সোমবার, ১৯ অক্টোবর, ২০০৯

কবিতা হলো ব্যক্তির বিরুদ্ধে সক্রিয়

কবিতা হলো ব্যক্তির বিরুদ্ধে সক্রিয়
অন্যসব ক্ষমতা মোকাবেলার শক্তি চার্লস সিমিক

মার্ক ফোর্ড : আপনার বাল্যকাল কেটেছে বেলগ্রেডে। বলবেন কি দিনগুলো তখন কেমন ছিল? আপনার বাবা-মা সম্পর্কেও জানতে চাই। তারা কেমন ছিলেন, কী করে তাদের সাক্ষাৎ হয় এসব আর কী।
চার্লস সিমিক : বাবা ছিলেন অভিজাত বংশোদ্ভূত। তার পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বাবাই প্রথম বিশ^বিদ্যালয়ে পড়তে যান। অন্যদিকে মা ছিলেন বেলগ্রেডের ঐতিহ্যবাহী পরিবার থেকে আসা। মায়ের পূর্বপুরুষরা অন্তত ২০০ বছর ধরে বেলগ্রেডে বসবাস করছিলেন। উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকেও তাদের প্রাচুর্য ছিল, পরে সর্বস্বান্ত হন। আমার নানা ছিলেন সেনাবাহিনীর লোক। অবসরে যাওয়ার পর তিনি জুয়া খেলে সব অর্থবিত্ত ছাইয়ের মতো উড়িয়ে দেন।
আপনার পরিবারের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা একত্রিত হলো কী করে?
চার্লস সিমিক : সত্যি কথা বলতে কী, তারা পরস্পরকে বরং ঘৃণাই করতেন। বাবার আত্মীয়দের পছন্দ করতেন না মা। চোখ পাকিয়ে, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতেন। এ কাজে বাবার জ্ঞাতিরা ছিলেন আরো সরাসরি। তারা আকণ্ঠ পান করতেন, হৈ-হল্লার মাস্টার ছিলেন একেকজন। আমার পরিচয় তাদের সঙ্গেই মিলে যায় বেশি।
মায়ের পরিবার ছিল অনেকটা ভীতু টাইপের, কেমন যেন অপ্রকৃতস্থ, গূঢ়চারী। তাদের সব শৌর্যবীর্য, বিত্ত-বৈভব হারিয়ে গেছে, অস্তিত্ব সংকটে সদা আতঙ্কিত। লোকগুলোর মধ্যে রসবোধ বলে কিছু ছিল না। সব বিষয়ই তাদের কাছে ঠেকতো রসকসহীন। বাবার আত্মীয়রা ছিলেন শিল্প-সাহিত্যের বিশেষ অনুরাগী, সদা প্রফুল্ল, খাবার টেবিলে জড়ো হলে তাদের মুখে খই ফুটতো। তাদের সঙ্গ আমার মায়ের কেমন লাগতো আশা করি কল্পনা করতে বেগ পেতে হবে না।
নাৎসি ও কমিউনিস্ট মতবাদের ™^›™^ সম্পর্কে ওই বয়সে কতটা সজাগ ছিলেন?
চার্লস সিমিক : যথার্থ। তাত্ত্বিক বিবেচনায় নয়, আমি সচেতন ছিলাম এই অর্থে যে, আমার চারপাশের সবাই তখন প্রায় সবসময়ই রাজনীতি নিয়ে তোলপাড় করতেন। বাবার দরদ ছিল রাজা-রানীর পক্ষে।
প্রথম বিশ^যুদ্ধে নানা ছিলেন শীর্ষ সেনা কর্মকর্তার দায়িত্বে। এই সেই ভদ্রলোকÑ যিনি তার পারিবারিক ধনসম্পদ জুয়া খেলে শেষ করেনÑ বিশ^াস করতেন, আমাদের যুদ্ধ থেকে তফাতে থাকাই উচিত ছিল। যতক্ষণ না মিত্ররা ইয়াল্টা কনফারেন্সের মতো আমাদের মুক্তির সনদ নিয়ে হাজির হয়।
মা সারাজীবন বিশ^াস করতেনÑ তিনি তার বিশ^াসের ঢোল প্রকাশ্যে পিটাতেন সব সময়Ñ যে সার্বীয়রা মূঢ়। রাজনৈতিক বুদ্ধিশুদ্ধি তাদের নেই বললেই চলে। অতএব তারা যে সিদ্ধান্তই নিক না কেন ভুল হবে, তাতে মা শতভাগ নিশ্চিত।
বাবার পরিবারের দিক থেকে, অপেক্ষাকৃত তরুণরা সবাই ছিলেন বামপন্থী, কমিউনিস্টদের প্রতি অনুরক্ত। তারা বলতেন, আমাদের মুক্ত করতে রাশিয়ার বীর সেনানিরা আসছে। মায়ের পরিবারের মতো লোকদের কচুকাটা করবে। একবার ভেবে দেখলেই পরিষ্কার হবে, এরপর অনেক চিৎকার-চেচামেচি হতো, গড়াতো অশ্রু, দড়াম করে দরোজা বন্ধের আওয়াজ শোনা যেত।
বছরগুলো আপনার জন্য কতটা দুঃসহ ছিল?
চার্লস সিমিক : আমাদের পরিবারে একটা গল্প চালু ছিল। ১৯৪৫ সালের ৯ মে বিশ^যুদ্ধ শেষ হয়, দিনটি ছিল আমার জš§ দিন। আমি সেদিন রাস্তায় খেলছিলাম। যাহোক, আমাদের অ্যাপার্টমেন্টে মা ও তার প্রতিবেশীরা রেডিও শুনছিলেন। একটু পানি পান করতে সেখানে ঢুকলাম, তারা সমস্বরে চিৎকার করে উঠলো, যুদ্ধ শেষ। তাদের মুখ কেমন পা-ুর মনে হলো। আমি বললাম, ‘মজা করার দিন ফুরালো!’ যুদ্ধের সময় বাবাদের খবরদারি ছিল না। বড়রা তাদের জীবন বাঁচাতে ছিল সদা ব্যস্ত। সেই সুযোগে শিশুরা ইচ্ছে মতো যেদিক খুশি ছুটে বেড়াতে পারতো। কয়েক বছর আগে, দুটি বই পাই, যেগুলো ঠাসা ছিল বসনিয়ার যুদ্ধের ছবিতে। ছবির মুখগুলো কী অসুখী। সারজেভোর কয়েকটি শিশুর ছবি চোখে পড়লো, ওদের চোখেমুখে হাসির স্ফুরণ। যেন শিশুরা বলছেÑ এটাই কি মহৎ নয়, আর ওইটা ভয়ানক! হাসিখুশি মুখগুলো দেখে মনে হলো, এগুলো আমি ও আমার বন্ধুদের মুখচ্ছবি।
যুদ্ধ শেষে আমাদের মজা কিন্তু ফুরোয়নি, চলতেই থাকে। হ্যাঁ, আমাদের দরিদ্রতা ছিল, ছিল কমিউনিস্ট অনুশাসন, কিছু মার্কিন চলচ্চিত্রও ছিল, মার্কিন সেনাদের রেডিও থেকে প্রচার করা জাজ সংগীত, আর ছিল রাস্তাজুড়ে দুরন্ত শিশুর দঙ্গল। আমরা তখন থাকতাম বেলগ্রেডের কেন্দ্রবিন্দুতে, প্রতিবেশী বেষ্টিত। ফলে আমাদের দিনগুলো বিষণœতায় ভরে ওঠেনি, বরং আনন্দে কেটেছে। ইশকুলে প্রত্যেকটি ব্ল্যাকবোর্ডের ওপরে টানানো থাকতো টিটো, স্ট্যালিন ও লেনিনের ছবি। ছবিগুলো আমাদের স্কুলের পাঠের দিকে তাকিয়ে থাকতো।
স্কুল টিচাররা বলতেন, ছবির লোকগুলো খুবই জ্ঞানী, তারা সারা দুনিয়ার তোমাদের মতো শিশুদের জন্য আনন্দ বয়ে আনছেন। আমি পড়ি মুশকিলে। কার কথা বিশ^াস করি? বাড়ির লোকেরা বলেন, অন্য কথা। তারা বলেন, ছবির তিন লোক বদের হাড্ডি, তাদের জন্যই তোমার বাবাকে পরিবার পরিজন ছেড়ে দূরে দূরে থাকতে হচ্ছে।
আপনি ফ্রান্সে পৌঁছলে, ফরাসি কর্তৃপক্ষ আপনাকে উ™^াস্তু শ্রেণীতে বিবেচনা করে। বাস্তুচ্যুতি, নির্বাসনের একটি নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল?
চার্লস সিমিক : হ্যাঁ, আমি মনে করি তা ছিল। ফরাসিদের আমার পছন্দ হয়ে যায়; কিন্তু ফরাসিরা কী করতো, আমাদের অপমান করে মজা পেত। কয়েক মাস পর পর আমাদের পারমিট নবায়ন করতে হতো। নবায়ন করতে গিয়ে দেখা যেত ঘণ্টার পর ঘণ্টা লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর কর্তৃপক্ষ বললো, তোমার ওই কাগজটা কোথায়, ধরা যাক আমার নানীর মায়ের জš§ সনদ নেই। যুগোসøাভিয়া থেকে অনেক চেষ্টা করে তা জোটানো গেল, তখন হয়তো কর্তৃপক্ষ বলে বসলো, ওইটার আদৌ দরকার ছিল না। আমরা এক বছর প্যারিসের একটা হোটেলে ছিলাম। তখন বাবা ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে। তার পাঠানো অর্থে আমাদের খাওয়া খরচ চলতো। আমরা জানতাম না ভিসা পেতে আর কতকাল তীর্থের কাকের মতো তাকিয়ে থাকতে হবে। ওই সময় আমরা প্যারিসের পথে পায়ে হেঁটে চক্কর দিতাম। ছবি দেখতাম আর শিখতাম ইংরেজি। মা কিনে আনতেন ‘লাইফ’, ‘লুক’ ধরনের ম্যাগাজিন। আমার ভাই আর আমি ম্যাগাজিনের পাতা উল্টেপাল্টে দেখতাম স্নানের পোশাক পরা নারী মডেল, বাহারি রঙের নতুন মডেলের গাড়ি আর খাবার ভর্তি রেফ্রিজারেটরের ছবি। এ কাহিনী করতাম প্যারিসের স্কুলে যাওয়ার দিনগুলোতে। ওই সময়ই কিন্তু প্রথম মজি কবিতায়। ইশকুলে যা হয় আর কীÑ বোদলেয়ার, ভার্লিন, র‌্যাবোর কবিতা মুখস্থ করো, ক্লাস ভর্তি ছেলেমেয়ে আবৃত্তি করে শোনাও। ভেবে দেখ কী দশা আমার হতো তখন। ফরাসি উচ্চারণ কতটা কঠিন ছিল। তারপরও কবিতাগুলো পড়তে পড়তে আমার চোখে জল এসে যেতো।
আপনি প্রায়ই বলেন, নিউইয়র্ক আপনার পছন্দের শহরÑ প্রথম দর্শনেই কী শহরটির প্রেমে পড়ে যান?
চার্লস সিমিক : ঠিক তাই। নিউইয়র্কে প্রথম পা রাখি ১৯৫৪ সালে। তখন ইউরোপ ছিল একেবারে ধূসর আর নিউইয়র্ক ঝকমারিÑ বাহারি রঙের ছড়াছড়ি, চোখ তাতানো বিজ্ঞাপন, হলুদ ট্যাক্সিক্যাব। তখন ফ্রান্স থেকে জাহাজে চড়ে নিউইয়র্ক আসতে সময় লাগতো মাত্র ৫ দিন। কিন্তু তখন মনে হতো বহু দূরের পথ। আজকাল চীনকে যতটা দূরের ঠেকে। নিউইয়র্ককে তখন মনে হতো, কার্নিভাল উৎসবেÑ যেখানে রয়েছে দাড়ি লাগানো রমণী, তলোয়ারবাজ কিংবা সাপুড়ের পোশাক পরা লোকজন আর জাদুকরেরাÑ সুসজ্জিত।
দশ বছর পর আপনার বাবার সঙ্গে দেখা হলো, তখন ক্যামন অনুভূতির জš§ হয় আপনার মনে?
চার্লস সিমিক : অবিশ^াস্য। বাবা আর দশজনের মতো ছিলেন না। তথাকথিত পিতা-পুত্রের সম্পর্কে তার আস্থা ছিল না, যদিও ব্যাপার মোটেও অতটা সহজ ছিল না। তিনি আমাদের নিয়ে বাইরে বেরুতে পছন্দ করতেন, যেতেন বারে, রেস্তোরাঁয়, জাজ ক্লাবে। নিউইয়র্কে আমার প্রথম জাজ ক্লাবে যাওয়া বাবার সঙ্গেই। বাবা ভালো ভালো অনেক গল্প জানতেন। তাই তার সঙ্গে আলাপ করে খুব মজা পেতাম, সবসময়ই দারুণ লাগতো। উপরি পাওনা হতো, বাবার পাঠ। ইতিহাস, সাহিত্য, রাজনীতি, প্রাচ্যের ধর্মতত্ত্ব, দর্শন, মিস্টিসিজম, রহস্য গল্প, পত্রিকায় খেলার পাতা এমনকি গসিপের কলামে তার উৎসাহে কমতি ছিল না, বিপুল আয়োজনে মনোনিবেশ করতে পারতেন তিনি, পড়তেন সবকিছুই। তার আরেকটা গুণ ছিল। তিনি শুনতেও পছন্দ করতেন। কেউ কিছু বললে বাবা আগ্রহ ভরে শুনতেন, কাজেই তার সঙ্গ সহজ হয়ে উঠতো, ভালো লাগতো। অনেক বছর পর আমার কবি বন্ধু জেমস ট্যাইট এবং মার্ক স্ট্রান্ডের সঙ্গে বাবার সাক্ষাৎ হওয়ার পর আমার বন্ধুরা নিশ্চিত করে, বাবার সঙ্গে কথা বলে তাদের ভালো লেগেছে। তারাও সাক্ষ্য দিল বাবার সঙ্গ উপভোগ্য।
কিন্তু আপনার মায়ের সঙ্গে তার খুব একটা বনিবনা হয়নি, তাদের ভালো কাটেনি?
চার্লস সিমিক : না। তাদের পুনরোকেত্রীকরণের দুই বছর যেতে না যেতেই ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। দশ বছরের দীর্ঘ বিচ্ছেদের পর তাদের দেখা। ছোটবেলা থেকেই আমি দেখে এসেছি, তাদের মধ্যে কোনো ধরনের সাযুজ্য ছিল না। কিচ্ছু না। দুজন ছিলেন দুই ভুবনের বাসিন্দা। মা ছিলেন অবিশ^াস্য রকমের সাহসী ও সৎ ব্যক্তি। তার রাজনৈতিক দৃৃষ্টিভঙ্গি ছিল বাবার চেয়ে বেশি স্বচ্ছ। হলে কী হবে, দিনকে দিন তিনি রস হারাতে থাকলেন। হয়ে উঠলেন শঙ্কাগ্রস্ত। আমাকে হয়তো বাসার খুব কাছের মুদির দোকানে পাঠালেন কোনো সদাই কিনতে, আমাকে পাঠিয়ে দিয়ে রাজ্যের যত খারাপ কল্পনা তার মাথায় ভিড় করলো, দুর্ভাবনায় কাতর হলেন তিনি, আমি সহিসালামতেই ফিরে এলাম, মা বলে ডাকও দিলাম, তার ঘোর তখনো কাটে নাÑ তিনি অবাক হয়ে আমার প্রত্যাবর্তন দেখেন। যুদ্ধের বীভৎসতা আমাদের কারো ওপরই মায়ের মতো এমন প্রকটভাবে পড়েনি। তিনি প্রায়ই অভিযোগ তোলেন, তোমার বাবা সিরিয়াস লোক নন। তিনি বুঝতেই চেষ্টা করছেন না আমাদের ওপর দিয়ে কী ঝড় বয়ে গেছে। মা নিজেকে পরাস্ত সাব্যস্ত করলেন; কিন্তু তিনি কিছুতেই পরাজয় মানতে প্রস্তুত ছিলেন না; তিনি ভাবতে শুরু করলেন, ইতিহাস তাদের জীবনকে অর্থহীন করে দিয়ে গেছে।
আর আপনি? কখনো কি ভেবেছেন ইতিহাস আপনাকে নিপীড়ন করেছে?
চার্লস সিমিক : ছোটবেলায় এরকম কখনো ভাবিনি; কিন্তু এখন আমি নিশ্চিত নই। শৈশবে যেধরনের ক্ষেপাটেরা পৃথিবীকে বিষিয়ে তুলেছিল, তারা এখনো আমাদের চারপাশে রয়েছে। তারা আরো যুদ্ধ চায়, চায় আরো আরো লোককে বন্দি করতে, হত্যা করতে। এসব ভয়ানকভাবেই পরিচিত, ক্লান্ত করে আমাদের, সন্ত্রস্ত তো করেই।
শিকাগো কেমন লাগলো?
চার্লস সিমিক : শিকাগোকে মনে হলো, কমিউনিস্ট ইস্তেহারের কফি-টেবিল সংস্করণ, যার বাইরেটা চকচকে, হ্রদমুখো বাহারি ভবন; কিন্তু শহরের ভেতরে বস্তি। এর একপাশে মিশিগান এভিনিউ, যেখানে বিলাসী হোটেল আর ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, কয়েকটা অ্যাপার্টমেন্ট দূরে দেখা যায়, কারখানার ধোঁয়া কু-লি পাকিয়ে উঠছে আকাশে, আর রাস্তায় ঝুলকালি মাখানো শ্রমিকরা বাসের প্রতীক্ষা করছে। শিকাগোকে বলতে পারেন, অভিবাসীদের স্বর্গ। বহু কারখানা দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা সরগরম থাকে। সেখানে সবারই কাজ জুটে। ধারে-কাছেই রয়েছে চমৎকার সব সমুদ্র সৈকত, যেখানে সুন্দর যুগলেরা বালুর ওপর বসে কামু ও সাত্রের লেখা পড়ে। সুইডিশ, জার্মান, ইতালীয়, ইহুদি, কালো সব ধরনের বন্ধু জুটেছিল, তারা নিজ নিজ দৃষ্টিকোণ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাখ্যা করে আমাকে শোনাতো। আমি শিকাগো ছিলাম মাত্র ৩ বছর। শিকাগোই আমাকে প্রথমবারের মতো মার্কিন নাগরিকত্ব দেয়। তাই ওখানের সব ঘটনাই আমার কাছে বেশ চিত্তাকর্ষক ছিল।
সেটা কিরকম?
চার্লস সিমিক : সেখানকার সব কিছুই আমার কাছে ছিল অভিনব। কাজ খুঁজতে যাওয়া, কাজে গিয়ে প্রতিদিন নতুন নতুন মুখের দেখা পাওয়া, তাদের সঙ্গে বন্ধুতা, সব কিছুই
ছিল একেবারে নতুন। নতুন মুখগুলোর অধিকাংশই কিন্তু বয়সে আমার বড় ছিলেন। তারপরও চুটিয়ে গল্প করতাম, প্রত্যেক রাতে দল বেঁধে যেতাম বারে, মদমাতাল হয়ে তারা তাদের জীবনের বিচিত্র সব গল্প বলে যেত।
সেখানেই কী প্রথম কবিতা লিখতে শুরু করেন?
চার্লস সিমিক : প্রথমত আমার কিন্তু গোপন অভিলাষ ছিল চিত্রশিল্পী হওয়ার।
কী ধরনের চিত্রশিল্পী হতে চেয়েছিলেন?
চার্লস সিমিক : পোস্ট ইম্প্রেসনিস্টদের অনুকরণ করে যাত্রা শুরু। পরে জার্মান এক্সপ্রেশনিস্টদের দিকে ঝুঁকি।
আঁকাআঁকি ছেড়ে দিই আমার ৩০ বছর বয়সে। ততদিনে আমি হয়ে উঠেছি পুরোদস্তুর বিমূর্ত এক্সপ্রেশনিস্ট। সত্যি কথা বলতে কী, চিত্রশিল্পী হওয়ার মতো প্রতিভা আমার সামান্যই ছিল।
আপনি সিরিয়াসলি লিখতে শুরু করেন কখন?
চার্লস সিমিক : ওক পার্ক হাইস্কুলের শেষ বছরে আমি লিখতে শুরু করি, সিরিয়াসলি বলা ঠিক হবে না। তখন মাঝে মধ্যেই কবিতা রচনায় বসি। আগ্রহ কিন্তু তখনো পেইন্টিংয়ের প্রতিই বেশি।
ওক পার্কে স্নাতক ডিগ্রি লাভের পর শিকাগো সান-টাইমসে অফিস বয়ের চাকরি পান। এরপর পড়াশোনা চালানোর ব্যাপারে কী কথা হয়েছিল?
চার্লস সিমিক : অনেক কথা হয়েছে। নিউইয়র্ক বিশ^বিদ্যালয় ও শিকাগো বিশ^বিদ্যালয় আমার ভর্তির আবেদন গ্রহণ করে; কিন্তু আমার দিক থেকে পড়া চালিয়ে যাওয়ার পথ রুদ্ধ হয়ে পড়ে। খরচ জোগানোর প্রশ্নে বাবার ওপর আর নির্ভরের সুযোগ থাকে না। তখন তার আয় কমে এসেছিল, স্যালারি যা পেতেন নিমেষেই ফুরিয়ে যেত।
বাড়ি ছাড়েন কবে?
চার্লস সিমিক : আমার ১৮ বছর বয়সে। লিংকন পার্কের একটা এপার্টমেন্টে উঠি। আমার প্রতিবেশী ছিলেন সান-টাইমসের এক সহকর্মী। তিনি তখন শিকাগো বিশ^বিদ্যালয় থেকে দর্শনের ওপর একটা ডিগ্রি শেষ করছিলেন। তিনিই হয়ে ওঠেন আমার কবিতার প্রথম সিরিয়াস পাঠক। কল্পনাকে তিনি সন্দেহের চোখে দেখতেন। জোর দিতেন যুক্তির ওপর, অধিবিদ্যায় নয়। মিশিগান লেকের তীরে বসে আমি তাকে ‘প্রুফ্রক’ ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করি, তিনি জিজ্ঞেস করেন, সন্ধ্যাকে কি করে টেবিলে শোয়া অক্সিজেন লাগানো রোগীর সঙ্গে তুলনা করা যায়? আমি যুক্তি দিতাম তিনি পাল্টা যুক্তি দিয়ে তা খ-নের চেষ্টা করতেন। কবিতা সম্পর্কে গভীরভাবে ভাবতে তিনি বল প্রয়োগ করতেন। তখন তিনি আমার জীবনের খুব গুরুত্বপূর্ণ এক ব্যক্তি হয়ে ওঠেন। আমরা ৪৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে ভালো বন্ধু ছিলাম।
তখন কোন ধরনের কবিদের কবিতা পড়ছিলেন?
চার্লস সিমিক : আধুনিকতাবাদী, ইউরোপীয় ও মার্কিন কবিদের কবিতা। এলিয়ট, পাউন্ড, উইলিয়ামস, স্টিভেন্স, অ্যাপলিনেয়ার, ব্রেতো, রিলকে, প্রমুখের কবিতা। ঔপন্যাসিকদের মধ্যে নেলসন আলগ্রেন, শিকাগোতে তার সঙ্গে পরিচয় হয়। একদিন রবার্ট লয়েলের একটা বই পড়তে দেখে তিনি বললেন, সিমিক এসব ভুষিমাল পড়া ছাড়ো! নিজেকে শিশু বানিয়ে রেখো না। বরং পড়ে ফেলো কার্ল স্যান্ডবার্গ ও ভ্যাশেল লিন্ডসের রচনাগুলো!
মধ্য-পশ্চিমাঞ্চলে একটা জনপ্রিয় চল ছিল তখন, পূর্বাঞ্চলের এলিট বুদ্ধিজীবীদের দেখা হতো সন্দেহের চোখে, খুব একটা পছন্দও করা হতো না তাদের।
যতদূর মনে পড়ে, হার্ট ত্রেক্রনকে কবি হিসেবে আমার প্রথমে খুবই মনে ধরে। তিনি ছিলেন অনেকটা গুপ্ত, তাই আমার মধ্যে তার আবেদন লক্ষ্য করি। তার দুর্ভেদ্য কবিতাগুলোর সুর তখন অনেকটা উত্তুঙ্গ বলে মনে হতো।
ক্রেনের অল্প অনুকরণ করে তখন বহু কবিতা আমি লিখেছি। একেবারে তার শব্দ বন্ধ হুবহু উঠিয়ে এনেছি আমার কবিতায়, সেসব কবিতা পাঠক তো দূরে থাক, আমি নিজেই মর্ম উদ্ধারে প্রায়ই হিমশিম খেতাম। আমার সৌভাগ্য যে, ওই ধরনের লেখা সব নষ্ট হয়ে গেছে।
আপনার অধিকাংশ কবিতা অকর্মা, নৈঃসঙ্গ্যপীড়িত লোক, বেপরোয়া দুর্বৃত্ত, পথে ঘুরে বেড়ানো মরমি, সস্তা নোংরা হোটেলের স্থায়ী বাসিন্দাদের... জীবনযাপনকে উপজীব্য করে লেখা। আপনার কুড়ি বছর বয়সে নিউইয়র্কে দেখা লোকজনের জীবনালেখ্যর সঙ্গে এদের একটা যোগসাজশ আছে, তাই না?
চার্লস সিমিক : ঠিক বলেছেন। আমি নিউইয়র্ক আসি ১৯৫৮ সালের গ্রীষ্মকালে। তখন খুব নিঃসঙ্গ বোধ করি।
অথচ শিকাগোতে আমার বহু বন্ধু ছিল, যারা বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করেÑ কোন দুঃখে তুমি নিউইয়র্ক যেতে চাও বন্ধু? শিকাগোতে অনেক কিছুই ছিল আমার পছন্দেরÑ সিনেমা, জাজ ক্লাব, বইয়ের দোকান। রাতের বেলা ক্লাসে যেতাম, দিনে কাজে। ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে শার্ট বিক্রি করেছি, ঘর রঙ করেছি, বই বিক্রেতাও ছিলাম, কেরানিগিরি করেছি এই টাইপের কত কাজ যে তখন করতে হয়েছে! কাজ কিংবা ক্লাস না থাকলে যেতাম মদ খেতে কিংবা সিনেমা দেখতে। সেই সময়টায় ঘুমাতাম কম, পড়তাম অনেক বেশি, আর প্রায়ই প্রেমে পড়তাম।
যতদূর মনে পড়ে, তখন খুব একটা সুখী কিংবা বিষাদগ্রস্ত কোনোটাই ছিলাম না। স্কুলে যাওয়ার পথে মানুষকে ল্যামপোস্টে ঝুলে মরে থাকতে দেখে যে লোকগুলো বেড়ে ওঠে তাদের দশ সুবিধার একটা হলো, জীবন সম্পর্কে তাদের নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়।
আপনার প্রথম দিকের অপ্রকাশিত সব লেখা নষ্ট করে ফেলেছিলেন বলে জেনেছি। কিন্তু এ কাজ আপনি কেন করলেন?
চার্লস সিমিক : ঘটনা ১৯৬১ সালের। তখন আমি সেনাবাহিনীর দায়িত্ব পালন করতে ফ্রান্সে গেলাম। বছর খানেক পর আমার ভাই জুতার বাক্সে ভরে আমার প্রথম দিকের কবিতাগুলো পাঠায়। পড়ে মাথা বিগড়ে যায়। কী সব রদ্দিমাল। আমি এতদিন ভুষিমালের কারবারি করেছি! নিজের সৃষ্টির কাছে জীবনে আর এত লজ্জায় পড়িনি আমি। রাতে বাক্স ভর্তি কবিতা বগলদাবা করে ব্যারাক থেকে বেরিয়ে পড়লাম। ছুড়ে মারলাম সেগুলো।
স্নায়ুযুদ্ধের সময় বসবাসরত সবাই এক ধরনের যুদ্ধের মধ্য দিয়ে অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। কিউবার ক্ষেপণাস্ত্র সংকট শুরু হলে নিশ্চয়ই আপনারা সম্মুখ সমরের জন্য প্রস্তুত হয়ে পড়েন?
চার্লস সিমিক : হ্যাঁ। আমরা তখন সদা সতর্ক অবস্থায় ছিলাম। কারণ আশঙ্কা করছিলাম যেকোনো সময় যুদ্ধ বাধবে, এমনকি পারমাণবিক যুদ্ধও ছড়িয়ে পড়তে পারে। কিউবা সংকট তখন প্রকট হয়ে উঠেছে। আমাদের কমান্ডিং অফিসাররা সতর্ক করে দিলেন। যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব বিরাজ করছে, অফিসারদের মুখ থেকেও কথা সরে না। এমন একটা অবস্থা। আমরা সশস্ত্র ছিলাম। অস্ত্রটা যেকোনো মুহূর্তেই গর্জাতে পারতো। ভাগ্যিস সংকট মোচন হলো, আমাকে মানুষ খুন করতে হয়নি।
এ সময় কি কবিতা লিখছিলেন? এমন যুদ্ধাবস্থায় কি লেখা চালানো সম্ভব?
চার্লস সিমিক : সম্ভব ছিল, কিন্তু আমার নিজেরই তখন কবিতা লেখার মতো কোনো ইচ্ছা ছিল না। ওই অবস্থায় একটা নোট খাতায় কিছু মন্তব্য লিখে রাখি, তখনকার সময়ে পড়া বইগুলোর সম্পর্কে আমার মতামত টুকে রাখি, এসব কয়েক মাস চালিয়ে যাই, এর বাইরে আর তেমন কাজ নেই।
আপনার নির্বাচিত কবিতার সংস্করণে শুরুতেই দেখা যায় ‘কসাইয়ের দোকান’ কবিতাটা প্রথমেই রাখেন, আপনি কি মনে করেন এই কবিতাতেই নিজের কণ্ঠস্বর প্রথম ফোটে, এ কবিতা আপনার কাব্যসৃষ্টির তোরণ™^ার?
চার্লস সিমিক : আমার লেখা প্রথমদিকের কবিতাগুলোর মধ্যে এটাকেই প্রথম সংরক্ষণের কথা মনে হয়। কবিতা লিখে ফেলি সেই ১৯৬৩, তখন থাকতাম ইস্ট থার্টিন্থ স্ট্রিটে। আমার আস্তানার আশ পাশে তখন বেশ কটা পোল্যা-ীয় ও ইতালীয় কসাইয়ের দোকান ছিল, যেগুলোতে শূকর, ভেড়া, হাঁস-মুরগি মেরে চমৎকার করে ঝুলিয়ে রাখা হতো। কসাইখানার সামনে গিয়ে একটুখানি থামি, দোল খাওয়া গোস্তের দিকে তাকাই, এটা আমার একটা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে যায়। কসাইখানার সামনে দিয়ে যেতে যেতে আমি আমার শৈশবে প্রত্যাবর্তন করি, ইউরোপে। সেই ছেলেবেলায়, আমি কিনা কসাইদের মতো হাঁস-মুরগির গলা কেটেছি কত! তারপর শূকর...। স্মৃতির মধ্যে ডুব দিই।
যদি বলি আপনার এই কবিতার মূল সুরে সৃষ্টিশীলতা ও সহিংসতার কোথাও একটা যোগসূত্র আছে, ভুল বলা হবে কি?
‘সেখানে রয়েছে প্রকা- এক গাছের গুঁড়ি আর ভাঙা হাড়গোড়
রগড়ানোÑ আর একটা নদী মরে পড়ে আছে বিছানায়
সেখানে খাবার খাই
গভীর রাতে অচেনা ডাক শুনতে পাই।’
চার্লস সিমিক : আমারো তাই মনে হয়, কিন্তু কবিতাটি লেখবার সময় এ ব্যাপারে সচেতন ছিলাম কিনা আজ আর মনে পড়ে না। আমি যে একটা কসাইখানায় বেড়ে উঠি ব্যাপারটা বুঝে উঠতে অনেক বছর গড়িয়ে যায়, আমার বেলগ্রেডবাসী শৈশবের বন্ধুদের সঙ্গে কয়েক বছর পর দেখা হলেই তা পরিষ্কার হয়। আমাদের ভূসম্পত্তি শুধু যে দখল করা হয় তাই নয়, আমার শৈশবে গৃহযুদ্ধ বাধে, নানান গোষ্ঠীর মধ্যে চলে সংঘর্ষ। রাস্তায় রাস্তায় রক্ত গড়াগড়ি খায় আমি কতবার যে এদৃশ্য দেখেছি! নিরীহ নিরপরাধ মানুষকে খুন হতে হয়Ñ এটাই ছিল আমার প্রথম পাঠ। ‘স্রেফ যুদ্ধের’ কোনো ঘটনা পড়তে গিয়ে টের পাই, হাজার হাজার নিষ্পাপ লোক মারা পড়ছে এবং তারা মরতেই থাকবে, আমার অন্তরাত্মা চামড়া ছিঁড়ে লাফিয়ে বেরিয়ে আসতে চায়।
আপনার বহু কবিতায়Ñ ‘কোকরোচেস’-এর কথাই ধরি না কেন, দেখা যায় এমন সব লোকের আনাগোনা, যাদের কোনোমতেই কাব্যিক বলা যায় না।
চার্লস সিমিক : এই কবিতাটাও প্রথম দিকে লেখা। নিউইয়র্কে থাকার সময় আমার চারপাশে তেলাপোকারা গিজ গিজ করতো। তেলাপোকাদের সঙ্গে আমার উঠবস ছিল নিত্যদিনের। এরাই ছিল আমার একমাত্র সম্মানিত মেহমান, যারা সারাক্ষণ ঘুরঘুর করতো। আমিও ভদ্র আচরণ করতাম, সতর্ক থাকতাম, যাতে আমার মাননীয় অতিথিদের স্বাস্থ্য হানি, অঙ্গহানিও বলা যায়Ñ না ঘটে।
পোকামাকড়ের চরিত্র আপনার কবিতায় ঘুরেফিরে এসেছে। পিঁপড়ার প্রতিও আপনি বেশ অনুরক্ত, বিশেষ করে ‘জ্যাকস্ট্রস’-কাব্যে এ ধরনের মন্তব্যের পক্ষে নজির পাওয়া যায়।
চার্লস সিমিক : জানি আমার বন্ধুরা কাব্যগ্রন্থটি পাঠ করার সময় বলে, সিমিক তুমি কি আজকাল মদ একটু বেশিমাত্রায় গিলছো? সব দেখি ছারপোকা! আসলে আমি কিন্তু বরাবরই ক্ষুদে সব পোকামাকড়ের কাজ-কারবার বিপুল আগ্রহের সঙ্গে লক্ষ্য করি। ওরা সব দল বেঁধে বরযাত্রী যাচ্ছে, নানা কাজে সদা ব্যস্তÑ তা তাদের কাজ যাই হোক না কেন। মাছিরা শঙ্কাগ্রস্ত, বিভিন্ন ধরনের পতঙ্গ আছে যেগুলো ক্ষেপাটে, কিন্তু প্রজাপতি কী সুন্দর, নকশা করা ডানা তাদের, ওদের সৌন্দর্য কিন্তু তাদের প্রতি তোমাকে সদয় করে তুলবে, তুমি কোনোভাবেই প্রজাপতি মারতে উদ্ধত হবে না। পিঁপড়েরাও কিন্তু দেখতে চমৎকার। ছোটবেলায় খেলার ছলে পিঁপড়েদের পায়ে পিষতাম; কিন্তু আজ এই বয়সে, কোনো ভিমরুল যদি আমাকে হুল ফোটাতে থাকে, আমি ওই বেটাকেও মারতে পারি না।
অনেক সমালোচক মন্তব্য করেছেন, আপনার কাব্যসৃষ্টিতে ইউরোপ ও আমেরিকার প্রভাবের ঘুটমিশেল আছে। আপনিও কি আদৌ তাদের মতো করে বিবেচনা করেন?
চার্লস সিমিক : এ প্রশ্নের উত্তর কীভাবে দেয়া যায় আমার ঠিক জানা নেই। ইউরোপীয় কবিদের বিপুল কবিতা পড়েছি আমি; আমার সাময়িক মার্কিন কাব্যের কোনোটাও বাদ দিইনি। আমার ব্যাকগ্রাউন্ডের কারণে পাঠাভ্যাস আর দশজনের মতো ছিল না।
অনেকে হয়তো বলবেন সিমিকের কবিতার সুর কেমন বিদেশি। এখানে অনেককে রাগ আর হতাশা মেশানো অনুযোগ করতে শুনেছি, ‘সিমিক আমাদের একজন নয়।’ টের পাই আমার কেইসটা জটিল, আমাকে শ্রেণীকরণে বেশ সমস্যা, আমি না নির্বাসিত, না অভিবাসী; কিন্তু এ ব্যাপারে আমার সত্যি কোনো মাথাব্যথা নেই। আমি ইচ্ছে করে এ জীবনে চলে আসিনি কিংবা এমনতর কবি হতে চাইনি। বলা যায় ঘটনাটা এভাবেই ঘটে গেছে।
আপনার মাতৃভাষা নয়, ছোটবেলায় এ ভাষায় কথা বলেননি, এমন একটা ভাষায় লিখতে কেমন বোধ করেন?
চার্লস সিমিক : জানি না এ প্রশ্নের কী জবাব হয়। আমি কখনোই মাতৃভাষায় কবিতা লিখিনি। আমার ভেতরে ভাষা নিয়ে কোনো লড়াই ছিল না।
কবিতা লেখার প্রস্তুতির জন্য কোনো কিছু পড়ার পরামর্শ আছে কি?
চার্লস সিমিক : কবিতা লিখতে কোনো প্রস্তুতির দরকার নেই। খুব ভালো একটা কবিতার সংকলন কিংবা দর্শনের বই পকেটে নিয়ে ৪ বছর ঘুরে বেড়ালে, তা তন্ন তন্ন করে পাঠ করলে, বিশ^বিদ্যালয় পাসের জন্য হয়তো কাজে দেয়; কিন্তু কবিতা রচনায় নয়।
আপনার কবিতাকে ঐতিহ্যবাহী এবং নিরীক্ষাধর্মী দুই-ই আখ্যা দিয়ে সমালোচক ও কবিরা প্রশংসা করেন। এই যে ™ি^ধারার লড়াই, এ ব্যাপারে আপনি কতটা সজাগ ছিলেন?
চার্লস সিমিক : এতক্ষণ ধরে তো একথাই বলছিলাম। বিটস ও চার্লস ওলসনের প্রকল্প কবিতা তো ছিলই, আবার দেখ রবার্ট ব্লাই তার ‘দ্য সিক্সটিস’ ম্যাগাজিনে মার্কিন কবিদের উদ্দেশ্যে নিয়মিত প্রেসক্রিপশন দিতেন। আমার ঝোঁক ডব্লিউ এস মারউইন, জ্যামস রিট ও ব্লাইয়ের প্রতিই একটু বেশি ছিল। কারণ তাদের কবিতাগুলো ছিল অনেকটা পরাবাস্তববাদী। তারপরও কাব্যশৈলী এবং কবিতার আইডিয়া খুঁজে ফিরেছি অন্য কোথাও। কোন গুণ কবিতাকে মহত্তর করে এ রহস্য উদ্ঘাটন আমার কাছে বরাবরই কঠিন মনে হয়েছে। গত একশ বছরের সাহিত্যের ইতিহাস যদি কিছু প্রমাণ করে, তাহলে এ সত্যকেই সমর্থন করে। রবার্ট ফ্রস্ট, রবার্ট ক্রিলি, গেরট্রুড স্টেইন এবং ডোনাল্ড জাস্টিসের কবিতা আমার ভালো লাগে। তথাকথিত ভাষাবাদী কবির দল আর নতুন প্রজšে§র কবিরা যারা কবিতার শরীর নির্মাণের ব্যাপারে মোচড়া-মুচড়ি করেন, আজকাল মনে হয় তাতে সময়ের অপচয় ছাড়া কাজের কাজ কিছুই হয় না।
আপনার কবিতায় গল্প বলার ভঙ্গির সঙ্গে অসম্ভব শক্তিশালী চিত্রকল্পের অদ্ভুত সমন্বয় লক্ষ্য করা যায়। এটা আপনার কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্যের একটি। আগে থেকে কল্পনা করা যায় না এমন সব চিত্রকল্পে থাকে গল্পের সারকথা, প্রচ্ছন্নভাবে হাজির হয় সময়, এক ধরনের টানটান উত্তেজনা; কীভাবে এসব কবিতায় ছড়িয়ে দেন?
চার্লস সিমিক : কার্লোস উইলিয়াম কার্লোস আমার ওপর বেশ মুগ্ধতা তৈরি করেন। আর আমার রচনাশৈলী গড়ার ক্ষেত্রে শুরুর দিকে ক্র্যান ও স্টিভেনস-এর অনুকরণে কাব্যচর্চাও অংশত একটা ভূমিকা রাখে। পাঠকদের চমকে দেয়ার একটা চেষ্টা আমার মধ্যে তখন ছিল। অন্য কথায় বলি আমি চাইতাম আমার কবিতা একটা কুকুরও বুঝতে পারুক। এখনো তাই, কিছু অচেনা অদ্ভুত শব্দ কবিতায় চালান করি, বিস্ময়কর চিত্রকল্প নির্মাণের প্রয়াস রাখি, চমক সৃষ্টিকারী অধিবিদ্যার ™^ারস্থ হই। এক সন্ন্যাসীকে ঢুকিয়ে দিই বেশ্যার ঘরে। মদ্যপানরত কিংবা অন্তর্বাস পরা নারীদের কুচকাওয়াজ দেখতে দেখতে কেউ একজন শুকনো রুটিতে অনবরত কামড় বসাচ্ছে অতি অনায়াসে লিখে দিই।
যুদ্ধোত্তর মার্কিন কবিতার মানচিত্রে আপনার সমগোত্রীয়দের শনাক্ত করতে বললে আপনি নিশ্চয়ই চার্লস রিট এবং জ্যামস ট্যাইটের নাম বলবেন। ঠিক বলেছি?
চার্লস সিমিক : নিশ্চয়ই। তাদের আমি চিরকালের মতো চিনি। চার্লস রিটের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয় ১৯৬৩ সালে ফ্রান্সে, তখন আমি সেনাবাহিনীতে ছিলাম। তারপর আমরা বন্ধু হয়ে যাই, এখনো আছি। আজ থেকে ৩০ বছর আগে আমাদের গায়ে নয়াপরাবাস্তববাদী কবির লেবেল এঁটে দেয়া হয়, আমাদের কবিতা আত্মপ্রচারণামূলক, অর্থহীন শব্দের ফুলঝুরিতে ভরা, প্রতি-বুদ্ধিজীবীবাদী বলে আক্রমণ চালানো হয়, সত্যি বলতে কী, ওই ধরনের লেবেল ছিল শূন্যগর্ভ। পরাবাস্তববাদী কবিতার এক সময় জাঁকজমক ছিল, কিন্তু সে তো অনেক বছর আগের কাহিনী এত দিনে মরে গেছে, সেই কবে গত হয়েছে। স্বীকার করি আমাদের কবিতায় চিত্রকল্পের ছড়াছড়ি ছিল, ছিল অননুমেয় উল্লম্ফন, সেটাই শেষ কথা ছিল না। ১৯৬৩-১৯৬৪ সালে নিউইয়র্ক লাইব্রেরিতে আমি মার্কিন লোকসাহিত্য খুব মনোযোগ সহকারে পড়েছি, বহু। তখন জাদুকরি ভাষায় কথা বলার প্রতি আমার আগ্রহ জšে§, আগ্রহী হয়ে উঠি ছন্দোবদ্ধ লম্ফঝম্ফে, প্রবাদ বাক্যে। আমাদের লোকসাহিত্যে পরাবাস্তববাদী চিত্রকল্পের উপস্থিতি নেহায়েৎ কম নেই। একবার তো নোট নিতে শুরু করি, ওইসব চিত্রকল্প সংগ্রহ করে একটা বই প্রকাশের চিন্তা-ভাবনা করি।
বহির্বিশ^কে দেখানোর কথা ভাবি। শেষ পর্যন্ত অবশ্য রণে ভঙ্গ দিই। নোটবইটা কানায় কানায় ভরে গেলে একদিন তা হারিয়ে যায়। ব্যাপারটা হয়তো কাউকে প্রমাণ করতে পারতাম না, কিন্তু নিজের জন্যই একটা বড় দলিল ছিল।
আপনার কবিতায় চলচ্চিত্র, নগর জীবন ঘুরে ফিরে আসে। কবে চলচ্চিত্রের প্রেমে পড়েন?
চার্লস সিমিক : আমার ১০ কী ১১ বছর বয়স। বেলগ্রেডে, যেখানে আমার শৈশব কেটেছে, ভয়াল অন্ধকার ছিল, যুদ্ধের বছরগুলো তারও পরের কয়েক বছর ছিল বিপজ্জনক। তখনকার আমার বিনিদ্র রাত কাটানোর সঙ্গী ছিল চলচ্চিত্র। বিশেষ করে মার্কিন চলচ্চিত্র আমার মনে কবিতার রস সঞ্চার করে, বৃষ্টিঝরা রাতে জানালার পর্দা তোলার সাহস জোগায়, আমি দেখি রাস্তা শুয়ে আছ, স্নান করছে। আমার বন্ধুদের অনেকেই ওইসব চলচ্চিত্র পছন্দ করতো না, বিষয়টি আমাকে আহত করতো, ভাবতাম এও সম্ভব!
একবার সাক্ষাৎকারে অ্যালেন গিন্সবার্গকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তিনি কেন তার মতো লেখেন, উত্তরে তিনি বলেন, ‘একমাত্র কারণ হলো আমি লিখি!’ কেন কবিরা তাদের মতোই লিখেন, এর বাইরে কি কিছু বলার নেই?
চার্লস সিমিক : সম্ভবত নেই। আমি লিখি ঈশ^রকে রাগাতে আর মৃত্যুকে হাসাতে। আমি লিখি কারণ আমি তা ঠিকভাবে পাই না।
আমি লিখি কারণ আমি চাই এই পৃথিবীর সব নারী আমার প্রেমে পড়ুক। কেউ হয়তো এরকম চালাকি করতে পারেন, কিন্তু শেষমেষ গিন্সবার্গের কথাই সত্য হয়ে যায়।
গত ৪০ বছরে আপনার কবিতাশৈলী, নিজস্ব স্টাইল, কিভাবে রূপান্তরিত হলো?
চার্লস সিমিক : আমার শুরুর দিকের কবিতায় জোর দিতাম চিত্রকল্পের ওপর, শ্রুতির প্রতি যতœবান ছিলাম না, আটপৌরে শব্দ ব্যবহার করতাম। ইতিমধ্যে আমার কবিতার ভাষা ও সংগীতের ব্যবহারের প্রতি সচেতন হয়ে উঠেছি। আরো আত্মজীবনীমূলক উপাদান, আরো বর্ণনাধর্মিতার ব্যবহার করছি। আমি হয়ে উঠেছি লোক ও নাগরিক কবি। আমার আছে আবিষ্টতা, বাজে স্বভাব ও অন্ধ খুঁত। এতদিন ধরে যে কবিরা লিখে চলেছেন তাদের দশজনের মতোই আমার কবিতায় পুনরাবৃত্তি আছে। উত্তরণের চেষ্টা করি না এমন নয়, তারপরও রাতের পর রাত একই আচ্ছন্নতা পেয়ে বসে, পুরনো আমাতেই দোল খাই।
আপনি সরাসরি ইতিহাস লিখতে না চাইলেও এটা নিশ্চিত যে, ৯০-এর দশকের গোড়ার দিকে লেখা আপনার ‘রিডিং হিস্টরি’ কিংবা ‘এম্পায়ার্স’ কবিতায় বলকান যুদ্ধের ইতিহাস কথা কয়।
চার্লস সিমিক : ব্যাকগ্রাউন্ড তাই ছিল, আমি নিশ্চিত। ভারতীয় এবং চীনের ইতিহাসের ওপর বেশ কয়েকটি বই পড়ার পর আমি লিখে ফেলি রিডিং হিস্টরি। কয়েকটা পাতার মধ্যেই, অবশ্যই গণহত্যার কথা থাকতো, সংঘর্ষের কথা, হাজার হাজার লোকের মৃত্যু বার্তা। তাতে আমার চিন্তা ঘুরপাক খেত। এম্পায়ার্স কবিতাটি আমার নানিকে উপজীব্য করে লেখা। তিনি ১৯৪৮ সালে আমার বয়স যখন ১০ বছর, মারা যান তিনি। আমার শিশুবেলাটা কিন্তু তার নিবিড় সান্নিধ্যে। বাবা-মা কাজে চলে গেলে নানিই আমার দেখাশোনা করতেন। নানি তখন রেডিওতে হিটলার, স্ট্যালিন, মুসোলিনির বক্তব্য শুনতেন। নানি কিন্তু বেশ কয়েকটা ভাষা জানতেন। কাজেই হতাশ হতেন। মিথ্যা ভাষণের ওপর আস্থা রাখতে পারছিলেন না তিনি। পৃথিবীর সংকটটা কী? এ প্রশ্ন তিনি জনে জনে জিজ্ঞেস করতেন। ভালো প্রশ্ন, যার উত্তর আমার এখনো জানা হয়নি। আমার এই বয়সেই কত যুদ্ধ হলো, কত কত মানুষের প্রাণহানি! আমিও নানির মতোই হতাশ। মানুষ হত্যা আমাকে বিচলিত করে, বিস্মিত হই। মানুষ খুন করে পৃথিবীর উন্নয়ন সম্ভব, মার্কিন বুদ্ধিজীবী মহলে এ ধারণা বেশ জনপ্রিয়; কিন্তু ইতিহাস এর পক্ষে সাক্ষ্য দেয় না। এ ব্যাপারে আমি সব সময় ভাবি।
অডেন ১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর তার ‘টু আনডু দ্য ফোল্ডেড লাই’ কবিতায় লিখলেন, সর্বসাকুল্যে আমার আছে একটা কণ্ঠস্বর। অডেন অবশ্য পরে এ কবিতাটি অগ্রাহ্য করেন... কিন্তু আমার মনে হয়, এ কবিতার অন্তর্নিহিত আহ্বানের সঙ্গে আপনার কবিতার কোথাও সাযুজ্য রয়েছে। অন্তত রাজনীতিবিদ ও প-িতদের নানা ভড়ংবাজির মুখোশ উšে§াচনের ক্ষেত্রে আপনার কবিতা তৎপর।
চার্লস সিমিক : আমার বিবেচনায় কবিতা হলো কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে সক্রিয় অন্য সব ক্ষমতা মোকাবেলার শক্তি। প্রত্যেকটা ধর্ম, আদর্শ এবং চিন্তার প্রথা ও পন্থা ব্যক্তি মানুষটাকে পুনঃশিক্ষা দিতে চায়, তাকে ভিন্ন একটা মানুষে রূপান্তর করতে চায়। একজন সত্যিকারের দেশপ্রেমিক নিজের জন্য ভাবেন না, তারা তোমাকে এ কথাই বলবে। আমি লক্ষ্য করেছি, কবিতার একটা দীর্ঘ ঐতিহ্য হলো, ক্ষমতা সম্পর্কে সত্য কথা বলতে বিরত থাকা। আমার মধ্যে এই ধারণাকে লালন করতে চাইনি।
অন্যদিকে আপনার কবিতার একটা বড় আনন্দদায়ক বৈশিষ্ট্য হলো, আমার বিবেচনায় অন্তত, জীবনের সবধরনের সাদামাটা আনন্দ উপভোগে আপনার কবিতা আমন্ত্রণ জানায়। এমনকি চিংড়ি ভাজা, টমেটো, রোস্ট, রেড ওয়াইন...
চার্লস সিমিক : সস নিতে ভুলে যেও না, আলু আর পিঁয়াজও নিও! দুই-একজন দার্শনিককেও হাতে নিয়ে নেয়ার বিশেষ উপদেশ রইলো। এক বোল স্পাগেটি খেতে খেতে প্ল্যাটোর কয়েকটা পৃষ্ঠা ও ভিটগেনস্টাইনের ‘ট্র্যাকট্যাটাস’।
বিপরীতধর্মী দুটি বস্তুর সম্মিলনকে আমরা সেরা মনে করি, সবকিছুকে বাস্তব বলে মানি, একের ভিতর আরেক, কোনো না কোনোভাবে সম্পৃক্ত। এভাবেই কবিতা ও দর্শনের সহাবস্থান আমাদের মনে বিস্ময় জাগায়। আমার বিবেচনায়, আটপৌরে জীবনের আনন্দ থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো ‘সত্য’ মূল্যহীন। প্রত্যেকটি মহা থিওরি ও সেন্টিম্যান্টকে প্রথমে রান্না ঘরে এবং পরে বিছানায় পরীক্ষা করে দেখতে হবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন