সঙ্গীতের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ
সঞ্জীব কুমার দেবনাথ
সঙ্গীত সাধনায় ব্যবহারিক প্রক্রিয়া মুখ্য হলেও শাস্ত্রীয় জ্ঞানের অভাবে তা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। তাই সঙ্গীতের ব্যাকরণ, বিজ্ঞান, দর্শনসহ ব্যবহারিক অনুশীলনের পাশাপাশি এর উৎপত্তি, ক্রমবিকাশ এবং উৎকর্ষ সাধনের ইতিহাস সংক্রান্ত তথ্যাদির সঙ্গে পরিচয় থাকা বাঞ্ছনীয়। কারণ_ বিষয়টি শাস্ত্রীয় জ্ঞানেরই একটি উল্লেখযোগ্য অংশ। প্রত্যেক শিল্পকলার উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশের পেছনে একটি সুদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে, যা আলো-আঁধারের বিচিত্র বিবর্তন নিয়ে রচিত। সঙ্গীতকলার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। সঙ্গীতের উৎস সন্ধানে ইতিহাসবিদ, সঙ্গীতশাস্ত্রবিদ, দার্শনিক, প-িত ও নৃবিজ্ঞানীরা যুগ যুগ ধরে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু এর উৎপত্তি সংক্রান্ত সর্বজনীন গ্রহণযোগ্য কোন মতবাদ তারা অদ্যাবধি প্রদান করতে পারেননি। তাই সঙ্গীতের উৎপত্তির বিষয়টি আজও মূলত লৌকিক উপাখ্যান ও ধর্মীয় কল্প-কাহিনীর সঙ্গে সম্পৃক্ত, যা যুগের পর যুগ মানুষ বিশ্বাস করে আসছে।
হিন্দু-ধর্ম বিশ্বাসে সঙ্গীতের ছয়টি আদিরাগের পাঁচটিই শিব বা মহাদেবের মুখ থেকে নির্গত হয়েছে। অবশিষ্ট একটি রাগ জন্মেছে শিবের স্ত্রী পার্বতীর মুখ থেকে। অপরদিকে পাশ্চাত্যদেশে সঙ্গীতের প্রথম সৃষ্টি সংক্রান্ত চমকপ্রদ কাহিনীটি হলো, হার্মেস-এর গাথায় পাওয়া যায়, জন্মের পর হোমার কিল্লেনি পর্বতের উপর গুহার পাশে একটি কচ্ছপ দেখতে পান। তিনি কচ্ছপটিকে মেরে তার খোলে (ঝযবষষ) গরুর চামড়া ও ভেড়ার অন্ত্রে তৈরি সাতটি তার দিয়ে বাদ্যযন্ত্র সৃষ্টি করেন। সঙ্গীত উৎপত্তির এমন বহু গল্প রয়েছে। এসব ধর্মীয় বিশ্বাসে ও লৌকিক উপখ্যানের উপর আঘাত হেনে সঙ্গীতের উৎস সংক্রান্ত বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা প্রাচ্যে সম্ভব হয়নি। তবে পাশ্চাত্যে কিছু কিছু হয়েছে। যেমন : কাটসাকস, এ. ডানিয়েল, এইচ.জি ফারমার প্রমুখ পাশ্চাত্য লেখক এই উপ-মহাদেশীয় সঙ্গীত নিয়ে ব্যাপক কাজ করেছেন। তাঁরা সবাই একমত পোষণ করেছেন যে, প্রাচীনকালে সমগ্র বিশ্বের অসংখ্য জাতি ও দেশের মধ্যে সঙ্গীতের প্রচলন ছিল এবং তা বিকাশ লাভ করেছে স্ব স্ব দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মজীবনের ভিতর দিয়ে।
উল্লেখ্য, প্রাচীন পারস্যের রাজদরবারে সঙ্গীত পরিবেশন করা হতো। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া তথা তাজিয়ার সময়ে তাদের অপরিহার্য উপাদান ছিল সঙ্গীত। সঙ্গীতের অনুষ্ঠান হতো ইমাম হাসান ও হোসেনের উদ্দেশে। সামগান, নাথগীতি, চর্যাগীতি প্রভৃতি প্রকীর্ণ শ্রেণীর প্রবন্ধসঙ্গীত গীত হতো এই উপ-মহাদেশীয় সঙ্গীত উৎপত্তির প্রারম্ভিক লগনে। তবে সঙ্গীতের অনুশীলন হতো মূলত মন্দির ও চার্চে উপাসনার মাধ্যমে। অর্থাৎ সঙ্গীতের রূপ ছিল তখন ধর্মীয় প্রার্থনার সঙ্গে সম্পৃক্ত। এ বিষয়টি সঙ্গীতের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ সংক্রান্ত প্রাচীন সংহিতা, আরণ্যক ও ব্রাহ্মণ সাহিত্যগুলোর আলোচনায়ও লক্ষ্য করা যায়। তবে সঙ্গীতের কাঠামোগত পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও পরিমার্জনের মাধ্যমে জনসাধারণের কাছে এর আকর্ষণ ও গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পাওয়ার জন্য তখন বিভিন্নভাবে প্রচেষ্টা চালানো হতো। যেমন : বৈদিক সঙ্গীতের সঙ্গে যুক্ত করা হয় নৃত্য এবং গণমুখী লৌকিক সঙ্গীত যদিও গ্রীস ও পারস্য প্রভাবে পরবর্তীতে নৃত্য একটি আলাদা কলা হিসেবে আবির্ভূত হয়।
সঙ্গীতের প্রচার, প্রসার ও উন্নতির জন্য প্রাচ্যের হিন্দু সন্ন্যাসী ও বৌদ্ধ ভিক্ষুরা রাজকীয় অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিবেশন করতেন। এ রেওয়াজ পাশ্চাত্যের ধর্মযাজকরাও চালু করেছিলেন। সুতরাং এ থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়, সঙ্গীতের উৎস এবং বিকাশের গতিধারায় প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের মধ্যে মৌলিক কোন পার্থক্য ছিল না। স্বাভাবিক কারণেই সঙ্গীতের উৎপত্তি বিষয়ক পাশ্চাত্য দেশীয় সংজ্ঞা প্রাচ্যের ক্ষেত্রেও সমভাবে প্রযোজ্য। তবে সে ঐতিহাসিক পটভূমির আলোচনায় মনে রাখতে হবে, শুধুমাত্র বাস্তব ঘটনা পর্যালোচনা করে ইতিহাসের সার্থক রূপ সৃষ্টি করা যায় না; এর জন্য প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট ঘটনাসমূহ কখন, কোথায় এবং কিভাবে বিকাশ লাভ করেছিল, সেগুলোর প্রমাণযোগ্য তথ্য সংগ্রহ করে তা বর্তমান দর্পণে প্রতিফলন করা।
সঙ্গীতের উন্নয়ন সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য ও তত্ত্ব বিশ্লেষণ করতে গিয়ে অনেকে মনে করেন, গ্রীকরাই সঙ্গীতের প্রচার ও প্রসারের একচ্ছত্র কৃতিত্বের অধিকারী। তাদের মতে, গ্রীকরা রোম নগরী আক্রমণ করার সময় গ্রীসের সৈনিক ও দাসরা যে সঙ্গীতচর্চা করত তা দেখে রোমের অধিবাসীদের মনে সঙ্গীত শিক্ষার আকাঙ্ক্ষা জাগে এবং পরবর্তীতে গ্রীস সঙ্গীতের দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। কিন্তু সঙ্গীতের যে রূপ আজ আমরা দেখছি, সে রূপের পশ্চাতে রয়েছে শত-সহস্র সঙ্গীতজ্ঞ, সাধক, জ্ঞানী-গুণীদের যত্নশীল উদ্যম; রয়েছে তাদের পারস্পরিক নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের আদান-প্রদান। এই উপ-মহাদেশসহ তুরস্ক, বেলজিয়াম, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্স, স্কটল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, আমেরিকা এবং অন্যান্য পাশ্চাত্য দেশে সঙ্গীতের ক্রমবিকাশ হয়েছে মোটামুটি একই আদলে। এই সঙ্গীতের মাধ্যমেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষ নিজেদের মধ্যে সাংস্কৃতিক ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ স্থাপন করেছে বলে প্লিনি, স্ট্রাবো, মেগান্থিনিস প্রমুখ প্রাচীন বিদেশী ঐতিহাসিকগণও মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করেছেন। সুতরাং সঙ্গীতের সমৃদ্ধি ও সার্বিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে পৃথিবীর সব সুসভ্য দেশই একে অন্যের কাছে ঋণী। এতে বিভিন্ন জাতি বা জনগোষ্ঠীর একক কোন কৃতিত্ব নেই। অপরদিকে বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা অনুযায়ী সঙ্গীতের সৃষ্টি জীবজন্তুর চিৎকার নকল করার প্রবণতা থেকে, যদিও চার্লস ডারউইনের মতে, বিপরীত লিঙ্গের প্রাণীকে যৌনাসক্ত করার প্রচেষ্টা থেকেই সঙ্গীতের সৃষ্টি। তবে ফরাসী দেশের জ্যাঁ জাক রুশো, ইংল্যান্ডের হারবার্ট স্পেনসার প্রমুখ দার্শনিকদের মতে, উচ্চকণ্ঠে কথা বলা থেকে সঙ্গীতের শুরু। এদিকে ওয়ালাসেচক তার ুচৎরসরঃরাব গঁংরপচ্ নামক গ্রন্থে সঙ্গীতের উৎপত্তির ক্ষেত্রে তাল, লয় বা মাত্রার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। জার্মান লেখক কার্ল বুকার ্তুঅৎনবরঃ ধহফ জযুঃযসঁং্থ গ্রন্থে সমষ্টিগত কাজের সুবিধার জন্য সঙ্গীতের সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করেন। ফাদার ডবিস্নও স্মিথ এবং কার্ল স্টাম্ফ-এর মতে প্রাচীন মানুষ তাদের প্রয়োজনের তাগিদেই ভাষার মতো সঙ্গীতের জন্ম দিয়েছে।
তবে উলি্লখিত গবেষণামূলক তত্ত্ব ও তথ্যের মধ্যেও একচেটিয়া সত্যের অভাব রয়েছে বলে অনেক সঙ্গীত-বিশারদ যে ধারণা পোষণ করেন, তাও কিন্তু অমূলক নয়। তাদের মতে, মানুষ যেমন তার নিজের প্রয়োজনে ভাষা সৃষ্টি করেছে, সঙ্গীতও তারা নিজের প্রয়োজনেই সৃষ্টি করেছে। আদিম মানুষ তাদের আনন্দ উল্লাস বিভিন্ন শব্দ, আওয়াজ বা ধ্বনির মাধ্যমে প্রকাশ করতো। পরবর্তীকালে সঙ্গীত শাস্ত্রবিদগণ সেই শব্দ, আওয়াজ বা ধ্বনিকে 'নাদ' নাম দিয়ে একে সঙ্গীতের আদি উৎস হিসেবে অভিহিত করেছেন। নাদ থেকে স্বর, স্বর থেকে সুরের উৎপত্তি। সুরের সঙ্গে কথা, তাল ও লয়ের সমন্বয়ে গীত বা সঙ্গীতের উৎপত্তি। উল্লেখ্য, এ তত্ত্বটি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য উভয় সঙ্গীতের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য বলে সঙ্গীত তত্ত্ববিদগণ মনে করেন।
পাশ্চাত্য-সঙ্গীত উৎপত্তির বিষয়ে অনেকে মনে করেন ২৩৪৮ খ্রীস্টপূর্বাব্দে মহাপ্লাবনের (উবষঁমব) পূর্বে জুবল (ঔঁনষব) সঙ্গীতের সৃষ্টি করেন (উদ্ধৃতি : ভারতীয় সঙ্গীতের ইতিহাস, স্বামীজি প্রজ্ঞানানন্দ, পৃষ্ঠা-২৮)। ৬০০ অব্দে পীথাগোরাস গ্রীসীয় সঙ্গীত পদ্ধতিকে এগিয়ে নিয়ে যান। তবে ইংল্যান্ডের আদিম অধিবাসী বৃটনরা এবং ইংল্যান্ডে বসবাসকারী স্যাক্সনরা খ্রীস্টধর্মে অভিষিক্ত হবার পর চার্চসহ বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সঙ্গীতধারার প্রবর্তন করেন। খ্রীস্টপূর্ব (৬৭২-৭৩৫) অব্দের মাঝামাঝি সময়ে ইংরেজ সন্ন্যাসী ও ঐতিহাসিক বিডি (ইবফব) সুপ্রসিদ্ধ শিল্পী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তৃতীয় হেনরীর রাজত্বকালে ওয়ালটার ওডিংটন সাতটি অক্ষরের সাহায্যে স্বরলিখনের (ঘড়ঃধঃরড়হ) প্রবর্তন করেন। এই সাঙ্গীতিক স্বরলিপি প্রথার ক্রমবিকাশ ও উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে কণ্ঠ ও যন্ত্রসঙ্গীতের বিস্তৃতি ঘটে। মোটামুটিভাবে ১৪০০ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ড, নেদারল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি প্রভৃতি দেশে সঙ্গীত রচনার কাজ বিশেষভাবে প্রসার লাভ করে। এরপর গেব্রিয়েল (১৫৩০-১৬১২) নামে একজন ইতালীয় সঙ্গীত শিল্পী অকেস্ট্রা-সঙ্গীত এবং জার্মানির গুক (১৭১৪-১৮৮৭) ও মোজার্ট (১৭৫৬-১৭৯১) অপেরা সঙ্গীতের মাধ্যমে পাশ্চাত্য সঙ্গীতের যথেষ্ট উৎকর্ষ সাধন করে গেছেন। এই অপেরার মাধ্যমে রাশিয়ায় সঙ্গীত নবজীবনের সূচনা করে। পাশ্চাত্য-সঙ্গীতের উন্নয়নে হ্যান্ডেল-এর ভূমিকাও অনস্বীকার্য। প্রখ্যাত জার্মান সঙ্গীত রচয়িতা হ্যান্ডেল অধিকাংশ সময়ই ইংল্যান্ড-এ বসবাস করতেন। তিনি বাইবেলের কিছু কিছু অংশে সুর বসিয়েছিলেন। এগুলো শত শত কণ্ঠে এবং শত শত যন্ত্রে 'হ্যান্ডেল' উৎসবে গাওয়া হয়ে থাকে। একবার রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং ঐ উৎসবে উপস্থিত ছিলেন বলে তিনি তাঁর 'সঙ্গীত' প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন।
প্রাচ্যসঙ্গীত-এর সূতিকাগার হলো আমাদের এই ভারতীয় উপ-মহাদেশ। কারণ প্রাচ্যের দেশগুলো বিশেষ করে চীন, জাপান, কম্বোডিয়া প্রভৃতি দেশের সঙ্গীত সমৃদ্ধি লাভ করেছিল ভারতবর্ষের স্বরগ্রাম ব্যবহারের মাধ্যমে। এখানে সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের প্রাথমিক নিদর্শন পাওয়া গেছে হিমবাহ যুগে (৪ লক্ষ-২ লক্ষ খ্রীস্টপূর্ব)। সেই হিমবাহ যুগ থেকেই ক্রমবিবর্তনের ধারায় জন্ম নেয় প্রস্তর যুগ এবংি পরবর্তীতে সিন্ধু সভ্যতা (খ্রীস্টপূর্ব ৩০০০-২০০০)। এই যুগে প্রাপ্ত নৃত্যরতা নারীমূর্তি, বিভিন্ন সীলমোহর, মৃৎপাত্রের গায়ে নকশা, শিলালিপি, গুহাচিত্র এবং অন্যান্য প্রত্নতাত্তি্বক নিদর্শন অবলোকন করে সিন্ধু সভ্যতাকেই এই উপ-মহাদেশীয় সঙ্গীতের প্রারম্ভিক কাল এবং গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। কারণ এর পূর্বে সঙ্গীতের প্রমাণযোগ্য কোন ইতিহাস পাওয়া যায় না।
তবে খ্রীষ্টপূর্ব দু'হাজার বছরের পর থেকে সিন্ধুসভ্যতা ধীরে ধীরে পতনের দিকে এগিয়ে যায়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দার কারণে সিন্ধুর অধিবাসীরা বাধ্য হয়ে সুকুমার বৃত্তিগুলো ছেড়ে বাঁচার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এ সময় আফগানিস্তান ও ইরানের মালভূমিতে বসবাসরত কৃষিজীবী আর্যরা হিন্দুকুশ গিরিপথের ভিতর দিয়ে এ উপমহাদেশে প্রবেশ করে। নাগরিক সভ্যতার সঙ্গে পরিচয় না থাকায় তারা মৃতপ্রায় সিন্ধুসভ্যতাকে আঘাতের পর আঘাত করে আস্তে আস্তে সনাতনী গ্রাম্য সভ্যতার দিকে এগিয়ে যায়। তারপর একে একে আসে পারসী, গ্রীক, আরব, পাঠান, মোঘল এবং একাধিক ইউরোপীয় জনগোষ্ঠী। এদেশের মানুষের সঙ্গে; জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশে তারা একটি উন্নত ধরনের নিয়মতান্ত্রিক সঙ্গীত পদ্ধতির জন্ম দেয়। তাঁদের সৌন্দর্যবোধ বা নন্দনরুচি ছিল প্রশংসনীয়। বৈদিক যুগে (যীশু খ্রিস্টের জন্মের আনুমানিক ২০০০ বছর পূর্ববর্তীকাল) সৃষ্ট ঋগ্বেদের শ্লোকগুলো তারা তখন সংগৃহীত ও কণ্ঠস্থ করে। সুরারোপিত ঋগ্বেদের শ্লোকগুলোই পরবর্তিতে সামবেদ তথা সামগান নামে পরিচিতি লাভ করে। সামগানে বাদ্যের মাধ্যমে গানের সুর ধারাকে অনুসরণ করার রীতি প্রচলিত ছিল। প্রাথমিক পর্যায়ে সামগানে স্বরের সংখ্যা তিন বা চার হলেও ধীরে ধীরে তা সপ্তসুরে বিকাশ লাভ করে। এজন্যই হয়ত সামবেদকে সঙ্গীত পদ্ধতির প্রাথমিক পদক্ষেপ বলে মনে করা হয়। স্বামী প্রজ্ঞানানন্দের মতে, এই সামগান বিশ্ব সঙ্গীতের মূল উৎস। উল্লেখ্য, আর্যদের এই সামগান পরবর্তীতে মার্গ সঙ্গীত নামে পরিচিতি লাভ করে এবং সেই মার্গ শ্রেণীভুক্ত গানগুলো খ্রীস্টপূর্ব ৫ম শতক পর্যন্ত প্রচলন ছিল।
পঞ্চম শতাব্দীর পরই আসে বাংলাভাষার প্রথম নিদর্শন নাথগীতি এবং চর্যাগীতি নামে এক প্রকার প্রকীর্ণ শ্রেণীর প্রবন্ধসঙ্গীত। স্ত্রোত্র আকারে গেয় এই প্রবন্ধসঙ্গীত থেকে উদ্ভব লৌকিক সঙ্গীত। আবার এই লৌকিক সঙ্গীত থেকেই জন্ম নেয় ক্লাসিক্যাল বা রাগসঙ্গীত। ঋগ্বেদের প্রখ্যাত ভাষ্যকার কালীনাথ মনে করেন, মার্গ সঙ্গীত, গান্ধর্ব সঙ্গীত ও ক্লাসিক্যাল সঙ্গীত একই সূত্রে গাঁথা। স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ 'যতি'কে রাগের পূর্বসূরি বলে আখ্যায়িত করেছেন। এই যতির কথা নাটক সম্বন্ধীয় ভরত মুনির 'নাট্যশাস্ত্রে' উল্লেখ রয়েছে, যা ক্রমবিবর্তনের ধারায় উপমহাদেশীয় সঙ্গীতকে মাতিয়ে রাখে প্রায় সাত শ' বছর। এই যতি যুগের প্রথম দিকে স্বরের সংখ্যা অনুযায়ী রাগের শ্রেণী বিন্যাস করা হতো। পরবর্তীতে শুদ্ধ, শংকর ও ছায়ালগ এই তিন শ্রেণীতে বিন্যাস করে শেষ পর্যন্ত ছয় রাগ ছত্রিশ রাগিনীতে বিভক্ত করা হয়।
এরপর অর্থাৎ দ্বাদশ শতকে সঙ্গীত শৈলীর অন্যতম নিদর্শন হিসেবে আবির্ভূত হয় জয়দেবের গীতগোবিন্দ। জয়দেব ছিলেন রাজা লক্ষণ সেনের সভাকবি এবং সংস্কৃত সাহিত্যের শেষ শিল্পী। মূলত রাধাকৃষ্ণের লীলাকে কেন্দ্র করে রচিত গীতগোবিন্দ সঙ্গীত জগতে এক নবতরঙ্গের সূচনা করে। এ সময় সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বিশেষ করে সঙ্গীতের ক্ষেত্রে মুসলমান সম্প্রদায়ও বেশ অগ্রগামী ছিলেন। হিন্দু ও বৌদ্ধদের মতো তারাও ধর্মাচরণে সঙ্গীত ব্যবহার করেছেন। খাজা মঈনউদ্দিন চিশতী (১১৪২-১২৩৬) ভারতবর্ষে ইসলাম প্রচারকালে মুরিদগণকে নিয়ে সামা নামক গান গেয়ে খোদার প্রেমে তন্ময় হয়ে যেতেন। উপ-মহাদেশের বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত মুসলিম পীর, আউলিয়া, সুফি, দরবেশ, ফকিরদের মাজার শরীফে, হুজুরায় ও খানকা শরীফে আধ্যাত্মিক ধর্মসাধনায় সঙ্গীত অনুশীলন হতো, যা এখনও প্রচলিত আছে। তবে ত্রয়োদশ শতাব্দীতে সম্রাট আলাউদ্দিন খিলজীর শাসনামলে (১২৯৫-১৩১৬) মুসলিম সঙ্গীতজ্ঞরা সর্বপ্রথম এ উপ-মহাদেশীয় সঙ্গীতকে ধর্মীয় বলয় থেকে মুক্ত করে সাধারণ মানুষের কাছে নিয়ে আসার প্রচেষ্টা চালায়। সে প্রচেষ্টায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন কবি শেখ সাদী (১১৭৫-১২৯৫)। তাছাড়া কবি ও সঙ্গীতজ্ঞ আমীর খসরু (১২৫৩-১৩২৫) অতিমাত্রিক বৈকরণিক শাসনে অতিশয় নিরস ও স্থবির হয়ে থাকা নিয়ম-নীতি ও গায়ন-শৈলীকে ভেঙ্গে সহজ-সরল রূপ দিয়ে সর্বপ্রথম 'খেয়াল' রীতির প্রবর্তন করেন এবং গজল বচনায় মনোনিবেশ করেন। তাছাড়া তিনি কাওয়াল নামক এক প্রকার গানেরও প্রচলন করেন।
বাংলা সঙ্গীতের আরও একটি উল্লেখযোগ্য উপাদান হলো কীর্তন। পঞ্চদশ শতকে ৪১৮টি পদ সম্বলিত বড়ু চ-ীদাসের (১৩২৫-১৪০২) শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন যেমন শ্রীচৈতন্যের (১৪৮৬-১৫৩৩) হাতে বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে, ঠিক তেমনি শেখ সাদীর 'খেয়াল' জৌনপুরের শেষ সুলতান হোসেন শাহ শারকী (?) কর্তৃক সংস্কার হয়ে বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। তবে, মোগল সম্রাজ্য পতনের পর খেয়াল বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয় এবং এর শক্তিমান আপন বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলে। পরবর্তীতে মঙ্গলকাব্য থেকে উদ্ভব হয় মঙ্গলগীতি। এ গানের মূল বিষয় হলো মঙ্গলোচ্চারণ অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশে প্রার্থনা। তবে, এসব কাব্যে বাঙালির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও আচার-আচরণের প্রতিচ্ছবিও বর্ণিত হয়েছে। ষোড়শ শতকে লোচন দাসের (?) ধামালি এবং অষ্টাদশ শতকে রামপ্রসাদ (১৭২০-১৭৮১) তার গানের মাধ্যমে আধ্যাত্মিক সাধনার জগতে বৈচিত্র্য আনেন।
অষ্টাদশ শতকের শেষভাগে পাঞ্জাব অঞ্চলের লোকগীতি টপ্পা গানের প্রচলন শুরু হয়। প্রধানত উটের গাড়ি চালকের মুখেই টপ্পা গান বেশি শোনা যেত। শোরী মিয়া (১৭৪২-১৭৯২) নামে একজন সঙ্গীতজ্ঞ টপ্পা গানগুলোকে সাঙ্গিতিক আদর্শে সাজিয়ে সম্পূর্ণ আলাদা একটি গায়ন পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। এ পদ্ধতি অনুসরণ করে রামনিধি গুপ্ত বা নিধু বাবু (১৭৪১-১৮৩৯) বাংলা টপ্পা রচনা করেন। এখানেই ভারতীয় বা হিন্দুস্থানী রাগসঙ্গীতের ধারার সঙ্গে বাংলা রাগসঙ্গীত চর্চা যুক্ত হয়। পরবর্তীতে টপ্পাকার কালীমির্জা (১৭৫০-১৮২০), বাংলা ভাষায় ধ্রুপদ রীতির প্রবর্তক রামশংকর ভট্টাচার্য (১৭৬১-১৮৫৩) এবং বাংলা ভাষায় খেয়াল রচয়িতা রঘুনাথ রায় (১৭৫০-১৮৩৬) বাংলা গানকে আরও সমৃদ্ধ করে হিন্দুস্থানী রাগসঙ্গীতের ধারার সঙ্গে যুক্ত করেন। উনিশ শতকের প্রথম দিকে আসে বাউল গানের যুগ। লালন ফকির (১৭৭৪-১৮৯০), কাঙাল হরিনাথ মজুমদার (১৮৩৩-১৮৯৬), গগন হরকরা (?), রাধারমন (?), হাছন রাজা (১৮৫৪-১৯২২) প্রমুখ মরমিয়া সাধকদের গান বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে। বাউল গানের পাশাপাশি লোকগীত, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, পল্লীগীতি প্রভৃতি মাটি ও মানুষের গানে এদেশের মানুষ তাদের শেকড়ের সন্ধান খুঁজে পায়। এর পরবর্তী পর্যায়ে বাংলা গানের বিকাশ সাধিত হয়েছে মূলত ব্রাহ্মধর্মান্দোলন, দেশোদ্দীপনা ও নাট্যমঞ্চ-এ ত্রিধারায়। যেমন : প্রথমত দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪০-১৯২৬) এবং সঙ্গীতবিজ্ঞানী কৃঞ্চধন বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৪৬-১৯২৬) কর্তৃক বাংলা গানের স্বরলিপির পদ্ধতি প্রণয়ন করার পর বিষ্ণুপুরের ধ্রুপদকে ব্যবহার করে সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে প্রণয়োচ্ছ্বাসিত হালকা বাংলা গানে ভাব ও বন্দিশের গাম্ভীর্য আনতে উদ্যোগ নিয়েছিল ব্রাহ্মসমাজ। দ্বিতীয়ত, ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গরোধ আন্দোলনকালে রাখিবন্ধন উৎসবকে কেন্দ্র করে রচিত হলো অসংখ্য স্বদেশী গান, জেগে উঠে বাংলা গানে দেশভাবনার অনচ্চ ইঙ্গিত, সূত্রপাত হয় স্বদেশী আন্দোলন। তৃতীয়ত গিরিশচন্দ্র (১৮৪৯-১৯১২), দ্বিজেন্দ্রলাল রায় (১৮৬৩-১৯১৩), নজরুল (১৮৯৯-১৯৭৬) প্রমুখ বাংলা নাটকে ব্যবহার করতে থাকেন সমসাময়িক কালের চাহিদা অনুযায়ী প্রাণবন্ত বাংলা গান।
মোটামুটিভাবে বলা যায়, ঊনবিংশ শতাব্দীর সত্তর দশক থেকে বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশ দশকের সেই ত্রিধারার সঙ্গীতরীতিই সতর্ক অনুধাবনে সমীকৃত হয়েছে নতুন ভাবনা রূপায়ণে এবং এই চলমান প্রক্রিয়া পরিপূর্ণ রূপ পরিগ্রহ করে পঞ্চপ্রদীপ খ্যাত রবীন্দ্র (১৮৬১-১৯৪১) দ্বিজেন্দ্র-রজনী (১৮৬৫-১৯১০), অতুল (১৮৭১-১৯৩৪) এবং নজরুল-এর মাধ্যমে। তাঁরা তাদের ব্যক্তিগত অনুভূতিকে নিজের মতো করে প্রকাশ করেছেন নিজেদের বাণী ও সুরসৃজনে। কিন্তু নজরুল পরবর্তী বাংলা গানে সুরের চলনে ও গীত রচনায় আসে নানা বিভাজন। গীতিকার গান লেখেন, সুরকার সুর দেন, আবার কণ্ঠে রূপায়ণ করেন আরেকজন। এগুলো সমন্বয়ের জন্য তথা গানের পরিপূর্ণ রূপ প্রকাশ করার জন্য থাকে এ্যারেঞ্জার নামে এক নতুন ব্যক্তি। একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, স্বদেশী আন্দোলনে, ৫২-এর ভাষা আন্দোলনে, ৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে এবং আমাদের মহান স্বাধীনতা আন্দোলনে দেশের গান এদেশের সংগ্রামী মানুষকে নিরন্তর প্রেরণা যুগিয়েছিল। তবে পঞ্চাশ কিংবা ষাট দশকে বাংলা গান যেভাবে শ্রোতাদের মন জয় করেছিল আজ তা পারছে না। তাই চলছে পেছনের দিকে যাবার পালা। এরকম বাধ্য হয়েই রেকর্ডিং কোম্পানিগুলো প্রকাশ করে চলেছে পুরনো হিট গান বা তার রিমেক। তারা মূলত ক্যাসেট বের করে চলেছে চলি্লশ থেকে সত্তর দশকে গাওয়া শিল্পীদের আধুনিক গান। ১ বৈশাখ, বর্ষামঙ্গল, বসন্ত উৎসব, ঈদ কিংবা পূজা উপলক্ষে এখন আর গান রচনা হয় না। পঞ্চপ্রদীপের গানেই সে কাজ মিটে যায়। এর পরও বলতে হয় বাংলা গান থেমে নেই। যুগ যুগ ধরে চলছে এবং চলবে সেই চিরায়ত সারস্বত সাধনা।
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
অসাধারণ!!!!!
উত্তরমুছুনউনবিংশ ও বিংশ শতকের রাগ সঙ্গীত বিশেষ করে সুর সম্রাট আলাউদ্দিন খা ও তার পরিবার এর অবদান নিয়ে এমন সমৃদ্ধ প্রবন্ধ লেখার অনুরোধ করছি। আর এমন প্রবন্ধ থেকে থাকলে লিঙ্ক অথবা বইয়ের নাম শেয়ার করতে অনুরোধ করা হলো।
sbr.fire@gmail.com