সোমবার, ৮ মার্চ, ২০১০

কাকমানুষের চকখড়ি


কাকমানুষের চকখড়ি
কুলদা রায়

প্রকাশক: আমার প্রকাশনী
প্রকাশকাল : বইমেলা/২০১০
পৃষ্ঠা সংখ্যা : ১৩৪
প্রচ্চদ: সুমন
মূল্য : ১৫০ টাকা


KAKMANUSHER CHALKKHORI
a collection of stories
BY KULADA ROY
New York, USA.
Kulada_roy@yahoo.co.in





উৎসর্গ

তিন পুরুষ-
হে জল, শরচিহ্নিত ঘড়ি

আমার প্রপিতামহ স্বর্গীয় সৃষ্টিধর রায়
আমার পিতামহ স্বর্গীয় বিঁধুভূষণ রায়
আমার পিতা স্বর্গীয় শঙ্করকুমার রায়



ভুমিকথা :

জলকে জলের মত ভেবেছি, পদ্মপাতায় জলদেবী বসে-
ঋষিকা মৌসুমী লিখত, আমাদের বাগানে একটি টুনটুনি পাখি বাসা বেঁধেছে। আমি তখন ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে। ঢেউ গুনছি। আর বুঝতে পারছি- টুনটুনি পাখিটি আমার বুকের মধ্যেই উড়ে আসছে। পাখিটি প্রাণজ। ওর প্রাণ আমার প্রাণে বাঁধা। সেই মধ্য আশিতে। ঋষিকা মৌসুমীর কাছে লিখতে লিখতে এই গল্পগুলির বীজ উপ্ত হয়েছিল।
আর আজ আমি নিজেই একটি টুনটুনি নয়- সমুদ্রপাখি। ডানা নেই। আছে হাহাকার।
চোখ খুলে দেখি আমার বড়ো মেয়েটি খট খট করে লিখছে। আর ছোট মেয়েটি আমার কাছে কাগজ আর কলম দিয়ে বলেছে- লেখ বাবা। লেখ।
-কী লিখব মা?
-তোমার ইচ্ছে। ইচ্ছে লেখ।
মেয়েটি একটি আঁকাবাঁকা দাগ দিয়েছে কাগজের উপরে। বলে, কি লিখছি জান বাবা? লিখেছি-একটি পরীকথা। আর এই দাগটি হল আকাশযথা। অই দাগটি- মাটিব্যাথা। ফুল ফুটেছে। চাঁদ উঠেছে। হাতি নাচছে। ঘোড়া নাচছে।
হা হা হা। কী রূপ লিখছে আমার মেয়ে। যেন পাতা। একটি গাছ। ভরভরন্ত ফল। মিষ্টি সুবাস। কী সহজ। কী সরল। প্রাণদায়ী। আমি এই গাছটির নিচে একটু বসি। আর আমার বড়ো মেয়েটি পিয়ানো বাজায়। ছোট মেয়েটি নিষ্পত্র ডানা মেলে উড়ে যায় তার আকাশযথায়।
আমি আমার বড়ো মেয়েটির সঙ্গে লিখি। ছোট মেয়েটির সঙ্গে লিখি। লিখতে লিখতে হাঁটতে শিখি। হেঁটে হেঁটে অনেকদিন পরে কাজে যাই। বসে থাকি। বিড় বিড় করে বলি, এসো ঘুম। এসো আনন্দ। এসো জীবন। হে কদম, পক্ষীভুত রোদ।
ততদিনে স্বজনের ভস্ম থেকে নতুন পাখিরা এসে গেছে। আমার কাঁধে এসে বসেছে। ওদের লেজটি দেখে আমার প্রাণ নতুন করে ভরে এসেছে। আমি লেজের ছায়াটিকে মনে করে লিখেছি। ছায়াটির নড়াচড়া দেখে হেসেছি। আর কিছু নয়। অন্য কিছু নয়।
সোহম। আমি সে-ই। সে-ই আমি।
কী দরকার অন্য কিছুর।



মধুবাতা ঋতায়তে-

এই গল্পগুলো- অমি রহমান পিয়ালের তাড়ায় লিখিত হয়েছে। কবি বন্ধু তুষার গায়েনের সঙ্গে দীর্ঘ দিন কথা হয়েছে লেখলেখি নিয়ে। আর মদদ জুগিয়েছেন কথাশিল্পী পাপড়ি রহমান, কবি সেলিনা সিকদার, জামিলা হাসান, ক্রিস্টিনা রোজারিও। এঁদরে শত্রুতাও মধুর।
বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ পাঠিয়ে দিয়ে মনীষী কলিম খান প্রশ্রয়ের হাসি হেসে উঠেছেন। খোঁড়া পাহাড় ডিঙোতে যাচ্ছে। শ্রী কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস এরকমই বলেছিলেন।

স্নেহজল- জলের স্নেহ-
এবং আমার চাচা আলোকচিত্রী নাইব উদ্দিন আহমদ চেয়েছিলেন যেন আমি লিখি। কি লিখব? তিনি সকল লেখার পারে চলে গেলেন এ শীতে। তাঁর আশ্রয় না পেলে আমি কি কখনো তাঁর চোখদুটো চেয়ে নেয়ার সাহস পেতাম?




ঋণস্বীকার দীনস্বীকার-

জলকে জলের মত ভেবেছি, পদ্মপাতায় জলদেবী বসে

প্রফেসর আব্দুল কুদ্দুছ মিঞা, প্রফেসর সুবোধ চন্দ্র সরকার, প্রবীর শিকদার সুজন, গৌতম শিকদার
কবি তাপস গায়েন, কলিম খান, সুশান্ত দাশগুপ্ত, মাহমুদুল হাসান রুবেল,
Dr. Jagadeesh Sindagi, Ms. Mary Matos, Manica Naraine, Fiona Johnson, Jenifer, Crystal, Julious Oluokun, Olakunle, Myson Jean Jaques, Kendrick, Hans Piere, Lopej, Benny, Folake M Sodia, Mojeed, Belliboot, Md. Shohail Shafi, Md Ashraf, Dr. Allarakha Sheikh,


ফ্লাপ পরিচিতি-

কুলদা রায়

জন্ম অঘ্রাণে। দিনটি অজানা। বৃহস্পতিবার। গোপালগঞ্জ শহরের একটি শুদ্র গৃহহীন পরিবারে। পঁয়ষট্টির ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময়।
একাত্তরে এক কুলদা রায়কে দেখা যায় দেশান্তরে। বাবার কাঁধে চড়ে যাচ্ছে। আরেক কুলদা রায় দুর্ভিক্ষের মধ্যে সংগ্রহ করছে রিলিফের দুধ। আরেকজন বসে আছে পরেশ মাস্টারের মুদি দোকানে। পাথুরে শ্লেট, লকলকা বেত আর বাটখারা তার সহপাঠী। পড়ছে- ঐ অজগর আসছে তেড়ে।
বুড়োমানুষের চিঠি লিখছে অন্য কোন কুলদা রায়। এর পরে লিখবে কয়েকটি মুদি খাতা। বাবার খাবার পৌঁছে দেবে বাজারে। তারপর স্কুল। আরেকজন স্কুল থেকে দেখতে যাবে ধানক্ষেত। পাঠাগারের বইয়ের ছদ্মলিপি লিখে দেবে অন্য আরেক রায়। তিন পাগলের সঙ্গে খাবে দুধভাত। যাবে পালাগানে।

আরকজন কুলদা রায় কবিতা লিখে ভর্তি হয়েছে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। আরেকজন ফাঁকে ফাঁকে করছে দক্ষ শ্রমিকতা, তারা গোণা, পোস্টার লেখা, দেখনদারী। আরেকজন মেতে আছে ধানের ফুল নিয়ে দীর্ঘ গবেষণায়। তার অভিসন্দর্ভ- ধানের আমিষ বাড়ানোর উপায়। এর মধ্যে একজনের হাতে ঝুলছে কৃষি বিদ্যায় স্নাতকোত্তর।
একজন কবিতা লিখত নাম লুকিয়ে- আনন্দ রোজারিওর কবিতা। দুএকটা ছোট কাগজ প্রকাশও করেছে। কেউ কেউ দিয়েছে ফিরিয়ে । আরেকজন দীর্ঘ পনেরটি বছর বরিশালের গ্রামে ঘুরেছে নদী, নালা, খাল, বিল, ফসল, গাছপালার সঙ্গে। দেখে বেড়িয়েছে গাছের রোগ-পোকার জগৎ। মাটির স্বাস্থ্যকথা। পাঁচটি বছর তার জলবাস। আর কৃষকের সঙ্গে হেঁটে চলে গেছে আরেকজন কুলদা রায়।
অন্য একজন চলে গেছে সমুদ্র পেরিয়ে। চিকিৎসকের পরামর্শে লিখছে গল্প। অন্তর্জাল-সাহিত্য।
এসব কুলদা রায়ের কোন বই নেই। অন্য কোথাও এরা লেখে না। কেন লিখবে?
এদের একজন থাকে নিউ ইয়র্কে। গৃহহীন। স্ত্রী মেরী হালদার। দুকন্যা পূর্বা অতন্দ্রিলা আর প্রজ্ঞা পারমিতা। সঙ্গী একটি বিড়াল আর তিনটি পাখির ছায়া।




সূচিমুখ

১। হারিয়ে যাওয়া : শোলার ফুল
২। আলো ও হাওয়ার গল্প
৩। টম সাহেবের বাড়ি
৪। যে কথা আগুনের- যে কথা স্নেহজলের
৫। গোলাপ সুন্দরী
৬। ছাতিম পাতা
৭। মেঘ মল্লারের কথা : একজন পাথর মানুষের কথা
৮। গোফাগুন
৯। কবিতা অথবা রহস্য খোলার রেঞ্চ
১০। প্রজ্ঞা পারমিতার জলতল অথবা এ্যান্ডারসনের চকোলেট
১১। কৌটো ও মেঘকুঁড়ি
১২। জলের ঈশ্বর : ঈশ্বরের জল
১৩। ঈশ্বরের চোখ : আদিপাঠ
১৪। পরীকথা
১৫। একটি হত্যাকাণ্ডের নিষ্পত্র ডানা
১৬। নির্বাসন শিখিনি, মৃত্যু কবজ
১৭। আমি নই ক্ষত্রিয়
১৮। ছয়ফুল মুলক বদিউজ্জামাল উরফে চান্দু মিয়ার সহি সফরনামা
১৯। যে কথা রক্তের, হাহাকারের
২০। নারাণকাকুর মেটিরিয়া মেডিকা
২১। কাকমানুষের চকখড়ি
২২। একটি বুড়ো আম গাছ অথবা অমৃত ফল বিষয়ক যাদুবাস্তব গল্পের খসড়া
২৩। ইঁদুর অথবা নক্ষত্রের রোদ
২৪। মল্লদের শালবন
২৫। পাতা ঝরার গান : পতিত শ্রমণ
২৬। হাওয়া পুলিশের পেরজাপতি : আধখানা নভেলেট
২৭। ভাসান চর- হাসান চর
২৮। আখুঞ্জীনামা/১ : অতি আদুনিক নোবেল : গৈয়া বাগানের পিয়ারা বিগম
২৯। আখুঞ্জীনামা/২ : নয়া ছিঃনেমা : দি বেড বাগ- যহন ছারপুকা আইল
৩০। আখুঞ্জীনামা/৩ : আয়ুব খানের ঘোড়া : কে তাহারে চিনতে পারে
৩১। পরিশিষ্ট



নদী মরে গেলে সত্য হারিয়ে যায়
দুপাড়ের মানুষের বুক থেকে ঝরে পড়ে
বয়সের মতন এক একটা নিটোল স্বপ্ন
প্রতিটি গল্পের সাথে জেগে থাকে দীর্ঘশ্বাস
এরকম কথা আমাকে শুনিয়েছে একজন বুড়ো চাষি

আমি সেই থুত্থুরে বুড়ো চাষির বুকের ভিতরে
হাত দিয়ে দেখি-
অনেক দূরের সবুজ ধান
পুড়তে পুড়তে হলুদ হয়ে যায়-







হারিয়ে যাওয়া : শোলার ফুল

একবার আমাদের ভুলু হারিয়ে গেল। কে তাকে খুঁজবে? আমি বের হলাম। টলোমলো পায়ে রাস্তা দিয়ে হাঁটছি। বটগাছের শেকড়-বাকড়-ঝুরির ফাঁকে ফাঁকে খুঁজে দেখছি। ডাকছি, ভুলু। ভুলু।
রাস্তা পেরিয়ে গোহাট। কোনো গরু নেই। কিছু খড়কুটো আছে। একপাশে মন্দির। মা-কালী জিব কেটে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে মুণ্ডুমালা। গলায় শোলার ফুল। পায়ের নিচে শিব ঠাকুর। ঘুমুচ্ছে। একটি শিয়াল স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ফিস ফিস করে বলল, চুপ চুপ।
মাঠ পেরিয়ে নিচুপাড়ার খাল। জল ছল ছল করে না। কচুরিপানায় ভরা। চওড়া পাড়। একজন বুড়ো মিস্ত্রী ঠুক ঠুক করে নৌকা গড়ছে। বললেন, তুমি কোন বাড়ির খোকা?
আমি কোন বাড়ির খোকা? বললাম, ভুলুদের খোকা।
-কোন ভুলু?
- হারিয়ে যাওয়া ভুলু।
মাথার উপরে একটি শিল কড়াই গাছের ছায়া লম্বা হয়ে নৌকার গায়ে ঝুঁকে পড়েছে। বুড়ো মিস্ত্রী তার গামছাটি পেতে দিলেন। শান্ত হাওয়া এলো। আমাকে ঘুমের মধ্যে ধরে নিয়ে গেল।
তখনো সন্ধ্যে হয়নি। ঘুম ভাংলো। ছায়াটি খালের ঐ পাড়ে চলে গেছে। হাতুড়ি বাটাল বাক্সে ভরে বুড়ো মিস্ত্রী আমার গায়ের মাছি তাড়াচ্ছেন। হেসে বললেন, দ্যাখো, তোমাকে খুঁজতে এসেছে।
ভুলু আমার পায়ের কাছে ন্যাজ নাড়ছে। বুড়ো আমার মাথায় তার রোগা আঙ্গুলগুলো বারদুয়েক রেখে বললেন, কক্খোনো হারিয়ে যেও না খোকা।
কে হারাবে? কোনো মানুষ না থাকলেও ভুলু কুকুরটিতো আছে। আমাকে ঠিক খুঁজে বের করবে।
এ গল্পটি যখন আমার মেয়েদের কাছে করি, মেয়েরা হাসে। বলে, কী বোকা। কেউ হারায় নাকি! হুম, প্রশ্ন বটে।
যখন প্লেনে উঠেছি, তখনো আমার স্ত্রী কাঁদছেন।মেঘের অনেক উপরে চলে এসেছি। আমাদের শহরের আলোবিন্দুগুলো আর নেই। ছোট মেয়েটি বলল, আমরা কোথায় যাচ্ছি, বাবা?
জানি না।
বড়ো মেয়েটি বলল, হারিয়ে যাচ্ছি।
এই প্রথম সত্যি সত্যি হারিয়ে গেলাম। কোনো বটগাছ, গোহাট, জিব বের করা মা-কালী, ঘুম কাতুরে শিব ঠাকুর, ছোট মাঠ, খাল পাড়, শিল কড়াইয়ের ছায়া, বুড়া মিস্ত্রী, আধগড়া নৌকা, অথবা আমার ভুলু কুকুরটিও আজ জানে- যে যায়, সে আর ফেরে না।



আলো ও হাওয়ার গল্প

১.
মেয়েটোর নাম পরী। এই পরী মেয়েটিকেই একদিন পরীতে পেলো। আমাদের উঠোনে তখন ঘাস উঠেছে। এই ঘাসগুলো তুলে ফেলতে ফেলতে দেখলাম- পরীর পিঠে দুটো ডানা উঠেছে। কী অসাধারণ ডানা দুটো। রেশমী। রোদে চিকমিকিয়ে ওঠে। ঘাস তুলবো কি- চেয়ে চেয়ে দেখি- সেই ডানা মেলে মাটি থেকে অনেকটা উপরে উঠে গেছে পরী। চুলগুলো হাওয়ায় উড়ছে। আর হাসি হাসি মুখ।
পরী উড়ে গেল পেয়ারা গাছের ডালে। সবে রং ধরেছে পেয়ারায়। কামড়ে কামড়ে খেলো। কচ কচ শব্দ কানে এলো। একটি শিউলি তলায় ফুল ঝরে থাকত। আর পাতায় শিশির। পরী সেই শিশির বিন্দুগুলো তার দুহাত ভরে কুড়িয়ে নিল। সেই প্রথম একটি মালা গাঁথল শিশির দিয়ে। মুক্তোর চেয়েও লাবণ্যময় সেই মালাটি। গলায় পরে সেদিনই পরী একটি নতুন গান গাইল। কী গাইল, বুঝতে পারিনি। কী আশ্চর্য গানের কথাগুলো। যেন অনেক দূর থেকে ভেসে আসা। অনেক দূরে ভেসে চলে যাওয়া। আমরা শোনার আগেই ভুলে গেলাম। কেবল তার যাওয়া আসার সুরটি কানের মধ্যে বাজতে লাগল। এই সুর জীবনে এর আগে কখনো শুনিনি।
যে নদীতে আমরা প্রতিদিন নাইতে নামি সে নদীতে একদিন অমল জলে নামা ভুলে গেল। অবাক হয়ে চেয়ে রইল হিজল গাছটির দিকে। হিজলের পাতাগুলি ঘন সবুজ। জলে নুয়ে পড়েছে ডাল-পালা। আর লাল লাল ফুল। এই হিজলের ডাল থেকে ঝাপ দিয়ে পড়লাম নদীতে। অমল নামল না। চেচিয়ে ডাকলাম, অমল- নেমে পড়। জলে নেমে পড়।
অমল সেই প্রথম বধির হয়ে গেল। সে চেয়ে রইল হিজলের ছায়াটির দিকে। খণ্ড খণ্ড হয়ে ছায়া ভাসছে জলে। দূরে যেতে যেতে আবার ফিরে ফিরে আসছে। শান্ত বাতাস। আর তক্ষুণী পরীকে দেখতে পেলাম। একটি ফড়িংয়ের মতো পরী উড়ে এসে জলের উপরে অই হিজলের ছায়ার উপরে বসেছে। তার কলসটি জলের ধীর স্রোতে ভেসে যাচ্ছে। বসনপ্রান্ত সামান্য ভেজা। পরীর মুখে সেই ডানাওয়ালা পরীটির হাসি। অমল এইবার ঝাপিয়ে পড়ল জলে। কলসের সাথে সাথে সেও ভেসে চলে গেল বহুদূর।
আমরা দেখলাম, পরীর পা দুখানি লাল। আলতা মাখা।
সেই প্রথম জেনেছি, আলতার মধ্যে কোনো কোনো ফুল গোপনে ফোটে। ফুলটির পাপড়িতে জ্যোৎস্না মাখা। ফুলটির নাম আমাদের জানা নেই। কোনোদিন কি জেনেছি? জানতে পেরেছে কি- অমল? প্রদ্যুম্ন? অথবা আমি?

২.
... আমাদের চারিদিকে যখন সৌন্দর্য বিকশিত হইয়া ওঠে তখন আমরা যেন একজন-কাহার সহিত মিলনের জন্য উৎসুক হই- সংসারে আর যাহারই প্রতি মন দিই, মনের পিপাসা যেন দূর হয় না। এইজন্য সংসারে থাকিয়া আমরা যেন চিরবিরহে কাল কাটাই। কানে একটি বাশিঁর শব্দ আসিতেছে, মন উদাস হইয়া যাইতেছে, অথচ এ সংসারের অন্তঃপুর ছাড়িয়া বাহির হইতে পারি না। কে বাঁশি বাজাইয়া আমাদের মন হরণ করিল, তাহাকে দেখিতে পাই না, সংসারের ঘরে ঘরে তাহাকে খুঁজিয়া বেড়াই। অন্য যাহারই সহিত মিলন হউক না কেন, সেই মিলনের মধ্যে একটি চিরস্থায়ী বিরহের ভাব প্রচ্ছন্ন থাকে।...
(বাঁশির স্বর : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)




টম সাহেবের বাড়ি

বাড়িটা ছিল টম সাহেবের। লাল ইটের। দোতলা। নীচতলায় ডাকঘর। দোতলায় একটি বড়ো সড়ো ঝুল বারান্দা। সেখানে যে ফুললতা ছিল, তার নাম- ব্লিডিং হার্ট।
একটু দূরেই মধুমতি। এই নদীর পাড়ে স্টিমার থেকে একদিন টম সাহেব নেমেছিল। এর পর কেউ আর কোন দিন স্টিমারের ‘ভো’ শোনেনি। সেদিন থেকে নদীটাও বুড়ো হয়ে গেল।
এই বাড়িটার ছাদে মাঝে মাঝে চাঁদ ঝুলে থাকত। সেদিন অন্য কোথাও জ্যোৎস্না উঠত না। কেবল এই বাড়িটা ঘিরে থাকতো আলো। আর শীতল হাওয়া।
যেদিন এই ঘটনা ঘটত, সেদিন আগে ভাগে ডাক-হরকরারা কাজে বেরিয়ে যেত। আবার আগে ভাগে কাজ শেষ করে চলে যেত। দুপুরের পর থেকে ছোট্ট শহরটা থমথমে হয়ে পড়ত। এইদিনে আমাদের ঠাকুমা সন্ধ্যার আগেই ঘুম পাড়িয়ে দিত।
আমাদের প্রদ্যুম্ন একদিন নাই হয়ে গেল। তারপর বেশ কবার নতুন করে ফুল ফুটল আমাদের কৃষ্ণচূড়ার ডালে। কয়েকটা শিউলিগাছ ঢলো ঢলো হয়ে উঠল। কয়েকটা পাখি পালক বদলালো। আমরা যখন প্রদ্যুম্নকে ভুলে যাব ভুলে যাব করছি- সেই সময়ই সে ফিরে এলো। বন থেকে ফেরা অন্য এক প্রদ্যুম্ন। গায়ে সবুজ গন্ধ। এই নতুন প্রদ্যুম্নকে কোনো কোনো দিদি-বৌদি চুরি করে নাড়ু মুড়ি খাওয়াত। একদিন লীলা মাসি ওর মাথায় চুড়ো বেঁধে দিল। ময়ুরের পালক গুজে দিল কে জানি। এক বোষ্টুমী খঞ্জনী বাজিয়ে গান ধরল-
কালা- তোর তরে
কদমতলে চেয়ে থাকি।
সেদিন নদী থেকে একটি নতুন হাওয়া উঠল। এক রকম হাওয়া এর আগে কখনো দেখিনি। সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে সারা শহরটি ঘুমিয়ে পড়ল। যে শিয়ালগুলি প্রহর ঘোষণা করত- সেদিন তারাও কেন জানি চুপ করে গেল। গাছের পাতারাও শব্দহীন।
টম সাহেবের বাড়িটার পাশে একটি তাল পুকুর। কোনদিন তার জল শুকায়নি। তার পাড়ে একটি বিবাহিত অশ্বত্থ গাছ। ঝুরি নেমে এসেছে মাটিতে। আকড়ে ধরে আছে নম্র একটি বট গাছকে।
সে রাত ছিল ঘন অন্ধকার। হঠাৎ করে বাঁশি বেজে উঠল। কী যাদুময় সে সুর। অন্ধকারের ভিতর থেকে অন্যরকম আলো বের হতে লাগল। । ঘন পাতার ফাঁক দিয়ে একটি চাঁদ বাড়িটার কার্নিশে ঝুলে পড়ল। দোতলার একটি জানালা খুলে গেল। সেখানে দেখা গেল একটি মুখ। ফ্যাকাসে - থরথরো। মুখটি ফিস ফিস করে ডাকল, বাবা। বাবা। চিঠিটা কি এসেছে?
কার চিঠি? কোন চিঠি? আমি অমলের দিকে তাকালাম। অমল আমার দিকে। প্রদ্যুম্ন বাঁশিতে বিভোর। এ প্রদ্যুম্নকে আমরা কখনো দেখিনি। কখনো চিনিনি। জানিনি। কোনো এক রূপের জগতে তার বাড়ি। সে রূপের জগতের সুর বাজিয়ে চলেছে। এই বাঁশির সুরে টম সাহেবের বাড়ির উপরে ধীরে ধীরে একখণ্ড মেঘ জমল। ঝির ঝির করে বৃষ্টিও ঝরল। শান্ত হাওয়া বইল। কাঠালী চাঁপার গন্ধে ভরে গেল চারিদিক।
এই সময় টম সাহবের ঝুল বারান্দার দরোজাটা খুলে গেল। একটি মেয়ে ঘোর লাগা চোখে বারান্দা থেকে হেঁটে হেঁটে নীচে নেমে এলো। হাওয়ার মধ্যে পা ফেলে ফেলে মেয়েটি তাল পুকুরটির পাড়ে এলো। ঘাঘরাটা সামান্য একট উঁচু করে ধরল। তারপর পুকুরের জলের উপর তারা কোমল শাদা পা রাখল। অমল আমার হাত খামচে ধরল। চেচিয়ে বলল, চোখ বন্ধ কর। চোখ বন্ধ কর।
চোখ বন্ধ করব কি? আমাদের চোখ কি তখন আমাদের চোখের মধ্যে ছিল? চোখগুলো সব বাইরে বেরিয়ে পড়েছে নিজের ইচ্ছেয়। মেয়েটির পিছে পিছে ঘুরছে। ফিরছে। তার গা থেকে ঝরে পড়া আলো প্রাণের মধ্যে টুক টুক করে কুড়োচ্ছে। এই চোখহীন অন্ধ চোখ-কুঠুরী থেকেই আমরা দেখতে পেলাম, তাল পুকুরের মাঝখান অবধি ছোট ছোট পায়ের ছাপ চলে গেছে। জলের মাঝখানে ফুটে আছে একটি অনন্ত ফুল। শত শত তারা সে ফুলটিকে পাহারা দিচ্ছে। তার পাপড়ি সত্যি সত্যি অনেকগুলো নীল চিঠি।
এই চিঠিগুলো কে লিখেছে? অমল? প্রদ্যুম্ন? না- আমি? কখনো কি লিখতে পেরেছি এ রকম কোনো চিঠি!!
২.
..একটি হৃদয়ের জন্য আর একটি হৃদয় গঠিত হইয়া আছেই। তাহারা পরস্পরের জন্য। শত ক্রোশ ব্যবধানে, এমন কি জগৎ হইতে জগদন্তরের ব্যবধানেও তাহাদের মধ্যে একটি আকর্ষণ থাকে। তাহাদের মধ্যে দেখাশুনা হউক বা না-হউক, জানাশুনা থাকুক বা না-থাকুক, তাহাদের উভয়ের মধ্যে যেমন সম্বন্ধ, তেমন কোনো দুই পরিচিত ব্যক্তির, কোনো দুই বন্ধুর মধ্যে নাই।
(যথার্থ দোসর : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)





পুত্রশোকাতুর রবীন্দ্রনাথ রাত্রে ট্রেনে আসতে আসতে দেখলেন জ্যোৎস্নায় আকাশ ভেসে যাচ্ছে, কোথা কিছু কম পড়েছে তার লক্ষণ নেই। তাঁর মন বললে, কম পড়েনি- সমস্তের মধ্যে সবই রয়ে গেছে, আমিও তারি মধ্যে। সমস্তর জন্যে আমার কাজও বাকি রইল। যতদিন আছি সেই কাজের ধারা চলতে থাকবে। সাহস যেন থাকে, অবসাদ যেন না আসে, কোনওখানে কোনও সূত্র যেন ছিন্ন হয়ে না যায়- যা ঘটেছে তাকে যেন সহজে স্বীকার করি, যা কিছু রয়ে গেল তাকেও যেন সম্পূর্ণ সহজ মনে স্বীকার করতে ত্রুটি না ঘটে।
(-রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ : পূর্নানন্দ চট্টোপাধ্যায়)


যে কথা আগুনের- যে কথা স্নেহজলের

আমার বড়ো পিসি আগুন দেখলেই হাত জোড় করে বসে পড়তেন। বিড়বিড় করে কি সব বলতেন। চোখে মুখে ফুটে উঠত মিনতি। তারপর স্নেহসুধা।

শহরের প্রান্তেই পিসির বাড়ি। বেশ বড়ো। একটি টিনের ঘর। পাশে ছোট মন্দির। সারাদিন সারারাত মন্দিরে প্রদীপ জ্বলতো। পিসি ঘুমোতেন এই দুটো প্রদীপের খুব কাছে। বুকের কাছে। বাইরে দীর্ঘ কড়াই গাছ। হাওয়ায় পাতা ঝরে পড়লে পিসি ব্যস্ত হয়ে উঠতেন- প্রদীপ যেন নিভে না যায়। প্রদীপের শিখার মধ্যেই তার প্রাণ। প্রাণপণে এই প্রাণদুটোকে তিনি বাঁচাতে চাইতেন। হাওয়ার সঙ্গে তাঁর চলতো যুদ্ধ।

আমি যখন প্রথম স্কুলে গেলাম, আমার ঠাকুরদা একটি প্রতিমা কিনে আনলেন। বোনরা কুড়িয়ে আনল গাঁদা ফুল। মালা গেঁথে দেবীর গলায় পরিয়ে দিল। বাবা আনলেন একহাড়ি মহারাজপুরের দই। মা ভাজল খই। বড়দি চন্দন ঘষে আমাদের কপালে ফোঁটা দিল। স্নান সেরে ভোর ভোর পরেছি শাদা জামা। আজ সব কিছুই শাদা। শ্বেতবর্ণ।

পুরোহিত বসেছেন পূজায়। ঢাকী বাজাচ্ছেন ঢাক। আমরা বসেছি ঘা ঘেষাঘেষি করে। দিদি বলছে, পূজা হোক- তারপর খাবি। রান্না ঘরে লুচির গন্ধ। মা লালপেড়ে শাড়ি পরা। লুচি বেলে গরম তেলে ছাড়ছে। ঠাকুরদা তুলসীতলায় বসে আছেন। একটি বেড়াল তাঁর পায়ের কাছে চুপ করে শুয়ে আছে। ভুলু কুকুরটি লেজ তুলে উঠোনের চারিদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

বড়ো পিসি এসে গেলেন। হাতে দুখানা বই।, দুটো খাগের কলম আর দুটো সুলেখা কালির দোয়াত। হাতে ঝুলছে একটি ইলিশ মাছ। পুরোহিত মন্ত্র পড়া থামিয়ে বলে উঠলেন, এটো হয়ে যাবে পূজা খোলা। ওকে ঠেকাও। ওকে ঠেকাও।

পিসি কিন্তু পুজাখোলায় ঢুকে পড়েছেন। দোয়াত, কলম আর বইদুটো ঠাকুরের সামনে সাজিয়ে রেখেছেন। আর কলাপাতায় রেখেছেন মাছটি। আঁচল থেকে প্রদীপ দুটো বের করে জ্বালিয়ে দিলেন। বসলেন হাত জোড় করে।

বিড়বিড় করে প্রদীপের আলোর দিকে বলতে শুরু করেছেন। আমি এই প্রথম বুঝতে পারলাম পিসি বলছেন- হে অগ্নিদেব, তুমি আমার বিশু-নিশুকে নিয়েছো। ওরা তোমার আশ্রয়ে আছে। তোমার কাছে মিনতি করছি- তুমি ওদের দেখে রেখো। ওদের মানুষ করে তুলো। হে অগ্নি, তুমি সহজ, সরল, স্নিগ্ধ।

তারপর মাতৃস্নেহে পিসি বললেন, সরস্বতী স্তুতি-

যা দেবী সর্বভূতেষু বিদ্যারূপেণ সংস্থিতা।
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ।।

তারপর বললেন-

তুমি মানসের মাঝখানে আসি
দাঁড়াও মধুর মুরতি বিকাশি,
কুন্দবরণ-সুন্দর-হাসি
বীণা হাতে বীণাপাণি।
ভাসিয়া চলিবে রবি শশী তারা
সারি সারি যত মানবের ধারা
অনাদিকালে পান্থ যাহারা
তব সঙ্গীতস্রোতে।

প্রতি মন্ত্র দুইবার করে। স্পষ্ট উচ্চারণে। ফুল দিয়ে প্রণাম করলেন দুইবার। যেন পিসি দুটো শিশুর হয়ে জ্ঞানের দেবীকে অর্ঘ দিচ্ছেন। মেগে নিচ্ছেন প্রজ্ঞা এবং বিনয়।

মা ইলিশটি রান্না করল সর্ষেবাটা দিয়ে। আমাদের পাতে একটি খণ্ড এলো। আর পিসি আমাদের পাতের পাশে প্রদীপ দুটো জ্বালিয়ে দুইখণ্ড মাছ, ভাত, দই রেখে কাদের যেন খাওয়াতে লাগলেন। আমার ঠাকুরদা আড়ালে চলে গেলেন।

২.
ঠাকুরদাকে যেদিন শ্মশানে নেওয়া হল বড়ো পিসি অনেকটা পরে এলেন। হাত জোড় করে বললেন, বাবা, অগ্নিদেব তোমাকে গ্রহণ করছে। ওঁর কাছে আমার বিশু-নিশু আছে। তুমি ওদেরকে গান শেখাবে। যেন তোমার মত গাইতে পারে-

আগুনের পরশ-মণি ছোঁয়াও প্রাণে
এ জীবন পূণ্য করো দহন-দানে।

৩.
আমার মোটর সাইকেল উঠোনে থামল। চেয়ে দেখি, বাবা শুয়ে আছেন খোলা বারান্দায়। মা কোথায় জানিনা। দাদা বাবার পা ছুঁয়ে বসে আছে। আমার বোনেরা বাবাকে সাজিয়ে দিচ্ছে- চন্দনে, ফুলে, পাতায়, চোখের জলে।

সেদিন শ্মশানে আমাদের সবার আগেই বড়ো পিসি পৌঁছে গিয়েছিলেন। প্রদীপ দুটি জ্বালিয়ে মন্দিরে পূজা দিয়েছেন- শ্মশানকালীর। প্রণাম করছেন উত্তরে, দক্ষিণে, পূর্বে- পশ্চিমে। ঘুরে ঘুরে ধুপকাঠি জ্বালিয়ে দিচ্ছেন প্রতিটি সমাধি-মঠের সামনে। তারপর আমরা ভাই বোনেরা সবাই মিলে আগুন তুলে দিচ্ছি বাবার মুখে- ঘুরে ঘুরে প্রণাম করছি আর আগুন তুলে দিচ্ছি বাবার মুখে- দুরে ডেকে উঠছে রাত্রির শেয়াল। বড়ো পিসি হাত জোড় করে মিনতি করছেন আগুনকে। বলছেন- আগুনের আশ্রয়ে চলে যাওয়া বাবার দিকে- তার একমাতো ভাইয়ের দিকে- বলছেন, ভাই, আমার বিশু-নিশুকে কাজকর্ম শিখিয়ে দিস।

৪.
আমার ছোটো পিসি আমার বাবাকে খুব ভালবাসতেন। পিসির তো ঘরবাড়ি ছিল না। ছিল আশ্রম। আশ্রমের গাছপালা, তার নীচে চরে বেড়ানো ছাগল ছানাটি- দুধেল গাইটি তার সন্তান সন্তুতি। একটি পাখির জন্যও তার মাতৃস্নেহ ছিল অপার।
ছ'মাসের মধ্যেই ছোটো পিসি বাবার কাছে চলে গেলেন। একমাত্র ভাইকে একা ফেলে এখানে থাকবেন কিভাবে? ছোটো পিসি মাটির আশ্রয়ে চলে গেলেন। তার সন্তানদল তাদের ছায়ায়ই তাদের মাকে রেখে দিল। গাছ দিল ছায়া, ছাগল ছানাটি চোখের জল-আর গরুটির হাম্বা হাম্বা কান্নার শব্দ। পাখি দিল সমুখে শান্তি পারাবার। বড়ো পিসি প্রদীপ দুটি ছোটো পিসির শিয়রের কাছে রাখলেন। বললেন, বোন, তুই আমার বিশু-নিশুর ঘাম মুছে দিস।

৫.
আমাদের আরেকটি বোন যখন অসুস্থ হয়ে পড়ল, মৃত্যু তার শিয়রে বাঁশি বাজাতে শুরু করছে এই সময় আমার বড়ো পিসি আমার ফেরার পথে দাঁড়িয়েছিলেন। আমার হাত ছুঁয়ে দিলেন মাত্র একবার। প্রদীপখানি হাতে ধরা। তারপর আর পিছন ফিরে তাকাননি। চলে গেলেন দেশ ছেড়ে। সাথে নিলেন- তাঁর মন্দিরে গোপনে লুকিয়ে রাখা সেই পাট গুদামের পোড়া কাঠ কয়লা- যার সাথে মিশে আছে তার বিশু-নিশু, দোতলায় ঘুমিয়ে আছে কোমল শিশুদ্বয়- নিচে পাটের স্তুপে লেগেছে আগুন। আগুনের শিখা উঠছে দাউদাউ করে। শিশু দুটি আগুনের মধ্যে দৌড়ুচ্ছে। চিৎকার করে বলছে- মা, মা। হাওয়া প্রবল হচ্ছে। আগুন স্পর্শ্ব করছে আকাশ। আকাশ থেকে খসে পড়ছে অন্য কিছু নয়- বিশু-বিষুর হাড়; আর সেই প্রদীপ দুটো।

আর কাউকে তিনি বিশু-নিশুর কাছে এত তাড়াতাড়ি পাঠাতে রাজী নন।




গোলাপ সুন্দরী

গোলাপের জন্য অনেক মায়া। কিন্তু গোলাপ সহজে ফোটে না।
মন্দিরের পাশে তুলসীতলা। তার পাশে গাঁদা ফুল গাছ। ফুল ফোটে শীতে-বসন্তে। সেই ফুল ঠাকুরের পায়ে দিয়ে মা বলে, সবার ভাল করো।

স্কুলের পেছনেই একা একটি বাড়ি। ছোট্ট টিনের ঘর। পুরনো। নিকোনো উঠোন। উঠোনের পাশটিতে টগর, হাসনু হেনার ঝাড়। একটি কাঠালি চাঁপা। সবাই বলে চাম্পা ফুল। বর্ষায় কদম ফুটে ওঠে। আর অশোক গাছটিতে মাঝে মাঝে তক্ষক ডেকে ওঠে। তিনটি ছাতিম গাছে ফুল ফুটলে বাতাস আকুল হয়ে যায়। দাদু বলেন, ইহা ছাতিম নহে- সপ্তপর্ণী। একটি বোটায় সাতটি পাতা।

এই বাড়িটির নাম ফুলবাড়ি। এ বাড়ির গোলাপ গাছটিতে পাঁচ রঙের গোলাপ ফোটে। এ বাড়ির যে মেয়েটি ডুরে শাড়ি পড়ে, সে গাছে জল দিতে দিতে বলে, আমার বাবা যাদু জানে।

বাজারে ওর বাবার আলু-পটলের দোকান। যায় ভোরে। ফেরে সন্ধ্যায়।

এই মেয়েটি একদিন আমাকে একটি গোলাপ চারা দিল। তুলসী গাছের পাশে খুব গোপনে লাগালাম। এই গাছের জন্য কিছু যাদু দরকার। কোথায় পাব সে যাদু?
মেয়েটি বলল, ভালবাসা থেকে।

এরপর মেয়েটিকে আর কখনো দেখিনি। শুধু দেখেছি- ফুলবাড়ির উঠোনে ঘাস গজাচ্ছে।মাধুরীলতা ঘরের চাল বেয়ে নিচে নেমেছে। জানালা অবধি পারুল লতা। আর ওর বাবা সারাক্ষণ উঠোনে ছাতিম গাছের তলায় বসে থাকে। বিড়বিড় করে। একদিন লোকটি হয়ে ঊঠল রবীন্দ্রনাথ। শুধু আল্লাখাল্লা নেই। কোমরে গামছা বাঁধা। আর হাসনু হেনার তলায় দুটো সাপ থান গাড়ল। রাতারাতি বাড়িটার নাম পাল্টে গেল- জঙ্গলবাড়ি।

মাঝে মাঝে বাড়ি ফিরতে সন্ধ্যে পেরিয়ে যায়। অন্ধকারে মডেল স্কুলের পেছনের জামরুল গাছটিকে অচেনা লাগে। গা ছম ছম করে। মা বলে, ভয় পাবি না। মনে মনে বলবি- তুলসী, তুলসী, তুলসী।

একদিন ফিরতে ফিরতে বেশ রাত হয়ে গেল। বৃষ্টি নামছে টিপ টিপ করে। চুল বেয়ে জল নামছে চোখে মুখে। জামরুল গাছের পাতা নড়ছে।
ঠিক এ সময় শুনলাম কে যেন ডাকছে, গোলাপ! গোলাপ!

মাত্র দুই কি তিনবার। কেঁপে কেঁপে। থেমে থেমে। স্নেহ ভরে। ভয়ে ভয়ে।

একবার জোরে বজ্রপাত হল। বিদ্যুৎ চমকাল। একটি ছায়ামুর্তি দ্রুত সরে গেল বৃষ্টি আর অন্ধকারের গভীরে। আঁতকে বলে উঠলাম, মা, মা। মা মনের ভিতর মা বলে দিল, তুলসী। তুলসী। তুলসী।

একদিন গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেল। বাবার সঙ্গে কে একজন লোক কাঁপা কাঁপা গলায় কথা বলছেন। বলছেন, এখন কী করি, শঙ্কর। এখন কী করি।
মনে হল এ গলা একজন বিপন্ন বাবার। একজন ভেঙে পড়া মানুষের। বৃষ্টির মত ভেজা স্বর। অথবা এই এই স্বরে পৃথিবীতে শেষ বৃষ্টিপাত হয়ে যাচ্ছে। তারই শব্দ মর্মরিত হয়ে হাহাকার করে উঠছে।

এর পরদিন মডেল স্কুলের পুকুর পাড়ে অনেক মানুষের ভিড় জমে গেল। কৃষ্ণচূড়া গাছগুলো নতুন ফুলে সেজেছে। বাতাসে নড়ছে চিরল চিরল পাতা। জলে পড়েছে সবুজ ছায়া। সে ছায়ার মধ্যে একজন মানুষ ঝুলে আছে। শুন্যে দুটি পা। মাথা নিচু। এবং পরাজিত।

আর পুকুর পাড় থেকে একটু দূরে সেই ফুলবাড়িটা অথবা জঙ্গলবাড়িতে দুদল মানুষ হৈ চৈ করছে। একদল ঘরের ভিতরে ঢুকে পড়েছে। সোনা দানা খুঁজছে। বলছে, এটা আমাদের বংশের ছেলে সোলেমানের বউয়ের বাড়ি।

আরেকদর মানুষ গোলাপ গাছটার গোড়ায় দিয়েছে কুড়ালের কোঁপ। এইখানে মন্দির গড়বে। এটা তাদের বংশের লোকের বাড়ি। কে যেন গঙ্গাজল ছিটিয়ে পবিত্র করছে বাড়িটার ভূমি।

এই জঙ্গলবাড়িটা একদা ছিল ফুলবাড়ি। হাসনুহেনা ফুটলে গন্ধে আকুল হত বাতাস। চাম্পা ফুল ফুটলে পরী নেমে পড়ত।

বেলা গড়িয়ে গেলেও কৃষ্ণচূড়া গাছগুলো তেমনি দাঁড়িয়ে রইল। লোকগুলো নেই। পুকুরের ছায়ার ভিতরে শূন্য মানুষটি কেবল পশ্চিম থেকে পূবমুখী হয়েছে। এই জল ছায়াটি মুছে ফেলার কেউ নেই। যারা এসেছিল, তারা একটি মানুষের ভিতরের গোপন মানুষটিকে দেখে ফিরে গেছে নিজস্ব ঘরে।
সেদিন সন্ধ্যার গভীরে আবার বৃষ্টি নেমেছে। বাতাস হালকা- শীতল। জামরুল গাছের নিচে এসে বললাম, গোলাপ! গোলাপ!
ঠিক সামনেই একটি পোড়ো বাড়ি। জঙ্গলে ঢেকে আছে। বিদ্যুৎ চমকানোর মধ্যে দিয়ে একটি ছায়া এসে দাঁড়াল। ফ্যাকাসে মুখ। শরীরটা খুব শীর্ণ। শিউরে শিউরে উঠছে। বলল, বাবা, ভাত এনেছ? তিন দিন আসোনি। আমার খাওয়া হয়নি।

এই গলাটি কাঁপা কাঁপা। রিনরিনে। গোলাপের পাপড়ির মত মৃদু। যাদুকরি। এবং
মৃতপ্রায়।





ছাতিম পাতা

নদীটা সাদা। এবং কালো। মাঝখানে ফুলে ফুলে উঠেছে। বাবা বলল, মধুমতির জলে তালতলার খাল আইসা পড়ছে।

এরপর ধানক্ষেত। কাটা হয়ে গেছে। নাড়া পড়ে আছে। ফাঁকে ফাঁকে কলমির ফুল। শালুক। তিরতির করছে ছোট জল।
বাবা বলল- ঐ দ্যাখ।

একটি মেঠো ইঁদুর আকাশের দিকে তাকাল। চিঁ চিঁ করে ডাকতে ডাকতে সামনে এগিয়ে গেল। মোটা সোটা। একটি বিড়ালের মত। বাবা হাততালি দিল। বললেন, যাহ্। ইঁদুরটি থেমে গেল। ফিরে তাকাল।

রাস্তার মাঝামাঝি ভাঙা। সেখানে বাঁশের জালি বসানো। বিল থেকে জল খালের দিকে সড় সড় করে নেমে যাচ্ছে। জালির ওপাশে নৌকা। আর পুঁটিঁ, শোল, পাবদা, রয়না মাছ ভেসে আসছে জলের সঙ্গে। জালির ওপাশে খালের মধ্যে একটি নৌকা। জালিতে বাঁধা পেয়ে লাফিয়ে উঠছে মাছগুলো। পড়ছে নৌকার মধ্যে। এর পাশে একটি কুঁচে বক একপায়ে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে দেখছে। খুব চুপচাপ। বাবা এই ভাঙনটুকু কোলে তুলে পার করে দিল।

গ্রামের শুরুতেই একটি বটগাছ। নিচে একটি গরু চরছে। আর একজন খুব বুড়ো লোক গুড়ুক গুরুক করে তামাক টানছে। দুচোখ বন্ধ। চোখ বন্ধ রেখেই বুড়ো বলে উঠলেন, টাউন থিকা আসা হৈতাছে। টাউন থিকা আসা হৈতাছে?
বাবা দাঁড়াল। বলল, হ।
বুড়ো খুক খুক করে কাশতে শুরু করলেন। আর বলতে লাগলেন, টাউন থিকা আসা হৈতাছে। কাশি চলছে। আর তামাক টানারও বিরাম নেই। বারবার বলছেন, টাউন থিকা আসা হৈতাছে। গলার শিরা ফুলে উঠেছে। গরুটা গলা তুলে একবার ডাক দিল, হাম্বা। একটি নেলি বাছুর ছুটে এসে বাটে মুখ দিল।

খোকা বলল, বাবা। বাবা।
বাবা খোকাকে নিয়ে হাঁটা শুরু করল।
বুড়ো তামাক খেতে খেতে বললেন, যাওয়া অবি কোতায়?
-নারিকেলবাড়ি।
-নারিকেলবাড়ি। নারিকেলবাড়ি। কাশতে কাশতে বারবার বলছেন। আর তামাক খাচ্ছেন। ওরা একটু এগিয়ে গেছে। মাথা উঁচু করে বললেন, অ, নারিকেলবাড়ি। মাস্টার বাবুর বাড়ি। মাস্টারবাবুর বাড়ি।
তারপর কি মনে করে বললেন, একটু তফাতেই কালি খোলা। খুউব জাগ্রত দেবি। পেরনাম কৈরা যাইয়েন। বড়ো জাগ্রত দেবি।
বুড়োর চোখ বন্ধ। গরুটা ঘাস খাচ্ছে।

রোদ ওঠেছে। ফুল ফুটেছে। ফুলের ভেতর দিয়ে একজন মহিলা ছুটে এলেন। খোকার হাত ধরে বললেন, আহা, কচি পোলা। ইকটু জিরাইয়া যান।
খোকাকে নিয়ে বাড়ির ভেতরে এল। বারান্দায় জলচৌকিতে বসালেন। আঁচল দিয়ে ঘাম মুছিয়ে বললেন, মুখডা শুকায়ে গেইছে। খিদা লাগছে, বাজান?

একজন মাঝবয়েসী লোক বকুলতলায় নামাজ পড়ছিলেন। বাবার জন্য শীতল পাটি পেতে দিলেন। সুতার নকশী করা। একটি গোলাপ ফুল। নিচে লেখা : মনে রেখ- ভুল না আমায়। দুপাশে দুটো ময়ূর। পেখম তুলেছে।

বললেন, বসেন, বসেন। যাইবেন কুথায় এই রৈদে। ত্যাজ কুমলে যাইয়েন।
বিবিজান ততক্ষণে সানকিতে করে গুড় আর মুড়ি নিয়ে এসেছেন। আর দুটো মিঠে কলা। বললেন, খাও বাজান। হুড়ুম খাও।

তিনি হাতপাখা দিয়ে বাতাস করছেন। দুটো ছেলে মেয়ে এসে তার কোল ঘেষে দাঁড়িয়েছে। একজন আঁচলে মুখ পুরে চুষছে। চেয়ে চেয়ে খোকাকে দেখছে । মুখে গুড়-মুড়িতে মাখামাখি। একটি মাছি ঠোঁটের কাছে ভন ভন করছে। ফিক করে হেসে দিয়েছে মেয়েটি। তার ফ্রকে কাদামাটি।

দুটো কচি ডাব কেটে দিলেন ইরফান মাঝি। বাবা যতœ করে খেলেন। শাঁসটুকু খেলেন আরও তৃপ্তি করে। প্রাণ ঠাণ্ডা হয়ে এসেছে। ইরফান মাঝি বললেন, যাইবেন কুথায়?
-নারিকেলবাড়ি।
- অ, মাস্টারবাবুর বাড়ি? কি লাগে?
- শ্বশুর।
- অ, তাইলে দেরি কৈরেন না। যান। তিনি আমার বিয়া দিছিলেন।

ইরফান মাঝি তাঁকে উদ্দেশ্য করে একটি সালাম দিলেন। আর তার বিবি দিলেন এক শিশি আবে জমজমের পানি। খোকার মাথা আঁচড়ে দিলেন লাল কাঁকুই দিয়ে। হাত ধরে এগিয়ে দিলেন বাড়ি থেকে রাস্তা অবধি। বললেন, ফি আমানুল্লাহ।

কিছু পথে জল-কাদা। বাবার কাঁধে চড়ে খোকা পার হল। শোলার খেতে কয়েকটি শালিক বসে আছে। শির শির করে দুলছে ক্ষুদে ক্ষুদে কচি পাতা। গায়ে একটুকু ছোঁয়া লাগে।

উঠোনে একটি কুকুর ঘাড় গুজে শুয়ে আছে। তারপাশে একজোড়া খড়ম। এক বালতি জল। তিনটি তালগাছের ছায়া টিনের চালের এসে পড়েছে। জং ধরা টিনের উপর পাটখড়ি ছড়ান। একটি লাউগাছ বেয়ে উঠেছে। পাতা সবুজ। সজীব।

ঘরের বেড়াগুলো নল খাগড়ার। পূব দিকের বেড়া খুলে রাখা। সেখানে একটি টিয়া পাখি খাঁচা। বলে উঠল, অতীত আইছে। বসতি দেও।

লোকজন সরে গেল। মাটির উপরে হোগলার পাটি পাতা। সেখানে কে একজন শুয়ে আছেন। মাথার কাছে প্রদীপ। জ্বলছে মিটমিট করে। সাদা চুল- সাদা ভ্রু। সাদা দাড়ি। চোখ বন্ধ। অস্ফুট গলায় কি যেন বললেন। তার কানের কাছে দিদিমা মুখ নিয়ে বললেন, আপনের সেজো জামাই আইছে। আর নাতি। বীণার ছেলে।

দূর থেকে ভেসে এল হা হা হাসি। মেজো মামা হাসছেন। পেয়ারাগাছের নিচে। হাসতে হাসতে হু হু করে কাঁদছেন।

বাবা ঝুঁকে পায়ের কাছে নত হল। প্রণাম করল। খোকাকে এগিয়ে দিল।
তাঁর ভ্রু নড়ে উঠল। ঠোঁট কেঁপে উঠেছে। অস্ফুট স্বরে কিছু বললেন। দিদিমা মাথার কাছে রাখা একটি পুরনো বইয়ের পাতা উল্টালেন। ভেতর থেকে কি একটা বের করে খোকার হাতে দিলেন। একটি পুরনো পাতা। বিবর্ণ। ছাতিম পাতা। শিরা বেরিয়ে পড়েছে। পাতার উপরে কালো অক্ষরে আবছা করে লেখা-

তিনি আমার-
চোখের আরাম,
মনের আনন্দ,
আত্মার শান্তি।

টিয়া পাখিটা বলে উঠল, অতীত আইছে। বসতি দেও।

খোকার গরীব দাদুর আর কিছুই ছিল না। এই একটি মাত্র সম্বল- ছাতিম পাতা। পঞ্চাশ বছর আগে এনেছিলেন ভুবনডাঙ্গা থেকে। কুড়িয়েই এনেছিলেন। বাঁকা অক্ষরে নাম লিখে দিয়েছিলেন কবি ঠাকুর- রবি ঠাকুর।

তিনি একবারই মাত্র চোখ খুললেন। অদ্ভুত সবুজ দুটি চোখ। নবীন পাতার মত। প্রদীপের মত। জ্বলজ্বলে।
আর প্রশান্তির অশ্রুবিন্দু।
কারা গেয়ে উঠল-


সমুখে শান্তি পারাবার-
ভাসাও তরণী হে কর্ণধার।
তুমি হবে চিরসাথি, লও লও হে ক্রোড় পাতি-
অসীমের পথে জ্বলিবে জ্যোতি ধ্রুবতারকার।।
মুক্তিদাতা, তোমার ক্ষমা তোমার দয়া
হবে চিরপাথেয় চিরযাত্রার।
হয় যেন মর্ত্যরে বন্ধনক্ষয়, বিরাট বিশ্ব বাহু মেলি লয়-
পায় অন্তরে নির্ভয় পরিচয় মহা-অজানার।।



মেঘ মল্লারের কথা : একজন পাথর মানুষের কথা

আমরা ছিলাম গরীব। যে বাড়িটিতে জন্মেছিলাম, যখন বুঝতে শিখেছি- তখন জেনেছি- বাড়িটি আমাদের নয়। আমরা দয়ায় আছি। আমার ঠাকুরদা আমার নামটি রেখেছিলেন বড়ো করে। কুলদানন্দ রায়। নাম রাখতে তো পয়সা লাগে না। বিনি পয়সায়ই যখন নাম রাখা যায় তখন কেন ছোট করে রাখবেন। রাখলেন বড়ো করে আমার নাম- এমন নাম, কোথাও তুমি পাবে নাকো খুজেঁ। দাদাগিরি না করলেও সবাই আমাকে দাদা বলে ডাকে। এমনই নামের মাহাত্ম্য।

গরীব হওয়ার কারণে আমি আসলে গরীবদেরই ভালবাসি। ধনীদের এড়িয়ে চলি। আমার জ্ঞাতিদের সঙ্গেও আমার সাক্ষাৎ ইতিহাসের গবেষণার বিষয়। আমার এতো সময় কোথায়! আমি রুটি রুজির সংগ্রামের ফাকেঁ ফাকেঁ যখন যেটুকু সুযোগ পেয়েছি, আমি পড়ালেখা করেছি। কাউকে বলিনি। কাউকে ধরিনি। আমার রোগা পটকা চেহারা দেখে অনেকেই টেনে তুলেছেন নিজ থেকে এসে। এক শিক্ষক বাড়ি থেকে ডেকে এনে আমাকে চাকরি দিয়েছিলেন। তার জন্যই আমি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রী নিতে পেরেছিলাম। আমারতো এই রকম হওয়ার কোনো সামর্থ্যই ছিল না। গরীব মানুষের গরীব থাকাই ভাল। আমার প্রিয় মানুষ প্রয়াত শওকত চৌধুরী তো তাঁর সারাটি জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন গরীব মানুষদের জন্য। আমি তাই কখনো ধনী হতে চাইনি।

ছেলেবেলায় দুজন পাগল ছিল আমার বন্ধু। একজন অমূল্য পাগল। আরেকজন রমজান ছ্যাকা। অমূল্য পাগলের বাড়ি কোটালিপাড়ায়। বর্ষাকালে পাগল হয়ে যেতেন। আসতেন আমাদের শহরে। পাগলামি করে চেয়ে চিন্তে চলত তার দিন। রবীন্দ্রনাথের মতো দাড়ি। গৌরকান্তি। পোলাপান তাকে তাড়িয়ে বেড়াত। ঢিল ছুড়ত। আর অমূল্য পাগল তাদের দিকে লাঠি নিয়ে তেড়ে যেতেন। আমিও তাড়া খেয়েছি। দিনের বেলা আমাকে কখনো চিনতেন না। রাতের বেলায় আমার জানালার পাশে এসে দাঁড়াতেন। সারাদিনে পাওয়া টাকা পয়সা জমা দিতেন। আর প্রায়ই আমাকে ডিমটা, কলাটা, পেঁপেটা, পেয়ারাটা দিতেন। এগুলো তার ভিক্ষে করা খাবার দাবার। বলতেন, বেটা- শক্ত হয়ে দাঁড়া। আমি যেবার প্রথম পাবনা গেলাম, এই অমূল্য পাগল আমাকে সত্তরটি টাকা জোর করে গুজে দিলেন। বললেন, বেটা তোর ইচ্ছে পুরণ কর। সেই প্রথম একসাথে এতগুলো টাকা আমার নিজের হল। পাবনা শহরের একটি দোকান থেকে একটি হারমোনিকা কিনলাম। ফু দিয়ে দেখি, বাজে না। বললাম, পাল্টে দিন। দোকানি বললেন, এটা বাজানোর জন্য বিশেষ কায়দা দরকার। শিখে নিও। সেই হারমোনিকা কোনোদিনই বাজে নি। নষ্ট বাশিঁ কি বাজে? সেই ইচ্ছে পুরণের অমূল্য পাগলই আমার জ্ঞাতি। আর কে হবে আমার জ্ঞাতি?
আমার স্বজন কি কেউ বলেছে, ভাই- আমার ছায়ার পাশে এসে দাড়া।

আর রমজান ছ্যাকা ছোটখাটো মানুষটি। লেখাপড়া জানা মানুষ। একদম মৌনী বাবা। কারো কাছে হাত পাততে দেখিনি। অনেক মুদির খাতা পত্র লিখে দিতেন। কেউ কিছু দিলে খেতেন। না হলে- অভুক্ত। শোনা যায় ছ্যাকা খেয়েই তার এই দশা। এজন্য তার নাম রমজান ছ্যাকা। এই রমজান ছ্যাকার কাছে আমি বটতলায় বসে অংক শিখেছি। শিখেছি- স্কুলের পড়া। একদিন তিনি শোনালেন, আমরা দুজন একটি গায়েঁ থাকি/ সেই আমাদের একটি মাত্র সুখ/ তাদের গাছে গায় যে দোয়েল পাখি/ তাহার গানে আমার নাচে বুক।এই রমজান পাগলই সেদিন আমাকে একটি গাঁয়ে পৌঁছে দিলেন। আমি আর সেখান থেকে নড়ি না চড়ি না। কাউকে দেখলেই মনে হয়, তাহার দুটি পালন করা ভেড়া / চরে বেড়ায় মোদের বটমূলে/ যদি ভাঙে আমার ক্ষেতের বেড়া/ কোলের পরে নিই তাহারে তুলে। রমজান ছ্যাকাই আমার আত্মীয়।
সেই থেকেই আমি এই এক গায়েঁর লোক। এই এক গায়েঁর জন্যই আমার ভালবাসা আছে। কিছু দায়িত্ব আছে।

এই ভালবাসার সুরটি বেঁধে দিয়েছেন ড: আ ব ম নূরুল আনোয়ার। আমার শিক্ষক। সকলের নূরু ভাই। তাঁর দুটি কাজ- ক্রিকেট শেখানো আর গান ছড়ানো। জ্যোৎস্না রাতে তিনি আসতেন ময়মনসিংহ শহর থেকে। তার রিকশার টুং টাং শুনতাম। শুনতাম, তিনি আমার নাম ধরে কালোয়াতি সুরে ডাকছেন, খু-কন। তিনি নিয়ে যেতেন ব্রহ্মপুত্রে। নৌকায়। মাঝি- ঈশ্বর। শোনাতেন রবীন্দ্রনাথের গান। আমার যে দিন ভেসে গেছে চোখের জলে। একটি কুরচি গাছের গোড়ায় নৌকাটি বেঁধে ফেলত ঈশ্বর। গাইতেন- তারি ছায়া পড়েছে শ্রাবণগগনতলে।। আমাকে তিনি দিয়েছিলেন বেগম আখতারকে। বেগম আখতার রাত্রি ভেদ করে কিন্নর কণ্ঠে গেয়ে উঠেছেন- জোছনা করেছে আড়ি/ আসে না আমার বাড়ি/ গলি দিয়ে চলে যায়/ লুটিয়ে রুপালী শাড়ি। আমি সেই আড়ি দেওয়া অভিমানী জ্যোৎস্নার পিছনে দৌড়েছি। তার লুটিয়ে পড়া শাড়িটিকে তুলে দিতে চেয়েছি তার হাতে। শাড়িটির আঁচল থেকে ধুলো ঝেড়ে দিতে চেয়েছি।

আর এই অভিমানী চলে যাওয়া রূপকে দেখেছি- টিএসসির পিছনে বসে রয়েছেন। পাথরের চেয়ারে। আমি দুরে। একজন কবি তাকে শোনাচ্ছেন কবিতা, ছাট কাগজের মলাট। জলমগ্ন পাঠশালা। ফিরে এসো চাকা। কবির কণ্ঠ থেকে যে হিরক শব্দ শুনছি তা কেবল শব্দ নয়। মেঘ মল্লারের তান। এই তান যখন বাঁশিতে বেজে ওঠে- তখন সরস্বতী বন পেরিয়ে আসেন। মগ্ন হয়ে শোনেন মেঘ মল্লার। আর মনে হয়, আকাশটা যেন আয়না। সেখানে ফুটে উঠেছে কত রুপের জগৎ। কবি বলছেন, শোনো। ওটা আয়না নয়। আয়না হবে কেনো। ওটা মুকুর। মুকুরে প্রতিফলিত সূর্যালোক স্বল্পকাল হাসে। সেই থেকে জেনেছি -আয়নায় নিজেকে দেখা যায়। আর মুকুরে দেখা যায় লাবণ্যকে। এই কবি কাজল শাওনেওয়াজই আমার আত্মীয়।
আমার আত্মীয় সেই রূপকথার বুড়ো। সকাল হলেই সূর্য দেখতে ছোটেন। আর সন্ধ্যায় পাখিরা ফিরেছে কিনা সে খবর নেন। তিনি হাঁটেন ঘাসের উপর দিয়ে। তার পায়ে পায়ে লাফিয়ে ওঠে রোদ আর শিশির। ফুলের ভিতরে দেখেন কতটা মৌমাছি এলে বীজের উদ্গম হবে। তিনি বললে, জ্যোৎস্না ওঠে। জলের উপরে ঈশ্বর ঘুমিয়ে পড়েন। এ-ই তিনি। তিনিই আমি। আমার পালক নাইব উদ্দিন আহমদ।
কী দরকার আমার অন্য জ্ঞাতি-গুষ্ঠির।

এইভাবে চিনেছি, আমার ভাবনাটিকে। আমার আত্মীয়কে। এরা সবাই আমার গ্রামের লোক। কোনো বান এলে সবাইকে ডেকে তুলতে হবে। গ্রামটিকে বাঁচাতে হবে। গ্রামের সবুজটি ধরে রাখতে হবে। বলতে হবে, দুয়ার এটে ঘুমিয়ে আছে পাড়া/ কেবলি শুনি রাতের কড়া নাড়া/ অবনী, বাড়ি আছো?

আমার ভুবনে যা পাই, সবাই ভাগ করে খাই। একটি ফুল পেলে, সবাইকে ডেকে বলি- এই দ্যাখো ফুল। গানটি পেলে বলি, এসো এক সাথে শুনি। কিছু পেলে, একসাথে পড়ি। সব সুন্দর একা একা কেনো দেখব? সুন্দরকে সবাই মিলে দেখব। সত্য-সুন্দরকে সবাই মিলে চোখের মণির মতো বাচিয়েঁ রাখব।

এজন্য আমার নিজের কিছু নেই। আমার সবই- সবার সবকিছু। আবার সবার সব কিছু আমারও কিছু বটে। এজন্য যার যেখানে যা পাই- ভাল লাগলে নিয়ে আসি, সবাইকে দিয়ে দেই। আমার কাছে কেউ চাইলে আমি কখনো ফেরাই না । বলি- নাও, এ তোমার জিনিস। একেই কি অবাধ তথ্য প্রবাহ বলে? কি জানি।

আমি সময় পেলে কথা বলি। মন খুলে কথা বলি। সত্যের কথা বলি। আমার গরীব হওয়ার কথা বলি। আমার চোখের জলটির কথা বলি। আমার স্বপ্নের কথা বলি। কোনো লুকো ছাপা নেই। এখন এই আমার কথা যদি কেউ তার কথার ভেতরে সাজায়, তাতে আমার কী আসে যায়? সেতো তারই কথা। সেতো সবারই কথা। সেই এক গাঁয়েরই কথা। বলুক না যে কেউ। এতো প্রাণের মধ্যেই প্রাণে মিশে যাওয়া। সর্বপ্রাণের আলো-হাওয়া।

যে ধম্মা হেতুপ্পভবা
তেসং হেতুং তথাগতো আহ
তেসঞ্চ যে নিরোধা
এবং বাদী মহাসমনো।।

এটা কী সবার কথা নয়? সত্যের কথা নয়? সবাইকে ভালবাসার কথা নয়।

আসুন পড়ি একসাথে -
...এক এক রাত্রে সে বড় অদ্ভুত স্বপ্ন দেখত। কোথাকার যেন এক পাহাড়ের ঘন বেতের জঙ্গল আর বাঁশ বনের মধ্যে লুকানো এক উর্দ্ধভগ্ন পাষাণমূর্তি। নিঝুম রাতে সে পাহাড়ে বেতগাছ হাওয়ার দুলছে, বাঁশবনে শিরশির শব্দ হচ্ছে, দীর্ঘ দীর্ঘ বেতডাঁটার ছায়ায় পাষাণমূর্তিটার মুখ ঢাকা পড়ে গেছে। সে অন্ধকার অর্ধ রাত্রে জনহীন পাহাড়টার বাঁশগুলোর মধ্যে ঝোড়ো হাওয়া ঢুকে কেবলি বাজছে মেঘ মল্লার!
ভোরে উঠে রাতের স্বপ্ন দেখে আশ্চর্য হয়ে যেত কোথায় পাহাড়, কোথায় বেতবন, কার ভাঙা মূর্তি, কিসের অর্থহীন দুঃস্বপ্ন!...
(-মেঘমল্লার/ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়)




গোফাগুন

মাকে বলব না। কাউকে বলব না। বলা যাবে না।

সকাল থেকেই রোদ উঠেছে। ফুল ফুটেছে। হাতি নাচছে। ঘোড়া নাচছে। আজ অন্য কিছু হবে। ভিন্নতর কিছু হবে।
যে লোকটিকে চিনি তাকে তো চিনিই না। দাদা বলল, চল না, চল না যাই।
দাদা বলছে যাবে। দাদা কিন্তু যাবে না। অথচ যেতে চায়। অধীর হয়ে বলছে, চল না যাই।

লোকটার একদম কাছেই চলে গেলাম। কাঠগোলার ভিতের বসে আছে হাতল ভাঙা চেয়ারে। মাথাটা একটু হেলানো। নাক দিয়ে ফোঁস ফোঁস করে শব্দ হচ্ছে। ভেবেছিলাম ভয় পাব। পাওয়ারই তো কথা। কিন্তু পেলাম না। দূর থেকে দাদা হাত ইশারা করে বলছে, চলে আয়। ওর কাছে যাসনি। চলে আয়।
ভেবেছিলাম চলে যাব। ফিরে যাব। দাদার হাত ধরে ফিরে যাব। অথচ লোকটার সামনে গিয়ে হাট করে দাঁড়ালাম। হাসি হাসি মুখ।
লোকটা চোখ বন্ধ রেখেই বলল, পেছনে যা। পেছনে চেয়ারে মাথাটা হেলানো। মাঝখানে পাতলা হয়েছে চুল। বলল, চুলকে দে।
চুলকে দিতে দিতে আঙুলের মাথায় উঠে এল খুশকী। আর বেতো তেলের গন্ধ। বলল, অইখানে যা।
-কোথায়?
-অইখানে। চোখ বন্ধই আছে। হাত তুলে দেখাল। স্তরে স্তরে কাঠ সাজানো। তার উপরে একটি কুলুঙ্গি। সেখানে একটি ময়ুরের পালক।

মনে করেছিলাম পারব না। কিন্তু না পেরেতো উপায় নেই। পারতেই হবে। দূর থেকে দাদা হাত নেড়ে নেড়ে বলছে, উঠিস না। উঠিস না। না উঠে পারি? ময়ুরের পালকটা তুলে দাদাকে দেখালাম। নীল আর কালো। মাঝখানে কৃষ্ণের চিহ্ন। দাদা ভয়ে আতংকে হাত জোরে জোরে নাড়িয়ে বলছে, খুব সাবধান। খুব সাবধানে নেমে আয়।
হা হা হা। কত সাবধান আর হওয়া যায়। পাটা হড়কে গেল। পায়ের নীচ থেকে কয়েকটি কাঠ সরে গেছে। হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল কাঠের স্তুপ। কাঠের সঙ্গে আমি নিজেও। দাদা দৌঁড়ে আসতে চেয়েছে। লোকটা হাত তুলে বলেছে, না। ঠিক চোখ বন্ধ করেই আছে। হাটু ছড়ে গেছে। এক টুকরো কাঠের চেরা হাতের মাংসে ঢুকে গেছে। মাথার পিছনটা ফুলে উঠেছে।
হাত থেকে পালকটা নিয়ে নাকে সুড়সুড়ি নিতে লাগল লোকটা। সুড়সুড়ি লাগছে। পুলকে একটু হেসেও উঠছে। চোখ কিন্তু বন্ধ। হাত তুলে এলোমেলো কাঠগুলো দেখাল।

আমরা দুভাই মিলে কাঠগুলো সাজাচ্ছি। হাতে পায়ে মাথায় ব্যথা করছে। তবু বলছি, সত্যি দাদা। আমার ব্যথা লাগেনি। সত্যি লাগেনি। মা ঘাস বেটে লাগিয়ে দিলেই হবে। দাদার চোখ জ্বলছে। সত্যি সত্যি ব্যথা লাগতে পারে না।

কাঠ গোলার পিছনে একটি পুকুর। পাড়ে গোটা কয়েক তালগাছ। তাল পেকেছে। অমৌসুমী তাল। জলে পড়ার শব্দ হলে দাদা বলে, আবার পড়েছে। শুনতে পেলি। ছোট বোনটি বলে- কী পড়েছে রে দাদা?
মা বলে, ঘুমো। ঘুমোতো তোরা। সকালে অনেক কাজ।
আমরা ঘুমিয়ে পড়ি। ঘুমিয়ে পড়া ছাড়া আর কি কাজ আছে আমাদের। ঘুমের ভিতরে স্বপ্ন দেখি, পুকুর ভরা তাল ভাসছে। আমি আর দাদা সব চেয়ে পাকা মিষ্টি আর বড় তালদুটো তুলে আনছি। মা ভাজছে তালের পিঠে।

লোকটি হাত তুলে পুকুরটি দেখাল।
পুকুরে জল টলটল করছে। খাড়া পাড়। অনেক গভীর। তাল ভাসছে। দাদা বলল, যাসনি। তুই যাসনি।
আমি যাব। না যেয়ে পারি? যেতেই তো এখানে এসেছি।
কাঠগুলো সাজিয়ে রাখছে দাদা। আর মাথা নাড়ছে। আমি নেমে যাচ্ছি খাড়া পাড় বেয়ে। পাড় থেকে জলে। জলের গভীরে। তালগুলো ভেসে আছে। মিষ্টি। পাকা। আর বড়। মা পিঠে বানাবে।

জল লেগে পা জ্বলছে। হাত জ্বলছে। সাঁতরে সাঁতরে তালগুলো পাড়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছি। লোকটি চোখ বুজে আছে। আর হাত দিয়ে দেখিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে- অইটে। আরও অইটে।
বুক ভারী হয়ে যাচ্ছে। ঘন ঘন পড়ছে শ্বাস। পায়ের সঙ্গে জড়িয়ে পেঁচিয়ে গেছে পদ্মফুলের ডাঁটা। ছাড়াতে পারছি না। ডুবে যাচ্ছি নিচের দিকে। তলিয়ে যাচ্ছি অন্ধকারের মধ্যে। হারিয়ে যাচ্ছি মহাশূন্যের ভিতরে।

*****************************************************
ছোট বোনটি দৌড়ে এল। তালদুটো লুফে নেওয়ার কথা। একটুও তাকালও না। ভয়ে টলটলে মুখটি শুকিয়ে গেছে। বলল, দাদা, মাকে খুঁজে পাচ্ছি না। মা কোথায়?
দাদার প্যান্ট থেকে তখনো টপটপ করে জল পড়ছে। চুল ভিজে। বলল, কেন কি হয়েছে মায়ের?
-মাতো ছিলই সকাল থেকে। এখন খুঁজে পাচ্ছি না। দাদা, কি হবে?

বড় ঠাকুরমার রান্নাঘরে তখন পায়েস রান্না হচ্ছে। কাঁচা মুছি পাটালির গন্ধ। গরু দুটোকে সুন্দর করে স্নান করানো হয়ছে। গলায় ঝোলানো হয়েছে শেফালি ফুলের মালা। বড় ঠাকুরমার গলায় সোনার বিছে হার। কপালের অনেক চুল সাদা হয়ে এসেছে।
গরুটার কপালে তেল সিঁদুর পরানো হল। বাছুরটা লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে। আজ বড় আনন্দের দিন।
রান্না ঘর থেকে লাল পেড়ে শাড়ি পরে কে একজন বৌমানুষ পায়েসের হাড়িটা ধরে নিয়ে এল। গোবর লেপা গোয়াল ঘরে কলা পাতা বিছানো হয়েছে। কলাপাতায় পায়েস ঢেলে দিল। ঠাকুরমা উলুধ্বনি দিল।
জ্বেলে দিল দুইটি প্রদীপ। সুগন্ধী ধুপ। বেজে উঠল শাঁখ।
দাদা বলল, পায়েস। পায়েস রে।
ছোট বোনটি খিন খিন করে বলছে, মা কোথায়, দাদা?

বড় ঠাকুরমা মাটিতে পড়ে প্রণাম করছে। বিড় বিড় করে বলছে, হে গোমাতা, তুমি কল্পতরু। কামধেনু। জগন্মাতা। আজ এই ফাগুনের দিনে তোমাকে উৎসর্গ করছি শ্রেষ্ঠ অন্ন। তুমি গ্রহণ করো মা। আমাদের ধন্য করো হে জননী।

আমরা খুঁজে বেড়াচ্ছি সারা উঠোন ভরে আমাদের মাকে। খুঁজছি ঘরে। বাইরে। বাগানে। ঘাটে। পথে। সবখানে। বাছুরটি পায়েসে মুখ দিয়েই লাফিয়ে উঠল। দৌড়ে গেল উঠোনের এক কোণে। ওখানে একটি মরিচবাটি ফুলগাছ । তার কচি পাতা মুখে পুরে দিল।
আর মা গরুটি পায়েস নয়- কলাপাতিটি মহা আনন্দে খেতে খেতে ডাক দিল- হাম্বা।

বড় ঠাকুরমা কলাপাতাসমেত পায়েসটুকু নিয়ে বাছুরটির পিছনে পিছনে ছুটছে। মুখের সামনে ধরছে। বলছে, খাও দেবতা। বিমুখ করো না। খেয়ে নাও। বাছুরটি লাফিয়ে লাফিয়ে দৌঁড়ে দৌঁড়ে ছুটে ছুটে উঠোনময় ঘুরে বেড়াচ্ছে। একপাশে জেগে উঠেছে একটি সফেদা গাছ। তার ডালটির পাতা চিবুতে লাগল। তার কানে মুখে চোখের পাতায় লেগেছে নতুন ধানের নতুন গুড়ের সুপক্ক পায়েস। এই অতি সুস্বাদু পায়েস বড় ঠাকুরমা ওর গায়ে পিঠে মাখিয়ে দিল । সবাই হৈ হৈ করে উঠেছে। বলছে, জয়- গোফাগুনের জয়।
বৌ মানুষটি গরুটির প্রসাদ করে দেওয়া পায়েস কলাপাতা থেকে অনেক যতেœ তুলে নিয়েছে একটি থালায়। গভীর মায়ায় দাঁড়াল উঠোনের মাঝখানে। এইখানে জড়ো হয়েছে কয়েকটি শিশু, বালক বালিকা এবং কিশোর ও কিশোরী। সবাই হাত পেতে নিল। ছোট বোনটির হাতের আঙুলের ফাঁক দিয়ে অনেকটাই পড়ে গেছে মাটিতে। কান্না কান্না গলায় শুধু বলে উঠল, মা।

তার মাথার আঁচল খুলে গেল। যতœ করে আচড়ানো চুল। সিঁথিতে সিঁদুর। বড় বড় করে তাকাল আমাদের দিকে। গভীর চোখ। জ্যোৎস্নার চেয়ে সুন্দর। স্নেহময়। সজল। সঘন।

এই আমাদের মা।



কবিতা অথবা রহস্য খোলার রেঞ্চ

১.
ঘোড়ার রোগ ব্যাধির তালিকা মুখস্থ করছে মুন। কোলে উপরে ক্লাশ নোট। মাথা নিচু। এখন তার ঘুম আসছে। কিন্তু ঘুমোবার সুযোগ নেই। কাল পরীক্ষা। পরীক্ষক যদি হেসে ওঠেন, তাহলে ফেল। রেগে গেলে পাশ।
পাশের চেয়ারে বসে কল্লোল কথা বলছেন আরেকটি মেয়ের সঙ্গে। মেয়েটির চোখে মুখে মুগ্ধ বিস্ময়। একজন মানুষ কী করে কবিতার মতো কথা বলে?

-খিদে পেয়েছে। মুন নোট থেকে মুখ তুলে বলল। কল্লোল একটু ভ্রু কোচকালেন। আরেকটি মেয়ে চেয়ার টেনে বসেছে। হাতে চায়ের কাপ। বলল, অমল কান্তি কবিতাটি বলুন না কল্লোল ভাই, প্লিজ।
অমলকান্তি রোদ্দুর হতে শুরু করল। মুন বলল, খিদে পেয়েছে।
থেমে গেলেন কল্লোল। মাথার চুল দুহাতে খামচে ধরলেন। কিছুক্ষণ থম মেরে থাকলেন। নতুন মেয়েটির হাত থেকে চায়ের কাপটি নিলেন। দাঁড়িয়ে পড়লেন। ক্যাফেটারিয়াতে অনেক ছেলেমেয়ে। গল্প করছে। চা খাচ্ছে। সিঙ্গাড়া খাচ্ছে। রাজনীতি করছে। অথবা ফিসফিস। কেউ কেউ একা।
-শুনুন। কল্লোল তার ঝংকৃত কণ্ঠে বলে উঠলেন। শুনুন আপনারা। একটি কবিতাকে বিব্রত করার প্রতিবাদে আমি আমার মাথায় গরম চা ঢেলে দিচ্ছি।
এবং সত্যি সত্যি তিনি সবাইকে অবাক করে গরম চা নিজের মাথায় ঢেলে দিলেন।
কেউ এগিয়ে আসেনি। সবাই দর্শক। অনেকেই কেটে পড়লেন। কেবল মুন নামের মেয়েটি তার নিজের চোখের জল নিয়ে এগিয়ে এসেছিল।
এই চোখের জল কি কবিতা? নাকি সেদিনের ঠোঁটের অমলকান্তি?

২.
চৈত্রমাস তখনো আসেনি। দুপুরে গরম। আমগাছের ছায়া ঘন হয়ে এসেছে।
সেলিম ভাই হাফাতে হাফাতে এসে বললেন, খাইছো কিছু?
উত্তরের অপেক্ষা না করে আবার ছুটে চলে গেলেন।
রিকশা থেকে একজন আধবয়েসী লোক নামলেন। কালো। টাক মাথা। কিছুক্ষণ মুক্তমঞ্চের দিকে তাকালেন। ওখানে লেখা স্বৈরাচার বিরোধী কবিতা পাঠ। কিন্তু কোনো লোক নেই। চারিদিকে ফুল ফুটে আছে।
সেলিম ভাই খাবার নিয়ে এলেন। বললেন, খেয়ে নাও।
দুজনে থেতে শুরু করব, এ সময় তিনি লোকটিকে দেখলেন। বললেন, একি, এ যে দেখছি কবি ফয়েজ আহমদ আইসা পড়ছেন।
তিনি ছুটে গিয়ে লোকটিকে ডেকে আনলেন রাস্তা থেকে। আমরা তিনজন ঘাসের উপরে বসে ভাগ করে মধ্যাহ্ণ ভোজন সারলাম। সেলিম ভাই খুব ডগোমগো। ঢাকার বিখ্যাত সাংবাদিক কবি এসে গেছেন। আমাদের সঙ্গে গাছের ছায়ায় বসে আছেন। এবং কবিতা পড়বেন। আমি ঘুমিয়ে পড়লাম ঘাসের উপরে।
বেলা পড়ে এসেছে। চোখ মেলে দেখি, অনেক লোক জমে গেছে। কেউ কেউ রাস্তায় দাঁড়িয়ে। কেউ কেউ বসে পড়েছে ঘাসে। ফুলের বাগানে। একজন মহিলা কবিতা পড়ছেন। শাদা শাড়ি। লালপাড়। ময়মনসিংহ শহর থেকে এসেছেন। তাকে মাঝে মাঝে দেখেছি ব্রহ্মপুত্রর পাড়ে একজন বয়স্ক লোক সৈয়দ শামসুল হকের সঙ্গে চুপচাপ বসে আছেন। কখনো টিএসসির পাথুরে চেয়ারে- কোনোদিন শহীদ শামসুল হক হলের স্কুল অব থটে। সেলিম ভাই বললেন- ইনার নাম তসলিমা নাসরিন। কি একটা লিটিল ম্যাগাজিন বের করেন। তিনি কবিতা পড়লেন বিজ্ঞপ্তি পাঠের মতো। হাততালি পাওয়া গেল না। দর্শক উঠি উঠি করছে।
হাসানুজ্জামান কল্লোল কবিতা পড়লেন। কেউ কথা রাখেনি- তেত্রিশ বছর কাটলো। আহা, দর্শক হাততালিতে ফেটে পড়ল। তিনি পড়লেন নাজিম হিকমতের - প্রিয়তমা আমার, তোমার শেষ চিঠিতে তুমি লিখেছে..। স্বৈরাচার বিরোধী কবিতা উৎসব জমে গেল।
পুরনো আমগাছের তলায় ঘুমিয়েছিলেন সেলিম ভাইয়ের সেই ঢাকা থেকে আগত কবি। বেশ কয়েকটি পাতা তার গায়ে ঝরে পড়েছে। এতো কবিতা পাঠ আর হাততালির মধ্যেও তিনি অঘোরে নাক ডেকে ঘুমোচ্ছেন। সেলিম ভাই করিৎকর্মা লোক। তিনি কবিকে ডেকে তুললেন। বললেন, চলেন, কবিতা পড়বেন।
-কী পড়বো?
-কবিতা।
-কি কবিতা?
-স্বৈরাচার বিরোধী কবিতা।
-হুম। বুঝসি। চলো। আমি কবিতা পড়বো। কবিতাই পড়বো।
তিনি দর্শকদের ভেদ করে চলে গেলেন মঞ্চে। চোখে এঁটে নিলেন চশমা। আর একটা প্যাকেট খুলে কী একটা মুখে পুরলেন। চিবুতে লাগলেন।
দেরী দেখে কোনো কোনো দর্শক উসখুস করছে। তিনি তাদের দিকে তাকিয়ে একটু মুচকি হাসি দিলেন। মাথাটা নাড়লেন। ডোন্ট ওরি। এখুনি কবিতা পড়া শুরু হবে। দর্শক রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছেন। চারিদিকে পিন পতন নীরবতা।
তিনি পড়লেন তার সদ্যোজাত কবিতা-

ওরে স্বৈরাচার
তুই বড়ো দুরাচার।
আমি খাই আমের আচার..

আরও কি সব। শোনা গেল। দর্শক তুমুল হর্ষ ধ্বনি করতে লাগল। এক সময় কবিকে মঞ্চ থেকে কাঁধে করে নামিয়ে আনল। দীর্ঘ মিছিল শুরু হল। নেচে গেয়ে অসাধারণ সে মিছিল। ওরে স্বৈরাচার/ তুই বড়ো দুরাচার।/ আমি খাই আমের আচার..
স্বৈরাচার এক কবিতায় নিপাত গেল।
এরপর থেকে আমের আচারের বিক্রি হু হু করে বেড়ে গেল। আর বিখ্যাত হয়ে গেলেন সেদিনের সেলিম ভাইয়ের ফয়েজ আহমদ ওরফে সত্যিকারের আব্দুল জব্বার। প্রফেসর, কৃষি অর্থনীতি বিভাগ। ইতি দ্বিতীয় সর্গ।

৩.
মাইকের সামনে একজন মানুষ এসে দাঁড়ালেন। গোলগাল মুখ। চোখে গোল চশমা। গাঢ় গোঁফ। প্রিন্টেড শার্ট। ঢলঢলে। পরনে জিন্স। ঠোট টিপে ধরলেন। তারপর শুরু করলেন তার কবিতা পাঠ। ছাট কাগজের মলাট। জলমগ্ন পাঠশালা। রেঞ্জ দিয়ে একটি একটি কবিতার রহস্য খুলে ধরলেন আমাদের সামনে।
কবিতার প্রতিটি সত্য শব্দ তিনি উচ্চারণ করছেন পূর্ণভাবে। ধীরে ধীরে। শব্দের মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসছে শব্দের মর্ম। শব্দের অধিক অন্য কোনো শব্দ। তার অস্থি, মজ্জা- প্রাণ। একেই বলে শব্দ ব্রহ্ম। ব্রহ্মের শব্দ। ম্যাজিকের মতো এই শব্দপাপড়িগুলো আমাদের সামনে রচনা করছে রূপের জগৎ। রহস্যের প্রণয়। আর গুপ্ত ঘাতকের ছুরির ফলা। লাফিয়ে উঠছে আমাদের যাপিত জীবন, স্বপ্ন, সাধ, ব্যর্থতা আর শান্ত ঈর্ষা।
যে মেয়েটি ভালবাসতে শুরু করেছে- তার ভালবাসা গভীর হয়ে গেল। যে ছেলেটি ভালবাসেনি, সে ভালবাসা শুরু করল। যে লোকটি জেনেছে, বেঁচে থাকা মানে আসলে এক ধরনের দায়িত্ব, তিনি জানলেন , বেঁচে থাকা মানে বেদনা এবং ভালবাসার দ্বৈরথ। অপার বিস্ময়।
সেদিন এই কবিতা পাঠের আসরে আমার পাশ থেকে বৃদ্ধ আমগাছগুলো গুটিগুটি পায়ে হেঁটে কবির সামনে গিয়ে বসেছে। করিডোর থেকে বোগেন ভিলিয়ার ঝাড় আর এলামেন্ডাও চলে এসেছে দর্শকদের ভেতরে। গাদা আর হলিহক পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইল। দূর থেকে ঘাড় উঁচু করে কান খাড়া করছে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র। জাফরান, মহুয়া আর চন্দনবন। তাদের সঙ্গে চুপচাপ লেপ্টে আছে একটি পাওয়ার টিলার। মানুষের মাঝখানে সেই প্রথম আমরা দেখলাম আকাশ থেকে একজন দেবদূত ঘোষণা করছেন আকাশ বানী। আর যারা শুনছেন সেই বানী- তারাও হয়ে গেলেন দেবদূত। শান্ত। সৌম্য। সুন্দর।
এই-ই কবিতা। এই-ই কবি। আমার কবি।

৪.
সন্ধ্যে হলেই খোকা ভাইয়ের মনে গান আসে। খোলা মাঠের মধ্যে বসেন ঠিক ঘাসের উপরে। হালকা বাতাস। পাশেই কয়েকটি আকন্দ গাছ। পাতা নড়ে। পাতা চড়ে।
সবার শেষে আসেন বাবুল ভাই। হাপাতে হাপাতে। কয়েকটি ডিম তিনি ইককিউবিটরে রেখে এসেছেন। ২১ দিন পরে ফুটবে। কয়েকটি শিশুমুরগী দানা খুটে খুটে খাবে। এই ভেবে তিনি সারাক্ষণ ইনকিউবিটরের সামনে বসে থাকেন। আর নিজেন ভেতরে অনুভব করেন আসন্ন মাতৃস্নেহ।

খোকা ভাই হারমোনিয়াম টিপে টিপে গাইছেন-

নিশিদিন মোর পরানে প্রিয়তম মম
কত-না বেদনা দিয়ে বারতা পাঠালে।।
ভরিলে চিত্ত মম নিত্য তুমি প্রেমে প্রাণে গানে হায়
থাকি আড়ালে।।

টেন টেনে গাইছেন খোকা ভাই- নিশিদিন মোর পরানে। ঘুরে ফিরে অনেকটা সময় নিয়ে। কত না বারতা পাঠালে। বাতাস কেটে কেটে যাচ্ছে শব্দগুলো। গন্ধপথের মতো দূরে চলে যাচ্ছে। চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। আবার ফিরে আসছে। বারতা পৌঁছে যাচ্ছে। বারতা ফিরিয়ে আনছে। চিত্ত ভরে উঠছে। প্রেমে প্রাণে গানে। আবার এসবের বাইরে যে আড়ালে যে আমি আছি হাহাকার করে উঠছি। বারতার চেয়ে বেদনা কেঁদে কেঁদে উঠছে।
হালকা কুয়াশা ভেদ করে চাঁদ উঠেছে আকাশে। অনেকটা ঝুঁকে পড়েছে এই খোলা মাঠের দিকে। আর আকাশ থেকে ঝাঁক বেঁধে নেমে এসেছে পরীরা। ডানা মেলে ঘাসের উপরে কুয়াশার গায়ে ভর দিয়ে বসে পড়েছে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে। দূরে ইউক্যালিপটাসের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে দূরাগত ট্রেন গেছে থেমে।

খোকা ভাই গাইছেন-
ভরিলে চিত্ত মম নিত্য তুমি প্রেমে প্রাণে গানে হায়
থাকি আড়ালে।।

একটি গানই গাইছেন খোকা ভাই। না থেমে, না থেমে। কখনো ধীরে- কখনো দীর্ঘলয়ে। আর নির্মাণ করছেন বেদনা, ভালবাসার ছবি- হাওয়া দিয়ে নির্মিত এই চিরন্তন ছবিটি।
কখন বাহাদূর এসে বসে পড়েছে আকন্দগাছের পাশে আমরা কেউ বুঝিনি। আধো আলো আধো অন্ধকারে ঘাসের ভেতরে থুতনি রখে শুয়ে আছে বাহাদুর। দুচোখ বন্ধ। বাহাদুর যেন এই গানের পর্বে পর্বে আকন ফুলের গাছ ।
অনেক রাতে সেলিম ভাই উঠে দাঁড়ালেন। সোজা পরীদের ভেতর দিয়ে চলে গেলেন, মাঠের মধ্যে দিয়ে- কাউকে কিছু না বলে, না কয়ে বারতাকে বুকে করে। বাবুল ভাই ফিরে গেলেন তার মাতৃস্নেহের টানে ইনকিউবিটরের ঘরে। ভালবাসার ভার তার বুকে। যোয়েব কিছুটা বিহ্বল। খোকা ভাইয়ের হারমোনিয়ামটি কাঁধে নিয়ে হাঁটা শুরু করেছে কোথায় ঠিক নেই। বন থেকে বনান্তর। জীবন থেকে জীবনান্তরে।

আর সবশেষে আকন ফুলের মাঝখান থেকে উঠে দাঁড়াল বাহাদূর। অনেক কষ্ট করে থুতনিটা উঁচু করল। আকাশের দিকে তাকাল। সামনের দুপা আগে- পেছনের দুপা পরে একবেঁকে দাঁড়াতে পারল। একা একা। চারিদিকে আবার চোখ মেলল। একবারমাত্র। মেঘের ভেতরে যে চাঁদ ঢুকে পড়েছে তার দিকে তাকিয়ে কি ভেবে একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। তারপর এলোমেলো পায়ে হেঁটে গেল সামনে। মাঠ পেরিয়ে। গাছ পেরিয়ে। ট্রেন পেরিয়ে। আকাশ পেরিয়ে। মেঘ পেরিয়ে। গন্ধপথে। মন্দ্র পথে। যেখান থেকে ফিরে এসেছিল, সেইখানে। সেইখানে।
ডেকে বললাম, বাহাদু..র।
কেউ শুনল না। কেউ শুনবে না। কেবল চোখে পড়ল, তার শীর্ণকায় লেজটা একেবারে মিলিয়ে গেছে আমাদের কুড়ি কুড়ি বছরের আগে।





প্রজ্ঞা পারমিতার জলতল অথবা এ্যান্ডারসনের চকোলেট

আমার ছোট মেয়ে প্রজ্ঞা পারমিতা। যেদিন বাড়িতে এলো, আমার বাগানে সেদিন বেগুন পাতায় টুনটুনিরা বাসা বানাল। ফুটে উঠল বর্ষার শেষে কয়েকটি গাদা ফুল। বড়ো মেয়ে পূর্বা ভয় পেয়ে পালিয়েছিল পালপাড়া। ফিরে এসে বোনের আঙুল ছুয়ে বলল, কী ছোটো, কী ছোটো। সারাক্ষণ এই নতুন বোনটির কাছে বসে রইল। মাঝে মাঝে মাছি তাড়াল। আগডুম বাগডুম খেলল। বোনের পাশেই ঘুমিয়ে পড়ল। আর তুলতুলে প্রজ্ঞা পারমিতা একজন সুখী মানুষের মতো হেসে উঠল খিল খিল করে।

বাসার সামনেই পুকুর। বেশ বড়ো। চারিদিকে নারিকেল গাছ। আর কয়েকটি দীর্ঘতরু- রেইনট্রি । একটি বরই গাছ বুড়ো মানুষের মতো জলের উপর ঝুঁকে আছে। ডালে ডালে অর্কিড। লাল লাল ফুল ফোটে। জলের উপরে ফুলের ছায়া পড়ে।

বড়ো মেয়েটির পিঠে দুটো ফিশিং বল বেঁধে দিলাম একদিন। সারা পুকুর জুড়ে ভেসে ভেসে বেড়াল। কিছদিন পরে ফিশিং বল দুটো খুলে ফেলল ও নিজেই। প্রজ্ঞা পারমিতা জানালা থেকে হাততালি দিল- দিদি। দিদি। দিদি।

দিদি তখন জলে থাকে। জলে ভাসে। ভাবে, সেও এক হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান এ্যান্ডারসনের মৎসকুমারী। বলে, বাবা দ্যাখোতো আমার পা দুটি লেজ হয়ে যাচ্ছে কিনা? বলে, মৎসকুমারী হলে তার চুল হবে সোনালী আর ঠোঁটে থাকবে সমুদ্রপাখির গান।

আমি তখন জলে জলে ঘুরে বেড়াই। সকাল থেকে সন্ধ্যে। কখনো অনেক রাত্তিরে। কখনো কচানদীতে, সন্ধ্যা, কালিগঙ্গা, বলেশ্বর, অথবা পানঘুচি নদীতে। কখনোবা সুগন্ধ্যা, কীর্তনখোলা, তেতুলিয়া, পায়রা, কালাবদরে। মাঝে মাঝে আড়িয়াল খাঁতে। মাঝে মাঝে চোখে পড়ে- জল থেকে লাফিয়ে উঠছে ইলিশ। জেলে নৌকায় আচড়ে পড়ছে। কয়েকটা লাফ দিয়ে হয়ে যাচ্ছে নিথর। আহা, ইলিশ। ইলিশের যদি ডানা থাকত!

একদিন ছোটো মেয়েটি টলোমলো পায়ে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এলো। একা। পেয়ারা গাছের নিচে বিউটির মা কাপড় কাচছে। তার আঁচল নিয়ে খেলল। তাঁর আঁচল মাথায় দিয়ে বসে রইল কিছুক্ষণ। একটি শুকনো পেয়ারা পাতা ঘাস থেকে তুলল। নেড়ে চেড়ে দেখল। গুজে দিল পাকা চুলের ভিতর। দোতলার বারান্দায় ইঞ্জিনিয়ার ভাবি চাল বাছছেন। চেচিয়ে বলল, কাকী। কা-কী-ই।

আমার বড়ো মেয়ে পুকুরর পাড় ঘেসে জল ছিটিয়ে থৈ থৈ খেলছে পাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে। ছিটকে উঠছে জল। ঢেউ খল খল। এর মধ্যে প্রজ্ঞা এসে পড়ল। পাড় থেকে। গড়িয়ে। জলের মধ্যে। ওরা হৈ হৈ করে উঠল- প্রজ্ঞা সাঁতার শিখছে। সাঁতার শিখছে প্রজ্ঞা। জলের মধ্যে ওরা ঘিরে ঘিরে জল নিয়ে নতুন খেলা শুরু করছে।

রাতে ঘরে ফিরে দেখি, আমার স্ত্রী শুয়ে আছে। তার চোখ থেকে ঝরছে জলধারা। পিঠের আড়ালে ঘুমিয়ে পড়েছে পূর্বা অতন্দ্রিলা। ছোটটি নেই। বুকের মধ্যে ধ্বক করে উঠল। বলে উঠলাম, আমার কাটুস কই?

স্ত্রী কেঁদে উঠল শব্দ করে। বলল, আছে। আছে। এই দ্যাখো।

দেখি, বুকের মধ্যে কাদা হয়ে ঘুমিয়ে আছে ছোট মেয়ে প্রজ্ঞা পারমিতা। নিশ্চিন্তে। নিরাপদে। শান্তিতে। আঁচল দিয়ে ঢাকা। ঠোঁট চুক চুক করছে। ঘুমের মধ্যে হেসেও উঠছে মাঝে মাঝে। হাতের মুঠোয় একটি শুকনো পেয়ারা পাতা। পাকা চুল জড়ানো।

ওর মা বলল, বিউটির মা ফিরিয়ে এনেছে।

যদি না থাকত বিউটির মা পেয়ারা গাছের তলায়? যদি না থাকত ইঞ্জিনিয়ার ভাবি দোতলায় বারান্দায়?

একথা আমার ছোট মেয়েটির কিচ্ছু মনে নেই। এখন তার লম্ব চুল। বেনী বাঁধে। হাসে। স্কুলে যায়। বরফের উপর দিয়ে হাঁটে। পরীপাখির দিকে ফিরে গান গায় সমুদ্রপাখিদের মতো- তুম্বালা, তুম্বালা, তুম্বালাইকা।

ওর মনে আছে শুধু দেলোয়ার কাকার কথা। মুদি দোকানী দেলোয়ার কাকার চকোলেটের কথা। সারি সারি কাঁচের বয়ামের ভেতরে কাগজে মোড়ানো চকোলেট। খুব মিষ্টি। বলে, বাবা- চকোলেট না। ক্যান্ডি। ক্যান্ডি। বলো, ক্যান্ডি। য়ু আর নট স্মার্ট, ড্যাড!

বাবা কিচ্ছু জানেও না। জানে না- ও রকম মিষ্টি ক্যান্ডি আর কখনোই সে খায়নি। খেতে পারবে কি আর কখনো?

*পরিশিষ্টে প্রজ্ঞা পারমিতা রচিত গল্প পড়ুন




কৌটো ও মেঘকুঁড়ি

রোদ উঠলেই মেঘ উধাও। বৃষ্টি কিভাবে হবে?
একটি লোক খুকখুক করে কাশছিল। তাকে বলল, কাউয়া ঝিঙ্গার পাতা- বেটে মাথায় পট্টি লাগাও। ঠিক তালুতে।
অযুত বুড়ি বসেছিল সেই সকাল বেলা থেকে। লাঠি একপাশে রাখা। ঝিমুতে ঝিমুতে গেল সারাদিনটা। এখন রোদ হেলে পড়েছে। নড়তে চড়তে কষ্ট। বলল, আমার নাতনিটার কি হবে?
বললেন, জবা ফুল। জবা ফুল।
জবা ফুল দিয়ে কি হবে বললেন না। উঠে পড়লেন। গড় হয়ে প্রণাম করল সবাই। তিনি একবার মাটির দিকে তাকালেন। একবার আকাশের দিকে। কানের কাছে মৃদু ঘাম জমেছে।
সন্ধ্যার পরে জ্যোৎস্না উঠল ঘাম বিন্দুর মতো। দুটো বাসকগাছ হঠাৎ করে মাথা উঁচু করল। একটি তক্ষক দুইবার জিব বের করল। মাঠ ফেটে চৌঁচির। পাতা হলুদ। এর মধ্যে শোনা গেল অনেক দূর থেকে কুল কুল শব্দ ভেসে আসছে। ধীরে ধীরে স্পষ্ট হল। আর বয়ে গেল শীতল হাওয়া। জেগে উঠল পুরনো একটি নদী। পাড়দুটো শ্যাওলায় ঢাকা। উপরে ঝোপঝাড়। নম্রতরুর ডালপালা হেলে পড়েছে জলের গায়ে। ছপ ছপ শব্দ উঠল। এগিয়ে এলো একটি নৌকা। মাঝিকে দেখা যায় না। আলোছায়ার আড়ালে লুকিয়ে আছে। গোসাইজি একটি পা বাড়ালেন। আজ তাঁর জ্যোৎস্নাগমণ। মুখে হাসি। আলোর মায়ায় একটি হারিয়ে যাওয়া বৈঠার শব্দ ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল। কোথায়? কেউ জানে না। কেউ জানে না নদীটাও কখন জ্যোৎস্নার সাথে হেঁটে চলে গেল। আর সব কিছু সুনসান।
রহিম চাচা মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন। তার গরুটি মাঠের মধ্যে গো গো করে বসে পড়েছে। বউটা জামগাছে ঝুলে পড়তে গিয়ে কি ভেবে আবার ফিরে এসেছে। সেদিন সকাল থেকেই দুটো সাদাকালো কাক শুকনো ডাল থেকে ঝরে পড়ে মরে গেল। তাদের ডিম দুটো কে পাহারা দেবে?
কজন তারস্বরে গেয়ে উঠল,
আল্লা ম্যাঘ দে,
পানি দে রে তুই আল্লা।
আর হিন্দু পাড়ায় শুরু হল ব্যাঙের বিয়ে। অন্ধকারের মধ্যে শুরু হল মিটিং। বটতলায়। কেউ কারো মুখ দেখতে পাচ্ছে না। সবার গলা ফিসফিসে। বিষন্ন । ক্লান্ত। হতাশ।
-কী করা যায় এখন?
- পরী নাচাতে হবে?
-পরী?
- হ্যা। পরী। শঙ্খ পরী।
-একা একা পরী ঘুরবে আকাশের নীচে। গায়ে থাকবে আলোর পোষাক।
এইখানে কোন শব্দ নেই। সাড়া নেই। দূরে শিয়ালের গলা শোনা গেল। হাহাকারের মতো। কান্নার মত।
-কোনো অসুবিধা নাই। আমরা দুজনে পাহারা দেবো। ম্যাঘ এইবার যাবা কই?

-এই গলা চেনা গেল। এ দুটো লোকের চোখ সব সময় লাল থাকে। তাদের গল্প শুনে বালিকারা আতংকে সূর্য ডোবার আগেই ঘরে ফেরে। শিশুরা ঘুমিয়ে পড়ে। কোনো কোনো নির্জন পথ বিকেল থেকেই নির্জনতর হয়ে উঠে।
মেঘের জন্য কত কাজই করতে হয়। আমাদের কোনো কাজ নেই। শঙ্খমালা কদমতলায় আমাকে সাজাল। চুল আচঁড়ে দিল। ভুরু টেনে দিল লম্বা করে। গলায় পরিয়ে দিল শুকনো ফুলের মালা। চুলে গুজে দিল পাখির পালক। একটি বাঁশি হলে বেশ হত। খিল খিল করে হেসে উঠল।
পরণে ধানী রং শাড়ী। চুল এলো। কানে জবা ফুল। আমাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল। বলল, তুমারে খুব মানাইছে গো। একদম কিসনো ঠাকুর।
কদমতলা ঝাড়ু দিল। পেতে দিল পাতার বিছানা। খেতে দিল পদ্মকুড়িঁ। বলল, ঘুমাও।
আঁচল দিয়ে বাতাস করল। হাই উঠল ওরও। ছায়া পড়ে এলো। শুনলাম, কে যেন গান গাইছে-
কালা তোর তরে
কদমতলায় বংশী বাজায় কে?

ঘুম ভাঙতেই দেখি দুটো কালো লোক শঙ্খমালাকে ধরে ফেলেছে। বলছে, চল- সিঙ্গির মাঠে। তোকে পরী হতে হবে। আসল পরী।
শঙ্খমালা চিৎকার বলছে, আমি পরী না। আমি পরী না। মানুষ। শঙ্খমালা।
লোকদুটো হেসে উঠল। বাঁশবন শিউরে উঠল। একটা পচা গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। মৃত কাকদুটো মাটির উপরে পড়ে ছিল। এইবার একটু একটু নড়ছে চড়ছে। ডানা ঝাপটিয়ে উঠে পড়ল। মাটি থেকে উড়ে গেল। কা কা করে ডাকতে লাগল। মাথার উপরে।
সেই সময় কুয়োতলা থেকে অযুত বুড়িটা এলো। লাঠি ঠুক ঠুক করে। হেকে বলল, শঙ্খ। শঙ্খ।
কে উত্তর দেবে? দূর থেকে গো গো শব্দ ভেসে এলো। অযুত বুড়ির কোটর থেকে ছিটকে বেরিয়ে এলো দুটো আগুনদলা। মাথার শনের মতো চুলগুলো হয়ে গেল খাড়া। শুকনো হাতটা বাড়িয়ে দিল বাঁশবনের দিকে। হাতটা লম্বা হতে হতে পৌঁছে গেল সেইখানে। টেনে আনল শঙ্খমালাকে। শঙ্খমালার ডুরে শাড়ী ঝুলে পড়েছে।
বুড়ি লোকদুটোকে হেঁকে বলল, তোরা কি চাস?
-ম্যাঘ। ম্যাঘ।
কদমতলার মাটি সরিয়ে বুড়ি তুলে আনল একটি পুরনো কৌটো। রুপোলী। ঢাকনাটা খুলল খুব ধীরে ধীরে। বলল, এই দ্যাখ ম্যাঘ।
কৌটার ভেতরে একটি মেঘকুঁড়ি ঘুমিয়ে আছে। তুলতুলে। কী অদ্ভুত তার রং। টলমলে। বলল, ম্যাঘ কি এমনি এমনি পাওয়া যায়? তারে চাইতে হয়। প্রাণ থেকে। মন থেকে। সবাই মিলে। ভালবেসে। জোর করে চাইলে তারে পাওয়া যায় না।
মেঘকুঁড়ি চোখ মেলল। মিটমিটিয়ে । তারপর ছোট্ট দুটি ডানা মেলল। উড়ল। বুড়ির চারিদিকে উড়ে বিড়াল। তার চুলে বসল। উড়ে গেল শঙ্খমালার কপালে। চুলে। কানে। নাকে। গালে। চোখে।
চোখের ভেতর থেকে মেঘপাখি চলে গেল আকাশে। ফুলের মত ফুটতে লাগল মেঘফুল। চমকাতে লাগল বৃষ্টি। ঝরে পড়ল এক ফোঁটা বৃষ্টি।
বৃষ্টির ধারা।
আলো, হাওয়া ও প্রাণের।

বৃষ্টি শেষ হওয়ার আগে শঙ্খমালা একটি বৃষ্টিকুঁড়ি কৌটোর মধ্যে পুরে রাখল।
এইভাবে মেঘকুঁড়ি ঘুমিয়ে থাকে পুরনো কৌটার ভেতরে।
জানে কেবল অযুত বুড়ি।
তারপর শঙ্খমালা।
শঙ্খ।
অন্য কোনো অযুত বুড়ি অথবা শঙ্খমালা।




জলের ঈশ্বর : ঈশ্বরের জল

ঈশ্বর সঙ্গে ছিলেন। আমাদের কোনো ভয় ছিল না।
হাওয়া উঠলে হেসে উঠতেন। ছায়া নামলে গেয়ে উঠতেন।
আমরা জলের মধ্যে সহজে হাত রেখেছি। বুঝতে পেরেছি, মাছ ও মানুষের মধ্যে অনেক তফাৎ।
এই আমাদের ঈশ্বর। কখনো কুর্চিগাছের নিচে ছোট্ট নৌকাটি বাঁধতেন। চোখে দিতেন জলের ঝাপটা। হাসি হাসি মুখ। দূরে সর্ষে ক্ষেতের আড়ালে মিলিয়ে যেত তাঁর পেশল শরীর।
আমরা মনে করতে পারতাম, কালো চুল একটি মেয়ের মুখ। কালো মেঘ মেয়েটির চোখ। কালো রাত্রির সাদা বৃষ্টির সুখ। শান্ত। সুন্দর।
ঈশ্বর ছিলেন মুখর। কখনো ভাবতে পারিনি, পৃথক পালঙ্কের কথা। আমরা দেখেছি, লাল ফুল সুগন্ধি ছড়িয়ে ফোটে। জ্যোৎস্না ওঠে। অনেক হারানো পাখি নতুন নতুন ডানা ফিরে পায়। দূরে উড়ে যায়। ঘরে ফিরে আসে। শুনি পাতার মর্মর ধ্বনি।
এই-তো আমাদের ঈশ্বর।
ঈশ্বর থাকেন নৌকায়। আমরা থাকি জলে।
কাশবন কি আমাদের বোন? এই প্রশ্ন কখনো আমাদের জাগেনি। বেনুবন কি আমাদের দিদি? এই প্রশ্ন কখনো করিনি। শুধু দেখেছি, আকাশও দূর থেকে মরালীর মতো জলতলে নেমে আসে। হাওয়ায় হাওয়ায় নাচে কাশবন। দূলে ওঠে বেনুবন। এই-ই আমাদের আনন্দ। এই-ই মিলন। মিলনই মৌলিক।
শুধু একদিন দেখেছি, মাথার উপরে এক সঙ্গে অনেক সূর্য জ্বলে উঠেছে। কোথাও কোনো হাওয়া নেই। ছায়া নেই। কুর্চিগাছের নিচে একমাথা ঘন চুল। পায়ের ফাঁকে ডানকানা মাছ। হাতের ফাঁকে মৌরালা মাছ। বক্ষে কাহার তৃষ্ণা। চক্ষে আমার জল। থৈ থৈ নদী।
দুটি ছেলেমেয়ে বসেছিল ব্রহ্মপুত্রের পাড় ঘেসে। ভীত মেয়েটি ছুটে পালাল আগে। তার পিছনে আতংকিত ছেলেটি। কোথায়? জানা নেই। আর কেউ কোথাও নেই। স্রোতে ভেসে গেছে চুল, চোখ, মুখ...।
সেদিন থেকে আমরা নৌকায়।
ঈশ্বর থাকেন জলে।

সহজে জেনে গেছি, মাছ ও মানুষের মধ্যে কোনো তফাৎ নেই। আকাশ এক দুরের মানুষ।
বিরহই মৌলিক।




ঈশ্বরের চোখ : আদিপাঠ

আমার ঠাকুরদা একজন ব্যর্থ মানুষ। পৃথিবীতে ব্যর্থ মানুষের গল্পই বেশি। ব্যর্থ মানুষের আঙুল কাটা।

ঠাকুরদা থাকত রাস্তার পাশে একটি পুরানো গোয়াল ঘরে। গরু ছিল না বলে এটা হল গুদাম ঘর। গোবর আর গোচনার গন্ধ ভেসে বেড়াত। আর ছিল একটা বড় দাস মাছি। ওর ছিল পুঞ্জাক্ষী। ঘাড় না ঘুরিয়েও চারিদিক দেখতে পেত।
ঠাকুরদা আর দাস মাছিটি এক সঙ্গে চেয়ে থাকত দোতলা বাড়িটির দিকে। বাড়িটির রং নেই। ছাদ ভাঙা। জল পড়ত বৃষ্টির দিনে। কার্নিশে বেড়ে উঠেছে বটগাছ।

একদিন জানতে চাইলাম, কী দ্যাখো দাদু?
ঠাকুরদা কোন উত্তর দেয়নি। আমার ছোটখাট ঠাকুরদা, হালকা পাতলা নিভৃতচারী মানুষটি- আমার ডান হাতটি ধরল। তার হাতটি থরথর করে কাঁপছে। মুখটি বিষ ন্ন । চোখ দুটো স্থির।
ঠাকুরদা দেখাল- একটা পথের রেখা, হু হু প্রান্তর, আর অনন্ত আকাশ। জলের মধ্যে হাত রেখে বলল, টের পাচ্ছিস?
জলের মধ্যে আরো জল। মাছ। কচুরিপানা। আর বিপুল ঢেউরাশি। ওপারে ধানক্ষেত। রৌদ্র ছায়ার লুকোচুরি খেলা রে ভাই লুকোচুরি খেলা। মেঘগুলো দাঁড়িয়ে থাকে না। উড়ে যায়। ঝরে পড়ে। আবার উড়ে আসে।

একটি গাছের দিকে চেয়ে বলল, দেখতে পাচ্ছিস?
পাতার পরে পাতা। ফুল ফুটেছে। ফল ধরেছে। একটি পাখি উড়ে এসে বসেছে। লেজ নাচাচ্ছে। আরেকটি পাখি উড়ে যাচ্ছে বহুদুরে। তার ডানা নড়ছে। বীজ লেগে আছে ঠোঁটের উপর।
মাটির উপরে পাটখড়ি দিয়ে ঠাকুরদা লিখে দেখালেন, অ।
আমি বললাম, অ।
ঠাকুরদা বলল, স্বরে অ। অজো নিত্যঃ শাশ্বতোহয়ং পুরাণো। ইনি অজর। প্রতিদিনের। চিরকালের। পুরনো কাল থেকে ভেসে এসেছে। ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে। একে হত্যা করা যায় না। ইনি কখনো মারা যান না।

আমার ঠাকুরদা কিন্তু মারা গেল। সেদিন ছিল ভোরবেলা। শান্ত বাতাস। ডালুপিসির মা বলল, ওরে, উনি তোদের দিন দিয়ে গেছেন। আহা, কী দিন।
ওঁ অদ্য নো দেব সবিতঃ
প্রজাবৎ সাবী সৌভাগম্ৎ ।
পরা- দুঃস্বপ্নং সুব।।
হে দেব সবিতাঃ! তুমি সর্ব-প্রসবকারী, প্রসব কর আমাদের জন্য পুত্র পৌত্রাদি সৌভাগ্য ,বিদুরিত কর দুঃস্বপ্ন-দুঃখদুরিতপূর্ণ দুর্ভাগ্য ; প্রদান কর পরম সৌভাগ্য; প্রেমভক্তি, যেন মায়া মোহে আমরা অভিভূত না হই।

এই রকম কোন একদিন সুর্য উঠছে সবিতৃদেব হয়ে। আর তখন দাদা আমি আমার বোনেরা মায়ের হাত ধরে নেমে এসেছি অই পুরনো বাড়িটির দোতলা থেকে। দোতলার কার্নিশে সর্বপ্রসবকারী এই সূর্য ঝুলে থাকলেন। তিনি অভিভূত। গুদাম ঘরটি আমাদের ঘর। ঠাকুরদার নড়বড়ে তক্তপোষটি বাবার তক্তপোষ। শুয়ে শুয়ে বাবা চেয়ে থাকে- নির্মল আকাশের দিকে। বাবা খুব তাড়াতাড়ি ঠাকুরদা হয়ে গেল।

বাবার হাতের মধ্যে কৌশিকের হাত। গোহাটা পেরিয়ে কৌশিকের ঠাকুরদা নতুন একটি পথ খুঁজে বেড়ায়। শিরশির করে হাত কাঁপছে। কৌশিক বলে উঠল, কী দেখছ, দাদু।
একটি দীপ্যমান সূর্য উঠছে। মাথার উপরে পুত্র পৌত্রাদিক্রমে এসে গেছে। অন্ধকার সূর্যকে গিলে খাচ্ছে। মায়া হয়। হাহাকার জাগে। বাবা বলল, অন্ধকার। অন্ধকার ছাড়া আর কিছু দেখতে পাইনা রে।
বাবা এই গভীর অন্ধকারের মধ্যে চলে গেল। নীরবে চলে গেল। কে তাকে ফেরাবে?

আমার দাদা বাবার মতই হাঁটে। পথে প্রান্তরে। আকাশে। বাতাসে। হাতের মধ্যে ফর ফর করে ওড়ে একটি খসখসে কাগজ। লেখা, মহামান্য আদালত এমত মনে করিতেছে যে- এই ভূমিতে যাহারা পুত্র পৌত্রাদিক্রমে বসবাস করিতেছে, ইহার প্রকৃত মালিক ক, খ, গ, ঘ, ঙ। ইহার উপরিস্থিত যে গ্রহটি নির্মিত আছে- উহা গোবাদিপশুর বাটি বলিয়া বর্ণিত আছে। এই গবাদিপশুর মালিক ক, খ, গ, ঘ, ঙ।

-কী দেখছিস, দাদা?
-কিছুই না। কিছু দেখতে পাইনারে ভাই। অন্ধকারও না। সব শূন্য।

এইতো আমার গল্প। পুত্র পৌত্রাদিক্রমে পরিযায়ী পাখিমানবের গল্প। আর কি বলার আছে আমার!

******************************************************************
কিছুতো বলতে হবে। বল রায়। কথা বল রায়।
অধীর আগ্রহে মেরী মাতোস আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ওর ঘরটি ছোট। সদাপ্রভু উর্ধ করে দাঁড়িয়ে আছেন। হাসি হাসি মুখ। বুকের মধ্যে দিয়ে চলে গেছে একটি পথ। বহুদূরে।
মেরী মাতোস বলল, তোমাদের টেগোর বলেছেন- মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ। কেন পাপী হচ্ছ?

পাপ কী? পূণ্য কী? এ এক জটিল ধন্ধ হে ধর্মরাজ। তারপর যক্ষ বললেন, বার্তা কি? আমার এই প্রশ্নের উত্তর দিয়ে অতঃপর জলপান কর।
জনহীন মহাবনে স্বর্ণময়-পদ্মশোভিত সরোবরে তাঁর ভ্রাতারা প্রাণহীন নিশ্চেষ্ট হয়ে পড়ে আছেন। ভ্রাতাদের গায়ে অস্ত্রাঘাতের চিহ্ন নাই। ভূমিতে অন্য কারো পদচিহ্ন নাই।
যুধিষ্ঠির তখন দেখলেন, তালবৃক্ষের ন্যায় মহাকায় বিকটকার সূর্য ও অগ্নির ন্যায় তেজস্বী এক যক্ষ বৃক্ষে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে । মেঘমন্দ্রস্বরে বললেন, আমি বহুবার বারণ করেছিলাম। তথাপি তোমার ভ্রাতারা জলপান করতে গিয়েছিল। তাই তাদের মেরেছি। যুধিষ্ঠির, তুমি আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দাও। তারপর জলপান করো।

আগে ছিল এক পায়ে দাঁড়ানো বক পাখি। এখন ধর্মগুণে যক্ষ। মহাতেজা। কী করে কে জানে? ঝামেলা করে লাভ নেই। যুধিষ্ঠির বলল-
অস্মিন মহামোহময়ে কটাহে
সূর্যাগ্নিনা রাত্রিদিনেন্ধনেন।
মাসর্তুদর্বী পরেঘট্টনেন
ভূতানি কালঃ পচিতীতি বার্তা।
-এই মহামোহরূপ কটাহে কাল প্রাণিসমূহকে রান্না করছে। সূর্য তার অগ্নি। রাত্রিদিন তার ইন্ধন। মাস-ঋতু তার আলোড়নের দর্বী (হাতা/ খুন্তী)। এই বার্তা।

- আশ্চর্য কি?
প্রাণিগণ প্রত্যহ যমালয়ে যাচ্ছে। তথাপি অবশিষ্ট সকলে চিরজীবি হতে চায়। এর চেয়ে আর আশ্চর্য কি আছে?

- সুখী কে?
হে জলচর বক, যে লোক ঋণী ও প্রবাসি না হয়ে দিবসের অষ্টমভাগে (সন্ধ্যাকালে) শাক রন্ধন করে সেই সুখী।
আর বাকী সময়? হাওয়া খাও। হাওয়া গাও। হাওয়া বিলাও।
এই ধন্ধে পড়িয়া আমার প্রাণ উড়িয়া যায় হে যুধিষ্ঠির। তুমি ধর্মপুত্র। মাতা কুন্তীর অনুরোধে সাক্ষাৎ ধর্ম জন্মবীজ বুনে দিয়েছিল। আবার তোমার তাত বিদুর মৃত্যুকালে ধর্মে লীণ হয়ে গিয়েছিল। ধর্মের জয়ই সর্বত্র। মিছে কথা বলি কি করে। আমার স্ত্রী ম্যানহাটন থেকে ফিরে আমাকে একটি আপেল দিল। আমি জানি, এই আপেলটি সকালে নিয়েছিল ঘর থেকে। খায়নি। এখন আমাকে দিয়ে বলছে, খাও। আপেল নিষিদ্ধ ফল। ফলে- স্বর্গ হৈতে বিদায়। কোন স্বর্গ? ভুল স্বর্গ। সদিয়া খেতে খেতে বলে, রায়- কোথা হৈতে আনিয়াছ এই সুমিষ্ট আপেলটি?
-পরলোক।
-পর..লউক! সদিয়া খেতে খেতে হাসে। আজ খুব সুখী। বলে, গুড রায়। এই পর..লউক দেশটি তো ভাল। তোমার দ্যাশ? টিসু পেপারে মুখ মুছে বলে, এই দ্যাশে যাইতে পারিলে ভাল হৈত। যে দ্যাশে মাগনা আপেল ফ্রুইট পাওয়া যায় হেই দ্যাশে না যাইয়া পারা যায়?

সদিয়ার গার্বেজ ক্যানের উপরে বসি। যেতে যেতে সদিয়া বুড়ি একটি নাইজেরিয়ান গান ফেলে গেছে হাওয়ায়। বেশ বুঝতে পারি, কুন্টে কিন্টো ঝোঁপের আড়ালে লুকিয়ে আছে। কয়েকটি শক্তহাত তাকে সাঁড়াশির মতো ধরে ফেলেছে। আঙুলগুলো সাদা। সে চলে যাচ্ছে সমুদ্রের ভিতর দিয়ে। এই সমুদের ঢেউগুলো মুক্ত । আর যে পাখিরা ওড়ে তাদের ধরে ফেলবার কেউ নেই। ওরা স্বাধীন। আর আমি চলে যাচ্ছি মানুষের মধ্যে দিয়ে। দাসের পৃথিবীতে। শেকড়চ্যুত। এই গান আমার মা আমাকে শুনিয়েছিল। আমার বউ শোনাচ্ছে তার ছেলেকে। তার বউ শোনাবে তার অনাগত ছেলেকে- মেয়েকে। হা ঈশ্বর, তোমার আপেলগুলোর কোনো দোষ নাই। সর্পতো মহৎ। দোষ অই বাসনার। কেন বাসনাবশে খাইলে হে মাতা হাওয়া। কেন তোমার শেকড় হারাইলে?

অ্যা মা রম ক্যাডুম্যাবে আইয়ামু ইয়া পোতা
অ্যা না মা চ ইনা ওবাদুম।
মানা এবে নিন্যা বো মিলি না অচিচি
ওহ, অনইয়া ইয়া বোজেলম অইয়াম
ইফা ব আকালাকাম*

এই শেকড়ের কথাটিই লিখলাম। একটি একটি অক্ষরে। পূর্ণ একটি বাক্যে। পূর্ণ একটি জলে। পূর্ণ একটি কান্নায়।
দূর সম্পর্কের মেঘ অথবা বোন শকুন্তলা লিখল, সাহিত্যের জায়গাটি আপনার নয়। ওটা কালিদাসের। আপনি কেন এখানে এসেছেন? দেখেছেন- কতবড় সিঁড়ি।

সত্যিই তো। অনেক বড় সিঁড়ি। ধাপে ধাপে উঠে গেছে কৈলাসে। স্বর্গের দরোজায়। ওখানে দাঁড়িয়ে আছে কালা পাহাড় আর ধলা পাহাড়। গেলেই পান করে আর জানতে চায়, তোমার গেট পাস আছে? তুমি কোন দলের? কোন মালের?

কী কাণ্ড। আমারতো স্বর্গ বলে কোন ব্যাপার নেই। আমার মাতামহ আমার মাতামহীর অনুরোধে আপেল গিলেছিল। স্বর্গ থাকে কি করে? আমার কি দরকার এইসব বাতেনি সিঁড়িতে পা রেখে?
বাতেনি সিঁড়িতে পা রাখার অনেক আগেই আমার ঠাকুরমা দ্রৌপদী সহসা ভুপতিত হলেন। তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুন তাকে জয় করেছিলেন। তিনি ছিলেন চিরযৌবনা। একারণে পঞ্চভ্রাতাকে খাদ্য দেহ দানে মুগ্ধ রাখতে হয়েছে। ভীম যুধিষ্ঠিরকে বললেন, দ্রুপদনন্দিনী কৃষ্ণা কোনও অধর্মাচরণ করেননি। তবে কেন তিনি সিঁড়িতে উঠতে পারলেন না? ঠাকুরদা যুধিষ্ঠির বললেন, অর্জুনের প্রতি এর বিশেষ পক্ষপাত ছিল। এখন তার ফলভোগ করছেন।
সহদেব, নকুল, অর্জুনও পথের উপরে ধুলোর ভিতরে পড়ে গেলেন। পড়ে ছটফট করতে করতে তাকিয়ে দেখল, স্বর্গের সিঁড়ি খুব খাড়া। ওখানে ওঠা খুব কঠিন।
একটু একটু করে এগিয়ে চলেছেন যুধিষ্ঠির, ভীম আর একটি লোহিত বর্ণের কুকুর। অনন্তর ভীম ভূপতিত হয়ে বললেন, মহারাজ, মহারাজ, দেখুন আমিও পড়ে গেছি। আমি আপনার প্রিয়। তবে আমার পতন হল কেন? যুধিষ্ঠির বললেন, তুমি অত্যন্ত ভোজন করতে এবং অন্যর বল না জেনেই নিজ বলের গর্ব করতে। এই বলে যুধিষ্ঠির ভীমের প্রতি দৃষ্টিপাত না করে অগ্রসর হলেন। একটি কুকুর তাঁর পিছনে চলল। তিনি স্বগের্র সিঁড়িতে একটি পা রাখলেন। কুকুরটিও লাফিয়ে উঠল সিঁড়িতে। যুধিষ্ঠির আরেকটি সিঁড়ি পার হলেন। কুকুরটিও তার সঙ্গী হল। স্বর্গের দরোজা দিয়ে ঢুকতে গেলে দারোয়ান কালাপাহাড় আর ধলা পাহাড় গ্লাসে চুমুক দিল। চোখ ঢুলু ঢুলু। বলল, তাত, তোমার লগে এইডা কে? যুধিষ্ঠির ক্ষেপে গেলেন। বললেন, আমার আত্মার সঙ্গী।
যোগ্য সঙ্গী। হা হা হা। কালাপাহাড় আর ধলা পাহাড় হেসে কুটি কুটি। একদলা খৈনি মুখে পুরে বলল, এই হালায় দেখছি পশুমেহনকারী। অরে নরকের দরোজাডা দেহাইয়া দে।
ধর্মরাজ নরকে যাবে? তাও একা একা। অবস্থা ভয়ংকর। তাইলে ধর্মরাজ হৈয়া কী লাভ হৈল হে কেশব। তখন কুকুরটি আপন রূপ পরিবর্তন করিয়া ধর্মদেব হৈলেন। তিনি অতি গুরুগম্ভীর এবং লাবণ্যময় হৈলেও কিছুটা বিষণ্ন। ধর্মের সূক্ষ তত্ব ব্যাখায় অতি চিন্তাহেতু তিনি পুরাতন অম্বল রোগী। থেকে থেকে তার হিক্কা ওঠে। আর গ্যাসবায়ু নির্গত হয়। সর্বগ্রাসী খিদে পায়। খিদে পেলে তার নখদন্ত বের হয়। ধর্ম আর ধর্ম থাকে না। খ্যাপা কুকুর হয়ে যায়। কুকুররূপ ধারণ করে ঘুরে বেড়ায়। আর কুন্তিকে খুঁজে বেড়ায়। কুন্তির গর্ভে তিনি যুধিষ্ঠিরের জন্মবীজ ঢেলেছিলেন। কুন্তিদের গর্ভে আরও ধর্মপুত্তর জন্মদানে ইচ্ছুক। এই ইচ্ছ এত প্রবল যে কুকুররূপ না হইয়া উপায় নাই। তিনি কুকুর নহেন- তিনি ধর্ম। তিনি ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের ইললিগাল জন্মদাতা পিতা শ্রীমান ধর্ম। তাহার বংশদণ্ডটি দীর্ঘ। ছুরিকার মতো ধারাল। সর্বদা উষ্ণ। এবং তীর্যক। বীর্যবান। তিনি যুধিষ্ঠিরকে ঠেলে নিয়ে স্বর্গে প্রবেশ করিলেন। বলিলেন, ওহে গর্দভবৃন্দ, স্বর্গে একাকী যাওয়া যায় না। সদাসদরূপ কুকুর লাগে।

মহাভারতের কথা অতি মুল্যবান।
কুলদা রায় ভনে শুনে গুণবান।।

সৌতি বললেন, চরাচর গুরু হৃষীকেশ হরিকে নমস্কার করে আমি ব্যাসপোক্ত মহাভারতকথা আরম্ভ করছি। কয়েকজন কবি এই ইতিহাস পূর্বে বলে গেছেন। এখন অপর কবিরা বলছেন। আবার ভবিষ্যতে অন্য কবিরাও বলবেন। তারা বলছেন-

এখন এই কুকুরটি একটি কিশোরকে ঘেউ ঘেউ করিয়া বিরক্ত করিতেছিল। কিশোরটি মহাবনে একাকী ধনুর্বিদ্যা চর্চা করিতেছিলেন। তাহার মনোযোগ ছিন্ন হওয়ায় তিনি সাতটি তীর ছুড়িয়া মারিয়া উহার মুখটি সেলাই করিয়া দিলেন। কুকুরটির মুখে রা নাই। দেখিয়া অর্জুনের কম্প হৈল। তিনি গুরু দ্রোণাচার্যের মুখপানে তাকাইলেন। তাহার চেয়েও বীরের পয়দা হল কি করে? এটাতো কথা ছিল না, গুরু! তাইলে তো ধর্মযুদ্ধে জেতা যাবে না। ধর্মকথা মিথ্যা হৈয়া যায়!
দ্রোণাচার্য তাহাকে জিজ্ঞাসিলেন, কে তুমি।
-আমি একলব্য। নিষাদপুত্র। শুদ্র।
-অ, শুদ্র। নীচু জাত। ছোটলোক। হা হা হো হো করে হাসতে হাসতে কাশতে কাশতে হাচতে হাচতে পঞ্চপাণ্ডব আর কৌরবপুত্রগণ বিষম খাইতে লাগিল। উহাতে মহাবনে মহাভুমিকম্প উপস্থিত হৈল। বনের পশুপক্ষি ভয়ে ছুটিয়া পলাইল। আর সমুদ্রে দীর্ঘ ঢেউ জাগিয়া উঠিল।
-হু। বৎস। তোমার তুল্য যোদ্ধা এ ভবে আর কেউ নাই। ইহা মানিতেছি। তোমার গুরু কেডা?
একলব্য তাহার বামপার্শে র ঝোপজঙ্গল সরাইয়া একটি মৃন্ময়মুর্তি বাহির করিলেন। যুধিষ্ঠিরাদি চমকাইয়া উঠিলেন। সমস্বরে কহিয়া উঠিল, গুরু দ্রোণাচার্য! আপনি? ছোটলোকদিগকে বিদ্যাশিক্ষা দিতেছেন? ছি ছি ছি। আমাগো নুন খাইয়া আমাগো লগে নাফরমানী- বেঈমানী?
দ্রোণাচার্য আসলে ব্রাহ্মণ। তবে নাপিতও হৈতে পারেন। কোন কিছুই ঠিক নাহি। নাপিতের বুদ্ধি অতি চমৎকার। তিনি চিৎকার করিয়া উঠিলেন, খামোশ।
সবাই শান্ত হৈল। তিনি জিজ্ঞাসিলেন, ওকে, গাই। ওয়েলডান। এইবার তুমি আমারে গুরু দক্ষিণা দাও।
- বলুন, আপনি কী চান।
-তোমার আঙুল। তোমার বুড়ো আঙুল। কাচকলাটি- বুঝলে।
ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির অবিচল রহিলেন। অবিচল তাহাকে থাকিতে হয়। কেননা ধর্মের তত্ব অতিশয় সূক্ষ এবং জটিল। একজনের কাছে যাহা পূণ্য- তাহা অন্যের কাছে পাপ। সুতরাং পূণ্য কী? পাপ কী?
এই জটিল রহস্যকথা ভাবিতে ভাবিতে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির দেখিলেন, অতি ছোটলোকের পুত্র একলব্য তাহার বুড়ো আঙুল কাটিয়া গুরু দ্রোণাচার্যের পায়ের কাছে রাখিলেন। কাটা আঙুলটি লাফাইতে লাগিল। আর অর্জুন তাহা হাতে নিয়ে নাড়িয়া চাড়িয়া ঘুরাইয়া ফিরাইয়া দেখিতে লাগিলেন- ইহাতে কোনো যাদু আছে কিনা। একলব্য ধনুর্বান ফেলিয়া গভীর বনের ভিতরে চলিয়া গেল। তাহার আঙুল হইতে দরদর করিয়া রক্ত ঝরিতেছে। তাহাকে আর কোনদিন দেখা যায় নাই। তিনি আউট। পুরাণকথা হৈতে চিরকালের জন্য আউট। ধর্মকথা ইন। ধর্মের জয় অবশ্যম্ভাবী। অথঃ মহাভরতের কথা আপাতত সমাপ্ত।
এই লগে একজন স্বখ্যাত পরিযায়ী কবির কাছে একটি অভিজ্ঞানতুল্য অঙ্গুরীয়সহ পত্র গেল, এই কুলদা রায় লোকটি খুব খারাপ। অতিশয় শুদ্র। সে চান্স পাইলে মহাভারত লেখে। বেদমন্ত্র পাঠের পরে বাইবেল পড়ে। কত্তোবড় বেত্তমিজ! উহার জন্য মহামুনি কৌটিল্য শাস্ত্রে গীত করিয়াছেন- শুদ্রের কানে সিসা ঢালিয়া দাও যদি সে বেদমন্ত্র পাঠে আগ্রহ দেখায়। তাকে আমি ঘৃণা করি। শাস্ত্রে আমার শ্রদ্ধা অবিচল হে ভ্রাতঃ। শাস্ত্রবিহীন কিছু নাই। শাস্ত্রই গেটপাস।
হা হা হা। কে কার ঘৃণার জন্য অপেক্ষা করে? কে কার করুণার জন্য অপেক্ষা করে। ভালবাসার জন্য অপেক্ষা করে?

মেরী মাতোস বলল, তোমাকে ভালবাসে এমন কে কে আছে এই চরাচরে রায়?
-আমার স্ত্রী। আমার কন্যাদ্বয়।
মাতোস আমার সঙ্গে ঘুরছে। আর কি সব বলছে। আর কি সব নোট করছে। রাস্তা পেরিয়ে পার্কে ঢুকেছি। পাতাগুলো সবুজ থেকে এখন হলুদ হয়ে যাচ্ছে। হাওয়ার ঝরে ঝরে পড়ছে। শীত আসছে।
-গুড। রায়, এই পার্ক তোমাকে ভালবাসে না?
আমি পার্কের গাছগুলোর বাঁকলগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখি। প্রাণ বুঝতে পারি। এই আমার ভাই গাছ- অই আমার বোন গাছ।
-আর এই পুকুরটি?
-আমার মা। আমার মা-ইতো এই পুকুরটি।
-আর এই পার্কের হলুদ হাওয়া?
-আমার বাবা।
-আর মাথার উপরের আকাশ?
-আমার ঠাকুরদা।

মেরী মাতোস পড়িলেন, ইশ্বর কহিলেন, আমরা আমাদের প্রতিমূর্তিতে, আমাদের সাদৃশ্যে মনুষ্য নির্মাণ করি; আর তাহার, সমুদ্রের মৎস্যদের উপরে, আকাশের পক্ষীদের উপরে, পশুগণের উপরে, সমস্ত পৃথিবীর উপরে, ও ভূমিতে গমনশীল যাবতীয় সরীসৃপের উপরে কর্ত্তৃত্ব করুক। পরে ঈশ্বর আপনার প্রতিমূর্ত্তিতে মনুষ্য সৃষ্টি করিলেন; ইশ্বরের প্রতিমূর্তিতেই তাহাকে সৃষ্টি করিলেন; পুরুষ ও স্ত্রী করিয়া তাহাদিগকে সৃষ্টি করিলেন। সোহম। আমিই তিনি। তিনিই আমি।
গার্বেজ ক্যানের উপরে বসে আমি এই তারই কথা লিখছি। একটি শব্দ লিখি। আরেকটি শব্দ এসে এসে যায়। একটি পূর্ণ বাক্য হয়ে ওঠে। গড়ে ওঠে ঈশ্বরের মানুষ। ঘরবাড়ি। বাগান। সর্পগন্ধ্যা। না-মৃত্যু। জলতরঙ্গ।
তরঙ্গ থেকে একটি ব্যাঙ ওঠে আসে। পাশে এসে বসে। তার গা থেকে সোনার আলো বেরোয়। কোন এক পাখি উড়ে আসে। তার জল থেকে হিরের দ্যূতি ঠিকরে পড়ে। কোন এক ফুলদল ফুটে ওঠে প্রাণের ভিতরে। ছায়ায় ছায়ায় সুগন্ধি।
আর শত শত দেবদূত আমাকে ঘিরে গাইছে গান। শান্ত হাওয়া করছে একদল পরী। আমি যেন তাদের ছোট ভাইটি। আলাভোলা। গরীব। সে কেবল গরীবই থাকতে চায়। আর চায় শুধু ঈশ্বরের দুটো চোখ। আর কিছু নয়। স্নিগ্ধ। শীতল। প্রাণদায়ী।
আর সব মিথ্যে। মিথ্যে। মিথ্যে। ব্যর্থতার অন্য নামইতো মিথ্যে। আমার ঠাকুরদা একজন ব্যর্থ মানুষ। ব্যর্থ মানুষেরা আঙুল কাটে। গল্প বলে।

আঙুল কাটিয়া কলম বানাইলাম
চক্ষে জল কালি
পাজর কাটিয়া লেখন লেখিয়া
পাঠাই বন্ধুর বাড়ি রে,
-আমি আগে জানি নাই।

এ বেলেম ইমবো আকাম, ওয়েমে ইফি এডেমেডে
অনায়া ইমমিলিমবু এডেমেডে অজি,
ওবিম না এটিওয়া এটিওয়া
ইনজি টালু জি লেটে
-ওহ অনায়া ইনফুলুনায়া ইলমাভো ইয়া

..............................................................................
* পবিত্র বাইবেলের প্রাচীন বাংলা অনুবাদটি আমাকে দিয়েছেন আমার অগ্রজা ক্রিস্টনা রোজারিও। আর মহাভারতের অংশটি রাজশেখর বসু মহাশয়কৃত। গানটি কবি জসীমউদ্দিনের সোজনবাদিয়ার ঘাট থেকে উদ্ধৃত। এটা একটা মুর্শিদা গান। নাইজেরিয়ান ইবো ভাষার গানটি আমার প্রাণের বান্ধবী জেনিফার বলেছে। (*কখন সূর্য উঠবে আমি জানি না/ আমি চেষ্টা করছি তীরে পৌঁছাতে/ চারিদদিকে শুধু জল আর অন্ধকার/ কে আমাকে নিয়ে যাবে বান্ধবের কাছে/ হা কপাল আমার...)







মহাভারত ১৯৭১


সূর্য কখনও অস্ত যায় না, উদিতও হয় না। লোকে যখন মনে করে যে সূর্য অস্ত যাচ্ছে, তখন তা কেবল দিনের শেষে পৌঁছে পথবদল করে, আর তখন তার নিচে হয় রাত্রি, আর অন্যদিকে দিন। তারপর যখন লোকে মনে করে যে সূর্য প্রাতে উঠেছে, তখন তা কেবল রাত্রির শেষে পৌঁছে দিক পরিবর্তন করে, এবং নিচে দিন ও অপরদিকে রাত্রি হয়। বস্তুত সূর্য কখনই অস্ত যায় না।
-ছান্দোগ্য উপনিষদ









''ওঁ পিতা নোহসি, পিতা নো বোধি, নমস্তেহস্তু
মা মা হিংসীঃ। বিশ্বানি দেব সবিতার্দুরিতানি পরাসুব,
যদ্ভদ্রং তন্ন আসুব। সমঃ শম্ভবায় চ মায়োভবায় চ, নমঃ শঙ্করায়
চ ময়স্করায় চ, নমঃ শিবায় চ শিবনায় চ-

অনুবাদ : তুমি আমাদের পিতা, পিতার ন্যায় আমাদের জ্ঞান শিক্ষা দাও। তোমাকে নমস্কার। আমাকে মোহজাল থেকে রক্ষা করো, আমাকে পরিত্যাগ করো না। আমাকে বিনাশ করো না। হে দেব! হি পিতা! পাপ-সকল মার্জনা করো। যা কল্যাণ তা আমাদের মধ্যে প্রেরণ করো। তুমি যে সুখকর, কল্যাণকর, সুখ-কল্যাণের আকর, কল্যাণ ও কল্যাণতর, তোমাকে নমস্কার।।

পরীকথা

আমার এক মাসি পরী হয়ে গেল। সেদিন আকাশে চাঁদ ছিল না। জ্যোৎস্নাও ছিল না। এক ফালি মেঘ শরবনের ফাঁক দিয়ে আকাশে উঠে গেল। টুক করে হালকা অন্ধকার ঘিরে এল। আর বুড়ো মানুষের মত ঝিমুতে লাগল।

মাসি একবার জামগাছের নিচ দিয়ে, পেয়ারাতলার ধার দিয়ে পলকা একটা অরবরই গাছের ডালে পা ঝুলিয়ে বসল। বলল, অ খোকা, আমারে দেখতি পারতিছিস?
আমি মাসিকে সত্যি সত্যি দেখতে পাচ্ছিলাম। একটা ডুরে শাড়ি পড়েছে। চুলে বেঁধেছে হালকা লাল রঙের ফিতে। বললাম, না তো মাসি। তুমি কুথায়?
-সত্যি তুই আমারে দেখতি পারতিছিস না!
-দেখতি পাইলি তো কব।
মিথ্যে বললাম। যদি বলি দেখতে পাচ্ছি, তাহলে মাসির মন খারাপ হয়ে যাবে। মাসির মন খারাপ হোক, আমি কক্খনো চাই না। হে ভগবান, মাসি আমার হাসি খুশি থাকুক।
-হুম। তাইলে ক’তো, আমি কুথায়?
-দেখতে পারতিছি না।
-হি হি হি। আমি কিন্তু এখন অরবরই গাছে নাই। এই আমি উইড়া যাইতাছি জাম গাছে। জাম খাইবি তুই?
মাসি কিন্তু অরবরই গাছেই আছে। জামগাছে যাবে কিভাবে! একট দূরে জামগাছটা সাধুবাবার জটা চুলের মতো ডালপালা ছড়িয়ে আছে।
-হি হি হি। কী মজা। নে, এই জামগুলা ধর। পাইছিস? কুড়ায় পাইছিস?
- হ মাসি। খুব টসটসে হৈছে। আরো দুইডা দ্যাও। মাইজা মামারে দেব।
- তোর দিতি হবে না। মাইজাদা ফিরলি আমিই দেবখন। এই দ্যাখ, আমি এখন পেয়ারা গাছের পাতার উপরে বইসা পড়ছি।
মাসি কিন্তু অরবরই গাছেই আছে। পা দুটো আরেকটু চঞ্চল হয়েছে মাত্র। বললাম, অ মাসি। তুমি এই গাছে গাছে যাইতাছ ক্যামনে?
-ক্যান, উইড়া উইড়া।
-তুমার ডানা আছে?
এইবার মাসি একটুকু চিন্তিত হয়ে পড়ল। ফোস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল, নাহ। এখনো অয় নাই। জোসছোনা উডুক। তখন গজাইবে।

এ সময় দাদুর পদশব্দ পাওয়া গেল। খড়ম খুলে পা ধুচ্ছেন। বিড়ালটা লেজ উচিয়ে চারিদিকে ঘুরছে।
তালগাছের নিচ থেকে একটা শিয়াল উঁকি ঝুঁকি মারল। দাদু অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে আলো খুঁজতে লাগল। কোথাও কোন আলো জ্বলে ওঠেনি। দাদুর স্কুল বন্ধ। তবু স্কুলে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে গান ধরল-

আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি।
চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস, আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি।।

কয়েকটি ছেলেমেয়ে গুটি গুটি করে ছুটে এসেছে। গোল হয়ে বসেছে উঠোনে। ওরা অমৃত মধুর গলায় গলা মেলাচ্ছে-

ও মা, ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে,
মরি হায়, হায় রে-
ও মা অঘ্রাণে তোর ভরা ক্ষেতে আমি কী দেখেছি মধূর হাসি।।


মাসি অন্ধকারে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মেঘের মধ্যে কীঁ একটা খুঁজে চলেছে। কয়েকটি তারা উঠেছ। চাঁদ ওঠেনি। মাসি ফিস ফিস করে বলল, আমারে নিয়া যা। বাবা এক্খুনি ডাকপে।

দাদু ডাকল না। সন্ধ্যা সঙ্গীত শেষ হল। ঘরের কোনে একটি খোলা মাটির পিদিম জ্বেলে বড় মামা বসে আছে। মুড়ির কলসিটা খুঁজছে।
মাসি কিন্তু আমাকে না ধরেই ঠিক ঠিক ঘরের মধ্যে হেঁটে গেল। বড়ো মামাকে মুড়ি বের করে দিল। একদলা আখের গুড়ও দিল। মামা খেতে খেতে পৌষ সংক্রান্তির পিঠার কথা ভাবতে লাগল।


দিদিমা ভোর ভোর চাল কুটতে বসেছে। দাদু অনেক আগেই গাত্রোত্থান করে গাড়ু নিয়ে মাঠে গেছে। বড়ো মামা হা করে ঘুমোচ্ছে। দিদিমা ডাকল, রসো। অ, রসরঞ্জন।
মামা মুখ বন্ধ করে পাশ ফিরল মাত্র। পিঠের নিচে খড় বিছানো। উপরে হোগলার পাটি। মাসি বলল, আজ তোরে হলুদ দিয়া সিনান করাব।
এমন ঝামেলা হল- কারো ঘরে কাঁচা হলুদই পাওয়া গেল না। আনাজখোলায় মাটি খুঁড়ে দেখা গেল- হলুদগাছ পচে গেছে। ডালিম পাতা বেটে আমার সারা গায়ে মাখিয়ে দিল। বলল, তোর গা ডালিম ফুলের মত হৈবে। বললাম, মাসি তুমি মাকপা না?
-পরীদের মাখতি হয় না। মানুষদেরই মাখতি অয়রে বোকা। পরীরা ডালিম কুমারী।

সেদিন দুপুরেও মেজো মামার দেখা নাই। আজিমা ভাউতা শোলের মাথা দিয়ে ডাটা শাকের পাতা ভাজি করেছে। খুন্তি নাড়তে নাড়তে পথের দিকে বারবার তাকাচ্ছে।
বড়ো মামার কোন ভাবনা নেই। আজ তার মন খুব ভাল। পিঠা খেতে পারবে। কয়েকটা কাঁচা মরিচ তুলে আনল গাছ থেকে। শেষে দুটো ঝাল পিঠা খাবে।


বারখাদিয়ার মাঠের মাঝখানে বুড়ো বটগাছ। ঝুরি নেমেছে। একটা পাটখড়িতে একটা একটা করে পিঠা গেথেছে আজিমা। অনেকে খুব বড়ো বড়ো পিঠাখড়ি এনেছে। আমাদেরটা বেশ ছোট। বটগাছের নিচে হেলান দিয়ে রাখল। আর একটা ঝুরির গায়ে তেল সিঁদুর মেখে দিল।
বড়ো মাসিও এসেছে। আজিমাকে বলল, মা- কপিল আসে নাই?

আজিমা কিছু বলছে না। বিড় বিড় করে পিঠা বুড়িকে বিনতি করছে। সধবারা গেয়ে উঠল-

লক্ষ্মীদিঘা ধানের আগায় সাজাই দিলাম হুল,
এই না পউষে পিঠা খাইও না কৈরো মা ভুল।।
চইতরো মাসে আগুন জ্বলে প্যাটে বিষম জ্বালা
এইনা জ্বালার কুসুম তুইলা গইড়া দিলাম মালা।।
ওরে, রূপার মালা উইড়া যাওরে যাওরে দক্ষিণ দেশ
গোলা ভৈরা লক্ষ্মী দিও না করিও দ্বেষ।।
তোমার ধান তোমায় দিলাম গৈড়া চিতই পিঠা
তুমি খাইয়া তুষ্ঠ হৈলে আমরা পাইব মিঠা।।

মাঠের মাঝখানে একজন আধবুড়ো লোক বাক্স টকি দেখাচ্ছে। তার মাথায় খুব পুরনো একটা বাদুরে টুপি। বহুদিন ধোয়া হয়নি। জনা পাচেক ছেলে মেয়ে বাক্সের সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। আর আধবুড়ো লোকটা ভাঙা ভাঙা গলায় সুর ধরেছে- আইসা গেল তাজমহল।
তাজমহলের সামনে পরিখা। জল টলমল করে। বাসন্তিবালা মাসিকে জিজ্ঞেস করল, তাজমহলটা কোন দ্যাশে রে?
মাসি কিছু বলল না। বুড়োটা তখন সম্রাট শাহজাহানকে দেখাচ্ছে। আর মমতাজ মহলের কিসসা ধরছে। মমতাজ মহলের পিঠে দুটো ডানা। উড়ে আসছে মেঘের উপর দিয়ে। নিচে পরিখাঅলা তাজমহল। ঝিলিক দিয়ে উঠছে। তাজমহল মমতাজের মরণঘর।

খুব ভিড় জমেছে চক্রক্রীীড়ায়। ঘাসের উপরে পাটি বসিয়ে রাখা হয়েছে তিব্বত স্নো, মায়া পাউডার, মিস নূরজাহান লিপিস্টিক। চক্র ছুড়ে যার গায়ে গাথা যাবে সেটা তার। কে একজন স্টার সিগারেটের প্যাকেট জিতেছে। ভুর ভুর করে টানতে লাগল। খেলা জমে গেছে।

মাসির পছন্দ কাচের চুরি। বাসন্তি বাঁহাতে ছয়টি পরেছে। ঘুরয়ে ঘুরিয়ে দেখছে। মাসিকে বলল, নিবি নাকি?
-না। চুরি আমার ভাল লাগে না।
গোটা চার পাঁচজন লোক মাসির বাঁহাতটা শক্ত করে চেপে ধরল। বলল, আমাগো ভাল লাগে।

মেলার মধ্যে খুব হৈ চৈ লেগে গেল। যে যেভাবে পারল পালাতে লাগল। পিঠেখড়ি তছনছ হয়ে গেল। অন্ধকার নেমে এল। ওরা, বীরদর্পে মেলার মাঠ পেরিয়ে চলে গেল। যেতে বলল, বাঘ মার্কা জিন্দাবাদ। পাকিস্তান জিন্দাবাদ।

আমি বলছি, মাসি উড়াল দাও। উড়াল দ্যাও। উইড়া যাওগে।
মাসি কাঁদতে কাঁদতে বলছে, ডানা নাইরে। ডানা নাই। উড়াল দিমু ক্যামনে। আমার ডানা দুইডা আইন্যা দে।

অন্ধকারের কাছে বিনতি করছি, হে অন্ধকার- তুমি চান্দকে ডাইকা আনো। হে চান্দ- তুমি জোৎস্নাকে আসতি কও। তুমি মাসির পিডে ডানা গজাইয়া দ্যাও। হে পিঠা বুড়ি, তুমি মাসিকে ইবার সত্যিকারের পরী কৈরা দ্যাও। মাসিকে উড়াল করতি দ্যাও।

মেজো মামাকে পাওয়া গেল দেবাসুরের বিলে। হাঁটুজলের মধ্যে মামা একা একা ছুটাছুটি করছে। মুখে কোন কথা নেই। দাড়ি গজিয়ে গেছে। উদ্ভ্রান্ত চোখ। পথ হারিয়ে ফেলেছে।

ততদিনে কিছু লোকজন পোটলা পুঁটলি বেঁধে ফেলেছে। চোখ থেকে নিদ্রা উধাও। দাদু ভয়ে সিটিয়ে গেছে। ঘর থেকে বেরয় না। অর বরই গাছের গায়ে হেলান দিয়ে বসে আছে মেজো মামা। মাথাটা বুকের কাছে ঝুলে পড়েছে।
বাসন্তিবালার বাবা মামাকে বারবার জিজ্ঞেস করছে- অ কপিল, কতো- কি করি অখন?
মামা নির্বাক। দুপা ছড়িয়ে দিয়েছে। হাঁটুর চামড়া উঠে গেছে। মাছি ভন ভন করছে।
বাসন্তিবালার বাবা কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলছে, অ কপিল- কি শুইন্যা আইলি ঢাকা থেইক্যা। আমাগো আবার দ্যাশ ছাইড়ে হৈব? আর কুনো উপায় নাই? অ কপিল, কথা করে বাপ।

তেতুলিয়ার কেশির মা খুব বড় গুণিন। কাঠ মালতি গাছের নিচে মেজো মামার মুখে হাত বুলিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। অনেক ঝাড় ফুঁক করেছে জীবনে। কখনো ব্যর্থ হয় নাই। বড়মামাকে কেশির মা বলল, অরে লৈয়া যা।
বড় মামা চিন্তিত হয়ে বরল, কপিলের কী অইবে?
- জানি না।


মধুমতির উপর দিয়ে খোলা নৌকায় বাসন্তিবালার বাবা মেজো মামাকে ধরে আছে। বড়ো আশায় বারবার বলছে, কথা ক। কথা ক, অ কপিল।

এই সময় একটি লঞ্চ দূর থেকে ভটভট করে আসতে দেখা গেল। দোতলার রেলিংএ কিছু লোকজন দাঁড়িয়ে আছে। একটা শালু কাপড়ে লেখা- জাগো বাঙালী জাগো। বড় মামা বিরক্ত হল। ঢেউ দুলিয়ে দিচ্ছে ছোট নৌকাটাকে। তাল সামলানো মুশকিল। ঢেউয়ের আড়াআড়ি নৌকাটা তুলে দিল। বলল, কাগু, কপিলরে ধইরা রাইখো ঠিক কৈরা।
হঠাৎ করে মেজো মামা লাফিয়ে উঠল। দাঁড়াল সোজাসুজি। মাথা খাড়া করে দুহাত ছড়িয়ে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে চেঁচিয়ে বলল, মুজিব ভাই...।

লঞ্চের বাইরে সাদা পাঞ্জাবী দীর্ঘদেহ চশমা পরা পাইপ হাতে কে একজন জলদ গম্ভীর স্বরে বলে উঠলেন- জয় বাংলা।

সেদিন সন্ধ্যার আগেই ঝকঝকে চাঁদ উঠল। ফুল ফুটল। জোৎস্না ভরে গেল চারিদিক।

মেজো মামা বাসন্তিবালার বাবা বড়ো মামা বুড়ো দাদু আজিমা - আমাদের সবার পিঠে সত্যি সত্যি এবার ডানা গজিয়ে গেল। এই ডানা বেশ মজবুত। ঝড়ের মধ্যে উড়াল দেওয়া যায়। হাসতে হাসতে ঢেউয়ের সমুদ্রও পাড়ি দেওয়া যায়। আর কোন ভয় নাই।






নদীজলে ভেসে আসে ডাবের খোলস নাকি মানুষের মাথা
ভেতরে শিংমাছ, সাপ, বাইল, কাদা - কি ভেদ, কে বোঝে আজ
সম্বিতহীন বর্ষার জলধারা অবিরাম আচ্ছন্ন করে নামে
রক্তবর্ণ মেঘের ইশারায় ... ...
(-তুষার গায়েন, একাত্তরের খনি, বৃষ্টির অন্তরত্রাস)


একটি হত্যাকাণ্ডের নিষ্পত্র ডানা

ছোট পিসির ঘরটি ছোট। বড় একটি ঘরের একপাশে বাড়তি তোলা চাল। মাটির মেঝেতে হোগলার পাটি আর কয়েকটি কাঁথা বিছানো। ছোট বোনটি ঘুমিয়ে পড়েছে। দাদা মুড়ি চিবুতে চিবুতে বলল, খাবি?
সারাদিন ভাত খাওয়া হয়নি। পিসি ভাত তুলে দিয়েছে। বলল, কাল চাল কুটব। পিঠা খাবি।

মা বোন দুটির পাশে একটু চোখ বুজেছে। বড়দিদি পিসির সঙ্গে রান্না ঘরে। বুড়ি দিদি ডাল বাছছে পা ছড়িয়ে। বলছে, পিসি, ডালের বড়ি আছে? পিসি হেসে মাথা নাড়ল। আছেরে মাইয়া। আছে। সব আছে।

উঠোনের মাঝখানে মাটির প্রদীপ জ্বেলে পিসে মশাই নৌকাটির গায়ে হাতুড়ি বাটাল চালাতে শুরু করেছে। আর কিছুদিনের মধ্যেই নৌকাবাইচ। বাবা হাই তুলতে তুলতে বলল, বেশ বড়ই মনে হচ্ছে।

পিসেমশাই হেসে উঠল। হাতুড়ি ঠুক ঠুক করে বলল, হ্যা। বেশ বড়ই হবে। এত বড় বাইচের নাও- কেউ আগে দ্যাখে নাই। কেউ পারবে না এর সাথে।

প্রদীপটা আরও উসকে দিয়ে বলল, সারা জনমের এইডাই হাউস। সবচে বড় নাও বানামু। বাইচে নামমু।
চাঁদের টুকরো আলো এসে পড়েছে আধুবুড়ো পিসেমশাইয়ের গালে। গভীর তৃপ্তির ছাপ লেগে আছে। জলের শীতল হাওয়া ভেসে আসছে। আসছে ঢাকের মৃদু বোল। কে একজন নারীকণ্ঠ চোখের জলে ভেসে ভেসে গান গাইছে। মৃত স্বামীর প্রাণ দাবী করছে সুরে সুরে। মা বলল- এইটা রয়ানী গান। পিসি কপালে হাত ছোঁয়াল। ঠাকুর, ঠাকুর। রক্ষে করো সবাইকে।


প্রভাত সময়কালে
শচীরাণীর আঙিনা মাঝে
কার গৌর নাচিয়া বেড়ায় রে-

প্রভাতে উঠিয়া ডাকে শচী মাতা। শচীমাতা বিমলানন্দে সবাইকে ডাকছেন। ঘুমিয়ে থাকা যায় না।
উঁকি দিল একটি সুখী সুখী মুখ। কপালে তিলক। চুল চূড়ো করে বাঁধা। পরণে কমলার শাড়ি। নাকে রসকলি। কাকে বলল, হ্যাগো ছোট বৌ, আমার রাধামাধব দ্যাও।
পিসি উঠোনে গাই দোয়াচ্ছিল। বলল, যাও না ঠাকুরঝি তোমার রাধামাধবরা সব ঘরের মৈদ্যে। যাও না ঘরের ঢুইকা।

ছোট বোনটির ঘুম টুটে গেলেই কেঁদে ওঠে। আজ কিন্তু কাঁদল না। মুখের মধ্যে তর্জনিটি পুরে চুষতে চুষতে বড় বড় করে তাকাল। মা উঠে বসেছে। মাথায় ঘোমটা সামান্য টেনে দিল। ঠাকুরঝি বলে উঠল, আমি তোমাগো কমলা ঠাকুরঝি, বউমণি। আমার রাধামাধবদের দ্যাও। কীর্তনের সময় চৈলা যায়।
দাদা বড়দিকে ঠেলে ডাকল, দিদি ওঠ। দিদি ওঠ। দিদির আগে মেঝদি- বুড়িদি উঠে পড়ল। তৃতীয় বোনটি দৌড়ে ঠাকুরঝির খঞ্জনিটি হাতে তুলে নিল। ঝুন ঝুন করে বাজানো শুরু করল। ঠাকুরঝি হেসে দিল। বলল, চল, চল- বেলা বয়ে যায়।
ঠাকুরঝি খঞ্জনি বাজাতে বাজাতে গান গাইতে শুরু করল।

একে গোরার নবীন বেশ
মুড়াইয়া চাঁচর কেশ
সোনার অঙ্গ ধুলাতে লুটায় রে-

তার পেছনে আমার ছয় ভাই বোন। উঠোনে শান্ত আলো। নম্র বাতাস। পিসি গাই দুয়ে রান্না ঘরে ঢুকে পড়েছে। উঠোন নিকোন হয়েছে সূর্য ওঠার অনেক আগেই। ঘরের চালে এক কুড়ি জালালি কবুতর গলা ফুলিয়ে বলছে, বাক বাকুম, বাক বাকুম।


শিউলি গাছে ফুল ফোটেনি। কদম গাছে কদম ফুটেছে। বেলি ফুলে সাদা হয়ে গেছে। ঠাকুরঝি প্রণাম করল শিউলি গাছটিকে। কদম গাছটিকে। নত হয়ে বেলি ফুলের পাতা কপালে ছোঁয়াল। বুড়িদি ফুল তুলতে শুরু করে দিল। তৃতীয় বোনটি নাকে চেপে ধরে গন্ধ শুকছে। একদম ছোটটি বলছে, দিদি, আমালে দে। দিদি, আমালে দে। আলু থালু চুল। পরীর মত পোষাক পরা। লাফিয়ে লাফিয়ে বলছে, আমালে দে না। আমালে দে না।

বড়দি নীচু স্বরে গাইতে গাইতে ছোট বোনটির হাতে বেলি ফুল তুলে দিল। হাতে না রেখে কোচড়ে রাখল। জবা এল। টগর এল। অপরাজিতা এল। দাদার হাতে কদম ফুলের তোড়া। সূর্য উঠছে পূব দিক থেকে। ধীরে ধীরে। ঠাকুরঝি সূর্য প্রণাম করে নিল। এই কুড়ি ঘর বাড়িটির দুয়ারে দুয়ারে ঘুরে প্রভাত সঙ্গীত পৌঁছে দিয়ে চলেছে। সব ঘর থেকে ছেলে মেয়ে বেরিয়ে এসেছে। রাধা মাধবের মন্দির নেচে গেয়ে মুখর করে তুলল। ঘাটে জল থৈ থৈ করছে। কোন নৌকা নেই। দূরে ধান ক্ষেত-ঘন সবুজ হয়ে উঠেছে। নূয়ে পড়তে শুরু করেছে পাতা। ঠাকুরঝি এই ঘাট, জল, ধানক্ষেত, আকাশ, মাটি, জল ও হাওয়াকে প্রণাম করল। গানে গানে জেগে উঠল মাটির পথটি। খাঁ বাড়ির বড়ো মিয়া হেঁটে যাচ্ছিলেন। একবার দাঁড়িয়ে গেলেন। মুখে হাসি। নদীটিও বাদ গেল না। সূযের্র সাথে সবাই জেগে উঠল।

শোনোনি গো শচীমাতা
গৌর আইল প্রেমদাতা
ঘরে ঘরে হরির নাম বিলায় রে-


বাবা বাড়ি নেই। ভোররাতে পিসে মশাইর সঙ্গে গভীর বিলে চলে গেছে। মাঝিগাতির ওহাব মুন্সী খবর দিয়েছিল- দিনের বেলা পুরুষদের সরে থাকতে হবে। বুড়ো-বুড়ি, মহিলা ও শিশুদের কোন অসুবিধা নেই।

মা খাচ্ছে খুব ধীরে ধীরে। পিসি বলছে, খাও বউ, খাও। দুপরে সোনামুগ রানবোনে। সোনামুগ দাদা ভালবাসে।
বড়দি মেজদি নারিকেল কোরা নিয়েছে ভাতের সঙ্গে। একখণ্ড মুছি গুড়। আর গরম গরম দুধ। দুতিনটে মাছি উড়ে এসে ভন ভন করছে। ছোট বোনটি খাওয়া রেখে একটি মাছির পিছনে ছুটতে শুরু করেছে।

বাড়ির বউ-ঝিরা ভিড় করে এসেছে। মাকে দেখছে। মা একটু লজ্জা পেয়েছে। ঘোমটা টেনে দিল। মাঝ বয়েসী হারাধনের বউ বলল, এ যে লক্ষ্মী ঠাইরেনগো। শ্যামলী নামের মেয়েটি ছুটে গেল তাদের ঘরে। সুগন্ধি তেলের শিশিটা আনতে হবে। মায়ের চুল বেঁধে দেবে। দুটি বউ ঢেঁকির দিকে ছুটে গেল। চাল কুটে দেবে। দিদিরা উঠোনে এক্কা দোক্কা খেলতে চলে গেল। মেজ দিদি একবার বলে উঠল, বাবা কখন আসবে?

কে যেন ভাঙা ভাঙা গলায় ডাকল, কেডারে? নতুন মানুষ কেডা যায়?
ছোট মন্দির। চালের উপরে অপরাজিতার ঝাড়। ফুটে নীল হয়ে আছে। ভেতরে হরি ঠাকুর। শান্ত চোখে চেয়ে আছেন। একটি ঢোল, করতাল, কাসি আর মৃদঙ্গ। গান শেষে সাজিয়ে রাখা হয়েছে।

এর মাঝে জড়সড় হয়ে শুয়ে আছে খুনখুনে এক নিলয় বুড়ি। শনের মতো চুল। পরনে শাদা ধুতি । দুচোখ বন্ধ। শিয়রের কাছে একটি বিড়াল। কান খাড়া হয়ে উঠল। আর একটি টিয়া পাখি- একটি কাঠির উপরে বসে আছে। বলছে, হরি আইছে, বসতি দাও।

টিয়া পাখি উড়ে বুড়ির কানের কাছে বসল। বুড়ি চোখ বন্ধ করে বলল, অ হরি, কবে আইলি। বিড়ালটি পায়ের কাছে গুটিশুটি মেরে ঘুমিয়ে পড়ল।


হাপরটা একবার ফুলে উঠছে- আরেকবার চুপছে যাচ্ছে। কয়লার মধ্যে আগুনের আঁচ ফিনকি দিয়ে ঊঠছে। তার মধ্যে কি একটি গুঁজে দিয়ে কেলে কামার বলল, বোজলা, আমরা হৈলাম এই লোহার লাহান। আগুনে ফেলাও। বাড়ি মার। যা মঞ্চায় তাই গড়াও। লোহার নিজির কুনো হাউস নাইকা। হা হা হা।

তিনটা কুকুর উঠোনের মাঝ দিয়ে হাউ হাউ করতে করতে দৌড়ে গেল। পশ্চিম দিকে আকাশে কালো ধোঁয়া দেখা গেছে। কেলে কামারের বিড়িটা ঠোঁট থেকে খসে পড়ল জ্বলন্ত কয়লার মধ্যে। দপ করে আগুন জ্বলে উঠল। সাগরেদ লালচাঁনের হাত থেকে হাতুড়িটা নিচে নেমে এল না। দড়ি টানা থেমে গেছে। হাপরের মুখ থেকে ফস-স করে শব্দ হল। এক ঝাঁক কাক চক্রাকারে উড়তে শুরু করেছে।

ঢেঁকিতে পাহার থেমে গেল। পিসির মুখটা বন্ধ হয়ে গেছে। মা শাকভাজি মেখে নিয়েছে। খুব ধীরে ধীরে পোড়া মরিচ ঘষচে থালার উপরে। মাথাটা একদিকে সামান্য হেলানো। শেফালি ঢেঁকির নোট থেকে হাত উঠিয়ে বলল, খুড়িমা- যাইয়া দেহি, কী হৈচে।

শেফালি দৌঁড়ে বেরিয়ে গেল। পায়ের ধাক্কায় দুধের ঘটি উল্টে গেল। মায়ের খাওয়া থেমে গেছে। শাকে ভাতে মাখামাখি। পিসি সোনামুগের ডালাটা নিয়েই বেরিয়ে গেল। যেতে যেতে বলল, দেহি, আমার ধলি গাইটা গেল কই?

মদন মোহনের বুড়ি বউটা অন্ধকার কোনে একটি পুটলী গোছানোর চেষ্টা করছে। ছেলে সাধনকুমার গতকাল কাজুলিয়ার হাটে গিয়েছিল। ফেরেনি। রূপোহাটি শ্বশুরবাড়ি গিয়ে থাকতে পারে। কচি বউটা সারারাত ছটফট করেছে। এক ফোঁটা ঘুমায়নি। এখন কাঁদতে বসেছে। মদন মোহনের বউ জোরে জোরে বলছে, অলো অবাগীর বেটি, গুছাইয়া ল। দেরি করিসনা। তর শউর আইতাছে।

একহাত গোমটা টানল সাধনকুমারের বউ। টিনের সুটকেসটা টানতে গিয়ে মাটিতে পড়ে গেল। ছড়িয়ে পড়ল পুঁতির মালা, একটা তিব্বত স্নো। একটা আড় বাঁশি। আর কৃষ্ণের শতনাম পাঁচালী। তিনটি শুকনো পুইপাতা। আরেকবার সত্যি সত্যি তার বুক কাঁপিয়ে কান্না পেল।

শিবুর মা দৌড়ে এল। কোলের ছেলেটা ধপ করে নামিয়ে দিয়ে ছুটল- বড় ছেলে শিবুকে খুঁজতে। শিবুর এক চোখ কানা। কিছু তার মনে থাকে না। হাঁটতে হাঁটতে যেখানে যায় সেখানেই থাকে। ফিরে আসতে পারে না। বলে, তুমরা জানো- আমার বাড়ি কুথায়? তুমরা জানো আমার বাড়ি কুথায়? খ্যান খ্যান করে বলতেই থাকে। কোন লোকজনকে চিনতে পারে না। কেবল মাকে পেলে হাসে। গো গো করে হাসে। মাথায় জটা নেমেছে। কোলের ছেলেটা মদন মোহনের মায়ের কাছে হামাগুড়ি দিয়ে গেল।

হরিপদর বাবা বারান্দায় খুক খুক করে কাশছে। একখানি ময়লা নেংটি পরা। খালি গা। হাড় জিরজিরে। সাদা দাড়ি আর সাদা চুলে মাখামাখি। থালায় কিছু মুড়ি আর গুড়। মাছি এসে বসেছে। হাতড়ে হাতড়ে ঘটিটা হাতে নিল। কাঁপা কাঁপা হাতে উঁচু করে তুলে মুখের কাছে আনল। এক ঢোক জল ছিল। মুখের মধ্যে যতটুকু গেল- তার চেয়ে বেশি বাইরে পড়ে গেল। দাড়ি আর বুক ভিজে গেল। চেঁচিয়ে উঠল, অ মালতি মালতি, এক ঘটি জল দে রে।

ঘরের মধ্যে কেউ নেই। ছড়ানো ছিটানো দুএকটা শাড়ি, চালের সরা আর কাঁথা ও বালিশ। বাইরে কুকুরটি ঘেউ করে উঠল।

মেজো মণ্ডলের বউ রতœবালার ব্যথা উঠেছে। ভোররাতেই আমেনা বেওয়া এসে পড়েছে। হালকা গরম তেল মালিশ করছে। রতœবালা চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। বড় বড় শ্বাস ফেলছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। বড়ো মেয়ে শান্তি দরোজার কাছে দাঁড়ানো। তাকে ঘিরে আছে আরও চারটি বোন। রতœবালা ফ্যাস ফ্যাস করে বলল, যা মা। অগো লৈয়া যা। দেরী করিসনি।
-কার লগে যামু?
-হগগলেই তো যাইতাছে। দেরি করিসনি। যাগো পাবি- তাগো লগেই যা শান্তি।
আমেনা বেওয়া ওদের হাত ধরে তাড়াতড়ি বাইরে নিয়ে এল।

উঠোনে তখন মানুষের ছুটোছুটি কোলেকাখেঅগ্রেপশ্চাতেনিকটেদূরত্বে মানুষ ছুটে চলেছে উর্ধ্বশ্বসে ছুটছে জননীরা আঁচল খসে পড়েছে পোটলাপুটলি নেই কে একজন গরুটিকে নিতে চেষ্টা করছে তাকে ধাক্কা মেরে এগিয়ে গেল কারা যেন পথের উপর গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে তালগোল পাকিয়ে উঠে বসে ছুটল তাদের পিছনে গরুটি দড়ি ছেড়া হাম্বা হাম্বা করে ডাকছে ব্যা ব্যা করে ডাকছে একপাল ছাগল পাখা ঝাপটাচ্ছে ঝাকে ঝাকে কবুতর ..

আমিনা বেওয়া ওদেরকে ছেড়ে দিয়ে বলল, ফি আমানুল্লাহ।
শান্তি চারটি বোনকে নিয়ে ছুটে গিয়ে আবার ফিরে এল। জানতে চাইল- তুমি যাবা না?
-না। আমি গেলি তর মারে দেখপি কেডা।

তখন অনেক কাজ। তার বাড়ির নিজের ছেলেটা মেয়েটা অথবা স্বামীটা কি করছে তা চিন্তা করার সময় নেই। রান্না ঘরে ঢুকে গেল। চুলায় গরম পানি চাপাল। নতুন শিশুটি আসবে তার হাত দিয়ে। উঁচু করে ধরবে । প্রথমবারের মতো শব্দ করে উঠবে। শব্দটি কান্নার। পৃথিবীর প্রথম আলোটি দেখবে। এই আলোতে বড় হয়ে উঠবে। আসমান সমান হয়ে উঠবে। তিনি কোন জন কে জানে। হিন্দু কী, মুসলিম কী নাসারা কী কাফির কী সাধু কী দুশমন কী ফেরিশতাৃতাকে বরণ না করে কি যাওয়া যায়? হাসল আমেনা বেওয়া

আর তক্ষুণি মন্দিরের ভিতরে বিড়ালটি নড়ে চড়ে বসেছে। টিয়া পাখি দুবার ঠোঁট ঘষল। গুটি শুটি পায়ের শব্দ হল। নিলয় বুড়ি বলে উঠল, অ হরি, আইলি।

বাতাসে ঘর পোড়া গন্ধ। আগুনের তাপ উড়ে আসছে। অসংখ্য বজ্রের শব্দ শোনা যাচ্ছে। আকাশটা ফেটে পড়ছে। তীক্ষ্ণ দাঁত গৃধিনীরা মুখ ব্যাদান করে চিৎকার করছে।

তখন ধুলিবৃষ্টি রক্তবৃষ্টি ও উল্কাপাত হল, যক্ষ রাক্ষস ও পিশাচগণ অন্তরীক্ষে কোলাহল করে উঠল, ঘোর দর্শন কবন্ধসকল নৃত্য করতে লাগল। আর হরি এসে অশক্ত অক্ষম অশিতিপর বুড়িটার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল।

নদীতে তরঙ্গ উঠিয়াছে। নবজলধারা খল খল করিতেছে। খরসান বাতাস।

তরুণতর বড় দাদার কাঁধে আজ বাবার কাঁধের বড় পোটলাটি। আর মেজ দিদির কাঁধে দাদার পোটলাটি। বড়দিদি সেজ বোনটিকে নিয়ে জলে ঝাপ দিয়ে পড়ল। মা হায় হায় করে উঠল। ছোট বোনটিকে কোলে নিয়ে বড়দিদিকে টেনে ধরেছে। জলে ভেসে যেতে যেতে একাবার আকাশের দিকে তাকাল। ছোট বোনটি চোখ বন্ধ করে ফেলেছে।

এ সময় খাঁ বাড়ির বড়ো মিয়া আর সনাতন মিস্ত্রির সবল হাত এগিয়ে এল। ওদেরকে জল থেকে টেনে তুলল। তারপর আবার ওরা টুপ করে ঢুকে পড়ল পাট ক্ষেতে। বলে উঠল, মরে গেলিও কেউ কিন্তু শব্দ করতি পারবা না।

পাটক্ষেতে তখন অনেক লোক। কে মেয়ে কে পুরুষ ঠিক নেই। মাটি আকড়ে পড়ে আছে। কেউ কারো দিকে চেয়ে নেই। কোন ফাঁকা নেই।

.. পাট ক্ষেত পেরিয়ে.. পাশের ধানক্ষেতে জলের ভিতরে ঢুকে যেতে যেতে ..নাক জাগিয়ে .. মাছের ঘ্রাণ নিতে নিতে .. বয়স্ক সাপের মতন উৎসাহী মৃত্যুর দিকে চেয়ে চেয়ে .. কয়েকটি সাদা বক উড়ে উড়ে এসে মাথার উপরে বসতে বসতে ..জলের দিকে কেঁপে কেঁপে .. শব্দের বৃষ্টির মধ্যে নেয়ে নেয়ে ..

সবাই এই প্রথম আকাশ এবং মাটির মধ্যকার দূরত্ব ঘুচিয়ে লাফিয়ে দাপিয়ে উঠল। ভেঙে পড়ল শান্ত শীতল সবুজ পাট গাছ। ছিন্ন ভিন্ন হল পাতা। নদীর মধ্যে গড়িয়ে গড়িয়ে মিশল উষ্ণ জলধারা। কালো জল শাদা জল লাল জল মিলে গেল ধীরে ধীরে। কেউ কোন শব্দ শুনতে পায় নি। কারো মুখ থেকে কোন শব্দ উচ্চারিত হয় নি। সবাই ছিল মৌন- মুক।

মাছির ডানায় ভর করে রাত্রি এল। সারি সারি গাছগুলো স্তব্ধ। বাতাসও কংকালের মতন নিষ্পলক। অসুস্থ দগ্ধ চাঁদ ধুকতে ধুকতে একটু একটু করে ঝুলে পড়েছে। আধখানা আলোর মধ্যে পোড়া মাংসের গন্ধ আর অনাদি অনন্ত ছাই বেয়ে কখনো হেঁটে কখনো খুড়িয়ে খুড়িয়ে কখনো হামাগুড়ি দিয়ে যে অস্থানে পৌঁছে গেল মা আর তার একপাল ছেলে মেয়ে সেখানে একটি শিউলি গাছের তলায় একটি কাঁসর ঘণ্টা পড়ে আছে- আর আছে ভাঙা খঞ্জনিটি আর সুধামুখ রমনীয় হাত- শক্ত দড়ি দিয়ে বাঁধা- চুপ চুপ করে গেয়ে উঠছে- প্রভাত সময়কালে/ শচীরানীর আঙিনা মাঝে / কার গৌর নাচিয়া বেড়ায় রে-

উঠোনের এখানে ওখানে কয়েকটি দড়ি ছেড়া গরু, একটি বকনা বাছুর লাফিয়ে উঠতে গিয়ে থেমে আছে। আর কালো কালো ছাগলগুলো- ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে শেফালি, শান্তি অথবা সাধনকুমারের কচি বউটি- ছিটকে পড়েছে হাত থেকে এক কৌটা সিঁদুর।
কিছু হাঁস জলে ভাসছে। কিছু ঘাটের উপরে। কিছু বাড়ি ফেরার পথে। পিঁপড়ের সারি ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।

মায়ের হাত ধরে আছে শিবু। বিস্ফোরিত একটি মাত্র চোখ। লাল হয়ে আছে। জাম গাছ পেরিয়ে উঠোনে কেবল এই নুলো ছেলেটিকে নিয়ে পা রেখেছে।

হাপরের আগুন টেনে নিয়েছে কেলে কামারের পা। শাকরেদ লালচাঁনের বুকের নিচে হাতুড়ি।

বারান্দা থেকে ছিটকে পড়েছে হরিপদর বাবা। মুখটা আরেকটু ছোট ছোট লাগছে। কাঁসার থালার পাশে এক খণ্ড গুড়।
কালো হয়ে গেছে বাশেঁর খুঁটি। কয়লা আর ছাইয়ের মধ্যে রতœবালা- পাশে নির্ভার আমেনা বেওয়া- হাসি হাসি মুখ। তার হাতের ভিতরে একটি নতুন শিশু। চোখ বন্ধ। মাথার পিছন দেখে বোঝা যায় তার এক মাথা কালো চুল হয়েছিল।

খুব কালো হয়ে পড়ে আছে একজন পুরুষ কি নারী কিশোর কি কিশোরী কি হিন্দু কী মুসলিম কী নাসারা কী কাফির কী সাধু কী দুশমন কী ফেরিশতা শিয়রে টিয়া পাখি পদতলে একটি বিড়াল আর বুক জুড়ে যে শিশু অথবা বালক অথবা

গোপালকিহরিকিযীশুকিরহিমকিসাকারকিনিরাকারকিক্রুশকিবৃক্ষকিপ্রাণীকিহাওয়াকিরোদকিঅতীতকিবর্তমানকিভবিষ্যৎ







নির্বাসন শিখিনি, মৃত্যু কবজ

-বল,পাতা।
-আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল পূর্বা।
বললাম, বল, পাতা।
এবার গন্ধরাজের পাতাটিকে দেখল। হাত বাড়িয়ে দিল। ধরল। এই পাতাটি ছুঁয়ে দেখার জন্য প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে কান্নাকাটি শুরু করে পূর্বা। বারান্দায় ছেড়া পাতায় ভরে থাকে। কিছুটা মুখে দেয়। মেরী বলে, কি সব আজে বাজে জিনিস শেখাচ্ছ।
একদিন গন্ধরাজ ফুল ফুটল রাতে। জানালা দিয়ে ভুর ভুর করে গন্ধ ভেসে আসছে। অনেক দূরে বাজছে সেতার। রবি শঙ্কর। পূর্বা জানালার রড ধরে বলতে লাগল, পা আ তা আ। পা আ তা আ। ঝুঁকে ঝুঁকে বলতে লাগল। ওর মা রান্না রেখে ছুটে এল। বলল, কি হয়েছে? পূর্বা মায়ের দিকে ফিরে শোনাতে লাগল, পা আ তা আ। পা আ তা আ।
মেরী একটি ফুল ছিড়ে বলল, ফুল। ফুউল।
পূর্বা বলল, পা আ তা আ। পা আ তা আ।

যেদিন ফুল ফোঁটা শেষ হয়ে গেল, সেদিন পূর্বা হাউ মাউ করে কান্নাকাটি করল। বলল, ফুউল। ফুউল।
এদিন থেকে আমার বাগানে বারমাসী ফুলের চাষ করে দিলাম। আর আমার সহকর্মী ফারুখ আহমদ একবাক্স মৌমাছি এনে দিল। বারান্দায় গ্রীলের ভেতর দিয়ে মৌমাছি আসে আর যায়। মেরী খেপে অস্থির। মেয়েকে বারান্দায় আসতে দেয় না। দরোজা বন্ধ করে রাখে। বলল, মেয়েকে কামড় না খাওয়ালেই কি নয়?

আমি প্রতিদিন মৌমাছির বাক্স খুলি। বাচ্চা মৌমাছিগুলোকে একটু হাওয়া খাওয়াই। বাক্সটা পরিস্কার করি। মাঝে মাঝে মধু তুলি। পূর্বা চেটে পুটে খায়। বলে মিত্তি। মিত্তি দাও। কিন্তু বাক্সর কাছে যেতে পারে না। জানালা দিয়ে দ্যাখে, মৌমাছি বাক্স থেকে উড়ে যাচ্ছে। আবার ফিরে আসছে। উড়ে যাচ্ছে। ফিরে যাচ্ছে। একদিন শুনি পূর্বা জানালা দিয়ে বলছে, মৌমাতি, মিত্তি দ্যাও। মৌমাতি মিত্তি দ্যাও।
মেরী ওকে মধু দেয়। আর পূর্বা খেতে খেতে বলে, মৌমাতি মিত্তি দ্যাও।
বর্ষার দিনে মৌমাছি বাইরে যেতে পারে না। বাগানে ফুলের গাছ এলামেলো হয়ে পড়ে। আগাছায় ঢেকে যায়। বাক্স থেকে বেশি বেশি মরা মৌমাছি বের করি। মুখে দুশ্চিন্তা বাড়ে।

একদিন শ্রাবণের বৃষ্টির দিন পূর্বা আমার ঘুম ভাঙাল। বলল, বাবা তলো। বালান্দায় তলো।
ওর মা ঘুমিয়ে আছে। আমরা দুজন বারান্দায় এসে পড়েছি। মৌমাছির বাক্সের সামনে অনেক মৌমাছি পড়ে আছে। আর ভিতরে কোনো শব্দ নেই। পূর্বা বাক্সর গায়ে হাত বুলিয়ে দেখল। কান পেতে শুনল। তারপর আমার হাত ধরে ঘরে টেনে আনল। বলল, বাবা মিত্তি দ্যাও।
ফ্রিজ থেকে রসগোল্লা বের করে দিলাম। ও মাথা নেড়ে বলল, না। না। অই মিত্তি না।
মধুর বোতল দেখিয়ে দিল। একটি বাটিতে মধু দিলাম। ও দৌঁড়ে বারান্দায় চলে এল। মৌমাছির বাক্সের সামনে মধুর বাটিটা রাখল। বাক্সের কাছে মুখ রেখে বলল, খাও। মিত্তি খাও। মৌমাতি, মিত্তি খাও।

সুড় সুড় করে মৌমাছি বের হল। মধু খেতে শুরু করল। পূর্বা নাচতে নাচতে বলল, বাবা, মৌমাতি খাতথে। মৌমাতি খাতথে।

এই থেকে পূর্বা অতন্দ্রিলার সঙ্গে মৌমাছির খুব ভাব। এরপর ধীরে ধীরে টুনটুন পাখির সঙ্গে ভাব হল। আমাদের বেগুন গাছে বাসাও বানাল। কোত্থেকে একটি গরু এসে আমাদের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে যায়। জানালার দিকে ফিরে বলে, হাম্বা।
পূর্বা হাসতে হাসতে বলে, গলু। গলু।

হামিদ খান লাঠি ঠুক টুক করে একদিন আমার বাসায় এল। বললাম, কী খান সাহেব, ধানক্ষেতে কোনো সমস্যা?
হেসে বলল, না।
-তাহলে?
-আমার নাতিটারে দ্যাখতে আইলাম।
পূর্বা ততক্ষণে ভেতর থেকে সাড়া পেয়ে চলে এসেছে। হামিদ খানকে নিয়ে বারান্দায় চলে গেছে। বলছে, মৌমাতি। মৌমাতি মিত্তি খায়।
হামিদ খান ফোকলা দাঁত বের হাসে। দুজনে কলা খায়। আর মৌমাছিদের সঙ্গে গল্প করে। মুড়ি খায়। পেয়ারা খায়। কাউ ফল খেতে থেকে বলে, নাতিলো, আমালে মিত্তি দেবা না?
-তুমি কি মৌমাতি?
-মৌমাতির দাদু।

বলেশ্বরের পাড়ে লাহুড়ী গ্রাম। আমবাগান-বনবাগান- কলাবাগান। মাফলারের মত গোপাট। তারপর মাঠ। মাঠের মধ্যে ধান- সাক্করকোরা। বুড়ি পাগলী। মন্তেশ্বর। এরপর ছোট বাড়ি। দেখে বলি, অবনী- বাড়ি আছ?
পূর্বা বলে, ও বাবা, অবনীর বাড়িটা ভাল। দৌড়ে ভিতরে চলে গেল।
মিলাদ পড়ানো শেষ। নতুন ঘরে হুড়মুড় করে লোকজন ঢুকতে গেল। হামিদ খান দরোজা আগলে দাঁড়িয়ে আছে। বললে, না।
-কেন না?
-আমার নাতনী আগে যাইবে।
- আপনের নাতনী? নাতনী পাইলেন কৈ? মাইয়া আছে নি!
হামিদ খান বিড়বিড় করে কি সব বলতে লাগল। কেউ শুনতে পায় না। মুখটা ঘেমে উঠেছে। সবাই হাসে। ইমাম সাবের নামাজপুরে সালাম সিকদারের বাড়ি দাওয়াত। খামোখা দেরী। পুলিন সা লক্ষ্মীদিয়া থেকে আসতে দেরী করেছে। হাতে একছড়া শবরী মালতী ধান। বরল, হামিদরে- এইডা তর নতুন দর্জায় ঝুলাইয়া দে। দুগ্গা দুগ্গা।

কৈতরবানু ঝপাঝপ কয়েক খোলা চিতই পিঠা নামাল। ছোট্ট থালায় দিয়েছে গুড় মুড়ি। পূর্বা আঙুল দিয়ে লেপটে নিয়ে মুখে দিয়েছে। হাসিতে ভরে গেছে মুখ। কৈতর বানু বলে, মিডা লাগে?
-হুম।
একটা পিঠা ধরতে গিয়ে ছ্যাতা লেগেছে হাতে। লাফিয়ে উঠেছে। বলছে, গরম। গরম। কৈতরবানুর পিঠা পুড়ে গেল। তাড়াতাড়ি ফু দিয়ে ঠাণ্ডা করতে করতে বলল, মাইয়ার তর সয় না। একদম মায়ের লাহান।
পূর্বা পিঠা খায় গুড় মাখিয়ে মাখিয়ে। পিড়িতে বসে বসে আরও গুড় চায়। কৈতরবানু পিঠা বানায়।
বড়পোলা আবু রইস দৌড়ে এল। বলল, আব্বায় চেইতা গ্যাছে। অরে আটকাইয়া রাকসেন ক্যান?
-ত্যাক্ত করিস না রইস। যা তুই। অরে খাইতে দে।

আবু রইস কোলে তুলে নিল। দিল ছুট। লোকজন ঠেলে খান সাবের হাতে দিল। পূর্বা হাতপা ছুড়ছে। আর বলছে, আমার পিঠা। আমার পিঠা।
দরোজা খুলে দেয়া হল। অন্ধকার। ভিতরে টিমটিম করে একটি মাটির প্রদীপ জ্বলছে। তেলের গন্ধ। পূর্বা তার ছোট্ট পাটি রাখল চৌকাঠের ওপারে। একটি পুরনো হাওয়া এসে নিবিয়ে দিল দীপশিখাটি। ছোট মেয়েটি আঁতকে উঠল, বাবা- ও বাবা।
ঘুলঘুলি দিয়ে আলো এসে পড়েছে। একটু একটু করে স্পষ্ট হচ্ছে সব কিছু। ঘরের মধ্যে একটি ছোট খাট। খাটের উপরে একটি বাবু পরি বসে আছে। তার চোখ দুটি ঢলো ঢলো। নাকে নোলক। পূর্বা বলল- তোমার নাম কি?
-পরীবানু।
-কি করো?
-ঢেকি পাহার দেই।
খুট খট। খুট খুট। ঢেকিতে পাহার পড়ে। ধানের নাম মৌলতা। চিড়ামুড়ি হবে।
বাপো খাবে মায়ে খাবে
খাবে সোনার চান,
এই না চানের লাইগা আমি
না করিব মান।

কৈতরবানু জানালা খুলে দিয়েছে। আলোর ঝাপটানি ঘরটি ভাসিয়ে দিল। পরীবানু নেই। ছোট একটি কাঁথা পড়ে আছে খাটের উপরে। আর একটি খেলনা কাঠের ঢেকি। কিছুটা মলিন। ধাই ধাই জ্বর।

ইমাম সাব ঘরে ঘুরে দেখলেন ঘর দোর। বারান্দা। সিঁড়ি দিয়ে উপরেও উঠলেন। পুলিন সা এদিক চায়। ওদিক চায়। হাঁফাতে হাঁফাতে বলে, কী বানাইছসরে হামিদ। হ্যাতে দেহে ধানক্ষেতও দেহন যায়। অই যে তালগাছ। বলশ্বর। ঘাটে নাও বাঁধা।
এই ঘাটে কৈতরবানু একদিন ভোরবেলা দাঁড়িয়ে ছিল। কোলে জ্বরে নেতিয়ে পড়েছে পরীবানু। হামিদ খান চারিদিকে চায়। ছুটে বেড়ায়। তার নৌকা নেই। নৌকাটি কে নিল?

সেদিন পুড়ে গেল লক্ষ্মীদিয়া। পাখির মত নদীর পাড়ের মানুষগুলো বউয়ারী ধানের ক্ষেতে। দুধকলম শীষের ফাঁকে। শুয়ে আছে। যোগা গোন। জল এসে ভাসিয়ে নিয়েছে সব।
সালাম সিকদার উঠোনে পাড়া দিয়ে বলছে, ইমাম সাব, দেরী হৈয়া যায়।
কৈতরবানু খামছে ধরেছে সালাম সিকদারের হাত। নখ বসে গেছে। সিকদার যন্ত্রণায় কঁকিয়ে ওঠে, চাচী, করেন কি? করেন কি?
কৈতরবানু ফ্যাস ফ্যাসে গলায় বলে, ক ত ছালাম, হেইদিন নাওডা লৈছিলি ক্যান? লৈছিলি ক্যান নাওডা?
ছালাম সিকদার পিছু হটতে হটতে বলে- সেই কথা কি মনে আছে? দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে বলে, মনে রাখার দরকার আছে আছে নি এদ্দিন পরে?

কিন্তু পুলিন সা’র মনে আছে। তার বাহুমূলে দগদগে গুলির ক্ষতটির মনে আছে। হাবিব সর্দারের মনে আছে। তার হাটুর উপরে বেয়নেটের খোঁচাটির মনে আছে। বউয়ারী ধানক্ষেতের মনে আছে। জোয়ারের জলের মনে আছে।

নৌকাটি ঘাটে এল। ততক্ষণে শিউলি গাছের নিচে পরীবানুকে শোয়ানো হয়েছে। নৌকার পাটাতনে বেশ কিছু গুলির খোসা। গান পাউডারের শেলের পাছা। কৈতরবানুর হাতে শূন্য কাঁথা। খেলনা ঢেকি। কিছু মলিন। এখনো জ্বর লেগে আছে।
পূর্বা পিঠা খেতে খেতে বলে, অ নানী, এই ফুলের নাম কি?
-শিউলী। শিউলী ফুল।

* পরিশিষ্টে পূর্বা অতন্দ্রিলার গল্প সংযুক্ত





আমি নই ক্ষত্রিয়
(সরি, গল্পটি একটু বড় হয়ে গেল অমি রহমান পিয়াল )

স্বপ্নের মধ্যে শুধু বৃষ্টি আসে। আর আসে সেই পুকুরটা। কেন বাবা হেমামালিনী আর জুহু বীচ আসতে পারে না?

কিছুক্ষণ আগে বৃষ্টি হয়ে গেছে। পাতা থেকে এখনো টুপাটাপ জল ঝরছে। কিন্তু গরম। জলে নামতে পারলে বেশ হয়।
একটি লোক হাতছানি দিলেন। খোঁচা খোঁচা দাড়ি। চোখ দুটো উজ্জ্বল। বললেন, এত ছোট ছেলে তুমি। পূর্ব বাংলা থেকে এসেছ? বাবা-মায়ের কথা মনে পড়ছে না?
-লেবুবাই কৈলেন। তাই যুদ্ধ করতে আইসি।
-কার পক্ষে যুদ্ধ করবে?
-বাঙালীদের পক্ষে।
-কোন্ বাঙালী? ধনী বাঙালী? না, সর্বহারা বাঙালী?

কঠিন প্রশ্ন করেছেন এই দাদা লোকটি। তিনি বুঝিয়ে বললেন, তোমরা যে যুদ্ধ করছ, এটা কোনো জনযুদ্ধ নয়। একটি বিদেশী শোষক শ্রেণীর বদলে আরেকটি দেশী শোষক ধনীক শ্রেণীকে ক্ষমতায় আনার জন্য তোমাদের এই যুদ্ধ ? সর্বহারা শ্রেণীর কি হবে এই যুদ্ধে?
-তাইলে কী করতে হবে?
-শ্রেণী সংগ্রাম। একমাত্র শ্রেণী সংগ্রামই হল এ সময়ের কর্তব্য। আওয়ামী লীগ হল ধনীক শ্রেণীর প্রতিনিধি। শোষক শ্রেণীর দল।
-আমি তো আওয়ামী লীগের লগে নাই। কম্যুনিস্টগো লগে আছি!
-কোন কম্যুনিস্ট? মনি সিংহের? মনি সিংহ তো রাজার ছেলে! সে কি করে বিপ্লবী কম্যুনিস্ট হবে? হু, এরা হল সংশোধনবাদি। এরা বিপ্লবের জন্য খুব ক্ষতিকর। সর্বহারাদের মধ্যে থেকে শ্রেণী সংগ্রামের বিপ্লবী নেতৃত্ব গড়ে উঠবে। বিপ্লব দীর্ঘজীবি হোক।
বিপ্লব তাইলে শিশু! তার দীর্ঘজীবি হওয়া দরকার।

পুকুরের জল দুলে দুলে উঠল। পশ্চিম বঙ্গের পুকুরে জল কম। বাংলাদেশের জল শীতল- ছায়াময়।


বাড়ি ফিরেই দেখা গেল- লোকজন নেই। সব ফাঁকা। দরোজায় তালা। অনেক ডাকাডাকির পরে আম্মার গলা পাওয়া গেল। পেছনের দরোজা দিয়ে বেরিয়ে এসে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, তোর আব্বা- ভাইদের বাঁচা, মান্নান।
-কেন, তারা কী করছে?
-রাজাকারি করছে। এখুন পালাইছে।

অনেক জিনিস পত্রে ঠাসা ঘর। এগুলো আগে ছিল না। ঘরের খুঁটিতে সিদুঁরের দাগ। দরোজায় হালকা করে স্বস্তিকা চিহ্ণ আঁকা। ঘরের মাঝখানে একটি সেগুনকাঠের পালঙ্ক। মাথার কাছে লেখা- সুখে থাক। হাজী আবদুল গফুর ভূঁইয়া। এটা বিখ্যাত ভূঁইয়াদের বড় ছেলে ঘুমাত। সুখে থাক লেখার কাছে রক্তের দাগ। তাকে কি মেরে ফেলা হয়েছে? আম্মা রান্না ঘরে চলে গেলেন। মান্নান বাইরে নতুন তোলা ঘরের বারান্দায় গুম হয়ে বসে রইলেন।

পরদিন একটি ঘটনা ঘটল। ভারত থেকে প্রত্যাগত শরণার্থীরা কলেজ মাঠে তাবুর মধ্যে থাকত। মান্নান বামহাতে একটা মাছকাটা বটি ডানহাতে তার আব্বাকে টেনে নিয়ে এলেন কলেজ মাঠটিতে। লোক জমে গেল। তিনি বটি উঁচু করে অলৌকিক এক বক্তৃতা দিলেন। বললেন, তার আব্বা বিশিষ্ট রাজাকার। লুটপাট করেছেন। কিছু মানুষকে হত্যার সঙ্গেও জড়িত। আরও কি সব। তার আব্বা এখন ধনীক শ্রেণীর মধ্যে পড়েছে। ধনীক শ্রেণী হল শোষক শ্রেণী। এই শোষক শ্রেণীকে তিনি সকলের সামনে কতল করবেন। শ্রেণী সংগ্রামের সূত্রপাত করবেন। শ্রেণী শত্রুকে রেহাই দেয়া যায় না।

তিনি বটি উচু করে ধরলেন। তার আব্বা হুজুর জোরে জোরে সুরা ইয়াসিন পড়ছেন। আম্মা মান্নানের শার্ট চেপে ধরেছেন। তারস্বরে চিৎকার করছেন- কী করিস মান্নান। কী করিস মান্নান। তার তিন ভাইও চিৎকারে গলা মেলাচ্ছে। এরা তিনভাই কুখ্যাত রাজাকার হিসাবে একাত্তরে এলাকা দাপিয়ে বেড়িয়েছে।

ভয়ংকর হয়ে উঠছে ঘটনাটি। শ্বাস রোধ হয়ে গেল অনেকের। অনেকে চোখ বন্ধ করে ফেলল। কজন দুর্বল মনের মহিলা ওয়াক ওয়াক করতে লাগল। তাদের মাথা ঘুরতে শুরু করেছে। আর শিশুরা মায়ের আঁচলের তলায় মুখ লুকাল। বটিটা অনেক উপরে উঠল। মান্নানের চোখমুখ শক্ত হয়ে উঠেছে। বটিটা ধা করে নিচে নেমে আসবে। তার গলা বরাবর নেমে আসছে। এক, দুই, তিন ..

একজন মুরুব্বি চিৎকার করে উঠল। বাবা, পিতৃহত্যা নাজায়েজ।

সেদিন কোন রক্ত ফিনকি দিয়ে উঠল না। কারো মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মাটিয়ে ছিটকে পড়ল না। কারো স্ত্রী বিধবা হলেন না। কারো পুত্র পিতৃহীন হল না। ধর্ম রক্ষিত হল। কলেজ মাঠে যে সমস্ত শরণার্থীর শ্বাস বন্ধ হয়ে গিয়েছিল- তাদের নতুন করে শ্বাস বইতে শুরু করল। এরা অনেকেই পিতৃহীন, মাতৃহীন, ভ্রাতৃহীন, সদ্য বিধবা, সর্বস্বহীন এবং কোনো কোনো নারী ধর্ষিতা।

মান্নান হিরো হয়ে গেলেন। পুচকি মান্নান হয়ে গেলেন বিপ্লবী মান্নান ভাই। তার আব্বা হুজুরও ডাকতে লাগলেন- মান্নান ভাই। ভাইগুলো হাতের রক্তটক্ত মুছে একটা সাইন বোর্ড ঝুলিয়ে দিল বাড়ির গেটের সামনে খেজুর গাছে। লেখা- বিশিষ্ট বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ আব্দুল মান্নান ভাই-এর বাড়ি। মান্নান ভাইয়ের জন্য নতুন তোলা ঘরটি বরাদ্দ হল। ঘরটি নিচু পাড়া থেকে লুট করে আনা। পুরনো শালকাঠের একটি আলমারী। পালংকে ঘুমানোর সময় চোখে পড়ে লেখাটি- ‘সুখে থাক।‘ হাজী আবদুল গফুর ভূঁইয়া অংশটি চুন দিয়ে বুজিয়ে ফেলা হয়েছে। ভুঁইয়া সাহেব সপুত্র নিহত হয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে। এই পরিবারটি শ্যাখের দল করত। মান্নান ভাই এই ঘরটিতে থাকেন। আর ঘুমান। মুরগী-মুসাল্লাম খান। আলমারীতে লাল লাল সব বই সাজান। মাঝে মাঝে তিনি চিৎকার ওঠেন, বিপ্লব দীর্ঘজীবি হোক। সে চিৎকার রাত্রি ভেদ করে দিনে গভীরেও পৌছেঁ যায়।

মান্নান ভাইয়ের আব্বা হুজুর এবং ভাইগণ ব্যবসাপাতি শুরু করলেন জোরে শোরে। কলেজ মাঠের শরণার্থীরা অনেকে বাড়ি ফিরে গেল। কোন উপায় না দেখে কেউ কেউ ওপারে চলে গেল। তাদের মন ভেঙে গেছে। তাদের ঘরদোর পুড়ে গেছে। সব কিছু লুটপাট হয়ে গেছে। কেউ পোড়া ভিটেতেই তাবু খাটিয়ে বসবাস শুরু করতে লাগল। কলেজ মাঠে লাল বাহিনী, নীল বাহিনী খায় দায়- ঘোরে ফেরে- আর মাঝে মাঝে মার্চপার্ট করে। হাক দিয়ে ওঠে- জয় বাংলা। রাতে মাহফিল। লাল দোপাট্টা মল মল।

লেবু ভাই বললেন, মান্নান চলো- লোকজনের কাছে যাই। ঘরবাড়ি তুলতে সাহায্য করি।

মান্নান ভাই দিল খোলা মেজাজে বলে দিলেন, এইটা আমার কাজ না। আমার কাজ বিপ্লব।
- আমরা তো বিপ্লবের জন্য কাজ করছি!
- -আপনে বিপ্লবী হতে পারেন না। আপনের বাপ জোদ্দার। তিনি শ্রেণী শত্রু।

লেবু ভাই মন খারাপ করে ফিরে গেলেন। মান্নান ভাই পড়তে লাগলেন লাল লাল অই বইগুলো। আর খেতে লাগলেন মুরগী মুসাল্লাম। তার স্বাস্থ্য টগবগ করতে লাগল। বিপ্লবের দীর্ঘজীবি হওয়ার জন্য সুস্বাস্থ্যের বিকল্প নেই। দুটো ফ্যান ওনার জন্য ঘর থেকে বের করা হল। এই ফ্যান দুটি গীর্জাঘরে হাওয়া দিত। গীর্জায় হাওয়ার দরকার নেই। এ বড় কঠিন তত্ব। তত্ব না বুঝলে বিপ্লব করা যাবে না।

কিছুদিন পরে লেবুভাই নিহত হলেন। দিনের বেলায় তাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। মান্নান ভাই আমাদের বাসায় এলেন। একটা গানের খোঁজে। যিনি গানটি করতেন সেই ঠাকুরদা নেই। আমার বোনের খাতা থেকে গানের পাতাটি ছিঁড়ে নিলেন। আর নিয়ে গেলেন দিদির হারমোনিয়ামটি। অসাধারণ অধ্যবসায় তার। স্কুলে যেতে আসতে শুনতাম, মান্নান ভাই হারমোনিয়াম টিপে টিপে গাইছেন কানা কেষ্ঠর গান-

মুক্তির মন্দির সোপান তলে
কত প্রাণ হলো বলিদান, লেখা আছে অশ্রুজলে৷
কত বিপ্লবী বন্ধুর রক্তে রাঙা, বন্দীশালার ওই শিকল ভাঙা
তাঁরা কি ফিরিবে আজ সুপ্রভাতে
যত তরুণ অরুণ গেছে অস্তাচলে৷
মুক্তির মন্দির সোপান তলে.
..লেখা আছে অশ্রুজলে ৷
যারা স্বর্গগত তারা এখনো জানে,
স্বর্গের চেয়ে প্রিয় জন্মভূমি
এসো স্বদেশ ব্রতের মহা দীক্ষা লভি
সেই মৃত্যুঞ্জয়ীদের চরণ চুমি
যারা জীর্ণ জাতির বুকে জাগালো আশা
মৌন মলিনমুখে জাগালো ভাষা
আজ রক্তকমলে গাঁথা মাল্যখানি,
বিজয়লক্ষী দেবে তাঁদেরি গলে
মুক্তির মন্দির সোপান তলে...
লেখা আছে অশ্রুজলে ৷


একদিন তার আলমারীটা ঝাড় দিতে ডাকলেন। বললাম, পূজায় যাব।
বললেন, ছি কমরেড, ধর্ম হল আফিং। তার চেয়ে বিপ্লব জরুরী। দেরী করলে বিপ্লবের ট্রেন ছেড়ে দেবে। তখন?

ঝেড়ে পুছে আলমারীতে বইগুলো সাজিয়ে রাখতে হল। মাও সেতুং, মার্কস, এংগেলস, লেনিন, স্টালিন-এর রচনাবলী মাওলানা আব্দুর রহিমের ইসলাম ও সমাজতন্ত্র, লু সুনের গল্প এবং সিরাজ সিকদারের কিছু লেখা। তার পশে বেহেশতের কুঞ্জি, সচিত্র কোকশাস্ত, কী করিলে কী হয় এবং সচিত্র রোমাঞ্চ। প্রচ্ছদে অপূর্ব সুন্দরী একটি মেয়ের ছবি। নায়িকা টায়িকা হবে। উর্ধাঙ্গ ফাঁকা। হেসে বললেন, বিপ্লব হলে এরকম নায়িকাদের পাওয়া যাবে। বিপ্লব দীর্ঘজীবি হোক।

পড়তে পড়তে সুন্দর লিখতেও শুরু করলেন মান্নান ভাই। কী সব কঠিন কঠিন প্রবন্ধ। বোঝার ক্ষমতা নেই। শিক্ষামন্ত্রী কাজী জাফর আহমদ এলেন ফরিদপুর। জসিমুদ্দিন হলে মান্নান ভাই তার সম্মানে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা শীর্ষক একটা প্রবন্ধও পড়ে এলেন। সেটা পরে ছাপাও হল পুস্তিকা আকারে। ডিসি সাহেব সব স্কুলের টিচারদের কাছে প্রবন্ধটি পাঠিয়ে দিলেন। তাদের বেতন খেকে পুস্তিকাটির দাম কেটে নেওয়া হল।

এ সময় তার অত্যন্ত প্রিয় গান হয়ে উঠল এসডি বর্মনের-
শোনোগো দক্ষিণ হাওয়া
প্রেম করেছি আমি

সমস্যা হয়ে গেল আমাদের এই শহরের সব লোকই মান্নান ভাইকে মান্নান ভাই বলেই ডাকে। সমীহ করে চলে। মেয়েরা তাকে দেখলেই কাতর হয়ে পড়ত। তারা ঘেমে উঠত। তাদের শ্বাস ঘণ হয়ে যেত। তাদের চোখের সামনে বটি হাতে মান্নানের চেহারাটি ফুটে ওঠত। কোনো গোলাপ নয়। মান্নান ভাই দমলেন না। পাড়ি দিলেন ঢাকায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে গেলেন। কিভাবে ভর্তি হলেন- সে এক রহস্য। একদিন বললেন, নতুন গান শিখছি- নব প্রাণ আন্দোলনের গান। গেয়েও শোনালেন দুএক কলি।

‘বৃষ্টি বাদল দুই ভাই বোন শহর দেখতে আসে
বড়লোকদের গাড়িগুলো সব কাছিমের মতো ভাসে
ভাই বলে বোন বোন বলে ভাই আজ স্কুল থাক
বড়লোকদের গাড়িগুলো সব বন্যায় ভেসে যাক...’

কানের মধ্যে ঢুকল না। মাথার উপর দিয়ে সুর আর বানী চলে গেল। গানটা গুতা খেল টিএসসির ছাদে। অইখানে দুটো পাখি বসে কিচির মিচির করছিল। দুটো পাখিই ধপ করে পড়ে মারা গেল। তিনি একটি কবিতাও শোনালেন। নিজেই লিখেছেন। তিনি ঠিক করেছেন কবিতাই লিখবেন। বিপ্লবীরা সবাই কবিতা লিখতেন। এ সময় একটি মেয়ে বাতাসে ভাসতে ভাসতে এসে পড়ল। একদম শ্রী দেবী। বলল, হাই। তার চোখে তেপান্তরের ঝিলিক। কে উপেক্ষা করে তাকে। তার দিকে দৌড়ে গেলেন। যেতে যেতে বললেন, বিপ্লব দীর্ঘজীবি হোক। তিনি বিপ্লবের পিছনে পিছনে দৌড়ে গেলেন।

আমাদের বয়স থেমে নেই। আরও জোরে দৌড়ুতে শুরু করেছে। শিশুটি থেকে বড়োটি হয়ে গেছি। বড়োটি থেকে বুড়োটি হয়ে যাচ্ছি। বিপ্লব কিন্তু সেই কচি খোকাটি। বিপ্লবের বয়স বাড়ে না।

একটি চাকরীর ইন্টারভিউ ছিল ঢাকায়। ভোর ভোর বাসে উঠেছি। গোয়ালন্দে দেরী হয়ে গেল। নির্ধারিত সময়ে ফেরী আর ছাড়ে না। লোকজন উসখুস করছে। ফেরীর লোকজন বললেন, স্যার নামাজ পড়ছেন। শেষ হলেই ছাড়া হবে।

ফিরে এলেন স্যার। চমৎকার স্যুটেড বুটেড। স্যারের কপালে দাগ পড়েছে। মাথার টুপিটা ঠিক করলেন। জিন্নাহ টুপি। পকেটে উকি দিচ্ছে মওদুদীর বই। সরকারী গাড়ি। আমার দিকে একবার তাকালেন। একটা কার্ড দিলেন। সচিবালয়ে পোস্টিং। পাশে ভাবি। বোরকা পরা। মুখ ঢাকা।

হাত মেলালেন না। হালকা করে উঁচু করলেন। বাতাসে আতরের সুবাস। মুখে তোরাবোরা পাহাড়ের হাসি। একটু জেগেই উবে গেল। মনে হল মৃদু স্বরে বললেন, বিপ্লব দীর্ঘজীবি হোক।
তিনি কী সত্যি সত্যি বলেছিলেন- বিপ্লব দীর্ঘজীবি হোক। না কি ভুল শুনেছি? ধাঁধা লেগে গেল।

কোনো বটি নয়- তার হাতে তখন একটি বই। খুব আদব লেহাজের সঙ্গে পড়ছেন একটি লোকের আত্মজীবনী- একাত্তরে আমরা ভুল করিনি। ছবিতে লেখক খুব সহি সালামতে রাও ফরমান আলী আর টিক্কা খানের সঙ্গে বসে আছেন।

বিপ্লবীরা কখনো ভুল করেন না।





জিজ্ঞেস করো ঘোড়া হে উড়ন্ত অশ্ব তোমার পিঠে কে ভাসমান
জিজ্ঞেস করো প্রবর্তক পথিক অথবা গোপন রাজদূত কিনা
জিজ্ঞেস করো জিজ্ঞেস করো কারণ সম্মুখে আমাদের গণজমায়েত
কারণ এটি জানা দরকার আরোহীর আগুন আমাদের ভিটেমাটি কতোটুকু পোড়াবে।
(-কবি আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহর কবিতা/ পলাশী ও পানিপথ)


ছয়ফুল মুলক বদিউজ্জামাল উরফে চান্দু মিয়ার সহি সফরনামা

শেফালী বেগম! ইয়ে ঠিক নেহি হ্যায়। নাপাক এলফ। তুম হে এক পাক নাম কি জরুরত হ্যায়।

শেফালী বেগম অবাক হৈয়া চাইয়া রৈল। কয় কি ইমাম সাবে। ঘরের দক্ষিণে আছিল গাছডা। হেমুন্তে তলা ফর্শা হৈয়া যাইত। দাদাজান কৈলেন, এই মাইয়ার নাম হৈবে শেফালী। আকিকার দিন ফাইনাল হৈল- শেফালী বেগম। মাইয়াডা শেফালী ফুলির লাহান হাইসা উডপি। হা হা হা।
নিজাম উকিল শেফালী বেগমের পিডে হাত রাকলেন। চউক্ষের ইশারায় কৈলেন, চেইত না। হুজুরে আলা যা কয়- হেইডাই কতা। আর সব আউট।

ইমাম সাব মোরাকোবা কি হালত হৈলেন। এই সুমায় তার ঠোঁট নড়ে না। বুকির মৈদ্যি দম আডকাইয়া থাহে। জমিন থেইক্যা আসমানে একবার চক্কর মাইরা আসেন। গুপ্ত বা অগুপ্ত এলমে হগল কিছুই তার চউক্ষে ভাইসা ওডে। তিনি একডা কালা দুপাট্টা দিয়া চউক্ষু দুইডা বাইন্ধা রাহেন। ইহার রহস্য অপার হে।

তিনি হাইস্যা দেলেন। হাসিডা আইল ঠোডের উপ্রে। দাঁত দেহা যায় না। কৈলেন, আপকা নাম বহুৎ মোবারক হ্যায় মুছাম্মাৎ হায়াতুন্নিছা খাতুন।
নিজাম উকিল হাত তুল্লা কৈলেন, আলহামদুলিলাহ।

একদিন রাত কে বাদ হায়াতুন্নিছার হোশ হৈলে পর তার শাউড়ি আম্মা হাইসা কৈলেন- অ বউ, দ্যাকোগো মা- চান্দের লাহান তুমার পোলা হৈচে। হায়াতুন্নিছা তার কেলান্ত চউক্ষু মেইল্লা দ্যাকল- পোলার বাম কানডা এটটু ব্যাঁকা। গাত্র বন্নে চান্দ কি রোশনী। মুনে মুনে কৈল- তুমার নাম হৈল- চান্দু মিয়া। আমার চান্দু মিয়া। লেকিন ইমাম সাব নাম রাকলেন- ছয়ফুল মুলক। উসনে লম্বা সফর কিয়া।

তিনি একটা স্বর্ণের তাবিজ লেইখ্যা দেলেন। ভুজ পাতায় জাফরান দিয়া ল্যাখলেন- ছয়ফুল মুলক। শেফালী বেগম আরেককডা পাতায় লেইখা লৈলেন- উরফে চান্দু মিয়া। মুম দিয়া মুখডা বুজাইয়া দিয়া দেছেন। সামনে পিছনে চারদিকে পোলার কপালে ফু দিয়া গলায় ঝুলায়া দিলেন এই স্বর্ণের তাবিজ। ইহার সামনে লম্বা আজিব কা সফর অপিক্ষা করতাছে হে।

নিজাম উকিল এক বড়া মাইফেলের আয়োজন করলেন- হেইদিন দুফরের পরে কে বা কাহারা জেইলখানার তালা ভাইঙ্গা ফেলল। ভিতর থেইকা কাশেম মোক্তার ধীরেন বাকচি বাবু আর লগে লগে যারা ছিলেন নেতা চেতা না চোর না চ্যাছোড় না ডাকাইত তারাও দৌড়াইয়া বারায় গেছে। ধীরেন বাকচি বাবুর লগে হেমা ডাকাইত বক সিগরেট খাইলেন। লম্বা কৈরা হাওয়ায় ধুয়া ছাড়লেন। চেচানিকান্দিতে বদ্যিবাড়ির ফ্যালা বদ্যি হাতুড়ি দিয়া হাতকড়া ভাইঙ্গা দেল। এই সুময় চৌরুঙ্গিতে বড়দার দুকানে উলু আর কাফু চা খাইতে আছিল। তাগো সামনে দাড়াইতে পারে এমুন বাপের বেডা কেডা আছে এইহানে? লেকিন এইকালে ধড়াম কৈরা অরা দুইজন ঠিক রাস্তার মদ্যিখানেই পৈড়া গেল। আর জামানসাবের ছুডো ভাই খোড়া জামান বাঘ মার্কা আর জিন্নাসাবের ফডো লৈয়া পাইখানার মৈদ্যি ঢুইক্যা বসল। নিজাম উকিল তাগো পুরানা আমগাছের উপ্রে পরগাছার আড়াল লৈছে। অইখানে ছিল ডাইয়া পিপড়ার বাসা। তারা নিজাম উকিলের বংশদণ্ডে কয়েকডা এমুন কামুড় বসাইয়া দিল যে হেইদিন তার মুনে হৈল- ইহা অকার্যকর। এইরহম ডাক্তারে কৈছিল। হুজুরে আলার দুয়ায় কুন সময় যে পড়াৎ কৈরা কার্যকর হৈয়া উডল হেইডা সীতারামপুরের কালা কুছ কুছ রমজান মোক্তারের পোলা গোপালগুঞ্জির নয়া উকিল মুহাম্মদ নিযাম উল হকও টের পায় নাই। তাহার পোলার নাম- ছয়ফুল মুলক। ইহার মাতা সত্যি। নাম শেফালী বেগম। উরফে মুছাম্মাৎ হায়াতুন্নিছা খাতুন। সাং বাইদ্যা পট্টি। রহস্য অপার। তাহার অজানা কিছুই নাই হে।

নিজাম উকিলের বুড়ি আম্মা বিছানার উপ্রে ছয়মুল মূলককে লৈয়া গুম যায় আর গুনগুনাইয়া ঘুমের মৈদ্যে ছয়ফুল মুলক বদিউজ্জামালের কিসসা গায়। শেফালী বেগম উরফে মুছাম্মাৎ হায়াতুন্নিছা খাতুন বাটা ভৈরা পান চিবায় আর চউক্ষে লম্বা কৈরা সুরমা টানে। মাঝে মাঝে শোনে দৈরার পাড়ে পরী শেহজাদি বদ্দিউজ্জামালকে দেইখা ছয়ফুল মুলক পাগল হৈচে।

রাজোহাস কৈন্যা তুমি আইলা নদীকুলে।
চারি চউক্ষু মিলন হৈলো প্রাণো উডে দুলে।।

এইনা দিবস যায়গো কাইটা রাতি না পোহায়।
খোয়াবগুলায় মিলায় দূরে কে তারে লুকায়।।

পঙ্খি আমার উড়াল দ্যাওরে যাওরে পরীর দেশ।
মন বধূয়ায় দিও গিয়া এইনা মাথার কেশ।।

চউক্ষে দিও কালা কাজল ম্যাঘেরো বরণ।
কর্ণে দিও চান্দোপাশা পুষ্পেরো গড়ন।।

গলায় পৈরো মুক্তাহারো চান্দেরো গোহন।
অঙ্গে শোভো রাতুল বসন মুরলী মোহন।।

না কৈরো গো মিছা কান্দন না হারাইও শ্বাস।
অচিন দৈরায় ভাসাই তোরী তুলিয়া নিবাস।।

সাক্ষী থাইকো চান্দো সুরুয আকাশেরো তারা।
ফিরায় আনুম কৈন্যা তুমায় খোয়াবেরো পারা।।

যাও পঙ্খি গাও পঙ্খি সামালো সামাল।
ছয়ফুল মুল-উল্ক ভনে বদিউজ্জামাল।।

বুড়ি দাদীআম্মা হাসে। তার ফোঁকলা দাঁত। ছয়ফুল মূলক বড়া হৈলে সফরে যাবি। চান্দের লাহান বদিউজ্জামালরে আনবি।
তিনি হাডছিলেন কপালি বসু পাড়ার মৈদ্যে দিয়া। লাগে তালবেলেম। একদল হাডে সামনে লাফাইয়া লাফাইয়া। আরেকদল হুজুরে আলার পিছন পিছন ঝাপাইয়া ঝাপাইয়া। কপালি বসুরা ছোড লোক হিন্দু। খাডো ধুতি পরে আর গলায় আইচার মালা। চৈতরো সংক্রান্তিতে নীলপাটের পূজা দ্যায় কাঁচা আম দিয়া। রজনীকালে দশাবতার সাইজা অষ্টক গান করে। এ্যাদের বউঝিরা কাম কাজে চতুর । আর বহুপেরজা বৎসা।

বসুপাড়ার নরোত্তম বসুর বাবা মদুসূদন বসু ছিপের আগায় বড়শী লাগাইতে ব্যস্ত আছিল। তার পাশে নাকে প্যান লৈয়া নাতি শেতল মাডির উপ্রে খেলতি খেলতি হাইসা দেল। তিনি কৈলেন, বেটা- আপকো আবেহায়াত। আপ দিনমে দো দফা পিঙে।
বসু মশাই হুজুরে আলার হাত থিকা আবে হায়াতের শিশিডা লৈয়া কপালে ঠেকাইল। হাত জোড় কৈরা কৈল, ইমাম হুজুর, আমরা কি করমু? দ্যাশ ছাইড়া কি চৈলা যামু?
তিনি হাসলেন। খুব মেরদু হাসি। ঠোঁডের উপ্রে দিয়া ঝিল্লিক দিয়া চৈলা গেল। তিনি কৈলেন, ইস জাগাকো ছোড়নে কা কেয়া ফায়দা হো? তোমকো এয়াসে কৌন নিকালে? তোম লোগ সব গনিমতে মাল। কোই মুশকিল নেহি হ্যায়।

কপালি বসুরা হুজুরের চার্দিক ঘিরা ধরল। কেডা এ্যাক ছোকরা কৈল, হুজুর কৈছেন কুনো অসুবদা নাই। আমাগো হুজুর দ্যাখপে হে।
নিজাম উকিল চমকাইয়া হুজুরে আলার দিকি চাইয়া পৈড়ল। হুজুরের চউক্ষে কালা দোপাট্টা। গাত্র বন্নে চান্দ কি রোশনী। তিনি হগলের আগে আগে সেয়েতমান্দ লোকের লাহান হাইডা চৈলছেন। বসুপাড়া পুরোডা ঘুইরা গেলেন। আছছোরোমের খাল থেইকা পশ্চিমে হাইডা গেলেন। ওহানে তালগাছের সারি। নিচে মোসলেম সিকদারের ইডের পাজা। তিনি কৈলেন, মুহাম্মদ নিযামুল হক- হামেশা মেরী বাত পর একিন করে। কোই মুশকিল নেহি হ্যায়।

এ্যার তিন রাত কা বাদ হাসাপাতালের ঘাডে একহান গানশিপ আইসা ভিড়ল। থার্ড অপিছার নিশান উড়াইয়া সুবেহ সাদেকের আগেই খাড়াইছিলেন। তার পাশ মে দুইজন আর্দালি ঝুইকা ছিল। ডরে কাঁপে। আর পড়ে সুরা ইয়াসিন। তারা দুইুনই পঙ্খির লাহান লুডায় পৈড়ল। হাসপাতালের গেডে ঝাঁক ঝাঁক গুলি ছুইডা গেল। খাডি পাকমন গুলি।
পলোকের মৈদ্যি সারা গঞ্জের রাস্তাঘাড ফাঁকা। আর কোতাও কোতাও বৈশাকি বারিষের লাহান পানি জৈম্যা গেল। রাঙা। গরোম। পুড়া ঘর থিকা কালা ধুমা অনেক উপ্রে উইড়া গেল। বসুপাড়ার যে লোকডা আছছোরোমের পানির মৈদ্যি পৈড়া গেল তার নাম নরোত্তম বসু। পিতা : মদুসূদন বসু। সাং পাচুড়িয়া। জাতে কপালি বসু- ছোড হিন্দু। পিশা : জমির কামলা। বউ ঝিরা বাঁশের কামে ওস্তাদ। কোলে পিডি মাডিতে ছাও পোনা গড়ায়। বছর বছর পেরজা বিয়ায়। বাঁশ বাগানির মৈদ্যি কাউরিই আর দেহা গেল না। উডানে কাডা দাও আর বাঁশের পাতলা পাতলা চডা। সব শুনশান হে। কেউ কুথাও।

হুজুরের পরতি অবিশ্যাসী হওনের কুনো উপায় নাই। কেনুনা নিজাম উকিল তাজ্জব হৈয়া চাইয়া দেকতি পাইল, তাগো বুইড়া আম গাছের একডা মোডা ডাল মড়াৎ কৈরা ভাইঙা পৈড়ল। হুজুরে আলা এইমত আগাম কৈছিলেন- তাতে তার গায়ের লোম খাড়ায় গেল। ডাইয়া পিপড়াগুলান তার যে নেতানো মেতানো বংশদন্ডডায় কামুড় দিছিল- তা এতকাল দৈরা আছিল নড়ন চড়ন নট- বালও ফ্যালানোর কুনো খ্যামতা ছিল না, হেইডা আচানক ফাল দিয়া খাড়ায় গেল- অবিশ্যাসী হৈও না। হৈয়া তো কুনো ফায়দা নাই হে। তিনি হন্ত দন্ত হৈয়া পাজামার গিট্টুডা গিটাইবার কতা ভুইল্লা গেলেন। জেবনে পেরথম বারির লাহান তার পূরা রেতঃপাত হৈল। একডা চিল পঙ্খি উইড়া যাইতাছিল। এই দিরিশ্য দেইহা তার ছয়মাসির গব্ব হৈল। আকাশি থাকতিই ডিম পাড়ল। ডিম ফাইট্টা বাচ্চা বিয়াল। বাচ্চাডা কৈল, অমা, এ কোন জমানায় আইলাম গো। মালিকের পাজামার কম্ম শ্যাষ। আর সামনে খাড়াইয়া তেজি বাদি। হাওয়ামে উড়তা যায়ে/ মেরে লাল দুপাট্টা মল মল...। এ্যাতে কুনো অবিশ্যাস নাই হে। তাগো লবেজান বাদিডা জিব্যা কাইডা কৈল, আম্মাজান কৈছেন- বাইরি যাইয়া আর কাম নাই। ঘরে আহেন। যুদি যানই এক বিড়া পান আর সুপ্রি আইনেন। লগে মর্দানি জর্দা। হি হি হি।

বিশ্যাসী কম্মে তিনি অতিশয় ব্যস্ত হৈয়া গেলেন। ঘুইরা ঘুইরা দেহেন গঞ্জে কেডা কেডা আসে আর যায়। একডা খাতায় ল্যাখতে থাহেন তাগো নাম ধাম রাঙা কালি দিয়া। গঞ্জ ছাপা হৈয়া যায়। আর মুছাম্মাৎ হায়াতুন্নিছার কোলে বাড়ে চান্দের লাহান পোলা ছয়ফুল মূলক। তার বাম কান ব্যাঁকা। এই নিয়া কুনো ক্ষোব নাই। কারণ যার নড়ন চড়োন নাই এতোকাল ধৈরা- এহন রজনী পরভাতে দিনি রাতি কোন সুময় অসুমায় নাই হে। ফাল দিয়া ফাল দিয়া ওডে। ঠ্যালা সামলানি মুশকিল। ইহার রহস্য অপার।


ক্যাপটেন তাজ তাগো বাগান দেইখ্যা আমুদ পাইল বহুৎ। পুরান পুরান গাছগাছালি। কেডা লাগাইছে কুন কালে কেডা জানে। আজিব- আজিব কা বাত। একপাশি একডা তুলসীর ঝোপ। একডা তক্ষক জিব বাইর কৈরা পাতার আড়ালে লুকাইল। ভাঙা আমগাছের ডালের চার্দিক ঘুইরা ফিইরা দেইয়া হাইসা হাইসা কৈল, তোম শরীফ আদমী হ্যায়। কেয়া আপ কাবুল ছে আয়া হে?

কাবুল কি ফায়সালাবাদ ইরাক কি ইরান মিশর কি আপ্রিকা এগুলার খবর তার জানা নাই। এ্যাতে অবিশ্যাস কি? তিনি ঘাড় নাড়তি নাড়তি জবাব দেলেন, সহি বাত। সহি বাত।

ক্যাপটেন তাজ গম্ভীর হৈয়া কৈল, কোই মুশকিল নেহি। হাম চাহতে হ্যায় আপ সব আচ্ছা হো যায়ে। হাম তুমহারা বিবিকো পেটসে সহি বাচ্চে কো জনম দেঙ্গে।

ক্যাপটেনের জিপ গাড়িডা হোশ দিলে তাগো বাড়ির সামনে থিকা চৈলা গেল। অন্দর হৈতে বুড়ি আম্মাজি চিক্কুর পাইড়া কৈল- কি করলি হারামি? তর গায়ে পুকা পৈড়বে। তিনি তার চেহারা মোবারকে দলা দলা থু থু ছুইড়া মারলেন। আবার অন্দরে ছুইডা গেলেন। তার কোলে পোলা ছয়ফুল মুলক পা ছুইড়া ছুইড়া কাইন্দা কৈছে-

ও দাদী আম্মাগো কিসের বাইদ্য বাজেগো
দাদী আম্মা-
মোর খিদায় পরান যায়, যায়

তিনি বেহেচান হৈয়া হুজুরে আলার দরবার শরীফে তশরিপ রাকলেন। হুজুরে আলা তহন তাহার বাঁশ বাগানের মাতার উপ্রে চান্দ উডিবারকালে মোরাকোবা কি হালতে ছিলেন। অই অবস্থায়ই তিনি কৈলেন, মুহাম্মদ নিযামুল হক, ক্যা আপকে ঘর পাছ নোকরানি হ্যায়?
-আছে হুজুর।
-ফিকার মাত। কোই মুশকিল নেহি হ্যায়। আক্কলমন্দ কে লিয়ে ইশারা হি কাফি হ্যায়।

তিনি হাত বাড়াইয়া পোলাডারে কোলে লৈলেন। এই পোলার নাম ছয়ফুল মুলক। এ্যাডা যে সে নাম নয়গো। নামের আগে কিসসা আছে। ইউসুফ নবী ( রাঃ) ছিলেন বহুৎ খুব সুরৎ।। তাহার পরে যে বহুৎ সুরৎ আদমী পয়দা হৈবে তাহার জন্যে তিনি দুইডা মোহর বানাইয়া যাইলেন। পারস্যের শেহজাদা ছয়ফুল মুলক পয়দা হৈলে পর তাহার হাতে সোনা দানা মুনি মুক্তা হিরা জহরত কা সাথ মোহর দুইডাও আইসা পড়ল। মোহর দুইডার একডায় আছিল যাহার তছবির তাহার নাম এই বেডা পারস্যের শেহজাদা ছয়ফুল মুলক আর অন্য তছবিরে পরিস্তানের শেহজাদি বদিউজ্জামাল। তারই লাইগা ছয়ফুল মুলক বাইর হৈল দৈরার সফরে হে।

আর এই ভাবী সফরী আদমী ছয়ফুল মুলক এহন মাত্র চাইর মাসের পোলা মাত্তর। অতি তুলতুল। লেকিন ক্ষুধায় পরান যায় যায় রে দাদীআম্মা, কিসের বাইদ্য গো বাজে...। শুকনা ঠোঁডে বারবার জিব্যা চাইটা লৈতাছে। তার বাম কানডা ব্যাকা। আর এই ব্যাকা কানডার দিকি চাইয়া দেখলেন নিজাম উকিল মোরাকোবা কি হালতি আদমী লাহান ফিরা যাইতাছে পাকমন মে। তার হাতে বেহেশতের কুঞ্জি আর সেই খাতাখানা- তার পাতায় পাতায় লেইখা যাইতাছেন কেডা কেডা দুষ্কর্মে লিপ্ত আছে, কেডা জয়বাংলা কৈছে, কেডা জানি দুশমন ইনডিয়ার দালাল, কারা কারা এহনো বাঁইচা আছে- আখেরে বাঁইচা থাকপার কুনো উপায় নাইকা। তাইলে বলেন হগলে,

পাক সার জমিন সাদ বাদ-

ক্যাপটেন তাজ খোশ আমদেদ কৈয়া পাশের ঘরে চৈলা গেলেন। যাইতি যাইতি কৈলেন, কোই মুশকিল নেহি হ্যায় ইমাম সাব। আগে যায়ে।
-এ কেয়া হ্যায়?
-সাচ্চা পাক জেনানা মহল। দে আর গোয়িং টগ বি মাদারস অব সহি পাক আদমী। ইয়ে কোই হরতেঙ্গেজ বাত নেহি হ্যায়।

তহন যে দর্জা দিয়া ঢুইক্যা গেলেন, হেই ঘরে যারা বিমর্ষ বদনে হতবাক চউক্ষে চাইয়া আছে তাগো কাউরি চিনবার পারছেন না ইমাম। সব কুছ ক্যান জানি অচিন অচিন মালুম হৈতে লাগল। কিম্বা হগলেই তার অতি চিনা অতি চিনা। এ্যার মৈদ্যি থাইকা কারে তিনি ডাকতি আইছেন- না বুঝবার পাইরা এট্টু ঘাবড়াইড়া গেলেন বটে। লেকিন তার অতি সহবত কা ঠোঁডে ডাইকা উডলেন- শেফালী! শেফালী? শেফালী বেগম।

এক জেনানা তার সামনে আইসা খাড়াইয়া দাঁড়াইল। আহিস্তা আহিস্তা হুজুরে আলা ইমাম সাবের চোখের উপ্রে থেইকা কালা দোপাট্টাডা খুইলা ছুইড়া মারল ঘরের মৈদ্যি। জেনানারা টুকরা টুকরা কৈরা কালা দুপাট্টাডা ছিড়া লৈয়া অঙ্গ ঢাকপার চেষ্টা কৈরলেন বটে। কিন্তু একডা মাত্র অঙ্গও ঢাকল না। অঙ্গের কী শ্যাস আছে হে। অঙ্গের মৈদ্যি আবার পাকমন শিশু অঙ্গ বাইড়া উডবার লাগছে। আর যারা কালা দোপাট্টার এক টুকরাও হাতে পাইল না তারা চিক্কুর পাইড়া কৈল- এই ল্যাংটা শকুন বেডারে কেডা ঢুকপার দেছে। অরে তাড়া তাড়া তাড়া..

শেফালী কি শেফালী বেগম কি হায়াতুন্নিছা কি মুছাম্মৎ হায়াতুন্নিছা কি মুছাম্মৎ হায়াতুন্নিছা খাতুন অনেকদিন পর দেখবার পারল- হুজুরের চউক্ষু নাই। আন্ধা। বা কান ব্যাঁকা। গাত্র বন্নে চান্দনি রোশনী। চউক্ষের খোড়ল থেইকা যা ঝরতাছে তা আবে জমজম নয়- নয় সিন্দু কি বিপাশা,- লোহু, তপ্ত এবং মদুমতি অথবা পদ্মা অথবা বেম্মপুত্তর অথবা নবগঙ্গা অথবা গড়ুই অথবা সুরমা অথবা ম্যাঘনা অথবা পায়রা অথবা পশুর অথবা আগুনমুহার তেজি পানির লাহান লেলিহান লহু, ধক ধক কৈরা হগল কিছু পুড়াইয়া দেয়, নষ্ট কৈরা দেয় হে ..

ক্যাপটেন তাজ নিজাম উকিলের নোড খাতাডা মিলাইয়া দেকল, আর লোকগুলানরে ডাইক্যা কৈল- ইনসান আলী?
ইনসান আলী পা ঘষটাইতে ঘষটাইতে টেবিলের সামনে খাড়াইলেন। চউক্ষু দুইখ্যান ফুইল্যা গ্যাছে। নখের ভিতরে সুঁই। ইনসান আলী কুনো কথা কৈলেন না। নিজাম উকিল মাতাডা নাইড়া কৈল, জ্বী আচ্ছা স্যার। মুক্তিগো বাপ ইনসান আলী হ্যায়।

ইনসান আলীর পিছনে পিছনে তার লায়েক পোলা হুমড়ি খাইয়া পৈড়তে পৈড়তে নিজাম উকিলের দিকি আখেরীবার চাইয়া কৈল, চাচা- আপনে মানুষ না। জানোয়ার। জানোয়ার হে।

ক্যাপটেন তাজ চা খাইতে খাইতে হাইসা উডল। কাপে চুমুক দিতি দিতি নিজাম উকিলরে কৈল- ঘাবড়াইয়ে মাৎ। হাম উনি আজাদ কর রহে হ্যায়। উই উইল সেনড দেম টু দি দোজগ। দে ক্যান ফাইট দেয়ার এ্যাজ মুক্তি। হা হা হা।

জানালা থেইকা খানিক তফাৎ মে তালগাছগুলানরে দেহা যায়। মাঝখানের গাছডায় ইনসান আলী, বাঁয়ে বড় পোলা ডাইনে মাইজা পোলা। তলায় কুডি কুডি আরও চারডি পোলাপান। ধমাধম কৈরা অগো হাতে পায়ে বুকি লোহার পেরাক পুতা হৈল। তিনজুনারই মাথা ঝুইলা পড়ছে। নিচের কুডি কুডি পোলাপানগুলান সামনে গর্তে ধবাস কৈরা ঝৈরা পড়ল। ইনসান আলী শেষবারির লাহান কৈয়া উডল, জয় বাংলা। আর কিছু শোনা যায় নাই। পাশের ইডের পাজায় যে হগল পাতি শিয়াল হাড্ডি গুড্ডি চাটতিছিল তারা আচানক ভয় খাইয়া গেল। লেজ তুইলা দূরি পলাইয়া গেল। নিজাম উকিলের পিড চাপড়াইয়া ক্যাপটেন তাজ কৈল- আচ্ছা কাম। আপ সাচ্চা পাকিস্তানী আদমী। কেয়া আপ কাবুল ছে আয়া হে?

ইমাম হুজুর শুধু ফরমাইলেন, আপ হামেশা মেরী বাত পর একিন করে। তাহার কাছে সবই জানা। তিনি আসমানে তাকাইলেন। আর অমনি ঝর ঝরাইয়া বারিষ নামল। এই বারিষে বহুদিন বাদ গোসল হৈল। কৈইন্নার চুল ছিড়্যা ছিড়্যা খাডো হৈয়া গেছিল। নয়া চুল গজাইল। হাডু পর্যন্ত কালা চুল নাইমা আইল। হুজুরে আলা কৈলেন, আর তার ছিন্ন কুচযুগল পুনর্গঠিত হৈল। উহা আগের চাইয়া বহুৎ খুবসুরৎ। ঝিল মিল কৈরা ওডে। কৈইন্না ফির বালেগ বনেগা। ইহা অবিশাস্য নয়কো। ইহার রহস্য অপার হে।

এই রহস্যের কুন কুল কিনারা নাই। কারণ তাকে যহন গোরা সৈন্য কি ইনডিয়ার মেলিটারি কি নাবালেগ ছেলে ছোকরা বাঁশবাগান হৈতে মোরাকোবা কি হালতে জেলখানার দিকি টাইন্যা লৈতে আসতি আছিল তহন তিনি অই অবস্থায়ই আঙ্গুলি বিস্তার কৈরলেন- আর আছছোরোমের খালডার পাশে পুরানা পাকুড় গাছ ঝপাৎ কৈরা পানির মৈদ্যি পৈড়া গেল। এ্যাতে এ্যাতো শব্দ হৈল যে উপারে নতুন ইস্কুলের লগে খানসাবের বাসার ভিতরে এক ঝাঁক রাজহাস প্যাক ফ্যাক কৈরা উডল। খানসাব শ্যাখ সাবের চাচা লাগে। সাং গিমাডাঙ্গা। টুঙ্গিপাড়া। তিনি মৃত লোকদের লিস্টি রচনায় ব্যেস্ত আছিলেন। দৌড়াইয়া আইসা খান সাব কৈলেন- হুজুর ..

হুজুর একবার হাস্য কৈরলেন। হাসিডা তার ঠোঁডের উপ্রে দিয়া মিল্যা গেল। দাঁত দেহা গেল না। আর তহন ইশারা কৈরলেন। দমকা বাতাস উডল। এবং বাঁশবাগানের মাতার উপ্রে চাঁদ উডবার কালে শোলোকবলা কাজলাদিদিগণ গনিমতে আপাগণ নেবুর বনে দুমড়াইয়া মুচড়াইয়া হাহাকারে আতর্নাদে আকুলি বিকুলি কৈরবার লগে লগে ইসরাফিলের শিঙ্গা ফুকিবার লাহান শব্দ হৈল। এই শব্দ নয়া এবং অপার রহস্য পূর্ণ। সমুন্দুরির বেতমিজ হাওয়ার মৈদ্যি তেজি ঢেউয়ির মৈদ্যি ঝড়ে ছেড়া পালের লাহান পৎ পৎ কৈরা কে য্যান চিক্কুর কৈরা উডল- ছয়ফুল মুলক বদিউজ্জামাল

ছয়ফুল মুলক ফিরা তাকাইল না। তাকানোর কুনো সময়ও তার নাই। সামনে বহুৎ সফর। মদুমতি থিকা, কালিগঙ্গা হৈয়া, কচা হৈয়া, পানঘুচি হৈয়া, পশুর হৈয়া, বঙ্গোপসাগর হৈয়া, আরব সাগর হৈয়া..এ সফরের কুনো আদিও নাই অন্তও নাই ..

কে এক নাদান পোলা ইমাম হুজুরের বাড়ির মৈদ্যি ঘোরাঘুরি করতে আছিল। বিরাট বাড়িডা। অনেকগুলান ঘর। কদিন আগেও লোকে গমগম কৈরত। এখুন কেউ নাই। শুনশান। কয়েকডা জালালি কৈতর চাল হৈতে বাগ বাকুম বাগ বাকুম কৈরা ওডে। আর লতাপাতা আগাইয়া আসে জঙ্গল থিকা ঘরের ভিতরে।

নাদান পোলাডা বাঁশবাগান ছাইড়া আম বাগানের মৈদ্যি ঢুইকা পৈড়ল। পুরনো কাচা মিডা আমগাছে তহন অনেক আম ঝুইল্যা আছে। পাড়বার কেউ নাই। সড়াৎ সড়াৎ কৈরা গাছের উপ্রে উইডা গেল। হাতে লম্বা লাডি। আর তহুনি আচানক শিঙ্গা বাইজা উডল। জিন পরীদের হাক। ভয়ে গা শিউরি উডল। পৈড়া যাইতে যাইতে একডা মোডা ডাল ধইরা ঝুইলা বাঁচল। চউক্ষু খুইল্যা দেহে হাওয়া আহে। পাতা নড়ে। আর শিঙ্গা বাইজা ওঠে। জিন পরী বাড়ি পায়রা দ্যায়।
পোলাডা কিন্তু নাদান। বয় ডর কম। উপ্রে ভাল কৈরা চাইয়া দেকল। তারপর লাডি দিয়া আমগাছের মগডালে খোচা মারতি লাগল।

সড় সড় কৈরা পুরান আমগাছের মজডাল হৈতে মাডিতে আইসা পড়ল- ছোড দুইডা পায়ের হাড়। দুইখান হাতের হাড়। বুকির পাজর। আর ছোড একডা মাতার খুলি। খুলির মৈদ্যি হাওয়া ঢুকলি শিঙ্গা বাজে। কু উ উ উ উ ............

এই ফাঁকা বাড়িতি কেউ নাই। নাদান পোলাডা হাড়গুলান নাইড়া চাইড়া দেকতি দেখতি গলার হাড়ের লগে একডা স্বর্ণের হার পাইয়া গেল। আর তার লগে স্বর্ণের তাবিজ। মোম খুইল্যা দ্যাহে ভিতরে পাতলা কাগুজে জাফরানী কাগজে লেহা ছয়ফুল মুলক উরফে চান্দু মিয়া। কাগজডা তার কুনো কামে লাগে না। খালের জলে ছুইড়া মারল। আর স্বর্ণের হারডা গলায় ঝুলাইয়া আরেকডা গাছে কাচা মিডা আম পাড়তি লাইগা গেল।

খালের জলে কাগজ ভাসতি লাগল। কাগজতো নয়। জাহাজ। মাস্তুলি ছয়ফুল মুলক সামনে চাইয়া আছে। অথৈ পাথার। কুনো কুল নাই কিনারা নাই। তাকে পাড়ি দিতে হৈবে এই লম্বা সফর। খুঁইজা বাইর কৈরতি হবে পরীস্তান। সেইহানে খুঁইজা দেখতি হবে কুনহানে আছে শেহেরজাদি বদিউজ্জামাল। তারপর আবারো সফর। এ্যার আদি নাই অন্ত নাই হে

সাক্ষী থাইকো চান্দো সুরুয আকাশেরো তারা।
ফিরায় আনুম কৈন্যা তুমায় খোয়াবেরো পারা।।
যাও পঙ্খি গাও পঙ্খি সামালো সামাল।
ছয়ফুল মুল উল্ক ভনে বদিউজ্জামাল।।



(এরপর-কাকমানুষের দ্বিতায় পর্বে যেতে হবে...)

1 টি মন্তব্য: