শুক্রবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০০৯

পারুলবৃক্ষ দুই বোন


পাপড়ি রহমান


পাথরের শ্লেটের উপর কয়লা ডলে সাদা করার চেষ্টা করেও আমরা বড় বেশি সুবিধা করতে পারি না। অর্থাৎ শ্লেটকে হিকজিক খাওয়াতে পারি না। পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলার পর দেখি মসৃণ-ঠা-া-কালো রঙ যেন আরো জেঁকে বসেছে। আমরা এত ঘন ঘন কয়লা ডলি, তবু তা আগের চেয়ে আরো কালো কুচকুচে হয়ে ওঠে। আমরা শ্লেটগুলো ঘষে মেজে পরিষ্কার করি আর ভয়ে ভয়ে থাকি_ দাদাজানের হাতে পড়লে আর রক্ষা নেই। দাদাজান আমাদের শ্লেটে পেন্সিল দিয়ে ফুলগাছ অাঁকবেই অাঁকবে। অন্য কোনো ফুলগাছ না_ একটা বড়সড়ো শেফালি ফুলগাছ। অবশ্য দাদাজানের শেফালি ফুলগাছে পাতার চাইতে ফুল ধরে বেশি। আমরা অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখি আর ভাবি_ ইস্সিরে! কবে আমরা ওইরকম একডা আস্ত ফুলগাছের অাঁক কষতে পারুম। কয়লা ঘষে শ্লেট পরিষ্কার করে আমাদের হাত কালো হয়ে থাকে। ওই কালো হাত দিয়ে আমরা কপালের ঘাম মুছি, নাক চুলকাই। আমাদের কপালে-নাকে কালো ছোপ লেগে থাকে। কিন্তু, আমরা তা বুঝতে পারি না। কপাল-নাক কালো করে আমরা ঘুরে বেড়াই। এদিকে দাদাজান হামানদিস্তায় ছেঁচা পান গালে পুরে মনের সুখে শেফালি ফুলগাছ এঁকে চলে। দাদীজান, ফুপুজান, চাচীজান আর মাকে সামনে পেলেই বলে_ তুমরা পদ্দা কর। পদ্দা কর। পদ্দা হইলো ধম্মের পরথম কথা।

ধম্ম বা অধম্ম কি তাও আমরা বুঝি না। কিন্তু দেখি সবাই কালো আলখেল্লা পরে বাইরে বেরোয়। আমরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করি। কখনো বা বিশু ফিসফিস করে বলে_

এনারা কি ইমাম সাহেব হয়া গেল নাহি?

পরে বুঝতে পেরে বলি_

ইমাম টিমাম না এনারা বোরখা পইরা চলাফেরা করতাছে।

দাদাজান আমাদের ধোয়া-মোছা-পরিষ্কার শ্লেট পেলেই তাতে শেফালি ফুলগাছ অাঁকে।

হয়তো আমরা ভেবে রেখেছি ওইখানে লিখব_

'জুলেখা বাদশার মেয়ে। তার ভারি অহঙ্কার। সে সব সময় মুখ ভার করিয়া থাকে। একদিন সে বাগানে গেল।'

দাদাজানের ফুলগাছের জ্বালায় আমরা কিছুই লিখতে পারি না। কখনো রেগে যাই_ হালার বুইড়া কুনহানকার! আমাগো পরিষ্কার শেলেট পাইলেই ফুলগাছ আঁইক্যা ভইরা থুইয়া দেয়'।

তবে অনেক বেশি রাগতে পারি না_ কারণ দাদাজানের ফুলগাছ আঁকার কারিশমা আমাদের প্রায় মোহগ্রস্ত করে রাখে। আমরা দাদাজানের চারপাশে গোল হয়ে বসে একমনে ফুলগাছ আঁকা দেখি। দেখতে দেখতে উঠানের শেফালি ফুলগাছটা আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। আমরা মেলাতে চেষ্টা করি কোনটা কেমন আসলে? দাদাজানের শেফালি ফুলগাছটা কি উঠানেরটার মতো হইলো নিহি? এইসব হিসাব-কিতাব নিয়া আমরা এতই মগ্ন থাকি যে, মনোয়ারা কাক্কি যে দাঁড়ানো অবস্থা থেকে দড়াম করে পড়ে যায় তা আমরা টের পাই না। টের পাই যখন চাচীজান আর মা মিলে কুয়া থেকে বালতিকে বালতি পানি তুলে কাক্কির মাথায় ঢালতে থাকে। পাকঘরের সামনে এত পানি জমে যে, আমাদের মনে হয় ছোটমোট একটা নদীই বুঝি বয়ে যাচ্ছে। আমরা তখন ওই নদীতে ছপছপ করে পা ভিজিয়ে বলি_

আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে

বৈশাখ মাসে তার হাঁটুজল থাকে ...

চাচীজান আমাদের ধমক মেরে চুপ করাতে চায়। কিন্তু আমরা ভ্রূক্ষেপ করি না। কিচিরমিচির করে আমাদের ছোট নদী বলতেই থাকি। আর আড়চোখে দেখি মনোয়ারা কাক্কি চোখ বুঁজে পাকঘরে পড়ে আছে। কাক্কির মুখটা একেবারে বেলেমাছের মতো ফ্যাকাশে দেখায়। চট করে বিশু বলে_

'দেখছস কাক্কিরে বাইল্যা মাছের মতো ফ্যাকাশে লাগতেছে।'

শুনে যুথি বলে_

'ল যাই বাইল্যা মাছ ধইরা আনি।'

_তক্ষুণি আমরা মনোয়ারা কাক্কিকে ফেলে পুকুরের পাড়ে দৌড়াই। বাইল্যা ধরা কি আর কঠিন কিছু? এত ভোদাই মাছডা! এই ভোদাই শব্দটা আমরা সদ্য শিখেছি। আমাদের কলেজপড়ুয়া মাহমুদ চাচা প্রায়ই বলে_

'তুই একটা আস্ত ভোদাই'

চাচার কথা শুনে আমরা মনে মনে ভাবি আমরা আসলে কতোটা ভোদাই? পুকুরের কিনারে এসে শুয়ে থাকে ভোদাই বেলেমাছ! টলটলা পানি থেকে তাকে তুলে আনা এমন কোনো ঘটনাই না। বাইল্যা মাছ কি কানা নিহি?_ আমরা যখন ধরে ফেলি তখন সে আর ছুটতে পারে না!

দাদাজান আগের বুলি ছাড়ে_

পদ্দা কর। পদ্দা কর। পদ্দা হইলো পরথম ধম্ম। দাদীজানকে আমরা একদিন আর চিনতে পারি না। খাকি রঙের বোরখায় আপাদমস্তক ঢাকা দাদীজানকে মিলিটারির ট্রাকের মতো দেখায়। দাদীজানের মুখের উপর চৌকো একটা পর্দা' পড়ে থাকে। চোখ আর নাকের জায়গাটায় চারকোণা জাল লাগানো। দাদীজানরে আর চেনাই যায় না। মিলিটারি বোরকা পরে দাদীজান খালি হোঁচট খায়। দাদীজান হোঁচট খায় তারপরও দাদাজান বলে_

'পদ্দা কর। পদ্দা কর।'

দাদীজান পর্দা করে আর তার মিলিটারি বোরখার পকেট দুইটা আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকে। দাদীজান কারো বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেই বোরখার পকেট থেকে বেরোয় চিনির সন্দেশ, নিয়ালি কলা, নারকোলের নাড়ু, আরো কত কি!

কিন্তু দাদীজান প্রায়ই হোঁচট খেয়ে পড়ে বলে আমাদের রাগ যেয়ে পড়ে দাদাজানের উপর_

হালার বুইড়া তুই পুইড়া খা-গা। খালি কয় পদ্দা কর পদ্দা কর।

আমরা সমানে দাদাজানরে শাপ-শাপান্ত করি। কিন্তু দাদীজান পাড়া বেড়িয়ে এলে যখন সন্দেশ-কলা-জিলাপি হাতে পাই তখন খুশিতে বাক-বাকুম করি। মিলিটরি বোরখার পকেট না থাকলে দাদীজান কীভাবে এসব খাবার আনতো?

খাবারের লোভে দাদীজানের পেছনে আমরা বেশি বেশি ঘুরঘুর করি। কিন্তু দাদীজান একদিন বোরখা পরা অবস্থায় এমন হোঁচট খায় যে তার বাঁ হাত ভেঙে যায়। কুয়ার ঠাণ্ডা পানিতে দিনমান হাত চুবিয়েও বেদনা কমে না। দাদাজান মুরগির কচি বাচ্চা ছেঁচে ভাঙা হাতে প্রলেপ দেয়, কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় না। আমরা মন বিষণ্ন করে এতসব কা- দেখি। দাদীজানের জন্য লুকিয়ে লুকিয়ে কান্না করি। ক্যান হের হাতডা বাঙলো? নিয়ালি কলা আর চিনির সন্দেশের গন্ধ ভুরভুর করে নাকে এসে লাগে। কিন্তু দাদীজানের ভাঙা হাত দেখে আমরা নিয়ালি কলা আর চিনির সন্দেশ হাওয়ায় ভাসিয়ে দেই। ধুর। যাউকগা হেইসব। দাদীজানের ভাঙা হাতডা কবে ভাল হইব?

দাদীজান ভাঙা হাতের বেদনায় কাতরায় আর আমরা সারাবাড়ি টইটই করে বেড়াই। ফের ভাল করে কয়লা ডলে পাথরের শ্লেট পরিষ্কার করি। দাদাজান মুরগির কচি বাচ্চা ছেঁচতে ছেঁচতে শেফালি ফুলগাছ আঁকার কথা ভুলে যায়। আমরা তখন চকচকে কালো শ্লেটের উপর লিখি_

'গনি মিয়া একজন কৃষক। নিজের জমি নাই। অন্যের জমি চাষ করে। তাহাতে ধান হয়, পাট হয়। সে তাহার অর্ধেক ভাগ পায় ....'।

আমাদের লেখা শেষ হয় কি হয় না। মনোয়ারা কাক্কির ঘরে বাড়ির মেয়েরা হুড়মুড় করে ছুটে যায়। আর আমরা চিলের মতো কান খাড়া করে রাখি। লেখাপড়ায় আমাদের আর মন বসে না।

আমরা দেখি মা আর চাচীজান মনোয়ারা কাক্কির ঘর থেকে দুইটা সাদা পুতলা বের করে আনে। আমরা পড়িমরি করে দৌড়াই। বাড়ির সবাই ভিড় করে পুতলা দেখে। আমরাও দেখি। মনোয়ারা কাক্কির মতোই ধপধপা ফর্সা তারা। এক্করে বাইল্যা মাছ। কিন্তু তারা চক্ষু খোলে না। আঠা দিয়া তাদের চক্ষু জোড়া লাগানো? পুতলা দুইটা দেখে বড়রা বলে_

'সাত মাসেই পইড়া গেলতো তাই চক্ষু ফোডে নাই।' সাত মাস কি, পড়ে যাওয়া কি, আমরা বুঝতে পারি না। উঁকিঝুঁকি মেরে দেখি মনোয়ারা কাক্কি রক্তের নদীতে শুয়ে আছে। কাক্কির সায়াতে চাপ চাপ রক্ত। এত রক্ত আইলো কইথন? মনোয়ারা কাক্কি কি রাক্ষুসির ছাওনি? মা-গো!

মনোয়ারা কাক্কিকে রেখে উঠানে এলে দেখি মা আর চাচীজান পুতলা দুইটারে গোসল দেয়। এত পানি তারা ঢালতেছে কিন্তু পুতলারা ট্যাঁ-টুঁ কিছুই করে না! আশ্চয্যি কা- তো! গোসল দিয়া তাদের সাদা কাপড়ে মুইড়া দেয়। পুতলাদের মাথার কাছে প্যাঁচ দেয়া সাদা কাফন দেখে আমরা হতবাক হয়ে যাই।

বিশু বলে_

'মইরা গেছে গা।'

আমি বলি_

'হ'

যুথি কিছু বলে না। আতঙ্কিত চোখে তাকিয়ে থাকে। তারপর বাড়ির বড়রা ছোট দুইটা গর্ত করে। একেবারে হাতখানেক গর্ত। গর্তের ভিতরে সাদা কাফনে মোড়া পুতলা দুইটারে শুইয়ে দেয়। মাটিচাপা দিতে দেখে আমরা কাঁদতে থাকি। তখন বড়রা এসে হাত ধরে আমাদের ঘরে টেনে নিয়ে যায়। দাদীজানও ভাঙা হাত নিয়ে আমাদের সাথে কাঁদতে থাকে।

ওই ছোট দুইটা কবরের পাশে আমরা প্রায়ই চুপচাপ বসে থাকি। মনোয়ারা কাক্কি প্রায়ই এসে কবর দুইটা দেখে আর হাউমাউ করে কেঁদে বলে_

'আল্লারে মাইয়া দুইডারে ক্যান নিলি?'

মনোয়ারা কাক্কির কান্না দেখে আমরাও গোপনে চক্ষু মুছি। একদিন যুথি বলে_

'জানস ওগো কবর থিক্যা গাছ বার অইব।'

'মিছা কতা কইস না।'

'না মিছা, না, হাছা কতা। সাত ভাই চম্পাগো গাছ, বার অইছিল না?'

'আরে ধুর হেরাতো পুলা আছিল।'

'পুলা আর মাইয়া কি? দেহিস গাছ অইব আর ফুল ধরব।'

ফলে আমরা অপেক্ষায় থাকি। এত ছোটমোট দুইটা কবর। এমন ছোট কবর আমাদের কবরস্থানে আর একটাও নাই!

দীর্ঘদিন পার হয় কিন্তু কোনো গাছ জন্মায় না। আমরা তবু ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করি। এভাবে বর্ষাকাল এসে পড়ে। কয়েকদিন তুমুল বৃষ্টির পর আমরা দেখি সত্যি সত্যি জোড়া কবরে গাছ জন্মেছে। তবে দুইটা না। চার-পাঁচটা। আমরা তখন ধন্ধে পড়ি। পারুলবোন গাছ কোন দুইটা? চার-পাঁচটা গাছ তরতরিয়ে বেড়ে ওঠে_ কিন্তু আমরা চিনতে পারি না কি গাছ এইগুলা? না চিনেও এইগুলাকে আমরা পারুলগাছ বলে ডাকি। মনে মনে ভাবি গাছ চার-পাঁচটা হইলেও ক্ষতি নাই। ফুল ধরবো দুইটা। আর দুই-দুইটাই পারুল বোন। আমরা পারুল বোন বলে ডাকলেই তারা সাড়া দেবে। কিন্তু পারুল ফুলও তো আমরা চিনি না। তখন শ্লেট থেকে গনি মিয়াকে কয়লা ঘষে তুলে ফের ঝকমকে করি। ভাল করে ধুয়েমুছে দাদাজানের হাতে দিয়ে বলি_

'দাদাজান একডা পারুল বুইন অাঁইকা দেন।' দাদাজান অবাক হয়ে তাকিয়ে বলে_

'পারুল বুইন কিডা জিনিস?'

আমরা তখন দাঁত দিয়ে জিভ কেটে বলি_

'না না বুইন না পারুল ফুল আঁইক্যা দেন।'

'পারুল ফুল আমি আঁকবার পারি না। পারুল ফুল দিয়া তুমাগো কাম কি?'

আসলেই তো পারুল ফুল দিয়া আমাদের কাম কি। দাদাজান তখন ফের শেফালি ফুলগাছ আঁকতে শুরু করে। আর আমরা বিষণ্ন মনে পারুলবোনদের কবরের কাছে দৌড়ে যাই। গিয়ে দেখি জোড়া কবরের উপরে কোনো গাছ-লতার চিহ্নমাত্র নাই! আমরা কি করবো বুঝতে পারি না। তখন আমাদের মনে পড়ে পারুলবোনদের কবরের চারপাশে কোনো বেড়া ছিল না। ফলে গরু বা ছাগল হয়তো সাবাড় করে দিয়েছে। পারুলবোনদের কবরে আর কোনো পারুল গাছ নাই দেখে আমরা জোরে কেঁদে ফেলি। গাছ নাই আমাদের বোন দুটো আর ফুটতে পারবে না।

এভাবেই পারুলবোনদের কবর প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। আমরা তবু খুঁজে খুঁজে চিহ্ন রাখার চেষ্টা করি। দাদাজান শ্লেটে শেফালি ফুলগাছ অাঁকতে অাঁকতেই শরৎকাল এসে পড়ে। আর আমাদের উঠানের শিউলি গাছটা ফুলে ফুলে সাদা হয়ে যায়। গাছের তলায় শিউলি ফুল কুড়াতে কুড়াতে আমরা চোখ মুছি। আমাদের মনে পড়ে পারুলবোনদের গাছ গরু বা ছাগলে সাবাড় করে দিয়েছে। কাঁদতে কাঁদতেই হঠাৎ আমাদের মনে আসে সাত ভাই চম্পার বোনের নাম পারুল না হয়ে শিউলি হলো না কেন? শিউলি হলে আমাদের মরে যাওয়া বোন দুটো হয়তো এভাবে ফুটতে পারতো।

আমরা কি তাহলে বলতাম_

দুই বোন শিউলি, জাগোরে জাগো।

কিন্তু আমাদের কানে শিউলি খটকার মতো শোনায়। আমরা তৎক্ষণাৎ মত পাল্টে ভাবি_ না, পারুলাই ভালো। বোনদের কবরে কোনো গাছ না জন্মালেও আমরা তাদের ডাকবো_

পারুল বোনেরা_ জাগো

জেগে ওঠো তো একবার ...

এবং আমরা সত্যি সত্যি ডাকি। ডেকেই চলি।

কিন্তু আমাদের ডাকের কোনো উত্তর আসে না।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন