মঙ্গলবার, ৫ জানুয়ারী, ২০১০

ওবায়েদ আকাশের কবিতা /১

কুয়াশা উড়ালো যারা





উ ৎ স র্গ
বধ করেছে আচার-রীতি
নিয়ম তোড়া তোড়া
প্রথায় ভারি মুখ পুড়েছে
জন্মকানুনখোড়া

ভূমিকা
সিংহের রাজত্ব আর আমার তো দর্প চুরে ভয়
কুয়াশা উড়ালো যারা, নাটাইয়ের শক্তি অতিশয়
ঘাসে ঘাসে প্রান্তকথা ছড়ানো ছিটানো
কে-ই-বা বলেছে তোমার মুখটি তুলে আনো
কতো কী বিস্মৃত গাথা মর্মে তুলে আনি
আমাকে গেথেছে কেবল জ্ঞাতি ও বিজ্ঞানি
















কুয়াশা উড়ালো যারা
ওবায়েদ আকাশ

বিশাকা প্রকাশনী
গ্রন্থস্বত্ব
ইকবাল আহসান
প্রচ্ছদ
তৌহিন হাসান
প্রকাশক
শহ্জাহান বাচ্চু
বিশাকা প্রকাশনী, ৩১/৩২ বাংলাবাজার, ঢাকা-১১০০
খোঁজখবর : ৭১৭২৮৪২, ০১৭২০৬৯৬৫৭
মূল্য
৬৫ টাকা

















সাম্প্রতিকগুলো

হাল আমলের এই ব্যাপারগুলোই আমার মর্মে ঢুকে পড়া ছিল
সাধারণ ব্যাপার
রাত্রির দোহাই দিয়ে আমি তোমার হাতে তুলে দিয়েছি
একটি অন্ধকার গোলাপ
অথবা ঝড় এলো বলে পতিত নক্ষত্রগুলোয় ঝলসে দেবো
তোমার অদিতি
প্রতীক বিশ্বের দিকে আমার অন্ধত্বকে খুঁজে দেবো ভাষা
আর যাদুবাস্তবতা, তুমি দেখো- এই মায়াবিশ্বের ব্যাপারগুলো
পরস্পর সম্বন্ধতাড়িত হয়ে
আমার যে পরস্ত্রীকাতরতা ভর করেছিলো-
আর আমার মহাত্মা ধানজমিগুলো
এক এক করে
জলের দামে বিকিয়ে দিয়েছিলাম...

ঐ ধানের জন্য মায়া, আর
ঋণের জন্য খুলে দিয়েছিলাম অন্দরের সিঁড়ি...

এই পরস্পর নিভৃত ব্যাপারগুলোয়
তোমার দিকে হাত পাততেই জমেছিলো দ্বিধা-
তোমার শ্রেষ্ঠত্ব থেকে একে একে খুলে নিয়েছিলাম
কপোলের অভ্রকুচি, চুলের সুষমা...
তুমি সিংহ-শাবক কোলে তুলে নিয়ে, দ্বিধান্বিত পৃথিবীর পটে
ভেঙে ফেলেছিলে তাজমহলের কাঁচ
যা কিছু সাধারণ ব্যাপার-
একদিন প্রিয়কবি সাফোকে তোমার এ প্রকার সাম্প্রতিকগুলো
লিখে দিয়েছিলে
ম্যাটাফর কবিতার ভাষায়


জারুল, গোপনে গোপনে

জারুল অভ্যস্ত আছে এই ঝড়-বাদলের পিঠে, লিখে দিতে
নিজের ঠিকানা

সুরেশ্বর মাঝির কনিষ্ঠার বিবাহদিনে উড়ে গেছে তার
মস্তকবিহীন শরীরের
আগুনে বিদগ্ধ ডানা
জারুল, ঘুম ভেঙে বসে আছে
আমাদের বিবাহিত জীবনের
ক্যাম্পাসের চারপাশ ঘিরে
গ্রহণের অন্ধকার নক্ষত্রগুলো
কেউ তাকে ফিরিয়ে দিয়েছে
কেউ তাকে ফেলে রেখে গেছে বিষণ্ন মেঘেদের কাছে
ভাড়াটে ঝড়ের তল্লাটে
অনায্যই ভেবে বসে আছে : গাণিতিক সম্বন্ধগুলো
পৃথিবীতে সুপ্রাচীন সভ্যতার ভেতর
চুরি হয়ে যায়
উড়ে যায় মাতৃদুগ্ধ- যে কোনো বয়সী শিশুর
নাগাল এড়িয়ে
ঝুম ঝুম বৃষ্টিতে তাকে প্লাবনের মুগ্ধতা এসে তুলে নেয়
জারুল গোপনে গোপনে এতোটুকু অভিমানী নয়


বদলে যাওয়া

বদলে যাচ্ছে আমার প্রেমপত্রের ভাষা
প্রতিদিন একটি একটি দিব্য সত্যকে আমি খুন করে থাকি
পত্রস্থ অভিমানগুচ্ছে গুঁজে দিই মিলনের তুচ্ছতা

বদলে যাচ্ছে দেয়ালের ছবি। ইতরবিশেষে তারা কথা বলে
মধ্যরাতে ঘুমন্ত মৃতদের মতো প্রতিটি ভুলের স্বপ্নে
শালপাতায় ছেয়ে আছে তোমাদের সত্যদ্রষ্টা মুখ
কখনো সুখ সুখ মনে হলে
হাতড়ে হাতড়ে ছুড়ে ফেলি পুরোনো চিঠির বাক্স
রঙধনুর মতো তোমার শতাব্দীপ্রাচীন পোস্টকার্ড

নিষ্কাম যৌনতার দিকে খুব করে খেয়াল ফিরে আসে
আমার হাতের খোঁড়লে বেড়ে ওঠে
সমুদ্রের প্রমত্ত অন্ধকার শোক
পিকাসোর অন্ধকার ছবি, ফ্রেমবন্দী মেঘ
নিকোটিনের সমান বয়সী কবি
প্রত্যেকে হাত ধরে ধরে
পবিত্র সভ্যতার দিকে লেলিয়ে দিয়েছি
আমাদের ক্ষুধার্ত যৌনতা

আমরা ভিক্ষে করে যা কিছু পাই
ঐসব রক্তাক্ত যোনি, আরব্য রজনীর শোক...
যার যার থলের ভেতর লুকিয়ে দেখেছি
তারা কথা বলে আদিম অর্চনা ভেঙে

আমরা প্রাক-বৈবাহিক লোভে দেহ দান করে
অনর্থই ঘোষণা করেছি বৃষ্টি
আমরা নগরে নগরে ঘুরি
যার যার ডিজিটাল চোখে
বিনিময় করি পথে পথে খুনের গাণিতিক অভিজ্ঞান
আমাদের বিদ্যাভবনের ক্লাসে
প্রতিটি রুটিনের দিকে ফুটে ওঠে
আমাদের নির্মল পদচ্ছাপ, অবজ্ঞাত হাসি...
আমরা বদলে বদলে আসি
আমরা বদলে বদলে যাই
আমাদের আদগ্ধ ওষ্ঠের ভাপে শতাব্দীর প্রার্থনারত হাত
আঙুলের ন্যুব্জতায় অতি দূর সমুদ্রে মিলিয়ে যায়


বর্ণ ও বৈশ্বায়ন

আর আমার জন্য বসে আছে ক্লান্ত কিছু লোক
তারা আমার লাশ বয়ে নিয়ে একটি মরচেধরা জাহাজের
নোঙরের অপেক্ষা করবে...
জাহাজ থেকে লাফিয়ে পড়বে জন্মান্ধ প্রবীণ নাবিক
খুচরো কিছু তুষার মানবী

এবার তারা আমাকে লিঙ্গান্তর করে
একটি হিমাগারের দিকে নিয়ে যেতে চাইবে
দরজায় বসিয়ে দেবে সমাজতন্ত্রের ঘোড়া
কেননা আমার তো লিঙ্গ ছিলো না কোনো, বরং
এ জাতীয় ব্যবচ্ছেদ বিষয়ে জমেছিলো সহস্রাব্দের মেদ

আর আমার বর্ণ ও বৈশ্বায়ন নিয়ে
পৃথিবীতে পতিত রাজতন্ত্রের নায়কেরা, যারা যারা
অন্যায্যই প্রশ্ন তুলেছিলো
আর ঝুম ঝুম প্লাবনের তোড়ে ঝরে পড়ছিলো
পৃথিবীতে স্বৈরতন্ত্রের নুন
অভাব্যই আমার মৃত্যুর ভেতর থেকে খসে পড়েছিলো
নক্ষত্রের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা
কারো কারো আজন্মের লালিত কৃমিতেই তারা
বেদনাতাড়িত হয়ে ঝুলে পড়েছিলো
সরু সরু সুপুরিশাখায়

কারো কারো প্রসব যন্ত্রণার কথা মনে পড়ে

-তারা আমার হাত ধরেছিলো
-বুকের মাংসের ভেতর গুঁজে দিয়েছিলো
থেঁতলানো মুখ
এবার বৃষ্টির ভেতর তারা আমার সুস্বাস্থ্যের কথা ভেবে ভেবে
জল থেকে তুলে এনেছিলো প্রকাণ্ড কুমির
ঝলসানো পাঁজরের কাছে সঁপে দিয়েছিলো
রক্তাক্ত থাবা, আর
জাহাজের পাটাতনগুলো এক এক করে
খুলে যাচ্ছিল লবণাক্ত জলে

অথবা যে এক চিলতে চাঁদ
মুখের কার্নিশে বসে, আমার অক্ষত লাবণ্যের দিকেই
ঝুঁকে পড়েছিলো, অগত্যা
জন্মান্ধ প্রবীণ নাবিক, চড়ে বসেছিলো
জাহাজের লিঙ্গের চূড়ায়
আমরা তুষারের ভেতর, একটি জাহাজের নোঙরের ভেতর
একটি মাস্তুলের কথা কখনো বলিনি!

আমার জন্য ছুটে এসেছিলো ক্লান্ত কিছু লোক
-তাহাদের ঘুমের প্রয়োজন ছিলো
-তাহাদের মৃত্যুর প্রয়োজন ছিলো
আমার লাশ বয়ে বয়ে কেউ কেউ
রাজতন্ত্রের ক্লান্ত গাধাটির মতো
গড়িয়ে পড়ছিলো তলে

ধনতন্ত্র আর সাম্রাজ্যবাদের তুষার রূপসীরা
আমাকে টেনে নিয়েছিলো নিরন্তর প্রসব বেদনায়



ছায়া

একঝাঁক ছায়াকে কেউ বনান্তর হতে দেখে না
একসাথে
যার যার পিঠের মধ্যে লুক্কায়িত স্নেহগুলো
পাতাদের ভিড়ের মধ্যে ছুড়ে দিতে চায়

আর তাই ভোর হলো হলো
যে কোনো গোলাপের ঘ্রাণে
ছায়াদের দৌড়ঝাপ পড়ে থাকে

প্রকৃত গ্রীষ্মের দিনে, ছায়াগুলো ঝুলে যায়
ঊষর মরূদ্যানে

শীত-গ্রীষ্ম-- ষড়ঋতু...
কে কবে ভেবেছে এমন--
ছায়াগুলো চিরকাল, অবিকল মানুষের মতো
অনুভূতিপ্রবণ
ঘুমনিদ্রাপ্রিয়


কবি

কথন-ভঙ্গিমার কাছে তোমাকে পরাজিত হতে হবে
বাক্যান্ধ মানুষেরা তালপাতার ওড়াউড়ি দেখে
ভুলে থাকে নিজের নড়াচড়া

তোমাকে বোধের কাছে শুতে দিয়ে দেখি
তুমি কথা বলছো প্রতি জন্মনিয়ন্ত্রণে

তোমাকে মেঘের মধ্যে উড়তে দিয়ে দেখি
তুমি ডানা খুলে পড়ে যাচ্ছো ঘুমে

বস্তুত, মৎস্য শিকারে নিয়ে যেতে চাই
খলুই ভর্তি মাছ খেয়ে খেয়ে
তুমি হবে নিরামিষাশী ঋষি
আর তোমার চোখ, খুলে খুলে ঝরে যাচ্ছে সমুদ্র-সলিলে
তুমি দেখবে সমুদ্রের বিশালতা কিছু নেই
সমুদ্রের বৈধতা কিছু নেই
চক্রাকার পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসছে আলো
পৃথিবীর ধ্বংসের কিছু গমগম ধ্বনি

তোমাকে মধ্য সমুদ্রের ভেতর
কিছু কিছু শর্তের কথা তুলে ধরা হবে
চারদিকে জুড়ে দেয়া হবে বিশুষ্ক লবণের চাঙড়

তোমার অন্ধত্ব জুড়ে ডুবে যাবে সহস্র নাবিক
তোমাকে উদ্ধৃত করে বয়ে যাবে প্রাচীন প্রবাল...
তুমি, মৃত কুমারের হাতে তুলে দেবে লোহিত সূর্যাস্তকণা
জলের সারল্য কিছু
রঙের প্ররোচনা

উড়ে যাচ্ছো ভেসে যাচ্ছো বিবেকী ডানার মহিমা


জাতীয়তা

আমার তো গ্রাম-বাংলার জাতীয়তা হতে
নামধাম রটে যাবে বলে
ব্যক্তিগত রীতিগুলো তুলে রাখি পরম গোপনে

আর আমার মনে আছে--
পাঠশালার মেয়েগুলো, যারা যারা
জলবাগান ফলবাগান ঘুরে ঘুরে
উঁচু উঁচু স্বপ্ন গড়েছিলো
--নখগুলো খুলে ফেলে দিতো মাংসসমেত
--শানানো ঘাটলায় বসে ধবধবে হাড় ধুয়ে ধুয়ে
ফিরে যেতো ডাক্তারখানায়
কারো কারো জন্মদিনে আমার নেমন্তন্ন হয়--

মনে মনে ভাবি, নামধাম রটে গেছে বলে
এ-পর্বে আমাকেই ডাকা হলো
গ্রামীণ এই রঙ্গ-তামাশায়

আমার তো কথা ছিলো তালপাতায় লিখে দেবো
লাঙলের রেখা...
স্টেশন পেরিয়ে গেলে রেলের হুইসেল ধরে
যারা যারা মধ্যরাতের নাগরিক অভিজ্ঞান নিয়ে
ঘরে ফিরেছিলো
পাতালের গোঙানির ভেতর
বেতসের মতো ছিঁড়ে ফেলেছিলো
আমাদের গ্রামীণ ইশতেহার

আর আমার ব্যক্তিগত ভালোবাসাবাসি
উড়েছিলো বাঁশবনে ফাল্গুনের হাওয়ায়...
আর আমার মধ্যবিত্ত স্মৃতিগুলো আখক্ষেত, অরহের বনে...

আমার তো কথা ছিলো নরম ডাঁটার মতো নুয়ে যাবো
রাইশস্য, চিনিচাঁপা, মেহগনি ফলের ঘ্রাণে...

বৃষ্টি এবং মেঘলাগাছ
তোমার সাথে দেখা হলে একলা একটি গাছের ভেতর মর্মরিত দুঃখভেদে পরস্পর বৃক্ষ হয়ে যাই। আর যাই বলো, মাছের কানকোয় চড়ে দুঃখদের জলভ্রমণের দিনে তোমার কাছে যাবো না বলে ভাবতেই পারি না। তোমাকে একজন বৃষ্টির কথা বলি : একজন শরৎকালের নাম রাখা আছে বৃষ্টি। প্রজন্মান্তরের এই ধারণার ওপর আমাদের কোনোই হাত ছিলো না। আমাদের এই শিশু-বিদ্যায়তন ফি বছর শরৎ এলেই খুলে দেয়া হয়। আর শরতের বৃষ্টিতে কাশফুলের ভিজে ওঠা দেখে পাড়ার শিশুরা সকল একজন হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার নাম দেয় বৃষ্টি। এবারেও আমাদের কোনোই হাত থাকে না। আর এই শিশু-সন্তানেরা মা মা করে ডেকে উঠলেই, সকলের প্রিয় বৃষ্টি হতে বৃষ্টি ঝড়ে পড়ে। ওরা বলে : এই পৃথিবীর দৈত্য-দানোর গল্প বলো মা! তখন আমি আকাশ থেকে লাফিয়ে পড়ি, মেঘলাগাছ। শিশুরা সব পাতায় পাতায় ঝুলে গেলে, মা-র মনে পড়ে তেঁতুলগাছে ঝুলে থাকা বাদুড়ের ঝাঁক। প্রিয় শিশুদের শিশ্নের ডগায় চুমু খেতে খেতে বলে : এবার আমি আর মেঘলাগাছ তোমাদের জন্য একটি স্বশিক্ষিত বিদ্যায়তন নিয়ে ভাবতে বসে যাবো। শরৎ ফুরিয়ে এলো; বৃষ্টিকে তারা নির্জনে গেঁথে একে একে ঘরে ফিরে যায়

কথা যদি ওঠে
টিটি-মাস্টার হাটে আমাদের নতুন বোনজামাই থাকে; বারোমাস সবজির হাইয়ের ডগায় উঠে দেখে রাখে পানাপুকুরের হাট। তোমার মন ভালো নেই, ও বোন-ভাশুর, এই হাট সুনাম কিনেছে কাল ব্রয়লার মোরগের ঝোলে। এবার ঝাপের পোস্টার বেচে মাসীমাকে বুঝে দাও পদ্মার ইলিশের দেনা। জলকচু, বরবটি এ গাঁয়ে ফলে না আর। পানপাতা, তেলাকুচো ঝরে নাকি ফিরিঙ্গি বাতাসে! আর ঝাপ খুলে উড়ে যায় দেশী মাগুরের তেজ। এ তোমার অবশ্য জানা, ডাঙর মেয়েরা বলে, ও মশাই টকটকে লাল দুলাভাই, এই হাটে ওঠে নাতো চিনেজোঁক, শেয়ালের পরম মালিশ; তোমার ধ্রুপদী দোকান-- শ্যাওলায় ডুবে গেলে, ব্যাঙের মাশরুম হতে তুলে রেখো শর্করা-আমিষ।
একদিন বসন্ত-শাপ উড়েছিলো সকাশে তোমার : লাউয়ের খোঁড়লে শুয়ে ভুলে গেলে ও সাঁই লালন ফকির! আমি বলি আমাদের নব বোনপতি, এই নিয়ে একদিন কথা তোলে যদি!

বাঁদরবিষয়ক
মাকে দেখলাম, এই প্রথম একটি বাঁদরের গলায় বড়শি গেঁথে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন দ্রুত। মা আমার বললেন শুধু, এতোদিন পর...! আমি ভাবলাম, এই ভর সন্ধ্যার সুদর্শনগুলো চেয়ে আছে, মাকে আমি একজীবনে এমন উৎফুল্ল কখনো দেখিনি। এমন বিদগ্ধ করে হাসতে দেখিনি আজো। আর অম্নি দেখি ট্রাক ট্রাক পুলিশ এসে হাতকড়া দিয়ে ধরে নিয়ে গেলো মাকে। তারা বললো, হাজার হাজার বছরে এই একজন মাত্র, যাকে সত্যিকার বাঁদর-নিধনকারী বলে চিহ্নিত করা গেলো। সুতরাং একটি রক্তাক্ত কামরায় পুরে মাকে আমার পুরস্কৃত করা হলো। আর এই ফাঁকে, পোশাকধারী লোকগুলো যার যার বুটের তলা থেকে মানুষজন্মের ইতিহাসগুলো পড়তে পড়তে বলে, শালী বাঁদরের বাচ্চা! বাঁদরের রক্ত খেতে চাও! লোকগুলো যার যার পোশাক খুলে লাফিয়ে লাফিয়ে ট্রাকে উঠে গেলো।

আবহমান সম্মাননা ঝরে পড়ে যায়
একগাছি সোনামুখো ধান নিয়ে এলাম বিদেশ-বিভুঁইয়ে। একটি একটি পক্ষীশাবক যে যার কাঁধের ওপর বসিয়ে নিয়ে ঘামে নেয়ে গেলো। কারণ, যে যার স্মৃতিকাতর ঘুমে একটি একটি পক্ষীশাবক অবশ্য পুষে থাকে। আমার হাতে সোনামুখো ধান, ঝরছে। পক্ষীগুলো ঠোঁটে ঠোঁটে আবহমান সম্মাননা খুঁটে খুঁটে খায়।

বিনিময়যোগ্য এই সন্ধ্যের অবসরে
অর্ঘ্যেমোড়া সন্ধ্যেগুলো অক্ষরের মালায় জড়িয়ে ফেরত নিয়ে নেবো। এই উদ্যানগুলো, যা তোমার কাছ থেকে ভিক্ষে নেয়া ছিলো, তুমি তাকে শীতের বৃষ্টির ভেতর নাইতে পাঠিয়েছো, তার পায়ের ধুলায় উড়িয়ে দিয়েছো তোমার বিনুনির ভাঁজে লুকোনো সন্ধ্যা। তোমাকে আমার গল্প বলার অনেক কিছু আছে... প্রথম প্রথম কাব্যগ্রন্থে লুক্কায়িত অন্ধকার আছে... তোমার আমার সন্ধ্যেগুলি গ্রন্থিত হয়ে আছে। আমরা ভালোবাসার ভান করে করে একসমুদ্র শামুক প্রসব করেছি; পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে উড়ন্ত ফরিঙের মতো উপেক্ষা করেছি সমস্ত ভূ-ভাগ। আর আমাদের সন্তানেরা একসমুদ্র জীবন পেয়ে দিগি¦দিক বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। কেউ বলে নক্ষত্র সে; কেউ বলে নিতান্ত রাত্রি। আমরা যখন আমাদের সন্ধ্যেগুলি বিনিময় করে থাকি, আমাদের সন্তানেরা, সমুদ্রের কতোটুকু গভীরতা ধরে হাঁটে! আর আর কী কী মন্তব্য করে তারা?

অধরা গভীর নির্জনে

জ্বলেছিলো ক্ষত
যা কিছু উদ্যত, তার
কিছু ব্যবহৃত, মাগো
একফালি নক্ষত্রের আলো
অমনি বিদ্যুত চমকালো

পুড়েছিলো দেহ
কিছু তার বিস্মৃত স্মরণ
অর্ধেকই পুড়েছিলো মন
ভাবি, ঘন বরিষণে
অধরা গভীর নির্জনে

আকাশে তোমার ভর্ৎসনা
আমাদের প্রিয় ঘটিবাটি
এ জন্ম নির্জনে হাঁটি
ও বকুল প্রিয় প্রিয় ফুল
কবুল কবুল
আমাদের যা যা কিছু ভুল

খসে গেলো ছায়া
যা কিছু ভেসেছে ক্ষত
তার সারা অঙ্গে মায়া

কে ফেলে নির্জনে আলো
অমনি বিদ্যুৎ চমকালো

নির্জনতা বলেছিলো

নির্জনতা একঝাক দোয়েলের ভিড়ে
আলস্যে এলিয়ে গেলো
ডানার লাবণ্যধুলো মুখ থুবড়ে পড়ে আছে
অমিয় সম্বন্ধ সুতোয়

প্রাচীন হাওরের ওমে ধুয়ে যাচ্ছে ভুলের মর্মর

নির্জনতা ভুলে গেল জলের প্রজন্ম-কথা
পানাপদ্ম ছোট্ট ঢেউ-- কেউ তাকে ফিরিয়ে
দেবে না আর

নির্জনতা বলেছিলো জলের কল্লোল বলে
যা কিছু অভাব্য সূচনা
নির্জনতা বলেছিলো : দোয়েলের নিভৃত বেদনা

ঘাসজীবন
আমার ঘাসজীবন থেকে তোমার সঙ্গে সখ্য করে
এতো দূর এলাম

তুমি মাছের কাঁটা বিছিয়ে রেখে একঝলক বিদ্যুৎ হাতে
বেরিয়ে যেতে পথে; সেবার
নক্ষত্রের শিশুদের কাছে আমার নিরামিষাশী
মেয়েদের কথা জানতে চেয়েছিলে
তাহাদের ফি বছর ছুটির তালিকা পৌঁছে দিয়েছিলে হাতে

আমার ঘাসজীবন থেকে একটি উদ্ভিদের বেড়ে ওঠার কথা
কখনোই হলো না বলা
আমার শস্যগন্ধা স্ত্রী, চতুর্দিকে মাছের কাঁটায়
আবৃত ছিলো চিরকাল-- তার জন্য
আমার মেয়েশিশুদের ভবিষ্যৎ নিয়ে এবার ভাবতে বসেছো

তাহাদের মায়েরা এবার প্রথাবদ্ধ জীবনের প্রতি আরক্তিম
বিক্ষুব্ধ হয়ে আছে
আর তাদের কনিষ্ঠ বোনেদের জন্য
একে একে নির্বাচন করেছে বিশিষ্ট সাতটি তারা

আজও যারা আকাশের বিদগ্ধ যুবক





বদলে যাওয়া

বদলে যাচ্ছে আমার প্রেমপত্রের ভাষা
প্রতিদিন একটি একটি দিব্য সত্যকে আমি খুন করে থাকি
পত্রস্থ অভিমানগুচ্ছে গুঁজে দিই মিলনের তুচ্ছতা

বদলে যাচ্ছে দেয়ালের ছবি। ইতরবিশেষে তারা কথা বলে
মধ্যরাতে ঘুমন্ত মৃতদের মতো প্রতিটি ভুলের স্বপ্নে
শালপাতায় ছেয়ে আছে তোমাদের সত্যদ্রষ্টা মুখ
কখনো সুখ সুখ মনে হলে
হাতড়ে হাতড়ে ছুড়ে ফেলি পুরোনো চিঠির বাক্স
রঙধনুর মতো তোমার শতাব্দীপ্রাচীন পোস্টকার্ড

নিষ্কাম যৌনতার দিকে খুব করে খেয়াল ফিরে আসে
আমার হাতের খোঁড়লে বেড়ে ওঠে
সমুদ্রের প্রমত্ত অন্ধকার শোক
পিকাসোর অন্ধকার ছবি, ফ্রেমবন্দী মেঘ
নিকোটিনের সমান বয়সী কবি
প্রত্যেকে হাত ধরে ধরে
পবিত্র সভ্যতার দিকে লেলিয়ে দিয়েছি
আমাদের ক্ষুধার্ত যৌনতা

আমরা ভিক্ষে করে যা কিছু পাই
ঐসব রক্তাক্ত যোনি, আরব্য রজনীর শোক...
যার যার থলের ভেতর লুকিয়ে দেখেছি
তারা কথা বলে আদিম অর্চনা ভেঙে

আমরা প্রাক-বৈবাহিক লোভে দেহ দান করে
অনর্থই ঘোষণা করেছি বৃষ্টি
আমরা নগরে নগরে ঘুরি
যার যার ডিজিটাল চোখে
বিনিময় করি পথে পথে খুনের গাণিতিক অভিজ্ঞান
আমাদের বিদ্যাভবনের ক্লাসে
প্রতিটি রুটিনের দিকে ফুটে ওঠে
আমাদের নির্মল পদচ্ছাপ, অবজ্ঞাত হাসি...
আমরা বদলে বদলে আসি
আমরা বদলে বদলে যাই
আমাদের আদগ্ধ ওষ্ঠের ভাপে শতাব্দীর প্রার্থনারত হাত
আঙুলের ন্যুব্জতায় অতি দূর সমুদ্রে মিলিয়ে যায়

এ গল্প জানে না কোনো শিশু প্রজাপতি

শৌখিন শিশুটির কাছে একগুচ্ছ ফুলের মালা পড়ে আছে
ফুল নিয়ে আমাদের ধারণা অনেক
একঝুড়ি কাগুজে ফুলে কতো কী সম্বন্ধ হয়ে যায়
মনে মনে ভাবি, আকালের সম্পর্কগুলো
এই ভাবে, রূপ-অন্ধ মানুষের ভেতর সুখ্যাত বেশ

ফুলে ফুলে সম্বন্ধগুলো রটে আছে পুরাকাল হতে
এ গল্প জানে না কোনো শিশু প্রজাপতি

আমাদের মহত্ত্বগুলো আলোয় বিবর্ণ হয়ে ঝরে গেছে কাগুজে ফুলে
কেবল শিশুটির পাশে থরে থরে পড়ে থাকে
প্রকৃত গোলাপ, মালতি


বোবা রাজকন্যা

একজন কৃমি-ব্যবসায়ীর বয়স বেড়ে যাচ্ছে দ্রুত
তার হাতের ভেতর একমুঠি স্খলিত নক্ষত্রের দিকে
চেয়ে আছে বোবা রাজকন্যা
কখনো খবরপত্র পড়েনি সে; অথবা বিজ্ঞাপনচিত্রে
সুডৌল কিশোরীর মতো তার কিছু হারাবার কথা
আজও তো ভাবেনি কখনো

অথচ ইচ্ছে ছিল মিস ইউনিভার্স নামে যে কোনো
বহুজাতিক দেয়াশলাই বাক্সে তার কিছু
কৃতি থেকে যাক
আর তার সুরক্ষিত অন্দর ভেঙে উড়ে যাক
বুনো খেকশিয়াল

আজ তার মাস্টারমশাই সুদীর্ঘ সিক লিভ নিয়ে
যমুনার ভাঙনের দিকে ফিরে গেছে গ্রামে
একটি নক্ষত্রের কথা ভুলে গেল সে
ফরাসী সুগন্ধী হতে উড়ে গেল ক্ষুধার্ত মক্ষিকা

একজন কৃমি ব্যবসায়ী অহেতু সমুদ্র ভ্রমণে যায়
ফি বছর বর্ষালগ্নে মুঠি মুঠি নক্ষত্র সে
সঁপে দেয় বোবা মেয়েটির পায়


একটি রক্তরঙা ফুল

একটি রক্তরঙা ফুল
আমার বুকের কাছে বিশ্রাম করে গেল এতোকাল
তার রক্তাক্ত নাভিতে কিছু জোছনা জমেছিলো?

বুভুক্ষু চৈত্রের হাওয়া
আমি বুক উজাড় করে শুয়ে আছি আশটেগন্ধা রোদে
একটি রক্তরঙা ফুল, বলেছিল
বর্ণান্ধ মানুষের বৈরাগ্য কিছু

পৃথিবীর তাবত রক্ত শরীরে মুড়েছে সে
একটি রক্তরঙা ফুল
তার রক্তাক্ত নাভিতে কিছু মৃত্যু জমেছিলো


সেবার শীতে একটি শিশু
ভূমিষ্ঠ হলো
চায়নার কোলে শিশুটিকে তার মায়ের মতো স্নেহময়ী মনে হলো
চায়না তার জন্মোৎসব বলে কিছুই ভাবেনি কোনোকালে

আজ তার শিশুটির জন্মদিন ছিলো
একটি বৃক্ষের দিকে তাকালো সে

একটি হলুদ পাতা, একঝাঁক খাঁ খাঁ বৃক্ষের কথা মনে পড়ে গেলো তার

জাকিয়ে বসেছে শীত
একটি ভূমিষ্ঠ শিশুর ক্রন্দনধ্বনি মনে পড়ে গেলো তার


এ কোনো দুঃসংবাদ নয়

এই সব হাড়-মসলার গল্পের মতো আমার তো
চোখ-কান ফুঁড়ে বেরিয়ে পড়ছে
ডোমকন্যাকে নিবেদিত প্রেমপত্রের ভাষা

অতএব ব্রিজের তলায় বসে
কয়েক সহস্র জামপাতা ঘিরে
আমাদের যে অগ্নিকাণ্ডের মতলব জুটেছিলো
আমরা যে উৎসবের জন্য অগ্নিকেই ভেবেছি অমোঘ

আমাদের ঘুম চলছিলো, আর এক এক করে
রেলব্রিজগুলো উড়ে যাচ্ছিলো
শকুনের ডানার ঝাপটায়

পৃথিবীতে এ কোনো দুঃসংবাদ নয়
এ খবর বয়ে এনেছিলো আমাদের পাগল হবিদাস


রোকেয়া হল : এক্স-১

ঘোড়াটি ছুটছে; নিবাস বিশেষে এ খবর রটনা করে কি কেউ?

ঋজুমন, দেয়ালে দেয়ালে শিলালিপি হতে
যার যার যৌবনযাপনকালে, পোশাকের রঙধনু নিয়ে
সুদীর্ঘ নিবন্ধ রচে থাকে। তাদের উদার প্রান্ত
কিংবা ব্যাপক বন্ধনীগুলো, অধিকৃত ভাঁজে ভাঁজে
মেহগনি দরজার ফাঁকে উঁকি দেয়

নিবন্ধের ঘোড়াগুলো ভূরি ভূরি বাক্যের বন্যায়
অতিশয় দুরন্ত প্রাচীরে, বৃষ্টি আর প্লাবনের আগে হেরে যায়...

অন্ধকার বাড়িময়, এমন উৎসব না হয়
বিপন্ন কান্নার কালে
পরিযায়ী অশ্বগুলো নীলক্ষেতের গহীন কচুরিপানায়
ঝিনুক সন্ধানে নেমে পড়ে

রোকেয়া হল : এক্স-২

বৃক্ষকুল সঙ্কলন করে এই সন্ধ্যা এলো

সারাবন গাছপালা থেকে মনোযোগ এসে
আদিম অনন্য শব্দের অতীতে নত হয়

জলের বাহুল্য হতে সমবেত ঝরনার ঐশ্বর্যে
দেখো, কারো কারো নাম হয়
মেঘবৃষ্টি, প্রকাণ্ড ফোঁড়নে। এলায়িত পঙ্ক্তির মূলে
কম্পমান হরিণেরা জল দিতে নেমে
দেয়ালে দেয়ালে এসে ঠেস দেয়

প্রতীক্ষার কালোজল পোশাকের সমারোহে
কতটা বর্ষিত হলে, লোহার শৃঙ্খল ভাঙে
এলোমেলো চতুর হরিণী?

ঘরে ঘরে আলো নেই--
নিষিদ্ধ তামাশা হলো এ বাড়ির প্রাচীন নমিনি


ছাত্রীনিবাস : এক

শীতল জোছনার ভিড়ে বড় হয় ঝিনুকের ভ্রম
শীতের স্নিগ্ধতা হয়ে প্রজাপতি
আঁকিবুঁকি লিখে রাখে ডানার কল্পনা

খোলো খোলো নিঝ্ঝুম রাত
স্বপনের মরীচিকা দূরের সিন্ধুর পারে
মোতির প্রেরণা হয়ে, ঝিনুকে ঝিনুকে ডুবে জড়ো হয়

এই সব বালিয়াড়ি ঢেউ
কেউ কেউ শিখে নেয় নিতান্ত প্রহরে

ফলবতী কেউ কেউ অপার রজনী শেষে
আজো নাকি সমুদ্র দেখেনি ঠায়


ছাত্রীনিবাস : দুই

অদূরের খেয়াগুলো এই ঘাটে ভেড়ে নাকো আর
পারাবত উড়ে থাকে সুকল্প দৃশ্যের প্রয়োজনে
মাঝি এক চলে গেছে জোয়ারের শানবাঁধা ঘাটে

এ-পারের মাছ নাকি অতিশয় আদরপ্রবণ
কেউ ছিল কেউ নেই, তাকে আর রচনার
কত জল বাকি! উড়েছি শিমুল ভ্রমে
ঘাসের সান্নিধ্য ছেড়ে এ প্রকার ভালো থাকা
হয় নাকি করুণাপ্রবণ? যদি এই কান পাতি
চৈত্রের দাবদাহে মাছের মড়কের ভাষা
কোনোদিন মনে ধরা ভুল হয়ে যাক

শেকলের রতিস্বাদে ঢুলু ঢুলু প্রাচীর কুসুম
একদিন ভেসে ওঠে-- ব্যাপক নন্দন জলে





ছাত্রীনিবাস : তিন

আঁধারের ধুপ জ্বেলে ফিরে গেছে রাতের সারথী

মলাটের ভাঁজ খুলে জ্বলে ওঠে কামনার রঙ
অথচ প্রহর তার গুন গুন সারাক্ষণ
প্রতিবেশী, অভিমান আঁটোসাঁটো তুষের আগুনে

জোনাকির ঘরগুলো রাতের কপাট সেঁটে
একে একে ডুবে যায় তারার আঁধারে

অভিবাসী মন; ক্রমে-ভ্রমে খুঁজে নেয়
নিশুতির ভাঁজ। ধোঁয়ার কুণ্ডলি উঠে
চড়ে বসে অগোছালো শরীরের ঝড়ে
‘এই ঘরে কেউ নাই’ অথবা তাহারে সঁপেছি এমন
স্বমেহন সারল্য বা নিতান্ত ঐশ্বর্য তার...

প্রগাঢ় রাত্রির শেষে
দেয়ালের চিকাগুলো ধূসর ধূসর লাগে খুব

ছাত্রীনিবাস : চার

থেমে থেমে উড়ে যায় বেদনার শতরঙ বক
গহন শস্যের বনে ভূমিহীন কৃষকেরা
লাঙলের ফলা নিয়ে নিকোটিনে মোহ রচে থাকে
মরসুম নেমে এলে কদাচিৎ রাখালেরা
কামনার চারাগাছে ঊষর উদ্যানে
জুড়ায় তৃষ্ণার গলা। অতিশয় রোপণের কালে
প্রযুক্তির সুশাসন শরীরের খোলামাঠে
প্রতিবার ব্যবহৃত হলে, সুঠাম কৃষককুলে
ঝুড়িগুলো ভরে ওঠে চিটায় চিটায়

ছাত্রীনিবাস : পাঁচ

রৌদ্রের আড়ালে ডুবে থাকে এক স্বর্গের সীমানা
সূর্যের প্রক্রিয়া শিখে এ ধরাকে খুব করে
নিরাপদ মনে হয়। আর এই শিখেছি ভ্রমণ
তরল জোছনার সাথে বাহু বেঁধে অবারিত ঘুম

সখিরে অধরে করে পড়ে আছে প্রাচীন ঈগল
রূপ নেই ধাতু নেই সাবলীল দিন যায় তবু
দেবদারু বন থেকে জ্যোতি এসে চুমু খেয়ে গেলে
শিহরণ থাকে নাকি শরীরে শরীরে ঘুরে?
অথবা বৃষ্টির ছাঁটে কেমন চাতক বলো
নির্ঘুমে অস্থির কাটে! এই এক ধরা আছে
অধরার জোনাকিরা অদ্ভুত যাপনে কাটায় বিভোর সময়

ছাত্রীনিবাস : ছয়
বহুদিন জলঘুমে, ধুমকেতু উড়ে গেল আজ
সাবলীল নেচেছিল এ বাড়ির ধূপদেয়া বধূ
বোধের সিঁড়িতে হেঁটে সারা ঘর জুড়ে নেয়
অবলা কুসুম। অতঃপর ঝড় আসে
গরাদের মোহ ভেঙেচুরে। আদিম সংখ্যার পাঠে
পাঠ নেয় থেমে থেমে নামতা কুমারী ভীরু?
দুই চোখে জ্বলে যায় অনাহূত ধবল পুরুষ
ফলে তার ছায়া পড়ে আদিম রাত্রির যামে
বাজারের ঝুড়ি ঘেঁটে তুলে নেয়া অসাড় পৌরুষ
এ ঘরের ইতিহাসে সফল রাজত্ব শেষে
একদিন নীহারিকা ঝরে যায় ধূমকেতু হয়ে

ছাত্রীনিবাস : সাত
প্রতিবেশী ঘর ছেড়ে উড়াল শিখেছো নাকি বিভোর ডানায়
অধরে ঝিলিক ছিলো, আয়ু তার নিভে গেছে
ক্ষীয়মাণ বলিরেখা হয়ে। আরো এক রীতি আছে
সরল সখ্যের শেষে সীমানার দূর জেনে
কেউ কেউ উড়ে থাকে যতোটুকু চেনা মনে হয়
ব্যাপক শৃঙ্খলব্যাপী তারাগুলো জ্বলে থাকা
প্রতিদিন গণিতের বাহুল্য হিসাব। নীহারিকা
খসে গেলে জলের প্রপাতে ভেসে, আরো এক
গ্রহ রচে থাকে। ডানার আখ্যানে আঁকা
প্রজাপতি কারুকাজ ইতিহাসে ভুল লেখা হয়

ছাত্রীনিবাস : আট
জলের সিঁড়িতে ওঠে শরীরের ঢেউ; পোশাকের
মোহ জাগে ঝরনার তুমুল বর্ষণে। এই করে
শুরু হলে কাহার বন্দনা করে উঁকি দেয়া শরীরের ভাঁজ?
একে একে খসে থাকে আচরিত বস্ত্রের ওজন
আঁটোসাঁটো সারাঘর, ছলাৎ শব্দের ভিড়ে
অনূদিত শীৎকার বাজে; আদিম অর্চনা এই
ঘরে ঘরে নেমে এলে, দূরের ইথারে ভাসে
ক্লান্তির আরাম।... স্নানাগারে জড়ো হয়
দিনমান মনে মনে, অভিলাষে রচে থাকা কামনার মুখ
ঝড়ের প্রাবল্য হয়, আবেদিত মনোরথে, ভেসে আসা
পৌরুষ আদল, অতঃপর নিভে আসে, প্রমাদের
আলোছায়া প্রণয়ের শ্বেতাভ সলিলে

ছাত্রীনিবাস : নয়
ঘরগুলো ঘুম পাড়ে মাঝরাতে অবারিত ঘরে
কাহার কান্নার ধ্বনি অশরীরে ফুঁসে ওঠে বিষাদের ঢল
পাঁজরের হাড় ভেঙে গুমোট বাতাসে জ্বলে বিরহের মাস
ভুলে ভরা ছায়া তার জুড়ে আসে নানা বিশেষণে

ইথারের চাঁদ হলো ঝুলে থাকা আতপ্ত আগুন
তারাগুলো নিঝ্ঝুম উনুনের খোলামাঠে ঝরঝর
খইয়ের গুন গুন। গরাদের স্নেহ ছুঁয়ে নেমে আসে
বারুদের ঘ্রাণ, কখনো রজনী হয় জমাট রক্তের
ভাষা, অবলার গান। পাথরের ব্যথা জাগে
দেয়ালে দেয়ালে ঘেরা হিমালয় ঘরে। একদিন প্রতিদিন
ভালোবাসা জ্বলে গেছে থেমে থাকা বেদনার ক্ষতে

ছাত্রীনিবাস : দশ
আয় সখি গুন গুন সারাক্ষণ তাহারে বলেছি যাহা
এসব জৈবিক ভাষা তেঁতুলের স্বাদে কেনা তরল গরল
বেহুলার অপলাপে নরের শরম হয়ে
জনে জনে ছুটে যায় স্বজাতের ঘর ভেঙে ঘরে
অথবা এমন ঋজু কেহ তারে শোনে নাই
এই এক স্বরাজ তাদের যতো গূঢ় বলে রাখা
স্বধীন অসুখ। কেবল আরোগ্য থাকে প্রাচীরের
পরপারে জনমন সুসভ্য নিবিড়ে। অথচ নগর এক
ঠায় পায়ে বসে আছে নগরের ভিড়ে
রতি-মদ-শীৎকারে সেই এক সংলাপ রচনা করে


ছাত্রীনিবাস : এগারো
কোনখানে থেমে গেছে অধরার দুরন্ত গমন
সারাবেলা গেঁথে যায় পাখিকুলে পালকের প্রেমে
অথবা স্বাধীন স্বভাবে বাঁচে বিপুলা সমুদ্রবাসী
কোলাহলে থৈ থৈ জলের গুঞ্জনে কাটে
মোহনার প্রাগে। সেই এক প্রাচীর শাসন
সঘন সন্ধ্যায় জাগে ঋজু মাথা তুলে
দেহ ঘর জুড়ে থাকে খোলা-মাঠ স্নেহ-ছায়া
সখা-সখি প্রাণের উচ্ছ্বাসে। অতঃপর ঘুম ঘুম
ছায়া নামে আবদ্ধ আখরে, বিষাদের খোলা-ঝিলে
মাছেরা সাঁতার শেখে শেকলের টানে

ছাত্রীনিবাস : বারো
অধীনের দুই সখি, মুখোমুখি, ডুবে যায় চূড়ার আঁধারে
প্রণয়ের দেয়া ঝরে চঞ্চু আর বুকের উত্থানে
কোন ভ্রমে খসে যায় এলোমেলো পাজামার গিঁড়ে
অথৈ পদ্মের ভাঁজে ফুঁসে ওঠে অসুখের ভাপ
মুখোমুখি দুই সখি কে কার তীর্থের পাখি...
বোশেখের কালো ঝড়ে অগাধ ভাংচুর শেষে
ঘামে ডুবে যায়। বেঘোরে ঘুমের শেষে
কোনো কোনো রাত হয় অভিমানী খুব। অগোছালো
জোড়া সখি, বোধের অতীতে বসে প্রাচীন রচনা থেকে
তবু ঘরে পাঠ নেয় চরম অর্থের ভাষা

ছাত্রীনিবাস : তেরো

পাঠের আনন্দ এসে শিয়রে শুশ্রুষা রাখে
সখিনার সারাদিন সরব ক্যাম্পাসে কাটে
রোদনের কালে। ঝর ঝর পাতা ঝরে
ব্যথাক্ষত ক্লান্তির ওপর, অথবা এমন
হাওয়া, শীতল স্নিগ্ধতা ওড়ে অভিবাসী
খোলা সরোবরে। সাবলীল ছায়া ধরে
ঝুলে আছে প্রহরের কাল, ঘরে ঘরে শিশুমন
অভিলাষে ফিরে আসে অতিহৃত করণীয় ঘরে
ভাবনার সরুজাল, ঘুম ঘুম খেলা ফেলে অতিদূর
নিসর্গে ওড়ায়। এলোমন ঝিমঝিম পাঠের প্রেরণা
পেলে, নিথর মগ্নতা রাখে পাতায় পাতায়

ছাত্রীনিবাস : চৌদ্দ

স্মৃতিগুলো নড়েচড়ে, ধানগাছ স্রোতের প্রাবল্য পেলে
যতোটা হারায়। প্রজাপতি শিখেছিলো ডানার সুষমা শুধু
ওড়াউড়ি, ছায়াশীল নয়। ওপরে হাউইগুলো
চতুর বিস্মৃতকালে ব্যাপক স্বচ্ছতা ধরে হেঁটে যায়
অভিবাস ছেড়ে যাবে, ছেড়ে যায়, ছেড়ে গেলে
ব্যবহৃত ব্যথাগুলো হৃত কাল হৃত প্রেমে
সরল জাজ্বল্য হয়ে দূরের নিঃস্বতা ঘিরে
বড়ো হয়। প্রসারিত ব্যাকুলতা ছায়াময়
হাতে হাতে অবাধ মমতা রাখে। ধু ধু পথ
টনটনে ব্যথা-ক্ষত কাঁটাময় স্মৃতি হতে
কেউ কি গো কোনোকালে স্নানে ভিজে থাকে!

তোমার রোল-কল মানে

রোল-কল করে পেয়ে গেলেই, ভাবনা হয় :
আজ আমার অফিস ছিল না কোনো?

সমুদ্র বেড়াতে গেলে তোমার মধ্যে
নানা ধরন প্রতিক্রিয়া হয়
তোমার রোল-কল, মানে যথার্থ হিতোপদেশ পেলে
একপাল ভেড়ার দঙ্গলে আমি অসহায়

ভেবেছ স্নিগ্ধতা বুঝি...
উড়োপাতাদের দিকে নজর এলিয়ে বুঝে থাকি
তোমার মুগ্ধতা

তোমার প্রসিদ্ধ আহ্বান মানে :
ছেঁড়া বাবুইয়ের বাসায় পরিযায়ী কাল

যদি মুক্তি চাই, অভাব্য কসরতগুলো
মেঘে মেঘে বিদ্যুচ্চমকের মতো ঝলসে যায়
বাতাসের গমগম ধরে ভেঙে যাই ঝড়ের প্রাবল্যে

যে তুমি উদাত্ত মহিমা, অনর্থ ভঙ্গিমা করে
সামান্যই ডেকেছিলে বলে-

এই তো সুবোধ শিক্ষার্থী হয়ে আছি


গভীর শূন্যতার দিকে

দ্যাখো, উপভোগ্য বলে কিছুই রইল না আর

গাছপালার ন্যুব্জতার দিকে যে বনের মর্মর শোনা যায়
অবশ্য এক্ষণই তা মিলিয়ে যাবে
ভাঙ্গনপ্রবণ এই ঘোলা জলস্রোতে

দস্যু ও মাঝিরা আজ অলৌকিক অন্ধকার নিয়ে
বসে গেছে চূড়ার আড়ালে
একাকী ভাঙ্গনগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে দিলে সাড়া পায় তারা

জলবিদ্যুৎ নিভে গেছে রাত্রিদূত চাঁদের খোঁড়লে
নিঃসঙ্গ সৌন্দর্য নিয়ে বসে আছে মনভাঙা চাঁদ

কিছুই রইল না আর উপভোগ্য বলে

যারা যারা মেঘের স্নিগ্ধতা নিয়ে
ময়ূরের পুচ্ছ নেড়েছিল
ছুটে এলো সদম্ভ সমুদ্র-সন্ধ্যায়
অহেতুই অরণ্য-গ্রহণে তারা
ঢেউয়ে ঢেউয়ে গভীর শূন্যতার দিকে
চলে গেল...




তামাশা

তামাশা হচ্ছে...
তবক দেয়া পানে তামাশার রুচিবোধ নিয়ে
শংসয় কাটে না। তুমি সুন্দর, কিছু
বালখিল্য রকম। চশমার বাঁকানো হাতল, তাতে
অনর্গল পড়ে ফেলা যায় সহাস্য রূপের বর্ণনা

যথেচ্ছই তামাশা হয় দেখা-অদেখার সম্ভাব্য রূপে
এই ভবরূপ, ভূগোলের যথার্থ উপমা। যে যত
পতিত মানুষ, অবশ্য তামাশা তাকে কখনো ভোলে না

ঋজু চোখ যায় নক্ষত্র, চূড়ায়-
ভূ-তলে সামান্য মানুষ সুডৌল হিমালয় হতে
তামাশায় বিশিষ্ট করুণা

অধিত গহ্বর থাকে শ্রেণীকৃত তামাশালোকে
লোক-অধিলোকে সমস্তই উৎকৃষ্ট অপেরা

উঁচু উঁচু মানুষেরা এই সব রচনা করে


কম্পন

ময়ূরের পুচ্ছ নাচা হলো
নড়ে ওঠে নরম নিশ্চিন্ত ঘুম
তোমার জাগ্রত গলা
অবিশ্বাস্য বিশেষণে কেঁপে ওঠে
সামন্ত ঘরের বউ
যার হাত
ন্যুব্জ অলঙ্কারে
সে তার নিক্বণে বোঝে কম্পনের ভাষা
পৃথিবীটা কাঁপে
ক্বচিৎ-বা খসে গেলে নক্ষত্রের ফোঁটা
কাঁপে বিদ্যুরেখা, ভয়ার্ত বৃষ্টি-সম্ভবা মেঘে

সংক্ষুব্ধ আগুনে কাঁপে দাহ্য জলকণা
মাটির হাঁড়িতে কাঁপে উনুনের ভাত

ঋজু ধানগাছ, কখনো স্খলিত জলে কাঁপে অবিরাম
এত ঝাউবন, ছেঁড়া কলাপাতা-- প্রমত্ত বাতাসে কাঁপে
নানা প্রকরণ

অঘোষিত প্রভু, রচিত সাম্রাজ্য থাকে
আদি-অন্ত ঘুমে
জ্বরের প্রাবল্যে কাঁপে নিপীড়িত প্রজা
যদিবা পর্বত কাঁপে--
মসনদ কাঁপে না তো সিংহনাদ ছাড়া





মৃত্যু

অযথা বাক্যব্যয় হতে মৃত্যু অনেক উৎকৃষ্ট বেশ্যা
ধাতব সখ্যের মতো সুনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে ছুটে যায়...
মুছে দেয়-- যথাসাধ্য ঘামক্লান্ত মানুষের পরিব্রজ রীতি
সংরক্ষিত দ্বারের গোপন ভুবনে থেকে
সহৃদয় ছোবলের বেশি প্রিয়তম বলে হাঁক দেয়

বহুঘ্রাত যোনির গহ্বর হতে কালোপক্ষের
জোছনার বেশে কৃষ্ণদাঁতে বলে, আহা কী
আদিখ্যেতা, এই নাও ভুবনের কষ্টকৃত মানুষের
লালসার ইশতেহারনামা। সুনিশ্চিত ডুবে দেখো
ব্যথা-হৃত বেদনার ক্ষত থেকে, কী ভাষায়
উগড়ে পড়ে ভেদবমি ক্রমাগত জলস্তর হতে...
অনিবার্য অবসর থাকে, না-ফেরা সমুদ্রে ঘোরার
অযথা বাক্যব্যয় হতে যা কেহ কখনো পাবে না

ক্ষুদ্রতার প্রতি অবজ্ঞা

যথেচ্ছ মৃত্যুর দিকে তাকাবো না
শীত-গ্রীষ্মের ভেতর থেকে তা খুব
নিঃশব্দে বেরিয়ে পড়তে পারে
যে কোনো পরম নির্ভরতায় ঝুলে যেতে পারে
লাউগাছের মাচায়
আমার দৃষ্টিপাত কোনো ঝুলন্ত অস্তিত্বকে লক্ষ্য করে নয়
খোলা প্রান্তরের দিকে শস্যশূন্যতা
বা কোনো মেঘভর্তি নক্ষত্রহীন আকাশের দিকে নয়

কখনো মৃত্যুর দিকে তাকাবো না
যতটা না বৃষ্টি পতনের দিকে দু’চোখের মুগ্ধতা থাকে

অমার্জনীয় বেলীফুলের স্নিগ্ধ মুগ্ধ ঘ্রাণ
অথবা ভরা বর্ষার কদম্বের কথাই বলি--
যে কোনো ছুটির দিনে তাহাদের মৃত্যু হলে
একা একা পাহাড়ের দিকে ছুটে যাই...
সুউচ্চ চূড়া হতে, তখন কী ক্ষুদ্রই না দেখায়

আমাকে!

সাম্প্রতিক পৃথিবীর মতো অবিশ্বাস হতে

আমাকে ছুড়ে দাও নিস্তব্ধ বাতাসের দিকে
কালো ফ্রেমের মতো সন্ধ্যা, সন্ধ্যার অবিমর্ষ চাঁদ
আমাকে সাজতে দাও সাদা বৃষ্টিপাত, জোছনার পোশাকে

তুলে নাও সমস্ত প্রার্থনা-- ঘন ঝাউগাছের ছায়া
চালতা বাগানের ভেতর চালতা ফুল, ঘুমন্ত বাতাসের দিকে

আমি দেখি পাখির বন্দনা
নিঃসঙ্গ তালগাছে বাবুইয়ের ঝুলন্ত সংসার যাপন

ঘরে ফেরা সন্দিগ্ধ কুমারী, ধানভানা বধূ


নির্যাতিত প্রজা ডুবে যাবে পয়মন্ত ঘুমে

আমাকে শুশ্রুষা দাও বিকলাঙ্গ নিস্তব্ধ বাতাসে
অঢেল সোনাইল ফুলে বিগলিত ঘ্রাণে
আমার প্রার্থনা রাখো অন্ধকার দুর্বিনীত নদী
তামাটে ধীবররাজ, দুর্দান্ত গলিত মানুষ

ভেজা শরতের ঘাস, কুয়াশার্ত ক্ষেত
বিতাড়িত বেকার যুবকের মুখ, ভূমিষ্ঠ শিশুর কান্না
সাম্প্রতিক পৃথিবীর মতো অবিশ্বাস হতে
আমাকে নিষ্ক্রান্ত করো বায়ু-শূন্যতায়














পূর্বপুরুষ

পুবের হাওয়ার ঝাপটায় আমার অবিশ্বাস ভেঙে যায়। প্রাচীন তরু মর্মরের নিচে আমার পূর্বপুরুষের বিশ্বাসের কথা লিপিবদ্ধ আছে--ভেঙে-পড়া সুপ্রাচীন দালান, রক্তাক্ত হরিণের ছাল, ঈগলের ডানা।...
প্রিয় জলতরঙ্গ বাজে, বিভিন্ন বেশ্যার হাতে দুলে ওঠে মদের পেয়ালা, গ্লাসের টুংটাং... আর চতুর নিক্বণ ধরে আনগ্ন বাঈজীরা এসে ভর করেছিল আমার পূর্বপুরুষের মর্মে। কেউ কেউ বনেছিল তারা তৃতীয় চতুর্থ বা শততম পিতা। ঢ্যাঙা রাজহাঁস জলের সারল্য ফেলে যদিবা চিৎকার জুড়েছিল, শত শত দাসী-চাকরের বুকে গর্জেছিল ভয়ার্ত আরশ বিদীর্ণ কান্না। আমার পূর্বপুরুষেরা অনর্থ ভণিতা ভেঙে প্রিয় বুলেটের ঠোঁটে শিকার ধরেছে অজস্র বেয়াড়া প্রজা। নিবেদিত গ্রামোফোন বাজে, আহা আমার আদি পুরুষেরা অলক্ষ্যে ঘুমিয়ে পড়েছিল ক্রমাগত অগণ্য বেগমের বুকে

প্রিয় অন্ধকার আমার

আমি যে অন্ধকারের কথা ভাবি, তার পা দুটো ঠিক চেয়ারের হাতলের মতো এলানো। গত শতকের দিকে একবার ঝুঁকে পড়েছিল ঘরের বাঁকানো সিঁড়িতে। মিট মিট নক্ষত্রের দিকে তার চলার উদগ্র বাসনা দেখে একবার পাঁজাকোলা করে তাকে ছাদে শুতে দিই। প্রিয় অন্ধকার আমার, শরীরের ঘামাচির মতো ডলে দিয়েছিল সমস্ত জোনাকির রঙ। মাঝে মাঝে উদারাময় হলে তার চোখ দুটো ভেজা বালিশের মতো চুপসে যায়। যথেচ্ছ ভেদবমি তার, ঘরময় ভেসে ভেসে, সন্ধ্যা হলো হলো হঠাৎ রাত্রির গায়ে মিশে যায়। আমি যে রাত্রির কথা ভাবি, সারাদিন তারা হৈ হৈ করে নীচুস্তর মানুষের মাঝে। তার হাত দুটো কাঁচা সবজির মতো দাক্ষিণ্যে ভরে, জুড়ে নেয় পুরোটা স্বদেশ। আমার সংসারে তাকে প্রতিপালনের জন্য, দাসী-চাকরের অভাব ঘটে না। ফলে সে আমাকে রোজ চোখে চোখে রাখে সারাক্ষণ। পরমই স্বাস্থ্যবতী সে। আর এবার জানাজানি হলো, ফলবতী অন্ধকার আমার, সংসারের অলিগলিগুলো শতাধিক সন্তান দিয়ে ভরে দেবে


উদ্বাস্তু মা ও তার কিংবদন্তি শিশুর দিগন্ত

চুলগুলো কাত হয়ে আছে দিগন্তের দিকে। বর্ষার ভরা বর্ষণের ভেতর প্রিয় আবাসনগুলো ভেসে যায়। মাটি ও স্নিগ্ধতা নিয়ে বেঁচে যায় এরা-- পাতালের দিকে। ঈশ্বরের সৌন্দর্যগুলো পরিচর্যারত এই গন্ধ-প্রহরে। অগণ্য সামান্য মানুষ বিহ্বল পৃথিবীর ঘোরে সমস্ত জীর্ণতা নিয়ে বসে থাকে । আদিখ্যেতা মজে যায় স্যাঁতসেঁতে ভেজা বালিশের ভাঁজে, বানেধোয়া উদ্বাস্তু ঘরে। কিংবদন্তি শিশুগুলো ঘোলা কুয়াশার মতো ম্রিয়মাণ হলে-- মা তার শিয়রের পাশে, বিপন্ন গ্রহণের দিকে নিভে যেতে দেখে একটি পিদিম। বহু দূর, দূরে-- মিটিমিটি নক্ষত্র থাকে প্রভুগণে অপার সৌন্দর্যপাড়ায়। কেউ তা দেখে না-- ছেঁড়া-ছিন্ন পরিধানে ঘাম-চিটিচিটে কেশদাম, ক্রমশই তা কাত হয়ে হয়ে অনিবার্য মৃত্যুর দিগন্তে যায়...



বিনম্র প্রার্থনামূলে

যা তাকে বিচ্ছিন্নতার দিকে নিয়ে গেল
সেদিকে পিছন ফিরে ঘুমিয়ে কেটেছে

সাদা ভাঁটফুল
সমস্ত প্রত্যক্ষ করে রাখে
আপাত দুর্লঙ্ঘ্য বলে প্রাত্যহিক সূচিতে মজে
আরও দূর নিবিষ্টতায় এসেছে সে

মুখরতার এপ্রিলগুলো কে কেন বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়?
ভেঙে যায় ঔজ্জ্বল্যের চাঁদমারি!
বিনম্র প্রার্থনাগুলো অধিকন্তু ফলপ্রসূ হলে
সুশীল মৃত্তিকা হতে
শুষে নেয় আর্দ্র জলকণা!

কে কত বিচ্ছিন্ন থাকে--
বোঝা যায় :
সাধ্যাতীত অনুগত হলে
ফলাফলে


সাদা বেড়াল আর যুবক মেয়েটি

এখন ক’দিন ঘুমিয়ে যাবো যেমন অনেক দূরে
সাদা বিড়াল ঘুমিয়ে আছে সিন্ধু নদী খুঁড়ে

বাঁকের যুবক মেয়েটিকে দুধের গল্প বলা
সিন্ধু বিড়াল বলেছিল, মহৎ শিল্পকলা

অথবা তার ভেজা পায়ে একটি নদী এঁকে
রাজকুমারীর গল্প শোনো হাজার জীবন থেকে

কুমিরগুলো আছড়ে বেড়ায় জলের চতুর্পাশ
ধবল-কোমল পা দুটো তার কুমীরপুরীর ত্রাস

ঢেউয়ের তোড়ে ভেসে গেছে কুমড়ো ফুলের মাঠ
সাদা বেড়াল করছে শুরু নতুন জীবন পাঠ

সাদা পরীর ঝলসে গেছে অমল ধবল মুখ
উরুজলে বেঁধেছে সে আশার সমান বুক

যেমন অনেক খুন হয়ে যায় জলের হাঙর মাছ
সুতরাং সে হাল ধরেছে একটি তৃণ গাছ

এমন তৃণে জমেছে তার বুকে তিমির কালো
উরুসন্ধির মগ্ন ত্রাসে মুখ হয়েছে আলো

সাদা বেড়াল মুখ খুলেছে : ‘ঢলে পাওয়া মেয়ে
বালুতটেই ঘর বেঁধেছে একটি জীবন পেয়ে’

আমরা এখন ঘুমিয়ে যাবো যেমন বহু আগে
সাদা বেড়াল লুকিয়ে ছিল শোণিত-সংরাগে

সরে যাবো, অন্ধকারে

ঋতুভেদে আমাদের ফিরে যেতে দাও সরে-যাওয়া অন্ধকারে
বন্ধ হোক অনিবার্য হাতসাফাইয়ের ভেতর আমাদের মৃত্যু কামনা

কখনো স্নেহবন্ধনী, আমাদের মৃত্যু উপত্যকার দিকে
ঠেলে নিয়ে যাবে...
ফেলে যাওয়া হাড়গোড়, রক্তাক্ত ক্ষত
দলিত শ্যাওলার মতো ভেসে চলে যাবে অনার্য সভ্যতার ভেতর...
অসামান্য বাড়ি, ব্যবহৃত পৃথিবীপৃষ্ঠে পালানের মুথাঘাস হতে
চকচকে সোনালু পোকার সংসার সমীপে
যাবতীয় মনোযোগ পাবে
অনাত্মীয় ধবধবে ফ্যাকাশে শরীর!

অথবা ভ্রমণে--
ডানাছিন্ন কানা বক, শিকারের সন্ধ্যার বেশি
অবশিষ্ট পাবে না কিছু
মিছেমিছি রোদ স্যাঁতসেঁতে নদীতট ধরে
আমাদের মৃত্যুকে ঘিরে, ধুয়ে দেবে
ভবঘুরে মানুষের ব্যথা
অথচ কিছুই পাবে না : একদিন দানাদার মিথ্যের ভেতর
বেহায়া মৃত্যুকে ছাড়া

সরে যাবো...
সরে-যাওয়া অন্ধকার থেকে অন্যত্র কোথাও যাবো না

প্রতিবেশিনী

দেখতে দেখতে অন্ধকার। ভূগোলের সাদা মাংসের নিচে ট্রাউজার পরে প্রতিবেশিনীর মুখ মনে হয়। আরো ছিপছিপে সরু জানালার পাশে গাঢ় জঙ্গলের মতো পড়ে থাকে অধিকৃত রাত্রের পৃথিবী। আর থাকে শেষ বাজারের মৎস্য-বিক্রেতার সংরক্ষিত নীরব কোলাহল। প্রতিবেশিনীর দিকে সাত রাতের সংক্ষুব্ধ বুভুক্ষুতা হতে সে তাকে বিশ্বস্ত করে ধবধবে সাদা বেলুনের মতো উদ্ধত স্তনে রেখে সুপুরুষ সৈনিকের শিরস্ত্রাণ। রতিবৃত অন্ধকার। সে এসে অনার্য কৌমার্য হতে পুরাকৃত কলাপাঠে আদিখ্যেতা করে গেছে শতায়ু লৌহ দরজায়। আর আমার ভয় হয়, সিগারেট বাক্সের নিচে লুকানো মহার্ঘ সিগারেট শলাকার শেষে জ্বলে ওঠা দেয়াশলাইয়ের চেয়ে ঢের বেশি তাৎক্ষণিক রকমে। ফ্রতিবেশিনীর মুখে ব্যবহৃত শাওয়ারের শব্দে জুড়ে আসে বিধিভুক্ত ঘুম। সে ঘুমায়, সাদা ত্বক হতে সবটুকু দূরত্ব শেষে মহাপৃথিবীর দিকে হিংস্র অন্ধকার জুড়ে এলে

সাম্প্রতিক পৃথিবীর মতো অবিশ্বাস হতে

আমাকে ছুড়ে দাও নিস্তব্ধ বাতাসের দিকে
কালো ফ্রেমের মতো সন্ধ্যা, সন্ধ্যার অবিমর্ষ চাঁদ
আমাকে সাজতে দাও সাদা বৃষ্টিপাত, জোছনার পোশাকে

তুলে নাও সমস্ত প্রার্থনা-- ঘন ঝাউগাছের ছায়া
চালতা বাগানের ভেতর চালতা ফুল, ঘুমন্ত বাতাসের দিকে

আমি দেখি পাখির বন্দনা
নিঃসঙ্গ তালগাছে বাবুইয়ের ঝুলন্ত সংসার যাপন

ঘরে ফেরা সন্দিগ্ধ কুমারী, ধানভানা বধূ


নির্যাতিত প্রজা ডুবে যাবে পয়মন্ত ঘুমে

আমাকে শুশ্রুষা দাও বিকলাঙ্গ নিস্তব্ধ বাতাসে
অঢেল সোনাইল ফুলে বিগলিত ঘ্রাণে
আমার প্রার্থনা রাখো অন্ধকার দুর্বিনীত নদী
তামাটে ধীবররাজ, দুর্দান্ত গলিত মানুষ

ভেজা শরতের ঘাস, কুয়াশার্ত ক্ষেত
বিতাড়িত বেকার যুবকের মুখ, ভূমিষ্ঠ শিশুর কান্না
সাম্প্রতিক পৃথিবীর মতো অবিশ্বাস হতে
আমাকে নিষ্ক্রান্ত করো বায়ু-শূন্যতায়


ক্যাম্প

গোল চাদরের নিচে আমাদের সুদৃশ্য ক্যাম্পের কাছে এসো
শতাব্দী শুরুতে যাকে ঘোড়াশাল বলে
চালিয়ে দিয়েছে কেউ কেউ

আমাদের অশ্বগুলো এত বেশি পৌরাণিক বলে
আজও তার ছায়াটি ধরে
গড়ে ওঠে অবারিত গ্রাম, ছল ছল নদী

যদিবা ঘোমটা পরা বৌ ছয় বেহারার পালকি ফেলে
অরক্ষিত ক্যাম্পেই বেশি নিরাপদ থাকে
বা কোনো জন্মান্ধ কিশোর
সুনিশ্চিত ছুড়ে দেয় শিকারের স্ব-লক্ষ্য গুলি
তুমি এসো, আমাদের ধান-বৃষ্টির পাড়াগাঁয়ে এই
ষোড়শী যৌবন নিয়ে অভয়ে; ভররাত বৃষ্টি হলে
যা কিছু সমালোচনা লিখে যেয়ো


প্রতারিত চান্দ্রকাল

জলস্তর পার হয়ে একটি দেয়াশলাইয়ের প্রয়োজন পড়েছিল। হাতি-ঘোড়াশালে অক্লান্ত সওয়ারেরা মজুরির মিটমাট হলে প্রতীক্ষার রাস টেনে ধরে। ঘরে ঘরে জেনে যায়-- অশ্বখুর বেজে ওঠে পাঁজরের ধুঁকধঁকে দরজায় জলস্তর শুয়ে আছে ডোবা আমনের মাঠে দলিত কলমির ঝাড়ের বিপন্ন রকমে। অসমাপ্ত আধো রাত, কুঁড়েঘর ভর করে, সমস্ত মিটমাট শেষে, ঝুঁকে আছে ঘোলাটে কুয়াশা সমীপে। অথবা জেগেছে তারা-- রণব্যঙ্গ সারারাত মুখোমুখি লুণ্ঠিত অশ্বখুরে খুরে

অমর্ত বণিতার পাশে ওইসব সওয়ারেরা ঘোলাচোখ জ্বেলে গেছে তৃণভোজী জীবনের মৌল রণাঙ্গনে। আরও গূঢ় অন্ধকারে শোণিতের জমাট মুদ্রায় নেচে গেছে রঙ্গ-বণিকেরা
অমীমাংস্য রাত। প্রতারিত চান্দ্রকালে অগত্যা একটি দেয়াশলাইয়ের বড় প্রয়োজন


একটি সাম্প্রতিক কবিতার খসড়া

গত শরতের দিকে
যথার্থই ভালো লোক বলে তোমাদের নেমন্তন্ন পেলাম
হাঁড়ি-কলসির নিশ্ছিদ্র সাজানো ফটকে
তোমাদের অভ্যর্থনা পায়ে পড়ে গেল
বলা হলো--
জাহাজ ছুটছে
ঢোল বাজছে
রুটিতেই আপনার প্রচণ্ড আসক্তি, তাই তো?
বললাম, ‘না’
তাহলে ভেতরে ঢুকুন বাবা
জানেন তো, কেরোসিনের ফলন ভালো
এ নিয়েই দুটো কথা বলি বোন

দেখছো যে, সিঁদুর রাঙানো ষাড়
ও থেকে আমরা রোজ কেরোসিন দুয়াই
কেরোসিন খাই...

ট্রেন এসে যাচ্ছে, আমার শ্যাম্পুর পাতা?
এ সবই মায়ের জন্য উপহার
মা বলেন, ‘খ্যাতি নেই খাদ্য নেই
পারফিউমের গন্ধে আমার
উটকি আসে বাবা’

যা দিনকাল, আপনারা সরুন তো
সুঘ্রাণ আসছে
সুঘ্রাণের জন্মদিন ছিল
আমার নেমন্তন্ন ছিল
সংবর্ধনা পায়ে পড়েছিল...

খাতায় মার্জিন টানুন... আমাদের ছবির মাপ নিন
আমার মায়ের নাম : কেওড়াজল
বাবা : গন্ধবণিক
পেশা : দিগি¦জয়
-এভাবে ক্যাপশন দিন

...চলুন কাস্টমসের দিকে
সঙ্গে হোমিওপ্যাথ
বাবা ডাক্তার ছিলেন
ভালো মেয়ে দেখতে পারেন

স্যার, আমার ফাইলপত্রে
এক ডজন সুন্দরী বেড়াতে এসেছেন
গায়ে ডেটলের ঘ্রাণ, লাইকলি ইমিগ্রান্ট
ভাগ্যটা খুলে নিন স্যার

দ্রুত ফিরে চলুন, বাংলার টিচার
রোল-কল হবে
নো লেট-মার্ক
-টিচার, আপনার ছাত্রীদের ডাকে ধর্মঘট
কাল আসবো না
বাসায় বেড়াতে যাবো, থাকবেন টিচার?
সঙ্গে সংবর্ধনা
সুঘ্রাণ
বাবা-মা থাকবেন

আফিমের ঘ্রাণ পাচ্ছো?
দোতলার ছাদে আফিমের চাষ হয় খুব
ডবলডেকারে ওঠে
স্কুলে যায়
ভালো শিস দেয় মিনি স্কাট
ছাদে রোদ এলে পত্ পত্ ওড়ে পাজামার ফিতে

আর মনে পড়ে পঙ্কজ উদাস
হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়া
জলতরঙ্গ...
বিটোফেন...
মোজার্ড...
‘বেলা বোস তুমি শুনতে পাচ্ছো কি?’
ডব্লিউ ডব্লিউ ডট অঞ্জন দত্ত ডট...
আহা অতুল প্রসাদ আলু ছোলা বেচে ঘুমিয়ে পড়েছেন

কফি হাউসের রোদে
ফোলা ফোলা গাল বসে থাকে
মরুভূমির নাভি
ধারী ধারী পাছা

কাল আপনাকে দেবদাস ছবিতে দেখেছি
সংবর্ধনাকে ভালো চিনবার কথা আপনার
‘ইয়েস অনলি শি ইজ!’
চলুন মা’র কাছ থেকে ছুটি নিয়ে আসি

এত হাসি হাসি কথা কী করে বলেন?
আপনার বোগলের ঘ্রাণে বমি বমি লাগে
-কোলে তুলে নিন, ওজনে পাতলা
ভালো স্বাস্থ্য
একহারা
পছন্দ : এ্যাশ টি শার্ট
ব্ল্যাক জিন্স
হানড্রেড পাইপারস
আর
ফোলা ফোলা গাল

একটি রং নাম্বার ডায়াল, হাসপাতাল!
রিয়েলি লোনলি ডাক্তার
প্লিজ, পেইন কিলার...

-সিস্টার, আপনার ফ্রকের হুকগুলো খুলে যাচ্ছে কেন?
-ম্যাডাম, আপনার এ্যাপ্রোনটি ভীষণ উড়ছে বাতাসে
আমার চশমাটা খুলুন
মাইনাস থ্রী পয়েন্ট ফাইভ
পূর্বপুরুষের ছিল
চশমাটা ভেঙে দিন, আপনার শুশ্রুষা
বড় প্রয়োজন
আরও শীঘ্র ভালো করে দিন
মা বকবেন
তিনি তো অফিস যান না কতদিন

সকাল সকাল শেভ হয়ে যাচ্ছে
ধোঁয়া উঠছে চায়ে
(মধ্য দুপুর... জলপাই-রং জীপ... হ্যান্ডকাপ...)
অভিযোগ : রঙধনু দেখা
দেদার গঙ্গার প্রবাহ অঙ্কন
শীতবস্ত্রহীন
বুকপকেটে প্রেমিকার চুম্বনের ছাপ
প্রেসক্রিপশন
শালপাতার বিড়ি
আমাকে গেট অব্দি পৌঁছে দিন
যাবজ্জীবন, সশ্রম...

প্রিয় শোক : জীবনানন্দ দাশ
সমুদ্র ভ্রমণের দিনগুলি

বালাগাল উলাবে কামালিহি...
আপনাকে খুব সুফি সুফি লাগে
আপনি হারামির মতো মুখ ভার করে হাসেন
আপনি খুব পর্নো পড়েন
কিছুটা ঘুমিয়ে নিন
আপনার কিছু ঘুমের প্রয়োজন আছে
ঘুমের মধ্যে আপনি খুব মন খারাপ করেন

কেউ ফুটপাত ধরে হাঁটছে
যাবজ্জীবন ঘুমের কথা আপনার মনে পড়ছে নাতো!

প্রেমের কবিতা : এক

তিরিশোর্ধ কুমারের কী আজব ঘুম পেয়ে যায়
কোনো কোনো হ্যান্ডবিল হতে
এ গুজব জেনে গেছে
জবরদস্ত রাজকন্যা এক

কেউ তাকে বাগানের ভেতর হেঁটে যেতে বলে
কেউ বলে বিকলাঙ্গ কৃষ্ণচূড়া সে

নৈবেদ্য ফলেছে ভারি
ঘুমিয়ে পড়েছে সে তিরিশোর্ধ নারী



প্রেমের কবিতা : দুই

বাঁশিকেই শিখিয়েছি তার সুরের বদান্যতা
যথেচ্ছই ঝুলে ঝুলে আছে
তার জন্য সম্মাননা ফল
ঝুলে আছে মহিমা অনল, লাবণ্য সকাশে...

কেউ তাকে ফেলে রেখে গেছে
একা এক নমনীয় মেঘ
কেউ তাকে মাতাল বলেছে--

গড়িয়ে চলছে দ্যুতি...
কেউ তাকে তুলে নিয়ে গেছে
ইথারে--
সৌন্দর্যপাড়ায়


গোলাপবিষয়ক
তোদের কাছে এই সুগন্ধি গোলাপের রীতি প্রশ্নের মুখোমুখি
চা-বিস্কুট খেতে দিলে, চারদিকে বাতাস ভারি হয়

যাও, অভয়গঞ্জে; অরণ্য-কুন্তলে যাও
ঝুড়িভর্তি পাতা নিয়ে যারা যারা
এই ভর সন্ধে জঙ্গল ছেড়ে উঠে এলো

এবার জিগ্যেস করো
ঋতুকালীন সন্ধেগুলোয়
কে কেমন গোলাপের ঘ্রাণে বিভোর হয়ে ওঠে


ঐশ্বর্য ওপাড়ায় থাকে

মেঘমেদুরতা, এসে ভাই বলে ডাকে
স্বপ্নের গোছগাছ নিয়ে, ব্যাপক রাত্রি চলে যায়...
আর যদি ডাকো, পড়িমরি পথ ভুল করি

মেঘমেদুরতা, আকাশে বিদ্যুল্লতাময়--
ভেবেছি, ঐশ্বর্য ওপাড়ায় থাকে



নগরায়ন

দেবনাথপল্লীর দিকে উড়ে যাচ্ছে
একঝাঁক ইজিচেয়ারের ধুলো
সোঁদা এক কিশোরীর কাঁধে
বেহালায় চড়ে বসে
রাজ্যের নাগরিক উৎকণ্ঠা
আমাদের নিকটপল্লী মহেঞ্জোদারো--
অবশ্য ঘুমিয়েছো এক ধূসর মলাটে
আমাদের গোলাভর্তি ধান
দেবনাথপল্লীর দিকে জুড়ে আসে
একঝাঁক নাগরিক অভিজ্ঞান


মাধ্যমিক পাড়ি দিয়ে

বেদনার্ত চিল চেয়ে আছে আসমুদ্র নিঃসীম শূন্যতায়

সারা রাত কলব্রিজ খেলে
ঘুম ঢুলু ঢুলু মাদকতা ঘিরে
যুবকেরা
সনির্বন্ধ কুয়াশার দিকে হাঁটছে

কারো কারো পেটের পীড়া এই ভোরবেলা অতিক্রম করে গেল
শিশিরে আচ্ছন্ন
গাঢ় গমক্ষেত হতে উড়ে গেল মৃত পাপিয়ার শিকারে বিচ্ছিন্ন ডানা

পাড়ার টিউকল হতে সাদাফ্রক কিশোরী সকল
ধুয়ে যাচ্ছে মুখের দুর্গন্ধ অসুখ; এবার
সাঙ্গীতিক অনুশীলন হতে কারো কারো চাঁদমুখ
সুনির্ণয় করা গেল
জানা গেল
মাধ্যমিক পাড়ি দিয়ে যুবকেরা কেউ কেউ
সারারাত
নিতান্ত কলব্রিজ নিয়ে মেতে ওঠে
আমবাগান মেতে ওঠে নিবু নিবু সলতের আলোয়

আঁকিবুকি প্রেমপত্রে, লেখা হয় প্রথাবদ্ধ জীবনের রক্তবমি রেখা
মা তার শিয়রের পাশে কল্পনায় বুঝে নেয় :
তাঁহার প্রজন্মক্রিয়ায়
প্রলম্বিত সাদাচোখ
শূন্যতায় চেয়ে থাকা চিল ও চণ্ডালের দিকে মুখোমুখি



তোমাকে সম্মানিত করা হবে

এই খোলা মধ্যাহ্ন শেষে তোমাকে প্রাত্যহিক ভ্রমণ বিষয়ে সম্মানিত করা হবে। হাওড়ের জলডিঙিটির কাছে গোলপাতায় আচ্ছন্ন শিশিরের জলে তোমাদের ক্রন্দন-আশ্রিত মুখ, অবিভাজ্য শোক-- তোমাকে সম্মানিত করা হবে মাছরাঙা-কোরা-সরালির সম্মোহিত গানে। বিবর্ণ নক্ষত্রের দিকে চেয়ে দেখো, ছুঁয়ে দেখো বাদামি সন্ধ্যার গ্রহণ, ঘন ঝাউবন হতে কে কবে বন্য রমণী এক অভাবিত উড়িয়ে দিয়েছে বেণী, ধূসর হোগলার ঝাড়ে ফেলে গেছে শরীরের গোপন সরম। অতঃপর, মাছেরা খেয়েছে তার গ্রহণের সোনালি আমিষ। নেবুফুল ঝরে গেছে পথে পথে অজেয় বিভায়। কে এক জলজ ষোড়শী শেষে, ভেঙে গেছে আঁধারের উত্তুঙ্গ গ্রীবা।... অথৈ কৌমার্য ঢেলে আসে যায় বুনো-বাঈ হাওড়ের উদার আড়ালে।... প্রগাঢ় মধ্যাহ্ন শেষে সম্মাননা ফিরে আসে অরহের ক্ষেতের গোপনে দক্ষিণে শালবন ঘিরে


পরমাত্মীয়

আমাকে একবার সুসংবাদের ব্যাখ্যা করে দিয়ে সে আমার পরমাত্মীয় বনে যায়। সেই থেকে তার ওড়না ও উত্তরীয়গুলো উন্মুক্ত ছাদে শুকাতে দিলে, চন্দনকাঠের ব্যবহার বিষয়ে গবেষণাগারে বসে যেতে হয়। অন্ধকারে আমার মেয়েদের জন্য আহৃত দেশলাইগুলো ব্যবহার করে থাকি।... তার জন্মদিন ছিল।... সে আমাকে কতিপয় মোমবাতির বৃত্তান্ত বলেছিল। আর আমার দুঃখবতী মেয়েগুলো ঐ সব মোমবাতি নিয়ে একদিন খেলাধুলা করে যাবে!

নির্বাসন : দুই

কিঞ্চিৎ দৈবত্ব পেলে একদিন উত্তরের দিকে বনান্তরে চলে যেতে পারি। হ্যাঁ-স্বভাব কিশোরীরা, যারা যারা আত্মত্যাগ করেছিল বলে কথিত রয়েছে, আদগ্ধ ব্যর্থতা নিয়ে উড়ে গেছে অনিত্য সংসারে বসে-- আমপাতা বেলপাতা আর দুধভাত ভালোবেসে; ঐ নিরামিষাশী প্রাণের নগরে আমার তাহাদের নিক্বণ ভালোলাগে। একদিন ঘোলা বুদ্বুদের ভেতর ডুব দিয়ে অস্পৃশ্য চলে যাবো পৃথিবীর শেকড় সন্ধানে। ঐখানে বনমরিচের ঝালে কিশোরীর ক্রোধে লেখা নীল খামগুলি ছুড়ে দেবো প্রক্ষালিত আকাশের রঙধনু ভরে। চিনিচাঁপা বনে বনে হাত ভরে তুলে নেবো পৃথিবীর বিশ্বস্ত মাটি। মা তোমার জন্মের দেনা এইখানে লিখে দেবো; এই নির্বাসনে-- দেখো মা, স্বাগত এই নির্জনে আমার সমস্ত একাকী


মন্বন্তর

এবার মন্বন্তর হলে, ছিঁড়ে খাবে বাতাসের শিরা-উপশিরা; ধানবীজ, মোটর, বাদামের খোসা-- বিশ্বাসী জোয়ারের মতো গলে যাবে বুভুক্ষু মনুষ্য শরীরে। আলো মিটমিটে রাত খোঁড়লের চন্দ্রালোকে অভাব্যই লিখে দেবে মথিত বেদনার ভাষা; অপরাহ্ণে মেয়েগুলো পৃথিবীর লাবণ্য হতে লেবুপাতা ছিঁড়ে ছিঁড়ে বাদামি শস্যের ক্ষতে সঁপে দেবে অধীত সরম। এবার মন্বন্তর হলে, অথৈ শস্যের গোলা উড়ে যাবে পামরীর ঝড়ে; সাবলীল ঘরগুলো বিষাদের কোলাহলে খুঁজে পাবে বাবুইয়ের রীতি; আতাগাছ, প্রিয় ফুল... লোনাজল ছিঁড়েখুঁড়ে বুঝে পাবে ডানার ব্যগ্রতা-- তোমাদের স্বাধীনতা কেবল মেলেছে বিস্তৃতি...



পৃথিবীর দিকে আকাশের দিকে তাকিয়েছো

তোমাকে তাকাতে হলো আকাশের দিকে, নক্ষত্রের নিঝুম অরণ্যে
যেখানে খলবল করে বেরিয়েছিল চাঁদ, জ্যোৎস্নারাশি...

আজ তার সঘন অনুপস্থিতিই পড়ে আছে অন্ধকার জুড়ে
অথবা এমন, এক প্রহরারত মেঘ, আঁকিবুঁকি বিদ্যুতের রেখায়
যে কোনো নক্ষত্রের মূলে
জ্বলেপুড়ে নিষ্ক্রান্ত হলো পৃথিবীর সবুজ অরণ্যে

আর তোমার চোখ জুড়ে ছিল সহস্র বছরের ঘুম
একদিন ডুমুরের বনে ডাহুকের অন্তিম ক্রন্দনের ভেতর
জিগ্যেস করেছিলে-- তাহাদের অবতারিত বেদনার বয়স

তারপর আকাশের দিকে বৃষ্টির প্রখরতা জুড়ে
ঝরেছিল ঝুম ঝুম বৃষ্টির ধ্বনি
নদীবর্তী চিলের চিৎকার

অবিভাজ্য সুখ তার ছেঁড়া-জ্বীর্ণ আস্তিনের ভেতর
তুলে নিয়েছিল যে কোনো নক্ষত্রের দিকে প্রসারিত হাত
সংক্রমিত রাতের জোনাকি

আর তোমার তারাদের দিকে তাকাবার বয়স, ঝুলে ঝুলে আছে
পাহাড়ে, নৃত্যরত উপজাতীয়তায়

তুমি গাছেদের কাছে তাহাদের বন্ধ্যত্ব মোচনের কথায়
একদিন ভররাত ঘুমিয়েছো একটি প্রস্ফুটিত ফুলের প্রত্যাশায়

তুমি পাহাড়ের ঔদ্ধত্য ভেঙে, উঠে গেছো প্রত্যন্ত চূড়ায়
তুমি পৃথিবীর দিকে তাকিয়েছো
তাকিয়েছো, আকাশের মহান শূন্যতায়







ডিসেম্বর বা শীতের এলিজি

আর আমার জন্য পড়ে রইল খড়খড়ে শীতের বাঁশবাগান

চা-বিরতির পর তোমাকে দেখলাম একজন হাতঘড়ি হয়ে
বদলে নিচ্ছো চিঠির বাক্স, উঠোনের গোলাপগুচ্ছ...
ঝুড়িভর্তি বেতফল নিয়ে ঢেলে দিচ্ছো উদ্যানের টবে

তোমাকে দেখলাম, নামী কোম্পানির মনোগ্রাম নিয়ে
শপিং সরণির দিকে ঝুলিয়ে দিয়েছো তোমার অভ্যর্থনা
পরিবর্তিত তোমার ব্যক্তিগত উঁচু-নিচু সুরম্য মহল

বহু বিস্মৃত হালটের øিগ্ধতাগুলো বাতাবিলেবুর মতো
ঝড়ের মর্মর হয়ে গড়িয়ে চলেছে আজ
কাঠ চেরাইয়ের অকথ্য নৈপুণ্যের মতো, ব্যক্তিগত দুঃখগুলো
ভাগ হয়ে হয়ে জুড়ে যাচ্ছে মেঘে

পরস্পর সঙ্কলিত অর্ঘ্যমঞ্জরি জনে জনে
ভিখিরির হাতে তুলে দেবো বলে
আমাদের জন্য পড়ে আছে পরস্পর ভালোবাসাবাসি
অনারোগ্য দ্বিখণ্ডিত চাঁদ

তোমার জন্য প্ররোচিত অন্ধকার নিয়ে উড়ে গেছে
জলের আর্দ্রতা কিছু, পৃথিবীর উর্বরতম ধূলি

বাঁশবাগান জুড়ে আছে খড়খড়ে শীতের পত্রমঞ্জরি



চলে যাবার স্মর্তব্যগুলি

তোমার চলে যাবার দিকে তাকিয়ে ছিলেন নির্মলেন্দু গুণ
তাকে যে সহস্র বছরের বীভৎসতায় পেয়ে বসেছিল
আর একমাত্র প্রাচীন বৃক্ষ থেকে খসে খসে পড়ে যাচ্ছিল
তার সমস্ত কবিতা, আর

তার ঝরে যাবার দিকে তাকিয়ে ছিল
ভয়ঙ্কর বিদ্যুতের রেখা
অন্ধ চোরাগলি

তোমার প্রস্থানের নখে লাল টুকটুকে মোরগের ঝুঁটি
যা কিছু বেদনার্ত ইঙ্গিত করেছিল : যেমন--

-জন্ম-নিরোধক বমি-বিষয়ক নিষেধাজ্ঞা
-সন্ধ্যে নাগাদ মুখ ভার করে ঝরে যাওয়া একটি গোলাপ
-আর সমঝদার মেয়েদের জন্য নিবেদিত প্রত্যাখ্যানগুলো
বেদনার্ত কবিতার মতো ঝরে ঝরে পড়া

তোমার চলে যাবার স্মর্তব্যগুলি বিস্মৃত হয়ে
আকাশের দিকে উড়ে যাচ্ছে কিশোরীর শরীরের ঘ্রাণ

সোনালি ধানক্ষেতগুলোয় উড়ে উড়ে ঝরে যাচ্ছে
আমাদের স্বপ্নমঞ্জরি


হ্যাঙ্গারে ঝুলন্ত শুভদিন

আমাদের পর্দাবিহীন ঘরের জানালার ভেতর
কতো কতো দৃশ্যের কথা সে এবার বাজারে তুলেছে

হ্যাঙ্গারে ঝুলন্ত মানুষ আর আমার বৈমাত্রেয়
বোনেদের সঙ্গে কথা কাটাকাটি-- এ সবের দরদাম হলো

কবিদের জন্য রক্তাক্ত প্রেমপত্রের নিচে
পৃথিবীতে নিষিদ্ধ অভিধান নিয়ে
এতো এতো দরকষাকষি-- সব আমার ভালো লেগে গেল

আর আমি বললাম তাকে, অনঙ্গ অন্ধকার নেমে এলো
আমাদের ঝুলন্ত বাড়ি
বাড়ন্ত দরদামগুলো ছাদে-ওঠা শিশুদের কাছে
ফেলে রেখে যাই

কারও কারও ব্যাগভর্তি মাথা, মুণ্ডিত নাভি
বাজারে ওঠে তো আরও যৌনক্রিয়াবলী...

আর আমি বললাম তাকে, এ সবই বাজারের রীতি
আমাদের শিশুরা বলেন--

তিন এক্কে তিন
ঘরে ঘরে ডাকছে নিলাম
এমন শুভ দিন







পাতাল নির্মাণের প্রণালী


বাংলাদেশে একদিন ইংলিশ রোড নামকরণ হলো

আমার নাম দাও শিবপোকা। শিবপোকা মানে, একটি নতুন পোকার নামকরণের ক্ষমতা।... তুমি করো দোয়েলের চাষ। দোয়েল কি পরিযায়ী নাম? ইংলিশ রোডের কোলাব্যাঙগুলো সেবার বর্ষায় ছিলো সাদারঙ হয়ে। আমি জানি, এ প্রকার জলসাদা ব্যাঙ পৃথিবীতে কখনো ছিলো না। এমন ব্যাঙরঙ ধরে যখন ভোর হয়, আবার কৈবর্তপাড়ায় ভেঙে যায় রাজ্যের নিয়ম। কেমন আফিমগন্ধে বাজারের আঁশটের ভেতর আমি শিব শিব করে পোকা হয়ে উড়ি তোমার তালাশে।... তুমি করো দোয়েলের চাষ।... ভালো ছাইরঙ বোঝো।... মেটে কলসি, লাউয়ের খোঁড়লে কী গভীর সুর তুলে আনো। তোমাকে জানাই তাহলে, আমাদের ইংলিশ রোডের কোলাব্যাঙগুলো আমার জিহ্বার তল থেকে একদিন তুলে নিয়ে গেছে সমস্ত লালা। সেই থেকে সুরহারা হয়ে শীতল শস্যের মতো তোমাকে সযতেœ রাখি ঘরের নিভৃত কোণে। তুমি তো জানো, কতোটা বেসুরো হলে হাটের গুঞ্জন ওড়ে আকাশে বাতাসে















বিন্দুবিসর্গ

তাকে কেউ বিন্দুবিসর্গের সন্ধানে পাঠিয়েছে আমার কাছে। যতোবার দ্রৌপদী তার শরীরের যতিচিহ্নগুলো সঁপে দেয় নানাবিধ হিংস্রতায়, আমি ততোবার তাকে ফিরিয়ে দিয়েছি। বুঝিয়েছি, মর্মরিত বেদনার ভাষা, তোমরা কি জানো তার বিন্দুবিসর্গ কিছু? আমার বাগানে এক মৃত্যুমুখো ফুল, আমি তার শুশ্রুষা ফেলে তোমাদের হলভর্তি স্রোতাদের মুখে কতোবার তো দাঁড়াতে চেয়েছি। ভেবেছি, আমাদের পূর্বপুরুষের ভিটেয় যে দাউ দাউ অগ্নিমুখ হতে তোমরা আলস্যের উৎসসমূহ খুঁজে বের করো, ঘরের আড়ার দিকে অহেতু চোখটান করে ভাবো, কতো সাল থেকে কতো সাল তুমি বেঁচে যেতে পারো, আর তোমাদের হাত-পায়ের দৈর্ঘ্যগুলো পৌঁছে দাও অগ্নিসন্ধানে; আমি তার বৃত্তান্তের বিন্দুবিসর্গ সত্যি কি করেছি আড়াল পরম গোপনে!
আর ভাবো, আমাদের কাঠের কুঠরি, শস্যের গোলা কতোবার ঐ অগ্নিমুখ হতে বাঁচিয়ে নিয়েছে তার ঐশ্বর্য বন্দনা; আর আমরা ভবিষ্যৎ সম্বন্ধগুলো পাকাপাকি করে আর একটি প্রজন্মের অগ্নিমুখ খুলে দেবো বলে যথার্থ ভেবেছি, দলবেঁধে ছুটে গেছি আমাদের ভবিষ্যৎ ভিটেয়-- তোমাদের ধ্যানমগ্ন ঘুমের আয়াস ভেঙে কখনো কি এসব করেছি বর্ণনা?
আমাদের বিদগ্ধ অতীত যা কি-না একদিন আগুন লেগে টকটকে লাল হয়ে উঠেছিল, আর খসে পড়েছিল তার প্রাচীর-পলেস্তারা, আর একদিন হঠাৎ ঘুম ভেঙে দেখেছিলাম আমার আদগ্ধ পিতার মুখ... আর আমার সন্তানের ভস্মমুখ থেকে শুনেছিলাম আর্ত অভিশাপ-- কখনো কি করেছি তার আদ্যোপান্ত সরস বর্ণনা?
একদিন মধ্যরাতে গোল চাঁদ থেকে যে রক্তের প্রস্রবণ বয়ে যেতে দেখি, আর তোমরা হঠাৎ ঘুম ভেঙে হাই তুলে তুলে নিমিষে এগিয়ে যাও বৃষ্টির প্রস্রবণ ভেবে-- একদিন তার বিন্দুবিসর্গ বলে জানবার থাকবে কি কিছু!


প্রাক বৈবাহিক

একবার আমাকে একটি বিবাহ-উপযুক্ত মেয়ের হস্তাক্ষর পাঠিয়ে বলা হলো, এই মেয়ে এতোদিন জলেই বসবাস করেছেন; আর তার সাম্প্রতিক স্যাঁতসেঁতে প্রকাণ্ড শরীর রৌদ্রে শুকোতে দেয়া আছে। তার হস্তাক্ষরে এই যে কোথাও মাত্রা পড়েছে বা পড়েনি, আর এই যে যতিচিহ্নের কোথাও ভুল বা কোথাও সঠিক ব্যবহার-- এসব কিছুই নাকি মেয়েটির যথার্থ যোগ্যতা বা দোষগুণ যেটাই ধারণা করা হোক। মেয়েটির উচ্চতা আমাদের মাঠভর্তি জলের সমান, অর্থাৎ এটা আমার আন্দাজ করে নেয়ার কথা। যা হোক, আমি মায়ের কাছ থেকে পত্রমারফত এ সংবাদ জেনেই কিছু ব্যক্তিগত প্রশ্নপত্র তৈরি করেছি। আর ভাবছি, মীন রাজ্যের অধ্যয়ন পর্বে মেয়েটির দীর্ঘ বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এসব প্রশ্ন খুব একটা কমন পড়ার কথা নয়। আর তাহলে এভাবে হস্তাক্ষর পাঠিয়ে এক জননীর কোনো অনাথ যুবকের এ মতো মন ভোলানোর কোনো মানেই হয় না। ভেবে দেখছি, আমার অপেক্ষার দিনগুলো কী উৎকণ্ঠার! শীত কিংবা বর্ষাই আমার প্রিয় ঋতু হলেও ভাবছি, তাকে ভেজা জবুথুবু নাকি শীতে কোঁকড়ানো দেখতেই বেশি আনন্দদায়ক হবে। আজ এই মুখর বর্ষণে ছাতা হাতে বৃষ্টি বাঁচিয়ে এমনতর ভাবনাগুলোই পোস্টাপিস অবধি পৌঁছে দিয়ে এলাম। আর তখনই আমার হঠাৎ মনে এলো-- তাকে শেষ প্রশ্নটি করাই হয়নি যে, অবশিষ্ট জীবনে তিনি মীন ধর্মেই ফিরে যেতে আগ্রহী কিনা...









আমার পোষা কাঠবেড়ালি

আমার পোষা কাঠবেড়ালি রোজরাতে শহরের অন্ধকারগুলো খুঁটে খুঁটে দেখে। তার ওড়ার সাহস, ডানার ক্ষমতা খাঁচার অন্ধকার হতে কেউ তাকে বুকে গুঁজে দেয়। পরম পোষা কাঠবিড়ালি আমি তাকে বিদ্যালয়ের ভাষা, সঙ্গীতের ধ্বনি মাঝে মঝে মুখে তুলে দিলে সে আমাকে সবুজ পাতা, হলুদ ফুল আর লাল-সাদা পাপড়ির ভেতর অবাধ বন্যতার মতো স্তব্ধ করে দেয়। আমি তাকে ঘরের আসবাব হতে রঙের প্রাবল্য এনে যতোবার ডলে দিতে চাই, সে তার নিমীলিত চোখ, আদিম লাবণ্যকণা গহীন অরণ্যের ভেতর বয়েসী পাতার মতো ঝরে যেতে দেখে



















মাংস বিক্রেতা

আমাদের গলির মোড়ের মাংস বিক্রেতা রোজ সাঁঝে সাফসুতরো হয়ে ঘরে ফিরে যায়। আর আমি চতুর পথিক এই কীর্তি দেখে দেখে ভররাত বিভোরে ঘুমাই। ছুটি কিংবা উৎসবের দিনে ভোর-ভোর মোড়ে এসে যেই কিছু মাংস দিতে বলি, হুড়মুড় আনন্দে তাকে কেটে কেটে মাংস দিতে দেখি। যে কোনো উৎসবে নাকি আমি তার গগনের চাঁদ-- সদ্য-তাজা রক্ত ঘেঁটে মাংস নিয়ে যাই। বাঘেদের উৎসবে জানি রক্তভেজা মাংস নাকি অনিবার্য থাকে। সারারাত জেগে জেগে এভাবে ওভাবে চলে মাংসের মহড়া। আমরা যে ভূরিভোজ উৎসবের কথায় লালায়িত হই, থরে থরে মাংসের যোগান ছাড়া তা নাকি নিতান্ত অর্থহীন


















ভেঙে পড়ছে আমার সম্ভাব্য নগরী

এবার আমার সেলাই-সুতো পড়ে থাকছে। ঝড় দেখে উঠে পড়ছি বেগুন গাছে। আমাকে দেখতে এসেছেন প্রযুক্তিবিদ। ভালো গান করে তার সুনাম রটেছে গাঁয়ে। আর আমার মনোযোগ ভেঙে বলবেন কিছু কথা। আমি তাকে দাঁড়াতে বলি। হাতের কাজ ফেলে ডেকে আনি আমার সদ্য প্রণয়িনী। সে তার পা ধুয়ে দেয়। ছিপি খুলে এগিয়ে দেয় জলভর্তি সালশার বোতল। পূর্বপুরুষের ব্যামো। একবার ফুঁ দিয়ে দেন যদি।
আজ আমার ঘুম হচ্ছে ভালো। আজ কোনো মসলার বায়না নেই। ঢোলকলমি, জলকচু-- এ সবই বাজারে উঠেছে। তবে কি যাবো! এ সবই অগ্নিনাশক। মা বলেন, অতোটা ঘুষখোর হলে রেহাই কি আর পাবি! চল্ এবার শীতে-- শিলং কিংবা জলপাইগুড়ি-- কতো রকম চাষবাস হলো... মেঘ-রৌদ্রের আর্দ্রকথা... হায় তোর মরমে পাওয়া সখি-- তার জন্যে ঘর-কবরেজ... এসব কোনো কথা হয়রে বাপ!
দিন যাচ্ছে। আমরা ক’জন ময়মুরব্বি স্নেহত্রাতা কারো মুখে তাকাবার আগে, প্রবল তোড়ে ঝড় বয়ে যায় সুখে। হায়রে দক্ষিণা হাওয়া... নরম-ডাঁটা ফসলের ঘ্রাণ... মগভর্তি দুধ। আজ হাটবার। ধামাভর্তি ফল... হাটভর্তি পদ্মার ইলিশের চাঁই-- এ আমার মনোযোগ ভেঙে পড়ে আছে যমুনার ব্রিজের পাড়ে।... কেউ কি জানো, ঝড় উঠছে-- কপোতাক্ষের পাড়ে যে কবির ভেসে গেছে বিপন্ন নগরের এতো অভিবাস-স্মৃতি, সে নদে উঠেছে ঝড়; ঢেউয়ে ঢেউয়ে উগড়ে উঠছে স্মৃতি, মৃতের ক্রন্দনধ্বনি শ্মশানে শ্মশানে... কেউ কি জানো, এবার আরাধ্য শীতে ভেঙে পড়ছে পৃথিবীর অব্যক্ত নগর, অনাগত তাজমহলের কাঁচ; আর আমার সম্ভাব্য সুরম্য প্রাসাদ পৃথিবীর অন্ধকার গহ্বর ধরে ডুবে যাচ্ছে প্রাচীন প্রহরে। একদিন চাঁদের মুখশ্রী ভেঙে ঝড় এলে আমি চড়ে বসি মর্মরিত বেগুন শাখায়। একদিন আরোগ্য এলো দেশে। হায় আমার সদ্য প্রণয়িনী...



চঞ্চলতা ছিল

চঞ্চলতা ছিল। তার বাদামি তরল মুখ, ধবধবে হাড়; তার মুখ ফসকে কথা বলার রীতি, প্রবল সমুদ্র বিহার... চঞ্চলতা ছিল, আজ নেই... বেড়েছে স্বস্তি, শান্ত মোহনার জল, ঘুমিয়ে পড়া গ্রাম... চঞ্চলতা ছিল... তোমার দেঁতো হাসির খিলখিল ধ্বনি, ভেঙে ভেঙে ফেরিওয়ালার হাঁক, তরমুজের বীভৎস লালে মাছির গমগম... চঞ্চলতা ছিল, আজ নেই... ক্যাম্পাসের পৌরাণিক ইট, বিবর্ণ ধুলো, ছেঁড়াখোঁড়া মেঘে আধ-ডুবো চাঁদ-- ফুসকার রঙ, ভ্রাম্যমাণ স্মৃতি... চঞ্চলতা ছিল, আজ নেই... উদ্যানের রোদ, ঘাসের সবুজ ব্যাপক চাঞ্চল্য ফেলে একদিন কেউ তাকে ব্যবহৃত হতে দেখে



















প্রাণী-পৃথিবীর দিকে

অন্যতর ভাবনার মধ্যে বুঁদ হয়ে আছি সারাক্ষণ। আর আমার শখ রাত্রিকালীন শেয়ালের তামাটে শরীর থেকে উত্তাপ কেড়ে নেয়া। বাড়ির আঙিনা ভেঙে মধ্যরাতে দাঁড়িয়েছি পুরনো স্কুলঘরের টানা বারান্দায়। আমার পায়ের কাছে নত হয়ে আসে শালবন : ঝিঁঝিঁ নেই পেঁচা নেই... একটি প্রণত শেয়াল তার তামাটে আগুনের ভেতর সিদ্ধ করছে মানুষের স্তূপীকৃত সাদা হাড়। আর সেই আগুনের হল্কার ভেতর আমার শখের নিবন্ধগুলো রচনা করে যাই। প্রতিটি মেয়ে হাড় নিয়ে উৎসবের সাতরঙ আমার পূর্বপুরুষের কালে যথেচ্ছ প্রসিদ্ধি পেয়ে গেছে। সংসারের দৌর্দণ্ড ভাপে একদিন আমি ঝলসে যেতে দেখেছি আমার স্নেহার্দ্র মায়ের মুখ; শোকার্ত শকুনের পিঠে একদিন ওড়ার বাসনা তার তুলে নিয়ে গেছে মুঠি মুঠি চুলের সুষমা। এই আমার প্রাচীনতম শখ আমি শৈশবের শিশুপাঠ থেকে তুলে নিয়ে আসি মহাপৃথিবীর ঝলসানো রোদে। একদিন তামাটে শেয়াল আমার ভূগোলের ভেতর কী দারুণ সাক্ষী হয়ে হয়ে বেঁচে আছে ঘোর রাতের নির্মম আকস্মিকতা। আমি দেখি, মধ্যরাতে জ্বলে ওঠা অজস্র বুনো বেড়ালের চোখ... কুকুরের বাঁকানো লেজ... হরিয়ালের বিস্তৃত পালক... আমি দেখি, প্রতিটি নবজাতকের মুখে ঝুঁকে নেমে আসে প্রাণী-পৃথিবীর বিভিন্ন ছায়া। একদিন শেষরাতের শালবন হতে আমার স্যাঁতসেঁতে চোখ তুলে নিয়ে গেছে অনাগত বনমানুষেরা...








সমুদ্র ও তারকাবিষয়ক

গরম তেলে ভাজা হচ্ছে সমুদ্রের পোনা। আর তাই কড়াইয়ের প্রতিটি বুদ্বুদের ভেতর ভেসে ওঠে সমুদ্রের লিঙ্গ ও প্রজনন ক্ষমতা। এই দৃশ্য আমি তোমাদের রান্নাঘর থেকে সৈকতের বালির ওপর আছড়ে ফেলে দিলে ভিড় করে শিকারী শখেরা-- যারা সমুদ্রের অটোগ্রাফ নিতে এসে এই এক দৃশ্যবন্দী হয়ে যারপরনাই তারকা হয়ে যায়। আমরা ব্যাপক তারকার প্রয়োজন অনুভব করি। কেননা, সমুদ্র ভ্রমণের মতো অনিবার্যতা তারা কখনো এড়াতে পারে না। এ মতো অনিবার্যতা পৃথিবীর অবাধ সমুদ্রকূলে সাবলীল হয়ে আছে। দল বেঁধে সমুদ্র ভ্রমণে গেলে এইসব সাবলীল ঢেউয়ে প্রকৃত সুস্থতার ভাষা মুদ্রিত হয়ে থাকে। তারকাদের ভেজা শরীরের ভাঁজে ডুবে যায় সংক্রমিত মানুষের ব্যথা। তুমিও সমুদ্র ভ্রমণের পর তারকাদের চেকবই মুদ্রণের কাজটি অন্তত পেয়ে গেছো। তোমার কড়াইয়ে তাই উঠে এসেছে প্রকাণ্ড সামুদ্রিক পোনা। না হয় ভুলক্রমে আরোগ্য নিকেতনের হয়ে একবার সমুদ্র ভ্রমণে এলে। তোমার গায়ে লেগে আছে সামুদ্রিক পারফিউমের অভাব্য নোনা ঘ্রাণ। তুমি জানো, এই এক স্বর্গীয় ঘ্রাণে মথ হয়ে জুড়ে বসে পৃথিবীর অগণিত পর্যটক-ভ্রমর। কেউ জানে, আত্যন্তিক রুগ্ণতা নিয়ে একদিন দল বেঁধে ছুটেছিলে সমুদ্র ভ্রমণে। আর আজ দেখো তোমার দুর্লভ্য অটোগ্রাফ পেতে সমুদ্রই বাড়িয়ে দিয়েছে তার দীর্ঘ সাদা ঢেউ...










কান্না পরম্পরা

হাত সরালেই ভেসে উঠবে আমাদের প্রথম রাতের ব্যাপক ভণিতা। রাতভর জাল পেতে রেখে ভোরবেলা বুঝে পাই জিয়লের ঘাই। আমাদের হাতের আড়ালে চাপা পড়ে আছে মৃত মাগুরের স্বপ্নের ভরা পেট। আমরা কি জানি কে কোন রাজদণ্ড উপেক্ষা করে বরাবর বিদ্রোহী হয়ে থাকে; আমরা কি জানি কে কোন জলের সাম্রাজ্য ভেঙে মরে পড়ে আছে এই এক বর্ষার নাইলনের জালে! আমাদের অতৃপ্ত শরীর অপক্ব বৃদ্ধের মতো ভুলে গেছে রঙ্গের কথা। বিষকাঁটা জিয়লের ঘাইয়ে যে তামাশা থাকে আমাদের প্রাক-সম্বন্ধের আত্মীয় সে-- যে তার নগ্নতা হতে দশ হাত বাঁচিয়ে রাখে আমাদের হিংস্র ব্যর্থতা। যদি ভোর হয়, অগণন হাতের আড়ালে চাপা পড়ে যায় পৃথিবীর তাবত পূর্ণতা। চোখের চশমার ভেতর কেউ তারা মৃদু রব তোলে। ভুলের সম্বন্ধগুলো ইতিহাসে বেঁচে যায় সমুদ্রের গভীর অতলে। দিনমান আমাদের রক্তের উজানে চলে ধুতুরার বিষের রিরংসা। আর তাই জলে নেমে দেখি, সন্ধ্যার অন্ধকার ফুঁড়ে নেমে আসে আমাদের নিমীলিত চোখ। শিকারের ধাতব আঘাতে যারা ডুবে যায় অতলান্ত স্রোতে। সন্ধ্যার শিকারী হাতে ফুলেফেঁপে কেঁদে ওঠে আড়ালের জঘন্য শোকেরা!












অযথা মেঘের কবিতা

ঘাটাও, ঘাটাও যদি পানপাতায় তুলে দেবো
জলস্মৃতি, শালুক কুড়োনো দিন...
কে আমাকে অভিভূত করে?
একবার জলস্তরে
ঘটে গেছে ভেজা শাড়ি, স্রোতের মহড়া...

হায় অন্ধ! যদি দোষ থেকে থাকে কিছু
আমার ভুল ভৈরবী
সে তার কিছু-বা কি জানে?

গাঢ়রঙ প্রদোষের ক্ষতে
স্মরণে যে ভাসাও ডোবাও--
নীল চাঁদ ডুবে গেলে শুরু করো ক্ষরণের ধারা...

হৃতসুখ গভীর চাতুরী
তুমুল বর্ষণে রেখে আলো ও আঁধারে
অযথা রচেছো নাকি মেঘের কবিতা?











লাল রঙের কবিতা

আমি এক ভ্রামণিক সিঁদুরের কাছে জানতে চাই
তার দাঁত আছে কিনা
সে বলে
আপনার কিছু গোলমাল দেখতে পাই

একদিন নোনাতীর ধরে হেঁটেছি
আমার বিলুপ্ত বসতের কিছু লালচিহ্ন লেগে আছে তাতে
আমি সন্দেহ করি। আর বলি--
কী কী সব উৎসে আপনি নড়েচড়ে খান
আপনার বলার সহজ ভঙ্গিমা
নিশ্চিত জানুন ফ্রয়েড অবধি কখনো পৌঁছবে না

হঠাৎ দমকা হাওয়ায়
আমার দাঁতগুলো রক্তাক্ত হয়ে ওঠে
তাকাই পেছন ফিরে
সন্ধ্যার টকটকে রোদ, গলছে--
একদিন আমার বসত ঠিক ওইখানে ছিল











অসম্ভব কিছু

অসম্ভব কিছু চাই হাতের ভেতরে
যাকে প্লেটের ওপর ছুড়ে দিলে
সান্ধ্যতীর বেদনার মতো
গুণ্ঠিত মনে হয়
একদিন রাজশেখর বাবু
আমার বিদ্যাভবনের পিতা
দু’হাত অসাড় করে
চেয়েছিলেন অসম্ভব কিছু
আমি বললাম
আপনার ধ্বনিগুলো অন্ধকালা স্যার
আপনার জন্য বয়ে আনা রজনীগন্ধা
আমার পায়ের তলায় লুটিয়ে পড়েছে
এ কিছু অসম্ভব ব্যাপার না তো!
তুখোড় বৃষ্টির দিনে
উড়িয়ে দিয়েছি সে কী কাগজের ঘুড়ি
সান্ধ্যতীর বেদনার ভাষা
কেউ কিছু জানে?
এই তীরে গুণ্ঠিত আছে মৃত ঘুড়িগুলো










জলরঙ কলা

কিন্তু আমার ভেসে থাকবার উপায় হলো না আর--
গঞ্জের অসুখ নিয়ে বিভোরে ঘুমিয়ে পড়েছি
চোরাকাঁটা, শীতের স্বভাবে--
আমার ঘর ভাঙছে, সমুদ্রে
লবণের চাঙড় এসে--
ঢের উঁচু বরফের দিকে তুলে ধরেছি আমার
বিস্রস্ত মুখ
আমার মুখ ভাঙছে... ঘুম ভাঙছে
ভাঙছে বত্রিশ বছরের এক প্রাচীন পরিখা--
আমি ঢেউয়ের গভীর থেকে তুলে আনছি
অসুখের অজস্র প্রবাল
স্রোতের বিভাজন কিছু
আমার পূর্বপুরুষের ঘিলু
প্রেমিকার মুখের লালিমা--
পতনের শব্দগুলো ভেসে যাচ্ছে গভীর নিরিখে
ঝিনুকের-শঙ্খের ভেতর কিছু তার বিভাজন থেকে যায়--
জলের কুণ্ডলি ঘিরে ডুবে যাচ্ছে জীবনের
তুখোর বর্ষণ--
হর্ষরোদ মাছের ঝিলিকের ঘায়ে
উড়ে যাচ্ছে আমার চোখের পাতা--
টান টান সিনায় লালিত সাহস
ঘুঙুরের নৃত্যের মতো
নেশায় আকীর্ণ স্রোতে
কেবল গুণ্ঠিত হয় নাভিতে আমার--
সরল নখের ফাঁকে চাঁদের গলিত আলোয়
জলরঙ কলাগুলো
পৃথিবীতে থেকে যায়
শিল্পের অসম ভাষায়...
অসমাপ্ত নদী

অসমাপ্ত নদী
তোমার দুন্দুভি নিয়ে
এবার নামাবো আমার ঘোড়া

নেই আমার ধানের কুঠরি
নাচের যথেষ্ট মহড়া
তবু চাই হোক
বাঁধা থাক
জন্মের অনিবার্য গতি...

অসমাপ্ত নদী
অর্ধেকই ভিজিয়েছি পা
সেবার চড়ায় বসে
যা তাকে ঘুরিয়ে বলেছি

অসমাপ্ত নদী
তোমার ঢেউয়ের কেশরে
মৃত ব্যাঙ, পূতিগন্ধ
আমি যার নমস্য কবি

একদিন করেছি প্রার্থনা







লক্ষ্য

এইসব জীবাশ্ম, বর্ষার পাখি-- শরীরের লক্ষ্য হতে বহু দূরে থাকে। সে বছর ভ্রমণে আমার ফিরে এলো দৈবদিন-- চারণ প্রার্থনায়। চাবুকের উল্লম্ফন হলো ঢলে পড়া হ্রদের কোরাসে। আর ভ্রামণিক যারা, ভালোবাসে ডুমুর ফলের হাসি, বেতসের বঙ্কিম কাটাত্বক... আমি তার লক্ষ্য হতে ফিরে আসি যুগান্তের শস্যবন্দনায়। আমাকে চেনে না হ্রদ, খালবিল তরল সিম্ফনি। চাবুকের গঞ্জনা হয়... দূরে ঐ উদ্ধারের মৃত বরিষণ। কারো হাত ভরে দেয় ভালোবাসা দিয়ে। পড়ে আসে শীত। আমি চাই লক্ষ্যের প্ররোচিত হাসি। ওড়াবো বুকের মস্করা। আমি চাই ফল জীবাশ্ম তাতার-ওড়া দিন। যারা খায় তরল ধুতুরা-- মরে আর বাঁচে ঢের বেশি...


















একবেলা রমনাপার্কে

রমনার ঘাসগুলো শীতের কাইকুই ভেঙে
একটুও উড়তে পারছে না
না-হয় আমি যাই, ওখানে...
ক্লিবলিঙ্গ যেখানে রোজরাতে শুয়ে পড়ে
শীতের আঁধার কোরাসে। আর কোনো লাশঘর নেই
হাতিশাল কিংবা রান্নার ধোঁয়া...
ব্যান্ডেজ পায়ে কেউ কেউ আসে। ঘুষি মেরে
ছিঁড়ে ফেলে অশোকের পাতা--
বাড়িতে ঘুমোচ্ছে যার নবপরিণীতা
তার অম্লরোগ থাকে--
দীর্ঘ প্রাতঃভ্রমণের কালে
ঘাসগুলো শীতের বিশুষ্ক রোদে
কখনো দাঁড়াতে পারে না
কেননা, কেউ নবপরিণীতা
একদিন ঢলে ঢলে শুয়ে পড়ে ঘাসে
ক্লাসের গরাদ ভেঙে ছুটে আসে বিদ্যালয়
সাম্প্রতিক কলেজের আলো
নিরাপদ দূরে দূরে
এইসব জানাজানি করে তারা









প্রসঙ্গ নাভি

একপিণ্ড আলোকে তার নাভির দিকে নেমে যেতে বললাম
সে তার ডানা খুলে খুলে
ঘরময় বাড়িয়ে দিল অজস্র হাত
আমি তার মস্ত হাতে চাপা পড়ে অন্ধকার হয়ে থাকি
-এই আমার ভূগোল

একপিণ্ড আলোকে কখনো বলিনি আমার প্রেমিকার কথা
আমার শখের-আনন্দের কথা...
একবার সে ঢুকেছিল আমার প্রেমিকার ঘরে
সে তার হাত দুটো স্তন দুটো আবদার করে
কেড়ে নিয়ে গেল
সে তার জ্বল জ্বল চোখে অন্ধ করে গেছে প্রেমিকা আমার

একপিণ্ড আলোকে তার নাভির দিকে নেমে যেতে বলে
আজ আমরা অন্ধ হয়ে আছি-
ঐ এক নাভিতে কিছু বর্ষা জমে ছিল

একপিণ্ড আলোকে তার নাভির দিকে নেমে যেতে বললাম
কেননা, তার জন্মের বৃত্তান্তে কিছু নাভির প্রসঙ্গ ঢুকে পড়ে...









বিমর্ষতা

এই বিমর্ষতা একদিন হাতের ফাঁক গলে
উড়ে যেতে চেয়েছে কোথাও
বলেছি-- যাও...
কলকে হাতে দুয়ারে বসেছে ঋষি
ওষুধের রঙ, বিদ্যালয়ের ভাষা
এসব কিছুই বিমর্ষ নয়-- বলেছিল সে
ময়দানের হাঁসগুলো
উড়ে যেতে চেয়েছে কোথাও
বলেছি-- বসাও...
তোমাদের আত্যন্তিক স্নেহগুলো
এই সাঁঝে বসিয়ে যেতে পারো
অথবা বসাও
কে কতো বিমর্ষ হতে পারো
পড়ে আছে সেলাই সুতো, সোনামুখো সুঁই
কারো হাতে তুলে দিয়ে যাবো
অভিন্ন সব বিমর্ষতা
নকশিকাঁথায় অবশ্য তুলে দিও











মেঘের উৎস সন্ধান

মেঘ বলছে ব্যবস্থাপত্র গুটিয়ে রেখেছে তার
এইমাত্র উড়াল দিয়েছি
গায়ে জমে আছে ভ্রমণের দীর্ঘ খরতা
এবার ঝড় আসুক
মৌসুমের অকস্মাৎ ঝড়ে রাজ্য শাসনের মতো
কিছু অসংলগ্নতা থাকে
আমাদের কর্তব্য এবার উড়ে যাওয়া
চারিদিকে মেঘ, আর ভাবি
ঘোষিত ব্যবস্থাপত্রে
কী কী সব উপভোগ্য থাকে?
দিকে দিকে উড়ছে কালো কাক
খোঁয়াড় ভেঙে শিকারেরা হামলে পড়েছে বনে
আমরা যে উড়ি
এসব কিছুই অবিবেচ্য নয়
আমাদের গ্রহণ বর্জনের ভীতি
পৃথিবীতে মেঘ হয়ে উড়ে বেড়ায়












শীতের বিবর্তনগুলি

শীতের প্রবন্ধগুলো শেষ হয়ে এলো। খোলনলচে পালটে ফেলেছে কলাইয়ের মাঠ। আজ কি উঠেছে চাঁদ? পাতায় পাতায় জমে উঠছে পরিব্রজ শিশিরের সুখ। দেখো, সন্ধ্যে হলে পূর্বাপর প্লাবনের মতো জরায়ুর নিভৃত শোকে আমি শীতের প্রস্রবণ দেখি। আর আমার অধ্যয়ন জুড়ে সুর তোলে নিঃসঙ্গ পেঁচার ভৈরবী। আমি তার প্রাণান্ত অন্ত্যমিল ভেঙে খুঁজে দেখি পতনের বৈরাগ্য শুধু। তবে কি ঝরেছে শিশির? হাইব্রিড ফলনের কিছু অভাবিত সুখদুঃখ থাকে। আর এই দীর্ঘ প্রবন্ধব্যাপে উল্লিখিত যা যা থাকে-- চাদর গোটানো মুখ, মাছ ভাজার ঘ্রাণ, আবাল্য আমাকে কারো ভালোবাসার ওম... আজ আমার সংসারে তাকে ব্যবহৃত তুলসীপাতা, অব্যর্থ পথ্যের মতো উপলক্ষে প্রযতেœ রেখেছি

















গণতন্ত্রের তীর

আস্তে আস্তে ডুবে যাচ্ছে ভোটযুদ্ধের সম্ভাব্য দলিল
একজন কৃষক তার ন্যাড়ামাথায় ঘষে চলে উনুনের ছাই
একটু বিলম্ব হলে জঙ্গলের শেকড়বাকড়ে
ছেয়ে যাবে তার তেলতেলে মাথা
সে তার বলদগুলো বদলে নিতে চায়
সবুজ ঘাসের ভেতর ছড়িয়ে দেবে তার প্রস্রাবের রঙ
তাকে কেউ চিনতে এলে দাঁতগুলো খুলে ফেলে দেবে
তার দিকে ধেয়ে আসা আনন্দ মিছিলে
সে শুধু বাজাবে বাঁশি
তার শরীরে প্রবিষ্ট তীর তুলে দেবে ভোটযুদ্ধের
ইশতেহার হতে
সাঁই সাঁই উড়ে যাচ্ছে অজস্র গণতন্ত্রের তীর
তীরের চকচকে ঠোঁটে উৎসর্গিত ওষ্ঠের সুষমা
মুখের গন্ধের ভেতর রক্তের প্রমত্ত ঝলকানি
সে দেখে, একটি ভূমিষ্ঠ শিশুর কাঁচা ত্বক ধরে
গড়িয়ে পড়ছে লাল
আর তার পুনর্জন্মের ক্ষতদাগগুলো
ধীরে ধীরে জ্বাজল্য হয়ে ওঠে










প্রসঙ্গত ঘটনাবলী

আজ যে ছেলে মেঘ দেখছে
পাতার ওপর দাঁড়িয়ে তাকে বেঁচে যেতে হবে বহুকাল
সারা বাড়ি অন্ধ করে
ছেড়ে যাবে শিকারী মোষেরা
তার শরীরের আগুন
আগুনের লালার ভেতর
বেড়ে উঠছে ভ্রমণের স্মৃতি, সান্ধ্য মেলামেশা
আজ যে নদী গোঙাচ্ছে দূরে
তার গোঙানির ভেতর
মজে আছে এক দুরন্ত শিশুবেলা
থকথকে ঘাস
হলুদ কাউনের মাঠ
আজ যে বাঁশিতে চৌরাসিয়া রিভারস রিভারস করে
সরণিতে তুলে দিচ্ছে ঝড়ের মর্মর
আমার সদ্য ভাসানো ভেলা
মেঘ দেখা প্রভূত ঘটনাবলী
প্রসঙ্গত করতালি ভেঙে
একটুও এগুতে পারছে না










রক্তের ভাষা

আমাকে পাথর থেকে তুলে নিয়ে
চর্বি খুলে গুনে দেখছো হাড়
দীর্ঘ পঁয়ত্রিশ বছর আগুনের সান্নিধ্য থেকে
যাকে একবার নিবেদন করেছি ‘নক্সী-কাঁথার মাঠ’
কবে যে দোলনায় আর বাকিকাল খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে
ভেসে গেল দীর্ঘ বয়স
গ্রামাঞ্চল, নটিবাড়ি, হাটখোলা, বিদ্যাভবন
আজো কি যথেচ্ছ করেছি অধ্যয়ন?
বুকের চারপাশ দিয়ে গজিয়ে উঠছে শিং
ঘিলুজল গড়িয়ে গড়িয়ে খোলা পায়ে পাতায় পাতায়...

মাগো, আজো হন্যে হয়ে তালাশ করি যে জল
গাছে গাছে, ফল হতে শাশ্বত রক্তের আকর
যে যার মুখশ্রী হতে বুঝে নিতে চায় রক্তের ভাষা
আর আমার নক্সী-কাঁথায় বেড়ে যায় রক্তের দূরত্ব ঢের

তোমার ধ্যানমগ্ন মুখে ক’ফোঁটা অশ্রুর ভেতর
যুগ যুগ ভ্রমণ করেছি, নার্সিসাস...
নিশ্চিত জানো না তা কিছু
হাড়ের গল্পচ্ছলে আমাদের নক্সী-কাঁথায়
কতোবার এঁকেছি তোমার তোমার অবিশ্বাসী মুখ!







ব্যথার অস্তিত্ব সন্ধান

কিন্তু আমি না সেই ঋষি ধ্যানী প্রফেট এ্যালজেবরার দক্ষ টিচার বদ্ধ জ্ঞানী উড়ো পাতায় জলের মতো নিঃশেষিত দাহ্যপ্রবণ নির্মমতার ভয়াল আধার কাঠের টুলেই কেটে গেছে বর্ষা আমার নব্য জ্ঞানীর খড়ম সরম ওসব থেকেই প্রত্ন ব্যামো সেই ধরেছে উগ্লে ওঠা বিষফোঁড়াটা ভাবছি এবার তুলেই দেবো ব্যথার শিরা ব্যথার পিঠেই মুখ ঘষেছি রং লাগেনি বরং কিছু ব্যথাই হলো ঘষটে মুখে চিমনি ভেঙে রং এনেছি যাচাই বাছাই হচ্ছে হবে এবার প্রভুর জ্ঞানের বহর শহর শহর ঘুরেই মরে যেমন-বা নীল আকাশ জুড়ে উড়েই মরে খয়েরি চিল কে-ই-বা ব্যথা কবার হাগে কবার-বা খায় পরান ভরে চাইলে ছুঁতে হাতের ঘষায় কম বা বেশি শিউরে ওঠে অথবা ঢের নগ্ন দেহে দুই কাঁধে দুই শালিক বসায় পুলিশ ভেবে
















সোজাসাপটা বলা

আমার নিকট থেকে কেউ পাশের বাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ পায়। ধান, নাকি গম যব-- এসব কিছুই আমার স্মৃতিতে আসে না। অথচ মাড়াই হচ্ছে কিছু ইঞ্জিনের পেট্রল পুড়িয়ে : কাউকে কি পাঠাতে পারি? আমার রাগ ক্ষোভ আবেগানুভূতি একবার যদি কাঁধে তুলে বয়ে নিয়ে যায়! আর সরু লেজসমেত একবার ঢুকিয়ে দেয় ইঞ্জিনের আধারের ভেতর! যেমন আমার কবন্ধ শরীর একবার সবটুকু ক্ষুইয়ে এইমতো অন্ধ হয়ে আছে। আর আমার বিলেতি কুকুর, নাম : মিস্টার টম, আমি তাকে বহুবার মৌসুমের মেহনের জন্য নিয়ে গেছি সদর রাস্তায়-- যে কি-না আমার সুরম্য টাওয়ারের ভেতর কোম্বলের গোটানো ওমে সাবলীল হয়ে আছে। এবার তাকে ঘরে রেখে, অলিগলি চোরাপথে নিজেই দেখো ঘুরিফিরি-- তার জন্য আয়না-কাকই, মোটা জুতো-- সোজাসাপটা বলাই ভালো, উপভোগ্য রূপের তালাশে...















চাঁদের জন্য প্রার্থনা

আমরা দক্ষিণে বারান্দার দিকে গাড়ি রেখে
সিঁড়ি ভেঙে উঠে পড়লাম ছাদে

কেউ আমাকে ডাকলো, আর
রেলিং ধরে ঝুঁকে পড়ে দেখি--
এলোমেলো ছড়ানো এক গোল চাঁদ নিয়ে
সে কী কাণ্ডই না ঘটে যাচ্ছে নিচে!

চাঁদ বলছে, ‘এবার দেখি কে কে আমার
কলঙ্ককে মেনে নিতে পারো?’
আর আমি দীর্ঘ সাতশো বছর পৃথিবীতে
একটি চাঁদের জন্য প্রার্থনা করে
তার কলঙ্ককেই জোছনা ভেবে বসে আছি















বোধের কবিতা

মৃত ঘড়িটির পায়ে জমে আছে বোধ
বর্ষণে তার নিভে গেছে সব বোধ

দেয়ালের গায়ে মাকড়সা বোনে জাল
নিভৃতে তারে ছুঁয়েছে একটি আল

এই ঘড়ি নাকি মর্মে ধরেছে কাল
বর্ষণে কিছু হয়তো পড়েছে ভাটা
মৃত মথগুলি খেয়ে গেছে তার কাঁটা
সূর্যের দিকে কিছুটা খেয়েছে টাল

দেয়ালের গায়ে ভাবনায় এতো আলো
মৃত ঘড়িটিকে ঘিরেছে নিবিড় কালো

মরে গেছে তার সময়ের যাদু ভীতি
বজ্র আঁধারে আছে কিছু পরিচিতি











কেউ কি প্রসিদ্ধ হলো

শীতল বারান্দার পাশে ঝুঁকে আছে রক্তরঙা ফুল। কেউ কি মোহিত হলো? ছাদের কার্নিশে বসে একটি-দুটি রাঙা বুলবুলি, আমগ্ন গন্ধের ঝাড়ে বাড়িয়ে দিয়েছে তার প্রমত্ত ক্ষুধা। আজ আর খুদ-কুড়ো জোটেনি কোনো গেরস্তের ঘরে। একমেঘ ভাসমান হাউই, হল্লা করে আমাদের বৃষ্টিভেজা মাঠে কেন যে অনাস্থা রেখে গেলো! তাদের দম বড়ো কম। একটু একটু ঝড়ো হাওয়া শীতল মৃত্যুর মতো মুগ্ধময়। ওরা বলে, ঝড় চাই, ঝড়; সমস্ত উদ্যানজুড়ে খড়খড়ে পাতার ওড়াউড়ি।... এবার বিপন্ন হলে ব্যাপক সন্ধের ভেতর আমাদের হালটের মতো নির্জন হয়ে যাবো।... এক আছে পড়শিবাড়ির মেয়ে। আর বড়ো উত্তাপ কিছু নেই। গভীর বৈরাগ্য আমাকে চেনে। আমি জেনে গেছি, এইসব মায়াবাস্তবতা মার্কসের চেয়ে ঢের বেশি বোঝেনি তো কেউ। আমাদের ক্ষুধার রাজ্যে কেউ কেউ উগড়ে দিয়েছো বমি, শ্যাওলা ঘুণ ছেটানো মগজ। কে পারো নিশ্চিহ্ন করো... গভীর শেকড়সমেত উপড়ে ফেলো খানাখাদ্যরক্তহীন বীভৎস দালান। ছাদের কার্নিশ ভেঙে উড়িয়ে দাও এক-সহস্র রাঙা বুলবুলি। যে পারো নিশ্চিহ্ন করো... উচ্ছল ঝরনার পাশে একঝাড় রক্তরঙা ফুল, প্রাণান্ত গন্ধ সমাহার...

কেউ কি প্রসিদ্ধ হলো?









যে এই নারী

আমি যে মৃত মেয়েটির কাছে ফুলের গন্ধ বয়ে নিয়ে এলাম, তার জারুলপাতা শাড়ি, ধূসর হাতঘড়িটির পাশে রেখে এলাম আরেকটি বৃক্ষের স্বপ্নচ্যুত রাশি রাশি ফুল... আর আমি ফুল ভালোবাসি বলে একটি অনাথিনী গাছের পাঁজর ছিঁড়ে বয়ে নিয়ে এলাম ভালোবাসার পবিত্র ভাঁড়ার... যে এই নারী একটি সকালের মতো তার সমস্ত জীবনের পাশে ভেঙে ফেলেছিল রাতের নিস্তব্ধ কপাট... একটি শস্যগন্ধা মাঠ, দুগ্ধবতী গাভী আর তার টসটসে ওলানের প্রতি তুলে ধরেছিল আমার সমস্ত মনোযোগ। যে এই নারী আমার বিধ্বস্ত লাবণ্যের ভেতর গুঁজে দিয়েছিল হাজার রাতের স্বপ্নে পাওয়া সোনার কাঠি রুপোর কাঠি... আমার অন্ধকার ভূগোলের ভেতর একে একে সঁপে দিয়েছিল অজস্র নক্ষত্রের আকাশ, লক্ষ্মীপেঁচার চোখ। মর্মছেঁড়া দুঃখগুলো স্নিগ্ধতার উদ্যান জুড়ে পালকের মতো খুলে ফেলেছিল বেদনার্ত স্মৃতি...
ওই তার খুন-হওয়া জীবনের প্রতি কারো কারো মনোযোগ ভেঙে আমি বয়ে নিয়ে আসি এইসব পুষ্পসমাহার... আর তার মৃতমুখ থেকে ঠিকরে-পড়া রোদে মানুষের থমকে-যাওয়া বর্ধমান আয়ু, তার আনত মুখশ্রী ভরে ঢেলে দিচ্ছে অরণ্যের শুভ্রতা... ঝর্ণার মুগ্ধতা কিছু, জীবনের অঢেল সুষমা...








নাভি

নিরপেক্ষ নাভির দিকে ঝুঁকে আছে আসমানের চোখ
এই বৃষ্টিবাদলার দিনে
প্রাগুক্ত আলোক বর্ষণে কী আর সাযুজ্য থাকে!

একা একা একটি নাভি
আলোচ্য প্রসঙ্গ ধরে কোনো কথাই বলছে না

এ-মৌসুম শরীরে শরীরে বয়ে যাচ্ছে প্রচণ্ড ঝড়
এ-মতো অযান্ত্রিক শিরায়
কতো যে বায়না থাকে এক একটি নাভিকে ঘিরে

বিবিধ প্রসঙ্গে নাভির সংক্রমণ বোঝা যায়
আমাদের জন্মদিন হতে নাভির প্রসঙ্গগুলো ভুলে যেতে হলে
সমস্ত মিথ্যাবাদই প্রসিদ্ধ হয়ে ওঠে

মৃতের বিস্মৃতিগুলো বিদগ্ধ হলে
কেবল নাভিই বেঁচে থাকে











জলক্রীড়া

দীর্ঘদিন জলের চাঞ্চল্য হতে মুগ্ধতা গেলো না

যে জল আছড়ে পড়ে ধুয়ে গেলো শতাব্দীর ফসল
তার সুঠাম কোমরের প্রতি দৃষ্টি চলে যায়

যে কোনো গাল্পিক যদি এ-সব সম্বন্ধ নিয়ে
তার খেরো খাতা ভারি করে তোলে
এ হেতু সুদীর্ঘ একটি নদীই বরাদ্দ করা যায়, তার জন্য--

জলের নিচে ঘর করে যে নাবিক
প্রকৃত আরোগ্যের জন্য বসে আছে
ঝর্ণার প্রবাহ কিছু তাকে তো পাঠানো জরুরি


















আমি নাকি

কেউ বলে আমি নাকি দীর্ঘদিন হলো ঘরবাড়ি ছেড়ে একটি দোতলা বাসের পিঠে সওয়ার হয়ে প্রাতঃভ্রমণের অভ্যেস করেছি। আর বাড়ির জন্য সম্পূর্ণ আগুনের তৈরি একটি আত্মপ্রতিকৃতি পাঠিয়ে দিয়েছি ক্রাচে। আমাদের পুকুরপারের বনমরিচগুলো অপেক্ষায় আছে। আর একটি মেটে হাঁস তার সমস্ত চৈ চৈ ভেঙে সেই থেকে এক ঠ্যাং তুলে জলে নামার অপেক্ষায় আছে আজো। আর আমাদের সদ্য বিয়োনো গাভী একমাত্র নধর বাছুরের জন্য আজো নাকি অবরুদ্ধ রেখেছে তার ওলানের দুধ। অথচ আমি সেই কবে একটি উড়ন্ত চিলের পিঠে চড়তে গিয়ে কোথায় যে পড়ে আছি হিতাহিত খেয়ে। আর একবার নাকি এক ডলার বণিকের হাতে উঠে গেছি সমস্ত কঙ্কাল নিয়ে। এ-ও আমার জানা হলো না যে, আমি এক বিদগ্ধ প্রেমিক, প্রেমিকার স্তনের ভারে চাপা পড়ে একবার জ্বালিয়ে দিয়েছি তার দুরন্ত কেশদাম। আর সেই পোড়াগন্ধ খেয়ে খেয়ে আমার চোখমুখ থেকে ঠিকরে পড়ছে শুধু মানুষ পোড়ার ঘ্রাণ। আমি নাকি স্নিগ্ধ এক জলাশয় আর মধ্যরাতের গহীন অরণ্যের ভেতর অন্ধকার পেঁচার চোখের সমস্ত তীক্ষèতা পেতে বেঁচে আছি পৃথিবীর এক ধাতব সমুদ্রে। আমি নাকি আমার ছোট্ট বোন আর ছোট্ট ভাইটির জন্যে প্রকাণ্ড এক হারমোনিয়মে এই সমুদ্রের তাবত গর্জন তুলে নিতে চেয়েছিলাম একদিন।







সিজোফ্রেনিক

আমরা বারান্দায় বসে একখণ্ড ধাতব মেঘের গল্প শুনছিলাম। শুনছিলাম, হাততালি দিলে ঐ অদ্ভুত মেঘের আড়াল থেকে কী করে পালিয়ে যায় পায়রার ঝাঁক। আমার বয়স্ক শিক্ষক একদিন বলেছিলেন বৃষ্টি আর মেঘের সে এক নিবিড় পারম্পর্যের কথা। সেই থেকে মেঘ দেখলেই আমার বুকের ভেতর পায়রার ওড়াউড়ি দেখি। দেখি তার সাদা পালকের ঢালে অজস্র বৃষ্টির প্রস্রবণ। আমরা প্রকাণ্ড ষাঁড়ের মৃত মাংস খাই। ভালোবাসি খুব। আর আজ এই ধাতব মেঘখণ্ডটি জীবিত এক হিংস্র ষাঁড়ের মতো আমার ভেতর অদ্ভুত এক আতঙ্কের নাম



















আমাদের প্রয়োজন সম্বন্ধে জ্ঞাতব্য

আমরা আর ঠেকবো না কোথাও। আমাদের পড়শিবাড়ির কোথাও কোনো ভালো ব্যায়ামাগার নেই। আজ যার গায়ে হলুদ, তিনি হলুদ প্রিন্টের জামায় ভীষণ মানিয়ে গেলেও, আমাদের আতিথ্য তার প্রয়োজন পড়েছে। আমরা আর ঠেকবো না কোথাও। আমাদের চিনে গেছে খেয়াঘাটের মাঝি, হলুদ বরণ উৎসব। আমরা দরকারী কেউ। নদীর পারে ধু ধু করছে বালি। চিনে বাদাম, কাঁকড়ার ফলন-- এ সব নিয়ে আমরা তো মেতে উঠতে পারি! আমরা আর ঠেকবো না কোথাও। দূরে দূরে খবর পাঠাবো যে, আমাদের কি প্রয়োজন পড়েছে আপনাদের? আমরা ভালো স্বাস্থ্য, ছৈ-সমেত নাওয়ের গভীরে যা যা কিছু করি তারও মাহাত্ম্য থাকÑ আমরা বলবো না কোথাও। আমাদের পড়শিবাড়ির কোথাও কোনো ব্যায়ামাগার নেই। আমরা ভালো স্বাস্থ্য, রোদ চাষ করি; জল ঘেঁটে তুলে আনি জলভৈরবী। ঘরের নড়বড়ে সিঁড়ি, শীতল পা-পোশের নিচে ধুলো, আমরা বর্ধিত কোলাহল, অজাত সম্বন্ধের ঘোড়া। আমাদের প্রয়োজন ছাড়া একদিন মেঘ হলো খুব, বৃষ্টি হলো খুব, অজস্র শিলা...












মাকড়সা

ঠিক ঠিক একটি মাকড়সা মরে পড়ে আছে এই শহরে। তার চোখমুখ থেকে ঠিকরে পড়ছে দীর্ঘ তেত্রিশ বছরের এক সৌর রশ্মিকণা। আর তার অসংখ্য পায়ের নিচে যে বেলুন ফোলানো ছিলো, তাকে কনডম ভেবে কেউ কেউ নাকমুখ ঢেকে অদূরে বাড়িয়ে দিয়েছে গলা। তার চেহারার সৌম্য কান্তি দীর্ঘ মৃত্যুর পরই সাবলীল হয়ে জ্বলছে। নগরীর প্রাসাদগুলি, তার মুখে ঝুঁকে পড়ে বলে : তোমার আত্যন্তিক স্নেহে এই দেখো আনত করেছি মাথা। যারা যারা মদ্য বা ধূমপান করে, তাদের অপবিত্র কণ্ঠ হতে তার জন্য বর্ষিত হলো আশীর্বাদ। আজ এই মৃত্যুস্নাত ভোরে এ শহর গুটিয়ে রেখেছে তার পোশাকী সরম। প্রিয় মাকড়সা শাহরিক সীমান্ত ভেঙে উড়িয়ে দিয়েছে তার সূক্ষ্ম জটাজাল। কে তাকে মৃত্যুর মতো ডেকে নিয়ে এলো!
মৃত মাকড়সা চিৎ হয়ে পড়ে আছে শহরের প্রসিদ্ধ প্রাঙ্গণে। তার রক্তহীন পা, আকাশ বিদীর্ণ করে ভুলে যায় মাটির মুগ্ধতা














তোমাকে দীর্ঘদিন না দেখার পর

বিশ হাজার বছর, খুব কি বেশি? নাকি বিশ দিন, খুব কম? আমি নরম করে কথা বলতে জানি। এ যে মাটির কথা! একটু একটু জলেই কেবল ক্ষয়ে ক্ষয়ে যায়! কতো যে জল গড়িয়ে গেল হাজার বিশের গায়ে! নাকি বিশ দিন-- তোমার অর্ধেক মুখশ্রী আমি দেখেছি এরও ঢের দিন আগে; যেমন চাঁদ-মৌসুমে, আমি বনের মধ্যে হাঁটাচলা করি! যে প্রিয় ফুল, তার চাঁদমুখ আমি নির্ণয় করি কিনা। বলো বিশ দিন-- খুব কি কম, নাকি হাজার হলেই খুশি-- আমি তোমাকে দেখি না





















ঘরে ফেরা হলো না

তোমাকে দেখছি আর হাড়জিরজিরে একটি মানুষের মুখ আমার বুক থেকে উড়ে যাচ্ছে। তোমাকে বাঞ্ছা করেছি আজ-- বিকেল বিকেল তোমার শাড়ির মধ্যমা থেকে একহাত সূর্যাস্তের দিকে ঝুঁকে বসবো। এই পাকের্, আমার রুটিনকর্মের এই দিন, একটু একটু হেলে পড়ছে সূর্যোদয়ের পর-- আমরা যখন, মানে ঐ হাড়জিরজিরে আর আমি-- যখন প্রচণ্ড মাছ ধরতে ভালোবাসি বলে জলে নেমে যাই... তোমাকে দেখলাম আর একটি একটি বনমরিচ ঝরে যাচ্ছে তোমার ঐশ্বর্য থেকে; উড়ে যাচ্ছে কানের লতিকায় লুকানো উষ্ণতা থেকে বিদগ্ধ চিল-- যে তোমার কান নিতে এসে ঘুমিয়ে পড়েছিল। এই পার্কে--
এক. খুন হয় মানুষ
দুই. ঘুমোয় বিভোর
আমরা কি বসে নেবো নাকি নেবো না, আমরা কি খুন হবো নাকি হবো না, নাকি আবার ওড়াবো প্রেম মৃত্যুর প্রতি...
তোমাকে দেখলাম তাই পার্কেই সমৃদ্ধ হলো মরাপাতাদের খুন... বসন্তে... এতো পথ ভুল হয়ে গেলো; ঘরে ফেরা হলো না এবার













পাখিপ্রেম

ধর্মান্ধপাড়ার বাবুটিকে আমার বয়সে ছোটোই মনে হয়। সে যখন হামাগুড়ি দিয়ে পতপত পতাকার মতো বাড়ির আঙিনা ডিঙোবে-- তাকে বসতে হলো কাঠের চেয়ার ঝেড়ে। কখনো দেখেছি, বেতের আসনে আদরে আহ্লাদে জড়িয়ে পড়েছে সে। বাবুটির পরম দয়িতা ছিলেন, আমার ঘুমন্ত মাসীমা। তিনি তো ঘুমে। যাও আঙিনা ভাঙো বাবু। বাদ্যি শেখো, ঢোলক বাজাও, পাঁজর খুঁড়ে হাত ঢুকিয়ে বেদনা তুলে আনো। এবং কলমিলতা, পানাপুকুর, জলের মর্মে নাক ডুবিয়ে মীনধর্মে থেকো। ধর্মান্ধপাড়ায় আজ তার এক হাত উঁচু হয়ে আছে। যেমন দয়ার্ত কৃষক-- বাঁশের ডগায় মানবমূর্তি ফলবতী ফসলের কালে ঝুলিয়ে দেয় সুখে। আমার স্বভাব বলে, পাখিকে যে তাড়িয়ে দেয়, তার মধ্যে পাখিমন কি থাকে! অগোছালো পাখির মাতম আমার পরম ভালো লাগে...

















আমার সময় যাচ্ছে

আমার ভিতরে বসে কেউ একজন উগড়ে দিয়েছিলো সাদা ভাত। একবার ভাতজন্মে সে আমাকে লালন করেছে বুকে। আর আমার বয়স বাড়ছে বলে, মহার্ঘ শুক্রাণুর মতো অনেক কিছুই ধারণ করতে পারি।

তাকে আমার বয়ঃসন্ধির মর্ম খুলে বলে, নিভৃত পথে আমার এক জীবনে পালাবার কথা বলে দেয়া আছে। ভূভাগ দু’ভাগ করে কতোবার যে মিলিয়ে গেছি তলে!

পৃথিবীর প্রতিটা মানুষ এবম্প্রকার মহৎ কেনো ভাবি। আমার পলায়ন পথে কারো চোখে চোখ পড়ে না ভুলে আর ঠিক ঋণী হয়ে আছি যার যার কাছে আর ধারণ করেছি যাকে-- তারাই আজ কেউ কেউ আমার ভেতর থেকে উগড়ে দিচ্ছে সাদা ভাত। এসব কী ঘটছে, কোথায় যাচ্ছে... ভেবে আমার সময় যাচ্ছে খুব












আমাদের বাড়ি একজন বাগানের মেয়ে

এবার চোখের শার্শির মধ্যে জন্ম নিয়েছে রঙচোরা এক বাড়ি
একফালি কাটা তরমুজের লালে তার আরক্তিম চোখ
পৃথিবীতে ধ্রুব নক্ষত্রের মতো জ্বলে যায়
তার জন্মাবার পথে একটু একটু করে
তাকে আমি নিভৃতে নিয়েছি আমার চোখের ভেতর
ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছি তার ধুলোবালি, আশ-শ্যাওলা
বিশুষ্ক পত্রমঞ্জরি
প্রগাঢ় অরণ্যের পথ ধরে কেউ এখন হেঁটে চলে যাবে
অথবা একাকী পথিক বিস্তৃত সদর রাস্তায়...

এ বাড়ি বাসনা হলে নির্বিশেষ পথিকের ঠোঁটে
সঁপে দেবে পাতালের জল
গাঢ় প্রেম ঢেলে দেবে পায়ে পায়ে পরম মুগ্ধতায়
আমাদের একান্ত বাড়ি সাবলীল বসে আছে পায়ে পায়ে মাটির খোঁড়লে
আড়ালে লুকিয়ে গা-- এই আসে কাহ্নপা
চণ্ডীদাস, রূপসী বাংলার কবি আর শেফালিকা

এবার চোখের শার্শির মধ্যে চুপচাপ বসে আছে এক বাড়ি
শালপাতা মেহগনি নারকেল সুপারির ঝাড়ে
কেউ তাকে বসিয়ে রেখেছে এ গাঁয়ের সদর প্রাঙ্গণে
লালফুল রাইশস্য চিনিচাঁপা কাঁঠালের ঘ্রাণে, ধুয়ে গেছে
বিবাগী মুখের দুস্থতা। উদোম শিশুরা দেখে
অপার পৃথিবী ফুঁড়ে চুল খুলে বসে আছে জোছনায় বাগানের মেয়ে





পাতাল বিস্তৃত হলে ভালো

ভুলে ভুলেই এ সম্বন্ধ হয়ে গেছে। চারদিকে পাতাল নির্মিত হচ্ছে। আমরা ভালোবাসি টিলা। কখনো পাতালে যাবো না। যাদুমন্ত্র শিখিয়ে গেছেন মা। ঠোঁট ভেঙচানো হাসি কী তার রহস্য ঘোচে না। আমাদের বাড়িতে কোনো উঠোন নেই। চলছে পাতাল নির্মাণের প্রণালী। আমাদের বিশ্রাম চলছে বহুদিন। এ রহস্য ঝুলে আছে গাছে গাছে পাতার মর্মরে। আমাদের সম্বন্ধ হয়েছে খুব-- টিলায় টিলায়। আছে প্রতিবেশী। তারাই রহস্য বোঝে। আমরা ঘুমিয়েছি। আমাদের বিশ্রাম চলে। পাতাল বিস্তৃত হলে ভালো। আমরা টিলাই ভালোবাসি। আমাদের টঙঘরে আলো। আলোদের ঠোঁট ভেঙচানো হাসি


















মানুষের ভূগোল

মানুষের ভূগোল আমার দীর্ঘ পাঠ বিরতিতে রাজত্ব করে গেল। যখন সমুদ্রে ছিলাম, মীন রাজ্যে শরীরে ভেঙেছি জল। আচার্য দেবতাগণ, তাদের প্রমত্ত সাঁতার-- আমাকে অতলান্ত ধু ধু পথে টেনে নিয়ে গেছে সরোষে। যখন উষ্ণতা চাই-- অগাধ সমুদ্র ভ্রমণের পর, আগুনের দেবতা আমার শাশ্বতিক নক্ষত্রের দিকে ঠেলে নিয়ে যায়
আদি-অস্ত সাদা ঘুমের পর-- যেই বলি, বর্ণমালা, ও আমার বর্ণমালা, তোকে জলে ধুয়ে, আগুনে সেঁকে দীর্ঘায়ু পরম মানুষের মতো করে যেতে চাই...
প্রিয় বর্ণমালা দীর্ঘ পাঠ বিরতিতে মানুষের ভূগোলের কথা বলে


















পলায়ন : এক

নিভৃত পতঙ্গে আজ দাড় ভেঙে ঘুমিয়েছি ঘাসে
কেউ যদি বিবসনা হঠাৎ সিম্মৃত হয়ে খুলে ফেলে সুশীল সরম
এবার পালাবো তবে রাজার দরাজ স্বরে
দাউ দাউ উনুনের ব্যবহৃত আকণ্ঠ আগুনে

এতো হয় ভুল হয় চুলচেরা গণিতের আমগ্ন পাতায়
এ মতো ধূসর সাঁঝে বাসি ফুলে উড়ে উড়ে
আমাকে নিভৃতে ফেলে বাণে ভেসে যায়

দোর ভেঙে বুনো রোদ মাঠের লাবণ্যে যদি
মুছে দেয় প্রকৃত আয়াস, এবার পালাবো তবে
ধানের শেকড়ে শুয়ে যতো দূর ঘুম নামে শিরায় শিরায়

অথবা ফুরিয়ে যাবো, কেউ গেছে...; শালিখের পিরামিডে
শিল্পের সুষম চুলে জলের আর্দ্রতা যতো
ঝরে গেছে মধ্যাহ্নের তুমুল খরায়। এমন স্বরূপ ভাবি
কেড়ে খেলে কাক-চিল কিছু-বা কি ঘটে!










পলায়ন : দুই

কেউ কি পালাতে চায়? অথবা কাতর করে
মাঠ ঝিল নিরিবিলি মরে থাকে বরাবর অতি প্রিয়জনে?

কাকের ক্রন্দন গুনে চিরকাল ভালো থেকে বলে কী গো
এই দেখো, হাতের তালুতে বসে রাজহাঁস এলোমেলো
চরম শুশ্রুষা রাখে ব্রীড়ারত সুশীল সময়!

চাঁপার স্নিগ্ধতা মেখে যারা যারা ধুয়েছিল
সারামুখ ব্যবহৃত গ্লানি-মলিনতা; ঘুম-হৃত
সারাবেলা কেউ তাকে বলে না কি-- এবার মিলিয়ে যাবো
ষড়ঋতু ঘুম-জল অথবা প্রয়াণে!

প্রিয়রঙ ঘষে ঘষে আনগ্ন তুলেছে যারা
ত্বকের প্রণত ব্যথা; মাগুরের ঘাই নাকি
জলের সারল্য ভুলে মরে আছে তুমুল খরায়...
এবার পালাতে নেমে করোনি তো অভিমান গ্রহণের কালে!












পলায়ন : তিন

বিবেকী সভ্যতা এলো। তুলে রাখো কোলনের করুণ ধুতুরা
ব্যয়িত বৃক্ষের মূলে ছুঁয়ে দেখো পৃথিবীতে প্রাচীন জলেরা
এই করে ঘুমিয়েছে সোনালি সময়। মৃত সাল জ্বলে জ্বলে
তোমার পহেলা ভুলে মেলে দেয় অসুখের প্রাচীন প্রকার...

ক্ষণকাল মদিরার, হাউই ওড়ালে বলো নাটাইয়ের প্রণোদনা
কী যে ভ্রমে খুলে রাখো বিনীত আশায়; জলের অধীত কলা
স্বপ্নের সাদা পাড়ে অথৈ মালিন্য লেপে ঢেকে দিলে
প্রবরের প্ররোচিত মুখ; এবার পালাবে বলো--
ক্ষরণের সাদারঙ হরিতকি, তেলাকুচো, পীচফল হয়ে?

ভোরের আরোগ্য হয়ে একদিন পৃথিবীতে ঝরে যদি
ত্বকের কোমল; আলোয় বিবর্ণ মেঘে ঘটে গেলে
স্রোতে-পথে শোকের প্লাবন; কোথায় মনীষী বলো--
এ মতো আরোগ্য রোদে হলুদ সোনালু ফুলে গুঁজে দেয় মাথা!
চাইলে পারো কি ঢেকে এ মতো কাটাতে জীবন প্রথম প্রথম!












পলায়ন : চার

কথার কৌলিন্য ভেঙে শুঁকে দেখো মরা রোদ ঘাসপাতাময়
আঠায় জুড়েছে নাক অভাবিত অবেলায় করুণ দশায়

দয়িতা জেনেছে তার নাকফুল ঝরে গেলে থকথকে ঘাসে--
আলোর সান্নিধ্য ছেড়ে ঘুণে খাওয়া পৃথিবী কি মনে রাখে কিছু?

অথচ বটের ডালে যে পাখির ঘুম নামে হিম হিম চোখে
কে তাকে করেছে অমোঘ গভীর নিদাঘ হতে আড়ালে বসিয়ে!

মোরগের পালকে যে রতির প্রাবল্য আসে, বাড়িময় জ্বলেপুড়ে
নিয়ত অব্যক্ত তা প্রিয় পরিবেশে; ময়ূরীর খোলা বুক
কখনো কি ছুঁতে পায়, প্রকৃত পালায় যারা বিভোর নিয়মে!

প্রথায় পরেছে যে মৃত ত্বক, কোলাহল, প্রবাহ বাতাস
ধোঁয়ায় আকীর্ণ ঘরে পালাতে প্রবৃত্ত কেবল ঢুলু ঢুলু চোখ













পলায়ন : পাঁচ

ধুলায় ওড়ে কি প্রাণ, মৃত হ্রদ মৃত মেঘ মৃত পরিখায়
কেবল বিশুষ্ক তার প্রতিবেশ ওড়ে যদি চিতায় চিতায়

মুখের প্রসিদ্ধ ছায়া চিরকাল জুড়ে আসে অবারিত ক্ষতে
প্রভাবিত পৃথিবীতে এ হালে ঘনায় কালো প্রীত পরিবেশে

ঘোড়ায় চড়েছে যারা বিদিশার রঙকালো বিপন্ন মরায়
দুটো চাঁদ আধভাঙা অথবা সহস্র-সে, কখনো-বা
জ্বলেপুড়ে শ্মশানের মোম। কী গাঢ় সন্ধ্যায় দেখো
পালাতে পড়েছি ভেঙে নিহত চিতায়। ব্যথায় আকীর্ণ পাতা
এইবার পালাবে কি ছেঁড়া নক্সায়!

গড়িয়ে ধরেছে যারা একবুক ভালোবাসা...
মৃতমতো এই দিনে এখনই ওঠে কি চাঁদ
ভালোবেসে যারা গেছে, যেতে হয় বলে!













পলায়ন : ছয়

চারিদিকে খুলে রাখো সুশীল মুখশ্রী আর পালাও নিভৃতে একা
ভোরের জোনাকি। নাচের ঘুঙুরে বসে দেবতার পাঁয়তারা
অধীত করেছে তার পালাবার রীতি। প্রথা-রীতি, কিছু ব্যথা
কেবল উলঙ্গ করে ওড়ে না তো বাঁশবন আখক্ষেত শিশিরে শিশিরে...
আর এই অবক্তা শুশুক, জলের প্রসিদ্ধি বলে কখনো বাঁধে কি ঘর
ম্রিয়মাণ স্রোতে? নিয়ত আরোগ্য তার
অতল গভীরে বসে যতো দূর মনে পড়ে
প্লাবনের ভীতি! অতঃপর, রৌদ্রের তালাশে নেমে
পালাতে প্রবৃত্ত যদি ভাসমান স্রোতের প্রদোষে; দূরে দূরে
লেখা হয় এই মতো যথারীতি জলের প্রকৃতি

চতুর মুখশ্রী যারা নিমিষে উড়িয়ে দেয় সমগ্র প্রমাণে
পালাবার আনত পথে, কেউ কিছু বলে না তো
মৃদু রব, নীরব ক্রন্দনে














পলায়ন : সাত

অস্বচ্ছ ভালো কি বাসা যায় কোনো ক্ষণে? যে করে পায় না কেহ
ঘোলাচাঁদ পৃথিবীতে সূর্যের প্রমাণ। সারাবন মরে থেকে
অবাধ ঝঞ্ঝায় যদি কথা বলে নিমেষের বোলে
পাখিমন সখি তার কোথায় পালাতে নেমে, ভুলে থাকে
ওড়ার ব্যগ্রতা। ভোরের আলস্য কিছু জুড়ে এলে
প্রিয় বন অনাথ একাকী শুধু ভুল চরাচরে

প্রকৃত বেসেছে ভালো সবুজ অরণ্য যারা; এই পাখি
কোনো কালে ব্যাপক তুফানে বলো
কী করে ভাসাবে পালক, ডানার সুষমা!

দহনের পোড়ারঙ কখনো বিদগ্ধ করে
একদিন নিভে গেলে বিস্তৃত সবুজ; সমাহৃত হবে না কি
প্রকৃত প্রেমিক যারা দহনের কালে...?














পলায়ন : আট

আড়ায় ঝুলেছে মেঘ, খোলাছাদ কার্তিকে যাপিত পাপে
চাঁদমুখ মেঘখানি ঘরের দ্যোতনা ভেদে
পাঁজরের ব্যথা ঘেঁটে মনভেঙে পালালো কি বটের ছায়ায়...?
ক্ষমার অন্যথা যদি এ-ভব বিপন্ন সুখে ঝুলে পড়ে হিম ঘুমে
প্রকৃত প্রস্থান তবে আলোয় বিপন্ন নাকি
প্রিয় সমারোহে। মেঠোফুল ফুলদানি... অযথা ঘ্রাণের মদে
পড়ে থাকে অযাচিত হয়ে। উদিত করুণ মেঘ একদিন ঝরে না তো
ব্যাপক প্রণয়ে। নিমীলিত পৃথিবী সে বাসিফুল ভালোবাসা
দু’হাত উপুড় করে ঠায় পায়ে বসে আছে ব্যাপক সুদূরে

কেউ-বা ওড়ালে তাকে তুমুল প্লাবনে সে কি
ঘুম ঘুম খেলা ফেলে ভেঙে দিত বিরাট ভূগোল!
কুসুমের শোক-তাপ ভাঙনের মুখোমুখি
এই করে লিখে যেত খা-খা রোদ উনুনের তুমুল খরতা














পলায়ন : নয়

গ্রামের গভীরে এসে তবে নাকি ভোলা গেল আলোর মহড়া
আর এই ডুবেছে গ্রাম বিদ্যুততাড়িত রোদে ঘোর অবেলায়

শিশু যারা, আলোয় বিদীর্ণ হয়ে মনে রাখে সামান্য অতীত?
বলে না তো বেঘোরে উঠেছে চাঁদ বাঁশবন ছিঁড়েফুঁড়ে
বিনীত শাখায়! কেবল প্রযুক্তি ভোরে ড্যাব ড্যাব
চেয়ে দ্যাখে, কোনোকালে নিভেছে কি আলোর ব্যয়িত স্মৃতি!

কাতর ভেবেছে অতীত, বেহাল লুকিয়ে বাঁচা এই দেশে
হলো কি গো টেরাকোটা মৃত মাঠ প্রাচীন নিয়মে!
আবার পালাতে পেরে অভাবিত মিশে যায় সরল শৃঙ্খলে

খোলা ঝিল সরোবরে প্লাবনের সরু ধারা
যে করে ক্ষয়িত হয় প্রিয় রঙ গতরে গতরে














পলায়ন : দশ

গ্রন্থের গভীরে সে বিস্তৃত ঝুঁকে আছে মৃদু শিহরণে
গ্রহণে সচ্ছল যারা ঠোঁট ভরে তুলে রাখে পাতার আকর
ব্যাকুলতা নিভে গেলে ব্যাপক সিক্ততা তবু পারে হায় ভেজাতে অধর!

অবাধ ওড়ার কালে ব্যথাহীন ক্ষতে যদি মৃতের ছোবলে...
দারুণ শঙ্কিত হয়ে ঘিরে আসে হাজার মাকড়
অনাথ শরীরে তারা অভাবিত ভরে কি গো শোণিত ওজন!...
মৃতের ক্ষতেরা জানে ওড়ার আরোগ্য হতে
কত কী বা ব্যথাহীন ঝরে যায় প্রাচীর গড়িয়ে

অনাথিনী উড়ে উড়ে কোথায় পালায় বলো গ্রন্থের সাদায়
প্রখর বিস্তৃতি ভেঙে কেউ তাকে বুঝে নেয় পরম প্রহর
















পলায়ন : এগারো

একবার সম্বোধন করো।... চাইনি তো ধোঁয়ায় আকীর্ণ ঘরে
ঢেলে দেবে সূর্যের খরতা। সেবার বেজেছে বাঁশি আমলকি
বেথুল বাগানে। না হয় পাথেয় হবো কালোরঙ পৃথিবীতে
ভালোবেসে বলেছে যে এই নাও মুঠোহীন অন্ধের ভাষা
আর সে জেনেছে বুঝি বাঁশের খোঁড়লে শুয়ে
বিবাগী সুরেরা শেখে ভাঙাবুক শালিখের আঁতুড় যন্ত্রণা

ভোরের বিদেহ ক্ষতে জানো কি উড়েছে যতো
ধূসর খয়েরি কি-বা সাদাপুঁজ থকথকে প্রবীণ ভ্রমর
এ আমার প্রতিবেশ গুন গুন চারদিকে কাতর কোরাসে
বলিনি তো মেঘমন প্রবল বৃষ্টির তোড়ে ভাসাও ডোবাও

ভালোবাসি-- মজে আছি আবডালে, রাইক্ষেত মাথা তুলে
যতোটা আড়াল জানে, উপচোখে ঘিরেছে সে অনাথ বালকে
ছায়ার সুষমা না হয় বিবাগী সম্বন্ধ হলে
ধুলায় ওড়াবো মেঘ সাদা বক প্রিয় চিল আলোয় বিভাসে












পলায়ন : বারো

তোমার চুম্বন, নাকি বিশাল বৃক্ষের মেদে ভেসে আছে
পিকাসোর প্রেম। পাথরে জমানো জলে জাজ্বল্য হয়েছে খুব
অলীক স্বপ্নেরা। কখনো ফোটে কি ফুল বোবারঙ পৃথিবীতে
তোমার গন্ধেরা যদি খুঁড়িয়ে ফুরিয়ে যেতো প্রকৃত অতলে?

অধীনের প্রিয় ঘ্রাণ প্রমাণ সমুদ্র ভেঙে
ধুলায় সদম্ভ যদি মৃত চরাচরে, ওভাবে বৃক্ষের মেদে
তোমার প্রেরণা হয়ে বেছে নেবে ভুলের মর্মর?
না হয় শিকার হয়ে এবার কুড়িয়ে পাবো প্রকৃত ভ্রমর
শখের পবিত্র ফুলে গেঁথে যাবো সারাদিন ডানার কৌশলে

বলো কি উড়িয়ে দেয়া গন্ধের সুষমা কি নাটাইহীনা!
চতুর ঈশ্বরী যদি সুতোর সকাশ ছেড়ে
ডুবে যায় আড়ালে খোঁড়লে; এ ভুবন একদিন
বিগত শোকের মুখে অযাচিত ভুলে যাবে আলোর মহড়া













পলায়ন : তেরো

বিষাদ সন্দেহ ঘৃণা-- আলোয় লাবণ্যবতী এবার লুকালে তবে?
স্রোতের প্রচ্ছদ পথে বাঁকের গ্রন্থনা করে বেগবতী ওড়ার সারথী
জলের অনন্য গাথা কেউ তাকে মুছে দেয়
ব্যবহৃত ডানার সম্মানে। অপার লাবণ্য হতে কিছু রঙ খসে গেলে
সবুজ শস্যের জালে অবারিত জ্বলে ওঠে অলীক স্বপ্নেরা

যাপিত বর্ষায় দ্যাখো কুনোব্যাঙ পিপীলিকা গহন প্লাবনে ভেসে
বেছে নেয় সুড়ঙ্গ ঠিকানা। অথবা উড়ন্ত মেঘে
হাজার প্রত্যাশা-ঠাঁই ভরঋতু ঢেকে যায় প্রাচীন সলিলে

অধীনের ঘর ভেঙে যা কিছু মহার্ঘ বোধ, চিরদিন থেমে থেমে
করে নাকি দুইপাড়ে ভুল আরাধনা?
সমুদ্র বেড়াতে এলে জলের প্রতিমা মুখ
নিঝঝুম খেলা ভেঙে ভালোবাসে ওড়ার কল্পনা




তারপরে, তারকার হাসি





উ ৎ স র্গ
রূপনগর ছেড়ে যাব তাই তোমরা যারা আগলে রেখেছিলে
অপার হে আর প্রগাঢ় ভালোবাসা ঢেলে

এই মহানাগরিক জীবনে আমার অসহায় দিনগুলোতে
বুক ভরে যারা যুদ্ধে থাকার সাহস গুঁজে দেয়--

প্রিয় বন্ধু রশীদ, রিপন, স্বাধীন...
প্রিয় অগ্রজ মাহমুদ ভাই, বাবলু ভাই, বাদল ভাই, নাজিম ভাই...




























রূপনগর

রূপনগর আমার হাত থেকে একদিন কেড়ে নিয়ে গেছে চালতার ব্যাগ। আমার প্রিয় চালতাফুল, যাকে বড় হতে দিয়ে একদিন ছ’টাকায় উঠে পড়ি এই নগরের ট্রেনে; সঙ্গে ইলিশ পোড়ার ঘ্রাণ, কাগজী লেবু, অথৈ দীর্ঘশ্বাস... এই ফাঁকে মাটির হাঁড়িতে জল, শিং মাছের ঝোল-- এই নিয়ে ট্রেনের কামরায় কামরায় কেউ গান ধরে দিলে ঝিলপাড় থেকে ডগাভাঙা দুবলার কষে কেউ কেউ ধুয়ে নেয় হৃদয়ের ক্ষত। আর তাতে বনমরিচ, বুনো বিছুটির মতো টগবগ করে ছুটে যায় ট্রেন উত্তরের দিকে। আর আমি দুধভরা গাভীর ওলান ভেবে দুই হাতে খুঁজে পাই পুরু ফ্রেমের তলে ফোলা ফোলা চোখের অসুখ। বাঁশবাগান, ঘাসফুল, প্রাচীন হালটের ঢালে বাতাবিলেবুর ফুলে এমন আষাঢ়ের দিনে, একদিন মৌমাছি তুলেছিল বৃষ্টির ভাষা; অথৈ সবুজ থেকে নুয়ে পড়া স্নেহের গভীরে বসে চালতাফুল, ক্রমে তারা ফিরে পায় বহুরঙ মানুষের রূপ।... রূপনগর, এই প্রিয় অভিবাস মুখরতা কোলাহলে ছায়াহীন ভালোবেসে বসে আছে অজস্র স্টেশন শেষে


হাসপাতাল থেকে ফিরে

আমি যখন পাগল হয়ে ফিরে এলাম
দেখি, কেউ আমার চেনা নয় আর

স্ত্রীকে বলি-- ভাবি, তোমার মতো মেয়ে, যারা
সারারাত্রি স্বাস্থ্যসেবা করে
তারা কেউ নয় আমার স্ত্রীর মতো পরিচর্যারত

আমি তাদের চুমু খেয়ে, গন্ধ শুঁকে
মুখ ভরে ঢেলে দিই বাংলা মদের ঝাঁঝ
তারা কেউ কেউ বলে-- তাদের ঘরে রাত্রিযাপন
নির্বিঘ্নে হরিণ শিকারই

ভাবি বলে বাপু-- ‘তোমার সন্তানগুলো
তারা তো ঘুমিয়ে পড়েছে
আমাকে খুঁজতে এসেছে মধ্যরাতের মাঝি’
আমি দারোয়ান সমেত কাউকে বেরিয়ে যেতে দেখি

দেখি, ডাক্তার এসে আমার পালস দেখছে, গাল টিপছে
আমার হাড় কব্জি ঘষতে ঘষতে তার দীর্ঘ কালো চুলে
ঢেকে দিচ্ছে মুখ
আমার নিঃশ্বাস বাড়ছে, আর
সে তার কম্পিত ঠোঁটে রাক্ষস হয়ে চেটে খাচ্ছে রোগ



মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ গল্প

বারান্দায় সিঁদ কেটে চুরি হয়ে গেছে আমার প্রিয় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ গল্পের বইটি। তাতে আমার কোনো হাত নেই। কেননা, এ বইয়ের একটি গল্পও যখন পড়া ছিল না, তখন একদিন হারানের নাতজামাই ছোটবকুলপুরের যাত্রীদের কাছে নিয়ে এসেছিল কতগুলো উলঙ্গ টিকটিকির ছানা। আমি তাদের ছোটো ছোটো লেজগুলো ঝরে পড়তে দেখি; দেখি তাদের বিপন্ন নাচানাচি। যারা হাসছে, কাঁদছে আবার এই মতো বিচ্ছিন্নতায় ক্ষুধার জন্য মিছিলে যাচ্ছে, বিপ্লব করছে... আর সুরক্ষিত এলাকা থেকে তাদের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে নিয়মিত ঠ্যাঙারে বাহিনী; আমাদের প্রিয় মানিক দা তার কোনো প্রাক-গল্পের ভূমিকায় এ সংক্রান্তে কতদূর কী লিখেছেন, ভেবেছেন-- সে সম্পর্কে আমার ধারণা ছিল না কোনো



নেতা

নেতার কণ্ঠ ছিঁড়ে গলগল করে গড়িয়ে পড়ছে বর্ণমালা। যেন তস্করের পকেট ছিঁড়ে ঝুর ঝুর করে পড়ে যাচ্ছে সিকি আধলা-- সব। মাঠভর্তি স্রোতা। জনারণ্যের ভিড় ঠেলে দৃষ্টিবাণ ঠেলে দিচ্ছে নেতার কণ্ঠের সুষমায়। এবার ফিনকি দিয়ে উঠে আসছে মদ রক্ত বালি!... নেতার কণ্ঠের দিকে ঝুঁকে আছে উৎকণ্ঠিত সারি সারি ভাগ্যকামী মুখ। কেউ দেখছে, এই সব বালি একবার জেগেছিল পদ্মার বিক্ষিপ্ত গ্রাসে সারি সারি গ্রাম, বিস্তৃত শস্যের মাঠ যে সালায় ভেসে গেল ছল ছল বিপন্ন বাণে। কেউ দেখছে, এই সব বীভৎস তরল একবার ভেসেছিল জয় বাংলা যুদ্ধের প্রাক্কালে।
অবরুদ্ধ জনসভা চলছে তো চলছে নেতার রক্তচক্ষু অঙ্গুলি সাড়ায়। আর অকথ্য রক্তপাত হেতু নেতার মৃত্যুদৃশ্য কেউ দেখছে, কেউ দেখছে কি-না, বড় কথা এই সব ভাগ্যকামী মুখ থেকে চোখ তুলে এই যে নিস্তব্ধ হচ্ছেন নেতা; হতভাগ্য জাতিটার এমন দুর্দিন নাকি ইতিহাসে কখনো ছিল না



অভিবাস

মা আজ কান্নার জলে ভাসছেন
চিঠি লিখি--
শোনো মা
বকুল আমার ভীষণ বিরক্তিকর ফুল
যখন তুমি কাঁদবে, বকুলতলায়
কখ্খোনো নয় মা
আমার চিরুনি হতে তোমার দীর্ঘ দুটি চুল
মেঝের ওপর গড়িয়ে পড়ে গেল--
তুমি দীর্ঘকাল পর গড়ানো অশ্রুর ভেতর
কেমন করে ভেসে যাচ্ছো মা!
আজ কিংবা কাল
আরো যে সব নালিশগুলো তোমার কাছে পৌঁছে যেতে পারে
তা যেমন এই যে, কী করে আমরা
হাড়ের চিরুনি, ধাতব বর্শায় (বর্ষায়) অভ্যস্ত হয়ে উঠছি--

এই শহরে ভনভন করছে মাছি
তুমি কান্নার মতো নোনাস্রোত চোখে
কোনোদিন জেনে যেতে পারো
মাছিরা গুনগুন করে নিরন্তর কাঁদে



জনপদ

তোমাকে নায়িকার পেশায় কেমন মানাচ্ছে বলো তো? কতো দিন হলো চিংড়ি মাছের ঝোল, টাকি ভর্তা, মগভর্তি কফি, তোমার শরীরের আঁশটেগন্ধা ঘাম... এসব ফেলে অন্য নারীতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি। একদিন তুমি ডাকলেও তার আনুষ্ঠানিকতা, যা আমি অন্য নারীদের বেলায় মানিয়ে নিয়েছি, বলো, কখনো কি মেনে নেয়া যাবে আজ! ধরো, একদিন এক নায়িকার মনে রাগ হলো, গর্ব হলো, অভিমান হলো খুব--; সে কি তার শীতের ওম, বর্ষণের স্রোতে গড়ে দিতে পারবে কোনো জনপদ



নন্দনতত্ত্ব

বহুবছর পর একজন প্রাজ্ঞ নন্দনতাত্ত্বিক, তার দেখা পাওয়া গেল। দুর্ভাগ্য হলো, বহুকাল ধরে আমাদের নন্দনতত্ত্বের শানানো ছুরিতে অত্যধিক অনুশীলন হেতু যে যত্রতত্র হত্যাকাণ্ড ঘটে যাচ্ছে রোজ, তার কোনো ময়না তদন্ত, যা সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয় কিংবা নিরপেক্ষ কোনো সংবাদপত্রের রিপোর্টের ভিত্তিতে তৈরি হয়েছে; যা এই মহাত্মা নন্দনতাত্ত্বিক ফালি ফালি করে ছিঁড়ে ফেলে দেন, আর বলেন, এই হচ্ছে একজন স্যুররিয়ালিস্ট ম্যাজিশিয়ানের হাত থেকে প্রকৃত নন্দনতত্ত্বের মুক্তির পদ্ধতি। এরপর তিনি যখন আমাদের বাহবা পেতে শুরু করেন, তখন আমাদের মাথার ওপর পাকুড়গাছে পাতা ঝরার শুরু। তিনি বলেন, এ বছর বন্যার শেষে ফসলের ফলন হেতু সাম্প্রতিক নান্দনিকতা বিষয়ে যে সকল অনাড়ম্বর সেমিনারের আয়োজন করা আছে, সম্পূর্ণ ব্যুরোক্র্যাটিক পদ্ধতিতে তার নিরাপত্তা বিষয়ে, কতিপয় সুদর্শনা অক্সফোর্ড কিংবা বিশ্বভারতীর রন্ধনশালায় অনারারি ডিলিট-পদকে ভূষিত হয়েছেন



এত বিষাদ এত নিনাদ

আসল কথা আমরা সবাই এত গোপন আড়াল করি ভিড়ভাট্টায় এটা ওটা গল্প করে সত্য যা তার লাগাম ধরে যুদ্ধ করি বমি করি ঘরের কোণে যেমন কিছু গোপন থাকে মধ্য শীতের তপ্ত রোদে তুষারপ্রতিম এমন গোপন ছিটকে বেরয় মাংস ছিঁড়ে তবু এমন নিভৃতে সে থেকেই তো যায় কী হয় না হয় বলগা হরিণ ছুটে গেলে তবু কিছু হাওয়া তো বয় ছুটে যাবার অর্থ না হয় গোপন থাকে কিন্তু তবু মিথ্যে তা নয় পাতার ওপর বৃষ্টি এলে অনেকক্ষণই কাঁপতে থাকে কিন্তু যে মেঘ শূন্যের ওপর ভেসে বেড়ায় শূন্য বলেই মিথ্যে তো নয় শূন্যেরও তো হাত পা থাকে কাঁপতে থাকে এসব যেমন গভীর কথা এদিক ওদিক উড়ে বেড়ায় নিভৃত শোক দুঃখ তাদের গোপন থাকে কিংবা ধরো চণ্ডীদাসই রাধা কিংবা গোপ পল্লীর দুষ্টু বালক দুষ্টুমি তার আড়াল করে অমর তিনি করেই গেলেন প্রাচীন সে প্রেম কিংবা যেমন তোমার আমার এত গোপন এত বিষাদ এত নিনাদ তরুণ কবির রক্তে কি তা বর্ণমালায় ভাষা পেলেই লেখা হবে অমর কাব্যগ্রন্থখানি আমরা দুজন পরস্পরের যা যা জানি উঠে এলেই নিভৃতে তা স্বীকৃতি কি পাবে বলো মহাকালের কাব্যধ্বনির



দেয়ালে টাঙানো ছবি

যার দেখা পাবো বলে আমরা দীর্ঘক্ষণ
তার ড্রয়িং রুমে বসে আছি
তিনি এখন বাজার করছেন
চা খাচ্ছেন বটতলায়, পুরনো বন্ধুদের নিয়ে
মেতে উঠছেন নস্টালজিয়ায়

আমরা যে ফর্দ পাঠিয়েছি
তাতে আমাদের কোনো নাম নেই
অভিলাষ নেই
আমরা তার দেয়ালের ছবিটি দেখছি--
একটি কিশোর তার সমান বয়সী
একটি স্টিলের রিঙবল নিয়ে
আমাদের দিকে ছুটছে...
আর তার রিঙের ভিতর দিয়ে
যা কিছু এপাড় ওপাড় হয়ে যাচ্ছে দ্রুত
তা থেকে মুহূর্তও ঘোরানো যাচ্ছে না চোখ
-মা এসে কান মলে দিচ্ছেন
-অনর্গল বেত্রাঘাত করছেন স্যার
-প্রেমিকার প্রথম চুম্বনের স্মৃতি খুঁড়ে তুলছেন কেউ
আর চাকরির প্রথম চেক পেয়ে
বিবাহযোগ্য হয়ে উঠছে বাড়ি

আমরা যার জন্য বসে আছি, আজ তিনি
ঘরভর্তি আসবাব নিয়ে
চলে যাবেন নতুন বাড়িতে

উঠোনে টমটম গাড়ি
আমরা এটাওটা তুলে দিচ্ছি, ঝেড়ে দিচ্ছি
অথচ দেয়ালে টাঙানো সামান্য ছবিটি
হাজার চেষ্টাতেও সরানো যাচ্ছে না মোটে



ক্যাপ্টেন বাড়ি ফিরছেন

ক্যাপ্টেন বাড়ি ফিরছেন
আর মাত্র বছর পেরুলে তার উর্দিতে
লটকানো হবে সুনির্দিষ্ট বর্ণময় এই
প্রস্তর ফলক-- ‘ক্যাপ্টেন’

ইতোমধ্যে একবার মাত্র
বঙ্গোপসাগরের নীল, আর প্রকাণ্ড তিমি
তাকে বলেছিল যুদ্ধের কথা--
ঘাসের বিষণ্ন শোক, মায়ের প্রার্থনা
এই এক যুদ্ধের প্রস্তাবনা ফিরিয়ে দিয়েছে বলে
রণরৌদ্রে ঝলসে গেছে
ছায়াচ্ছন্ন মুখখানি তার--

ক্যাপ্টেন, আজ ইলশেগুড়ি প্রিয় রৌদ্রে
ভেসে যাচ্ছে এক বিনীত যোদ্ধার গ্রাম
সারাবাড়ি কান্নার মর্মরে তুমি, স্বাগত
ঘুমন্ত সর্বনাম


রবীন্দ্র প্রতিকৃতি

যথার্থ সমারোহে মোড়ক উন্মোচন করে
চিরস্থায়ী করা হলো বাংলা ভাষার অনিবার্য
দিকপাল রবীন্দ্রনাথের আত্মপ্রতিকৃতি
চারিদিকে ঘাস আর বৃষ্টিদৃশ্য নতজানু হয়ে
তাকে সম্মানিত করে

আমরা যারা দ্বিধান্বিত হয়ে, আধুনিক শালবস্ত্রে
কবিকে পদ্মাপারের ঘাসবাড়ি থেকে
যার যার মতো ঢাকা কিংবা কলকাতার
অর্বাচীন টাওয়ারের চক্রাকার সিঁড়িতে চড়িয়ে দিয়েছি
তাদের ঘরে ঘরে থরে থরে
সাজানো রয়েছে বাঁধাই সৌকর্যের
মহার্ঘ রবীন্দ্র রচনাবলী
ঘুঘুচড়া নিঃসঙ্গ অরণ্যের মতো গল্পগুচ্ছের নরনারীগুলো
ক্ষুধাতৃষ্ণার দক্ষযজ্ঞে উঁচু উঁচু বইয়ের খোঁড়লে
মুখথুবড়ে পড়ে থাকে দীর্ঘ বর্ণলিপি

তারা জানে, শতাব্দীর প্রণোদনাগুলো
ঝরাফুল মরারোদে থরে থরে বাসি হয়ে যায় যদি
গভীর শিল্পের ছোঁয়ায় নিপুণ ভাস্কর্য হয়ে
আজো তো নির্মিত হয়
অবিকল রবীন্দ্র প্রতিকৃতি


ঘুম ফুল ও বিদ্যালয়বিষয়ক

কাল ঘুমাইনি সারারাত, আমার
বিদ্যালয় ছিল খোলা
তোমরা বাগানে ছিলে, ঠোঁটে মধু, হাতে
কালো কাপড়ের ব্যাগ
তোমরা ফুল তুলছিলে
গাছে, বসে ছিল কারা
যখনই গন্ধের প্রসঙ্গ এলো
কালো ব্যাগ কেড়ে নিল তারা
বলল, ফুল-- যতো পারো ব্যাগভর্তি করো
যখনই গন্ধের প্রসঙ্গ এলো
ব্যাগভর্তি ফুল, নামিয়ে নিল তারা

ফুল নিয়ে রচনা লিখব কাল
গন্ধ লিখব না শালা
কাল বিদ্যালয় ছুটি, বাতাসে ঘুমের শর্করা


স্যাঁতসেঁতে জীবনের মানে

বাঁশবাগানে মাথার ওপর আমাদের কোনো চাঁদ নেই। আর কোনো অন্ধকার নেই পিঠেপিঠি সদ্যজাত হরিয়াল পাখির চোখে। এই শীতে, আমরা আগুন জ্বেলে তার লাল ফুলকিতে সেঁকে নিচ্ছি উদগ্র স্বপ্নের ডালপালা। তারা কেউ রান্নাঘর, ড্রইং রুম, নদীতীর ভেঙে শীতার্ত অন্ধকারে আগুনের ফুলকির ভেতর পৃথিবীতে নিরন্তর স্যাঁতসেঁতে জীবনের মানে খুঁজে পেতে চায়। তারা চায় যে কোনো ধ্বংসের মতো অনিবার্য অনুষঙ্গে বৃষ্টি নামুক বাঁশবাগান, হরিয়াল পাখির চোখে। তারা চায় শোক, শ্যাওলার পিচ্ছিলতা, বর্ষণের দৈর্ঘ্যরে ভেতর আত্মঘাতী স্বপ্নগুলো ফিরে আসুক উদ্যানের ফোয়ারার রোদে। একদিন নদীতীর ধরে যে সকল জনপদ ভেসে ভেসে ফিরে পেল যথার্থ সিন্ধুর মানে, তারা জানে, আরণ্যক অন্ধকারে মরাফুল নির্জনতা নাটাইয়ের সুতোছেঁড়া আকাশে প্রতিবার ঘুড়ির ঠিকানা


ভালো রচনার বই

পাঠ করছি গদ্যশিল্পীর ভালো রচনার বই। আপাত দীর্ঘকায় বইগুলো অনভ্যস্ত পাঠকের হাতে পর্বতময় পড়ে থাকতে পারে বহুদিন। আজ শিল্পবৃষ্টির দিন। ধ্র“পদী উপন্যাসখ্যাত গদ্যশিল্পের বইটিকে হাতে নিয়ে আজ পূর্ণিমায় উঠে পড়লাম ছাদে। নাম-ভূমিকার মেয়েটি ছোট্ট কবিরাজঘর থেকে বড় হয়ে যেই আজ হাতে পেতে চায় গনগনে আকাশের চাঁদ; জোড়াসাঁকোর শিল্প পরিবার থেকে দিক্ষিত যুবকের রচনাবলি, একে একে সয়লাব হলো শিলাবৃষ্টির জলে, আর ভেজা জবজবে রাতে বাড়ির দক্ষিণ দিকে নিম্নগতি চাঁদের বয়সের সমান মধ্যবিত্ত নায়কের হাতে, রচনার তৃতীয় কলায় যে কৃষ্ণ বিবরের ভাষা লিপিবদ্ধ আছে, হঠাৎ এই অন্ধকারে আমি তার আদি অন্ত কিছুই দেখি না বলে পর্বতময় পড়ে আছে ভালো রচনার বই



ধীরেন্দ্র আর ভুশার নস্টালজিয়া

‘ধিরে, সুখ নাই।’
[ভুশার একমাত্র ঘোড়াটি গতরাতে চুরি হয়ে গেছে। কিংবা ধারণা করা যায়, এ মুষল বৃষ্টিতে ঘোড়াটির দুরন্ত শৈশবের কথা মনে পড়ে যায়।]

‘কেন?’ --বলল ধীরেন্দ্র।
আবার ধীরেন্দ্র কয়, ‘তোর থেকে ত্রি-দন্ত চতুর কেউ একজন ঘোড়াটির আজকাল খোঁজখবর নেয়।’

‘ধিরে, এখন কী করি?’
‘যত দূর জানা আছে, তার কিছু তথ্য বের করি।’
[তথ্যে বেরিয়ে পড়ে, এ ভরা শ্রাবণে, তিনিও ঘোড়ায় চেপে হঠাৎই ছুটছেন নাকি সোমত্ত কৈশোরের দিনে।]

‘মাঝি, কোন ঘাটে ভিড়বে তোমার তরী?’
[নদীতীরে ধীরেন্দ্র আর ভুশা, তাদেরও শৈশবের দু’টি টিকিট যদি মেলে!]
মাঝি বলে, ‘আপনারা ব্যাটা নাকি ছেলে?’
এ ওর দিকে চায়, তারপর ধীরেন্দ্র বলে-- ‘মুশকিলে পড়িলে ভুশা, মাঝিও মনের কথা রঙ ধরিয়ে বলে।’



গানের থাকে সুখদুঃখস্মৃতি

একটি গান ধরলে
সহস্র মানুষ আমার চারপাশ থেকে স্লোগান দেয়-- ‘আহা!’
তারপর বলে :
‘ওই গানটি গান তো সুররাজ।’
আমার মাথায় বাজ ভেঙে পড়ে।

তারপর আমি আমার মাথার মধ্যে
এক হাজার কালো কুকুর, মানে
ডগ স্কোয়াড ও তাদের রাখাল, মানে
এক সহস্র সশস্ত্র সৈনিকসমেত ঢুকে পড়ি।

কুকুরগুলো শুঁকতে শুঁকতে যতই গভীরে যেতে থাকে
ততই আমি ভাবতে থাকি শ্রোতাদের কথা।
তখন কেউ একজন বলে :
‘আপনি একটা আস্ত চুতিয়া দেখি!
এমনি এমনি এত গান করেন, আর এত জনে বলি--
আপনি খালি ধান্ধাবাজি করেন!’

একজন সৈনিক চিৎকার করে বলে :
‘ব্লাডি বাস্টার্ড, হয়ার আর দ্য সঙ্গস?’
একটি কুকুর সৈনিকের মুখের মধ্যে লেজ গুঁজে দিয়ে বলে :
‘চুপ, ওরা কাঁদছে!’
আর যাই হোক, ওদের কান্নার মানে আমি কি আর বুঝি?

এই যে সহস্র শ্রোতা-- যারা গান শুনে
দু’চোখ ভাসিয়ে দেয়; আর জানে--
পৃথিবীতে গানেরাই বোঝে দুঃখের মর্মসার, অথচ
গানের কান্নার কিছু সুখদুঃখস্মৃতি
কখনো কি জেনেছে মানুষ!



বৃষ্টির প্রসঙ্গ না হয়

শঙ্খনাদ বেজেছিল সেদিন শুক্রবার, সূর্য ওঠার মাত্র দু’তিন ঘণ্টা পর। অথবা পরস্পর বৈরাগ্যের ছিল মৌন জন্মদিন। কতদিন পর তোমার আবাল্য ঐশ্বর্যকে সাদা পাতায় মুড়িয়ে এনেছো ঝুলে থাকা হাসিতে তোমার। মুহূর্ত মৌনতা ভেঙে শঙ্খ নর্তকী, স্মৃতিচারণের মতো ব্যবহার্য গড্ডল থেকে বহুদূর মুখোমুখি হয়ে, রেখে যাবে স্বভাবত দার্ঢ্য সম্ভাষণ যখন, না হয় আমি বলি, তবু চাই হোক, পরস্পর বলা যাক স্নিগ্ধ কথাগুলি।... যতোটা অকৃত্রিম তার মুখ, তারও চেয়ে চোখের প্রাচুর্যে তার উড়ে যায় নাক্ষত্রিক ধূলি। আর যদি ওঠে চাঁদ, ছেঁড়া ছেঁড়া শুভ্র মেঘগুলি, বৃষ্টির প্রসঙ্গ না হয় তার কাছে থাক




দীঘি ও চাঁদ

একটি সুমসৃণ চাঁদ রোজ রাতে আমাদের দীঘির ভেতর এসে ডুবে যায়। দীঘিতে ভাসন্ত মাছ, পারের সজনে গাছ সাক্ষী রেখে এই চাঁদ ডুবে যেতে যেতে তার নিজের সম্পর্কে আমাদের আশ্চর্য ভাবনাগুলো ফেলে রেখে যায় পথে। আমি তার প্রস্থান পথের দিকে দুটো কাক কিংবা শেয়ালের জ্বলজ্বলে চোখ বসিয়ে রেখে ভাবি, এই দীঘি অজস্র অস্তগমনের সাক্ষী হলেও সে কোনো জনপ্রিয় নভেলিস্ট কিংবা আখ্যানকার বলে নিজেকে পরিচয় দিতে পারবে কি?
মনে মনে ভেবেছি, এই দীঘি ও চাঁদের সম্পর্ক নিয়ে একটি ধ্র“পদী চলচ্চিত্র বানানো গেলে একজন ভ্রাম্যমাণ নায়কের প্রয়োজন হতে পারে-- যিনি অন্ধ; আর তার নাম হতে পারে-- অন্ধকার। আর এ কল্পিত হার্টথ্রব হিরোর পাল্লায় আমাকে আলোবন্দি করা হলে চমৎকার মানিয়ে যাবো ঠিক। যেহেতু অজস্রবার ঐ গোল চাঁদ আমি ডুবে যেতে দেখেছি দীঘিতে। কিন্তু একবার হলেও দীঘির ঐ সুশীতল জলে নেমে দেখিনি যে, এত আলো নিয়ে পৃথিবীতে সম্মানিত চাঁদ, নগণ্য দীঘি কেটে কেটে কোথায় যেতে পারে



শামসুর রাহমান

তখন কালের ধুলোয় পৃথিবীতে গড়া হলো
অনিন্দ্য প্রতিমা
আকাশের চিত্রশালায় এত যে মেঘ
এত যে রূপালি স্নান-এর ধারা
সেই রাত : অগণ্য নক্ষত্রে ছিল
বলো দেখি আরো কত শস্যের প্ররোচনা

পাতালের রৌদ্র এনে যে রূপ মহার্ঘ আজো
জলাশয়ে শাপলার শাদায়
যদি যেতে চাও
পারো কি সহজে এত!
বলো তো, বাংলার নিসর্গ আর
বাঙালির এই প্রিয় নাম
কতটা বিভক্ত তারা
কবিতার বিবিধ সংজ্ঞায়




বিস্মৃতি

যদি ঢেউ আসে, তুমি খুলবে না তোমার ধাতব ত্বকগুলি। জল যদি ওঠে, আর একবার যদি ঝরে যেতে থাকে পাহাড়ের ঊষর গড়ানে বেশ, তুমি ভুলবে না শীতঋতু, প্রিয় স্মৃতিগুলি। সেবার মেঘ ছিল খুব, তোমাদের অন্ধকার বাড়ি-- কাঠের দরজায় কিছু নক্ষত্রকুচি; চোখঅন্ধ মালী যদি ভুল করে তোমার মুখমণ্ডলই ফুল ভেবে ফেলে যায় চলে; আমাদের যৌথ দুই বাড়ি যদি পড়ে থাকে ভাঙা চাঁদ, ছেঁড়াখোঁড়া সম্বন্ধের কুচি; ও দেশের বিশুষ্ক হাওয়া, ধূলিঝড়, মেঘ ওড়াউড়ি-- প্রকৃত প্রস্তাবে তারা কেবল বিস্মৃতি



জাতিশ্মর

আজ এই প্রেমিক-প্রেমিকার মধ্যে একটা কিছু না ঘটে যাবার কথা কেউ উড়িয়ে দেয়নি। আজ সারাদিন আবহাওয়া ছিল স্বাভাবিক। আর তারা চারপাশ বিবেচনা করে পরস্পর হাত ধরেছিল অতীতের মতো। আর মেঘ হলো। আর বজ্রপাত হলো হঠাৎ। মেয়েটি শুনতে পেল তার মায়ের বজ্রফাটা বীভৎস মৃত্যুর সংবাদ; আর ছেলেটি তার বাবার মহাপ্রয়াণের কথা এইমাত্র জেনে, পরস্পর হলো মৌন মুখোমুখি। আর বৃষ্টি এলো অদূরের নদী, শালবন ভেঙে। নদীটি ফেলে রেখে গেল তার বুকভর্তি জল-- মেয়েটির জন্য; আর শালবন বাঁচিয়ে রেখেছে তার বিশুষ্ক শরীর; যা এই ছেলেটিকে নিঃশর্ত সমর্পণ করে দেবে। আর এই জল বা বৃক্ষ ভেবে দেখে-- একদিন অন্ধকার ছিল, আর তার নিমগ্ন মুকুরে ভেসে উঠেছিল এই মানব-মানবী



নিঃসঙ্গতা

মনে পড়ে, উড়ে যেতে চেয়েছি কোথাও
উড়ে গেলে
শূন্যতার ভেতর দিয়ে
শূন্যতাকে ছেনেছুনে, ভেবে দেখি--
খুব বেশি নিকটতম মনে হয় তাকে

সকালে বা উদ্যানের থকথকে রোদে
ব্যাপক শূন্যের ভেতর হাহাকার করি...
ধরি, এ মতো নিঃসঙ্গতা বুঝি আমার একার
এত হাহাকার! ঘরভর্তি নিরাকার বন্ধুরা আমার
এত এত বান্ধব-- যারা, সকলে নিরাকার
একদিন ঝুঁকে পড়ে
ভেঙে গেছে সমগ্র আকার
একদিন অস্থির প্রহর, ব্যাপক বর্ষণে



রাষ্ট্রপতির মেয়ে

অসুখ হলে ভালো-মন্দ বুঝি না তার কিছু। রাষ্ট্রপতির মেয়ে, সন্ধ্যে হলে এই পথে যায়। আঁচল ভরা পুঁথি, কেউ দেখে ফেললে ঝোপের ভেতর লুকিয়ে নেয় মুখ। রাষ্ট্রপতি ঘরে ফেরেন, ফেলে আসেন দীর্ঘ সরু পথ। পথ্যি আনেন, মুঠোভর্তি তুলে আনেন ঈশ্বরের ছায়া। রাষ্ট্রপতির মেয়ে, সারা দেহে রুগ্ণতার অজস্র বুদ্বুদ; আর সূর্য ওঠে ভ্রাম্যমাণ সড়কের পাশে। রাষ্ট্রপতির মেয়ে মুখভর্তি আলো নিয়ে পাঠশালায় যায়। আনন্দ বিহারের এক প্রত্ন পোড়া ইটে, পরস্পর অঙ্ক কষে (ক+খ) নামাঙ্কিত হয়



শালবন বিহার

মাটি ভেঙে উদ্ধার করা সৌধের বৃত্তান্ত আছে। আছে ফাটলের ভেতর লুক্কায়িত যুদ্ধের ইশতেহার। আমরা কালো পোশাক, দু-চারটি দেশলাই সমেত মুঠো ভরে নিয়ে যাচ্ছি সভ্যতার সমরাস্ত্র ধূলি। বিভাজন রেখাগুলো নেমে গেছে অন্ধকার ঢেঁড়সবাগানে; বুনো ফুল, আলতামাখা পদচ্ছাপে জমে আছে শিশিরের প্রগাঢ় স্বচ্ছতা। পৃথিবীতে সপ্তম শতকের পর ভবদেবের প্রত্নরীতি ব্যবহারে এইমাত্র অভ্যস্ত হয়ে উঠছি। তাদের কান্নার ভাষা সাঙ্গীতিক আনন্দজ্ঞানে, আমাদের সুখস্মৃতি, মুখরতা-কোলাহলে, একদিন মিশে যাবে ঠিক


এ্যান্টেনা

প্রশস্ত শীত ঋতুর পর বাড়ি ফিরছি আমি। একটি খসে পড়া ধাতব এ্যান্টেনা জড়িয়ে আছে আমার আবাল্য সরল মুখ। আমার থেঁতলানো চোয়াল, এলোমেলো চুলে হাত রাখছেন মা। কপালে চুলের টিকলি, মাজার সুতো, ফুটো আধলি-- কে কবে পরিয়েছিল একটু একটু মনে পড়তে, আমার পঁচিশটি আঙুল দিয়ে তৈরি এই পতিত এ্যান্টেনার পাশে বিভিন্ন বর্ণচোরা ফুল, নীল মোমবাতি-- এসব দিয়ে মাকে কেউ বরণ করে নিল। জঙ্গলের ভেতর থেকে অজস্র যে মুখ এই দৃশ্য দেখতে এসেছিল; কারো-বা পা, মেরুদণ্ড, কব্জির হাড়-- সমস্তই প্রয়োজন ছিল এ-মতো এ্যান্টেনা নির্মাণে। আমি জঙ্গলের সীমানা পেরিয়ে হাঁটি। এই নদী অববাহিকার দেশে ঋতু বদলের ফলে, বিবিধ রুগ্ণতা নিয়ে বাড়ি ফেরা কালে, এই দৃশ্য চোখে পড়ে খুব



আমার সান্ধ্যকালীন বিদ্যালয় ভবন

আড্ডাবাজ প্রতিষ্ঠানটি ফুলেফেঁপে উঠছে ঘাসের ভেতর। একদিন তার নামকরণ ছিল; আমরা প্রতি রবিবার সবুজ ছেঁড়া কলাপাতা বিছিয়ে বসে বসে বদলে নিতাম পরস্পর রঙের পট, বুনো কাঠের তুলি। একদিন এই অতি চেনা রঙ বিরান কাঠের আড্ডা ছেড়ে উঠে গেল সর্বোচ্চ দেয়ালে, আড়ায়; আজ তার নতুন যে নামকরণ হলো-- আর এই রঙিন প্রাসাদের দিকে দাঁড়িয়ে যারা যারা ছানাবড়া হতবাক চোখে অকপট অন্দরের দিকে ঢুকে যায়; তাদের শাড়ি কিংবা কামিজের বিস্তৃত ত্বকে সেই সব রঙ ক্রমশ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে; ঢেকে দেয় ঘাসের সবুজ, গোলাপের লাল। একদিন যারা পট বিনিময় শেষে চোখেমুখে রঙচঙে হয়ে ঢেকে দিতাম সন্ধ্যার লাল, পূর্ণিমার রোদ; একদিন যারা পুরনো ডুমুরগাছের প্রযত্নে রেখে, আড্ডাবাজ বাড়িটিকে ভররাত নিরাপদ করে ফেলে রেখে যাই; আজ ভোরে অধুনা নামকরণের পর, আমাদের জন্য সম্মাননা হাতে, সুউচ্চে দাঁড়িয়ে রয়েছেন তিনি



গন্ধ

আমরা কিছু গন্ধ নিয়ে খেলছি

গন্ধ, আকাশ থেকে পড়ে
খেলা শেষে
বৃষ্টিদানার মতো গড়িয়ে যায়

বিষাদের গন্ধের মতো কিছুই অদৃশ্য নয়
যারা যারা এই সত্য জেনেছি প্রথম
উপমান ফুল
একদিন তাদের জন্য ফুটেছিল মেঘে

ধূসর পালকের হাঁস, এই কালে
মেঘ হয়ে ওড়ে
তারপরে, তারকার হাসি...
যদি বলি গন্ধই অমোঘ ছিল
বাসি ছিল ফুল
মেঘের ওপারে কিছু ফুটে আছে তারা
গন্ধে শুধু ভেসেছে দু’কূল



সর্বনাম

সর্বনাম একদিন নেমে এসেছিল মাটিতে

ঘাসের দীর্ঘ চুল আর ব্যবহৃত ফুলগুলো
তার শনাক্তকরণের এক অনন্য পদ্ধতি--

শ্রেণীকক্ষে অধ্যয়নকৃত এই সর্বনাম
বহুকাল হলো কান ফুটো, চোখ ফুটো করে
সাপের মন্ত্র জপ করে করে
দিনান্ত রিক্সায় চেপে
অন্ধকার অভিসারে যায়। আর
একদিন তার প্রেমিকার মুখ পেঁচার আকৃতি পেয়ে
ফিরে আসে অন্ধকার রাতে...
প্রিয় সর্বনাম, আমাদের বিপন্নের এক অনন্য আশ্রয়--
তার হাতের বালা, বুকের হাড়, কাগজের জামা
মারাত্মক এই অভিসারে তাকে অভ্যস্থ করেছে

ফুলের কিছু গন্ধ আর অযথা দুঃখের কালো
প্রতিদিন সঙ্গে করে যত দেশ ঘুরি, কেউ বলে--
পেঁচার শোক, আগুনের ঘুড়ি
এই সব সঙ্গে করে-- প্রতিদিন দেখা করে
আমাদের বিশিষ্ট সর্বনাম



বাইরে তখন

বাইরে তখন কিলবিল করছে মানুষ, তাতে
পথ আটকে যাবে-- এমন কথা
ভাবছে না কেউ
বরং শীত পড়ছে, কেউ কুয়াশার ভেতর
একঝলক রৌদ্রের জন্য
তার মনোযোগ ঘুরিয়ে নেবে
তখন বৃষ্টি হলে শুরু, যদি মনে পড়ে
কালো মুখ কিশোরীর কথা
বাইরে তখন সাদা জোছনায় মানুষের কোলাহল
বাঁশবনের ছায়া--
যে যার মতো বসে পড়ছে, গল্প করছে
পাতার ওপর রোদ পড়ছে, বৃষ্টি পড়ছে
জোছনা পড়ে গাঢ় হচ্ছে ছায়া
পথ আটকে শুয়ে পড়ছে গাছের ছায়ায় কেউ
আগুন দিয়ে সেঁকে নিচ্ছে চুল
বেশি কথার ধ্বনি--
নদী তীরে জেগে উঠছে ঘর
পুরনো হাট, দীর্ঘ প্রবীণ
উড়ন্ত শ্মশান
এদিক ওদিক লক্ষ্যভেদে কেউ কিনছে চাঁদ
বয়স ভেদে নদী কিংবা মাঠ--
শীতজর্জর মুখ, মধ্যরাতের নির্জনতায়
যে যার মতো খুঁজে নিচ্ছে বাড়ি

বাইরে তখন শুধুই কোলাহল




আমাকে কেউ

আমাকে কেউ ভাবছে না আজকাল
এমন কথা কেমন করে বলি--

যারা ঢিল ছুড়ছে, ফুল ছিঁড়ছে, আবার
পাতার সৌন্দর্য দেখে ছুটে যাচ্ছে বনে, তাদের
এমন কথা কেমন করে বলি--

তুমি গান ধরছো, ঘুম পাড়ছো
বৃষ্টির মর্মরে তোমার জেগে উঠছে বাড়ি

আমাকে কেউ ভাবছে না আজকাল
তোমার পরনে কলাপাতার শাড়ি



তোমার অস্তিত্ব

তোমার অস্তিত্ব থেকে আমি নিশ্চুপ ক’টি হলুদ পাতায়
জমা করে রাখি মুখের লাবণ্যরাশি। তুমি ঝরে যাচ্ছো
এই মরাকটালের দেশে ছাইরঙ মৃত প্রজাপতি--

আমি হাত পাতি, আর নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকি-
ইলিশের ঘ্রাণ এসে লাগে-- নাকে...
দু’পাশে কালোজাম শাড়ি
মুঘল বাদশাহী হতে ঋণে পাওয়া উত্তরাধিকারের স্বর

এবার তাকিয়ে থাকি, আর তোমার সদ্য কেনা শৌখিন
কলসির পাড়, গাঢ়-ত্বক কোলবালিশের রোদ
সরে যাচ্ছে মৃদু গুঞ্জরণে
তোমার অস্তিত্ব বুঝি টলমান রেলব্রিজ হয়ে
উঠে পড়ছে মধ্য যমুনার বাঁকে
আর আমার ঘরে ফেরার পালা শেষ হবে বুঝি

তোমার সন্ধিগ্ধ প্রকাশ কবন্ধ মানুষের মতো
যদি অন্ধ হয়ে ফিরে ফিরে আসে
আর আসে ধান-ফসলের ঘ্রাণে আমার বিস্মৃত শৈশব
বিহ্বল জোনাকির চোখ, খুব রাত হেঁটে হেঁটে
মধ্যরাতে হাটুরের মুখর কোলাহল...

আমি আবার এসে প্রগাঢ় অন্ধকার দু’ভাগ করে
খুঁজে পাবো তোমার অস্তিত্বধারা

তবে ফুল হতে যে ভোরের সান্নিধ্যগাথা
সন্ধ্যার ক্লান্তির মতো নুয়ে এলো প্রায়ান্ধ রাতের শহরে
আমি তার দাঁড়াবার ঢঙ, চোখের বঙ্কিম রেখায়
না হয় জ্বালিয়ে দেবো একঝাঁক লাল মোমবাতি




আমাদের প্রতিবেশী পিঁপড়েদের কথা

আমাদের কোনো বাড়ি নেই, তাই
সারি সারি পিঁপড়ের দেখা
আজকাল মেলে না খুব

যখন শৈশব ছিল
বাড়ি ছিল আমাদের
আমরা ঘাসের ওপরে ঘাস
মানে, উঁচুতে ক’হাত
তালপাতা সাজিয়ে গুছিয়ে
নির্মাণ করেছি ছাদ

আমাদের শরীরের ঘাম, ও
তালপাতার সুউচ্চ নির্মাণ, পরস্পর
ছিল কাছাকাছি

আমরা ডাকিনি মাছি
আমাদের শরীরের ঘ্রাণ, কিংবা
মাটির কাছাকাছি
সারি সারি পিঁপড়ের দেখা
পরস্পর পেতাম



অপেক্ষা

আমি পালকিতে চড়ে
এই বাজারে নেমেছি এসে
আজ ঘোড়া ছিল না বাঁধা
কিংবা পালকিই ছিল রোগজর্জর আজ

তোমার কেমন লাগছে শুনে
যে মেয়েটি সর্বপ্রথম
বাজারে ওঠে, আর
চলে গেলে
ক্রেতাগণ ফোঁসফাঁস ঝড় তোলে চায়ে
আমার এই বাজার ভ্রমণ
তেমনি কিছু হবে

তোমার কেমন লাগছে শুনে
তার হাতে ময়লার ঝুড়ি
আর আমরা ক’জন
সবুজ চায়ের ভেতর ঠোঁট গুঁজে দিয়ে
পরস্পর ইলিশের দরদাম শুনি

তার কোনো ঘোড়া নেই
আমরা পালকি ও ঘোড়ার জন্য
অল্পকাল অপেক্ষা করেছি



যুদ্ধ ও ক্ষমতা

আচ্ছা বলো তো দেখি--
যুদ্ধ ও ক্ষমতা যদি
অলটারনেটিভ হয়, আর যারা
পালাই পালাই পালাই করে
দেশ ছেড়ে যায়
শহরের অলিগলি হতে
টায়ার পোড়ার ঘ্রাণে
কিছু নারী গর্ভবতী হয়

আচ্ছা বলো তো দেখি
তুমি ভালোবাসো রাজা
আর আমি রসিক ভ্রমরা
ফিসফিস গান আমি
রচনা করেছি ঢের
আমিও বৈশাখ হতে
খরতপ্ত রোদে
শুকিয়ে সযত্ন করি
এ পোড়া হৃদয়

বিচ্ছেদ ও বিরহ যদি
অলটারনেটিভ হয়
নিমগ্ন কবিরা যদি
দীর্ঘ বরষায়
কামনার চোরাগলি
সেঁটে দেয় তালা
আমিও নিমগ্ন থাকি
চোরাবালি স্রোতে
আর কবিতায়
যা-তা লিখে যারা যারা
কবি হয়ে ম’লো
আচ্ছা বলো তো দেখি
দেয়ালে দেয়ালে
যে সকল প্রেমপদ্য
ঝোলে পোস্টারে
এই সব
লিরিক ও রক্তই যদি
সমার্থক হয়
প্রীতি ও প্রসঙ্গ ওঠে
রাজার সকাশে
আর ওড়ে বিহঙ্গ কিছু
আকাশে আকাশে
মানুষই জঙ্গলে বাস, আর
পশুরা প্রাসাদে
আচ্ছা বলো তো দেখি
ব্যাপক ঘর্ষণে হলো
ধরা যাক সাদা এক বাড়ি
মস্ত এক বিকৃত পশু
এই ঘরে বসবাস তারই
পেন্টাগনে ঝড় ওঠে বারুদে বারুদে
আরও গীত যা যা তার
ঘুম ডেকে আনে
সে কি তা জানে সে কি তা জানে
ভোর হলো ভোর হলো
তার জন্মান্ধ বাড়ি
থাকে চিরঅন্ধকারই



গেটলক : একটি সংবর্ধনা স্মারক

আমরা এই সমাজপতির সংবর্ধনায় আর কোনো ভুঁইফোঁড় কিংবা গাঁজাখুরি শব্দ ব্যবহার করতে যাবো না। কেননা জীবন কিংবা ভাষার বিবিধ ব্যবহারে আজ, এই সব গাঁজাখুরি শব্দের সম্বন্ধ ভেঙে আমরা বহুদূর এগিয়ে এসেছি। যা দিনকাল, আমরা একটি বরেণ্য বিদ্যালয়ের দিকে ঢুঁসে দেবো আমাদের ধ্বনিযন্ত্রের তির্যক শব্দরশ্মি। ক্রিকেট খেলার মধ্যাহ্ন বিরতিতে আমাদের এই সংবর্ধনাসভার যতি টানা হবে, ঠিক আপেক্ষিক। শেষপর্বের বক্তাদের কণ্ঠে তার তাবৎকালের কর্মকাণ্ড তুলে ধরা হবে বরণীয় বাক্যবন্দনায়। এই ফাঁকে আমরা উত্থাপন করবো-- আমাদের পুরনো রেলগাড়ির জন্য একটি ইঞ্জিনের প্রয়োজন। আমাদের একমাত্র ছাদের ওপর একটি প্রাযুক্তিক পুলিশ স্টেশন চাই। ভোঁতা হয়ে গেছে আমাদের ধান মাড়াইয়ের কল। এটাকে অন্তত আমাদের মগজ কিংবা ঘিলু মাড়াইয়ের জন্য যথার্থ করা হোক। আমরা আর কোনো গাঁজাখুরি শব্দমঞ্জরি অন্তত আপনার জন্য প্রযোজ্য রাখিনি। এবার নিশ্চিত আপনার বিবাহের বরযাত্রী হয়ে আমাদের মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার সাফল্যের জন্যে গড়ে তুলবো দুর্বার আন্দোলন। আমাদের আস্থা করুন, আমাদের প্রকাশিতব্য সদ্যজাত কবিতার পাণ্ডুলিপি থেকে সমস্ত বৈবাহিক চিত্রকল্পগুলো আপনার বিয়েতে সৌজন্য পাঠাবো। আমরা প্রত্যেকে অসংখ্য মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির সুযোগ্য দালাল। আমাদের কোনো চাকরির প্রয়োজন নেই। আমাদের প্রেমিকাদের একটা হিল্লে করে দিন। দেখুন আমরা প্রাক-বৈবাহিক সন্তান উৎপাদন, জন্মকল্প কিংবা এ্যাবরশনে একদম বিশ্বাসী নই। আমরা মিছিলে যাই না; তবু মিছিল এসে ঘিলু খুলে দেখে আমাদের। তারা গোলটেবিল করে আমাদের ভবিষ্যৎ প্ল্যান নিয়ে। আর দেখুন আমাদের আমলা বন্ধুদের বাড় বেড়ে যাচ্ছে দিন দিন। এমনকি সংখ্যাও হা হা। আমাদের আড্ডায় তো চলতে পারতো ফরেন হুইস্কি থেকে আদিমতর যা কিছু। গলিঘুপচির মাগির দালালদের সঙ্গে আমাদের সখ্য যে সেই আদ্যিকালের! অযথা অধ্যয়ন থেকে সেই কবেই তো আমরা আমাদের সাংসারিক আড্ডাগুলোয় শেষরাত অবধি অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি। আমাদের একটা রফা না হয় করুন; আমাদের মাইনের সিংহভাগ চলে যায় বাড়ি ভাড়া, চটি পুস্তিকা, পর্নো ডিস্কেট, ক্ল্যাসিক, রাগ কিংবা ভরত নাট্যমের টিকেট সংগ্রহে। মান্যবর সমাজপতি, এসবই পুরনো প্রযুক্তি, আর সব ক্লিশে ধ্রুপদী। দেখুন, আর চাইনে এসব, আমাদের মাস্টারবেশনের চমৎকার এক অভিনব পদ্ধতি বাৎলে দিন। বিশ্বজুড়ে তেলের দামের পাশাপাশি বেড়ে যাচ্ছে কাগজ আর সাবানের মূল্য-- একবারও উঠেছি গর্জে এসবের প্রতিবাদে-প্রতিরোধে, কখনো কি মনে পড়ে কারো? প্রিয় সমাজপতি, পুরনো চা-পাতা, সিগারেটের দগ্ধ ফিল্টার, কফি আর ব্যবহৃত কনডমের খোসায় তড়পাচ্ছে আমাদের ঘরভর্তি প্লাস্টিকের ঝুড়ি; আজকাল যত্রতত্র ডাস্টবিন থেকেও শোনা যায় ভাগ্যাহত নবাগতের আর্তচিৎকার। এই সব নবজাতকের মিছিলে একবার আমিও ছিলাম। ওদের মায়েদের সঙ্গে, ওদের অধিকারের ধারায় আমিও তুলেছিলাম ভয়ার্ত স্লোগান। আমাদের গন্তব্য বলতে দেখুন, কখনোই কোনো জিরো পয়েন্টের অস্তিত্ব ছিলো না। আমাদের আর্তকণ্ঠ সেদিন গর্জে উঠেছিল আপনার সুরক্ষিত বাড়ির লোহার দরজায়। আমাদের নিষ্পাপ নরম তুলতুলে পা সেদিন বৃষ্টির মতো বর্ষিত হলো আপনার সুরাসিক্ত তলপেট জুড়ে। প্রিয়বর সমাজপতি, আমার প্রিয়তমা বোনের জন্য আজ একটি গিটার, অর্গান কিংবা হারমোনিয়মের বিশেষ প্রয়োজন; চাই একটি নাচের পোশাক, হীরের নূপুর, আরো চাই পারফিউমের সর্বোচ্চ ব্রান্ড, ত্বকের প্রসাদ মানে রূপব্যবসার আরো আরো আনুষঙ্গিকী। আর চাই অবাধ রাত্রিযাপনের এক সুরম্য প্রাসাদ; ঘ্রাণময় কেবল জলের ফোয়ারা-- যা এই পৃথিবীর তাবত অন্ধকার নিয়ে ছুটে আসে প্রিয়তম আমার বোনের টান টান দুটি গোল চোখ থেকে। আমাদের আস্থা করুন সমাজপতি, আমরা জল থেকে জলস্তরে, ঘুম থেকে ঘুমান্তরে অগাধ সমুদ্র থেকে ব্যাপক চরায় এসে দাঁড়িয়েছি। মান্যবরেষু হে, আমার নধর সন্তান, পিতার বার্ধক্যের ত্বকে ভরে দিন অজস্র জীবাণুশূন্য রক্তের ইনজেকশন; আমি জানি, আজ কিংবা কাল, যে কোনো আততায়ীর ক্ষুধার্ত লালায়, তাদেরই প্রস্রবিত রক্তের ধারায় আঁকা হবে উৎসবের শত রঙ। আপনার দুটি অত্যুজ্জ্বল নাক্ষত্রিক চোখেই আমাদের নিবদ্ধিত দৃষ্টি হে মহান পতি। আমরা হরিজন, অচ্ছুৎ, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জাতকূলহীনা, লঘু...; সামান্য বিদ্যুচ্চমকে দেখুন, কেঁপে ওঠে আমাদের পাঁজরের হাড়; এক আঁজলা কেরোসিনের বরাদ্দ দিন; জ্বেলে দিন আমাদের শনবাতার ঘর, ছেঁড়া বস্ত্র, ছালাচটি-- আমাদের অযত্ন অভুক্ত সন্তানের খসখসে বিশুষ্ক ফাটা ত্বক। নিজেকে একটু সেঁকুন মান্যজন; জল থেকে জলে হ্যালোট্যাব দিয়ে শুদ্ধ করুন, ধুয়ে দিন ছাইভস্মের চিহ্ন অপার। আর আমার দু’হাত ভরে দিন, ভরে দিন আগ্নেয় ধাতব কিংবা লৌহজাত ভালোবাসার অথৈ বৈদ্যুতিক পাওয়ার দিয়ে; দেখুন শত শত বিস্ফোরণে কেমন মাতাল উল্লাসে নেচে ওঠে বাংলাদেশ; মান্যজন সমাজপতি, আজকের এই রাশি রাশি ঘ্রাণবতী ফুলের বন্যায়, আপনার এই নগন্য সংবর্ধনায় এটুকু বিশ্বাস না হয় করেই দেখুন!




নির্বাসন

[সংশোধিত নতুন সংস্করণ]

নির্বাসনে দেখা হয়েছিল ভ্রমণের মেঘ।... নির্বাসনপ্রিয়তাগুলো অদম্য রয়ে গেলো আজও।... যারা সঙ্গীত ভালোবাসে, এ সকল অজ্ঞাত পরবাসী জলে তাহাদের বড়শিগুলো নুয়ে পড়ে স্বাস্থ্যবান মাছে ।... যদি উঠে আসো জলহস্তিনী-- ডানার ওজনে এই শূন্যতা দেবো পাখিদের।... এইখানে, আমাদের দীনতাগুলো স্রোতের শরীরে ভেঙে গুনে নিতে পারি।... যদি নির্বাসন ভালো, জলে-- নগ্নতায় ডুবে থাকা যায়।... যদি উৎসব ভালো-- রাজকুমারীর বিয়ে বিয়ে ঢেউ গুনে ফেলা যায়।... মাছের সাম্রাজ্য দেখো। মাছেরা জন্মেছে শুধু চিলের ঔরসে বেড়ে।... আজও পৃথিবীতে মাছ হলো মেয়ে। কেননা কচুরিপানায় মানুষের জমাট মাংসে মাছেরা তো সাবলীল থাকে। অথবা প্রসঙ্গ মেঘে যদি যুদ্ধের কথা আসে-- সকল বর্ষণ শুধু জলের উপমা, জলের প্রতিমামেয়ে।... প্রতিদিন সিংহ দরজায় আমাদের কথা হয়; ব্যথা পাই প্রজাদের রাজস্ব শোষণে।... তবু প্রজাপতি তোমার ডানার শিল্পে এইসব নির্বাসন লিখে রাখো; ছুঁয়ে দেখো আমাদের উত্তপ্ত হাত, কষময় সকল গোড়ালির ফাটা দাগ।... সমুদ্রের উজ্জ্বল কাঁধে এ সকল সুখের ভেতর অনেক অনেক বছর কেটে গেলো জোনাকির ওমে। লিখে নাও সমুদ্রসেনানী-- পৃথিবীর সকল জোনাকি আমার গর্ভধারিণী




অপেরা

তুমি যে যাবে
সে মতো সেজেছে আমার পঙ্খীরাজ ঘোড়া?
এখনই ভাঙছে নদী
ঢেউ যার প্রিয় সহোদর

তুমি যে এলে
সেদিন ঘোড়দৌড়, কূলে কূলে জাঁকালো অপেরা


হলোই রূপসী

এক টুকরো ছেঁড়া শাড়ি, ভাঙা চুড়ি, পলিশ করা নোখ দেখলে ভাবি-- এ কোনো বিধ্বস্ত নারীর ধ্বস্তাধ্বস্তি পড়ে আছে পথে। এক পশলা অতীত এসে ভিজিয়ে দেয় চোখ। আর পথ চলি, সময় নিংড়ে নিয়ে। এমন দৃশ্য আমরা কবে ভাঙতে চুরতে পারি! খুইয়েছে যে নোখ, হলোই রূপসী-- রূপে কেন অতি মায়া করে, দীর্ঘ দম ছাড়ি?



অঝোর বর্ষণে আছি

খালি হাত, তবু হায় করুণার
এ কেমন উল্লম্ফন
কারো কি ডাগর ছিল চোখ
সে কেমন হাওয়া, দুলেছিল
মুঠি মুঠি শস্যের সবুজ
রৌদ্রে তার অভ্র কুচি কুচি
কারো মেঘচুলে প্রাচীন বর্ষণের রীতি

এত ঘুরি, তবু তো তাই মনে হয়--
কিছু নাই
তুমুল ক্রন্দন করে যেমন এ আকাশ
কেমন বিস্মৃত, নাকি শূন্য মনে হয়

খোলাচুল, মুখোমুখি এত রঙধনু
ওপারে কি কারো মুখ
রঙিন রঙিন মনে হয়
এত ধারা এত যে করুণা ওঠে মেঘে
কিছু নাই তবু
অঝোর বর্ষণে আছি
মৃত অনুরাগে

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন