কুলদা রায়
এই গল্পটি লিখতে শুরু করেছি। এর আদিও জানি না, অন্তও জানি না। লিখতে লিখতে যাচ্ছি। শুধু জানি একটি জলের ভিতর থেকে একটি শহর উঠে আসছে। তার গাছগাছালি, গরু ছাগল, আর যন্তরমন্তরের হাড়গোড়। যতটুকু লিখব ততটুকু আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করব।
আদুরির শব্দকঙ্কাল : পর্ব এক
ছাতিমগাছের ডালে পাখিটি বসে আছে। হলুদ পাখি। ছাতিম পাতা অবুজ সবুজ। আর হাৎতা-ফাৎতা। এর আড়াল থেকে মাঝে মাঝে পাখিটিকে দেখা যায়। টুব টুব করে তাকায়। খুব খুব করে বাঁকায়। আবার পাতার আড়ালে হারিয়ে যায়। সতুবাবৃ চশমার কাঁচ ধূতির খুঁটে বার কয়েক মুছে নিলেন। কিন্তু পখিটি ঘন হলুদ পালকের জন্যই চোখে পড়েছিল। কিন্তু এবার দেখতে পাচ্ছেন না। তিনি ভুরু কুঁচছে ডাকলেন, ভুতো, ভুতো…।
ভুতো তখন দরোজার পিছনে হা করে ঘুমোচ্ছিল। আর ফত ফত করে নাক ডাকছিল। গরমে ঘেমে উঠেছ্। আর গোটা কয়েক নীল মাছি ভন ভন করে উড়ে বেড়াচ্ছে। গতরাতে সিঙ্গিদের বাড়ি নৌকাবিলাস পালায় গিয়েছিল। রাধা ঠাকুরুণ নীলশাড়ি পরেছে। হাঁটুর নিচের পায়ের গোছায় ঝম ঝম নূপুর থমকে আছে। আর বৈঠা হাতে কৃষ্ণ মিটি মিটি হাসছে। বিশাখা রাধাকে কনুই দিয়ে লম্বা একটা ঠেলা মেরে নৌকায় উঠে পড়ল। বিশাখার বুক থেকে আচঁল সরে গেছে। গোছ গোছ তুলো দেখা যাচ্ছে। যোগিনের মুখ হা হয়ে গেল। কি মনে করে শিস দিয়ে উঠল। আর অমনি কে এক ছোকরা মাজা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে গেয়ে উঠল--
এমনি যদি চাইয়া রবি হাটে যাবি কবে,
জলের মৈদ্যে জল নামিছে তেষ্টা কেন তবে।
ও সখি,
মরণ তাপে চরণ জোড়ায় মাখ্খন গলে যায়,
আমার কী হবে উপায়।।
ঠিক এমনি সময় সতুবাবু চশমাটা চোখের সামনে তুলে ধরলেন। কাঁচে হিজিবিজি বিজ বিজ। নাভির উপর পেটটা খিজি ঘিজ ঘিজ। চেঁচিয়ে ডাকলেন, ভুতো…।
ভুতো চোখ ডলতে ডলতে উঠে পড়ল। আর মাছিগুলে ভয়ে ভয়ে একটু তফাতে গেল। সতুবাবু নয়, রাধা ঠাকুরুন তার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখের নিচে উলুক ঝুলুক। বলছে, কি গাইছিলিরে ছোড়া?
--গান।
--কিয়ের গান?
--মাখ্খনের গান।
মরণ তাপে চরণ জোড়ায় মাখ্খন গলে যায়…
--বদ, তুই বদেরও বদ। দাঁড়া, তোর মাখ্খন গলাচ্ছি। বলেই রাধা ঠাকুরুণ তার বক্ষোদেশ থেকে ভাঙা পাতিলের একটি টুকরো বের করে ছুড়ে মারল। তার অতিশয় স্ফীত বক্ষোদেশ উন্মোচিত হল। তুলন ভুলন নাই। উহা কালোন। মুখের মতো ধলন ফলন নয়। এই ক্ষণে ভুতোর অবাক হওয়ার সুযোগ নাই। রাধা ঠাকুরুণের চক্ষু লাল। আর গণ্ডেদেশ লালন। ছুড়ে মেরেছে ভাঙা পাতিলের টুকরো। মাথাটা সরিয়ে না নিলে ফটেং ফট হয়ে যেত। রাধার বক্ষে একপাল কালো কাক। তারস্বরে ডাকছে, কা-কা-।
এই সময় রাস্তার উপর দিয়ে একদল লোক হেঁটে আসছিল। তাদের খালি পা। কপালে কারো কারো তিলক। ঘামে হাব জাব। এক তিলক বুড়ি থেকে থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে। তাকে ধরে রাখা মুশকিল। চেঁচিয়ে বলছে, ওরে আমার শুক, তুই গেলি কুনহানে…। তার পেছনে আধো ঘোমটা বউটির বুকে সেটে আছে একটি শিশু। মাই চুষছে। আর বউটির চোখ দিয়ে জল ঝরছে। ভুতো ছুটে বেরিয়ে তার পেছনে জুটে গেল। আর তার দিকে তাকিয়ে শিশুটি একটু থেমে আবার মাই চুষতে লাগল।
সতুবাবু চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন। মুখে বিরক্তি। হাতপাখা নামিয়ে রাখলেন। জানালা দিয়ে হাওয়া উঠে আসছে। পরমের দোকোনে জিলিপি ভাজা হচ্ছে। তেলে বলগ ঝলক উঠেছে। টাইপের খোপে ময়লা জমেছে। মুখ ফুলিয়ে ফুঁ দিলেন। ময়লা উড়ে এসে চোখে মুখে লাগল। আর ডান হাত তুলে আনল পাইকা টাইপ। একটা একটা করে। নির্ভুল।
যে সকল প্রাণ গ্রীষ্মের খরতাপে মৃত্তিকার ন্যায় শুষ্কপ্রায়, চৌচির হইয়া গিয়াছে—তৃষ্ণায় ওষ্টাগত, দগ্ধপ্রায়—একটি সলিলবিন্দুর জন্য হাহাকার করিতে করিতে ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছে—কোথাও কোনো আশার সরোবর মিলিতেছে না, হতাশ্বাসে মৃত্যু তাহাদের চক্ষুর নিচে উৎসব করিতে আরম্ভ করিয়াছে…
ঠিক তখুনি জানালার ওপাশ থেকে পদ্ম উঁকি দিল। মুখে কৌতুক। নাকে নথ ফৎ ফৎ। শিক ধরে বলল, বাবা, ও বাবা।
সতুবাবু তখনো মগ্নচৈতনে আবিল। গলার নিচে থর থর করে কাঁপছে। আর পিঠে থকথক ঘাম। তার হাতের মধ্যে সিসার ছোট ছোট অক্ষর।
…এই কৃষ্ণকায় মৃত্যোৎসবের মধ্য দিয়া জগদীশ্বর যখন দেখা দেন—তখন তাহার হস্তস্থিত নির্মল সলিল প্রাণের সঙ্কেত বহিয়া আনে। বলে, ওরে মন, আর ভয় নাই। তোর জীবন এবং জীবনের জন্য যতটুকু খেদ মৃত্যুর নিকট হইতে তোকে ফিরাইয়া আনিতে চাহে…
পদ্ম ফিসফিস করে বলল, বাবা—ও বাবা। জিলাপি।
পরমের দোকানে জিলাপির উপর মাছিগুলো ছুটে গেছে। আর ভন ভন করছে। পদ্ম বলছে, ও বাবা, খিদা লাগছে।
সতুবাবু তখন ঘোরের মধ্যে অক্ষর নিয়ে সলিলবিন্দুর স্বরূপ নির্ণয়ে মেতে গেছেন। আর পদ্ম ডাকাডাকি করে থেমে গেল। জানালার পাশে ছাতিম গাছটির দীর্ঘ ছায়া পড়েছে। সবুজ অবুজ ঘাস। পদ্ম ঘাসের উপর হাত্তু পাত্তু করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ল। গায়ে ডুরে কাপড়। পায়ে মল। কাজল কালন চোখ। মুখখালি ঢলোমলো। দুএকটা ছাতিম পাতা তার গায়ের উপরে খুব চুপখু্প এসে পড়ছে। আর সেই হলুদ পাখিটা দেখল, আশে পাশে কেউ নেই। পাতার আড়াল থেকে এই ফাঁকে বেরিয়ে এল। ডানা ছড়িয়ে খড়িয়ে পদ্মর গায়ের উপর বসল। কী মনে করে কাপড়ের সুতোর ভিতরে উবে গেল। কাপড়টি তখন আর আন্তা খান্তা নেই। পুরোটাই হলুদ।
রাস্তা দিয়ে দল বেঁধে যারা যাচ্ছিল দক্ষিণ পাড়ায়—তাদের কেউ কেউ কেঁদে কেঁদে উঠছে, ওরে শুক। আমরা কেন শুকহারা হৈলাম রে শুক।
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন