রবিবার, ৩ জানুয়ারী, ২০১০
(অ)কবির (অ)কবিতাচারন...
অমি রহমান পিয়াল
ক. আমার বাবা মিথ্যা একটা আত্মতৃপ্তি নিয়া কবরবাসী হইছেন। মৃতু্যর আগ পর্যন্ত তার ভূলটা ভাঙ্গাই নাই- কারণ সেটা তার প্রতি অতি অবিচার করা হইত। ঘটনাটা আমি যখন ক্লাস সিক্সে পড়ি তখনকার। 'একের ভিতর পাঁচ' নামে ইয়া মোটা একটা বই ছিল বাসায় যা আমার মেট্রিক পরীক্ষার্থী ছোট খালা ব্যবহার করতেন। সেই বইটার শেষ দিকে একটি ইংরেজি কবিতা ছিল, যার সারটা এরকম- সন্তানকে অযথা শাসন করে যে, সেই বাবা-মা তার সৃজনশীলতার পথটাও রুদ্ধ করে দেয়। এ যেন চলমান একটা নদীকে আটকে দেওয়া। যাই হোক বাবা তখন ইরানে। চিঠিতে আমি কবিতাটা তাকে পাঠাই। উনি সেটি নিয়ে পুরো দুটো ঘণ্টা আনন্দে কেঁদেছেন। সহকর্মীদের দেখিয়েছেন- দ্যাখেন আমার বড় ছেলে কীরকম জিনিয়াস। এই বয়সে কী লিখছে! উনি সেটি ফার্সিতে অনুবাদ করে ইরানের বেশ কটি পত্রিকায় ছাপিয়ে দেন। স্যরি বাবা, জীবনে তোমাকে অশান্তিতেই রেখেছি। যেটুকু তৃপ্তি ও গর্ব তোমার আমাকে নিয়ে করার সৌভাগ্য হয়েছিল তা মিথ্যের ইটপাথরে গড়া হলেও প্রাসাদটা ভাঙতে দিইনি।
খ. তাই বলে কবিতার সঙ্গে দোস্তি কী ছিল না। সে বড় পুরানো দোস্তি। ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ায় ছোটবেলায় এক অনুষ্ঠানে আবৃতি করে একটা পাউডার রাখার কৌটা গিফট পেয়েছিলাম মনে আছে। এরকম টুকটাক আবৃত্তি করেছি খেলাঘর করার সময়। স্কুল ও কলেজের সাময়ীকিতে 21 ফেব্রুয়ারি, 26 মার্চ বা 16 ডিসেম্বর নিয়ে আবেগময় কথার মালা গেথেছি প্রচুর। এই দিনগুলোতে পাড়ার বন্ধুরাও সাময়ীকি বের করে কিছু পয়সা কামাতাম। তো লিখতাম। হাত খুলেই, পদ্যগদ্য সবই। কিন্তু মানের বিচারে সেগুলো ছিল একদমই কাঁচা হাতের আনাড়িপনা।
গ. মেডিকেলে পড়ার সময় আমার দ্বারা কবিতা সম্ভব এই বোধটা জাগিয়েছিল তিতাস (মার্কিন প্রবাসী ডাঃ মোশতাক মাহমুদ, মমতাজউদ্দিন আহমেদ স্যারের ছেলে)। তার আগ পর্যন্ত আমার যা কিছু ছিল সবই টুকলিফাই। মানে আমি তখন প্রচুর মেয়েকে প্রচুর প্রেমপত্র লিখতাম এবং শুরুটাই হতো কবিতার কোনো চরণ দিয়ে। আমার সংগ্রহে এরকম দ'ুলাইন চার'লাইন প্রচুর ছিল। খ্যাত-অখ্যাত সবার। তো একদিন ক্যাফে রোজে খেতে গেছি দুপুরে। ভাত আসতে দেরি হচ্ছে। টেবিলে তিতাস আর আমি রাজা-উজির মারছি। বাইরে খুব মেঘ ছিল, হঠাৎ দেখি ঝলমলে রোদ। আমি খাতায় লিখে ফেললাম, 'মেঘটা ছন্নছাড়ার মতো টুকরো টুকরো হয়ে গেল/ অথচ আমি প্রচণ্ড আশায় ছিলাম এক পশলা বৃষ্টির।' নিতান্ত সাধারণ ক'টা লাইন। তিতাস এতই মুগ্ধ হলো যে আমাকে নিয়মিত লেখার জন্য উৎসাহ দিয়ে আবেগময়ী একটা বক্তৃতাও দিয়ে ফেলল।
গ. ক্যাম্পাসে কবি কম ছিলেন না। রোকনের কথা আগেই বলেছি- সেই ছিল সেরা। বড় ভাইদের কয়েকজন ছিলেন, ডাঃ জিল্লুর রহমান এখনো লেখেন। আর আমাদের তিতাস, আতিক, রোমেল- এদের লেখনী ছিল দুর্দান্ত। বাংলাদেশের প্রথমসারির পত্রিকার সাহিত্য পাতাটা এখন যিনি দেখেন (দেখেনই, কারণ তার ওপর ওয়ালা আছেন একজন, এমনকি ব্রাত্য রাইসু পর্যন্ত তাকে হুজুর হুজুর করেই চাকরি করেছে), তাকে অহরহ ধর্ণা দিতে দেখেছি রোকনের কাছে। কীনা লেখা চাই! আর আমি কদিন আগে তার কাছে যখন লেখা নিয়ে গেলাম- অবলীলায় বলে দিলেন, 'আপনারা যারা প্রথম আলো ছেড়েছেন তাদের লেখা সম্ভবত ছাপানো যাবে না।' হরি বোল!
ঘ. একবার পায়ে ব্যথা পেয়ে (আসলে খাবার খরচ বাঁচাতে) স্টুডেন্ট ওয়ার্ডে ভর্তি হলাম। বারান্দায় বসে গাঞ্জা খেতাম, আর তারপর কবিতা ভর করত। একদম অখাদ্য হতো তা নয়, তবে উচ্চাঙ্গেরও নয়। 1986 সালের 20 ডিসেম্বর কবি রফিক আজাদ সম্পাদিত সাপ্তাহিক রোববারের কবিতার পাতায় আমার একটি কবিতা ছাপা হয় 'বিস্মরণ' নামে। এক মেয়েকে নিয়ে ভাবছি তার চেহারাটা মনে আসছে না- এই নিয়ে কবিতাটা। শেষ লাইনগুলো ছিল- আমি যেন স্মৃতির সুন্দরতম পোট্রেটটার সামনে দাঁড়িয়ে, যেখানে পারিপাশ্বর্িকতাকে উন্মোচন করেও মডেলটা তার ঘোমটা টেনে নামিয়েছে।'
ঙ. আরেকটা চিটিং এই সময় করেছি। ডেবোনিয়ার নামে ভারতীয় এক ম্যাগাজিন রাখতাম। মিমি সুপার মার্কেটের বিখ্যাত বই দোকান লায়সিয়ামের মালিক খোকন ভাই আমার জন্য একটা রেখে দিতেন। এতে টপলেস ইন্ডিয়ান মেয়েদের ছবি ছাপা হতো। কিন্তু পড়ার মতোও ছিল অনেক কিছু। এখান থেকে এক উড়িয়া কবির কবিতা আমি অনুবাদ করি আমার মতো করে। মেডিকেলের সাহিত্য সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় 2য় স্থান পায় সেটি! কিন্তু লেখালিখি চলেছে। '91তে আমি আর ডাঃ শাহাদত হোসেন রোমেল আমাদের 28তম ব্যাচের শেষবর্ষপূর্তির স্মৃতিতে একটি বই বের করি। আয়তাকার চটি বই। দুজনের মোট 14টা করে কবিতা (ইমদাদুল হক মিলন ও আফজাল হোসেনের দুই যুবক নামের উপন্যাসটার আদলে)। আমারটার নাম ছিল 'প্রেম চতুর্দশী'। যাই হোক পুশিং সেলে সেবার 12 হাজার টাকার মতো কামাই- আমার টার্গেট সিনিয়ার আপারা। একটা বই 500 টাকায়ও বিক্রি করছি।মজার ব্যাপার হচ্ছে ধুলো বালির কেচছা' নামের একটি ক্যাসেটে আমার দুটো কবিতা আবৃত্তি হিসেবে ঠাই পায়!
চ. কবিতার সঙ্গে আড়ি এরপর দীর্ঘদিন। তবে নিজে না লিখলেও পড়ি, প্রচুর পড়ি, পড়েছি সময়টাতে। হঠাৎ এবছর 14 ফেব্রুয়ারি উপলক্ষ্যে একটা লিখলাম পরিস্থিতি-4 নামে। এটাই পত্রিকা অফিস রিজেক্ট করেছে। অথচ ইরাজ ভাই, শিবব্রত বর্মন কিংবা কামরুজ্জামান কামু বা আমাদের সঞ্জীব দা (দলছুটের) বেশ প্রশংসা করেছিলেন। আমার তাদের কাছে একটিই প্রশ্ন ছিল- কবিতাটা ছাপার যোগ্য কীনা, মানে তারা সাহিত্যপাতার সম্পাদক হলে ছাপাতেন কীনা। উত্তর ছিল ইতিবাচক। পরে রোহন কুদ্দুস তার অনলাইন ম্যাগাজিন 'সৃষ্টি'তে কবিতাটি ছেপে দেয়। তো ওর অ্যাসেসমেন্ট হচ্ছে যদি লেখা লেখি চালিয়ে যাই, আগামী 5 বছর পর হয়তো ভালো কবিদের একজন হয়ে যাব। ব্রাত্য অবশ্য আমার ব্যাপারে আগে থেকেই ডিসাইসিভ- আমার দ্বারা কবিতা লেখা অসম্ভব।
ছ. কিন্তু লেখকের কী আর এত ভাবলে চলে। আমি লিখি মনের আনন্দে। সেটা পদ্যই হোক আর গদ্য। সামহোয়ার ইন ব্লগে চার-পাঁচটা লিখেছি। প্রিয়মানুষরা প্রিয় বলেই হয়তো প্রশংসা করেছে। সর্বশেষ কানসাটে নিহত কিশোর আনোয়ারকে নিয়ে একটা কবিতা লিখলাম। মনে হয়েছিল হয়তো জাতের হয়েছে। কিন্তু বড় বড় সম্পাদকরা এর ভুল ধরলেন। আরে তাতে থোড়াই কেয়ার আমার। আমি লিখে যাই মনের আনন্দে। ছাপা হলে 500 টাকা বিল পাব, এই আশায় চটির ছাল তুলে সাময়ীকির সম্পাদকদের পেছনে হাত কচলে হাটা আর জি্ব হুজুর হবে না আমাকে দিয়ে। হবে না আজিজ সুপার মার্কেটে গিয়ে এবই সেবই মুখস্ত করে উগড়ে নিজের জ্ঞান জাহির করা। অগত্যা কী আর করা। এই (অ)কবি এভাবেই লিখে যাবে তার (অ)কবিতাসমগ্র।
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন