শুক্রবার, ৬ নভেম্বর, ২০০৯

সেতু বাঁধবেন কী করে এবং কী ভাবে ?

রবি চক্রবর্তী


ভারতীয় উপমহাদেশের সংস্কৃতির বা বঙ্গসংস্কৃতির অনন্যতা কেন নিশ্চিতভাবে প্রমাণ হয়ে গেল না, তার কারণ কি কখনো ভেবে দেখেছেন ?
একটা সভ্যতা বা সংস্কৃতির মধ্যে অনেক রকমের কলা, বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস ইত্যাদি থাকে। কিন্তু সেই সভ্যতার মর্মমূলে যদি যেতে হয়, তবে যেতে হয় তার বিশ্ববীক্ষায় ; যেমন কিনা কোনো ব্যক্তির ভিতরের সত্য বুঝতে হলে যেতে হয় সেই মানুষের ভাবনাচিন্তার গভীরে।
প্রাচীন গ্রীসের স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের মধ্যে যে আড়ম্বরহীন ঋজুতা ও সুষমা, তার পিছনে অবশ্যই রয়েছে একটি বিশেষ বিশ্ববীক্ষা বা জীবনবোধ। কিন্তু সেই বিশেষ বিশ্ববীক্ষা বা জীবনবোধ আমরা কোথায় খোঁজ করব ? অবশ্যই প্রাচীন গ্রীসের কাব্য, সাহিত্য ও দর্শনে। সেজন্য তাদের কাব্য ও সাহিত্যের মধ্যে যে রচনাশৈলী ফুটে উঠেছে, সেটিকে ভাল করে অনুধাবন করতে হয়; উপরন্তু বুঝতে হয় কী মানসিকতা স্পষ্টভাবে ব্যক্ত হয়ে আছে তাদের, অর্থাৎ প্রাচীন গ্রীকদের, গদ্যরচনা. ইতিহাস ও দর্শন জাতীয় নানান রচনার মধ্যে। গ্রীকরা নিজেরা কী ভাবত সেটা জানাটাই আমাদের অন্তিম লক্ষ্য এমন অবশ্য নয়, কিন্তু সেটা না জানলে কোনোক্রমেই সম্যক আলোচনা হয় না। অভিজ্ঞ ব্যক্তি মাত্রই জানেন অ্যারিস্টটলের Catharsis তত্ত্ব নিয়ে কত হিমশিম খেতে হয় গ্রীকভাষায় শব্দটির কতটা ব্যাপ্তি ছিল সে সম্বন্ধে নিশ্চিত ধারণা না থাকায়। ট্র্যাজেডি সম্বন্ধে আলোচনায় Hubris,১ Hamartia,২ Sophrosyne,৩ Nemesis৪ এ ধারণাগুলির গুরুত্বও কম নয়। এ জন্যই গ্রীক ট্র্যাজেডি বা গ্রীক দর্শন সম্বন্ধে সুষ্ঠু আলোচনার স্বার্থে প্রাচীন গ্রীক ভাষায় কিছুটা ব্যুৎপত্তির প্রয়োজন। যে কোনো সভ্যতাকে বুঝতে গেলে সেই সভ্যতার আধার ছিল যে-ভাষা, অর্থাৎ যে-ভাষাকে অবলম্বন করে সে-সভ্যতা আত্মপ্রকাশ করেছিল, সেই ভাষায় অধিকার অর্জন করে তবে সেই সভ্যতাকে ঠিক বোঝা যায়। কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশের বেলায় কী জিনিস ঘটল ? পশ্চিমী পণ্ডিতরা, প্রধানত যাদের কাছে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত আমরা আধুনিক ভারতীয়রা পাঠ নিয়েছি, সকল বিদ্যার ক্ষেত্রে তাঁরা কি ভারত-সংস্কৃতির ওপর সুবিচার করেছেন ? না, তাঁরা তা করেননি। অথবা এ-কথা বলাই ভাল যে, তাঁরা তা করতে পারেননি। আমরা ইংরেজি-শিক্ষিত বাঙালিরা তা করিনি। কিন্তু কোন্ কার্যকারণে এমন জিনিস ঘটল ?

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমাদের হাজার বছর পিছিয়ে গিয়ে নিজেদের দিকে দেখা শুরু করতে হয়। একাদশ শতাব্দীতে মহান ইরানী পণ্ডিত আল বিরুনি (৯৭৩-১০৪৮ খ্রীষ্টাব্দ) সংস্কৃতভাষা সম্বন্ধে দু’টি গুরুতর অভিযোগ এনেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, বহুরকমের সমৃদ্ধি সত্ত্বেও এই ভাষার বড় ত্র“টি এই যে, এই ভাষায় একদিকে একটি শব্দ দিয়ে বহু জিনিসকে বোঝানো হয়, আবার অন্যদিকে একই জিনিস বোঝানোর জন্য বিভিন্ন শব্দের ব্যবহার হয়। দ্বিতীয় অভিযোগ সত্যি হলে বুঝতে হবে এ-ভাষায় বহু অপ্রয়োজনীয় শব্দ আছে। কিন্তু প্রথম অভিযোগটি আরও গুরুতর। এটি যথার্থ হলে বুঝতে হবে এই ভাষায় রচিত গ্রন্থের মর্মোদ্ধার সুকঠিন কাজ। উপরন্তু শব্দার্থের ক্ষেত্রে এমন নৈরাজ্যের কারণে এই ভাষায় কোনো বড় সৃষ্টি সম্ভব নয়। অথচ ঋগ্বেদ সহ পুরাণাদি ও রামায়ণ-মহাভারতের মতো বড় সৃষ্টি তো এই ভাষায় বহু আগেই হয়েছে ! কী করে হল ?

না, সে প্রশ্নের উত্তর জানার চেষ্টা করা হল না। আল বিরুনির আনা অভিযোগের কোনো নিষ্পত্তি হল না, সে-কাজ মুলতবি রইল শতাব্দীর পর শতাব্দী। এই পরিস্থিতির মধ্যেই পশ্চিমী দেশের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা হয়ে গেল পৃথিবীর দিকে দিকে, আমাদের দেশেও। সেই সূত্রে পশ্চিমের পণ্ডিতরাও এলেন এ-প্রাঙ্গণে, আর নিজেদের মতো করে বোঝার চেষ্টা করলেন ভারতীয় উপমহাদেশের সাহত্যি-ইতিহাস-সংস্কৃতিকে। আমাদের কিছু কিছু পণ্ডিতদের সহযোগিতা অবশ্য তাঁরা পেলেন, কিন্তু তাতে খুব কিছু লাভ হল না। প্রথমত তাঁদের সহযোগী এ-দেশীয় পণ্ডিতরা ততদিনে নিজেদের ঐতিহ্যকে পুরো না বুঝে তার বোঝাটাই বহন করে চলছিলেন, আল বিরুনির অভিযোগের নিরসন তাঁরা করতে পারেননি। তার ওপর পশ্চিমী পণ্ডিতরা তাঁদের বিদ্যাচর্চার অভ্যস্ত ছকের মধ্যে বিচরণ করতে চাইবেন, এটাই ছিল স্বাভাবিক। প্রসঙ্গভেদে শব্দার্থের ভিন্নতা হওয়ার সম্ভাবনাকে তাঁরা বিচারের মধ্যেই আনলেন না। সব শব্দের মধ্যে বিশেষ বিশেষ ক্রিয়ার দ্যোতনাটা যে সবচেয়ে প্রধান কাজ এ-কথা তাঁরা বুঝলেন না। এর ওপর পশ্চিমী Mythology সম্বন্ধে তাঁদের চর্চা যতদূর এগিয়েছিল তার ভিত্তিতে তাঁরা এদেশের বেদ-পুরাণাদির ব্যাখ্যা দিতে লাগলেন। বেদ-পুরাণাদির কাহিনীগুলি সামাজিক ইতিহাসেরও বয়ান হতে পারে সে সম্ভাবনা তাঁদের মনেই এল না। অথচ নানাবিধ পুরাণকাহিনীর বহু পাত্রপাত্রীর নামের মধ্যেই নির্দেশ আছে কাহিনীগুলি কি-জাতীয় সামাজিক সত্যের উপস্থাপনা করছে। পুরাণাদির কাহিনীর পাত্রপাত্রীদের সুস্পষ্ট ব্যঞ্জনাবাহী নামগুলির সঙ্গে তাদের আচরণগুলির যে যথেষ্ট সঙ্গতি আছে এ-সত্যাটি তাঁরা ধরতেই পারলেন না। একবার দেখুন না - ধৃতরাষ্ট্র, বিভীষণ, যুধিষ্ঠির, রতি, মদন, শিব - এই নামগুলির সঙ্গে তাদের আচরণগুলির কতখানি মিল পাওয়া যায। আবার দেখুন, দুর্যোধন, দুঃশাসন - এগুলো কি কখনো পিতৃদত্ত নাম হয় ? উপরন্তু, পুরাণাদিতে এমন কথা বলা আছে যে, দক্ষ, ব্যাসদেব প্রভৃতি চরিত্র বারে বারে জন্মাবে, এবং দেখানো হচ্ছে যে বশিষ্ঠমুনি পিতা-পুত্র-পৌত্রাদি ক্রমে পৌরহিত্য করেই যাচ্ছেন। অথচ পুরাণের বিভিন্ন চরিত্রকে ‘ঐতিহাসিক ব্যক্তি’ মনে করে তাদের কাল নিরূপণের চেষ্টায় কত না পণ্ডশ্রম করেছেন আমাদের দেশের জিজ্ঞাসু গবেষকরা। যদিও সবচেয়ে সহজে যা করা যেতে পারত, তা হল সেগুলিকে ‘ব্যক্তি’ না-ভেবে ‘সামাজিক সত্তা’ ভেবে নেওয়া; আর সেটা করার মতো জ্ঞান তখনকার ইউরোপীয় পণ্ডিতদের ছিল। কেননা ইউরোপের মধ্যযুগের Morality নাটকে Knowledge, Mercy, Pleasure, Beauty, Kinship - এই রকম নানান নামের চরিত্র থাকত। অথচ সেরকম সত্তাদের সঙ্গে সাদৃশ্য খুঁজে এদেশের অতীতের সত্যান্বেষণ শুরু হল না। শাসকের গর্বে তাঁরা সেভাবে ভাবতেই পারলেন না। তাঁরা বুঝিবা ভাবলেন, শাসিতের সংস্কৃতিতে অত উচ্চমার্গের ভাবনা থাকবে কি করে। সম্ভবত এই ছিল তাঁদের বিশ্বাস।

মোটকথা, এদেশে পশ্চিমী লেখাপড়ার সূত্রপাত হয়ে যাওয়ার পর, বেদ-পুরাণ-রামায়ণ-মহাভারতাদির ভেতর যে ভাবসম্পদ নিহিত আছে তা ধরতে পারার যে অক্ষমতা আগে থেকেই ছিল তা ক্রমে বেড়েই চলল। কিন্তু তার থেকেও বড় ক্ষতি হল এই যে, আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত বাঙালি বাংলাভাষার সৃজনশীল ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। প্রাচীন ভারতীয় ভাষা থেকে পাওয়া উত্তরাধিকারের জোরে বাংলাভাষায় ক্ষমতা ছিল অসীম  অনেক আপাত বিভিন্ন বস্তু বা সত্তাকে একই নামে চিহ্নিত করা যেত, সমস্ত সত্তাকে দেখা হত বিশেষ বিশেষ ক্রিয়ার আধার হিসেবে এবং সে-জন্যই বাইরের দিকের পার্থক্য সত্ত্বেও একই নামে বহু আপাত পৃথক সত্তার উল্লেখ করা যেত। বলা বাহুল্য, সংস্কৃত ভাষার এ-রীতি হিন্দু ধর্মের সূত্রপাতের আগেই মৃতপ্রায় হয়ে পড়েছিল। হিন্দু ধর্মের সূত্রপাত (৭৫০ খ্রীষ্টাব্দে) তার মৃত্যুঘণ্টা বাজিয়ে দেয়। কিন্তু তাই বলে সেই রীতি কিন্তু হারিয়ে যায় না। মধ্যযুগে (১৩০০ খ্রীষ্টাব্দে) পাঠান রাজত্বের ছত্রছায়ায় তা নবজীবন লাভ করে বাংলাভাষায় আর সেই রীতি অনুসরণ করেই সেকালের বাংলাভাষা জন্ম দিয়েছিল বিশাল মঙ্গলকাব্যের, বৈষ্ণবসাহিত্যের, আউল-বাউল সাহিত্যের এবং সর্বোপরি বাংলা রামায়ণ-মহাভারতের। যদিও ১৮০০ খ্রীষ্টাব্দে পৌঁছে বাংলাভাষায় এ রীতির অনেকটাই হয়ে পড়েছিল অভ্যাসগত এবং বাংলাভাষীর তরফে তাত্ত্বিক সচেতনতা ততদিনে খুবই দুর্বল হয়ে পড়েছিল।

তবুও চেষ্টা থাকলে সেই অবস্থা থেকেও মানবজাতির এই মহত্তম অর্জনকে তখনই উদ্ধার করা যেত, যদি ইউরোপের শাসকসুলভ-দৃষ্টিভঙ্গী সংশ্লিষ্ট পণ্ডিতদের দৃষ্টিকে কলুষিত করে না দিত। কারণ বাংলাভাষায় তখনও পর্যন্ত সবকিছু কমবেশি জীবন্তই ছিল। ছিল বাঙালির নিত্যনৈমিত্তিক ভাষা ব্যবহারে, বাঙালির দৃষ্টিভঙ্গীতে। এখনও তো প্রায় সেই অবস্থা থেকেই আমরা (কলিমখান ও আমি) আমাদের সেই মহত্তম অর্জন সাধ্যমতো পুনরুদ্ধার করছি।৫ পার্থক্য শুধু এই যে, তখনকার পণ্ডিত বিশ্বাস করে ফেলেছিলেন ইউরোপের চেয়ে কোনো বিষয়েই বেশি কেউ জানে না, জানতে পারে না, আমাদের কারও উপরই সেরকম কোনো অন্ধ বিশ্বাস নেই। চেষ্টা করলে বাঙালির সেই অর্জনকে যে-কেউ চিহ্নিত করতে পারেন।
আলোচনার পরবর্তী পর্যায়ে যাওয়ার আগে কিছু অন্য কথায় বোধ করি যাওয়া দরকার। বাংলার সম্পদ দেখাতে গিয়ে মাঝেমধ্যে সংস্কৃতের উল্লেখ করেছি। আজকের পরিস্থিতির কারণে হয়তো অনেকের এটা অসঙ্গত ঠেকছে। বিশেষ করে, পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশ  বাংলা ভাষার দুই ভুবনেই এখন সরকারি পণ্ডিতদের একান্ত চেষ্টা সংস্কৃত থেকে বাংলাকে আরও দূরে সরিয়ে নেওয়ার। দু’জায়গাতেই এই চেষ্টার মূলে আছে হিন্দুত্বের ভূত দেখা এবং হিন্দুত্বের সঙ্গে সংস্কৃতকে মিলিয়ে দেখার অভ্যেস। তফাৎটা এইখানে  বাংলাদেশে আছে আরবি-ফারসি দিয়ে শূন্যতা পূরণের কল্পনা, আর পশ্চিম বাংলার অবস্থা আরও বিপজ্জনক  তাঁরাও বাংলাভাষার মূলে সংস্কৃতকে সক্রিয় থাকতে দিতে চান না, কিন্তু যাবেন কোথায় তাও জানেন না, ফলত তাঁদের এক দিশেহারা অবস্থা। তবে এই সংস্কৃত-উচ্ছেদ-আগ্রহীদের মনে করিয়ে দিতে চাই  মাইকেল-এর ‘হে বঙ্গ ভাণ্ডারে তব’ কবিতাটির কথা। মাইকেল বলছেন, তিনি মণিজালে পূর্ণ মাতৃভাষা পেয়ে গেছেন এবং তিনি তাতে সুখী। ভেবে দেখবেন, এটি গ্রামবাংলার বাংলা ভাষা বা কাব্য নয়, এবং কোনো মতে তা হতে পারে না। মাইকেলের কাছে বাংলা আর সংস্কৃতের ঐশ্বর্য যেন যৌথ সম্পদ। এবং এর মূলে রয়েছে ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থবিধি, যা কিনা সংস্কৃত ও বাংলা ভাষার প্রায় প্রতিটি শব্দের মূলে আজও সক্রিয়। তাই, এর পর থেকে নিবন্ধে বাংলা-সংস্কৃত ঐশ্বর্য বোঝাতে ‘আমাদের ক্রিয়াভিত্তিক (বাংলা বা সংস্কৃত) ভাষা’ শব্দটি ব্যবহার করব, এই দুই ভাষার মিলিত রাজ্যকে বোঝাবার জন্য।


আমাদের বাংলাভাষার সম্পদস্বরূপ তার মহত্তম অর্জন রয়েছে তার শব্দ তৈরির নিয়মে। সে-নিয়মের কথা এখন থাক, কেবল উদাহরণ দিয়ে দেখাব সেই সূত্রে আমরা কি পেয়েছি। পদ শব্দটি দিয়েই foot, position, বাক্যের ভিতরের শব্দ, কবিতার পঙ্ক্তি, কবিতা, এমনকি রন্ধনের ফরংয পর্যন্ত বোঝানের মধ্যে কোনো অসঙ্গতি কোনোদিন বাংলা ভাষীর চোখে পড়ত না এবং বলা যায় এখনও এদেশের বাঙালি সমাজের মধ্যে চলাফেরা করেন এমন বাঙালির চোখে পড়ে না (একটু বিশ্লেষণ করলেই দেখিয়ে দেওয়া যায়, এখানে শব্দ সৃজনের ক্ষেত্রে কোনো মূলগত ত্রুটি নেই)। অথবা সিদ্ধডিম আর সিদ্ধপুরুষ নিয়েও কোনো অস্বস্তি বোধ করেন না বাংলাভাষীরা, যদিও এমন হওয়ার কারণ জানেন না আধুনিক বাঙালিরা প্রায় কেউই।
কিন্তু মনের দিক থেকে আগের শব্দার্থতত্ত্ব থেকে চ্যুত হয়ে যাওয়ার ফলে ইংরেজি- লেখাপড়া-শেখা বাঙালি প্রতিটি বাংলা শব্দের সমর্থন খুঁজতে লাগলেন ইংরেজিতে। ধর্ম শব্দটি হয়ে গেল Religion-এর প্রতিশব্দ, অর্থ শব্দটি হল Money বা Meaning-এর, পদ শব্দটির প্রতিশব্দ হল foot বা position-এর| Religion, Money / Meaning, Foot / Position ইত্যাদি ছাপিয়ে আরও অনেক কিছু বোঝানো যে-ক্ষমতা ছিল যথাক্রমে ধর্ম, অর্থ. পদ ইত্যাদি শব্দের, সে-ক্ষমতা কার্যক্ষেত্রে এই শব্দগুলি হারিয়ে ফেলল। অগণিত শব্দের ক্ষেত্রে এমন ঘটায় সমগ্রভাবে বাংলা শব্দভাণ্ডারের ব্যাপকভাবে অর্থহানি ঘটে গেল, এবং বহুক্ষেত্রে সূক্ষ্ম ও মারাত্মকভাবে। ভাব শব্দটিকে যখন idea বা urge-এর সমার্থক করা হয়, প্রকৃতিকে nature-এর, আকাশকে sky-এর, বস্তুকে matter-এর, যুক্তিকে reason বা argument-এর (এরকম অগুনতি উদাহরণ দেওয়া যায়), তখন সমগ্রভাবে আমাদের চিন্তাকাঠামোই পঙ্গু হয়ে যায়।৭

এইরকম করে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত বাঙালি বেশি করে আশ্রয় খুঁজল ইংরেজি ভাষায়, কোথাও দাঁড়ানোর একটি নিশ্চিত জায়গা পাবার আশায়। তার নিজস্ব যে অর্জন ছিল, শ্রেণীগতভাবে মধ্যযুগের ব্রাহ্মণ তাকে অনাদর করলেও পাঠানরাজা তাকে যথেষ্ট সম্মান দিয়েছিলেন। কিন্তু ১৭৫৭ খ্রীষ্টাব্দে ইংরেজ এসে তার আকাশটাকেই অস্বীকার করে বসল। কিন্তু মাথার উপরে আকাশটা তো চাই। ভাষা-সংস্কৃতি-দর্শনই তো মানুষের মাথার উপরের প্রকৃত ছাদ, তার আকাশ।৮ দেশের শাসক যদি সেই আকাশকে দেখতে না-পেয়ে অস্বীকার করে, শাসিতের মাথায় তার ‘আকাশ ভেঙে পড়ে।’ সে দিশাহারা হয়ে যায়। এই অবস্থাতেই প্রায় একশো বছর কাটিয়ে দিশাহারা বাঙালি একদিন বিদ্যাসাগর রামমোহনের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিল নিজস্ব সংস্কৃতির আকাশটি যদি আমাদের সুরক্ষা দিতে না পারে তবে বরং ইউরোপের ‘আধুনিকতা’র আকাশটিই দিক। শিক্ষিত বাঙালিদের মাথা থেকে বাঙ্গালির নিজস্ব পরম্পরাগত আকাশটি সরে গিয়ে তার স্থানে দেখা দিল ইউরোপীয় আকাশের ছায়া। এর পর থেকে বাঙালির নিজস্ব আকাশের স্থান হল গ্রামবাংলায়, তথাকথিত অশিক্ষিতদের মধ্যে, ক্ষয়িষ্ণু হয়েও সেখানেই টিকে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা চালাতে লাগল সে। কার্যত আমাদের ভাষা-সংস্কৃতি থেকে ইউরোপের ভাষা-সংস্কৃতির বড় পার্থক্য এই যে, আমাদের শব্দসমূহে ইঙ্গিত থেকে যত ক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে, হচ্ছে বা হবে, তাদের দিকে পশ্চিমী ভাষায় শব্দের উদ্দেশ্য হল ক্রিয়ার কর্তা কর্ম প্রভৃতিকে সুস্থিত এবং বাহ্য রূপে সুনির্দিষ্ট সত্তার অধিকারী হিসেবে দেখানো।

এর ফল হল মারাত্মক। শিক্ষিত বাঙালির মাথার উপর সক্রিয় হল ইউরোপের আকাশ, সেই শিক্ষিত বাঙালি হল তার জাতির পথপ্রদর্শক পরিচালক, যে-জাতির মাথার উপরের আকাশটিই ভিন্ন স্বভাবের। তার ভাষায়, অভ্যাসে, রক্তে পরম্পরাগত আকাশের তলায় বাস করবার আচরণ পুরো মাত্রায় সক্রিয়। শুরু হল ইউরোপের আকাশ কর্তৃক বাংলাভাষীর মনোলোকের আকাশ দখলের লড়াই।

বাংলা শব্দসমূহের যে ব্যাপ্তি ও দ্যোতনক্ষমতা ছিল, যদিও তার অনেকটাই অব্যবহৃত হয়ে পড়ে থাকতে, আধুনিকতার সূত্রপাতের পর এবার তা বলতে গেলে এক কোপেই হারিয়ে গেল। বাংলা হয়ে গেল যেন একটি রক্তাল্পতাগ্রস্ত ভাষা। ধাতুর আগে উপসর্গ ও পরে প্রত্যয় জুড়ে যে-বিশাল শব্দরাজ্য বাংলায় সৃষ্টি করা যায়, সেখানে সৃজনশীল ভাবে বিচরণ করার অধিকার হারিয়ে ফেলল আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত বাঙালি। এমনকি তার মনে হতে লাগল আমার ভাষা দরিদ্র, ইংরেজির তুলনায় শব্দসম্ভারে অনেক হীন। সত্যি কথাটা এই, এইরকমের হীনমন্যতা নিয়েই পশ্চিমের সংস্কৃতিজগতে প্রবেশ ঘটেছে আমাদের এযুগের বাংলাভাষীদের।


কিন্তু সত্যিই কি আপনার-আমার ভাষা দরিদ্র বা হীন ?
...................................
এই প্রশ্নের আলোচনার সূচনায় ভাষাসম্পদ বললে আসলে কী বোঝাতে পারে তার দিকে একটু নজর দেওয়া প্রয়োজন। কোনো বিশেষ ভাষার অভিধানে কত শব্দ দেখানো আছে তা দিয়ে নিশ্চয় এ প্রশ্নের মীমাংসা হয় না। ভাষায় যে সম্পদ আছে, তা দিয়ে ঐ ভাষাভাষীদের কতটা সুবিধা হচ্ছে ভাবপ্রকাশ ও ভাববিনিময়ের ক্ষেত্রে, সেটিই আসল বিচার্য। এ প্রসঙ্গে আর একটি জিনিসও মনে রাখতে হয়। যে-শব্দগুলি চোখে-দেখা, কানে-শোনা ইত্যাদি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জিনিসকে সূচিত করে, তাদের নামের বেলায় আমাদের দাবি একটাই  শব্দগুলি যেন আমাদের পক্ষে সহজে ব্যবহারযোগ্য হয়। কিন্তু যে শব্দগুলি নানান বিমূর্ত ভাবকে ব্যক্ত করে, তাদের একটি বিশেষ গুরুত্ব আছে। তারা আমাদের ভাবনাচিন্তার সহায়ক এবং উদ্দীপক হতে পারে, আবার তারা আমাদের প্রকৃত ভাবনাচিন্তার অন্তরায়ও হতে পারে। বুঝবার সুবিধার জন্য একটি পশ্চিমী উদাহরণই টানা যাক। বাংলা আমাদের জননী হলেও, ইংরেজিই যে এখন আমাদের পালিকা-মা ! ইউরোপের আকাশের তলাতেই যে আমরা আধুনিক বাঙালিরা বড়ো হয়ে উঠেছি। সুতরাং একবার ইংরেজি, ফরাসি ও জার্মান ভাষার পরিভাষার দিকে নজর দেওয়া যাক।
মাটি, জল, হাওয়া প্রভৃতি জড়জগতের জিনিস, সুদূর অতীত থেকে চলে-আসা পারিবারিক সম্পর্ক, এমনকি সপ্তাহের সাতদিন ইত্যাদির বেলায় যেসব নাম ইংরেজিতে পাই, সেগুলি ইংরেজির জ্ঞাতি-ভাষাসমূহে (অর্থাৎ ডাচ, জার্মান, ডেনিশ প্রমুখ জার্মানিক ভাষায়) ব্যবহৃত শব্দসমূহের অনুরূপ। কিন্তু উচ্চাঙ্গের মানসিক চর্চার ক্ষেত্রে, নানান ঐতিহাসিক কারণে ইংরেজি শব্দভাণ্ডারের চরিত্র অন্যরকম। সেই এলাকায় ইংরেজির শব্দভাণ্ডার ল্যাটিন, ল্যাটিন-উদ্ভূতা ফরাসি, অথবা (সরাসরি কিংবা ঘুরপথে) গ্রীক থেকে ধার-করা। এই রকমের শব্দভাণ্ডার ইংরেজি বা এমনকি ফরাসির পক্ষেও শুভ হয়েছিল, তা বলা চলে না। কিছু উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে এ প্রসঙ্গে। ইংরেজ বা ফরাসি কোনো ইধৎসধরফ (পানশালার পরিচারিকা)-কে যদি জিজ্ঞেস করা যায় ঈড়হংঃবষষধঃরড়হ অথবা ঈড়হংপরবহপব বললে কি জাতের জিনিস বেঝাতে পারে, তবে কোনো সন্তোষজনক উত্তর পাওয়া যাবে না। অথচ ঠিক এক পর্যায়ের কোনো জার্মান নারীকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় এবংঃরৎহ (= ঈড়হংঃবষষধঃরড়হ) অথবা এবরিংংবহ (= ঈড়হংপরবহপব) শব্দের কি রকমের মানে হতে পারে, তবে সঠিকের ধারে-কাছে আসে এমন উত্তর পাওয়ারই সম্ভাবনা। কেননা ঝঃবৎহ (নক্ষত্র), ডরংংবহ (= শহড়)ি হল জার্মান ভাষায় নিত্য-ব্যবহৃত শব্দ, এবং সমষ্টিগত ব্যাপ্তি বোঝাতে এব নিত্য-ব্যবহৃত উপসর্গ। এমন অবস্থা রাতারাতি হয়নি। রেনেসাঁস এবং পরবর্তীকালে ইংরেজ যেখান তত্ত্বালোচনার ক্ষেত্রে ল্যাটিন (এবং গ্রীক) থেকে অনর্গল শব্দ আমদানি করতে লাগল, জার্মানরা প্রথমে তা করলেও অল্প পরেই স্বাবলম্বনের রাস্তা ধরল। অর্থাৎ নিজের ভাষার উপাদান নিয়ে পরিভাষা তৈরি করে নিতে লাগল। ফলে দর্শন ও বিজ্ঞানের পরিভাষা জার্মানের কাছে অনেক স্বচ্ছ, যে সম্পদটি ইংরেজের ঘটল না। ফরাসির ভাগ্যও এদিক থেকে বিশেষ ভাল না; ল্যাটিন-জাত ভাষা হলেও ফরাসিভাষার মধ্যে ল্যাটিনের যথেষ্ট সৃজনশীল উপস্থিতি নেই। অষ্টাদশ, ঊনবিংশ, এমনকি বিংশ শতাব্দীতেও উচ্চাঙ্গের তত্ত্বের সৃষ্টি ও বিকাশের ক্ষেত্রে ইংরেজ বা ফরাসির তুলনায় জার্মানরা যে অনেক বেশি কৃতী, তার মূলে আছে তাদের পরিভাষার স্বচ্ছতা ও সহজ ব্যবহারযোগ্যতা। স্মরণ করা যায় যে, কাণ্ট হেগেল মার্কস আইনস্টাইন ফ্রয়েড  সকলেই তাঁদের অসামান্য মৌলিকতার বনিয়াদ সৃষ্টি করেছিলেন জার্মান ভাষায়। পাণ্ডিত্য, স্বচ্ছ দৃষ্টি, প্রজ্ঞা ও সৃজনশীলতার একত্র সম্মিলনে সমগ্র ইংরেজি সাহিত্যে যাঁর জুড়ি নেই সেই কোলরিজ বলেছিলেন তাঁর জানা মোট দু’টি ভাষায় গভীর আলোচনা করা যায়  একটি গ্রীক, আর একটি জার্মান।
যাই হোক, ইংরেজির তুলনায় বাংলাভাষা হীন কি না, এটিই আমাদের আলোচ্য। সেই প্রসঙ্গে ফিরে আসছি।
ব্যাকরণ, সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শন  প্রথমেই কয়েকটি অতি প্রচলিত শব্দ নিচ্ছি। অল্প চেষ্টাতেই বোঝা যায়, ইংরেজি প্রতিশব্দ  যেগুলি আবার গ্রীক বা ল্যাটিন থেকে আসা সাধারণ ইউরোপীয় উত্তরাধিকার  তাদের তুলনায় বাংলা শব্দগুলি কত বেশি যথাযথ এবং ব্যাপক। এৎধসসধৎ বললে বোঝায় খোদাই করে বা আঁচড় টেনে লেখালিখি সংক্রান্ত বিদ্যা; সেখানে ব্যাকরণ শব্দটিতে বোঝায় ভাষাকে বিশেষ আকারে এনে তার বিশ্লেষণ। খরঃবৎধঃঁৎব বললে বোঝাতে পারে ষবঃঃবৎং বা বর্ণ সংক্রান্ত কিছু, বা বর্ণাকারে লিখিত কিছু ভাষা; আর সাহিত্য শব্দ থেকে বোঝা যায় এটি মানুষকে মানুষের নিকটে আনে। তেমনি ঐরংঃড়ৎু (= যরংঃড়ৎ বা জ্ঞানী লোকের জ্ঞান) অথবা ঢ়যরষড়ংড়ঢ়যু (= ঝড়ঢ়যরধ বা প্রজ্ঞার প্রতি আকর্ষণ) শব্দের পাশে কত বেশি যথাযথ ও সমৃদ্ধ (ইতি হ আস = এইরূপ ছিল) বা দর্শন শব্দটি। আর, আমাদের ‘অধ্যাত্মবিদ্যা’কে বোঝানোর মতো কোনো শব্দই নেই ইংরেজিতে। তাছাড়া, পশ্চিমের শব্দগুলির তাৎপর্য খুঁজতে হয় অভিধানে, বা বেশির ভাগ মানুষ ঐ শব্দ দিয়ে কি বুঝছে তা বুঝে অনুমানে। আর বাংলা বা সংস্কৃত শব্দের তাৎপর্য তার উপাদান থেকেই পরিস্ফুট।
এরকম অনেক পারিভাষিক শব্দ দেওয়া যায়, যেখানে আমাদের ভারতীয় শব্দ পশ্চিমী শব্দের তুলনায় অনেক বেশি সমৃদ্ধ। ঝঃধঃঁং-এর জ্ঞাতি ঝঃধঃব শব্দটিতে বোঝায় যা দাঁড়িয়ে আছে, আর রাষ্ট্র বললে বোঝায় যার সাহায্যে ‘রাজ’ (= রাজ্যশাসন) করা যায় (রাজ্ + ত্র) যেমন মননের জন্য মন্ত্র, শাসনের জন্য শাস্ত্র, পান বা পালনের জন্য পাত্র, সেইরকম। ঞৎড়ঃয শব্দের জাতি ঃৎঁঃয-এর আদি মানে চুক্তিতে বিশ্বস্ততা অথবা কথা রাখা, আর সত্য বললে বোঝায় সৎ (অর্থাৎ যা আছে, যা বিদ্যমান)-এর গুণ বা তার প্রতি আকর্ষণ বা নিষ্ঠা।
পশ্চিমের ভাষাগুলির শব্দভাণ্ডারের বড় অংশই নানা ঘটনা-সমাবেশের ফলে ভাষার মধ্যে জায়গা পেয়েছে। রাজকোষকে ঊীপযবয়ঁবৎ, পার্লামেণ্টের সভাপতিকে ঝঢ়বধশবৎ, ফটোকপিকে ঢবৎড়ী, সামাজিক বর্জনকে ইড়ুপড়ঃঃ ; এমনকি মহান নাটসৃষ্টিকে ঞৎধমবফু (= ছাগগীতি)  সর্বত্র এই তাৎক্ষণিকতার মনোভাব ফুটে ওঠে। আর আমাদের দেশের পরিভাষার সর্বত্রই প্রতিটি সত্তাকে তার ক্রিয়ার পরিচয়ে চিহ্নিত করার চেষ্টা। এ প্রসঙ্গে বিশেষ সত্যকথা এই যে, ক্রিয়াভিত্তিকতা যদি ভাষার সাধারণ চরিত্র না হত, তবে শুধু পরিভাষার শব্দে এই বৈশিষ্ট্য দেখা যেত না। ভাষার সাধারণ শব্দই তো বারেবারে প্রয়োগের মধ্য দিয়ে পারিভাষিক শব্দ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে যায়।
ক্রিয়াভিক্তিকতাই আমাদের দেশের প্রাচীন ভাষার শব্দার্থতত্ত্বের মূল নীতি। কলিম খান-এর ভাষাতাত্ত্বিক উদ্যোগের গৌরব ঠিক এইখানে, এই শব্দার্থতত্ত্বের পুনঃপ্রতিষ্ঠায়। তিনি দেখালেন, প্রতিটি প্রাতিপদিক (বা বিশেষ্য শব্দ) কোনো ধাতু (বা ক্রিয়ার নাম) অবলম্বন করে সৃষ্টি হয়েছে  যাস্কমুনির এই প্রাচীন তত্ত্বটি একটি ব্যাকরণের কেতাবি তত্ত্ব মাত্র নয়। এ তত্ত্বটিকে যথোচিত গুরুত্ব দিয়ে ভাষাবিচারে এগোলে পর, আমাদের দেশের প্রাচীন সাহিত্য ও ঐতিহ্যের নানা রহস্য একটার পর একটা উন্মোচিত হতে থাকে। আর সেই সঙ্গেই বোঝা যায় আমাদের ভাষার কী বিপুল শক্তি, আর কী সম্পদ ধরা আছে নিছক ভাষাটির মধ্যে।
মোটকথা, আমাদের শব্দসম্ভার যে ইংরেজি বা পশ্চিমী শব্দসম্ভাবের তুলনায় অনেক বেশি যথাযথ এবং ব্যাপক, সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। এর কারণ আমাদের বাক্য নির্মাণের কৃৎকৌশল  বিস্তার, স্বল্প উপকরণে অধিক কার্যসিদ্ধির ক্ষমতা, উদ্ভাবনী সৃজনশীলতা, স্বচ্ছতা এবং অন্তর্নিহিত প্রজ্ঞাদৃষ্টি। এইসব ক’টি গুণের মূলে আছে আমাদের ভাষায় শব্দগঠন ও শব্দ-ব্যবহারে ক্রিয়াভিত্তিকতার নীতি। এই নীতি পালনের মধ্যে কোনো জটিলতা নেই। ধাতুর সংখ্যা ইংরেজি াবৎন-এর সংখ্যার তুলনায় অনেক অনেক কম। কিন্তু প্রয়োজন মতো ধাতুর শেষে আসে প্রত্যয় আর বিভক্তি এবং আগে বসে যায় উপসর্গ। সেই প্রত্যয়-বিভক্তি-উপসর্গের সংখ্যাই বা কত ? সব মিলিয়ে দাঁড়ার প্রায় ৩২০টি মূল ধাতু, তার ৭ বিভক্তি, ৩ বচন, প্রায় ২০০ প্রত্যয় ও ২০টি উপসর্গ। লিঙ্গ সন্ধি সমাসের কথা বাদ দিয়ে দিলেও কত শব্দের প্রজনন-ক্ষমতা ধরে আমাদের এই ভাষা ? ৩২০ গুণ ৭ গুণ ৩ গুণ ৩০০ গুণ ২০ = ২৬৮৮০০০০। এত বেশি অবশ্য হয় না, কারণ প্রত্যয়-উপসর্গ সর্বত্র ব্যবহৃত হয় না। সংখ্যাটিই তাই খানিকটা কমে যায়। তা সত্ত্বেও তা ইংরেজির তুলনায় বহু গুণ বেশি। অর্থাৎ আমাদের ভাষায় দৃশ্যত এই স্বল্প উপকরণের সাহায্যে, নানারকম সংযোজনের জোরে, অর্থের এক বিশাল এলাকায় আমাদের দখল কায়েম হয়ে যেত। ভাষার এই নীতি চালু রাখার জন্য প্রয়োজন হত পরিলক্ষিত জগতের যাবতীয় ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার চরিত্র বিচার  যার ফলে বহু অসদৃশ প্রাণী বা বস্তুর মধ্যে ক্রিয়াগত সমধর্মিতা সহজেই চোখে এসে যেত। ফলে বিশাল এলাকার যাবতীয় ক্রিয়ার যথাযথ বর্ণনা দেওয়া যেত। ভাষার উদ্ভাবনী সৃজনশীলতা অব্যাহত থাকত। এবং অবশ্যই শব্দসম্ভারের স্বচ্ছতা মানুষকে দিতে পারত ভাব ও চিন্তার জগতে বিরাট মুক্তি।
এই বক্তব্যের সমর্থনে কৃ (= র্ক = করা) ধাতু থেকে তৈরি বাংলায় নিত্যব্যবহার্য কিছু শব্দ তুলে ধরছি ঃ আবিষ্কার, পুরস্কার, তিরস্কার, বহিষ্কার, পরিষ্কার, সংস্কার, আকার, প্রকার, বিকার, উপকার, অপকার. অধিকার, সৎকার, চমৎকার, ধিক্কার, ন্যক্কার, অহঙ্কার, অলঙ্কার, স্বীকার, অঙ্গীকার, চিৎকার ফুৎকার ইত্যাদি। আকৃতি, বিকৃতি, প্রকৃতি কিংবা কর্তব্য, করণীয়, কৃতার্থ ... এসব এখন থাক। তালিকাটি আরও অনেক বড় করা যায় স্বচ্ছন্দেই। তবে লক্ষণীয় এই যে শব্দগুলি এদের ইংরেজি প্রতিশব্দসমূহের তুলনায় কত বেশি সুসংবদ্ধ, স্বচ্ছ, সহজবোধ্য, এবং সহজে ব্যবহারযোগ্য; অথচ শব্দগুলি একই ক্রিয়াজাত বলে তাদের পৃথক শব্দ হিসেবে ধরা হয় না, যদিও একেবারে পৃথক ভাব বা বস্তুকে তারা শনাক্ত করে। বিপরীতে ইংরেজি প্রতিশব্দগুলি পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কহীন, এবং সেকারণেই গুনতিতে সংখ্যায় বেশি। বলে রাখা যাক, -কার-এর যে শব্দখণ্ডটি জোড়া আছে, তারা ভাষার নানান ক্ষেত্রে এত ব্যবহৃত হয় যে, বাংলাভাষী সহজেই শব্দটির অর্থ অনুমান করে নিতে পারেন। পরিশেষে আপনাদের মনে করাই যে, শেষকালের -কার-এর বদলে -কর, -র্ক, -কারণ, -কারক, -কৃত, -কৃতি ইত্যাদি যোগ করে আরও কত কত নিত্যপ্রয়োজনীয় শব্দ বাংলায় ব্যবহার হয়, তার হিসাব করে নিন। এর পরেও বাংলা শব্দের সংখ্যা কম কেন ? দশগুচ্ছ আঙুরকে দশটি ফল বলে ধরলে এবং তার সঙ্গে একশোটি কুলকে তুলনা করলে আঙুরের সংখ্যা কম তো হবেই। তাই ইংরেজির তুলনায় বাংলা শব্দের সংখ্যা কম।
এখন স্বল্প কয়েকটি ধাতু দিয়ে দেখাতে চেষ্টা করব কত কম উপকরণের সাহায্যে কত বেশি ভাব আমাদের ভাষায় প্রকাশ করা হয়। ধরা যাক, কোনো একটি সম্মেলনের ব্যবস্থা হচ্ছে। প্রস্তুতিপর্বে এমন বাক্য যে কেউ লিখতে পারেন ঃ
প্রায় এক যুগ পরে যে সম্মেলনের উদ্যোগ (= উৎ + যোগ) নেওয়া হয়েছে, সেখানে কত লোক যোগ দিচ্ছেন, কত আয়োজন করতে হবে, এবং যোগ্যতা অনুযায়ী কত লোককে কাজে নিযুক্ত করার প্রয়োজন হবে, সে বিষয়ে এখন যুক্তি পরামর্শ হচ্ছে, এবং নানারকম যোগাযোগ চলছে।
লক্ষ্য করুন, মাঝারি দৈর্ঘ্যরে এই বাক্যে যুজ্ ধাতু থেকে তৈরি শব্দ কতবার ব্যবহৃত হয়েছে; বাক্যটির ইংরেজি অনুবাদ করে দেখুন, দেখবেন পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কহীন ক’টি ইংরেজি হড়ঁহ বা াবৎন ৎড়ড়ঃ-এর সাহায্য নিতে হয়, সেটিও একবার মিলিয়ে দেখুন। যে কোনো রকমের যোগ ঘটলে, জুড়ে (= যুড়ে) দেওয়া, যুতে দেওয়া, বা যুক্ত হওয়ার অথবা যুক্ত করার ব্যাপার হলেই  তা সে জড়বস্তু-প্রাণী বা কোনোরকমের ভাব, যাই হোক না কেন  যুজ্ ধাতুটির ব্যবহার সম্ভব। অর্থাৎ যদি বিভিন্ন কাজের মধ্যে কোনো মূলগত ঐক্য থাকে, তবে একটি ধাতু দিয়েই অনেক বিভিন্ন কাজকে বোঝানো যাবে। সেই ঐক্যটি বুঝে নিয়ে ধাতু এবং ক্রিয়াপদের সৃষ্টি এবং ব্যবহারেই বাংলা (বা সংস্কৃত) ভাষার কৃতিত্ব। ধরা যাক মন ধাতুটি (= মনে করা)। এই ধাতু থেকে নিষ্পন্ন শব্দগুলি কত ভিন্ন কাজকে সূচিত করে, কিন্তু একটি মূলগত ঐক্যের জোরে উপসর্গটির সাহায্যে স্পষ্ট অর্থের সৃষ্টি হয় প্রতিটি ক্ষেত্রে ঃ প্রমাণ (= ঢ়ৎড়ড়ভ), অনুমান (= মঁবংং, রহভবৎ), সম্মান (= যড়হড়ঁৎ), উপমান (= ংরসরষব? ), অভিমান (?), অপমান (?), বিমান (= বিশেষ মান, যেটা উঁচুতে অধিষ্ঠানেই সম্ভব)। দিশানির্দেশ বা দিশ্ ধাতু থেকেও কি শৃঙ্খলার সঙ্গে তৈরি হচ্ছে এই সব শব্দ ঃ দেশ, প্রদেশ, উদ্দেশ, নির্দেশ, আদেশ, সন্দেশ (= হবংি), উপদেশ।
তাৎপর্যময় নতুন শব্দসৃষ্টিতে উপসর্গ (ঢ়ৎবভরী) এবং প্রত্যয় (ংঁভভরী)-এর ভূমিকা কম নয়। শুধু উৎ (= উপরের অভিমুখে) উপসর্গের সাহায্যে তৈরি শব্দাবলীর কিছু নমুনা দিচ্ছি ঃ উদাহারণ (= উৎ + আহরণ), উদ্দেশ্য, উত্থাপন (= উৎ + স্থাপন), উদয় (= উৎ + অয় = উপরে আসা), উদ্যোগ (= উৎ + যোগ), উদ্যম (= উৎ + যম), উত্তেজনা, উৎপাত, উচ্ছ্বাস (= উৎ + শ্বাস), উৎসর্গ (= উৎ + সর্গ), উল্লেখ, উদ্ভিদ (= যা উপরের দিকে ভেদ করে ওঠে), উৎপত্তি, ইত্যাদি। প্রত্যয়ের উপযোগিতা দেখানোর জন্য মাত্র দু’টি প্রত্যয়ের ব্যবহার থেকে কিছু উদাহরণ উল্লেখ করছি। যার সাহায্যে কোনো ক্রিয়া নিষ্পন্ন হয়, সেই বস্তু বা সত্তাটি চিহ্নিত হয় ধাতুর সঙ্গে ‘ত্র’ প্রত্যয় ব্যবহার করে; যথা মন্ত্র (মন্ + ত্র), যন্ত্র (নিয়ন্ত্রণ বা নিয়ম বা যম্ + ত্র), পাত্র (পান / পালন = পা + ত্র), শাস্ত্র (শাস্ + ত্র), রাষ্ট্র (রাজ্ +ত্র), নেত্র (নী + ত্র বা কাছে নিয়ে আসা)। আবার, শব্দের শেষে -র এর অবস্থান থেকে বুঝি কোনো গুণের উপস্থিতি ঘটেছে. যথা ভঙ্গুর, স্থবির, স্থির, ছিদ্র (যেখানে ছেদনকার্য সম্ভব), বিদুর (জ্ঞানী, বিদ্), মেদুর, কম্প্র, নম্র (নম্ = নত হওয়া), ধীর, ইত্যাদি।
বাংলাভাষার মূলে সংস্কৃত ভাষার যে ঐশ্বর্য রয়েছে যাঁরা খোঁজখবর রাখেন তাঁদের পক্ষে এত উদাহরণ অপ্রয়োজনীয় সন্দেহ নাই। কিন্তু যাঁরা তা আদৌ জানেন না, তাঁদের কথা ভেবেই এই উদাহরণ কয়টি দিতে হল। কারণ আমি নিজেকে দিয়েই বুঝি। আমরা এ-যুগের লেখাপড়ায় শিক্ষিত বাঙালিরা ইংরেজি ভাষার ছটায় মুগ্ধ, এবং আমাদের অভ্যাস হল আমাদের ভাষাকে ইংরেজির তুলনায় শক্তিহীন মনে করা। মানসিক চর্চার বেলায় আমরা দাঁড়ানোর মতো শক্ত জায়গা খুঁজি ইংরেজির ভাবনার জগতে। আর ওদের নানান ঃবৎস বা প্রত্যয়বাহী শব্দের প্রতিশব্দ খুঁজতে আসি বাংলায়। তারপর ওদের শব্দের  ধঢ়ঢ়বধৎধহপব, ৎবধষরঃু, সধঃঃবৎ, হধঃঁৎব, ংঁনংঃধহপব, ফরধষবপঃরপং, পধঢ়রঃধষ, বঢ়রপ, ফরংপড়ঁৎংব প্রভৃতির  যথাযথ প্রতিশব্দ আমাদের ভাষায় খুঁজে না পেয়ে ভাবতে থাকি আমাদের ভাষাতেই আছে খামতি। এ সম্ভাবনাটা খতিয়ে দেখি না যে, ওদের ভাষা এবং আমাদের ভাষা, দুই ভাষাতে ছক সাজানোর পদ্ধতি (= ফরংপড়ঁৎংব) তো আলাদা হতে পারে। আমরা ভুলে যাই ইংরেজির তথাকথিত বিশাল শব্দভাণ্ডার (যথা, হঠাৎ-মনে-আসা কিছু নমুনা উদাহরণ ঢবৎড়ী, ঝধহফরিপয, ঈধৎফরমধহ, ইঁহশঁস, ঔঁমমবৎহধঁঃ, ঝঢ়বধশবৎ, ইড়ষড়হবু, গড়ষষুপড়ফফষব, গরংযসধংয, ঐঁহশু-ফড়ৎু, ঝপৎরননষব, ঝঃধমমবৎ ইত্যাদি) গড়ে উঠেছে একটা বিশেষ নীতিতে  তা হল, ভাবগত বনিয়াদকে গুরুত্ব না দিয়ে তাৎক্ষণিক সুবিধার ভিত্তিতে প্রায় নির্বিচারে শব্দ তৈরি ও শব্দ আমদানি। ইংরেজিতে গড়ে উঠেছে স্বয়ংভর, অসংলগ্ন, ও অসম্পৃক্ত শব্দের বিপুল সমাবেশ।৯ তার ওপর দুই শতাব্দীর বেশি কাল ধরে বিশ্ব রাজনীতিতে ইঙ্গ-মার্কিন দাপটের ছায়ায় ইংরেজি ভাষার অবিরাম ঢক্কানিনাদ এবং বাণিজ্য, উপনিবেশ ও সাম্রাজ্যের সুবাদে ইংরেজির ক্রমান্বয় প্রসার, সব মিলিয়ে সৃষ্টি হয়েছে ইংরেজি ভাষার অবিসংবাদিত শ্রেষ্ঠত্বের কিংবদন্তী। নিজস্ব সৃজনশীলতার গুণে রবীন্দ্রনাথ (এবং তাঁর আগে মাইকেল ও বঙ্কিম) অবশ্যই বুঝেছিলেন সংস্কৃতপুষ্ট বাংলার শক্তি। কিন্তু এই শক্তির কোনো সহজ যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা তাঁরা দিয়ে যেতে পারেননি ; সময় তার পক্ষে অনুকূল ছিল না বলে। রবীন্দ্রনাথ যে ভাল করেই উপলব্ধি করেছিলেন সংস্কৃত ভাষা থেকে আসা উপাদানের অসীম গুরুত্ব, তার অকাট্য প্রমাণ হল এই যে হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ গ্রন্থটির সৃষ্টির মূলে আছে রবীন্দ্রনাথের অকৃপণ প্রেরণা।
এই প্রসঙ্গে এ কথাও মানতে হবে যে  বঙ্গভূমিতে বাংলাকে বিদ্যাচর্চার বাহন করাতে রবীন্দ্রনাথের যে বিপুল সমর্থন ছিল তার মূলে আছে দেশের সকল মানুষকে নিয়ে মুক্তির সাধনা এবং আধুনিক বিদ্যাচর্চার আঙ্গিনায় দাঁড়ানোর ঐকান্তিক আগ্রহ। সেখানে বাংলাভাষার শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে কোনো তত্ত্বঘোষণা ছিল না। তা যদি থাকত, তাহলে ইংরেজির তুলনায় বাংলার শব্দভাণ্ডারের দৈন্যের কল্পনা করে তা নিয়ে খেদ করতেন না ভাষাচার্য সুনীতিকুমার তাঁর পরিণত বয়সের সৃষ্টি ‘ভাষাপ্রকাশ বাঙ্গালা ব্যাকরণ’ গ্রন্থে।১০ এ বিষয়ে একেবারে কঠিন সত্য এই যে, বাংলা তথা সংস্কৃতের শব্দভাণ্ডারের ক্রিয়াভিত্তিক উৎপত্তিকে যথোচিত গুরুত্ব না দিলে বাংলা এবং সংস্কৃতের বিপুল কার্যকারিতাকে কিছুতে উপলব্ধি করা যায় না। উল্টো পক্ষে সেই পদ্ধতি নিয়ে এগোলে  যে-কাজ পশ্চিমবঙ্গের অ্যাকাডেমির চোখে ঃধনড়ড় লেখক কলিম খান গত দুই দশক ধরে করেছেন, করছেন  বহু যুগ ধরে আগলে রাখা ‘যকের ধন’ যেন চলে আসে আমাদের সকলের হাতের মুঠোয়।
আরও কিছু কথা আপনাদের মনে করিয়ে দিয়ে ভাবের বাহন হিসেবে আমাদের ‘ক্রিয়াভিত্তিক বাংলাভাষা’র অসামান্যতার প্রসঙ্গে ইতি টানব। বিশ্বসংসারের চলমানতা বা পরিবর্তনশীলতার তত্ত্ব আমাদের ভাষার ছত্রে ছত্রে পরিস্ফুট। জগৎ, সংসার, চরাচর  এই শব্দ তিনটির মধ্যে গতির দ্যোতনা মাঝারি শিক্ষিত বাঙালিও অনুভব করেন। এর পাশে ড়িৎষফ, ঁহরাবৎংব, পড়ংসড়ং ইত্যাদি শব্দে এমন কিছু ভাব খুঁজে পাওয়া যায় না। এই চলমান বিশ্বে যে কোনো রকমের অস্তিত্বের মধ্যে আবর্তন যে আছে, তার স্বীকৃতি রয়েছে আবর্তন, পরিবর্তন, বর্তমান, বৃত্তি, বার্তা (= য ঘটছে তার খবর) প্রভৃতি শব্দে, এমনকি বেঁচে-বর্তে থাকার মতো গ্রাম্য শব্দমেল-এর মধ্যেও। ইংরেজি লেখক ঞরসব, ঃযব জবভৎবংযরহম জরাবৎ নামে বই লিখলে, ফরাসি পরিচালক ঞযব জরাবৎ নামে ছবি তুললে আমরা তার মধ্যে মনীষার প্রকাশ দেখি, কিন্তু আমাদের ভাষায় এইরকম ধারার কল্পনা ও মাহাত্ম্য বর্ণনা তো চারিদিকে ছড়ানো। জগৎসংসার, চরাচর ছেড়ে একবার গঙ্গার কথাটিই ভাবুন না কেন। শ্রেষ্ঠ ধারা গঙ্গা (গম্ + গ + আ = নিত্যগমনশীলতা) এবং তার নানা রকমের মাহাত্ম্য বর্ণনার মধ্যে তার পরিচয় পাই।১১ ওদের দেশের ভাষায়, ঈশ্বরপুত্র (ঝড়হ ড়ভ এড়ফ) মানবকায়া পরিগ্রহণ (রহপধৎহধঃরড়হ) করেন। আমাদের ভাষায় ঈশ্বর অবতীর্ণ হন ধরার মধ্যে বা ধরায় অবতরণ করেন, তাই আমরা পাই ঈশ্বরের অবতার। নানা ক্ষেত্রেই আমরা উত্তরণের কথা ভাবি  পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হই, রসোত্তীর্ণ সাহিত্যের কথা ভাবি। বিদ্যার তীর্থে সতীর্থ পাই, সম্পদের বিতরণকে মর্যাদা দিই। সচরাচর আমরা কাজকর্মের যে চৌহদ্দির মধ্যে বিচরণ করি, সেটি হল আচার। সেই রীতিনীতির সীমা লঙ্ঘন করা বা অতিক্রম করা হল অত্যাচার। একটু জানা থাকলে, আর একটু ভাবলে পরই আমাদের ভাষা প্রাণময় হয়ে ওঠে। কোনো কিছু হওয়া বা হওনের জন্য আছে ভূ ধাতু, যার থেকে নিষ্পন্ন হচ্ছে ভব, ভাব, ভাবনা, সম্ভাবনা, ভূমি, ভূত, ভূতি, বিভূতি ইত্যাদি। যেটা মনের মধ্যে আসছে সেটাকে ভাব বলা যায়, আর হওয়ার প্রত্যাশা সত্ত্বেও কিছু না-হওয়াটা হল অভাব। যেখানে কিছু হচ্ছে সেটি ভূমি (ভূ + মি); সুতরাং কোনো কথা বলার প্রস্তুতি হল ভূমিকা। আবার দেখুন হৃদ্ (হৃ + দ) শব্দটি কত যথাযথ; হৃদ হল সে, যে হরণ (হৃ) করে, এবং দান (দা  দ) করে। সেভাবে শব্দটি যবধৎঃ এবং পবহঃৎব দুইকেই বোঝায় ; আর ইংরেজিতে যবধৎঃ যদি পবহঃৎব-কে বোঝায় তবে তা কেবল তুলনা হিসেবে। কিন্তু আমাদের ভাষা বোঝায় সরাসরি, একেবারে তার কার্যকারিতার উল্লেখ করে। মোট কথা আমাদের ভাষার ভাবপ্রকাশের ক্ষমতার যে উদাহরণ দেওয়া যায়, তার যেন সীমা নেই।
আমাদের ভাষার ভিতর প্রজ্ঞাদৃষ্টি যে কতটা সক্রিয় তার আরও কিছু দৃষ্টান্ত দিচ্ছি। আমাদের ভাষায় ক্ষমতা-র সঙ্গে ক্ষমা-র, শ্বাস-এর সঙ্গে বিশ্বাস-এর, স্বচ্ছ-র (অর্থাৎ ঃৎধহংঢ়ধৎবহঃ-এর) সঙ্গে ‘আচ্ছা’-র, আকাশ-এর সঙ্গে প্রকাশ প্রভৃতির শব্দগত নৈকট্য বিস্ময়কর। ক্ষমতা না থাকলে ক্ষমার অর্থ হয় না। বিশ্বাসের অভাবে শ্বাসগ্রহণ অর্থাৎ প্রাণধারণ হয় না, স্বচ্ছতার অভাবে সন্তোষ (‘আচ্ছা’ বলে যা আমরা প্রকাশ করি) আসে না, আকাশ না পেলে কোনো কিছুর প্রকাশ হয় না  এ সবই যেন জানা। এই শব্দগুলির ইংরেজি প্রতিশব্দগুলি যদি মিলিয়ে দেখেন, দেখবেন সেখানে কোনো রকমের সংলগ্নতাই খুঁজে পাবেন না। আমাদের বাসি শব্দটি দেখিয়ে দেয়, এক বাসস্থানে ‘বাসি’ হয়ে গেলে বা আটকে গেলেই চলিষ্ণু মানুষ তার টাটকা, সতেজ ভাব হারিয়ে ফেলে। আবার কোনো কিছুকে রেখে দেওয়া বা রক্ষণ করা মানেই তার শক্তিকে নষ্ট করে দেওয়া। অত্যন্ত সঙ্গত কারণেই রক্ষা আর রাক্ষস শব্দের ধ্বনিগত নৈকট্য।
আমাদের ভাষা থেকে এত উদাহরণ দেওয়ার আর একটি কারণ আছে। দেশের ভাষাকে উপেক্ষা করেও স্বাদেশিকতার কল্পনা বা চেষ্টা সম্ভব। ইংরেজির মধ্যে দিয়েই ভারতকে বুঝে নেবো, এমন চিন্তা অনেক ভারতীয়ের মনেই উঁকি মারে। তাঁদের মনে হয় এ-কাজটি করতে পারলে এক ঢিলে দু’-পাখি মারা যাবে; ভারত আয়ত্তে থাকবে, আবার দুনিয়াদারিও চলতে থাকবে। তাঁরা ভাবেন, প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য  বেদ, উপনিষদ, রামায়ণ, মহাভারত ইত্যাদি সব দরকারি বইয়ের ইংরেজি অনুবাদ তো হয়েই গেছে। অতএব ইংরেজির মধ্যে দিয়ে ভারতকে বুঝতে অসুবিধে হবে কেন ? এ-রকম চিন্তা বিরাট সংখ্যক পদস্থ মানুষের মাথায় নিশ্চয় খেলে। না হলে রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ-নিবেদিতা বা অরবিন্দের নামে এত ইংলিশ-মিডিয়াম স্কুল গজিয়ে ওঠে কেন ? যাঁদের অবশ্য কোনো ভারতীয় ভাষাই জানা নেই তাঁদের পক্ষে ইংরেজি অনুবাদে পড়ে নেওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। কিন্তু ভাবপ্রকাশের আকাশটাই বদলে দিলে অনুবাদের মধ্যে দিয়ে কতটুকু বোঝা যাবে ? এমনিতেই অনুষঙ্গগত কারণে ভাষান্তর ঘটলে শব্দের সূক্ষ্ম ব্যঞ্জনা হারিয়ে যায়। ঊঃরয়ঁবঃঃব বা রাজনীতি সংক্রান্ত বহু বিশেষ শব্দ এই কারণেই ফরাসি থেকে টেনে আনতে হয় ঃ যথা, ৎধরংড়হ ফ’বঃৎব, ধাধহঃ-মধৎফব, পড়ঁঢ় ফ’বঃধঃ, ঢ়ৎড়ঃড়পড়ষ, বহপড়ৎব, ারাধ াড়পব, ষধরংংবু-ভধরৎব, নড়ঁৎমবড়রং ইত্যাদি। তার ওপর ক্রিয়াভিত্তিক হওয়ার কারণে বাংলা বা সংস্কৃত শব্দের পশ্চিমী ভাষায় অনুবাদ বিশেষ কঠিন। অর্থ, ধর্ম, পদ, অধিকার, ক্ষেত্র, ভাব, যোগ, যোগী, সম্পদ, বিষয়, বিষয়ী, সমাধি, পক্ষ, পুরুষ, প্রকৃদি ... প্রভৃতি শব্দের এক এক রকম তাৎপর্য। সে-কারণে অনুবাদ করতে গেলে পদে পদে ভ্রান্তির সম্ভাবনা। এবং সেই ভুল হয়েছেও অতি বিশাল মাত্রায়।
সন্দেহ নেই, বাংলাভাষা সংস্কৃতভাষা থেকে অনেক ব্যাপারে সরে এসেছে। বলতে কি, সংস্কৃতভাষা তার প্রাণসম্পদ হারিয়ে ফেলেছে হিন্দুযুগের সূত্রপাতের (৭৫০ খ্রীষ্টাব্দের) আগেই, কিন্তু মধ্যযুগের (১২০০ খ্রীষ্টাব্দ পরবর্তী) বাংলায় তা নবজীবন লাভ করে কৃত্তিবাস-কাশীরাম-বৈষ্ণবসাহিত্য-মঙ্গলকাব্যের হাত ধরে। তাই, বাংলার মধ্যে অনেক কিছু আছে যা ধরে প্রাচীন সংস্কৃত ভাষার অর্থের জগতে সহজেই প্রবেশ করা যায়, এবং যেগুলি এখনও বাংলাভাষায় ফল ধরানোর ক্ষমতা রাখে। এ-অবস্থায় ইংরেজি ভাষা সম্বল করে আমাদের দেশকে বুঝে নেবো  এই ইংলিশ-মিডিয়ামী হিন্দুত্বের আত্মাভিমান কোনো কাজের কথা নয়। যাঁর বাংলা ভাষায় পা রাখার ক্ষমতা আছে তাঁর পক্ষে এটা নেহাৎই আত্মঘাতী পরিকল্পনা।
বাংলা ভাষার দৈন্য সম্বন্ধে আমাদের ইত্যাকার কল্পনা কতটা অসার তা দেখানোর জন্য আর একটি প্রসঙ্গ আনছি। আমাদের ভাষার মূল থেকে আমরা যত বিচ্ছিন্ন হই, তত আমাদের প্রবণতা বাড়ে ইংরেজির মাপে বাংলা শব্দের অর্থকে ছেঁটে নেওয়ার। আর, তারপর ভাবতে থাকি যে, আমাদের বাংলাভাষা শব্দসম্ভারের সংখ্যার দিক থেকে দীন। কিছু উদাহরণ দিচ্ছি। আমরা ফরংপড়াবৎ-এর বাংলা করলাম আবিষ্কার, কিন্তু রহাবহঃ-এর বেলায় অতি যথাযথ এবং আরো ব্যাপক শব্দ উদ্ভাবন আমাদের মনে পড়ল না। ফলে রহাবহঃ-এরও বাংলা করলাম আকিষ্কার, আর মনে মনে বাংলাভাষার খুঁত ধরলাম। ‘দৈব বনাম পুরুষকার’ (যে-পুরুষকার স্ত্রীলোকেরও থাকে)  এই শব্দসমষ্টি আমাদের মনেই এল না। আর, অর্থ বললে লক্ষ্য, অভীষ্ট প্রভৃতি বুঝায় তাও মনে করলাম না। ফলে ংবহংব ড়ভ াধষঁবং-এর বাংলা করলাম ‘মূল্যবোধ’; অথচ এর থেকে অনেক ভাল প্রতিশব্দ হত পুরুষার্থ বিচার। ব্যুৎপত্তি (সূ = ত্র) থেকে তো বটেই, এমনকি প্রয়োগ থেকেও বোঝা যায় ভড়ৎসঁষধ-র চেয়ে সূত্র অনেক ব্যাপক শব্দ। ঝবপঁষধৎ-এর চেয়ে ‘ঐহিকতাবাদী’ বেশি সঠিক শব্দ, কিন্তু আমরা চালু করে দিয়েছি পঙ্গু ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দটি। গবফরঁস ড়ভ রহংঃৎঁপঃরড়হ-এর বাংলা করি ‘শিক্ষার মাধ্যম’, কিন্তু ‘শিক্ষার বাহন’ হত অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ, এবং রবীন্দ্রনাথ এই শব্দটিই ব্যবহার করতেন। মনে পড়ছে, এক বাংলার অধ্যাপক দুঃখ করছিলেন  বাংলায় শব্দের বড় অভাব;  যধহফংড়সব, ঢ়ৎবঃঃু, নবধঁঃরভঁষ, হরপব সকলেরই প্রতিশব্দ দিতে হয় ‘সুন্দর’। তাঁর মনে পড়ে না সুষমামণ্ডিত, লাবণ্যময়, নয়নাভিরাম, মনোমোহন, মনোমুগ্ধকর, চিত্তরঞ্জন, কান্ত, সুশোভন, দীপ্ত, শ্রীযুক্ত, শ্রীল, শ্লীল, রুচির ইত্যাদি এ-রকম অগনতি শব্দের কথা, যেগুলোর প্রতিশব্দ ইংরেজিতেই পাওয়া কঠিন। ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ যতটা আয়াসসাধ্য, বাংলা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ তার চেয়ে অনেক বেশি কঠিন।
ইংরেজি তথা পশ্চিম দেশের ভাষার তুলনামূলক খামতির কথা বলছিলাম। এ-কথা কিন্তু বলিনি যে ওদের সাহিত্য দীনতাগ্রস্ত। বরং বহু শতাব্দী ধরে যে-সৃষ্টিশীলতার প্রকাশ হয়ে চলেছে ওদের সাহিত্যে, তার তুলনা অন্যত্র দেখতে পাই না। ৮০০ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ১৯০০ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত ইউরোপের যে সাহিত্য তার তুলনা সমকালীন বিশ্বসাহিত্যে বিরল। মধ্যযুগের বাংলাসাহিত্যের হয়তো কিছুটা তুলনা চলে তার সঙ্গে। মনুষ্যজীবনে সার্থকতা কোথায় তার অন্বেষণে নিরলসভাবে তৎপর গ্রীক ট্র্যাজেডি, দান্তের কাব্য, শেক্সপীয়ারের নাটক প্রভৃতি। দীর্ঘকাল ধরে যে খণ্ডবাদী ভাবনা  সবকিছুকে আলাদা করে দেখার অভ্যাস  মানুষের চেতনাকে আকার দিয়ে আসছে পৃথিবীর সব দেশে, তাকে অনেকবার ছাড়িয়ে উঠেছেন ওদের দেশের কবি, শিল্পী প্রভৃতি। ইংরেজ কবি ব্লেক (১৭৫৭-১৮২৭) পারতেন, অন্তত কল্পনায়, ‘ঃড় ংবব ঃযব ঁহরাবৎংব রহ ধ মৎধরহ ড়ভ ংধহফ’। কোলরিজ বলতে পেরেছিলেন, ‘ডব ৎবপবরাব নঁঃ যিধঃ বি মরাব / অহফ রহ ড়ঁৎ ষরভব ধষড়হব ফড়বং ঘধঃঁৎব ষরাব.’।১২ ওয়ার্ডসওয়ার্থ নিজের অভিজ্ঞতায় জেনেছিলেন  এবং পরে তা কবিতায় প্রকাশ করতে পেরেছিলেন  ভাবের অতলে তলিয়ে গিয়ে ভাবসমাধিতে পৌঁছে যাওয়ার কথা। আধুনিক জীবনের রিক্ততা যেমন তিনি দেখেছিলেন, তেমনি তাঁর কবিদৃষ্টিতে দেখেছিলেন চরাচরকে উদ্ভাসিত করে আছে ‘ঃযব ষরমযঃ ঃযধঃ হবাবৎ ধিং, ড়হ ংবধ ড়ৎ ষধহফ’।১৩ শেক্সপীয়ার বলতে পেরেছিলেন, ‘ডব ধৎব ংঁপয ংঃঁভভ / অং ফৎবধসং ধৎব সধফব ড়হ ধহফ ড়ঁৎ ষরঃঃষব ষরভব / ওং ৎড়ঁহফবফ রিঃয ধ ংষববঢ়’।১৪ পাশ্চাত্যের কবিদের গৌরব এই যে, তাঁরা ত্র“টিপূর্ণ ভাষা দিয়েই উচ্চমানের সত্য প্রকাশ করে গিয়েছেন। আর আমাদের দেশের বেলায় কি হয়েছে ? ৭৫০ খ্রীষ্টাব্দের আগে যা সৃষ্টি হয়েছিল সেগুলি অর্থবিস্মৃতির কারণে আজ মৃত, এমনকি মধ্যযুগে বাংলায় যে-বিপুল সৃষ্টির বান ডেকেছিল, তাও অর্থ হারিয়ে মৃতপ্রায় হয়ে রয়েছে। অথচ আমাদের ভারতীয় পূর্বপুরুষদের হাতে অতি সমৃদ্ধ ভাষা তৈরি হয়ে গিয়েছিল খ্রীষ্টজন্মের আগেই। সে পর্যায়ের সৃষ্টিগুলিকে  যথা বেদ, উপনিষদ, রামায়ণ. মহাভারত ইত্যাদিকে আমরা এখন আর ঠিক বুঝে উঠতে পারি না, এমনকি বুঝতে পারছি না মধ্যযুগের বাংলা সৃষ্টিগুলিকেও। ইতিহাসের মারে সেই সমৃদ্ধ ভাষার যথেষ্ট ব্যবহার হয়ে উঠল না আমাদের দেশে। এই ভাষার শক্ত বনিয়াদের মূল কথাটা (সর্বস্তরে ক্রিয়াভিত্তিক শব্দগঠন) যেন ভুলেই গেল দেশের মানুষ। না হলে আল্ বিরুনির অভিযোগ সম্ভব হল কি করে ?
আর একটি কথাও এখানে প্রাসঙ্গিক। বিশ্বভাষা আবির্ভাবের পথে ইংরেজি ভাষার সম্ভাব্য ভূমিকা কি হতে পারে তা নিয়ে কোনো বক্তব্য রাখছি না। কোনো ভাষার বিস্তার নির্ভর করে সেই ভাষা যারা ব্যবহার করে তাদের প্রতিপত্তির ওপর। ব্যবহারকারীর সংখ্যা হিসেবে ১৬০০ সালেও ফরাসি, জার্মান, স্প্যানিশ  প্রতিটি ভাষা ছিল ইংরেজির চেয়ে এগিয়ে। অথচ ১৯০০ সালে এদের মধ্যে ইংরেজি চলে এল এক নম্বরে। প্রতিপত্তির সূত্রেই ইংরেজি আজ বিশ্বভাষা-মঞ্চে প্রথম আসনে, সেই একই সূত্রে কোনোদিন তা নেমেও যেতে পারে। এখন তা নিয়ে অনুমানভিক্তিক আলোচনা নিরর্থক।
কিন্তু চিন্তার বাহন হিসেবে ভাষার গুরুত্বের বিচার একটু অন্য রকমের। তাতে ভাষাটি কে ব্যবহার করছেন তার চেয়ে সেই ভাষার ভিতরে মানবজাতির অর্জন কতখানি রয়েছে সেই সত্যের বিচার হয়। প্রথম শতাব্দীতে ভূমধ্যসাগর অঞ্চলে গ্রীক ভাষা আর (রোমের ভাষা) ল্যাটিনের সমান গুরুত্ব যেন। সেই দুই ভাষার উত্তরাধিকারীদের বর্তমানের অবস্থান কোথায় ? ফ্রান্স, স্পেন, পর্তুগাল, ইতালি, রুমানিয়া, গোটা ল্যাটিন আমেরিকা  এ-সবই এখন ল্যাটিন-উদ্ভুত ভাষার এলাকা। আর গ্রীক-উদ্ভুত ভাষার এলাকা শুধু আজকের গ্রীস দেশ। তবু শিল্প, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির দুনিয়ায় পথনির্দেশ পেতে আজকের মানুষ ল্যাটিনের চেয়ে অনেক বেশি করে যায় গ্রীক ভাষায় ও সাহিত্যে।
এবার মূল আলোচনায় ফেরা যাক। ক্রিয়াভিত্তিক বাংলা ভাষার চলনসই জ্ঞানও যদি থাকে, ইংরেজি ভাষা তথা পশ্চিমী ভাষা ও সংস্কৃতির অনেক জটিলতার সমাধান আমাদের উদ্যোগেই হয়ে যায়। আপনাদের জানা থাকতে পারে, অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর সূচনায় সংস্কৃত ভাষার আবিষ্কার কী উদ্দীপনা এনেছিল ইউরোপের, বিশেষ করে জার্মানির পণ্ডিতদের জগতে। পশ্চিমের রাজনৈতিক স্বার্থ ও মজ্জাগত কুসংস্কার সেই আলোড়নকে নি®প্রভ করে দেওয়ার চেষ্টা কম করেনি। তবু ভাষাবিজ্ঞানের জগতে সকল পণ্ডিত প্রায় একবাক্যে স্বীকার করেন যে (১) ভারতের ভাষাবিজ্ঞানের কাছে প্রথম তালিম নিয়েই ঢ়যড়হবঃরপং বা ধ্বনিবিজ্ঞান নামের বিদ্যাটির পত্তন হয় ঊনবিংশ শতাব্দীতে ; (২) পাণিনির ব্যাকরণ হল মানববুদ্ধির মহত্তম সৃষ্টিগুলির অন্যতম ; (৩) ভারতীয় ব্যাকরণের কারক, সমাস প্রভৃতি তত্ত্বের কাছে এখনও অনেক কিছু শেখবার আছে। ক্রিয়ার দিক থেকে বিচার করায় ভারতীয় ব্যাকরণের কারকতত্ত্ব পশ্চিমী ব্যাকরণের (বিশেষ্যের আকার নির্ভর) পধংব-তত্ত্বের থেকে অনেক উঁচু মানের। সে রকম, সমাসের বিচারে ভারতীয় সূক্ষ্মতা আসলে উচ্চাঙ্গ চিন্তারই প্রস্তুতি।১৫
বলে রাখা ভালো, এই পণ্ডিতেরা এখনও পর্যন্ত আমাদের ক্রিয়াভিত্তিক শব্দগঠন পদ্ধতি ও ক্রিয়াভিত্তিক ভাষার খবর পর্যন্ত জানেন না, বা তাঁরা আমাদের যাস্কমুনির নাম শোনেননি, কিংবা তাঁর ‘নিরুক্ত’ গ্রন্থটির কথা জানেন না, এমন নয়। কিন্তু গ্রন্থটির অর্থই তাঁরা বুঝতে পারেননি, কিংবা বলা ভালো, একেবারেই ভুল বুঝেছেন। অথচ এই ‘নিরুক্ত’ই মানবজাতির শব্দার্থতত্ত্বের সবচেয়ে প্রাচীন গ্রন্থ। সেই শব্দার্থতত্ত্ব যখন তাঁরা বুঝতেই পারলেন না, তখন সেই শব্দার্থতত্ত্ব অনুসরণ করে লেখা বেদ-পুরাণ-রামায়ণ-মহাভারতের অর্থও বুঝতে পারলেন না তাঁরা, ফলে সমগ্র ইউরোপই তা বুঝতে পারল না। সবই তাঁদের কাছে মনে হল রূপকথার রাজ্য, গুঃযড়ষড়মু। আমাদের ভাষাতত্ত্বের মূল অর্জনটিই তাঁদের হাতে গেল না, ফলে গেল না আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠত্বের কথাও এবং সর্বোপরি তাঁদের সেই না-বোঝা দিয়েই তাঁরা শিক্ষিত বাঙালিদেরও কলুষিত করে দিলেন। আমরা নিজেদের আকাশ ছেড়ে তাঁদের মনোলোকের আকাশের তলায় গিয়ে আমাদের নিজেদের অতীত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম।
অথচ একেবারে বিপরীত ফলও ফলতে পারত। আমাদের ভাষার ক্রিয়াভিত্তিক তত্ত্ব যদি তাঁরা বুঝতে পারতেন, তাহলে তা দিয়ে তাঁর কেবল আমাদেরই বুঝতে পারতেন এমন নয় ; অনেক ভালোভাবে বুঝতে পারতেন তাঁদের নিজেদের বর্তমান ও অতীতটাকেও। কেননা, আজ আমরা দেখতে পাচ্ছি সেই ক্রিয়াভিত্তিকতার তত্ত্ব দিয়ে পশ্চিমের ভাষাচর্চা ও ইতিহাসের অনেক অসম্পূর্ণতার ওপর আলো ফেলা যায়।
ভাষার ক্ষেত্রে বুঝতে পারি যে, প্রকৃত প্রস্তাবে সমার্থক শব্দ কোনো ভাষায় থাকে না। তথাকথিত সমার্থক শব্দ চালু হয় একই সত্তার আধারে ভিন্ন ভিন্ন ক্রিয়া বোঝানোর জন্য। সচেতন মানুষের উদ্যোগে ‘সংস্কৃত’ হয়ে যাওয়ায় আমাদের দেশের ভাষায় সেই সব শব্দের উৎপত্তি উদ্ধার করা যায়, কিন্তু অন্য ভাষাগুলি সেই সব উৎপত্তি ভুলে গেছে। তথাকথিত সমার্থক শব্দগুলোর স্বাতন্ত্র্যকে তারা মনে রাখে প্রয়োগক্ষেত্রের অনুষঙ্গের জোরে। অশ্বের গতি বোঝাতে ইংরেজিতে চারটি স্বতন্ত্র শব্দ ব্যবহার করা হয়  ধসনষব, ঃৎড়ঃ, পধহঃবৎ, মধষষড়ঢ়। কিন্তু সেগুলোর একটি আরেকটির সমার্থক নয়। আমাদের ক্রিয়াভিত্তিক (বাংলা-সংস্কৃত) ভাষায় যে-সব সমার্থক তুল্য শব্দ পাই, সেগুলো স্পষ্টতই ভিন্ন ক্রিয়ার হিসাবে তৈরি। নেহাৎই নমুনা হিসেবে কয়েকটি শব্দগুচ্ছ তুলে ধরছি ঃ পৃথিবী, বসুমতী, ধরিত্রী ইত্যাদি ; সূর্য, রবি, তপন, দিবাকর, অর্ক প্রভৃতি; নারী, মানবী, স্ত্রী, কামিনী, ললনা ইত্যাদি ; অগ্নি, অনল, হুতাশন প্রভৃতি। এই শব্দগুলি ভাঙলে পরই বোঝা যায় কোথায় কোন্ ক্রিয়ার উল্লেখ হচ্ছে। আগেই বলেছি, আমাদের এই শব্দার্থতত্ত্ব এখনও বিশ্বের হাতে পৌঁছায়নি, পৌঁছায়নি পাণিনি-পূর্ববর্তী আদি শব্দার্থতাত্ত্বিক রচনা (নিরুক্ত)-টি। কারণ যাস্কমুনির নিরুক্ত এতদিন কেউই সঠিক ভাবে বুঝতে পারেননি। আমাদের এই শব্দার্থতত্ত্ব পশ্চিমী ভাষাগুলিকে তো বটেই, এমনকি তাদের অলঙ্কারশাস্ত্রের অনেক কিছুকে নতুন আলোয় উদ্ভাসিত করে দেওয়ার যোগ্যতা ধরে। গবঃধঢ়যড়ৎ, গবঃড়হুসু  দু’টি ক্ষেত্রেই দেখি কোনো বস্তু বা সত্তাকে তার প্রচলিত নাম থেকে সরিয়ে এনে অন্য বস্তুর বা সত্তার সঙ্গে জুড়ে দেখা হয়। পাঠক বা শ্রোতা এইরকম অলঙ্কারের ব্যবহারে কি-রকম আনন্দ বা তৃপ্তি পান ? প্রকৃতপক্ষে তা হল অনেকটা এইরকম ঃ গবঃধঢ়যড়ৎ-এর বেলায় বাইরের দিক থেকে দু’টি ভিন্ন রকমের বস্তু বা সত্তার ক্রিয়াগত সাদৃশ্য লক্ষ্য করা, আর গবঃড়হুসু-র বেলায় ক্রিয়া এবং ক্রিয়ার আধারের অভেদ আনার চেষ্টা। অর্থাৎ বস্তু বা সত্তার ভিতরের ক্রিয়াটির দিকে নজর তাঁদের পড়েছে, আর তার ব্যাখ্যা খুঁজছেন তাঁরা তাঁদের অলঙ্কারশাস্ত্রের সহায়তা নিয়ে। তবে কিনা, এ-চেষ্টা তো কার্যত উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত মানবজাতির আদি ক্রিয়াভিত্তিক শব্দকে প্রাণে মেরে দিয়ে তারপর তাকে জীবন্ত করে তোলার জন্য শবসাধনা  মড়ার হাত-পায়ে ¯িপ্রং লাগিয়ে তাকে সচল করে দেখানোর জাদুকরী চেষ্টা। সেই চেষ্টাকেই তাঁরা বড় গলায় ঘোষণা করেন  গবঃধঢ়যড়ৎ ড়ভ ঃযব ংড়ঁষ ড়ভ ঢ়ড়বঃৎু। দোষ তাঁদের নয়। দোষ তাঁদের উপর ইতিহাসের যে মার পড়েছে, তার। বরং তাঁদের গৌরব এই যে, আদি মানবজাতির ভাষায় ক্রিয়াভিত্তিক স্বভারে অধিকাংশ উত্তরাধিকার হারিয়েও তাঁরা নিজেদের একান্ত চেষ্টায় দেখে ফেলেছেন শব্দের ভিতরে প্রাণ ছিল এবং এখনও তার চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। তাই গবঃধঢ়যড়ৎ নিয়ে নানা চপল মন্তব্য করে বসেন। কেউ কেউ এমনও বলে বসেন যে, সব ভাষাই আসলে ‘সবঃধঢ়যড়ৎরপ’। আমাদের ক্রিয়াভিত্তিক ভাষার ‘লিঙ্গ’-কে যেদিন তাঁরা তাঁদের ‘ষরহমঁধ’-র সঙ্গে সমার্থক বুঝবেন, সেদিন তাঁদের গবঃধঢ়যড়ৎ-এর মরূদ্যানের সামনেই এক স্বর্গোদ্যানের নতুন দিগন্ত খুলে যাবে।
হ্যাঁ, ইংরেজি ভাষা অনেক বৈশিষ্ট্যকে গভীরতর তাৎপর্যে বোঝা যায় ক্রিয়াভিত্তিক ভাষার প্রেক্ষিতে। ইংরেজির ঢ়ধংঃ ঃবহংব এবং ঢ়ধংঃ ঢ়ধৎঃরপরঢ়ষব-এ যা সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় সেই -ফ, -বফ, -ঃ এর মধ্যে আমরা দেখতে পাই -ক্ত প্রত্যয়ের জ্ঞাতি। সংস্কৃতের সঙ্গে ইংরেজি একই ভাষা-পরিবার, যথা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা-পরিবারের সদস্য হওয়ার সুবাদে, দুইয়ের মধ্যে আমরা অনেক সাদৃশ্য লক্ষ্য করি। একটি ছোট মিলের কথা উল্লেখ করছি। সংস্কৃত শব্দের শেষে -ইন্ (যথা যার ভিতরে গুণ আছে = গুণ + ইন্ = গুণিন্ ; কামিন্ = কামী ; গামিন্ = গামী ; প্রার্থন = প্রার্থী ইত্যাদি) ইংরেজি রহ শব্দের সঙ্গে এক তাৎপর্যের। তবে বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয় হল, ইংরেজি মৎড়ঁঢ় াবৎন-এর জনপ্রিয়তা। সংস্কৃতে ধাতুর আগে উপসর্গ যোগ করার উপায়ে কম উপকরণে বেশি ভাব স্বচ্ছতার সঙ্গে প্রকাশ করা যায়। ইংরেজিতে ঠিক সেই কাজ হয় মৎড়ঁঢ় াবৎন দিয়ে। অনড়ষরংয, পড়সঢ়বহংধঃব, ফড়সরহধঃব, ফরিহফষব, ধমমৎধাধঃব ইত্যাদিতে অস্বচ্ছ এবং দীর্ঘ শব্দের ব্যবহার এ-যুগের গতিবাদী ইঙ্গ-মার্কিনের ‘না-পসন্দ্’। এড়, সধশব, পঁঃ, ংবঃ, ৎঁহ, ঢ়ঁঃ, মরাব, ঃধশব, যরঃ প্রভৃতি একাক্ষরী (সড়হড়ংুষষধনরপ) াবৎন-এর ড়ভভ, ঁঢ়, ড়ঁঃ, রহ, ধঃ, ঃড় প্রভৃতিকে অনুসর্গ হিসেবে ব্যবহার করায় আধুনিক ইংরেজিভাষী পায় সহজিয়া ভাষা-ব্যবহারের আনন্দ। তবে সংস্কৃততে উপসর্গ আসে আগে, প্রত্যয় আসে পরে  সেই পদ্ধতিতে সংস্কৃততে যথাযথ ভাবপ্রকাশের সুযোগ অনেক বেশি। উপরন্তু উপসর্গ আর প্রত্যয় যোগ বিষয়ে এক সুশৃঙ্খল ও বিশাল ব্যবস্থা রয়েছে সংস্কৃতের ব্যাকরণে। তাই ইংরেজি ভাষার জগতে অধিকার কায়েম করতে আমাদের ক্রিয়াভিত্তিক ভাষার জ্ঞান অবশ্যই সাহায্য করে।
এক ভাষা পরিবারের সদস্য হওয়ায় ইংরেজির বহু শব্দের জ্ঞাতিশব্দকে পাওয়া যায় বাংলার মধ্যে এ-কথা আপনাদের জানা। যেখানে সে সব শব্দের সাদৃশ্য অতি স্পষ্ট, সেখানে তাদের উল্লেখের কোনো প্রয়োজন নেই। যেখানে রয়েছে আবছা সাদৃশ্য, সেখানে বোধহয় কিছু শব্দের উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে ঃ যথা  ভষড়,ি প্লব ; ৎড়ঃধ, রথ ; পুপষব, শঁশষড়ং, চক্র ; ফরপঃরড়হ, দিশ্ ; ুড়শব, যুগ ; ৎবরহ, ঋণ ; ৎরমযঃ, ঋত ; ৎরপয, ঋচ্ ; ধহমবৎ, অঙ্গার ; ঢ়ড়ঁৎ, পূর্ণ ; ড়িসন, অম্বা ; ঃধী, তক্ষণ ইত্যাদি আরও অনেক শব্দ। কিন্তু বেশ কিছু শব্দ ও শব্দন্যাস (ঢ়যৎধংব) আছে ইংরেজিতে, যাদের গহনলোকে প্রবেশ সম্ভব হয় কেবলমাত্র আমাদের ভাষার ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থতত্ত্বের রাস্তায় (যে পথে কাটাই ও বাঁধাইয়ের কাজে আজ ছয়-সাত বছর আমি কলিম খানে-এর সহব্রতী)। কিছু উদাহারণ দিলে বক্তব্যটি স্পষ্ট হবে।
পশ্চিমী ভাষাবিজ্ঞান অনুসারে ইংরেজি জার্মান প্রমুখ জরমানিক বা টিউটনিক ভাষাগোষ্ঠীর এলাকায় ধহফ একটি ভুঁইফোঁড় শব্দ। আমরা কিন্তু শব্দটির জ্ঞাতি পাচ্ছি আমাদের ভাষার ‘অণ্ড’ শব্দে, ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ অনুসারে যার মানে হল ‘যাহার দ্বারা অবয়ব সংযোগপ্রাপ্ত হয়।’ আণ্ডা (= বমম), অণ্ডকোষ, এবং ধহফ শব্দটি  সবকিছুর যোগসূত্র ধরিয়ে দিচ্ছে আমাদের অভিধান। শুধু তাই নয়, ক্রিয়াভিত্তিক ভাষায় শব্দের শেষে ‘র’-এর অবস্থান প্রায়ই বিশেষ কোনো গুণের উপস্থিতি নির্দেশ করে। এই নিয়মের প্রয়োগেই বোঝা যাবে কেন গ্রীক ভাষায় পুরুষ বা সধষব অর্থে অহফৎড় শব্দের ব্যবহার হয়। প্রকৃত ঘটনা এই যে, আদি ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষায় কোন্ শব্দ কিভাবে গঠিত হল, বা কিভাবে গঠিত হয়, অন্যান্য দেশ তা ভুলে গেছে, কিন্তু তার স্মৃতি বহন করছে আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতি। যে কারণে ‘নেহাৎ প্রথার মধ্যে মানবভাষার উৎপত্তি’  এ তত্ত্ব ভারতীয় উপমহাদেশের ঐতিহ্যে বিশেষ আমল পেতে পারে না।
বঙ্গীয় শব্দকোষে লিঙ্গ শব্দের একটি ক্রিয়াভিত্তিক অর্থ দিচ্ছে  ‘জ্ঞান সাধনের উপায়।’ এটি জানলে পর বুঝি কেন ল্যাটিনের ষরহমঁধ শব্দ (যে শব্দ থেকে ষধহমঁধমব, ষরহমঁরংঃরপং ইত্যাদি কয়েকটি শব্দ নিষ্পন্ন) দিয়ে বোঝানো হবে মানুষের ভাষাকে (এবং ভাষার যেখানে উদ্ভব সেই জিহ্বাকে)। কিংবা দেখুন রহাবংঃ কথাটিকে। আমাদের দেশে কোনো ব্যক্তিকে দায়িত্ব, ক্ষমতা ও মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করতে গেলে তার সাথে চাদর বা কিছু আবরণ দিয়ে তাকে বরণ ( = বৃ) করে নিতে হয়  সে বধূ, জামাতা, পুরোহিত, সভাপতি, প্রধান অতিথি যাই হোক না কেন। কোনো ব্যক্তিকে ক্ষমতা অর্পণ করলে ইংরেজিতে গায়ে াবংঃ বা জামা চড়ানো বা রহাবংঃ ংড়সবনড়ফু রিঃয ধঁঃযড়ৎরঃু কেন বলা তা ভাল করে বোঝা যায় আমাদের বরণ কথাটির সূত্রে। পশ্চিমী ভাষার অনেক উপাদানকে পশ্চিমী পণ্ডিতরা ব্যাখ্যা করে দেন সাদৃশ্য বা সবঃধঢ়যড়ৎ-এর তত্ত্ব দিয়ে। কিন্তু আমাদের ভাষায় শব্দরাই ধরিয়ে দেয় কি বোঝানো হচ্ছে। আমাদের ভাষায় যে প্রক্রিয়াটি হল পিতার পদে অধিষ্ঠিত হওয়া সেটি ওদের ভাষায় সবঃধঢ়যড়ৎ হয়ে বজায় থাকছে ‘ংঃবঢ় রহঃড় ঃযব ংযড়বং ড়ভ যরং ভধঃযবৎ’ আকারে। কুমারীর কৌমার্যহরণ অর্থে ফবভষড়বিৎ শব্দটি কেন ব্যবহার হয় সেটি বুঝতে পারি যখন জানি যে আমাদের দেশে কোনো কুমারী ঋতুমতী (অর্থাৎ বিবাহযোগ্যা) হলে বলা হত এবং এখনও গ্রামের লোকে বলে থাকেন ‘অমুক মেয়েটি পুষ্পবতী হয়েছে।’ সেই কথাটি সাধারণের ভাষায় ‘বিয়ের ফুল ফুটেছে’ আকারে এখনও কথায় কথায় বলা হয়ে থাকে।
ওদের দেশের বহু শব্দের ব্যাখ্যা আমাদের দেশের জ্ঞানসম্পদ দিয়েই সম্ভব। ইঁষষ রহ ধ পযরহধ ংযড়ঢ়  এই শব্দন্যাসের নিশ্চয় সবঃধঢ়যড়ৎ হিসেবে অর্থ করা যায়। কিন্তু অনেক ভাল ব্যাখ্যা আমরা দিতে পারি। চীনামাটির শিল্পে প্রায়শই দেখি দক্ষতার পরাকাষ্ঠা ; সেই দক্ষতা আসে শ্রমবিভাজনে, অর্থাৎ বারে বারে এক কাজ করে যাওয়ায়। অথচ পুনরাবৃত্তির একঘেয়েমি হল মানবপ্রকৃতি বিরোধী। স্বভাবতই দক্ষতার নীতির বিরোধী হলেন মানুষের আদিদেব শিব, যাঁর আবির্ভাব ঘটে দক্ষতার নীতিতে চালিত সামাজিক কর্মযজ্ঞকে ভণ্ডুল করার জন্য। আর শিবের বাহন এবং প্রতীক দুই’ই হল বৃষ বা নঁষষ। সুতরাং নঁষষ রহ ধ পযরহধ ংযড়ঢ় শিবের আক্রমণে দক্ষযজ্ঞ পণ্ড হওয়ার স্মৃতি বহন করছে। এরকম নঁষষংযরঃ-এও পাই ‘ষাঁড়ের গোবর’, যা কিনা আমাদের কোনো কাজে লাগে না। (ষাঁড়ের গোবরের ব্যাখ্যা ? মার্জনা করবেন, এ-আলাপে অত অবকাশ নেই; আজ থাক)।
শব্দের অর্থগত পূর্ণতার স্মৃতিকে আমাদের ভাষাই বহন করে নিয়ে যাচ্ছে। এর খুব ভাল উদাহরণ হল ‘লোক’ শব্দটি। এই শব্দখণ্ডটি দিয়ে তৈরি আমাদের ভাষার নানান শব্দকে তাদের পশ্চিমী, বিশেষ করে ইংরেজি প্রতিশব্দ সমেত নীচে তুলি ধরছি।
লোক ঃ সধহ
লোক ঃ ংঢ়যবৎব; ল্যাটিন ষড়পঁং (= স্থান) যার থেকে ষড়পধষ, ষড়পধঃরড়হ
আলোক ঃ ষরমযঃ, ল্যাটিন ষীঁ (উচ্চারণ লুক্স্)
লোক ঃ ষড়ড়শ
লোকন / লোচন ঃ বুব
আলোকন / আলোচন ঃ ফরংপঁংং, ঃযৎড়ি ষরমযঃ ; ল্যাটিন ষড়য়ঁবৎব (যার থেকে বষড়য়ঁবহঃ, ষড়য়ঁধপরঃু, ড়নষড়য়ুঁ) ; গ্রীক ষড়মড়ং (যার থেকে ষড়মরপ এবং - ষড়মু)
খড়পঁং, ষীঁ, ষড়য়ঁবৎব, ষড়মড়ং, ষড়ড়শ  এদের ভিতর জ্ঞাতিত্ব পশ্চিমী পণ্ডিতরা সন্দেহ করেন না। কিন্তু ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থতত্ত্ব এদের ভিতরকার যোগসূত্র আমাদের দেখিয়ে দেয়। যিনি দেখছেন, যাকে তিনি দেখছেন, যার সাহায্যে তিনি দেখছেন এবং দেখা কাজটি  সব মিলেই তো এক অখণ্ডতা। আমরা কেউ ভাবব না যে বিভিন্ন ভাষা থেকে টুকরো অর্থগুলি এনে আমাদের দেশে জোড়া হয়েছিল। বরং মানুষের পূর্বপুরুষের অখণ্ড বোধই কেউ পেয়েছে খণ্ডভাবে, কেউ পেয়েছে অখণ্ডভাবেই ; কোনো দেশের ভাষায় সেই বোধ রয়েছে টুকরো টুকরো হয়ে, কোথাও-বা রয়েছে খানিকটা অখণ্ডভাবেই  এটা ভাবাই যুক্তিসঙ্গত। আমাদের সৌভাগ্য যে, আমরা বাংলাভাষীরা অখণ্ডের উত্তরাধিকারী।
ভাষার ক্ষেত্রে যেমন, তেমন পশ্চিমী পুরাণ ও ঐতিহ্যের অনেক কিছু বোধগম্য হয় আমাদের ঐতিহ্য বোঝার পর। ভারতের ব্রাহ্মণের মাথায় যে-শিখা দেখি, সে-শিখা আসলে মাথার ভিতর বাহিত জ্ঞানের অগ্নিশিখার সূচক তথা বহিরঙ্গ সহযোগী। জ্ঞানের এই শিখা বহন যিনি শুরু করেছিলেন তিনি আদিদেব আদি-শিখা-বহনকারী শিব, ইন্দ্র প্রমুখ দেবতাদের সঙ্গে যাঁর মৌল বিরোধিতা। এদিকে দেখুন গ্রীক পুরাণ কি বলছে। ঙষুসঢ়ঁং পাহাড়বাসী তবঁং প্রমুখ দেবতাদের অগ্রজ ঞরঃধহ-দের অন্যতম চৎড়সবঃযবঁং মানবকল্যাণের জন্য স্বর্গ থেকে চুরি করে আনেন আগুন। আর সেই মানবহিতৈষী মহৎ কাজের জন্য প্রমিথিউস নিত্য নিপীড়িত দেবরাজ তবঁং-এর হাতে। আবার শিবের সঙ্গে তাঁর বাহন বৃষের অচ্ছেদ্য বন্ধন বা অভিন্নতা যদি মনে রাখি তবে বুঝব গ্রীক পুরাণের ‘মন্দ’ রাজা গরহড়ং-এর সন্তান কেন বৃষদেহী, কেন চতুর তবঁং-কে বারে বারে বৃষের আকার নিতে হত বিভিন্ন প্রকৃতিরূপা বা নারীর সঙ্গে মিলিত হতে, আর কেনই বা আজও বৃষের সঙ্গে লড়াই ইউরোপে, বিশেষত স্পেন দেশে, ৎরঃঁধষ-তুল্য অতি প্রিয় বিনোদন। আবার পশ্চিমের গ্রীসীয়, স্ক্যাণ্ডিনেভীয়, কেলটীয় পুরাণে অশ্ব, অশ্বমানব (আমাদের কিম্পুরুষ ও কিন্নর) প্রভৃতি নিয়ে যে-সব উপকথা আছে তাদেরও বেশি করে বোঝা যায় আমাদের ঐতিহ্যের অশ্বমেধ, এমনকি  পাঠক বিস্মিত হবেন না  অশ্বত্থবৃক্ষের পূজা ইত্যাদির সম্যক ব্যাখ্যার আলোয়। (অন্যত্র১৬ সে ব্যাখ্যা করেছি, স্থানাভাবে এখানে সে-ব্যাখ্যা করতে পারলাম না বলে পাঠকের মার্জনা চাইছি)।
একটি চরম বিস্ময়ের কথা বলি। নাচ আর গান সহযোগে বিনোদনের যোগান দেওয়ার জন্য গ্রীক নাটকে ঈযড়ৎঁং-কে রাখা হয়নি, এটি আগে থেকেই বুঝতাম। তবে আমাদের ‘কুরু’ শব্দের সঙ্গে গ্রীক ঈযড়ৎঁং-এর সমত্ব (পুরু-র সঙ্গে চড়ৎঁং-এর যেমন সমত্ব) যখন আমার নজরে এল, তখন এক ঝলকে বুঝে গেলাম গ্রীক নাটকে ঈযড়ৎঁং-এর প্রকৃত ভূমিকা। আমাদের দেশে যুদ্ধের ক্ষেত্র বলা হয়েছে কুরুক্ষেত্রকে। কেননা সেখানেই ‘কি করা উচিত’ (মা কুরু = করিয়ো না, করা উচিত নয়) অর্থাৎ কর্তব্য কি তার নিরূপণ হয়। বুঝলাম, ঈযড়ৎঁং কেন কর্তব্য আর অকর্তব্যের তর্কটাকে নাটকের আগাগোড়া জিইয়ে রাখে।
প্রথমত, যে আলোচনা করেছি তাতে নিশ্চয় দেখেছেন ক্রিয়াভিত্তিকতায় গেলে বাংলা ভাষা কত জীবন্ত হয়ে ওঠে আপনার, আমার এবং সকলের ব্যবহারে। দ্বিতীয়ত, ইংরেজির মাপে বাংলাকে ছেঁটে নেওয়ার অভ্যাস ছাড়ার পর আপনার যে চোখ খুলবে তার সঙ্গে একটু ক্রিয়াভিত্তিক বিশ্লেষণ মেলালে আপনি বাংলা ভাষার সঙ্গে বেশি করে যুক্ত হতে পারবেন। আপনি যে কত শব্দ ব্যবহার করতে পারেন তার সামান্য কিছু নমুনা এখানে দিচ্ছি ঃ যথা, বিন্দুবিসর্গ (= বিন্দুতে আরম্ভ থেকে বিসর্গতে শেষ পর্যন্ত), হস্তীমূর্খ (= বড় রকমের মূর্খ), পূর্বাশ্রমের নাম (= ব্রহ্মচারী, গৃহী, অথবা বানপ্রস্থী অবস্থার নাম), দিকপাল / দিগ্গজ (= এক এক দিকের পালনকারী), জাতধম্মো (= জাতি বা নরৎঃয অনুযায়ী ধর্ম বা পেশা), পারানির কড়ি (= সংসারনদী বা ভবনদী পার হওয়ার জন্য মাঝিকে দেয় পয়সা), অপদার্থ (= পদ বা ঢ়ড়ংরঃরড়হ-এর যোগ্যতাহীন), দায়সারা (= দেয় পড়ে আইনের এলাকায়, দায় পড়ে আদি সমাজের ন্যায়ের এলাকায়  অতএব দায়সারা = অবহেলায় করা)। এ-রকম অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়, যেগুলি অতীতকে না বুঝে তার বোঝা বয়ে বেড়ানো টুলো পণ্ডিদেতরা দেখতে বা দেখতে পারিননি, আর ইংরেজির মাপে যাঁরা বাংলা পড়েন, তাঁদেরও নজর এড়িয়ে গেছে।
তৃতীয়ত, ক্রিয়াভিত্তিকতার পথে এগোলে আমাদের প্রাচীন গ্রন্থাদির মধ্যে পাওয়া যাবে মাত্র একটি দৃষ্টিভঙ্গী বা জীবনদর্শন, তা নয়। সেখানে ধরা আছে সমাজ-বিবর্তনের দীর্ঘকালের ইতিহাস। সে ইতিহাসে স্বতন্ত্র ব্যক্তিদের নাম থাকে না, সেখানে থাকে সত্তার নাম, যেমন দেখি রবীন্দ্রনাথের লেখায় ‘বণিকের মানদণ্ড পোহালে শর্বরী দেখা দিল রাজদণ্ড রূপে।’ আমরা দেখতে পাই বিষ্ণু বা নারায়ণের দশাবতারের কাহিনীর মধ্যে পুঁজির বিবর্তনের ইতিহাস। লক্ষ্য করবেন যে বাঙালির মুখের কথার মধ্যে ধরা আছে নগদ নারায়ণের নাম, ধান্য বা মুদ্রার মধ্যে নারায়ণ-পতœী লক্ষ্মীর অবস্থান। আরও খেয়াল করবেন যে সংস্কৃত ভাষা না-শিখে তখন কেবল ইংরেজিতে পাওয়া যায় এমন জিনিস পড়েই ঊনবিংশ শতাব্দীতে বিদেশী মনীষী কার্ল মার্কস পুঁজিপতিকে বলেছেলেন ‘ঃযব সড়ফবৎহ ঢ়বহরঃবহঃ ড়ভ ঠরংযহঁ’। সেই রীতিতে ভাষাবিচারে কিঞ্চিৎ রপ্ত হলে দেখবেন নদী বললে শুধু জলধারা বা ৎরাবৎ বোঝায় না, নদ শব্দটিও নিছক ব্যাকরণের চাহিদা মেটানোর জন্য তৈরি শব্দ নয়। নদনদী বললে বোঝায় মানুষকে ন (= বিত্তন আ সম্পদ) দান করে এমন জ্ঞানধারা বা কর্মধারা। ব্যুৎপত্তি অনুসারে গঙ্গা বললে বোঝায় নিত্যগমনশীলতা ; অতএব অবাধ পণ্যপ্রবাহ সহ যে-কোনো পর্যায়ের অবাধ ধারাকে বোঝাতে গঙ্গা শব্দ ব্যবহার করা যায়। মনে করিয়ে দিই, শান্তনুর ঔরসে গঙ্গার গর্ভে জন্মাচ্ছে অষ্টবসু, এবং বসু মানে সম্পদ, যে কারণে পৃথিবী হল বসুমতী, বুসন্ধরা, বা বসুধা। পুরাণের সব কাহিনীর মধ্যেই পাব সামাজিক সত্য এবং অন্য নানা স্তরের সত্য। ঠিক পথে পুরাণের চর্চায় এগোলে অনেক কিছু ধরা যায়। পুরাণের ভাষায় সূর্যবংশ মানে সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় পুঁজির সমর্থক, আর চন্দ্রবংশ বললে বোঝায় ব্যক্তিগত পুঁজির সমর্থক। দেবতার বর মানে বিশেষ (সামাজিক) শক্তির হাতে নির্বাচন বা বরণ, যার মানে এক সঙ্গে বেশ কিছু দায়িত্ব ও ক্ষমতা লাভ। সে-রকম ধনু মানে হল ষধ।ি অতএব হরধনু, ইন্দ্রঘনু, রামধনু বললে বোঝায় যথাক্রমে হর (বা মহাদেব), ইন্দ্র, এবং রামের আইন। লক্ষ্য করবেন রামধনুই সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করে মানুষকে। দেবাসুরের মিলিতভাবে সমুদ্রমন্থন মানে রাষ্ট্রীয় পুঁজি (অসুর) আর ব্যক্তিগত পুঁজি (দেবতা)  দুই মিলিতভাবে জনগণ (সমুদ্র)-কে দিয়ে ধন (= লক্ষ্মী ) উৎপাদন করছে। ব্যক্তিপুঁজির সঙ্গে মিলিয়ে দেখবেন সমুদ্রমন্থন কালে শত চাতুরী করছে দেবতারা। এবং দেবগুরু বৃহস্পতির পুত্র কচের তরফেই কি কম চাতুরী !
আমার অনেক অসম্পূর্ণতা সত্ত্বেও একটি জিনিস এতক্ষণ ধরে আপনাদের হাতে তুলে দিতে চেষ্টা করেছিলাম তা হল আমাদের ভাষা এবং সংস্কৃতি সম্বন্ধে যুক্তিগ্রাহ্য কিছু তত্ত্ব ও তথ্য। আশা করি আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতির অনন্যতা তথা আজকের দিনে এর উপযোগিতা নিয়ে মনে সংশয় থাকলে তা কিছুটা কেটে যাবে। ক্রিয়াভিত্তিক (বাংলা-সংস্কৃত) ভাষাকে বোঝার জন্য চাই ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থতত্ত্ব আর সেই তত্ত্বের প্রয়োগকে যাচাই করে নেওয়ার জন্য আমাদের ক্রিয়াভিত্তিক (বাংলা-সংস্কৃত) ভাষার চর্চা। কিন্তু তারপর ? একেবারে প্রথমেই আসে বিচ্ছিন্ন শব্দসমূহের প্রকৃত অর্থ উদ্ধার করা, আর তার পরেই আসে পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারত প্রভৃতির কাহিনীগুলির মর্মার্থ উদ্ধার করা। এই দু’টি কাজে হাত লাগানো এখনও বিপুল পরিমাণে বাকি আছে, এবং এর প্রতি পদক্ষেপে নানান অন্তরায়। বলে রাখা ভালো, বর্তমান পশ্চিমবঙ্গে, বিশেষত সরকারি জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রগুলেতি নতুন কথা শোনার লোক এখন খুবই কম। অধিকাংশই জাবর কাটায় বিশ্বাসী। বাংলাভাষীর হৃতগৌরব পুনরুদ্ধার করার কথা তাঁরা ভাবতে পারেন না।
সে যাই হোক, আরও যে-সব কাজ তার কথা বলছি। প্রথম, আমাদের যত প্রাচীন গ্রন্থ তার প্রতিটিকে ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থতত্ত্বের আলোয় নতুন করে অনুবাদ করে দেওয়ার প্রয়োজন। এটা আমাদের কাছে মানবসভ্যতার দাবি। এতদিন যে অনুবাদ চলছিল তা প্রায় সম্পূর্ণতই ভুল। যেমন জ্যেতিষশাস্ত্রের রাহু কেতুকে আক্ষরিক অর্থে দু’টি সড়হংঃবৎ বলে কল্পনার করা হত। এবং এই কারণেই আল বিরুনী খেদ করেছিলেন যে, হিন্দুস্থানের বিজ্ঞানীদের অসামান্য তত্ত্বজ্ঞানের সঙ্গে আজগুবি গল্প মিশিয়ে দেওয়ার দুর্বুদ্ধি যে কেন হয় ! এখানেও আল বিরুনীর অভিযোগরে নিষ্পত্তি করতে হবে তো ! তার ওপর আমাদের পুরাণকাহিনী তথা ভাষার থেকে কি নির্দেশ পেতে পারি সেটাও দেখা দরকার। সমাজের অবতরণের পথ জানা থাকলে উত্তরণের হদিশ মিলবে, এমন তো আশা করা যায়। একটা উদাহরণ দিতে ইচ্ছে হয়। ওদের ঢ়যরষড়ংড়ঢ়যু (ষড়াব ড়ভ রিংফড়স) থেকে আমাদের ‘দর্শন’ শব্দটি সমৃদ্ধতর, কিন্তু আমাদের ‘অধ্যাত্মবিদ্যা’ তো আরও মহান। অধ্যাত্মবিদ্যায় সব কর্ম, এবং সব জ্ঞানের আদিতে এবং অন্তে যে ‘আত্ম’কে আনে, এটা বৃথা নয়। গীতার ‘আত্মানং বিদ্ধি’ আর প্রাচীন গ্রীসের ‘কহড়ি ঞযুংবষভ’  দু’জায়গাতেই পাচ্ছি প্রকৃষ্ট প্রজ্ঞার নির্দেশ। এটির সমর্থন বিজ্ঞানের শীর্ষদেশেও পাই।
যে শব্দার্থতত্ত্বের চাবি দিয়ে আমাদের ভাষাসম্পদের অতি অল্প কিছুটা উদ্ঘাটন করলাম, তা দিয়ে অনেক বিদ্যাতেই নতুন সৃষ্টি সম্ভব হয় এবং হয়তো-বা সভ্যতার রূপান্তরে তারা পরিণতি পায়। তবে সব কাজেরই সমাপ্তি আছে, এ আলাপ-সংলাপেরও ইতি টানতে হয়। বিদায় নেওয়ার আগে পত্রপ্রবন্ধের শিরোনামের দিকে আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করি। আর কোনো কারণে ণয়, শুধু আমাদের ভাষার সূক্ষ্মতার কথা আর একবার দেখাবার জন্য।
শিরোনামে আছে ‘কী করে’ এবং ‘কী ভাবে’। জানি না, এ দু’টিকে আপনার সমার্থক মনে হয় কি না, ইংরেজি যড়ি এবং রহ যিধঃ সধহহবৎ-এর মতো। কিন্তু প্রকৃতই এ শব্দগুলো তা নয়। ‘ভাবে’ শব্দটিতে বোঝায় ভবের (বা হওয়নের) নিয়ম বা রীতিনীতি, আপনি নিজে কেমন হয়েছেন, আপনার নিজেকে কেমন হতে হবে ইত্যাদি  সেজন্য আমরা বলি ‘ধীরস্থিরভাবে’, ‘অস্থিরভাবে’, ‘গম্ভীরভাবে’, ‘শুদ্ধভাবে’ ইত্যাদি। কিন্তু ‘কী করে’ বললে বোঝায় কি কি কাজ সম্পন্ন করে, কি কি কাজের মধ্য দিয়ে ইত্যাদি। এখানে দু’টোর কথাই বললাম। যে কোনো কাজ করতে গেলেই তো আগে কিছু কিছু কাজ করে নিতে হয়, আর সেই সঙ্গে নিজেকেও তো কাজের জন্য তৈরি করে নিতে হয়।



পাদটীকা
১। ঐঁনৎরং = সাফল্যজাত বেপরোয়া ভাব, রহংড়ষবহপব ড়ভ ঃৎরঁসঢ়য.
২। ঐধসধৎঃরধ = ঃৎধমরপ বৎৎড়ৎ, ট্র্যাজেডি-সংঘটক সীমালঙ্ঘন।
৩। ঝড়ঢ়যৎড়ংুহব = অপ্রমাদী ন্যায়চরণ।
৪। ঘবসবংরং = প্রত্যাবৃত্ত ন্যায়দণ্ড।
৫। এ-বিষয়ে আমাদের বেশ কয়েকটি গ্রন্থ ও অনেকগুলি নিবন্ধ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছ। আগ্রহী পাঠক তা দেখে নিতে পারেন।
৬। জল, নীর বা কর (= ঃধী) দানকারীকে বলা হয় যথাক্রমে জলদ, নীরদ, করদ। আবার ‘প’ সূচীত করে পান/পানকারী অথবা পালন/পালনকারীকে। সেই সূত্রে ‘ভূ’ ও ‘নৃ’ পালসকারী যথাক্রমে ভূপ এবং নৃপ, আর মধুপানকারী হল মধুপ। সুতরাং যে বা যাহা পান/পালন করে, তাকেই পদ বলা যায়। এ-বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা নীচের ৭ নম্বর পাদটীকায় উল্লেখিত গ্রন্থের বিভিন্ন প্রবন্ধে রয়েছে।
৭। কলিম খান ও আমার লেখা যৌথ গ্রন্থ ‘বাংলাভাষা ঃ প্রাচ্যের সম্পদ ও রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থে এ-বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
৮। কাশ-এর, অর্থাৎ আমরা যত কথা বলি তার, আধার হল আকাশ। মানুষের চিন্তার সকল প্র‘কাশ’ গিয়ে গড়ে তোলে মানবমনের আকাশ বা চিদাকাশ। এক-কথায় একে সংস্কৃতিও বলা যায়। এই ‘আকাশ’ তাই দৃশ্য ংশুটিকে যেমন বোঝায়, তেমনি মানুষের মনোলোকের আচ্ছাদনটিকেও বোঝায়। এবং বলতে কি, সেকালে প্রধানত সেই চিদাকাশকে বোঝাতেই বাংলায় ‘আকাশ’ শব্দের ব্যবহার হত। আর সেজন্যই আজও ‘আকাশ ভেঙে পড়া’ শব্দবদ্ধটি বাংলাভাষায় নির্বিবাদে প্রচলিত আছে। কারণ মূর্খেও জানে, ংশু কখনো মানুষের মাথায় ভেঙে পড়ে না। যেটা কখনো কখনো ভেঙে পড়ে সেটা মানুষের চিদাকাশ। বলে রাখা ভালো, ইসলাম যখন এদেশে আসে তখন আমাদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েনি, কারণ তাঁরা আমাদের একই আকাশের অন্য দিগন্তের বাসিন্দা ছিলেন। তাই তাঁরাও আমাদের বুঝতে খুব বেশি অসুবিধা বোধ করেননি, আমাদেরও অসুবিধা হয়নি। কিন্তু ইউরোপ ছিল ইসলামী আকাশের শেষ দিগন্তের বাসিন্দা। তাকে আরব-প্রভাবিত ইসলাম খানিকটা বুঝলেও আমাদের বাংলাভাষী হিন্দু-মুসলিমের পক্ষে সে ছিল একেবারেই অন্য জগতের লোক। তাই সেও যেমন আমাদের বুঝতে পারেনি, আমাদের নিজস্ব আকাশের তলায় বাস করে আমাদের পক্ষেও তাকে বোঝা দুঃসাধ্য ছিল। একমাত্র উপায় ছিল আমাদের নিজেদের আকাশটিকেই জলাঞ্জলি দেওয়া। রামমোহনের হাত ধরে আধুনিক বাঙালি তাই করেছিল।
৯। পরিস্থিতিটি অনেকটা মুদ্রাস্ফীতির মতন। বাজারে বেশি মুদ্রা বা হড়ঃব ছাড়া আছে, কিন্তু তাদের ক্রয়ক্ষমতা ক্ষীয়মান।
১০। দ্রষ্টব্য ঃ ঐ গ্রন্থের রূপতত্ত্ব ৩.০৯২ [৩]
১১। উপরোক্ত ‘বাংলাভাষা ঃ প্রাচ্যের সম্পদ ও রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থটিতে এ-বিষয়ের বিস্তারিত ব্যাখ্যা রয়েছে।
১২। উবলবপঃরড়হ: ধহ ঙফব.
১৩। ঊষবমরধপ ঝঃধহুধং, ংঁমমবংঃবফ নু ধ চরপঃঁৎব ড়ভ চববষব ঈধংঃষব.
১৪। ঞবসঢ়বংঃ ওঠ.র.১৪৮ .
১৫। অ ঝযড়ৎঃ ঐরংঃড়ৎু ড়ভ খরহমঁরংঃরপং: ঈযধঢ়ঃবৎ ংরী : জ. ঐ. জড়নরহং.
১৬। ‘ভাষাতত্ত্বের নতুন দিগন্ত ও প্রকল্পিত আর্য-আগমনতত্ত্ব / বাংলাভাষা ঃ প্রাচ্যের সম্পদ ও রবীন্দ্রনাথ / কলিম খান ও রবি চক্রবর্তী।

২টি মন্তব্য:

  1. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ থেকে ইংরাজি শব্দগুলো বন্ধনীর মধ্যে ঠিক মত আসেনি।

    উত্তরমুছুন
  2. এই লেখার সঙ্গে কিছুটা দ্বিমত পোষণ করলেও মূল বক্তব্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই এই লেখা পোষ্ট ক'রে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়াটা প্রশংসনীয়। কিন্তু অনুরোধ রইল যে অসংখ্য টাইপো আছে সেগুলোকে সংশোধন করার; নচেৎ সেগুলো লেখাটি পড়ার জন্য বিরক্তি তৈরি করছে। আর অবশ্যই অনুগ্রহ করে লেখাটির সোর্স এবং প্রকাশকাল বলে দিন, প্রথমে, না হয় শেষে; এ দুটোই খুব গুরুত্বপূর্ণ।

    উত্তরমুছুন