শনিবার, ১০ অক্টোবর, ২০০৯

জীবনানন্দ দাশের দুটি কবিতা

মেয়ে
........
আমার এ ছোট মেয়ে- সব শেষ মেয়ে এই
শুয়ে আছে বিছানার পাশে
শুয়ে থাকে- উঠে বসে- পাখির মতন কথা কয়
হামাগুড়ি দিয়ে ফেরে
মাঠে-মাঠে আকাশে আকাশে...

ভুলে যাই ওর কথা- আমার প্রথম মেয়ে সেই
মেঘ দিয়ে ভেসে আসে যেন
বলে এসে; 'বাবা, তুমি ভালো আছে? ভালো আছো? ভালোবাসো?
হাতখানা ধরি তার : ধোঁয়া শুধু
কাপড়ের মতে শাদা শাদা মুখখানা কেন!
'ব্যথা পাও? আমি কবে মরে গেছি- আজো মনে করো?'
দুই হাত চুপে-চুপে নাড়ে তাই
আমার চোখের 'পরে, আমার মুখের 'পরে মৃত মেয়ে;
আমিও তাহার মুখে দুহাত বুলাই
তবু তার মুখ নাই- চোখ চুল নাই।

তবু তারে চাই আমি- তারে শুধু- পৃথিবীতে আর কিছু নয়
রক্তমাংস চোখ চুল-আমার সে মেয়ে- সেই পাখি- শাদা পাখি- তারে আমি চাই :
সে যেন বুঝিল সব- নতুন জীবন তাই পেয়ে
হঠাৎ দাঁড়ালো কাছে সেই মৃত মেয়ে।

বলিল সে : আমারে চেয়েছ, তাই ছোট বোনটিরে
তোমার সে ছোটো- ছোটো মেয়েটিরে এসেছি ঘাসের নিচে রেখে
সেখানে ছিলাম আমি অন্ধকারে এতদিন
ঘুমাতে ছিলাম আমি'- ভয় পেয়ে থেমে গেল মেয়ে,
বলিলাম : আবার ঘুমাও গিয়ে-
ছোট বোনটিরে তুমি দিয়ে যাও ডেকে।
ব্যথা পেল সেই প্রাণ- খানিক দাঁড়াল চুপে- তারপর ধোঁয়া
সব তার ধোঁয়া হয়ে খসে গেল ধীরে-ধীরে তাই,
শাদা চাদরের মতো বাতাসেরে জড়াল সে একবার
কখন উঠেছে দাঁড়কাক
চেয়ে দেখি ছোটো মেয়ে হামাগুড়ি দিয়ে খেলে- আর কেউ নাই।



নদী
...
রাইসর্ষের খেত সকালে উজ্জ্বল হলো- দুপুরে বিবর্ণ হ'য়ে গেল
তারি পাশে নদী;

নদী, তুমি কোন কথা কও?
অশথের ডালাপালা তোমার বুকের 'পরে পড়েছে যে,
জামের ছায়ায় তুমি নীল হ'লে.
আরো দুরে চলে যাই
সেই শব্দ সেই শব্দ পিছে-পিছে আসে;
নদী না কি?

নদী, তুমি কোন কথা কও?

তুমি যেন আমার ছোট মেয়ে- আমার সে ছোটো মেয়ে :
যতদূর যাই আমি- হামাগুড়ি দিয়ে তুমি পিছে পিছে আসো,
তোমার ডেউয়ের শব্দ শুনি আমি : আমারি নিজের শিশু সারাদিন নিজ মনে
কথা কয় (যেন)

কথা কয়- কথা কয়- ক্লান্ত হয নাকো
এই নদী
একপাল মাছরাঙা নদীর বুকের রামধনু
বকের ডানার সারি শাদা পদ্ম- নিস্তব্ধ পদ্মের দ্বীপ নদীর ভিতরে
মানুষেরা সেই সব দেখে নাই।

কখন আমের বনে চলে গেছি
এইখানে কোকিলের ভালোবাসা কোকিলের সাথে,
এখানে হাওয়ায় যেন ভালোবাসা বীজ হ'য়ে আছে,
নদীর নতুন শব্দ এইখানে : কার যেন ভালোবাসা পুষে রাখে বুকে
সোনালি প্রেমের গল্প সারাদিন পাড়ে
সারাদিন পাখি তাহা শোনে; তবু শোনে সারাদিন?
পাখিরা তাদের গানে এই শব্দ তবু
পৃথিবীর খেতে মাঠে ছড়াতে পারে না,
নদীর নিজের সুর এ যে!

নদী, তুমি কোন কথা কও?

গাছ থেকে গাছে, আর, মাঠ থেকে রোদ শুধু শুধু মরে যায়
সব আলো কোন দিকে যায়!
নিজের মুখের থেকে রোদের সোনালি রেণু মুছে ফ্যালে নদী
শুধু তার ফুল নিয়ে খেলিবার সাধ
ফুলের মতন কোন ভালোবাসা নিয়ে,
ধানের কঠিন খোসা- খড়- হিম- শুকনো সব পাপড়ির মাঝে সেই
মেয়ে ইস্ততত বসে আছে;
গান গায়;
নদীর- নদীর শব্দ শুনি আমি।

নদী তুমি কোন কথা কও!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন