সোমবার, ৫ অক্টোবর, ২০০৯

বিশ্বায়নে ঋষিপ্রবাহ : এবার তবে জোড়ার পালা

কলিম খান


সংস্কৃতিপ্রসঙ্গ : ঋষিপ্রবাহের কথা
......................
বঙ্গীয় শব্দকোষ গ্রন্থে ‘ঋণ’ শব্দের অর্থ দিতে গিয়ে হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, ‘মনুষ্য জন্মমাত্র তিন ঋণে বদ্ধ হয়’ পিতৃঋণ, দেবঋণ, ও ঋষিঋণ ; আর সেই ঋণ শোধ করার উপায় হল পিতৃতর্পণ, দেবতর্পণ, ও ঋষিতর্পণ করা।
এগুলি বাংলা কথা হলেও, এসব কথার অর্থ আমরা ইংরেজি-জানা বাংলাভাষীরা এখন বুঝতে পারি না, যেকারণে এই কথাগুলিকে ইংরেজিতে অনুবাদ করা যায় না ; খুব চেষ্টা করলে বড়জোর খানিকটা ভুল অনুবাদ করা যায়। আর যে-বাংলাভাষীরা ইংরেজি জানেন না, ইতিহাসের মারে তাঁরাও এর অর্থ গেছেন ভুলে। তবে, সদ্য হাতে-আসা বাংলা ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থবিধি১ অনুসরণ করে এগোলে আমরা এর সরল অর্থটি সহজেই বুঝে নিতে পারি, তখন চাইলে এর ইংরেজি অনুবাদও করে ফেলা যায়। কেবল তাই নয়, আজ আমরা ‘সংস্কৃতি’, ‘কৃষ্টি,’ ‘ঐতিহ্য’, ‘কালচার,’ ‘জ্ঞান’, ‘নো-হাউ’ ও ‘ইনফরমেশন’ প্রভৃতি নানা শব্দে মানুষের মানসম্পদের প্রবাহক যে খণ্ড খণ্ড করে বিচ্ছিন্ন ঘনবস্তু রূপে বুঝে থাকি, আমাদের প্রাচীন পূর্বপুরুষেরা সেগুলির সমগ্র চেহারাটিকে কেন অখণ্ড প্রবাহ রূপে বুঝতেন এবং সে বিষয়ে তাঁদের অভিপ্রায় কী রূপ ছিল, তাও জানতে পারি।
তবে, সে-কথায় যাওয়ার আগে মনে রাখা চাই, বিশ্বের সমস্ত প্রাচীন সাহিত্যে বেদ-পুরাণ-রামায়ণ-মহাভারত-বাইবেল-কোরআন-ত্রিপিটক-ইলিয়ড-অডিসি ও পশ্চিমের পুরাণাদি গ্রন্থে মানবজাতির যে-অর্জন লিপিবদ্ধ রয়েছে, তাতে বিশ্বের সকল মানুষের সমান অধিকার। তা কোনো দেশের বা জাতির, কোনো বিশেষ ধর্মাবলম্বীদের বা ধর্মহীনদের নয়; বিশ্বের সমস্ত মানুষের। কেন, সে অনেক কথা, এবং প্রয়োজনে সে-সব কথা বারান্তরে বলা যাবে। আপাতত বিষয়ীর কথা মুলতুবি রেখে মুক্ত মন নিয়ে বিষয়ে প্রবেশ করা যাক।
তথ্য এই যে, ‘পিতৃলোকের তৃপ্তিসাধন’ বা ‘পিতৃগণের তৃপ্তিসাধন’কে ‘তর্পণ’ বলে।২ সেকালে ‘পিতৃলোক’ ও ‘পিতৃগণ’ কথাটির অর্থ ছিল এইরকম- ‘পুত্ররূপে জন্মে লোক ভার্য্যার উদরে।’৩ এ- বিশ্বাস পৃথিবীর সকল দেশের সমাজেই কমবেশি ছিল, আছে। তাছাড়া, ছেলে তো প্রায়শ ‘বাপের মতো’ই দেখতে হয়। আমার অস্তিত্বেই আমার পিতার অস্তিত্ব। এই ‘পিতৃ’ আমার মাধ্যমে, আমার পুত্রের মাধ্যমে, তার পুত্রের মাধ্যমে চিরপ্রবহমান এক ‘পিতৃলোক’ গড়ে তোলেন ; আর এই পিতৃলোকে থেকে যান পিতৃপরম্পরায় সমস্ত পিতৃগণ। ভবিষ্যতের দিকে দাঁড়িয়ে দেখলে একে ‘পিতৃপ্রবাহ’ এবং অতীতের দিকে দাঁড়িয়ে দেখলে একে ‘পুত্রপ্রবাহ’ বা ‘সন্তানপ্রবাহ’ রূপে চিহ্নিত করতে আমাদের একটুও অসুবিধা হয় না। এই প্রবাহ রক্ষা করা ও তাতে বেগ সঞ্চার করার জন্য আমার শরীরটিকে বাঁচিয়ে রেখে, সেই শরীরের উত্তরাধিকারীর সৃষ্টি করে যেতে পারলে প্রবাহটি অব্যাহত থাকে। এই কাজটিই ‘পিতৃতর্পণ’-এর ফলিত প্রয়োগ, আর পিতৃতর্পণ মন্ত্রটি হল ক্রিয়াভিত্তিক ভাষায় প্রকল্পিত তার কোড মাত্র। অর্থাৎ, সন্তানপ্রবাহ রাখাকেই পিতৃতর্পণ বলে এবং জীবমাত্রেই এ-কাজ করে থাকে, কিংবা নেচার তাকে ঘাড়ে ধরে করিয়ে নেয়।
স্বভাবতই সন্তানপ্রবাহ অব্যাহত রাখার কথা মানুষও ভাবে। কিন্তু ভাবলেই হয় না। তার জন্য অনেক কিছুই লাগে। সবার আগে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় বাহ্যসম্পদ লাগে, সঙ্গিনী ও সন্তানের জন্যও সে সম্পদের প্রয়োজন হয় ; সে-সব সম্পদ সৃষ্টি করা, সংগ্রহ করা, রক্ষা করা ও তার বিকাশ সাধন করার জন্য এবং সর্বোপরি সবগুলি ব্যাপারের মধ্যে সামঞ্জস্য রক্ষা করার জন্য অবশ্যই প্রয়োজন হয় যথেষ্ট পরিমাণ জ্ঞানবুদ্ধির। অর্থাৎ সন্তান উৎপাদন, বাহ্যসম্পদ-সৃজন, এবং মানসসম্পদের প্রয়োগ করে তবেই পিতৃগণের তৃপ্তিসাধন করা যায় ; সন্তানপ্রবাহে যথার্থ বেগ সঞ্চার করা যায়। সেকালে বাহ্যসম্পদের প্রবাহে বেগ সঞ্চারকে ‘দেবতর্পণ করা’ এবং মানসসম্পদের প্রবাহে বেগ সঞ্চারকে ‘ঋষিতর্পণ করা’ বলা হত।
আসলে আমাদের প্রাচীন পূর্বপুরুষেরা মনে করতেন, মানুষ জন্মায় তিনরকম উত্তরাধিকার বা ঋণ নিয়ে - (ক) পিতার শরীরের উত্তরাধিকার বা পিতৃঋণ, (খ) পূর্বতন প্রজন্ম পর্যন্ত সমাজের উৎপন্নের উত্তরাধিকার (ঘটিবাটি থেকে ইণ্টারনেট, পূর্বতন সমাজ যা বানিয়ে রেখেছে, যার মাঝখানে মানুষ জন্মায়) বা দেবঋণ, এবং (গ) পূর্বতন প্রজন্ম পর্যন্ত মানুষের অর্জিত জ্ঞানের উত্তরাধিকার (সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার) বা ঋষিঋণ। বিশ্বের প্রায় সকল দেশের মানুষ ধর্মশিক্ষা নিয়ে বা না-নিয়ে তাঁদের স্বাভাবিক প্রাকৃতিক সংস্কারবশেই এই তিন প্রকার ঋণ শোধ করে থাকেন। প্রথম ঋণ শোধ করেন উত্তরাধিকারীর জন্ম দিয়ে ও তার রক্ষণাবেক্ষণ করে, দ্বিতীয় ঋণ শোধ করেন কোনো না কোনো প্রকারের সামাজিক উৎপাদন কর্মে যোগ দিয়ে, এবং তৃতীয় ঋণ শোধ করেন কোনো না কোনো প্রকারের সাংস্কৃতিক কর্মে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে লিপ্ত হয়ে। এর ফলে সন্তানপ্রবাহ, বাহ্যসম্পদ-প্রবাহ ও মানসসম্পদের প্রবাহ অব্যাহত থাকে। একালের ভাষায় এগুলিকে যথাক্রমে যঁসধহ ৎবংড়ঁৎপব ফবাবষড়ঢ়সবহঃ বা মানবসম্পদের বিকাশ, পড়হংঁসবৎ ঢ়ৎড়ফঁপঃরড়হ ফবাবষড়ঢ়সবহঃ বা ভোগ্যপণ্য উৎপাদনের বিকাশ (পড়সসড়ফরঃু ভষড়)ি, এবং পঁষঃঁৎধষ ঃৎধফরঃরড়হ (= ভষড়)ি বা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য - এই তিন জাতীয় শব্দবন্ধের দ্বারা কমবেশি প্রকাশ করা হয়ে থাকে।
জ্ঞানের এই প্রবাহকে বা পঁষঃঁৎধষ ঃৎধফরঃরড়হ-কে এখন থেকে আমরা ‘ঋষিপ্রবাহ’ বলতে চাই। কারণ মানুষের সর্বপ্রকারের জ্ঞান, সংস্কৃতি ইত্যাদি সর্বপ্রকার মানসফসলের প্রবাহকে সমগ্রভাবে বোঝাতে হলে ‘ঋষিপ্রবাহ’ না বলে উপায় নেই। এরই খণ্ড খণ্ড বিচ্ছিন্ন রূপকে একালে আমরা অঙ্ক বিজ্ঞান ইতিহাস নাচ গান সাহিত্য সংস্কৃতি ইত্যাদি নানা নামে চিহ্নিত করে থাকি। খেয়াল করতে পারি না যে, মানসসম্পদের এই প্রবাহের ভিতরে একধরনের ঐক্য ও ‘পূর্ণতা’ এবং ‘ধারাবাহিকতা’ রয়েছে। কার্যত এ হল মনচাষিদের (ঋষিদের) মানসফসলের প্রবাহ, যা কিনা ঋষিপরম্পরায় বা চিন্তক-পরম্পরায় প্রবাহিত থাকে এবং তাঁদের মাধ্যমে দেশের জনসাধারণের মনে আলোহাওয়া ও জলসেচ দেওয়ার কাজ করে। তাই এর স্বভাব অনেকটা বায়ুপ্রবাহের মতো, যা কিনা সমাজের ও মানুষের মনোলোকের আকাশে প্রবাহিত থাকে। একে সমাজের ও মানুষের মনোলোকের ভূমিতে নদীপ্রবাহের মতো প্রবাহিত ধারাও বলা যায়। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘ভারতবর্ষের গঙ্গা, মিশরের নীল ও চীনের ইয়াংসিকিয়াং ... এই সমস্ত নদী মাতার মতো একটি বৃহৎ দেশের এক প্রান্ত হইতে আর-এক প্রান্তকে পালন করিয়া চলিয়াছে। ইহারা এক-একটি প্রাচীন সভ্যতার স্তন্যদায়িনী ধাত্রীর মতো। তেমনি মহাকাব্যও ... ইলিয়ড, অডেসি, রামায়ণ ও মহাভারত।’৪ কেবল তাই নয়, ‘বিদ্যাসমবায়’ নিবন্ধে তিনি লিখেছেন, ‘বিদ্যার নদী আমাদের দেশে বৈদিক, পৌরাণিক, বৌদ্ধ, জৈন, প্রধানত এই চারি শাখায় প্রবাহিত।’ এমনকি ‘বিদ্যার স্রোতে’র মিলনের কথাও তিনি বলেছেন। জ্ঞান ও সংস্কৃতি সম্পর্কে তাঁর এইরূপ ‘ধারাবাহিকতা’র ধারণা ছিল বলেই তিনি ‘শিক্ষার বাহন’ কথাটি ব্যবহার করতেন। অর্থাৎ মানুষের সমাজে মানসফসলের চলাচল বায়ুপ্রবাহ বা নদীপ্রবাহের মতো। সেই কারণে একে ‘ঋষিপ্রবাহ’ বললেই সঠিক বলা হয়।
হ্যাঁ, মানসসম্পদ সৃষ্টির অর্থাৎ ‘ঋষিপ্রবাহে বেগ সঞ্চার’-এর কাজই মানুষের সবচেয়ে মহৎ কাজ; বাহ্যসম্পদ সৃষ্টি কিংবা সন্তান উৎপাদনের চেয়ে তা বহুগুণে শ্রেষ্ঠ। কারণ সেই মানসসম্পদ নিজের প্রবাহকে এবং বাহ্যসম্পদ ও মানবসম্পদ প্রবাহকে রক্ষা করার ও তাতে বেগ সঞ্চার করার ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা গ্রহণ করে থাকে। ঋষিপ্রবাহের এই ধারায় একটি সামান্য গানের কিংবা একটি পত্রিকার প্রকাশও অনেক সময় যথেষ্ট বেগ সঞ্চার করতে পারে, যদি সেই গানে বা পত্রিকায় প্রকাশিত বাকফসল মানুষের ব্যবহারে লেগে যায়।
মানসসম্পদের প্রবাহে বা ঋষিপ্রবাহে হাত লাগানোর মানেই হল পরোক্ষভাবে মানুষের সমস্ত প্রবাহগুলিতেই বেগ সঞ্চারের চেষ্টা, মানবসম্পদ বিকাশের চেষ্টা। এর মূল উপায় হল নিজ নিজ মানবজমিনে সোনা ফলানো বা মনচাষ করা। তার জন্য নিজ নিজ মানবজমিনে ‘কৌতূহল’ ও ‘অজানাকে-জানার-আগ্রহ’র বীজ পুঁততে হয়, এবং বহু প্রাচীন কাল থেকে চলে আসা এবং এখনও বয়ে চলা ঋষিপ্রবাহ থেকে তত্ত্ব-তথ্যের জল নিয়ে তাতে সেচের ব্যবস্থা করতে হয়। এই মনচাষের যত ফসল ফলে তার প্রধান ফলটির নাম ‘সম্পর্ক জ্ঞান’, আর সে জ্ঞান সুরে-ভাবে, সুরে-শব্দে, বিষয়ে-বয়ানে, মানুষে-মানুষে, মানুষে-জীবে, মানুষে-জড়ে, জীবে-জীবে, জড়ে-জড়ে জগতের সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছে। এই মনচাষের সেরা ফসলকে বলা হয় ‘প্রকৃতির সম্পর্কের নিয়মকে জেনে ফেলা’ বা ‘ব্রহ্মলাভ’ করা।৫ ভূতল ও আপেলের মধ্যেকার সম্পর্কের নিয়মকে জেনে ফেলেছিলেন নিউটন ; অসীমে-সীমায়, ভাবে-সুরে বিধৃত থাকা সম্পর্কের নিয়মকে জেনেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাই তাঁদের ব্রহ্মলাভ ঘটেছিল। ব্রহ্মলাভই ব্যক্তিমানবের জীবনের সবচেয়ে বড়ো সার্থকতা। এই ব্রহ্মলাভই অপরদিকে বিশ্বমানবকে এগিয়ে যাওয়ার উপায় সরবরাহ করে, মানুষকে সুখ-শান্তি দেয়, আনন্দ দেয়।
মনচাষের এই ফসলগুলির সবচেয়ে বড়ো অবদান এই যে, সেগুলি মানুষের মনোলোকের উপরের আচ্ছাদনস্বরূপ বিশ্বাসের আকাশটি গড়ে তোলে। এই আকাশের তলাতেই কাটে মানুষের মানসজীবন। আগেই বলেছি, ঋষিপ্রবাহে বেগ সঞ্চারের কাজই মানবজীবনের মহত্তম কাজ। দু-দশ শতাংশ মানুষের সন্তান না জন্মালে কিংবা দু-দশ শতাংশ মানুষ সামাজিক উৎপন্নে হাত না লাগালেও বিশ্বমানবের খুব একটা ক্ষতিবৃদ্ধি হয় না, কিন্তু মানসসম্পদের প্রবাহে সামান্যতম বিঘ্ন ঘটলে বিশ্বমানবের অগ্রগতি দারুণভাবে ব্যাহত হয়। মানুষের মাথা খারাপ হয়ে গেলে, সেই উন্মাদ-অবস্থাকে যেমন মানুষটির জীবনের সর্বোচ্চ ক্ষতি বলে মনে করা হয়, তেমনি সমাজের মানসসম্পদের প্রবাহে বিঘœ ঘটলে তার ফল সমাজের পক্ষে সবচেয়ে ক্ষতিকারক হয় ; সমাজের মাথা খারাপ হয়ে যায়; মানুষের মাথায় তার মনোলোকের ‘আকাশ ভেঙ্গে পড়ে।’ সুনামির মতো ভয়ঙ্কর প্রাকৃতিক দুর্যোগ যখন কোনো জাতিকে আচ্ছন্ন করে ফেলে, কিংবা একেবারে বিজাতীয় সংস্কৃতির ধারক সাম্রাজ্যবাদ যখন কোনো জাতিকে আচ্ছন্ন করে ফেলে তখন এরকমই হয়। তখন সে-সমাজের অগ্রগতির সমস্ত চেষ্টাই নষ্ট হয়ে যায়।
সেই কারণে জ্ঞানপ্রবাহে বেগ সঞ্চার করার কাজটিই মানুষের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। বিষয়টি রবীন্দ্রনাথ জানতেন। তাই তিনি বলেছেন, ‘... আমার যতটুকু সাধ্য, এই প্রবাহের পথকে আগে ঠেলিয়া দিতে হইবে। ইহার জ্ঞানের ভাণ্ডারে আমার সাধ্যমত জ্ঞান, ইহার কর্মের চক্রে আমার সাধ্যমত বেগ সঞ্চার করিয়া দিতে হইবে।’৬
মানবপ্রজাতির জন্মলগ্ন থেকে এই ঋষিপরম্পরায় বা চিন্তক-পরম্পরায় আজ পর্যন্ত প্রবাহিত হয়ে এসেছে। এই প্রবাহই মানুষকে নেচারের সকল সৃষ্টির উপরে স্থান করে দিয়েছে; সমস্ত জীব থেকে তাকে শ্রেষ্ঠ করেছে। অন্যদিকে যে-মানুষ এই ক্ষেত্রে কিছু সৃষ্টি করেন, শিল্পে সাহিত্যে বিজ্ঞানে যাকে আবিষ্কার, উদ্ভাবন বা সৃষ্টি বলা হয়, সে-মানুষ ব্যক্তিজীবনেও চরম সার্থকতা লাভ করেন, চরম তৃপ্তি ও শান্তি পান। তাই বহু প্রাচীন কাল থেকেই মানুষ এই মানসসম্পদের প্রবাহকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে আসছে।

সংস্কৃতিপ্রসঙ্গ : ঋষিপ্রবাহের বর্তমান স্বরূপ
একজন ইংরেজিভাষীকে যদি বলেন, ‘ঞযব ংশু যধং নৎড়শবহ ফড়হি ড়হ সু যবধফ!’ সে কথাটির মাথামুণ্ড কিছুই বুঝতে পারবে না ; আপনার মাথার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকবে। কিন্তু একজন বাংলাভাষীকে বলুন, ‘আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়েছে!’ দেখবেন সে হন্তদন্ত হয়ে জানতে চাইবে ‘কেন ? কী হয়েছে ?’ অর্থাৎ কথাটির মানে সে শোনার সঙ্গে সঙ্গেই বুঝতে পেরেছে।
আপনি ভাবতে পারেন সত্যিই তো ! ‘মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়া’র কথাটা আমরা এত সহজে বুঝতে পারি, অথচ ইংরেজ কেন যে বুঝতে পারে না !
‘বুদ্ধিমান’ কেউ হয়তো আপনাকে বলে বসতে পারে - আরে বাপু, এ হল কালচারাল গ্যাপ। ওদের কালচার আলাদা, আমাদের কালচার আলাদা। আমাদের সব কথা ওদের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়।
কিন্তু সেই বুদ্ধিমানকে যদি জানতে চান, ইংরেজের কোন্ কথাটি আমরা বুঝতে পারিনি, অন্তত আমাদের লেখাপড়া জানা কোনো বাংলাভাষীই বুঝতে পারেননি ? দেখা যাবে, তিনি একটিও নমুনা দিতে পারছেন না। তাঁকে আপনি এ-কথাও স্মরণ করিয়ে দিতে পারেন যে, পরীক্ষা করে দেখার জন্য আমাদের দেশী-শিক্ষায় শিক্ষিত ইংরেজি-না-জানা কয়েকজন পণ্ডিতকে একবার ইউরোপীয় (গ্রীক) দর্শনের সবচেয়ে কঠিন বিষয়গুলি বলে দেওয়া হয়েছিল ; তার একটু পরেই দেখা গেছে, তাঁদের পক্ষে সেই ইউরোপীয় দর্শন নিয়ে নিজেদের ভাষায় আলোচনা করতে বিশেষ অসুবিধা হচ্ছে না।৭ অথচ আমাদের অধ্যাত্মবিদ্যা তো বহু দূরের ব্যাপার, সাধারণ বাংলাভাষীর মুখে প্রচলিত শতসহস্র কথা ইউরোপের মহা মহা পণ্ডিতেরাও যে বুঝতে পারেননি, তা আমরা গুণে গুণে দেখিয়ে দিতে পারি।
অর্থাৎ কিনা, আমরা চাইলে ইউরোপীয়দের মানসসম্পদকে সম্পূর্ণ আত্মসাৎ করতে পারি, কিন্তু তাঁরা চাইলেও আমাদের মানসসম্পদকে সম্পূর্ণ আত্মসাৎ করতে পারেন না। কালচারাল গ্যাপই যদি হবে, এ কেমন গ্যাপ ?
আসলে তাদের ংশু-এর ‘কনসেপ্ট’ আর আমাদের ‘আকাশ’-এর ‘কনসেপ্ট’, দু’টিই আলাদা চরিত্রের। তাঁরা ংশু বলতে বোঝেন উপরের নীল আকাশটাকে ; সেই আকাশের চিত্রপটটি ছাড়া তাঁদের ংশু শব্দটি আর কোনো ধারণাকে আশ্রয় দেয় না। আর আমরা এককালে ‘আকাশ’ বলতে উপরের ংশু-টি সহ আরও অনেককিছুই বুঝতাম ; ‘কাশের আশ্রয় যাতে’ থাকত, সেই চিদাকাশ, জলাকাশ, ঘটাকাশ, মেঘাকাশ, মহাকাশ সবকিছুই আমাদের ‘আকাশ’ ধারণার অন্তর্ভুক্ত ছিল। সাংস্কৃতিক বিপর্যয়ের কারণে আমরা সেই অনেককিছুর কিছু কিছু হারিয়েছি বটে, কিন্তু সামান্য কিছু আমাদের কথা বলার অভ্যাসে থেকে গেছে। এদেশে ইংরেজ-আগমনের পর, সেই ‘কিছু’কে একটুখানি সরিয়ে রেখে আমরা ইংরেজের সঙ্গে মানসিক লেনদেন শুরু করি এবং আমাদের ‘আকাশ’কে ওদের ংশু শব্দের সমান করে নিই, অন্যথায় লেনদেনের অসুবিধা। কিন্তু তাই বলে ‘আকাশ’ শব্দের বাকি যে ‘কিছু’ অনুষঙ্গ আমাদের কথা বলার অভ্যাসের ভিতর থেকে গিয়েছিল, সেগুলি তো আর উবে যেতে পারে না; সেগুলি থেকেই গেছে। তারই কারণে আমরা ‘মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়া’, ‘আকাশ হাতে পাওয়া’, ‘আকাশ থেকে পড়া’, ‘আকাশ পাতাল ভাবনা’, ‘ঘটে (ঘটাকাশে) বুদ্ধি থাকা’, ‘চিদাকাশে ধ্বনি ওঠা’ এরকম কিছু কথা এখনও বলে ফেলি। আর, ‘আকাশ’-এর এই ‘কনসেপ্ট’গুলি ইংরেজের ভাষায় না-থাকায়, তারা আমাদের এই কথাগুলির কোনো মানেই বুঝতে পারে না।
ইংরেজিভাষী ও বাংলাভাষী, দুই জাতির মধ্যে কেন এরকম ভাষাবিভ্রাট হল, ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থবিধি হাতে আসার পর আজ তার কারণ আমরা জানতে পারছি। এর মূল কারণটি হল, অনিবার্য সাংস্কৃতিক বিপর্যয়, যা জাতিগুলিকে নিজেদের অতীত থেকে ‘আত্মবিচ্ছিন্ন’ করে দিয়েছে, বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে অন্য জাতিগুলি থেকেও। আদিতে পৃথিবীর সবজাতের আদি মানুষেরা যে একই আদিম যৌথসমাজের বাসিন্দা ছিল, একই সংস্কৃতিতে লালিত-পালিত হত এবং একই ভাষায় কথা বলত, সে-বিষয়ে আজ আর সন্দেহমাত্র নেই। (অন্যান্য সাক্ষ্যের পাশাপাশি সম্প্রতি এ-কথার পক্ষে সাক্ষ্য দিচ্ছিল ‘জিন আর্কিয়োলজি’, আজ ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থবিধিও সুস্পষ্টভাবে তার সাক্ষ্য দিতে শুরু করেছে)। সে ছিল এক আদি ক্রিয়াভিত্তিক ভাষা ও আদি সংস্কৃতি। আজকের পৃথিবীর সমস্ত মানুষ যেমন সেই একই আদিম মানবজাতির উত্তরসূরি, তেমনি আজকের পৃথিবীর প্রত্যেক মানুষের ভাষা ও সংস্কৃতি সেই আদি ভাষা ও সংস্কৃতিটিরই উত্তরসূরি, যদিও তাঁদের আত্মবিচ্ছেদের বিষয়ে তাঁরা নিজেরাই সচেতন নন। এই আত্মবিচ্ছেদ ঘটেছে মূলত তিন প্রকারে - অগণিত বিন্দু রূপে, কিছু কিছু প্রক্ষিপ্ত ঢেউয়ের আকারে, এবং মাঝে-মধ্যে সামাজিক-প্রলয় রূপে। এই তিন রূপে সাংস্কৃতিক বিপর্যয় নেমে এসেছে মানুষের উপর, আর সেই সমস্ত বিপর্যয়ের ফলস্বরূপ মানুষ, তার সংস্কৃতি ও ভাষা, তার আদি রূপ থেকে বিপর্যস্ত হতে হতে তার বর্তমান স্বরূপে এসে পৌঁছেছে।
বিন্দু-বিন্দু রূপে আত্মবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই, একটি দেশ থেকে, তার সংস্কৃতি থেকে একটি একটি করে মানুষ বিচ্ছিন্ন হয়ে অন্য সংস্কৃতির এলাকায় চলে যেতে বাধ্য হন, এবং তখন তাঁর ঐ বিচ্ছিন্ন জীবন কাটতে থাকে (রবীন্দ্রনাথের ভাষায়) ‘টিকটিকির কাটা লেজের মতো।’ ফলত প্রাণ বাঁচাতে এই আত্মবিচ্ছিন্ন মানুষ তাঁর নিজের সংস্কৃতি ও ভাষা থেকে সরে যেতে থাকেন, তাঁর পরবর্তী প্রজন্ম আরও সরে যায়। প্রক্ষিপ্ত ঢেউ রূপে বা গোষ্ঠী রূপে আত্মবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই, মানুষ দলে দলে দেশত্যাগ করছেন ; যেমন ঘটে দেশভাগে, নানারকমের দলবদ্ধ দেশান্তরের ঘটনায়। এর চেহারা অনেকটাই সদ্য-বলিপ্রদত্ত পাঁঠার ধড়ের মতো, যার মাথাটাই নাই। এই অবস্থায় গোষ্ঠীটি তিন-চার প্রজন্ম পর্যন্ত নিজস্ব সংস্কৃতি ও ভাষাকে ধরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালায়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সবটা ধরে রাখতে পারে না। জিপসিদের ইতিহাসে এই ঘটনার বিস্তারিত প্রমাণ মেলে। সর্বোপরি, সামগ্রিকভাবে বা জাতি রূপে আত্মবিচ্ছেদের ঘটনা ঘটে ‘প্রলয়’ আকারে। প্রথম ‘প্রলয়’কে পশ্চিম দেশ চিহ্নিত করে রেখেছে তাদের ‘গ্রেট এক্সোডাস’ ধারণায়, আমাদের ইতিহাসে তা চিহ্নিত হয়েছে ‘দক্ষযজ্ঞ-পণ্ডে’ ও মৎস্যাবতারের কাহিনীতে। বিশ্বের ইতিহাসে এরকম প্রলয় ঘটেছে অন্ততপক্ষে আরও সাত-আট বার। বৌদ্ধ-খ্রীষ্টান-ইসলাম-হিন্দু প্রভৃতি ধর্মগুলির উত্থান ও বিপর্যয় কালে, সাম্রাজ্যবাদের বিশ্বদখলে, পৃথিবীর কয়েকটি দেশে সমাজতন্ত্রের উত্থানে, এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে। উত্থান ও পতন কালে এই প্রলয়গুলির চেহারা হয় খানিকটা জোয়ার ও ভাটার মতো। এই প্রলয়ে বিপর্যস্ত জাতির চেহারা হয়ে যায় অনেকটাই সুনামি-জাতীয় বড় ঘটনায় পরিবার-পরিজন-ধনসম্পত্তি সর্বস্ব হারিয়ে ‘হাবা’ হয়ে যাওয়া মানুষের মতো। তার পরে একদিন সে আবার কথা বলা শুরু করে বটে, কিন্তু আগের মানুষটির সঙ্গে এই ‘হাবা থেকে ক্রমান্বয়ে স্বাভাবিক হয়ে ওঠা’ মানুষটির বিস্তর ফারাক ঘটে যায়। সেই মানুষ কদাচিৎ যদি তার হারানো পরিজনের একজনকেও জীবিত অবস্থায় ফিরে পেয়ে যায়, সে-মানুষ তৎক্ষণাৎ প্রাণ পেয়ে সরব হয়ে ওঠে। অর্থাৎ এই যে ‘টিকটিকির কাটা লেজের মতো’ মানুষ, ‘কাটা ছাগলের মতো’ মানুষ, সর্বহারা ‘হাবা’ মানুষ, এঁরা প্রাণ পান কেবল তখনই যখন কখনো তাঁদের হারানো অংশটির সঙ্গে তাঁদের সংযোগ ঘটে যায়। আর, সে সংযোগ কদাচিৎ ঘটে কোনো কোনো পরবর্তী প্রলয়ের জোয়ারের সময়, ভাটার সময় নয়। (এ বিষয়ে আমরা পরে আসছি)। তখন এই বিপর্যস্ত মানুষগুলির, জাতিগুলির আত্মবিচ্ছেদের ছিন্নসূত্র সমূহের কয়েকটিও যদি কোনোভাবে জুড়ে দেওয়া সম্ভব হয়, তারা মুহূর্তে প্রাণবন্ত হয়ে উঠতে পারেন।
আত্মবিচ্ছেদের এই তিনরকম প্রক্রিয়া বিশ্বের মানুষের সংস্কৃতি ও ভাষার প্রবাহকে দারুণ ভাবে বিঘ্নিত করেছে। স্বভাবতই বিঘ্নিত হয়েছে মানুষের বাহ্যসম্পদ ও মানবসম্পদের প্রবাহ। ভারতীয় উপমহাদেশের সমস্ত জাতিগুলির ক্ষেত্রে এই ঘটনার কথা বুঝতে পেরেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ও কার্ল মার্কস। রবীন্দ্রনাথ একে বলেছেন ‘নির্মম আত্মবিচ্ছেদ’, আর মার্কস বলেছেন, ভারতবাসীর সমস্ত দুর্দশার কারণ এই ‘আত্মবিচ্ছেদ।’ কিন্তু ইউরোপের ও অন্যান্য দেশের জাতিগুলির ক্ষেত্রে এই আত্মবিচ্ছেদের কত ঘটনা ঘটেছে ? কেউ কি কখনো সেই আত্মবিচ্ছেদকে শনাক্ত করেছেন ? না, আমার স্বল্পজ্ঞানে সে খবর সবিশেষ জানা নেই। আমার বিশ্বাস, নিশ্চয় কেউ না কেউ, কখনো না কখনো তা করে থাকবেন। সামান্য লেখাপড়ায় যতটুকু যা বুঝেছি, তা হল - আদিম মানবজাতির প্রথম স্রষ্টাসংক্রান্ত ধারণার ঈশ্বরের ‘একমেবাদ্বিতীয়ম’ অভেদ রূপটিকে আজ আমরা শনাক্ত করতে পারছি, তার উত্তরাধিকারটি তাঁরা সরাসরি পাননি (যদিও বহু পরে যীশু ও মহম্মদ তাকে পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করে গেছেন), পাননি তার দ্বিতীয় দ্বৈতাদ্বৈত ‘অর্ধনারীশ্বর’ রূপের উত্তরাধিকারও; কিন্তু আরও পরের তৃতীয় রূপটির উত্তরাধিকার তাঁরা সরাসরি পেয়েছিলেন, যাকে খ্রীষ্টান ইউরোপ তাত্ত্বিক রূপ দেয় তাদের ‘ট্রিনিটি গড’-এ ঃ ‘গড দ্য ফাদার’, ‘গড দ্য সান’, ও ‘গড দ্য হোলি স্পিরিট’-এ; আমরা ভারতীয় উপমহাদেশের বাসিন্দারা যার উত্তরাধিকার পেয়েছিলাম Ÿ্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর রূপে। কিন্তু তাতেই তো ঈশ্বরের বিবর্তন থেমে ছিল না, অজস্র মাতৃপূজায় তা বিবর্তিত ও খণ্ডিত হয়ে গিয়েছিল। প্রাচীন ইউরোপের সেই উত্তরাধিকার যীশুর জন্মের আগে-পরে রীতিমতো প্রচলিত ছিল। খ্রীষ্টান ইউরোপ তাদের সেকালের সমাজের সেই প্রচলিত মাতৃপূজাকে আত্মসাৎ করবার উপায় বের করে সেই সমস্ত মাতাদের আসনে ‘ভার্জিন মেরি’কে বসিয়ে দিয়ে। ফলস্বরূপ পাশ্চাত্যর মাতৃপূজা বিলুপ্ত হয়ে যায়। কেবল তাই নয়, অন্যান্য মূর্তিপূজার স্থানে তাঁরা বসিয় দেন ‘গড দ্য সান’ যীশুকে। ‘গড দ্য ফাদার’ ও ‘গড দ্য হোলি স্পিরিট’কে তাঁরা রেখে দেন বৌদ্ধ ও মুসলমানেদের মতো নিরাকার করে। এইভাবে পূর্ব এশিয়ার বৈদিক-তান্ত্রিক-বৌদ্ধ সভ্যতা ও পশ্চিম এশিয়ার ইহুদি ও ইসলামী সভ্যতার মাঝামাঝি (একই সঙ্গে সাকার-নিরাকার) অবস্থানে নিজের জায়গা নির্দিষ্ট করে নেন তাঁরা এবং এইভাবেই তাঁরা তাদের অতীত থেকে বিচ্ছিন্ন হতে থাকেন। এমনকি শেক্সপিয়ারের হাতে অতীতের যে-বিশাল আকাশটি ধরা দিয়েছিল, রেনেসাঁস-উত্তর ইউরোপ সে আকাশটিকে ছেঁটে ছোট করে নেয়। এবং এই বিচ্ছিন্নতা সেখানেই থেমে থাকে না, আরও পরবর্তীকালে প্রোটেস্টাণ্ট-ইউরোপ প্রাচীন ইউরোপ ও ক্যাথলিক ইউরোপের অধিকাংশ বেশভূষা তাদের জাতীয় চেতনা থেকে খুলে নিয়ে নামিয়ে রাখে। এভাবে তাঁরাও ক্রমান্বয়ে অতীত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন।
বিশ্বের প্রতিটি জাতির অগ্রগতির ইতিহাসেই এরকম বিপর্যয় ঘটেছে। আর প্রতিটি বিপর্যয় জাতিটিকে তার অতীতের সংস্কৃতি ও ভাষা থেকে আরও বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। বিচ্ছিন্ন করেছে দু’ভাবে - অন্তরের দিক থেকে এবং বহিরঙ্গের দিক থেকেও। অবশ্য এই আত্মবিচ্ছেদের ছিন্ন সূত্রগুলি কখনোই জোড়া দেওয়ার চেষ্টা করা হয়নি, অতীতকে ফিরে পাওয়ার বা পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা কোনো জাতিই আর কখনো করেনি, এমন নয়। বরং বলা ভালো, মানুষের স্বভাবের ভিতরে অন্তর্নিহিত চেষ্টা থেকেছে তার আদি অর্জনগুলিকে ফিরে পাওয়ার। আর সেজন্যেই পৃথিবীর ইতিহাসে দেখা গেছে এক-একটা উল্টোরথের পালা, যাকে কখনো নাম দেওয়া হয়েছে রেনেসাঁস, কখনো নাম দেওয়া হয়েছে রিভাইভাল। দৈনন্দিন জীবনে মানুষ যেমন কর্মচক্রে এগিয়ে চলতে বাধ্য হয়, চলে তার আয়-আহরণ ও সবকিছুকে নিজের দিকে আকর্ষণের পালা ; আবার কোনো একটা ছুটির দিনে চলে তার ত্যাগের পালা, ব্যয়-বিকর্ষণের উল্টোযাত্রা ; রবীন্দ্রনাথের মত ‘উল্টা করিয়া নিজেকে সারিয়া লওয়া।’ জাতিগুলির আত্মবিচ্ছেদের ছিন্নসূত্র জোড়া দেওয়ার এসব চেষ্টা চলেছে অনেকটা সেরকমভাবেই, বলতে গেলে প্রকৃতির অমোঘ নিয়মেই।
হ্যাঁ, সেই প্রাকৃতিক নিয়মে প্রতিটি জাতিই তার আত্মবিচ্ছেদের ছিন্নসূত্র জোড়া লাগানোর চেষ্টা কমবেশি চালিয়ে গেছে, কেউ কেউ কখনো কখনো কমবেশি সফল হয়েছে, কেউ-বা কখনোই তেমনভাবে সফল হতে পারেনি। ভারতীয় উপমহাদেশের বিশেষত্ব হল, তারা সেই চেষ্টায় অত্যন্ত সফল হয়েছিল তার প্রথম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর, আনুমানিক ১৩০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে, যখন সে আদিম মানুষের ভাষার মূল নিয়মে প্রচলিত ভাষাকে সংস্কার করে সংস্কৃত ভাষার জন্ম দিয়ে ফেলেছিল, ঋষিপ্রবাহকে লিপিবদ্ধ করতে শুরু করে দিয়েছিল। তারপর আবার চলে তার বিচ্ছিন্নতার পালা। সংস্কৃতভাষার বলতে গেলে মৃত্যু হয়ে যায়। পুনরায় সে নবজন্ম লাভ করে বঙ্গবাসীদের হাতে ১৩০০-১৪০০ খ্রীষ্টাব্দে; বাংলাভাষায় রামায়ণ-মহাভারত লেখা হয়, মঙ্গলকাব্য ও বৈষ্ণবসাহিত্যের জন্ম হয়। সেই কারণে অতীতের ভাষা ব্যবহারের অভ্যাসের বেশ খানিকটা থেকে গেছে বাংলাভাষীর কথা বলার অভ্যাসের ভিতর। আর ইউরোপ সেই চেষ্টায় কখনো কখনো বেশ খানিকটা সফল হলেও, বিশেষত শেক্সপিয়ারের কালে কিংবা রেনেসাঁসের প্রথম দিনগুলিতে, বিচ্ছিন্নতার দিকে তার দৌড়ের গতি অত্যন্ত বেশি থাকার ফলে তার সাফল্যের চেয়ে বিচ্ছিন্নতাটিই আজ বেশি করে চোখে পড়ে। বলতে কি, অতীত থেকে বিচ্ছিন্ন হতে হতে তার ভাষা আজ প্রায় একার্থ-সম্বল হয়ে গেছে। সেই কারণে আমরা চাইলে তাকে বুঝতে পারি বটে, কিন্তু সে চাইলেও আমাদের পুরোপুরি বুঝতে পারে না। আমরা তাদের ংশু-কে পুরোটাই চিনতে-বুঝতে পারি, সে আমাদের ‘আকাশ’কে আংশিক বোঝে ; সম্পূর্ণ বুঝতেই পারে না। এভাবে আমরা, প্রত্যেক জাতির মানুষেরা, কেবল অতীত থেকেই ক্রমান্বয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়িনি, পরস্পর থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছি এবং সেটি সবচেয়ে বেশি ঘটেছে ঋষিপ্রবাহের বা মানসসম্পদের প্রবাহের ক্ষেত্রে।
অথচ মানুষের এই মানসসম্পদ তার অস্তিত্বের সবচেয়ে বড়ো সহায়ক। বলতে গেলে এই সম্পদই তার প্রাণসম্পদের কারণ, জগতে তার টিকে থাকার চাবিকাঠি। কেননা, জগতের নিয়মগুলিকে আত্মসাৎ করে তাকে ব্যক্তরূপে প্রকাশ করা হয় এই ঋষিপ্রবাহে। জীবিত মানুষের মনের আধার যেমন তার নাচ-গান-কথা-জ্ঞান-বুদ্ধি-চিন্তা প্রভৃতি সমস্ত প্রকার প্রকাশ, তেমনি সমাজমনের আধার এই ঋষিপ্রবাহ। এ-যাবৎ অর্জিত বিশ্বমানবের সমস্ত মানসিক সম্পদ প্রবাহিত থাকে এই ধারায়। বিশ্বমানব এই অমৃতধারায় সিক্ত থাকে বলেই সে প্রকৃতির শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি রূপে সক্রিয় থাকে। এই প্রবাহকে বাদ দিয়ে মানুষের অস্তিত্ব ভাবাই যায় না। এই প্রবাহই মানুষকে রসেবশে রাখে।

সংস্কৃতিপ্রসঙ্গ : ঋষিপ্রবাহে বিঘ্নের ফল
নেচারের নিয়মের মতোই মানুষের সামাজিক সম্পর্কগুলিতে কিছু অনিবার্য নিয়ম সক্রিয় থাকে এবং প্রায়শই তা আমাদের চোখে পড়ে না। সেলাম ঠুকি সম্মুখস্থ প্রত্যক্ষ যমদূত দারোগাকে, তার লক্ষগুণ বড়ো দেশের রাজার কথাটাই ভুলে যাই। মুজতবা আলী বলতেন - চোখের সামনে নিজের বুড়ো আঙ্গুল তুলে ধরলেই হিমালয় আড়াল হয়ে যায়। চোখের সামনের সাময়িক সমস্যাগুলি সরিয়ে দিয়ে একটু দূরদৃষ্টি ফেলে সমাজের ইতিহাসের দিকে তাকালেই আমরা নিয়ামক রূপে আমাদের প্রকৃতি-রাজ্যকে অত্যন্ত সক্রিয় দেখতে পাই।
তথাকথিত সভ্যযুগের সূত্রপাতে বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ থাকা সত্ত্বেও নিত্যনতুন আবিষ্কারমূলক নীতি সাময়িকভাবে পরিত্যাগ করাই উচিত বলে মনে হয়েছিল মানুষের। তার অনিবার্য ফল ফলে যৌথসমাজের বিভাজনে, ঘটে যায় প্রথম প্রলয়। তার পর পাহাড় থেকে পতনের পর প্রস্তরের চাঁই যেমন গড়াতে থাকে, গড়িয়ে গড়িয়ে ক্রমশ বিচূর্ণীভূত হতে থাকে, মানবসমাজের বিবর্তন চলতে থাকে সেভাবেই। পরবর্তীকালের সামাজিক সত্তা ও শক্তিগুলি সেই গতিকে বড়জোর ত্বরান্বিত বা শ্লথ করেছে মাত্র ; তাদের আর কোনো ভূমিকা এখন আর মালুম করা যায় না। সেভাবেই আদি যৌথমানুষ ক্রমশ চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে তার আজকের স্বরূপে এসে পৌঁছেছে। কেন তার এই অধঃপতন, তা কতখানি অনিবার্য ছিল, সে-সব কথায় এখন আর আমরা যাব না। আমরা দেখব এর ফলে সে বর্তমান কী রূপ লাভ করেছে এবং সেখান থেকে সে কোথায় পৌঁছতে পারে।
আমাদের সমাজ যত খণ্ডিত হয়েছে তত বেড়েছে আমাদের আত্মবিচ্ছেদ। অতীতের সঙ্গে বর্তমানের আত্মবিচ্ছেদ ঘটেছে দু’ভাবে  বহিরঙ্গে এবং অন্তরঙ্গে। বাইরের শরীরের যে খণ্ডতা তার স্বরূপ একরকম, অন্তরের যে বিচ্ছিন্নতা তার স্বরূপ অন্য রকম। প্রথমে বাইরের বিচ্ছিন্নতার কথাতেই আসা যাক।
আজ আমরা দেখছি মানুষের দেশগত ও জাতিগত বা ধর্মগত বিভাজনের মতো মানুষের জ্ঞানও অজস্র খণ্ডে বিভাজিত  অঙ্ক বিজ্ঞান দর্শন ইতিহাস সাহিত্য রাজনীতি অর্থনীতি নাচ গান বাজনা চিত্র স্থাপত্য ভাস্কর্য ... ইত্যাদি ইত্যাদি এবং সর্বোপরি ভাষা; সে আবার প্রতিটি দেশের একেবারেই আলাদা আলাদা। এর মধ্যে যেগুলি ব্যক্ত (বীঢ়ষরপরঃ) জ্ঞানের ধারা, যেমন অঙ্ক ও বিজ্ঞান, সেগুলি অতীত থেকে বর্তমান পর্যন্ত প্রায় অব্যাহত ভাবেই এগিয়ে চলেছে। কিন্তু যেগুলি অব্যক্ত (ঃধপরঃ) জ্ঞানের ধারা, যেমন দর্শন সাহিত্য ইতিহাস সঙ্গীত ইত্যাদি, সেগুলির প্রত্যেকটি নিজ নিজ অতীত থেকে ক্রমান্বয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। ঘটেছে সেগুলির আন্তরিক বিচ্ছিন্নতা। কয়েকটি উদাহরণ দিয়ে এখন সেই আন্তরিক বিচ্ছিন্নতার বিষয়টিকে স্পষ্ট করার চেষ্টা করা যাক। (বহিরঙ্গের বিচ্ছিন্নতার কথায় যাব না কারণ অনেকেই তা কমবেশি জানেন)।
সবার আগে মূলনীতিটির কথা হোক। যতদূর বোঝা গেছে, আদিম মানুষের সমস্ত রকম ‘প্রকাশ’-এর মূলনীতি ছিল  যাকে দেখা যাচ্ছে না, যার বাহ্য চেহারা নেই, অথচ সমাজে ও প্রকৃতিতে সক্রিয়ভাবে বিরাজ করছে এবং মানুষের চলার পথে নানারকম ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ঘটাচ্ছে, তাকে দেখানো এবং তার বিষয়ে সবাইকে অবিহিত করা। অর্থাৎ বিমূর্ত সত্তাকে মূর্ত করাই ছিল প্রকাশের মূলনীতি। যাকে খালি চোখে দেখা যায়, আঙ্গুল দিয়ে দেখানো যায়, তার বিষয়ে মানুষের আদিপুরুষের কোনো মাথাব্যথা ছিল না। দৃশ্য বস্তুকে বোঝানোর জন্য ভাষা-গান-ছবি কোনো কিছুরই প্রয়োজন হয়নি তাঁদের। একমাত্র ‘অদৃশ্য-কিন্তু-বর্তমান-ও-সক্রিয়’ সত্তাগুলিকে নিয়েই ছিল তাঁদের মাথাব্যথা। ... ভাষা, সঙ্গীত, চিত্র, ভাস্কর্য প্রভৃতি সমস্ত মানবিক প্রকাশের মূলে ছিল এই নীতি।
প্রথমে ভাষার কথাতেই আসি। পৃথিবীর সব ভাষাই আদিতে এক ছিল, বাইবেলের ইধনবষ-কাণ্ডে এই আদি সত্যের আভাষ রয়েছে। সেই আদি ভাষা ছিল ক্রিয়াভিত্তিক রূপে এবং তার প্রথম ও প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ক্রিয়া দিয়ে ক্রিয়াকারীকে বোঝানো ; যে-ক্রিয়াকারী অদৃশ্য হতে পারে, দৃশ্যও হতে পারে। প্রথম প্রলয়ে সেই ভাষা কমবেশি ষোলোটি খণ্ডে বিভক্ত হয়ে গেলেও প্রত্যেকের মধ্যেই কিছুটা পরিমাণে আদি ক্রিয়াভিত্তিক গুণ থেকে গিয়েছিল। আদিতে মানুষ বলত ‘জ্ঞ আত্মন্’ বা ‘মহড় ধঁঃ(স)ড়হ’ (= নিজেকে জানো)। প্রথম বিভাজনের পরে ইউরোপ বলল ‘মহড়ঃযর ংবধঁঃড়হ’; আর আমরা বললাম ‘আত্মানং (ধঁঃড়হ-ংব) বিদ্ধি (= জ্ঞ = জ + ঞ = ম-হড় ঃযর)’। পরবর্তী অধ্যায়ে ইউরোপ সেটিও হারিয়ে ফেলল, পৌঁছালো ‘ শহড়ি (ম-হড়) ঃযুংবষভ’-এ, আমরা পৌঁছলাম ‘নিজেকে জানো’-তে। ইউরোপের সঙ্গে আমাদের পার্থক্য অনেকখানি বেড়ে গেল। এরপর ইউরোপের প্রতিনিধি ইংরেজ যখন বাংলায় পা রাখল, আমরা বাধ্য হলাম আমাদের ‘আত্ম’র সমস্ত অর্থ ফেলে দিয়ে তাকে ইংরেজের ংড়ঁষ-এর সমান করে নিতে। দুই ভাষার মধ্যেকার পার্থক্য এবার দুস্তর পারাবার হয়েই থেকে গেল। অথচ উভয়েই যে একই উৎস থেকে যাত্রা করে বর্তমান অবস্থানে এসে পৌঁছেছি, সে নিয়ে আজ আর সন্দেহের অবকাশ নেই। কিন্তু নিজ নিজ অতীত থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছি, পরস্পর থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছি।
একই অবস্থা চিত্রে-ভাস্কর্যেও। মানুষের ছবি আঁকার মূল নীতি ছিল যা বাস্তবে আছে কিন্তু বাহ্যিক চেহারা নেই, তাকে বোঝানোর জন্যই ছবি আঁকা ; বিমূর্ত-বাস্তবকে মূর্ত করা। সে ছবিতে সমাজের শিব ছিলেন এক নম্বর আসনে ; ছিল তাঁর বৃষ, ধর্মের ষাঁড়, শিবতেজের বাহন  মানবসমাজের ঋষিপ্রবাহের বেগ সঞ্চারকারী ঋষি-মানুষের প্রতীক। গোয়ালের বন্ধন যার নেই, কারও ঘাসজল খায় না, সবাই যাকে খাতির করে ভক্তি করে খেতে দেয় ; আর সে প্রকৃতির রোদে-জলে স্বাধীন থেকে সম্পূর্ণ ন্যাচারাল থাকে ও ভব্যিষ্যৎ প্রজন্মের প্রজননের কাজ চালায়। ফলে গো-প্রজাতির উত্তর প্রজন্ম ন্যাচারাল থাকে, স্বাভাবিক থাকে। মানুষেরও সেই অবস্থা ছিল, মহর্ষিরা সংসারবন্ধন থেকে দূরে থাকতেন, বাহ্যসম্পদের পেছনে কখনো যেতেন না, সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে নিজ নিজ মানবজীবনে চাষ চালাতেন (সেকালের ভাষায় যাকে বলা হত সাধনা করা), লোকে তাঁদের ভক্তিশ্রদ্ধা করে খেতে দিত, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে শিক্ষা দিয়ে ‘দ্বিতীয় জন্ম’ দিয়ে ‘দ্বিজ’ বানাতেন তাঁরা, সমাজকে পথ দেখাতেন। সেই শিব ও বৃষ প্রাচ্য-পাশ্চাত্য উভয় দেশের চিত্রে-ভাস্কর্যে প্রচলিত ছিল। প্রথম প্রলয়ের পর ইউরোপ শিবকে হারিয়ে ফেললেও বৃষকে হারায়নি দীর্ঘকাল, যদিও ক্রমে তার অর্থ হারিয়ে ফেলেছিল। অজস্র বৃষের চিত্র ও ভাস্কর্য ছিল তাদের। এশিয়ায় সংস্কৃতভাষার জন্মের ফলে তার সহায়তায় শিব ও বৃষ দু’টিই থেকে গেল দীর্ঘকাল, যদিও ক্রমান্বয়ে সেও অর্থ হারাচ্ছিল। ঈষধংংরপধষ অহঃরয়ঁরঃরবং-এর যুগ শেষ হওয়ার পর ইউরোপ তার বৃষকেও অর্থহীন বলে ফেলে দিল এবং ইউরোপের প্রতিনিধি ইংরেজ ভারতে পা দেওয়ার পর আমরাও আমাদের চিত্রশিল্পে ও ভাস্কর্যে শিব ও বৃষ দু’টোকেই অর্থহীন বলে ফেলে দিলাম। নিজেদের অর্থ হারিয়ে আমাদের শিব আর বৃষ থেকে গেল কেবল ধর্মেই। সুখের কথা এই  ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থবিধি আজ তার অর্থ উদ্ধার করে ফেলেছে। চিত্র-ভাস্কর্যের ইতিহাসে এখন তাকে জুড়ে নেওয়া আর অসম্ভব নয়।
প্রায় একই ঘটনা ঘটল বহুমাথাওয়ালা মূর্তিগুলির বেলায়। আমরা জানি দশ কথাটির মানে শুধুমাত্র ঃবহ নয়,দশ মানে ‘অনেক’ও হয় (দশে মিলি করি কাজ)। রাষ্ট্রের বহু বিভাগ, বহু মাথা। মানবসমাজের সেই বিমূর্ত বহু-ডিপার্টমেণ্টওয়ালা প্রথম রাষ্ট্রশরীরকে আঁকা হত দশ-মুণ্ড দশানন রূপে। ধারণাটির উত্তরাধিকার ইউরোপ পেয়েছিল শতমাথা সহস্রমাথা মূর্তিতে। কিছুদিন পরে এত মাথাওয়ালা মূর্তির মানেটাই তারা হারিয়ে ফেলল। আর আমরাও ব্রিটিশ যুগের পরে রাষ্ট্রের মূর্তি আঁকতে ভুলে গেলাম; মানেটা ভুলে গিয়েছিলাম ১৭০০ সালের আগেই। সেজন্যই একালের কোনো শিল্পীই ‘রাষ্ট্র’-র মূর্তি আঁকতে পারেন না।
কেবল তাই নয়, বৌদ্ধযুগের আগেই আমরা ‘জনসাধারণ’-এর মূর্তি বানাতাম মহামায়া রূপে, ‘শিক্ষিত জনগণ’-এর ছবি আঁকতাম দুর্গা রূপে, ‘শ্রমিক জনতা’ ও ‘কৃষক জনগণ’-এর ছবি আঁকতাম যথাক্রমে কালী ও শ্যামা রূপে। ব্রিটিশের আগমনের পরে সেই প্রতিমাগুলিকে আমরা ‘অসভ্যের মাতৃপূজা’ নাম দিয়ে ঠেলে দিলাম কেবলমাত্র হিন্দুধর্মের এলাকায়, যে-ধর্মের জন্মই হয়েছিল সেই প্রতিমাগুলির আবির্ভাবের বহু পরে, ৭৫০ খ্রীষ্টাব্দে। আমাদের আত্মবিচ্ছেদ এত হল যে, আমাদের আধুনিক কবি-সাহিত্যিকদের কেউ-বা সেই ‘শিক্ষাজীবী জনসাধারণ’-এর মাতৃমূর্তিকে ‘ল্যাংটা সাঁওতাল মাগী’ বলতেও কুণ্ঠিত হলেন না। মাঝ থেকে পাশ্চাত্য সভ্যতার দাপটে আমরা ‘জনসাধারণ’-এর মূর্তি আঁকতেই ভুলে গেলাম। অবন ঠাকুর ও নন্দলাল প্রথম দিকে তাও খানিকটা চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু ছবিগুলির অর্থ হারিয়ে ফেলায় তাঁরাও একদিন সে-পথ ত্যাগ করেন। আজও ভারতীয়রা তাঁদের সংস্কৃতিতে অর্থহীন বোঝার মতো করে হলেও ঐ মূর্তিগুলি বহন করে নিয়ে চলেছেন, তবে সে হিন্দু ধর্মের নামে। ভক্তির জোরটুকু না থাকলে এই বোঝা বহন নিতান্তই দুঃসাধ্য ছিল। কিন্তু সেই প্রতিমাগুলি যে আদৌ অর্থহীন ছিল না, মহত্তম অর্থবান ছিল, বাংলাভাষায় আবিস্কৃত ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থবিধি বিশ্বমানবের চিত্র-ভাস্কর্যের সেই বিশাল দিগন্তও উন্মুক্ত করে দিয়েছে। আজ চাইলে চিত্র-ভাস্কর্যের ইতিহাসের আদি থেকে বর্তমান পর্যন্ত সবটাই জুড়ে নেওয়া যায়।
আজকের পৃথিবীতে পুনরায় বিমূর্ত ছবি ও ভাস্কর্যের কাজ হচ্ছে। কিন্তু ছবি-ভাস্কর্যের নিজের আদিম ইতিহাসের সঙ্গে তার যোগ নেই বলে সে জানেই না যে, চিত্র-ভাস্কর্যের সূত্রপাতই হয়েছিল বিমূর্তকে মূর্ত করার জন্য। আজকের চিত্রশিল্পী ও ভাস্করগণ মূর্তকে বিমূর্ত করে দিয়ে তার মাধ্যমে বর্ণের (রঙের ও অক্ষরের) গোড়ায় যে-অখণ্ডবোধ ছিল, যুক্তি-শৃঙ্খলহীন অব্যক্ত জ্ঞানের ইশারার সাহায্যে তার গন্ধ অনুভব করানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। চাইলে তাঁরা বিশ্বমানবের আদি অর্জনকে এবার তাঁদের ব্যক্ত জ্ঞানের সাহায্যেই আপডেট করে নিতে পারবেন।
এ-কথা কবিতা ও গানের কথার ক্ষেত্রেও বলা যায়। আদি ভাষায় শব্দের ভেতরে (= ক্রিয়াভিত্তিক = বর্ণভিত্তিক) অর্থ ছিল। কয়েকটি প্রলয়ের পর পৃথিবীর সব দেশই তাদের ভাষার শব্দের ভেতরের সেই অর্থ হারিয়ে ফেলল। তাই আধুনিক ভাষা অনুসারে শব্দের ভিতরে কোনো অর্থ নেই, সে প্রতীক মাত্র ; কোনো বস্তু বা বিষয়কে উল্লেখ করার মূর্ত ‘আওয়াজ মাত্র।’ তা দিয়ে বিমূর্ত কিছু বোঝানো বেশ অসুবিধাজনক। এদিকে আধুনিক কবিও মানুষ, স্রষ্টা। তাঁর চোখে বিমূর্ত অনেক কিছুই ধরা দেয়। কিন্তু এই ‘স্থির’ স্বভাবের শব্দগুলির সাহায্যে সেই বিমূর্ত সচলকে তিনি বোঝাবেন কেমন করে ? স্বভাবতই তিনি তাঁর মূর্ত শব্দগুলিকে বিমূর্ত ও অস্থির করে নেওয়ার জন্য নানান রকমের তাৎক্ষণিক কৌশল ও উপায়ের উদ্ভাবন করেন, যে-কৌশলের সঙ্গে পাঠক সাধারণের যোগ নেই। আধুনিক কবির কবিতা সে-কারণেই পাঠক আর বুঝতে পারেন না। এই কবিরা যদি জানতেন বিমূর্ত ও অস্থিরকে বোঝানোর জন্যই মানুষের আদিভাষার জন্ম হয়েছিল, তাহলে হয়তো এতদিনে অন্য পথ বেরিয়ে আসত।
সঙ্গীতের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। আদিম মানুষ গান গাইত ভাব প্রকাশ করার জন্য। সুরের অকারণ কালোয়াতি করার বোকামি ছিল না তাঁদের ‘সঙ্গীতে’ (= নৃত্য + গীত + বাদ্য)। প্রথম প্রথম যখন সে ‘অ-ই-উ’ ছাড়া আর কোনো স্বর-ব্যঞ্জনেরও সৃষ্টি করতে পারেনি তখন তাকে তো কাজ চালাতে হত শুধুমাত্র সুর দিয়ে। ভাবের রকমফেরে তার সুরও বদলে যেত। রবীন্দ্রনাথ সঙ্গীতে হাত লাগাতে গিয়ে দেখলেন  ভাবের কথাটাই একালের সঙ্গীতকাররা ভুলে মেরে দিয়েছেন। তবু ভালো, বাঙালি হিন্দু-মুসলিম পদকাররা, কীর্তনীয়ারা, লালন-হাসনরাজারা যতটুকু পেরেছেন ভাবপ্রকাশকে তাঁদের সঙ্গীতে যতটা সম্ভব গুরুত্ব দিয়ে গেছেন। কিন্তু ভাব ও সুরের যে অভেদ, সুরের সঙ্গে ভাবের যে ‘লীলা’ (এ শব্দটির ইংরেজি অনুবাদ করা যায় না), তার কারণ তিনি জানতে পারলেন না। কোনো উত্তরাধিকার নেই, প্রাচ্য-পাশ্চাত্য সবাই ভুলে গেছে, তিনি দেখলেন। অথচ এককালে ভারতের হাতে তা ছিল, তিনি তাও দেখতে পেলেন; কিন্তু হাতে পেলেন কেবল সেই আদি অভেদাত্মক সঙ্গীতের শুষ্ক সরোবরটি, খাঁচাটি - প্রাণপাখিটা নাই। তিনি দেখলেন, ইউরোপের হাতে এমনকি আদি অভেদাত্মক সঙ্গীতের প্রথম পর্যায়ের খাঁচাটিও নেই, রয়েছে দ্বিতীয় পর্যায়ের রূপটি - হারমনি, যেখানে বাদী-বিসম্বাদী সুরের সমমর্যাদা মৌলবাদী কট্টরতায় প্রতিষ্ঠিত, কিন্তু ভাবের খবর নেই। কী করবেন তিনি ! আবেদন জানালেন -
“সঙ্গীতবেত্তাদিগের প্রতি আমার নিবেদন যে, কী কী সুর কিরূপে বিন্যাস করলে কী কী ভাব প্রকাশ করে, আর কেনই বা তাহা প্রকাশ করে, তাহার বিজ্ঞান অনুসন্ধান করুন। ... দুঃখ সুখ, রোষ ও বিস্ময়ের রাগিণীতে কী কী সুর বাদী ও কী কী সুর বিসম্বাদী, তাহাই আবিষ্কারে প্রবৃত্ত হউন। ... আমাদের সুখদুঃখের রাগরাগিণী কৃত্রিম নহে। অর্থশূন্য নাম (মুলতান, ইমন-কল্যাণ, কেদারা ইত্যাদি) পরিত্যাগ করিয়া, বিভিন্ন ভাবের নাম অনুসারে আমাদের রাগরাগিণীর বিভিন্ন নামকরণ করা হউক। ... এখন যেমন সঙ্গীত শুনিলেই সকলে বলেন, ‘বাঃ ইহার সুর কী মধুর’, এমন দিন কি আসিবে না যেদিন সকলে বলিবেন, ‘বাঃ কী সুন্দর ভাব।’
আমাদের সঙ্গীত যখন জীবন্ত ছিল, তখন ভাবের প্রতি যেরূপ মনোযোগ দেওয়া হইত, সেরূপ মনোযোগ আর কোনো দেশের সঙ্গীতে দেওয়া হয় কি না সন্দেহ। ... সেদিন গিয়াছে। কিন্তু আবার কি আসিবে না ?” - (সঙ্গীতচিন্তা / রবীন্দ্রনাথ)
অগত্যা ক্রিয়াভিত্তিক শব্দবিধি ছাড়াই রবীন্দ্রনাথকে এগোতে হল। তিনি তাঁর প্রবল প্রতিভার অসামান্য শক্তিতে যতদূর অনুভব করতে পেরেছিলেন, তাকেই আপডেট করে তাঁর কবিতা ও সঙ্গীত সৃষ্টি করে যেতে লাগলেন। আদি অখণ্ডের গন্ধ নিয়ে তাঁর কাব্য-সঙ্গীতের ধারা প্রবাহিত হতে লাগল। কিন্তু উৎসবের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতার ছিন্নসূত্রগুলি তিনি নিজস্ব প্রতিভার শক্তিতে তাঁর অব্যক্ত (ঃধপরঃ) জ্ঞানে অনুভব করে নিতে পারলেও সেগুলিকে ব্যক্তভাবে (বীঢ়ষরপরঃষু) বুঝে নিয়ে কিছুতেই জোড়া দিতে পারলেন না, সারাজীবন ধরে বারংবার হা-হুতাশ করে গেলেন। মাঝ থেকে সঙ্গীতের অতীতের সঙ্গে বর্তমানের বিচ্ছিন্নতা কার্যত বিচ্ছিন্নতাই থেকে গেল।
ইউরোপ বেচারা কী আর করবে। সঙ্গীত বিষয়ে তার হাতে এমনিতেই অতীতের উত্তরাধিকার এশিয়ার তুলনায় অনেক কম ছিল। তার ওপর যেখানে সে ছিল, সেখান থেকে সে ছিটকে গেল বহু দূরে। কারণ, যন্ত্রসভ্যতার দাপট তার ওপরই পড়ল সবচেয়ে বেশি করে। আর যন্ত্রসভ্যতার স্বভাবই এই যে, একই কর্মের দারুণ পুনরাবৃক্তির কারণে প্রকৃতি থেকে মানুষকে সে অত্যন্ত বিচ্ছিন্ন করে দেয়। আদি মানুষের সভ্যতা জন্মেছিল প্রকৃতি থেকে, তার অখণ্ডবোধ ছিল স্বাভাবিক। দক্ষের আবির্ভাব একধরনের আদি-যান্ত্রিকতা বলেই তার সামাজিক স্বীকৃতির সঙ্গে সঙ্গেই মানুষ ক্রমশ তার প্রকৃতিগত স্বভাব ও সংস্কৃতি থেকে সরে সরে যাচ্ছিল; শিল্পবিপ্লোত্তর যন্ত্রসভ্যতা ইউরোপকে প্রকৃতি থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন করে দিল। কৃষক ও জেলে-মাঝির ভিতর দিয়ে প্রকৃতি গান হয়ে তা-ও দেখা দিতে পারে, কিন্তু মেসিনম্যানের কিংবা কম্পিউটার অপারেটারের ভেতর দিয়ে প্রকৃতি গান হয়ে বেরোনোর পথ পায় না। যন্ত্রসভ্যতা মানুষের গান কেড়ে নিল। অফিসে কারখানায় কাজ করা মানুষ মাঝি-চাষির মতো গান গেয়ে উঠতে পারল না। কোনো মানুষকে তার প্রকৃতি থেকে, স্বভাব থেকে দীর্ঘকাল এভাবে পেটের দায়ে বিচ্ছিন্ন করে রাখলে সে যেমন ছাড়া পেলে অনেকক্ষণ ধরে একনাগাড়ে হাত-পা ছুড়ে প্রবল চীৎকার করে মনের ক্ষোভ মেটায়, বিংশ শতাব্দীর গোটা পাশ্চাত্য দেশ তার সঙ্গীতের ভেতর দিয়ে সেভাবেই তার মনুষ্যত্বের চরম অবমাননার প্রকাশ খুঁজতে থাকে। তারই ঢেউ এসে লাগছে আজ ভারতীয় উপমহাদেশেও; কারণ, আসছে সেই দমবন্ধ করা উপকরণবহুল যন্ত্রসভ্যতাও। এখানকার সঙ্গীতও আজ মাতালের চীৎকারের দিকে পা ফেলতে শুরু করেছে। আদি সুর ও স্বরের সঙ্গে এর যোগ ক্ষীণ, অন্যদিকে আজকের মানুষ সঙ্গীতে খুঁজছে তার মনুষ্যত্বের অবমাননার ক্ষোভের প্রকাশ। যন্ত্রসভ্যতার প্রচণ্ড চাপে হাঁফিয়ে ওঠা প্রকৃতিবিচ্ছিন্ন মানুষ খানিকক্ষণ ধরে একনাগাড়ে চেঁচিয়ে নিজেকে হালকা করতে চায়। তার দাবি, তার সেই চেঁচানিকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করুক বাদ্য ও নৃত্য। নরম সুরের মলম তার চায় না, রাগ করে সে তা ছুড়ে ফেলে দেয়। এক ভয়ানক পরিস্থিতি !
একই ব্যাপারে জ্ঞানের সব শাখাতেই - সাহিত্য, ইতিহাস, নৃত্য, বাদ্য, চিকিৎসাবিদ্যা, বাস্তুবিদ্যা - সর্বত্র। সবক্ষেত্রেই অতীত থেকে বর্তমান ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এখানে তা নিয়ে আর বিস্তারিত আলোচনায় না গিয়ে আমরা বরং এই পরিস্থিতির পিছনে প্রকৃতির নিয়মের ইশারা কী, এবং পরিস্থিতিটি কোন্ দিকে যেতে চাইছে সেদিকে নজর দিই।
গোলোকায়নী (এষড়পধষরুরহম) সভ্যতার সংস্কৃতিপ্রসঙ্গ ঃ এবার তবে জোড়ার পালা
উল্টো পথে নিজেকে সেরে নেওয়ার অঙ্ক সংসারকর্মে লিপ্ত কর্মীর বেলায় যদি সপ্তাহে একদিন হয়, তবে সমাজের বেলায় সে হয় এক এক যুগ পরে। প্রকৃতির নিয়মেই হয়। সেই নিয়মেই আসে প্রলয়। নানা যুগে সেই প্রলয়ের নানা নাম। আজ যে-প্রলয় এসেছে তার নাম দেওয়া হয়েছে বিশ্বায়ন।
পুরাকালে প্রাচ্যদেশে জনসাধারণকে বলা হত ‘জল’ এবং এই বিশ্বায়নের মতো ব্যাপারকে বলা হত ‘প্রলয়’ বা ‘একার্ণব।’ এর অর্থ, দুনিয়ার সমস্ত মানুষের ‘এক জনসমুদ্রের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাওয়া’ ; কিংবা বলা যায়, একই জীবনাচারের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাওয়া। এর কারণ হল  জলকে যেমন কেটে কেটে খণ্ড খণ্ড করা যায় না, মানুষ-নামক ‘ঝাঁকজীব’টিকেও তেমনি টুকরো টুকরো করে আলাদা করা যায় না ; করলে সে-চেষ্টা তার বিপরীত প্রতিক্রিয়ায় বারংবার বিপর্যস্ত হবেই ; একেই একটু আগে বলেছি ‘উল্টোভাবে সেরে নেওয়া।’ সতীনাথ ভাদুড়ী নামে এক বাঙালি সাহিত্যিক তাঁর ‘ডায়েরি’তে এ-কথাটিই লিখে গেছেন একটু অন্যভাবে, ‘মানুষ অতৃপ্ত - কী যেন খুঁজছে সারা জীবন - কী সে জিনিস ? সেই পূর্ণ জিনিসটা নয়তো - যার থেকে সে খণ্ডিত হয়ে এসে বর্তমানের জীবন নিয়েছে ?’ তার মানে, মানুষের মনের গভীরে বিশ্বপ্রকৃতির এক অমোঘ ইচ্ছা নিয়ত কাজ করে চলেছে। তারই কারণে একদিন ফাঁক পেলে সে, যান্ত্রিকতার চাপে তার আত্মস্বরূপের যে-জায়াগাগুলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে গেছে, সেগুলি সেলাই করে নিতে দৌড়োয়। ব্যক্তিমানুষের মতো সমাজও তার প্রলয়কালে সেইরকম আচরণই করে থাকে। তাই এই প্রলয়ের সবচেয়ে বড় বিশেষত্ব দেখা যায় এর আয়োজকদের চরিত্রে। দেখা যায়, এতকাল যে-শক্তি লোকালাইজেশনের বা খণ্ডতার জয়গান গাইছিল, প্রলয়কালে সেই শক্তিই গ্লোবালাইজেশনের বা অখণ্ডতার ডাক ডাকছে, এবং এতকাল যে-শক্তি আদি গ্লোবালাইজেশনের উত্তরাধিকার থেকে কিছুতেই লোকালাইজ্ড্ হতে রাজি হচ্ছিল না, সেই শক্তিই এই প্রলয়কালে লোকালাইজেশনের পক্ষে সওয়াল করছে। অর্থাৎ যে-শক্তি বহুকালক্রমাগত ধারাকে ছিঁড়ছিল, সেই বলছে সেলাইয়ের কথা ; এবং যে-শক্তি যথাস্থিতি বজায় রাখছিল, কিছুতেই ছিঁড়তে দিচ্ছিল না, সেই-শক্তি এই সেলাই-চেষ্টায় আপত্তি তুলছে। বোঝা যায় আপত্তিটা তার সেলাইয়ে নয়, পাছে সেলাইয়ের নাম করে বর্তমান সেলাই-চেষ্টার দাবিদাররা আরও ছিঁড়ে না দেয়। এইসব কারণে আমরা এক ‘বিশ্বায়ন’ না বলে ‘গোলোকায়ন’ বা ‘গ্লোকালাইজেশন’ বলে শনাক্ত করছি।
কিন্তু ‘একই জীবনাচারের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাওয়া’র জন্য বর্তমান গোলোকায়নী সভ্যতার এই যে ডাক, এর আর একটি অর্থ হল, কেবল রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক একাকার নয়, এ-প্রলয় সব ক্ষেত্রেই। একাকার চলবে কেবল পণ্যের দুনিয়ায় বা দেবপ্রবাহে, তা হবে কেমন করে ! দেবপ্রবাহ তো ঋষিপ্রবাহের উপর নির্ভরশীল। সেখানেও অতএব একাকারের ডাক এসেছে। সেই ডাকে সাড়া দিতে গেলে বিশ্বের সমস্ত জাতির ঋষিপ্রবাহকে একত্রে জুড়ে নেওয়া প্রয়োজন। যে যে ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্নতা ঘটেছে, সেই সেই ক্ষেত্রে এখন জুড়ে নেবার পালা। আর সে-কাজই শুরু হয়েছে আজ বিশ্বজুড়ে।
পূর্ববর্তী প্রলয়গুলিতে এই কাজ তেমন করে কেউই করতে পারেননি। বৌদ্ধ-প্রলয়ে বিশ্বের অন্য জাতিগুলির সঙ্গে যে একাকার ঘটেছিল, তাতে মানুষ যে এক হতে পারেনি সে-কথা আমরা জানি। ক্রুসেড বা জেহাদের সময়ও তা হতে পারেনি। সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের সময় কিছুটা হয়েছিল বলেই আমরা বিভিন্ন দেশের ইতিহাস সংস্কৃতি ভাষা ইত্যাদির একটা সামগ্রিক সংবাদ আজও পাই। ইউরোপীয় পণ্ডিতেরা চেষ্টা করেছিলেন বাকি বিশ্বকে ইংরেজিতে অনুবাদ করে নিতে, যদিও বহু ক্ষেত্রেই প্রভুগিরির কারণে সেই একাকারেও আমরা এক হতে পারিনি। সবচেয়ে বড় কথা, এই একাকার ঋষিপ্রবাহের ক্ষেত্রে যেটুকু এক করার চেষ্টা করেছিল তা সবই বহিরঙ্গের একাকার। অন্তরের নয়। ফলে একাকার হয়েছিল, এক হয়নি। কেন হয়নি তার ব্যাখ্যা দিয়ে গিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ - ‘একাকার হওয়া এক হওয়া নয়। যারা স্বতন্ত্র তারাই এক হতে পারে। পৃথিবীতে যারা পরজাতির স্বাতন্ত্র্য লোপ করে, তারাই সর্বজাতির ঐক্য লোপ করে।’৮ আজকের বিশ্বায়ন-নামিত প্রলয়েও এইরকম শক্তি এখনও সক্রিয়। সে অন্যের স্বাতন্ত্র্য স্বীকার করতে চায় না, অথচ একাকার চায়। তাছাড়া, একালের দেবপ্রবাহের অধিকারীরা এখনও যুগের প্রয়োজনের সম্পূর্ণ যোগ্য হয়ে উঠতে পারেননি। তাঁরাও অপরের স্বাতন্ত্র্য স্বীকার করতে এখনও ইতস্তত করছেন।
তবুও, প্রকৃতির নিয়মেই আজ বিশ্বজুড়ে একটা চেষ্টা শুরু হয়েছে মানুষের সমগ্র ঐতিহ্যকে, তার পিতৃপ্রবাহ, দেবপ্রবাহ ও ঋষিপ্রবাহকে একত্রে বুঝে নেওয়ার, একাকার করে নেওয়ার। সেই আদিকাল থেকে আজ পর্যন্ত মানুষের সমাজ যে পথ বেয়ে এসেছে, সেই পথের সংবাদ যার কাছে যেটুকু আছে, তা নিয়ে এবার বিশ্বসভায় হাজির হওয়ার ডাক শোনা যাচ্ছে। আর সন্দেহ নেই, এই সংবাদ আজ সবচেয়ে বেশি রয়েছে বাংলাভাষীদের হাতে।
সেকালের ভাষায় সন্তানপ্রবাহকে (পিতৃগণকে) ব্রহ্মা, দেবপ্রবাহকে বিষ্ণু এবং ঋষিপ্রবাহকে মহেশ্বরও বলা হত। আদিতে এঁদের সমমর্যাদা ছিল, ছিল পরস্পরকে উচ্চ বলিয়া ব্যবহার। আদি প্রলয়ের প্রাক্কালে শিবের অসম্মান ঘটিয়ে দেয় দক্ষ বা একই কর্মের পুনরাবুত্তি, যা কিনা একপ্রকারের যান্ত্রিকতা বৈ অন্যকিছু নয়। তাই, সমাজে যান্ত্রিকতার (দক্ষতার) সামাজিক স্বীকৃতির পর থেকেই ঋষিপ্রবাহে বিঘেœর সূত্রপাত হয়। এই একই কর্মের পুনরাবৃত্তি প্রচলিত ঋষিপ্রবাহে, রবীন্দ্রনাথের মতে, ‘একটেরে’ করে দেয়। সমস্ত জোর পড়ে যায় বাহ্যসম্পদের প্রবাহে বা দেবপ্রবাহে বেগ সঞ্চারের দিকে। দৈবই প্রবল হয়ে ওঠে এবং পুরুষকার গুরুত্ব হারায়। হিন্দু যুগের সূত্রপাতের ঠিক আগে এইরকম দৈবই প্রবল হয়ে উঠেছিল। তখন ভারতসমাজ পুরুষকারের গৌরব ঘোষণা করে এবং দৈবকে পর্যুদস্ত করে দেয়, ভারতসমাজে বহির্বাণিজ্য নিষিদ্ধ হয়ে যায়। এরপর ভারতসমাজে মানুষের বাহ্যিক সমৃদ্ধি হত কদাচিৎ, সে-দৈবাৎ তখন ‘হঠাৎ’ অর্থে গৃহীত হতে থাকে। বলতে কি, হিন্দুসভ্যতায় পুরুষকারের এই প্রাবল্য দৈবকে প্রায় নিঃশেষ করে ফেলে, ভারতসমাজ ভিখারি ও দুর্বলদের সমাজে পরিণত হয়ে যায়। তারপর পাঠান-মোগল-ব্রিটিশ ও স্বাধীনতার যুগ পেরিয়ে আজ আবার আমাদের দেশে দৈব (পণ্যজনিত সমৃদ্ধি) প্রবল হয়ে উঠেছে ; সারা বিশ্বজুড়েই আজ দৈব অত্যন্ত প্রবল। পুরুষকার আবার পদদলিত। অথচ কমপক্ষে উভয়ের সমমর্যাদা এবং অধিকপক্ষে উভয়ের ‘পরস্পরকে উচ্চ বলিয়া ব্যবহার’ই দেবপ্রবাহ ও ঋষিপ্রবাহের মধ্যেকার সম্বন্ধ (সম-বন্ধন) হওয়া উচিত এবং আদিতে সেরকমই ছিল।
হ্যাঁ, আজ দৈবই প্রবল, পুরুষকার তার সেবায় নিয়োজিত অর্থাৎ ঋষিপ্রবাহ দেবপ্রবাহের সেবাদাস। তার স্বাতন্ত্র্যকে, তার ‘পথপ্রদর্শক’-এর ভূমিকাকে এখনও যথোচিত মর্যাদা দিতে বাকি। আজও মানুষের সমস্ত জ্ঞানবুদ্ধি পণ্য উৎপাদানের সেবাদাসে পরিণত হয়। অঙ্ক বিজ্ঞান দর্শন সাহিত্য সবই পণ্য-উৎপাদকের কাছে চাকরি নিতে বাধ্য হয়। ফলস্বরূপ এই দেবপ্রবাহ, রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘যে বিজ্ঞান (= ঋষিপ্রবাহের একটি অংশ) যথার্থ আত্মসাধনার সহায় তাকে বিশুদ্ধ জ্ঞানের পথ থেকে ভ্রষ্ট করে জগতে মহামারী বিস্তার করেছে।’৯ তবে এর সবচেয়ে খারাপ ফল ফলছে অন্যদিকে। সবচেয়ে মহান যে মানুষটি তাকে যদি সেবাদাসের কাজে নিয়োগ করা হয়, সবাইকে পথ দেখানোর মহান দায়িত্বের দিকটি ফাঁকা পড়ে যায়। সেদিকটি পূর্ণ করার লোক পাওয়াও যায় না। অথচ এতদিন সেটাই ছিল ঋষিপ্রবাহের সর্বোত্তম কাজ - সমাজকে পথ দেখানো, সেই কাজটি আজ দারুণভাবে ব্যহত। আজকের গোলোকায়নী বিশ্ব অন্ধ, জানে না সে কোথায় যাবে। তার পথপ্রদর্শকের আসন শূন্য। লোকে অনুসরণ করছে দৈবকে (পণ্যজনিত সমৃদ্ধিকে), পুরুষকার পদদলিত, গোলোকায়নী সভ্যতা এগিয়ে চলেছে, সবার সামনে সিলিকন ভ্যালির ধনীরা এগিয়ে চলেছেন এবং তাদের সামনে অন্ধকার ভবিষ্যৎ। পথ দেখানোর কেউ নেই। অথচ এই সিলিকন ভ্যালির নেতৃত্বেই আজকের অন্ধ গোলোকায়নী সভ্যতা তীব্র বেগে ছুটে চলেছে ! অন্ধের এই দুর্বার গতি নিঃসন্দেহে মহা বিপজ্জনক ! কেননা এই দুর্বার গতির উপরে আমরা, বিশ্বের সাধারণ মানুষেরা, সওয়ার আছি ! এ-পাগল খাদে পড়ে মরতে চায় মরুক, কিন্তু এ যে আমাদের সকলকে নিয়ে খাদে পড়বে ! নিজেও মরবে, আমাদেরকেও মারবে ! তাই অবিলম্বে এর দিশা ঠিক করে দেওয়ার উপায় বের করতে হবে। নইলে নিস্তার নাই। আর সে-দিশা করে দেওয়ার যোগ্যতা ধরে কেবল মানুষের ঋষিপ্রবাহ। অবশ্য তার আগে তাকে তার আত্মবিচ্ছেদের ছিন্নসূত্রগুলি জুড়ে নিতে হবেই।
একালের ঋষিরা (মনচাষিরা) তাঁদের মানসফসল দিয়ে আজকের এই সমস্যা সমাধানের উপায় বের করতে পারেন। সেক্ষেত্রে দু’টো মুখ্য কর্তব্য ঃ (১) ঋষিপ্রবাহকে সমাজের পথপ্রদর্শকের দায়িত্বে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা, এবং (২) দেবপ্রবাহের ক্রীতদাসত্ব থেকে ঋষিপ্রবাহকে মুক্ত করা ও দেবপ্রবাহের নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় তাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা। তবে সেকাজ করতে গেলে সবার আগে ঋষিপ্রবাহকে তার আত্মবিচ্ছেদ থেকে বাঁচানো দরকার। আর সেটাই বর্তমান সময়ের ঋষিদের (সংস্কৃতিচিন্তকদের) প্রধান কাজ।
আজকের একাকারে ঋষিপ্রবাহের বহিরঙ্গের আত্মবিচ্ছেদের ছিন্নসূত্রগুলি জোড়া দেওয়ার কাজটি একালের ইনফর্মেশনের দুনিয়া বিশ্বজুড়ে শুরু করে দিয়েছে। ঋষিপ্রবাহের আন্তরিক জোড়ের দিকের কাজটায় এখনও তেমন করে হাতই পড়েনি। কেননা তার জন্য যে-অন্তর্দৃৃষ্টির প্রয়োজন, আজকের একাকারের ডাক যাঁরা দিচ্ছেন তাঁদের হাতে সেই বস্তু নেই। আদি থেকে বর্তমান পর্যন্ত ঋষিপ্রবাহের যে-ধারা, তার উৎসের দিকটা তাঁরা একেবারেই জানেন না। এইখানে ডাক পড়েছে বাংলাভাষীদের। কেননা তাঁদের হাতে রয়েছে ঋষিপ্রবাহের আদি থেকে বর্তমান পর্যন্ত একটি সার্বিক অন্তর্দৃষ্টি। অন্য জাতিগুলিকে তাঁদের অতীত থেকে বর্তমানে আসার পুরো পথটি আবিষ্কারের ব্যাপারে গাইডের সহায়তা করতে পারেন বাংলাভাষীরা। কিন্তু সে-কাজ তাঁরা করবেন কেমন করে !
না, অর্জনগত যোগ্যতা থাকলেও বাংলাদেশ বা পশ্চিমবঙ্গের অধিবাসী-বাংলাভাষীরা এ-ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করতে পারবেন বলে মনে হয় না। কারণ তার জন্য প্রয়োজনীয় সংযোগ তাঁদের নেই। সেই সংযোগটি হল অন্য জাতির বর্তমান ঋষিপ্রবাহের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সাহচর্য। এই জায়গায় রয়েছেন বাংলার বাইরে থাকা বাংলাভাষীরা, বাংলাভাষী অগ্রবীজেরা। এই কাজ তাঁরা হাতে নিতে পারেন। তাতে একদিকে যেমন বর্তমান একাকারের অনুকূলে তাঁরা মাথা উঁঁচু করে হাঁটতে পারবেন, তেমনি অন্যদিকে তাঁদের অস্তিত্বের নিজ নিজ হারানো অংশটির সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক ঘটে যাবে, ফেলে আসা অতীতের সংস্পর্শ ঘটে যাবে। এই সম্পর্ক তাঁদের অস্তিত্বে প্রাণ সঞ্চার করবে এবং স্বস্তি দেবে বলেই মনে হয়।
গোলোকায়নী সভ্যতা মানুষের অতীত থেকে বর্তমান পর্যন্ত সমস্ত যাত্রাপথটিকে জুড়ে নিতে চাইছে, বিভাজিত মানবসমাজকে এক করতে চাইছে, মহামানবের পুনর্গঠন করে নিতে চাইছে। সেই কাজে ঋষিপ্রবাহের হরাইজণ্টাল ও ভার্টিকাল বিচ্ছিন্নতাগুলিকেও জুড়ে না নিলে সে এগোতে পারছে না। আর সেই কাজে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য তার প্রয়োজন বাংলাভাষী অগ্রবীজদের। যুগের এই ডাকে তাঁরা কি নীরব থাকতে পারেন ?





..................................................................
টীকা ও টুকিটাকি
১। মানুষের আদি ভাষায় শব্দের গঠনপদ্ধতি ছিল ক্রিয়াভিত্তিক। আজকের পৃথিবীর সব ভাষাই সেখান থেকেই জন্মেছে এবং ক্রমান্বয়ে প্রতীকী স্বভাবের হয়ে গেছে। এমনকি নিজেদের এই অতীতের কথাও প্রায় সব ভাষা এবং তাদের ভাষাতাত্ত্বিকেরা ভুলে গেছেন। এর উত্তরাধিকার এখনও যতটুকু জীবন্ত অবস্থায় রয়েছে, তা রয়েছে একমাত্র বাংলাভাষায়। সংস্কৃতের এ-উত্তরাধিকার ছিল, তবে ‘মৃতভাষা’ বলে তার সে-উত্তরাধিকার রয়েছে ‘শব’ রূপে। এই ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থবিধি উদ্ধার করে বর্তমান লেখক আমাদের প্রাচীন গ্রন্থগুলিকে যথাসাধ্য একালের মতো করে ব্যাখ্যা করে চলেছেন। এ-বিষয়ে লেখকের বেশ কয়েকটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। আগ্রহী পাঠক তা থেকে বিস্তারিত তথ্য পেয়ে যাবেন।
২। দ্রষ্টব্য ঃ বঙ্গীয় শব্দকোষ / হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়।
৩। দ্র্রষ্টব্য ঃ মহাভারত / কাশীরাম দাস। কৃত্তিবাসী রামায়ণেও এই রকম ধারণার কথা আছে।
৪। ‘সাহিত্যসৃষ্টি’ / রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
৫। জিনিসটি কী, তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা করা হয়েছে রবি চক্রবর্তী ও কলিম খান লিখিত গ্রন্থ ‘বালাভাষা ঃ প্রাচ্যের সম্পদ ও রবীন্দ্রনাখ’ গ্রন্থে। এখানে তা অতি সংক্ষেপে সারতে হল।
৬। ‘ততঃ কিম’ / রবীন্দ্র রচনাবলী, ৭ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫০৯।
৭। সাধক প্রফেসর অরিন্দম চক্রবর্তী লেখা নিবন্ধ থেকে। প্রকাশক দেশ।
৮। কালান্তর, পৃষ্ঠা ১৮৩।
৯। ‘আরোগ্য’ / রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন