জা কি র তা লু ক দা র
নন্দনতত্ত্বের প্রধান সীমাবদ্ধতা হচ্ছে, কোনও সৃজনশীল শিল্পই যে সুনির্দিষ্ট একটি চৌখুপির মধ্যে নিজেকে আটকে রাখতে চায় না, এই সত্য বুঝতে না চাওয়া। কোনও লেখক একটি মার্কসবাদী বা কলাকৈবল্যবাদী বা উত্তরাধুনিক গল্প-কবিতা-নাটক লিখবেন ভেবে লিখতে বসেন না। কিন্তুু নন্দনতত্ত্বের একেক ঘরানা চায় ঐ লেখকের সৃষ্টিকে নিজ ঘরানার আলোকে পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা করতে, গ্রহণ করতে বা প্রত্যাখান করতে
“অনেক লোকেরই অভিযোগ হল যে প্রজ্ঞাবান মনুষের বাণী নীতিকাহিনী ছাড়া কিছুই নয়, এবং প্রতিদিনের জীবনে তা কোনো কাজেই আসে না , আর প্রতিদিনের জীবনই আমাদের একমাত্র জীবন ।ঃ এই সমস্ত নীতিকথা আদতে এর থেকে বেশি কিছু বোঝায় না যে , যা অভাবনীয় তা অভাবনীয়ই, আর তা তো আমরা জেনেই ফেলেছি। তবে প্রতিদিনের সঙ্গে লড়াইয়ের যে-ঝক্কি আমাদের পোয়াতে হয় সে কথা আলাদা।”
[অন্ প্যারাবেল্স ।। ফ্রান্জ কাফকা]
নন্দনতত্ত্বের প্রধান সীমাবদ্ধতা হচ্ছে, কোনও সৃজনশীল শিল্পই যে সুনির্দিষ্ট একটি চৌখুপির মধ্যে নিজেকে আটকে রাখতে চায় না, এই সত্য বুঝতে না চাওয়া। কোনও লেখক একটি মার্কসবাদী বা কলাকৈবল্যবাদী বা উত্তরাধুনিক গল্প-কবিতা-নাটক লিখবেন ভেবে লিখতে বসেন না। কিন্তুু নন্দনতত্ত্বের একেক ঘরানা চায় ঐ লেখকের সৃষ্টিকে নিজ ঘরানার আলোকে পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা করতে, গ্রহণ করতে বা প্রত্যাখান করতে। বিভ্রান্তি বিশেষভাবে তৈরি হয় কোনও মহৎ লেখক ও মহৎ রচনাকে নিজের গোত্রে জোর করে টেনে আনার অপচেষ্টায়। এটি করতে গিয়ে ঘরানাভিক্তিক নন্দনতত্ত্ব কখনও-কখনও এমন প্রপঞ্চের বা এমন প্রমাণপদ্ধতিরও আশ্রয় নিতে দ্বিধা করে না, যেটি তার মুলনীতি থেকে দূরে চলে যায়; এমনকী কখনও কখনও মূলনীতির পরিপন্থী হয়ে দাঁড়ায়। তবুও সরবে সে তার যুক্তিজাল তথা কুতর্ক বিস্তার করতে থাকে। এটাই হল নন্দনতত্ত্বের রাজনীতি। আর এই রাজনীতি দীর্ঘদিন থেকে চলে আসছে কাফকাকে কেন্দ্র করে। বলাবাহুল্য, কাফকা ছাড়াও বিশ্বসাহিত্যের প্রায় প্রতিটি মৌলিক লেখক কম-বেশি এই রাজনীতির শিকার। কাফকা এই প্রবন্ধে গৃহীত হয়েছেন একটি দৈবচয়িত উদাহরণ হিসাবে।
কাফকার কোনও রচনা অন্য কারও পক্ষে সংক্ষেপে উপস্থাপন করা এককথায় অসম্ভব। কেননা তার লেখায় কোনও বাক্য তো দূরের কথাÑ কোনও শব্দ-শব্দাংশ-দাড়ি-কমা-সেমিকোলন পর্যন্ত অতিরিক্ত নয়। কাফকাসংক্রান্ত যে কোনও আলোচনায় প্রবেশের আগে পাঠকের উচিত সেই রচনা পূর্বাহ্নেই পাঠ করে ফেলা। তবু কাফকাবিষয়ক নন্দনতাত্ত্বিক-রাজনৈতিক কুতর্কে প্রবেশের আগে আমরা কাফকা-র বিষয়বস্তু ও শব্দ-বাক্যভঙ্গি দেখে নিতে পারি। কাফকা শুরু করেন তার রচনা এইভাবেÑ “নিশ্চয়ই কেউ জোসেফ কে-র নামে অপবাদ ছড়িয়েছে , কেননা কোনও দোষ না থাকা সত্ত্বেও এক সকালবেলায় তাকে গ্রেপ্তার করা হল।”
হঠাৎ একদিন দুজন অচেনা লোক জোসেফ কে-র বাড়িতে উপস্থিত হয়, এমন এক কোর্টের দণ্ডাজ্ঞা হাতে নিয়ে যা সে কখনও চোখে দেখেনি। ভীতি ও বিদ্রƒপ, অলীক কল্পনা ও বাস্তবের আলোছায়ায়, এক বিচিত্র কাফকীয় আবহাওয়ার মধ্যে তাকে এক পরিত্যক্ত বধ্যভূমিতে নিয়ে যাওয়া হয়। আর তখনই আইনব্যবস্থার মৃত্যু ঘনিয়ে এসেছে এই সত্যকে আবিস্কার করে জোসেফ কে নিজেকে প্রশ্ন করতে থাকেÑ “কাছাকাছি কোনও সাহায্য ছিল কি? তার সপক্ষে কোনও যুক্তি কি চোখ এড়িয়ে গেছে? নিশ্চয়ই তাই হবে। যুক্তি নিঃসন্দেহে অটল, কিন্তু যে মানুষ বেঁচে থাকতে চায় তার সঙ্গে যুক্তি পাল্লা দিতে পারে না। সেই বিচারক কোথায়, যাকে সে কখনও দেখেনি ? কোথায়ই বা সেই আদালত, যেখানে সে কখনও প্রবেশ করেনি?” কিন্তু ততক্ষণে একজন জল্লাদ দুই-দুইবার তার হƒদ্পিণ্ড বিদ্ধ করেছেÑ শেষ হয়ে আসছে তার জীবন। ঠিক সেই মুহূর্তেই জোসেফ কে তার মৃত্যুর অমানুষিকতা বুঝতে পারে মৃত্যুর কারণ না জেনেই। সেটা সম্ভবত এই জন্যই যে, সে তার জীবনের অমানুষিকতা সম্পর্কেই কখনও সচেতন ছিল না। “বুজে আসা চোখ নিয়ে কে তখনও তার ঠিক সামনে ঐ দুজনকে দেখতে পাচ্ছিলÑ মুখের উপর ঝুঁকে পড়া মুখÑ শেষ দৃশ্য প্রত্যক্ষ করার ভঙ্গিতে। সে বলে উঠল ‘‘কুকুরের মতো’; যেন এই লজ্জা তার মৃত্যুকে ছাড়িয়েও বেঁচে থাকবে।”Ñ এই কথাগুলির সঙ্গে-সঙ্গে উপন্যাসেরও পরিসমাপ্তি ঘটে, আর আমরা জোসেফ কে-কে এক অস্তিত্বের অযোগ্য মৃত্যুর সামনে ছেড়ে দিয়ে আসি, যে-অস্তিত্বকে এতদিন সে সত্য বলে জানত।
এই অদ্ভুত গল্পটিই কাফকা-র দি ট্রায়াল উপন্যাস। আর প্রকৃতপক্ষে এটাই হল আমাদের পৃথিবী, যেখানে ন্যায়ের ধারণার মধ্যেই লুকিয়ে থাকে অন্যায়ের বীজ। ভালবাসার ছদ্মবেশে জেগে থাকে ঘৃণা। অতিবাস্তব এই জগৎটির অন্তরালের জগৎটি তুলে ধরেছেন কাফকা। ভয়ঙ্কর হতবুদ্ধির জগৎ। কোনও প্রতিপৃথিবী নয় সেটা; বরং সেটাই আমাদের প্রকৃত অভিজ্ঞতার পৃথিবী। এখন প্রশ্ন হচ্ছে নন্দনতত্ত্বের কোন চৌহদ্দিতে অবস্থান করেন কাফকা? কোন তকমা কাফকা-রচনার গায়ে চাপিয়ে দিলে সবচেয়ে ভালো মানায় ? মনে রাখা দরকার, হ্রস্বজীবনে সর্বাধিক ভয় পেতেন কাফকা এই ‘চাপিয়ে দেওয়া’ ব্যাপারটিকেই। কিন্তু নন্দনতত্ত্ব নাছোড়।
০২.
কোনও রচনা বা লেখককে ‘ক্লাসিক’ বা ‘ধ্র“পদী’ খেতাব দিতে পারলে নন্দনতত্ত্বিকরা কেন নোবেল পুরস্কারপ্রদানের আত্মতৃপ্তি লাভ করেন। প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যের ‘ধ্র“পদীত্ব’ ধারণাটির জায়গা নিয়েছে এখন ইউরোপের রেনেসাঁপুষ্ট ‘ক্লাসিক’ অভিধাটি । ক্লাসিকপন্থী নন্দনতাত্ত্বিকরা বলে দিয়েছেন যে, ক্লাসিক হবে উঁচুমানের বিষয় এবং যার আবেদন হবে চিরস্থায়ী। সেই সঙ্গে তারা বাতলে দিয়েছেন ‘ক্লাসিক’ জগতে ধরনা দিতে হলে আর কী কী শর্ত পূরণ করে আসতে হবে। সেগুলির মধ্যে রয়েছে অনেক মূর্ত ও অনেক বিমূর্ত চাহিদা। যেমনÑ ক. কবি-শিল্পীদের পক্ষে নৈর্বক্তিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে শিল্পজগৎকে এবং বিশ্বজগৎকে দেখার সক্ষমতা থাকতে হবে; খ. শিল্পীর শিল্প ভাবাবেগের উচ্ছ্বসিত প্রকাশ নয়Ñ সেই কারণে প্রকাশে সংযমের নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে; গ. অ্যারিস্টটলের শিল্পবিচারে যে-ব্যাপ্তি ও শৃঙ্খলার উল্লেখ আছে, ক্লাসিক গুণসম্পন্ন শিল্পে সেই দুটি বৈশিষ্ট্যের পরিমিত প্রকাশ থাকতে হবে; ঘ. ঐতিহ্যকে সর্বাধিক মূল্য দিতে হবে। ক্লাসিক শিল্প ও সাহিত্যে নতুন সৃষ্টিতে কল্পনার ব্যবহার থাকলেও সেই কল্পনায় সংযম থাকতে হবে; ঙ. ক্লাসিক শিল্পে যে-সমস্ত বিষয় ও ঘটনাবিন্যাস থাকবে, সেগুলির মধ্যে পরিচ্ছন্নতা, যুক্তিবাদীতা, গঠনশৈলীর নির্দিষ্টতাÑ ইত্যাদি বৈশিষ্টের উপস্থিতি থাকতে হবে; চ. এক ধরনের গভীর মননশীলতা যা চিত্তকে ও শিল্পভাবনাকে সংহত করে এবং ধ্যানীচিত্তের মগ্নতার দিকে নিয়ে যায়, সেই গভীর মননশীলতা থাকতে হবে।
উপরের শর্তাবলির পাশে যে কেউ কাফকা-র মননকে স্থাপন করলে পরিষ্কার বুঝতে পারবেন যে, কাফকা এসব প্রক্রিয়া মেনে ক্লাসিক অভিধা পেতে মোটেই উৎসাহী ছিলেন না। সময়ের অমোঘ গণ্ডি পেরিয়ে তার রচনা ভবিষ্যতের হাতে পৌঁছুবে কি না, তা নিয়ে বিন্দুমাত্র ভাবিত ছিলেন না কাফকা । উপরন্তু ‘আজি হতে শতবর্ষ পরে’ কেউ তার রচনা পাঠ করবে বা পাঠ করুক এমন রোমান্টিসিজম-এ ভুগতেন না কাফকা। তিনি বরং মৃত্যুশয্যা থেকে শেষ চিঠিতে বন্ধু ম্যাক্স ব্রডকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন তার মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই তার সমস্ত রচনার পাণ্ডুলিপি যেন পুড়িয়ে ফেলা হয়। তিনি কি নিজের সৃষ্টির অকিঞ্চিৎকরতায় ভীত ছিলেন? নাকি এই অহঙ্কারে আচ্ছন্ন ছিলেন যে তার রচনাকে সঠিক অর্থে গ্রহণ করার মতো ধী-মান পাঠক ভবিষ্যতে অল্পই জš§াবে? সেইজন্যেই কি তিনি বলেছিলেনÑ “একটি বিশেষ গল্প শোনার মতো উপযুক্ত শ্রবণেন্দ্রিয় তৈরি হওয়ার আগে প্রায়শই অনেক বৎসর কেটে যায় । কিন্তু মানুষ তো অবশ্যই মরণশীলÑ আমাদের পিতৃপুরুষরা যেমন ছিলেন অথবা অন্য সব যা কিছু আমরা ভালবাসি বা ভয় পাই সব শেষ হয়Ñ আমরা তাদের যথার্থ বুঝতে পারার আগেই”?
অমরত্ব চাননি কাফকা। সম্ভবত বিশ্বাসও করতেন না অমরত্বে। শুধু নিজের জীবনের অর্থ খুঁজে পেতেন একটিমাত্র কাজে। তা হল লেখা। কিন্তু লেখাকে জীবিকা করা যায়নি। জীবিকার জন্য গ্রহণ করতে হয়েছে চাকুরি। তাই ডায়েরিতে ফুটে উঠে আত্মদহনের তীব্রতাÑ “আমি একটি সামাজিক নিরাপত্তা অফিসে কর্মরত আছি। এখন, এই দুটি বৃত্তিকে কখনোই মেলানো যায় না, আবার সমান গুরুত্ব দেওয়াও মুশকিল। একটি ক্ষেত্রে সামান্য আনন্দ অন্যটিতে বিপর্যয় ডেকে আনে । কোনও সন্ধ্যায় ভালো লিখতে পারলে পরের দিন অফিসে আমার মাথায় আগুন ধরে যায়ঃ কিছুই ঠিকমতো করতে পারি না। অফিসে আমি বাহ্যিক বাধ্যবাধকতা পালন করি, কিন্তু আন্তরিক অনুশাসন নয়। এবং প্রতিটি অপূর্ণ আন্তরিক আকাক্সক্ষাই চরম দুর্দশার উৎস হয়ে ওঠে।” সম্ভবত এই দুর্দশার দুঃখ সামলাতে হিমসিম যুবক কাফকা অজান্তে চলে যাচ্ছিলেন মানসিক স্বেচ্ছানির্বাসনে । কেননা ততদিনে সমাজ তাকে স্পর্শ করে থাকলেও তার সঙ্গে কোনও সরব সম্পর্ক তৈরি হয় না, যেখানে সৃষ্টিকে চোখ রাঙিয়ে আইনের ঘোরালো জাল তাকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলে।
এই জায়গায় প্রবেশ করে অস্তিত্ববাদ। সরব দাবি জানায় যে, কেবলমাত্র অস্তিত্ববাদই পারে কাফকা ও তার রচনার পূর্ণাঙ্গ নন্দনভাষ্য তৈরি করতে। কিন্তু অস্তিত্ববাদের মূল নান্দনিক প্রবক্তা জাঁ পল সার্ত্র-এর হাইপোথিসিস নিজেই এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে অনেকাংশে। যেখানে সাহিত্য বলতে কী বোঝায়, তা সার্ত্র-এর মতেÑ “লেখা জীবন নয়। প্লেটোনিক সারবক্তা অনুধাবনের জন্য অথবা সৌন্দর্যের আদর্শ সম্বন্ধে চিন্তা-ভাবনার জন্য জীবন থেকে পলায়নও নয় সাহিত্য। এটি একটি পেশার অনুশীলন যার জন্য শিক্ষানবিশি, কঠোর পরিশ্রম, দায়িত্ববোধ এবং পেশাগত সচেতনতা প্রয়েজন। এই দায়িত্ববোধ থেকে একজন লেখককে এমনভাবে লিখতে হবে যেন পাঠক পৃথিবী ও পারিপার্শ্বিক সম্পর্কে অজ্ঞ না থাকে এবং লেখক সম্পর্কে কেউ যেন একথা না বলে যে, তিনি তার চারপাশে যা কিছু ঘটছে সে সম্বন্ধে নির্বিকার।” এই বক্তব্যের পাশাপাশি সার্ত্র-এর ‘লেখক ও শিল্পীকে বাস্তবতার প্রতিফলনে উদ্বুদ্ধ হতে হবে নিজস্ব চেতনার ভিত্তিতে’ এই অনুসিদ্ধান্ত কাফকা-র রচনার প্রসঙ্গে অস্তিত্ববাদী নন্দনতত্ত্বের দাবি খারিজ করে দেয় বহুলাংশে।
রাজনৈতিক কাঠামোর মতো নন্দনতত্ত্বের ক্ষেত্রেও মার্কসবাদ বেদনাদায়ক যান্ত্রিকতা যেমন দেখিয়েছে, তেমনই দেখিয়েছে নিজের সৃজনশীল বিকাশের মাধ্যমে নিজের প্রসারণকে অচিন্ত্যনীয় পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার সক্ষমতাও। পরন্তু শুরু থেকেই মার্কসবাদ শিল্প ও নন্দনতত্ত্ব সম্পর্কে নিজের কাঠামোর মধ্যেই এক ধরনের দ্বান্দ্বিক বিস্তার ও অব্যাহত বিতর্কের প্রক্রিয়া জারি রেখেছে। আমরা মার্কসবাদী নন্দনতত্ত্বের সূচনাযুগেই এমন দ্বান্দ্বিক বিস্তারের পরিচয় পাই গেওর্গে লুকাচ ও ব্র্রেখ্ট -এর বিতর্কের মধ্যে। এই দুই মার্কসবাদী তাত্ত্বিক পরস্পরের বিরুদ্ধে লেখনী চালিয়েছেন দীর্ঘদিন ধরে। বিতর্ক শুরু হয়েছিল ১৯৩২ সালে। তা চলতে থাকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত। এমনকী গড়ায় ১৯৬৬ পর্যন্ত। এই একই বছরে লুকাচ-এর দুই খণ্ডে রচিত নন্দনতত্ত্ব এবং ব্রেখ্ট-এর তিন খণ্ডে রচিত শিল্পসাহিত্য প্রসঙ্গে প্রকাশিত হলে পাঠকদের সামনে তাদের বিতর্কের সামগ্রিক চিত্রটি হাজির হয়।
শ্রেণীচেতনার ইতিহাস বিষয়ক লুকাচ-এর একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৯২৩ সালে। কিন্তু এই গ্রন্থটি কমিউনিস্ট তাত্ত্বিকদের দ্বারা চরমভাবে সমালোচিত হয়। তারা অভিযোগ করেন, এই বইটি পাঠ করলে দেখা যায় যে, লুকাচ-এর শ্রেণীদৃষ্টিভঙ্গি স্বচ্ছ নয়, অর্থাৎ মার্কসবাদসম্মত নয়। এরপরে লুকাচ আর মূল রাজনৈতিক তত্ত্বের দিকে অগ্রসর হননি। বরং তিনি পুরোপুরি মনোনিবেশ করেন নন্দনতত্ত্ব ও সাহিত্য আলোচনার ধারায়। তার খ্যাতি এতদূর বিস্তৃত হয় যে তাকে ‘নন্দনতত্ত্বের কার্ল মার্কস’ নামে অভিহিত করা হতে থাকে। ১৯৩৮ সালে ডাস ভোর্ট পত্রিকায় এক্সপ্রেশনিজম প্রসঙ্গে লিখিত এক প্রবন্ধের সূত্র ধরে লুকাচ ও ব্রেখ্ট-এর মধ্যে বিতর্কের সূচনা হয়। উভয়েই তখন বিশ্বজুড়ে মার্কসবাদী হিসাবে পরিচিত। ফ্যাসিস্টদের উত্থান রোধ করার নৈতিক যুদ্ধে উভয়েই ছিলেন সামনের কাতারের চিন্তাসৈনিক। কিন্তু নন্দনতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে দুজনের দূরত্ব ছিল মেরুপ্রমাণ। লুকাচ বিপ্লবী সর্বহারাদের মিত্র হিসাবে উদারনৈতিক বুর্জোয়াদের ফ্যাসিবাদবিরোধী সংগ্রামে অন্তর্ভুক্ত করতে আগ্রহী ছিলেন। তাই তিনি সমাজতান্ত্রিক বাস্তববাদকে ঊনিশ শতকীয় বুর্জোয়া লেখকদের সমালোচনামূলক বাস্তববাদের বিকাশ হিসাবেই দেখেছেন। অন্যদিকে ব্রেখ্ট-এর স্থির সিদ্ধান্ত ছিল, অবক্ষয়ী বুর্জোয়াদের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করেই কেবলমাত্র প্রলেতারিয়েতরা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম জোরদার করতে সক্ষম। ব্রেখ্ট মনে করতেন, বুর্জোয়া সাহিত্য যে-শিল্পগত নিষ্ক্রিয়তা সৃষ্টি করে তা কখনোই সাহিত্যের লক্ষ্য হওয়া উচিত নয়। তার মতে, লুকাচ-এর সাহিত্য সম্বন্ধীয় সমালোচনাগুলি যান্ত্রিকভাবে আবর্তিত। তিনি লুকাচ-এর মধ্যে দেখতে পানÑ “সরাসরি আত্মসমর্পণ, সংগ্রাম থেকে পশ্চাদপসরণের সুস্পষ্ট লক্ষণ, ইউটোপীয় ও আদর্শবাদী চিন্তার ছাপ (অবশ্য এসব লুকাচ কাটিয়ে উঠতে পারবেন বলে ব্রেখ্ট আশাবাদীও বটে) স্পষ্টত-ই আমাদের অসন্তোষ সৃষ্টি করে; অবশ্যই সেগুলিতে অনেক চিত্তাকর্ষক বিষয়ও রয়েছে; কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই ধারণাই জš§ায় যে, লুকাচ একটিমাত্র জিনিস নিয়েই ব্যস্ত, তা হলো জনসাধারণকে প্রমোদ দানÑ সংগ্রাম নয়, নতুন পথ নয় ,অগ্রগতি নয়।”
ব্রেখ্ট ১৯৩৮ সালে ডাস ভোর্ট পত্রিকার সহ-সম্পাদক ভিলি ব্রেডেলকে এক চিঠিতে অভিযোগ করেন যে, লুকাচ তাকে অবক্ষয়ী লেখক হিসাবে প্রচার চালাচ্ছেন। কারণ তিনি জয়েস ও কাফকা-র কিছু কিছু সাহিত্য টেকনিক ব্যবহার করে থাকেন। তিনি আত্মপক্ষ সমর্থন করেন এই বলে যে, নতুন ভঙ্গি গ্রহণ করে তিনি মার্কসবাদী শিল্পতত্ত্বের সঙ্গে বিশ্ব^াসঘাতকতা তো করেনই নি, বরং তার প্রয়োগের ক্ষেত্র অনেকখানি প্রসারিত করেছেন।
ব্রেখ্ট বলেনÑ“বর্ণনামূলক ভঙ্গি; যেমন মন্তাজ, মনোলোগ বা অ্যালিয়েনেশন পদ্ধতিÑ ইত্যাদি সম্পর্কে সম্ভাব্য সব রকমের অভিযোগ তোলা যেতেই পারে, কিন্তু বাস্তববাদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কোনও অভিযোগ আনা অসম্ভব যদি না অবশ্য আমরা আপাদমস্তক আঙ্গিকসর্বস্ব সংজ্ঞা গ্রহণ করতে স্বীকৃত হই। স্পষ্টতই মনোলোগের ব্যবহারকে আঙ্গিকসর্বস্বতা বলে নস্যাৎ করে দেওয়া যেতে পারে কিন্তু এমন অনেক অন্তঃস্থিত মনোলোগ ব্যবহার হতে পারে যা যথার্থ বাস্তববাদী। আর এমন কোনও বাধ্যবাধকতা নেই যে মন্তাজের সাহায্যে শ্রমিকশ্রেণীর জীবনচিত্র সমান স্পষ্টতা সহকারে তুলে ধরা যেতে পারে না। আঙ্গিকের পবিত্রতা সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে মার্কসবাদের নামে নির্বোধের মতো অনর্গল কথার ফুলঝুরি ছড়ানোর দরকার নেই। এটি মার্কসবাদ নয়।”
একই প্রসঙ্গ আরও বিস্তারিত হয় ব্রেখ্ট-এর কলমেÑ “লুকাচ-এর মতো বিদ্যাদিগ্গজ সমালোচকরা নতুন কোনও আঙ্গিকের ব্যবহার দেখলেই ‘গেল গেল’ রব তোলেন, কিন্তু তারা নিজেরাই আঙ্গিকসর্বস্ব। কারণ তারা পুরনোকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চান এবং আঙ্গিক ছাড়া আর কিছুই তাদের দৃষ্টিগোচর হয় না।’
বিতর্কের মধ্যে এসে পড়ে টলস্টয়, বালজাক বা টমাস মান প্রসঙ্গ। মনে রাখা দরকার, বালজাক ছিলেন মার্কস ও লেনিনের খুব প্রিয় লেখক। লুকাচ-এর চোখেও বালজাক ছিলেন ঊনিশ শতকের সমালোচনামূুলক বাস্তববাদের প্রধান প্রতিনিধি। অথচ ব্রেখ্ট তার মধ্যে দেখেন সস্তা, চটুল সাহিত্যকর্ম। বালজাকের উপন্যাসে ব্যক্তি সমগ্র সামাজিক অবস্থার বিরুদ্ধে যেখানে সংগ্রাম করেছে, ব্রেখট-এর চোখে তা কখনোই শ্রেণীসংগ্রাম নয় বরং ফেনিমোর কুপারের আদর্শে রচিত ইন্ডিয়ান টেলস-এর মতো কিছু একটা। লুকাচ-এর দৃষ্টিতে বিংশ শতাব্দীর সমালোচনামূলক বাস্তববাদের শ্রেষ্ঠতম উদাহরণ টমাস মান। অন্যদিকে ব্রেখ্ট, টমাস মানের লেখাকে ‘সাহিত্যের নরক’ হিসাবে গণ্য করেছেন।
লুকাচ ও ব্রেখ্ট-এর মতদ্বৈধতার ইতিহাস এই কারণে প্রাসঙ্গিক যে, এই বিতর্ক মনে করিয়ে দেয়, মার্কসবাদী নন্দনতত্ত্বের নিজস্ব ডিকশন এখনও কিছুটা পরীক্ষামূলক স্তরে নিহিত এবং কারও কথাকে শেষ কথা বলে ধরে নিলে ভুল করার সমূহ আশঙ্কা থাকে। বিশেষ করে কাফকার মতো হƒদয়বেদ্য ও স্পর্শকাতর সাহিত্যস্রষ্টাদের ব্যাপারে মার্কসবাদী নন্দনতত্ত্ব সবসময়ই অস্বস্তিতে ভুগে এসেছে। আর বারবার কাফকার সামাজিক সত্তাটির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতে চেয়েছেÑ “যদি পৃথিবীতে আপনিই একমাত্র মানুষ হতেন, তবে স্বাধীনতা শব্দটিই অর্থহীন হয়ে পড়ত। আপনি হতেন অর্থহীনতার অধীন। স্বাধীনতা আপনার স্বরূপের পূর্ণ উপলব্ধি। সেক্ষেত্রে অন্য অস্তিত্ব অপরিহার্য। অন্য অস্তিত্বগুলির সঙ্গে সম্পর্কের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া নিজের ভেতরে উপলব্ধি করে নিজেকে সঠিকভাবে চেনা ও জানাই হল মুক্তিÑ সেটাই স্বাধীনতার শ্রেষ্ঠ চেহারা।”
কাফকা-সৃষ্ট চরিত্রগুলির সম্পূর্ণ সমাজবিমুখতা ও বিচ্ছিন্ন অস্তিত্ব মার্কসবাদী নন্দনতত্ত্ব এই বলে যুক্তিসিদ্ধ করে যে, মানুষ তার বিশেষ ব্যক্তিগত-মানবিক গুণগুলিকে আকারসর্বস্ব ও ফাঁপা সর্বজনীনতার কাছে বিসর্জন দিতে অস্বীকার করে, যার সঙ্গে তার কোনও আত্মীয়তা নেইÑ একাত্মতা তো দূরের কথা। বিযুক্তির এই প্রক্রিয়া তুঙ্গে পৌঁছয় তখনই যখন বিচ্ছিন্নতার বোধটাই চলে যায়, অর্থাৎ যখন বস্তুতে পরিণত হওয়ার প্রক্রিয়া এতই এগিয়ে যায় যে, আসল ব্যক্তিত্বের আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। মানুষের অস্তিত্ব তখন তার বাস্তবসত্তার এক বিমূর্ত রূপ ছাড়া কিছুই নয়Ñ যা শেষ পর্যন্ত ব্যক্তিত্ববিহীনতা ও অবাস্তবতার পর্যায়ে চলে যায়। কাফকার সৃষ্ট চরিত্রগুলি এই কারণেই সঙ্গতি ধারণ করে। এই কারণেই তারা সঙ্গত।
কিন্তু কাফকা-পাঠ আমাদের ভিন্ন তাৎপর্যে উপনীত করে। মার্কসবাদী নন্দনতত্ত্ব যেখানে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয় পরিপ্রেক্ষিতের ওপর, তার সামাজিক-ঐতিহাসিক প্রাসঙ্গিকতার ওপর, সেখানে দেখা যায় কুয়াশায় ঢাকা এই অস্পষ্ট জটিল লেখককে যখনই তার সামাজিক ও ঐতিহাসিক প্রাসঙ্গিকতার বাইরে আনা যায় তখনই তার জটিলতা কমতে থাকে, তিনি ধীরে-ধীরে স্পষ্ট, স্বচ্ছ হয়ে ওঠেন।
আর সেই সঙ্গে অস্তিত্বের যুক্তিহীনতার পক্ষে কাফকা-র আর্ত হাহাকারÑ অজ্ঞাত-অস্পষ্ট কোনও কারণে অচেনা ব্যক্তির কাছে নির্যাতিত বা দণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত হওয়ার মধ্যে কোনও যুক্তি আছে কি? শুধু তাই-ই নয়, যে-লড়াই কেবল ব্যর্থতাতেই পর্যবসিত হয়, তারই বা অর্থ কী?
মানবিক সম্পর্কের এই যুক্তিহীনতা কাফকা-র নিজস্ব সৃষ্টি নয়Ñ বাস্তব জীবনের মধ্যেই এই যুক্তিহীনতা রয়েছে। এই কথা বলে কাফকাকে নিজের বলয়ভুক্ত প্রমাণের জন্য এগিয়ে আসে উত্তরাধুনিকতা।
উত্তরাধুনিকতায় শিল্পকর্ম দো-আঁশলা (হাইব্রিড), বিকেন্দ্রিক, তরল, বিচ্ছিন্ন , স্বেচ্ছাচারী এবং জগাখিচুড়ির মতো জিনিস। উত্তরাধুনিকতা অধিবিদ্যাভিত্তিক জ্ঞানগর্ভ গভীরতার পরিবর্তে কল্পিত গভীরতাহীনতা, ক্রীড়াময়তা, আনন্দ উপভোগের কৌশল ইত্যাদি গ্রহণ করে। উত্তরাধুনিকতা সবধরনের নির্দিষ্টতাকে সন্দেহের চোখে দেখে এবং সেই কারণে তার গৃহীত রূপ হয় বক্রোক্তিমূলক, জ্ঞানতত্ত্ব আপেক্ষিক এবং সন্দেহপ্রবণ। একই সঙ্গে এই মতবাদ উঁচুশ্রেণীর শিল্পকর্মকে সরিয়ে ব্যবহারে স্বাচ্ছন্দ্য জাগে এমন শিল্পকর্মের সন্ধান করে, আর উঁচ-ুনীচু স্তরভিত্তিক সব মূল্যকেই সন্দেহের চোখে দেখে। ভালো কিংবা খারাপ বলে তার কাছে কিছু নাই কেবল ভিন্ন-ভিন্ন সবকিছু। এদের কাছে ধর্মীয়সাহিত্য পূজনীয় নয়, নেহায়েৎ পর্ণোগ্রাফিও নিন্দনীয় নয়। এরা মানবদরদীকেও যেমন ভালো বলে না, তেমনই উগ্র জঙ্গিত্ব বা মৌলবাদকেও খারাপ বলে না। সেই কারণে এদের কাছে মৌলবাদও এক ধরনের দার্শনিক বৈধতা পেয়ে যায়। তৃতীয় বিশ্বের দেশে দেশে ধর্মীয় মৌলবাদের সঙ্গে উত্তরাধুনিকদের সখ্যেও এটি অন্যতম একটি কারণ। সাহিত্য প্রসঙ্গে এদের দাবি হচ্ছে, টেক্সট লেখকের নয়Ñ পাঠকের। লেখক কী বলতে চেয়েছেন তার কোনও গুরুত্ব নেই। বরং পাঠক কী বুঝেছে, লেখাটি পাঠ করে সেটিই গুরুত্বপুর্ণ।
পাঠক ঠিকভাবে সংজ্ঞায়িত করতে পারবে না আশঙ্কায় যে-লেখক মৃত্যুশয্যায় তার সমস্ত রচনা ভস্মীভূত করতে ইচ্ছা পোষণ করেন, তাকে নিজেদের গোত্রভুক্ত বলে দাবি করার উত্তরাধুনিক খায়েশ এখানেই শেষ হয়ে যায়।
০৩ .
বলয়ভুক্ত নন্দনতত্ত্বের (দুর্ভাগ্যক্রমে তত্ত্ব মানেই এক ধরনের বলয়) আগ্রাসনে অতিষ্ঠ হয়ে রোলাঁ বার্থের আর্তচিৎকারÑ “তাহলে কি আমাদের সাহিত্য সবসময়ই রাজনৈতিক বাস্তববাদ এবং ‘শিল্পের জন্য শিল্প’ অঙ্গীকারের নীতি এবং নন্দনতত্ত্বের বিশুদ্ধতা, আপস-রফা এবং অজীর্ণতার ক্লান্তিকর যাতায়াতের মধ্যে বন্দি হয়ে থাকবে ? কখনও কি ‘এই পৃথিবীতে’ তার ‘নিজস্ব কোনও জায়গা’ হবে না?”
এই প্রশ্নের যথার্থ উত্তর কাফকার রচনা।
সেই সঙ্গে কাফকার জীবনপথ দেখিয়ে গেছে অন্যসব প্রকৃত সাহিত্যস্রষ্টাকেও। নিঃসঙ্গ জীবন, বিপথগমন, অনুসন্ধান, বিমূর্ততার নির্মাণ, ইত্যাদি ধ্র“বক, যাদের কাফকা-র জগৎ বলা হয়ে থাকে, সেগুলি কি আমাদের অন্য লেখকদের মধ্যেও বিরাজ করে না , যখন তারা কর্তৃত্বপূর্ণ জগতের সেবার জন্য লিখতে অস্বীকার করেন? কাফকার মতো তারাও কি সরবে-নীরবে বলেন না যে সাহিত্যের অস্তিত্ব তার নিজস্ব রীতি ছাড়া অন্য কোথাও নেই?
প্রকৃত সাহিত্য তো মহাবিশ্বের ছিন্নাংশ। বিশ্লেষণের ছুরির তলায় খান-খান হয়ে যাওয়া নরম আর নিরাকার পদার্থের বিপরীতে মহাবিশ্বের এই ছিন্নাংশ তৈরি করে এক কঠিন, সুসমঞ্জস পূর্ণতা, যা একেবারেই অবিভাজ্য। এই কাঠিন্য এবং অস্বচ্ছতাই ধারণ করে তার অভ্যন্তরীণ স্তরবিন্যাস এবং ঘনত্বকে, তাকে জোগায় সেই অন্তর্ভেদী শক্তি যা পাঠকের বাহ্যিক বুদ্ধির মরুভূমিতে না গিয়ে বরং তার সংবেদনশীল আত্মার উর্বর, অবসন্ন এবং অসংরক্ষিত এলাকায় উপনীত হয়, সৃষ্টি করে এমন এক রহস্যময় আঘাত, এমন এক আবেগের উš§াদনা, যার ফলে জীবনের অনির্বচনীয়তাকে তার সমস্ত সূক্ষèতা, জটিলতা এবং তার অপরিমেয় গভীরতাসমেত উপলব্ধি করা সম্ভবপর হয়ে ওঠে।
নন্দনতত্ত্ব অনেকসময়ই অর্বাচীনভাবে এই অনির্বচনীয়তাকে বাক্সময় করতে চায়, সমস্ত অস্পষ্টতাকে জোর করে দূরে সরিয়ে দিতে চায়। লেখকসৃষ্ট অস্পষ্ট একটি মুখশ্রীকে স্পষ্ট করতে গিয়ে নন্দনতত্ত্ব তার মুখের ওপর ছড়িয়ে থাকা কুয়াশা সরাতে থাকে। কিন্তু ফলাফল দেখা যায় হিতে বিপরীত। কুয়াশা সরাতে গিয়ে মুখটাই মুছে গিয়েছে। বেচারা নন্দনতত্ত্ব বুঝতেই পারেনি যে-কুয়াশা ঐ মুখটির অচ্ছেদ্য অংশ। লেখক মুখটিকে সৃষ্টি করেছিলেন কুয়াশাসমেতই। কোনও নন্দনতত্ত্বই কোনওদিন বুঝতে পারবে না যে মহৎ সাহিত্য কীভাবে পাঠককে একই সঙ্গে পূর্ণতার আভাস এবং এক গভীর নিঃস্বতার অনুভূতির মাঝখানে এনে দাঁড় করিয়ে দেয়।
নন্দনতাত্ত্বিক সমালোচনা কোনওদিনই কোনও মহৎ সাহিত্যকে পরিপূর্ণভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে না, কারণ তারা নিজেরাই খণ্ডিত। নিজের সীমাবদ্ধতা স্বীকার না করে নন্দনতত্ত্ব যখন জবরদস্তিমূলকভাবে অগ্রসর হয় সেই কাজে, প্রকৃতপক্ষে তখনই শুরু হয় নন্দনতত্ত্বের রাজনীতি। জর্জ লুই বোর্হেস মনে করতেন, নন্দনতত্ত্ব শিল্পের অভিমুখে যাত্রা হয়তো শুরু করতে পারে, কিন্তু অন্ত্যে পৌঁছুনোর রসদ তার ভাণ্ডারে নেই। এখানে সে গতির বিরুদ্ধে জেনো-কথিত স্ববিরোধী তত্ত্বের অধীন। ধরা যাক, সাহিত্যের প্রবেশমুখ ‘ক’ বিন্দু এবং অন্ত্যবিন্দু হচ্ছে ‘খ’। নন্দনতত্ত্ব ‘ক’ থেকে ‘খ’ বিন্দুতে যেতে চায়। অ্যারিস্টটলের মত অনুযায়ী, চলমান একটি বস্তু ‘ক’ থেকে ‘খ’ বিন্দুতে পৌঁছুতে পারে না। কারণ প্রথমে তাকে অবশ্যই এই বিন্দুর মধ্যেকার দূরত্বের অর্ধেক অতিক্রম করতে হবে, এবং তা করতে হলে এই অর্ধেক দূরত্বের অর্ধেক আগে অতিক্রম করতে হবে, এবং তা করতে হলে অর্ধেকের অর্ধেকের অর্ধেক আগে অতিক্রম করতে হবে, এবং এইভাবে চলতে থাকবে অনন্তকাল পর্যন্ত।
এই একই ভাগ্যলিপি নন্দনতত্ত্বের।
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন