সোমবার, ৮ মার্চ, ২০১০

আখুঞ্জীনামা

কুলদা রায়ের 'কাকমানুষের চকখড়ি' গল্পগ্রন্থ থেকে

আখুঞ্জীনামা/১


অতি আদুনিক নোবেল : গৈয়া বাগানের পিয়ারা বিগম

গৈয়া গাছ নিয়া বড়ো বালা-মুছিবত। একবার বাজান বোলায় কৈলো- বাগানে যাইয়া পায়রা দ্যাও। বাগানে গৈয়া দরতে শুরু হরছে। রঙ ঢং আইতাছে। এই সুমায় কাউয়ায় গৈয়া টুকরায়। মহা জামেলা।

গেইসি বাগানে একদিন। একখান বারমাস্যা চটি মাতায় দিয়া গুমায় পড়সি।

ও খোদা, কোত্থিকা য্যান জটপট শব্দ। কু কু করে রে। দেহি কাউয়া উইড়্যা যায়। বোজেন ব্যপারডা।

মুনে করলাম, দুইডা গৈয়া পাইড়া খাই। যেইনা উডসি, বাবসি কুন গৈয়াডা পাড়ুম, অমনি হুনি কে য্যান খিল খিল্যাইয়া হাসে। কেউরি দেহি না। দেহি গৈয়া ডালে একজোড়া রাঙা পা। কী বেপদ, বোজেন?

হেই দিন থেইক্যা কানে দরসি, আর কুনোদিন গৈয়া খামু না। আর কুনোদিন খিলখিলানো হুনমু না। তাতে জেবন থাউক আর যাউক।

কিছুদিন যাইতে না যাইতে মামুজান আইসা কইলেন, এই পোলাডার তো মাথাডাই গেসে।
তিনি নিয়া গেইলেন এক কাচারী গরে। সেইহানে বাজান তামুক খাইতাছে গুড়ুক গুড়ুক কইরা। আর আছেন কয়জুন মামাতো ফুফাতো বাইবোন। এন্ডিগেণ্ডি। ময়মুরুব্বি। আর এক কাজী সাব। আমি কী আর করি। চক্ষু বুইজ্যা ঝিমাই।

হাসু খালা হাত দইরা নিয়া গেইলেন বাড়ির বিত্রে। একখান গর। বালই সাজসইজ্জা। বাবতাছি এইহানে ক্যান আইসি। কী দরকার মোর এই রহম গরে?

চক্ষু তুইল্যা দেহি- টেবিলের উপ্রে একখান প্লেডে দুইডা গৈয়া। টসটসে। আর কেউ নাই। মোর ডর কইরা উডল। কৈলাম, কেউ আছেননি এইহানে?

কেউ নাই। পদ্দার বাইরে দেহা যায় শুদু একজুড়া রাঙা পা। কাইপা উডলাম। অবস্থা বয়ংকর। কৈলাম, কেডা আপনে? কুন পরী?
কানে আইলো হেই খিলখিলানি হাসি। কে য্যান কৈল, মোর নাম পিয়ারা বিগম।

মুই চক্ষু মুঞ্জে দেলাম। আর কুনোদিন চক্ষু খুলি নাই। হেই থেইক্যা চক্ষু মুঞ্জা রাকসি এই বুইড়া কাল পরযন্ত। কুনোদিন দেহি নাই পরীডার মুক।

আইচ্চা, মুই কি বুল করসি?




আখুঞ্জীনামা/২

নয়া ছিঃনেমা : দি বেড বাগ- যহন ছারপুকা আইল
একবার টহি (টকি) দ্যাকপার গেইসি। পাতারহাডে তহনো গানদী বাবুর লঞ্চ আহে নাই। গয়না নৌকায় আইয়া পড়ছি। সদোর রোডে টহি হাউস। নয়া বই- কানেচোন মালা। বিলাক এন্ড হোআইড।

কানচোনরে সাপে কাডছে। মহা হৈ চে গটোনা। মালার অবোস্তা টাইট। কড়ি চালান হৈচি। কড়ি ফালাইয়া ফালাইয়া যাইতাছে। সাপরে দৈরা আনছে। কয়, বিষ তোল।

সাপ পায়ে মুক ডুবাইয়া চুইষা চুইষা বিষ তুলতাছে। বয়ংকর দিরিশ্য। হাতে কেলাপ। গাম দিয়া জ্বর ছাড়ল।।

দেহি, পাশের ছিডে মোর উনি চউক মুছতাছে আর কানতাছে। ডেকসি উঠ্যা পড়ছে। মাইয়া মাইনসের মন। খুব নরোম।
কইলাম, কানতাছো ক্যান?
উনি কথা কয় না। খালি কান্দে। মহা জামেলা।

কই, কান্দো ক্যান। কানচোন বাইচা উডছে। হাসো। এহুন সবাইতো হাসতাছে। আর এইডা হাচা না, টহি, ইসটোরী।
মোর উনি উইডা পড়লেন। কইলেন, টহি ফহি না। ছারপুকা। ছারপুকায় কামড়ায়।
বোজেন ঠ্যালা। ইজ্জত কা সওয়াল। মুই কানে দরছি। জেবনে আর টহি না।

টহি বদলাইয়া হুনছি এহুন ছিঃনেমা হৈচে । বিডিও হৈচে।

হেইদিন গরমে বিমরি খাইতাছি। ছোডো নাতনি আনজুম বিডিও দ্যাখতাছে। নয়া ছবি- এক টাহার খালা।
হডাৎ আনজুম চিক্কুর পাইড়া উডলো, বাগ। বাগ।

মুইতো বয়ে মরি। এই ডাহা শহুরে আবার বাগ আইলো কুনহান থেইক্যা। তাও আবার ৬ তালার উপ্রে! সব্বোনাশ। কামড়াইলে বেপদ।

আনজুম হাইসা কৈল, ভয় খাইসো, দাদায়?
-বয় খামু না? বাগ বৈল্যা কথা। বাগ না, ব্যা..ব্যা..গৃ..ব্যাগ..রো।
না, না। ব্যাগরো হৈব ক্যান। টাইগার হৈব ক্যান। এই দ্যাহো- আনজুম কী এটটা হাতের তালুতে আইনা চউকের সামনে মেইলা দরলো। দীরে দীরে দেহি, ও খুদা, এ যে দেহি মোগো পুরানো ছারপুকা। রক্ত খাইয়া ডোল।

আনজুম গোস্বা কইরা কয়, উহুম। দাদায় ইসমার্ট হও। এইটা ছারপুকা নয়। বেড বাগ। বেড বাগ।

কততো দিনইতো বদলাইয়া গেইলো।
ব্যাডা, ছারপুকার কুনো বদল নাইক্যা!





আখুঞ্জীনামা/৩


আয়ুব খানের ঘোড়া : কে তাহারে চিনতে পারে

আমার মামু গওহর আলী মসতো বড়ো কবিয়াল। জাকড়া চুল। বাউলা ডেরেস।
একদিন গঞ্জ থিক্যা ফিরা মামুরে আর খুইজা পাওয়া গেল না। মূলাদি আর আমতলীর বায়নাওয়ালারা চইলা গেল। তাগো মুক ভার। কেডা আর তাগো আসর জমাইবো। এই চিন্তায় তাগো মাতা আউলা।
মামীর কিন্তু কুনো চিন্তা নাই। খুপ কুশি। আগে গান পসনদো করতো না। কৈতো গানই হ্যার সতীন। আর এহুন রান্না করে আর নিজি নিজি গুনগুনাই গান গায়- নিশিতে যাইও পুল বনে। চউক্ষে কাজল। বুজলাম, বেপার সুবিদার না। কৈলাম, মামু কৈ?
মামী হাইস্যা কুডি কুডি। কয়, দ্যাহো খাডের তলায়।
খাডের তলায়ই মামুরে পাওয়া গেল। মাতার হেই লোম্বা চুল আর নাই। টাক। নয়া চুল গজাইতেছে। কদম পুলির লাহান। আর বোজা যায়- কিছুডা আলকাতরার দাগ চান্দিতে এহনো আচে।
-কী হৈচে মামু?
- আয়ুব খানের আম্রি চুল কাইডা দিচ্ছে। কৈছে নয়া জামানায় এইসব চলবে না।

মামু মাতায় গামছা বাইনদা গঞ্জে গেল। ফিরা আইল দুইদিন পর। মাতায় কিস্তি টুপি। লগে দুইডা ছাগোল। ব্যা ব্যা কৈরা ডাকতেআছে।
-ছাগোল দিয়া কি হরবা মামু?
- ঘোড়া দৌড়ানিতে নামামু।
- ঘোড়া দৌড়ে ছাগোল? বুজবার পারতাছি না।
-সুইজা কাম নাই। এইডা তুমার বাপের ছাগোল না- আয়ুব খানের ছাগোল। মুন্সী সাব দিছেন।

হেইদিন হৈতে মামুর লগে লগে ছাগোল দুইডা। ছাগোল দুইডার লগে লগে মামু। হারাদিন গেরামের ব্যাবাক কাডোল পাতা খাইয়া শ্যাষ। হ্যারপর অন্য গেরামের পাতাও শ্যাষ। আয়ুব খানের ছাগোলের তাগোদই আলেদা। পরের কাডোল পাতা খাইয়া পাঞ্জাবী ঘোড়ার মতো নাদুস নুদুস হৈয়া উডল। হডাৎ কৈরা দেকলে হ্যাগো ছাগোল না- হাছা ঘোড়ার লাহানই লাগে। আর দ্যাশ গেরামের ছাগোল গুলান খাইদ্য না পাইয়া শুটকো ইনদুর হৈয়া গেল।
অবোস্তা আরও জুটিল হৈল- যহন মামু ছাগোলের লগেই গুমান শুরু করলো। মামী রাগে গজ গজ কৈরতে লাগল। আগে আছিল গানের পাগোল। এহুন হৈছে ছাগোলের পাগোল।
মামু কয়, একদুম চুপ। এডি ছাগোল নয়রে। এডি আয়ুব খানের ঘোড়া। সমসসা হৈলে মহাবেপদ।

কাউয়ার চরে সাতদিন দৈরা প্যানডেল বানান হৈল। লেহা হৈল শালু কাপুড়ে- ঐতিহাসিক ঘোড়ার দউড়। আর আইল মাইক। দিন রাইতে বাজতে লাগল- লাল দুপাট্টা মল মল মল।

যেইদিন ঘোড়ার দউড় হেইদিন সহালে দুইজুন কসাই আইসা ছাগোল দুইডারে জবাই কইরা ফেললো। অন্য কুনো কতা নাই। কয়জন বাবুর্চি আইসা রাননা বাননা শুরু করল বড়ো ডেকচিতে। মামু আতকা কৈলো- এইডা কি করলেন? মোর ঘোড়ার দউড় হৈবে ক্যামনে?
লুকগুলান কতা কয় না। গুইরা গুইরা নাচে। আর রাননা করে। আর গান গায়- লাল দুপাট্টা মল মল মল।
মামী শরমে ঘরে গিয়া খিল দিল। খাডের নীচে ডুকলো।

মুন্সী সাবের লঞ্চ কাউয়ার চরে আইসা বিড়ল। মাতায় জিননাহ টুপি। চউক্ষে সুরমা টানা। লোম্ব শেরওয়ানী। কালো মুকাসিন পায়ে। মচোর মচোর শব্দ অয়। চোস পাজামা। আতরেরর গইন্দে নাকের মইদ্যে ছ্যাত কৈরা ওডে। খানা পিনা সারলেন লঞ্চেই। লোম্ব ডেইক ছাইড়া কৈলেন, আইচ্চা বি খানা হ্যায়। দিল তক বি ঠান্ডি হো জায়গা।
মামু বিড় বিড় কৈরা এর মইদ্যে একবার কৈলেন, মোর ঘোড়া দউড়োনির কি অইবে?
মুন্সী সাব দাঁত খিলাইতে খিলাইতে কৈলেন, এইডা তুমার চিন্তা না। গান বানাইচো?
-না।
-সে কি? তুমার এহুন কাম নয়া নয়া গান বানদা। আর নাপসোন্দ গানের কতা পাল্ডাও। আরও কত কি কৈলেন মুন্সী সাব। মেলা হিস্টিরি। হ্যাষে কৈলেন, তাইলে একহান গান হোনাও তো দেহি। হুনি।
গওহর মামু কি আর করেন। গান দরলেন-

প্রাণ সখিগো
অই শোন কদম্বডালে বংশী বাজায় কে?

মুন্সী সাবের নয়া বিবি একবার কেবিন থিকা বাহিরে আইলেন। কিচুক্ষণ চাইয়া রইলেন চরের দিক। আবার কেবিনের মইদ্যে ডুইকা গেলেন। তার বয়স ১৬-১৭ বচোর। মুন্সী সাব হাত দিয়া মামুরে থামাইয়া দেলেন। কৈলেন, তুমার এই প্রাণ সুখিডো কেডা?
-রাদা।
-কদম্ব মানে কি?
- কদম পুল।
- বংশী?
- বাশিঁ।
- আর বাঁশিডা বাজায়- হেইডা কেডায়?
- কিসনো।
- কোন কিসনো? মাইয়াগো লগে দিললাগি করতো যেই কালা বেডা- হেই নিকি তুমার কিসনো?

মামু কুনো কতা কৈল না। মুন্সী সাব ঠান্ডা গলায় হুকুম দেলেন, এই ছাগোলডারে বান অই খাজুরগাছের লগে। আর অর কান দুইডা কাইডা ফ্যালা। হালায়, মালাউনগো গান গায়!
মুন্সী সাব ঘোড়া দউড়ানির মাডের দিক হাডা দিলেন।

হেইদিন কাউয়ার চরে লুকে লুকারণ্য। কুনো জাগা ফাকা নাই। ইস্টেজে মুন্সী সাব নাক ডাকতেআছেন। খানাপিনা আচ্ছা হৈচে তো। আর বয়সডাও তো কম না। মাইকে বাজতেআছে- আর কিচুক্ষণের মইদ্যে শুরু হৈবে । অইতিআসিক ঘোড়ার দউড়। এডি যে কুনো ঘোড়া লয়গো। এইডি পিল্ড মার্শাল আয়ুব খানের ঘোড়া।

মুন্সী সাবের গুম বাঙতে বাঙতে রাইত নাইমা আইল। চর জুইড়া গুডগুডা আনদার। দুএকডা জুনাকি পিরিক পিরিক কৈরা জ্বলে। এর মইদ্যে কুন সুমায় ঘোড়ার দউড় শুরু হৈল বুজবার পারলাম না। আবসা আলোতে দেকলাম, কয়ডা শুডকি ইনদুর দউড়াইতাছে জিমাইতে জিমাইতে। আর হ্যাগো পিচে একডা মানুষ মেলা কষটে দউড়ানোর বঙ্গি করতাচে। লুকডা ঠিকমতো খাড়াইতেই পারে না। দউড়াবে কি! পইড়া পইড়া যায়। আর দুইডা দইত্য হ্যার ঘাড় দইরা তক্ষুণি উডাইয়া দ্যায়। হাইকা কয়, দৌড়া- ঘোড়া দৌড়া।

মেলাদিন পরে গঞ্জে গেছি। লঞ্জ গাডে দেহি ছুডো খাডো বিড়। বিড়ির মইদ্যে একডা লুক কিমরির বড়ি বেচতেআছে।
মাতায় জিননা টুপি। কানের জাগায় কান নাই। হেইহানে ছাগোলের দুইডা কান দড়ি দিয়া বানদা।
কৈলাম, মামু, অ মামু!
কেডা কার মামু? লুকডা বেঞ্জু বাজায় আর গান গায়-

পিয়ারা দোসতো গো
অই শোন খাজুর তলায় শিঙ্গা ফুকায় কে?

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন