সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ ও সম্মানীয়। ১৯০১ সাল থেকে ডিনামাইট আবিষ্কারক আলফ্রেড নোবেলের নামে এই পুরস্কার চালু হওয়ার পর বিশ্বের খ্যাতিমান কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, দার্শনিক এ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। খ্যাতিমান যারা এ পুরস্কার পেয়েছেন তারা হলেন- রুডইয়ার্ড কিপলিং, পল হাইসে, টোমাস মান, গাব্রিয়েলা মিস্ত্রাল, হারম্যান হেস, আদ্রেজিঁদ, উইলিয়াম ফকনার, বার্ট্রান্ড রাসেল, উইনস্টন চার্চিল, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, আলবেয়ার কামু, বরিস পাস্তেরনাক, জন স্টেইনবেক, ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা, স্যামুয়েল বেকেট, আলেকজান্ডার সলঝেনিতসিন, পাবলো নেরুদা, সল বেলো, আইজ্যাক বাশেভিস সিঙ্গার, গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ, উইলিয়াম গোল্ডিং, ওলে সোয়িংকা, জোসেফ ব্রডস্কি, নাগিব মাহফুজ, অক্টাভিও পাজ, নাডিম গোর্ডিমার, ডেরেক ওয়ালকট, টনি মরিসন, কেনজাবুরো ওয়ে, সিমাশ হিনি, হোসে সারামাগো, গুন্টার গ্রাস, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ভিএস নাইপল, হ্যারল্ড প্রিন্টার, ওরহান পামুক ও ডোরেস লেসিং।
আর এ বছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন ফরাসি ঔপন্যাসিক জ্যঁ-মাহি গুস্তাভ লো ক্লেজিও। গতকাল সন্ধ্যায় সুইডিশ একাডেমি এ কথা জানিয়েছে। তিনি কেবল উপন্যাসই লিখেননি, একাধারে লিখেছেন গল্প, প্রবন্ধ। ভারতীয় মিথলজির ওপর দুটি গ্রন্থ অনুবাদ করেছেন তিনি।
গতকাল নোবেল প্রাইজ ঘোষণার সময় সুইডিশ একাডেমি লো ক্লেজিও সম্পর্কে বলেছে, author of new departures, poetic adventure
and sensual ecstasy, explorer of a humanity beyond and below the
reigning civilization.
প্রকৃত অর্থেই তিনি তার উপন্যাসে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেছেন। তিনি তার উপন্যাসে কেবল কাব্যিক দ্যোতনারই সৃষ্টি করেননি, মানুষের ইন্দ্রিয় অনুভূতি, সভ্যতা ও মানবতার জয়গান তিনি এমনভাবে গেয়েছেন যা সভ্যতা ও মানবিকতাকে ছাপিয়ে এক নতুন জগতের সন্ধান দিয়েছে।
পুরস্কার হিসেবে তিনি এক কোটি ক্রোনারের (১৪ লাখ ডলার) চেক, একটি সোনার মেডাল পাবেন। এছাড়া সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমের ‘ওল্ড টাউন’-এ অবস্থিত একাডেমির হেডকোয়ার্টার্সে বক্তৃতাও করবেন তিনি।
ফরাসি ঔপন্যাসিক জ্যঁ-মাহি গুস্তাভ লো ক্লেজিও ১৯৪০ সালের ১৩ এপ্রিল ফ্রান্সের নিস শহরে জন্ম গ্রহণ করেছেন। এ বছর (২০০৮ সাল) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার আগে ১৯৬৩ সালে তিনি চৎরী Renaudot পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন।
১৮ শতকে তার পরিবার ব্রিটানি থেকে মরিশাসে চলে যায়। এ দেশটি বৃটিশ শাসনের অধীনে আসে ১৮১০ সালে। এরপরও এখানকার অধিবাসীরা তাদের সহায়-সম্পদ ভোগ করতে পারতো এবং বৃটিশ ন্যাশনালিটি ভোগ করা সত্ত্বেও ফরাসি ভাষা ব্যবহার করতো। তার বাবা বৃটিশ আর্মিতে সার্জন হিসেবে কাজ করেছেন। তখন এই পরিবারটি কিছু সময়ের জন্য আফ্রিকায় বসবাস করেছে। তার মা ছিল বোবাকালা/মূকবধির। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পরিবারের সদস্যরা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, পরিবারের সদস্যরা সবাই তখন নিস শহরে ছিল; কিন্তু তার বাবা ছিল তাদের থেকে অনেক দূরে। এই নিসেই তিনি স্নাতক হয়েছেন। এরপর তিনি যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষকতার চাকরি নিয়ে চলে যান।
জ্যঁ-মাহি গুস্তাভ লো ক্লেজিও (সংক্ষেপে জে.এম.জি. লো ক্লেজিও) একজন পর্যটকও বটে। মাত্র সাত-আট বছর বয়স থেকেই তিনি লেখালেখির জগতে প্রবেশ করেন। ফরাসি সাহিত্যে পড়াশোনার পর তিনি মাত্র ২৩ বছর বয়সেই খ্যাতিমান হন তার প্রথম উপন্যাস দি ডিপোজিশন-এর জন্য। এটি ফরাসি ভাষায় লিখিত। এর জন্যই তিনি ১৯৬৩ সালে চৎরী জবহধঁফড়ঃ পুরস্কার লাভ করেন।
এরপর থেকে এ পর্যন্ত তিনি প্রায় ত্রিশটি বই লিখেছেন। এর মধ্যে রয়েছে ছোট গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ এবং ভারতীয় মিথলজির ওপর দুটি অনুবাদগ্রন্থ। এছাড়া অগণিত বইয়ের ভূমিকা ও পর্যালোচনাও লিখে দিয়েছেন তিনি।
তার লেখক-জীবনকে মূলত দুই ভাগে ভাগ করা যায় :
১৯৬৩-১৯৭৫
এ সময়টিতে তিনি বাতুলতা, ভাষা ইত্যাদি থিম নিয়ে কাজ করেছেন। তার এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষার সঙ্গে তার সমসাময়িক জর্জ পারেক বা মাইকেল বাটোর-এর সাদৃশ্য দেখা যায়। তখন মানুষের দৃষ্টিতে তিনি নতুন কিছু করতে আগ্রহী ও একটু বিদ্রোহী টাইপের ইমেজ কুড়িয়েছিলেন। তবে এসবের ফলে মিশেল ফুকোর প্রশংসাও লাভ করেছেন তিনি।
১৯৭০-এর দশকের শেষের দিকে লো ক্লেজিওর লেখার স্টাইলে বড় ধরনের পরিবর্তন চলে আসে। তিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষার অভ্যাস পরিত্যাগ করেন। তার রচনার উপজীব্য হয়ে ওঠে শৈশব, বয়োঃসন্ধি, ভ্রমণ ইত্যাদি, যা পাঠকগোষ্ঠীর একটি বড় অংশের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়। তিনি জনপ্রিয়তা লাভ করেন এবং ডেজার্ট উপন্যাসের জন্য ১৯৮০ সালে তিনি ফ্রেঞ্চ একাডেমি থেকে পুরস্কার পান।
১৯৯৪ সালে ফরাসি সাহিত্য বিষয়ক ম্যাগাজিন লিরার একটি জরিপে ১৩ শতাংশ পাঠক তাকে জীবিত ফরাসি লেখকদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলে রায় দেয়।
১৯৮৫ সালে ঔপন্যাসিক ক্লাউড সিমনের পর তিনিই ফরাসি ঔপন্যাসিকদের মধ্যে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করলেন। তিনি নিজ দেশে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করলেও এই উপমহাদেশে তার গ্রন্থ তেমন পঠিত নয়। তার পরিচিতিও এই অর্থে নেই। যেমন নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির আগে গুন্টার গ্রাস, টনি মরিসন, ভি এস নাইপল, হেরাল্ড প্রিন্টার, ওরহান পামুক প্রমুখ লেখক যেভাবে পরিচিতি লাভ করেছিলেন।
তার উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম
দি ডিপোজিশন (১৯৬৩), ফিভার, দি ফ্লাড (১৯৬৬), ম্যাটেরিয়াল এক্সটাসি (১৯৬৭), বিলাভড আর্থ (১৯৬৭), দি বুক অফ এসকেপস ওয়্যার, হেই (১৯৭৩), দি জায়ান্টস (১৯৭৩), জার্নিস বিওন্ড (১৯৭৫), চিলাম বালাম প্রফেসিস (১৯৭৬), টু দি আইসবার্গস, এন এসেই অন হেনরি মাইচক্স (১৯৭৮), মনডো অ্যান্ড আদার স্টোরিস (১৯৭৮), দি স্ট্র্যাঞ্জার অন দি আর্থ (১৯৭৮), থ্রি হলি সিটিস, ডেজার্ট (১৯৮০), দি রাউন্ড অ্যান্ড আদার কোল্ড হার্ড ফ্যাক্টস, দি প্রসপেক্টর, ডিয়েগো রিভেরা অ্যান্ড ফ্রিডা কাহলো, জার্নি টু রড্রিগোজ, দি মেক্সিকান ড্রিম অর ব্রোকেন থট, স্প্রিং অ্যান্ড আদার সিজনস, এ রেফারেন্স টু দি আফ্রিকান সিটি অফ ওনিটশা, ওয়ান্ডারিং স্টার, পাওয়ানা, কোয়ারান্টাইন, দি গোল্ডেন ফিশ, দি ক্লাউড পিপল, সাং সেলিব্রেশন, সেরেনডিপিটি, বার্নট হার্ট অ্যান্ড আদার রোমান্সেস এবং দি আফ্রিকান (২০০৪)।
বিগত দুই দশকের বেশি সময়ে কোনো ফরাসি লেখক সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাননি। লো ক্লেজিওর পুরস্কার প্রাপ্তির মধ্য দিয়ে এই দীর্ঘ শূন্যতা পূরণ হলো। আধুনিক ফরাসিদের জীবন-যন্ত্রণা, শূন্যতা, মানবতাবোধ ও সংগ্রামের ভিন্নমাত্রিক উপস্থাপন বাংলা ভাষাভাষী মানুষ এবার তার সম্পর্কে জানার সুযোগ পাবে তার মূল্যবান রচনা পাঠের মাধ্যমে। লো ক্লেজিওর চিন্তার জগৎ, কল্পনার বিস্তার ও সৃষ্টিশীলতার বহুমাত্রিক দিকটিও উন্মোচিত হবে।
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন