শনিবার, ২৮ আগস্ট, ২০১০

অভিবাসী

পাপড়ি রহমান

কালা গরলের জ্বালা আর তাহে অবলা...

কালকা মেল তখন উড়ন্ত সাপের গতি পেয়েছে। হাওয়া আর রোদ্দুরের বুক চিরে সাঁ সাঁ করে সামনে এগিয়ে চলেছে। দুই পাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ঘর-বাড়ি, সামান্য ঝোঁপ বা কিছু প্রাচীন বৃক্ষরাজি, শুষ্কভূমি, দুই-চারটা জলাশয় সেলুলয়েডের ফিতার মতো দ্রুত টেনে নিয়ে যাচ্ছে। টেনে নিয়ে মুহূর্তে সব চোখের আড়াল করে দিচ্ছে।
অথচ বর্ধমান পেরুবার পরই কি এক অদ্ভুত কারণে কালকা মেলের গতি শ্লথ হয়ে যায়। ঢেকিকয়ে ঢেকিকয়ে চলো। কোনো কোনোদিন সিগনাল না পেয়ে হয়তো কোনো ইস্টিশনেই ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে।
বন্দুক কি কামান দাগালেও সে তখন একচুলও নড়বে না।
ব্যান্ডেল জংশন পার হলেই হুগলি ইস্টিশন। বেশিরভাগ সময়ই ট্রেনটা এখানেই ঘাপটি মেরে থাকে। এতে অবশ্য নীহার ভট্টাচার্যের সুবিধে হয়। ধীর-সুস্থে যাকে বলে খানিকটা রয়ে-সয়ে ট্রেন ধরতে পারে। হুগলি পেরোলেই চচূঁড়া। তারপর চন্দননগর, ভদ্রেশ্বর, বৈদ্যবাটি, শেওড়াফুলি, শ্রীরামপুর, বিষড়া, কোন্নগর, হিন্দমোটর, উত্তরপাড়া, বালি, বেলুড়, লিনুয়া।
কিন্তু এই ট্রেনের মতি-গতি বেশ মুশকিলে! কোনো কোনোদিন বর্ধমান ছাড়িয়ে হুগলিকে একেবারে দলিত-মথিত করে দিয়ে হুসহুসিয়ে চলে যায়। কোনোদিন ফের হুগলি ছাড়ালেই পা পিছলে যেন কোনো ঢালে যেয়ে পড়ে। তারপর শুধু নামতে থাকে। নামতেই থাকে। নামতে নামতে একেবারে খাঁদে গিয়ে ঠেকে। আর এই খাঁদ হলো গিয়ে হাওড়া ইস্টিশন।
থাম বাপ থাম। একটু রেয়ে-সয়ে চল।
সামান্য ঢেক্কিয়ে ঢেক্কিয়ে চললে কি হয় বাপ তোমার?
কাল কেউটের মতো জলগতিতে না চলে অজগরের মতো জিরিয়ে জিরিয়ে, ঢিলেঢালাভাবে চলনা। অজগরের মতো চললে রোজকার ভাবনাটা কম ভাবতে হয়।
নিত্যই কোনো না কোনো ফ্যাসাদ এই ট্রেনে ঘটে। উল্কা গতি না-হয় শম্ভুকগতি। শম্ভুকগতি না-হয় উল্কাগতি।
যেদিন কালকা মেলের শরীরে জোর হাওয়া লাগে সেদিন একেবারে ব্যারাছ্যারা অবস্থা। নীহার ভট্টাচার্যের লালপেড়ে কোরা শাড়িটা ঘামে-ধুলায় সামান্য মলিন হতে না হতেই হাওড়া ইস্টিশন চোখের সামনে। তখন প্যাসেঞ্জারদের নামার তাড়া। বাস্ক-পেটরা লটবহর নিয়ে হুড়োহুড়ি। যেন সমুদ্দুরের বিশাল ঢেউ এই মাত্র আছড়ে পড়লো কূলে।
গন্তব্য এসে পড়লে এই হুড়োহুড়ি করে দলা পাকানোর মানে কি? নামার জন্য এত অস্থির বিস্থির করারই বা অর্থ কি?
কালকা মেল যেদিন হুগলিতে পৌঁছেই নড়ন-চড়নহীন হয়ে যায় সেদিন নীহার ভট্টাচার্যের তেমন কষ্ট হয় না। ছিপছিপে রোগা দেহটা শুধু টেনে ট্রেনে ওঠাতে পারলেই হলো। তারপর টু-টায়ার আর থ্রি-টায়ারের খাঁজেভাঁজে বিলি কেটে গলাটা পরিষ্কার করে উঠতেই যত বিড়ম্বনা। একতারা বা দোতারা কিছু হাতে নাই। কিন্তু পুরানা অভ্যাসের গুণে ডান হাতের তর্জনীটা আপনা-আপনিই বেজে ওঠে-
কালা গরলের জ্বালা আর তাহে অবলা
তাহে মুঞি কুলের বৌহারি
অন্তরে মরম ব্যথা কাহারে কহিব কথা
ঘুপতে সে গুমরিয়া মরি॥
সখি হে বংশী দংশিল মোর কানে।
ডাকিয়া চেতন হয়ে পরান না রহে ধড়ে
তন্ত্র-মন্ত্র কিছুই না মানে॥
মুরলী সরল হয়ে বাঁকার মুখেতে রয়ে
শিখিয়াছ বাঁকার স্বভাব।
দ্বিজ চণ্ডীদাস কয় সঙ্গ দোষে কি না হয়
রাহু মুখে শশী-মসি লাভ॥

নীহারের গলাটা সামান্য বসা হলেও সুর একেবারে টনটনে। যেন বাঁশের ঝোঁপ থেকে সদ্য মুখ বাড়ানো সবুজ ডগা কঞ্চিটা। পৃথিবীতে রোদ্দুরের জৌলুস দেখা অবাক নয়নে তাকিয়ে আছে!

হররোজ কিছুই এক রকম হয় না। সূর্যের আলোও যে পৃথিবীতে পৌঁছে তারও তো তারতম্য হয়। হাওয়া যে বইতে থাকে তাতেও তো আর্দ্র বা শুষ্কভাবের বেশ-কম হয়। ফলে নীহারেরও তারতম্য হয়। তার নিত্যদিনের জীবনের ওঠা-নামা হয়। কিন্তু গলাটা তার একই থাকে। গলা একরকম হলেও অবস্থা অনুকূলে থাকে না।

কালা গরলের জ্বালা তাহে অবলা
তাহে মুঞি কুলের বৌ হারি

কীর্তনের মুখটা ধরতে না ধরতেই কেউ কেউ চেহারা ব্যাদান করে ফেলে। নীহার তখন কি করে? গিলতে না পারা, উগরাতেও না পারা অবস্থা হয় তার। ফলে গান শেষ না করেই সটকে পড়তে হয়। বা লজ্জা থেকে বাঁচতে গুণগুণ করে না দেখার ভান করতে হয়। টু টায়ারে সামনে দাঁড়িয়ে নীহার ভট্টাচার্য ফের অন্তরায় টান দেয়-
সখি হে বংশী-দংশিল মোর কানে।
ডাকিয়া চেতন হয়ে পরান না রহে ধড়ে
তন্ত্র-মন্ত্র কিছুই না মানে॥

ভাগ্য প্রসন্ন হলে দুই/ একজন পুরুষযাত্রী তখন পকেট হাতড়ায়! দুই বা এক রূপী যাই উঠে আসে নীহারের হাতের তালূতে ফেলে দেয়। টু বা থ্রি টায়ারের মহিলা যাত্রীরা নির্বিকার দৃষ্টিতে তাকে পরখ করতে থাকে। পাটের আঁশের মতো মসৃণ সূক্ষ্ম অজস্র বলিরেখায় ভরে যাওয়া মুখটাতে তখন খানিকটা বেশি রক্ত ছলকে ওঠে! রঙ জ্বলে তামাটে হয়ে-যাওয়া ত্বকের এই পরিবর্তন হঠাৎ ধরা পড়ে না।
নীহার ভট্টাচার্য প্রণামের উদ্দেশে দুই হাত কপালে ঠেকিয়ে মাথা নিচু করে। তখন ঝুরঝুরিয়ে সামান্য সিঁদুর ঝরে পড়ে কামরার মেঝেতে। সিঁদুরের এই ঝরে পড়াও ঘটে সবার অলক্ষ্যে। যেমন অলক্ষ্যেই থাকে তার শীর্ণ হাতদুটোও। এবং তাতে সহজভাবে জড়িয়ে থাকা শাখা-পলাও। এমনকি মেদ-মাংসের বাহুল্য বর্জিত তার দেহখানাও কোরারঙ শাড়ির আড়ালে থেকে যায়। এতসব কিছু আড়াল করে রাখে নীহারের কীর্তন। তার সুরেলা কণ্ঠ।
ট্রেনের হট্টগোল ছাপিয়ে থইথই সুর ভেসে বেড়ায়।

সই কে বা শুনাইল শ্যামনাম
কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল গো
আকুল করিল মোর প্রাণ॥
না জানি কতেক মধু শ্যামনামে আছে গো
বসন ছাড়িতে নাহি পারে।
জপিতে জপিতে নাম অবশ করিল গো
কেমনে পাইব সই তারে॥
নাম-পরতাপে যার ঐছন করিল গো
অঙ্গের পরশে কি বা হয়।
যেখানে বসতি তার নয়নে দেখিল গো
যুবতী-ধরম কৈছে রয়॥
পাসরিতে করি মনে পাসরা না যায় গো
কি করিব কি হবে উপায়।
কহে দ্বিজ চণ্ডীদাসে কুলবতী কুল নাশে
আপনার যৌবন যাচায়।।

নীহার কীর্তন গায়। কেউ মন দিয়ে শুনলো কি শুনলো না তা সে দেখে না। দেখলে যে সে নিজেই আর আপনাতে থাকে না।
নীহার ভট্টাচার্য সব জানে। সব বুঝে। বুঝেও না বুঝার ভান করে সে। না করে উপায় নাই।
প্রথম প্রথম ভীষণ সঙ্কোচ হতো। ছিঃ! কি করে সে হাত পাতবে অচেনা মানুষের সামনে?
কিন্তু তিন ছেলেই যখন অন্য হাড়ি করলো তখন দেয়ালে পিঠ ঠেকেছে। পেছনে বাধা ছাড়া আর কোনো পথ নাই। শিবনারায়ণ ভট্টাচার্যর সাহস করে নিজেই এ পথে এসেছিল।
প্রথম দিকে হারমোনিয়ামটা গলায় ঝুলিয়ে নীহার আর সে দুজনে মিলে গাইতো। নীহার ভাবে- আহা! বেশতো দিন ছিল তখন। দুজনে মিলে ভগবানের নাম করে পথে নামা। ভগবানের নাম শুনে কেউ ইচ্ছে করে দুই/ তিন রূপী যা খুশি দিক। না দিলেও তারা তো অভিযোগ করছে না।
শিবনারায়ণ বলতো-
‘ভিক্ষে তো আর করছিনে? মোগো কি মনু এই কইরে দিন চইলবে না?’
২৭/২৮ বছর আগে পূর্ববঙ্গ ছেড়ে এলেও কথাতে মাতৃভাষার টান রয়ে গেছে। হুগলীর ভাষা তখনো ভালো রপ্ত করতে পারেনি!
নীহার জানে শিবনারায়ণ তাকে যতই প্রবোধ দিক, নানা ছলাকালায় মন মজাতে চাক- এ আসলে ভিক্ষা। ভিক্ষা ছাড়া আর কি?
ভগবানের নাম কণ্ঠ তুলে নিয়ে সেতো আসলে মানুষের দয়া-দাক্ষিণ্য-করুণাই চাইছে।

অঞ্জন রঞ্জিয়া কেবা খঞ্জন বসাইল রে...

হুগলি থেকে কত দূর বাংলাদেশ? এই বাংলাদেশের এক অজ পাড়াগায়ে জন্মেছিল নীহার ভট্টচার্য। যেখানে খেঁজুর গাছের ঘন জঙ্গল আর তালের বন। সুপারির মম গন্ধ ছড়ানো। শীত নামতেই খেঁজুর গাছের মাথা চেঁছে দেয়া হয়। তারপর তাতে নল বসিয়ে গলায় হাঁড়ি বেঁধে দেয়া হয়। শীতকালটা গলায় গলগণ্ড রোগের মতো হাঁড়ি ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সার-সার খেঁজুর গাছ। সমস্ত শীতের রাতে ফোঁটা ফোঁটা রস ঝরতে থাকে। মাছি আর মৌমাছি। ছোট ছোট রেতো প্রজাপতি, বড়গুলোও সেই হাঁড়ির রসে সাঁতার কাটে। পাখনা নাড়ে। মরে যায়। কুয়াশামাখা-ঠাণ্ডানিবিড়-নির্জন শেষ রাতে দেখা যায় এইসব। কোনো কোনো রাতে কুয়াশা কম পড়ে। সাদা সাদা মেঘ বেশ করে ভেসে থাকে। ওই সাদা মেঘ ফুঁড়ে ভেসে ওঠে মস্ত পানা ঘোলাটে চাঁদ।
এইসব দেখে দেখেই তো নীহারের কেটে গিয়েছিল ২০-২৫ বছরের জীবন।
তারপর হঠাৎ একদিন সব বদলে গেল! বারুদের গন্ধ আর কালো ধোঁয়া। তাতে ঢেকে গেল মেঘ, মাছি, মৌমাছি আর গোলপনা চাঁদ।
নীহারের তখন দুটো ছেলে জন্মেছে। তাদের নিয়ে এলোপাতারি ছোটাছুটি। নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য উৎকণ্ঠা। শিবনারায়ণের যেন কোন বিকার নেই। ছিল না। সে সদা ব্যস্ত খবরাখবর নিয়ে! রাত নামলেই তিনব্যান্ড রেডিওটা কানের কাছে নিয়ে কিছু একটা শোনার চেষ্টা করা। ঘরঘর শব্দে মগ্ন হয়ে থাকা।
স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে যদি কিছু আশার বাণী ভেসে আসে! বা আকাশবাণী কোলকাতাকে কানে উপুড় করে যদি কিছু সান্ত্বনা সঞ্চয় করা যায়।
নীহার রেগেমেগে যেতো। কি হয় এত সবে কান পেতে? সারাক্ষণ রেডিওর ঘরঘর আর ঘরঘর।
নীহারের রাগ উপেক্ষা করে শিবনারায়ণ শান্ত স্বরে বলতো-
‘খবর না রাখলে অইবে কেমনে মনু?’
‘অত খবরে কাম কি মোগো?’
‘দ্যাশে ফাইট চলতেছে। এই ফ্যাইটে জিইত্যা গেলে মোগো নিজেগো দ্যাশ অইবে। নিজেগো রাষ্ট্র অইবে। মোরা স্বাধীন দেশের মানু অমু।’

এমন বলতে বলতে শিবনারয়ণের চোখদুটো কি এক আশায় যেন চকচক করে উঠতো।
কার সাথে গুজগুজ করতে দেখে নীহার ঠিকই আঁচ করে ফেললো। শিবনারায়ণ যুদ্ধে যাওয়ার ট্রেনিং করার জন্য বর্ডার পার হবার তাল করছে।
শিবনারায়ণ চলে গেলে নীহারের কি হবে? বাচ্চা দুটোর কি হবে? বুড়ো বাপ গঙ্গানারায়ণের কি হবে? সোমত্ত বোন দুটোর কি হবে?
সব ভেবে-চিন্তে নীহার বাগড়া দিয়ে বসলো।
শিবনারায়ণ কিছুতেই একা যেতে পারবে না। গেলে সবাইকে নিয়ে যেতে হবে। যুদ্ধ করতে হলে সবাই মিলেই যুদ্ধ করবে।
নীহারের কথা শুনে শিবনারায়ণ বেকুব! এত জোর কোথায় পেল সে! শিবনারায়ণের যুদ্ধে যাওয়া হলো না! কিন্তু সে চুপচাপ বসেও থাকলো না। গোপনে গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করে যেতে লাগলো। গোলার ধান, পুকুরের মাছ আর গাছের ফল-পাকুড় যেমনটা পারলো দিয়ে গেল। এসব গোপন সাহায্য গোপন রাখা মুশকিল। ফলে গোপন ছিল না কিছুই। গোপনকে অগোপন করতে ফেউদের তো অভাব নেই।
ফলে নিজের বাড়িতে বাস করাও বিপদজনক হয়ে উঠলো। পাক-সার-জমিন-সাদ-বাদ পন্থীরা ঘন ঘন উঁকি ঝুঁকি দিতে শুরু করলো। নিজের বাড়ি-ঘর ছেড়ে শিবনারায়ণকে পালাতে হলো। সঙ্গে তার পরিবার। দূরে কোনো এক অচেনা গ্রামের উদ্দেশ্যে পা বাড়িয়েও নীহারের মন ব্যাকুল হয়নি। চোখ ফেটে জল নামেনি। কিসের যেন জোর ছিল সবখানে। যত দূরেই যাক ফিরে তারা আসবে। আসবেই এটা যেন নিশ্চিত জানা ছিল। আর বিভেদইবা তেমন কই? এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রাম। হোক না কোনো দূরের গ্রাম। এ যেন নিজের দুয়ার ছেড়ে পড়শির দুয়ারে যাওয়া। পড়শির দুয়ারে জল-খাবার খেয়ে, জিরিয়ে নিয়ে নিজের ভিটেতে ফিরে আসা।
কিন্তু এই ফিরে আসার ব্যবধানের মাঝেই যা ঘটার ঘটে গিয়েছিল। শিবনারায়ণদের বাড়ি লুট হয়ে গিয়েছিল। শুধু বাড়ি নয় ঘরেও দখল নিয়েছিল পাক-সার-জমিন-সাদ পন্থীরা। যাদের কাছে চাঁদ-তারা-খচিত সবুজ পতাকার গুরুত্ব বেশি ছিল।
লুট-তরাজ, আগুন জ্বালানো আর পাকিস্তান জিন্দাবাদের মাঝে শিবনারায়ণের আশাই পূর্ণ হয়েছিল।
বাংলাদেশ!
বাংলাদেশ শিবনারায়ণের স্বাধীন দেশ। নিজের দেশ! স্বাধীন দেশে নিজের ভিটাতে বড় শান্তি নিয়ে ফিরেছিল শিবনারায়ণ। কিন্তু ঘরে জল ভরে খাওয়া ঘটি পর্যন্ত ছিলো না। সবকিছুই লুট হয়ে গিয়েছিল। খাট-পালঙ্ক-চেয়ার-টেবিল কিছু নাই! চায়ের একটা চামচ পর্যন্ত নাই। তুলশীর ভাঙা বেদী উল্টে পড়েছিল দুয়ারে। জল না পেয়ে গাছগুলো শুকনো মচমচে। তুলশীর বেদী সোজা করতে করতে নীহারের দুচোখ জলে ভরে গিয়েছিল। দুহাত কপালে ঠেকিয়ে প্রণাম করে বলেছিল-
রাম! রাম!
‘ভগবান! স্বাধীন দ্যাশ! হেলে এডা কিসের নমুনা?’
শিবনারায়ণ আস্তে করে বলেছিল-
‘ঘরে যাও নীহার!’
নীহার তাকিয়ে ছিল স্বামীর মুখের দিকে। ওই মুখে কোনো রাগ নেই! অভিমান নেই! বেদনা নেই! কষ্ট-যন্ত্রণা কিছু নেই! কিভাবে পার শিবনারায়ণ এমন নির্বিকার থাকতে?
যেন কোথাও কিছু ঘটেনি। হয়নি। এ সংসারে কোনো কিছুর আঁচ লাগেনি!
সবকিছুই আগের মতো! একেবারে ঠিকঠাক!

আদতে কোনোকিছুই ঠিকঠাক ছিল না। লুট করে নেয়া জিনিস-পত্র কেউ ফিরিয়ে দিতেও আসেনি। শুধু শূন্য ঘর ফিরিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু ওই ফিরিয়ে দেয়াও ছিল সাময়িক।
কত বড় চক্রান্ত শিবনারায়ণকে ঘিরে জালবিস্তার করেছিল তা বুঝতেও সময় লেগেছিল। তা বছর খানেকতো হবেই। শিবনারায়ণের বাড়ি-ঘর, জমি-জিরাত পাক-সার-সার-জমিন-সাদ-বাদের চক্করে তলিয়ে গিয়েছিল। কিচ্ছু করার ছিলো না। কোনো প্রতিবাদও কেউ করতে আসেনি।
তাজা বুলেটের সামনে কোনোকিছুই চলে না।
আর চোদ্দপুরুষের হাড়-মাংস মজে যাওয়া ভিটা ছাড়তে কি মানুষের সময় লাগে না? চেনা-আলো-হাওয়া-জল-বৃক্ষ ছাড়তে কি মানুষের দ্বিধা হয় না? হয়!
সময়ও লাগে। শিবনারায়ণেরও লেগেছিল।

শিবনারায়ণের দুই পায়ে যেন আর জোর ছিল না! তার মনে হতো কোনোদিনই সে আর হাঁটতে পারবে না। নিজের জন্মভিটা কেমন যেন অচেনা। এই খানেই কি সে জন্মেছিল? এই মাটি কি তার জন্মমাটি? এই ঘর-দোর-উঠোন কি নিজের ছিল?
এই যে তার সাজানো সংসারের সবকিছুই লুটপাট হয়ে গেছে। ভিটে ছাড়ার জন্য তাকে অলক্ষ্যে ভয় দেখানো হচ্ছে। জানে ভয় ধরিয়ে দিলে কোনোকিছুই আর আগের মতো থাকে না। নিজের থাকে না। সব হঠাৎ অচেনা, পর, অদ্ভুত হয়ে ওঠে!
কোনো রাতে তক্ষক ডাকলেও ভয় পেয়ে কুঁকরে যেতো নীহার। কোনো অশুভ যেন তড়াক করে লাফিয়ে নেমেছে সংসারে!

জপিতে জপিতে নাম অবশ করিল গো
কেমনে পাইব সই তারে...

প্রায় এক বস্ত্রে চলে আসা। রাতের ঘোরঘুট্টি অন্ধকারে নিজেদের বাঁচাতে সব ফেলে পালালো তারা। তারা মানে শিবনরায়ণের পুরো পরিবার। এক দূর সর্ম্পকীয় আত্মীয়র সূত্র ধরে খোঁজ খোঁজ। তারপর এই হুগলি। এখানে বরিশালের তালের বন নেই। সুপারি গাছ আরো নেই। শীত পাকা কোনো রাত কোনোদিন আসেনি এই শহরে! ধু ধু দিন। ধু ধু রাত। খরখরে দিন আর রাত্তির।
নীহার ভট্টাচার্য নিশ্চুপ হয়ে গিয়েছিল। দম দেয়া কলের পুতুল যেন। জেগে উঠেছে, হাঁটছে, স্নান করছে। খাচ্ছে-দাচ্ছে। সব কেমন যেন বালুঘড়ির পেটের ভেতর আটকানো। পানসে-নিরানন্দময়। স্বেচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক-স্বদেশ ছেড়ে এসে অন্যকে ভালোবাসা বড় কঠিন। নীহার ভট্টাচার্য পারলো না!
নীহার ভট্টচার্যের পারা বা না পারাতে কিইবা এসে যায়? জীবন তো হেঁটে যায় জীবনের নিয়মেই।
হুগলির অচেনা-অজানা জল হাওয়ায় আরো তিনটা ছেলেপিলে জন্ম নিল তার। তারা বড় হলো। বড় হতে হতে পরগাছা হয়ে গেল।
ঘর নেই, বাড়ি নেই, বৃক্ষ নেই, জমি নেই, গরু নেই, পুকুর নেই-সবখানেই নেই নেই। এতসব নেই নেই দেখে নীহার জানে সেও আসলে পরগাছাই। পরগাছা।
দানা খুঁটে খেতে শেখা পাখির উড়াল দেখেছে নীহার। দেখেছে শিবনারায়ণও। ছেলেরা যে যার মতো ভিন্ন অন্নে চলে গেল। কি করবে এই দুই মানুষ?
নীহার ভট্টাচার্য দিদিমার কাছে থেকে শোনা শোলোক আওড়েছিল-
অভাবে স্বভাব নষ্ট
কুল নষ্ট কুবচনে
যাচনে মান নষ্ট
বুদ্ধি নষ্ট নির্ধনে...

অভাবে শুধু স্বভাব কেন? সমস্ত দেহটাই যে পচে গলে দুর্গন্ধযুক্ত হয়ে ওঠে।

একদিন হঠাৎ করে পুরনো হারমোনিয়ামটা টেনে নিয়েছিল শিবনারায়ণ-

সুধা ছানিয়া কেবা ও সুধা ঢেলেছে রে
তেমতি শ্যামের চিকন দেহা।
অঞ্জন রঞ্জিয়া কেবা খঞ্জন বসাইল রে
চাঁদ নিঙ্গাড়ি কৈল থেহা॥
থেহা নিঙ্গাড়ি কেবা মুখানি বনাইল রে
জবা নিঙ্গারিয়া কৈল গণ্ড।
বিম্বদল জিনি কেবা ওষ্ঠ গড়িল রে
ভুজ জিনিয়া করি শুভ॥
কম্বু জিনিয়া কেবা কণ্ঠ বানাইল রে
কোকিল জিনিয়া সুস্বর।
আরদ্র মাখিয়া কেবা সারদ্র বনাইল রে
ঐছন দেখি পীতম্বর॥
বিস্তারি পাষাণে কেবা রতন বসাইল রে
এমতি লাগয়ে বুকের শোভা
কানড়-কুসুম বোবা সুষম করিল রে
এমতি তনুর দেখি আভা॥
আদলি উপরে কেবা কদলী রোপল রে
ঐছনি দেখি উরুযুগ
আঙ্গুলি উপরে কেবা দর্পন বসাইল রে
চণ্ডীদাস দেখে যুগযুগ॥

নীহার ভট্টাচার্য প্রচণ্ড ধন্দের ভেতর-হঠাৎ কীর্তন কেন?
শিবনারায়ণ গান শেষ করে চোখের জল মুছে বলেছিল
‘ভগবানের নামে পথে নামতে উপায় লাগে না বড় বউ।’
‘এসব কথা কও কেয়া?’
‘কই কিয়া! ভগবানকে কণ্ঠে নিয়ে একবার চেষ্টা করতে দোষ কি?’
‘চেষ্টা! কিসের চেষ্টা?’
এত যুগ পর কিসের চেষ্টা করতে চায় শিবনারায়ণ? একেবারে নিজের মাঝে জড়ো হয়ে থাকা মানুষ এত কথাই আজ বলছে কেন?
পরদিনই ভোরে স্নান সেরে আধময়লা ধূতিটা পরে শিবনারায়ণ নীহারকে বলেছিল-
‘বড়বউ যাও তো-চান করে পূজা সাইরা আসো।’

নীহার চান করে লালপেড়ে কোরা শাড়িটা পরে ভক্তি ভরে পূজোর ঘরে ঢুকেছিল। পূজো শেষ করে আসতে না আসতেই শিবনারায়ণের গলায় ঝোলানো হারমোনিয়াম দেখে নীহার একেবারে এতটুকুন হয়ে গিয়েছিল। কি করতে চাইছে লোকটা? কেন এত সাজ-পোশাক? সুর আর গীত?
কোনো কথা না বলে শিবনারায়ণ মুখটা ধরেছিল-

মনেক মরম কথা শুনলো সজনি।
শ্যাম বাবু পড়ে মনে দিবস রজনী॥
কিবা রূপে কিবা গুণে মন মোর বান্ধে।
মুখেতে না ফুরে বাণী দুটি আঁখি কান্দে॥
কোন বিবি নিরমিল কুলবতী বলো।
কেবা নাহি করে প্রেম কার এত জ্বালা॥
চিতের আগুনি কত চিতে নিবারিব।
না যায় কঠিন প্রাণ কারে কি বলিব॥
জ্ঞান দাস কহে মুঞি কারে কি বলিব।
বাসুর লাগিয়া আমি সাগরে পশিব॥

তারপর হুগলি ইস্টিশনে। চচূঁড়া। চন্দননগর। ভদ্রেশ্বর। বৈদ্যবাটি। শেওড়া ঝুলি। শ্রীরামপুর। বিষড়া। কোন্নগর। হিন্দমোটর। উত্তরপাড়া। বালি। বেলুড। লিনুয়া।
চলতে চলতে হাওড়ার অন্ত্রের ভেতর। ফের লিনুয়া। বেলুড। বালি। উত্তরপাড়া।
শিবনারায়ণ নীহারকে বেশিদিন সঙ্গ দিতে পারেনি। পক্ষাঘাতে একদিক খেয়ে ফেললে কালকা মেল আর হয়ে ওঠেনি।
নীহার কবে থেকে যেন একা! একাই! হারমোনিয়াম নেই। একতারা নেই। দোতারা নেই। আসলে কিছুই আর তার সঙ্গে নেই। সুর জ্ঞানটা টনটনে। আর গলাটা ভারি মোহন।
মোহন গলায় কয় রূপীই বা হয়? কোনোমতে একবেলা আধবেলা। কোনো কোনোদিন স্রেফ উপবাস। তবুও বেঁচে তো আছে দুই প্রাণী! ভগবান সাক্ষী মেনে জোড় বাধা। ফের ভগবানকে কণ্ঠে তুলে লোকালয়ে ঝাঁপ দেয়া।
কোনো কোনো রাতে একদম ঘুমুতে পারে না নীহার। ঘুম আসে না তার। হঠাৎ হাওয়া এসে সুপারীর গন্ধে ভরিয়ে দেয় জীর্ণকুটির। ধান পাকা সোনালি মাঠ ঢুকে পড়ে জানালা গলিয়ে। আর গঙ্গানারায়ণ কুঁজো হয়ে তিন আঙুলে জপের মালা টেনে চলে।
তক্ষকের ডাক শোনার জন্য অপেক্ষা করে নীহার ভট্টচার্য। কিন্তু হুগলি শহরের কোনো রাতেই তক্ষক ডাকে না। নীহার ভট্টচার্য ভয় পেতে চায়। ভয়ে কুঁকড়ে উঠতে চায়। কিন্তু সব ভয় সে ফেলে এসেছে বাংলাদেশে। নিজের জন্মভিটায়। ভয়কে ফিরিয়ে আনার জন্য যদি সে একবার যেতে পারতো নিজ দেশে! সার সার খেঁজুর গাছের তলায় সরু পথ ধরে একবার যদি হেঁটে যেতে পারতো!
নীহার ভট্টাচার্য জানে তার ভাবনা কতোটা অবান্তর! সব ফেলে কালই তাকে ভোর ভোর উঠতে হবে। চান সেরে পূজা ঘর। পূজা সেরে চাল-ডাল কোনো মতে ফুটিয়েই দৌড়াতে হবে ইস্টিশনে।
ট্রেনের কোচ। টু টায়ার। থ্রি টায়ার।

পহিলহি চাঁদ করে দিল আনি।
ঝাঁপল শৈলশিখরে একপাণি॥
অব বিপরীত ভেল গো সব কাল।
বাসি কুসুমে কিরে গাঁথই মাল॥
না বোলহ সজনি না বোলহ আন।
কী ফল আছয়ে ভেটব কান॥
অন্তর বাহির সম নই রীত।
পানি-তৈল নাহি গাঢ় পিরীত॥
হিয়া সম-কুলিশ বচন মধুরার।
বিষঘট উপরে দুধ-উপহার॥
চাতুরি বেচহ গাহক ঠাম।
গোপত প্রেম-সুখ হই পরিণাম॥
তুহুঁ কিয়ে শঠি নিকপটে কহ মোয়।
জ্ঞানদাস কহ সমুচিত হোয়॥

হররোজ তো এভাবেই ভগবানের নাম জপে নীহার ভট্টার্যে। গলা বসা হোক। ধরা হোক।
ট্রেন ধরাটাই যা যন্ত্রণার। সুর ভাসিয়ে নিয়ে যায় তার চেনা অতীত। ক্ষত-বিক্ষত বর্তমান।
ঝাপসা এক ভবিষ্যত তাকে টেনে নিয়ে যায় ইস্টিশন থেকে ইস্টিশনে।
আজ কত রূপী জুটবে কীর্তন গেয়ে?
একটু বেশি রোজগার তাকে ভাবতেই হচ্ছে। শরীর কুলোয় বা না-কুলোয় তেলহীন সলতের মতো দপ দপ করে নিভে যেতে সে পারে না! পারবে না।
দু মুঠো চাল যোগাড় না-হলে পঙ্গু মানুষটা উপবাসী থাকবে...

1 টি মন্তব্য: