খো ন্দ কা র আ শ রা ফ হো সে ন
মানুষ
মানুষকে কেউ ধারণ করতে পারে না
না নিসর্গ না ঈশ্বর না প্রেম না ঘৃণা
মানুষের হাতে নীল বেলুন তার চোখে দুই কালো মাছি
মানুষকে কেউ ধারণ করতে পারে না, মানুষের
কোনো জন্মদাতা নেই, তার কটির উত্তাল যৌবন কারো
উত্তরাধিকার নয়।
মানুষকে কেউ ধারণ করতে পারে না
না নিসর্গ না ঈশ্বরের দিগন্ত-প্রসারী আলখাল্ল¬া
না নদী না জন্মভূমি।
মানুষের কোনো উপমা নেই, রূপকল্প নেই, ব্যতিহার
বহুব্রীহি নেই, স্বরলিপি ব্যাকরণ নেই
শাসনতন্ত্র, অর্থ-অভিধান চর্যাচর্য নেই।
মানুষ আত্মভেদী, আত্মনাশী নীল পতঙ্গ
একদির সে পাঁজরের হাড় দিয়ে গড়েছিল এ পৃথিবী
একদিন মানুষই ধ্বংস করবে তাকে।
না ঈশ্বর না দেবতা না পাষাণ মৃদঙ্গ না প্রভাত না
মধ্যরাতে নিমগ্ন বালিশ না ফোয়ারা না যোনী না
কবন্ধ রাত্রির ঘুম কোনো কিছু না।
শুধু মানুষই পারে কোনো কিছু ভাঙতে। যেমন সাজাতে।
আমি সেই ভঙ্গুর ভঙ্গপ্রিয় ত্রিভঙ্গ মুরারির জন্যে
আমার কবিতা রেখে যাই।
আর কেউ নয়, আর কারো জন্যে আমার
দীর্ঘশ্বাস নেই, না গ্রন্থ না সুহৃদ না পলাতক
ভ্রমর গুঞ্জন না নারী না নিশ্চল বসন্ত বাহার ...
আমি মানুষকে ভালবাসি কেননা সে একদিন
নিজহাতে নিজেকে পোড়াবে।
নিজের কবিতা নিয়ে কথা বলা খানিকটা অশোভন এবং অনেকটা বিপজ্জনকও বটে। কারণ একে আত্মপ্রচারণা ভাবতে পারে কেউ, আবার কোনো-কোনো সমালোচক-ইতিহাসকার একে ভবিষ্যতে ব্যবহার করতে পারে সহজ-খেয়া হিসেবে, অনুধাবনের শ্রম বাঁচাবার জন্য। কিন্তু আমি মনে করি, কবিকে তাঁর কিছু কথা বলতে দেওয়া উচিত, কেননা প্রায়শ অপসমালোচক ও নির্বোধ ব্যাখ্যাকাররা ক্ষতি করে থাকে কবি ও কবিতার। আর আমি রোলাঁ বার্তের কথার সাথেও পুরোপুরি একমত নই, আমি মনে করি না কবিতা রচনার সাথে সাথে রচয়িতা-কবির মৃত্যু ঘটে।
আমার নিজের প্রিয়তম কাব্যগ্রন্থ জীবনের সমান চুমুক। প্রথম কবিতা ‘মানুষ’ পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে, কিন্তু কী আশ্চর্য, আমি তাকে পরিহার্য ভেবেছিলাম- গ্রন্থপ্রকাশের সময় ওকে স্থানই দিতে চাইনি। জীবনের সমান চুমুক -এর পাণ্ডুলিপি সাজাচ্ছিলাম যখন, কবিতাটি তাতে দেব কি দেব না এ নিয়ে দ্বিধা ছিল। পাশে বসা ছিলেন তখনকার তরুণ কবি, একবিংশ-র প্রথম সহকারী সম্পাদক বদরুল হায়দার। তিনি বললেন, ‘মানুষ’ কবিতাটি শুধু গ্রন্থভুক্ত করবেন তা নয়, ওটিকে দিতে হবে প্রথমে। আমি তার কথা মেনে নিই। আজ বুঝি, যথার্থ পাঠকের অন্তর্দৃষ্টি তার ছিল বলে কবিতাটি রক্ষা পেয়েছে। প্রসঙ্গত, কবি সবসময় নিজের কবিতার শ্রেষ্ঠ বিচারক না-ও হতে পারেন, তার সেই নির্মোহতার দূরত্ব না-ও থাকতে পারে।
কী আছে ঐ কবিতায়? প্রথমবার পড়লে মনে হবে কিছু স্টেটমেন্টের সমাহার, মানুষকে সংজ্ঞায়নের প্রচেষ্টা, কিছু মর্মবস্তুর সমাপতন যার মাধ্যমে মানুষ নামের প্রাণীটি সম্পর্কে আমার প্রতীতি বিধৃত। কিন্তু কী এমন নতুন কথা তাতে আছে যা আগে কেউ বলেনি? মানুষ নামের এক রহস্যময়তার সামনে অভিভূত লালন ফকির গান বেঁধেছিলেন- ‘সহজ মানুষ ভেবে দেখ না, যাবে অচেনারে চেনা।’ শেক্সপীয়রের হ্যামলেটের উক্তি : ÔWhat a piece of work is man! How noble in reason, how infinite in faculty... ’কিন্তু মানুষকে কেউ পুরোপুরি বোঝেননি। মানুষ নামক অপরিজ্ঞাত ও অপরিজ্ঞেয় রহস্য আমাকে উদ্দীপিত করেছে সবসময়। তবে কবিতাটি কোনো সচেতন মানবপ্রশস্তি নয়, বরং আমার অবচেতনা থেকে উঠে-আসা একটি অবাঙমানসগোচর অনুভূতি। মনে আছে, এক ঝকঝকে সকালবেলা একরকম ঘোরের মধ্যে কবিতাটি লিখেছিলাম, অথবা আমার ভেতরের অন্য কেউ আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছিল। আমি আজো জানি না কার অদৃশ্য হাত বেজে উঠেছিল শব্দ হয়ে। আমার ভেতর-বাসিন্দা হয়তো তিনি, আমার কাব্যনিয়ন্তা। ‘আমি মানুষকে ভালবাসি কেননা সে একদিন নিজ হাতে নিজেকে পোড়াবে’-এ কথাকে এ্যাপক্যালিপ্টিক বা প্রফেটিক যাই মনে হোক না কেন, মানুষের অবিনশ্বরতায় আমার আস্থা অপরিসীম। একে মানবতান্ত্রিকতার পুরোনো বাচনও ভাবতে পারে কেউ, কিন্তু মানুষের বিধ্বংসী প্রবণতার নান্দীপাঠ আর কেউ করেছে বলে আমার জানা নেই।
মানুষকে কেউ ধারণ করতে পারে না, কেননা মানুষ মানুষের কল্পনাসীমাকেও স্ফারিত করে দিয়ে যায়। কিছুটা ধরতে পেরেছিলেন ওঅল্ট হুইটম্যান : তার বিশ্বাতিক্রমী চেতনায় মানুষের আত্মার যে বিপুল-বিশালতার জয়গান তার তুলনা পাওয়া ভার।
Do I contradict myself?
Well then I contradict myself.
I contain multitudes.
এই বিপুল মহাবিশ্ব, এই অন্তহীন কালপরিধি এই স্তবকের পর স্তবক সজ্জিত নীহারিকাপুঞ্জ সব কিছু আমাকে-মানুষকে-জন্ম দিয়েছে লক্ষ কোটি বছরের সাধনায়, আমারই ভ্রƒণকে লালন করেছে পরম মমতায়, যাতে অতি-শৈত্য অতি-আতপে নষ্ট না হয়ে যায়, অমিতকায় সরোয়েডরা মুখে করে বহন করেছে সে-ভ্রƒণ, আমি আসব বলে লক্ষ কোটি বছর তপস্যা করেছে মহাপৃথিবী। একমাত্র হুইটম্যানের প্রচণ্ড রোমান্টিক কল্পনায়ই মূর্ত হতে পেরেছিল মানুষের সেই অধিজাগতিক রূপমহিমা। বাংলা কবিতায় নজরুল ইসলামের ‘মানুষ’ কবিতাটির পেছনে দূরবর্তী প্রভাব হুইটম্যানের, নিকট প্রণোদনা মার্কস। সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই-চণ্ডীদাসের এই মহৎ উচ্চারণের নবায়ন নজরুলের কবিতায় : ‘গাহি সাম্যের গান/মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।’ আমার কবিতা তার পাশে সামান্যই; তবে কবিতাটি পাঠকের মনোযোগ পেয়েছে জেনে আমি আনন্দিত। কোনো কোনো অপরিণতমনস্ক পাঠক এর ভিন্নরকম পাঠের চেষ্টাও করেন বলে শুনেছি। ঈশ্বরের আলখাল্ল¬াও মানুষকে ধারণ করতে পারে না-এ উচ্চারণ বিব্রতকর ঠেকে তাদের কাছে যারা মরমিয়াতত্ত্বের আস্বাদ কখনো পায়নি, জানে না স্রষ্টাও এক অর্থে সৃষ্টির ওপর নির্ভরশীল-কারণ সৃষ্টিই তাকে সংজ্ঞায়িত করে। তবে সুফিতত্ত্ব আমজনতার জন্য নয়।
সোমবার, ১৯ অক্টোবর, ২০০৯
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন