে নিয়ে গেছে
ফেলে গেছে নব নব বিধানাবলী--

মেয়েটি আমাকে বলে, ‘প্রণম্য চিকিৎসক : শুনে রাখি কতদিন পরে
ঠোঁটে করে শুশুষা পাঠাবে তুমি?
আনারস, থানকুনিপাতা, উসতের ঝোল
আজকাল মেলে না বুঝি?’

আমি ফ্যাল ফ্যাল করে তার দিকে এগুতে গেলে
কখনো নার্স কিংবা কখনো ডাক্তার এসে
তার উত্তাপ মেপে দেখে




আরোগ্যের মনোভূমি

একটিমাত্র স্থিত বাক্যের ভেতর লুক্কায়িত তোমার সমস্ত উপমা

ভোরের স্বচ্ছতোয়া পাতাবাহারের অজস্র বর্ণিল নক্সায় রচিত এই অনন্য শব্দমঞ্জরি
হরিণীর সিংহের আদলে কখনো বিস্তৃতি পেলেও
পৃথিবীতে অগণ্য শব্দের ভেতর নির্বাচিত কিছু সাবলীল শব্দসমষ্টি তুমি

অথবা সুরের অভাব্য বিস্তৃত ধারায়
কখনো-বা সন্ধ্যার কূজন বাঁচিয়ে চড়ে-যাওয়া
পাখিদের মিলিত কোরাসে
মধুর-মধুরতম তুমি বিরল-বিজন কণ্ঠস্বর

অথবা ধরো, পৃথিবীর তাবৎ মানবীর একক উপমা হয়ে
আকাশে উপমান একটিই গোল চাঁদ
তুমি তার প্রাগৈতিহাসিক কালের
যখন তার কুমারী সৌষ্ঠব জুড়ে পড়েনি কলঙ্কের কোনোই আঁচড়

পৃথিবীর প্রাচীনতম কবির প্রত্ন শব্দ সমাহার থেকে
সভ্যতার শেষতম কবির অযুত অযুত শব্দ সমুদ্রে অধরা গুটিকয় বর্ণের
তুমি উজ্জ্বল প্রবাহণ

গ্রহ গ্রহান্তরে ভূরি ভূরি ভাষার ঐশ্বর্যে অবগাহিত
তুমি সুলিখিত ভাষায় বর্ণিত একক বাক্যের উপমা
পৃথিবীর সমগ্র আয়ুষ্কালের একক সম্রাজ্ঞী তুমি
আকাশের বিস্তৃত পেটে অনন্তকাল ধরে ভেসে ওঠা তাবত আরোগ্যের মনোভূমি



অভাব্য খরতায়

একলা আমার সময় ফুরিয়ে এলো
এবার দুজন হবো

আমার রচনাবলী এবার জানালার পাশে
মিহিনীল পর্দার ফাঁকে ভিজে যাবে শ্রাবণের ঢলে

বৃষ্টি ও একা
আমরাই তারা, যারা যারা জীবনের অনেক গল্প করি
পরস্পর জেনে যাই দুজনের একলা ঘটনাবলি

বৃষ্টির প্রেসে উঠে ফি-সালায় জন্ম নেয়
পৃথিবীতে অজস্র নতুন কবিতা
আমরাই তারা-- একজন বৃষ্টি ও আরজন অভাব্য খরতা
প্রবল বর্ষণকালে দেখা হয় কবিতার নিঃসঙ্গ সভায়

বৃষ্টি ও একা-- এবার দুজন হলে
শালবন ভরে যাবে একাকী জীবনের কত গল্পের চারায়




নিয়ম করে হচ্ছে

নিয়ম করে হচ্ছে এত কিছু, যেমন
ঘোড়দৌড় দেখে এ কথা আন্দাজ করতে পারি
হয়তো নিয়ম করেই ওড়ে
অশ্বপুচ্ছ কিংবা ধরো এলোমেলো আকাশের ঘুড়ি

তোমার হাতে এরোপ্লেনের চাবি
ওজনের নিক্তিতে উঠে আজ আর কাল
হঠাৎ ছুটিতে আছেন বিমানসুন্দরী
ওজন ফেয়ারে রাখা এই-প্রজ মানবীকুলে অবশ্য দরকারি

আর আছেন পাইলট যিনি
নিয়ত ভেজাল ভোজনে অন্তত সপ্তাহ হলো
কলেরার জীবাণু মারেন

আছেন প্রাজ্ঞ আবহাওয়াবিদ
একদা আবির্ভূত যিনি নদীগ্রাসী চরাঞ্চল ফেলে
ফি বছর বর্ষা এলে তাই
দীর্ঘ ছুটিতে কিংবা নৌকাভ্রমণে বেরোন
নদীতে বিস্তৃত পাল তুলে

তোমার হাতে এরোপ্লেনের চাবি
টিকিট কেনা যাত্রীগুলো নিয়ম করে বৃষ্টিভেজা হয়
এমন বৃষ্টির দিনে কৈ-মাছ নিয়ম করে উঠোন জুড়ে ফলে
লোভে লোভে যাত্রীরা তো নিয়ম করেই বাড়ি ফিরে যায়!





প্রতিবিম্ব

এতকাল নির্বান্ধব ছিলে, তাই
প্রতিবিম্ব আবিষ্কারের একদিন আগেই
বলেছ ভেবে--
বিদায় নদীতীর



বিড়ালনৃত্য

অসম্ভব কিছু ঘটছে, যার চারদিকে বসে
আমরা দেখছি বিড়ালনৃত্য, প্রেতের মস্করা

আজ রাতে বেড়ালটিকে কামড়েছিল দেঁতো মৌমাছি
ফলে, তার কিছু স্বভাব-স্বকৃতি হারাতে বসেছে এই
মিউ সম্প্রদায়ের একজন
আজ তার চাই কাগজের নাও, ভূতের ফিসফিস ধ্বনি
যা তাকে রাতের গভীর থেকে
তুলে নিয়ে যাবে অবারিত স্রোতে
যা তাকে শীতের জড়তা ভেঙে
ডেকে তুলবে কতকটা ভীতির মোড়কে

বেড়াল-স্বভাব আমাদের পছন্দ নয় জানি
যেমনটা ইঁদুর স্বভাব
তবু পরস্পরবিরোধী এই প্রজাতি-সকাশে
আমাদের ভালোবাসা কিছু বেঁচে থাকতে দেখি
সেই প্রাচীন প্রাচীন কাল থেকে




বিভাজন

যারা ঊর্ণজালের ওইপাশে বসে আমাকে দেখেছে
তারা জানে, কতগুলো বিভাজন-রেখা
আমার মুখের মধ্যে বর্তমান ছিল
কিংবা সেই আদিম আমাকে
দেখে ফেলতে পারে কেউ কেউ

আর আমার বয়স যখন বাড়ছে আর
বৃদ্ধ হচ্ছে মাকড়সার জাল--
ওই পারে অনন্ত যৌবনা যারা
আমি বহুবার লাফ দিয়ে ছুঁয়ে দেখতে চেয়েছি তাদের

সুতরাং আমি মানুষ হলে
পৃথিবীতে অগণ্য মানুষের মধ্যে
এমন কিছু স্বভাব গরিমা বর্তমান আছে সত্যি

আর যতবার ওই অনন্ত যৌবনের মুখে
নির্মাণ করেছি কত বিভাজন-রেখা--
মাকড়সার শরীর ভেঙে অন্ধকার এসে
লেপটে দিয়েছে আমার ভরাট কালো চোখ

ফলে দেখি, পৃথিবীতে একমাত্র যৌবনই মৌলিক
আর সর্বত্র-ভরা বিভাজন শুধু
যেমনটা বিভাজিত আমাদের
দেখা-না-দেখার দায়



মা কি জানতেন!

দীর্ঘকাল পর আজ আমি আবার
হাসপাতালের সামনে দিয়ে যাবো

একটিও ঘুমের বড়ি সঙ্গে নাই দেখি
আজ তড়িঘড়ি ট্রাভেলব্যাগ গোছাতে গিয়ে
কতকিছু ভুল হয়ে গেল

যতবার ব্যাগ খুলে এটা ওটা দেখতে যাই
কখনো আজানের ধ্বনি, ট্রাফিকের বাঁশির হুইসেল
ব্যাগের গভীর থেকে সতর্ক করে শুধু

আজ অন্তত মাকে বলেই
এই সদর হাসপাতালের সামনে দিয়ে বেরিয়ে পড়েছি

আজ তিনিই আমাকে গুছিয়ে দিয়েছেন
আমার প্রিয় ট্রাভেলব্যাগ, এটা-ওটা

মা কি জানতেন আমি
নিয়মিত ঘুমের পিল সেবন করে থাকি!




চাঁদের আলোয় মুখ ঝলসালে

যে আমাকে দগ্ধ করে, ফালি ফালি করে
তার কথা মনে পড়তেই
কত নিঃশেষ হয়ে যাই

আর এই নিঃশেষ হওয়া মানে, বিবমিষা?

একবার চাঁদের আলোয় মুখ ঝলসালে
পৃথিবীতে অনর্গল প্রশ্নের উত্তরে
আদিঅন্ত বিবমিষা জাগে
তীব্রতর হয় অসহায়ত্বের ভার




আজকাল ওষুধের গুণে

একবার ঘুমিয়ে পড়ো
তারপর ভাবো, পৃথিবীর সবচেয়ে
সতর্ক মানুষের মতো জেগে আছো তুমি

আজকাল ওষুধের তেমন গুণাগুণ নেই
এ-কথাও ভাবতে পারো তুমি

আমি যে তোমার শিয়রে বসে
হাজার বছরের এক প্রাচীন মানুষ
ক্রমশই ছোট হয়ে আসছি বয়সে

এর প্রকৃত অর্থই জানি আরোগ্য

তোমার নামধাম আমার কখ্খোনো
ছিল না জানা
অথচ আমি প্রকৃতই বিশ্বাস করি যে
কেবলই ওষুধের গুণে
তোমার শিয়রের পাশে নিতান্ত ঠাঁই দিয়েছিলে




ভ্রমণ

আদিঅন্ত সূর্যাস্ত যদি এইখানে ঘটে রোজ
আর ওঠে বড়শিতে আমাদের
ভ্রমণের কিছু স্বাদ

আমরা এসেছি ডাঁই করা মৃত্যুর ভেতর
একবার সূর্যাস্ত হলে তার কিছু অন্ধকার মেখে

আমরা ভ্রমণের পায়ে পৃথিবীতে অবিন্যস্ত
নদনদী যত নুয়ে যেতে দেখেছি বহুবার--
আমরা এই ব্রিজের রেলিং ধরে প্রতিজ্ঞা করে
একবার সূর্যোদয় হলে
নবপরিণয়ে লিখিনি কি অজস্র কবিতা?

ধরো, আমাদের জানা নেই কোনো
অভাবিত ভ্রমণের পাঠ
আজ কেউ সহজ করেই
তার যতো ব্যাখ্যা দিতে চেয়েছে আমূল
আমাদের অভিজ্ঞতা, তাতে কিছু
ভেসেছে কি ঋণে?
আমরা ভ্রমণে এসেছি
পূর্বাপর ঘটনাবলি-- এইমাত্র মদে ও গীতে
নেশায় হয়েছে চূর




কৃষককন্যার কাব্যচর্চা

এক কৃষকের মেয়ে-- কিশোরী সে-- স্কুলে যায়-- লোকজন বলে-- প্রতিটি সকালে-- না যদি সূর্য ওঠে-- একমুঠো কাঠের আগুনে-- পৃথিবী কি আলোকিত হয়?

প্রতিবেশী আমি-- এমনই কিশোরী সে-- রাত করে ছড়া-পদ্য লেখে-- কেবলই আমাকে চেনে-- আর ভাবে মনে মনে-- একদিন তুমিও কিশোর-- প্রেমপদ্য লিখে লিখে-- ছুড়েছো আগুনে-- আমি তার পদ্য ঘেঁটে পাই-- রূপের আগুনে তার-- পতঙ্গেরা পুড়ে পুড়ে-- কত হলো ছাই-- আরো লেখে মেয়ে-- অন্যত্র তুষের আগুন-- কৃষক পিতাকে তার-- আজন্ম জ্বালিয়েছে-- তারো চে’ দ্বিগুণ-- আমি তাকে বলি-- রূপের সীমানা যদি-- খেয়ে যায় ঘুণে-- ছড়া-পদ্য লিখে মেয়ে-- তুমিও ছুড়বে আগুনে--

আমার রচনাবলি-- চারিদিকে বারুদের ঘ্রাণে-- একদিন জেনো তারা-- গড়াবে ধুলায়-- আর তুমি কৃষককন্যা-- একমুঠো কাঠের আগুন-- প্রতিদিন দেখা হবে-- তারায় তারায়






আর বিচলিত করে না

চোখের ওপর পোকামাকড় এঁদোমশা চামচিকাদের
বংশবৃদ্ধি ফেলে চলে যাচ্ছি সুস্বাস্থ্যের লোভে
আর যাদের ফেলে যাচ্ছি প্রতিবেশি তারা
হাত খুলে প্রার্থনা করছে যেন
তাদের জন্যও সুষম ব্যবস্থাদি ঠিক করে
বংশের কূল রেখে
প্রথামতো ভোটযুদ্ধে নির্বাচিত হই

আমার জন্য এইসব বিপন্ন মানুষের এত
উপচানো আবেগ আমার দুই চোখে তুলে নিতে গেলে
তারা দাঁড়িয়ে পড়ে মানববন্ধনে

আমার চোখভর্তি যে স্বাস্থ্যকর রঙিন স্বপ্নেরা
কতকাল হলো হঠাৎই জ্বলে উঠবে বলে প্রতিশ্র“ত আছে
গণমানুষের এত আবেগের কাছে
নিজেকে সে এতটুকু সে বঞ্চিত করবে না বলে দেয়





নভরহস্য

অবিশ্বাস্য পড়ে আছে মানুষের মতো দিকচিহ্নহীন
নভরহস্যের বিশাল কঙ্কাল
বহুদূর হেঁটে এসে আমাকে ক্লান্ত ভেবে
ডেকে ডেকে মৃত কঙ্কালে বসিয়ে দিয়েছে কেউ
আমি এই নভরহস্যের বন্ধুর পিঠে উঠে গিয়ে দেখি
এই পথে পথিকেরা আসে না তো ভুলে

এই হলো সেই অরণ্য অদিতি
আমি আর কাঞ্জিলালের মেয়ে
একবার বেড়াতে বেরিয়ে একে অন্যকে
কোথায় যে হারিয়ে ফেলেছি

আমাদের অগ্নিবৃত্তান্ত বলেছিল কাঞ্জিলাল
সেই থেকে আমি মুখভর্তি আগুন নিয়ে
পৃথিবীর তেত্রিশ লক্ষ শীতল দরজা
একে একে জ্বালিয়ে দিয়েছি
পতিত বিশাল শূন্য নভরহস্যের পাশে
পৌঁছেছি এই অরণ্য গভীরে

আর এই অরণ্য অদিতি জানে
একবার কোনো এক মানবীর ঔজ্জ্বল্যে পুড়ে
কী করে কঙ্কাল হলো
নভমণ্ডলের অপার রহস্যগাথা




শুভ জন্মদিন

হৃদয়ের চৌহদ্দি থেকে
বাতাস বেরিয়ে গেল
আজ তোমার শুভ জন্মদিন

বিবর্ণ ছবিটায়
ধুলোকালি উড়ে গিয়ে
কী নিবিড় মনোযোগ এলো নেমে
আজ তোমার শুভ জন্মদিন

খাতাপত্র খুঁটে খুঁটে
কিছু লেখা সম্মানিত হলো
এই লেখা কোনো কালো
পড়েনি কেউ আগে
আজ তোমার শুভ জন্মদিন



অতিবাস্তবতার শিকার শিশুটি

অধিকারবঞ্চিত শিশু কিছুক্ষণ তার নির্বাক মা-বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে মৌসুমের হাতিদৌড় দেখতে ছুটে গেল বড় রাস্তার দিকে। আর তার পেছন পেছন যে ছায়াটি দৌড়াতে দেখেছি আমি তার প্রাজ্ঞ চেহারা জুড়ে অতিবাস্তব কিছু ব্যাপার ঘটে আছে। যেমন উবু হয়ে সোনার লাঠি ভর করে দৌড়াচ্ছে এক লাল ভবনের দিকে। আর দুই কানে বসা
শান্তির পায়রা দুটি খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে তার শরীরের নুন। সে চিৎকার করে ছুটছে আর তার বুকপকেট ছিঁড়ে মণিমুক্তার মোহরগুলো অধিকারবঞ্চিত শিশুর মা-বাবার পায়ে চুপচাপ নতজানু হয়ে থেমে গেল। আর মা তৎক্ষণাৎ তা রান্নার হাঁড়িতে গচ্ছিত রাখবে বলে একটিও হাঁড়িই পেল না খুঁজে। হাতিদৌড় দেখা উজ্জ্বল আনন্দ নিয়ে শিশুটি যখনই পুনরায় তাকাতে গেল তার বাবা-মা’র কাক্সিক্ষত মুখের দিকে, তাদের একটিও অবয়ব শিশুটি দেখতে পেল না আর

কাব্যগ্রন্থ :
ঋতুভেদে, পালকের মনোবৃত্তিগুলি

ভূমিকা

ইতস্তত উড়ে যাচ্ছে কখনো তা মেঘ
সারিবদ্ধ সাদা বক চতুর গতিবেগ

ধবল ডানায় উড়িয়ে নেয়া তুচ্ছ কিছু রোদ
মেঘের কাছে ব্যয় করেছে সারাদিনের বোধ

মেঘে যেমন ক্ষয় ধরেছে ডানায় কি তার কিছু
সাদা মেঘের ফুরিয়ে গেল মেঘের পিছু পিছু?

অথবা সে ঘর করেছে ব্যাপক বিলে ঝিলে
মেঘের কি ঘর সংসার আছে ভয় করে কি ঢিলে?

সাদা মেঘের জন্মদিনে প্রবল ঢেউয়ের তোড়ে
শিকারমুখো লগ্ন ধরে একশ’ সারস ওড়ে

কখনো মেঘ বর্ষে নাকি মলিন মেঘের বুকে!
ক্রন্দসী মেঘ ঝরে বেড়ায় সাদা বকের সুখে















ক্ষণভাষ্য জুড়ে থাকে পুড়ে যাওয়া মুখ
অবিবেচ্য প্রতিদিন অসুখ অসুখ

খুলে যাচ্ছে সাদা পথ, অন্ধ পারাবত
অমীমাংস্য পড়ে থাকে ওড়ার মতামত

খরামগ্ন পোড়ো মাঠ, বিস্তৃত মাঠ জেগে
বিশেষত উপাসনা বৃষ্টিপ্রবণ মেঘে

ডুবে যাচ্ছে কালো ভ্রমর নীলপদ্মজলে
একজন একা ভেসে যাচ্ছে মন খারাপের ঢলে

ঘুমকল্প বিষণ্নতা গল্প আঁকা মুখে
স্বাস্থ্যবতী ব্যথা থাকে এ অরণ্যে সুখে

কালো চাঁদের প্রজাপতি অথৈ ওড়ার ডানা
সারা রাজ্য জুড়ে নেবার কৌশল আছে নানা

সদাহাস্য অন্ধকারে ভেসে যাচ্ছে গাঁ
কৃষ্ণ হ্রদে ঘর বেঁধেছে বিকল প্রতিভা


















সূচি

অনন্তের পথে পা ১২ স্তাবকতা ১৩ আজকাল ১৪ যৌথ বনিবনা ১৫ পৃথিবীর করুণারাশি ১৬ বৃষ্টি পড়ছে ১৭ চিঠি ১৮ ১৩ জুন, ২০০৩ ১৯ ফাঁকা ফাঁকা মন ২০ বিনম্র প্রার্থনামূলে ২১ মৃত্যু ২২ সরে যাবো, অন্ধকারে ২৩ ক্ষুদ্রতার প্রতি অবজ্ঞা ২৪ প্রতিবেশিনী ২৫ সাম্প্রতিক পৃথিবীর মতো অবিশ্বাস হতে ২৬ পাথরকন্যা ২৭ নিখোঁজ খবর ২৮ প্রতœ গৃহঘর ২৯ হৃতনদীচর ৩০ বর্ষাকালীন কবিতা ৩১ আলপথ ৩২ আলস্য ৩৩ সঙ্গীত শিল্পের সার্থকতা ৩৪ সাঁতার ৩৫ দোদুল্য বিভাজন ৩৬ অবিশ্বাস্য মৌনতা ৩৭ কাঠঠোকরার শ্রমসাধ্য ব্যাপার সম্বন্ধীয় ৩৮ ইরেজার ৩৯ এমন যদি হয় ৪০ উড়োপাতাদের কথা ৪১ পারফেক্ট ৪২ চেনা যায় না ৪৩ গতি ৪৪ পরিবর্তিত হতে দেখা যায় ৪৫ তাড়না ৪৬ উর্ধতন রূপসীরা ৪৭ মূলত দেশটাই হলো ৪৮ মৃত্যু, বৃষ্টিবিধৌত ৪৯ তুলসী-বাগান ৫০ আরোগ্যালয় ৫১ আর আমার মায়ের ঐশ্বর্য ৫২ সুপুরিবাগান ৫৩ বাগানের মেয়ে ৫৪ অসুখে আড়ালে ৫৫ আঙুর ফল ৫৬ পাখি সংক্রান্ত ৫৭ দূতাবাস ৫৮ স্বপ্ন ৫৯ বর্ষার গৌরব ৬০ অমুদ্রিত ৬১ শিহরণ ৬২ ভ্রমণ ৬৩ স্পর্শ ৬৪ ল্যাম্পপোস্টের নিচে নিস্তব্ধ পার্ক ৬৫ জেলেপাড়া ৬৬ ঈশ্বর ৬৭ বৃষ্টির জনপদ ৬৮ বলবার কথা ৬৯ স্নান ৭০ বেদনার্ত টেবিলের নিচে ফটোগ্রাফ ৭১ শুভ প্রণয় ৭২ অনেক অর্থের ভেতর, অনর্থ ৭৩ রাজ্যপাট ৭৪ গোলাপ বাগান ৭৫ ভালো থাকবার প্রার্থনা ৭৬ নিয়ন্ত্রণহীন ৭৭ ত্বকের আড়ালে ৭৮ গাছ ও আগুনে ভ্রমণ ৭৯ পরম শূন্যের ভেতর ৮০

অনন্তের পথে পা

অনন্তের পথে পা বাড়ানোর
এ এক কৌশল মাত্র
যা আমি রপ্ত করেছি এতকাল

প্রথমবার সূর্যের রং ধরে টান দিতে গিয়ে
এই কথা বুঝে ফেলি আমি

সে আমার ঈশ্বর ছিল
যখন ঠিক প্রথমবার
অনন্তের পথে বাড়িয়েছি পা

যখন ভাল্লুক পুষে
খুব আমার নামডাক হলোÑ
চাঁদের শরীরের ভেতর নাক গুঁজে
ঘ্রাণ নিতে গিয়ে
সেই আমার শুরু হলো প্রথম সর্বনাশ

আমি টের পাই। চৈত্রের চৌচির মাঠে
দাবদাহ নেমে এলে
পতঙ্গেরা পা বাড়ায়
অনন্তের অসীম যাত্রায়


স্তাবকতা

অবশ্য স্তাবকতা আর ভালো নয় বলে উত্তর দিয়েছি
উড়িয়ে দিয়েছি খোলা বাক্সের ভেতর
পরমত সহিষ্ণু অহঙ্কার থেকে সবটা!

বাতাসের সংলাপে রচিত অনুসৃতি পত্রগুলো
লতাগুল্ম অন্ধকার ঢেলে দু’হাতে মাড়িয়ে দিয়েছি

ঘন ঘন বেতসের বনে যাই
পায়ে চোরাকাঁটা।... স্খলিত মনোবৃত্তিগুলো
অন্যায্য স্তবগীতে ভরে যায়
হাত বাড়ালেই সরে যায় প্রার্থনার মানুষের মুখ

বয়সের খাকি অন্ধকার দেখে সরে যাই
যাচ্ছেতাই উড়ে উড়ে ক্রন্দসী পারাবতগুলো
যথার্থ স্তবঢলে ভেসে যায়

সুসাধ্য মনে হয় বটে
ঘাটে ঘাটে কলসীগুলো ভরে ওঠে স্তোত্রপাঠে


আজকাল

লতায় মুড়িয়ে আছে হাস্নাহেনা
এখনো গোধূলি
তার ঘ্রাণ জড়িয়ে ধরেছে ধুলো

গতকাল ভিজেছে তারা তুমুল বর্ষণে
তোমার আসবার কথা, যখন
হাস্নাহেনা এলোমেলো ফোটে, আমার
তোমাকে ভাববার কথা, যখন
হাস্নাহেনা ফোটে বা না-ফোটে, তুমি
তুমুল বর্ষণে আমাকে ভাবতে দেখেছো, আমি
বিভোর ঘ্রাণে
তোমাকে হারিয়ে ফেলেছি

আজকাল
ইলিশের মৌসুম এলে
আমি এইসব কথা ভাবি

আজকাল
প্রবীণ বটের পাতা ঝরে পড়তে দেখে
আমি তার শৈশবের কথা ভাবি



যৌথ বনিবনা

আর ডুবে গেলে তুমি ঝিনুক পাবে না খুঁজে

ঝোলা বাদুড়ের ঝাঁক পৃথিবীর নক্ষত্রের দিকে
ছুড়ে দেবে পা
অবিভাজ্য ঘৃণা

ঘোলা শরতের দিনে একাকী সূর্য পাবে না খুঁজে
অদূরেই ঢেকে যাবে মানুষে মানুষে কত হৃত আনাগোনা

জবাফুল ভেসে যাবে মৃদু মৃদু ঢেউয়ে

তোমাকে প্রসিদ্ধ করে
চোরাবালি স্রোতে
ঝিনুকেরা ভুলে যাবে যৌথ বনিবনা




পৃথিবীর করুণারাশি

কিছুটা তার বিকেলবেলার আহারের মধ্যে ডুবে যাবে

ভেসে উঠবে আসমুদ্র দীর্ঘশ্বাসের ফেনা
ভেঙে পড়বে শালবনের মেঘ
শস্যদানা খুঁটে খুঁটে খাবে সাদা পারাবত

তুমি ইতস্তত বসে বসে
দু’হাতের সংখ্যাতত্ত্বে
আমাদের পূর্বপুরুষের কথা ভাবছো
স্নান করছো
ইটে ত্বক ঘষে ঘষে
সাদা রক্ত ঝরছে
তুমি বাবলাফুল ছিঁড়ে ছিঁড়ে এনে
তার বিকেলবেলার আহারের দিকে ঠেলে দিচ্ছো

মৌমাছি ডাকছে খুব, আজ তার
বিষাদের ভেতর তুমি উল্কি আঁকছো
ঘরদোর রং করাচ্ছো-- সাদা সাদা চুন-চর্বিতে

তুমি ভেঙে পড়ছো, আকাশের ইলশেগুঁড়ি মেঘে--
বাতাসের সান্নিধ্য চাচ্ছ, গুমোট আঁধারে

আমাদের বড়ইতলা বুক উজাড় করে
ঝরাফুল নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে কাল--
বৃষ্টি আসছে, তার বেদনাগুচ্ছ
বিকেলের অন্ধকার হতে ধুয়ে যাচ্ছে দূরে
কিছুটা তার তোমার পরম কৌমার্য হতে বর্ষিত ছিল

তুমি ঘেমে উঠছো খুব
পৃথিবীর করুণারাশি মৃদু মৃদু শ্বেদকণা হয়ে ঝরছে



বৃষ্টি পড়ছে

ঐদিকে, সীতাঘাট ধরে বৃষ্টি পড়ছে
শুল্কের বাজার পড়েছে, পদ্মায়
ভালো জন্মেছে ইলিশের পোনা

ধনেশের মেয়ের সম্বন্ধটি ভালোই ঘটেছে
পলকে রটেছে বাবা
মোটা ভাত মোটা কাপড় ক’জনার জোটে আর!

পরিশ্রমী গাভীগুলো বান উজাড় করে দুধ দেয়, প্রত্যুষায়
ভরে ওঠে কাঁচা সবজির ঝুড়ি : অলক্ষ্যে--

পাড়ার স্কুলঘরে ফি-বার্ষিক সম্মেলন হলো :
শিশুদের জন্য চাই প্রস্ফুটিত গোলাপের বাগান
স্বাস্থ্যকর খেলার সামগ্রী
দীর্ঘতম মাঠ

তোমার জন্য প্রবাহিত দ্বীপান্তরের হাওয়ায়
এ খবর পৌঁছে যাবে

একটি মাত্র ইলিশের বিনিময় হলে
মিটে যাবে সমস্ত পারাপারের দেনা

তুমি ফিরে এসো




চিঠি

চিঠি আসছে কি?-- ডাকহরকরা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে একঝলক বিদ্যুৎ বর্ষে দিলেন। আমার অভিমান হয়। রাশি রাশি বর্ণমালা সদম্ভে মাত্রা ঝাঁকিয়ে বলে, মৌসুমের ছুটিছাটাগুলো এ বছর কাটাবো ভ্রমণে।... চিঠি আসছে কি? বেলপাতা, তেলাকুচো লতা, কাঁচা মরিচের ঝালে সমৃদ্ধ প্রসিদ্ধ চিঠিখানা?-- মনমরা ডাকহরকরা আলতো গালিয়ে দৃষ্টি, নিভে যাচ্ছে প্রাণান্ত আঁধারে। চিঠি কি আসে না তবে? বালিশের আবদ্ধ ওয়াড়ে ভূরি ভূরি গরল বাক্যের গরীয়সী ঋদ্ধ পত্রগুলি? চিঠি আসছে কি? মহাপ্লাবনের তোড়ে বিপন্ন ব্যাকুলতা ধরে সে যে অবশ্য পত্রমঞ্জরি! পোয়াতি ধানগাছগুলোয় শতশ্িছদ্র তরীখানা, কী কালো জলের ঘোরে করে কি মিনতি? আর এই ছিন্ন-ভেজা পত্রগুলি জলতটে ঘুলঘুলি ভরে ডুবে যাবে অপ্রাপ্য সাগরে? চিঠি কি আসে না ভুলে? যার সব ভেসে গেল প্লাবনের তোড়ে, প্রহরে-- চিঠি আসবে কি? এত যে বিরহ-ব্যাপার বানে ভেসে গেল সুদূরে




১৩ জুন, ২০০৩

উত্তর-তিরিশের দিকে হাঁটছি...
গা-গতর ঝুলে যাচ্ছে মধ্যবর্তী পাকুড়ের মতো, প্রকাশ্যে--
কয়েকটি টিংটিঙে বক মেটে পালকের নিচে
পুষে রাখে অনিবার্য মৃত্যুর প্রার্থনা
তাহাদের আসবাব থাকে, থাকে অলক্ষ্য ভ্রমণের ডানা
ওখানে জাগছে যে কোনো জন্মের দিকে ধ্র“পদ যাত্রা

প্রিয় আলিঙ্গনকৃত অবিমর্ষ অন্ধকার ছুটি
যদি পেয়ে যাবো উত্তর-তিরিশে আজ
একটি টিংটিঙে বক গাঢ় বেদনার ভেতর
উড়ে উড়ে, দেনাকৃত পৃথিবীর দিকে ছুটে যাবে

ভাড়াটে মেয়েটির হাতে পড়ে থাকে সমস্ত তিরিশের ভার
পরিবর্তিত পুরু চশমার গ্লাস, ঢোলা পাঞ্জাবি
ঝরে যাওয়া আরণ্যক কেশদাম
মহত্তম স্মৃতি...

ঘোলা জলস্রোত, যদিবা ঘুমুচ্ছে ডানা
বিকলাঙ্গ মোহনা সমীপে--
তিরিশের অশ্বত্থ পাড়ে ভেসে ওঠে সমুদ্র রচনা
এবার সমুদ্রের কথা মনে হলো
ক্ষয়িষ্ণু তিরিশে দেখো--

উল্লিখিত সমুদ্রের দিকে যাচ্ছি...




ফাঁকা ফাঁকা মন

কিছুক্ষণ ফাঁকা ফাঁকা থেকে আবার ভরে ওঠে মন
এ তোমার ছলচাতুরি, মনকে বলি--
এই সত্য জেনো, সিংহে আজও কেশর তবু নাচে...

বনবিড়ালির মতো কাউকে তো খুঁজতে আসা বনে
মানে, মনে
ভয় শুরু হলে ফাঁকা ফাঁকা লাগে খুব

ও তোমার কেশর দুলুনি রাখো বনরাজ
একা একা বনবাদাড়ে মন-ভরা কিনে
সুস্বাস্থ্যে বাড়ি ফেরা যায়। আর, বাড়ি ফেরা চাই





বিনম্র প্রার্থনামূলে

যা তাকে বিচ্ছিন্নতার দিকে নিয়ে গেল
সেদিকে পিছন ফিরে ঘুমিয়ে কেটেছে

সাদা ভাঁটফুল
সমস্ত প্রত্যক্ষ করে রাখে
আপাত দুর্লঙ্ঘ্য বলে প্রাত্যহিক সূচিতে ঢুকে
আরও দূর নিবিষ্টতায় এসেছে সে

মুখরতার এপ্রিলগুলো কে কেন বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়?
ভেঙে যায় ঔজ্জ্বল্যের চাঁদমারি!
বিনম্র প্রার্থনাগুলো অধিকন্তু ফলপ্রসূ হলে
সুশীল মৃত্তিকা হতে
শুষে নেয় আর্দ্র জলকণা!

কে কত বিচ্ছিন্ন থাকে--
বোঝা যায় :
সাধ্যাতীত অনুগত হলে

ফলাফলে




মৃত্যু

অযথা বাক্যব্যয় হতে মৃত্যু অনেক উৎকৃষ্ট বেশ্যা
ধাতব সখ্যের মতো সুনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে ছুটে যায়...
মুছে দেয়-- যথাসাধ্য ঘামক্লান্ত মানুষের পরিব্রজ রীতি
সংরক্ষিত দ্বারের গোপন ভুবনে থেকে
সহৃদয় ছোবলের বেশি প্রিয়তম বলে হাঁক দেয়

বহুঘ্রাত যোনির গহ্বর হতে কালোপক্ষের
জোছনার বেশে কৃষ্ণদাঁতে বলে, আহা কী
আদিখ্যেতা, এই নাও ভুবনের কষ্টকৃত মানুষের
লালসার ইশতেহারনামা। সুনিশ্চিত ডুবে দেখো
ব্যথা-হৃত বেদনার ক্ষত থেকে, কী ভাষায়
উগড়ে পড়ে ভেদবমি ক্রমাগত জলস্তর হতে...
অনিবার্য অবসর থাকে না-ফেরা সমুদ্রে ঘোরার
অযথা বাক্যব্যয় হতে যা কেহ কখনো পাবে না



সরে যাবো, অন্ধকারে

ঋতুভেদে আমাদের ফিরে যেতে দাও সরে-যাওয়া অন্ধকারে
বন্ধ হোক অনিবার্য হাতসাফাইয়ের ভেতর আমাদের মৃত্যু কামনা

কখনো স্নেহবন্ধনী, আমাদের মৃত্যু উপত্যকার দিকে
ঠেলে নিয়ে যাবে...
ফেলে যাওয়া হাড়গোড়, রক্তাক্ত ক্ষত
দলিত শ্যাওলার মতো ভেসে চলে যাবে অনার্য সভ্যতার ভেতর...
অসামান্য বাড়ি, ব্যবহৃত পৃথিবীপৃষ্ঠে পালানের মুথাঘাস হতে
চকচকে সোনালু পোকার সংসার সমীপে
যাবতীয় মনোযোগ পাবে
অনাত্মীয় ধবধবে ফ্যাকাশে শরীর!

অথবা ভ্রমণে--
ডানাছিন্ন কানা বক, শিকারের সন্ধ্যার বেশি
অবশিষ্ট পাবে না কিছু
মিছেমিছি রোদ স্যাঁতসেঁতে নদীতট ধরে
আমাদের মৃত্যুকে ঘিরে, ধুয়ে দেবে
ভবঘুরে মানুষের ব্যথা
অথচ কিছুই পাবে না : একদিন দানাদার মিথ্যের ভেতর
বেহায়া মৃত্যুকে ছাড়া

সরে যাবো...
সরে-যাওয়া অন্ধকার থেকে অন্যত্র কোথাও যাবো না




ক্ষুদ্রতার প্রতি অবজ্ঞা

যথেচ্ছ মৃত্যুর দিকে তাকাবো না
শীত-গ্রীষ্মের ভেতর থেকে তা খুব
নিঃশব্দে বেরিয়ে পড়তে পারে
যে কোনো পরম নির্ভরতায় ঝুলে যেতে পারে
লাউগাছের মাচায়
আমার দৃষ্টিপাত কোনো ঝুলন্ত অস্তিত্বে নয়
খোলা প্রান্তরের দিকে শস্যশূন্যতা
বা কোনো মেঘভর্তি নক্ষত্রহীন আকাশের দিকে নয়

কখনো মৃত্যুর দিকে তাকাবো না
যতটা না বৃষ্টি পতনের দিকে দু’চোখের মুগ্ধতা থাকে

অমার্জনীয় বেলীফুলের স্নিগ্ধ মুগ্ধ ঘ্রাণ
অথবা ভরা বর্ষার কদম্বের কথাই বলি--
যে কোনো ছুটির দিনে তারাদের মৃত্যু হলে
একা একা পাহাড়ের দিকে ছুটে যাই...
সুউচ্চ চূড়া হতে, কী ক্ষুদ্রই না মনে হয়
আমাকে তখন!




প্রতিবেশিনী

দেখতে দেখতে অন্ধকার। ভূগোলের সাদা মাংসের নিচে ট্রাউজার পরে প্রতিবেশিনীর মুখ মনে হয়। আরো ছিপছিপে সরু জানালার পাশে গাঢ় জঙ্গলের মতো পড়ে থাকে অধিকৃত রাত্রের পৃথিবী। আর থাকে শেষ বাজারের মৎস্য-বিক্রেতার সংরক্ষিত নীরব কোলাহল। প্রতিবেশিনীর দিকে সাত রাতের সংক্ষুব্ধ বুভুক্ষুতা হতে সে তাকে বিশ্বস্ত করে ধবধবে সাদা বেলুনের মতো উদ্ধত স্তনে রেখে সুপুরুষ সৈনিকের শিরস্ত্রাণ। রতিবৃত অন্ধকার। সে এসে অনার্য কৌমার্য হতে পুরাকৃত কলাপাঠে আদিখ্যেতা করে গেছে শতায়ু লৌহ দরজায়। আর আমার ভয় হয়, সিগারেট বাক্সের নিচে লুকানো মহার্ঘ সিগারেট শলাকার শেষে জ্বলে ওঠা দেয়াশলাইয়ের চেয়ে ঢের বেশি তাৎক্ষণিক রকমে। প্রতিবেশিনীর মুখে ব্যবহৃত শাওয়ারের শব্দে জুড়ে আসে বিধিভুক্ত ঘুম। সে ঘুমায়, সাদা ত্বক হতে সবটুকু দূরত্ব শেষে মহাপৃথিবীর দিকে হিংস্র অন্ধকার জুড়ে এলে



সাম্প্রতিক পৃথিবীর মতো অবিশ্বাস হতে

আমাকে ছুড়ে দাও নিস্তব্ধ বাতাসের দিকে
কালো ফ্রেমের মতো সন্ধ্যা, সন্ধ্যার অবিমর্ষ চাঁদ
আমাকে সাজতে দাও সাদা বৃষ্টিপাত, জোছনার পোশাকে

তুলে নাও সমস্ত প্রার্থনা-- ঘন ঝাউগাছের ছায়া
চালতা বাগানের ভেতর চালতা ফুল, ঘুমন্ত বাতাসের দিকে

আমি দেখি পাখির বন্দনা
নিঃসঙ্গ তালগাছে বাবুইয়ের ঝুলন্ত সংসার যাপন

ঘরে ফেরা সন্দিগ্ধ কুমারী, ধানভানা বধূ

নির্যাতিত প্রজা ডুবে যাবে পয়মন্ত ঘুমে

আমাকে শুশ্রুষা দাও বিকলাঙ্গ নিস্তব্ধ বাতাসে
অঢেল সোনাইল ফুলে বিগলিত ঘ্রাণে
আমার প্রার্থনা রাখো অন্ধকার দুর্বিনীত নদী
তামাটে ধীবররাজ, দুর্দান্ত গলিত মানুষ

ভেজা শরতের ঘাস, কুয়াশার্ত ক্ষেত
বিতাড়িত বেকার যুবকের মুখ, ভূমিষ্ঠ শিশুর কান্না
সাম্প্রতিক পৃথিবীর মতো অবিশ্বাস হতে
আমাকে নিষ্ক্রান্ত করো বায়ু-শূন্যতায়



পাথরকন্যা

মগ্ন পাথর ছুঁয়ে দিলেই উপাসনায় যতি
ছুঁয়ে দেবার রীতি আছে, যৎসামান্যই ক্ষতি

রীতিবদ্ধ প্রবল স্রোতে ভেসে যাচ্ছে নাও
মগ্ন পাথর অতলে তার গড়েছে এক গাঁও

সন্ধ্যা নামে গাঁয়ের মেয়ে পুঁথি-পাথর পরে
মগ্ন হবার রীতিনীতি বেঘোরে পাঠ করে

ঋজু অঙ্গ স্রোতের তোড়ে একটু যদি টলে
সারা নগর আছড়ে পড়ে গহন নদের জলে

কাড়ি কাড়ি যক্ষবিত্ত বহ্নিজলে ভাসে
ওলট-পালট সচল পাথর স্মিতমুখ হাসে

প্রতি অঙ্গ ঝলসে ওঠে মন্ত্রমুগ্ধ জলে
গহন নদের পাথরকন্যা অঙ্গ নিয়ে খেলে





নিখোঁজ খবর

যেখানে হাহুতাশ থাকে বৃষ্টি আর বাবলাগাছের ভেতর
অনার্দ্র ছোট্ট বাড়িটি থাকে একা
একা এক পক্ষিপালকের বাড়ি
থাকে, অতি এক মুখর কিশোরী
আর কিছু নয়

ঝিঙেফুল মেঘের গর্জনের আগে ঝরে যায়
বাজারের সান্নিধ্য হতে বহুদূর বেঁচে যেতে হবে
যে তামাক সেবিকা মেয়েটি, সে
বড় হবে অজ্ঞাত ঘরে
ফিরে কি যাবে পক্ষিপালকের কাছে কোনোদিন?

অথবা ফিরবে না সে
যতটা প্রয়োজন পড়েছে বহুদিন!




প্রত্ন গৃহঘর

১৭ মে, ২০০৩ ও সিকদার আমিনুল হকের চলে যাওয়া

নানা ভাঁজে বিছানা হয়। বিছানা হয় পরিপাটি ছাদে
ইতিহাসে শুকতারা কখনো কি কাঁদে?

সতত ডানার মানুষ। মানুষেরও ভেদবমি থাকে
প্রকৃত আরোগ্য হতে পথ মরে বাঁকে

জলে ভাসে জলছাপ, কাটাকুটি মানুষের রীতি
মুছে যাওয়া ঢেউগুলো ব্যবহৃত স্মৃতি

লতাগুল্ম জুড়ে আসে, বানে ভাসে ফাঁকা ধানজমি
কখনো বেহাত হলে নিলামের ভূমি

দৃশ্যত উড়ে উড়ে, শাল্মলি, অসামান্য ঝড়ে
অভিবাস ছেড়ে যায় প্রত্ন গৃহঘরে

চূড়া হতে মুছে যায়, ঝরে যায় সৌরসূর্যকণা
অসমাপ্ত পড়ে থাকে কড়ে কড় গোনা




হৃতনদীচর

উপলক্ষে ব্যবহৃত হয়ে গেছে
দৈর্ঘ্য প্রস্থ অনিন্দিত মেয়েমানুষের মুখ

শিলপাটায় ঘষে ঘষে বিদ্যুৎ প্রহৃত হয়

সোনালি সামন্ত মেয়ে
কড়ি খেলা হেরে গেছে অরুণোদয়ের আগে
কী কথায় বশে গেছে
আঁকিবুঁকি বিদ্যুতের রেখা
যাথাপ্রথা...

ঝাঁ ঝাঁ চিল ছুঁয়ে গেছে অতলান্ত ক্ষত
শত ধূপ জ্বেলে গেছে মৌ-সান্ধ্য-সভা


বর্ষাকালীন কবিতা

আকাশে চেপেছে ভয়, ফিরে যাবো, ফিরে যাওয়া অমোঘ শাসন
এ মৌসুম বৃষ্টি হবে, ঝরনা হবে, ধুয়ে দেব মন

এ মৌসুম পাহাড়ের, সানুদেশে বর্ষাকালীন বন
উচ্ছলতা ঝুঁকে আছে, লগ্নে তার অতি প্রিয় বোন

ওঠে-নামে প্রিয় মুখ, প্রিয় পথ সিন্ধু বরাবর
ঘন-লগ্ন সন্ধ্যা হলে, বলে দেবো চূড়া সমাচার

উপজীব্য ঊর্মিমালা সিন্ধু-সমুদ্দুরে
চূড়া হতেই ভর করেছি প্রিয় মানুষেরে

কাঁচা দেহের ঘ্রাণ সঁপেছি ঝরনাধারা খুঁড়ে
ভেসে যাচ্ছি মুগ্ধ ধারা পাহাড় হতে দূরে

বালুতটে গ্রহণ যখন সিন্ধু অভিসার
ফিরে যাচ্ছি, ভেসে যাচ্ছি মেঘের অনাচার








আলপথ

চিরটাকাল মাঠের আল ধরে
হাঁটার পদ্ধতি রপ্ত হয়ে আছে
আজকাল তাই
ফুটপাত ধরে হাঁটতে গেলেই
অবারিত ফসলের মাঠে
সরু এক আলের কথা মনে হয়



আলস্য

আলস্যের নাম দিয়েছি দুর্ভোগ
পৃথিবীতে আলস্য ছাড়া কখনো দুর্ভোগ আসে না
কিংবা মৃত্যু
সেও নেমে আসে আলস্যের পাখায় ভর করে
কিংবা আলস্যের নাম হলো নিশ্চিত
আনমনতা

যেমন দিগি¦দিক অলক্ষ্য হেতু যে-পাখি আলস্যের পায়ে ভর করে
চুপচাপ বসে থেকে শীতের রোদ পোহায়, আর
চতুর শিকারীর ভাষা বোঝে না সে অচেতন জ্ঞানে--
তাই তাকে পাওয়া যায়
লোভী শিকারীর ভরাট উদরে

কিংবা আলস্যের এক অনন্য নাম হলো
নিজেকে নক্ষত্র বানাবার ব্যর্থ অভিলাষ এক

আমরা যখন গভীরতর রাতে লেপের গভীরে শুয়ে হাত নেড়ে মুখ বার করে এটা ওটা বলি
তখন তারাদের উৎসব চলে রাতের আকাশ ঘিরে

আর তাতে নির্ধারিত হয়
আকাশের ভবিষ্যৎ নক্ষত্রের নাম



সঙ্গীত শিল্পের সার্থকতা

যখন সঙ্গীতের সুর চরমে তুলে
নিজেকে সে ঘোষণা করে পরম শূন্যতার ভেতর
আর শত শত মহান শ্রোতা
রাতের নিস্তব্ধ কোটরে
চোখেমুখে টের পায় শিশিরের আসিক্ত ভাষা
এই হলো সঙ্গীত জীবনের এক
অভিন্ন সার্থকতা

এই কথা জেনেছি আমি
পৃথিবীতে অগণ্য সঙ্গীতশিল্পীর স্বগত উচ্চারণে















সাঁতার

সাঁতার মুগ্ধকর শারীরিক কৌশল বিশেষ
ফড়িং বা তিতির প্রজাপতি-- আজন্ম হাওয়ায় ওড়াউড়ি

বিত্তহীন মানুষেরা অভাবের সমুদ্রে সাঁতরায়
জ্ঞানগর্ভ মনুষ্য মহলে সাঁতার এক আগন্তুক ফর্মুলা

যেভাবে পাথরেরা, কখনও সাঁতার প্রসঙ্গে ভাবে না






দোদুল্য বিভাজন

আমার যাবার কথাকে তার দৈনন্দিন ইশতেহার থেকে
তুলে নেব
আর থেকে যাবো এই মাটির ঘড়াকে নিয়ে, তার
শরীরের বিষণœ আল্পনালতা, গেছোসাপ, ঢোল-খঞ্জনি...
অবিশ্বাস্য সাফছুতরের ব্যস্ততা নিয়ে

তার জন্য দুঃখের দিনগুলি না হয় বর্ণময় ছিল
ছিল হাঙরের পেটে পাওয়া
সোনার চামচে তার নৈশ ভোজন
তার জন্য সংবর্ধনা ঠোঁটে করে যারা
উড়ে এসেছিল, ঝুলেছিল
সুউচ্চ টাওয়ারের ছাদে
অনর্থে ঠোঁট লাল করে বলেছে কি, এবার
নমিত যাত্রা?

দোদুল্য বিভাজন ফেলে যদি চলে যাবো
খুনসুটি, বাউকুড়ানির হাওয়া...
তাকে যে ইশতেহার হতে ভ্রমণের গল্পগুলি
খুঁজে দেয়া হলো
বলা হলো অবশ্য বিদায়
তাকে এই শূন্য ঘড়াকে নিয়ে বেঁচে যেতে হবে একা?




অবিশ্বাস্য মৌনতা

ফেলে দিচ্ছ আর হাভাতের মতো
তুলে দিচ্ছ তোমার ক্ষুধাকে

অনবদ্য মৌনতার দিকে তোমার চক্রাকার ছায়া
অত্যুজ্জ্বল মুখ
অবিশ্বাস্য হাসি...

শুধু ফেলে দিচ্ছ পৃথিবীতে অমোঘ উপাদেয় যা
দুধভাত
সামুদ্রিক লবণের কণা
আর
ঢ্যাঙা মোরগের মতো তুলে দিচ্ছ তোমার ক্ষুধাকে

অগত্যা তোমার ছায়াকে ঘিরে, বিনয় দা
সম্ভাব্য ঢাকা ভ্রমণের কথা ভাবছেন







কাঠঠোকরার শ্রমসাধ্য ব্যাপার সম্বন্ধীয়

মিস সন্ধ্যার কাছে আমার লাল ঠোঁট জোড়া পড়ে আছে
প্রত্যহ বিদ্যুৎ প্রভায় শানানো বটে
তা আজও রথেই থেকে গেল

কাঠঠোকরার শ্রমসাধ্য ব্যাপার সম্বন্ধীয় আমার বসবাস
বিদ্যুৎ চমকালো, অন্ধকার ক্ষয়ে যেতে যেতে
হাতুড়ি ও পলিশ কৌটা কেউ আমার হাতে তুলে দেয়

যথেচ্ছই ভাবি, বাসাবাড়ি গোছানোর মতো
যা যতো অপরির্হ্যা
এ আমার নিমীলিত চোখ কেবল তা দেখতে চলেছে

মিস সন্ধ্যা প্রত্যহ কিছু অন্ধকার ভেঙে খান খান করে দেয়
অগত্যা জোড়া দিতে দিতে নেমে পড়ে ঘুমের প্রহর
তার ঠোঁট দুটো জমে যেতে যেতে
কী করুণ লাল হয়ে যায়
যা বীভৎস

আর আমার ভাষ্য হলো
প্রিয় ঠোঁট দুটো তার কাছে জমা রাখবার মতো সুখের




ইরেজার

প্রকাশ্য অভ্যাসগুলো উড়ে উড়ে
দৃশ্যত কোথাও চলে যায়...
মুছে যায়, ভাঙা হরফের লেখায়
প্রাচীন গ্রন্থ সকলি

প্রিয় রাজহাঁস জলের সান্নিধ্য ছেড়ে উঠে এলে
ভেজা পালকের শোকে
মুছে যায় আত্ম-জল-কলা

মৃত মেঘগুলো ছায়ার প্রপঞ্চ নিয়ে
দৃঢ় আবাসনগুলো রচে যায় যদি সুদূরে
কোনো ভোলানাথ, তীরের সৌন্দর্য আঁকে
মুছে যাওয়া রোদে





এমন যদি হয়

স্কুলঘর পেরিয়ে গেলে ঘটিবাটির দোকান। চুন-সুপারি আদা-লবঙ্গের দোকান। অভিজাত মেয়েদের শাড়ি-ব্লাউজের বিপণি আর পাশাপাশি আশটেল ডাল নিয়ে বসে গেছে দাঁত ব্রাশ করার নানা পদ্ধতি। অগত্যা আমার ক্লাস-শিক্ষকের অনুমতি পেতে দেরি হলো বলে সন্ধ্যা নামে নামে, বিপণিতে হাবা মেয়েগুলো ঘেমে যেতে দেখি। যারা যারা নেশা করে থাকে লবঙ্গ ও পানে, ঘটিবাটি সাজিয়ে তারা বিজ্ঞাপনের নিমপাতা ঘষে দাঁত সাফ করে। কারো কারো রুটিনকর্মে রাত হয়ে গেলে স্কুলঘরে থেকে যেতে হয়। আমার ক্লাস-শিক্ষকের লালচোখ দুটো : কেউ কিছু মনেই করে না? এমন যদি হয়-- আমার দুটো ঘটিবাটি চুন-সুপারি রুটি-বেলুন চাই!





উড়োপাতাদের কথা

কেউ তোমাকে শুনিয়ে থাকবে উড়োপাতাদের কথা
হাটের মজলিশ ঘরে এ নিয়ে তো বাকবিতণ্ডা হয়--
এত ধুলোঝড় পাতা ওড়াবার ক্রমপরম্পরাগত

পাতা ঝরে যায়--
নানা ভাবনায় বিদ্যাভবনের ক্লাসে
গবেষণাগারে শিশু বসে বসে, পাতা ছেনে ছেনে
মনে মনে ভাবে, আকালের পাতা...
চলো বনে যাই, পাতাদের নিবিড় বেদনা কিছু
ঝরে যায় নাকি আশরীর হতে!





পারফেক্ট

না হয় কিছু ধার-দেনা আর ঋণ-কর্জ কথা না রাখা আ রেসপেক্টেবল বেশ তো তাই ঘুম ভাঙলেই এক চিলতে মহার্ঘ হাসি খট খট খট বুট জুতো পায়ে সকাল ন’টায় অফিস বাসে দু’টাকা কম লাগসই কথা রাজনীতি যায় দেশ চলে গেল ভাঁগাড়ে রে ভাই তাই যত কথা এবার দেখুন খবরের পরে দূরদর্শনে পুরো প্রোগ্রামে স্যালাইন গেলা আর শেষাশেষি গজলসন্ধ্যায় ঐতিহ্য চাই দেশীয় মোড়কে খাঁটি আমেজই... প্রোগ্রাম শোনেন... থাক না হে ভাই প্রতি রোববার উঁচু উঁচু পাছা কচকচে নোটে পিএস অথবা বান্ধবী সমেত প্রমোদ ভ্রমণে আপনিই তো ভাই পারফেক্ট গ্রেশাস



চেনা যায় না

তোমাকে ঠিক কতটাই চেনা হলো যে লাল স্রোত বয়ে চলে গেল উদ্ভ্রান্ত কালো কেশদাম ধরে ঝরে পড়ে গেল ইথারে-শিশিরে তোমাকে তো ঠিক চেনাই গেল না কখন কে তুমি শাড়ি ও কামিজে ভোরের আকাশে তুলো তুলো মেঘ শপিং সরণির প্রিয় রাজবধূ খোলা চুলগুলো এলানো বাতাসে কত দূর যাবে তুলে আনা মুখ ভণিতা জেনেছে দু আনায় কেনা লাল টিপগুলো কবে-বা পরেছো মনেই পড়ে না কী যে ভ্রম হয় চেনাই চলে না উড়ো দিনগুলো ধুলোবালিঝড়ে হায় খুনসুটি শিক্ষিত হলে আদুল পোশাকে আর কত দূর এ বেলায় বুঝি সঙ্গ পাবো না কখ্খনো না একমাথা চুল দুটি ভাগ করে মেলে ধরেছিলে সিঁদুর ভাসাতে কতকাল হলো মনেই পড়ে না





গতি

যারা বসে আছে, তাদের পথ দূরতিক্রম্য
সুরম্য টাওয়ারের দিকে মিশে গেছে--
বসে বসে মৃত পাতা গুনে কেটে গেছে ঘুমের প্রহর
যেখানে অরণ্যের দেশ, সমুদ্র উঠেছে জেগে
প্রাচীরে। হায় মরীচিকা!-- এই বসে-থাকাদের
সুশীল দাম্পত্য ঘরে তোমার অত্যুজ্জ্বল বনিবনা!

যারা উঠে গেছে, বর্ষা-ফলকের মতো
বিঁধে গেছে প্রকাণ্ড বৃক্ষের মেদে; যারা
ছুটে যেতে চায় আহত ঘোড়াটির চেয়ে সবেগে




পরিবর্তিত হতে দেখা যায়

কেন তার বকুলবাগানে এত সময় পড়ে থাকে!
নিমপাতার দিকে তাকানো যাচ্ছে না বহু দিন
সে নিম ভালোবাসতো বলে প্রসিদ্ধি পেল
সুঠাম, গজালো দুটি হাত
আর, বড্ড চোখ দুটি

সে নতুন হতে চলল বুঝি বকুল বাগানে
তাকে নতুন সময়ের ভেতর পরিবর্তিত হতে
অনেকে দ্যাখে
নিমের তিক্ততা ভালো নয়
যদ্যপি সে ফুলের ঘ্রাণ নিতে শিখেছে

















তাড়না

তৎক্ষণাৎ একটি ফুটবল তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। ইশারায়। উদগ্র বিবমিষায়। যে কোনো অরণ্যের ভাপ মধ্য দুপুরে তাকে জ্বরাক্রান্ত করে। সদ্য নবিসী এক স্বাস্থ্য-সচেতন পুরুষ ফুটবলাক্রান্ত হয়ে তোমাদের ঢোঁড়া সাপের পল্বলের দিকে নামছে। ব্যবহার্য চিমনির ভেতর সামান্য অগ্নিচূড়াকে জেনেছে সে, যে কোনো আলোক সম্পাতের উৎস-স্বরূপ। যে কোনো উৎসই তাকে তাড়িত করে : যথা-- ফুটবল। ফুটবল আজন্মই অস্থিরতাময় এক গতির উৎস।... পৃথিবী এক প্রপঞ্চই বলা যায়। অথবা নিশ্চিতই এক নির্দিষ্ট গতিময় গ্রহ। অন্যথা যে কোনো আলোকচিত্রে পৃথিবী তো অসামান্য ফুটবলপ্রমাণ। যা কিছু ঝরছে, উড়ছে : রবিশস্য, সোনালুপোকা-- উৎসে এক যথাযোগ্য ফুটবলের কথা বলা যায়। ভেসে যাওয়া, সাঁতার কাটা; খানাখন্দ বা সমুদ্রই বলো-- জ্বরাক্রান্ত তাড়িত মানুষ, কে যে ঠিক কোন দিকে যায়!





উর্ধতন রূপসীরা

মৃত প্রচুর্যের মতো মহাজগতের উর্ধতন রূপসীরা
যথেচ্ছ ভালোবেসে থাকে ভাগাড়ের গোপন প্রান্তর--
আদিখ্যেতা পড়ে থাকে কালো কালো মাংসের নিচে
সদাব্যস্ত উদগ্র অর্থ-মুদ্রায়
বৈভবের রাজঘোড়া রূপসীর ঢিপ ঢিপ বুকে
অবিশ্বাস্য মেলে ধরে লাগামের রীতি

বিকলাঙ্গ সভ্যতা কবোষ্ণ চুম্বন পেয়ে
মিসরীয় বালুভূমি অনাবৃত ফেলে গেছে
পুরাকাল হতে
আজও তার রৌদ্র হতে, মমীকৃত মেয়েগুলো
সংগোপন পুষে রাখে অকৃপণ জাজ্বল্য গরিমা--

মৃত পৃথিবীর মতো সদ্য ধোয়া রূপসীরা
প্রিয় কবিতার মতো মুদ্রিত থাকে হৃদ্যতায়



মূলত দেশটাই হলো

মাটির গোলোকে তোমার প্রিয় দেশটাকে দেখো তো খুঁজে! বোঝা চাই যেখানে উঁইঢিবি ছিল, ঠা ঠা দুপুরের দিকে মনে হতো, আর কালো জঙ্গলের দিকে ছুটে যেতাম-- বুনো বিষণ্ন সন্ধ্যায়। মূলত দেশটাই হলো সমস্ত রকমে এক, কখনো-বা উঁচু-নিচু জলাজঙ্গলের ভেতর বহমান নদী... ঢ্যাপ কিংবা মলা-খলসের অজস্র অনাদি পুকুর... আশৈশব স্কুল ফাঁকি... নোই খেলেখুলে সময় ফুরোনো... পাকা দাঁত তুলে ইঁদুরের গর্ত হতে প্রার্থিত চকচকে দাঁত... সংক্ষুব্ধ বাতাসে বাঁশঝাড়ের মর্মরতায় রাত্রিভর উঠোনে মাদুরে ঘুমানো... চরকিকাটা চাঁদে মুখোমুখি বিশ্বস্ত চেয়ে থাকা। দৈত্যপুরীর সোনার কলস, রুপার পালঙ্ক...

বোঝো কি, দেশটাই হলো জ্বাল দেয়া ইলিশের ঝোলে সদ্য ভোরে পেট পুরে মজানো পান্তা

বোঝো না বোঝো, এ-খ্যাত মাটির গোলকে তোমার, পুরো দেশটাই হলো গোটাদুই আবালের জোড়া, লাঙলের গুটি ধরে অনাদি ধাই ধাই... ধেই ধেই...




মৃত্যু, বৃষ্টিবিধৌত

সার্বক্ষণিক পাঠের কবি সিকদার আমিনুল হক

বাতিগুলো জ্বলছে সবুজ। আর অপেক্ষা করো
সমাধিস্থ মৃতদের দিকে কারা আসছে
ঝুলন্ত আঙুর বাগানে পেড়ে খাবে সমস্ত আঙুর

যে মানুষ মরে যায় বিদ্যুৎপ্রভাময়
তার জন্য বিস্তৃত উদ্যান পড়ে থাকে
থাকে টংঘর, সবুজ ফরাসী আলো
অভিন্ন বৃষ্টি আসে রোজ, প্রসারিত মেঘের ডালপালা
ধুয়ে দেয় আঙুরগুচ্ছ, বেদনার্ত মুখ





তুলসী-বাগান

বৃষ্টি-প্লাবনের দিন শেষ হয়ে যাক
আর শীতবস্ত্র থাক ঠাণ্ডা আর বিশুষ্ক বাতাসে
বুঝি তুলসী-পাতায় যা কিছু পরোক্ষ হয়
এ ততো ঔষধি নয় গৌণ--

ক্ষত শুকাবার দিন শেষ হয়ে যাক
দু’হাতে তুলসী-বাগান তুলে আনো







আরোগ্যালয়

যে কোনো আরোগ্যের জন্য তাকে নিবেদন করা হলো
অভাব্যই খুলে দেয়া হলো কত ঝাউবন
সুউচ্চ মরিচ বনের ছায়া

যারা যারা আমাদের মেঘলা দিনের
পতিত আখরোট নিয়ে বসে গেছে
আমাদের সম্বন্ধগুলো বেচে দিয়ে গেছে
মহাজনী ভাঁড়ে
একাকী ঔদ্ধত্য নিয়ে অনর্থই ফিরে গেছে তারা
নাগরিক চিকিৎসাগারে





আর আমার মায়ের ঐশ্বর্য

কিছুই থাকবে না আর অবশিষ্ট বলে
পাড়ার কিশোরী মেয়ের গোপন শরমের মতো
বিস্তৃত হবে আমাদের বুক

আলো নিভে যাবে, কালো মহিষেরা
জলের অতলে পাবে কবোষ্ণ আরাম

সাঁকো ভেঙে যাবে, দ্বিধাহত পথিকেরা
বাতাসের মুগ্ধতা নিয়ে ভেঙে দেবে জলের গরিমা

যে তুমি ঘোমটা টেনেছো, শরতের জোনাকিরা
রাতের আড়ালে বসে ছুঁয়ে দেবে প্রকৃত গোপন

সাদা দুধভাত, ওলানের সান্নিধ্য ছেড়ে
তুলে নেবে তুলতুলে শিশুটির গাল
ঘরের যুবতী বধূর অথৈ লাবণ্য-কণা

আহত শস্যের ফড়িং, ডানার ঔদ্ধত্য-ভারে
গেয়ে যাবে বাংলার আবহ-গীতি
বলে দেবে, শস্যের সুষম ভাষা

উড়ে যাবে সাদা পারাবত, আর আমার
মায়ের ঐশ্বর্য পাবে
স্নেহশীলা পৃথিবীর যে কোনো অরণ্য-প্রহরে




সুপুরিবাগান

সুপুরিবাগানে বসে দাঁত ব্রাশ করে ঘরে ফিরে আসি। আজ এই সুপুরিবাগান আমাদের প্রচ্ছন্ন আশ্র্র্রয়; কেননা তার প্রচণ্ড ধৈর্যক্ষমতা সুপুরি খাবার দীর্ঘক্ষণ পরও আমাদের দাঁত সাফ করবার শক্তি যোগায়। এ রকম দীর্ঘক্ষণ ধৈর্যধারণকে আমাদের ঠুনকো সব সংসারের টিকে থাকবার আশ্রয় না বলে উপায় আছে! কেউ কেউ সুপুরি বাগানে গেলে উত্থিত শিকড়গুচ্ছে হাত দেয়; আমি বলি : যারা যারা বাগানে হাঁটো, তোমাদের বিগত দিনের মেদবহুল শরীরের কথা মাঝেসাঝে ভেবে দেখো তো




বাগানের মেয়ে

বাগানের মেয়েটিকে হাত ধরে নিয়ে যেতে চাই
দরদামে বনে গেলে, আমি ভাবি, এমন অরণ্যের মালিক কে না হতে চায়
আর এই মেয়ে শর্তহীন, নিতান্ত আমার। কেননা একাকী আকাশে
জগতের পক্ষিণীকুলে ও ছিল একমাত্র মাতা; আর আমি
পৃথিবীর পক্ষিরাজ্যের যদ্যপি একান্ত পিতা--
সুতরাং কী এমন কথা হতে পারে আমাদের সাম্রাজ্য ঘিরে!
ইতিহাসে নিরঙ্কুশ সৌন্দর্যের ভাষা কেবল অরণ্যে ফলেছে...
আর এই অরণ্যচারী, যে শুধু ধবল বিধবা রূপসী
তাকে এই বাঁওড়ের পারে, অরণ্যের কুমারীভোরে--
কেউ আর খুঁজো নাকো ভুলে




অসুখে আড়ালে

একা ঐ সবুজ বসন্তের দিকে আমার যেতে ইচ্ছে হলো। তালপাতার সহোদর মেয়েটির কথা মনে পড়ল আজ। তিনি এক গণিকাকন্যা, সাইকোসিস বংশোদ্ভূত ইশতেহার হতে আমি তার প্রেমে পড়ে যাই। ডাল-ভাত, রুটি-গোশ্ত, ছেঁড়া বেলুনের মতো ব্যবহারিক ঘড়িটির দিকে ব্যাপক মনোযোগ নিয়ে সবুজ ঐ বসন্তের দিকে চলে যেতে পারি। সুপুরিবাগান হতে যুবতীর কটিদেশ ভ্রমে আমি সবন্তের দিকে উত্তুঙ্গ ওঠাবো আমার বেয়াড়া শাসন। আমি বলে দেব, দুরারোগ্য যুবতীরা খাঁ-পাড়ার ডাকঘর-ঝিলে বিবসন ধুয়ে চলে গেছে যে যেমন অধীত যৌবন। কারো কারো সবুজাভ টিপ, মসলিনে আবৃত স্তন-- অভাব্যই ঝুলে ঝুলে আছে প্রতিশ্র“ত সবুজ বসন্ত দিনে। প্রহৃত রক্তাক্ত মাঠ। আমি চলে যাবো, যে কোনো গণিকার জন্য ব্যবহৃত অসুখে আড়ালে



আঙুর ফল

সে আসে এই বিভীষিকাময় রাত্রে
আমি তার আঙুর ফল কোমল পেলব হাতে নেড়েচেড়ে বলি :
শালাদের চৌদ্দ জন্মে
আঙুর দেখে নাই নাকি কেউ!



পাখি সংক্রান্ত

আরেকবার বিস্ফোরণে বলে দিতে পারি--
এই পাখি রৌদ্রে ও স্নানে, কেন সে বারবার বলে খাঁচা বদলের কথা
এইবার বসন্ত এলো দেশে। তাকে এই মুখর সঙ্গীতকালে
পলায়নরত, গ্লানিময় হতে হলো। দূরের সমুদ্রের পারে
ঝিনুকের শঙ্খের স্বরে সঁপে যেতে হলো আকণ্ঠ সঙ্গীত সমূল

তোমাকে বললাম বলে, এ এক অনৈচ্ছিক প্রবন্ধে রচিত হয়ে গেল
আর আমার শৈশবের বিদ্যায়তনে
এই সবই পঠিত হবে বহু বহু কাল



দূতাবাস

উৎসর্গ : পৃথিবীতে ছড়ানো ছিটানো সকল মার্কিন দূতাবাস

একটি দূতাবাস গিয়ে বসে আছে মগডালে
তার রক্তের ভেতর প্রবাহিত বিষাক্ত আরাম

পৃথিবীতে অজস্র কুকুর
প্রতিটি নেড়ে কুকুরের শিশ্নের মাথায় আমি তাকে পড়ে যেতে দেখি



স্বপ্ন

আমার এক স্বপ্নের কথা মনে আছে। অহেতু বাজারে গেলে
যে-সকল ফসলের সাথে কথা বলে বলে হেঁটে চলে যাই--
আমি ভাবি, বড় হয়ে সম্বন্ধ নষ্ট হলে
কোনো কোনো পক্ষ থাকে
বাজারের বাহারি ঝুড়িতে বসে, এই স্বরে কথা বলে কি-না

আমার এক স্বপ্নের সাথে, ফসলের স্নিগ্ধতাগুলো
অতিদূর প্রবাসে বসে, মুগ্ধতায়-- বিস্মৃত হয়ে গেল




বর্ষার গৌরব

বর্ষার লিখন তার লেখা হয়ে গেছে

শুধু এ বেলায়, কেউ তাকে জানিয়ে দেবে--
আসন্ন পত্রমঞ্জরি, যা ঝরে পড়ে গেছে গত শীতে
পূর্ববৎ বৃষ্টি-প্লাবনে তাই ছিল মহিমান্বিত

যা ছিল সঙ্গীতে স্নিগ্ধ, হাওড়ের আবদ্ধ সলিলে--
পদ্মপাতার দিকে আরাধ্য মনোযোগ ঝুঁকে ছিল--
সমস্ত সৌন্দর্য ছিল ঘন বর্ষণে--
এ বছর অবশ্য প্লাবনে তা তাকে প্রসিদ্ধি এনে দেবে

সাদা পারাবতগুলো উড়ে যাবে। সামান্য স্নিগ্ধ বর্ষণে
নুয়ে যাবে লজ্জাবতী লতা, ভাজা ইলিশের ঘ্রাণে
ভুলে যাবে প্রপঞ্চ-মানুষ-- ভেদাভেদ অনিন্দ্য সংঘাত

বর্ষার লিখন তার লেখা হয়ে গেছে
ক্ষেতখামারেই নিভে আছে সমস্ত গৌরব






অমুদ্রিত

মেঘ-মহল্লার মেয়েটিকে শাদা কাশফুল বনে বাড়ি ফিরে যেতে দেখা যায়। সে তার বাবার শরীরে ভর ভর করে করে মানুষের প্রজননজ্ঞানে বর্ণিত ছিল বহুকাল। একদা সন্তানের জননী সে : এই কথা জানা গেছে ঢের পরে। অথচ বান্ধবকুলে ঐশ্বরিক জ্ঞানবতী এই, স্রোতের উচ্ছ্বাসে ভেসে পাঠ নেয়।... আজন্ম নদীকে অধ্যয়ন করে পারের কাশফুল বনে কদাচিৎ মেয়েদের ত্বকে ফুটে ওঠে বর্ণনার নিজস্ব ভাষা।... এ জাতীয় জ্ঞানের গুহামুখ থেকে মানুষের জানবার ভাষা চিরদিন গোপনে গোপনে অলিখিত থেকে যায়।... ঢেউয়ে ঢেউয়ে মূর্ছিত বৈকালিক ছেলেগুলো প্রাথমিক যৌনতার ভাষা নিষিদ্ধ করে রাখে।... মা জানেন নিতান্ত সঙ্গমের রাতে পৃথিবীতে প্রাক-যুবকেরা অন্ধকার বিদ্যায়তনে অঘোষিত জ্ঞান লাভ করে। অথচ সাংসারিক সন্তরনে সন্তানের প্রজননজ্ঞানে বরাবর সাবধান হতে দেখা যায়...


শিহরণ

মৃদু শিহরণ জাগে ভোরে। আলস্যের উৎসসমূহে ঘুম নাকি
একধিপত্যবিস্তারী। নিদ্রাতুর মানুষেরা
তাহাদের দুঃস্বপ্নের ভেতর শিহরিত হয়
প্রত্যহ ঊষাকাল ভরে জগতের ফুলগুলো মৃদু বাতাসের সাথে
ঝরে যায়। সুতরাং শিহরণ মানে ভোর...

চারদিকের পুকুরের জলে অসংখ্য আবাদ চলেছে বহুদিন
মাথামোটা কাতলেরা, সাবলীল খেয়েদেয়ে প্রত্যুষায়
আমাদের ঘুমের প্রাক্কালে, সমুদ্রের দিকে ছুটে যায়...

শরীরে আলস্য ঘনায় ভোরে। আমাদের প্রজনন ক্রিয়ায়
রাত্রির প্রয়োজন অধিক, অথবা প্রতিপালনের কালে, নিদ্রিত সন্তানেরা
প্রাকৃতিক সম্পাদনায় রাত্রিকেও যোগ্যতর ভেবে থাকে। সুতরাং
যে কোনো স্বপ্নের জন্য প্রত্যুষাই শ্রেয়তর বলে
ঘরে ঘরে ঘুম নেমে আসে!

অতি শিহরণ জাগে ভোরে :
আমাদের ঘুমের প্রাক্কালে জগতের ফুলগুলো ঝরে যায় বলে



ভ্রমণ

সাদা হাঁস বাতাসে ভাসছে। ভ্রমণের দিনগুলো
অতিশয় জোছনার রঙে তাহাদের প্রার্থনা করে
শীতার্ত অনুভূতিগুলো অজস্র জলাধার হয়ে ভেসে গেছে উদ্ভিদের দেশে
গ্রামান্তের মেয়েগুলো বৈকালিক ভ্রমণের কালে
উপনীত শহরের কাছে ফিরে যেতে চায়। আর এই যথাযোগ্য দিনে
ফিরে পাওয়া স্মৃতিগুলো ফেলে রেখে গেছো পথে
অথবা রেলভ্রমণের আগে অসংখ্য মালিদের কাছে
তোমার এক স্বপ্নের কথা বিস্মৃত হয়ে গেছে

শালিখের আঁচড়ের ভেতর বিক্ষত চরাচর।... ধনাঢ্য বণিকেরা
জাহাজের নোঙরের কালে, অর্থময় ভ্রমণের ভেতর ভেসে চলে যায় সুদূরে
আরো দূরে সাদা হাঁস জলজ ভ্রমণের দিকে ছুটে যায়। আর তুমি
øিগ্ধ এই জলবায়ুর দেশে
ভ্রমণের দিনগুলো
অপচয় করে রাখো



স্পর্শ

স্পর্শে জেগে ওঠে ব্যবহারের সুখ
যেভাবে ঘোষণার শেষে শিহরিত রোমকূপগুলো টিলাময় হয়ে থাকে
অথরা স্পর্শকে, নিভে যেতে যেতে শেষতম নক্ষত্রের বেশি
ঘনিষ্ঠতায় পায়। স্পর্শিত হতে চাই ...
প্রেমিকার আঙুলের ভাঁজের শীতার্ত অনুভূতিগুলো
ব্যবহৃত দুঃস্বপ্নের চেয়ে বিভীষিকাময়
অথচ এই ব্যাপক আকাশের ডালার ভেতর, বিস্তৃত তারকামালা
আমৃত্যু বেঁচে গেছে শত শত বিধ্বস্ত ঠোঁটের মাতাল স্পর্শে

যদিবা বৃষ্টির স্পর্শ চায় মরুভূমির সুখ
অথবা বিস্তৃত ডানার প্রজাপতি, ফুলের গোপনে খোঁজে সমূহ জীবন
সুতরাং নিংড়ানো ফুলগুলো স্পর্শেই ঝরে যায়
পৃথিবীতে জোনাকি সন্ধ্যায়




ল্যাম্পপোস্টের নিচে নিস্তব্ধ পার্ক

রাত্রির টাওয়ার থেকে মেয়েগুলো দৌড়ে পালাচ্ছে
তাহাদের শেমিজ থেকে দুর্দান্ত গন্ধ-হাওয়া
নিস্তব্ধ পার্কের ভেতর ঢুকে গেল
মেয়েগুলো নাচছে, কাঁপছে নাকি কাতরাচ্ছে
এ-সংক্রান্ত ফলোআপ নিয়ে
আমাদের দূরদর্শনগুলো কী-ই-বা করে থাকে!
‘মাঝি, না হয় এই সামান্য জলাশয়টুকু
ব্যবহৃত হোক কুয়াশা-শরতে...
ল্যাম্পপোস্টের আলোয় আড়াআড়ি পথটুকু
আজ এই পার্কের ভেতর দিয়ে হেঁটে যেতে চাই’...



জেলেপাড়া

তির্জক রোদ্দুর পড়ে জেলেপাড়ায়। উঁচুনিচু বাড়ি হতে ষোড়শী রোদ্দুরগুলো আঁশটে বাতাসের ভেতর ভেসে বেড়ায়। জালে গাব দেয়। অকথ্য বেদনার ভেতর আদি-অন্ত জেলেপাড়াগুলো নদীবর্তী থাকে। ভাঙনের সূত্রপাত হতে ঢেউ এসে কিনারে কিনারে গর্জে। মাঝি ফিরে এলে, জেলে-নাও পড়ে থাকে সারি সারি মোহনা সমীপে। সাঁকো ভেসে যায়। ভেসে যায় দিনমান খাদ্যশস্যের দেনা। অথৈ øিগ্ধতা আসে রোদ্দুরে। রোদ লাগে স্মৃতিবদলের হাওয়ায়। মাঝি ডুবে থাকে কাঁঠালিচাঁপার ঘ্রাণে, হাটের কোলাহল হতে জলের জোছনার ভেতর রাশি রাশি স্বপ্নের সম্ভাবনায়। মাঝি ফিরে যায়। সুপুরি বাগানের ভেতর ভাতশালিকের ঝাঁকে কখনো রোদ্দুর পড়ে না। হাঁসের চৈ চৈ ধরে সমবেত রাত্রির ভাষা অন্ধকার গৃহমুখী পড়ে থাকে



ঈশ্বর

তবে ঝাঁপ দাও। ওকে তুলে আনো হলুদ
সরষেক্ষেত থেকে
তার হাতঘড়ি, শিশিরে ঘেমেছে মাঠে
দুরূহ ভয়ার্ত মেজাজ, যার ঘুম নেই
তাকে অগ্রাহ্য করো
দু’পাশের বাগানের ঢালে
বৈকালিক শীতার্ত প্রহরে
তার মন নেই, চেয়ে আছে লালরঙ রোদ্দুরে

øেহ করো যদি, তার আনগ্ন পায়ে, আরোহণ...
লক্ষ্য করো, ডুবে গেছে আকণ্ঠ খেজুরের রসে...
ভেজা জামা হতে
আকাশে ছড়াচ্ছে ঘ্রাণ, প্রাণপণ
আর ভালোবাসো ওকে ভুলে যেতে
ঝাউবন হতে দূরে দূরে
কাঁচা কলাইয়ের ক্ষেতে, ধানের নাড়ার গন্ধে
ওকে মনে রাখো আজরাত



বৃষ্টির জনপদ

বৃষ্টির জনপদে শীতল বাতাসের শাড়ি, উড়ছে। ধোঁয়া উপচানো মেঘ
বাড়ি বাড়ি প্রহরারত ঘুমে, স্পর্শের শীতলতা হতে খড়ের চালার
গহনে ঝরে যায়।... বৃষ্টির জনপদ
শিশুসন্তানের আর্দ্রতম নিঃশ্বাস হতে সবুজাভ...
শালবন মুখরিত করে বৃষ্টি। শীতরাতের অনুভূতিগুলো বাঁশবাগান চুয়ে চুয়ে
ধ্যানবান বৃষ্টির অতলে জড়ো হয়। বেদনাসম্মত মন--
ঘরে ঘরে গরাদের দেহ ধরে, প্রিয়তম কান্নার দিকে ঝুঁকছে
উড়ে যাচ্ছে ধবধবে বৃষ্টিস্নাত শাড়ি...
পরিত্যক্ত করে আছে কচুক্ষেত। উচ্ছ্বসিত যুবতীকে
ভিজেচুল বৃষ্টির ভেতর ওলানের রসদ সন্ধানে দেখা যায়
রবাহূত রাখালেরা বিদ্যুৎভরা মেঘে অনার্য রিরংসার ঝড়ে কম্পমান
বৃষ্টির জনপদ আরোগ্যের সমারোহে উজ্জ্বল
অথৈ মগ্নতায় চুপচাপ অভিবাস ঝুমঝুম বর্ষণমুখর



বলবার কথা

খুলে বললেই বলা হবে বলে বাজারের কথা শহরের কথা-কিছু
আমার বলার প্রয়োজন আছে, আছে
এক হাঁড়ি দুধের শরীরে ক’ছটাক গোশতের যোগান, তার
যাবতীয় ঘোষণার প্রয়োজন। ভালোবাসি এই
হেমন্তের সাদা কাগজের দিকে অহেতুক মন
প্রতিদিন বৃষ্টি চাই, ধাতু বর্ষণের সমান অঝর বৃষ্টি
আমাদের উৎসবের ক্ষণে
রাই-সরষের প্রহৃত বেদনা জাগে ঝরঝর প্লাবনের শেষে, আর
এসবই বলবার প্রয়োজন, ফুলে ফুলে সহাস্য পতনে--
আমাদের পরিবার জানে, সুবাতাস বয়ে গেলে
উঠোনের রাতগুলো ঝরঝরে আলোছায়া হয়
রূপকথাময়
অথবা এমন : এই অঘোষিত কথা
খুলে বললেই বলা হয়, জোনাকি সকাশে, অন্ধকার রাতে
নির্জনতা প্রিয় হলে শোকার্ত সঙ্গীত ভালোবেসে




স্নান

অন্যায্য রাত্রির ফাঁকে, অখেয়ালে ঝুঁকে থাকে দুর্বিনীত চাঁদ
তার চোখ নেই, বাহুবদ্ধ লোহার শেকল জুড়ে
আকাক্সক্ষার অ-দমন কিছু বোঝা যায়। বোঝা যায়
বেষ্টিত শাওয়ারের নিচে ভিজেচুল ঘ্রাণবায়ুময়
দেয়ালের প্রলুব্ধ নজর, সাবলীল প্রমত্ত শরীরে
নগ্নতার হুটোপুটি জল গড়িয়ে গড়িয়ে ভাসে
নতজানু মহার্ঘ প্রহরে। আলো নেই তবু উচ্ছলতা
সাবানের জড়লাস্যে আগুনের প্রকরণে জ্বলে ওঠে
প্রমত্ত শরীর সরোবরে। তুমুল কান্নার শোক
প্রাচীন ঝর্ণার তলে আদিকাল ভেসে গেল
কাঁচারঙ বঙ্কিম গতরে। অথবা বন্ধুর-ভাঁজে
আলোছায়া শিহরণ কণা কণা নেমে যায়
অতীত ক্লান্তির ঢলে, স্নানঘরে, পরম শীৎকারে



বেদনার্ত টেবিলের নিচে ফটোগ্রাফ

পানশালা থেকে উদ্ধারকৃত ফটোগ্রাফ হতে
তোমার মুখমণ্ডল চিনতে পেরেছি
পৃথিবীর পানশালাগুলো অস্থিরতাময়
এ-খবর বাড়ি বাড়ি পৌঁছে গেলে, প্রত্যহ পররাত্রে
যে কোনো ভূমিকম্পের মোকাবেলায়
আমাদের প্রস্তুত হতে হয়
মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনি কিংবা মোয়াজ্জিনের আজানের ভেতর
পানপাত্রের টুংটাংগুলো অবারিত হলে
এ জাতীয় হ্রস্ব বেদনা থেকে ছেঁকে তোলা যেত নিজেকে
তোমাকে এই বেদনার্ত টেবিলের নিচে
ফটোগ্রাফ হয়ে ঘুমুতে হয়েছে সারারাত
আজ ভোরে তোমার উদ্ধারকৃত মুখমণ্ডল
সমালোচিত হতে শুরু করেছে



শুভ প্রণয়

শুভ প্রণয়ের জন্য আকাক্সক্ষা হয় চিরদিন। উপজীব্য কোলাহলে
নির্মম এক দুঃখবোধ আজো জেগে ওঠে সোল্লাসে। মানুষ জন্মের ভেতর
অকপট গোপনে থাকে প্রণয়ের আঁধার বার্তা
যে যত প্রহৃত পথিক, প্রণয়ের ঋজু পথ অদূরে বিপন্ন তা
ঘোলা জলস্রোতে। মানুষের ব্যবধানে
ভুল ভুল ছবিগুলো আকাশে ঝুলন্ত ভাসে
মুখোমুখি নেমে এলে, অনুরাগ ঝরে নাকি অন্যায্য আড়ালে
প্রকৃত পাথর জানে, স্রোতের মর্মর গাথা
কী গভীর লীলাময় চিরদিন উজানে উজানে...
প্রণয়ের শিলাঝড়ে ব্যথাতুর প্রেমিকেরা অথৈ সমুদ্রে রচে
শুভ বরিষণ



অনেক অর্থের ভেতর, অনর্থ

হৃদয় দৌর্বল্যকর কেবল তুমি। অনেক অর্থের ভেতর
বুঝে নিতে চাই তোমাকে এখন। অর্থময় প্রতিটি
বৃক্ষের তিমিরে এই কথা হতে পারে; কিছু চিঠি
কিছু সন্ত্রাস, অদম্য ভালোবাসাবাসি অনাহূত এই
স্বার্থান্ধ বিষয় হয়ে আছে। চাইলে পারো না তুমি
এমন অরণ্য-- প্রতিটি বৃক্ষই তবু যেভাবে একা

অনন্ত শুধু মেঘ, অথবা ফুলের গন্ধেও কিছু
বিস্তৃতি নেই কম। এভাবে পারো না তুমি
প্রতিটি শ্বেতপাত্রের জলে একাকী চাঁদ
যেভাবে অমলিন হতে থাকে, আর গুঞ্জরণ থেমে গেলে
সূর্যাস্তের উদ্যানে বসে দেখো, পাখি ও পাখিনীর ঠোঁটে
চুম্বন শুনে দেখো-- আলো নিভে গেলে
পরস্পর বিস্তৃত হতে হতে নৈঃশব্দ্য নেমে আসে
সীমাবদ্ধতা আসে, পাখি ও পাখিনীকুলে সাম্রাজ্য ঘিরে

সকলই অদেখা তোমার? অনন্ত অর্থময় তুমি রৌদ্রে
অসামান্য দেহে! কতদিন বুঝে নিতে চাই
তোমাকে অনর্থ করে



রাজ্যপাট

প্রত্যহ ঘুরে ঘুরে দেখি রাজ্যপাট
কিছু কিছু অহেতু মিনার। বিস্মিত হবার আগে
আরেকবার বিদুৎ চলে যায়। স্খলিত পূর্ণিমা তুমি
উপ-বর্ণনার মেঘে এলোমেলো বর্ষার চাঁদ
না-হয়, মহা-অরণ্যের পাশে উদ্ধত জলজ প্রতিমা
গরাদের প্রহরা ভেঙে বহুদূর প্রবাসে এসেছো
আমি নেড়েচেড়ে তোমাদের রাজ্যপাট নিয়ে
এ বেলায় ভেবে ভেবে, দু’দণ্ড দাঁড়িয়েছি কোনো
শৃঙ্খলিত হ্রদে। আর থেকে থেকে বহু বহু
সুউচ্ছ সৌধের চূড়ায় উঠে চলে যাই...

এইখানে লক্ষ্যমান তুমি, মহাপ্লাবনের আলোয়
আরেক ভস্মের শিখায় উচ্ছ্বসিত তোমার অদিতি
তোমার রাজত্বে বড় ঢেউ, টিলাময় বন্ধুর যাত্রা
যে কোনো বৃন্তের তুমি বহুঘ্রাতা, বিশুষ্ক
মলনের ধানগাছ-- ডানাহীন সুবোধ পারাবত কারো
দেয়ালে দেয়ালে ঘুরে, খুঁটে খুঁটে খাও বর্ষা



গোলাপ বাগান

গোলাপ বাগানের প্রতি সম্মোহন জাগ্রত হয়
একদিন বিকেলবেলা শোকাহত গোলাপের কাছে দু’দণ্ড দাঁড়াতে চেয়ে
তাহাদের ঝাড় বর্ধনে ভেবেছি অনেক। ফি বছর
গোলাপ ও ভ্রমর বিষয়ে, কতিপয় প্রাবন্ধিকের দৃষ্টি ফেরাতে চেয়েছি
আজন্ম ঘ্রাণময়িগণ একাকী বাগানের ভেতর
রবাহূত ভ্রমরের প্রতি কী প্রকার আচরণ করে থাকে--
অনুষঙ্গে বলাবলি হলে, জনপ্রিয় কথোপকথনে
বড় বড় গ্রন্থমেলা করা যায়
শিশু ও কিশোরকিশোরীকুলে গোলাপ এক অতি আদৃত ফুলের নাম
এছাড়া, স্রষ্টা ও প্রেমিক-প্রেমিাকাকুলে সম্ভাব্য সম্পর্ক নির্মাণে
আশ্চর্য ক্ষমতাধর এই পুষ্প
কারো কারো ঝুলন্ত বাগানে রৌদ্র বা জ্যোৎস্নাসলিলে
কেউ কেউ সাবলীল কিনা-- এ জাতীয় বলাবলি হয় বেশ
স্টেশন হয়ে বাড়িফেরাকালে মুঠি মুঠি গোলাপগুচ্ছে
কণ্টকিত হয়ে থাকি
ঘরেফেরা রক্তাভ হাতে স্বাস্থ্যবান গোলাপেরা প্রশ্নময় হয়ে ফোটে



ভালো থাকবার প্রার্থনা

দর্জির দোকান থেকে ছুরিকাঘাত সয়ে, ভালো হয়ে বাড়ি ফিরে গেছে
মেয়েটি। বেদনার্ত ক্ষতস্থান থেকে কেউ কেউ ভালো থাকবার প্রার্থনা করে
এক্ষেত্রে প্রত্যুষার শিশিরে মৃত ফরিঙের ডানা অথবা
কালিঝুলি-ঘরের প্রজাপতির পাখায় ভেষজ বিদ্যার কথা
স্মরণে রাখে না কেউ। কতিপয় সংবাদ পাঠক
ইনিয়ে বিনিয়ে শুনে, মেয়েটির শরীর-সংক্রান্তে নৈসর্গিক আবহে
যতটুকু প্রচারের ঝুঁকি নিল, তা থেকে সুস্থতা নিয়ে
ঘোরতর সংশয় থেকে যায়। তাকে এই বৃষ্টি ভেতর
অরণ্যের বিশালতা ধরে কতিপয় শ্বাপদের কথায়
মূর্ছিত দেখা গেছে। অরণ্যের বাহুব্যাপে সারি সারি ধানক্ষেত থেকে
বিম্বিত সতেজ আদলে বোঝা যায় :
প্রসারিত ফসলের মাঠে, যা কিছু দুঃখবোধ
যাবতীয় নিবেদন করা যায়





নিয়ন্ত্রণহীন

রাজহাঁস দণ্ডিত আছে খড়ের দুয়ারে। তুমি পলক ফেলার ভুলে
ডুবে গেছো আনগ্ন চালায়। আমার দৌড়ের যাত্রা...
সাদা মহিষের পিঠে আমাদের স্বপ্নের শস্যের খালুই
তিল তিল বরিষণে ভালোবাসার ছেলেমেয়েগুলো
তাহাদের জনকের পিঠে আরূঢ় হতে চায়
এ সকল সন্তান জানে, কোনো কোনো জননীর হাতে
সমগ্র রাষ্ট্রিক কাজের ভরসা অর্পিত থাকে
ক্ষুদ্রতার নিতান্ত চালায় ডুবে থেকে
বুঝি আজ ভেবেছো এইসব!

সিঁদুরের অর্পিত ভাঁজ কেশময়।... দূরান্তের মহিষেরা
সদ্যোজাত সভ্যতার ইশতেহার নিয়ে
আমাদের স্বপ্নের মুঠোয় সমর্পণ করে গেছে
আমার দৌড়ের যাত্রা।... সভ্যতার ছেলেমেয়েগুলো
আজো নাকি বৈধতা পায়নি কেউ!



ত্বকের আড়ালে

মেয়েটির ত্বকের আড়ালে ভাসে সমুজ্জ্বল বেদনার ভাষা
ঐশ্বর্য খসে গেছে গহনের বলিরেখাময় মুখে
আজও নাকি বৃষ্টি হয় প্রকাণ্ড দেবদারু বনের শীতল সরোবরে
রাশি রাশি শস্যের কান্তি, দীপ্তিমান দৃষ্টির অতলে খাবি খায়...
দহনের আনগ্ন হাওয়া, মুহুর্মুহু বয়ে যায়
পক্ষাঘাত ডানার পরপারে
দণ্ডিত পায়ের সমীপে অগণন প্রশ্নময় হয়ে
এই পথে অজ্ঞাত এক মেয়ে
পক্ষময় খোলা খোলা মেঘের আড়ালে ভাসে চাঁদ
শ্রাবণের দিনগুলো শিল পাথরের ভারে
বেদনার্ত বর্ষণ ঘোষণা করে। ঝরে ঝরে, ব্যাপক কান্নার ভেতর
অভিমানী হলে, ভেজাডানা প্রজাপতিগুলো
অন্ধকার ওমের গভীরে ডুবে যায়
প্রতারিত কাল, মৌসুমের ভালোবাসাটুকু
নিভাঁজ বেদনার দিকে ফিরে দেয়



গাছ ও আগুনে ভ্রমণ

গাছে গাছে পরিভ্রমণকে বিখ্যাত করে রাখা যায়
কেবল আগুনের কাছে সাহচর্য প্রার্থনা আত্মধিক্কৃতি বলে মনে হয়
কেননা আগুনের থাকে অসম্ভব ঔজ্জ্বল্যের মাপে
বীভৎস ধ্বংসের প্রবণতা। ধ্বংসশীল মানুষেরা বরাবর
অগ্নিকেই অমোঘ আপন করে নেয়। যদিও আগুনের কোনো
সবুজাভ সতেজতা নেই, তাকে তাই স্নেহময়ী ভাবা নিতান্ত অন্যায় আচার
কোনো কোনো মাতাল ষোড়শী আমাদের ভেতর অগ্নিস্বরূপা
আর গাছ অভাবনীয় ধৈর্যশীল অভিভাবকরূপে ছায়া ও ফলমূল
খড়ি-লাকড়ির এক আজন্ম উৎস
আমরা পাথরের ওপর শীতলতাজ্ঞানে ছায়াময় বৃক্ষের নিচে বসে থাকি
যে কোনো বয়সের ওপর পাতাদের সবুজ স্নিগ্ধতা প্রভাবিত করে রাখে
বর্ষণ বা শীতের প্রখরতায় হলুদ পাতার দিনে গাছগুলো
বিচিত্র অনুভূতি সঞ্চারী। আর ঋতু বা ঋতু অন্তরে
গাছে গাছে পরিভ্রমণ স্বাস্থ্যকর অভ্যাস রকম
যে কোনো প্রাকৃতিক চর্চার সাথে একেও এক স্বখ্যাত মাধ্যম মনে হয়



পরম শূন্যের ভেতর

পরম শূন্যের ভেতর নিবস্ত্র শরীরে খুব নিশ্চিন্ত হওয়া যায়
কখনো বালুকাবেলায় ঢেউয়ের গর্জনগুলো পরম শূন্য হতে পাওয়া
মানুষ জন্মের ভেতর পরিত্যক্ত আবাসন একক শূন্যের মানচিত্র
অথবা প্রস্থানবেলায় হিমঘরে মুছে দেয় ঝুলকালি চিত্রমেলা...
যতটা পথিক থাকে, প্রতিবেশ সমারোহে ভুলে থাকা আরোগ্যের ভাষা
বিবমিষা শরীরে, স্নানের পরিধিব্যাপে ফ্যাকাশে রোদ্দুর জ্বলে স্যাঁতসে্যঁতে ওমে

ভাষাহীন বৃষ্টিতে যাওয়া-আসা লীলাময় এ ভুবন-সংসারে
প্রকৃত মানুষ-সকল গুহাময় পৃথিবীটা এফোঁড় ওফোঁড় করে
মরে থাকে পরম শূন্যের গভীরে