শনিবার, ৩১ অক্টোবর, ২০০৯

কবি বিজয় আহমেদের কবিতা

ম্যাজিক


এই যে লাল পাখিটা নীল হয়ে গেল।
একরাশ ধুলো এই যে হঠাৎ
হয়ে গেল মায়া;
আর সেই মায়ার নদীতে, এই যে একদল জাদুকর
নিজের নাম ভুলে, মুহূর্তেই
হয়ে উঠছে, লাল রঙের এক মাছের হাতে ধরা দুর্দান্ত রুমাল!

বলি, কি বলে একে, জাদু-অলক্ষ্যের গান,
পাখির বুকে লুকিয়ে থাকা বট- বীজের
খিলখিল হাসি?

এসব কিচ্ছু জানি না আমি, শুধু জানি চোখ মেললেই
-সিনেমাহলের গান হয়ে উঠে জালালি কবুতর
-গমক্ষেতের বাদামি রঙ হয়ে উঠে নীলচে প্রেমপত্র

আর একদল ধুলো হয়ে উঠে মায়া
আর মায়া হয়ে উঠে, নীলচে চিঠি, মায়ের ফটোগ্রাফ


২.
ধরো তুমি ধূলির গায়ে,
নীলচে নাকফুল আর ঘাসের পাশে
এঁকে দিলে দুষ্টুমতন একটা গায়ক চড়াই
বলতে পারো, কি করবে তার শালিক-চিলে?

আর শোনো, যদি দেখো অঙ্কিত ক্যানভাস থেকে হঠাৎ করে
সেই উড়ু মনের গায়ক চড়াই, উড়তে থাকে আচ্ছা
তখন তাকে বলো তুমি, শাবাশ বাঘের বাচ্চা?


৩.
বলি কেন যে এমন হয়
নদীরাও রাগী যুবকের শহর ছেড়ে এসে, আমার বাড়ির
পাশ ঘেঁষে চলে যায়;

আর আমি ব্যাকরণবীদ, নদীদের জন্যে
সোনার অক্ষরে লিখি
ডুবসাঁতারের নিয়ম-নীতি আর রূপ-অরূপের মায়া

আর নদী, সেও ইঙ্গিতপ্রবণ
বলে যে নাকফুলেই নাকি সবচেয়ে সুন্দর হয়ে ফোটে
মৃতদের শাদা শাদা হাসি


শীতের কবিতা

শুনছো তো এ শীতকালে, খেজুরবাগানের উষ্ণতা হতে
উড়ে আসা বেপেরোয়া গন্ধের মায়ার সাথে
ঝগড়া করছে তোমার বউ

তোমার বউ,
যে মূর্খ-সুন্দরী এবং কামগন্ধময়
যে কফিতে ঠোঁট ডুবিয়েই ভুলে যায় গ্রাম- রঙধনুর স্মৃতি

বলো তার কেন এতো মিহিন-মুগ্ধ
ঝগড়া আর বিবাদ
খেজুর বাগানের উষ্ণতার সাথে?


দস্যু মোহন

এখানে তুমিই দস্যু মোহন। দেবদারু বনের একান্ত ঝিরঝিরে গোপনে
কেনো যে ছড়িয়ে দিচ্ছো,
বিচিত্র সব মশলা ও লবঙ্গের ঝাঁঝ, রহস্য আর আবেগহীন উত্তেজনা,
সত্যি আমি কানা বাদক, এসবের মানে বুঝি না!

শুধু বুঝি অজস্র পুলিশ ও গোয়েন্দাবাহিনীর চোখ এড়িয়ে, এই যে শহরতলীর মাটি থেকে
তুলে আনছো সিনেমা হলের অতিপ্রাকৃত গান, তা আসলেই ধাঁধাঁ,
তা আসলেই যৌনভাষাময় একপ্রকার মায়ার জাদু।

আমি এমন গানের ভিতরে ঢুকে যেতে চাই, অন্ধ এক ডুবুরির মতন
আর ছোট্টবেলার কানিজ আপার কাছে, এক অতিকায় ট্রেনের লালচে বগী করে পাঠাতে চাই
তার প্রিয় ঘুমকাতুড়ে ও অদ্ভূত ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর মিউজিক।

এখানে তুমিই দস্যু মোহন, বলি, তুমিই জানো সোনাখনির লাল-নীল লোভে
কোন সে বিদেশি
ব্যাপক উন্মাদ ইদানিং!


আয়ুর জীবনী

আয়ু, প্রিয়তম বালক ভাইটি আমার
তোমাকে নিয়েই আমার মা লিখেছে এক হাসাহাসির উপন্যাস;
সেই গ্রন্থের পাতায় পাতায় সোনার হরফ আর আশ্চর্য মুগ্ধতা;
আমি সেইসব হরফের গায়ে হাত বুলাই
আর শুনি তাদের গায়ে একপ্রকার মিউজিক বাজতে থাকে!
আমি সেই মিহিন মিউজিকে দেখি দৌড়াচ্ছে এক ম্যারি গো রাউন্ড
এবং তার পিছু পিছু এক বৃষ্টি কাতর উন্মাদ;
মহাসড়কের পাশ দিয়ে আগন্তুক বোঝাই লরী থেকে আখ পেড়ে নিয়ে
হেঁটে যেতে যেতে রাংতা বালক আমি
ভাবি আমার মা তাইলে এমন প্রখর মেধাবী।
আয়ু আমাদের একঘেঁয়ে রান্নাঘরে তোর জীবনী আঁকা হলো যেদিন
সেদিন থেকেই জগতের সকল নদীর বাঁকে হারিয়ে যাওয়া অথবা পায়ের নিচে চাপাপড়া
রাস্তাগুলোর পুনরায় জন্ম হল মশলার ঝাঁঝ ও গুমোট গরমে।

ভাবি যদি এবার
সমুদ্রগ্রামের তলদেশ থেকে টাইটানিকের সাথেই উঠে আসে খোয়াজ খিজির
তবে কেমন হবে?

যাই হোক, বলি মা আমাকে গতকাল দিয়েছে আগুনের নৃত্য গুঁজে দেয়া
এক উলের স্যুয়েটার। আমি যেই মুখ ডুবিয়ে দেই সেই ম্যাজিক ভুবনে
তখনি যেন আকাশগ্রামে
আরো একটা উল্কাপতন ঘটে।
আর সেইসব উল্কারা তাদের ব্যক্তিগত যে স্মৃতিগুলো জমা রেখেছিল কফিনের
জাদুঘরে, তারা হুটহাট জীবন্ত হয়ে উঠে এবং চড়ে বসে এক ফ্লাইংসসারে,
আর ভাড়া করা মাইকে ‘হ্যালো মাইক্রোফোন টেস্টিং বলতে বলতে’ শোনায়
-এই যে ঘুড়ি, এরাই তারাদের দূতিয়ালি করে
-এই যে পায়রাগুলো এরাই আকাশগ্রামের সেইসব আউট ল যারা
রাজ্যের বিদ্রোহী ছিল
-এই যে শালিখেরা, টিয়েপাখিরা এরাই ছিল বৃদ্ধ রাজার দুই তরুণী-স্ত্রী,
যারা পালিয়েছিল একদা এক মেঘ ঝিরঝিরে বিকেলে সুপুরুষ
সেনানায়কের হাত ধরে, একই সাথে
আমি মাকে বলেছি মাগো একটা উড়ন্ত বাইসাইকেলের খুব লোভ
কেননা সাইকেল এমন মোহন জাদুকর, যে বাদ্যি বাজায় আর বলে অজস্র বিলুপ্তপ্রায় জোক্স
শুনে মা বলে বাবা রে, তুই যখন খুব ছোট, তখন এক শীতসকালে
খেজুরের রস আনতে গিয়ে চোরাকাঁটায় যখন কেটে গেল পা
আর বেরুল গলগল করে নীল-রক্ত
তখনি বুঝলাম তুইই হবি সেই মহত্তম পুরুষ
যে ইচ্ছে করলেই নিলীমাকে করতল বানিয়ে লুকিয়ে ফেলতে পারবি
সমুদ্র-বণিকের ম্যাপ!

বলি কী হবে হয়ে মহত্ত্বম পুরুষ
আমি জানি রেলট্র্যাকের পাশেই মুখ লুকিয়ে থাকে যে লজ্জাবতী ও ঘাসফুলের দঙ্গল
তাদের নিরন্তর ঝগড়াধ্বনিতেই আরো ইশারাকাতর আরো ইঙ্গিতবাহী
হয়ে উঠে এ পৃথিবী;
এ ঝগড়াধ্বনির চেয়ে সুরেলা আর কোনো গান নেই
এ সৌন্দর্যের চেয়েও অধিক কোনো সৌন্দর্য নেই ঘোড়ার কেশরও

জেনো মা, শুয়ে থাকা রেল-ট্র্যাক যে ভাষা শিখিয়েছে আমাকে
তার চেয়ে ধুঁয়া-ধূসর, উচ্ছ্বল ও স্বর্ণ-উজ্জ্বল আর কোনো ভাষাই নেই, এ পৃথিবীর দুপুরবেলা নামক পুস্তকে;
শোনে, মা হাসে আর বলে
-পায়রারাই দূত, ম্যাসেন্জার জানিস?
জানি
-মেঘেরাই রঙের দোকানদার, জানিস
জানি
-যৌনতাই সবচেয়ে উজ্জ্বলতম লাল রঙের ফুল এ পৃথিবীতে, জানিস?
জানি
-সমুদ্রই ঘুড়ি, আকাশে এঁকে দিচ্ছে হাওয়াদের শিস, জানিস?
জানি
-ধুলোই পৃথিবীর একমাত্র মায়াপ্রবণ প্রবন্ধ-গ্রন্থ, জানিস
জানি
-গ্রুপফটোতেই রচিত হয় জগতের সকল মৃত্যুকাতরতা, জানিস?
জানি
-আয়ুই হলো সেই গোঁয়ার মহিষ, যে দুপুরবেলায় ঘাসের বনে ছিটিয়ে
দিচ্ছে মায়ার ঔজ্জ্বল্য, জানিস?
জানি
-প্রতিটি গাছই কালিকালবিহীন নীলচে কালির কলম, তারাই ফলাচ্ছে
সোনার খনি নক্ষত্রম্যাপ, আর লিখছে আমার আদেশে আয়ুর জীবনী,
জানিস?
জানি না।

এই জানি না উচ্চারণের সাথে সাথেই কালহারা এক অসাধারণ হাসি ফুটে ওঠে
এক চিরায়ত ভঙ্গিতে, মা তোমার মুখে;
আমি খুব সাধারণ দর্শক হয়ে এ মধুর ঘটনা ও অবাক দৃশ্যপঞ্জি মুখস্থ করতে থাকি
আর বড় হয়ে উঠতে থাকি



আমার মেধাবি মা পছন্দ করেন, তাই

-খেজুরগাছকেই ডেকেছি উস্তাদ
-বাঘের গায়ে ছিটিয়ে দিচ্ছি কাতুকুতুর গল্প
-প্রবালের গায়ে এঁকে দিচ্ছি ভাস্কো ডা গামার টুপি
-বন্ধু-প্রেমিকার নাকফুলে গোপনে লিখেছি আমার নাম
-শত্রুদের দলে এনে দিচ্ছি রহস্যরঙ, মুচকিহাসির খেলা
-জন্মগ্রামে পুঁতে দিচ্ছি বাঁশফুলের ন্যায় উজ্জ্বল স্মারক




হেই আয়ু, দুষ্টু বালক, দুপুরগুলো খুব যৌনকাতরতায় ভোগে
তুমি কি তাকে একটিবারের জন্যে, হরতালের দিনে শহুরে সেলুনে পারো বসিয়ে দিতে
আর বলতে পারো, কবরফলকে বসেই সবচেয়ে ভালো গায় গ্রাম-গঞ্জের অখ্যাত দোয়েল;
আয়ু আসো, আউট ল হবার কায়দাকানুন জেনে নিয়ে, যাই রেস্তোরাঁয় আর আনন্দ করি
কেননা তোমার জীবনী হতে পারত আরো বর্ণাঢ্য, রঙচঙে, ও উদাহারণযোগ্য;
তুমি কি জানো না কৈ মাছেরাই সবচেয়ে বড় পর্যটক,
তাহলে কেন এত ডুবে থাকা প্রেমিকার ঘামগন্ধময় ঘাড়ে।
বরং চলো বেলুন কিনি, চা খাই এক কাপ, উঠি অবৈধ পাহাড়ে, নিজের ছেলেকে কিনে দেই ঘাসের সবুজ,
আর আরেকটু বিষণ্ন হই;
কেননা বিখ্যাত জীবনীতে থাকা লাগে একটু আধটু মন খারাপ, একটু আধটু কথা না রাখা,
একটু আধটু মন ভেঙে দেয়া, আর হঠাৎ হারিয়ে যাবার গাল-গপ্প



বিখ্যাত ছোট ভাইটি আমার, অনাগত বৃষ্টিময় বিকেলে, তোকেই
বিক্রি করে দিব, অন্য কোনো মায়ায় দঙ্গলে
তারপর সেই মানুষ অথবা মানুষীর দিকে তাকাব খুব ঈর্ষাকাতর চোখে;
আর আমি ও মা মিলে কাঁদব, অনেকক্ষণ ধরে, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে,
জাগতিক ব্যাকরণ ভুলে, আর হাত তোলে আকাশগ্রামের সেই মহৎ পুরুষের উদ্দেশে
বলব, আয়ু তো ডাংগুলিবালক, হাসতে হাসতে সে যেন ভালোই থাকে।

সে যেন পায় অনেকদিন পর ডুবোজাহাজের পেট থেকে বেরিয়ে আসা বেখেয়াল
রংধনু-বন্ধু, যেন চাইলেই, যার-তার আলখেল্লা করে দিতে পারে রঙিন

সে যেন পায় এমন এক বান্ধবী যার কাম-দক্ষতায় এ জগতের অনেক ডাকটিকিটই
হঠাৎ প্রাণ ফিরে পাবে আর ভুলে যাওয়া কোনো জেলা বা উপজেলা শহরের অলি-গলি ঘুরে শোনাবে
শাদাকালো বায়োস্কোপের সেই রহস্য-গল্প, যেখানে মরে যাওয়া নায়ক-নায়িকারা জীবন্ত হয়ে ওঠে
কোনো এক নাম না জানা অবাক কারিগরের কুশলী হাতের ছোঁয়ায়!

আমি আরো বলি, আয়ু এ পৃথিবীর সকল মুগ্ধতাকে তুই আগলে রাখিস পিতৃ-স্নেহে
আর ওদের কানে কানে বলিস আমার মেধাবি মায়ের কথা, যে মহিয়সী উলের স্যুয়েটার বুনতে বুনতে
হঠাৎ একদিন ইউরেকা বলে চিৎকার করে উঠেছিল আর নিজের বানানো হরফে লিখে ফেলেছিল তোর
জীবনী-পুস্তক, যে পুস্তক পৃথিবীর অনেক মহান মহান পুস্তকের চেয়েও অধিক সুরেলা, অধিক প্রাণোচ্ছল!
যে পুস্তকের পাতায় পাতায় ছড়ানো থাকে হাসিখুশি নামক দুই ভাই-বোনের গল্প, যারা
আমাদের ঘরে আসে অনেক অপ্রকাশ্যে, ভিনদেশি গোয়েন্দাদের মতন খুব অতর্কিতে!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন