রবিবার, ১ নভেম্বর, ২০০৯

প্রো লো গ

প্রো লো গ

আহমদ মিনহাজ

১৯৭১-এ পোড়া মাটি নীতি গ্রহণ করার সময় জেনারেল টিক্কা খান তাঁর সেনাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন,-‘আমি মাটি চাই, মানুষ নয়’। আর মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী তাঁর ডায়েরিতে লিখেছিলেন,-‘পূর্ব পাকিস্তানের শ্যামল মাটি রক্ত দিয়ে লাল করে দেয়া হবে’। জেনারেলদের সংকল্পটি সফল হবার দিনগুলোয় সুদূর ইউরোপ মহাদেশের জনৈক সংবাদকর্মী চরকির মতো সারা দেশ চষে বেড়াচ্ছিলেন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বিদেশীদের চলাচলের ওপর সরকারি নজরদারী ও বিধিনিষেধ থাকলেও সংবাদকর্মীর মনের জোর ছিল অজেয়। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি রণাঙ্গনে ঘুরে বেড়াতেন। যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে সংবাদ প্রতিবেদন পাঠাতেন। পরিস্থিতি দিন-দিন জটিল ও সংঘাতমুখর হয়ে উঠছিল। প্রচারমাধ্যমের কল্যাণে সারা বিশ্ব জেনে গিয়েছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রের পূর্বাঞ্চলে একটি ভয়াবহ গণহত্যা সংঘটিত হচ্ছে। বিশৃঙ্খলা বা গৃহযুদ্ধ দমনের নাম করে পাক সেনারা নিরীহ মানুষ হত্যা করছে সেখানে। পাকিস্তানের প্রতি বৈরী ও পূর্বাঞ্চলের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ায় অনেকে ধারণা করছিলেন আরেকটি পাক-ভারত যুদ্ধ বোধহয় আসন্ন হতে যাচ্ছে। অন্যদিকে পাকিস্তানী শাসকচক্র ভারতকে পূর্বাঞ্চলে ব্যস্ত রাখার মাধ্যমে পাকিস্তানের সীমানালগ্ন ভারতীয় এলাকাগুলো অরক্ষিত করার ফন্দি আঁটছিলো। সংকটপূর্ণ সেই পরিবেশের মধ্যে বিদেশী এই সাংবাদিক রক্তক্ষয়ী একাত্তরকে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরার দায়িত্বটি পালন করছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানের সামগ্রিক পরিস্থিতি তার মনকে গভীরভাবে বিচলিত করে তোলে। পেশাগত দায়িত্বের বাইরে এক গভীর ও ব্যক্তিগত অনুভব লিখে ওঠার তাগিদ বোধ করেন তিনি। রক্তঝরা রণাঙ্গন ঘুরতে-ঘুরতে সংবাদকর্মী ছোট এক শহরে হাজির হন। টিক্কার সংকল্প মোতাবেক শহরটি তখনো রক্তে লাল হয়ে ওঠেনি। নদী বেষ্টিত এই শহরটি সংবাদকর্মীর ভালো লেগে গেলো। খবর সংগ্রহের তাগিদে একের-পর-এক রণাঙ্গনে ঘুরতে হয় তাকে। তিনি দেখেছেন যুদ্ধ কীভাবে মানুষকে মূল্যহীন করে তোলে; সন্দেহ-অবিশ্বাস ও বিশ্বাসঘাতকতা কীভাবে গতিশীল হয় সেখানে; আর হত্যা-ধর্ষণ ও সেনা ক্যাম্পে নির্মম অত্যাচারের বলি হওয়া থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য নিরীহ মানুষ কীভাবে রাতের অন্ধকারে অজানার উদ্দেশে পলায়ন করে।

হত্যা ও পলায়নের এইসব দৃশ্য তাকে ক্লান্ত করে থাকবে হয়তো-বা। হতে পারে, খবর সংগ্রহের যান্ত্রিক চাপটি তিনি আর নিতে পারছিলেন না। কারণ যাই হোক, সংবাদকর্মীর মনে হলো শহরটি মন্দ নয়। যুদ্ধের লেলিহান শিখা থেকে সে এখনো বেশ দূরে অবস্থান করছে। মানুষ উদ্বিগ্ন হলেও পলায়নের জন্য ব্যতিব্যস্ত নয় এখানে। পাকিস্তানী সেনা ও মুক্তিবাহিনীর গতিবিধি তখনো সীমিত ছিল সেখানে। সংবাদকর্মী দেখলেন পাক সেনাদের ছোটখাটো প্লাটুন ও সহযোগী রাজাকার বাহিনীরা শহর টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে। মুক্তিবাহিনীর কোনো তৎপরতা চোখে পড়লো না তার। শহরকে বেষ্টনকারী নদীর আশপাশে মুক্তিবাহিনীর এক গোপন মৌচাকের খবর পেলেন তিনি; তবে হামলা চালাবার জন্য তাদেরকে খুব একাগ্র মনে হলো না। মুক্তিরা সম্ভবত নাটকীয় কোনো মুহূর্তের জন্য অটল হয়ে প্রতিক্ষা করছিল।
সংবাদকর্মী টহলদার সেনাবাহিনীর সাথে দেখা করলেন এবং শহরের একমাত্র হোটেলে গিয়ে উঠলেন। স্থানীয় লোকজনের অনেকের সঙ্গে তার খাতির জমে গেলো। ভিনদেশী এই সাংবাদিকের কাছে সবাই রণাঙ্গনের খবর শুনতে চাইতেন। মাঝেমধ্যে পাকিস্তানী সেনাক্যাম্পে তার ডাক পড়তো। সেনা ক্যাম্পের কমান্ডার বিদেশীকে কৌশলে জেরা করতেন। বিদেশী আসলে কী ধরনের খবর পাঠান সে-বিষয়ে অবগত থাকা ছিল কৌশলের মূল লক্ষ্য। যুদ্ধকালে প্রেস সেন্সরের অভিজ্ঞতা কোনো লেখক বা সংবাদকর্মীর জন্য নতুন কিছু নয়। সংবাদকর্মী এতে অভ্যস্ত ছিলেন বিধায় পাক কমান্ডারকে সামাল দেয়া তার পক্ষে কঠিন মনে হলো না। দায়িত্ব পালনের সেই দিনগুলোয় সংবাদকর্মী অনুভব করলেন নিজের অভিজ্ঞতা বয়ান করার মতো অবসর তার হয়েছে। হোটেলের প্রায়ান্ধকার একটি কক্ষে বসে সেই বিবরণ তিনি লিখতে বসে গেলেন ...

...

‘আমি রিচার্ড। রিচার্ড গেরহার্ড কোনেল। জার্মানির নাগরিক। ভাইমার নগরে আমার জন্ম,-এক ইহুদি পরিবারে। পেশায় আমি একজন সাংবাদিক। ভাইমার থেকে অনেক দূরে ভারতের নিকটবর্তী একটি শহরে বসে লিখছি। ভারতের নিকটবর্তী হলেও ছোট এই শহরটি পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্গত। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এই শহরের দূরত্ব প্রায় তিন হাজার মাইল, হতে পারে আরো বেশি! পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি জনগোষ্ঠীরা বসবাস করে। বাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চলটি পূর্ব বাংলা নামে অধিক পরিচিত। বাঙালিদের আরো একটি ভূখণ্ড রয়েছে। এই ভূখণ্ডটিকে পশ্চিম বাংলা নামে অভিহিত করা হয়। পশ্চিম বাংলা এখন ভারত রাষ্ট্রের অন্তর্ভূক্ত। সে যাই হোক, আমার লেখার বিষয় পূর্ব পাকিস্তানের যুদ্ধ পরিস্থিতি। এই বিষয়টির উপর আলোকপাত করার জন্য আমায় এখানে পাঠানো হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়া আমার কাছে নতুন কোনো ঘটনা নয়। এর আগেও এলাকাটি আমি সফর করেছি। দক্ষিণ এশিয়ায় কাজের অভিজ্ঞতা বিবেচনা করে কর্তৃপক্ষ আমার উপর আস্থা রেখেছে। আস্থার প্রতিদান আমি দিতে পারবো কিনা সেটি এই মুহূর্তে নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। অতীতের সফরগুলোর তুলনায় এবারের সফরটি অনেক কঠিন। পরিবেশের কারণে অন্যবারের চেয়ে আলাদা। পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলে একটি যুদ্ধ সংঘটিত হচ্ছে। বিগত ছয় মাস মাস ধরে এই যুদ্ধ-উপকূলটি আমি ঘুরে বেড়াচ্ছি।

আজ নিয়ে দশ দিন হলো ছোট্ট এই শহরে এসে উঠেছি আমি। টেবিলে একটি মোমবাতি আলো দিচ্ছে এখন। সন্ধ্যার পর সব বাতি এখানে নিভে যায়। যুদ্ধের ভাষায় একে ব্ল্যাকআউট বলা হয়। ব্ল্যাাকআউট শুরু হলে লোকজন ঘরে ঢুকে পড়ে। পরস্পরের সঙ্গে তারা ফিসফিস করে কথা বলে। অনেকে নিচু স্বরে ‘বিবিসি’ বা ‘স্বাধীন বাংলা বেতার’ শুনে। এটি একটি রেডিও স্টেশন। স্টেশনটি মুক্তিবাহিনীর খবর প্রচার করে থাকে। এই মুহূর্তে মুক্তিবাহিনী বাঙালি জনগোষ্ঠীর একমাত্র আশা-ভরসা। পাকিস্তানের দক্ষ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিরা প্রাণপণ লড়াই করে যাচ্ছে। ‘স্বাধীন বাংলা বেতার’ থেকে চরমপত্র নামে একটি অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়। অনুষ্ঠানটি বেশ জনপ্রিয়। এটি প্রচারিত হওয়ার সময় বাঙালিদের চোখ-মুখ অন্ধকারের মধ্যে জ্বলজ্বল করতে দেখেছি আমি। তারা বিশ্বাস করে ৭ মার্চের জনসভায় পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীকে হুঁশিয়ার করে শেখ মুজিব যে চরমপত্রটি ঘোষণা করেছিলেন সেটি ব্যর্থ হতে পারে না। পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক জান্তা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অভিযোগে মুজিবকে এরিমধ্যে গ্রেফতার করেছে। তিনি এখন কোথায় রয়েছেন সেটি নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তাঁর পরিবারের লোকজনকে ঢাকার একটি ছোট বাড়িতে আটক করে রাখা হয়েছে। সম্ভবত তাদেরকে হত্যা করা হবে। আওয়ামী লীগের অনেক নেতা কোলকাতায় অবস্থান করছেন। কুষ্টিয়ায় গঠিত মুজিবনগর সরকার কূটনৈতিকভাবে সক্রিয় রয়েছেন, তবে সার্বিক যুদ্ধ-পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে মনে হয়। দৃশ্যপটে শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতি বাঙালির যুদ্ধ জয়ের মনোবলকে খানিক দিকভ্রান্ত করলেও মুক্তিবাহিনী মরণপণ লড়াই করে যাচ্ছে। ভারতে প্রশিক্ষিত মুক্তিবাহিনী সংখ্যায় লাখের কোটা অতিক্রম করেছে। একটি শক্তিশালী ও পেশাদার সামরিক বাহিনীর সঙ্গে অপেশাদার মুক্তিবাহিনীর এই লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত কে জয়ী হবে তা এখনো স্পষ্ট নয়।

এখন সেপ্টেম্বর মাস। টেবিলে একটি মোমবাতি জ্বালিয়ে আমি লিখছি। কিছুক্ষণ আগে হোটেল বয় বলে গেলো আজ রাতে শেলিং হতে পারে। বিমান হামলাকে বাঙালিরা শেলিং বলে। এই শহরে এখনো বড়ো ধরনের কোনো বিমান হামলা হয়নি। হয়তো আজ হবে। লোকজন খাটের নিচে ঢুকে বিমান হামলা থেকে বাঁচার চেষ্টা করবে। আমি ঠিক কী করবো জানি না। মৃত্যুর দেবতা এখনো আমায় করুণা করছেন। তার এই করুণা আর কত দিন বজায় থাকবে কে জানে! হতে পারে, আজকের রাত আমার জীবনের শেষ রাত হবে! রণাঙ্গনে সব কিছু অনিশ্চিত। যেহেতু আমি একজন সংবাদকর্মী অনিশ্চয়তার এই ঝুঁকিটি আমায় নিতে হয়েছে। হতে পারে, আর একটু পরে, কিংবা এই লেখাটি শেষ করার মুহূর্তে আমি মারা যাবো! ঈশ্বর, তা যেন না হয়। লেখাটি শেষ করার সুযোগ যেন পাই। আর, ফ্রাউলিন, তোমায় বলছি,-‘আমার জন্য শোক করো না; আমরা সবাই ভাইমারের সবুজ পাইনবন থেকে এসেছি এবং অন্তিমে সেখানে ফিরে যাবো। তুমি নিশ্চিত থাকতে পারো,-লিখতে বসার আগে ডিনার সেরে নিতে আমি ভুল করিনি। অবশ্য ক্যান্ডেল নাইট ডিনার। ভাইমারের কথা খুব মনে পড়ে। ভাইমারে এমন কোনো রোববারের কথা মনে করা কষ্টের, যে-রোববারে আমরা দুজন ক্যান্ডেল নাইট ডিনার করি না। ব্যাপারটি চমৎকার। বিজলি বাতির কারণে রাত্রির অন্ধকার সেখানে উপলব্ধি করা কঠিন। আলোর বন্যার মাঝে ক্যান্ডল নাইটের আধো-অন্ধকারে তোমার হাতের রঙ আমি সবচেয়ে ভালোভাবে স্পর্শ করতে পারি। আজ সেটা ঘটেছে। আলো এখানে দুর্লভ ঘটনা হলেও ঘুটঘুটে অন্ধকারের মাঝে আমি যখন মোমবাতি জ্বালাই, মনে হলো ভাইমারের আকাশ পথ ভুল করে পূর্ব বাংলার ছোট্ট এই শহরে চলে এসেছে। তোমার সাদা রঙের স্কার্ট ও চোখে উজ্জ্বলতার আভাস পেলাম যেন। আভাসটি স্মরণ করিয়ে দিলো,-একদা আমরা পরস্পরকে খুব ভালোবাসতাম। তোমার স্কার্টের রঙ ও গায়ের গন্ধে জার্মান সসেজের ভাপ টের পেয়ে খেপে উঠতাম আমি। যৌনতা জার্মানদের অতি প্রিয় একটি শব্দ এবং তোমাকে আমি যৌনতার মতো ভালোবাসি। যৌনতা হচ্ছে সংবেদনশীল সবুজ; যাকে অনুভব করলে ভাইমার ও তোমার মুখ মনে পড়ে। কিন্তু এই দেশে পা’ রাখার দিন থেকে দেখছি যৌনতা প্রথমে লাল, তারপর কালচে সবুজ, তারপর...! নাহ! আমি আর এসব ভাবতে চাই না...

ভয় পেয়ো না ফ্রাউলিন, গত রাতে নিজেকে পরীক্ষা করেছি;-প্রাণপণে চোখ বুজে তোমার স্কার্টের রঙ মনে করার চেষ্টা করে! এটি জেনে তুমি সুখী হবে যে তোমার মুখ আমি মনে করতে পারি এবং আমার পুরুষাঙ্গটি ভাইমারের দিনগুলোর মতো দৃঢ় ও উচ্ছ্রিত হয়। এই সক্ষমতা আমায় পাইনবনের সুখ দিয়েছে। ভাইমারের ঘাসগুলোর খবর আমায় শোনাতো পারো। এই সেপ্টেম্বরে ওরা নিশ্চয় বেশ সবুজ হয়ে উঠেছে। আর আমার বন্ধুদের খবর কী বলো? মাথামোটা রাইকার্ড নিশ্চয় রোজ তোমায় এই বলে প্রশংসা করে,-‘গেরহার্ডের সঙ্গে ফ্রাউলিনের ভালোবাসা হের হিটলারের এমপিফিটামিন নেয়ার মতো একটি উদ্ভট ঘটনা। কেননা হিটলার এমপিফিটামিন নেয়, যা তার স্নায়ুকে চনমনে রাখে। মিত্র শক্তি বার্লিনে ঢোকার ক্ষণে এমপিফিটামিন তার কার্যকারিতা হারায়, এবং হের হিটলার প্রিয়তমা ইভা ব্রাউনকে নিয়ে বাঙ্কারের গর্তে নিখোঁজ হয়। নাৎসিবাদ একটি এমপিফিটামিন, আর হের হিটলার এখনো জীবিত।’ বেচারা রাইকার্ড। আমার হয়ে ওর গালে চুমু পাঠিয়ে দিও। ওকে জানিয়ে দিতে ভুলো না,-এমপিফিটামিনের চেয়ে ওর মোটাসোটা গালে চুমু খাওয়া অনেকবেশি কামদায়ী, এবং গেরহার্ড তার ফ্রাউলিনকে সেই অনুমতি দিয়েছে। তবে খোদার কসম,-রাইকার্ডের গালে যখন চুমু খাও, ওর পালস্টা মেপে নিও প্লিজ। ওকে বলো যুদ্ধ আমায় উদার করে দিয়েছে, আর হের হিটলার এখনো জীবিত! প্রিয় ফ্রাউলিন, নাৎসিবাদ একটি এমপিফিটামিন এবং সব যুদ্ধে সমান কার্যকর। যাকগে, ক্যাথির খবর কী বলো। সব্জি-রঙ মিষ্টি মেয়েটি কেমন আছে? সে কি আগের মতো খাটো স্কার্ট ও সরু হাইহিল পরে? বাতাস লেগে যা বেলুনের মতো ফুলে ওঠে তার টকটকে লাল প্যান্টিকে দৃশ্যমান করবে বলে? প্যান্টি একটি গোপনীয় অন্তর্বাস। যৌনতাকে এটি উত্তেজিত করে। উত্তেজিত হওয়া মানে তোমায় ভালেবাসা, ভাইমারের মুখ মন পড়া। এই শহরে আসার পথে তোমার প্যান্টির মিষ্টি ছাটের কথা মনে করে উত্তেজিত হতে শুরু করেছিলাম, কিন্তু প্রবল গোলাগুলি শুরু হলো,-আমার চোখ প্রথমে লাল, তারপর কালচে সবুজ, তারপর...! নাহ! এসব আর ভাবতে চাই না...

আমাদের বাড়ির খবর কি বলো? মা-বাবা কেমন আছে? বুড়ো-বুড়ি কি আমায় আলাপ করে? কতো বয়স হলো দু’জনার? বৃদ্ধ দম্পতিকে এই খবরটি পৌঁছে দিও,-তাদের শুকনো গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে, দৃৃশ্যটি বড়ো বেমানান হবে আমার জন্যে। গত ছয় মাস ধরে এতো মানুষকে কাঁদতে দেখেছি, এবার একটু হাসতে চাই। মা কি এখনো পিয়ানো বাজায়? আর বুড়ো? পিয়ানো সম্পর্কে তার মনোভাব কি বদলেছে? নাকি সে এখনো মনে করে মোজার্টের সিম্ফনিগুলো পিয়ানোর চেয়ে ভায়োলিনে জমে ভালো; এবং মোজার্টের শিষ্য হিসাবে হামেল খানিকটা কুঁড়ে ও অলস! বুড়োকে জানিয়ে দিও, মা আসলে খুব ভালো পিয়ানো বাজায়, বিশেষ করে বাখ ও ওয়াগনার। এই দেশে অনেকে ভালো হারমোনিয়াম বাজাতে পারে। ভারত উপমহাদেশে হারমোনিয়াম একটি জনপ্রিয় বাদ্যযন্ত্র। যন্ত্রটিকে তুমি পিয়ানোর ক্ষুদ্র সংস্করণ ভাবতে পারো, তবে এর আওয়াজ পিয়ানোর মতো অতোটা সুরেলা ও বিস্তৃত নয়। এখানে বাঁশি ও ভায়োলিনের চল আছে এবং অনেকেই ভালো বংশীবাদক। ভায়োলিন এমন এক বাদ্যযন্ত্র যেটি ভাইমারকে মনে করায়। জন্মভূমিকে জাগানোর জন্য পৃথিবীর সবখানে সুর তোলে সে। গেলবার এক ভায়োলিনবাদকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। গ্রাম্য কোনো সুর বাজাচ্ছিলো সে। মৃত্যুর বিষাদ ও জীবনের আস্বাদে যে আর্তি ধরা থাকে, ভায়োলিনবাদক সেই আর্তিকে তার আঙুলে জমা করেছিল। এবার তাকে খুঁজে পেলাম সবুজ কলাবাগানে;-পুকুরের ধারে কালো গর্ত ভরা দু’চোখ নিয়ে বসে আছে। ভায়োলিন বাজানোর অপরাধে সেনারা তার চোখ উপড়ে দিয়েছে। আমি তার কাঁধ স্পর্শ করলে লোকটি হাউমাউ করে কেঁদে উঠেছিল। মৃত্যুর ভয় জমা ছিল সেখানে।

ফ্রাউলিন, পূর্ব বাংলায় মৃত্যুর হাতে জখম হওয়ার ভয়ে মানুষ এখন কাঁদে। একটি ভয়-উপদ্রুত উপকূলে ঘুরে বেড়াচ্ছি আমি। একদা যেমন ছিল আউশভিৎস। যদি পারো আমার প্রিয়তম বুড়িকে জানিয়ে দিও,-গেরহার্ড কথা বলতে ভয় পাচ্ছে। মানুষকে আলিঙ্গন করতে ভয় পাচ্ছে। প্রতিটি আলিঙ্গন একেকটি মৃত্যুফাঁদ;-ভয়, সন্দেহ ও অবিশ্বাস সেখানে ওত পেতে রয়েছে! ঝগড়াটে বুড়োর কানে এই খবরটি যেন পৌঁছায়,-গত ছয় মাসে গেরহার্ডের চুল-দাড়ি অনেক লম্বা হয়ে গিয়েছে। তাকে দেখতে জেসাসের মতো লাগে। কিন্তু অন্ধকে দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিতে কিংবা মৃত কোনো ল্যাজারাসকে পুনর্জীবিত করতে সে অক্ষম। বুড়োকে আরো জানাও,-এই দেশে প্রচুর বুড়ো লোকজন বসবাস করে, যাদের বয়সের কোনো গাছ-পাথর নেই। অশীতিপর এক বৃদ্ধ সেদিন গেরহার্ডকে তার আক্ষেপের কথা শুনিয়েছে। পাকিস্তানী সেনারা বৃদ্ধকে হত্যা না-করে তার নাতিকে হত্যা ও নাত-বৌ’কে ধরে নিয়ে গেছে। রক্তের প্রবাহকে এভাবে হারানোর যন্ত্রণা বৃদ্ধকে মাঝেমধ্যে পাগল করে তোলে। কিন্তু সে আত্মহত্যা করতে পারছে না। বৃদ্ধ এখনো আশা করে,-যা ঘটেছে তা একটি দুঃস্বপ্ন এবং তার নাতি ও নাত-বৌ অচিরেই তার কাছে ফিরে আসবে!

এই বৃদ্ধের আহাজারি গেরহার্ডকে তার ইহুদি জনকের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। প্রিয় ফ্রাউলিন, গেরহার্ড তার বাবার কাছে এই খবরটি পৌঁছে দিতে তোমায় অনুরোধ করছে,-ইহুদি নিধনের মিশন আপাতত শেষ করেছে কেউ। বৌদ্ধ হত্যার মিশন ভিয়েতনামের কলা বাগানগুলোকে এখনো সবুজ করতে পারেনি। আর এখানে শুরু হয়েছে হিন্দু হত্যার মিশন। তারপর? অদূর ভবিষ্যতে নিশ্চয় মুসলমান হত্যার মিশনে নামবে কেউ? প্রিয় বাবা, ফ্রাউলিনের মাধ্যমে তোমায় অবগত করি,-ধর্ম একটি মারাত্মক এমপিফিটামিন। হের হিটলার এমপিফিটামিন ভালোবাসতেন। জেনারেল ইয়াহিয়া ও তার সহযোগীরা এটি ভালোবাসে। এখন তারা ঘরে ও ধানখেতে সমানে মানুষ হত্যা করছে। পূর্ব বাংলার ধানখেত ও ভিয়েতনামের ধানখেতের মধ্যে প্রচুর মিল রয়েছে। ধানখেত প্রথমে কচি সবুজ হয়, কচি সবুজ থেকে কালচে সবুজ, অতঃপর সোনালি হয়। তবে এই দেশে একটি নতুন ধানখেত আবিষ্কার করেছে গেরহার্ড। ধানখেত প্রথমে লাল, তারপর কালচে সবুজ, তারপর...! নাহ! এসব আর ভাবতে চাই না। ফ্রাউলিন, আমার বয়স্ক বাবার কানে খবরটি পৌঁছে দিও,-মোজেস ছাড়া স্বর্গের সিঁড়ি বোধহয় আজো কেউ নাগাল পায়নি। পৃথিবী থেকে শুধু নরক দেখা যায়। বাবাকে বলো,-আউশভিৎস ও গ্যাস চেম্বার এখনো সক্রিয়। যেমন সক্রিয় বেয়নেট ও যুদ্ধ বিমান!

ফ্রাউলিন, আরো কিছু খবর পাঠাও আমায়। অবশ্যই ভাইমারের। বিনিময়ে তোমায় আমি টেগোরের কবিতা ও গান শুনাবো। গ্যেটেকে ভাইমারের আত্মা বলে সম্বোধন করা হয়। টেগোরকে তুমি বাঙালির আত্মা নামে সম্বোধন করতে পারো। টেগোর এক বহুবর্ণিল মানুষ। বাঙালিরা টেগোরকে তাদের রক্তে ও পরিপাকে বহন করে; জার্মানি যেমন বহন করে গ্যেটে ও শিলারকে। আমি নিশ্চিত টেগোরের গান তোমার ভালো লাগবে। কারণ তার গান সহজ অম্লজানের মতো রক্তের ভিতরে ঢুকে ছন্দ তোলে। বাঙালিরা এই গানের বিষয়বস্তুকে বড়ো ভালোবাসে। তবে আমার ভালো লাগে গানের ভিতরে প্রবাহিত সুরধারা। টেগোর একজন উৎকৃষ্ট কম্পোজার। তাঁর গানে নিঃশব্দ-কে পড়া যায়। আমি পড়া শব্দটি ব্যবহার করছি। কারণ, টেগোরকে বাখ বা বেথোভেনের মতো অনুভব করতে হলে তোমাকে তার গানের সুরধারা খেয়াল করে উঠতে হবে। এখানে এসে কিছুটা বাঙলা শিখেছি আমি। তবে টেগোর বা অন্য বাঙালি কবিদের উপলব্ধি করার মতো যথেষ্ট বাঙলা আমি জানি না। এটি একদিক দিয়ে আমায় রক্ষা করেছে। বাঙালির মতো বাঙলা জানা থাকলে আমি হয়তো টেগোরের গানের ভাববস্তুকে বেশি গুরুত্ব দিতাম এবং তার সুরপ্রবাহ আমায় সেভাবে আকৃষ্ট করতো না। বাঙলায় খর্ব হওয়ার কারণে টেগোরের সুর শুনে আমি ভাইমারকে অনুভব করি। বিষয়টি আমায় আনন্দ দিয়েছে। তোমার জানা উচিত,-টেগোরকে আমি পছন্দ করি তার গ্যেটেসুলভ মহৎ কাণ্ডকীর্তির জন্য নয়; আমি তাকে পছন্দ করেছি, কারণ, তাঁর গান আমায় ফ্রাউলিন ও ভাইমারের মুখ স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। যাকগে, টেগোর সম্পর্কে আরো গল্প করার ইচ্ছে থাকলেও এই মুহূর্তে সেটি সম্ভব হচ্ছে না। যেহেতু ঈশ্বর আমায় করুণা করছেন এবং আমি তোমার শুষ্ক ঠোঁটের উদ্দেশে এখনো চুম্বন পাঠাতে পারছি। আমি মনে করি ভাইমার ত্যাগ করার সময় গ্যেটে তার বান্ধবীর শুষ্ক ঠোঁটে এইরকম চুম্বন করতেন। পবিত্রতা নামের নতুন এক রঙ দিয়ে আমি এটি অনুভবের ইচ্ছা করি। আমার কাছে চুম্বন হচ্ছে যুদ্ধ-প্রতিরোধী শব্দ। যদিও এখানে তা নয়। ঢাকা থেকে চিটাগাং যাওয়ার পথে শত্রুরা একটি কলোনিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। আগুনের লেলিহান শিখার অদূরে দাঁড়িয়ে দেখেছি দাড়িওয়ালা এক লোক একটি কিশোরীকে প্রাণপণ চুম্বনে বিধ্বস্ত করছে। মরণপণ সেই চুম্বনে কিশোরীর অনিচ্ছা আমি স্পষ্ট টের পাচ্ছিলাম। সে ছটফট করছিল। আগুনের শিখার মতো উজ্জ্বল সেই কিশোরীর ঠোঁটের রঙ প্রথমে লাল, তারপর কালচে সবুজ, তারপর...! নাহ! এই দৃশ্যটি আমি আর ভাবতে চাই না! পরিবর্তে তোমায় এই বাক্যটি স্মরণ করতে বলি,- চুম্বন এক মৃত্যু-প্রতিরোধী যুবক, যে তার দয়িতাকে জীবনের দিকে আগলে রাখে। তবে এখানে তা নয়। রণাঙ্গনে চুম্বন মৃত্যুকে প্রতিরোধ করতে পারে না।

ওসব থাক! ভাইমারের আরো খবর পাঠাও আমায়। জন্মভূমির জন্য আমি তৃষ্ণার্ত হয়ে আছি। এই তৃষ্ণা তোমার অন্তর্বাসের দিকে আমায় উৎকর্ণ করেছে। তুমি যখন ঘুমাও, টের পাও কি,-অন্তর্বাসরা শব্দ করে? ফ্রাউলিন, এই বাক্যটি তোমায় শিহরিত করার জন্য যথেষ্ট হবে,-অন্তর্বাস হচ্ছে এক সংগোপন যৌন-অস্তিত্ব, যেটি জন্মভূমির সঙ্গে মানুষকে মিলিত করে। আমি মিলিত হতে চাই। আজকের এই রাত বাস্তবিক মিলনের রাত হয়ে এসেছে;-তোমার সঙ্গে, এবং অদেখা জন্মভূমির সঙ্গে।

হোটেল বয় সতর্ক সংকেত দিয়ে গেলো আজ রাতে যুদ্ধ বিমান হামলা করতে পারে। মুক্তিবাহিনী নাকি শহরে ঢুকে পড়েছে। মুক্তিবাহিনী এক সংগোপন যৌন-অন্তর্বাস। হোটেলে বসে তাদের নড়াচড়া স্পষ্ট টের পাচ্ছি; তাদের কাদাভেজা অন্তর্বাসের খসখসানি শুনতে পাচ্ছি। গেরিলা রণাঙ্গনে অন্তর্বাস ঘুমন্ত কোনো নারীর মতো। তাকে স্পর্শ করার আগে সে কোনো শব্দ করে না। নৈঃশব্দ্য আমায় ভাইমারের দিকে মনোযোগী করছে এখন। আমার ছোট্ট শহর, বালকবেলার প্রথম যৌনতা,-তোমায় মনে করে গেরহার্ডের চোখ ভিজে উঠছে। তুমি তাকে আলিঙ্গন করো, তাকে নিজের ভেতরে জড়িত করো। গেরহার্ড তোমায় বলছে,-এই ছয় মাসে তার চুল জেসাসের মতো লম্বা হয়েছে এবং সে বাড়ি ফিরে যেতে ইচ্ছুক। প্রিয় ভাইমার, ফ্রাউলিনের মাধ্যমে তোমায় এ-বার্তাটি পৌঁছে দিচ্ছি,-গেরহার্ড একজন ইহুদি, আর ইহুদির কোনো স্বীকৃত জন্মভূমি নেই। তবু গেরহার্ড ভাইমারকে ভালোবাসে, যেমন ঈশ্বর ভালোবাসতেন মোজেসকে। তুমি কি একবার স্মরণ করবে,-আমরা সবাই আব্রাহামের বংশধর ছিলাম! আব্রাহাম আসে মিশর থেকে, অতঃপর সে ছড়িয়ে পড়ে সিরিয়া, কিনান, বেথেলহাম ও সৌদি আরবে। মরিয়ম পুত্র ঈসাকে বলো,-গেরহার্ড ভাইমারের সন্তান এবং মোজেসের অংশ। সে জন্ম নেয় ভাইমারে এবং তার জন্ম হয়েছে কিনান বা জেরুজালেমে। যেমনটি বাঙালিরা, তারা জন্ম নেয় পূর্ব বাংলায় এবং তাদের জন্ম হয়েছে মোহাম্মদের প্রবাহে। মরিয়ম-পুত্রের কাছে গেরহার্ডের জিজ্ঞাসা,-তুমি কি জানো রক্তের রঙ কেমন হয়? রক্ত হয় প্রথমে লাল, তারপর কালচে সবুজ, তারপর...! নাহ! এসব আর ভাবতে চাই না...!
কিছু মনে করো না ফ্রাউলিন। এই ছয় মাস আমায় উন্মাদ করে দিয়েছে। মানুষকে ভেবে-ভেবে নিজেকে ভাবার শক্তি হারিয়ে ফেলছি আমি। এবার তোমায় ভাবতে চাই। ভাইমারকে ভাবতে চাই। সাচ্চা এক ইহুদির পেশাগত আত্মবিশ্বাস জখম হয়েছে। এর জন্য ভাইমার কি তাকে উপহাস করবে। আশা করি তা ঘটবে না। জার্মান একটি মহান জাতি, আর ভাইমার আমাদের গর্ব। ছোট্ট এই রিপাবলিকে ইহুদিকে সম্মান করা হয়েছে, তুর্কিরা এখন যেটি পাওয়ার আশা করে জার্মানিতে। গেরহার্ড এই বার্তাটি মোহাম্মদকে পাঠাতে ইচ্ছা করে,-পূর্ব বাংলায় প্রেরিত পুরুষের ধর্মকে হত্যা করা হচ্ছে।

প্রিয় ফ্রাউলিন, আমি এখন হালকা হতে চাই। বুর্কেনহফের খবর জানাও আমায়। সে কি এখনো যথেষ্ট ওজন তুলতে পারে। ওয়েট লিফটিংয়ে বুর্কেনহফ এক আশ্চর্য প্রতিভা। তার দশাসই শরীর গঁথিক খিলানের মতো কারুকার্যময়। জার্মানি বীরত্বকে সম্ভ্রম করে, আর বুর্কেনহফ সম্ভ্রম করার যোগ্য। ওকে বলো,-গেরহার্ড বুর্কেনহফকে সমীহ করে; যেহেতু ওয়েট লিফটিংয়ে সে অতিমানবীয় কৃতিত্ব প্রদর্শন করতে যাচ্ছে। জার্মানি অতিমানবকে সমীহ করে। যদিও অতিমানব এক অবাস্তব ওয়েট লিফটিং, হের হিটলার যার অনুশীলন করতেন। বুর্কেনহফকে জানাও,-আসন্ন অলিম্পিকে ভাইমারের গর্ব যেন ক্ষুণœ না হয়। আমরা নিশ্চয় সোনার মেডেল পরা বুর্কেনহফের চেয়ে.. .. ক্রসটিকে অধিক পছন্দ করবো না? কিন্তু এখানে তা নয়। বুকে পদক ঝুলানো পাকিস্তানী জেনারেলরা পূর্ব বাংলায় শক্তির ওয়েট লিফটিং করছে এখন। তারা জেনে গেছে ওয়েট লিফটিং এক অতিমানবীয় ঘটনা, যা হের হিটলারকে চিরজীবী করেছে!

ফ্রাউলিন, ভাইমারের সংবাদ নেওয়ার আগে ওয়েট লিফটিংয়ের আরো কিছু বিবরণ শুনাই। ভাইমার একটি ছোট রিপাবলিক। এবং পূর্ব বাংলার এই শহরটি ভাইমারের মতো। এখানে পা রাখার আগে তেরোটি শহর ও এগারোটি গ্রাম আমি ঘুরেছি। সংবাদকর্মীর দায়িত্ব হলো ঘটনার বিবরণ ও পরবর্তী সম্ভাব্যতা অনুমান করা। রাজধানীতে বসে আমার সম্পাদক কী চায় সেটি তুমি জানো। দক্ষিণ এশিয়ায় উড়ে আসার আগে মি. শোফেনস্খিলের টেকো মাথায় প্রজাপতি উড়তে দেখেছি আমি। বিপদজনক বিছার মথ থেকে প্রজাপতির মতো যৌন-আবেদন সৃষ্টি করেন ঈশ্বর। প্রজাপতি একটি চমৎকার যৌনতা। এটি মি. শোফেনস্খিলের টেকো মাথা ও ন্যাড়া পুরুষাঙ্গে যুদ্ধের গুঞ্জন তুলছে। ফ্রাউলিন, তুমি কি জানো,-শোফেনস্খিলের পুরষাঙ্গ কীসে উত্থিত হয়? তোমায় আমি এই খবর দিয়ে হাসাতে চাই,-শোফেনস্খিলের পুরুষাঙ্গ ভাইমারের রাণি মার্লিন ডিয়াট্রিচের যৌবনকে স্মরণ করে শিথিল হয়ে পড়ে। ডিয়াট্রিচের যৌবন ছিল জার্মানির উত্থিত হওয়ার মতো ঘটনা। উত্থিত হওয়া এক গভীর শিল্পকলা, যেটি জার্মানিকে আমেরিকার কাছে বিস্ময়কর করেছে। ভাইমারের রাণি আমেরিকাকে উত্থিত করেছে তার শিল্পকলায়। শোফেনস্খিলকে পারেনি। তাকে যেটি উত্থিত করে, আমি কি সেই নাম উচ্চারণ করবো? তুমি খবর নিতে পারো, গেরহার্ড বলছে,-ভাইমারের রাণির চেয়ে বুখেনওয়াল্ডে শোফেনস্খিলের পুরষাঙ্গ অধিক দৃঢ় হয়ে ওঠে। হলিউড ভাইমার থেকে বহু দূর! বুখেনওয়াল্ড খুব বেশি হলে আট কিলোমিটার। শোফেনস্খিল এই আট কিলোমিটারের ভিতরে উত্থিত হয়; কারণ, বুখেনওয়াল্ড হলো এক আজব চিড়িয়াখানা। বন্দি ক্রীতদাসরা সেখানে ভাড়া খাটে মিল-কারখানায়, এবং বাধ্য হয় উত্থিত জার্মানিকে স্যালুট দিতে। ওইসব বন্দি প্রজাপতি শোফেনস্খিলের পুরুষাঙ্গ দৃঢ় করে; কারণ, বন্দি আসে পূর্ব ইউরোপের পেট চিরে, জার্মানির পেটের ভেতরে বসে গণতন্ত্র জারি রাখতে ইচ্ছুক সব এলাকা থেকে। প্রিয় ফ্রাউলিন, তুমি কি একমত হবে,-জার্মানি কখনো গণতন্ত্রে ছিল না, আর গণতন্ত্রে পুরুষত্ব উচ্ছ্রিত হয় না। শোফেনস্খিল আজো বিশ্বাস করে,-নাজিরা দরকারি, কারণ, তারা জার্মানিকে পুরুষত্ব দিয়েছিল!

ফ্রাউলিন, আমি কি বলতে পারি শোফেনস্খিলের পুরুষত্ব তার টেকো মাথা ও চৌকোনো গোঁফের মতো রঙদার? এই দেশের খবর পাঠাবার জন্য আমায় সে বেছে নেয়। যদিও আমার পুরুষত্ব এটি অনুভব করে উত্থিত হতে পারেনি। সে আমার পিঠ চাপড়ে বলেছিল,-রণাঙ্গনে যুদ্ধের খবর সংগ্রহের নাটকীয়তা সংবাদকর্মীর পুরুষত্বকে দৃঢ় করে! গেরহার্ড একজন শক্ত পুরুষ, এক খাঁটি জার্মান,-যুদ্ধের বিষকামড় সে সইতে পারবে।

ফ্রাউলিন, আমার হয়ে শোফেনস্খিলের টেকো মাথায় এই খবরটি চালান করো,-যুদ্ধের খবর সংগ্রহে আমি বোধহয় বিশ্বস্ততার পরিচয় দিতে সক্ষম হয়েছি। ইস্টার্ন গ্যারিসনের সর্বশেষ তৎপরতা জানার জন্য পূর্ব বাংলার তেরোটি শহর ও এগারোটি গ্রাম আমি সফর করি। তিনটি বধ্যভূমি সরেজমিনে পরিদর্শন করি। সফরটি আমায় এই অভিজ্ঞতা প্রদান করেছে,-গুলি-খাওয়া মানুষের রক্তের রঙ সরু ফোয়ারার মতো; কোনো মানুষ যখন গুলি খেয়ে মাটিতে গুঁড়ি মেরে বসে বা লুটিয়ে পড়ে, তার গুলিবিদ্ধ জায়গাটি থেকে পিচকিরির মতো লাল ফেনা বের হয়; অতঃপর সেই লাল গলে-পচে সংবাদকর্মী ও শকুনের খোরাকি হয়। মি. শোফেনস্খিলের কাছে জরুরি বার্তা পাঠাচ্ছে গেরহার্ড,-তুমি জেনে আনন্দিত হবে তিনটি বধ্যভূমি আমি ঘুরেছি। মুক্তিবাহিনী সন্দেহে কয়েক হাজার বাঙালিকে সেখানে হত্যা করা হয়েছে। একটি বধ্যভূমির মধ্যে বাঙালির পাশে কিছু সংখ্যক পাকিস্তানী সেনার লাশ পড়ে থাকতে দেখলাম। তাদের গায়ের ইউনিফর্ম দেখে মনে হলো বধ্যভূমিতে লাশ হওয়ার আকস্মিক দুর্ঘটনা তারা হজম করতে পারছে না। এটি এক বিস্ময়কর সমন্বয় মনে হলো। শত্রু-মিত্রে বিভেদ ঘোচানোর জন্য যুদ্ধ হলো একটি মোক্ষম এমপিফিটামিন। দুই প্রতিদ্বন্দ্বিকে সে বধ্যভূমিতে সমেবত করে।

ফ্রাউলিন, গেরহার্ডের হয়ে শোফেনস্খিলকে অবগত করো,-পূর্ব বাংলায় বধ্যভূমির সংখ্যা বাড়ছে আর আমি ক্রমাগত ভাইমারে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করছি। দয়া করে জানাও, শোফেনস্খিলের টাক মাথার দিব্যি দিয়ে গেরহার্ড এই খবরটি ছাপাতে বলেছে,-বধ্যভূমিগুলো মানুষের দুর্গন্ধে পচে উঠছে। চোখে ফেট্টি বাঁধা এইসব মানুষকে বর্ণনা করতে গেরহার্ড ভয় পাচ্ছে। তাকে যেন করুণা করা হয়। সে এখন ক্লান্ত। গত কিছুদিন ধরে একটি দুঃস্বপ্ন তাকে পাগলা কুকুরের মতো তাড়া করে। চোখ বুজলেই গেরহার্ড দেখতে পায় গ্যাস চেম্বারে ইহুদিরা ফুলে-ঢোল-হয়ে উঠছে, এবং শোফেনস্খিলের পুরুষাঙ্গ ও টেকো মাথার চতুর্দিকে একটি প্রজাপতি বনবন করে পাক খাচ্ছে।

প্রিয় ফ্রাউলিন, সুদূর পূর্ব বাংলা থেকে গেরহার্ড তোমায় এই সংকেত বার্তা পাঠাচ্ছে,-শোফেনস্খিল হইতে সাবধান! এই পুরুষাঙ্গ জীবনে কোনো নারীর জন্য উত্থিত হয় নাই। তুমি কি জানো, সে কীসে উত্থিত হয়? শোফেনস্খিল উত্থিত হয় বুখেনওয়াল্ডে। নিউজ চেম্বারে বসে তার টেকো মাথা সে উত্থিত করে পূর্ব বাংলায়। প্রিয়তমা ফ্রাউলিন, আমি তোমায় এই বলে সম্বোধন করি,-উত্থিত হওয়া এক দারুণ ব্যাপার; তোমায় ভেবে গেরহার্ড অহরহ উত্থিত হয় এবং শুধু তোমার কারণে সে-উত্থানের রঙ একান্তই গণতান্ত্রিক। সংকেতটি আবার পাঠালাম। শোফেনস্খিলের পুরুষাঙ্গের রঙ মনে করার চেষ্টা করো। ওভার ...!

...

অনেক হলো ফ্রাউলিন। গেরহার্ডের এখন ঘুম পাচ্ছে। এই ছোট শহরে আজ রাতে বিমান হামলা হওয়ার কথা ছিল। হয়নি। ঈশ্বর আরেকটি রাত আমায় করুণা করলেন। মোজেসকে ধন্যবাদ। তূর পাহাড়ের জ্যোতি এখনো তোমার দিকে মুখ করে রেখেছে আমায়। তোমার সঙ্গে কথা বলছি ফ্রাউলিন। এলোমেলো পারম্পর্যহীন অসংলগ্ন কথামালা! তুমি কি ঠিকঠাক শুনতে পাচ্ছো? আমার কানের পাশ দিয়ে বৃহৎ এক নদী প্রবাহিত হচ্ছে এখন। রাত যতো গভীর হয়, পূর্ব বাংলার নদীরা রজস্বলা হতে থাকে। রজস্বলা একটি পুরুষত্ব প্রতিরোধী শব্দ। স্ত্রী লিঙ্গবাচক। রজস্বলা দিয়ে তুমি প্রতিরোধ করো অবৈধ অনুপ্রবেশ। ফ্রাউলিন, তুমি কি রজস্বলা এখন? তোমার ছোট বোনের খবর কী বলো। তার বান্ধবী মার্গারিটের খবর কী? সে কি রজস্বলা? লিপজিগ থেকে তার সংবাদ যদি পাও,-জানিও। মার্গারিট কি বিয়ে করেছে? সুদর্শন পুরুষটির নাম পাঠিও। আমি তাকে অভিনন্দিত করবো। এই দেশে বিয়ে এক পবিত্র অঙ্গীকার, এক সম্পর্ক প্রতিরোধক দেয়াল। পরকীয়াকে এটি প্রতিরোধ করে এবং সন্তানের দিকে দুটি মানুষকে জাগ্রত রাখে। শহরে আসার পর দুটি নব-বিবাহিত মেয়েকে আমি দেখেছি। প্রথমটি বাংলার মাটির মতো শ্যামল। দ্বিতীয়টি চকোলেট রঙের। অবিকল মার্গারিটের মতো। আমি তাকে লিপজিগ শহরের গল্প করেছি। ভাঙা বাঙলায়। তার স্বামী আমায় জানালো জার্মানিকে সে কল্পনা করতে পারে এবং ভাইমারের চেয়ে বুখেনওয়াল্ড সম্পর্কে অধিক ধারণা রাখে। আমি তাকে জার্মানিতে নিমন্ত্রণ করবো ভেবেছি। কিন্তু যুদ্ধ লাগার ভয়ে নব দম্পতি শহর ছেড়ে গ্রামে চলে গেছে। কী মনে হয় তোমার? গ্রামে যাবার পথে চকোলেট রঙের মেয়েটি কি নিজেকে বাঁচাতে পারবে?

পূর্ব বাংলার ছোট এই শহরে আঠাশজন রাজাকার রয়েছে। আমি গুনে দেখেছি। রাজাকার একটি মুক্তিবাহিনী প্রতিরোধী ও পাক সেনা সহযোগী শব্দ। এটি কোনো নিয়মিত সেনাবাহিনী নয়। স্থানীয় বাঙালিদের মধ্য থেকে এর উদ্ভব হয়েছে। রাজাকাররা পাকিস্তান রাষ্ট্রের উপযোগিতায় বিশ্বাস করে। মুক্তিবাহিনী খতম করার মিশনে পাক সেনার চর হিসাবে তারা কাজ করে এখানে। শহরে ঢোকার পর তিনজন রাজাকারের সঙ্গে আমার আলাপ হয়। তারা আমায় পাকিস্তানের মাহাত্ম্য বুঝিয়ে বলেছে। রাজাকারদের একজন নিজেকে আল্লার পথের ফকির দাবি করলো। পাকিস্তানকে স্বপ্নে পাওয়া নিয়ামত উল্লেখ করে সে আমায় জানালো প্রেরিত পুরুষ মোহাম্মদের ইসলাম পাকিস্তানের মাধ্যমে ভারত উপমহাদেশে রক্ষিত হচ্ছে। সুতরাং প্রতিটি মুসলমানের সতর্ক হওয়া প্রয়োজন, যাতে হিন্দু-ইহুদি ও খ্রিস্টান চক্র পাকিস্তানের অখণ্ডতাকে বিপন্ন না করে। আরেকজন জানালো সে পাকিস্তানের প্রতি বিশ্বস্ত এবং এই বিশ্বাস মক্কা ও সৌদি আরাবিয়া থেকে আসে। সৌদি আরবের ওহাবি আন্দোলনের প্রবাহটি পাকিস্তানে শক্তিশালী, এবং রাজাকাররা অনেকে জামায়েতে ইসলামী’র সক্রিয় সদস্য। দলটির জনক মওদুদীকে আল্লামা উপাধিতে সম্মানিত করা হয়। আল্লামা একটি জ্ঞানবাচক বিশেষ্য, যার অর্থ হলো এই ব্যক্তি ইসলামে সুশিক্ষিত এবং ধর্মের গূঢ় তত্ত্ব সম্পর্কে গভীর ধারণা রাখেন। মওদুদীর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার তথ্য অস্পষ্ট। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে যে শুরুতে তিনি পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির বিরোধিতাকারী ছিলেন। ভারত ভাগ হওয়ার পর মওদুদী তাঁর মত পাল্টে পাকিস্তানের পক্ষে ভূমিকা রাখতে শুরু করেন। একজন ইসলামী চিন্তাবিদ ও জামায়াতে ইসলামীর প্রভাবশালী সংগঠক হিসাবে মওদুদী নিজেকে বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখতে পারেননি।

টিক্কা খানের জায়গায় জেনারেল নিয়াজি পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক অভিযান পরিচালনার দায়িত্ব নেওয়ার পর মওদুদী-পন্থি সংগঠনগুলো আরো শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। টিক্কা খান প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ও পিপিপি (পাকিস্তান পিপলস পার্টি) প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টোর বিশ্বস্ত প্রতিনিধি। তিনি একজন জেনারেল। পূর্ব পাকিস্তানের বিশৃঙ্খলা দমনের দায়িত্বটি তাকে দেয়া হয়। কিন্তু ২৫ মার্চের গণহত্যার কারণে নিন্দিত হওয়ায় শাসকগোষ্ঠী তাকে সামরিক অভিযান পরিচালনার দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার করে। ২৫ মার্চের গণহত্যার পর টিক্কাকে বাঙালিরা কসাই নাম দিয়েছিল। পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষমতা-মৌচাক উচ্চাকাক্সক্ষা পূরণ-কে ঘিরে আবর্তিত হয়। উচ্চাকাক্সক্ষা হলো আপেক্ষিক বিবৃতি। পাকিস্তানে এটি গণতন্ত্র-প্রতিরোধী ও স্বৈরাচার-সহযোগী শব্দ। জেনারেল টিক্কা বা রাও ফরমান আলী এর প্রতিনিধি।

টিক্কার জায়গায় জেনারেল নিয়াজি যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্বটি নিয়েছেন। রণাঙ্গনে বীরত্বের কারণে তাকে টাইগার নিয়াজি উপাধি প্রদান করা হয়েছিল। টাইগার নিয়াজি পশ্চিম পাকিস্তানের যোদ্ধা উপজাতি নিয়াজির বংশধর। নিয়াজিরা পাঠান গোত্রের অংশ। ভারতীয় উপমহাদেশে সাহসিকতা বা বীরত্ব হলো পাঠান ও রাজপুতের অলংকার। নিয়াজি নিজেকে সাহসী পাঠান মনে করেন এবং তাঁর বীরত্বকে সাড়ম্বরে ঘোষণা দিতে ভালোবাসেন। উপত্যকা আচ্ছাদিত পাকিস্তানে উপজাতিরা বীরত্ব জাহির করতে পছন্দ করে। নিয়াজিকে আমার তাই মনে হলো। ঢাকা ত্যাগ করার আগে প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা সম্পর্কে আমি তাঁকে প্রশ্ন করি। তিনি মন্তব্য করেন,-‘পাকিস্তানী সেনারা পরাজিত হওয়ার জন্য লড়াই করে না। আর সেটা যদি ভারত রাষ্ট্রের বিপক্ষে হয়, তবে আপনি নিশ্চিত থাকুন,-আমরাই জয়ী হবো। আমাদের রয়েছে দক্ষ পদাতিক ও বিমানবাহিনী। রয়েছে রাজাকার ও আল-বদর স্কোয়াড। এরা সবাই ইসলাম ধর্মের ঝাণ্ডা সমুন্নত রাখার জন্য জীবন বাজি রেখে লড়বে। জয় আমাদের হবেই।’

প্রিয় ফ্রাউলিন, গেরহার্ড তোমায় অনুরোধ করছে লিপজিগের মার্গারিটকে এই সংবাদটি যেন পৌঁছে দেওয়া হয়,-আমি এখন ভারতের নিকটবর্তী একটি দেশে রয়েছি। দেশটি পাকিস্তানের সৈন্যবাহিনী ও অনুচর শক্তিরা ঘেরাও করে রেখেছে। অধিবাসী বাঙালিরা স্বাধীনতা লাভ করার জন্য শক্তিশালী শত্রুর বিপক্ষে লড়াই করছে। এই দেশের সদ্য বিবাহিত একটি মেয়ের সাথে আমার পরিচয় হয়েছে। তার গায়ের রঙ চকোলেটের মতো। সে যখন হাসে তাকে মার্গারিটের যমজ বোন বলে মনে হয়। সেই মেয়েটি তার স্বামীর হাত ধরে গ্রামের পথে রওয়ানা দিয়েছিল। মেয়েটির পেছনে জেনারেল নিয়াজি তার প্রশিক্ষিত সেনা ও অনুগত রাজাকার বাহিনীকে লেলিয়ে দিয়েছে। গেরহার্ডের ধারণা মেয়েটির স্বামী তাকে বাঁচাতে পারবে না। গ্রামে পৌঁছবার আগেই রাজাকাররা তাকে ধরে ফেলবে ও সেনা ক্যাম্পে নিয়ে তুলবে। ঠিক যেভাবে মার্গারিট নামের মেয়েটির মা’কে নাজিবাহিনী ভাইমার থেকে বুখেনওয়াল্ডে তুলে নিয়েছিল। ওখানে তার মা একটি মেয়ের জন্ম সম্ভব করেন। মেয়েটির পিতার নাম অনিশ্চিত। তার গায়ের রঙ ছিল চকোলেটের মতো এবং তার নাম রাখা হয় মার্গারিট। সে এখন লিপজিগে বসবাস করে। প্রিয় মার্গারিট, ফ্রাউলিনের মাধ্যমে গেরহার্ড তোমায় এই বার্তা পৌঁছে দিচ্ছে,-চকোলেট রঙের মেয়েটি তোমার যমজ বোন। যদি পারো জেসাসের কাছে তার জন্যে প্রার্থনা করো। তোমার মতো নববিবাহের সুখে মেয়েটি যেন অভিনন্দিত হতে পারে। তোমার সুদর্শন স্বামীটিকে বলো,-গেরহার্ড বলেছে অভিনন্দন একটি আন্তর-মৌলিক উচ্চারণ, যেটি মানুষকে জীবনের দিকে আলোকিত করে।

প্রিয় মার্গারিট, তোমায় অভিনন্দিত করে ফ্রাউলিনকে আলোকিত করেছি আমি। ওকে এই বাক্যটি বলা প্রয়োজন,-অন্ধকার কক্ষে বসে গেরহার্ড আলোকিত শব্দটিকে চুইংগামের মতো নিজের জিভে জড়িত করেছে। তুমি কি এতে সন্তুষ্ট হবে,-প্রিয়তমার স্কার্টের রঙ ও রজস্বলা ত্রিভূজে সিক্ত অন্তর্বাস মনে করার চেয়ে আলোকিত-কে জিহ্বায় জড়িত করা গেরহার্ডের জন্য অনেক কঠিন ছিল? অন্তর্বাস এক সংগোপন যৌনতা, যা গেরহার্ড ও ফ্রাউলিনের মধ্যে চুপিসারে চলাফেরা করে। কিন্তু এখানে তা নয়। যুদ্ধ স্কার্ট ও অন্তর্বাসের ফারাক বোঝে না। যুদ্ধ হলো হতচ্ছাড়া স্ববিরোধ; ফাঁপা বুলি ও জাঁকালো মিথ্যের এক কদাকার প্রহসন। শোফেনস্খিলের টেকো মাথা ও ঘিনঘিনে বিছার মতো পুরুষাঙ্গ গেরহার্ডের মগজে গিয়ে ঢুকেছে এবং তাকে দিয়ে সাংবাদিক প্রতিবেদন উৎপাদন করাচ্ছে :-
‘পূর্ব বাংলার পরিস্থিতি ক্রমশ গোলযোগপূর্ণ হয়ে উঠছে। গতকাল এক বিবৃতিতে প্রেসিডেন্টের বিশেষ দূত বলেছেন পূর্ব পাকিস্তানের গোলযোগপূর্ণ পরিস্থিতির দায়-দায়িত্ব শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগকে বহন করতে হবে। এই ঝটিকা সফরে প্রেসিডেন্টের বিশেষ দূত ঢাকা শহর ঘুরে যুদ্ধ পরিস্থিতি অবলোকন করেন। রাজধানী সম্পূর্ণরূপে সেনা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে দেখে তিনি স্বস্তি প্রকাশ করে বলেন,-‘পরিস্থিতি ক্রমে স্বভাবিক হয়ে উঠছে। লোকজন তাদের বাড়ি-ঘরে ফিরতে শুরু করেছে। সরকারি অফিস-আদালতে কর্মী উপস্থিতির হার সন্তোষজনক। এটা প্রমাণ করে পূর্ব পাকিস্তান শান্ত হয়ে আসছে।’ আওয়ামী লীগের কর্মীদের নাশকতা সৃষ্টিকারী উল্লেখ করে বিশেষ দূত তাঁর বিবৃতিতে আরো বলেন,-‘নাশকতা সৃষ্টিকারী ও পাকিস্তানের অখণ্ডতার প্রতি হুমকিস্বরূপ মুক্তিবাহিনীকে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না।’ জেনারেল নিয়াজিকে এ-ব্যাপারে তিনি জিরো টলারেন্স অবলম্বনের নির্দেশ প্রদান করেন।

প্রিয় ফ্রাউলিন, শোফেনস্খিলকে জিজ্ঞেস করো,-সরকারি বিবৃতি ও সাংবাদিক প্রতিবেদনের মধ্যে পার্থক্য কী? ফিরতি বার্তায় উত্তরটি জানিও। আমি অপেক্ষা করছি। আমার পক্ষ থেকে ওকে বলো,-গেরহার্ড বলেছে সরকারি বিবৃতি সচিবরা মুসাবিদা করে, আর অন্যটি করে সংবাদকর্মীর পুরুষাঙ্গ। প্রেসিডেন্টের বিশেষ দূতের বিবৃতি এভাবে সত্য হতে পারে, গেরহার্ড যদি এটি বিশ্বাস করে যে ঢাকা শহরের জনসংখ্যা আত্মগোপন করেছে। গেরহার্ড,-ফ্রাউলিনের মাধ্যমে বিশেষ দূতকে চটজলদি জানাও,-ঢাকার জনসংখ্যা নিজেকে স্থানান্তর করেছে গ্রামে ও সীমান্তে। স্থানান্তর একটি জৈবিক প্রয়োজন। জঠরের ক্ষুধা মানুষকে স্থানান্তর করে; মৃত্যুর আতংক পারে তাকে স্থানান্তর করে দিতে। বাঙালিরা মৃত্যুর মৌলিক প্রয়োজনে স্থানান্তরিত। তাদের এই স্থানান্তরের নাম হোক,-পলায়ন।

গেরহার্ড, বিশেষ দূতের মাধ্যমে প্রেসিডেন্টকে এই বার্তাটি পাঠিও,-পূর্ব বাংলার শ্যামল মাটিতে সবুজ রঙের দুর্বা ও মুথা ঘাস ফলে। ঘাসগুলো এরিমধ্যে বাদামি হতে শুরু করেছে। বাদামি ঘাসের নিচে একটি জনসংখ্যা আত্মগোপন করে আছে; তার নাম-বাঙালি। মাননীয় প্রেসিডেন্টের জানা প্রয়োজন, বাঙালি জনসংখ্যা এখন ঘাসের সঙ্গে মিশে বাদামি হয়ে উঠেছে। ঘাসের শরীরে তারা পলায়ন ও আত্মগোপন করেছে। বাদামি ঘাস অচিরেই ধূসরবর্ণ হবে। ধূসরবর্ণ সেই ঘাসে মুক্তিরা ওত পেতে রয়েছে। খোলস ছেড়ে তারা যেদিন বের হবে, প্রেসিডেন্ট এই কথাটি যেন স্মরণ করেন,-‘পলায়ন ও আত্মগোপন কখনো অনন্ত হয় না! অনন্ত এক আপেক্ষিক ধারণা এবং সময় হলে তা পাল্টাবে’। বিশেষ দূতের মাধ্যমে গেরহার্ড মাননীয় প্রেসিডেন্টের কাছে এই সতর্ক সংকেত পৌঁছাচ্ছে,-আপনার জেনারেলদের অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী হতে মানা করুন। তাদের আত্মবিশ্বাস যাচাই করার জন্য সে তেরোটি শহর ও এগারোটি গ্রাম ঘুরেছে। রজঃস্বলা নদী ও পাইনবনের মতো ঘন বসতি পেরিয়ে এসেছে। সবখানে একটি দৃশ্যই চোখে পড়েছে তার,-মুক্তিসেনার গেরিলা পোশাকে বাদামি ঘাসের মতো বাঙালিরা আত্মগোপন করে আছে। ঘাস যেদিন ধূসরবর্ণ হবে,-আপনার সেনারা যেন একটি মরণপণ বিষকামড়ের জন্য প্রস্তুত থাকে।

প্রিয় ফ্রাউলিন, প্রেসিডেন্ট কিংবা শোফেনস্খিলের জন্যে নয়, এই সংবাদটি কেবল তোমার জন্য গচ্ছিত যে পূর্ব বাংলার নদীরা এখন গর্ভবতী। নদীগুলো অতিক্রম করার কালে টাইগার নিয়াজির সেনাদের পরিশ্রান্ত মনে হলো। অথচ ঘাস ও নদীর তীরে গোপনে ওত পেতে থাকা মুক্তিদের উজ্জীবিত দেখলাম। এটি কীসের ইঙ্গিত বলে মনে হয় তোমার? নিয়াজির সেনারা ক্লান্ত। তাদের ইউনিফর্মে বাসি দুধের গন্ধ; পায়ের ক্ষতে এরিমধ্যে পচন ধরেছে; মুক্তি ও ভারতীয় সেনা-আক্রমণ প্রতিহত করার ক্লান্তি তাদের চোখে-মুখে। চোখের গর্তে প্রশ্নচিহ্ন। তারা যেন কিছু বলে উঠতে চাইছে। কিন্তু জেনারেলের চোখ-রাঙানির ভয়ে চুপ করে রয়েছে। জেনারেলের প্যারা মিলিশিয়া বাহিনীর অত্যাচার দেখে মনে হচ্ছে গেস্টাপোরা কবর থেকে পূর্ব বাংলায় উঠে এসেছে। ধর্ষণ, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের মহড়ায় তারা ভুলে গেছে স্থানীয় জনসংখ্যার সদয় মনোভাব ছাড়া কোনো যুদ্ধ জেতা যায় না। এসব কীসের ইঙ্গিত বহন করে ফ্রাউলিন? কে জিতবে বলে মনে হয় তোমার? টাইগার নিয়াজি কি পারবে নিজের সুনাম ধরে রাখতে? নাকি অপেশাদার মুক্তিরা নিশ্চিত করবে বিজয়? যে জিতুক, এই সংবাদ শুধু তোমার জন্য পাঠালাম,-ভাইমারের কথা ভেবে গেরহার্ডের মনোবলের পারদ খালি নিচের দিকে নামছে। শোফেনস্খিলকে জানিয়ে দিও,-দেশে ফেরার এই ছেলেমানুষী আকুলতার জন্য সে সত্যিই লজ্জিত। তাকে বলো,-গেরহার্ড এক জঘন্য ইহুদি; যার পিতৃপুরুষ ভাইমারের ছোট্ট কুটিরে এক বেজন্মা ইহুদিকে প্রসব করবে বলে জেরুজালেম থেকে বিতাড়িত হয়। প্রিয় শোফেনস্খিল,-ছেলেমানুষীর জন্য আমি লজ্জিত। মাঝেমধ্যে গেরহার্ড ভুলে যায় বাংলার মেঠো ঘাসের মতো বাদামি হতে পারলেও ইহুদির স্বীকৃত কোনো মাতৃভূমি নেই; সর্বজনস্বীকৃত কোনো মাটি নেই। মাঝেমধ্যে সে ভুলে যায় ইহুদি এক স্থানান্তরিত ঘাস। জেরুজালেমের শক্ত মাটিতে তার পত্তন হয়েছে। কিন্তু তার স্থানান্তর ঘটেছে ভাইমারে। তারপর সে স্থানান্তরিত হবে বুখেনওয়াল্ড, আউশভিৎসে,-ইহুদির আত্মাচেরা সব মৃত্যুকূপে। ফ্রাউলিন, যদি পারো শোফেনস্খিলকে অবগত করো,-গেরহার্ড এক সাচ্চা ইহুদি। পূর্ব বাংলার মৃত্যুকূপে বসে রাগী পশুর মতো গর্জন ছাড়ছে সে। এই গর্জনের নাম দিতে পারো,-উদ্বাস্তু!

ফ্রাউলিন, পূর্ব বাংলার উদ্বাস্তুর হয়ে গেরহার্ড এই সতর্ক বার্তা পাঠিয়েছে,-শব্দটিকে তুমি মোলায়েমভাবে চুম্বন করো। কেননা উদ্বাস্তু এক বিপজ্জনক পশু; এক জন্মভূখা হাভাতে। হাভাতেকে চুম্বনের ক্ষণে তোমার ওষ্ঠে ঝরে পড়–ক করুণাধারা। বিব্রত ঠোঁট ফাক করে উদ্বাস্তুকে চুম্বন দিও না। উদ্বাস্তুর জন্য চুম্বন হলো এক বিপজ্জনক সহানুভূতি। সে এতে লজ্জিত হয়, অতঃপর সহানুভূতির জ্বালায় খেপে ওঠে। তাকে জেসাসের মতো ভালোবাসা দিও। তার ওষ্ঠ দিয়ে মোজেসকে চুমু খেতে দিও। মোজেস তূর পাহাড়ে ঈশ্বরের দ্যুতিতে দীর্ঘায়ু পায়। আর, ইহুদিরা হলো পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘায়ু উদ্বাস্তু!

মরিয়ম পুত্র ঈসা ও আব্দুল্লার পুত্র মোহাম্মদকে বলি,-ইহুদি গেরহার্ড এক বেজন্মা উদ্বাস্তু। সে এখন সুদূর পূর্ব বাংলার বাদামি ঘাসে একটি জনসংখ্যার পলায়ন ও স্থানান্তরের প্রতিবেদন লিখছে। জনসংখ্যার নাম বাঙালি। জনসংখ্যাটিকে তার প্রতিবেশীর ঘাসে আত্মগোপন করতে বাধ্য করা হয়। নিজ বসতি থেকে তাকে উৎখাত করা হয়েছে। সারা বিশ্বের চুম্বন ও সহানুভূতি সত্ত্বেও উদ্বাস্তু হওয়ার এই যন্ত্রণা সে আর সইতে পারছে না। দীর্ঘকাল ঈশ্বরের দ্যুতি কামনা করেছে সে; ততোধিক দীর্ঘকাল বসতি-উৎখাতের উৎকণ্ঠা সয়েছে। এটি জেনে রাখা প্রয়োজন,-ধৈর্য এক অ-নির্ভরযোগ্য বিশেষণ। পূর্ব বাংলার জনসংখ্যা তাদের ধৈর্য্যরে শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে। এখন তারা মর্মান্তিক গর্জন ছাড়ার জন্যে আহত পশুর মতো ধুঁকছে। প্রিয় ফ্রাউলিন, মরিয়ম পুত্র ঈসা ও আব্দুল্লার পুত্র মোহাম্মদের নিকটে গেরহার্ডের এই আবেদনটি যেন পৌঁছায়,-বাঙালি জনসংখ্যার গর্জনটিকে উদ্বাস্তুর ন্যায়সঙ্গত ক্রোধ নামে স্বীকৃতি প্রদান করা হোক। ফ্রাউলিন ও ভাইমারের শরীরে গেরহার্ডের চুম্বন যদি ন্যায়সঙ্গত হয়, হামেলের সুর বাজানোর কালে জেরুজালেমকে স্মরণ করে বৃদ্ধ ইহুদির আর্দ্র চোখ যদি ন্যায়সঙ্গত স্বীকার করা হয়,-ন্যায়সঙ্গতার সেই আবেগ মিশিয়ে গেরহার্ড দাবি করে,-পূর্ব বাংলার জনসংখ্যাকে তাদের মাটি ফিরিয়ে দেওয়া হোক। কেননা ঈশ্বর এক মহান সুবিচারক, আর প্রেরিত পুরুষরা হলেন তার জ্যোতি। ওভার!

...

প্রিয়তমা ফ্রাউলিন, ন্যায়সঙ্গত এই আবেদনের পর কিছু কি বলার থাকে গেরহার্ডের! হোটেলের অন্ধকার কক্ষটি এরিমধ্যে আলোকিত হতে শুরু করেছে। একটু পরে ভোরের আলো ফুটবে। মোজেস একটি রাতের জন্য করুণা করেছে আমায়। তুমি কি আরেকটি দিবালোক ভিক্ষা চাইবে তার কাছে? ভোর পেরিয়ে সকাল হবে একটু পর, সেই পরটুকু বেঁচে থাকার প্রার্থনা করো ফ্রাউলিন। এই অনুভূতিটি শুধু তোমার জন্য গচ্ছিত যে গেরহার্ড ছিল এক সাচ্চা ইহুদি। সে তার ফ্রাউলিনকে চুম্বন করেছে। মৃদু ভোরে প্রাণপণে ফ্রাউলিনের স্কার্টের রঙ মনে করার চেষ্টা করেছে। ফ্রাউলিনের স্কার্টের নিচে একটি ত্রিভূজ শুয়ে থাকে। প্রিয় ফ্রাউলিন, অ্যাপোলিনেখের কাছে গেরহার্ডের হয়ে এই বার্তাটি পৌঁছে যাক,-বিশুদ্ধ ত্রিভূজ এক নারীবাচক জন্মভূমি, আর জন্মভূমি একটি সংগোপন যৌন-অস্তিত্ব। গেরহার্ডের জন্মভূমি ভাইমার সেই অস্তিত্ববাহক যৌন-প্রিয়তা। ফ্রাউলিনের হয়ে ভাইমারের সবাই এটি জেনে যাক,-যৌন-প্রিয়তা এক সংবেদনশীল অম্লজান, পৃথিবীকে যেটি জীবনের দিকে পরিশ্রুত করে। প্রিয়তমা ফ্রাউলিন, তুমি উজ্জ্বল হবে জেনে,-বিগত দিনগুলোয় গেরহার্ড কিছু ওয়াদা করে। ওয়াদা সম্ভবত একটি আরবি উচ্চারণ। অঙ্গীকারবাচক শপথ। আর আমরা অঙ্গীকার করি তা না-রাখার জন্য। ওয়াদা-কে এভাবে ব্যাখ্যা করা যায়,-‘আমি প্রতিশ্রুতি দিলাম’। গেরহার্ড এই সংবাদটি ফ্রাউলিনের কাছে পৌঁছাতে চাইবে যে, ওয়াদা শব্দের চাপ সে নিতে পারছে না! এটি তাকে ভীত করে তোলেছে। ওয়াদা-র পরিবর্তে ‘আমি প্রতিশ্রুতি দিলাম’ বাক্যটি বেছে নিতে ইচ্ছুক সে। ওয়াদার সমার্থক হলেও ‘আমি প্রতিশ্রুতি দিলাম’ সম্ভবত কম ভীতিকর। এর ভিতরে সেই আশা জেগে রয়,-প্রতিশ্রুতি কোনো একদিন পালিত হবে। প্রিয় ফ্রাউলিন, নিচের প্রতিশ্রুতিগুলো গেরহার্ডের পক্ষে রক্ষা করা সম্ভব হবে কিনা জানিও। তোমার সোনালি চুল ও নীল চোখের কথা ভেবে গেরহার্ড তার প্রতিশ্রুতি উচ্চারণ করেছে ...

উচ্চারণ-১ : মাহমুদ শের, পাকিস্তান আর্টিলারি রেজিমেন্টের সৈনিক। সে তার সদ্যোজাত শিশু সন্তানের নামটি আমায় মুখস্থ করিয়েছে। আমি তাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছি,-খবর সংগ্রহের ছুতোয় যদি কখনো পাকিস্তানে ঘুরতে যাই এবং সেটা যদি পাঞ্জাবের সমতল ভূমি হয়, তবে তার পরিবারকে এই খবরটি পৌঁছে দেওয়া হবে,-‘আর্টিলারি রেজিমেন্টের মাহমুদ শেরের সাথে গেরহার্ডের দেখা হয়েছিল। মাহমুদ শের ইস্টার্ন কমান্ডের হয়ে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলে বীরের মতো লড়াই করছে। সবাই যেন তার জন্য প্রার্থনা করে। মহানবির ইসলাম রক্ষার জন্য জেনারেল নিয়াজি তাকে এই দায়িত্বটি দিয়েছেন। গেরহার্ডের মাধ্যমে সে তার পরিবারকে এই অভিজ্ঞতাটি পাঠিয়েছে,-পূর্বাঞ্চলের অধিবাসী বাঙালিরা একটি ধর্মভীরু জনসংখ্যা। অলি-দরবেশের অসংখ্য মাজার সেখানে বিদ্যমান। স্থানীয় লোকজন মসজিদে নামাজ পড়তে যায় ও ঘুম থেকে উঠে আল্লাকে স্মরণ করে। গেরহার্ডের মাধ্যমে পাঞ্জাবের সবাই যেন এই সংবাদটি পায়,-মাহমুদ শের একজন সত্যবাদী। ওরা তাকে মিথ্যা বলে এখানে নিয়ে এসেছে। মিথ্যেবাদীর জন্য আল্লা তার নরকের রাস্তা খোলা রেখেছেন। শেষ বিচারের দিন রাস্তাটি খুলে দেওয়া হবে এবং যে-যার প্রাপ্য বুঝে নেবে। কেননা আল্লা স্বয়ং অঙ্গীকার করেন,-মিথ্যেবাদীর উপর আল্লার লানৎ বর্ষিত হবে।

প্রিয় ফ্রাউলিন, লানৎ সম্ভবত আরবি অভিশাপবাচক ক্রোধ। মাহমুদ শেরের মাধ্যমে গেরহার্ড এই সতর্ক বার্তা পাঠাচ্ছে তোমায়,-ভাইমারের অধিবাসীদের জানা প্রয়োজন যুদ্ধ এক মনস্তাত্ত্বিক প্রতারণা। মাহমুদ শেরকে প্রতারণা করা হয়েছে। তার সন্তানটিকে সে হয়তো কোনোদিন চুম্বন করতে পারবে না। ‘আমি প্রতিশ্রুতি দিলাম’ পাঞ্জাবের সমতল ভূমির কাছে মাহমুদের লানৎ-টি পৌঁছে দেওয়া হবে। ওভার।

উচ্চারণ-২ : রামোস গনজালেস, ভিয়েতনামের যুদ্ধে আমেরিকান সিগন্যাল কোরের সদস্য। মার্কিন দেশে জন্মগ্রহণকারী স্প্যানিশ এই সৈন্যটিকে বলা হয়,-ভিয়েতনাম একটি দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র। একটি অগণতান্ত্রিক শক্তি ভিয়েতনামের অখণ্ডতাকে ধ্বংস করতে চাইছে। এশিয়া মহাদেশে চীন ও সোভিয়েতের অনুপ্রবেশ নিশ্চিত করার জন্যে ভিয়েতনামের সমাজতন্ত্রীরা নিজেকে ব্যয়িত করছে। আমেরিকার গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিরুদ্ধে এটি হলো ডিআরভি-দের (উবসড়পৎধঃরপ জবঢ়ঁনষরপ ড়ভ ঠরবঃহধস) একটি ষড়যন্ত্র। গণতন্ত্র একটি আমেরিকান অভিজ্ঞতা। একমাত্র মার্কিনী জাতীয়তাবাদ সেটি ভিয়েতনামে নিশ্চিত করতে পারে। সোভিয়েত রাশিয়া বা চীনা জাতীয়তাবাদ নয়।

সব শুনে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ বোধ করে গনজালেস। সিগন্যাল কোরের সদস্য হিসাবে শত্রুর বিরুদ্ধে আগ্রাসী হওয়ার শপথ করে সে। ভিয়েতনামের ধানখেত ও কলাবাগানে দুই বছর মরণপণ লড়াই করে ক্লান্ত গনজালেস একদিন তার গ্যারিসন কমান্ডারকে প্রশ্ন করে বসে,-কমান্ডার আমরা এখানে খামোখা লড়ছি কেন? কমান্ডার তার দিকে ক্রূর হেসে উত্তর করে,-ভিয়েতনাম ও রাশিয়ার পাছা মারার জন্য। কমান্ডারের উত্তর শুনে গনজালেস অনুধাবন করে,-এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলো মার্কিনী গণতন্ত্রকে কেন পাছা মারার গণতন্ত্র বলে ডাকে। এই উপলব্ধি গনজালেসের শপথ ও অঙ্গীকারকে দুর্বল করে ফ্যালে। বোমা-বিধ্বস্ত ভিয়েতনামের কথা ভেবে তার দু’চোখ অশ্রুতে ভরে ওঠে। এরপর একটি নির্জন রাত আসে গনজালেসের জীবনে। নির্জন সেই রাতে গ্যারিসন কমান্ডারের চোখ ফাঁকি দিয়ে নিজের মাথায় গুলি করে আত্মহত্যা করে সে।

প্রিয় ফ্রাউলিন, পূর্ব বাংলার এক বীর মুক্তিসেনা তার বাঙ্কারে বসে গেরহার্ডকে এই আত্মহত্যার গল্পটি শুনিয়েছিল। মুক্তিসেনাকে গেরহার্ড এই প্রতিশ্রুতি দিতে বাধ্য হয়,-পূর্ব বাংলার পরিস্থিতি বিষয়ে কোনো মিথ্যে ও অতিরঞ্জিত প্রতিবেদন সে পাঠাবে না। সে আরো প্রতিশ্রুতি দিয়েছে,-গেরহার্ডের লেখনী নিছক সাংবাদিক প্রতিবেদন হবে না, এটি এই মানবিক সত্য উন্মোচিত করবে যে বাঙালিরা স্বাধীনতা ও সম্প্রীতিপ্রিয় জনসংখ্যা, এবং তার একটি ইতিহাস রয়েছে। প্রিয় ফ্রাউলিন, ইতিহাস এক অস্তিত্ববাচক উন্মোচন। এর ভিতর দিয়ে জনসংখ্যারা বাক্যালাপ করে। মুক্তিসেনার মাধ্যমে ভাইমারের কাছে গেরহার্ডের এই সতর্ক সংকেত পাঠিয়ে দিও,-মিথ্যে ও প্রতারণা হইতে সাবধান। মিথ্যে একটি গোয়েবলসীয় আত্মরতি, যেটি মাহমুদ শের ও গনজালেসকে হত্যার অভিমুখে বিভ্রান্ত করেছে। জীবন-প্রতিরোধী বিভ্রান্তি জনসংখ্যার বাক্যালাপকে স্তব্ধ ও স্তিমিত করে। ‘আমি প্রতিশ্রুতি দিলাম’ সাংবাদিক প্রতিবেদন লেখার সময় বাঙালি মুক্তিসেনার অনুভূতিটি রক্ষা করা হবে। ওভার!

উচ্চারণ-৩ : লতিফউল্লা হিলালী, টাইগার নিয়াজির রাজাকার বাহিনীর একজন কামান্ডার। সে আমায় এই বিবৃতি টুকে নিতে জোর করে,-রাজাকার একটি স্বস্তিবাচক বিশেষ্য; ষড়যন্ত্রের বিপরীতে এটি হলো শান্তি ও স্থিতির পতাকা। জলপাই রঙের জিপে বসিয়ে হিলালী আমায় এই বিবৃতি উপহার দিয়েছে,-বিদায় হজ্বের ভাষণে আল্লার প্রেরিত পুরুষ একটি সম্প্রীতির উচ্চারণ করে গেছেন; পাকিস্তান সেই উচ্চারণের রাজনৈতিক ফলশ্রুতি। এখানে হিন্দু ও মুসলমান পরস্পরকে ভাই নামে সম্বোধন করে ও প্রতিবেশীর মতো বসবাস করে। ইসলামের বরাত দিয়ে হিলালী এই ব্যাখ্যাটি বৈধ করতে চেয়েছে,-নিজের আমল বজায় রেখে অপরের প্রতি সহিঞ্চুতা প্রদর্শন ইসলামের মূল কথা। আমল হলো র্কোআনিক বিশেষত্ব; যার অর্থ সম্ভবত এই করা যায়,-ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভ অনুশীলনের মধ্য দিয়ে আত্মার প্রশান্তি ও আল্লার সন্তুষ্টি অর্জন।
লতিফউল্লা হিলালী একজন সুপুরুষ। তাকে দেখে গেরহার্ডের অনুভব হয়,-লোকটি বোধহয় আল্লার সন্তুষ্টি অর্জন করেছে। আমার সঙ্গে তার কথা বলার ভঙ্গি ইসলামের চরিত্রের পক্ষে অনুকূল ছিল। কেননা ইসলাম ইহুদিকে নিন্দা করলেও মোজেসের প্রশংসা করেছে। মোজেস একজন প্রেরিত পুরুষ, এবং মোহাম্মদ তাঁকে বিনয় করেন। লতিফউল্লা হিলালী দক্ষ তার্কিক। ইসলামের প্রথা-আনুষ্ঠানিকতা ও দার্শনিক ভাবনাকে উপযুক্ত শব্দের সাহায্যে গ্রহণযোগ্য করে উপস্থাপনায় তার কুশলতা গেরহার্ডকে চমৎকৃত ও মুগ্ধ করেছে। বাঙালি বিদ্বান-সমাজ এবং মুক্তি সেনারা হিলালী ও রাজাকার-কে সমার্থক গণ্য করে। তারা বলে,-হিলালী প্রতিক্রিয়াশীল স্বেচ্ছাসেবক; পাকিস্তান রাষ্ট্রের অনুচর। নিজে বাঙালি হয়ে এই জনসংখ্যার অনুভূতি ও মূল্যবোধের সাথে সে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। তারা মনে করে,-হিলালীর বিশ্বাসঘাতকতা রাজাকার শব্দের অর্থটিকে পাল্টে দিয়েছে। প্রগতি ও বিশ্বাসের মধ্যে ভয়ংকর এক স্ববিরোধী রূপে এই রাজাকাররা উত্থিত হয় বলে তারা ধারণা করেন।

বিশ্বাসঘাতক ও স্ববিরোধী,-আখ্যা দুটি সম্পর্কে হিলালীকে আমি প্রশ্ন করি। কমান্ডারটি মৃদু হেসে উত্তর করেন,-অবিশ্বাসীদের জন্য এটি বিশ্বাসঘাতকতা ও স্ব-বিরোধী হতে পারে, কিন্তু আমার জন্য নয়। আমি ইসলাম ধর্ম বিশ্বাস করি, এবং আপনি জানেন ইসলাম অবিশ্বাসীদের বিষয়ে সতর্ক। তার বক্তব্যে হিলালী একটি বিশ্বাসকে ব্যাখ্যা করে। গেরহার্ডকে সে এই বিশ্বাসের দিকে প্ররোচিত করার চেষ্টা করেছে,-ইসলাম এক পূর্ণাঙ্গ জীবনপ্রণালী। প্রেরিত পুরুষ মোহাম্মদের বাণী মরুভূমিতে সুবাস ছড়িয়েছে। এখন এটি সারা পৃথিবী জুড়ে সম্প্রসারিত হচ্ছে। পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রের ভ্রান্তি বা দুর্গতির বিপরীতে ইসলাম একটি গ্রহণযোগ্য আধুনিকতা। ইসলামের অপব্যাখ্যা যারা করে তারা ভারত রাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষার জন্য সেটি করে। কাজেই ...

ফ্রাউলিন, হিলালীর হয়ে শোফেনস্খিলকে এই বিষয়টি অভিহিত করো,-হিলালী একজন রাজাকার। পাকিস্তানী সেনাদের স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর কমান্ডার। সে বিশ্বাস করে ভারত একটি সাম্প্রদায়িক ভূখণ্ড। হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা পাকিস্তান সৃষ্টির কারণ হয়েছিল। ভারতনেত্রী মিসেস গান্ধি পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে পরিকল্পিত বিরোধ ঘটিয়ে সেই সাম্প্রদায়িকতাকে আবার উসকে দিতে চাইছেন। ‘দ্বি-জাতি তত্ত্ব’র মাধ্যমে ভারতবর্ষ পৃথক হয়। এখন পাকিস্তান পৃথক হলে দক্ষিণ এশিয়ায় হিন্দু জাতীয়তাবাদের কোনো শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী থাকবে না। হিলালী মনে করে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হলেও মিসেস গান্ধির দৃষ্টিভঙ্গি পৌত্তলিক। এই পৌত্তলিকতা মানুষকে তার মহত্ত্ব থেকে সরিয়ে রাখার বিধান প্রচার করে; যেন মানুষ এক অবোধ পশু! কিন্তু আল্লা মানুষকে বোধসম্পন্ন করে সৃষ্টি করেন,-পশুর মতো অবোধসম্পন্ন করে নয়।

ইসলামের দার্শনিক তাৎপর্য সম্পর্কে হিলালীকে প্রশ্ন করলে সে উত্তর করেছিল,-ইসলাম ধর্মে নিরাকার এক শান্তিকে নিজের আমল ও নফস-এর পরিশুদ্ধি দিয়ে প্রণতি জানায় মানুষ। এই প্রণতি ইসলামের গূঢ় দার্শনিক ভিত্তি। আল্লার সৃষ্টিকে অনুধাবন করো। এর উপযোগিতাকে নিজের কাজে লাগাও। ইসলামে অনুধাবন ও উপযোগিতার উপর মোহাম্মদ প্রচণ্ড গুরুত্ব দিয়ে গেছেন। কেননা তারা আল্লার সন্তুষ্টি ও ‘পরিশুদ্ধি’ অর্জনে মানুষকে সাহায্য করে। ইসলাম হলো ‘পরিশুদ্ধি’র আহবান। মোহাম্মদ তোমায় আহবান করেন,-জাগতিক উৎকর্ষ ও আত্মিক মুক্তির শরীরে নিজেকে মিলিত করো। আল্লার সৃষ্টিকে অনুধাবন করো ও এর উপযোগিতাকে ব্যবহার করো। এই মিলন ধর্মকে রক্ষা করবে।’

ফ্রাউলিন, তোমার মাধ্যমে গেরহার্ড এটি স্মরণ রাখতে ইচ্ছুক,-হিলালী নিজেকে একজন পরহেজগার মনে করে। পরহেজগার ধর্মবাচক গুণাবলী। এর অর্থ সম্ভবত এই করা যেতে পারে,- পরহেজগার ইসলামী বিধানকে যথাযথভাবে পালন করে এবং ধর্মের পাঁচটি স্তম্ভকে আমল করে। গেরহার্ডের মাধ্যমে বাঙালি বিদ্বান-সমাজ ও মুক্তি সেনাদের কাছে হিলালী এই বার্তা পৌঁছে দিয়েছে,-বাঙালি বিদ্বান-সমাজ ব্যক্তিস্বার্থের পূজারী এবং তারা একটি পৌত্তলিক বিভ্রান্তির পৃষ্ঠপোষকতা করে। রাজাকার এই বিভ্রান্তিকে প্রতিবাদ করায় তাকে নিয়ে সকলের এতো মাথাব্যথা। গেরহার্ডের কাছে হিলালী এই অভিযোগটি তুলে ধরে,-ভারত রাষ্ট্রের অনুচর বুদ্ধিজীবী ও মুক্তিসেনারা অযথা ফিৎনা সৃষ্টির মাধ্যমে পাকিস্তান রাষ্ট্রের আসবিয়াহ-কে বিনষ্ট করছে। একজন রাজাকার ফিৎনাকারীকে ভয় করে না এবং তাকে শাস্তি প্রদানে রাজাকারের হাত কখনো কেঁপে উঠবে না। যেহেতু আল্লার প্রেরিত পুরুষ মোহাম্মদ বলবার চেষ্টা করেছেন,-ফিৎনা সৃষ্টিকারীকে তার গোত্র থেকে বহিষ্কার করো। প্রয়োজনে তাকে হত্যা করা যেতে পারে। আল্লা বনি ইসরাইলকে ফিৎনা সৃষ্টিকারী হিসাবে আখ্যায়িত করার পক্ষে, যেহেতু কিনান গোত্রের বনি ইসরাইলরা প্রথমে মোজসকে স্বীকার করেনি এবং তার বিধান অনুসরণ করেনি। তারা উদ্ধত। আল্লা সীমা লংঘনকারী ও ফিৎনা সৃষ্টিকারী গোত্রসমূহকে ধ্বংসের পক্ষে।

ফ্রাউলিন, এই দৃশ্যটি শোফেনস্খিলের কাছে বর্ণনা করা প্রয়োজন,-বনি ইসরাইল একটি ইহুদি বাচক ইঙ্গিত, যেটি মুসলমান ও ইহুদিকে পরস্পরের শত্রু করে দিয়েছে। ফিৎনা হলো র্কোআনিক বিশেষত্ব; অযৌক্তিক ও হিংসাত্মক মনোভাব সৃষ্টির মাধ্যমে ইসলামের শান্তি ও স্থিতিকে ধ্বংস করে বলে ফিৎনা-কে ঘৃণা করা হয়। ফিৎনা-র বিপরীত বিশেষণ আসবিয়াহ,-একটি একতা ও সম্প্রীতিবাচক বিশেষণ। ইবনে খলদুন একে জরুরি মনে করেছেন এই যুক্তিতে,-আসবিয়াহ মানুষকে সামাজিক ঐক্য ও সংহতির দিকে একত্র করে রাখে। হিলালী আমায় এই ধারণাটি দেয়ার চেষ্টা করে,-ফিৎনার বিপরীতে আসবিয়াহ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ১৯৪৭-এ ভারত ভেঙে পাকিস্তানের সৃষ্টি হয়। রাজাকার এই সৃষ্টির বৈধতায় আজো বিশ্বাস করে এবং তার কাছে এটি কোনো অপরাধ নয়।

ফ্রাউলিনের মাধ্যমে গেরহার্ড এটি জানানো কর্তব্য মনে করে,-রাজাকার হিলালী আমার কাছে এই প্রতিশ্রুতি আদায়ে সচেষ্ট ছিল যে আমি তার বক্তব্য অনুধাবন করতে সক্ষম
হয়েছি, এবং এই বক্তব্য কোনো উদ্দেশ্যমূলক কারণে বিকৃত করা হবে না। ‘আমি প্রতিশ্রুতি দিলাম’ হিলালীর বক্তব্যকে বিকৃত করা হয়নি। প্রেরিত পুরুষরা বলেন,-পৃথিবীর আশ্চর্য এই ফলবাগানে ঈশ্বর ছাড়া কোনোকিছু ধ্রুব বা নিশ্চিত নয়। সুতরাং এই প্রতিশ্রুতি করা যেতে পারে যে গেরহার্ড তার প্রতিবেদনে লতিফউল্লা হিলালীর বক্তব্যকে বিকৃত করে না। তবে ফ্রাউলিনের মাধ্যমে পূর্ব বাংলার মুক্তি সেনাদের কাছে গেরহার্ড এই বার্তাটি পৌঁছে দিচ্ছে,-ভাইমার ও বুখেনওয়াল্ডের দূরত্ব সম্পর্কে সে সজাগ রয়েছে। সুতরাং, হিলালীর বক্তব্যের বিপক্ষে সংগঠিত তর্ক ও প্রত্যাখানের প্রতি গেরহার্ডের জোরোলো সমর্থন বজায় রইলো। ওভার!

উচ্চারণ-৪ : শিউলি বালা দেবী ও মুজিব ফকির। শিউলি বালা দেবী পূর্ব বাংলার সংখ্যালঘু, আর মুজিব ফকির মুসলমান বাউল। পূর্ব বাংলায় বাউল একটি জনপ্রিয় সঙ্গীতবাচক বিশেষ্য এবং এটিকে অসংখ্য ক্রিয়াবাচক বিশেষণে বর্ণনা করা সম্ভব। ঈশ্বর, নদী ও জন্মভূমিকে ধর্ম এবং মানুষের দিকে সমার্থক করে বাউল। তাই ধর্ম বাচক হলেও এটি একটি নিরপেক্ষ সম্ভাষণ। মুজিব ফকির গান করে, আর শিউলি বালা ফকিরকে ভালোবাসে। পূর্ব বাংলার নদীগুলোর মতো বেগবান সেই ভালোবাসা। বাংলার মাটি আবেগ ও ভালোবাসার জাদুতে বর্ণিল। রমণীরা ভাইমারের মাটির চেয়ে কালো ও উর্বর। শিউলি বালা কৃষ্ণবর্ণ নারী। তার এই কৃষ্ণতা আফ্রিকার মতো কালো নয়। শিউলিবালার কৃষ্ণতা বাংলার ধানখেতের মতো,-সবুজ সেখানে বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারে না। ধানখেত একটি অস্থির যৌনবাচক ইঙ্গিত। এটি কচি সবুজ থেকে কালচে সবুজ, কালচে থেকে সোনালি রঙে তার যৌনতা পাল্টায়। নৌকায় মেঘনা নদী পার হওয়ার দিনগুলোয় শিউলি বালা গেরহার্ডকে জানায়,-মুজিব ফকিরকে ভালোবেসে অস্থির এই যৌন-অভিজ্ঞতাটি তার হয়।

মুজিব ফকির সাত্ত্বিক বাউল। সাত্ত্বিক এমন এক বিশেষণ যেটি বিনয় ও আসক্তি-প্রতিরোধী উচ্চারণের সঙ্গে মিলিত হতে ভালোবাসে। যার অর্থ হলো,-ভালোবাসায় কামনার বাড়াবাড়ি নেই। ভালোবাসা একটি মধুর সম্ভাষণ, যেটি ঈশ্বরের বিরাট সৃষ্টির দিকে মানুষের মুখ আলোকিত রাখে। পৃথিবী সম্পর্কে মুজিবের ধারণাটি সাত্ত্বিক হলেও গেরহার্ডকে সে এই বলে আশ্বস্ত করেছে,-সাধারণ মানুষের মতো বাউল-ও ক্ষুধার্ত হয়। ক্ষুধার্ত হলে খাদ্য ও শিউলি বালা,-উভয়কে সে গ্রহণ করে। এই সংবাদটি গেরহার্ড কেবল ফ্রাউলিনের জন্য সংরক্ষণ করছে,-বাউল মুজিব ফকিরের ক্ষুধাকে পূর্ব বাংলার খেয়ালখুশিভরা টিলা ও পাহাড়ের সাথে তুলনা করা যায়। বাংলার টিলা ও পাহাড় অনিশ্চিত স্বভাবের হয়। বর্ষায় পাহাড় ধসে পড়ে এবং টিলাগুলো অনেক সময় দেবে যায়। মুজিব ফকিরের খাদ্যের ক্ষুধা ক্ষণস্থায়ী। গেরহার্ড এটি লক্ষ করেছে, গাজায় দম দিয়ে ঘণ্টার-পর-ঘণ্টা গলা ছেড়ে গান গাইতে পারে সে।
শিউলিবালার কাছে জীবন একটি নেশা-ধরানো ভ্রমণ। ফকিরের সাথে এর অন্তিম পর্যন্ত ঘুরতে ইচ্ছুক সে। অন্যদিকে গেরহার্ডের কাছে ফকির তার ধারণাটি ব্যাখ্যা করে,-জীবন একটি নদী। নদীটি ঈশ্বরের দিকে আরাধনা করার জন্য বইছে। ফকিরের গান শুনে গেরহার্ডের ধারণা হয়েছে,-বাউল-রা ঈশ্বরকে নদী ও নারীর প্রতীকে স্পর্শ করতে পছন্দ করে। কেননা নদী হচ্ছে জীবনদায়ী আর নারী পুরুষকে যৌনতা ও সন্তানে আলোকিত রাখে। প্রিয় ফ্রাউলিন, শিউলি বালা এক কৃষ্ণবর্ণ প্রজাপতি; এই রমণীর কালো চোখে ঈশ্বর নিজের সৃষ্টিকে আলিঙ্গন করেছেন। ঠিক যেরকম, তোমার নীল চোখের তারায় আমি স্পর্শ করি ভাইমার। আমার গোপন যৌন-সংবেদন!

এই তথ্যটি শোফেনস্খিরের জন্য যে মুজিব ফকির ও শিউলি বালা গ্রামীণ সর্বহারা। জাতীয় উৎপাদনে তাদের ভূমিকা অস্পষ্ট। হয়তো-বা নগণ্য। শ্রমসাধ্য কোনো কাজ তারা করে না। ধর্ম বিশ্বাস অস্পষ্ট বা গুহ্য। মুসলমান ফকির ভালোবাসে হিন্দু রমণীকে, এবং তাদের যৌন মিলন হয়। এশিয়ার সামাজিক রঙ্গমঞ্চে বাউল একটি বিস্ময়কর ব্যতিক্রম; পূর্ব বাংলার সাপুড়ে জিপসিদের মতো। জিপসিদের এখানে বেদে বলা হয়। এরা নৌকায় করে বাংলার নদীগুলো ঘুরে বেড়ায় ও সাপের খেলা দেখায়। বাউলরা বছর ভরে হিন্দু-তীর্থ ও মুসলমান সাধু-ফকিরদের মাজারে গান করে বেড়ায়। গানের ভাষা উপনিষদের মতো রূপময়। সুরেলা ও আকর্ষণীয়। একতারা একটি অতি সাধারণ বাদ্যযন্ত্র। কিন্তু বাউলের হাতে বাদ্যযন্ত্রটি সহজ নিঃশ্বাসের মতো জীবনতরী বয়ে চলার কাহিনী বর্ণনা করে। বাউলরা ভায়োলিন বাজাতে পারে এবং তাদের ভায়োলিনের গঠন অতি সাধারণ খেলনার মতো। ভায়োলিন বাউলকে সুরের প্রবাহ ও গলার ভারসাম্য ঠিক রাখতে সাহায্য করে। মুজিব ফকির একজন দক্ষ কবিয়াল। তার এই ক্ষমতাটি শীত ঋতু এলে সবচেয়ে ভালোভাবে প্রকাশিত হয়। শীতে পূর্ব বাংলার গ্রামগুলোয় গানের আসর বসে। আসরে গাইবার জন্য দূরের সব গ্রাম থেকে ফকিরের সাথে যোগাযোগ করা হয়। এই যোগাযোগ একটি মৌলিক বার্তা বহন করে। গেরহার্ড মনে করে জাতীয় উৎপাদনে বাউলদের অবদানকে বিনোদন ও শিখন নামে সম্ভাষিত করা যায়। মুজিব ফকিরের মতো বাউলরা গানের আড়ালে ঈশ্বর, ভালোবাসা ও নৈতিকতাকে একত্রিত করে এবং মানুষকে তার জন্ম ও পরিণাম নিয়ে ভাবতে প্ররোচিত করে। স্থানীয় বিদ্বানরা গেরহার্ডকে এই ব্যাখ্যাটি উপহার দিয়েছেন,-বাউলরা এগনোস্টিক। বাংলায় এই শব্দটির অর্থ করা হয়,-মানুষকে চিন্তা করলে ঈশ্বরকে চিন্তা করা সম্ভব। ঈশ্বর এক তীরহীন মহানদী। মানুষ অচেতন পশুর মতো এই মহানদীকে তার শরীরে বয়ে বেড়ায়। মহানদীর প্রশ্নে সে সবসময় অচেতন; কারণ, এই নদীকে আজো কেউ সম্পূর্ণ জানে না, আর আগামী দিনেও জানতে পারবে না।

গেরহার্ডের কাছে মহানদী একটি জটিল বিশেষ্য, যার ভিতরে ভাইমারের মুখ সে দেখতে পায় না। তবে এই তথ্য ফ্রাউলিনের গোপন অন্তর্বাসে জায়গা করে নিক,- মুজিব ফকির ও শিউলি বালা পরস্পরের স্পর্শে গান করে। সঙ্গীত একটি মারাত্মক যৌন-অন্তর্বাস। যুদ্ধের দিনেও তারা গান করে। মেঘনা নদীর অগাধ জলরাশির তোড়ে ছোট নৌকায় জীবননদী পাড়ি দেয়ার ক্ষণে সঙ্গত ও সঙ্গীত করে। মুজিব ফকির এক আশ্চর্য প্রেমিক গায়ক! সঙ্গিনীর গোপন অন্তর্বাস উন্মোচনের ক্ষণে সে ঈশ্বরকে দয়াল নামে ডাক দিতে পারে। দয়াল একটি অসীমবাচক ইঙ্গিত। বাউল এই ইঙ্গিতকে গান করে। মুজিব ফকিরের মধ্য দিয়ে এই গান পৌঁছে যাক ফ্রাউলিনে এবং তা ঢুকে পড়–ক তার সংগোপন অন্তর্বাসে। জাগিয়ে তুলুক ফ্রাউলিনের যৌনতা। গান করে উঠুক সর্বপ্রাণে,-দয়াল তুমি দেখাও লীলা আজব ভূমণ্ডলে/ জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে/ ছায়া তোমার সর্ববৃক্ষে/...দয়াল তুমি নাচাও মোরে/ পাগলের হাট-বাজারে।

প্রিয় ফ্রাউলিন, গেরহার্ড একটি বিপদ সংকেত পাঠালো তোমায়,-নদী ভ্রমণের দিনগুলো ছিল মৃত্যুর আতংক ও জীবনের অনিশ্চয়তায় ভরা। একদিন মধ্যরাতে মেঘনা নদীতে ঝড় উঠেছিল। আকাশের উপর দিয়ে জঙ্গি বিমানগুলো পাক খাচ্ছিলো। মেঘনার মধ্যবুকে গেরহার্ডকে বহনকারী নৌকাটি নিশ্চিত মৃত্যুর তালে কেবল দুলছিল। তোমায় প্রাণপনে স্মরণ করে উত্থিত হতে চাইছিল সে। গেরহার্ড তোমায় বলছে,-এটি মনে রেখো যে স্মরণ একটি প্রতারক উচ্চারণ; সময়ে সেটি জাগে না। স্মৃতি ও পুরুষাঙ্গে ভাইমারকে জাগাতে না-পেরে নিজেকে সেদিন অসাড় মনে করছিল গেরহার্ড। মুজিব ফকির এই ভিনদেশি ইহুদিকে তার গানের ভিতরে জড়িত করে নিয়েছিল। ইহুদির জন্য এটি ছিল এক অমলিন স্বস্তি; এক প্রণয়মাখা ভালোবাসা ও চুম্বন। চুম্বনের অর্থ আমি তোমায় বলি,-সঙ্গীত। এটি এক সুমহান যৌনতা। ঈশ্বর এতে জেগে উঠেন বিপন্নকে রক্ষা করবেন বলে!

প্রিয় ভাইমার, আমায় অভিনন্দিত করো এই অনুভবের জন্য যে বেঁচে থাকা একটি মহান অভিজ্ঞতা; আর গেরহার্ড এখনো বেঁচে আছে! প্রিয়তমা ফ্রাউলিন, তোমার গোপন অন্তর্বাসে গেরহার্ডের পুরুষাঙ্গ দৃঢ় হওয়ার মুহূর্তে মুজিব ফকিরের গানটি অনুধাবন করার চেষ্টা করো। কারণ, সঙ্গীত হলো সেই উচ্চারণ যেটি প্রতিশ্রুতিকে অনন্তকাল ধরে মানুষের ভিতরে বাঁচিয়ে রাখে। আশা করি তুমি প্রতিশ্রুত যে আমাদের বেঁচে থাকা প্রয়োজন।

‘আমি প্রতিশ্রুতি দিলাম’ সংকটের মুহূর্তে জীবনের গান করার। ফ্রাউলিন, আমার হয়ে প্রতিশ্রুতিটি বুখেনওয়াল্ডের সকল মৃত মানুষের কাছে পৌঁছে দাও। প্রতিশ্রুতি পৌঁছে দাও এক লক্ষ আউশভিৎসে। একটি মহৎ কৃষক মারা গেছে বুখেনওয়াল্ডে। সে মারা পড়েছে পূর্ব বাংলার অগণিত বধ্যভূমিতে। সেই মহৎ কৃষকের আত্মা স্মরণ করে উচ্চারণ করো...

মৃত্যুর আতংক শেষে নব-বীজের উত্থান/ জীবনের এই তো রীতি ভাই.../ বীজ বুনে চলা কৃষকের কাজ/ বীজ বুনি ধান ভানি/ অপেক্ষা ও আক্ষেপ করি/ উদয়ের/ সেটি কার জানো ভাই.../ আমি অপেক্ষা করি/ শুভবুদ্ধি উদয়ের।
তোমার মাধ্যমে ফ্রাউলিন, কেবল তোমার শরীরকে অনুভব করার মাধ্যমে গেরহার্ড এই সিদ্ধান্তটি পাঠাচ্ছে :-

একটু পরে সকাল হবে। একটু পরে শহরটি আক্রান্ত হবে। একটু পরে মুক্তিবাহিনী নামবে। একটু পরে জনকের লাশের কাছে যুবতী কন্যাটি ধর্ষিতা হবে। একটু পরে চিকিৎসকের চোখ উপড়ে নেবে বেয়নেট। একটু পরে শহরের একমাত্র জীবিত কবির মুখে বারুদ ঠেসে ধরা হবে। আর, একটু পরে, গেরহার্ড এ-শহর ছেড়ে পালাবে।

প্রিয় ফ্রাউলিন, গেরহার্ড এখনো বেঁচে আছে এই বিস্ময়ের খবরটি রাষ্ট্র করো ভাইমারে। আর মাত্র সাড়ে তিন ঘণ্টা সময় হাতে রয়েছে। তোমার মুখে নিরাপত্তার স্বস্তি পাঠিয়ে দিতে সাড়ে তিন ঘণ্টা সময় লাগবে আমার। মোজেসকে প্রার্থনা করো,-তিনি যেন করুণা করেন। যেন আমি হ্যাভারসেকটি কাঁধে তুলে নিতে পারি। যেন পলায়ন করতে পারি সীমান্তে। মিসেস গান্ধি সীমান্তকে এখনো অক্ষত রেখেছেন।

প্রিয় ফ্রাউলিন, পলায়ন তৎপর সংবাদকর্মীর কাছে ভারত একটি মহান রাষ্ট্র। মিসেস গান্ধি সেই রাষ্ট্রের অলংকার। এটি শোফেনস্খিলের বার্তা ছিল যে,-মৃত্যু আসন্ন বুঝলে পালাও। তার সঙ্গে আমি একমত। কেননা, গেরহার্ড কোনো মুক্তিযোদ্ধা নয়, এবং পূর্ব বাংলা তার দেশ নয়। সে এসেছে সুদূর জার্মানির পাইন বন থেকে। তার গায়ের রঙ বরফের মতো সাদা, আর চুল সোনালি। প্রিয় ফ্রাউলিন, গেরহার্ডের হয়ে মিসেস গান্ধিকে এই শুভাশিস পাঠিয়ে দিও,-দুটি শত্রু রাষ্ট্রের মাঝে ধরা-খাওয়া এই মৃত্যু-উপত্যকা থেকে পলায়নের জন্য তিনি তার সীমান্ত এখনো খোলা রেখেছেন। তাকে বলো, আমি গেরহার্ড এই শুভাশিস পাঠাচ্ছি। সেই সঙ্গে এটি স্মরণ করিয়ে দিও, ভাইমার নগরীর বাসিন্দা গেরহার্ড মাত্র একবার তাঁকে সাক্ষাৎ করেছিল। তাঁর মনে না-থাকাই স্বভাবিক। মিসেস গান্ধিকে স্মরণ করিয়ে দিও, গেরহার্ড তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিল :-

‘আপনি কি পাকিস্তানকে শত্রু মনে করেন? আপনি কি মনে করেন যে পাকিস্তান ভারতকে শত্রু ভাবে?’

মিসেস গান্ধি তার বিখ্যাত পিতার মতো ধারালো ও সুদর্শন ভঙ্গিতে উত্তর করেছিলেন :-

‘আপনি এমন একটি প্রশ্ন করেছেন যার জবাব কোনো রাষ্ট্রপ্রধান সহজে দিতে চাইবেন না। আমি যদি একজন কূটনীতিকের মতো বলি,-ভারত পাকিস্তানকে মিত্র ভাবে এবং আমরা পরস্পরের আত্মীয়, তবে সেটা শুনে আপনি সম্ভবত হাসবেন। আর যদি বলি পাকিস্তান ভারতকে শত্রু গণ্য করে, তাহলে আপনার জন্যে সেটা হবে আকর্ষণীয় খবর; কারণ এতে তর্ক উসকে উঠবে আর ভারতকে নিন্দা জানাবে সবাই। হতে পারে আমাদের সীমান্ত এতে অস্থির হয়ে উঠবে এবং আপনারা খবর সংগ্রহের জন্য সেখানে ছুটে যাবেন। কেননা, দুটি রাষ্ট্রের মধ্যে এমন কোনো উত্তেজনা ঘটেনি যে আমি স্নায়ুচাপের বশবর্তী হয়ে এই মন্তব্যটি করবো। আপনার
প্রশ্নের উত্তরে আমি বরং বলবো,-সিন্ধু নদীর তীর ঘেঁষে আমাদের বসতি এই বিরাট ভূখণ্ডে বিস্তৃত হয়েছে, আর নদীকে আপনি যেভাবেই ভাগ করুন-না-কেন,-নদীর জল সবসময় সাগরে গিয়ে পড়বেই।’

প্রিয় ফ্রাউলিন, মিসেস গান্ধি সুদর্শন রাষ্ট্রনায়ক। তার সৌন্দর্য ভারতকে অমলিন রাখুক। তাকে এই বার্তাটি পৌঁছে দেওয়া প্রয়োজন,-শেখ মুজিবকে তিনি একটি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। শেখ এখন অনিশ্চিত প্রশ্নবোধক। বাঙালি তাকে খুঁজে পাচ্ছে না। এবং ঢাকায় বন্দি তার পরিবরাকে হয়তো এরিমধ্যে হত্যা করা হয়েছে। মিসেস গান্ধিকে এই খবরটি পৌঁছে দিও :-

মার্কিন দেশের জনৈক সংবাদকর্মী কিছুদিন আগে একটি ছবি তুলেছেন। ছবিটি এক নববিবাহিত দম্পতির কাহিনী বলার চেষ্টা করেছে। দম্পতি একটি ছোট শহরের অধিবাসী ছিল। শহরটি আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে তারা গ্রামে পলায়ন করে। যুদ্ধ সেখানে পৌঁছে যাওয়ার কারণে যুবক স্বামী তার নবপরিণিতা স্ত্রীকে নিয়ে ভারত সীমান্ত দিয়ে পলায়নের চেষ্টা করে। এইসময় গুলি বর্ষিত হয়। সীমান্তের ঠিক সেই রেখায় অবস্থানকালে তারা লাশ হয়, রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা যাকে নো-ম্যানস-ল্যান্ড নামে আখ্যা দিয়ে থাকেন।

ফ্রাউলিনের হয়ে মিসেস গান্ধিকে গেরহার্ড এই বার্তাটি পৌঁছে দিতে ইচ্ছুক,-নব দম্পতি গেরহার্ডের পরিচিত। যুবকটি ছিল বুদ্ধিমান, আর মেয়েটি ছিল চকোলেট রঙের। ফ্রাউলিনের ছোট বোনের বান্ধবী মার্গারিটের যমজ ছিল সে। মার্গারিট লিপজিগে বাস করে এবং সে নব বিবাহিত। মার্গারিটের বোনের মৃত্যু এটি স্মরণ করিয়ে দেয় যে বিগত দিনগুলোয় ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের শাসকগণ কিছু ওয়াদা করেছিলেন। ওয়াদা সম্ভবত একটি আরবি উচ্চারণ। অঙ্গীকারবাচক শপথ; আর ওয়াদা করা হয় তা না-রাখার জন্য। ওয়াদা-কে এভাবে ব্যাখ্যা করা যায়,-‘আমি প্রতিশ্রুতি দিলাম’।

প্রিয় ফ্রাউলিন, মিসেস গান্ধির কাছে গেরহার্ডের বার্তাটি পৌঁছানোর চেষ্টা করো,-শেখ মুজিব এখন বিস্ময়বোধক স্মারকের মতো নিখোঁজ। পূর্ব বাংলায় নিয়াজি ও মুক্তি সেনারা পরস্পরের মুখোমুখি। রণাঙ্গনের দিনগুলোয় মুখোমুখি অনিশ্চিয়তা বাচক সম্বোধন হয়ে ওঠে। পূর্ব বাংলার জনসংখ্যা এই অনিশ্চিয়তার পরিশেষ আশা করে। আর তা যদি না হয়, সীমান্ত দিয়ে পলায়ন তৎপর হওয়ার ক্ষণে মিসেস গান্ধি ও জেনারেল ইয়াহিয়াকে গেরহার্ড এই আবেদনটি জানিয়ে রাখা আবশ্যক বিবেচনা করে,-নো-ম্যানস-ল্যান্ড হলো শূন্যতাবাচক একটি দৃশ্য, কাজেই জনসংখ্যা সেখানে অবস্থান করতে পারে না। আপনাদের দক্ষ সেনাদের দিয়ে পূর্ব বাংলাকে জনসংখ্যা-শূন্য নো-ম্যানস-ল্যান্ড বলে ঘোষণা করুন। যদি সেটি সম্ভব না-হয়, গেরহার্ড বিনয়ের সঙ্গে এই আবেদন পেশ করছে,-সৈন্য ও কূটনীতি প্রত্যাহার করে আপনারা জনসংখ্যাকে তার মাটি ফিরিয়ে দিন। তাকে একটি প্রতিশ্রুত উচ্চারণ উপহার দিন যে এই-মুহূর্ত থেকে পূর্ব বাংলার জনসংখ্যা নিরাপদ। তারা এখন জীবনের দিকে মুখ ফিরিয়ে আলোকিত হতে পারে। কারণ জীবন হলো প্রতিশ্রুতিকে উচ্চারণ করা এবং সেই উচ্চারণকে অনন্তকাল ধরে মানুষের ভিতরে জাগিয়ে রাখা। আশা করি আপনারা প্রতিশ্রুত যে মানুষের বেঁচে থাকা প্রয়োজন...ওভার!
...

বি. দ্র : ‘হরমা’র প্রোলোগ হিসাবে সংবাদকর্মী রিচার্ড গেরহার্ড কোনেলের এই আলেখ্যটি রচনা করেছেন আহমদ মিনহাজ। কতিপয় সত্য-ঘটনা ও ঐতিহাসিক চরিত্র ব্যতীত আলেখ্যে বর্ণিত সংবাদকর্মী এবং সংশ্লিষ্ট চরিত্র ও ঘটনারা আলেখ্যের প্রয়োজনে সৃষ্ট। বাস্তবের কোনো চরিত্রের সঙ্গে সংবাদকর্মী রিচার্ড গেরহার্ড কোনেল বা সংশ্লিষ্ট চরিত্রের কোনো মিল কেউ যদি খুঁজে পান তবে তা অনিচ্ছাকৃত ও রচয়িতার অজ্ঞাতে ঘটেছে। আলেখ্যে ব্যবহৃত সত্য ঘটনা ও চরিত্রে যদি কোনো ভুল তথ্য পরিবেশন করা হয়ে থাকে, এর দায়ভার রচয়িতার নিজের।

‘হরমা’র পক্ষ থেকে এই সাংবাদিক-আলেখ্যটি পৃথিবীর সকল শান্তিকামী ও যুদ্ধ প্রতিরোধী অনুভবের সমর্থনে উৎসর্গ করা হলো। এটি উৎসর্গিত হলো যুদ্ধ সংক্ষুব্ধ গাজা ও ইরাকবাসীর প্রতি-ও। যেন অদূর ভবিষ্যতে কোনো সংবাদকর্মীকে রক্তপাত ও সহিংসতার এইসব বিবরণ লিখতে না হয়। আমরা যেন এটি স্মরণ করি যে মানুষ এক মহান সুবিবেচক। এই বিবেচনা সকল আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জীবনের দিকে আলোকিত রাখুক আমাদের।
-সম্পাদক, হরমা

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন