শনিবার, ১৭ অক্টোবর, ২০০৯

কবি জুয়েল মোস্তাফিজের কবিতা

জুয়ার আসরে কোনো আঙুলই মিথ্যা নয়

যেখানে ঘুমোতে হয় না ঠিক সেখানেই ঘুমানো গ্যালো। একটি কাগজের বাক্স, বাক্সের চার কোনায় চারটা নল, প্রত্যেক নলে গাঢ় অক্সিজেন ঢাললেই ঘুম আসে, খেটে খাওয়া ঘুমের বাড়ি গাড়ি নাই, ঘুমকেও অতি যতনে বাঁচতে হয়। আমাদের মতো জাগরী ঘুমের মানুষেরা সেই ঘুম পুষে রাখতে পারে না। দুঃখী মানুষেরা যেখানে ঘুমায়, সেখানেই চাঁদমারির বিছানা।
গল্পটা ফাঁদা যাক এবার, দরগাতলার আগুনে মানুষ পোড়ানো ভোর, প্রতিদিনের ভোর যথাসাধ্য বেলুন, বেলুনের উল্টো সোজা নেই, শুধুমাত্র ফুলে থাকা বেলুন। সুখী মানুষের অন্ধকারে দুঃখী মানুষের কোনো ঘুম আসবে না, আমরা তেলচিটে মানুষ পেটের খাবার জোটাতে গিয়ে রক্ত কালো হতে চলেছে, ঘুমের খরচ কোথায় জোটে; আর তাই তো আমরা ঘুমাতে যাই না চোখ বন্ধ করি, যারা সারারাত ঘুমাবে না বলে কৈবর্তপাড়ায় যৌনচক্রে পড়েছে, কেবল তাদের তালগাছের মতো ঘুম, আমরা বাকিতে কিনি।
গল্পটার শেষ অংশ কিন্তু এই রকম, ঘুমের ঘোড়া মারা যাবার পরই ঘুমের পাখি। নইলে কি স্বপ্ন দেখে এখান সেখান যাওয়া আসা? ঘুমের কল্যাণে তোমার বাড়িও যাওয়া যায়; কিন্তু ঘুমের ঘোড়ার আত্মার কথা ভেবে ঘুমের পাখি উড়ে যায় কুয়াশা গাছের ডালে, চাঁদ মাঠের জালে, এই জন্য ঘুমের গুরুত্ব পানসে। যাব না যাব না করে কতকাল গ্যালো, এটা কি কোনো গল্পের শেষ? আছে হয়তো রহস্য কিছু... ঘুমের ব্লেড ঘেমে উঠেছে এখন।



২.
মাটির ভেতর মাটিরা কি আরামে আছে! গাছের ভেতর একটা অদ্ভুত ফোঁকর থাকলেও আমরা দুঃখেই থাকি। আমাদের মাথার ভেতর হঠাৎ উদ্ভাবিত মৃত্যু। আমরা দৌড়াতে পারি না, কারণ আমাদের পা টুপি পরে থাকে। যাত্রার কিংবা সাকার্সের স্টেজের কাছে আমাদের মানায় ভালো, কিন্তু যাত্রা কিংবা স্টেজের বাঁশ খুঁটি আমাদের মানিয়ে নিতে পারে না। আমরা বড় বেশি হজম করতে যাই না, ফলে কবুতরের ভালোবাসা আমাদের পাঁজরে বাজিয়েছে অসময়ের ঘণ্টা। এই যে ধরুন, এত বছর ধরে সময় ব্যাপারটা আমরা বুঝতে পারছি না, এই ভেবে যে বসে আছি তা কিন্তু নয়, আমরা শাদা ঘড়ি, কালো ঘড়ি, কিংবা ইতিহাসের বিভিন্ন লাল ঘড়ির কাছে গিয়েছি, ভাঙা ঘড়ির পদতলে পূজো দিয়েছি তথাপি সময় ব্যাপারটা বুঝতে পারছি না। আমাদের সাথে প্রায়শ কথা বলতো সময়ঘাতী লোকজন। তখন দেখতাম সময়ের সাথে ধুতুরা গাছের কথা হতো, আমরা জ্যামিতি বক্সের কাঠি দিয়ে ফোড়া ফাটিয়ে ছিলাম বলে জীবনের সকল দাগই বাঁকা; আচ্ছা বলুন তো দাগ বাঁকা হলে কি বাঁচা যায়? বাঁচার জন্য অন্তত সময়ের সোজা সোজা দাগ লাগে...



৩.
সব গল্পই তো শেষ। রাতের গল্পটা, দিনের গল্পটা, এমনকি শেষ গল্পটাও। ভুল গল্পটা শেষ হবে না জানতাম কিন্তু সে গল্পটাও শেষ। শেষ গল্পটা বেশ মজা করে বলছিল পানু কাকা, সে গল্পও শেষ। মৃত্যুর গল্প ধরেছিল সরেন ডোম, মরার বাড় বেড়েছে উত্তর পক্ষে গল্প নয় সত্যি, সত্যিটুকুও শেষ হয়েছে গতরাতে। দেখুন, সব শেষ বলে আপনার পাগলা চুলগুলো আর বাড়তে দেবেন না প্লিজ! বারো মণ গালি কিনতে গিয়েছিল ওই কার্তিকের পাগল, সেই গালির কিছু অংশ শেষ হয়ে গিয়েছে কিছুক্ষণ আগে। গতরাতে পাগলনামা পড়তে পড়তে আমার মাথা ঘুরে গিয়েছিল, ঘুরবে না বলুন? এত ঘোড়া কীভাবে সামলানো যায়, ইতিহাস থেকে ঘোড়াগুলো পালিয়ে যাচ্ছে পালাতে পালাতে নিভে যাচ্ছে। বলে রাখলাম; আগামী বর্ষা থেকে ইতিহাসে আর কোনো ঘোড়া পাওয়া যাবে না। সব ঘোড়া পালিয়েছে ইতিহাসের পাতা থেকে, যুগের রক্ত থেকে। কী আশ্চর্য! শেষ হয়ে আসছে পুরনো রক্ত, নতুন রক্ত। আমি যদি ডাহুক কিংবা পরিত্যক্ত নারীর কথা বলি তবে আপনাদের মন কাঁদবে নিশ্চয়ই? তবে কাঁদুন একবার, ভিজে যান দ্রুতগামী নোঙর কিংবা ইঁদুরের মতো। শেষ হয়ে আসছে সকল গল্প, খালের গল্প, কালের গল্প। না না কালের ভেতর কোনো সাপ ঢুকেনি, দিব্যচোখের সরল দৃষ্টি আছে কালের পথে, দিব্যলোকের দৃষ্টি দেখতে অনেকখানি সাপের মতো, চেতনা বলতে যে ঝুমঝুমি বাজে আসলে তা কিছু নয় মেয়েটি পাগল হয়ে গিয়েছিল মাত্র; তার কান্নার গল্পটাও শেষ, তার কান্না থেকে তার কবর পর্যন্ত দৌড়াদৌড়ি কবে নাগাদ শেষ হবে এই ভেবে বসে আছি, বসে আছি আহত চাঁদ...



৪.
কতবেল গাছের ডালে ফাঁসি দিয়েছিল সরাইখানার শ্রমিক। ওই শ্রমিকের প্রাণে বাঁধা ছিল একটা নীল পাথর, তার মৃত্যুর পর অবশিষ্ট পাথর নিয়েই এবারের কাব্য। কাব্য ঠিক নয়; ওই পাথরের অর্ধ অংশ অন্ধকার হয়েছিল তারই গল্প হয়তো। আমাদের জীবন থেকে পশ্চিম দিকে যে পথ চলে গেছে, একটু লক্ষ করলেই পাওয়া যাবে কতগুলো দ্রুতগামী শিশু আর তাদের কান্না, সেই কান্না শুনতে শুনতে আমরা কালান্তর পাড়ি দিই। সরাইখানার শ্রমিকের কবর আছে জীবনের পশ্চিম পথে। মৃত্যুর জন্য কতবেল গাছই আদর্শ গাছ; সরাই শ্রমিকের এপিটাফে লেখা ছিল বলে আমরা পড়তে পেরেছিলাম। কতবেল গাছ স্বপ্নের ভেতর বড় হয়, ঘুমের ভেতর বড় হয়, বেশ্যার শাড়িতে বড় হয়। কতবেল গাছের ডালে মৃত্যুর আহ্বান আছে। একটু ভেবে নিলে ভালোভাবে বোঝা যাবে সরাইখানার মাঠে অনেক কতবেল গড়াগড়ি করে।
বাদ দিই এসব কথা; কতবেল গাছের রাগ হলে বাঁচান থাকবে না। সেদিন পোস্ট অফিসে দেখে এলাম প্রতিটি চিঠিই সরাইখানার, বেশ্যাবাড়ির আর কতবেল গাছের। ভয়ে দৌড়ে এসে দেখি সকল মানুষই কতবেল গাছের নিচে, বেশ্যাবাড়ির ছায়ায়, সরাইখানার ভেতর। মানুষেরা মৃত্যুগামী কখনোই ছিলো না, মৃত্যুরা মানুষগামী বলেই বেলগাছের পাতা সবুজ।



৫.
তোমাদের মতো গোছালো মাছের ঘর আমার নেই, পৃথিবীর প্রথম গান যেদিকে বেঁকে গেছে সেই দিকে আমার ভাঙা খাট আর ভাঙা বিছানা। তাই তো পথে পথে মাছওয়ালাদের দেখলেই আমি গোছালো শব্দের অর্থ বুঝি। অন্তত, যে মাছগুলো গান করে সে মাছের সময় বুঝি। বুঝতে বুঝতে মাছওয়ালা বেঁকে যায় ঘন গ্রামের দিকে, আমি বেঁকে যাই বাদুড়খানার দিকে। সাঁঝের বেলা বাদুড়ের ছেলেমেয়েরা মাদুর পেতে বসে, আমি কলাগাছের দিকে চেয়ে থাকি। কলাগাছের দুঃখটা শুনেছিলাম আইনাল হকের কাছে... যাক এসব, অনন্তের পথে তোমার কালো ব্লাউজই উজ্জ্বল... আমি গরিব মানুষ আমার ঘর বারো পথের বারোমাথায়।



৬.
পাখির ভালোবাসা দেখলাম আর কাঁদলাম। পাখিরা ভালোবাসবে এটা তো পূর্ব শর্ত ছিল? তবুও কাঁদলাম। আমি গরিব মানুষ দৌড় দিতে পারি না, তাই তো সাপ আমার আগে যায়, চুনারীপাড়া আমার আগে যায়, আগে চলে যায় মাটিবন্দি ঘুম। আরো পাখি পাখি করলে আরো কান্না আসে, পাখির আরো ভালোবাসা হয়। আমি কি পথের ভেতর করুণ বাঁশি, নইলে যে একটাই ঘুমে, ঘুম গ্যালো আগে আমি থাকলাম পিছে, বলুন দেখি এভাবে ঘুম হয়? এভাবে কি রাতের সন্ন্যাস বাঁচতে পারে? এইজন্য সব মিলিয়ে যা দাঁড়ায় তা হলো একপক্ষ মৃত্যু অন্যপক্ষে পাখির ভালোবাসা। একদিন সমস্ত অন্ধকার দাঁড়িয়ে গ্যালো রাতের বিরুদ্ধে। ধার করেছি নিঃশ্বাস, তা দিয়ে বেঁচেও আছি, কিন্তু ছোট ছোট হাতগুলো মৃত্যুর প্রসঙ্গ আনলো, মরতে পারাটা সত্যের মতো কিছু নয়, মিথ্যার মতো কিছু নয়। স্বপনে বপনে আমরা অনেক দেখি, হরেক রকম মৃত্যু আছে রাতের গভীরে। ছোট ছোট মৃত্যু দিয়েও বেঁচে থাকা যায়...
কোনটা বেশি জরুরি? বাঁচতে পারা নাকি পাখির ভালোবাসা। জরুরি আইন খুঁজে পাওয়া গ্যালো না। তাই তো অন্তিম অন্ধকারের কাছে রেখেছি জমা কোনটা জরুরি। জানি, তুমিই এই প্রশ্নের উত্তর জানো কিন্তু তোমাকে তো এই প্রশ্ন করিনি? যাই হোক, যা হোক, স্বপ্নগুলো আগে চলুক, আমি পরে যাবো...



৭.
হাসবো না আমি? আমার বাম পাঁজর ভেঙে গেছে গুনটানা প্রেমিকের পায়ে বেধে, প্রেমিকের পা দিয়ে বেকুব মাঝি এদিক ওদিক যায়... ভাঙলো তো রাতের পাটাতন? একটা সেপ্টিপিন আটকা পড়ে আছে মাংসের ভেতর, তোমরা তো সবাই জানো কতদিন লাল ময়ূরের স্বপ্ন আমি দেখি না, তবুও ভেঙে গ্যালো কাচ, এত মৃত্যু এত ভাঙা আর আমি হাসবো না? হেসে তো আর পার পাওয়া যাবে না তাই তো পথে নেমে খুঁজতে বেরুনো গ্যালো প্রেমিক। প্রেমিকের তো পাঁচ পা থাকে, প্রেমিকের তো পাঁচটা মৃত্যু এক পাত্রেই থাকে। পাত্রগুলো এখন উল্টে আছে পৃথিবীর পথে। আর কোনো প্রেমিক বেঁচে নেই মাটি কিংবা কাচের মতো। সেদিন দৌড়ে গেলাম পেছনে, দেখলাম ঘুঘু আর সর্বনাশ। মনটা খারাপ হলো; তারপর দৌড়ে গেলাম সামনে, দেখলাম সহস্র চোখ মারবেলের মতো পড়ে আছে পথেঘাটে। মনটা খারাপ হলো। এত খারাপ দিয়ে তো আর খুশি হবে না তুমি। তাই বর্ষার এক কোণে বসে থাকি। জানি চুল শুকানোর কোনো বাতিক নেই তোমার, বর্ষায় কোনো রোদও ওঠে না। ভুলেশ্বর তুমিই বলো, আমি তো সর্বনাশের আমি হাসবো না? খুব করে হাসবো, হেসে হেসে শ্মশানে যাবো, হেসে হেসে মাথা ফাটাবো, হেসে হেসে দেখে নেবো বেড়ালের মিছিল। হাসি ব্যাপারটা কেন জানি তোমাদের ভালো লাগে, তাই তো আমি হাসি, ভাঙনের চূড়ান্ত দিনেও আমি হাসি...



ঈশ্বরের ভাটিয়ালী

ভুবনের বাকল পুড়ছে আর আমরা জল হাতে দৌড় দিয়েছি আগুনের দিকে। আগুনের ভেতর এক অন্ধ ঈশ্বর বেলুন মুখে বসে আছে। আমাদের ভুবন পুড়ে যাচ্ছে জেনেও ঈশ্বরের মুখের একী কাণ্ড! আমরা ঈশ্বরের মুখে যতই জল ছুঁড়ে মারি ঈশ্বর ততই ভুবনের দিকে বেলুন ছুঁড়ে মারে। তাই তো উড়ন্ত বেলুন দেখি আর মনে হয় বেলুনের ভেতর হাওয়াটুকুই আমাদের সর্বনাশের কারণ। ধরে নেয়া যাক ভুবনের সকল ভেদ জেনে গেছে এক অন্ধ ঈশ্বরের চোখ। আর আমরা সমস্ত আগুন জলাঞ্জলি দিয়ে বসে আছি একটা বাঁশির কাছে। আমরা বাঁশির আশ্রয় নিয়েছি বলে ঈশ্বর হয়েছে ভাবের মানুষ। কী ভেবে যেন বসে আছে মৃত কচ্ছপের পাশে...
বন্ধু, রাতের কোলে আলো দেখে আর কোনো মরণ নয়, এবার আমরা জোনাকির প্রতারণা বুঝে গেছি। তাই তো দেহ থেকে রাতগুলো ঝরে যাওয়ার আগে আমরা আরো একবার দেহের ভেতর আজান নামাই। কারণ যে রাতে আমরা স্বপ্ন দেখিনি সে রাতের স্বপ্নগুলো আমাদের দেখে ফেলেছে। দেখনি গতরাতে একটা হারানো সংবাদ, তুমুল অন্ধকার হতে এক নবীন স্বপ্ন হারিয়ে গিয়েছে, গায়ের রঙ পৃথিবীর মতো, পরনে ছিলো শাদা শাদা ভ্রমর। সেই স্বপ্নটাকে দেখা গিয়েছিলো কদমের মাথায় বসে বিশ্রাম নিতে। আমাদের হাত নেই, পা নেই, আয়ু নেই, মৃত্যু নেই, এমন এক ভেজা মরা কালে আমাদের জীবনের ওপর তোমরা করেছ ঈশ্বরের আয়োজন?



২.
তুমি বর্ষা থেকে এসেছো বলে কি আমরা দায়ে পড়ে গেছি? আমাদের দায় পড়ে আছে, সময় ঘোড়ার পায়ে পায়ে। আমরা কেউ কখনো নিজেদের ওপর কোনো অধিকার রাখি না। তোমরা সারারাত আলকাপের হাড় বাজাও, আর আমরা থেকে থেকে কেঁপে উঠি। পৃথিবীর অভয় নিয়ে এত দিন গেলো, তবুও পৃথিবীর ভয় গ্যালো না। অনন্তের পথে আর কোনো বটগাছ জন্মালো না, না বাবা এবার ঘরে আর কোনো বর্ষা তুলতে পারবো না। গতকাল কত কাকে কবর দিলাম, তোমরা বুঝতেও পারো না। কী সব তোমার দাবি। কত আর কবর খুঁড়বো আমি। তোমরা সবাই কবর-বন্দি মানুষ। কেউ বাঁচতে চাও না। দাঁড়াও ওখানেই দাঁড়াও। আর গল্পটা শোনো। সেবার বর্ষা আসবে আসবে এরই মধ্যে ধীবর পাড়ায় মরার ধুম। এক হাতে কত আর কবর খোঁড়া যায়? তবুও মাটির আকাক্সক্ষা নিয়ে? কোদাল কুপিয়ে কুপিয়ে কবর খুঁড়ি আমি। যে মরা মাটির ভেতরে যায়, তারাই রাজহাঁস হবার সাধ জাগে। ওই রাজহাঁসের সাথে গোপন আলাপ করে দেখেছি। তাই তো বর্ষা এলেই আমি আর কবর খুঁড়তে কেয়ার করি না। জানি তো, বর্ষায় যারা যারা মরবে তারাই মাটির পূর্ব দিক দিয়ে উড়ে যাবে রাজহাঁসের মতো।



৩.
তুমি বাঁকা বলে আমার আঁকা সহজ হবে কেন? তাই তো আমি এই ছুরিটা নিয়ে দৌড় দিয়েছি মরাউড়ার বাঁকে... এখানে কত কার রক্ত কত রকমের ছুরি দিনরাত খেলা করে। আর খেলার ভেতর কারা যেন খালি পায়ে হেঁটে যায়। আচ্ছা তুমিই বলো, পথগুলো কি অতখানি বাঁকা ছিলো যতখানি বেঁকে ছিলো আমাদের পা? তাই তো বাঁকা পায়ের আঁকা পথে হরেক রকম ছুরি পড়ে আছে। এই ধরো এই পৃথিবীতে প্রথম গলা কাটা ছুরিটির কথা। ওই ছুরিটির হাসি শুনতে পাচ্ছো? কী দারুণ হাসি তাই না? কিংবা কবে বলে তো? মনে পড়েছে, পাড়ার কদম যেদিন প্রথম আদমের গল্প ধরলো। কী সব গল্প, ওই গল্পে কি আর মন মজে, তাই তো সোজা চলে গিয়েছিলাম জাদুঘরে, জাদুঘরের ছুরিগুলো কী অসহায়, সব যাদু ভুলে গিয়ে পড়ে আছে আমাদের হত্যা আকাঙ্ক্ষার ভেতর। এই তো কী বেফাঁস রকমের বেলা করে ওঠো তুমি, অথচ ভোরের তলপেটে শাদা শাদা ছুরিগুলো খেমটা তুলে নাচে, আর আমি ঠিকই বুক পেতে দিই ছুরির মুখে, ছুরিগুলো তোমার মতো রক্তের ভেতর এঁকেবেঁকে যায়। কিন্তু কখনো রক্তের চিহ্ন রাখে না তার গায়। তুমি বাঁকা বলে আমার আঁকা সহজ হবে, এমন দাবি কবে ভুলে যাবে তুমি?



৪.
তোমার মৃত্যুর প্রতি তোমাকেই সমবেদনা জানাতে হবে বন্ধু, নইলে পৃথিবীর সব পাখি মরে যাবে। এইজন্য বেছে নাও এমন এক মুহূর্ত যখন বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছে কুলীন পাখি।
ওই পাখিকে পরাণপাখি মনে করে আর ভুল নয়, বরং বৃষ্টির কাছে জেনে নাও কীভাবে নিজের মৃত্যুতে নিজে সমব্যথিত হবে। এই যে ধরো কেউ মরলে শাদা কাপড় কিনে আনো তোমরা, মাটিকে এত মুর্খ ভাবলে? সেই অবধি কত মানুষ মারা গ্যালো, কত পাখি ভিজে গ্যালো আর তোমরা মৃত্যুর শাদা কাপড়ে মৃত্যুর শিরোনাম লিখতে ভুলে গেলে। তোমরা তো কেউ জানলে না মাটিগুলো কীভাবে শীতে কাতরায় আর মাটির শীত তৈরি করে শিরোনামহীন মৃত ব্যক্তিরা। শীতের উত্তর দক্ষিণ নেই বলেই কি তোমরা মরার জন্য শাদা কাপড়ের সাহস পাও, কিন্তু তুমুল বৃষ্টিতে যখন পাখি ভিজে যায়, তখন সে বৃষ্টির ভেতর মরাগুলোকে দেখি নিজের মৃত্যুর জন্য নিজেরায় সমবেদনার কোরাস তুলে। তাই তো নিজের মৃত্যুর জন্য নিজের সমবেদনার ভাষা শিখে নিতে হবে বন্ধু। বেছে নিতে হবে সেই মুহূর্ত, যখন পাখিরা ভিজে যাবে আর সেই ভিজে যাওয়া বৃষ্টির শব্দগুলোই নিজের মৃত্যুর প্রতি নিজের সমবেদনার ভাষা।



৫.
না খেয়ে আছো বলে পৃথিবীর দিকে অমন করে তাকাচ্ছো কেন? পৃথিবীও না খেয়ে আছে। বাহ্! সংবাদটা শুনে কী দারুণ খুশি হয়ে গেলে। পৃথিবীও খুশি হয়েছে। ভেবো না বন্ধু, তুমি না খেয়ে মরে গেলে পৃথিবীও না খেয়ে মরে যাবে। আর ক্ষুধার কথা বলবে তো? আরে ওটা তো একটা প্ররোচনা। জীবন জীবন করে দিনরাত যে আয়ুবাদী চিৎকার শুনা যায় সেই চিৎকারকে বাঁচানোর জন্যই তো পৃথিবীতে ক্ষুধার জন্ম। এই যে এতদিন আয়ুর সংজ্ঞা জানলে তাতে কি ক্ষুধার কোনো কদর দেখতে পাও? একবার কী ভেবে দেখেছ, আয়ু কী প্রতারক। বাতাসের মতো আচরণ যার থান বেঁধেছো দেহে? বাদ দাও বন্ধু ওটা কিছু নয়, ওটা প্ররোচনা, দ্যাখো না পৃথিবীকে কতকাল না খেয়ে আছে। কতকাল আয়ুর বিরুদ্ধে হেলান দিয়ে আছে জীবনের পাহাড়ে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন