শনিবার, ২৮ আগস্ট, ২০১০

অভিবাসী

পাপড়ি রহমান

কালা গরলের জ্বালা আর তাহে অবলা...

কালকা মেল তখন উড়ন্ত সাপের গতি পেয়েছে। হাওয়া আর রোদ্দুরের বুক চিরে সাঁ সাঁ করে সামনে এগিয়ে চলেছে। দুই পাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ঘর-বাড়ি, সামান্য ঝোঁপ বা কিছু প্রাচীন বৃক্ষরাজি, শুষ্কভূমি, দুই-চারটা জলাশয় সেলুলয়েডের ফিতার মতো দ্রুত টেনে নিয়ে যাচ্ছে। টেনে নিয়ে মুহূর্তে সব চোখের আড়াল করে দিচ্ছে।
অথচ বর্ধমান পেরুবার পরই কি এক অদ্ভুত কারণে কালকা মেলের গতি শ্লথ হয়ে যায়। ঢেকিকয়ে ঢেকিকয়ে চলো। কোনো কোনোদিন সিগনাল না পেয়ে হয়তো কোনো ইস্টিশনেই ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে।
বন্দুক কি কামান দাগালেও সে তখন একচুলও নড়বে না।
ব্যান্ডেল জংশন পার হলেই হুগলি ইস্টিশন। বেশিরভাগ সময়ই ট্রেনটা এখানেই ঘাপটি মেরে থাকে। এতে অবশ্য নীহার ভট্টাচার্যের সুবিধে হয়। ধীর-সুস্থে যাকে বলে খানিকটা রয়ে-সয়ে ট্রেন ধরতে পারে। হুগলি পেরোলেই চচূঁড়া। তারপর চন্দননগর, ভদ্রেশ্বর, বৈদ্যবাটি, শেওড়াফুলি, শ্রীরামপুর, বিষড়া, কোন্নগর, হিন্দমোটর, উত্তরপাড়া, বালি, বেলুড়, লিনুয়া।
কিন্তু এই ট্রেনের মতি-গতি বেশ মুশকিলে! কোনো কোনোদিন বর্ধমান ছাড়িয়ে হুগলিকে একেবারে দলিত-মথিত করে দিয়ে হুসহুসিয়ে চলে যায়। কোনোদিন ফের হুগলি ছাড়ালেই পা পিছলে যেন কোনো ঢালে যেয়ে পড়ে। তারপর শুধু নামতে থাকে। নামতেই থাকে। নামতে নামতে একেবারে খাঁদে গিয়ে ঠেকে। আর এই খাঁদ হলো গিয়ে হাওড়া ইস্টিশন।
থাম বাপ থাম। একটু রেয়ে-সয়ে চল।
সামান্য ঢেক্কিয়ে ঢেক্কিয়ে চললে কি হয় বাপ তোমার?
কাল কেউটের মতো জলগতিতে না চলে অজগরের মতো জিরিয়ে জিরিয়ে, ঢিলেঢালাভাবে চলনা। অজগরের মতো চললে রোজকার ভাবনাটা কম ভাবতে হয়।
নিত্যই কোনো না কোনো ফ্যাসাদ এই ট্রেনে ঘটে। উল্কা গতি না-হয় শম্ভুকগতি। শম্ভুকগতি না-হয় উল্কাগতি।
যেদিন কালকা মেলের শরীরে জোর হাওয়া লাগে সেদিন একেবারে ব্যারাছ্যারা অবস্থা। নীহার ভট্টাচার্যের লালপেড়ে কোরা শাড়িটা ঘামে-ধুলায় সামান্য মলিন হতে না হতেই হাওড়া ইস্টিশন চোখের সামনে। তখন প্যাসেঞ্জারদের নামার তাড়া। বাস্ক-পেটরা লটবহর নিয়ে হুড়োহুড়ি। যেন সমুদ্দুরের বিশাল ঢেউ এই মাত্র আছড়ে পড়লো কূলে।
গন্তব্য এসে পড়লে এই হুড়োহুড়ি করে দলা পাকানোর মানে কি? নামার জন্য এত অস্থির বিস্থির করারই বা অর্থ কি?
কালকা মেল যেদিন হুগলিতে পৌঁছেই নড়ন-চড়নহীন হয়ে যায় সেদিন নীহার ভট্টাচার্যের তেমন কষ্ট হয় না। ছিপছিপে রোগা দেহটা শুধু টেনে ট্রেনে ওঠাতে পারলেই হলো। তারপর টু-টায়ার আর থ্রি-টায়ারের খাঁজেভাঁজে বিলি কেটে গলাটা পরিষ্কার করে উঠতেই যত বিড়ম্বনা। একতারা বা দোতারা কিছু হাতে নাই। কিন্তু পুরানা অভ্যাসের গুণে ডান হাতের তর্জনীটা আপনা-আপনিই বেজে ওঠে-
কালা গরলের জ্বালা আর তাহে অবলা
তাহে মুঞি কুলের বৌহারি
অন্তরে মরম ব্যথা কাহারে কহিব কথা
ঘুপতে সে গুমরিয়া মরি॥
সখি হে বংশী দংশিল মোর কানে।
ডাকিয়া চেতন হয়ে পরান না রহে ধড়ে
তন্ত্র-মন্ত্র কিছুই না মানে॥
মুরলী সরল হয়ে বাঁকার মুখেতে রয়ে
শিখিয়াছ বাঁকার স্বভাব।
দ্বিজ চণ্ডীদাস কয় সঙ্গ দোষে কি না হয়
রাহু মুখে শশী-মসি লাভ॥

নীহারের গলাটা সামান্য বসা হলেও সুর একেবারে টনটনে। যেন বাঁশের ঝোঁপ থেকে সদ্য মুখ বাড়ানো সবুজ ডগা কঞ্চিটা। পৃথিবীতে রোদ্দুরের জৌলুস দেখা অবাক নয়নে তাকিয়ে আছে!

হররোজ কিছুই এক রকম হয় না। সূর্যের আলোও যে পৃথিবীতে পৌঁছে তারও তো তারতম্য হয়। হাওয়া যে বইতে থাকে তাতেও তো আর্দ্র বা শুষ্কভাবের বেশ-কম হয়। ফলে নীহারেরও তারতম্য হয়। তার নিত্যদিনের জীবনের ওঠা-নামা হয়। কিন্তু গলাটা তার একই থাকে। গলা একরকম হলেও অবস্থা অনুকূলে থাকে না।

কালা গরলের জ্বালা তাহে অবলা
তাহে মুঞি কুলের বৌ হারি

কীর্তনের মুখটা ধরতে না ধরতেই কেউ কেউ চেহারা ব্যাদান করে ফেলে। নীহার তখন কি করে? গিলতে না পারা, উগরাতেও না পারা অবস্থা হয় তার। ফলে গান শেষ না করেই সটকে পড়তে হয়। বা লজ্জা থেকে বাঁচতে গুণগুণ করে না দেখার ভান করতে হয়। টু টায়ারে সামনে দাঁড়িয়ে নীহার ভট্টাচার্য ফের অন্তরায় টান দেয়-
সখি হে বংশী-দংশিল মোর কানে।
ডাকিয়া চেতন হয়ে পরান না রহে ধড়ে
তন্ত্র-মন্ত্র কিছুই না মানে॥

ভাগ্য প্রসন্ন হলে দুই/ একজন পুরুষযাত্রী তখন পকেট হাতড়ায়! দুই বা এক রূপী যাই উঠে আসে নীহারের হাতের তালূতে ফেলে দেয়। টু বা থ্রি টায়ারের মহিলা যাত্রীরা নির্বিকার দৃষ্টিতে তাকে পরখ করতে থাকে। পাটের আঁশের মতো মসৃণ সূক্ষ্ম অজস্র বলিরেখায় ভরে যাওয়া মুখটাতে তখন খানিকটা বেশি রক্ত ছলকে ওঠে! রঙ জ্বলে তামাটে হয়ে-যাওয়া ত্বকের এই পরিবর্তন হঠাৎ ধরা পড়ে না।
নীহার ভট্টাচার্য প্রণামের উদ্দেশে দুই হাত কপালে ঠেকিয়ে মাথা নিচু করে। তখন ঝুরঝুরিয়ে সামান্য সিঁদুর ঝরে পড়ে কামরার মেঝেতে। সিঁদুরের এই ঝরে পড়াও ঘটে সবার অলক্ষ্যে। যেমন অলক্ষ্যেই থাকে তার শীর্ণ হাতদুটোও। এবং তাতে সহজভাবে জড়িয়ে থাকা শাখা-পলাও। এমনকি মেদ-মাংসের বাহুল্য বর্জিত তার দেহখানাও কোরারঙ শাড়ির আড়ালে থেকে যায়। এতসব কিছু আড়াল করে রাখে নীহারের কীর্তন। তার সুরেলা কণ্ঠ।
ট্রেনের হট্টগোল ছাপিয়ে থইথই সুর ভেসে বেড়ায়।

সই কে বা শুনাইল শ্যামনাম
কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল গো
আকুল করিল মোর প্রাণ॥
না জানি কতেক মধু শ্যামনামে আছে গো
বসন ছাড়িতে নাহি পারে।
জপিতে জপিতে নাম অবশ করিল গো
কেমনে পাইব সই তারে॥
নাম-পরতাপে যার ঐছন করিল গো
অঙ্গের পরশে কি বা হয়।
যেখানে বসতি তার নয়নে দেখিল গো
যুবতী-ধরম কৈছে রয়॥
পাসরিতে করি মনে পাসরা না যায় গো
কি করিব কি হবে উপায়।
কহে দ্বিজ চণ্ডীদাসে কুলবতী কুল নাশে
আপনার যৌবন যাচায়।।

নীহার কীর্তন গায়। কেউ মন দিয়ে শুনলো কি শুনলো না তা সে দেখে না। দেখলে যে সে নিজেই আর আপনাতে থাকে না।
নীহার ভট্টাচার্য সব জানে। সব বুঝে। বুঝেও না বুঝার ভান করে সে। না করে উপায় নাই।
প্রথম প্রথম ভীষণ সঙ্কোচ হতো। ছিঃ! কি করে সে হাত পাতবে অচেনা মানুষের সামনে?
কিন্তু তিন ছেলেই যখন অন্য হাড়ি করলো তখন দেয়ালে পিঠ ঠেকেছে। পেছনে বাধা ছাড়া আর কোনো পথ নাই। শিবনারায়ণ ভট্টাচার্যর সাহস করে নিজেই এ পথে এসেছিল।
প্রথম দিকে হারমোনিয়ামটা গলায় ঝুলিয়ে নীহার আর সে দুজনে মিলে গাইতো। নীহার ভাবে- আহা! বেশতো দিন ছিল তখন। দুজনে মিলে ভগবানের নাম করে পথে নামা। ভগবানের নাম শুনে কেউ ইচ্ছে করে দুই/ তিন রূপী যা খুশি দিক। না দিলেও তারা তো অভিযোগ করছে না।
শিবনারায়ণ বলতো-
‘ভিক্ষে তো আর করছিনে? মোগো কি মনু এই কইরে দিন চইলবে না?’
২৭/২৮ বছর আগে পূর্ববঙ্গ ছেড়ে এলেও কথাতে মাতৃভাষার টান রয়ে গেছে। হুগলীর ভাষা তখনো ভালো রপ্ত করতে পারেনি!
নীহার জানে শিবনারায়ণ তাকে যতই প্রবোধ দিক, নানা ছলাকালায় মন মজাতে চাক- এ আসলে ভিক্ষা। ভিক্ষা ছাড়া আর কি?
ভগবানের নাম কণ্ঠ তুলে নিয়ে সেতো আসলে মানুষের দয়া-দাক্ষিণ্য-করুণাই চাইছে।

অঞ্জন রঞ্জিয়া কেবা খঞ্জন বসাইল রে...

হুগলি থেকে কত দূর বাংলাদেশ? এই বাংলাদেশের এক অজ পাড়াগায়ে জন্মেছিল নীহার ভট্টচার্য। যেখানে খেঁজুর গাছের ঘন জঙ্গল আর তালের বন। সুপারির মম গন্ধ ছড়ানো। শীত নামতেই খেঁজুর গাছের মাথা চেঁছে দেয়া হয়। তারপর তাতে নল বসিয়ে গলায় হাঁড়ি বেঁধে দেয়া হয়। শীতকালটা গলায় গলগণ্ড রোগের মতো হাঁড়ি ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সার-সার খেঁজুর গাছ। সমস্ত শীতের রাতে ফোঁটা ফোঁটা রস ঝরতে থাকে। মাছি আর মৌমাছি। ছোট ছোট রেতো প্রজাপতি, বড়গুলোও সেই হাঁড়ির রসে সাঁতার কাটে। পাখনা নাড়ে। মরে যায়। কুয়াশামাখা-ঠাণ্ডানিবিড়-নির্জন শেষ রাতে দেখা যায় এইসব। কোনো কোনো রাতে কুয়াশা কম পড়ে। সাদা সাদা মেঘ বেশ করে ভেসে থাকে। ওই সাদা মেঘ ফুঁড়ে ভেসে ওঠে মস্ত পানা ঘোলাটে চাঁদ।
এইসব দেখে দেখেই তো নীহারের কেটে গিয়েছিল ২০-২৫ বছরের জীবন।
তারপর হঠাৎ একদিন সব বদলে গেল! বারুদের গন্ধ আর কালো ধোঁয়া। তাতে ঢেকে গেল মেঘ, মাছি, মৌমাছি আর গোলপনা চাঁদ।
নীহারের তখন দুটো ছেলে জন্মেছে। তাদের নিয়ে এলোপাতারি ছোটাছুটি। নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য উৎকণ্ঠা। শিবনারায়ণের যেন কোন বিকার নেই। ছিল না। সে সদা ব্যস্ত খবরাখবর নিয়ে! রাত নামলেই তিনব্যান্ড রেডিওটা কানের কাছে নিয়ে কিছু একটা শোনার চেষ্টা করা। ঘরঘর শব্দে মগ্ন হয়ে থাকা।
স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে যদি কিছু আশার বাণী ভেসে আসে! বা আকাশবাণী কোলকাতাকে কানে উপুড় করে যদি কিছু সান্ত্বনা সঞ্চয় করা যায়।
নীহার রেগেমেগে যেতো। কি হয় এত সবে কান পেতে? সারাক্ষণ রেডিওর ঘরঘর আর ঘরঘর।
নীহারের রাগ উপেক্ষা করে শিবনারায়ণ শান্ত স্বরে বলতো-
‘খবর না রাখলে অইবে কেমনে মনু?’
‘অত খবরে কাম কি মোগো?’
‘দ্যাশে ফাইট চলতেছে। এই ফ্যাইটে জিইত্যা গেলে মোগো নিজেগো দ্যাশ অইবে। নিজেগো রাষ্ট্র অইবে। মোরা স্বাধীন দেশের মানু অমু।’

এমন বলতে বলতে শিবনারয়ণের চোখদুটো কি এক আশায় যেন চকচক করে উঠতো।
কার সাথে গুজগুজ করতে দেখে নীহার ঠিকই আঁচ করে ফেললো। শিবনারায়ণ যুদ্ধে যাওয়ার ট্রেনিং করার জন্য বর্ডার পার হবার তাল করছে।
শিবনারায়ণ চলে গেলে নীহারের কি হবে? বাচ্চা দুটোর কি হবে? বুড়ো বাপ গঙ্গানারায়ণের কি হবে? সোমত্ত বোন দুটোর কি হবে?
সব ভেবে-চিন্তে নীহার বাগড়া দিয়ে বসলো।
শিবনারায়ণ কিছুতেই একা যেতে পারবে না। গেলে সবাইকে নিয়ে যেতে হবে। যুদ্ধ করতে হলে সবাই মিলেই যুদ্ধ করবে।
নীহারের কথা শুনে শিবনারায়ণ বেকুব! এত জোর কোথায় পেল সে! শিবনারায়ণের যুদ্ধে যাওয়া হলো না! কিন্তু সে চুপচাপ বসেও থাকলো না। গোপনে গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করে যেতে লাগলো। গোলার ধান, পুকুরের মাছ আর গাছের ফল-পাকুড় যেমনটা পারলো দিয়ে গেল। এসব গোপন সাহায্য গোপন রাখা মুশকিল। ফলে গোপন ছিল না কিছুই। গোপনকে অগোপন করতে ফেউদের তো অভাব নেই।
ফলে নিজের বাড়িতে বাস করাও বিপদজনক হয়ে উঠলো। পাক-সার-জমিন-সাদ-বাদ পন্থীরা ঘন ঘন উঁকি ঝুঁকি দিতে শুরু করলো। নিজের বাড়ি-ঘর ছেড়ে শিবনারায়ণকে পালাতে হলো। সঙ্গে তার পরিবার। দূরে কোনো এক অচেনা গ্রামের উদ্দেশ্যে পা বাড়িয়েও নীহারের মন ব্যাকুল হয়নি। চোখ ফেটে জল নামেনি। কিসের যেন জোর ছিল সবখানে। যত দূরেই যাক ফিরে তারা আসবে। আসবেই এটা যেন নিশ্চিত জানা ছিল। আর বিভেদইবা তেমন কই? এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রাম। হোক না কোনো দূরের গ্রাম। এ যেন নিজের দুয়ার ছেড়ে পড়শির দুয়ারে যাওয়া। পড়শির দুয়ারে জল-খাবার খেয়ে, জিরিয়ে নিয়ে নিজের ভিটেতে ফিরে আসা।
কিন্তু এই ফিরে আসার ব্যবধানের মাঝেই যা ঘটার ঘটে গিয়েছিল। শিবনারায়ণদের বাড়ি লুট হয়ে গিয়েছিল। শুধু বাড়ি নয় ঘরেও দখল নিয়েছিল পাক-সার-জমিন-সাদ পন্থীরা। যাদের কাছে চাঁদ-তারা-খচিত সবুজ পতাকার গুরুত্ব বেশি ছিল।
লুট-তরাজ, আগুন জ্বালানো আর পাকিস্তান জিন্দাবাদের মাঝে শিবনারায়ণের আশাই পূর্ণ হয়েছিল।
বাংলাদেশ!
বাংলাদেশ শিবনারায়ণের স্বাধীন দেশ। নিজের দেশ! স্বাধীন দেশে নিজের ভিটাতে বড় শান্তি নিয়ে ফিরেছিল শিবনারায়ণ। কিন্তু ঘরে জল ভরে খাওয়া ঘটি পর্যন্ত ছিলো না। সবকিছুই লুট হয়ে গিয়েছিল। খাট-পালঙ্ক-চেয়ার-টেবিল কিছু নাই! চায়ের একটা চামচ পর্যন্ত নাই। তুলশীর ভাঙা বেদী উল্টে পড়েছিল দুয়ারে। জল না পেয়ে গাছগুলো শুকনো মচমচে। তুলশীর বেদী সোজা করতে করতে নীহারের দুচোখ জলে ভরে গিয়েছিল। দুহাত কপালে ঠেকিয়ে প্রণাম করে বলেছিল-
রাম! রাম!
‘ভগবান! স্বাধীন দ্যাশ! হেলে এডা কিসের নমুনা?’
শিবনারায়ণ আস্তে করে বলেছিল-
‘ঘরে যাও নীহার!’
নীহার তাকিয়ে ছিল স্বামীর মুখের দিকে। ওই মুখে কোনো রাগ নেই! অভিমান নেই! বেদনা নেই! কষ্ট-যন্ত্রণা কিছু নেই! কিভাবে পার শিবনারায়ণ এমন নির্বিকার থাকতে?
যেন কোথাও কিছু ঘটেনি। হয়নি। এ সংসারে কোনো কিছুর আঁচ লাগেনি!
সবকিছুই আগের মতো! একেবারে ঠিকঠাক!

আদতে কোনোকিছুই ঠিকঠাক ছিল না। লুট করে নেয়া জিনিস-পত্র কেউ ফিরিয়ে দিতেও আসেনি। শুধু শূন্য ঘর ফিরিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু ওই ফিরিয়ে দেয়াও ছিল সাময়িক।
কত বড় চক্রান্ত শিবনারায়ণকে ঘিরে জালবিস্তার করেছিল তা বুঝতেও সময় লেগেছিল। তা বছর খানেকতো হবেই। শিবনারায়ণের বাড়ি-ঘর, জমি-জিরাত পাক-সার-সার-জমিন-সাদ-বাদের চক্করে তলিয়ে গিয়েছিল। কিচ্ছু করার ছিলো না। কোনো প্রতিবাদও কেউ করতে আসেনি।
তাজা বুলেটের সামনে কোনোকিছুই চলে না।
আর চোদ্দপুরুষের হাড়-মাংস মজে যাওয়া ভিটা ছাড়তে কি মানুষের সময় লাগে না? চেনা-আলো-হাওয়া-জল-বৃক্ষ ছাড়তে কি মানুষের দ্বিধা হয় না? হয়!
সময়ও লাগে। শিবনারায়ণেরও লেগেছিল।

শিবনারায়ণের দুই পায়ে যেন আর জোর ছিল না! তার মনে হতো কোনোদিনই সে আর হাঁটতে পারবে না। নিজের জন্মভিটা কেমন যেন অচেনা। এই খানেই কি সে জন্মেছিল? এই মাটি কি তার জন্মমাটি? এই ঘর-দোর-উঠোন কি নিজের ছিল?
এই যে তার সাজানো সংসারের সবকিছুই লুটপাট হয়ে গেছে। ভিটে ছাড়ার জন্য তাকে অলক্ষ্যে ভয় দেখানো হচ্ছে। জানে ভয় ধরিয়ে দিলে কোনোকিছুই আর আগের মতো থাকে না। নিজের থাকে না। সব হঠাৎ অচেনা, পর, অদ্ভুত হয়ে ওঠে!
কোনো রাতে তক্ষক ডাকলেও ভয় পেয়ে কুঁকরে যেতো নীহার। কোনো অশুভ যেন তড়াক করে লাফিয়ে নেমেছে সংসারে!

জপিতে জপিতে নাম অবশ করিল গো
কেমনে পাইব সই তারে...

প্রায় এক বস্ত্রে চলে আসা। রাতের ঘোরঘুট্টি অন্ধকারে নিজেদের বাঁচাতে সব ফেলে পালালো তারা। তারা মানে শিবনরায়ণের পুরো পরিবার। এক দূর সর্ম্পকীয় আত্মীয়র সূত্র ধরে খোঁজ খোঁজ। তারপর এই হুগলি। এখানে বরিশালের তালের বন নেই। সুপারি গাছ আরো নেই। শীত পাকা কোনো রাত কোনোদিন আসেনি এই শহরে! ধু ধু দিন। ধু ধু রাত। খরখরে দিন আর রাত্তির।
নীহার ভট্টাচার্য নিশ্চুপ হয়ে গিয়েছিল। দম দেয়া কলের পুতুল যেন। জেগে উঠেছে, হাঁটছে, স্নান করছে। খাচ্ছে-দাচ্ছে। সব কেমন যেন বালুঘড়ির পেটের ভেতর আটকানো। পানসে-নিরানন্দময়। স্বেচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক-স্বদেশ ছেড়ে এসে অন্যকে ভালোবাসা বড় কঠিন। নীহার ভট্টাচার্য পারলো না!
নীহার ভট্টচার্যের পারা বা না পারাতে কিইবা এসে যায়? জীবন তো হেঁটে যায় জীবনের নিয়মেই।
হুগলির অচেনা-অজানা জল হাওয়ায় আরো তিনটা ছেলেপিলে জন্ম নিল তার। তারা বড় হলো। বড় হতে হতে পরগাছা হয়ে গেল।
ঘর নেই, বাড়ি নেই, বৃক্ষ নেই, জমি নেই, গরু নেই, পুকুর নেই-সবখানেই নেই নেই। এতসব নেই নেই দেখে নীহার জানে সেও আসলে পরগাছাই। পরগাছা।
দানা খুঁটে খেতে শেখা পাখির উড়াল দেখেছে নীহার। দেখেছে শিবনারায়ণও। ছেলেরা যে যার মতো ভিন্ন অন্নে চলে গেল। কি করবে এই দুই মানুষ?
নীহার ভট্টাচার্য দিদিমার কাছে থেকে শোনা শোলোক আওড়েছিল-
অভাবে স্বভাব নষ্ট
কুল নষ্ট কুবচনে
যাচনে মান নষ্ট
বুদ্ধি নষ্ট নির্ধনে...

অভাবে শুধু স্বভাব কেন? সমস্ত দেহটাই যে পচে গলে দুর্গন্ধযুক্ত হয়ে ওঠে।

একদিন হঠাৎ করে পুরনো হারমোনিয়ামটা টেনে নিয়েছিল শিবনারায়ণ-

সুধা ছানিয়া কেবা ও সুধা ঢেলেছে রে
তেমতি শ্যামের চিকন দেহা।
অঞ্জন রঞ্জিয়া কেবা খঞ্জন বসাইল রে
চাঁদ নিঙ্গাড়ি কৈল থেহা॥
থেহা নিঙ্গাড়ি কেবা মুখানি বনাইল রে
জবা নিঙ্গারিয়া কৈল গণ্ড।
বিম্বদল জিনি কেবা ওষ্ঠ গড়িল রে
ভুজ জিনিয়া করি শুভ॥
কম্বু জিনিয়া কেবা কণ্ঠ বানাইল রে
কোকিল জিনিয়া সুস্বর।
আরদ্র মাখিয়া কেবা সারদ্র বনাইল রে
ঐছন দেখি পীতম্বর॥
বিস্তারি পাষাণে কেবা রতন বসাইল রে
এমতি লাগয়ে বুকের শোভা
কানড়-কুসুম বোবা সুষম করিল রে
এমতি তনুর দেখি আভা॥
আদলি উপরে কেবা কদলী রোপল রে
ঐছনি দেখি উরুযুগ
আঙ্গুলি উপরে কেবা দর্পন বসাইল রে
চণ্ডীদাস দেখে যুগযুগ॥

নীহার ভট্টাচার্য প্রচণ্ড ধন্দের ভেতর-হঠাৎ কীর্তন কেন?
শিবনারায়ণ গান শেষ করে চোখের জল মুছে বলেছিল
‘ভগবানের নামে পথে নামতে উপায় লাগে না বড় বউ।’
‘এসব কথা কও কেয়া?’
‘কই কিয়া! ভগবানকে কণ্ঠে নিয়ে একবার চেষ্টা করতে দোষ কি?’
‘চেষ্টা! কিসের চেষ্টা?’
এত যুগ পর কিসের চেষ্টা করতে চায় শিবনারায়ণ? একেবারে নিজের মাঝে জড়ো হয়ে থাকা মানুষ এত কথাই আজ বলছে কেন?
পরদিনই ভোরে স্নান সেরে আধময়লা ধূতিটা পরে শিবনারায়ণ নীহারকে বলেছিল-
‘বড়বউ যাও তো-চান করে পূজা সাইরা আসো।’

নীহার চান করে লালপেড়ে কোরা শাড়িটা পরে ভক্তি ভরে পূজোর ঘরে ঢুকেছিল। পূজো শেষ করে আসতে না আসতেই শিবনারায়ণের গলায় ঝোলানো হারমোনিয়াম দেখে নীহার একেবারে এতটুকুন হয়ে গিয়েছিল। কি করতে চাইছে লোকটা? কেন এত সাজ-পোশাক? সুর আর গীত?
কোনো কথা না বলে শিবনারায়ণ মুখটা ধরেছিল-

মনেক মরম কথা শুনলো সজনি।
শ্যাম বাবু পড়ে মনে দিবস রজনী॥
কিবা রূপে কিবা গুণে মন মোর বান্ধে।
মুখেতে না ফুরে বাণী দুটি আঁখি কান্দে॥
কোন বিবি নিরমিল কুলবতী বলো।
কেবা নাহি করে প্রেম কার এত জ্বালা॥
চিতের আগুনি কত চিতে নিবারিব।
না যায় কঠিন প্রাণ কারে কি বলিব॥
জ্ঞান দাস কহে মুঞি কারে কি বলিব।
বাসুর লাগিয়া আমি সাগরে পশিব॥

তারপর হুগলি ইস্টিশনে। চচূঁড়া। চন্দননগর। ভদ্রেশ্বর। বৈদ্যবাটি। শেওড়া ঝুলি। শ্রীরামপুর। বিষড়া। কোন্নগর। হিন্দমোটর। উত্তরপাড়া। বালি। বেলুড। লিনুয়া।
চলতে চলতে হাওড়ার অন্ত্রের ভেতর। ফের লিনুয়া। বেলুড। বালি। উত্তরপাড়া।
শিবনারায়ণ নীহারকে বেশিদিন সঙ্গ দিতে পারেনি। পক্ষাঘাতে একদিক খেয়ে ফেললে কালকা মেল আর হয়ে ওঠেনি।
নীহার কবে থেকে যেন একা! একাই! হারমোনিয়াম নেই। একতারা নেই। দোতারা নেই। আসলে কিছুই আর তার সঙ্গে নেই। সুর জ্ঞানটা টনটনে। আর গলাটা ভারি মোহন।
মোহন গলায় কয় রূপীই বা হয়? কোনোমতে একবেলা আধবেলা। কোনো কোনোদিন স্রেফ উপবাস। তবুও বেঁচে তো আছে দুই প্রাণী! ভগবান সাক্ষী মেনে জোড় বাধা। ফের ভগবানকে কণ্ঠে তুলে লোকালয়ে ঝাঁপ দেয়া।
কোনো কোনো রাতে একদম ঘুমুতে পারে না নীহার। ঘুম আসে না তার। হঠাৎ হাওয়া এসে সুপারীর গন্ধে ভরিয়ে দেয় জীর্ণকুটির। ধান পাকা সোনালি মাঠ ঢুকে পড়ে জানালা গলিয়ে। আর গঙ্গানারায়ণ কুঁজো হয়ে তিন আঙুলে জপের মালা টেনে চলে।
তক্ষকের ডাক শোনার জন্য অপেক্ষা করে নীহার ভট্টচার্য। কিন্তু হুগলি শহরের কোনো রাতেই তক্ষক ডাকে না। নীহার ভট্টচার্য ভয় পেতে চায়। ভয়ে কুঁকড়ে উঠতে চায়। কিন্তু সব ভয় সে ফেলে এসেছে বাংলাদেশে। নিজের জন্মভিটায়। ভয়কে ফিরিয়ে আনার জন্য যদি সে একবার যেতে পারতো নিজ দেশে! সার সার খেঁজুর গাছের তলায় সরু পথ ধরে একবার যদি হেঁটে যেতে পারতো!
নীহার ভট্টাচার্য জানে তার ভাবনা কতোটা অবান্তর! সব ফেলে কালই তাকে ভোর ভোর উঠতে হবে। চান সেরে পূজা ঘর। পূজা সেরে চাল-ডাল কোনো মতে ফুটিয়েই দৌড়াতে হবে ইস্টিশনে।
ট্রেনের কোচ। টু টায়ার। থ্রি টায়ার।

পহিলহি চাঁদ করে দিল আনি।
ঝাঁপল শৈলশিখরে একপাণি॥
অব বিপরীত ভেল গো সব কাল।
বাসি কুসুমে কিরে গাঁথই মাল॥
না বোলহ সজনি না বোলহ আন।
কী ফল আছয়ে ভেটব কান॥
অন্তর বাহির সম নই রীত।
পানি-তৈল নাহি গাঢ় পিরীত॥
হিয়া সম-কুলিশ বচন মধুরার।
বিষঘট উপরে দুধ-উপহার॥
চাতুরি বেচহ গাহক ঠাম।
গোপত প্রেম-সুখ হই পরিণাম॥
তুহুঁ কিয়ে শঠি নিকপটে কহ মোয়।
জ্ঞানদাস কহ সমুচিত হোয়॥

হররোজ তো এভাবেই ভগবানের নাম জপে নীহার ভট্টার্যে। গলা বসা হোক। ধরা হোক।
ট্রেন ধরাটাই যা যন্ত্রণার। সুর ভাসিয়ে নিয়ে যায় তার চেনা অতীত। ক্ষত-বিক্ষত বর্তমান।
ঝাপসা এক ভবিষ্যত তাকে টেনে নিয়ে যায় ইস্টিশন থেকে ইস্টিশনে।
আজ কত রূপী জুটবে কীর্তন গেয়ে?
একটু বেশি রোজগার তাকে ভাবতেই হচ্ছে। শরীর কুলোয় বা না-কুলোয় তেলহীন সলতের মতো দপ দপ করে নিভে যেতে সে পারে না! পারবে না।
দু মুঠো চাল যোগাড় না-হলে পঙ্গু মানুষটা উপবাসী থাকবে...

শুক্রবার, ২০ আগস্ট, ২০১০

জ্যোৎস্নামানুষ : একজন জড়ুয়া ভাইয়ের গল্প

by Kulada Roy on Thursday, August 19, 2010 at 1:58pm

আমার ভাই মুহাম্মদ এনামূল হক। মাঝারী গড়ন। স্বাস্থ্য ভাল। ইন্টারিমডিয়েট পাশ। তিনি জেলখানায় ছিলেন দীর্ঘদিন। অপরাধ জাসদ করতেন। আমাদের পরিবারের কেউ জাসদ করত না। সময় নেই। তবু বঙ্গবন্ধু কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে একটি প্যানেল হল। ওদের লোকজন কম। আমার দাদার নাম একদিন বড় করে লিখে দিল দেওয়ালে। অন্য রকম কাণ্ড।

এ সময় কজন সত্যিকারের পাগলের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব ছিল। ওরা দিনের বেলায় আমাকে চিনত না। সন্ধ্যে হলেই আমি তাদের রামের ভাই লক্ষ্মণ। পাগলে পাগলে পাগলতুতু ভাই। রোগা পটকা আর হতচ্ছাড়া ছেলের সঙ্গে কোন ভাল মানুষের পো বন্ধুত্ব করে? খেয়ে দেয়ে তাদের কাজ নেই!

সে সময় মানুষের কাছে চেয়ে-চিন্তে দশটি টাকা যোগাড় করা যেত। টাউন প্রেসে তখন নিয়মিত মাছি পড়ে। মালিক রোগা পটকা মানুষ। তিনি বসে বসে সত্য ধর্মের একটি কঠিন বই পড়েন। জগৎ সৃষ্টির কথা, মানুষ ও ঈশ্বর, আমরা কেন বেদনার্ত হই, মরনের পরে আমার স্থুল দেহ পরমাত্মায় মেলে কিনা ইত্যাদি ইত্যাদি। তিনি খুব ধীরে ধীরে যত্ন নিয়ে কম্পোজ করেন। সকাল সাড়ে নটায় আর সোয়া চারটায় তার বড় মেয়েটি প্রেসের ভিতর দিয়ে যাওয়া আসা করত। পরণে স্কুল ড্রেস। আর কখনো দেখা যায় নি। শোনা যায় মেয়েটি গণিতে ভাল ছিল। ওর নাম ছিল শিখা। একদিন পোস্টারে দেখেছি। এই সময় থেকেই আমার মাথায় 'প্রেস ও দর্শন তত্ত্বের অভেদানন্দ' শিরোণামে একটি রচনা ঢুকে বসে আছে। সময় পেলে লিখব।

এই টাউন প্রেস থেকেই একটি দু'ভাজ কবিতাপত্র বের হত নিয়মিত। নাম—রূপোলী ফিতে। প্রীতি ও বন্ধুত্বের বিনিময়ে প্রকাশিত। পশ্চিমবঙ্গের অভিজিৎ ঘোষ আর নির্মল হালদার নামে দুজন কবি কবিতা পাঠাতেন। অভিজিৎ ঘোষের একটি বিখ্যাত ছিল—শুখা রুটি রোজগারে কাটে দিন মান। রুটি আমাদের খুব প্রিয় ছিল বলে মাঝে মাঝে গুড় দিয়ে খাওয়া হত। এই ইতিহাসখ্যাত রূপোলী ফিতের সম্পাদক--মুদিপুত্র অধমানন্দ, আর কবিপুত্র রেজা পল্টু। আকিকাঅনুসারে নাম রেজা সাইফুল ইসলাম পল্টু। স্কুলের নাম ছিল সহিদুল ইসলাম। এটা আমরা কেউ জানতাম না। সার্টিফিকেট জানত। তবে কবিতার নাম ছিল প্রতিক সাইফুল। আর্ট শিখেছিল ঢাকা চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে। ১৯৯৪ সাল থেকে প্রতিক সাইফুল প্রমোশন পেয়ে পূর্ণ সম্পাদক হিসাবে রূপোলী ফিতে বের করছে পরলোক স্ট্রিট থেকে। বেশ নাম ডাক আছে তার।

একদিন রূপোলী ফিতে হাতে একজন লোক আমাকে বটতলার শেকড়বাকড় থেকে খুঁজে বের করলেন। কবিতাপত্রটি দেখিয়ে বললেন, এগুলো কি?
--কবিতা।
--কবিতা কি জিনিস জানো?
--আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে,
বৈশাখ মাসে তার হাটু জল থাকে।
--হা হা হা। শুনিল গাঙুলির নাম শুনেছ?
--ব্যাংক পাড়ার শুনিল উকিল?

মডেল স্কুলের শিক্ষক ছিলেন শুনিল কুমার দাশ। ছাত্র ইউনিয়ন করতেন। পরে ন্যাপ। ছাত্রদের নিয়ে রবীন্দ্র শতবার্ষিকী করার অপরাধে মডেল স্কুল থেকে বিদায় করে দেওয়া হয়েছিল। তাঁর বিরুদ্ধে কেস টেস হয়। অভিমান করে তিনি আর অন্য কোনো স্কুলের মাস্টারী নেন নি। কেসে পড়ে নিজেই হয়ে গেলেন বিশিষ্ট উকিল। পাদ্মপুকুর পাড়ে তাদের বাসা। সামনে ছোট মাঠ। কয়েকটি আমগাছ। এ গাছগুলিতে কোনদিন বোল আসে নি। পাতাগুলো সুস্নিগ্ধ। এর পাশে একটি সরু রাস্তা। ওপারে টিনের ঘর। সামনে লাগানো সাদা রঙ দিয়ে লেখা একটি সাইনবোর্ড—শুনিল কুমার দাশ, বি.এ। এ্যাডভোকেট। এইখান থেকে নাপিত পাড়া শুরু। তিনি নাপিত, শুদ্র, কায়স্ত, ব্রাহ্মণ ও মুসলমান লোকজনেরও উকিল। এই শুনিল উকিলকে নিয়ে একটি কবিতা প্রচারিত ছিল। তার দুলাইন নিম্নরূপ--

শুনিল বাবুর কুড়ে ঘর।
ভাইঙা চুইরা নৌকা ভর।।

কিন্তু শুনিল বাবু নিজে কবিতা লেখেন এরকম জনশ্রুতি ছিল না। লোকটি শোনালেন। তেত্রিশ বছর কাটল—কেউ কথা রাখে নি। এবং তার পর ছেলেবেলার এক বোষ্টমীর উল্লেখ আছে। আছে বোষ্টমী আগমনীর গানের কথা। মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ার জোগাড়।

লোকটির নাম মুহাম্মদ এনামুল হক। ডাক নাম মেহেদী। এটা ২০ বছর পরে আবিষ্কৃত হবে । তার বয়স ছিল উনত্রিশ। তেত্রিশ বছর কাটল কবিতাটির আধখানা তিনি মুখস্ত বলেছিলেন। বাকীটুকু শোনার জন্য পিছনে পিছনে ছুটতে হল। শহর থেকে মাইল চারেক দূরে। মধুমতির পাড়ে—ফকিরকান্দি গ্রাম। গ্রামটির গাছে গাছে পাখি ডাকে। হাওয়া শিরশির করে বয়। আকাশ মাঝে মাঝে নিচু হয়ে আসে। বলে, অবনী বাড়ি আছ? মধুমতি নদীটি তখনো বাড়িতেই ছিল। কিছুটা পাগল প্রায়। বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে। এর পাশে একটি রাস্তা এক বেঁকে সোজা চলে গেছে শিখাদের চুলের ফিতার মত। এই রাস্তায় শব্দ করে টেম্পু চলে। মৎসবাজার টু হরিদাশপুর।

ফকিরকান্দি গ্রামে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে হল। তিনি গাছপালার মধ্যে ঢুকে গেলেন। আর কোনো লোকজন এলো না। শুধু মাটি ফুঁড়ে একজন ফকির এসে বললেন, বাবা, আখের নষ্ট করছ কেন?

--আখের গুড়?
--না বাবা, আখেরাত। কপাল। অদেরেষ্ট। কপাল নষ্ট করলি আর কি থাকে রে, বাবা!

কিছুক্ষণ পরে একটি বই হাতে মুহাম্মদ এনামুল হক ফিরে এলেন। আর ফকির লোকটি হাওয়া। শুনিল গঙ্গোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা। পদ্মপুকুরের শুনিল উকিল নয়। তিনি বইটির পাতা থেকে কবিতাটির বাকীটুকু পড়ে শোনালেন—আমাদেরকে দেখিয়ে দেখিয়ে লাঠি লজেন্স চুষেছে লস্কর বাড়ির ছেলেরা। সুবর্ণ কঙ্কন পরা ফর্শা রমণীরা কত রকম আমোদের হেসেছে। তার দিকে কেউ ফিরেও তাকায় নি। এ কবিতা শুনে মনে হল—সোনার চুড়ি পরা ফর্শা মেয়েরা ভাল নয়। বেশ নিষ্ঠুর। কখনো সুযোগ পেলে বকে দিতে হবে।

সে সময় মেয়েরা ফর্শা কি অফর্শা—এরকম বিচারআচার বোধটি হয় নি। শুধু পোস্টার পড়লে বোঝা যেত—কারো কারো ফর্শা হওয়া খুব ভাল কাজ। আর কালিবাড়ি গেলে কাল ভাল লাগে। কাল মানে সময়। টাইম। কালে খায় আমাদের কাল।

তবে কবিতাটি থেকে বোঝা গেল, পৃথিবীতে মেয়েদের দুটি শ্রেণী আছে। এক শ্রেণী হাতে সোনার চুড়ি পরে। অন্য শ্রেণী পরে না। তাদের হাতে হারিকেন আর মাঝে মাঝে কাঁচের চুড়ি। এজন্য তাদের চলতে হয় ভয়ে ভয়ে। এই সোনার চুড়ি আর কাঁচের চুড়ি নিয়ে কিছু ঝামেলা আছে। একে বলা হয় শ্রেণী দ্বন্দ্ব।
--এর জন্য কি দরকার?
--শ্রেণী সংগ্রাম।
--তারপর?
--বিপ্লব।
--বিপ্লব দিয়ে কি হবে?
-- সমাজতন্ত্র হবে। তবে যে সে সমাজতন্ত্র নয়—বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র। বলেছেন সিরাজুল আলম খান। সবার দাদা ভাই। ওনার তুল্য আর বিপ্লবী নাই এ ভবে। লম্বা ফিনফিনে চুল। আর দাড়ি। চক্ষু টানাটানা।

এগুলো খুব কঠিন বিষয়। কিন্তু শুনিল গঙ্গোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলি সহজ। নীল পদ্মর কথা আছে। বরুণা নামে কোন একটি স্বাস্থ্যবতী মেয়ের কথা আছে। একটি খ্যাপা গরুর কথাও আছে। বইটি কখনো হাতে পাই না। তিনি হাত ছাড়া করেন না। কখনো হাতে, কখনো ব্যাগে, কখনো বগলে রাখেন। হেঁটে হেঁটে চলে যান ছোট শহরের এ গলি থেকে ও গলিতে। তখন কলাপাতা নড়ে চড়ে—আমপাতা ঝরে পড়ে। আর কোন কোন দরোজায় টুক টুক করেন। যারা খুলে দেন তাদের তিনি পড়ে শোনান তেত্রিশ বছর কাটল কবিতাটি। শুরুটা একটু কঠিন কঠিন স্বরে। শেষ দিকে ধরা গলায়। শ্লেষ্মা জড়িয়ে আসে। আর আমাদের মাথা কখনো ছাদ, কখনো টিনের চাল ফুড়ে আকাশ স্পর্শ করে। টের পাই রোদ ঘুরে যায় দূরে দুরে। বেদনাহত। সন্ধ্যে হয়। তিনি ফিরে যান ফকিরকান্দি। আমি খাটরায়। উদয়ন পাড়ায়। পুরনো বটতলায়।

এইভাবে তিনি আমার ভাই হয়ে যান। তাকে বলি, এনামুলদা। জড়ুয়া কি ভাই। দুপুরে এক সঙ্গে ভাত খাই। পাঁচ ফোঁড়ন দিয়ে মা পাতে ঢেলে দেন গরম গরম মুসুরীর ডাল। খেয়ে দেয়ে দুভাই কবিতা পড়ি। ভাবি, লস্করবাড়িতে একদিন ঢোকা যাবে। এনামুলদা ফর্শা রমণীদের কবিতা শোনাবেন। আমি শুধু বকে দেব। তার জন্য আমাদের একটু অপেক্ষা করতে হবে। অপেক্ষা করা মন্দ নয়। এনামুলদা এটা খুব ভাল করে জানেন। দীর্ঘকাল জেলখানায় থেকে এইসব গুঢ় কথা জেনেছেন তিনি। আমাদের ছোট শহরে তার মত করে আর কে জানবে?

ঠিক এইখানে এসে হেসে ফেলেন আমার জড়ুয়া ভাই মুহাম্মদ এনামুল হক। খিন্ন-কিষ্ট হাসি। মাঝে শুনতে পেয়েছিলেন—জাসদের দাদাভাই নেই—মাঝে মাঝে কি এক থিসিস লিখতে মার্কিন দেশে তাকে যেতে হয়। আর হাওয়া খেতে হয়। ধানমণ্ডির লেকের হাওয়া তার জন্য স্বাস্থ্যকর। মাথার চুল সাদা। ফিনফিনে দাড়ি হাওয়ায় ওড়ে। দাদাভাইয়ের কথা আর কিছু শোনেন না। মনে রাখেন বিপ্লবের আসতে একটু দেরী হবে। বিপ্লব ক্লান্ত হয়ে সামান্য ঘুমিয়ে নিচ্ছে। গরমের দিন বলে তাঁর এসি ছাড়া চলে না। তবু বিপ্লব তুমি এসো। অনেকগুলো তেত্রিশ বছর কাটল। তোমারক কিন্তু কথা রাখতে হবে সত্যি সত্যি। এনামুলদার কাছে কোন ধানাই পানাই নট। নাহলে এতগুলো বছর হাঁটছেন কেন পথে পথে একা একা?

এনামুলদার গোলগাল মুখটি। শুকিয়ে আসছে। শীত আসার আগে এরকম শুকনো ভাব জাগতে পারে। হাতে এখনো শুনিলের শ্রেষ্ঠ কবিতা। আস্তে ধীরে হেঁটে হেঁটে—আমাদের ছোট মফস্বল শহর থেকে—মৎসবাজার পেরিয়ে—বেদগ্রামের স্লুইজ গেট ছাড়িয়ে—কুয়াডাঙার তেল পাম্পটি পাশ কাটিয়ে তাকে ফিরতে হয় ফকিরকান্দি গ্রামে। এই গ্রামে রাত্রির অন্ধকার আকাশের জ্যোৎস্নার সঙ্গে একটু নত হয়ে মেশে। মাঝে মাঝে শোনা যায়--জ্যোৎস্না নামের একটি মেয়ে কি রমণী কি রূপকথা পথ দেখিয়ে চলে কোন এক মানুষকে।

তেত্রিশ বছর কাটল।
তাদের কথা কেউ রাখে না।



সচলায়তনের লিংক--
ফেসবুক-

পশ্চিম বঙ্গের কবি গৌতম চৌধুরী বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক মৌলবাদিদের সার্টিফিকেট কেন দিচ্ছেন? বিষয়টা কি??

by Kulada Roy on Tuesday, February 9, 2010 at 12:29pm


গৌতম চৌধুরী কবি। তার বাড়ি পশ্চিবঙ্গে। তিনি আমাকে মেইল করেছেন। বলেছেন- রাও ফরমান আলী খান : ঠাণ্ডা মাথার খুনি নোটের একজায়গায় লিখেছেন - "কিভাবে দৈনিক নয়া দিগন্তে ফরহাদ মজহার নামক লোকজন লেখেন- আবহমান বাঙালি চেতনা একটি ফ্যাসীবাদি চেতনা। " - দয়া ক'রে যদি ফ.ম-র ওই লেখাটি পড়ান, কৃতজ্ঞ রইব।

আমি একাত্তরের গণহত্যার কাপালিক রাও ফরমান আলি খানকে নিয়ে একটি নোট লিখেছিলাম। রাও ফরমান আলিরা শুধু ৩০ লক্ষ মানুষ হত্যা করেনি- তারা হাজার বছরের আবহমান বাঙালি জাতিকে ও চেতনাকে হত্যা করতে চেয়েছিল। এখনো তা শেষ হয়নি। নানাভাবে রাও ফরমান আলির চেলা চামুণ্ডারা এই কাজটি এখনো করে যাচ্ছে। ফরহাদ মজহার নামের কতিপয় জীবিত ভাঁড় এই কার্যক্রমকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কবি গৌতম চৌধুরী এটা বিশ্বাস করেননি। মনে করেছেন- আমি বোধহয় বানিয়ে বানিয়ে ‘অকথা-কুকথা’ বলেছি ফরহাদ মজহার সম্বন্ধে। তিনি বারবার আমাকে মেইল করে ফরহাদ মজহারের ওই লেখাটি চাচ্ছিলেন। আমার অত সময় নেই সবার অনুরোধ রক্ষা করার। কিন্তু গৌতম চৌধুরীর বারংবার অনুরোধে আমি লেখাটির লিংক পাঠালাম। এ সংক্রান্ত নানাজনের মন্তব্যের আরেকটি লিংকও তাকে দিলাম। তিনি সেটা পড়ে লিখলেন- ‘ফরহাদ মজহার হলেন জীবিত বাঙালি শ্রেষ্ঠ কবিদের মধ্যে একজন। ফরহাদ মজহার হলেন বিভাগোত্তর বাঙালি জাতির একজন শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ। সব বিষয়ে যে তাঁর সাথে সবাইকে সহমত হতে হবে, এমন মাথার দিব্যি কেউ দেয়নি। তবে তাঁর চিন্তাকাঠামোর মোকাবিলা করতে চাইলে তা তো করতে হবে চিন্তা দিয়েই। আকথা-কুকথা বলে উড়িয়ে দেবার মতো খড়কুটো তিনি নন ।’

ফরহাদ মজহারতো নিজেকে বাঙালি বলে স্বীকারই করেন না। তাকে কেন জীবিত বাঙালি শ্রেষ্ঠ কবিদের মধ্যে একজন বলছেন গৌতম চৌধুরী? ফরহাদ মজহার বাঙালি জাতীয়তাবাদকে ফ্যাসিবাদি হিসাবে স্পষ্টভাবে নির্দেশ করেছেন। তিনি বলেছেন, 'বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদ একনায়কতান্ত্রিক ক্ষমতা পরিগঠনের মধ্যে শুধু নয়, ছিল নৃতাত্ত্বিক বাঙালি জাতীয়তাবাদী ধারণায়, তথাকথিত ‘সমাজতন্ত্রে’ এবং নিরন্তর এক যুদ্ধংদেহি মনোভঙ্গির চর্চায়। ফ্যাসিবাদ মজুদ ছিল আমাদের সেই সকল ধ্যান, ধারণা, আকাংক্ষা ও আবেগের মধ্যে যাকে আমরা কোন দিনই সন্দেহ করি নি, সন্দেহ করতে শিখি নি।' (৭ জুন, ২০০৮, দৈনিক নয়া দিগন্ত)।

তিনি লিখেছেন- ‘মুক্তিযুদ্ধ এখনো আমাদের অধিকাংশের কাছে দুই নৃতাত্ত্বিক সম্প্রদায় ‘বাঙালি’ বনাম ‘পাঞ্জাবি’র লড়াই।’ একাত্তরের পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বীর বাঙালিদের অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করাকে তিনি ধিক্কার দিয়েছেন। বলেছেন- এই অস্ত্র ধারণের কারণে মুক্তিযুদ্ধের গৌরব ঢাকা পড়ে গিয়েছিল। ফরহাদের মতে- যুদ্ধের চেয়ে ‘একটি নির্যাতিত জনগোষ্ঠির প্রতি বে-ইনসাফি এবং নির্যাতিতের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার ইত্যাদি রাজনৈতিক প্রশ্নই ছিল মুখ্য’। অস্ত্রের চেয়ে তার মতে ‘নৈতিক শক্তিটাকে বড় করে দেখা দরকার ছিল’। কী মনে হয়- গান্ধী কথা বলছেন!!

প্রশ্ন হল- ফরহাদ মজহার ষাট দশকের সময় থেকে গান্ধিজীর অহিংস পাঠশালায় ভর্তি হননি। গলাকাটা রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তার নেতা সিরাজ সিকদার একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিলেও ফরহাদ মজহার তার বিরোধীতা করেন। তখন তিনি কোথায় ছিলেন? কুড়িয়ানার পেয়ারা বাগানে? সেখানে তাকে দেখা যায়নি। দেশ স্বাধীনের পরে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক বিপ্লবী হুমায়ূন কবীরের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। তার গুরু আহমদ ছফা তার ডাইরীতে একথা বলে গিয়েছিলেন ষ্পষ্টভাষায়- নূরুল আনোয়ারের সম্পাদনায় ২০০৪ সালে আহমদ ছফার ডায়েরি নামে একটা বইতে ছফা সাহেব লিখেছেন--
"ভাত খেলাম। কাপড় ধুয়ে দিলাম। ঘুমোলাম। মনওয়ার এবং মসি এসে জাগালো। মসি ছেলেটাকে আমি ভয়ঙ্কর অপছন্দ করি। মনে হয় ছেলেটা কি একটা মতলবে ঘুরছে। আমার ধারণা হুমায়ুনের মৃত্যুরহস্যটা সে জানে। দিনে দিনে এ ধারণাটা আমার মনে পরিষ্কার রূপ লাভ করছে। কেমন জানি মনে হয়, ছেলেটার হাতে রক্তের দাগ লেগে আছে। এ ধরনের ছেলেদের কি করে এড়িয়ে চলবো সেটা একটা সমস্যা। রেবুদের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে সম্ভবত। এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত করতে পারিনি। আশা করছি এরই মধ্যে নতুন কোনো তথ্য জেনে যাবো। ফরহাদ মজহারের আমেরিকা পলায়ন, সালেহার সঙ্গে স্বামীর পুনর্মিলন এসবের সঙ্গে বোধ হয় হুমায়ুনের মৃত্যুর একটা সম্পর্ক জড়িত রয়েছে।

আহমদ ছফা আঁতকে উঠে এই গুরু মারা শিষ্য সম্পর্কে বলেছেন- ফরহাদ মজহার লোকটা সন্দেহজনক।

আমেরিকা পালিয়েছিলেন আরেক ছদ্মবেশী-সুবিধাবাদি সৈয়দ আলী আহসানের লেজ ধরে। সৈয়দ আলী আহসান সামরিক শাসক ও মৌলাবাদের চোঙ্গা ফুকাতেন। পাকস্তিান আমলে রবীন্দ্রবিরোধীতার পুরোধাঁ ছিলেন।

একাত্তরের পরাজিত শত্রু –ঘাতক জামায়াতে ইসলামী কিন্তু ফরহাদের এই কথাটাই বলে যে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ ছিল ভুল। ওটা ছিল ছিল ভায়ে ভায়ে দ্বন্দ্ব। ফরহাদ মজহার জামাতের কথাটা একটু আধুনিক ভাষায় কয়েছেন মাত্র। জামায়াত বাংলাদেশে জঙ্গীবাদের শ্রষ্টা ও মদদদাতা। এই জঙ্গীরা যখন সারা দেশে বোমাবাজি করেছে- তখন জামায়াতের আমীর বললেন- এই বোমাবাজি আসলে র এবং মোশাদের কাজকারবার। তাকে যখন প্রশ্ন করা হল- এ তথ্য কোথায় পেয়েছেন ? তখন নিজামী সাহেব বলে দিলেন কমরেড ফরহাদ মজহার এটা লিখেছেন। জামায়াতের তথ্য প্রণেতা হলেন ফরহাদ মজহার! জঙ্গিদের কর্মকাণ্ডকে তিনি ‘সন্ত্রাসী’ বলতে নারাজ। সে সময় জঙ্গীরা বিচাররকদের বোমা মেরে হত্যা করেছে। আর ফরহাদ মজহার এই হত্যাকারীদের সাফাই গেয়ে লিখেছেন- ‘নিজেদের জীবন ও জীবিকা রক্ষা করবার যে কোন লড়াই-সংগ্রামকে এখন অনায়াসেই ‘সন্ত্রাসী’ কর্মকাণ্ড হিশাবে আখ্যায়িত করা সহজ। আমরা তো চোখের সামনেই দেখছি আদালত মানুষের মানবাধিকার রক্ষা করছে না।’

বিগত নির্বাচনে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সারা দেশে প্রবল জনমত গড়ে ওঠে। সে সময় ফরহাদ মজহার ছিলেন বিএনপি-জামায়াত জোটের নির্বাচনী প্রচারের কর্মকর্তা। জঙ্গীবাদি সংগঠন হিজবুত তাহরীর একজন নেতা হলেন এই ‘সর্ব শ্রেষ্ঠ জীবিত বাঙালি কবি ফরহাদ মজহার। হিজবুৎ তাহরী এখন বাংলাদেশে একটি নিষিদ্ধ সংগঠন। জামায়াতের পত্রিকা দৈনিক নয়া দিগন্তের নিয়নিত লেখক হলেন ফরহাদ মজহার।

আর চিন্তাবিদ? রবীন্দ্রনাথকে অতিশয় হিন্দু এবং জমিদার বলে গালিগালাজ দিয়ে নিজেই রবীন্দ্র মজহার হতে গিয়ে ফেইল। কেউ তাকে পোছে না। তাই রেগে মেগে হতাশ হয়ে বললেন, নাহ, রবীন্দ্রনাথকে এড়ানো গেল না। তারপর তিনি লালন শাহকে রবীন্দ্রনাথের বিপরীতে দাঁড় করানোর চেষ্টা করলেন। করে নিজেই জীবিত সুফি উপাধি ধারণ করলেন। আর তার দল হিজবুত তাহরির যখন লালন ভাস্কর্য ভাঙতে লেগে গেল তখন এই সুফি চিন্তাবিদ টু শব্দটি করলেন না। বললেন, লালন ছিলেন কুতার্কিক। এই হল চিন্তার শ্রেষ্ঠ চিন্তার নমুণা।

ফরহাদ মজহারকে নিয়ে যত কম কথা বলা যায় ততই মঙ্গল। তার রয়েছে মৌলবাদিদের টাকা, জামায়াত-বিএনপির পৃষ্ঠপোষকতা, এনজিওর নামে মেরে দেওয়া বিদেশী অর্থ, বিপুল ব্যবসা বানিজ্য এবং গাড়ি-বাড়ি-নারী…। এবং কতিপয় ভাড়াতে পেশীবাজি মাস্তান-লেখক। এবং আন্তর্জাতিক কানেকশন। অধুনা পশ্চিম বঙ্গেও এরকম একটি কানেকশন তিনি দাঁড় করিয়েছেন বলে শোনা যায়।

ফরহাদের দায়িত্ব হল- তরুণ বুদ্ধিজীবীদের মগজ ধোলাই করা। তাদেরকে বলা যে-‘রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হত্যা, চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা রুদ্ধ করা, একদলীয় শাসন কায়েম ইত্যাদি নানান রাজনৈতিক নির্যাতন ও নিবর্তনমূলক শাসনের কারণে বাকশালী আমল ফ্যাসিবাদী আমল বলে গণ্য হয়।‘ বাকশাল বলতে তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকেও নির্দেশ করেন। বাকশাল বলাটা তার বাককৌশল। তার ভয়াবহতম প্রকল্প হল- বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানী ধারণায় সাম্প্রদায়িকীকরণ। জনাব ব্রাত্য রাইসু এন্ড গং প্রত্যক্ষভাবে এই দায়িত্ব পালন করছেন। ফরহাদ তরুণ প্রজন্মকে জামায়াতের প্রতি সহানুবূতিশীল করেগড়ে তুলতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এখান দেখা যাচ্ছে- তরুণ প্রজন্ম তাকে বুড়োর আঙুল দেখিয়ে দিয়েছে। জনগণ তার আদর্শের দল জামায়াত-বিএনপি'কে বিদায় করে দিয়েছে।

তাহলে পশ্চিম বঙ্গের কবি গৌতম চৌধুরী এইসব না জেনেই বলে ফেললেন- ‘ফরহাদ মজহার হলেন জীবিত বাঙালি শ্রেষ্ঠ কবিদের মধ্যে একজন। ফরহাদ মজহার হলেন বিভাগোত্তর বাঙালি জাতির একজন শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ’। বিষয়টা কি?
এক বন্ধু শুনে বললেন- ফরহাদ মজহার কবি! তাঁর কবিতা কে পড়ে এই বাংলাদেশে? তার কবিতা কি শ্রেষ্ঠ মানের কবিতা এবং জনপ্রিয় কবিতা? উত্তর শুনে পুরান ঢাকার ঘোড়াও হেসে উঠবে।

এখন গৌতম চৌধুরী এই একাত্তরের খুনীদের মুখোশ ফরহাদ মজহারকে শ্রেষ্ঠত্বের সার্টিফিকেট কেন দিলেন? পারলে ফরহাদ মজহারতো তার ঈমানী বাহিনী নিয়ে পশ্চিম বঙ্গের দাদাদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। আর তার পক্ষে গৌতম চৌধুরী! ফেসবুকে দেখেছি- গৌতম চৌধুরী পশ্চিম বঙ্গের এক কবির কবিতার পোস্ট দিয়েছেন। এর আগে তার নাম শুনিনি। না শোনাটা আমার অন্যায় নয়। পাঠক হিসাবে আমি দুর্বল। কিছুদিন আগে কবি রণজিৎ দাশ ফরহাদ মজহারের অন্যতম স্বজন সাজ্জাদ শরীফের সঙ্গে ফরহাদীয় শ্রেষ্ঠ কবিতা সংকলন করেছেন। কবি জয়দেব বসু জানুয়ারি মাসে সগৌতম চৌধুরী বাংলাদেশ ভ্রমণ করেছেন। তাদেরকে বাংলাদেশে নিয়ে গিয়েছিলেন অগ্রবীজের অন্যতম সম্পাদক মার্কিন মুলুকের সৌম্য দাশগুপ্ত। ভিডিওতে দেখেছি কবি ফরিদ কবিরের সঙ্গে আছেন গৌতম চৌধুরী। ফরিদ কবির সাজ্জাদ শরীফের আপন ভাই। ফরহাদ মজহারের লোকজনের সঙ্গে বাংলাদেশে তারা ফরহাদীয় নানা কিসিমের আয়োজনে ছিলেন। থাকুন- এটা নিয়ে কারো মাথা ব্যথা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু যখন এরা ছদ্ম বুদ্ধিজীবী মৌলবাদিদের সার্টিফিকেট দেন- তখন কিন্তু মাথা ব্যথা হয়। মাথার ভিতরে সেই পুরানো পাখি বলে ওঠে- এরা ভাড়াটে। এদের অনেকেই পশ্চিম বঙ্গে আছেন অভাবে-স্বভাবে। বাংলাদেশের কেউ ইশারা করলেই নাচতে নাচতে তারা এসে পড়ছেন। বাহ্যজ্ঞান শুন্য দশায় যা বলতে বলছে তাদের ভাড়াকারী বুদ্ধিবৃত্তিক মৌলবাদিচক্র- তারা তা অবলীলায় হড়বড় করে উগরে দিচ্ছেন।

কী বলেন পশ্চিম বঙ্গের কবি গৌতম চৌধুরী?


.....................
ফেসবুকের লিংক পড়ুন-

কোথাও মায়া লাগিয়া রহিয়াছে

by Kulada Roy on Monday, February 1, 2010 at 10:18pm


লিখে লাভ কি?
এই প্রশ্নটি মাঝে মাঝে ভাবি। ভাবি, লেখাটি না হলে কী ক্ষতি হত!

আমি একটি গাছের নিচে দাঁড়াই। গাছটির পাতা নাই। গান নাই। বাকলগুলো তীব্র শীতে ফেটে গেছে। ফাঁকে ফোঁকরে তুষার জমে আছে। গাছটিকে প্রশ্ন করি, ও গাছ- গাছ হয়ে তোমার লাভ কি?
গাছটি কিছু বলে না। একটি কাঠবিড়ালি সুড় সুড় করে বাকল বেয়ে উপরে উঠে যায়। আবার নেমে আসে। পিটপিট করে তাকায়। গাছের ফোঁকরে ঢুকে পড়ে। হারিয়ে যায়। এই ফোঁকরটি না থাকলে কি ক্ষতি হত?

এইসব গুহ্য তত্ত্ব। তত্ত্ব এলে মাথা তপ্ত হয়ে ওঠে। হাসফাঁস করি। সামনের পুকুরটির উপর কে জানি সাদা রং ঢেলে গেছে। রোদ পড়ে চিকচিক করছে। কয়েকটি হাঁস ভেসে বেড়ায় এইখানে । আজ হাঁসগুলি নেই। থৈ থে জলে মাছ ধরতে ভাল লাগে। ঝুঁকে দেখি, কয়েকটি পালক পুকুরে আধখানি ঢুবে আছে। বলছে, আয় না। আয়। একটু একটু করে পা বাড়াই। কাঁপতে কাঁপতে বাম পাটি রাখি জলের উপরে। সাদার উপরে। ভাবি, এইবার ডুবে যাব। ডুবে গেলে কী ক্ষতি? কী লাভ মাটি উপরে দাঁড়িয়ে থেকে! আকাশ দেখা? তারার আলোতে ব্যাকুল হয়ে ওঠা। নেত্রজল মেলে দেওয়া। কোথাও মায়া লাগিয়া রহিয়াছে।

এইসব ভাবলে জলের উপরে হাঁটা যায়। হেঁটে হেঁটে পালকের গায়ে হাত রাখি। কান পাতি। এইখানে কোথাও মাছ ছিল। এখন নেই। মাছ- আমাদের হৃদয়ের মৎসকুমারী বোন- তোমরা এখন কোথায়? হাহাকার করতে করতে আমি জলের উপর দিয়ে ছুটে বেড়াই। ক্লান্ত হয়ে জলের উপর বসে পড়ি। জলকে জলের মত ভেবেছি। পদ্মপাতায় জলদেবী বসে। জল, তুমি জল হলে না কেন?

২.
বহুদিন আগে একটি উপন্যাস পড়েছিলাম। পূর্ণেন্দু পত্রীর। নাম মনে নেই। সেখানে শালতি বেয়ে লোকজন চলাচল করে। জলের উপর ছপ ছপ শব্দ হয়। বহুদিন আমিও শালতি বেয়ে চলে গেছি বহুদূরে। ফিসফিস করে পত্রীকে বলেছি, ওকে ডেকে দাও। মালতীদিদির কাছে যাব। মেয়েটির নাম কি মালতিদিদি? অথবা মাধবী? এইসব মনে নেই। মালতিদিদির শালতির কথা মনে আছে। আর ছোট ছোট ঢেউয়ের মর্মগুলি।

নিশিকুটুম্ব পড়ে মনোজ বসু হয়ে উঠেছিলেন আমার বাড়ির দাদা। এই দাদাটি বলছেন সাহেবের কথা। সারারাত্রি ভর সাহেব ঘুরে বেড়াচ্ছে ঘর থেকে ঘরে। অদ্ভুৎ মেদুর ছোঁয়ায় তার হাতে উঠে আসছে সদ্য বিবাহিত নায়রী মেয়েটির সোনার হারটি, নাকফুল। অথবা কানপাশাটি। ভোরের আলোয় নৌকাটি চলে যাচ্ছে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। সাহেব ঘুমিয়ে আছে। শান্ত ঘুম। এই নৌকাটির ছায়া আমাদের চোখের উপরে লেখে আছে। বাতাসের আগে ছুটে চলে। ধরার বাইরে। ছোঁয়ার বাইরে।

ডিঙি নাওটিতে বহুবার উঠেছি। তখনো ভোর হয়নি। ন'মামা বলছে, কেউ ডাকলে সাড়া দিবি না। কে ডাকবে? শুনছি ছোট ছোট শব্দ। কোচের ফলাটির। আর ডিঙির গুরার ফাঁকে জমে উঠছে লবটুলি মাছ।
আমার ডিঙি নাওটি-ই কি কোষা নাও?


৩.
একজন বুড়ো লোক সখ করে কোষা নাওটি বানাচ্ছেন। আর তার নাতিপুতি সুপুরির খোলে চড়ে খেলছে ধুলোর ভিতরে। আর মাঝে মাঝে অধীর হয়ে অপেক্ষা করছে কখন নাওটি জলে ভাসবে। বুড়ো লোকটির কোষা নাওটি পূর্ণ হয়েছে বটে- তবে আলকাতরা লেপার পয়সাটি নেই। গাবের কষ মাখা হল তো জলে ভাসানোর বাতাসা কবে আসবে এই নিয়ে অনেক যত্নের অপেক্ষা আছে। যেদিন বাতাসা এল- আমরা দেখতে পাচ্ছি- কোষাটি জলে ভাসছে। লগি ধরেছেন বুড়ো দাদাজান। আর চড়ে বসেছে কয়েকজন আমরা মানুষ। এরা ভাসতে ভাসতে শাপলা তুলছে। সূর্য ডুবে যাচ্ছে। অন্ধকার ঘিরে আসছে। এ অন্ধকার না এলে কী ক্ষতি হত? তবু অন্ধকার এসেছে। আমরা মানুষের মধ্যে একটি বালককে দেখতে পাচ্ছি- জলের উপরে হাত রেখেছে। রাখতে রাখতে সেও জলের মত শান্ত হয়ে গেছে। খুব শান্ত। এই চন্দন নামের বালকটি আর কখনো ফিরে আসেনি কোষাটিতে। কিন্তু বারবার ফিরে এসেছে আমাদের মনে। দাদাজানের মনে। আর তাই স্তব্দ হয়ে গেল সকলের জলে ভাসা। জলের মত ঘুরে ঘুরে কথা বলা।
আবার একদিন দাদাজান আমাদের ডেকে নিলেন। দেখতে পাচ্ছি তিনি কোষাটিকে ভাসিয়েছেন জলে। আলোর মধ্যে দিয়ে। অন্ধকারের ভিতর দিয়ে। আর ভাসিয়ে দিয়েছেন সেই আমাদের বাইরে চলে যাওয়া চন্দনকে। ছোট ছোট হাহাকারকে। আমরা এই কোষাটির সঙ্গে ভাসতে ভাসতে বুঝতে পারি- কোথাও মায়া লেগে আছে।

৪. শাদামাটা গল্পটি। নিরাভরণ বর্ণনা। কোথাও কোন গল্প জেগে ওঠে না। গল্পের কোন সম্ভাবনাও উঁকি দেখা যায় না। একটি গল্পহীনতার মধ্য দিয়ে আমদের নির্বান্ধব যাত্রা শুরু হয়। কেউ কোথাও নেই। বুঝতে পারি- গল্প ভেঙে দেওয়ার যাদু আমাদের মাথার ভিতরে নীলকণ্ঠ পাখির মত ডাক দিয়ে যাচ্ছে। সাই সাই করে। কোন এক সম্ভাবনার অসীম আকাশে। জল রঙের মত। অস্পষ্ট। রহস্যময়। অপার। প্রাণের মত সৌম্য। নিখিল। তাকে কে এড়াবে এখন?

এই গল্পটি পাপড়ি রহমানের। নাম কোষা। এই না-গল্পের গল্পগুলো নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে এবারের বইমেলায় ধূলিচিত্রিত দৃশ্যাবলি। ধুলি সরিয়ে সরিয়ে এই দৃশ্যাবলি পড়তে পড়তে ভাবি, কী লাভ হত গল্পটি না লিখে? না ভেবে! জলকে জলের মত না ভেবে!


ধূলিচিত্রিত দৃশ্যাবলি
পাপড়ি রহমান
আমার প্রকাশনী

জহির রায়হান : অন্তর্ধান বিষয়ে ১৯৭২ সালের একটি লেখা

সাংবাদিক পার্থ চট্টোপাধ্যায় জহির রায়হানের সঙ্গে দেখা করেন তাঁদের কায়েৎটুলির বাসায়। ১৩ ডিসেম্বর তার অগ্রজ শহীদুল্লাহ কায়সারকে দুপুরবেলা আল বদর বাহিনী ধরে নিয়ে যায়। ১৪ ডিসেম্বর তাকে হত্যা করা হয়। বাড়ির প্রত্যেকের মত জহির রায়হানও এ হত্যাকাণ্ডকে মেনে নিতে পারেননি। তিনি পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে বললেন, আমার বিশ্বাস দাদা এখনো বেঁচে আছেন। বউদিও তাই বিশ্বাস করেন। কিন্তু সম্ভব-অসম্ভব অনেক জায়গায়তো খোঁজাখুঁজি করছি--
-মৃতদেহ কি শনাক্ত করতে পারেননি?
--আন্দাজে শনাক্ত করা হয়েছে। ডেডবডিগুলো এমন বিকৃত হয়ে আছে যে কিছু বোঝা মুশকিল। তাই এখনো সকলের মনে ক্ষীণ আশা তিনি বেঁচে আছেন।
--কারা কারা এই ঘটনায় জড়িত কিছু ধরতে পারলেন?
--একজনকে পাওয়া গিয়েছে। সে স্বীকার করেছে যে সে কালপ্রিটদের চেনে। নামও বলেছে। কিন্তু তাদের কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না।

... এর কয়েকদিন পরে জহির রায়হান একটি ফোন পান। তাঁকে জানানো হয়, তাঁর দাদা শহীদুল্লাহ কায়সারকে মীরপুরে আটকে রাখা হয়েছে। তিনি মীরপুরে চলে যান। এরপর জহীর রায়হানকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। সেদিন ছিল ৩০ জানুয়ারি, ১৯৭২।
পার্থ চট্টোপাধ্যায় লিখছেন, জহির রায়হান প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, যে সাম্প্রদায়িক চক্র ঢাকার বুদ্ধিজীবী হত্যার পিছনে দায়ী তাদের তিনি নির্মূল করবেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি ঢাকায় বুদ্ধিজীবী নিধন অনুসন্ধান কমিটি স্থাপন করেন। কমিটির অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন, 'হলিডে' কাগজের সম্পাদক এনায়েতুল্লাহ খান।
এই বুদ্ধিজীবী অনুসন্ধান কমিটির অফিস হয়েছিল ঢাকা প্রেসক্লাবে।

জহির একদিন আমাকে বলেছিলেন, প্রেস ক্লাবে আসুন। বহু চাঞ্চল্যকর তথ্য উদ্ধার করেছি। আপনাকে দেখাব।
আমি বলেছিলাম, এখন কি আর কাউকে খুজে পাবেন? এসব পণ্ডশ্রম হচ্ছে আপনার। আর তা ছাড়া স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলি ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে গেছে। আর তারা কোনোদিন মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। যা মারা গেছে তাকে কেন আবার খুঁচিয়ে তুলবেন।
জহির বলেছিলেন, এখানে আপনার সঙ্গে আমি একমত নই। যারা বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী তারা সাময়িকভাবে গা ঢাকা দিয়েছে বটে, কিন্তু তারা বাইরে কোথাও যায়নি। এই দেশেই আছে। আবার ঐক্যবদ্ধ হতে চেষ্টা করছে। আপনি ভাববেন না, সাম্প্রদায়িক শক্তি চিরদিনে মতো খতম হয়ে গিয়েছে।
জহির বলেছিলেন, আপনাকে আমি ওদের গোপন লিফলেট দেখাব। তাতে ওরা লিখেছে, আমাদের সংগ্রাম শেষ হয়নি--সবে শুরু। আপনি প্রেসক্লাবে আসবেন, বহু দলিল দেখাব।
নামধাম ঠিকানা সব পেয়েছি--তাদের কিছুতেই নিষ্কৃতি দেওয়া হবে না--আই স্যাল ফাইট আনটু দি লাস্ট।


প্রেসক্লাবে গিয়েছিলাম নির্ধারিত সময়ে। কিন্তু যথারীতি জহির সেদিনও কথা রাখেননি। আলাপ হল এনায়েতুল্লাহর সঙ্গে। আমাকে বললেন, কাগজপত্র সবতো জহিরের কাছ।...
সাম্প্রদায়িক চক্র সম্পর্কে জহির রায়হান বহু তথ্য উদ্ধার করেছিলেন। এ কাজেই তার কাল হল। তিনিও নিখোঁজ হলেন। ম্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের হাতে তাদের সবচেয়ে বড়ো শত্রুর জীবন এভাবেই শেষ হয়ে গেল।''

জামায়াতের পত্রিকা দৈনিক নয়া দিগন্ত আর দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকা জহির রায়হানের অন্তর্ধান দিবস উপলক্ষ্যে নিবন্ধ ছেপেছে। সেখানে তারা বলার চেষ্টা করেছে- জহির রায়হানের হত্যাকাণ্ডের পেছনে তৎকালীন আওয়ামী লীগের ষড়যন্ত্র ছিল এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহায়তায় তাকে শেষ করে দেওয়া হয়। এমনকি তারা বঙ্গবন্ধুকেও তারা দায়ী করার চেষ্টা করেছে। জামায়াতের এই অপপ্রচারের জবাবে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের লেখাটি পড়ে মনে হল, সব সত্যকে চাপা দেওয়া যায় না। অনেক সৎ দলিল রয়ে গেছে ঘাতকদের সমুচিৎ জবাব দেওয়ার জন্য। সেগুলো খুঁজে বের করা দরকার।

নোট :
সাংবাদিক পার্থ চট্টোপাধ্যায় ১৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১ ঢাকা পৌঁছান। তারপর পাঁচমাস তিনি ঢাকায় থেকে যান। সেই সময়কার লেখা ডেটলাইন ঢাকা নামে উল্টোরথ পত্রিকায় সেসময় ছাপা হয়েছিল। পরে ২০০৪ সালে পুনশ্চ প্রকাশন, ৯এ, নবীন কুণ্ডু লেন, কলকাতা থেকে বই আকারে বের হয়।

সাংবাদিকের ডায়েরি
পার্থ চট্টোপাধ্যায়
মূল্য ১৫০ টাকা


by Kulada Roy on Friday, January 29, 2010 at 10:19pm

লিংক :
জহির রায়হান : অন্তর্ধান বিষয়ে ১৯৭২ সালের একটি লেখা
ফেসবুক লিংক

গল্প লেখার গল্পটি

আমাকে বিপদে ফেলেছেন তিনজন। ডোবার ব্যাঙ, অমি রহমান পিয়াল এবং নুরুজ্জামান মানিক।
এদের কাউকে আমি চিনি না। চেনার কথা নয়। আমি গ্রামে গ্রামে ঘুরছি। নদীতে নদীতে কাটিয়েছি। গাছপালার চিকিৎসাকর্ম কিছু জানা ছিল। লেখালেখির জগৎ নিয়ে কোন মাথাব্যথা ছিল না। এই লেখালেখি আমাকে খেল।

আমি শুদ্রবংশের ছেলে। টুকটাক লেখাপড়া আর বাপের ক্ষুদ্র ব্যবসাতি নিয়ে দিন কেটেছে। ১০০% জন্ম গৃহহীন। সেজন্য বিপ্লবের প্রতি ভরসা ছিল। বিপ্লব এলে সত্যিকারের মাথাগোজার ঠাঁই পাব। এই বিপ্লব ব্যাটাই আমাদের চোখের সামনে থেকে নাই হয়ে গেল। বার্লিন কোন সুদূরের দেশে। সেখানে একটি দেয়াল ভেঙে পড়ল। আর আমাদের বাংলাদেশের গণ্ডগ্রামের কয়েকটি হৃদয় তার নিচে চাপা পড়ল। সে রক্তপাত এখনো চলছে। হায়, ভ্লাদিমি ইলিস, তুমি কোথায়? তুমি অভিশপ্ত হও।

কবিতা লিখে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পেরেছিলাম। নদী নিয়ে কবিতাটি লেখা। ‘নদী মরে গেলে সত্য হারিয়ে যায়’। সেটা ১৯৮৪ সালের ঘটনা। এটাকে কবি মোহাম্মদ রফিক আর নির্মলেন্দু গুণ আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় সাংস্কৃতিক উৎসবের সেরা কবিতা নির্বাচন করেছিলেন। কয়েকজন কবিজনোচিত লোকজন আমাকে ঘুরে ঘুরে দেখলেন। আর বললেন, ধুস, একে দিয়ে হবে না। এ শালা গাজা খায় না। মদ খায় না। চা-ও খায় না। রাত বিরেতে হল্লা করে না। নদী টদি নিয়ে কবিতা লেখে। বাতিল।
আমি ভাই রোগাপটকা মানুষ। পকেটের চেহারা আরও খারাপ। দিন কেটে যায় একা একা। আধা খেয়ে- সাধা খেয়ে। এ রকম না খাওয়া পার্টির সঙ্গে দুএকবার সায়ংকালে ঘুরে ফিরে মাথার গোঁজার ঠাঁই হল। পরে দেখি- এরা স্টার সিগারেট টানে। আর বসে বসে ঝিমোয়। মাঝে মাঝে দুএকজন ডিম ভাজি খায়। খেতে খেতে তাদের বাড়ির সিংহ দরোজার গল্প করে। এখানে আমার মতো নাই-বাড়ির লোকজন খুবই অচল।

একটি মেয়ে একদিন আমাকে বলল, তুমি কবিতা লেখ?
আমি কিছু বলার আগেই নেতা ওকে ইশারা করে ডাকলেন। মার্কস এঙ্গেল আউড়ে বললেন, ওর কোনো ভবিষ্যৎ নেই। ও বিপ্লবের অচল মাল।
কিন্তু আমি তো সত্যি সত্যি বিপ্লবকে ভালবাসতাম। বিপ্লব এলে আমার জননী যে তুলসী তলায় প্রদীপ জ্বালে সেটা সত্যি আমার মায়ের হত। কেউ বলতে পারত না, এটা তোমাদের বাড়ি নয়। তোমরা সর্বহারা। আহা, বিপ্লব, তুমি কেন রেড স্কোয়ারে মুখ থুবড়ে পড়লে? কমরেড ফরহাদ, তোমার নামে প্রদীপগুলো নিভে যাক।

আমি তখন কবিতা লেখা ছেড়ে দিয়ে লোকজনের ফাইফরমাস খাটতে শুরু করেছি। এর মধ্যে এই সব ঝিম মারা বিপ্লবীরা কোন ফাঁকে আমার নামে একটা পোস্টার সেঁটে দিল- কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সাহিত্য সম্পাদক পদে এই গোবেচারাকে ভোট দিন। আমি এসব জানতেই পারিনি। আমি তখন মধুপুরের জলছত্রে। কুষ্ঠ আশ্রমের পাদ্রী মহাশয়দের সঙ্গে ঈশ্বরের বাক্য পাঠ করছি- আর প্রভুর দুই নম্বর মেষ হয়ে ফ্রি খাওয়া খাচ্ছি। কারা কারা যেন যথাযোগ্য লোক না পেয়ে আমার মতো গোবেচারাকে সিল পিটিয়ে দিল। ভোটগুলো জলে পড়েছে। ছাত্র সংসদ যে আগামী দিনের ঘড়ের মাল তৈরির কারখানা এটা বুঝতে আমার সময় লাগল না। সদাপ্রভু আমাকে রক্ষা করলেন। ওরা বলল, এই লোকটা চাঁদাবাজি ছাড়া বিপ্লব করতে চায়। হা হা হা। বেঁচে থাকুক তাহাদের এই হা হা হা।

কিছুদিন পরে একজন প্রফেসর জিজ্ঞেস করলেন, বৎস, তুমি এই নিউটনী কোটখানা কোথায় পাইয়াছ?
বলিলাম, আমার সঞ্জীব দিয়াছে।
-এই শার্টিটি কাহার?
-বাতেনের।
-এই ঢলঢলে প্যান্টটি?
-কোনো মাদামোয়াজেলের নহে আর্যে। উহাও একজন বন্ধু মাসুদের। তিনি কিঞ্চিৎ ফাউভোজী।
-মোকাসিনটি?
-মুচির দোকান হইতে ভাড়া লইয়াছি। দৈনিক পাঁচসিকা।
-মার দিয়া কেল্লা। প্রিয় ভদ্রে, তোমার প্রিয় কর্ম কি?
-ঝিমানো।
তিনি রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। বুকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, পারফেক্ট। সিভিল সার্ভিসের জন্য ইহার যোগ্য আর কেহ নাহি। যাও বেটা। উপজেলাজেলায় যাও। ঘাস কাটো।

আমি দীর্ঘ পনেরটি বছর গ্রমে গ্রামে ঘাস কেটে বেড়িয়েছি। এই ঘাসের বর্ণ আমার মর্মে গেঁথে গেল। আহা আর্যে, প্রফেসর এবিসিডি আপনার টাকে অতি সুচিক্কন ঘাস গজাক।

গজানোর আগেই সদাপ্রভু তার এই নাদান মেষশাবককে প্লেনে তুলে দিলেন। কহিলেন, ওহে বৎস, নয়ন মেলিয়া দ্যাখো- হুই যে হাডসন নদী। ইহার ভিতরে আমি হস্ত উত্তোলনপূর্বক দণ্ডায়মান হইয়া স্বপ্ন বিতরণ করিতেছি। চাহিবামাত্র বাহককে দিতে বাধ্য থাকিব।
স্বপ্ন দূর থেকে দেখা ভাল। কাছে গেলেই বিপদ। স্বপ্নকে দেখে বড় বিস্মিত হলাম। বিস্ময় ভাঙতে সোজা হাসপাতালে। ডাক্তার ধীরে ধীরে আমার কানে কানে কহিলের, প্রিয় বয়স্য, অচেতনে কি কহিয়াছ একটু বুঝাইয়া কহিবে কি? তিনি একটি টিপ রেকর্ডার চালাইয়া দিলেন। শুনি, কোন এক আমি কহিতেছি- রূপ নারাণের কূলে জেগে উঠিলাম। জানিলাম এ জগৎ স্বপ্ন নয়। সত্য যে কঠিন। কঠিনেরে ভালবাসিলাম। ডাক্তার অনেক কষ্টে এই কথাগুলি অনুবাদ করে তার দরোজায় টানিয়ে দিলেন। নিচে লিখেছেন আমার নাম। আঁতকে উঠলাম। বললাম, বেটা ভগুচগু, ওটা রবীন্দ্রনাথের কবিতা।
রভীন-ড্রন- নাট? উহাকে চিনি না। যে ব্যাটার নাম খটোমটো তাহাকে আমার দরকার নাই।
কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে আমার দরকার। জীবনের প্রতি পদে পদে দরকার। আকণ্ঠ যন্ত্রণায় ডুবে তিনি আনন্দ ছেঁকে এনেছেন। এ লোকটাই আমাকে বুঝেছেন।

এই সময় আমি হাঁটতে ভুলে গেলাম। খাওয়া দাওয়া ঘুম- বিলকুল গায়েব। কোথাও কোন ক্রন্দন নেই। শুধু আমার ভিতরে আছে। সেকি বাঁচার জন্য? না, মরে যাওয়ার জন্য –জানি না। শুধু জানি মাঝে মাঝে আমি মরে যেতাম। ডাক্তার তখন বলতেন, প্রিয় বয়স্য, দ্যাখো- তোমার মেয়েদের চেয়ে দ্যাখো। আমি তখন বেঁচে উঠতাম।
আমার মেয়ে দুটি শান্ত। ডাল খায়। ভাত খায়। ছোট মেয়েটি বলল, জানো বাবা, ক্যান্ডি খেতে আমার ভাল লাগে না। দাঁত নষ্ট হয়। বড়োটি নভেল লেখা শুরু করল। পাঁচশত পৃষ্ঠা লিখবে। এই ঢাউস নভেল প্রকাশিত হলে প্রকাশক অনেক ডলার দেবে। ডলার ছাড়া সংসার অচল। ঠিক এ সময় আমার স্ত্রী চাকরী হারাল।

আমি ধীরে ধীরে হাঁটতে শুরু করেছি। হেঁটে হেঁটে কাজে যাই। দেখতে পাই- আমি একা নই। দুইজন লোক। একজন অসীম যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে রাস্তা পার হচ্ছে। পিছন থেকে আরেকজন কানের কাছে বলেই যাচ্ছে- থেমো না। হাঁটো। হাঁটতে থাকো। সামনের মানুষটি আমি। পিছনের মানুষটিও আমি। দুজনেই ক্লান্ত। শ্রান্ত। অবসন্ন।


এইসব দিনে অনন্ত দুঃখের মধ্যে আমি একটি অক্ষর লিখি। লিখি দুটি অক্ষর। কাঁপতে কাঁপতে লিখি একটি শব্দ। পূর্ণ একটি বাক্য। মরে যেতে যেতে লিখি একটি পাতা। এক পাতার গল্প। দীর্ঘশ্বাসের। বেদনার।আর হাহাকারের।
কেন জানি ডোবার ব্যাঙ আরেকটি গল্পের আবদার করে বসলেন। তার ভঙ্গিটি আমাকে আরেকটি গল্প লেখাল। ডাক্তার দেখেশুনে বললেন, ওকে। চালিয়ে যাও। থেম না। আমার মেয়ে দুটি আমার পাশে বসে লিখতে শুরু করে দিল। লিখতে লিখতে বলল, বাবা, লেখ বাবা।
লিখতে লিখতে দেখি, আমাকেই লিখছি। লেখার মধ্যে দিয়ে কোন এক আমি উঠে আসছে। ছেঁড়া খোঁড়া। পরাজিত। শুদ্র মানুষ। গৃহহীন মানুষ।

অমি রহমান পিয়াল উস্কে দিয়ে বললেন, একাত্তরকে নিয়ে লিখুন। বাহাত্তরকে নিয়ে লিখুন। পচাত্তরকে নিয়ে লিখুন।
এগুলোতো লিখছেন অমি রহমান পিয়াল। নূরুজ্জামান মানিক। ওদের লেখার মধ্যে দিয়ে ইতিহাস কানাগলি থেকে বেরিয়ে আসছে। অণ্ধকারের ভিতর থেকে ভাঙাচোরা আলো ফিরে আসছে। পথ দেখতে পাচ্ছি।

এই পথ দেখতে পাওয়াটা বিপদ। পথ জানা থাকলে আবারো বিপ্লবের ফেরার সম্ভাবনা জাগে। আবার মনে মনে আশা জেগে ওঠে- আমার মায়ের তুলসী তলাটি ফেরত পাওয়া দরকার, যেটি তার নিজের। কেউ তাকে বলবে না, তোমার কিছু নেই। শূন্য।

হায় শূন্যতা, তুমি আর কতকাল রহিবে আমাদের ঘাড়ে?

...................
কাকমানুষের চকখড়ি
গল্পগ্রন্থ
প্রকাশক : আমার প্রকাশনী।