সোমবার, ১২ অক্টোবর, ২০০৯

রাজনৈতিক দলগুলোয় গণতন্ত্র চর্চার অভাব রয়েছে : অধ্যাপক আনিসুজ্জামান




(অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। শিক্ষাবিদ ও লেখক। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমেরিটাস প্রফেসর। এর আগে তিনি অধ্যাপনা করেছেন ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। ভিজিটিং প্রফেসর ছিলেন বিশ্বভারতীতে। দেশের বিভিন্ন গণতান্ত্রিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এ বুদ্ধিজীবী। মুক্তিযুদ্ধের সময় সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ছিলেন। বাংলাদেশের সংবিধানের বাংলা ভাষ্যও তাঁর লেখা। যুগান্তরের সঙ্গে এ আলাপচারিতায় শিক্ষকতা এবং সাহিত্য সাধনার পাশাপাশি বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতি বিষয়ে তাঁর চিন্তাভাবনা উঠে এসেছে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেনমোহাম্মদ কবীর আহমদ)

যুগান্তর : দু’বছর আগেই আপনি সত্তর পেরিয়েছেন। পেছনে তাকালে নিজেকে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন? শিক্ষকতা, গবেষণা ও সমাজ-সংস্কারের সাধনা- কোনটা আপনার মূল?
আনিসুজ্জামান : আমার মনে হয় শিক্ষকতাই আমার জীবনের মূল। গবেষণা করেছি ঠিকই, তবে শিক্ষকতা করতে গিয়েই গবেষণা। গবেষণা আরম্ভ করেছিলাম শিক্ষকতায় প্রবেশ করার আগেই, কিন্তু শিক্ষক হব এ লক্ষ্য থেকেই গবেষণার কাজ আরম্ভ করেছিলাম। কাজেই শিক্ষকতাকে মূল বলি। সমাজ সংস্কারের চেষ্টা যে আমি করেছি তা বলব না। আমাদের সময় সমাজ সংস্কার-আন্দোলন তো তেমন ঘটেনি, কিন্তু সমাজ-পরিবর্তনের লক্ষ্যে নানা রকম প্রয়াস হয়েছিল। তার মধ্যে রাজনৈতিক আন্দোলনই বড়। এসবের সঙ্গে আমি যুক্ত হয়েছি। ভাষা-আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ অথবা স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন- তারপরও হয়তো কিছু কিছু। এগুলো আমার নিজের সচেতনতার একধরনের ফল। মনে হয়েছে, এসব কাজের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করা উচিত, সুতরাং যুক্ত হয়েছি। তবে আমি মনে করি, আমি মূলত একজন শিক্ষক।
হ্যাঁ, বিশ্ববিদ্যালয়-অঙ্গনেই আমার গোটা জীবন কেটেছে। এখনও তো বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত আছি। শিক্ষার্থীরা নিশ্চয়ই আমাকে তাদের শ্রদ্ধা-ভালোবাসা অনেক জানিয়েছে। সেজন্য আমি তাদের কাছে কৃতজ্ঞ। তবে সবসময়ে মানুষের মনে একটা অপূর্ণতাবোধ থাকে। যিনি বড় লেখক তাঁরও মনে হয়, তিনি হয়তো তাঁর যা দেওয়ার তার সব দিতে পারলেন না। তেমনি আমারও মনে হয়, হয়তো আমার কর্তব্য ছিল, ছাত্রছাত্রীদের আরও বেশি দেওয়া, সেটা দিতে পারিনি বা যেভাবে তাদের সঙ্গে ভাববিনিময় হওয়া উপযুক্ত ছিল, কিছুটা তাদের দোষে কিছুটা আমার দোষে, হয়তো সেটা হয়নি। তবে সব মিলিয়ে আমার আবার একটা তৃপ্তিবোধও আছে। আমি শিক্ষক হতে চেয়েছিলাম এবং শিক্ষকতার ক্ষেত্রে যা যা পাওয়ার, আমি সবই পেয়েছি।
যুগান্তর : ছাত্রাবস্থায় ‘মুসলিম-মানস ও বাংলা সাহিত্য’ লিখে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। আদি বাংলা গদ্য নিয়েও কাজ করেছেন। পরবর্তীকালে আপনার গবেষণা কাজে ধরাবাহিকতা না থাকার কারণ কী?
আনিসুজ্জামান : আসলে মুসলিম-মানস ও বাংলা সাহিত্য লেখা আরম্ভ করেছিলাম পিএইচডি পর্যায়ের গবেষণা করতে গিয়ে। শেষ যখন করেছি তখন আমি শিক্ষক হয়ে গেছি। এ বইটি বোধহয় আমার লেখার মধ্যে সবচেয়ে বেশি পঠিত হয়েছে এবং কলকাতায় দুবার, ঢাকায় তিনবার ছাপা হয়েছে। ষষ্ঠবার ঢাকায় আবার ছাপা হতে যাচ্ছে। সেদিক থেকে মুসলিম-মানস ও বাংলা সাহিত্য - আমার প্রথম বই - অনেক পাঠকপ্রিয়তা লাভ করেছে। আমার এক আমেরিকান সহকর্মী টোনি স্টুয়ার্ট (নর্থ ক্যারোলাইনা স্টেট ইউনিভার্সিটির ধর্ম ও দর্শন বিভাগের অধ্যাপক) - সে অনেক বই লিখেছে এবং যথেষ্ট খ্যাতিমানও। সে বলে, তোমার মুসলিম-মানসের মতো বই লিখতে পারলে আমি খুব খুশি হতাম। অনেক গবেষক আমার ওই বইটি ব্যবহার করেছেন। তাছাড়া গবেষণা-পদ্ধতির একটা ব্যাপারও বোধহয় মুসলিম-মানস ও বাংলা সাহিত্যে আমি প্রতিষ্ঠা করেছিলাম, যা আমার পরবর্তী গবেষকরা প্রায় সবাই অনুসরণ করছেন। কীভাবে পাদটীকা দিতে হয়, কীভাবে তথ্যনির্দেশ করতে হয়, কীভাবে গ্রন্থপঞ্জি করতে হয়- এসব বিষয়ে, আমার মনে হয়, বাংলায় যাঁরা গবেষণা করেছেন, তাঁদের মধ্যে সম্ভবত আমিই প্রথম আন্তর্জাতিক রীতিনীতি মেনে কাজ করেছি। মুসলিম-মানসের একটা ধারাবাহিকতা দেখা যাবে আমার মুসলিম বাংলার সাময়িকপত্রে। আর মুসলিম-মানসের মূল বিষয়বস্তুর একটা অতি সারসংক্ষেপ আছে, বলা যায়, আমার স্বরূপের সন্ধানে বইয়ের তৃতীয় প্রবন্ধে : ‘উনিশ শতকের বাঙালি মুসলমান লেখকদের ভাবজগৎ’। এই পর্ব মোটামুটি এখানেই শেষ করেছি।
মুসলিম মানসের যে-সর্বশেষ সংস্করণ কলকাতায় বেরিয়েছিল ওর ভূমিকায় প্রকাশের ৪০ বছর পর মুসলিম-মানস সম্পর্কে আমার যে-চিন্তা সেটা যোগ করার চেষ্টা করেছি। বইটি আমি পুনর্লিখন করিনি। কেননা তা করতে হলে আগাগোড়া নতুন করে কাজ করতে হয়। সংযোজনও করিনি সেজন্য। ভূমিকায় দু-একটি কথা বলে শেষ করে দিয়েছি।
আদি বাংলা গদ্য নিয়ে আমি ভাবনা শুরু করেছিলাম অনেক আগে থেকে। কিন্তু ১৯৮৪ সালে পুরোনো বাংলা গদ্য যে বেরুল, ওটাই এ-বিষয়ে আমার একমাত্র কাজ বলা যায়। আর গোটাদুই প্রবন্ধ আছে ইংরেজি ও বাংলায়। ইংরেজি প্রবন্ধ একটি গদ্য পাণ্ডুলিপি নিয়ে, আর বাংলা প্রবন্ধটি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ঢাকার কুঠির চুক্তিবদ্ধ তাঁতিদের অবস্থা নিয়ে। এর একটা ধারাবাহিকতা পাওয়া যেতে পারে আঠারো শতকের বাংলা চিঠি বইতে, যেটা চট্টগ্রাম থেকে বেরিয়েছিল। এ-সংক্রান্ত আরেকটা কাজ আমি এখনও করছি। যেসব রচনার ভিত্তিতে আমি পুরোনো বাংলা গদ্য লিখেছিলাম, সে মূল রচনাগুলো প্রকাশ করার চেষ্টা করছি এবং, আশা করছি, সামনের বইমেলায় বইটি বেরুবে পুরোনো বাংলা গদ্যসংকলন নামে।
যুগান্তর : বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আপনি প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিয়েছেন। পরিকল্পনা কমিশনের (তখন সেল বলা হতো) সদস্য হিসেবে বাংলাদেশকে কিভাবে দেখতে চেয়েছিলেন? এখনকার বাংলাদেশ তার থেকে কতটা দূরে?
আনিসুজ্জামান : বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আমার অংশগ্রহণ তো অনেক পরোক্ষ। তখন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা সেল - পরে পরিকল্পনা কমিশন গঠিত হয়েছিল, তার একজন সদস্য ছিলাম। পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হওয়ার যোগ্যতা যে আমার ছিল, তা নয়। তবে আমার মনে হয়, সরকারের কী ভাবনা ছিল, সরকারের ভাবনা-চিন্তার ক্ষেত্রে মূলধারাটা কী ছিল, সেটা আমি ভালোভাবে হৃদয়ঙ্গম করতে পেরেছিলাম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ সাহচর্যের কারণে। সরকার চেয়েছিল যে আমরা তিন রকম পরিকল্পনা করি : একটা স্বল্পমেয়াদি, একটা মধ্যমেয়াদি এবং একটা দীর্ঘমেয়াদি। আমি মনে করেছিলাম, আমাদের শুধু স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনাই করা উচিত। তারপরও কিছু কাজ হয়েছে সবরকম। যেমন, অধ্যাপক মুজাফফর আহমদ চৌধুরী বাংলাদেশের সংবিধানের একটি প্রস্তাবিত খসড়া তৈরি করেছিলেন। - এটি ছিল দীর্ঘমেয়াদি কাজের অন্তর্গত।
আমরা খুব বেশি সময় পাইনি। শুধু সময় পাওয়ার সমস্যা নয়, আমাদের তথ্য-উপাত্ত পাওয়ারও সমস্যা ছিল। কেননা যেসব বইপত্রের ভিত্তিতে আমরা কাজ করতে পারতাম তা ছিল না, যেসব খবর আমাদের দরকার ছিল তা আমরা পাইনি। স্বল্পমেয়াদি যে-পরিকল্পনা আমরা করি, তার জন্য আমাদের দরকার ছিল, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে যেসব ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে- পাকিস্তানি সেনারা যা করেছে বা মুক্তিযোদ্ধারা অনেক সময় যেসব সেতু-কালভার্ট উড়িয়ে দিয়েছে- এসবের একটা পূর্ণ বিবরণ। কিন্তু এটা আমরা পাইনি, ওই পরিপ্রেক্ষিতে পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল না। আসলে পরিকল্পনা কমিশনের মূল যে-চিন্তাটা ছিল সেটা হচ্ছে- রাজনীতির ক্ষেত্রে একটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা, অসাম্প্রদায়িক সমাজ গঠন এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সুষম বণ্টন নিশ্চিত করা, শেষটার জন্য একটা বড় পাবলিক সেক্টর গড়ে তোলা। বড় পাবলিক সেক্টর গড়ে তোলার পেছনে দুটি যুক্তি ছিল। একটা তো লক্ষ্যের দিক থেকে। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এগুতে হলে প্রাইভেট সেক্টরের চেয়ে পাবলিক সেক্টরের গুরুত্ব বাড়াতে হয়, যদিও দুটির মধ্যে সহযোগিতা অনিবার্য। আরেকটা ছিল, পাকিস্তানিরা যেসব বড় শিল্প, বীমা, ব্যাংক ফেলে যাচ্ছে, সেটা কিনে নেয়ার মতো টাকাও বাঙালি ব্যবসায়ীদের হাতে ছিল না। কাজেই এখানে রাষ্ট্র যদি এগুলোর দায়িত্ব না নেয়, তাহলে হয় না। এখন তো দেখা যাচ্ছে যে, আমরা সেইসব লক্ষ্য থেকে অনেক দূরে চলে এসেছি। যখন সংবিধান থেকে সমাজতন্ত্র উঠে গেল, ধর্মনিরপেক্ষতা উঠে গেল, রাষ্ট্রধর্ম প্রবর্তিত হল- তখনই আমরা অনেক দূরে চলে গেলাম। এখন আবার দেখা যাচ্ছে যে, প্রাইভেট সেক্টরও সরকারের অর্থসাহায্য চাইছে এবং গত আন্তর্জাতিক মহামন্দার পর দেখা যাচ্ছে যে, খুব বড় পুঁজিবাদী দেশেও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ, রাষ্ট্রের ভূমিকা কামনা করছে। কাজেই সবটা যে আমাদের ভুল চিন্তা ছিল তা নয়। কিন্তু গোলমাল হয়ে গেল প্রয়োগের ক্ষেত্রে। এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে, পাবলিক সেক্টর আমরা ভালোমতো চালু রাখতে পারিনি। কিন্তু যখন এগুলোকে বিরাষ্ট্রায়ত্ত করা হল- প্রাইভেট সেক্টরের হাতে তুলে দেওয়া হল - তখন দেখা গেল তাঁরাও অনেকে কল-কারখানা চালালেন না, কিন্তু তাদের যে ভৌত সম্পত্তি ছিল সেগুলো বিক্রি করে বা ব্যবহার করে তাঁরা অনেক টাকা-পয়সা করে ফেললেন। হয়তো পুঁজি গড়ে তোলার জন্য এ-ধরনের একটা ক্ষেত্র সরকার তৈরি করতে চেয়েছিল। এটা ঠিকই যে, মুক্তিযুদ্ধ কালের ধ্যানধারণা থেকে আমরা অনেক দূরে চলে এসেছি।
যুগান্তর : স্বাধীনতা-পরবর্তী রাজনৈতিক ঘটনা-দুর্ঘটনার কুশীলবরা কমবেশি সবাই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। তাদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব-সংঘাত কতটা আদর্শগত বলে মনে করেন?
আনিসুজ্জামান : স্বাধীনতা-পরবর্তী রাজনৈতিক ঘটনা-দুর্ঘটনার কুশীলবরা কমবেশি সবাই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন - একথা স্বাধীনতার পর প্রথম দশ বছর সম্পর্কে সত্য। পঁচাত্তরের বঙ্গবন্ধু হত্যা থেকে শুরু করে জেল হত্যা, ’৮১-তে জিয়াউর রহমানের হত্যা- এসব ঘটনার সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধারা কমবেশি জড়িত ছিলেন। তবে যাঁরা জড়িত ছিলেন তাঁদের কারও কারও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ ঘটেছিল একেবারে শেষ পর্যায়ে। কর্নেল ফারুক, কর্নেল রশীদ- এঁরা, আমি ঠিক জানি না, সত্যি সত্যি মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন, না পাকিস্তানের কোন পরিকল্পনা কার্যকর করার জন্য গিয়েছিলেন যুদ্ধের শেষদিকে। যুদ্ধ শেষ হয়ে যাচ্ছে এঁরা বোঝেননি, কিন্তু এঁরা মুক্তিযুদ্ধে তখন যোগ দিয়েছিলেন, হয়তো এঁদের অন্য কোন পরিকল্পনা ছিল। নইলে ১৫ আগস্ট যেভাবে ‘জয় বাংলা’ এই রণধ্বনি বাদ দিয়ে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ বলা হয়, রেডিও বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করা হয় বাংলাদেশ বেতারের বদলে, এসব থেকে মনে হয় যে এঁদের ভেতরে পাকিস্তানের ভাবাদর্শ খুব প্রবলভাবে কাজ করেছে। অতএব মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ সত্ত্বেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এঁরা ধারণ করেননি বলেই আমার বিশ্বাস। সেকথা জিয়াউর রহমান সম্পর্কেও আমি খানিকটা প্রয়োগ করব। জিয়াউর রহমান বড় মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন সন্দেহ নেই। মুক্তিযুদ্ধের সূচনায় তিনি যে-ঘোষণা দিয়েছিলেন সেটিও আমাদের উদীপ্ত করেছিল। কিন্তু রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধের সবকিছুর বিরুদ্ধে তিনি গিয়েছিলেন। যে শাহ আজিজুর রহমান শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বাংলাদেশ-প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন, জাতিসংঘে পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন, জিয়াউর রহমান তাঁকে ডেকে প্রধানমন্ত্রী করলেন। স্বাধীনতাবিরোধীদের তিনি পুনঃপ্রতিষ্ঠা দিলেন এবং মুক্তিযুদ্ধকালের ঘোষিত রাষ্ট্রীয় নীতি এক এক করে ভেঙে ফেলতে লাগলেন। সুতরাং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তাঁর মধ্যে খুঁজতে যাওয়া বৃথা হবে। আর জিয়া-হত্যার সময়ে যে মুক্তিযোদ্ধাদের সংশ্লিষ্টতা, এটা কতটা তাঁদের ব্যক্তিগত কারণে, কতটা বিভিন্ন ক্ষোভ থেকে- সেটা তো আজও ভালোভাবে বোঝা যায়নি। এটুকু মনে হয়েছে যে, কিছু মুক্তিযোদ্ধাকে কেউ কাজে ব্যবহার করেছিলেন। তখন জিয়াউর রহমান এবং জেনারেল মনজুর দুজনকেই একসঙ্গে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়া হল। এই দ্বন্দ্ব-সংঘাত এ কারণেই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আদর্শগত নয়। তবে আদর্শের ছাপ হয়তো এই দেখা যাবে যে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বদলে পাকিস্তানি ভাবাদর্শ প্রতিষ্ঠিত করার একটি চেষ্টা অনেকের মধ্যে ছিল। আবার খালেদ মোশাররফ যে প্রতিরোধ করলেন সেখানে হয়তো বঙ্গবন্ধুর প্রতি, মুক্তিযুদ্ধের প্রতি তাঁর এক ধরনের আবেগও কাজ করছিল। সেটা তো খুবই স্বল্পস্থায়ী হয়েছিল। পরবর্তীকালে অনেক অভ্যুত্থানের চেষ্টা হয়েছে। সেসব অভ্যুত্থান সম্পর্কে আমরা এত কম জানি যে সে-সম্পর্কে কিছু বলা খুব মুশকিল। এমনকি ১৯৯৬-তে জেনারেল নাসিম যে এক ধরনের বিদ্রোহ করেছিলেন, তার পেছনেও আদর্শগত কারণ অতটা ছিল না যতটা ছিল সেনাবাহিনীর তিনি যে-ধরনের বিন্যাস করতে চেয়েছিলেন, তা নিয়ে সংঘাত। কাজেই খানিকটা ভাবাদর্শ ছিল, কিন্তু অনেকখানি ব্যক্তিগত ক্ষোভ-ক্রোধ-জিঘাংসা এর পেছনে কাজ করেছিল।
যুগান্তর : আপনি একটি লেখায় বলেছিলেন পাকিস্তান আমলে বাংলাদেশের সমাজটা সেক্যুলার ছিল, রাষ্ট্র ছিল ধর্মতান্ত্রিক। আর এখন রাষ্ট্র সেক্যুলার কিন্তু সমাজটা ধর্মতান্ত্রিক হয়ে পড়েছে। এখন আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
আনিসুজ্জামান : হ্যাঁ, আমার এখনও মনে হয় যে, আমাদের সমাজ পাকিস্তান আমলের তুলনায় বাংলাদেশ আমলে অনেকটা ধর্মপ্রবণ হয়ে গেছে। ফলে এখানে ধর্মের নাম করে অনেক কিছু করা যাচ্ছে। আমরা এখনও দেখছি যে, আমাদের আইনমন্ত্রী বলছেন, আমরা এমন কোন আইন করব না যা মানুষের ধর্মানুভূতিকে আঘাত দেয়। কিন্তু আমরা পাকিস্তান আমল থেকে অনেক কিছু দাবি করে এসেছি, যা হয়তো ধর্মের বিধানের সঙ্গে সম্পূর্ণ সঙ্গতিপূর্ণ নয়, হওয়া সম্ভব নয়। এই যে আন্তর্জাতিক সিডও সনদ- এরও কোন কোন ধারায় বাংলাদেশ সরকার সই করেনি ধর্মানুভূতির কথা বলে। কিন্তু আমরা তো মনে করি, এটি খুবই গ্রহণযোগ্য একটি ব্যাপার। নারীকে যদি মর্যাদা দিতে হয় তাহলে ধর্মের বিধানের বাইরে তা করতে হবে, ধর্মের বিধানকে অতিক্রম করে করতে হবে। এটা মেনে নিতে হবে আমাদের। আমরা আজ পর্যন্ত একটা অভিন্ন দেওয়ানি বা পারিবারিক আইন চালু করতে পারলাম না পৃথক পৃথক ধর্মীয় আইন গ্রহণ করেছি বলে, অথচ ফৌজদারি আইনের ক্ষেত্রে আমরা অভিন্ন আইন চালু রাখতে পেরেছি। সেখানে তো আমরা ধর্মীয় আইনের সঙ্গে সঙ্গতি রাখার কথা চিন্তা করিনি। তাহলে সব ক্ষেত্রে যে আমরা ধর্মানুভূতির কথা বলছি তা নয়। আমরা পারিবারিক আইনের ক্ষেত্রে সেটা বলছি। আইয়ুব খান যখন পাকিস্তানে মুসলিম পারিবারিক আইন করেছিলেন, তখন কিন্তু তিনি ধর্মীয় বিধান অগ্রাহ্য করেই করেছিলেন। এখন এ ধরনের কাজ করা অনেক বেশি কঠিন হয়ে যাচ্ছে। এই অর্থেই আমি বলি যে, আমাদের সমাজ পাকিস্তান আমলে যত ধর্মনিরপেক্ষ ছিল, বাংলাদেশ আমলে সেই তুলনায় অনেক বেশি ধর্মপ্রবণ হয়ে গেছে। হয়তো আমরা ধর্মরাষ্ট্র চাইছি না, কিন্তু আমরা বেশি করে ধর্মীয় আইন-কানুনের কথা বলছি- যা আমাদের পেছনের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।
যুগান্তর : তিন খণ্ডে লেখা আপনার আত্মজীবনী ‘কাল নিরবধি’ ‘আমার একাত্তর’ এবং ‘বিপুলা পৃথিবী’ - পাঠকনন্দিত হয়েছে। তারপরও কারো কারো অভিযোগ, আপনি সেই সময়ের অপ্রিয় কথা এড়িয়ে গেছেন।
আনিসুজ্জামান : কাল নিরবধি বেরিয়েছে, আমার একাত্তর বেরিয়েছে, বিপুলা পৃথিবী এখনও লিখছি। কারও কারও ভালো লেগেছে। শিবনারায়ণ রায়ই প্রথম বলেছিলেন, আমি অপ্রিয় কথা এড়িয়ে গেছি। কেননা তাঁর মনে হয়েছিল, আমি কিছু কিছু বিষয়ে আরও বিস্তারিত লিখতে পারতাম। বিভিন্ন জন আমাকে মুখেই বলেছিলেন যে, অধ্যাপক আবদুল হাইয়ের মৃত্যুর ব্যাপারে আমি কেন আরও বিস্তারিত লিখিনি। কিছু না-লেখার কারণও থাকে। শরৎচন্দ্রের একটা উদ্ধৃতি দিয়েছিলাম কাল নিরবধিতে। শরৎচন্দ্র বলেছেন, সব কথাই যে লিখতে হবে তা নয়। অনেক কারণে লিখিনি, কেননা কোন কোন মানুষের মনে আঘাত না লাগে, আমি এটা চেয়েছিলাম। আমার এ-সিদ্ধান্ত নিয়ে তর্ক হতে পারে। আমি যাঁদের শ্রদ্ধা করেছি, তাঁদের ত্রুটির কথা কিছুই যে একেবারে বলিনি তা নয়, কিন্তু সবসময় বলিনি, সবটা বলিনি। এর একটা কারণ, তাঁদের স্ত্রী বা পরিবার দুঃখ পাবে এই চিন্তা। তবে সত্য গোপন করিনি। যা লিখিনি, আমার মনে হয়েছিল, ওই মুহূর্তে এটা লেখার প্রয়োজন নেই।
যুগান্তর : বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের বাংলা সাহিত্যের ভাষাশৈলীতে বড় কোন পার্থক্য লক্ষ্য করেন কি?
আনিসুজ্জামান : বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের বাংলা সাহিত্যের ভাষাশৈলীতে বড় পার্থক্য লক্ষ্য করি কি না? হ্যাঁ এবং না- দু’রকমই এর উত্তর। আমরা যে প্রমিত বাংলাভাষা ব্যবহার করছি সেখানে পার্থক্য কম। পার্থক্য হচ্ছে যে, আমাদের এখানে ‘সঙ্গে’র বদলে ‘সাথে’, ‘থেকে’র বদলে ‘হতে’- এসব পদ্যগন্ধী শব্দ ব্যবহারের প্রবণতা বেশি, পশ্চিমবঙ্গে কম। আমরা কিছু কিছু আরবি, ফারসি শব্দ বেশি ব্যবহার করি, পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে এগুলোর ব্যবহার কম। আবার ওঁরাও যেসব আরবি, ফারসি শব্দ ব্যবহার করেন আমরা হয়তো সবসময়ে তা ব্যবহার করি না। কিন্তু একটা বড় পার্থক্য এখন বোধহয় দেখা যাচ্ছে। আমাদের অনেক লেখক বাংলাদেশের জন্য একটা স্বতন্ত্র ভাষারীতি তৈরি করতে চাইছেন। এটি একটি বড় বিতর্কের বিষয়, এত সংক্ষেপে বলা যাবে না। আমি একটা পুরনো কথা বলি- বিংশ শতাব্দীর একেবারে গোড়ায়, ঠিক বঙ্গভঙ্গের আগে আগে, বঙ্গীয় সরকার শিক্ষাক্ষেত্রে একটা নতুন কাজ করতে চেয়েছিল এই ভাষারীতি নিয়ে। তারা বলল যে, বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন ভাষা প্রচলিত, আমরা যে-ভাষায় পাঠ্যবই লিখি তা সবার ব্যবহৃত ভাষা নয়। সেজন্য তারা পরিকল্পনা করল যে, পূর্ব পশ্চিম উত্তর দক্ষিণের চারটি উপভাষা একটু পরিমার্জিত করে এতে পাঠ্যবই লেখা হবে বাংলায়। মূল বই লেখা হবে ইংরেজিতে, তারপর বাংলার চারটি পৃথক উপভাষায় অনুবাদ করে পাঠ্যবই লেখা হবে, তাদের মতে, তা জনগণের মুখের ভাষার কাছাকাছি হবে। তখনই এর খুব বড়রকম প্রতিবাদ হয়েছিল, রবীন্দ্রনাথ ‘ভাষাবিচ্ছেদ’ নামে একটা প্রবন্ধ লিখেছিলেন। কাজেই এ-তর্কটা খুব পুরনো যে আমাদের মুখের ভাষা থেকে প্রমিত ভাষা আলাদা। কেন প্রমিত ভাষা আলাদা হয়, এটা আমরা সবাই জানি- মূলত যোগাযোগের সুবিধার জন্য। ভাববিনিময়ের সুবিধার জন্য একটা প্রমিত ভাষা দরকার। পশ্চিমবঙ্গ থেকে আমাদের প্রমিত ভাষা আলাদা হতে হবে, এটা পাকিস্তান আমলে প্রস্তাব করা হয়েছিল। আবুল মনসুর আহমদের কথা আমরা বিশেষ করে বলতে পারি। পরবর্তীকালে প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁ, অধ্যাপক আবুল কাসেম- এঁরাও এই চেষ্টা করেছিলেন। তখন আমরা সকলে মনে করেছিলাম যে, পাকিস্তান সরকার যে আমাদের বাংলা ভাষাকে আলাদা করতে চায় পশ্চিমবঙ্গের ভাষা থেকে, এঁদের কাজ তার থেকে খুব পৃথক নয়। সেজন্য এক ধরনের প্রতিবাদও উঠেছিল। কিন্তু এখন আমাদের তরুণ লেখকেরা বাংলাদেশের স্বাতন্ত্র্যবোধ থেকে এ-কাজটি করতে চাইছে - বাংলাদেশের জন্য আলাদা একটা প্রমিত ভাষা। বাংলাদেশের প্রমিত ভাষা আলাদা করলে আমরা বাংলা সাহিত্যের বিশাল ঐতিহ্য থেকে দূরে চলে যাব। মানে বিদ্যাসাগরের বাংলা, বঙ্কিমচন্দ্রের বাংলা, রবীন্দ্রনাথের বাংলা, শরৎচন্দ্রের বাংলা, প্রমথ চৌধুরীর বাংলা, কাজী নজরুলের বাংলা- এগুলো তো প্রমিত বাংলাই। সেই প্রমিত বাংলাকে যদি আমাদের বাংলা না বলি তাহলে আমাদের বলতে হবে যে এঁরা একটা ভিন্ন ভাষায় লিখেছেন।
বাংলা ভাষার ইংরেজি নাম কী হবে, ‘বেঙ্গলি’ না ‘বাংলা’? আমরা খুব উল্লাসের সঙ্গে ‘বাংলা’ বলছি। দশ বছর পরে লোকের ধারণা হবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন বেঙ্গলিতে আর শামসুর রাহমান লিখেছেন বাংলায়। এই ভাগটা চলে আসবে। এটি আমাদের জন্যে কল্যাণকর হবে বলে আমি মনে করি না।
এখন আমরা দেখছি যে আমাদের কোন কোন লেখক সম্পূর্ণ কবিতা, সম্পূর্ণ গল্প, এমনকি সম্পূর্ণ উপন্যাসও আঞ্চলিক ভাষায় লিখছেন। আমরা মনে রাখব যে জসীমউদ্দীন- যিনি সর্বাধিক আঞ্চলিক শব্দ ব্যবহার করেছেন- তাঁর কবিতারও বর্ণনার অংশ কিন্তু আঞ্চলিক ভাষায় লেখা নয়। পরীক্ষা হিসেবে অনেক কিছু চলতে পারে। হাসান আজিজুল হক তো একটি উপন্যাস লিখেছেন- ‘আগুনপাখি’ - বাঁকুড়া-বীরভূম অঞ্চলের উপভাষায়। কিন্তু তিনি নিশ্চয়ই তাঁর সমস্ত রচনাকর্ম এই উপভাষায় লিখবেন না। কোন কোন ক্ষেত্রে এটা দরকার হবে, কোন কোন ক্ষেত্রে এটা পরীক্ষা হিসেবে উল্লেখযোগ্য হয়ে থাকবে, তা সর্বব্যাপ্ত হবে না। আমার কিন্তু মনে হয় না আমাদের এই স্বাতন্ত্র্য-সন্ধান শেষ পর্যন্ত কল্যাণকর হবে।
যুগান্তর : বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার মান অনেক নেমে গেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এ জন্য অনেকে ’৭৩-এর বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ এবং রাজনৈতিক হস্তক্ষেপকে দায়ী করেন। আপনার মন্তব্য কী?
আনিসুজ্জামান : বিশ্ববিদ্যালয়-পর্যায়ের শিক্ষার মান নেমে গেছে, এ কথার দুটো দিক আছে। একটা হচ্ছে এ-অভিযোগটা সব সময়ে করা হয়। আমরা যখন ছাত্র ছিলাম, আমাদের শিক্ষকরা বলতেন যে, আমাদের লেখাপড়ার মান খারাপ হয়ে গেছে। আমরা আমাদের ছাত্রদের সেকথা বলেছি। অর্থাৎ বলা যায় যে, প্রায় প্রত্যেক যুগ তার পরবর্তী যুগের শিক্ষার মান সম্পর্কে নানা সন্দেহ ও আপত্তি প্রকাশ করেছে। এর একটা কারণ হচ্ছে যে, শিক্ষা ক্রমশ অধিক মানুষের কাছে পৌঁছাচ্ছে এবং যে-কোন জিনিসের সাধারণ ধর্ম এই যে, পরিমাণ যত বাড়ে, গুণের দিক কিছুটা কমে। তবে আমরা তো পরিমাণ বাড়াতে বদ্ধপরিকর। সেটা বজায় রেখে গুণ কীভাবে রক্ষা করা যায়, এ চিন্তা আমাদের করতে হবে। আমাদের ভাষার প্রশ্নে একটা বিশৃঙ্খলা আছে। আমরা এখনও স্থিরনিশ্চয় হতে পারিনি যে ভাষার মাধ্যম হিসেবে বাংলা চালু করব কি না। এর ফলে একধরনের অস্বস্তি এবং অস্থিরতার মধ্যে আমরা আছি। অন্যপক্ষে আমাদের ভাষাশিক্ষা খুব ত্র“টিপূর্ণ। আমরা বাংলা বা ইংরেজি কোনটাই ভালোভাবে শিখছি না। তার ফল খারাপ হচ্ছে। স্কুল-কলেজের সংখ্যা বাড়ছে, উপযুক্ত শিক্ষক পাওয়া দুর্লভ হয়ে যাচ্ছে। ফলে শিক্ষক যদি যোগ্য না হন তার ছাত্ররা যোগ্য হবে- এরকম প্রত্যাশা করা ঠিক হবে না। এ-অবস্থাটা, আমার মনে হয়, আরও কিছুকাল চলবে। কিন্তু তারপরে গুণগত পরিবর্তন হবে, আমরা ভালোর দিকে যাব।
বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কথা বলছ? বিশ্ববিদ্যালয়-প্রশাসন তার সমস্ত গণতান্ত্রিকতা সত্ত্বেও এখনো মূলত সরকারের দ্বারা প্রভাবান্বিত। আমরা দেখেছি, বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ হওয়ার পর সব বিশ্ববিদ্যালয়ে এ পর্যন্ত যত উপাচার্য নিযুক্ত হয়েছেন তাঁদের ৯০ ভাগই সরকার কর্তৃক নিযুক্ত হয়েছেন আগে। তাঁরা নির্বাচিত হয়েছেন পরে, কিন্তু আগে সরকার তাঁদের ক্ষমতায় বসিয়ে দিয়েছে। ক্ষমতায় বসে তাঁদের পক্ষে অনেক কিছু করা সম্ভবপর হয়েছে, নির্বাচিত হওয়াও কিছু কঠিন হয়নি। এঁরা অনেকে - সকলে নয়, সকলে নয়, একথা আমি বারবার বলব- এঁরা অনেকেই রাজনৈতিক বিবেচনার দ্বারা পরিচালিত হয়ে অনেক ধরনের নিয়োগ দিয়েছেন- বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে, শিক্ষকতার ক্ষেত্রে। শিক্ষক-নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনা-প্রয়োগ নিশ্চয়ই ক্ষতিকর হয়েছে। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ নষ্ট হয়েছে, শিক্ষাদানের মান নেমে গেছে। তবে এটিই একমাত্র কারণ নয়। শিক্ষার মান নেমে যাওয়ার কারণ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে দেখতে হবে, শিক্ষাদান প্রণালীর মধ্যে খুঁজতে হবে এবং শিক্ষার যে-অবকাঠামো সেটার মধ্যেও দেখতে হবে। এখনো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো দেশের এক নম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের যে-গ্রন্থাগার, সেটি গবেষণার জন্য যথেষ্ট অনুকূল নয়। এসব ক্ষেত্রে মনোযোগ না দিলে আমরা এগুতে পারব না।
যুগান্তর : আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম লক্ষ্য ছিল গণতন্ত্র ও শোষণমুক্তি। স্বাধীনতার ৩৮ বছর পর এই লক্ষ্য অর্জন কতটুকু সম্ভব হয়েছে?
আনিসুজ্জামান : আমাদের মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য ছিল গণতন্ত্র ও শোষণমুক্তি- সে-লক্ষ্য অর্জিত হয়নি।
দেশে এই যে একাধিকবার। সামরিক হস্তক্ষেপ, গণতন্ত্রের জন্য এটা ভালো হয়নি। তবে ২০০৭-এর সামরিক হস্তক্ষেপ বোধহয় একটা সাজানো নির্বাচনের হাত থেকে আমাদের বাঁচিয়েছে। গণতন্ত্র, তার প্রক্রিয়া ও ধারাবাহিকতা মূলত বিঘিœত হয়েছে সামরিক শাসনের ফলে। ওই যে আমি বলছিলাম, ঘটনা-দুর্ঘটনার কুশীলবরা সবসময় মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না। জেনারেল এরশাদের শাসনকালের কথা যদি মনে করি, তাহলে তা দেখতে পাব। তাঁর যে প্রায় দশ বছরের শাসন, সেটা তো মুক্তিযোদ্ধার শাসন ছিল না। সামরিক হস্তক্ষেপ গণতন্ত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। তাছাড়া, আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণতন্ত্রের চর্চার অভাব আছে। সেটি না হওয়ায় তাঁরা যখন ক্ষমতায় বসেন তখন তাঁদের আচরণ সবসময়ে গণতান্ত্রিক হয় না।
শোষণমুক্তির ব্যাপারটা প্রায় ভুলেই যাওয়া হয়েছে। আমরা ধরেই রেখেছি যে, এখন কম শোষণ হলেই চলবে। সেটাও খুব যে সফল হচ্ছে তা নয়। ফলে হয়তো এভাবে প্রাথমিক পুঁজি গড়ে উঠছে, কিন্তু সে-পুঁজি যদি শিল্পে বেশি করে বিনিয়োগ করা যেত, তাহলে দেশের একটা লাভ হতো। আমাদের এখানে যেনতেন প্রকারে যে-পুঁজি গড়ে উঠছে, সে-পুঁজির অনেকখানিই বিদেশে পাচার হয়ে যায় অথবা দৈনন্দিন ভোগের ক্ষেত্রে নিযুক্ত হয়। তা দিয়ে রাষ্ট্রের বা সমাজের খুব একটা লাভ হয় না।
যুগান্তর : সম্প্রতি জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটি শিক্ষা কাঠামো পুনর্বিন্যাস ও সংস্কারে বেশ কিছু সুপারিশ করেছে। এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য জানতে চাই।
আনিসুজ্জামান : আমি জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির রিপোর্ট এখনো দেখিনি। খবরের কাগজে যে-সারমর্ম বেরিয়েছে তা থেকে সবটা বোঝা যায় না। মনে হচ্ছে যে, তাঁরা ইংরেজি মাধ্যম স্কুল, মাদ্রাসা ব্যবস্থা এবং সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থা তিনটিই পাশাপাশি রাখতে চেয়েছেন। তিনটির মধ্যেই সংস্কার আনছেন। অর্থাৎ অভিন্ন শিক্ষাব্যবস্থার সুপারিশ হয়তো তাঁরা করেননি। তবে আমাদের সংবিধানে অভিন্ন শিক্ষাব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে। আর বেশকিছু সুপারিশ আছে যেগুলো আমার মনে হয়েছে ভালোই। প্রাথমিক শিক্ষার মেয়াদ বাড়ানো, বৃত্তিমুখী শিক্ষার প্রবর্তন করা, ছাত্রবৃত্তি বাড়ানো বা বিনা বেতনে শিক্ষার ব্যবস্থা করা- এগুলো ভালো পদক্ষেপ। মাদ্রাসা শিক্ষার মধ্যেও কিছু সংস্কারের কথা বলা হয়েছে। তবে গোটা রিপোর্ট পড়লেই হয়তো এ সম্পর্কে ঠিকমতো বলা যাবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন