সোমবার, ৩১ আগস্ট, ২০০৯
কবি সেলিনা শিকদারের কবিতা
রোমা ক্যাফে
..........
আমাদের সম্পর্কের গিট্টু ছিঁড়ে চলে গেছে সহজাত প্রাণ,
আর প্রতিবেশী শাদা মেয়েটির - প্রিয়তম বয়ফ্রেন্ড।
সকালে প্রায়ই ঘুম থেকে উঠে আমি ঢাকাই বাঙ্গাল আর
ইতালিয়ান বংশোদভুত আমেরিকান নারী ডেবি -
রোমা ক্যাফের নাস্তা টেবিলে দুই জনে একসাথে হই;
পুরুষ জাতির প্রতি ক্ষুদ্ধতায় শুরু করি দিন।
বলি - "পুরুষগুলোকে দেখেছো? ওরা ভালোবাসতে জানে না...
স্বার্থপর...গুল্লি মারো...হ্যাঁ গো তোমার নতুন ছেলে বন্ধু হলো ?"
খয়েরী টেবিলে আমাদের ঘন গাঢ় শ্বাসে প্রশ্বাসে
কেরামেল কফির সুবাস ভাসে বাতাসে,
ভারী গন্ধে বুক ভরে যায়।
কাপে চুমুক দিয়ে ডেবি বলে - "সেটা ছিল ব্লাইন্ড ডেইট।
সৈকতের অন্ধকারে গর্জন শোনার মতো সেই সোল-মেট"।
ম্যাজিশিয়ানের যাদুর টুপির মধ্যে যতোই বাড়িয়েছি
চেতনহীন আচ্ছন্নতার উৎসুক একটা হাত,
বারেবারে ফিরে এসেছিলো সমুদয় পূর্নিমার রাত।
দেখি ঘুরে ফিরে আজো রয়ে গেছি সকলেই গাঢ় অন্ধকারে।
ওই নীল আঁধারের নাম পুরুষ ছিল কি? তাই ছিল...।
বিশাল পুরুষ দেহ ঘিরে অন্তহীন আধাঁরের জল
শুধু নীল অন্ধকারে, নৈকট্য দিয়েছে তারে সবুজের আভা।
আলোর নিচে সে যে আমারই নীল ছায়া - নিয়তির গাঢ় অন্ধকার।
মানুষের জনপদে প্রাণের উত্থান
প্রেম কিংবা জীবনের ক্ষয়,
সবুজের স্বচ্ছ নদীটিতে থেমে গাঢ় লাল বিপ্লবের বান ডেকেছিলো।
আজকের ছায়াহীন ভূমন্ডলে আফ্রিকা- এশিয়া- অস্ট্রেলিয়া-
আরো বহু বিভক্ত হৃদয়। ইতিহাস যেন এই আমারই কাহিনী।
যুগের অচেনা কোনো সময়ের গহ্বর সামনে দাড়াঁনো,
ইউরোপীয় জাহাজের পালে তবু বন্ধ দু'চোখ মেলেছি ,
পলিমাটি দেশটির খোঁজে।
সবুজাভ অচেনা রোমশ বুকে থেমেছিল অভিযাত্রী হাল।
কলম্বাসের ইলিউশনে ভুল-প্রত্যক্ষণে
পুড়েছিল অভিযাত্রী সভ্যতার নক্ষত্রের রাত;
লম্বা চুলদাড়ি ধরে বশ মানিয়েছি যত গোত্রজ সংস্কৃতি।
অসীম সম্প্রীতি বুকে প্রকৃতিকে ভালোবেসে বেঁচে ছিলো যারা
আদিবাসী সেই সব শত শত মানুষকে পদানত করে
রোমশ বুকের ভূমির উপরে আমরা উড়িয়েছি অজস্র পতাকা...
আমাদের ওই মোহ পুরুষের নাম ছিল নর্থ আমেরিকা।
কালের তিলক
..........
রাষ্ট্রের সীমানা বেধে আকাশকে পরাধিন করেছে যে প্রেম,
হৃদয়ের ডানা মেলে কিছুতেই যখন আর স্বস্তি হয়না,
স্বাধীন ইচ্ছায় পেশীপূর্ণ হাতের থাবা যখন - নিয়ন্ত্রন;
নিজের পতাকা গেড়ে যেন এক বনমানুষ হুংকার ছাড়ে;
বর্বর যুগের যে প্রেম মনকে এইভাবে চোরাপথে ধীরে
নিয়ে যায় ক্রমাগত জীবাশ্মের প্রাচীন সংস্কারে -
প্রতিশ্রুতিমুক্ত সম্পর্কের কোষে প্রোথিত জমাট অবিশ্বাস
আর অধুনিক জীবন দখলে রাখে যেই সাম্রাজ্যের প্রেত -
তার থেকে সরে গিয়ে - অপ্রেমের যতো বিস্ফারক ক্ষোভ,
তীব্র রোষ, প্রতিশোধ - ব্যর্থপ্রেমে যতো অপরাধবোধ,
সম্বালহীনের কন্ঠরোধ - সেই সব থেকে যতো দূরে থাকি -
সব স্বার্থপর মোহ থেকে হৃদয় আমার যতো মুক্তো রাখি
ফাগুনের শিওরে দাঁড়িয়ে চেয়ে থাকি যতোই মরু তৃষায়
স্পর্শের বাইরে রুমঝুম সুর সুদূর মেঘের আঙিনায়।
নীল নদ সিন্ধু গঙ্গা তীরে অচেনা কোন জনবসতি থেকে
ইভ যদি আজ বির্বতিত নতুন আদলে হাত ছানি দেয়,
সময়ের দুটি হাত বাড়িয়ে বুকের মাঝে যতো ডাকাডাকি,
মরিচিকা হয়ে বহু দূরে - প্রেমিক পুরুষ - তুমি স্বপ্নবাদী|
তোমার সাম্যের গান রোমান্টিক আবেশের মতো নিরালায়
আমার সমস্ত গাঢ় অনুভূতি ছুঁয়ে কেন পলকে শুকিয়ে যায় ?
হৃদয়ের গভীরতম রোমান্টিকতার নাম সমাজতন্ত্র ?
বুকের গভীর উষ্ণতায় যে শিশুর সুপ্ত স্বপ্ন মিশে থাকে,
প্রজাপতি পাখী আর শিশু - দৃষ্টি সরে গিয়ে থামে তার দিকে,
উল্টো হয়ে ঘুমিয়ে রয়েছে শিশু - বৃষ্টিভেজা ভোরে,
আমাদের হৃৎস্পন্দনে যে শিশু কেঁদে ওঠে ঘুমের ঘোরে
ভ্রুণের ভাষার মতো তার নামও বুঝি সমাজতন্ত্র !
আজকের আদমের মন - অনুরাগে যদি হয় স্নিগ্ধ চাঁদ
পৃথিবীর বুকে শুধু রূপা ঝরা শান্ত এক পূর্নিমার রাত!
ভালোবেসে আজকের আধুনিক ইভ - কেবল স্রোতের ঢল,
হয় যদি আদমের বুকে কোনো নদী - টলোমলো ঢেউজল!
মাঝলা ধবল বক
.............
মাঝলা ধবল বকদের
তোমার কি মনে আছে?
এক সময় বাংলার নিম্নজলাভূমে ছিল ওদের আবাস -
অন্য সব ছোট বড়
জাতের বকের সাথে
বিভিন্ন রঙিন
স্বপ্ন বুনে চোখের সবুজে
বাসা বানাতো পানির ধারে গাছের গেরুয়া ডালে।
তোমার কি মনে আছে মাঝলা ধবল
বকদের কথকতা ?
আষাঢ় শ্রাবনে প্রজনন উৎসবে
বর্ণিল মিহি পালকের
ঝালর উড়িয়ে বকআত্মা শীষ দিয়ে ওঠে - বুঝি আমার স্বদেশ
সরু চঞ্চু তার গর্বে কৃষ্ণবর্ণ - প্রেমের আবেশ ।
দু' চোখের চারপাশে সবুজের খেলা - মোহনীয়া রেশ।
তখন বোঝেনি কেউ
কোনদিকে নদী তার
মারবে গোপন টান
কোনদিকে প্রকৃতির
চোরা ভাটা
কোনদিকে স্রোতের উজান।
বদলে গেছে পৃথিবীর পরিবেশ।
ধরনীর ছোট্ট দেশ - বদলে গেছে বাংলাদেশ।
উড়ালের কালে বিমান বন্দরে বসে
বুকের ভেতর তীব্র আর্তনাদে টের পাই
মাঝলা ধবল সবশেষ বকটার বুকফাটা কান্না।
আমারই অনুভব - আস্তিত্বের প্রতিচ্ছবি যেন
বিলুপ্ত প্রজাতি শেষ - শাদা স্বপ্ন- হায় উড়ে যায়!
যেতে যেতে বুক থেকে খসে পড়া
একটা একটা শাদা পালক
স্মৃতির বর্ণিল রেশ
পৃথিবীতে আজ তাজমহলের শীষ ...
বারবার
কিন্তু উধাও বাতাসে
দূরবর্তী দেশে।
গ্রামে গ্রামে
খালে বিলে
নিম্নজলাভূমে
তুমি হয়তো আমাকে আর দেখবেনা
এক পা আয়েসি
চিরন্তন নিভৃত স্বভাবী|
এতো ভাষায় উপভাষায় কথা কই
নিসর্গের কানে কানে
তবু জানিনা বিরল হতে হতে সময়ের হাতে
নিমর্ম কেন নিঃচিহ্ন হই বারবার
মাঝলা ধবল বক বেশে
সরু চঞ্চু প্রেমগর্বে কালো!
শেষ কথা
(ইরাকের নিপীড়িত জনসাধারণের প্রতি উৎসর্গীত)
.....................
কাহিনী
আজ ভোরে রেডিওতে একটি ঘটনা শুনলাম/ বিবরণে ছিলো মানব মৈত্রীর বাণী/ মন দিয়ে শুনি... মনে ভাসে দৃশ্যাবলী:/
ইরাকের স্বপ্নধৌত এক সাধারণ জনপদ, /হঠাৎ শত্রু সেনাবাহিনীর পদভারে আতংকিত/ ত্রাস ভয় ভেংচি কাটে চারদিকে/ আক্রান্তরা ভীত / যারা আক্রমনকারী (মার্কিন সেনাবাহিনী) ভয়ে আজ শংকিত তারাও। / ভয় এমনই এক রোগ, মৃদু বাতাসের শো শা / শব্দে মার্কিন সৈন্যরা শোনে হিমালয় শৃঙ্গে ঝড়ের মাতম। ভয়ানক ঝড়ের পরেই/ যেন মৃত্যু খুবলে খাবে - দেহ মন/ সীমাহীন সূর্যাস্তের অন্ধকারে অপহৃত সমস্ত জীবন/
সন্ধ্যার আকাশে ডানা মেলে আছে অলিক সময়/ চারদিকে কার্ফিউ তখন। মার্কিন সৈন্যরা দেখে/ কারা যেন আসছে এগিয়ে/
আসছে দ্রুত ক্রমশই মুখোশধারী, কাঁধে কাঁধ/ ঘন দীর্ঘ এক অশেষ মিছিল/ অস্ত্র হাতে কি না, সন্ধ্যার অন্ধকারে দেখা মুস্কিল।/ মুখোশে আবৃত মুখ - মৃত্যুর মিছিলে / রাজপথে কাতারে কাতারে কারা ওরা ভীতিময়?/ সমরসাজে সজ্জিত সেনা সব ভয়ে ত্রস্ত্র/ অস্ত্রের উদরে জ্বলজ্বলে বুলেটের ফুলঝুরি/ বিস্ফারক হুকুমের অপেক্ষায় বাধ্য ভৃত্য - স্তদ্ধ /
সৈন্যদের মনের ভেতর ভয়ংকর ভড় /ছায়া অন্ধকারে আতংকের শত তলা জাদুঘর / সন্দিগ্ধ মার্কিন কমান্ডার, এর মাঝে হঠাৎ তার/ আদেশের দৃঢ় কন্ঠস্বর - "সিজ ফায়ার! সিজ ফায়ার!"/
স্বশস্ত্র বেবাক তরুন সৈন্যরা সব হতবাক/ ওরা ভাবে : আগন্তুক বেশে সমুখে নিশ্চিত যম - /এমন বিপদে তবু কেন হুকুমের মতিভ্রম!/ অগত্যা সৈন্যরা দ্রুত একসাথে নিরস্ত্র সকলে,/ মনে মনে যেন ওরা অবনত মৃত্যুর দুয়ারে/
সেদিন সন্ধ্যায়/ রাজপথে যারা বের হয়/ ইরাকের একদল প্রতিবাদী সাধু / প্রত্যেকে মুখোশ খুলে সৈন্যদের পাশ দিয়ে ধীরে/ নিজ পথে চলে গেলো হেটে। ঘৃনা বিবাদের পরিবর্তে /স্মিত হাসি শান্তিপ্রিয় সকলের মুখে/ (এভাবে সেদিন অকারণ রক্তপাত থেকে সত্যি/ রক্ষা পেয়েছিলো মানুষের বিবাদী স্বভাবে শ্রান্ত পৃথিবীর এক ফোটা মাটি।)
গীতিকা
.........
অস্তিত্বের টানে নিজের জীবনে সব প্রাণ জয়ী হতে চায়।
বিস্ময়ের রঙধনু আকাশের তলে বসে তাই
শতরঙা প্রশ্ন আসে মনে - শত প্রশ্ন করে যাই:
আত্ম সমর্পনে শত্রু মিত্র সত্যি এক সাথে জয়ী হয়ে যায়?
যদি বাঘের সামনে হরিণ আর কোনো সাপের সামনে ইদুর?
জীবজগতের সত্য বেয়ে আজ মানুষের ধর্ম কতো দূর?
সূচালো শীতল তেজি সামুদ্রিক হাওয়ার দিকে
মুখ করে ডুবে যাই আরো এক গভীর বিস্ময়ে:
সমস্যার ছদ্মবেশে সমাধান হাটে পাশাপাশি?
প্রশ্নের সমুদ্রে ভাসি দিনরাত অদক্ষ সাতারু,
বৃক্ষের নিয়মে বিস্তারিত যাবতীয় চিন্তাগাথা
গহীন অন্তরে চিরদিন শত প্রশ্নের শেকড়,
জ্ঞানের সমুখে খুঁজে হয়রান প্রকৃত সত্যের ধ্রুবতারা -
দেখি তাসের ঘরের মতো ক্ষয়া - জ্ঞানের মাপক যতো !
অজানার অন্ধকারে তাই বুঝি দেখি রহস্যের পায়চারী ?
শাদা চোখে দেখি না কিছুই...
অনুমানে বলো কোন পথে তবে চলি ?
যতো প্রশ্ন ততো বেশী না-জানার ভয়, যতো উত্তর তারও ততো অজানা সংশয়,
সবকিছু এক পাশে রেখে তবু মন বলে আজ:
পৃথিবীতে যতো হৃদয় দুষণ, যুদ্ধ
ঈর্ষান্বিত নরনারী
আমাদের চারপাশে তার চেয়ে বহুগুন বেশী সহমর্মী।
মানুষের অনুভবে কত রঙ, কত আশা, স্বপ্ন
কত ভয়
কোনো অনুভব কোনো রঙ তবু শেষ কথা নয়।
দরজার ওইপাশে
..........
বেহালার ছড়ের আবেগে
আড়ঘাতে লেজ নাড়ে বসন্তের পাখী।
সকালের মিষ্টি রোদ কড়া নেড়ে ডাকে:
" সোনামনি ভোর হলো, ওঠো।"
আল্গোছে দরজা খুলে যায়
দরজার ওইপাশে কোনো ঘর নাই।
আমার অজস্র শ্রান্ত সোনামনি অনাদরে
ফুটপাতে গড়াগড়ি যায়।
ঢাকা গেট পার হয়ে দেখি
শহরের আবাসে নিবাসে কতো ঘর,
কতো বাড়ী - কতো দ্বার - কতো দ্বারী!
শুধু আমাদের দরজার
ওইপাশে ঘর নাই।
বাতাসের হুংকার সজোরে বলেছে
"ঘরে যাও, ঝড় হবে দেশে"
আল্গোছে দরজা খুলে যায়
দরজার ওইপাশে কোনো ঘর নাই।
বাংলার আত্মীয় আর পরিবার
পলিথিন মুড়ে
শুয়ে থাকে বাঁধের উপরে।
বন্যার মৌসুমে কতো কতো দানের দরজা
শুধু আমাদের
দরজার ওইপাশে কোনো ঘর নাই।
সুদূরিকা
........
পাল রাজাদের বিজয় স্তম্ভের উর্ধ্ব গ্রীবা গর্বে
নিষাদ ভাষার মতো একটি সুরভী মোমবাতি - স্তম্ভাকার
গত রাতে সারা রাত মাথা তুলে জেগেছিলো
শোবার ঘরের আলো আধাঁরির
সুপ্রাচীন কর্মফল - নির্জন রহস্যে কেউ যেন জেগেছিলো।
অনিবার্য অগ্নিকলা - আলুথালু
তার কাছে নিজেকে আপন মনে
খুলে দিতে দিতে
স্তম্ভ আকৃতির মোমবাতি মন
কতটুকু ধরে রেখেছিলো
আপন সত্তার গাঁথা ?
সেই আদিম আকারে
এতো এতো আল্পাইন সমারোহে?
অঙ্গারিকা মোমের সুবাসে ভাসে স্বপ্নাচ্ছন্ন রেশ;
বাষ্পরুদ্ধ অস্তিত্ব সংকট - চেয়ে দেখি অনিমেষ
অবশিষ্ট ভস্ম শুকে দেখি তবু
দেখি হাওয়ায় হাওয়ায় অন্য এক নতুনের দেশ -
বিশ্বময় বাতাবীর বাসে সবুজ ভাষার দূরদৃশ্য
পৌরানিক সেই এক রত্ন !
জন্মান্তর কিংবা রূপান্তর - তার চিন্তায়
তবু যেন
আমি শুধু এক পরবাসী সুদূরিকা ।
শূন্য হাত
......
ঘুম ভেঙে জেগে পেটে হাত!
আশটে দাঁত মেজে মেজে পরিচ্ছন্ন এক কারখানা ।
মনুষ্য বাজার, কাজ করে ভাত।
ফিরতে পথে থামি মুগ্ধ মনে
রোমান্টিক গান শুনি। মনটা ভাসাই ভারসাম্য বিধানের হরমোন নিঃসরণে ।
বিকেলের বয়স ফুরালে ফিরে আসি
নিজের পিঞ্জরে।
ভাবি বাউল পাখীর কথা।
ঘরের সুইচ টিপে সন্ধ্যাবাতি জ্বালি।
অজ্ঞতা কাটেনা তবু।
এইভাবে সারাটা দিন জীবনের টানে
দেহ আর মন - আমাদের দুজনের বেলা কাটে।
ঘুম ভেঙে জেগে উঠেছি সকালে - খালি হাত,
আবার ঘুমাতে যাচ্ছি রাতে - দেখি শূন্য দুটি হাত।
লেবেলসমূহ:
কবিতা,
সেলিনা শিকদার,
সেলিনা শিকদারের কবিতা
একদিন কথাকীর্তনের রাতে
শাহীন মোমতাজ
একদিন কথাকীর্তনের রাতে’র উৎসর্গ কবিতা
............................
ঝাপসা স্মৃতির দাহ,
দহনক্ষমতা আর নির্বাপণ,
বন্যা আর নদীজড়তার দ্বিধাদ্বন্দ্বময় তোমার প্রস্থান, চোরাবালি আর
অবদমনের মতো মানুষের যাপিত সংসার।
ডাকবাক্স
........
মধ্যরাতে জনসমাগম থেমে গেলে, একা একটি ডাকবাক্স
অধীর তৃষ্ণায় মুখ খুলে বসে থাকে।
আমি মাঝে মাঝে তার কাছে যাই,
তার লাল দেহে হাত রেখে অভিযোগ করি,
বলি, ‘আমার সকল পত্র তাঁর নামে
তাঁর জন্যে অপেক্ষায় ডাকঘর
খুলে বসে থাকি, তবু
অনীহায় অবিবেচনায় তিনি দূর থেকে রহস্য পাঠান।’
রহস্যে কাতর হই, দিকনির্দেশনাহীন হই,
তারপর একদিন সতৃষ্ণ ডাকবাক্স, তার পাশে ডাকবাক্স হই।
পেঁপেগাছ
.......
কারা দিল সরল বৃক্ষের মতো ভঙ্গিমায় ভরিয়ে আমাকে?
এই বৃক্ষে চিররাত্রিদিন, যেন বা সকল বাক্য নিদ্রাকুসুমের মতো
ফুটে আছে।
এইরূপ ফুল ও সংবাদ নিয়ে পেঁপেগাছ।
যাদের যোগ্যতা নিয়ে রাত্রিভর এত আলোচনা,
অথচ কোকিল ছিল গাছে গাছে;
নিরুপম রুপা ও নারীর ভাগ্য জ্যামিতির প্রতিপাদ্য বলে মেনে নিই;
অলক্ষ্যে হাসেন তিনি, যিনি মোর দ্বিধাদ্বন্দ্বে সমতা রাখেন।
আমি রাখি ভূমিহীন, প্রতিমূর্তিহীন হয়ে যথেচ্ছ আচার
আমাদের জন্মগত প্রাণ, সবকিছু একদা গচ্ছিত ছিল পেঁপেবীজে-
এসব স্মরণে এলে বড় ভয়, হীনম্মন্যতার।
ডায়েরি
......
সাদামাটা ডায়েরির পলেস্তারা থেকে
উঠে আসছে আমাদের উচ্ছ্বাসবেষ্টিত হাসি, বিবেচনাবোধ।
যে রাখাল আমাদের তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে, মরুভূমিপথে,
তার নিজেরই কোনো আচ্ছাদন নাই, দেশ নাই-
(তার পিছে অন্য এক অতিরাখালের হাসি শোনা যায়)
লাঠি হাতে দুপুরের বিষণ্ন আবহ থেকে
ধীরে ধীরে অবয়ব ফিরে পাচ্ছে যে রাখাল,
তার মতো পৃথিবী সংকেতময় এই তথ্য আমিও জেনেছি।
২.
মনে হয় ঝড় ওঠে আর তার বিপদসংকেত প্রচারিত হয়। সেই
সংকেতের মানে বোঝে এ জেলার একজন মেয়ে,
সে তার শাড়ি জামা খুলে
ঝড়ের মুহূর্তটিতে আয়নায় সাজতে বসেছে।
দেহতত্ত্ব
....
১.
এ দেহ মরীচিকা অত্র বিবাহের
প্রবাহে ঝরঝর
বর্ষা গান
গোধূলি প্রাপ্তির তাড়না বহমান
শঙ্খ বাজে কেন
ঘোষপাড়ায়
দুগ্ধফলবতী গাভী ও বৃক্ষের
চর্চা করি চলো
রৌদ্রে আজ
চিত্র অনুভূত জন্মতন্ত্রের
বিস্মরণে আর
মুগ্ধতায়।
২.
শারীরবিদ্যায় যারা এইমাত্র প্রবেশ করেছে
তারা জানে কোনো কিছু সংস্থিত নয়
কোনো কিছু সূক্ষ্ম শরীরে আর বিরাজ করে না।
এই কথা অধর্মসম্মত বলে ভীত নই।
ভীতির কারণ ছিল জলাশয়ে নীত।
এবার হেমন্তকালে সেই ব্যথা, জলাশয়,
স্নায়ুবিকলন দেখি আমাকে মুমূর্ষু আর
মুখাপেক্ষী করে রাখে পুনরায় হীনম্মন্যতার।
নাটক
.....
মধ্যবিরতির আগে যে নাটকে নিখোঁজ সংবাদ হলো রামানন্দ রায়,
সেই নাটকের শেষে তোমাকে উজ্জ্বলতম দেখা গিয়েছিল-
রচয়িতা তোমাকেও ভালোবাসে বুঝি।
বীজ
...
বীজের ও যাবতীয় চাষ-প্রকৃতির কথা
তুল্যমূল্য হলে
একদিন কৃষিসমাজের কাছে
কিছু দায় জন্ম নিয়েছিল।
এইসব বীজ আর বাণিজ্য-বাসনা নিয়ে
ভাবপ্রবণতাহীন,
তার ফলে, ছুটে চলে যাই।
হাটবাজারের কাছাকাছি এলে কোনো বীজে
ঘটে যায় প্রাণসঞ্চারণ;
সেইসব গুণবতী বীজ আমি
হাতের তালুতে নিয়ে দেখি;
দেখি আর ক্রমে ক্রমে বুদ্ধিমান হয়ে ওঠে
চাষি-সম্প্রদায়।
ধর্মনারায়ণ
......
ধর্মনারায়ণ বলে এক লোক ছিল
হ্রদের কিনারে বসে, মাছ-সমস্যার কোনো কিনারা হলো না
এই ভেবে তিনি, ধর্মনারায়ণ (জাতিতে ব্রাহ্মণ নন)
জাল ও জীবিকা নিয়ে অপেক্ষা করেন।
এই অপেক্ষার কালটুকু বাদ দিলে তাঁকে নিয়ে
পৃথিবীর কোনো শাস্ত্রে সপ্রমাণ আলোচনা নাই।
তাঁকে সমুদ্রের যাবতীয় প্রাণিকুল জাতি ও প্রজাতিভেদে
বিভক্ত করার হেতু গণ্য করা হয়।
যেহেতু মাছের প্রতি ছিল তাঁর অনিবার টান
তাই তাঁকে কোনো কোনো উপকূলে
মাছের দেবতারূপে অর্চনা করা হয়ে থাকে।
বাতাস ও নদীর নাব্যকথা
...............
একদিন সমস্ত শুকিয়ে গিয়ে পড়ে থাকে
কাদা আর কাদাখোঁচা পাখি।
এবার নদীতে গান- বিভিন্ন ঠাকুর এসে
গেয়ে যান, উপলক্ষ হরিত্ব-সাধন।
আমাদের প্রভু নাই, সাধনার
কত যে পদ্ধতি ছিল ভুলে গেছি; শুধু
ধানের মৌসুম ছেড়ে বাতাসের উড়ে যাওয়া দেখি,
এ বাতাস একদিন সামান্য ঢেউয়ের তোড়ে
মৃদুমন্দ লেগেছিল গায়ে।
বনভোজন
..........
বনভোজনের কথা এইমাত্র হারিয়ে ফেলেছি।
তারপর, কী করি এখন?
স্মরণখোলার প্রভু বাউলের জলসা বসিয়েছে,
প্রশ্ন করি শুধু আর বনভোজনের কথা
কেউই বলে না।
তাই আমি- চিন্তা করো মন,
যদি না প্রকাশ তবে কোথায় গোপন বিবরণ- বলে
লাফ দিই হতভম্ব, জলে।
এইসব দেখেশুনে মুগ্ধ হতে চেয়েছিল যারা,
তাদেরও গোপন কথা ছড়িয়ে গিয়েছে
ঝোড়ো বাতাসের আগে।
তোমাকে উদ্দেশ করি
..............
তোমাকে উদ্দেশ করি। এই প্রাণ, বয়ঃসন্ধিকাল,
বালিকণিকার মধ্যে খুঁজে পাওয়া ব্রহ্মাণ্ড বিষয়,
পতিত জমির জন্য শস্য ও খড়ের এই ব্যাকুলতা- এ সবকিছুই আজ
তোমাকে উদ্দেশ করে রচিত হয়েছে।
প্রায়-অন্ধকারে বসে বিরহসন্তাপ তুমি পাঠ করো।
দেখো এই দিনে, পতঙ্গ ও পশুপ্রজাতির মধ্যে
পড়ে থেকে বেড়ে উঠছে আমাদের চরিতমানস।
আর এই বৃক্ষ রচিত হবার আগে একবার পারিপার্শ্বিকতা নিয়ে,
জলীয় বাষ্পগাথা, পানিসেচ পদ্ধতির ত্রুটি ও বিচ্যুতি নিয়ে
আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল। তারপর পুনরালোচনা।
তারও পরে কতদিন তোমার সংলাপ আমি নিজ কানে করি না শ্রবণ।
তুমি দেখো, আমাদের বিগত জীবন, রীতি, গান-
মূলত যেগুলি ছিল বাস্তবতা- নীতিবিবর্জিত নয়,
নৈকট্যরহিত নয় কোনো কিছু।
তোমাকে উদ্দেশ করি। পৌরাণিক, তোমাতে জন্মের সারসত্য কথা
হারিয়ে ফেলেছি আমি মাত্র গতকাল।
কোনো উপলক্ষ নেই
................
কোনো উপলক্ষ নেই, কে যেন দুপুরবেলা
ডেকে বলে, ‘ভালো হয়ে যা।’
তবে আমি জ্যোৎস্নাজারিত দেহে
চলে যাব যেখানে-সেখানে।
একদিন শাস্ত্র দেখা দিলে,
দলে দলে লোকজন পালিয়েছে
বিভিন্ন প্রকারে।
সংগত হবে না জেনে এইসব ইতিহাস
এইসব পলায়নকথা, কত কী সিন্দুকে রেখে
চাবি ছুড়ে দিয়েছি জঙ্গলে;
তবুও দুপুরবেলা কেন যে গোপনে এসে
বলে যায় ভালো ভালো কথা!
ধর্মের কাহিনী
..........
একদা বিস্ময়চিহ্ন মুছে ফেলে
ধর্ম চুরি করেছিল যে জন দিবসে,
বিভায় কাতর আমি কোনদিকে
মন বলো তার দেখা পাই?
সেই এক মধ্যযুগে নেচে নেচে বিভিন্ন নগরে,
কাদের সমুদ্র থেকে নিয়ে এলে
মাণিক্যসঞ্চয়?
আর কোনদিকে দেখা দাও, কোনদিকে
নদীবর্তী ঠিকানাসমূহ খুঁজে
পৌঁছে যাও শতধা ধারায়?
এসবই জানার কথা, জেনে যাব
আগামী বছরে।
তবুও জন্মের গল্প শোনা হলো
রাত্রি জেগে জেগে;
জানা গেল, জন্মান্তরিত হয়ে পুনরায়
ফিরে আসে চোর।
তুলসীর মাঠে বসে আমি আরো একবার
সেই গল্পে মোহিত হলাম।
পাতা ও রাজকন্যা
................
গাছের পাতারা, দেখা গেল
মাঝে মাঝে নিজেদের মতো করে ঝরে।
একদিন পাতারা যেই একটু হলুদ হয়েছে কি,
অমনি বিড়াল দৌড়ে তার পুলিপিঠা নিয়ে পালিয়ে গেল অন্ধকারে;
রাজকন্যা তো মরেই ভূত ভয়ে আর বিস্ময়ে!
যে গ্রামে রাজকন্যা থাকে, তার তিন বর্গমাইলের মধ্যে পাতা ঝরে না।
তাই দেখে অন্য দেশের পুত্ররা বিবাহপ্রস্তাব নিয়ে আসে।
রাজকন্যা জানে যে এই সকল প্রস্তাবে কখনোই বিবাহ থাকে না।
শুধু বাগান বানানো দেখে দেখে তার নিয়মিত পুলক সঞ্চার।
এদিকে বিড়াল-অভিমুখী রাজ্যের যাবতীয় ভিক্ষা-উপজীবী,
সংক্ষেপে বর্ণনা করে গ্রামে গ্রামে পাতার মহিমা।
চন্দ্রগ্রহণ
....
রায়বংশ রাজাদের বাড়ি থেকে এক মাইল দূরে থাকে টিবি হসপিটাল।
পক্ষপাত ক্ষয়রোগে তোমাকে ভোগায়- একপক্ষে মরে যাও ধুঁকতে ধুঁকতে, পরপক্ষে রায়বংশ রাজাদের সাদা বাড়িটার মতো, বাড়িটার মারবেল পাথরে ঢাকা সিঁড়িটার মতো দেখা যেতে থাকে তোমাকে আবার। দেশে বড় চোরের প্রকোপ, নচেৎ এই মহামূল্য সিঁড়ি থেকে কোথায় হারিয়ে যাবে ইতালি-টাইলস্? (মধু স্যানিটারি এর ডামি নিয়ে দোকান খুলেছে)
গতকাল, মধুপূর্ণিমার রাতে বিশ শতকের শেষ চন্দ্রগ্রহণ ঘটে গেল।
সারা বাংলাদেশ থেকে এই দৃশ্য দেখা গেল, আর
যারা ছিল জনসাধারণ, তারা যে গরিব, তারা টেলিস্কোপ রাহুকেতু কিছুই জানে না, তাই
খাদ্যগ্রহণ নিয়ে দ্বিধায় কাটিয়ে দিল রাত।
ট্রেন
....
ট্রেন, তার সব চাকা আর পাটাতন
কাঁপাতে কাঁপাতে এই পার হলো মদনমোহন।
ডিগ্রি কলেজের মাঠে রাত্রিবেলা পড়ে আছে হিম।
বাংলা পড়াতেন যিনি, কফিল মাস্টার,
তার দিন তো চলে না, চলে রেলগাড়ি, কুয়াশায়;
জীবনে প্রথম এই কুয়াশায় ট্রেন-চলাচল দেখে
আমি পুলকিত।
তারু বাবুকে নিয়ে লেখা আমার প্রথম কবিতা
............................
তারু বাবু, কিন্তু তিনি লোকসমাজের চোখে তারু বাবু।
কালোমতো ফরসামতো রমণী দেখছেন।
যথাসাধ্য দূরে বসে চোখে রাখছি দৃশ্যগত বেদনার ভার।
হৃদয়ে ধারণ করছি ক্ষণ-দুর্বলতা।
বসন্তকালের কথা। তবু আমি ঢেউ গুনছি।
ঢেউয়ে ঢেউয়ে উঠে আসছে বংশলতা, লালিত্য মাখানো রূপ,
ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পে নদীবর্তী শোক, তাপ, আনন্দ-উদ্ভাস।
বাঁশি বাজে!
যে বাজায় সে তারুবাবু;
তাকে নিয়ে আরো কটি কবিতা লেখার আগে
প্রস্তুতিমূলক এই বাক্যনিচয়ের আমি
স্বয়ং প্রণেতা।
তোমাকে ইঙ্গিতে আমি
.............
তোমাকে ইঙ্গিতে আমি বহুবার
করেছি গোপন
কেন জন্মপ্রকরণ তবু ভুলে গিয়ে
হেমন্তের বিশুষ্ক বাতাসে আমি
অসবর্ণ বিবাহে উন্মুখ?
আমাদের দিনগুলি
এত বেশি আলস্যসূচিত বলে
জলমগ্নতার কথা মনে হয়;
মনে হয়, কোথাও কুণ্ডলী আছে,
জন্মলাভ আছে।
নিতান্ত আগ্রহবশে এই সব প্রতারণা,
গুপ্ত আলোচনাগুলি
গোপন চাবির কাছে জমা রেখে
উপনয়নের দিকে চলে যাব,
দ্বিজত্বপ্রাপ্তির দিকে চলে যাব আমি
কখনো তোমার সঙ্গে দেখা হলে
বইপত্রে, চিকিৎসাবিদ্যায়।
আলস্যবেদনা
..........
একান্ত পুরোনো দিনে ফিরে গিয়ে
বৃক্ষ, তাপ, সালোক-সংশ্লেষ আর মানুষের
অদূরদর্শিতা নিয়ে ভাবি;
তোমাকে বন্ধুর মতো মনে হলো, সেই কথা ভাবি।
অলসতা, বিনীত সূর্যের দিনে
তুমি আসো জাদুমন্ত্রে জাগাতে শরীর।
২.
অনুপ্রেরণার মতো তোমাকে আপন আর
ততোধিক কাম্য বলে মনে হলো সন্ধ্যাগোধূলিতে;
বিগত বাঁশের বনে, শিহরণে,
অঙ্গুলিসংকেত আমি টের পাই
যা শুধু তোমার দিকে বয়ে যাওয়া বোঝাতে সক্ষম।
আমি যে বন্ধুর কথা মনে করি,
সে তার সমস্ত কিছু, ছায়া, উপশম
একান্তে ফিরিয়ে নিয়ে চলে গেছে, দূরে।
রূপমনোহর রাতে, আলো ও আঁধারময়
যে আমি রয়েছি বসে, অলসতা,
তার জন্য দাঁড়াবার অনুমতিপত্র তুমি
জারি করে দাও।
তোমার ইশকুলে আমি ভর্তি হতে এসেছি যখন
...........................
তোমার সকাশে এই দিন, রাত্রির অধিক দীর্ণ
মলিনতাময় গ্রীষ্মকাল।
তুমি বাল্যপ্রেমিকার কথা ভাবো তো এবার;
উনিশ শো তিরাশি সালে যার কথা
একবার ফাঁস হয়েছিল।
এই দেশে বিবিধ সংকট- মুদ্রাবাজারের গতি ক্রমহ্রাসমাণ-
আরো নানা সমস্যা ও
সম্ভাবনা আছে,
তার পরও আমাদের তারল্য-সংকট ঘোচে না তো!
এসব দুর্দশা নিয়ে, তোমার ইশকুলে আমি
ভর্তি হতে এসেছি রে মন।
আমার মফস্বলবাসের ইতিহাস
...................
আমরা যারা কখনো গ্রামে থাকিনি কিংবা গ্রাম বলতেই যাদের মনে ছোট ছোট দৃশ্যময় ছড়াকবিতার স্মৃতিরোচক আবেদনের কথাই ভেসে ওঠে, এই গদ্যে আমি প্রথমেই তাদেরকে সাবধান করে দিতে চাই। আমাদের দেশের হাজারে হাজার গ্রামে হাজারে হাজার বৈচিত্র্যময় কাণ্ড তার ডাল-পাতাসহ বিকশিত হয়ে চলেছে যে কত প্রকারে, কেবল জগদীশ বিজ্ঞানী এই তথ্যটি জানতেন। জানতেন, কিন্তু প্রকাশ করেননি। তাঁর প্রকাশমাত্রই বৈজ্ঞানিক কিংবা নিদেনপক্ষে দার্শনিক, এই কথা এ কালে সাহিত্যচর্চা করতে আসা ভুক্তভোগীরা অবশ্যই জানেন। আর তাঁর সমস্ত অপ্রকাশ আমাদেরকে এক অতি আরামদায়ক ফলফলাদিবৃক্ষসমৃদ্ধ গ্রামভাবনার দিকে পরিচালিত করে এবং যার অস্তিত্বপ্রমাণ নিছক দীর্ঘ আলোচনাসাপেক্ষ।
সে প্রসঙ্গ বাদ। কেননা জগদীশ বিজ্ঞানী সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না।
আমি গ্রাম-সম্পর্কিত আমার তিন পুরুষের অনভিজ্ঞতার কথাই কেবল জানি। তাঁরা ছোট ছোট মফস্বল শহরগুলিতে বসবাস করে এসে কেবল এই ধারণাপ্রাপ্ত হয়েছিলেন যে, শহর হচ্ছে খুব বেশি শহরপ্রবণ আর গ্রাম খুবই গ্রাম্য। তাঁদের ভারসাম্যের নীতি আমরা মানি বা না মানি, মধ্যবর্তীরা সব সময়ই নিরাপদ থেকেছে। আমার মফস্বলবাসের ইতিহাস এ-ই।
২.
গ্রাম সম্পর্কে আমাদের আরো বেশি জানা দরকার। শীতকালের গ্রাম আর গরমকালের গ্রামের মধ্যেকার পার্থক্যগুলি আমার আর কোনো দিনই জানা হয়ে উঠবে না। কেননা পৃথিবীর কোনো গ্রামই এখন আর প্রকৃতপক্ষে গ্রাম হয়ে নেই। যে গ্রামে ফ্যাক্টরিতে তৈরি ম্যাচবাক্স টাকার বিনিময়ে বিক্রি হয় সেই গ্রাম কতখানি গ্রাম?
আমাদের হাজার বছরের আদি ও অকৃত্রিম গ্রামগুলি সামান্য ম্যাচবাক্সের বদৌলতে চারিত্রসংকটের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। এ হলো আফসোসের কথা।
৩.
আমি আপ্লুত হই এই ভেবেচিন্তে যে, শহরের রাস্তায় আর গলিতে গলিতে বিচরণ করে কোথাও বিবৃত হতে পারি নাই। আমার এই সমস্ত ব্যর্থতাকে আমি মহান বলি, কারণ ইতিহাসবিচ্যুতির ফলে লাস্য ও কলহাস্যমুখরিত শহুরে জীবন ভেঙে যাওয়া বৈবাহিক চিহ্নের মতো শরীরে ধারণ করে গুপ্তপথে এইমাত্র ব্যাবিলনের বাইরে এসে দাঁড়িয়েছি।
আমার আর কতটুকু জানা প্রয়োজন?
আমার যেসব সন্ধ্যা
............
আমার যেসব সন্ধ্যা, সায়াহ্নসমূহ
অপস্রিয়মাণ বহু দূরবর্তী সৌরশলাকার ঘাতে
একেবারে পর্যুদস্ত হলো, হয়ে পড়ে থাকল
খুবই পরিচিত এই মাঠে,
আমাদের পূর্বপরিচিত এই রৌদ্রদগ্ধ মাঠে, আর
যে সকল রাত্রিবেলা ক্রমপরম্পরাহীন বাতাস বহন করে
নিয়ে আসলো শীতকালে, গাছের পাতার মতো চুলে
আর অন্ধকারে, ফাঁকে ও ফোকরে,
সেসব সন্ধ্যার কথা সেসব রাত্রির কথা
দুপুরবেলাতে বসে ভাবি।
এ কবিতা লেখা হচ্ছে
..................
[এ কবিতা লেখা হচ্ছে যামিনীতে, মধ্যযামিনীতে।
যেহেতু কবিতা, তাই লেখা হচ্ছে যামিনীতে,
গদ্য হলে রাতের বেলাই হতো উপযুক্ত লেখার সময়।]
একটা সহজ অঙ্কে কাটা পড়ে এ মহাজগৎ।
আহা এ সায়াহ্নে বুঝি মোক্ষ জল,
ফুল-পাতা-ফল।
দেখো, গদ্যকবিতার যুগ ফিরে ফিরে আসে।
ফিরে আসে মধ্যযাম, কবিতা লেখার।
লিখি অঙ্কে ও কথায়, তার পরিণাম
ঘটনাপ্রবাহ; আর
প্রবহনে ভেসে যেতে যেতে ঐ মাথা তুলছে
অঙ্ক-কবিতার
শিরোনাম।
২.
উদাহরণের চেয়ে মিথ্যা বলে
মনে হয় সবকিছু, গদ্যকবিতা।
দিগন্তরেখার পাশে উঁচু উঁচু
তালগাছে সদানন্দ প্রহরী বসানো,
তার ফাঁক ও ফোকর দিয়ে মিটিমিটি
দেখা যাচ্ছে ও মহাজগৎ;
আমি এই পারে বসে উদাহরণের চেয়ে সত্য বলে
নিজেদের প্রতিপন্ন করি।
সত্য নিয়ে আলোচনা
...............
যেকোনো দিনের শেষে, যেকোনো তারিখে
দেখি ফরসা হচ্ছে, ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে
আমাদের অনুবর্তমান।
চিরকাল আমরা যে দেহমনস্কতা নিয়ে জেগে উঠি,
আপন পায়ের চিহ্ন কেন্দ্র করে গোল হয়ে বসি মধ্যরাতে
-তা-ই সত্য।
২.
সত্য নিয়ে যাবতীয় আলোচনা লিখিতই ভালো।
যথা- দক্ষিণায়নের কালে শীত আসে-
ভূগোলে পঠিত এই সত্য কথা
তোমার পুস্তকে নাই।
আমার বন্ধুর নাম সত্যপ্রকাশ ধর- এও যথা।
অযথার্থ বৃষ্টিপাতে আপন বন্ধুর মুখ ভুলে যাচ্ছি- যথা।
৩.
তীব্র চোরাচালানের দিনে, কোনো এক দীর্ঘ বিকালে আমি বসে আছি
তীর ঠেলে উঠে আসা চকচকে বালুসমাগমে,
সীমান্তনদীর।
ওই যুদ্ধে কে ছিল নায়ক?
হিতাকাঙ্ক্ষী বিডিআর ধরে ফেলছে
সমস্ত সংকেত, গুহ্য, চোরাচোখ
চোরাচালানির।
সন্ধ্যাবেলা, তারিণীচরণ
.............
আমাদের তারু বাবু,
বসে থাকে নদীর এ পাড়ে, ভাবে।
‘কী ভাব হে তারু বাবু?’ -প্রশ্ন করি;
‘দেখেন চে, সব নদী মিলায় সাগরে, সব পাখি, চিল,
মুখোমুখি বসিবার সমস্ত প্রস্তুতি আজ তার হাতে।’
আকাশের ওপারে আকাশ ভেবে আমি বলি, ‘তারু বাবু,
সব সত্য প্রকাশ কোরো না।’
আলস্য ও স্বপ্নবিষয়ক বিবেচনা
.....................
চক্ষুনিমীলনে জাগে উদ্দীপনা, বায়ুপ্রভাবিত আর
বৃষ্টিবহনকারী মেঘ উড়ে আসে।
অঘোর বর্ষার দিনে বৃষ্টিকবলিত হয়ে বসে থাকা
আমাদের চূড়ান্ত বিকাশ।
২.
স্বপ্ন, যাকে নৈশকল্পনার সাথে অর্থবিনিময়ে আমি রাজি করিয়েছি।
নৈশকল্পনায় আমি চোর দেখি, সিঁদকাঠি দেখি,
প্রধানত জ্বরের সময়। আর জ্বর হলে
আয়না দেখি না। আয়নার ভিতর দিয়ে একদিন
বহুদূর বিস্তারিত নিকষ বনের মধ্যে ভূত আর
প্রেতের চিৎকার শুধু শোনা যেত;
এখন সেখানে শোনো মধ্যদুপুরের গীতকথা,
এখন সেখানে চোর, সিঁদকাঠি চিকিৎসার মতো এসে
শিয়রে দাঁড়ায়।
তাঁর চিকিৎসাপ্রবণ মন খাতা-কলমের মধ্যে উপনীত
আমাকে বেষ্টন করে আষ্টেপৃষ্ঠে,
জ্বরতপ্ত আমাকে বেষ্টন করে…
এই সব স্বপ্নে, তথা নৈশকল্পনায় ঘটে থাকে।
বৃক্ষ
...
আমাদের সবার মাথায়ই চুল থাকে। যদিও আদিতে আমরা গুচ্ছ খানেক চুলসমেত (বলাবাহুল্য দন্তহীন) ভূমিষ্ঠ হই এবং আমাদের শরীর মৃত প্রোটিন উৎপাদনে কিছুকালের মধ্যেই পারদর্শিতা অর্জন করে। আমরা বিকশিত হই। এটা ঠিক যে, আমাদের চুল সালোক-সংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে না, তথাপি, বৃক্ষশ্রেণীও চুল নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। আর তারা অনর্থক চুলে বিনুনি করে সময় নষ্ট করে না, বরং বায়ুপ্রবাহের কালে দেহের উক্ত অংশটিকে আন্দোলিত করে থাকে। এতে তাদের শরীর আমাদের তুলনায় সমর্থ হয় এই প্রকারে যে, তারা নিজেদের খাদ্য নিজেরাই তৈরি করে নিতে শেখে। বলা বাহুল্য, বৃক্ষশ্রেণীও দন্তহীন।
পতঙ্গ
...
জোনাকি পতঙ্গদেহ আলোবাহী
রেখাময় উপাঙ্গ-সংকুল।
আলোকমথিত হলে
সেই দেহ সূতিকামণ্ডল;
দিকে দিকে ভাসমান
কন্ঠস্বর, চর্বিকণা,
চিরুনিবিমুখ কেশদাম;
হরিণদ্যুতির ছটা তেজোময়
দিকে ও অদিকে।
আমি অদিকের সম্ভাবনা
টের পেয়ে যাই।
ইঙ্গিতে সারিয়ে ক্ষত
কত জীব, কত কত প্রাণ
আরো প্রাণবন্ত করে,
ধুলাতে লুটাই মরদেহ;
দেহ থেকে দেহাত্মবাদের কথা শূন্যে উড়ে যায়।
ভ্রমণ ১
.......
আমাদের সব জমি বর্গা দিয়ে ফিরেছি এখানে;
অভেদ সাধন হবে এমত বিশ্বাসে
যাবতীয় রহস্যপুরাণ আজ
সবিনয়ে নিবেদিত হলো।
লতা গজানোর কাল শুরু হলে জেলায় জেলায়,
জীবাণুজীবন নিয়ে হরিনারায়ণ রায়
কোথায় বসতি?
২.
এই কার্য বিকাশের
মৃদু মৃদু মন্ত্র শোনা যায়
গ্রামে ও অগণ্য নদী, শীতনদী
কুলকুল-ধ্বনি-শরীরের নিচে রেখে দেয়
মদ আর মাছের কঙ্কাল।
ধর্মচারিণীর চুলে ঘাই মেরে,
চুল নিয়ে পালিয়েছে
নাপিতের ছোট দুই ছেলে।
সে চুলের লোভে
সন্ততিবিচ্ছেদ আর
মাৎসর্য-প্রণালী বেয়ে গেয়ে গান
উজানে উজানে।
ভ্রমণ ২
......
যেমন সরল বীজ
জড়ত্বের জ্ঞান মেনে চলে
শুনি তার নিখাদ ভণিতারীতি
তেমনি সরল গুণে মৃত কাঠে
জ্বেলে গেল পত্র-সম্ভাষণ।
তবে এই স্বয়ম্ভর অভ্রপুচ্ছ শিয়রে ধারণ করে
হা’ আমি কেমন করে
মর্তবাসী হই?
ধুলা-পাহাড়ের কাছে যাত্রীবহনের গরু
ধূলিকাভক্ষণ, আর কেন জানি
বহুবর্ণ চোর এসে
তার সাদা চামড়া ছাড়িয়ে নিয়ে
ফেলে গেছে মৃতদেহখানি।
খসে গেছে শৃঙ্গভয়;
তাই বৃক্ষমোচনের দিনে,
কাঠুরিয়া, আহা কাঠুরিয়া,
শৃঙ্গ বিভাজিত করে আজ তবে রসনায়
চিত্তের বিকাশ।
এই বিকাশনা দূরান্তবাসীর কাছে পৌঁছে যাচ্ছে অতি অপলকে।
আমি সংগীতে অসূয়াবোধে
সেই পথে পালিয়ে গিয়েছি।
ভ্রমণ ৩
.....
[ঘুম গেছে যার সমান্তরাল
ধর্মাধর্ম যুক্ত আড়াল
দিচ্ছে যেমন দিচ্ছিল সংবাদ
পাত্রে জাগে সেই মনোবল
ঘোর পাপে যার কণ্ঠ বিকল
কী উপায়ে দিচ্ছিল সংবাদ?]
এই সাড়াশব্দহীন
উল্কাপতনের পাশাপাশি,
অন্ধকার কক্ষ থেকে কত দ্রুত ছুটে যাচ্ছে ঘুম।
‘কে দেবে এমন পুণ্য’- বলে যেই প্রসারিত হাত,
দেখি তার সংখ্যাগণনার মতো বেড়ে ওঠে প্রবাদ বয়স।
তারপর বৃষ্টি ধারাপাত।
ঘুমের বিস্ময় থেকে যতিচিহ্ন
তুলে নিচ্ছ কারা?
সেইহেতু, স্বপ্নমাহাত্মের কাছে
কোনো এক গভীর রাত্রি রেখে
চলে গেছি বিশ্বভ্রমণে।
গৃহ
...
আজ গোত্রবিবাদের বাক্যরীতি
লেগে আছে চতুর্দেয়ালে।
এই বেলা, তপোজীর্ণ অরণ্যভূমির মেয়ে,
কত নদী, কত পুষ্করিণী ছুঁয়ে
ফিরে গেছে কয়লাখনিতে।
তবে যারা ছেলে চুরি করেছিল
নির্ধারিত ভ্রমণের মাসে,
তারা রীতিসিদ্ধ, তাই
বিবাদ পারেনি শিখে নিতে। তবু
যাবতীয় সম্ভাবনা একদিন জ্বলে উঠেছিল এই
সৌরকলামগ্ন পৃথিবীতে।
২.
আরো একদিন যদি পরী-ভাষা শিখে নিয়ে
গৃহমগ্ন হয়ে থাকা যেত!
একদিন কথাকীর্তনের রাতে
......................
এখন জঙ্গলপর্ব; মধ্যমাঠে
হঠাৎ গজিয়ে উঠি একা একা
আগাছাসমেত।
দূরের প্রতিমামুগ্ধ লোকালয় থেকে আসে ঘ্রাণ
আর সেই সূত্রে পল্লীবিমুখতা জেগে ওঠে।
যে সকল ভাগচাষি ভোরবেলা
চাষকর্মে নিয়োজিত হলো,
সন্ধ্যা হলে, যাবতীয় কর্ম রেখে
চলে গেল বাতাসের দিকে।
আহা কী আশ্চর্য দেখো,
সন্ধ্যা হলে পাখিরা ডাকে না।
সন্ধ্যা হলে বাঁশ চুরি করে ফেরে
গ্রামে গ্রামে বিভিন্ন মানুষ।
ভূতেরও প্রশ্রয়লিপ্সা জেগে ওঠে,
একদিন কথাকীর্তনের রাতে
যদি সন্ধ্যা হয়।
যে পথে নিবিষ্ট হয়
................
আর তুমি নদী, প্রতিটি রাত্রির শেষে
কুয়াশা মাখানো মুগ্ধতাকে পেছনে ছড়িয়ে দিয়ে
অম্লধারণায় ফিরে গেছ।
যে পথে নিবিষ্ট হয় প্রথাপার্বণের দিনে
শ্রুতিনিষ্ঠ মন,
একদিন, তোমাকে আমার মধ্যে
প্লাবনসংকেত নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখে
আমি সেই পথ, নদী, জনসম্মুখে হারিয়েছি।
আরো কিছু জল, আরো জাহাজডুবির কথা
জেনে যাওয়া বড় বেশি প্রয়োজন ছিল।
লগবুক ১
...........
১.
দেখা যাচ্ছে, কোনোরূপ প্রচেষ্টা ছাড়াই জীবনধারণ করা সমীচীন। কিছু আগাছা-কুগাছা ঘেঁটে আমাদের চিকিৎসাবিজ্ঞান এই গোপন রিপোর্ট এনে দিল। মেডিকেল কলেজগুলিতে কীরকম লেখাপড়া হয়, এ ব্যাপারে ছাত্ররাই বলতে পারবেন, কারণ তাদের জন্য সরকারি বরাদ্দ রয়েছে। খানাতল্লাশি থেকে নিজে রেহাই পেলেও কোমরে দড়ি বেঁধে আমাকেই নিয়ে যাচ্ছে সশস্ত্র বাহিনী- এই স্বপ্ন কেন দেখো ভাই? আমি ভদ্রলোক, যেকোনো স্বপ্নেই আমি ভয় পেয়ে পলায়ন করি। কোমরে খাগড়াই বেঁধে নিয়ে যাবে, তোমার বারান্দা থেকে এই দৃশ্য দেখা যাবে; জানি শূন্যে উড়ে গেলে মন আরো কিছু বাকি পড়ে থাকে, তবে তোমার সম্মানে আমি একটি পালকমাত্র রেখে যাব। তবু যদি কখনো আগ্রহ জন্মে পৌরাণিক বিষয়-আশয়ে!
২.
কীভাবে মনুষ্যজাতি সভ্য হলো এ সভার এটা হোক আলোচ্য বিষয়;
কেননা দেখাই যাচ্ছে লেজ নেই, মাছিদেরও নেই- এসব বিষয় নিয়ে কিছুক্ষণ গল্প করুন মহোদয়!
৩.
এবারে প্রেমের কথা বলি। জলে না ডোবাল তারে না ডোবাল কুলের কালিমা। মহত্তম ব্যক্তিদের সৃজনশীলতা নিয়ে ভাবনা হয় প্রতি সন্ধ্যাবেলা- তবু, কবিতা লেখার জন্য কাগজের নিত্য প্রয়োজন।
৪.
আমাদের মধ্যে যার বয়স একটু বেশি, তিনি বিবাহিত। তাই শ্রদ্ধা-অবনত হয়ে তাঁর কথা আলোচনা করি। বিগত শীতের কথা, অগ্নিমান্দ্য, কলেরা কীভাবে গত শতকের প্রাণসংহার করেছিল, এবং নিদ্রার কথা; নিদ্রাযাপনের মতো ভালো কাজ আছে পৃথিবীতে?
৫.
প্রতিদিন অবিশ্বাস করি। এই যে জীবিত আছি তিন বেলা, খাদ্য খাই, ডিম খাই- সে তোমারই ব্যবস্থাপনায়। চর্বির ভেতরে থাকে হৃদরোগ; দয়াময়, কেন তবু একে তুমি সিদ্ধ করেছিলে?
৬.
আমার বন্ধুকে আমি দেখতে যাব কাল;
তার স্বামী ইঞ্জিনিয়ার, তার দুটি ফুটফুটে শিশু,
যমজ সন্তান।
তোমার পুরোনো বন্ধু
................
তোমার পুরোনো বন্ধু প্রাচীন শ্যাওলায় ঢাকা দেয়ালে
বিদ্যুচ্ছবির মতো দেখা দিয়ে পুনরায় আরো কত
অস্তিময় শৈবালচিত্রের মধ্যে ডুবে গেল।
তাকে দেখে নিয়ে তুমি
দুপুরের খরদাহ ব্যর্থ করে চলে যাচ্ছ,
যেখানে যাবার কথা ছিল।
একটি ডাকঘর আজ পথে পড়ে;
তার দিকে কিছুমাত্র দৃষ্টিক্ষেপণ করে পুনঃগমনের দিকে,
সুতরাং, পৃথিবী বেদনাময়- এই বাক্য প্রমাণিত হলো।
দূরত্বের কথা তুমি ভাব।
বিভিন্ন হাওয়ার মধ্যে যান-চলাচল
খুবই দুরূহ ব্যাপার বলে মনে হয়।
তবু চৈতন্যদেবের মন্ত্রে নয়দিকে ভেসে উঠছে
তোমার বন্ধুর স্মৃতিকথা।
একটি দিকের কথা গোপনে রাখাই বুঝি ভালো;
যেন সবকিছু প্রকাশিত হলে
যেন পরিণত মানুষের দেহাবয়ব নিয়ে
গৃহমুখে চলে যেতে হবে।
যে দেবতা মদ ভরে দিয়েছিল নারীদেহে,
তাঁর কথা এইমাত্র পৌরাণিক অভিধানে পাই;
তাঁর কথা সকলে জানে না শুনে
তৃতীয় বারের মতো অবিন্যস্ত হয়েছিলে
তুমি একদিন।
ভ্রমণ বিষয়ে আরো একটি কবিতা
........................
চৈত্রকুল, এই নামে তোমাকে ডাকছি
যাব অন্নদানগর,
আজ সারা দিন গত বছরের মতো বৃষ্টি হোক
তাতে কোনো অসুবিধা নাই।
যাব অন্নদানগর, যদি টিকিট চেকার এসে মাঝপথে নামিয়ে না দেয়।
২.
ভবানী জংশন!
রাত তিনটায় আমি ভবানী জংশন দেখে ঘুমিয়েছি
তবে কোনো স্বপ্ন দেখিনি। তবে তার জন্য মন আমি
সদাই খারাপ করে রাখি।
এই মন-খারাপের মধ্যে জাগে টান, বাস ভ্রমণের স্মৃতি-
যাকে পদার্থবিদ্যায় ফেলে পুনরায় বিবেচনা করা যেতে পারে।
৩.
রসায়নে প্রভূত আনন্দ তুমি পাও;
বলো তো আমার এই দেহসদাশয় কোন জৈবঘটিত ফলাফল?
বেঁকে যাওয়া মেরুদণ্ড, দন্তবিকাশনা- এ সবই উল্লেখযোগ্য
বলে মনে করি;
কবিতায় এসব উল্লেখ করা সাধুতা ও কিঞ্চিৎ নৈতিক বলে মনে করি।
কারণ ভ্রমণ নিয়ে এর বেশি কথা বলা ধর্মে নিষেধ।
কম্যুনিটি সেন্টারে, বিবাহসন্ধ্যায়
..................
সকলের মনের মধ্যে ‘যাত্রা’ শব্দটি ধ্বনি তোলে। ‘দূরের যাত্রায়’- এই শব্দসমষ্টিও অতিথিসকলের মনের মধ্যে গুঞ্জরিত হয়। কিন্তু আমি জানি, কোন জাতীয় টানাপোড়েন মানুষকে তার আদিধর্মে স্থিত রাখতে বদ্ধপরিকর। সকালবেলার সিদ্ধান্ত খুব মজবুত আর সহনশীল নয়। মাঝে মাঝে খাদ্যরুচি, পোশাকচেতনা আর হৃদয়দৌর্বল্য তার গোড়া ধরে নাড়াচাড়া দেয়। তাকে হীনম্মন্য করে।
তাই, বরপক্ষের জন্য নির্ধারিত খাবারঘরটির দরজায় দাঁড়িয়ে তারু বাবু কেবল তৃষ্ণাদেবীর কথাই ভাবছেন, কোমল পানীয় সহযোগে। তাঁর চোখেমুখে গভীর প্রত্যয়। কারণ ‘তৃষ্ণা নিবারিত হলো’ শিরোনামে যে কবিতা তিনি প্রায়শ লিখে থাকেন, তার প্রথম বাক্যেই আছে- দুর্ঘটনা।
এখন কম্যুনিটি সেন্টারের বাইরে সন্ধ্যা নামছে। কাকপক্ষীও ঘরে ফিরে যাচ্ছে। আর শব্দদূষণের মধ্যে থেকে সন্তর্পণে উঠে আসছে বার্তাবাহকেরা।
দেখো, কোমল পানীয় সহযোগে দেখো বর এল কি না।
মেঘ ও বৃষ্টির কথা
................
যত দূর দৃষ্টি দিলে মেঘ ও বৃষ্টির কথা
বিষয়ভাবনা হয়ে ওঠে,
তারও চেয়ে দূরে কোনো ডাকপিয়নের কথা মনে করো।
নৈশ বিদ্যালয়ে আর তুমি যে সায়াহ্নে থাক
সেইখানে এইমতো বৃষ্টিপাত ঘটে।
ঘটে যাওয়া এসব বৃষ্টির মধ্যে
‘পরার্থপরতা’, ‘রূপ’ প্রভৃতি শব্দের অর্থে
ধীরে ধীরে নানা অর্থ প্রতিভাত হয়, ধ্বনিগত ভেদাভেদও ঘটে।
এসব ধ্বনির মধ্যে আরো কত
প্রকরণ, সিদ্ধ-ব্যাকরণ এসে লুকিয়েছে
একে একে তা-ও তুমি লিখে রাখছ নোটবুকে,
মুষলধারায়।
রিটার্ন লেটার অফিস
.............
চিঠিপত্র সব সময় ঠিকানায় উল্লিখিত প্রাপকের উদ্দেশে নির্ধারিত ডাকমাশুল প্রদানসাপেক্ষে প্রেরিত। কিন্তু যেসব চিঠির প্রাপক নিরুদ্দেশ কিংবা বনবাসী, তাঁদের কথা সব সময় চিন্তা করেন এরকম একজন সুহৃদ সরকারি বিধিমোতাবেক নিয়োগপ্রাপ্ত হন। প্রতিটি খামবন্দি চিঠি আমাদের নিকট রহস্যবিষয়ক অমীমাংসা আরো অধিক জাগিয়ে তোলে। একজন বেতনভোগী ডাক-কর্মচারীর মনে এরূপ রহস্যের অনুভূতি দীর্ঘ চাকরিজীবনের একঘেয়ে কর্মপরিকল্পনার ছত্রচ্ছায়ায় তীব্র হয়ে উঠতে কখনোই পারে না। তবে একজন সুহৃদ আমাদের পক্ষে ঈর্ষণীয় একটি পদে অধিষ্ঠিত থেকে পত্রলেখকদের মৌলিক চিন্তাভাবনা ও জ্ঞান গভীর মনঃসংযোগে অধ্যয়ন করেন। শোকপত্রগুলি আনন্দপত্রসমূহের বিপরীতে শর্টিং করা হয় কি না- শুধুমাত্র এটি ছাড়া আর কোনো বিষয়ে কৌতূহল প্রকাশ করবার অনুমতি কর্তৃপক্ষ কাউকে প্রদান করেন না। কঠোর গোপনীয়তার মাধ্যমে চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত বেওয়ারিশ দর্শনপত্রগুলি তাই ভষ্মীভূত করে ফেলা হয়।
ইতিহাস
......
ইতিহাসের ক্রমপরম্পরা বিঘ্নিত হয় মূলত মানুষের, রাজাদের দায়িত্বজ্ঞান ও সময়নিষ্ঠার অভাবহেতু। কারণ, পূর্বনির্ধারিত ঘটনা সংঘটনের কালে তাঁরা যথাযথ প্রতিক্রিয়া দেখাতে ব্যর্থ হন। আমাদের ইতিহাসবেত্তাগণ তাঁদের নিজ নিজ দেহমধ্যস্থ প্রবাহিত রক্তধারাকে পানি করে (পুনরায় সেই পানিকে রক্তে পরিণত করে) হারানো সূত্রগুলি উদ্ধারে তৎপর হন। যেহেতু ইতিহাসের মধ্যে সত্যের কিঞ্চিৎমাত্র অপলাপ সহ্য করা হয় না, তাই সংগত কারণে মহামতি আকবরের ছেলেবেলাকার ব্যক্তিত্ববিষয়ক চিন্তাভাবনাগুলি ইতিহাসের কোনো ক্লাসের বইয়েই স্থান পায়নি। এ বিষয়ে এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া ইতিহাসের মেধাবী ছাত্র জনাব আবুল ফজলও তাঁর জ্ঞানের স্বল্পতা আমাদের কাছে স্বীকার করেছেন, লজ্জাসহকারে।
শোয়া, বসা, দাঁড়ানো
...............
সরল কথোপকথনের মধ্যেও বিবিধ জটিলতা বিদ্যমান। কখনো কখনো সম্বোধনের ক্ষেত্রে যে বিস্ময়বোধক চিহ্নটি লেখ্যরীতিতে ব্যবহৃত হয়, সেই চিহ্নের মতো করে উদ্দিষ্ট মানুষটিকে চিন্তা করা সকলের পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না। শোয়া বসা ও দাঁড়ানো- মানুষের এই তিনটি অবস্থানকে একটিমাত্র চিহ্নে প্রকাশ করা নীতিবহির্ভূত ও অসম্ভব। স্বতঃসিদ্ধ এই যে, কেবলমাত্র দণ্ডায়মান ব্যক্তিটিকে তার পরিপার্শ্ব সম্পর্কে সচেতন করা সমীচীন নয়। কেননা গ্রামবাংলায় জীব ও জড়সকল অনুভূমিক- জীবনযাত্রা ও চিন্তাভাবনায় এই মতের প্রাধান্য ও সত্যতা লক্ষ্য করা যায়। সমাজজীবনে, পারিবারিক এমনকি ব্যক্তিগত জীবনেও মানুষ ত্রিবিধ বিঘ্ন অতিক্রম করে চলতে পারে না। সৃষ্টির শুরু থেকে মানুষ মূলত এই তিন শ্রেণীতে বিভক্ত হয়ে আছে।
ভালো ও মন্দ
..........
ভালো ও মন্দ- এই দুই ধরনের চেতনা বিদ্যমান। নীতিবাক্যগুলি যে সকল সময় ব্যাকরণ মেনে চলে না, তা লক্ষণীয়। এই বিষয়ে গ্রাম্য পণ্ডিত তাঁর বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া উনিশ শতকীয় টোল স্মরণ করে যে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন, তার উত্তাপ আমরা বহু বছর পরেও টের পেতে থাকব। তবে আমাদের কিছুতেই মনে পড়বে না যে, ত্রেতাযুগের আধিপত্যবাদ বিষয়টি নিয়ে কারো কোনো থিসিস লিখবার প্রয়োজন হয়েছিল কি না। এখন, বর্তমানে, সকল বিষয়ই মূর্ত- এই কথা তুমি আমি কেউই নিশ্চিত করে বলতে পারি না। অমূর্ত বিষয়ের প্রতি, তার অন্তর্গত রহস্যের প্রবল প্রতিপত্তির প্রতি কবিদের লোভ চিরন্তন। এই লোভের বশবর্তী হয়ে কবিতা লিখে কবিরা খ্যাতি অর্জন করেন।
বৃষ্টি
...
বসে আছি প্রাথমিক বৃষ্টি-ব্যাকুলতা থেকে
অংশত বিচ্ছিন্ন হয়ে রাত্রিবেলা, একা।
অন্ধকার তরঙ্গিত করে দিয়ে কোনো শব্দ নাই,
আন্তনগর ট্রেন ফেল করা গন্তব্যরহিত যাত্রীসকলের আর্তনাদ ছাড়া।
২.
ইশকুল পালানো খুদে ছাত্রটির মনে আজ মেঘবৃষ্টি;
আসন্ন কাদায় মাখা দেহ নিয়ে প্রত্যাবর্তনের কথা ভাবা তো যাবে না।
ভিজে যাওয়া বইপত্রে শিক্ষকপ্রদত্ত যত নির্দেশনা, গুরুবাক্যসমুচ্চয়
রসসিক্ত হয়ে যাচ্ছে ক্রমে।
৩.
অসুস্থতা উঠে আসে গোপন শক্তির মতো
অগোচরে, ভিন্ন পরিচয়ে;
তবে তার বারিপতনের নাম কেলাসন, অদ্রবীভবন।
৪.
কহতব্য যা কিছু তোমার কাছে,
একটি সুরেই নিবেদিত
তোমারই প্রেষণে গীত কোমল নিষাদ।
আয়না
....
১.
আমি জাদুকার্পেটের কথা, চোরাগোপ্তা খুন আর
সফল শিকার নিয়ে লেখা গল্প তোমাকে জানিয়ে যেতে চাই,
আর ব্যাকরণে নিপাতনে সিদ্ধ বলে কথা আছে-
সেই কথা তোমাকেই বলা প্রয়োজন।
২.
কেন পাশের বাড়িতে কেন মাঝরাতে আলো জ্বলে ওঠে?
আর প্রত্যেকটি বিদায়পর্ব ভোরবেলা অনুষ্ঠিত হয়?
আর সন্ধ্যাবেলা অন্ধকার হয়ে আসে সূর্য ডুবে গেলে?
এরকম জন্মসফলতা নিয়ে কেটে যাচ্ছে খ্রিষ্টীয় শতক।
৩.
জন্ম বিষয়ে আমি আরো কিছু কথা বলি শোনো-
তোমাকে সংশয়বাদী বলে মনে হয়, মনে হয় আয়না তোমাকে।
মহাবরিষন
.............
বর্ষাবিগলিত হয়ে দেখো চেয়ে
নদীর বিস্তার;
ব্রিজের ওপর থেকে
ফুলে ওঠা, দুলে দুলে ওঠা;
প্রথম সাক্ষাতে দেখো ভিজে যাওয়া,
কাকে বলে মহাবরিষন।
তুমি তারও চেয়ে বেশি ভেজা
কৃষ্ণাঙ্গ শিবিরে বসে ধ্যান করো মন,
করো কাকুতি মিনতি তুমি ‘এই ভিজে
মেঘের দুপুরে’।
২.
পথিপার্শ্ব এলোমেলো করে দিয়ে
বৃষ্টিবাতাসের তোড়ে ভেসে যাচ্ছে
একমাত্র চিঠি;
চিঠির প্রাপক জানে কাকে বলে মহাবরিষন।
গার্হস্থ্য
......
এখনো নিজের মধ্যে, পূর্বতন অভিনিবেশের মধ্যে,
নিম্নস্বর, সমস্ত সংবাদ, স্মৃতি, বিশ্বকোষ পার হয়ে
চলে যেতে চাই।
ক্রমান্বয়ে ঋতুবিভ্রাটের দিনে, শীতোষ্ণ পৃথিবীপথে দেখা হলে
চকিতে সম্ভব হবে স্বগৃহপ্রবেশ।
তোমাকে দুর্বল আর
চৈতন্যরহিত ভেবে কাজে নামি।
যদিও নিজের মধ্যে প্রবেশের পথ করে নিতে নিতে
বার্তাসূচকের কাঁটা কেঁপে ওঠে, দেখায় মধ্যাহ্নস্বর, জলদগম্ভীর।
তারবার্তা
...........
তুমিও তো রচয়িতা, তারবার্তা,
তুমিও নিবন্ধকার।
গোপন সংকেতে, চিহ্নে ভরে তোলো আমাদের
বর্ণপরিচয়।
২.
অতটা বছর আগে, গ্রামান্তরে
প্রথম টক্কায়
সকলের মুখে মুখে
দূরবর্তী স্বজনের শোক আর
আনন্দ-উদ্ভাস।
৩.
দূরের সম্পর্কসূত্রে বন্ধুপরিজন
নিভে যাওয়া আলো নিয়ে দেখা দিল
সতেরো পৃষ্ঠায়।
৪.
লিখেছি সরল বাক্যে নদীবর্তিনীর নাম
নদী তবু প্রবাহিত হয়।
লগবুক ২
........
সররাচর আয়নায় আমরা যে প্রতিবিম্ব দেখি তা অসদ্- এ কথা বিজ্ঞানমাত্র স্বীকার করে থাকে। একজন অন্যমনস্ক পাঠক তার ব্যাকরণজনিত জ্ঞানে আস্থাশীল থেকেও ভুল বাক্যে চিন্তা করে বসতে পারেন। তার এই চিন্তা তথা জ্ঞানপ্রকরণকে যথাযোগ্য মর্যাদা প্রদান করেন কেবল কবি। কবিরা জানে, একদা গর্জনশীল চল্লিশা বলে এক ভয়ঙ্কর সমুদ্রসংঘাত এসে উপস্থিত হয়েছিল পালতোলা জাহাজের সামনে। জাহাজের কাপ্তান আর তার অনুসারী নাবিকবৃন্দ ভয়বিহ্বলতা কাটিয়ে উঠে কীভাবে আবার সেই জাহাজকে শান্ত সমুদ্রের দিকে ধাবিত করেছিল, তা-ও আজ ইতিহাসের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে। তাদের শরীরে লবণাক্ত বাতাসের স্পর্শে জেগে উঠেছিল দেড় হাজার বছরের ক্রন্দন আর হতাশ্বাস। আর তারও মধ্যে থেকে অনুসন্ধানের দায়, আবিষ্কৃতি, যদিও বা পাঠকের এ বিষয়ে তৎপরতা লক্ষণীয় নয়, হঠাৎ সামনে এসে আমাদের ব্যতিব্যস্ত করে। আমরা নাবিকবৃন্দ, আবারও আয়নার সামনে প্রতিবিম্বটির দিকে তাক করে আমাদের সমস্ত কম্পাস নিয়ে বসি।
কোনো দিকনির্দেশনা, পাল তোলা,
বহু পূর্ব-পশ্চিমের এই বিশ্বে ঘটে যায় যদি!
যাত্রা
...
[প্রথমত, যাত্রার কথাই মনে আসে। যাত্রাই প্রকাশযোগ্য গমনশীলতা]
নিষ্কৃতির জমাট পাহাড়ে দৃষ্ট, রুক্ষতর মাথার উপরে চাঁদ ঢেকে যাচ্ছে
সাদা-কালো মেঘে। দূর থেকে ভালো বোঝা যাচ্ছে না শরীর নিয়ে
একটু একটু বোঝা যাচ্ছে এ রকম অবস্থানে দাঁড়াচ্ছে সবাই।
তাদের সাক্ষী রেখে যে-কেউ বিশ্বাস করবে এরকম মতবাদ
আজ আমি পেশ করতে চাই।
সর্বজনাব, এই মধ্যমাঠে, কুয়াশায় শ্বাস নিতে নিতে
আমাদের সকলেরই ক্ষুণ্ন্নিবৃত্তির কথা মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে
চাঁদ বুঝি অসময়ে উদিত হলেন।
আমাদের কথা তাঁর মনে ছিল। মনে ছিল
কার্তিক মেঘের মধ্যে ডুবে যাচ্ছে এই তথ্য, মেঘের সুষমা।
জমাট পাহাড়ে দৃষ্ট, রুক্ষতর মাথার ওপরে চাঁদ ঢেকে যাচ্ছে
সাদা-কালো মেঘে আর ক্ষুধা নিয়ে আমাদের
নিরন্ন কবির দল যাত্রা সবে শুরু করেছেন।
তাঁদের যাত্রায় আমি বিবেকের পার্ট নিতে বহুক্ষণ
ভোলা মন ভোলা মন বলে গলা সাধি।
এবে, যাত্রা হলো শুরু।
গ্রামের সমীপে
.........
এখন গ্রামের মধ্যে বসে থাকা অনেক সহজ
যে নদীর তীর ধরে হেঁটে যাচ্ছে গুণধর মাঝি
ঘুম আর প্রকৃতিজগৎ নিয়ে এখনো যাদের চিন্তা মনোহর
সেই নদী, সেই উপজগতের মধ্যে খুঁজে নিচ্ছি
প্রকৃত প্রস্তাব।
হোক রাত্রি, গ্রামের রাস্তায় যদি দেখা দিচ্ছে বিকলিত মন-
যা শুধু তোমার সঙ্গে বোঝাপড়া হবে না বলেই
বাঁধে শিশুশিক্ষা খুলে বসে থাকি।
২.
পৃথিবীর ধ্যানধারণার চেয়ে শিক্ষকতা ভালো।
ততোধিক ভালো এই বেচাকেনা, পাপক্ষালনের রীতি, পরহস্ত ধন।
তোমার বিক্রয়মূল্যে ভর করে আছে বিস্মরণ;
বিকালবেলার আলো, মুদ্রাবিনিময় আর প্রচারণা
তোমারই দোকান।
পণ্যভারাক্রান্ত হয়ে অধীর আগ্রহে এই চেয়ে থাকা তুলনারহিত।
জীবনযাপন
.........
ধর্ম নিয়ে আমাদের চিন্তা ছিল। চিন্তা ছিল কীভাবে প্রথম ছত্রে
রোদ বৃষ্টি সবকিছু আসে।
আমাদের চিন্তাপ্রণালী নিয়ে আপনি যে বিদ্রূপবাক্য, উপদ্রব এইসব পাঠিয়েছিলেন
তার সবকিছু ভাবাচ্ছে এমত।
‘সেহেতু জীবন নিয়ে কী করিব’- উত্তর প্রসঙ্গে কোনো প্রস্তাবনা নাই।
ধর্মগত প্রাণ নিয়ে রেললাইনের পাশে বসে আছি।
ট্রেন যায়, মালগাড়ি, দেখি।
আমরা দেখনদার। চিন্তা করে অন্য কোনো জন ।
মধ্যরাতে, নিদ্রাযাপনের কালে সেই চিন্তাবিদ এসে কীভাবে তাকায়!
উপজীবকের মতো কিছুটা সংকীর্ণ হয়ে, উবু হয়ে গভীর খাদের দিকে তাকাচ্ছ তাকাও,
তবে লম্ফ দিয়ো না।
বাংলা কবিতার সম্ভাবনা
....................
বিগত পথের পাশে পড়ে থাকা
পাথরের লোভ আমি ত্যাগ করতে
পারিনি মহেশ।
(এখানে মহেশ কোনো ব্যক্তি নয়, শিব)
এখনো ঘুমের মধ্যে শব্দ তুলে
অতিকায় রেলগাড়ি গন্তব্যে পৌঁছায়। তার
বহুবিধ যন্ত্র আর যন্ত্রণার
সাফল্যে নিহিত শেষ হাসিটাই
প্রণিধানযোগ্য বলে মানি।
এখনো ঘুমের মধ্যে নেশা হয়,
রাজনীতি নিয়ে ভাবি।
সম্ভাবনা এখনো রয়েছে তবে বাংলা কবিতার!
বর্ষার রাজনীতি
...........
গভীর সংকট থেকে উত্তরণে ব্যস্ত আছে
গদ্যরচয়িতা।
এই ফাঁকে পালাচ্ছি হে শব্দ থেকে,
উৎপন্ন ধোঁয়ার কালো কুণ্ডলীর বাঁচামরা থেকে।
অন্যতর অভিনিবেশের দিকে
আমাদের আচমকা প্রস্থান তুমি
কলহাস্যসহযোগে আরো বেশি
বর্ষণসম্মত করে গড়ে তোলো,
আমাদের সম্মিলিত পতনের এমত উচ্ছ্বাস, প্রীতিভাজনেষু,
ততোধিক বরষামণ্ডিত করে দিয়ে চলে যাও।
প্রেম
......
গ্রহণেরও আগে ঘটে সম্প্রদান। রাত্রি গভীর হয়।
নৈশপ্রহরীর চোখ ক্লান্তি আর ঘুমে আরো ঘোলা হয়।
তথাপি রাতের দৃশ্যে তাকে দেখে উৎফুল্ল হলাম।
স্বপ্ন থেকে এইমাত্র পালিয়েছে যে সাফল্য,
দুর্বলতা নামে কোনো তস্করের পিছনে পিছনে, তাকে
পুনরায় অর্ধসমাপ্ত স্বপ্নে ফিরিয়ে আনার জন্য
আবার ঘুমাতে চাই, প্রভু।
২.
রাত্রিজাগরণ তবু সম্ভব হবে না, কেন
বইপত্রে মনঃসংযোগহেতু তোমার কথাই শুধু,
ঘুরেফিরে মনে জাগছে দু-একটি বুদ্বুদ।
৩.
শিখা সমাদ্দার তার বাক্স গুটিয়ে নিয়ে চলে গেছে,
যে দিন বিগত তার পিছে পিছে, সম্মেলনকেন্দ্র থেকে
ততোধিক পিছে পিছে চলে গেছে
রাষ্ট্রপ্রধানের গাড়ি, পতাকা হারিয়ে।
সমস্ত শনাক্তচিহ্ন, উপহাস
.....................
আসঙ্গলিপ্সায় আমি
সমুদ্রের কাছাকাছি এসেছি এবার।
সন্ধ্যাকে রাত্রির মধ্যে সমর্পিত হতে দেখে
বহু বছরের প্রথা ব্যর্থ হলো, ব্যর্থ হলো
জেনারেটরের আলো, বৈদ্যুতিক পাখার দ্যোতনা।
এই সূর্যাস্তকালীন মন, মনোবিকলন আমি
অবরুদ্ধ করে দিয়ে উপবাগানের দিকে
আপাতত ফিরে যেতে মনস্থ করেছি।
ঢেউ এসে মালিন্য হরণ করে নিয়ে যায়
কোনো এক রৌদ্রকরোজ্জ্বলতার নিচে, শিশুবাগানের
পাশে তার প্রেম ব্যর্থ করে প্রাপ্তবয়সের
হাসি ছড়িয়ে দিয়েছি পথে পথে।
তাকে মনে পড়ে কি পড়ে না- এই দ্বিধাকল্পে
গত জীবনের সব হাসি-কান্না লীন হয়ে আছে।
ঢেউ তার সমস্ত শনাক্তচিহ্ন, উপহাস দ্রবীভূত করে দিয়ে
ফিরে যাচ্ছে এক সম্ভাবনা থেকে
অন্য কোনো রশ্মিবাগানের দিকে, দ্রুত।
ট্রেন
...
নিয়ে যাচ্ছে রাত্রির ভিতর দিয়ে
ততোধিক গ্রামের সমীপে এই ট্রেন।
উপগ্রহের ছায়া যতটুকু পাওয়া যাচ্ছে- নদীতে, ব্রিজের নিচে- ততটুকু-
রেলগাড়ি তত অন্ধকার দীর্ণ করে দিয়ে
আমার গরিমাসহ ছড়াচ্ছে এ দেশে,
এই গ্রামের সমীপে।
২.
রেললাইনের থেকে ঠিকরে ওঠা চাঁদের কলঙ্ক নাই,
শুধু তার রেলপ্রবাহের সঙ্গে
শব্দহীন প্রতিযোগিতার মতো ছুটে যাওয়া আছে।
অপ্রকৃত গতির রহস্য থেকে মুক্ত হয়ে
প্রকৃত বস্তুর দিকে এইরূপ দিগ্ভ্রান্তি
অনুভব করি।
সম্পর্ক
.....
১.
সকল বাক্যই থাকে অন্তরালে,
তোমাদের সমস্ত গরল।
তবু শান্তি পাই এই মনোভূমিকার কথা চিন্তা করে
একা, সন্ধ্যাবেলা।
পৃথিবীর সকল বিবাহ আজ হয়ে গেছে,
নির্বাপিত সমস্ত সংশয়, তবু
একটি সকাল আর পুনর্জন্ম বিষয়ের
গল্পগাছাগুলি তুমি
এখনো বয়ন করো দেখে ভালো লাগে।
২.
পুরাতন ফ্রিজবি খেলার মাঠে
আমাদের হতে পারত পুনরায় দেখা।
ডুমুরগাছের ডালে, পাতা ও ফলের বাঁকে
তোমাদের হাস্যকাতরতা ফুটে ওঠে;
বিবাহিত মেয়েদের হাসি আর
মনস্কামনা জেনে বড় হই,
প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে উঠি সন্ধ্যাবেলা।
৩.
এবারে নদীর গল্প শেষ হবে।
ছলাৎকার বন্ধ করে দিয়ে যাব
সর্বোপরি তোমার বাগানে;
ঘাসলতাপাতামুগ্ধ চোখে আমি
তাকাব তোমার অভিযোজনার দিকে।
সাইরেন
বাজাতে বাজতে যাবে অ্যাম্বুলেন্স,
‘আমাকে কোথায় নিয়ে যাবে ওরা?
কোথায় রক্ত নেবে?’-
আজন্ম প্রদাহ নিয়ে, মরা নদীটির তীরে
তোমার বিস্তৃত বালুসমাগমে বসে আমি
এই কথা ভাবি।
৪.
এই চোখ, এর কোনো উপযোগ নেই,
জগতের নারীপুরুষের দিকে অবিশ্বাসে
চেয়ে থাকা ছাড়া।
নিজের ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধে নামি।
প্রতি বসন্তের শেষে আমার নিজস্ব ছায়া
আমাকেই পরিত্যাগ করে!
আমাদের মনস্তত্ত্ব যৌথ ভাবাবেগ
আমাদের রক্তমাংস হলুদ কঙ্কাল, সব
সবকিছু সামান্য কথায় কত সহজেই
দীর্ণ হয়ে যায়।
সামান্য কথায় আর অসামান্য গ্রীষ্মকালে
ছায়া কি স্মৃতির সঙ্গে দ্বৈরথে নামি;
সমস্ত বিভ্রম, সুরসংগতির সংগত বাসনা, সব
সবকিছু কত বেশি সারল্যমথিত!
৫.
বস্তুপৃথিবীর আলো ক্ষীণ হয়ে আসে-
মৃত্যু, ঘাম, চর্বিতচর্বণ।
কে আমাকে নিয়ে যাচ্ছে?
কে আমাকে ধরে রাখছে,
আবার ফিরিয়ে দিয়ে যাচ্ছে রে তোতা পাখি,
যাচ্ছে ধনেশ?
কবি শাহীন মোমতাজের কবিতা
শাহীন মোমতাজ
ট্রেন
ট্রেন, তার সব চাকা আর পাটাতন
কাঁপাতে কাঁপাতে এই পার হলো মদনমোহন।
ডিগ্রি কলেজের মাঠে রাত্রিবেলা পড়ে আছে হিম।
বাংলা পড়াতেন যিনি, কফিল মাস্টার,
তার দিন তো চলে না, চলে রেলগাড়ি, কুয়াশায়;
জীবনে প্রথম এই কুয়াশায় ট্রেন-চলাচল দেখে
আমি পুলকিত।
ডাকবাক্স
মধ্যরাতে জনসমাগম থেমে গেলে, একা একটি ডাকবাক্স
অধীর তৃষ্ণায় মুখ খুলে বসে থাকে।
আমি মাঝে মাঝে তার কাছে যাই,
তার লাল দেহে হাত রেখে অভিযোগ করি,
বলি, ‘আমার সকল পত্র তাঁর নামে
তাঁর জন্যে অপেক্ষায় ডাকঘর
খুলে বসে থাকি, তবু
অনীহায় অবিবেচনায় তিনি দূর থেকে রহস্য পাঠান।’
রহস্যে কাতর হই, দিকনির্দেশনাহীন হই,
তারপর একদিন সতৃষ্ণ ডাকবাক্স, তার পাশে ডাকবাক্স হই।
পেঁপেগাছ
কারা দিল সরল বৃক্ষের মতো ভঙ্গিমায় ভরিয়ে আমাকে?
এই বৃক্ষে চিররাত্রিদিন, যেন বা সকল বাক্য নিদ্রাকুসুমের মতো
ফুটে আছে।
এইরূপ ফুল ও সংবাদ নিয়ে পেঁপেগাছ।
যাদের যোগ্যতা নিয়ে রাত্রিভর এত আলোচনা,
অথচ কোকিল ছিল গাছে গাছে;
নিরুপম রুপা ও নারীর ভাগ্য জ্যামিতির প্রতিপাদ্য বলে মেনে নিই;
অলক্ষ্যে হাসেন তিনি, যিনি মোর দ্বিধাদ্বন্দ্বে সমতা রাখেন।
আমি রাখি ভূমিহীন, প্রতিমূর্তিহীন হয়ে যথেচ্ছ আচার
আমাদের জন্মগত প্রাণ, সবকিছু একদা গচ্ছিত ছিল পেঁপেবীজে-
এসব স্মরণে এলে বড় ভয়, হীনম্মন্যতার।
দেহতত্ত্ব
১.
এ দেহ মরীচিকা অত্র বিবাহের
প্রবাহে ঝরঝর
বর্ষা গান
গোধূলি প্রাপ্তির তাড়না বহমান
শঙ্খ বাজে কেন
ঘোষপাড়ায়
দুগ্ধফলবতী গাভী ও বৃক্ষের
চর্চা করি চলো
রৌদ্রে আজ
চিত্র অনুভূত জন্মতন্ত্রের
বিস্মরণে আর
মুগ্ধতায়।
২.
শারীরবিদ্যায় যারা এইমাত্র প্রবেশ করেছে
তারা জানে কোনো কিছু সংস্থিত নয়
কোনো কিছু সূক্ষ্ম শরীরে আর বিরাজ করে না।
এই কথা অধর্মসম্মত বলে ভীত নই।
ভীতির কারণ ছিল জলাশয়ে নীত।
এবার হেমন্তকালে সেই ব্যথা, জলাশয়,
স্নায়ুবিকলন দেখি আমাকে মুমূর্ষু আর
মুখাপেক্ষী করে রাখে পুনরায় হীনম্মন্যতার।
পাতা ও রাজকন্যা
গাছের পাতারা, দেখা গেল
মাঝে মাঝে নিজেদের মতো করে ঝরে।
একদিন পাতারা যেই একটু হলুদ হয়েছে কি,
অমনি বিড়াল দৌড়ে তার পুলিপিঠা নিয়ে পালিয়ে গেল অন্ধকারে;
রাজকন্যা তো মরেই ভূত ভয়ে আর বিস্ময়ে!
যে গ্রামে রাজকন্যা থাকে, তার তিন বর্গমাইলের মধ্যে পাতা ঝরে না।
তাই দেখে অন্য দেশের পুত্ররা বিবাহপ্রস্তাব নিয়ে আসে।
রাজকন্যা জানে যে এই সকল প্রস্তাবে কখনোই বিবাহ থাকে না।
শুধু বাগান বানানো দেখে দেখে তার নিয়মিত পুলক সঞ্চার।
এদিকে বিড়াল-অভিমুখী রাজ্যের যাবতীয় ভিক্ষা-উপজীবী,
সংক্ষেপে বর্ণনা করে গ্রামে গ্রামে পাতার মহিমা।
ট্রেন
ট্রেন, তার সব চাকা আর পাটাতন
কাঁপাতে কাঁপাতে এই পার হলো মদনমোহন।
ডিগ্রি কলেজের মাঠে রাত্রিবেলা পড়ে আছে হিম।
বাংলা পড়াতেন যিনি, কফিল মাস্টার,
তার দিন তো চলে না, চলে রেলগাড়ি, কুয়াশায়;
জীবনে প্রথম এই কুয়াশায় ট্রেন-চলাচল দেখে
আমি পুলকিত।
ডাকবাক্স
মধ্যরাতে জনসমাগম থেমে গেলে, একা একটি ডাকবাক্স
অধীর তৃষ্ণায় মুখ খুলে বসে থাকে।
আমি মাঝে মাঝে তার কাছে যাই,
তার লাল দেহে হাত রেখে অভিযোগ করি,
বলি, ‘আমার সকল পত্র তাঁর নামে
তাঁর জন্যে অপেক্ষায় ডাকঘর
খুলে বসে থাকি, তবু
অনীহায় অবিবেচনায় তিনি দূর থেকে রহস্য পাঠান।’
রহস্যে কাতর হই, দিকনির্দেশনাহীন হই,
তারপর একদিন সতৃষ্ণ ডাকবাক্স, তার পাশে ডাকবাক্স হই।
পেঁপেগাছ
কারা দিল সরল বৃক্ষের মতো ভঙ্গিমায় ভরিয়ে আমাকে?
এই বৃক্ষে চিররাত্রিদিন, যেন বা সকল বাক্য নিদ্রাকুসুমের মতো
ফুটে আছে।
এইরূপ ফুল ও সংবাদ নিয়ে পেঁপেগাছ।
যাদের যোগ্যতা নিয়ে রাত্রিভর এত আলোচনা,
অথচ কোকিল ছিল গাছে গাছে;
নিরুপম রুপা ও নারীর ভাগ্য জ্যামিতির প্রতিপাদ্য বলে মেনে নিই;
অলক্ষ্যে হাসেন তিনি, যিনি মোর দ্বিধাদ্বন্দ্বে সমতা রাখেন।
আমি রাখি ভূমিহীন, প্রতিমূর্তিহীন হয়ে যথেচ্ছ আচার
আমাদের জন্মগত প্রাণ, সবকিছু একদা গচ্ছিত ছিল পেঁপেবীজে-
এসব স্মরণে এলে বড় ভয়, হীনম্মন্যতার।
দেহতত্ত্ব
১.
এ দেহ মরীচিকা অত্র বিবাহের
প্রবাহে ঝরঝর
বর্ষা গান
গোধূলি প্রাপ্তির তাড়না বহমান
শঙ্খ বাজে কেন
ঘোষপাড়ায়
দুগ্ধফলবতী গাভী ও বৃক্ষের
চর্চা করি চলো
রৌদ্রে আজ
চিত্র অনুভূত জন্মতন্ত্রের
বিস্মরণে আর
মুগ্ধতায়।
২.
শারীরবিদ্যায় যারা এইমাত্র প্রবেশ করেছে
তারা জানে কোনো কিছু সংস্থিত নয়
কোনো কিছু সূক্ষ্ম শরীরে আর বিরাজ করে না।
এই কথা অধর্মসম্মত বলে ভীত নই।
ভীতির কারণ ছিল জলাশয়ে নীত।
এবার হেমন্তকালে সেই ব্যথা, জলাশয়,
স্নায়ুবিকলন দেখি আমাকে মুমূর্ষু আর
মুখাপেক্ষী করে রাখে পুনরায় হীনম্মন্যতার।
পাতা ও রাজকন্যা
গাছের পাতারা, দেখা গেল
মাঝে মাঝে নিজেদের মতো করে ঝরে।
একদিন পাতারা যেই একটু হলুদ হয়েছে কি,
অমনি বিড়াল দৌড়ে তার পুলিপিঠা নিয়ে পালিয়ে গেল অন্ধকারে;
রাজকন্যা তো মরেই ভূত ভয়ে আর বিস্ময়ে!
যে গ্রামে রাজকন্যা থাকে, তার তিন বর্গমাইলের মধ্যে পাতা ঝরে না।
তাই দেখে অন্য দেশের পুত্ররা বিবাহপ্রস্তাব নিয়ে আসে।
রাজকন্যা জানে যে এই সকল প্রস্তাবে কখনোই বিবাহ থাকে না।
শুধু বাগান বানানো দেখে দেখে তার নিয়মিত পুলক সঞ্চার।
এদিকে বিড়াল-অভিমুখী রাজ্যের যাবতীয় ভিক্ষা-উপজীবী,
সংক্ষেপে বর্ণনা করে গ্রামে গ্রামে পাতার মহিমা।
লেবেলসমূহ:
কবিতা,
কবিতা : শূন্য দশক,
শাহীন মোমতাজ,
শাহীন মোমতাজের কবিতা
কবি আলতাফ হোসেনের ৩টি কবিতা
আলতাফ হোসেন
কী ভাবে গোছাবে সব?
..............
একজন বলে যাচ্ছেন তাঁর মৃত স্বামীর কথা আর অন্যজন তাঁর
প্রবাসজীবনের। তুমি একবার শুনছ ওঁর কথা আর একবার শুনছ এঁর
গল্প, তারপর ফিরে ফিরে নিজেরও হংসধ্বনি আসছে ভেসে, আর
আবার ভুলতেও পারছ না মার্থা বলেছিল এই তো এমনই সব আর
তার আঙুলের ফাঁক দিয়ে বাদামের শেষ খোসাগুলি...
কীভাবে গোছাবে সব? একবার আগে আগে সব-আগেকারও আগে গুছিয়ে
গুছিয়ে সব তাক, সব আলমারি, ক্লিফটনবালি, ধলেশ্বরী সব ভরে রেখেছিলে...
যা হয় তা হল তারপর সব তুমি জানো,এ মহিলা ও মহিলা জানেন, ছেলে জানে
মেয়ে জানে, কী আশ্চর্য, আশ্চর্য? হ্যাঁ, আশ্চর্যই, তারপরও কেন এক কথা,
একই গান, একই সুর গলায় তুলছে ওরা
মাথা ফাটছে সশব্দে তোমার। তুমি হাসিমুখে উত্তরে ঘোরাচ্ছ চোখ, দক্ষিণে
অন্যবার...
(১৯৯৫)
গাইড মিলনায়তনে, সভায়
................
শুনব বলেই তো এসেছি
এই বিরাট হলঘরটায়
গিজগিজ করছে লোক
সবার মধ্যেই বিচ্ছেদ লুকানো
সবার মধ্যেই হাসি
প্রত্যেকের মধ্যে মৃত্যু
কোথাও নিশ্চয়ই মিল রয়েছে
তবুও সব ঘটনা নিশ্চয়ই আলাদা
ঘরের মধ্যে অনেকদিন থাকা হলো
বিছানায়
নিজের সঙ্গে
নিজের-অনেকের সঙ্গে
সেখানেও গিজগিজ করছিল লোক
বিচ্ছেদ ছিল চাপা-পড়া
হাসিও ছিল
অনেকগুলি মৃত্যু
মনে করেছি হলঘরটায়
সত্যিকারের উত্তাপ পাব
এখানকার ফ্যানের হাওয়া ততটা ঠাণ্ডা নয়
তাই তো পাচ্ছি
অনেক ফ্যানের হাওয়াতেও কেমন ঝরঝরে লাগছে
শীত-শীত করে উঠছে না
কিন্তু মঞ্চে যে একজনের পর একজন উঠে দাঁড়াচ্ছ
উঁচু টেবিলটার সামনে
মাইক্রোফোনের সামনে
কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে চলে যাচ্ছ
কিছুই তো বলছ না
এবার তা হলে শুরু করো -
(১৯৭৮)
ট্রেনের জানালা দিয়ে
................
ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরে তাকানোমাত্র ঈর্ষা হচ্ছে খুব
ফিরে যাচ্ছে শিমূল, সজনে, ডালে বসে-থাকা মাছরাঙা, দোয়েল
যত জোরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে নিয়ে যাচ্ছে গাড়ি আমাকে উত্তরে
দক্ষিণে ততই ক্ষিপ্র বেগে আর আহ্লাদে ছুটছে টিলা, নারিকেল
এখন বৈশাখ বুঝি, আমার তাতে কী, ওরা একে-অপরকে দিচ্ছে সঘন ইশারা
তারপর ফিরে যাচ্ছে, দূর দিগন্তও দেখি ধীরে হলেও ফিরছেন
সেখানে মেঘের বাক্স বর্ণময়, কাঁদিনিস্কি তুলিটুলি হাতে নিচ্ছেন
আমাকে একাকী, ক্রুদ্ধ যেতে দিয়ে ফিরতে-ফিরতে কী ছবি-যে আঁকবেন তাঁরা!
লেবেলসমূহ:
আলতাফ হোসেন,
আলতাফ হোসেনের কবিতা,
কবিতা
কবি তুষার গায়েনের কবিতা ‘উত্তরমালঞ্চ’: তার রূপজগতের রূপকথা-চূপকথা
ফরহাদ মুস্তফা
(*উত্তরমালঞ্চ কবিতাটি আলোচনার নীচে দেওয়া হয়েছে)
‘রূপকথার সৌন্দর্য সম্ভার তাহার জন্য, যে পৃথিবীর সংকীর্ণ আয়তনের মাঝে নিজ আশা ও কল্পনাকে সীমাবদ্ধ করে নাই’।– শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়।
১.
ঠাকুরদাদার ঝুলির রূপকথা ছেলেবেলায় পড়েছি। এর মধ্যে ‘মালঞ্চমালা’ কাহিনীটি অন্যরকম। যখন দাদাজানের কাছে শুনেছি, অবাক ঘুরে বেড়িয়েছি রূপের জগতে। শুনতে শুনতে ঘুম এসে যেত। ঘুমের মধ্যে দেখতাম- একটি মেয়ে বনে বনে ঘুরছে, কোলে তার শিশু। তার সঙ্গে কথা বলে বাঘ, বনের পাখি, গাছপালা, নদী-নালা। আরেকটু বড়ো হয়ে শুনেছি, রূপবান যাত্রাপালাটি। মালঞ্চমালারই কাহিনী। শেষদিকে একটু বদলে দেওয়া। চরিত্রগুলোর নাম ভিন্ন, কিন্তু সুর অভিন্ন। অভিন্ন বলেই হিন্দু-মুসলমান এই কথাবস্তু ও ভাববস্তুর মধ্যে নিজস্ব আত্মার ধ্বনি চিনতে পেরেছে। উভয়ের নিজস্ব সম্পদ হয়ে উঠেছে । এই পালাটির গানগুলির মধ্যে একটি সতীনারীর সমগ্র জীবনের চোখের জলে ভাসানো জীবন-সংগ্রাম যে করুণ আবেদন সৃষ্টি করে, মনে হয়, এই কান্না বাতাসের, ঐ আকাশের, প্রকৃতি আর অখণ্ড সত্তার। খণ্ড খণ্ড হয়ে যে সত্তাটি জীবনের প্রতি বাঁকে বাঁকে কেঁদে ফেরে-‘আমার মিলন লাগি আসছ তুমি কবে’- অখণ্ডের সঙ্গে একাকার হয়ে যাওয়ার আকাঙ্খারই আর্তি এই সব।
২.
গল্পটির দিকে একটু ফেরা যাক। এক রাজার পুত্র-সন্তান হলে রাজজ্যোতিষী বললেন, এর আয়ূ মাত্র ১২ দিন। তাকে বাঁচাতে হলে ১২ বছরের কন্যার সাথে বিয়ে দিতে হবে। রাজা খুঁজে পেলেন- কোটাল কন্যা মালঞ্চমালা। মালঞ্চর বয়স বারো। সদ্য যৌবনপ্রাপ্ত মালঞ্চর সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হল ১২ দিনের শিশু রাজপুত্রের এবং বিয়ের রাতেই শিশুটি মারা গেল। কিন্তু গল্পটি মারা যায় নাই। রাজা ক্রুদ্ধ হলেন ও শিশুর মৃত্যুর জন্য দায়ী করলেন নিষ্পাপ মেয়েটিকে। বললেন, মেয়েটি ডাইনি, ওকে আগুনে পোড়াও। মৃত রাজপুত্রের সঙ্গে মালঞ্চমালাকেও চিতায় তোলা হল। আগুন জ্বলে উঠল।
বৃষ্টি এসে নিভিয়ে দিল সে আগুন। বেঁচে গেল মেয়েটি সতীদাহ থেকে। প্রকৃতি ঘোষণা করল মেয়েটি ডাইনি নয়, সতী নারী। সতী নারীর কোলে শিশু স্বামী- মৃত রাজকুমার। রাতে ভূত-প্রেত এসে মৃতদেহটিকে খেতে চায়। মালঞ্চমালা তাকে আগলে রাখে, ভুতপ্রেত ফিরে যায়। ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথেই মালঞ্চমালা শিশু স্বামীটির প্রাণ ফিরে পায়। এইখানে গল্পটি শেষ হলে ভাল হত। কিন্তু রূপের কথা শেষ হয় না। রাতে ভূত- দিনে বাঘ। কে বলে তাদের ভাগ।
বনের বাঘ এসে কচি শিশুটিকে খেতে চাইল। মালঞ্চমালার ব্যবহারে বাঘ মুগ্ধ হয়, বশ মানে। তারা আর ব্যাঘ্র নয়- হয়ে ওঠে বাঘ মামা, বাঘ মামী। কোনো মানুষ নয়- বাঘই এই একাকিনী মেয়েটির আত্মীয়-বান্ধব হয়ে ওঠে। বনের গভীরে বাসা বানায় মেয়েটি। দুধ আর মধু জোগাড় করে আনে এই বাঘ মামা-মামী।
রাজপুত্র বড়ো হলে বিদ্যালয়ে পাঠাল তাকে মালঞ্চমালা। সেখানে রাজপুত্রের সঙ্গে পরিচয় হল ভিন দেশী রাজকন্যা কাঞ্চীর সঙ্গে। গড়ে ওঠে প্রেম। এর পর অনেক ঘটনা। একটু সংক্ষেপে বলি।
রাজপুত্রের বাবা মালঞ্চমালার শ্বশুর বিপদে পড়ে বনে এলো। তখন জীবন বাঁচায় মালঞ্চমালা। রাজা মালঞ্চমালাকে চিনতে পারে। জানতে পারে তার পুত্র জীবিত। রাজপুত্রকে নিয়ে রাজা ফিরে যায় রাজ্যে। বনের মেয়ে বনে থাকে একা। কোটালকন্যা রাজার বাড়িতে যাওয়ার যোগ্য নয়। শাস্ত্র তাকে দিয়েছে নীচু জাত। বিয়ে হয় রাজকন্যা কাঞ্চির সঙ্গে রাজপুত্রের।
এরপর ভীন দেশের রাজা আক্রমণ করে রাজা ও রাজকুমারকে বন্দী করে। মালঞ্চমালা খবর পেয়ে বাঘবাহিনী নিয়ে তাদের উদ্ধার করে। নিজের দাঁত দিয়ে শিকল কেটে কেটে স্বামীকে মুক্ত করে। বাঘেরা মালঞ্চমালার প্রতি তার শ্বশুর শ্বাশুড়ীর অন্যায় অবজ্ঞা, অবহেলার কারণে খেতে চায়। মালঞ্চ তাদের বাঁচায়। রাজা কৃতজ্ঞতাস্বরুপ মালঞ্চমালাকে স্বীকার করে নেয়। রাজকন্যা কাঞ্চী হয় রানী, আর মালঞ্চমালা পাটরানী।
এইখানে মূল রূপকথাটির নটেগাছটি মুড়োলো। কিন্তু কবি তুষার গায়েনের ভাবের কথাটি ফুরায়নি।
৩.
তার আগে মূল কাহিনীর মালঞ্চমালাকে একটু ফিরে দেখা যাক। মালাঞ্চমালা নিম্নবর্ণের মেয়ে- কোটালকন্যা। শাস্ত্রমানা নারী। একটি মেয়ে যখন নারী হয়ে ওঠে – কারো স্ত্রী হয়ে ওঠে, তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য নির্ধারিত হয়- সতী নারী হয়ে ওঠা। তার নিজের জীবন বলে কিছু নেই। নিজের জীবন বিপন্ন করে তার স্বামী সংসারকে বাঁচাতে সবকিছু করে যায়।
এই কাহিনী সেই ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করে যে, পতি পরম দেবতা। স্বামী দেবতাটি যে রকমই হোক না কেন, তার সেবা করাই স্ত্রীর একমাত্র দায়িত্ব ও কর্তব্য। নারীর কোনো ব্যক্তিগত আশা-আকাঙ্খা, সুখ-দুঃখ, চাওয়া-পাওয়ার কোনো মূল্য নেই। নারী এখানে কোনো ব্যক্তি নয়। নিতান্তই পুরুষের সেবিকা। এটাই তার জীবনের চরম সার্থকতা।
৪.
এই প্রচলিত ধারণাটিকে ভেঙ্গে দিয়েছেন কবি তুষার গায়েন তার বিনির্মিত উত্তর মালঞ্চ কবিতায়। তার কাছে মালঞ্চমালা রক্তমাংসের মানুষ। একই সঙ্গে তিনি নারী এবং ব্যক্তি। মালঞ্চমালার মানসিক দ্বন্দ্ব ও তার রক্তক্ষরণের ইতিহাস যেমন এই কবিতায় দেখি, তেমনি শ্রেণীবিভক্ত সমাজ ও রাষ্ট্র কাঠামো কিভাবে প্রজাদের সঙ্গে আচরণ করত তার পরিচয় পাওয়া যায় এবং ঐতিহাসিকভাবে ভারত সমাজে কিভাবে জাতপাতের বিভক্তি শুরু হয়েছে তার উল্লেখও পাওয়া যায়। এটা একজন নারীর, ব্যক্তির, সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বোপরি আমাদের বাংলা তথা উপমহাদেশের ইতিহাসের এক অনু-মহাকাব্য গাথা যা সমগ্রতা তৈরি করে, এক অখণ্ড বোধে উপনীত হতে সাহায্য করে।
৫.
‘রূপকথা আমাদের দেশের অন্যতম প্রাচীন লোকসাহিত্যের ধারা, যাতে আমাদের দেশজ ও লোকজ ঐতিহ্যের প্রকাশ ঘটে। অর্থাৎ আমাদের মূল্যবোধ, দেশ ও জাতির অন্তরাত্মা এবং তার স্বরূপ: রূপকথার রাজকন্যা-রাজপুত্র ও রাক্ষস-খোক্কোসময় কাহিনীতে সম্পৃক্ত। এইসব ঐতিহ্য ও মূল্যবোধের সঙ্গে আধুনিকতার সম্পৃক্তিকরণ বর্তমান দিনের সাহিত্য সংস্কৃতির বড়ো লক্ষ্য।‘
শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় আরও বলেছেন, রূপকথার নির্দিষ্ট কোনো রচনাকার নেই। তা জাতির অন্তরাত্মার প্রতিফলন। রূপকথাতে ব্যক্তি বিশেষের কোনো কথা নেই, সমগ্র জাতিরই প্রাণের কথা, অন্তরতম আশা-আকাঙ্খা এতে ধ্বনিত হয়ে উঠেছে। মহাকাব্যের বিশালদেহে যেমন ব্যক্তি নিরপেক্ষ জাতির আত্মকথা বৃন্তহীন পুষ্পসম আপনাতে আপনি বিকশিত হয়ে ওঠে- রূপকথার রাজ্যেও সেই একই নিয়ম। কোথাও লেখকের নিজের এতটুকু কোনো ছাপ নেই। সর্বত্র একটা উদার বিশাল অনাসক্ত ভাবের লক্ষণ প্রস্ফুটিত হয়েছে।
আধুনিক কবি এই ভাবটিকেই পাল্টে দিতে চান। ব্যক্তিহীনতার বদলে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে প্রতিষ্ঠিত করেন। মানুষের অধিকার, মর্যাদাবোধ এবং ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্য ও গুরুত্বকে স্থাপিত করেন কথাবস্তুর মধ্যে। এইভাবে পাল্টে যায় রূপকথার জগৎটি আধুনিক কালের কবির কাছে। কথাবস্তু বলতে কোনো লেখার আক্ষরিক অর্থকে বোঝায়। আর এই লেখার মাধ্যমে যে অন্তর্নিহিত গভীর ভাবনার প্রতিফলন হয়, তাই হল ভাববস্তু। কালে কালে মানুষের বিচার বুদ্ধি পাল্টাচ্ছে। পাল্টাচ্ছে মানুষের মূল্যবোধ। তাই ভাববস্তুরও পরিবর্তন ঘটছে।
যেমন প্রাচীন মহাভারতে কর্ণ-কুন্তীর সাক্ষাৎকারের সঙ্গে আধুনিক কালের কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কর্ণ-কুন্তীর কথাবস্তু একই। তবে এদের ভাববস্তু আলাদা। মহাভারতে যুদ্ধপরায়ণতাই মূল। মহাভারতের কাহিনীতে কর্ণ-কুন্তীর যে সাক্ষাৎ হয় সেখানে মাতৃস্নেহ ও পুত্রস্নেহকাতরতার পরিবর্তে স্বার্থচিন্তা ও বীরত্ব প্রদর্শনের মেজাজটিই মুখ্য হয়ে দেখা দিয়েছে। আর রবীন্দ্রনাথে- কুন্তীতে মাতৃস্নেহ আর কর্ণে সেই স্নেহ-বুভূক্ষতা বড়ো হয়ে দেখা দিয়েছে।
রামায়ণের মেঘনাদ পাপী ও কাপুরুষ। মাইকেলের মেঘনাদ একজন বীরযোদ্ধা- নির্ভীক-সাহসী।
আবার প্রয়োজনে কথাবস্তুও পাল্টে যায় আধুনিক কালে। কালকেতুর কাহিনীর ভাববস্তু অচল হয়নি- মানুষের দুঃখ-বেদনার নিয়তি এখন লেখা হচ্ছে গল্পে, উপন্যাসে, নাটকে। কিন্তু মঙ্গলকাব্য আর লেখা হয় না।
সেই কথাবস্তু একেবারে বদলেছে। সেই প্রকাশ ভঙ্গিও একেবারে বদলেছে। যদিও সে তুলনায় ভাববস্তু বদলেছে কম।
বিষয়বস্তু আর রূপকলা – দুয়ে মিলে সাহিত্য একটি অখণ্ড সৃষ্টি হয়ে ওঠে। এই অখণ্ডতাই চিরন্তন। যামিনী রায় আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন- বড়ো শিল্পের মর্মকথা হল- চিরন্তনত্ব। শিল্পে এই চিরন্তনত্ব আছে তার বিষয়ে দেশীয় ঐতিহ্যে এবং মিথের সম্পৃক্তিকরণেরর মধ্যে দিয়ে। বিশেষ করে মিথের ব্যবহার, ভাঙন এবং মিথের পুনর্গঠনের মধ্যে দিয়ে।
কবি তুষার গায়েন ঠিক এই কাজটিই করেছেন। তার রূপের জগৎ থেকে পাল্টেছেন ভাববস্তুকে- পাল্টেছেন কথাবস্তুকে।
পতিব্রতা নারীর ভিতর থেকে প্রতিবাদী নারীটিকে প্রতিস্থাপন করেছেন আমাদের চৈতন্যের ভিতরে। তুষারের কাহিনী কোনো পাথুরে ভাষ্কর্য নয়- জলরঙে আঁকা একটি মহত্তম ছবি, যেখানে অনেক কিছুই সুপ্ত, ইঙ্গিতময়। পাঠককে শব্দের বাঁকে বাঁকে সে ইঙ্গিতকে দেখতে হয় শুধু চোখ দিয়ে নয়- চৈতন্য দিয়ে।
৬.
মূল ঘটনায় মালঞ্চমালা পাটরানী হয়েছেন। তুষার এটাকে গ্রহণযোগ্য মনে করেননি। তিনি মালঞ্চকে পাটরানী হবার পরিবর্তে স্বেচ্ছা নির্বাসনে পুনরায় পাঠিয়েছেন বনে। কারণ যে অপমান ব্যক্তি ও নারী হিসাবে মালঞ্চ পেয়েছেন তার প্রতিবাদ হিসাবে এমনটিই যেন মালঞ্চের মতো সাহসী ও গভীর অন্তঃকরণের নারীর সঙ্গে মানানসই। এটা শ্রেণী ও জাতপাতে বিভক্ত সমাজ ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, যা তার সাহস ও ব্যক্তিত্বের সাথে সংগতিপূর্ণ। এছাড়াও যে রাজপুত্রকে সে বড়ো করেছে কোলে-পিঠে, তার সঙ্গে বয়সের ব্যবধান ও সম্পর্কের জটিলতা (মাতৃ ও স্ত্রী সত্তার দ্বন্দ্ব) তাকে ক্ষত বিক্ষত করেছে, তাড়া করে ফিরেছে আজীবন দুঃস্বপ্নের মতো । একারণেই এর সহোদর কাহিনী ‘রুপবান’-এ শেষ দৃশ্যে বর্ণিত রহিম ও রুপবানের বিয়ের ঘটনাটিকেও তুষার অনুসরণ করেন নি।
আবার রাজকন্যা কাঞ্চীর সঙ্গে রাজপুত্রের সুখী দাম্পত্য জীবন দেখা ও তাদের সামনেই সমগ্র বঞ্চিত জীবন পাড়ি দেওয়ার নির্মমতা অনুষ্ঠিত হতে দেয়া স্বাভাবিক জৈব-মানসিক ধর্মের বিরোধী। বনে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্তই এই সব কিছুকে অতিক্রম করে যায়। রাজপুরী নয়, বনই তার নিজের ভূবন।
এটাই পুরণো মিথের ভিতর থেকে নতুন ভাববস্তুর সন্ধান ও আধুনিক বোধের সমন্বয়। মিথের সার্থক বিনির্মাণ। এরকম অনেক বিনির্মিত ঘটনা এবং উপলদ্ধির সমারোহ রায়েছে তুষারের উত্তরমালঞ্চ কবিতায়।
৭.
এই অসাধারণ লোকগাথা বা ‘বঙ্গীয় উপন্যাস’ কবি তুষার গায়েন স্থাপন করেছেন এক অনু-মহাকাব্যের আঙ্গিকে। কবিতা গল্প বা উপন্যাস নয়, কবিতা কবিতাই। অনেক গ্রহণ বর্জনের মধ্য দিয়ে কবিতাটিকে শব্দের যাদুতে বিনির্মাণ করেছেন।
তার বিনির্মিত কাহিনীটিকে তিনি সাতটি পর্বে ভাগ করেছেন চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যের মতো করে।
প্রথম পর্ব- বনপ্রস্থান :
মাঘের শীতে একটি বনপথের দৃশ্য ভেসে ওঠে- সেখানে ধানকাটা মাঠে জ্বলছে নাড়ার আগুন। ধুঁয়া আর কুয়াশা মিলে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে ধোঁয়াশায়। দৃশ্যকল্প বলে দিচ্ছে এটা এই একান্ত বঙ্গের ছবি। দেখা যায় এই বনপথে একটি সদ্য কিশোরী মেয়েকে, যার কোলে দিন কয়েকের একটি শিশু। এ শিশু মেয়েটির সন্তান নয়- স্বামী, যেন স্বাভাবিক মাতৃস্নেহে তার জন্য দুধ খুঁজছে। হিংস্র বাঘদের সঙ্গে তার আত্মীয়তার বন্ধন, তার সতীত্বের ঘোষণা, শিশুটির সঙ্গে তার বয়সের ব্যবধান ও সম্পর্কের জটিলতা, শিশুটি যেন চিরন্তন শিশুদের মতো তাকে মা বলে ডেকে না ওঠে এই শংকা, এই দূরাগত নির্জন একাকী জীবন, তার ভেতরের নারীটির রক্তমাংসের আকাঙ্খা, মানসিক ও শারীরিক জৈব ধর্ম- এইসব দ্বান্দ্বিক পরিস্থিতির একটি নাটকীয় উপস্থাপনা পাই।
থাকি ভয়ে ভয়ে এই ভ্রমে এই যদি মা বলে ডাকে
বিজন বনের পথে দূরাভাসে ছায়া কাঁপা কাঁপা
অতল রাত্রির থেকে জল ভেসে আসে, উথলে উথলে
ওঠা জল দু’চোখ বিহনে যাবে কোথা পাবে কোথা পথ
নেই পথ নেই পথ সতীধর্ম যৈবন নদীর
দু’কূল ছাপায়ে ওঠে বাষ্পে বাষ্পে ভারী
অবরুদ্ধ গীতি… গেয়ে যাও পানকৌড়ি
সলাজ রক্তের গানে প্রতীক্ষিয়া প্রতীক্ষিয়া বহু বর্ষ কাটে
এই পর্বের শেষাংশে দেখতে পাই, রাজপুত্রকে শিক্ষাদানের জন্য মালঞ্চমালা বন ছেড়ে লোকালয়ের দিকে যাত্রা করছে। স্কুলের ঘন্টা ও হ্রেষাধ্বনির উল্লেখ সেই আবহকে তুলে ধরে।
দ্বিতীয় পর্ব- স্মৃতি : বনে বাড়ে রাজার কুমার
ফ্লাশব্যাকে, রাজকুমারের বনে বড়ো হয়ে ওঠার চিত্রটা পাই। বনের উদার আশ্রয়ে বড়ো হয় রাজকুমার, যেখানে নেই লোকালয়ের ক্ষুদ্রতা ও জাতপাতের নিমর্মতা। মালঞ্চ তার শিশু স্বামীকে সন্তানস্নেহে বড়ো করে তোলে। কাজল আঁকে চোখে। এইখানে সেই চিরন্তন বাংলার রমণীকে পাওয়া যায়। মালঞ্চমালা নিজেকে শোনায়-
বনে বাড়ে, বন সে’তো দূরে নয় লোকালয় থেকে
তবুও বনের মনে কী গভীর রহস্য আছে
আছে দানধর্ম তার, লোকালয়ে নাই!
জানে তাই বাঘমামা গাছ থেকে মধু পেড়ে আনে
শিশু স্বামীটিরে কি খাওয়াবো, কি রাঁধি
কোলে নিয়ে বসে থাকি, কাজল এঁকেছি চোখে তাঁর
বিতাড়িত পথে পথে দুধের ফোয়ারা ছুটে আসে
এই দুধ ঠোঁটে মুখে তাঁর মেশে সকল অব্যয় ধ্বনি
যেখানে মানুষ নেই, আহা-
মমতা সেখানে জানি, ঘর বেঁধে রাখে।
তৃতীয় পর্ব- রাজটিকা :
রাজপুত্র রাজার ছেলে। কিন্তু মালঞ্চমালা কোটালকন্যা, নিচু বর্ণের। তবু নিজ দায়িত্বে তাকে রাজার ছেলের মতো তার বসন-ভূষণ-বাহন জোগাড় করে দেয়। তাকে রাজপুত্রের মতো বড়ো করে তোলে। হয়তো মনে সাধ, কুমার বড়ো হলে তাকে (মালঞ্চমালা) জানবে তার প্রকৃত পরিচয়ে, মূল্য দেবে তার আত্মত্যাগের ।
সকলেই জানে সে’তো বহুপূর্বে মৃত ছিল
চিতায় পুড়েছে ঘন বর্ষার রাতে
মরা কি জীয়ন্ত হয়, যদি না সে জাতিস্মর
বেভুলে কখনো কারো হঠাৎ অতীত মনে পড়ে!
চতুর্থ পর্ব- পাপসূত্র, মৃতের জীয়নকাঠি :
আরেকটি ফ্লাশব্যাক দেখি। সেই প্রথম দিনের ঘটনা যা ছিল মালঞ্চের জন্য ও তার পিতার জন্য অনিয়ন্ত্রিত। রাজার আদেশে একটি নিম্নবর্ণের ১২ বছরের মেয়ের সাথে ১২ দিনের রাজপুত্রের বিয়ে হল। শিশুর মৃত্যু, এই মৃত্যুর জন্য নিয়তিকে নয় মেয়েটিকে দায়ী করা, তাকে ডাইনী বলে ঘোষণা দেওয়া, চিতায় তোলা, বৃষ্টির কারণে আগুন থেকে বেঁচে যাওয়া মৃত শিশুটিকে ভূত-প্রেতের ছোবল থেকে বাঁচানো ও তাকে নিয়ে গোপনে বনে চলে যাওয়া - এই যে একটি সামাজিক, শাস্ত্রীয় ও ক্ষমতার শিকার হয়ে একটি মেয়ে অসহায় হয়ে লোকালয় ছেড়ে প্রকৃতির কোলে আশ্রয় নিল - তার চাওয়া-পাওয়া, আশা-আকাঙ্খার কোনো মূল্য নেই। এর কারণটির পেছনে রয়েছে ইতিহাসের কুটিল ছায়া। সেই ইতিহাসটি এসেছে ভারতে আর্যদের আগমনের সঙ্গে, যারা ঘোড়ায় চড়ে নেমে এসেছিল পাহাড় থেকে পলি সমতলে। সমগ্র সমাজ শ্রেণী বিভক্ত হয়ে যায় এই বিদেশী আর্যদের আগমন ও তাদের শাস্ত্র প্রণয়নের মাধ্যমে। এই ঘোড়ার প্রতীকটির সঙ্গে অনার্যদের সামাজিক অবস্থানের পতন – পতনের কারণ হিসাবে শাস্ত্রের উত্থান - এই ইতিহাসটাই এই পর্বে বর্ণিত হয়েছে।
পতন পতন শুধু ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দে
পতনের শুরু; আমিও পতিত তাই
কাল সব জানে, তারা কারা এসেছিল
পাহাড় প্রদেশ থেকে নেমে এই স্নিগ্ধ পলি সমতলে …
লালধ্বনি হ্রেষা আনে সকল বিভক্তি রীতি
শাস্ত্র নামে ঘটে গেছে জানি, বহুকাল আগে।
পঞ্চম পর্ব- ধল প্রহরের গান :
রাজপুত্রকে বিদ্যালয়ে পাঠায় মালঞ্চমালা। সেখানে কেবল রাজসন্তান ও উচ্চবর্গীয়রাই যায় শিক্ষা নিতে। সেজন্য রাজপুত্রকে রাজার বসন-ভূষণে-বাহনে পাঠানো হয়। সেখানে রাজপুত্রের সাথে দেখা হয় এক রাজকন্যার। দুধবর্ন তার গায়ের বরণ এবং মর্যাদায় সমবংশীয়। মালঞ্চ নিজেকে আড়াল করে রাখে, যেন বেড়ে ওঠা রাজকুমার তাকে ভুল করে মা বলে না ডাকে। তবুও মালঞ্চের গোপন আকাঙ্খা যেন রাজকুমার একদিন জানতে পারে যে সে তার স্ত্রী - যে একাই সমাজ, শাস্ত্র, দুর্যোগ ও সকল প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে প্রাণপন সংগ্রাম করে তাকে বড়ো করে তুলেছে এবং এই নারীটিকে তার নিজস্ব নারী হিসাবেই যেন অন্তত একবার হলেও রাজকুমার মূল্য দেয়।
দূরে দূরে থাকি যাতে অসম বয়সে
ভুল ভেবে না ডেকো গো, মা বলে আমাকে
আমি যে গো তোমার জায়া এই সত্য জেনে
দেখো ফিরে একবার এই একাকী নারীকে !
ষষ্ঠ পর্ব – দাঁতে কাটি কারাগার :
ভিনদেশী রাজার আক্রমণে পরাজিত শ্বশুর-রাজা ও স্বামী বন্দী রাজপুত্রকে উদ্ধারের সেই ঘটনাটি দেখতে পাওয়া যায়। বনে একা থাকা মালঞ্চমালা খবর পেয়ে তার স্বামী ও শ্বশুরকে উদ্ধার করে বাঘ বাহিনী নিয়ে। নিজের দাঁত দিয়ে স্বামীর শিকল কেটে তাকে মুক্ত করে। এক একটি দাঁতের বিনিময়ে এক একটি শিকলের বন্ধন কাটে মালঞ্চ। তাতে যে রক্তদর্শন ঘটে, তা এক ভিন্ন অনুভবে মালঞ্চের মনে সুপ্ত মিলনের আকাঙ্খা জাগিয়ে যায়। কেননা সতী নারী রক্তপাতের মধ্য দিয়েই প্রথম স্বামী মিলনের তৃপ্তি ও সুখ পায়। মালঞ্চ এইখানে তার স্বপ্ন- আকাঙ্খার কথা বলছে –
দাঁতে কাটি শিকলের বেড়ি, লোহার শিকল
সে নয় কঠিন এই ইচ্ছার থেকে
রক্তদর্শন ছাড়া জানি সুখ হয় না কখনো
এই রক্ত সুখ হবে যদি বাঁচে সাধের কুমার
তুমি স্বপ্নে উঠে এসো ক্রোড়ে, বনে বনে কেটেছিল
যদি অভয় নিদ্রার কাল, নিদ যাও নিদ যাও বুকে
তোমার তরুণ মুখ পিপাসার মত
পাহাড়ের ক্ষত থেকে জলের আর্তি আসে ছুটে
সপ্তম পর্ব – বনে ফেরা, ছায়ার কঙ্কাল :
এই শেষ পর্বে গল্পের পরিণতি ঘুরে যায়। যে বিপুল আত্মত্যাগ ও সংগ্রামের বিনিময়ে মালঞ্চমালা তার অসম বয়সী স্বামীটিকে বাঁচিয়েছে, তার শ্বশুরকে বাঁচিয়েছে - তার বিনিময়ে সে পায়নি তার প্রাপ্য অধিকার, সম্মানিত স্ত্রী ও আকাঙ্খিত ঘর সংসার। বরং পেল বনবাস যার চেয়ে মৃত্যুকেও তার প্রিয় মনে হয়। তাই তার আর্ত উপলব্ধি শুনি যে, ভালবেসে দাঁত দিয়ে শিকল কাটা যায়, কিন্তু মনের দেয়াল কাটা যায় না।
দাঁতে কাটে কারাগার মনের দেয়াল কাটে নাকো
গ্রহণের সীমারেখা মানুষের এত ছোট এত ছোট
কুমারের আয়ু আজ অনন্ত আকাশ
তবু রাজা আমায় দিলেন বনবাস
আমি যে কোটালকন্যা অবরুদ্ধজন, পথে পথে কাঁটা
সরোবরে ডুব দেবো সেখানে পাহারা…
এইখানে এসে চোখে জল আসে। এই বঞ্চিত নারীর জন্য আমাদের হৃদয় ভেঙ্গে পড়ে। শাস্ত্রের প্রতি জমে ওঠে ক্রোধ। আমরাও তাই সমর্থন করি তার বনে ফেরা- যেখানে জাতপাতের বিভাজন নেই, আছে ভালবাসা- যা উন্মুক্ত, উদার, অখণ্ড-
তবে আমি বনে যাই যার শাস্ত্র নাই কোনো
এই পথ চলে গেছে দূর পাতাস্রোতে
পাতার আড়ালে গাছ ধরে রাখে ছায়ার কঙ্কাল
রৌদ্র হলে জানি তাই মেলে দেবে পথে।
৮.
কবিতার শুরু বনে। শেষও বনে। বনমর্মর শোনা যায় কবিতার প্রতিটি শব্দে, প্রতিটি বাক্যে- কথাবস্তু ও ভাববস্তুতে। এই বন সহজ সরল, স্বাভাবিক, সপ্রাণ ও সবুজ। এখানে গাছপালা, পশুপাখি, নদীজল- আকাশবাতাস, মেঘ ও মাটি- একীভূত। অখণ্ড সত্তা। স্বার্থের দ্বন্দ্ব নেই। নেই বিভাজন। আছে উদার ঐক্য। অখণ্ড একাকার হয়ে যাওয়ার টান। শুভর সঙ্গে মিলনের বোধ।
যে কারণে শাস্ত্রবদ্ধ মানব কখনো কখনো বনবাসীর সন্দেহর কারণ হয়ে ওঠে। আবার যখন বোঝে, যে মানুষ শাস্ত্রবিহীন, প্রকৃতির মত সৎ বনে আশ্রয়প্রার্থী- তাকে আশ্রয় দেয় মায়ের মতন। বন যেন মা। আদিমাতা। তার অধিবাসী গাছপালা, পশুপাখিও এই মাতৃস্নেহ জানে – মাতৃস্নেহ মানে। সবাইকে কোলের আশ্রয়ে ধরে রাখে। কাউকে বিমুখ করে না। যে কারণে দেখি, বাঘ রাজপুত্রকে খেতে চায়। কিন্তু ব্যাঘ্রসমাজ মালঞ্চমালার সত্য কথনে মুগ্ধ। তারা শিশুটির জন্য গাছে গাছে যায় খাবার আনতে। গাছও তাদের দেয় অবারিত মধু। পথে পথে মেলে দুধ। এবং মেয়েটির জন্য তারা লড়াই করে বিভাজনকামী মানুষের বিরুদ্ধে। আক্রান্তদের বাঁচায়। আবার ন্যায়বোধে অন্যায়কারী শ্বশুরশ্বাশুড়ীকে খেতে চায়। মেয়েটির অনুরোধে তাদের ক্ষমাও করে দেয়। এই যে বাঘের ভেতরে দেখি সেই মহৎপ্রাণের উৎসারণ- যার ভেতরে নেই অশুভ ভাবনা। আছে ন্যায়বোধ ও মমতার সঘন হৃদয়।
আর গাছ প্রকৃতির অখণ্ড প্রতীক। গাছ তার ভিতরে ধরে রাখে প্রকৃতির বিশালতা। দানধর্ম। সুন্দরের আকাঙ্খা। কাউকে সে দূরে ঠেলে দেয় না। দেহ ও মনের খাদ্য সে যোগায় মায়ের মতোন। তার পাতাটি, ফুলটি, ফলটি, শাখাটি দানধর্মে প্রবল। আর শেকড় যেভাবে আকড়ে ধরে মাটিকে- কালের করাল গ্রাস থেকে ফেরায় মাটিকে, বাতাসকে, আলোকে- সে রকম আমরা দেখি গাছ সমগ্রকে ধরে রাখে। ছায়াটিকে ধরে রাখে। ছায়াটি হারিয়ে গেলে তার কঙ্কালটিকেও ধরে রাখে। কাউকে সে হারায় না। একাত্ম করে রাখে। এই খণ্ড- খণ্ডের সঙ্গে অখণ্ডের মিলনের খেলা তাই অতি স্বাভাবিক ও মহত্বের ইঙ্গিত।
প্রকৃতির শান্ত সুরটিই এ কবিতার প্রাণের সঙ্গীত। প্রকৃতির অখণ্ড বোধই এ কবিতার প্রাণ।
৯.
এই মর জর্জর, ষড়যন্ত্রময় জগৎ থেকে আমাদের ফেরায় এ কবিতাটি সেই দীর্ঘ শমিত অভিযাত্রায়- মাঘশীতে, ডোরাকাটা বনপথে, নাড়ার আগুনে, কাঁপা কাঁপা ছায়ার ভেতরে, অতল রাত্রিতে, জলে ভেসে যাওয়ার মধ্যে, পানকৌড়ির উড়ে যাওয়ায়, ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দে, মেঘে,মেঘের পালঙ্কে, বনমধুতে, আকাশময় আকাশে, কচুপাতায়, স্নিগ্ধ পলি সমতলে, শ্বেতপঙ্খীতে, পাহাড়ের ক্ষতে, জলের আর্তিতে, একটি বা দুটি তারায়, সরোবরে, পাতাস্রোতে, রোদ এবং ছায়ার কঙ্কালের ভেতরে, রূপের ভেতরে, প্রাণের ভেতরে। জীবনের প্রাণবন্ত অস্তিতে।
এ কবিতার আয়োজন যে শব্দে নির্মিত হয়- তারা সব সত্য শব্দ, সপ্রাণ এবং আত্মার ধ্বণিতে মুখর। তারা পাতার মতো মর্মরিত, আলোর স্পর্শে পুষ্টি যোগায় কবিতার গাছটিকে। শব্দগুলি ফুলের পাপড়ির মতো লাবণ্যময়, সুবিন্যস্ত। রচনা করে একটি ফুলজীবন- তার আছে ঘ্রাণ- আছে রঙের ইশারা, যা প্রজন্মকে ডেকে আনে। আরেকটি ফুলের সম্ভাবনাকে জাগিয়ে তোলে। জাগিয়ে তোলে আছে সৃজনের সক্ষম সামর্থ্য। অপ্রয়োজনের ভার কোনো শব্দ কাঠামোর ভেতরে ও বাইরে চিহ্ণিত হয় না।
কবি তুষার বলেছেন একটি রূপকথা- রূপের জগতের ভেতরে রূপের কথা, আরও গভীরে লুকিয়ে থাকা চুপকথা। এজন্য তিনি নির্মাণ করেছেন একটি পৃথক কাব্যভাষা। যা শান্ত, মন্দ্র এবং প্রাণোৎসারিত। যেমন আমরা দেখতে পাই-
মাঘশীতে ডোরাকাটা যায় দূর বনপথ
কুয়াশারেখায় ঢাকা পথ নেই পথ নাড়ার আগুন
ফিক ফিক করে জ্বলে নেভে ধোঁয়াশা ছড়ায়
দূরাবহে হেটে যায় পরী, কোলে তার
শিশু নয় স্বামী, বারোদিন রাত্রি কেটে যার
আয়ু হল কাল; পথে পথে কে আছে তাঁকে
দুধ দেবে ওগো, বাঘমামা আমি সতী নারী
থাকি ভয়ে ভয়ে এই ভ্রমে এই যদি মা বলে ডাকে
এ ভাষার মধ্যে সেই প্রাচীন রূপের জগতের মন্দ্রতা বোঝাতে ব্যবহার করেছেন দূরাবহ, রাত্রি, ভ্রম গুরুগম্ভীর শব্দ। আবার সমকালীন করে তুলেছেন- ডোরাকাটা, নাড়া, বাঘমামা- এইসব সহজ সরল প্রতিদিনের ব্যবহৃত শব্দ ব্যবহারের মধ্যে দিয়ে। এই মন্দ্র ও সরল শব্দ আশ্চর্যভাবে মিলিত ঐক্যতান সৃষ্টি করে- যা তুষারের কাব্য-সামর্থ্যের বিশেষ প্রকাশ।
যে কোনো শব্দের দুটো দিক থাকে। এক. তার অর্থের দিক। দুই. তার রস-প্রতীতির দিক। গদ্য শব্দের আক্ষরিক অর্থকে প্রধানত ধারণ করে। কিন্তু কাব্য উন্মোচন করে শব্দের রস-প্রতীতি বা রহস্য ও ব্যঞ্জনাকে। ‘সলাজ রক্তের গানে প্রতীক্ষিয়া প্রতীক্ষিয়া বহু বর্ষ কাটে’- এইখানে শব্দের অসাধারণ যাদুকরী ব্যবহার করেছেন তুষার। মেয়েটি ১২ বছরের। সবে যৌবনপ্রাপ্ত হয়েছে। তার ভেতরের নারীটি জেগে উঠেছে। ঋতুচক্রের যে নম্র লজ্জা এবং নারী হয়ে ওঠার গৌরব- এই দুটি বিষয়কে একই সঙ্গে তুষার ব্যবহার করেছেন ‘সলাজ রক্তের গান’ শব্দবন্ধটি। যে গানটির মাধ্যমে আবেদন জানাচ্ছে পুরুষটিকে- সে শিশুমাত্র। এখন এই সলাজ রক্তের গানের কোনো মানে নেই। কিন্তু একদিন মানে হবে। তার জন্য আছে অপেক্ষা। বহু বছরের প্রতীক্ষা।
এই রকম শব্দের অন্তর্গত আবেগ, সমাবেশ ও ধ্বনি বৈচিত্র্য এবং ছন্দের শোভনতা নিয়ে নির্মিত হয়েছে উত্তরমালঞ্চ কবিতাটির রূপময় ভাষা। হয়ে উঠেছে অনির্বচনীয়।
এবং রূপময় ভাষার অর্ন্তগত প্রতিটি বাক্যে প্রতিটি শব্দের মধ্যে আছে অন্বয় । আছে বাক্যের সঙ্গে বাক্যের অন্বয়। কোনো বাক্যই দুর্বল বোধ হয় না। হাত ধরাধরি করে কবিতার দিকে পাঠককে এগিয়ে নিয়ে যায়।
ক) ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দে সরে যায় মেঘ
!
খ) মেঘের পালঙ্কে শুয়ে রাজার কুমার
!
গ) বনে বাড়ে, বন সে’তো দূরে নয় লোকালয় থেকে
!
ঘ) তবুও বনের মনে কী গভীর রহস্য আছে
!
ঙ) আছে দানধর্ম তার, লোকালয়ে নাই!
প্র্রতিটি বাক্যই চমকে দেওয়ার মতো। প্রথম বাক্যে সামন্ত জীবনের বিলাস ব্যসনের অহংকার বর্ণিত হয়েছে, যার মধ্যে মেঘের সরল সৌন্দর্য হারিয়ে যায়। কিন্তু পরের বাক্যে দেখি রাজার কুমার সে কৃত্রিম বৈভবের মধ্যে নেই। তাই মেঘের সরল অলংকার তার পালঙ্ক হয়ে উঠেছে। এই মেঘের সৃজনশীলতার মধ্যে তার বর্তমান বন-বসবাস এবং আনন্দময় বেড়ে ওঠা। সেই বনের অখণ্ড সত্তার মধ্যে বেড়ে ওঠা- যেখানে লোকালয়ের ঈর্ষা-হিংসা-দ্বেষ-স্বার্থপরতা নেই , আছে কল্যাণের, বিস্তার যাকে তুষার বলেছেন- দানধর্ম। এই বাক্যটিকে একটু নিবিড়ভাবে দেখলেই বোঝা যায়- তারা আলাদা আলাদা বাক্য , আলাদা আলাদা চিত্র, কিন্তু একটি অখণ্ড চিত্রের দিকে- সম্পর্কের দিকে আমাদের সঙ্গী করে নিয়ে যায়, গভীর রহস্যের মধ্যে দিয়ে গাথা হচ্ছে একটি মালা। প্রতিটি পঙক্তিই মালাটির সমান লাবণ্যের ফুল। কোনোটি তাজা বা কোনোটি মৃত নয়। সকল শব্দই জীবন্ত। কোনো শিথিলতা নেই।
১০.
কবিতার ছন্দটি কথাবস্তু ও ভাববস্তুর মতোই নিখুঁত।
এ ছন্দ কান ও মনকে স্নিগ্ধ করে। আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্যের ভিতরকার ঋদ্ধ প্রাণের সুরটিকে প্রাণে পৌছে দেয়। বোঝা যায় কাব্য ও ছন্দ অঙ্গাঙ্গীভাবে বাঁধা। কেননা ছন্দ আর আবেগ যমজ। যেমন কবি কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত জানান, এই ছন্দ কৃত্রিম গণিত সাপেক্ষ মাত্রা গণনা নয়। তা কুস্তি করে সাজানোর কোনো প্রয়োজন নেই। তা নাচের তালের মতো স্বাভাবিক অঙ্গভঙ্গি। আর আমরাতো এই ভঙ্গিটিকে মুখ্যত দেখি না। ভঙ্গির মধ্যে দিয়ে অনির্বচনীয় আনন্দকে দেখতে চাই- যে আনন্দ কবিতারই অন্য নাম।
১১.
এ সময়ের অনেক কবি শেকড়ের কাছে ফেরার কথা বলেছেন। লিখছেন- মিথ নির্ভর কবিতা। মাটিবর্তী কবিতা। সে সব কবিতার মধ্যে যতো রয়েছে অহংকার আর নির্মাণ-চতুরতা- কিন্তু নেইস্বদেশ শেকড়ের আবিষ্কার। তাই কোনো কোনো কবিতা হয়ে ওঠ শব্দের সম্ভারমাত্র, শব্দের চমক অথবা দুএকটি বাক্যের স্ফূর্তিমাত্র। সেখানে যে আকাশ বর্ণিত হয়, যে জল ও মাটির ভুবন দৃশ্যমান হয়, তার সাথে আমাদের বাংলাদেশের মিল খুঁজে পাওয়া কষ্টকল্প হয়ে ওঠে। শেষমেষ তা হয়ে ওঠে- ঘোড়ার ক্ষুরের ধ্বনির ব্যর্থ অনুকরণ। যে মেয়েটিকে সে সব কবিতায় দেখতে পাই সে ছাদে দাঁড়িয়ে পাশের বিল্ডিং-এর ছাদে উঁকি মারে, যে ছায়াটিকে চোখে পড়ে তা ড্রাগনচিহ্ণিত কোন অপচ্ছায়া মাত্র, যে গাছটিকে লক্ষ্য করি- তা আসলে কোনো গাছ নয়- গাছের কঙ্কাল- বনসাই।
আর প্রকৃত আকাশ দেখা যায় এই ‘উত্তরমালঞ্চ’ কবিতায়। এ কবিতার আকাশ তা আমাদের বাংলাদেশেরই আকাশ, এ কবিতার জল আমাদের নদী ও পুকুরের জল। আমাদের আলো ও হাওয়ার ভিতরের জীবন-নিসর্গের রূপময়তা এ কবিতার ছত্রে ছত্রে। যে গাছটি সবুজ হয়ে ওঠে আমাদের চোখের সামনে, তা আমাদের আত্মার অখণ্ড আশ্রয়। আমাদের জীবন যা প্রকৃতিরই খণ্ডাংশমাত্র- যার মূল প্রবণতা প্রকৃতির অখণ্ড প্রাণের ভিতর ফিরে যাওয়ার- সে প্রাণকে ধারণ করে আছে প্রকৃতই কবি তুষার গায়েনের কবিতা।
http://www.facebook.com/s.php?q=Subrata+Augustine+Gomes&k=100000020&init=ffs#/note.php?note_id=227641105337&ref=mf
তথ্যসূত্র:
. ১.আধুনিক সাহিত্য : গোপাল হালদার। ২. রূপকথা : শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ৩.পটুয়াশিল্পী : যামিনী রায়
৪.কাব্যের মুক্তি : সুধীন দত্ত। ৫. বৃষ্টির অন্তর ত্রাস : তুষার গায়েন, নিসর্গ প্রকাশন, ঢাকা।
মূল কবিতাটি-
উত্তরমালঞ্চ
বনপ্রস্থান
মাঘশীতে ডোরাকাটা যায় দূর বনপথ
কুয়াশারেখায় ঢাকা পথ নেই পথ নাড়ার আগুন
ফিক ফিক করে জ্বলে নেভে ধোঁয়াশা ছড়ায়
দূরাবহে হেটে যায় পরী, কোলে তার
শিশু নয় স্বামী, বারোদিন রাত্রি কেটে যার
আয়ু হল কাল; পথে পথে কে আছে তাঁকে
দুধ দেবে ওগো, বাঘমামা আমি সতী নারী
থাকি ভয়ে ভয়ে এই ভ্রমে এই যদি মা বলে ডাকে
বিজন বনের পথে দূরাভাসে ছায়া কাঁপা কাঁপা
অতল রাত্রির থেকে জল ভেসে আসে, উথলে উথলে
ওঠা জল দু’চোখ বিহনে যাবে কোথা পাবে কোথা পথ
নেই পথ নেই পথ সতীধর্ম যৈবন নদীর
দু’কূল ছাপায়ে ওঠে বাষ্পে বাষ্পে ভারী
অবরুদ্ধ গীতি… গেয়ে যাও পানকৌড়ি
সলাজ রক্তের গানে প্রতীক্ষিয়া প্রতীক্ষিয়া বহু বর্ষ কাটে
বাঘমামা, যদি না থাকিতে বনে…এইবার যাই!
পালাই পালাই বন থেকে দূরে লোকালয়, বিদ্যালয়
প্রথম পাঠের ঘণ্টাধ্বনি, হ্রেষা শোনা যায়…
স্মৃতি: বনে বাড়ে রাজার কুমার
ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দে সরে যায় মেঘ
মেঘের পালঙ্কে শুয়ে রাজার কুমার
বনে বাড়ে, বন সে’তো দূরে নয় লোকালয় থেকে
তবুও বনের মনে কী গভীর রহস্য আছে
আছে দানধর্ম তার, লোকালয়ে নাই!
জানে তাই বাঘমামা গাছ থেকে মধু পেড়ে আনে
শিশু স্বামীটিরে কি খাওয়াবো, কি রাঁধি
কোলে নিয়ে বসে থাকি, কাজল এঁকেছি চোখে তাঁর
বিতাড়িত পথে পথে দুধের ফোয়ারা ছুটে আসে
এই দুধ ঠোঁটে মুখে তাঁর মেশে সকল অব্যয় ধ্বনি
যেখানে মানুষ নেই, আহা-
মমতা সেখানে জানি, ঘর বেঁধে রাখে!
রাজটিকা
কোটালকন্যার হাতে যদি বাড়ে রাজার কুমার
তবু সে’তো রাজপুত্র, রাজধর্ম তাঁর
একযুগ পার হলে যেন সব চিহ্ণ
সমান স্বরূপে ফুটে ওঠে তাঁর, এই ভার
নিয়েছি নিজের বোধে…কেউ জানে নাই
সকলেই জানে সে’তো বহুপূর্বে মৃত ছিল
চিতায় পুড়েছে ঘন বর্ষার রাতে
মরা কি জীয়ন্ত হয়, যদি না সে জাতিস্মর
বেভুলে কখনো কারো হঠাৎ অতীত মনে পড়ে!
পাপসূত্র, মৃতের জীয়নকাঠি
মৃতের শরীর থেকে মৃত্যু উড়ে গেছে
জীবন চিৎকার করে নামে সেইরাত
চোখের কোটরে দেখি আবার চোখের জল
ধুয়ে যায় দৃশ্যগাঁথা বন সর্ সর্
বিদেহী ছায়ারা দ্রুত মিশে যায় বাষ্পীভূত
আকাশে আকাশময় জড়ো হয় মেঘ
বড় বড় বৃষ্টিফোঁটা ধারা হয়ে নেমে আসে
ন’ড়ে চ’ড়ে কচুপাতা কিছু জল ধরে রেখে
বাকিটুকু ফেলে দেয় পতনের প্রেমে:
পতন পতন শুধু ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দে
পতনের শুরু; আমিও পতিত তাই
কাল সব জানে, তারা কারা এসেছিল
পাহাড় প্রদেশ থেকে নেমে এই স্নিগ্ধ পলি সমতলে…
লালধ্বনি হ্রেষা আনে সকল বিভক্তি রীতি
শাস্ত্র নামে ঘটে গেছে জানি, বহুকাল আগে।
ধল প্রহরের গান
ওঠো ওঠো রাজার কুমার বিদ্যালয়ে যাও
বিদ্যালয়ে তোমার সমান রাজকন্যা পাও
দূধের বরণ রাজকন্যা শ্বেতপঙ্খী নায়ে
এনে দেবো পঙ্খীরাজ চিঁহিঁ রবে গায়
দূরে দূরে থাকি যাতে অসম বয়সে
ভুল ভেবে না ডেকো গো, মা বলে আমাকে
আমি যে গো তোমার জায়া এই সত্য জেনে
দেখো ফিরে একবার এই একাকী নারীকে!
দাঁতে কাটি কারাগার
দাঁতে কাটি শিকলের বেড়ি, লোহার শিকল
সে নয় কঠিন এই ইচ্ছার থেকে
রক্তদর্শন ছাড়া জানি সুখ হয় না কখনো
এই রক্ত সুখ হবে যদি বাঁচে সাধের কুমার
তুমি স্বপ্নে উঠে এসো ক্রোড়ে, বনে বনে কেটেছিল
যদি অভয় নিদ্রার কাল, নিদ যাও নিদ যাও বুকে
তোমার তরুণ মুখ পিপাসার মত
পাহাড়ের ক্ষত থেকে জলের আর্তি আসে ছুটে
‘বাঘমামা, খেয়ো না খেয়ো না, এই কাঞ্চী কুমারের নিধি
এত সাধ রক্তপানে যদি, তবে খাও আমাকেই আগে’…
একে একে দাঁতের বিনাশে কাটে শিকলের ভার
কাক ডাকে ভোর হয় ফর্সা আকাশে
নিথর একটি, তবু, দু’টি তারা থাকে!
বনে ফেরা, ছায়ার কঙ্কাল
দাঁতে কাটে কারাগার মনের দেয়াল কাটে নাকো
গ্রহণের সীমারেখা মানুষের এত ছোট এত ছোট
কুমারের আয়ু আজ অনন্ত আকাশ
তবু রাজা আমায় দিলেন বনবাস
আমি যে কোটালকন্যা অবরুদ্ধজন, পথে পথে কাঁটা
সরোবরে ডুব দেবো সেখানে পাহারা…
রাজা আমায় নিলেন নাকো ঘরে, না দিলেন মৃত্যুপরোয়ানা!
তবে আমি বনে যাই যার শাস্ত্র নাই কোনো
এই পথ চলে গেছে দূর পাতাস্রোতে
পাতার আড়ালে গাছ ধরে রাখে ছায়ার কঙ্কাল
রৌদ্র হলে জানি তাই মেলে দেবে পথে।
(*উত্তরমালঞ্চ কবিতাটি আলোচনার নীচে দেওয়া হয়েছে)
‘রূপকথার সৌন্দর্য সম্ভার তাহার জন্য, যে পৃথিবীর সংকীর্ণ আয়তনের মাঝে নিজ আশা ও কল্পনাকে সীমাবদ্ধ করে নাই’।– শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়।
১.
ঠাকুরদাদার ঝুলির রূপকথা ছেলেবেলায় পড়েছি। এর মধ্যে ‘মালঞ্চমালা’ কাহিনীটি অন্যরকম। যখন দাদাজানের কাছে শুনেছি, অবাক ঘুরে বেড়িয়েছি রূপের জগতে। শুনতে শুনতে ঘুম এসে যেত। ঘুমের মধ্যে দেখতাম- একটি মেয়ে বনে বনে ঘুরছে, কোলে তার শিশু। তার সঙ্গে কথা বলে বাঘ, বনের পাখি, গাছপালা, নদী-নালা। আরেকটু বড়ো হয়ে শুনেছি, রূপবান যাত্রাপালাটি। মালঞ্চমালারই কাহিনী। শেষদিকে একটু বদলে দেওয়া। চরিত্রগুলোর নাম ভিন্ন, কিন্তু সুর অভিন্ন। অভিন্ন বলেই হিন্দু-মুসলমান এই কথাবস্তু ও ভাববস্তুর মধ্যে নিজস্ব আত্মার ধ্বনি চিনতে পেরেছে। উভয়ের নিজস্ব সম্পদ হয়ে উঠেছে । এই পালাটির গানগুলির মধ্যে একটি সতীনারীর সমগ্র জীবনের চোখের জলে ভাসানো জীবন-সংগ্রাম যে করুণ আবেদন সৃষ্টি করে, মনে হয়, এই কান্না বাতাসের, ঐ আকাশের, প্রকৃতি আর অখণ্ড সত্তার। খণ্ড খণ্ড হয়ে যে সত্তাটি জীবনের প্রতি বাঁকে বাঁকে কেঁদে ফেরে-‘আমার মিলন লাগি আসছ তুমি কবে’- অখণ্ডের সঙ্গে একাকার হয়ে যাওয়ার আকাঙ্খারই আর্তি এই সব।
২.
গল্পটির দিকে একটু ফেরা যাক। এক রাজার পুত্র-সন্তান হলে রাজজ্যোতিষী বললেন, এর আয়ূ মাত্র ১২ দিন। তাকে বাঁচাতে হলে ১২ বছরের কন্যার সাথে বিয়ে দিতে হবে। রাজা খুঁজে পেলেন- কোটাল কন্যা মালঞ্চমালা। মালঞ্চর বয়স বারো। সদ্য যৌবনপ্রাপ্ত মালঞ্চর সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হল ১২ দিনের শিশু রাজপুত্রের এবং বিয়ের রাতেই শিশুটি মারা গেল। কিন্তু গল্পটি মারা যায় নাই। রাজা ক্রুদ্ধ হলেন ও শিশুর মৃত্যুর জন্য দায়ী করলেন নিষ্পাপ মেয়েটিকে। বললেন, মেয়েটি ডাইনি, ওকে আগুনে পোড়াও। মৃত রাজপুত্রের সঙ্গে মালঞ্চমালাকেও চিতায় তোলা হল। আগুন জ্বলে উঠল।
বৃষ্টি এসে নিভিয়ে দিল সে আগুন। বেঁচে গেল মেয়েটি সতীদাহ থেকে। প্রকৃতি ঘোষণা করল মেয়েটি ডাইনি নয়, সতী নারী। সতী নারীর কোলে শিশু স্বামী- মৃত রাজকুমার। রাতে ভূত-প্রেত এসে মৃতদেহটিকে খেতে চায়। মালঞ্চমালা তাকে আগলে রাখে, ভুতপ্রেত ফিরে যায়। ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথেই মালঞ্চমালা শিশু স্বামীটির প্রাণ ফিরে পায়। এইখানে গল্পটি শেষ হলে ভাল হত। কিন্তু রূপের কথা শেষ হয় না। রাতে ভূত- দিনে বাঘ। কে বলে তাদের ভাগ।
বনের বাঘ এসে কচি শিশুটিকে খেতে চাইল। মালঞ্চমালার ব্যবহারে বাঘ মুগ্ধ হয়, বশ মানে। তারা আর ব্যাঘ্র নয়- হয়ে ওঠে বাঘ মামা, বাঘ মামী। কোনো মানুষ নয়- বাঘই এই একাকিনী মেয়েটির আত্মীয়-বান্ধব হয়ে ওঠে। বনের গভীরে বাসা বানায় মেয়েটি। দুধ আর মধু জোগাড় করে আনে এই বাঘ মামা-মামী।
রাজপুত্র বড়ো হলে বিদ্যালয়ে পাঠাল তাকে মালঞ্চমালা। সেখানে রাজপুত্রের সঙ্গে পরিচয় হল ভিন দেশী রাজকন্যা কাঞ্চীর সঙ্গে। গড়ে ওঠে প্রেম। এর পর অনেক ঘটনা। একটু সংক্ষেপে বলি।
রাজপুত্রের বাবা মালঞ্চমালার শ্বশুর বিপদে পড়ে বনে এলো। তখন জীবন বাঁচায় মালঞ্চমালা। রাজা মালঞ্চমালাকে চিনতে পারে। জানতে পারে তার পুত্র জীবিত। রাজপুত্রকে নিয়ে রাজা ফিরে যায় রাজ্যে। বনের মেয়ে বনে থাকে একা। কোটালকন্যা রাজার বাড়িতে যাওয়ার যোগ্য নয়। শাস্ত্র তাকে দিয়েছে নীচু জাত। বিয়ে হয় রাজকন্যা কাঞ্চির সঙ্গে রাজপুত্রের।
এরপর ভীন দেশের রাজা আক্রমণ করে রাজা ও রাজকুমারকে বন্দী করে। মালঞ্চমালা খবর পেয়ে বাঘবাহিনী নিয়ে তাদের উদ্ধার করে। নিজের দাঁত দিয়ে শিকল কেটে কেটে স্বামীকে মুক্ত করে। বাঘেরা মালঞ্চমালার প্রতি তার শ্বশুর শ্বাশুড়ীর অন্যায় অবজ্ঞা, অবহেলার কারণে খেতে চায়। মালঞ্চ তাদের বাঁচায়। রাজা কৃতজ্ঞতাস্বরুপ মালঞ্চমালাকে স্বীকার করে নেয়। রাজকন্যা কাঞ্চী হয় রানী, আর মালঞ্চমালা পাটরানী।
এইখানে মূল রূপকথাটির নটেগাছটি মুড়োলো। কিন্তু কবি তুষার গায়েনের ভাবের কথাটি ফুরায়নি।
৩.
তার আগে মূল কাহিনীর মালঞ্চমালাকে একটু ফিরে দেখা যাক। মালাঞ্চমালা নিম্নবর্ণের মেয়ে- কোটালকন্যা। শাস্ত্রমানা নারী। একটি মেয়ে যখন নারী হয়ে ওঠে – কারো স্ত্রী হয়ে ওঠে, তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য নির্ধারিত হয়- সতী নারী হয়ে ওঠা। তার নিজের জীবন বলে কিছু নেই। নিজের জীবন বিপন্ন করে তার স্বামী সংসারকে বাঁচাতে সবকিছু করে যায়।
এই কাহিনী সেই ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করে যে, পতি পরম দেবতা। স্বামী দেবতাটি যে রকমই হোক না কেন, তার সেবা করাই স্ত্রীর একমাত্র দায়িত্ব ও কর্তব্য। নারীর কোনো ব্যক্তিগত আশা-আকাঙ্খা, সুখ-দুঃখ, চাওয়া-পাওয়ার কোনো মূল্য নেই। নারী এখানে কোনো ব্যক্তি নয়। নিতান্তই পুরুষের সেবিকা। এটাই তার জীবনের চরম সার্থকতা।
৪.
এই প্রচলিত ধারণাটিকে ভেঙ্গে দিয়েছেন কবি তুষার গায়েন তার বিনির্মিত উত্তর মালঞ্চ কবিতায়। তার কাছে মালঞ্চমালা রক্তমাংসের মানুষ। একই সঙ্গে তিনি নারী এবং ব্যক্তি। মালঞ্চমালার মানসিক দ্বন্দ্ব ও তার রক্তক্ষরণের ইতিহাস যেমন এই কবিতায় দেখি, তেমনি শ্রেণীবিভক্ত সমাজ ও রাষ্ট্র কাঠামো কিভাবে প্রজাদের সঙ্গে আচরণ করত তার পরিচয় পাওয়া যায় এবং ঐতিহাসিকভাবে ভারত সমাজে কিভাবে জাতপাতের বিভক্তি শুরু হয়েছে তার উল্লেখও পাওয়া যায়। এটা একজন নারীর, ব্যক্তির, সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বোপরি আমাদের বাংলা তথা উপমহাদেশের ইতিহাসের এক অনু-মহাকাব্য গাথা যা সমগ্রতা তৈরি করে, এক অখণ্ড বোধে উপনীত হতে সাহায্য করে।
৫.
‘রূপকথা আমাদের দেশের অন্যতম প্রাচীন লোকসাহিত্যের ধারা, যাতে আমাদের দেশজ ও লোকজ ঐতিহ্যের প্রকাশ ঘটে। অর্থাৎ আমাদের মূল্যবোধ, দেশ ও জাতির অন্তরাত্মা এবং তার স্বরূপ: রূপকথার রাজকন্যা-রাজপুত্র ও রাক্ষস-খোক্কোসময় কাহিনীতে সম্পৃক্ত। এইসব ঐতিহ্য ও মূল্যবোধের সঙ্গে আধুনিকতার সম্পৃক্তিকরণ বর্তমান দিনের সাহিত্য সংস্কৃতির বড়ো লক্ষ্য।‘
শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় আরও বলেছেন, রূপকথার নির্দিষ্ট কোনো রচনাকার নেই। তা জাতির অন্তরাত্মার প্রতিফলন। রূপকথাতে ব্যক্তি বিশেষের কোনো কথা নেই, সমগ্র জাতিরই প্রাণের কথা, অন্তরতম আশা-আকাঙ্খা এতে ধ্বনিত হয়ে উঠেছে। মহাকাব্যের বিশালদেহে যেমন ব্যক্তি নিরপেক্ষ জাতির আত্মকথা বৃন্তহীন পুষ্পসম আপনাতে আপনি বিকশিত হয়ে ওঠে- রূপকথার রাজ্যেও সেই একই নিয়ম। কোথাও লেখকের নিজের এতটুকু কোনো ছাপ নেই। সর্বত্র একটা উদার বিশাল অনাসক্ত ভাবের লক্ষণ প্রস্ফুটিত হয়েছে।
আধুনিক কবি এই ভাবটিকেই পাল্টে দিতে চান। ব্যক্তিহীনতার বদলে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে প্রতিষ্ঠিত করেন। মানুষের অধিকার, মর্যাদাবোধ এবং ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্য ও গুরুত্বকে স্থাপিত করেন কথাবস্তুর মধ্যে। এইভাবে পাল্টে যায় রূপকথার জগৎটি আধুনিক কালের কবির কাছে। কথাবস্তু বলতে কোনো লেখার আক্ষরিক অর্থকে বোঝায়। আর এই লেখার মাধ্যমে যে অন্তর্নিহিত গভীর ভাবনার প্রতিফলন হয়, তাই হল ভাববস্তু। কালে কালে মানুষের বিচার বুদ্ধি পাল্টাচ্ছে। পাল্টাচ্ছে মানুষের মূল্যবোধ। তাই ভাববস্তুরও পরিবর্তন ঘটছে।
যেমন প্রাচীন মহাভারতে কর্ণ-কুন্তীর সাক্ষাৎকারের সঙ্গে আধুনিক কালের কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কর্ণ-কুন্তীর কথাবস্তু একই। তবে এদের ভাববস্তু আলাদা। মহাভারতে যুদ্ধপরায়ণতাই মূল। মহাভারতের কাহিনীতে কর্ণ-কুন্তীর যে সাক্ষাৎ হয় সেখানে মাতৃস্নেহ ও পুত্রস্নেহকাতরতার পরিবর্তে স্বার্থচিন্তা ও বীরত্ব প্রদর্শনের মেজাজটিই মুখ্য হয়ে দেখা দিয়েছে। আর রবীন্দ্রনাথে- কুন্তীতে মাতৃস্নেহ আর কর্ণে সেই স্নেহ-বুভূক্ষতা বড়ো হয়ে দেখা দিয়েছে।
রামায়ণের মেঘনাদ পাপী ও কাপুরুষ। মাইকেলের মেঘনাদ একজন বীরযোদ্ধা- নির্ভীক-সাহসী।
আবার প্রয়োজনে কথাবস্তুও পাল্টে যায় আধুনিক কালে। কালকেতুর কাহিনীর ভাববস্তু অচল হয়নি- মানুষের দুঃখ-বেদনার নিয়তি এখন লেখা হচ্ছে গল্পে, উপন্যাসে, নাটকে। কিন্তু মঙ্গলকাব্য আর লেখা হয় না।
সেই কথাবস্তু একেবারে বদলেছে। সেই প্রকাশ ভঙ্গিও একেবারে বদলেছে। যদিও সে তুলনায় ভাববস্তু বদলেছে কম।
বিষয়বস্তু আর রূপকলা – দুয়ে মিলে সাহিত্য একটি অখণ্ড সৃষ্টি হয়ে ওঠে। এই অখণ্ডতাই চিরন্তন। যামিনী রায় আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন- বড়ো শিল্পের মর্মকথা হল- চিরন্তনত্ব। শিল্পে এই চিরন্তনত্ব আছে তার বিষয়ে দেশীয় ঐতিহ্যে এবং মিথের সম্পৃক্তিকরণেরর মধ্যে দিয়ে। বিশেষ করে মিথের ব্যবহার, ভাঙন এবং মিথের পুনর্গঠনের মধ্যে দিয়ে।
কবি তুষার গায়েন ঠিক এই কাজটিই করেছেন। তার রূপের জগৎ থেকে পাল্টেছেন ভাববস্তুকে- পাল্টেছেন কথাবস্তুকে।
পতিব্রতা নারীর ভিতর থেকে প্রতিবাদী নারীটিকে প্রতিস্থাপন করেছেন আমাদের চৈতন্যের ভিতরে। তুষারের কাহিনী কোনো পাথুরে ভাষ্কর্য নয়- জলরঙে আঁকা একটি মহত্তম ছবি, যেখানে অনেক কিছুই সুপ্ত, ইঙ্গিতময়। পাঠককে শব্দের বাঁকে বাঁকে সে ইঙ্গিতকে দেখতে হয় শুধু চোখ দিয়ে নয়- চৈতন্য দিয়ে।
৬.
মূল ঘটনায় মালঞ্চমালা পাটরানী হয়েছেন। তুষার এটাকে গ্রহণযোগ্য মনে করেননি। তিনি মালঞ্চকে পাটরানী হবার পরিবর্তে স্বেচ্ছা নির্বাসনে পুনরায় পাঠিয়েছেন বনে। কারণ যে অপমান ব্যক্তি ও নারী হিসাবে মালঞ্চ পেয়েছেন তার প্রতিবাদ হিসাবে এমনটিই যেন মালঞ্চের মতো সাহসী ও গভীর অন্তঃকরণের নারীর সঙ্গে মানানসই। এটা শ্রেণী ও জাতপাতে বিভক্ত সমাজ ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, যা তার সাহস ও ব্যক্তিত্বের সাথে সংগতিপূর্ণ। এছাড়াও যে রাজপুত্রকে সে বড়ো করেছে কোলে-পিঠে, তার সঙ্গে বয়সের ব্যবধান ও সম্পর্কের জটিলতা (মাতৃ ও স্ত্রী সত্তার দ্বন্দ্ব) তাকে ক্ষত বিক্ষত করেছে, তাড়া করে ফিরেছে আজীবন দুঃস্বপ্নের মতো । একারণেই এর সহোদর কাহিনী ‘রুপবান’-এ শেষ দৃশ্যে বর্ণিত রহিম ও রুপবানের বিয়ের ঘটনাটিকেও তুষার অনুসরণ করেন নি।
আবার রাজকন্যা কাঞ্চীর সঙ্গে রাজপুত্রের সুখী দাম্পত্য জীবন দেখা ও তাদের সামনেই সমগ্র বঞ্চিত জীবন পাড়ি দেওয়ার নির্মমতা অনুষ্ঠিত হতে দেয়া স্বাভাবিক জৈব-মানসিক ধর্মের বিরোধী। বনে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্তই এই সব কিছুকে অতিক্রম করে যায়। রাজপুরী নয়, বনই তার নিজের ভূবন।
এটাই পুরণো মিথের ভিতর থেকে নতুন ভাববস্তুর সন্ধান ও আধুনিক বোধের সমন্বয়। মিথের সার্থক বিনির্মাণ। এরকম অনেক বিনির্মিত ঘটনা এবং উপলদ্ধির সমারোহ রায়েছে তুষারের উত্তরমালঞ্চ কবিতায়।
৭.
এই অসাধারণ লোকগাথা বা ‘বঙ্গীয় উপন্যাস’ কবি তুষার গায়েন স্থাপন করেছেন এক অনু-মহাকাব্যের আঙ্গিকে। কবিতা গল্প বা উপন্যাস নয়, কবিতা কবিতাই। অনেক গ্রহণ বর্জনের মধ্য দিয়ে কবিতাটিকে শব্দের যাদুতে বিনির্মাণ করেছেন।
তার বিনির্মিত কাহিনীটিকে তিনি সাতটি পর্বে ভাগ করেছেন চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যের মতো করে।
প্রথম পর্ব- বনপ্রস্থান :
মাঘের শীতে একটি বনপথের দৃশ্য ভেসে ওঠে- সেখানে ধানকাটা মাঠে জ্বলছে নাড়ার আগুন। ধুঁয়া আর কুয়াশা মিলে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে ধোঁয়াশায়। দৃশ্যকল্প বলে দিচ্ছে এটা এই একান্ত বঙ্গের ছবি। দেখা যায় এই বনপথে একটি সদ্য কিশোরী মেয়েকে, যার কোলে দিন কয়েকের একটি শিশু। এ শিশু মেয়েটির সন্তান নয়- স্বামী, যেন স্বাভাবিক মাতৃস্নেহে তার জন্য দুধ খুঁজছে। হিংস্র বাঘদের সঙ্গে তার আত্মীয়তার বন্ধন, তার সতীত্বের ঘোষণা, শিশুটির সঙ্গে তার বয়সের ব্যবধান ও সম্পর্কের জটিলতা, শিশুটি যেন চিরন্তন শিশুদের মতো তাকে মা বলে ডেকে না ওঠে এই শংকা, এই দূরাগত নির্জন একাকী জীবন, তার ভেতরের নারীটির রক্তমাংসের আকাঙ্খা, মানসিক ও শারীরিক জৈব ধর্ম- এইসব দ্বান্দ্বিক পরিস্থিতির একটি নাটকীয় উপস্থাপনা পাই।
থাকি ভয়ে ভয়ে এই ভ্রমে এই যদি মা বলে ডাকে
বিজন বনের পথে দূরাভাসে ছায়া কাঁপা কাঁপা
অতল রাত্রির থেকে জল ভেসে আসে, উথলে উথলে
ওঠা জল দু’চোখ বিহনে যাবে কোথা পাবে কোথা পথ
নেই পথ নেই পথ সতীধর্ম যৈবন নদীর
দু’কূল ছাপায়ে ওঠে বাষ্পে বাষ্পে ভারী
অবরুদ্ধ গীতি… গেয়ে যাও পানকৌড়ি
সলাজ রক্তের গানে প্রতীক্ষিয়া প্রতীক্ষিয়া বহু বর্ষ কাটে
এই পর্বের শেষাংশে দেখতে পাই, রাজপুত্রকে শিক্ষাদানের জন্য মালঞ্চমালা বন ছেড়ে লোকালয়ের দিকে যাত্রা করছে। স্কুলের ঘন্টা ও হ্রেষাধ্বনির উল্লেখ সেই আবহকে তুলে ধরে।
দ্বিতীয় পর্ব- স্মৃতি : বনে বাড়ে রাজার কুমার
ফ্লাশব্যাকে, রাজকুমারের বনে বড়ো হয়ে ওঠার চিত্রটা পাই। বনের উদার আশ্রয়ে বড়ো হয় রাজকুমার, যেখানে নেই লোকালয়ের ক্ষুদ্রতা ও জাতপাতের নিমর্মতা। মালঞ্চ তার শিশু স্বামীকে সন্তানস্নেহে বড়ো করে তোলে। কাজল আঁকে চোখে। এইখানে সেই চিরন্তন বাংলার রমণীকে পাওয়া যায়। মালঞ্চমালা নিজেকে শোনায়-
বনে বাড়ে, বন সে’তো দূরে নয় লোকালয় থেকে
তবুও বনের মনে কী গভীর রহস্য আছে
আছে দানধর্ম তার, লোকালয়ে নাই!
জানে তাই বাঘমামা গাছ থেকে মধু পেড়ে আনে
শিশু স্বামীটিরে কি খাওয়াবো, কি রাঁধি
কোলে নিয়ে বসে থাকি, কাজল এঁকেছি চোখে তাঁর
বিতাড়িত পথে পথে দুধের ফোয়ারা ছুটে আসে
এই দুধ ঠোঁটে মুখে তাঁর মেশে সকল অব্যয় ধ্বনি
যেখানে মানুষ নেই, আহা-
মমতা সেখানে জানি, ঘর বেঁধে রাখে।
তৃতীয় পর্ব- রাজটিকা :
রাজপুত্র রাজার ছেলে। কিন্তু মালঞ্চমালা কোটালকন্যা, নিচু বর্ণের। তবু নিজ দায়িত্বে তাকে রাজার ছেলের মতো তার বসন-ভূষণ-বাহন জোগাড় করে দেয়। তাকে রাজপুত্রের মতো বড়ো করে তোলে। হয়তো মনে সাধ, কুমার বড়ো হলে তাকে (মালঞ্চমালা) জানবে তার প্রকৃত পরিচয়ে, মূল্য দেবে তার আত্মত্যাগের ।
সকলেই জানে সে’তো বহুপূর্বে মৃত ছিল
চিতায় পুড়েছে ঘন বর্ষার রাতে
মরা কি জীয়ন্ত হয়, যদি না সে জাতিস্মর
বেভুলে কখনো কারো হঠাৎ অতীত মনে পড়ে!
চতুর্থ পর্ব- পাপসূত্র, মৃতের জীয়নকাঠি :
আরেকটি ফ্লাশব্যাক দেখি। সেই প্রথম দিনের ঘটনা যা ছিল মালঞ্চের জন্য ও তার পিতার জন্য অনিয়ন্ত্রিত। রাজার আদেশে একটি নিম্নবর্ণের ১২ বছরের মেয়ের সাথে ১২ দিনের রাজপুত্রের বিয়ে হল। শিশুর মৃত্যু, এই মৃত্যুর জন্য নিয়তিকে নয় মেয়েটিকে দায়ী করা, তাকে ডাইনী বলে ঘোষণা দেওয়া, চিতায় তোলা, বৃষ্টির কারণে আগুন থেকে বেঁচে যাওয়া মৃত শিশুটিকে ভূত-প্রেতের ছোবল থেকে বাঁচানো ও তাকে নিয়ে গোপনে বনে চলে যাওয়া - এই যে একটি সামাজিক, শাস্ত্রীয় ও ক্ষমতার শিকার হয়ে একটি মেয়ে অসহায় হয়ে লোকালয় ছেড়ে প্রকৃতির কোলে আশ্রয় নিল - তার চাওয়া-পাওয়া, আশা-আকাঙ্খার কোনো মূল্য নেই। এর কারণটির পেছনে রয়েছে ইতিহাসের কুটিল ছায়া। সেই ইতিহাসটি এসেছে ভারতে আর্যদের আগমনের সঙ্গে, যারা ঘোড়ায় চড়ে নেমে এসেছিল পাহাড় থেকে পলি সমতলে। সমগ্র সমাজ শ্রেণী বিভক্ত হয়ে যায় এই বিদেশী আর্যদের আগমন ও তাদের শাস্ত্র প্রণয়নের মাধ্যমে। এই ঘোড়ার প্রতীকটির সঙ্গে অনার্যদের সামাজিক অবস্থানের পতন – পতনের কারণ হিসাবে শাস্ত্রের উত্থান - এই ইতিহাসটাই এই পর্বে বর্ণিত হয়েছে।
পতন পতন শুধু ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দে
পতনের শুরু; আমিও পতিত তাই
কাল সব জানে, তারা কারা এসেছিল
পাহাড় প্রদেশ থেকে নেমে এই স্নিগ্ধ পলি সমতলে …
লালধ্বনি হ্রেষা আনে সকল বিভক্তি রীতি
শাস্ত্র নামে ঘটে গেছে জানি, বহুকাল আগে।
পঞ্চম পর্ব- ধল প্রহরের গান :
রাজপুত্রকে বিদ্যালয়ে পাঠায় মালঞ্চমালা। সেখানে কেবল রাজসন্তান ও উচ্চবর্গীয়রাই যায় শিক্ষা নিতে। সেজন্য রাজপুত্রকে রাজার বসন-ভূষণে-বাহনে পাঠানো হয়। সেখানে রাজপুত্রের সাথে দেখা হয় এক রাজকন্যার। দুধবর্ন তার গায়ের বরণ এবং মর্যাদায় সমবংশীয়। মালঞ্চ নিজেকে আড়াল করে রাখে, যেন বেড়ে ওঠা রাজকুমার তাকে ভুল করে মা বলে না ডাকে। তবুও মালঞ্চের গোপন আকাঙ্খা যেন রাজকুমার একদিন জানতে পারে যে সে তার স্ত্রী - যে একাই সমাজ, শাস্ত্র, দুর্যোগ ও সকল প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে প্রাণপন সংগ্রাম করে তাকে বড়ো করে তুলেছে এবং এই নারীটিকে তার নিজস্ব নারী হিসাবেই যেন অন্তত একবার হলেও রাজকুমার মূল্য দেয়।
দূরে দূরে থাকি যাতে অসম বয়সে
ভুল ভেবে না ডেকো গো, মা বলে আমাকে
আমি যে গো তোমার জায়া এই সত্য জেনে
দেখো ফিরে একবার এই একাকী নারীকে !
ষষ্ঠ পর্ব – দাঁতে কাটি কারাগার :
ভিনদেশী রাজার আক্রমণে পরাজিত শ্বশুর-রাজা ও স্বামী বন্দী রাজপুত্রকে উদ্ধারের সেই ঘটনাটি দেখতে পাওয়া যায়। বনে একা থাকা মালঞ্চমালা খবর পেয়ে তার স্বামী ও শ্বশুরকে উদ্ধার করে বাঘ বাহিনী নিয়ে। নিজের দাঁত দিয়ে স্বামীর শিকল কেটে তাকে মুক্ত করে। এক একটি দাঁতের বিনিময়ে এক একটি শিকলের বন্ধন কাটে মালঞ্চ। তাতে যে রক্তদর্শন ঘটে, তা এক ভিন্ন অনুভবে মালঞ্চের মনে সুপ্ত মিলনের আকাঙ্খা জাগিয়ে যায়। কেননা সতী নারী রক্তপাতের মধ্য দিয়েই প্রথম স্বামী মিলনের তৃপ্তি ও সুখ পায়। মালঞ্চ এইখানে তার স্বপ্ন- আকাঙ্খার কথা বলছে –
দাঁতে কাটি শিকলের বেড়ি, লোহার শিকল
সে নয় কঠিন এই ইচ্ছার থেকে
রক্তদর্শন ছাড়া জানি সুখ হয় না কখনো
এই রক্ত সুখ হবে যদি বাঁচে সাধের কুমার
তুমি স্বপ্নে উঠে এসো ক্রোড়ে, বনে বনে কেটেছিল
যদি অভয় নিদ্রার কাল, নিদ যাও নিদ যাও বুকে
তোমার তরুণ মুখ পিপাসার মত
পাহাড়ের ক্ষত থেকে জলের আর্তি আসে ছুটে
সপ্তম পর্ব – বনে ফেরা, ছায়ার কঙ্কাল :
এই শেষ পর্বে গল্পের পরিণতি ঘুরে যায়। যে বিপুল আত্মত্যাগ ও সংগ্রামের বিনিময়ে মালঞ্চমালা তার অসম বয়সী স্বামীটিকে বাঁচিয়েছে, তার শ্বশুরকে বাঁচিয়েছে - তার বিনিময়ে সে পায়নি তার প্রাপ্য অধিকার, সম্মানিত স্ত্রী ও আকাঙ্খিত ঘর সংসার। বরং পেল বনবাস যার চেয়ে মৃত্যুকেও তার প্রিয় মনে হয়। তাই তার আর্ত উপলব্ধি শুনি যে, ভালবেসে দাঁত দিয়ে শিকল কাটা যায়, কিন্তু মনের দেয়াল কাটা যায় না।
দাঁতে কাটে কারাগার মনের দেয়াল কাটে নাকো
গ্রহণের সীমারেখা মানুষের এত ছোট এত ছোট
কুমারের আয়ু আজ অনন্ত আকাশ
তবু রাজা আমায় দিলেন বনবাস
আমি যে কোটালকন্যা অবরুদ্ধজন, পথে পথে কাঁটা
সরোবরে ডুব দেবো সেখানে পাহারা…
এইখানে এসে চোখে জল আসে। এই বঞ্চিত নারীর জন্য আমাদের হৃদয় ভেঙ্গে পড়ে। শাস্ত্রের প্রতি জমে ওঠে ক্রোধ। আমরাও তাই সমর্থন করি তার বনে ফেরা- যেখানে জাতপাতের বিভাজন নেই, আছে ভালবাসা- যা উন্মুক্ত, উদার, অখণ্ড-
তবে আমি বনে যাই যার শাস্ত্র নাই কোনো
এই পথ চলে গেছে দূর পাতাস্রোতে
পাতার আড়ালে গাছ ধরে রাখে ছায়ার কঙ্কাল
রৌদ্র হলে জানি তাই মেলে দেবে পথে।
৮.
কবিতার শুরু বনে। শেষও বনে। বনমর্মর শোনা যায় কবিতার প্রতিটি শব্দে, প্রতিটি বাক্যে- কথাবস্তু ও ভাববস্তুতে। এই বন সহজ সরল, স্বাভাবিক, সপ্রাণ ও সবুজ। এখানে গাছপালা, পশুপাখি, নদীজল- আকাশবাতাস, মেঘ ও মাটি- একীভূত। অখণ্ড সত্তা। স্বার্থের দ্বন্দ্ব নেই। নেই বিভাজন। আছে উদার ঐক্য। অখণ্ড একাকার হয়ে যাওয়ার টান। শুভর সঙ্গে মিলনের বোধ।
যে কারণে শাস্ত্রবদ্ধ মানব কখনো কখনো বনবাসীর সন্দেহর কারণ হয়ে ওঠে। আবার যখন বোঝে, যে মানুষ শাস্ত্রবিহীন, প্রকৃতির মত সৎ বনে আশ্রয়প্রার্থী- তাকে আশ্রয় দেয় মায়ের মতন। বন যেন মা। আদিমাতা। তার অধিবাসী গাছপালা, পশুপাখিও এই মাতৃস্নেহ জানে – মাতৃস্নেহ মানে। সবাইকে কোলের আশ্রয়ে ধরে রাখে। কাউকে বিমুখ করে না। যে কারণে দেখি, বাঘ রাজপুত্রকে খেতে চায়। কিন্তু ব্যাঘ্রসমাজ মালঞ্চমালার সত্য কথনে মুগ্ধ। তারা শিশুটির জন্য গাছে গাছে যায় খাবার আনতে। গাছও তাদের দেয় অবারিত মধু। পথে পথে মেলে দুধ। এবং মেয়েটির জন্য তারা লড়াই করে বিভাজনকামী মানুষের বিরুদ্ধে। আক্রান্তদের বাঁচায়। আবার ন্যায়বোধে অন্যায়কারী শ্বশুরশ্বাশুড়ীকে খেতে চায়। মেয়েটির অনুরোধে তাদের ক্ষমাও করে দেয়। এই যে বাঘের ভেতরে দেখি সেই মহৎপ্রাণের উৎসারণ- যার ভেতরে নেই অশুভ ভাবনা। আছে ন্যায়বোধ ও মমতার সঘন হৃদয়।
আর গাছ প্রকৃতির অখণ্ড প্রতীক। গাছ তার ভিতরে ধরে রাখে প্রকৃতির বিশালতা। দানধর্ম। সুন্দরের আকাঙ্খা। কাউকে সে দূরে ঠেলে দেয় না। দেহ ও মনের খাদ্য সে যোগায় মায়ের মতোন। তার পাতাটি, ফুলটি, ফলটি, শাখাটি দানধর্মে প্রবল। আর শেকড় যেভাবে আকড়ে ধরে মাটিকে- কালের করাল গ্রাস থেকে ফেরায় মাটিকে, বাতাসকে, আলোকে- সে রকম আমরা দেখি গাছ সমগ্রকে ধরে রাখে। ছায়াটিকে ধরে রাখে। ছায়াটি হারিয়ে গেলে তার কঙ্কালটিকেও ধরে রাখে। কাউকে সে হারায় না। একাত্ম করে রাখে। এই খণ্ড- খণ্ডের সঙ্গে অখণ্ডের মিলনের খেলা তাই অতি স্বাভাবিক ও মহত্বের ইঙ্গিত।
প্রকৃতির শান্ত সুরটিই এ কবিতার প্রাণের সঙ্গীত। প্রকৃতির অখণ্ড বোধই এ কবিতার প্রাণ।
৯.
এই মর জর্জর, ষড়যন্ত্রময় জগৎ থেকে আমাদের ফেরায় এ কবিতাটি সেই দীর্ঘ শমিত অভিযাত্রায়- মাঘশীতে, ডোরাকাটা বনপথে, নাড়ার আগুনে, কাঁপা কাঁপা ছায়ার ভেতরে, অতল রাত্রিতে, জলে ভেসে যাওয়ার মধ্যে, পানকৌড়ির উড়ে যাওয়ায়, ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দে, মেঘে,মেঘের পালঙ্কে, বনমধুতে, আকাশময় আকাশে, কচুপাতায়, স্নিগ্ধ পলি সমতলে, শ্বেতপঙ্খীতে, পাহাড়ের ক্ষতে, জলের আর্তিতে, একটি বা দুটি তারায়, সরোবরে, পাতাস্রোতে, রোদ এবং ছায়ার কঙ্কালের ভেতরে, রূপের ভেতরে, প্রাণের ভেতরে। জীবনের প্রাণবন্ত অস্তিতে।
এ কবিতার আয়োজন যে শব্দে নির্মিত হয়- তারা সব সত্য শব্দ, সপ্রাণ এবং আত্মার ধ্বণিতে মুখর। তারা পাতার মতো মর্মরিত, আলোর স্পর্শে পুষ্টি যোগায় কবিতার গাছটিকে। শব্দগুলি ফুলের পাপড়ির মতো লাবণ্যময়, সুবিন্যস্ত। রচনা করে একটি ফুলজীবন- তার আছে ঘ্রাণ- আছে রঙের ইশারা, যা প্রজন্মকে ডেকে আনে। আরেকটি ফুলের সম্ভাবনাকে জাগিয়ে তোলে। জাগিয়ে তোলে আছে সৃজনের সক্ষম সামর্থ্য। অপ্রয়োজনের ভার কোনো শব্দ কাঠামোর ভেতরে ও বাইরে চিহ্ণিত হয় না।
কবি তুষার বলেছেন একটি রূপকথা- রূপের জগতের ভেতরে রূপের কথা, আরও গভীরে লুকিয়ে থাকা চুপকথা। এজন্য তিনি নির্মাণ করেছেন একটি পৃথক কাব্যভাষা। যা শান্ত, মন্দ্র এবং প্রাণোৎসারিত। যেমন আমরা দেখতে পাই-
মাঘশীতে ডোরাকাটা যায় দূর বনপথ
কুয়াশারেখায় ঢাকা পথ নেই পথ নাড়ার আগুন
ফিক ফিক করে জ্বলে নেভে ধোঁয়াশা ছড়ায়
দূরাবহে হেটে যায় পরী, কোলে তার
শিশু নয় স্বামী, বারোদিন রাত্রি কেটে যার
আয়ু হল কাল; পথে পথে কে আছে তাঁকে
দুধ দেবে ওগো, বাঘমামা আমি সতী নারী
থাকি ভয়ে ভয়ে এই ভ্রমে এই যদি মা বলে ডাকে
এ ভাষার মধ্যে সেই প্রাচীন রূপের জগতের মন্দ্রতা বোঝাতে ব্যবহার করেছেন দূরাবহ, রাত্রি, ভ্রম গুরুগম্ভীর শব্দ। আবার সমকালীন করে তুলেছেন- ডোরাকাটা, নাড়া, বাঘমামা- এইসব সহজ সরল প্রতিদিনের ব্যবহৃত শব্দ ব্যবহারের মধ্যে দিয়ে। এই মন্দ্র ও সরল শব্দ আশ্চর্যভাবে মিলিত ঐক্যতান সৃষ্টি করে- যা তুষারের কাব্য-সামর্থ্যের বিশেষ প্রকাশ।
যে কোনো শব্দের দুটো দিক থাকে। এক. তার অর্থের দিক। দুই. তার রস-প্রতীতির দিক। গদ্য শব্দের আক্ষরিক অর্থকে প্রধানত ধারণ করে। কিন্তু কাব্য উন্মোচন করে শব্দের রস-প্রতীতি বা রহস্য ও ব্যঞ্জনাকে। ‘সলাজ রক্তের গানে প্রতীক্ষিয়া প্রতীক্ষিয়া বহু বর্ষ কাটে’- এইখানে শব্দের অসাধারণ যাদুকরী ব্যবহার করেছেন তুষার। মেয়েটি ১২ বছরের। সবে যৌবনপ্রাপ্ত হয়েছে। তার ভেতরের নারীটি জেগে উঠেছে। ঋতুচক্রের যে নম্র লজ্জা এবং নারী হয়ে ওঠার গৌরব- এই দুটি বিষয়কে একই সঙ্গে তুষার ব্যবহার করেছেন ‘সলাজ রক্তের গান’ শব্দবন্ধটি। যে গানটির মাধ্যমে আবেদন জানাচ্ছে পুরুষটিকে- সে শিশুমাত্র। এখন এই সলাজ রক্তের গানের কোনো মানে নেই। কিন্তু একদিন মানে হবে। তার জন্য আছে অপেক্ষা। বহু বছরের প্রতীক্ষা।
এই রকম শব্দের অন্তর্গত আবেগ, সমাবেশ ও ধ্বনি বৈচিত্র্য এবং ছন্দের শোভনতা নিয়ে নির্মিত হয়েছে উত্তরমালঞ্চ কবিতাটির রূপময় ভাষা। হয়ে উঠেছে অনির্বচনীয়।
এবং রূপময় ভাষার অর্ন্তগত প্রতিটি বাক্যে প্রতিটি শব্দের মধ্যে আছে অন্বয় । আছে বাক্যের সঙ্গে বাক্যের অন্বয়। কোনো বাক্যই দুর্বল বোধ হয় না। হাত ধরাধরি করে কবিতার দিকে পাঠককে এগিয়ে নিয়ে যায়।
ক) ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দে সরে যায় মেঘ
!
খ) মেঘের পালঙ্কে শুয়ে রাজার কুমার
!
গ) বনে বাড়ে, বন সে’তো দূরে নয় লোকালয় থেকে
!
ঘ) তবুও বনের মনে কী গভীর রহস্য আছে
!
ঙ) আছে দানধর্ম তার, লোকালয়ে নাই!
প্র্রতিটি বাক্যই চমকে দেওয়ার মতো। প্রথম বাক্যে সামন্ত জীবনের বিলাস ব্যসনের অহংকার বর্ণিত হয়েছে, যার মধ্যে মেঘের সরল সৌন্দর্য হারিয়ে যায়। কিন্তু পরের বাক্যে দেখি রাজার কুমার সে কৃত্রিম বৈভবের মধ্যে নেই। তাই মেঘের সরল অলংকার তার পালঙ্ক হয়ে উঠেছে। এই মেঘের সৃজনশীলতার মধ্যে তার বর্তমান বন-বসবাস এবং আনন্দময় বেড়ে ওঠা। সেই বনের অখণ্ড সত্তার মধ্যে বেড়ে ওঠা- যেখানে লোকালয়ের ঈর্ষা-হিংসা-দ্বেষ-স্বার্থপরতা নেই , আছে কল্যাণের, বিস্তার যাকে তুষার বলেছেন- দানধর্ম। এই বাক্যটিকে একটু নিবিড়ভাবে দেখলেই বোঝা যায়- তারা আলাদা আলাদা বাক্য , আলাদা আলাদা চিত্র, কিন্তু একটি অখণ্ড চিত্রের দিকে- সম্পর্কের দিকে আমাদের সঙ্গী করে নিয়ে যায়, গভীর রহস্যের মধ্যে দিয়ে গাথা হচ্ছে একটি মালা। প্রতিটি পঙক্তিই মালাটির সমান লাবণ্যের ফুল। কোনোটি তাজা বা কোনোটি মৃত নয়। সকল শব্দই জীবন্ত। কোনো শিথিলতা নেই।
১০.
কবিতার ছন্দটি কথাবস্তু ও ভাববস্তুর মতোই নিখুঁত।
এ ছন্দ কান ও মনকে স্নিগ্ধ করে। আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্যের ভিতরকার ঋদ্ধ প্রাণের সুরটিকে প্রাণে পৌছে দেয়। বোঝা যায় কাব্য ও ছন্দ অঙ্গাঙ্গীভাবে বাঁধা। কেননা ছন্দ আর আবেগ যমজ। যেমন কবি কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত জানান, এই ছন্দ কৃত্রিম গণিত সাপেক্ষ মাত্রা গণনা নয়। তা কুস্তি করে সাজানোর কোনো প্রয়োজন নেই। তা নাচের তালের মতো স্বাভাবিক অঙ্গভঙ্গি। আর আমরাতো এই ভঙ্গিটিকে মুখ্যত দেখি না। ভঙ্গির মধ্যে দিয়ে অনির্বচনীয় আনন্দকে দেখতে চাই- যে আনন্দ কবিতারই অন্য নাম।
১১.
এ সময়ের অনেক কবি শেকড়ের কাছে ফেরার কথা বলেছেন। লিখছেন- মিথ নির্ভর কবিতা। মাটিবর্তী কবিতা। সে সব কবিতার মধ্যে যতো রয়েছে অহংকার আর নির্মাণ-চতুরতা- কিন্তু নেইস্বদেশ শেকড়ের আবিষ্কার। তাই কোনো কোনো কবিতা হয়ে ওঠ শব্দের সম্ভারমাত্র, শব্দের চমক অথবা দুএকটি বাক্যের স্ফূর্তিমাত্র। সেখানে যে আকাশ বর্ণিত হয়, যে জল ও মাটির ভুবন দৃশ্যমান হয়, তার সাথে আমাদের বাংলাদেশের মিল খুঁজে পাওয়া কষ্টকল্প হয়ে ওঠে। শেষমেষ তা হয়ে ওঠে- ঘোড়ার ক্ষুরের ধ্বনির ব্যর্থ অনুকরণ। যে মেয়েটিকে সে সব কবিতায় দেখতে পাই সে ছাদে দাঁড়িয়ে পাশের বিল্ডিং-এর ছাদে উঁকি মারে, যে ছায়াটিকে চোখে পড়ে তা ড্রাগনচিহ্ণিত কোন অপচ্ছায়া মাত্র, যে গাছটিকে লক্ষ্য করি- তা আসলে কোনো গাছ নয়- গাছের কঙ্কাল- বনসাই।
আর প্রকৃত আকাশ দেখা যায় এই ‘উত্তরমালঞ্চ’ কবিতায়। এ কবিতার আকাশ তা আমাদের বাংলাদেশেরই আকাশ, এ কবিতার জল আমাদের নদী ও পুকুরের জল। আমাদের আলো ও হাওয়ার ভিতরের জীবন-নিসর্গের রূপময়তা এ কবিতার ছত্রে ছত্রে। যে গাছটি সবুজ হয়ে ওঠে আমাদের চোখের সামনে, তা আমাদের আত্মার অখণ্ড আশ্রয়। আমাদের জীবন যা প্রকৃতিরই খণ্ডাংশমাত্র- যার মূল প্রবণতা প্রকৃতির অখণ্ড প্রাণের ভিতর ফিরে যাওয়ার- সে প্রাণকে ধারণ করে আছে প্রকৃতই কবি তুষার গায়েনের কবিতা।
http://www.facebook.com/s.php?q=Subrata+Augustine+Gomes&k=100000020&init=ffs#/note.php?note_id=227641105337&ref=mf
তথ্যসূত্র:
. ১.আধুনিক সাহিত্য : গোপাল হালদার। ২. রূপকথা : শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ৩.পটুয়াশিল্পী : যামিনী রায়
৪.কাব্যের মুক্তি : সুধীন দত্ত। ৫. বৃষ্টির অন্তর ত্রাস : তুষার গায়েন, নিসর্গ প্রকাশন, ঢাকা।
মূল কবিতাটি-
উত্তরমালঞ্চ
বনপ্রস্থান
মাঘশীতে ডোরাকাটা যায় দূর বনপথ
কুয়াশারেখায় ঢাকা পথ নেই পথ নাড়ার আগুন
ফিক ফিক করে জ্বলে নেভে ধোঁয়াশা ছড়ায়
দূরাবহে হেটে যায় পরী, কোলে তার
শিশু নয় স্বামী, বারোদিন রাত্রি কেটে যার
আয়ু হল কাল; পথে পথে কে আছে তাঁকে
দুধ দেবে ওগো, বাঘমামা আমি সতী নারী
থাকি ভয়ে ভয়ে এই ভ্রমে এই যদি মা বলে ডাকে
বিজন বনের পথে দূরাভাসে ছায়া কাঁপা কাঁপা
অতল রাত্রির থেকে জল ভেসে আসে, উথলে উথলে
ওঠা জল দু’চোখ বিহনে যাবে কোথা পাবে কোথা পথ
নেই পথ নেই পথ সতীধর্ম যৈবন নদীর
দু’কূল ছাপায়ে ওঠে বাষ্পে বাষ্পে ভারী
অবরুদ্ধ গীতি… গেয়ে যাও পানকৌড়ি
সলাজ রক্তের গানে প্রতীক্ষিয়া প্রতীক্ষিয়া বহু বর্ষ কাটে
বাঘমামা, যদি না থাকিতে বনে…এইবার যাই!
পালাই পালাই বন থেকে দূরে লোকালয়, বিদ্যালয়
প্রথম পাঠের ঘণ্টাধ্বনি, হ্রেষা শোনা যায়…
স্মৃতি: বনে বাড়ে রাজার কুমার
ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দে সরে যায় মেঘ
মেঘের পালঙ্কে শুয়ে রাজার কুমার
বনে বাড়ে, বন সে’তো দূরে নয় লোকালয় থেকে
তবুও বনের মনে কী গভীর রহস্য আছে
আছে দানধর্ম তার, লোকালয়ে নাই!
জানে তাই বাঘমামা গাছ থেকে মধু পেড়ে আনে
শিশু স্বামীটিরে কি খাওয়াবো, কি রাঁধি
কোলে নিয়ে বসে থাকি, কাজল এঁকেছি চোখে তাঁর
বিতাড়িত পথে পথে দুধের ফোয়ারা ছুটে আসে
এই দুধ ঠোঁটে মুখে তাঁর মেশে সকল অব্যয় ধ্বনি
যেখানে মানুষ নেই, আহা-
মমতা সেখানে জানি, ঘর বেঁধে রাখে!
রাজটিকা
কোটালকন্যার হাতে যদি বাড়ে রাজার কুমার
তবু সে’তো রাজপুত্র, রাজধর্ম তাঁর
একযুগ পার হলে যেন সব চিহ্ণ
সমান স্বরূপে ফুটে ওঠে তাঁর, এই ভার
নিয়েছি নিজের বোধে…কেউ জানে নাই
সকলেই জানে সে’তো বহুপূর্বে মৃত ছিল
চিতায় পুড়েছে ঘন বর্ষার রাতে
মরা কি জীয়ন্ত হয়, যদি না সে জাতিস্মর
বেভুলে কখনো কারো হঠাৎ অতীত মনে পড়ে!
পাপসূত্র, মৃতের জীয়নকাঠি
মৃতের শরীর থেকে মৃত্যু উড়ে গেছে
জীবন চিৎকার করে নামে সেইরাত
চোখের কোটরে দেখি আবার চোখের জল
ধুয়ে যায় দৃশ্যগাঁথা বন সর্ সর্
বিদেহী ছায়ারা দ্রুত মিশে যায় বাষ্পীভূত
আকাশে আকাশময় জড়ো হয় মেঘ
বড় বড় বৃষ্টিফোঁটা ধারা হয়ে নেমে আসে
ন’ড়ে চ’ড়ে কচুপাতা কিছু জল ধরে রেখে
বাকিটুকু ফেলে দেয় পতনের প্রেমে:
পতন পতন শুধু ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দে
পতনের শুরু; আমিও পতিত তাই
কাল সব জানে, তারা কারা এসেছিল
পাহাড় প্রদেশ থেকে নেমে এই স্নিগ্ধ পলি সমতলে…
লালধ্বনি হ্রেষা আনে সকল বিভক্তি রীতি
শাস্ত্র নামে ঘটে গেছে জানি, বহুকাল আগে।
ধল প্রহরের গান
ওঠো ওঠো রাজার কুমার বিদ্যালয়ে যাও
বিদ্যালয়ে তোমার সমান রাজকন্যা পাও
দূধের বরণ রাজকন্যা শ্বেতপঙ্খী নায়ে
এনে দেবো পঙ্খীরাজ চিঁহিঁ রবে গায়
দূরে দূরে থাকি যাতে অসম বয়সে
ভুল ভেবে না ডেকো গো, মা বলে আমাকে
আমি যে গো তোমার জায়া এই সত্য জেনে
দেখো ফিরে একবার এই একাকী নারীকে!
দাঁতে কাটি কারাগার
দাঁতে কাটি শিকলের বেড়ি, লোহার শিকল
সে নয় কঠিন এই ইচ্ছার থেকে
রক্তদর্শন ছাড়া জানি সুখ হয় না কখনো
এই রক্ত সুখ হবে যদি বাঁচে সাধের কুমার
তুমি স্বপ্নে উঠে এসো ক্রোড়ে, বনে বনে কেটেছিল
যদি অভয় নিদ্রার কাল, নিদ যাও নিদ যাও বুকে
তোমার তরুণ মুখ পিপাসার মত
পাহাড়ের ক্ষত থেকে জলের আর্তি আসে ছুটে
‘বাঘমামা, খেয়ো না খেয়ো না, এই কাঞ্চী কুমারের নিধি
এত সাধ রক্তপানে যদি, তবে খাও আমাকেই আগে’…
একে একে দাঁতের বিনাশে কাটে শিকলের ভার
কাক ডাকে ভোর হয় ফর্সা আকাশে
নিথর একটি, তবু, দু’টি তারা থাকে!
বনে ফেরা, ছায়ার কঙ্কাল
দাঁতে কাটে কারাগার মনের দেয়াল কাটে নাকো
গ্রহণের সীমারেখা মানুষের এত ছোট এত ছোট
কুমারের আয়ু আজ অনন্ত আকাশ
তবু রাজা আমায় দিলেন বনবাস
আমি যে কোটালকন্যা অবরুদ্ধজন, পথে পথে কাঁটা
সরোবরে ডুব দেবো সেখানে পাহারা…
রাজা আমায় নিলেন নাকো ঘরে, না দিলেন মৃত্যুপরোয়ানা!
তবে আমি বনে যাই যার শাস্ত্র নাই কোনো
এই পথ চলে গেছে দূর পাতাস্রোতে
পাতার আড়ালে গাছ ধরে রাখে ছায়ার কঙ্কাল
রৌদ্র হলে জানি তাই মেলে দেবে পথে।
লেবেলসমূহ:
কবিতা আলোচনা,
ফরহাদ মুস্তফা
কবি সুমন সুপান্থ-র কবিতা : নিশিন্দা মেঘের বাতিঘর
যৌথ ভুলের দিন
..........
একে একে বিফলে যাচ্ছে যতো সমুদ্রচর্চা ; ঢেউপ্রজনন!
তোমার জন্য থাকছে- গীত, বাঁশিসমেত পল্লীবিজ্ঞান
যেভাবে শিখেছি একদা স্তবের বিনিময়ে ভিক্ষা গ্রহণ
থৈ থৈ করে বাজছে তেমনি পরমায়ু হনন পিয়াসী অর্গান
উন্মুক্ত করে দিচ্ছে ক্ষয়ে যাওয়া যতো দগ্ধঘন ত্বক
তরঙ্গ তুলে নেচে উঠছে ধুলোবর্ণ বিকেল, অধুনা আলোক
স্রোতে স্রোতে ফিরে আসছে মুখোমুখি বসিবার দিন
দ্রোণফুলে নিবিষ্ট ভোমরা- অর্ধেক বিরহী বাকিটা রঙিন
উড়ে গিয়ে পুড়িয়েছে ডানা বিলোড়নের কালে
রঙ হারানোর রাতে তাই শোনো স্মৃতিমাতৃক যতো ভায়োলিন
সূত্র ভুলে বেজে উঠবে আবার অ্যালভিয়োলাস সকালে
নতুন সন্ধিতে কেউ ফিরে পাবে ফের যৌথভুলের দিন।
রোদ রঙা ঘোড়া চরিত
...............
বছরের শেষ মৃদু সন্ধ্যায় আমাকে এসে দেখে যায় মাছঘরের পাখি
ঘোর লাগা চোখে আমি তন্দ্রায় যাই আমার শিকারী পিতার মতন
কতো চন্দ্রমাস জালে আর জলে বন্দী নিজেদের পৌরাণিকী !
জেনো, আমারো ভাই ছিলো এক, লাঠিয়াল। আরেকজন বিভীষণ
আমাদের ধানসিঁড়ি নদীতে এসে জল খেতো রোদরঙা ঘোড়া
আমার বর্ষীয়সী দিদি’মা একবার কাঁথায় গেঁথেছিলো সেই অধ্যাস
পড়বে বলে আমার ভাই সেই যে ইশ্কুলে গেলো আর হয়নি ফেরা
আমার মা তাই মাঠের ভেতর খুঁটে ফেরে আত্মজ রক্তের ঘাস
প্রতি সন্ধ্যায় পুরোনো গাঙুর নদীটি উৎসবের সুরে
ভাঙতে ভাঙতে দু’তীর বেহুলার মতো মূক হয়ে যায়
আমার লখিন্দর ভাইটি তবু জেগে ওঠে না বিস্মরণের ভোরে
ধূম লেগেছে বিদ্রুমে আজ - নবান্ন ‘উপ-হাসে’ বছরান্তর
কালো ডানা থেকে বিন্দুপুরে তবু কৈবর্ত্যরে উষ্ণতা বিলায়
বর্গি তাড়াবে তাই, আমার সন্তান শুধু জেগে থাকে রাতভর
স্মৃতিফলকে গাঁথা কুমারী
...............
আমাদের পড়শি যে নদী ছিলো স্মৃতেশ্বরী
ভোর হলে ঘাটে ফিরে আসে ভেলা, বেহুলাভাসানতরী
তুমি তারে আঁচল করে পরে নিলে গত শীতে !
অথচ তুমিই তো কবে যেন আমাদের হাড়ে ও পেশীতে
এঁকেছিলে নাচঘর, হাড়ানো ঘুঙুরের মৃত ধ্বনি
স্রোতের গহিনে ডুব সাঁতারের দাগ, রক্তের সিস্ফনি
মাঝ সায়রে ডুবে যাওয়া এলাচের জাহাজ !
এই সবই গত শীতে।
আর আসছে যে বসন্ত সে কালে আমাদের অভিমান ফোটে
ফুটে কী, ফুটে ঝরে যায় ! তাতে স্বপ্নের অধিক
নিয়তির প্রতীক
তোমার অই বেহালা শীতেরই গান গেয়ে ওঠে
ওপারে তখন কেউ ছেড়েছে ঘুড়ি ধারালো সুতোয়
তাতে আমার আঙুল কাটে তোমার ছেঁড়ে আঁচল
গান নয়, রক্ত না জল
গূঢ় অভিমানে ফের আমার বুকেই শোয়
দাদাজানের ফরচা
..........
এই যে বিরহবেলায় রচিত গান গাওয়া হলো বিষণ্ন সুরে,
উড়ে যাবার আগে ব্যথিত শিস কেটে গেলো পাখিদম্পতি
তাদের ডানার নিচে কিছু রোদফুল ছিলো প্রতি ভোরে
ঝরে গিয়ে তারা ফুটেছে আবার! অতি সম্প্রতি
এমন কিছু তথ্য পেয়ে দিশেহারা ধুলোসমাজ
এবার একটা আবিষ্কার হবে নিশ্চয়ই ! কী করে
গানে ও শিসে সখ্য হলো, কেমন করে এমন কারুকাজ
ঝলসে ওঠে তোমার ঊরুমূলে, কিংবা আরও কিঞ্চিত ভিতরে
সবুজ সবজির মতো বাড়ছে যে এক হৃৎফুল
তাতে আমার কিছু প্রাপ্য আছে - তোমারও অর্ধেক
দাদাজান আমার রেখে গেছেন এমনই ফরচা এক
পশ্চিমে পোড়ারোদ, উত্তরে নদী, পুবে ঘর হয় যদি- দক্ষিণে তবে যৌথভুল !
ফেরা
....
ওগো নিদ্রিতা মেঘ আজ এসো আমাদের ইশ্কুলে
এসো প্রিয়পঙ্খি. . . নিশিন্দা নদীকূলে
জীবন অনন্যমাঠ- এটুকুই গোপন সম্ভাবনা
আমরা লিখিব পদ্য, তিরিশ উন্মনা
কথারা আজ উড়িতেছেন জাহাজের ডেকে
আমিও উড়েছি ধুলো বনেদি গন্ধ মেখে
বাতাস গ্যাছেন দূর; বহুদূর- মালয় সাগরে
প্রতিকূল স্রোতে ফিরো- বাদামি যুবক চেনা বন্দরে
আজ এসো প্রিয় প্রতিমা, এ মণ্ডপ দারুচিনি দ্বীপ
এসো যীশু ঘুমঘোরে- আজ দ্যাখাবো দোল পূর্ণিমা
সাঁওতাল মেয়ে নাচে : ঘুঙুরের মতো এক পাঁড় প্রদীপ
হেঁটে এসো পুরনো বেদেনি , শিঙায় নাচাও খোঁড়া অপ্সরী
মন্ত্রের কৌটা রেখেছি বাজি এই সহি স্মৃতিনামা
পীড়িত শালিখ আজ বাড়ি ফিরবে, সে তথ্য বিপণন করি
বৃষ্টি সন্ত্রাসে
........
এইবার বলো মেঘ কী শিখালে বৃষ্টির বিপরীতে
আমাকে কি ঝরিয়েছেন কালিদাস সেইসব মেঘের অন্তরালে
ঝরে ঝরেই শ্রীমান ফিরবো উত্তর আধুনিক মিথে?
ক্যামনে তবু মেঘের মেয়ে বেড়াতে আসে অমন বৃশ্চিক বিকালে !
না হয় সেই গান জানি বলে স্পাইরাল বৃষ্টির সংবর্ধনা আজ
প্রসঙ্গত মনে পড়ে যায় স্মৃতিবরেষু কেউ থাকে অজ্ঞাত
এমন প্রতীক্ষা কেমন বিস্বাদু যেন বা... পুনশ্চ শ্রাবণ রাত ও
স্মৃতিলুপ্ত ওফেলিয়া ফুটে ভেঙে গেলে যৌগ কোলাজ
সব ছন্দ অস্বীকার করে আমরা অপেক্ষা করি মেঘ কিশোরী
আমাদের ভিটে মাটি প্রত্নধনু ধুয়ে দিয়ে যাও রজস্বলা স্রোতে
বেয়াড়া ছাঁটে ভিজুক অধিরূঢ় ব্যাকুলতা...আহা মরি মরি!
আরো একবার পথভ্রষ্ট হয়ে আমরা গিয়েছিনু মেঘদূত সকাশে
ঠাকুরের গানে পাতা নড়ে, এমতো থৈ থৈ নির্লিপ্তি
তেইশ বছরের জীবন কাঁপে বৃষ্টির সন্ত্রাসে!
শুদ্ধমৃত্যু, প্রখরভুলে
............
কিছু কিছু ভুল সুর থাকা ভালো প্রতি অন্তরায়
হলুদ শ্মশানপথে মুদ্রিত উজ্জ্বল রোগে
পীড়িত হয়ে গেলে কিছু ভুল খেয়ে নেয়া যায়
দ্রাক্ষা ভেবে যাবতীয় মুদ্রাদোষ সহযোগে
তাতে সফেদ মৃত্যুর পূর্বে বেঁচে থাকার আশা ফোটে...
প্রত্যহ প্রত্যূষে কিছু ভ্রম মেখে নিলে ভালো
গহিন ক্ষত চিহ্নে ঘনঘোর গোপন ডানায়
ঠিক তখনই দ্যাখো আসমান চমকালো !
দূরের নক্ষত্র ছুটে এলো পেঁচার আস্তানায়
সফেদ মৃত্যুর পরে পেঁচাশিশু যাতে শুদ্ধ হয়ে ওঠে!
প্রয়াত কবির গ্রামে
...........
আকাশে আগুন লাগিয়ে আসমানি কৈতর
কী গীত গাহিলো শেষে
বোকা সন্ত বোঝেনি মনে অনন্ত ধ্যানের ভেতর।
কুমারী চাঁদের স্ব-হনন, মৃত লোবানের ঘ্রাণে
মিথ্যে শোকার্তের বেশে
বেজে চলে শিস্ তনু মন প্রাণে
চাঁদহীন রাতে ভেসে যায় কবির খসরা খাতা
ক’জোড়া পাঁজর হলো ভস্ম ছাই,
মর্মরতার জল পাতা
টুপ করে ঝরে কবি ঝরে শিস্ওয়ালা আচমকাই
কবিতার মাত্রা ভেঙে যে আঁকে কুমারী দেহ
বিষ বিঁধে বুকে কোমল সর্বনাশ
ঘর গেরস্থালি লক্ষ্ণৌ বাঈজী শুধু হাইড্রান্ট আশ্বাস !
কত বছর পর কোন দূর জানালায়
নিশির ধ্বনিরা নামে মাঝ রাতে সিন্থেটিক অধ্যায়
কবির সহোদর গাছ অবসাদহীন খেলা দ্যাখে
বনান্তে নক্ষত্রের বিয়ে জ্যোৎস্নার ঝালর নামে
ডানা মেলা কথার পরিরা ফের
নৃত্য করতে আসে প্রয়াত কবির গ্রামে ।
জলজ শোকগাঁথা
...........
রুপোলি ঘুড়ি যায় লুটেরা মেঘের শেকলে
কেন যায়? কে পাঠায়? সকলি থাকে অজ্ঞাত
আমরা দাহ করি জ্ঞাত স্বপ্ন হিম দাবানলে
তবু জোনাকি গিলে ফেলে রাজর্ষি রাত !
জানি জানি গো বিবাগি মেঘ বসিয়েছে পিঞ্জরে
এখন আমার বাড়ি হবে শান্তান পাড়া
এখন আমি মাতাল হবো ছায়াঘুমের তরে
বনেদি হাওয়া ও ভুলে যাবে পর্দা নাড়া
অন্ধতাকে তাই কেউ বলবেনা দৃষ্টিহীনতা
যতোই কাঁদুক একলা আকাশ ইস্টিশনে
মলাট দুটো লুকিয়েই রাখে জলজ শোকগাঁথা
এ কেমন পথভোলা? নদীরে বিশ্বাস করে
যেন বা নদীই জানে শুধু চিতাগ্নির গল্প!
চিঠি তাই আসেনা বুঝি ভাঙা ডাকঘরে?
আখ্যান ফের নাইওরি নাও
...............
বড় অসহায় আজ লেপ্টে আছে ঘাসে
আজ নামেনি বাক্য আজ অভিমান
উড়তে শিখেছে নৈর্ঋতের আকাশে
উড়ে উড়ে বুঝে গেছে বৃত্তই প্রধান
কাল এসে পড়ে যেয়ো নাইওরবরন শাড়ি
কুঁচির ফাঁকে ফাঁকে মেঘ বরিষন
ঝিঙের বধূরঙ ফুল আর স্মৃতিপ্রসারী
সব গহনা তুমি চেয়েছিলে ভীষণ
বৃত্ত ভেঙে তাই বুঝি প্রলুব্ধ করে দাও !
আর তাতেই খোয়াবেরও অতীত সব দৃশ্য দেখি
যেমন, দৃশ্যের আখ্যানে ফের নাইওরি নাও
নিকাহ্ হাওয়া লেগে গেলে পাল তোলে ঠিক ই।
নৈশ বিলাপের চতুর্দশপদী
.................
সরীসৃপ অন্ধকার পেরিয়ে জন্মস্মৃতি উঠে এলে বুক বরাবর
বিগত দিবারাত্রি খুঁজে জ্বেলেছি কুপি অভিবাসী সন্ধ্যায়
দূরে নয়, ওই খানে পুড়ি চিতা; শ্লোকঠাসা সমাধিপ্রস্তর
চঞ্চলা নদী এক পঙ্গু হলো বলে শুনেছি পলি ও কাদায়!
শেষ বার বিয়ারিঙে চড়ে ঘুরে এসেছি গোধূল নগর
বাল্যবন্ধু সেই স্মৃতি সেলাই করে লেখে চিঠি- ‘ফিরে আয়’
আজো সেই বেতবন, নিসর্গ লুটিয়ে আছে মৃতপ্রায়
পালকের চিহ্ন নেই আর কোন নাম নেই খামের ’পর
তবু কারা যেন লেখে ফের স্মৃতিতে জ্বলে পুড়ে
মানুষ নাকি আবার ডাকতে শিখেছে ডাক নামে
যে পাখি ভিনদেশে করে বাস সে ও নাকি স্বদেশী পাখায় উড়ে
নির্বাসিত রাত্রিগুলো বেচতে যায় প্রাত্যহিক দামে
এই সব নৈশবিলাপ; ছাইভস্ম, ফুল হয়ে ফোটে
একজন্মের সৌখিনতা উড়িয়ে দিয়ে হরিয়াল পাখির ঠোঁটে
শাস্তি
....
নিজের ক্রুটি কী করে স্বীকার করি যে, আমি প্রায়ই
মাতাল হয়ে পড়ে থাকি পথে! চোখের ভেতর জমা করি
নেশা, টলমলে দুঃখের মদ পান করে চলে যাই
অমৃতপাড়ায়! কখনো বা তোমার মতো কারো সুখের কানাকড়ি
ছিনিয়ে নিয়ে দিই দৌড়। পেছনে দৌড়ায় পুলিশ, বাঁশি
ফোঁকে তারা গগনবিদারী- ‘এ্যাই দাঁড়াও, না হলে
গুলি করবো...!’ এই তো আমার নিয়তি আমার বারোমাসী
ছুটছে আমারই পিছে ছায়ায় ও রোদে ক্রুর দাবানলে!
আগুনের মতো দূরে ন্যাড়া দ্বীপ ক্ষীণআশাপুরী
ভাবি, এইবার ওখানে থাকা হবে বেশদিন, নির্ভয়ে বেশ
হায়, কে যেন তবু জেনে যায় এই লুকোচুরি
ডেকে বলে, ‘উইঠ্যা আসো মিয়া ভাই! রানীমা’র নির্দ্দেশ
তোয়ার লাই নয়া দ্বীপ। নয়া ঠিহানা
সবি আছে; মাগার চান্নিটা দ্যাখবার পারবা না!’
নির্বাচিত স্মৃতির প্রণতি
.............
ভ্রমণে গেলে পাবকের প্রিয় পাখি?
আমি সেই ডানা ভেঙে দাঁড়িয়ে থাকি
প্রদগ্ধ গল্পদের ফিরে পাবো বলে
তখন দহনের সব স্রোত মথুরার জলে !
এই ভুল শিলাস্বপ্ন ফের ঘুমোবে না আর
যে গাঁথা এ জীবনের; শিল্প তার বিষণ্ন অধ্যাস
কার্তিকের মাঠ বোঝে মর্ম, করুণা বিলাস
কোন পাখি লেখে শিস্ নির্বাসন ব্যাকুলতার!
কোন্ দুঃখ বেশি বলি, কোন্ বেদনার গান!
কবি যে ভাসে আজ দুতাবাস কল্লোলে
লিখি স্মৃতি. . . উঁকি দেয়া প্রব্রজ্যা অভিমান
মধ্যরাতের পথিবী পোড়ে বৃহন্নলা জলে
তবু সেই ছোট নদী... ভস্মপ্রেম... উজানেতে যাই
‘কালকের না পাওয়া স্বপ্নটা আজ যদি পাই!’
স্মৃতি মাতৃক খুচরা কষ্ট
..............
সারারাত মুখরিত দহন; মথুরার গল্প নেমেছে পদ্যসুরে
ঘুমহীন মফস্বল কবি গ্রন্থিত হই শিশিরে পুনর্বার
কতোবার বলেছি আমার শহর দেখতে আসো যোজন দূরে
নিভৃত নিধুবনে নিঃস্বরাত জানে মর্ম, হৃদি যাতনার
সেই তো গেলে ভেসে ভেসে জলের বৈঠায় উজানে বহতা
আমার বর্ণিল মুখরতা এক ফাঁকে উড়ে গেলো গার্হস্থ্য রোদে
স্বপ্নকে আর ভাই ডাকি না এখন পথে ঘুমায় শ্যাওলা পিচ্ছিলতা
কতো পূর্ণিমাও চলে গেছে দূরদেশে. . . কতো প্রতীক্ষা ভ্রষ্টবোধে!
তবু জোছনা এলে মনে হয় তুমি দেখতে এলে আমাদের
মৃত্যুর উদ্ধৃতি ভুলে নাচতে নেমে যাই উন্মাতাল- স্বপ্নমাঠ
অকস্মাৎ কে কার ভাঙায় ভুল ব্যর্থতা এই রাতের!
সেই তুমি খুলে এলে লোকায়ত অন্তর্বাস. . . শাড়ি
অভিশপ্ত ভাস্কর তখন পেরিয়ে গেছে নিয়তির চৌকাঠ
নির্বাসনের সেই রাতে আমিও আর ফিরিনি বাড়ি
বনশ্রী রোড ২৫ অক্টোবর ১৯৯৬
....................
পাথর সময় নিয়ে চিঠি গ্যাছে বিষাদের শহর
পুরানো গ্রাম শুয়ে থাকে নির্জনতা অথৈ
তবু সাধ হয়, চিতায় না চৈত্যে হই খবর
বলো তবে এই সত্যে কী এমন অর্থ হলো সই!
পিরিতি গড়ায়ে গড়ায়ে যায় আমাদের বনশ্রী রোডে
যদি বলি প্রান্তরে ও পথে ঘুরে এটুকুই সঞ্চয়
আর কিছু দেখিনি পথিক মেট্রো সোডিয়াম শেডে
ও প্রত্ন প্রেয়সী তবে কি লিখিবে ‘পরাজয়’!
আর অই যে থাকলো কোলাজ ঘুড়িতে ওড়া গল্পাঞ্জলি
পাঁজরে বয়ে চলে সান্দ্র নদী... পুনশ্চ এক পড়শি জানি
অপাঠ্য থেকে যায়! সূর্যাস্তে আর নাই-বা বলি
আমিই তো বিস্মৃত হবো জুডাস-প্রভু যেশাসের বাণী!
সীমানা
....
ঘামে ও গল্পে এখনো ভেসে ওঠে রুচিতাদের বাড়ি
তীরের ফলায় স্বপ্ন ঝোলে, বিদ্ধ বনচারী
আজ কাগজে লিখি সেই সব কুয়াশা
তুমিও যেন শীত বৎসরান্তে ফিরে আসা
নদীঘাটে আরো যে ছিলো পড়শি বালিকারা
ওপারে রাখাল বালক আজ প্রিয় বাঁশিহারা!
কিংবা নকশি কাঁথার মতো চিত্রল তোমার দিদি’মা
এই পদ্য আজ বিজ্ঞাপিত করে তাহার মহিমা
আমার কিশোর ছায়া সেই দাউদাউ লাফায় অন্তর-তলে
বেইলি রোডে দেখি নাট্য সেই উপকথা বলে!
অমোঘ প্লাবনের নিচে কিছু শ্মশান থাকে অজানা
তৃণমূল কবি কি করে ভাঙে দশকের সীমানা!
ধূলো প্রবাহে রচিত
............
[ সোনিয়া চৌধুরী সুমি. ছায়ার অধিক ছায়া জমা করে পান্ডুলিপি রচি ]
সেই ভিজে মেঘের দুপুরে উড়েছিলে চিল সোনালি ডানার
তোমার কান্নার সুরে ধানসিঁড়ি দ্যাখে ম্লান চোখে অন্ধকার
পৃথিবীর রাঙা রাজকন্যা চলে যায় দূরে সবটুকু রূপ নিয়ে
সে দুঃখ পড়ে থাকে ঘাসের পাখনায় আমি কাতর লিখিয়ে!
কখন কুড়াবো সে ঝিনুক : নীরবে নীরবে যে সহে যায় ?
পদ্য না কি মুক্তো ফলাতে ঝরঝর ঘামি এই সন্ধ্যায় !
সন্ধ্যা তো জানে স্বাতীর হাতে কমলালেবু হৃৎপিণ্ড মানবিক
দ্রৌপদী শাড়ি রহস্য খুলে দেয় - আমি হাল ভাঙা নাবিক !
সমুদ্র যাত্রায় যাবো তাই জঠর অব্দি নেপথ্য তাপ
দিনগুলি আজ কী প্রকারে প্রকাশি এই ক্রুর জ্যোৎস্নার দেশে
পূর্ণিমার প্রচ্ছন্ন বিষাদে এই গৃহবিদ্যা. . . স্মৃতিপ্রদাহ ভালোবেসে !
পাতা কুড়ানো বউ আমার, মেঘমাতাল সই। . . .লিখি
ধু ধু সম্প্রদায় গুণে রেখো আজ পলায়নবার্ষিকী
ধুলোপ্রবাহে রচিত নিখোঁজ কিশোরের এফিটাফ
ইলোরা, তোমাদের মিথ্যে কথার শহরে
.......................
হাওয়ায় ভেসে এসেছি তাড়িখোর শহর স্বপ্ন মায়াবিনী
তোমাদের তুলতুলে শয্যায় দেখি উড়াল চাঁদঘুম
কষ্টমন্ত্রে পেয়েছি ছাড়পত্র তাই শস্যস্মৃতি আনিনি
চাষীপুত্র বুনেছি আশ্বাসবীজ. . . আলো আক্রান্ত মৌসুম
ইলোরা তোমার শহরে আজ বিভাজিত করি যতো ব্রাত্যগান
প্রিজম স্বপ্নে মুড়ে দেয়া উপকথা কিম্বা নিঝুপুর বৃত্তান্ত
পথ ঘুমিয়ে গেছে না হয় রাত ছুঁতো মাসকান্দির যাত্রানৃত্য আবহমান
বনেদি দৃশ্যে যৌবতি কন্যার আরো কিছু শোক ছিলো
হ্যাজাক বাতি জানতো।
আমি এসেছি দলছুট এসেছি মিথ্যে কথার শহরে
পৌরাণিক বাতাস তাই স্বনন কাটে ‘পলাতক হলো রে!’
জন্মান্তরের যাত্রা
.............
কীর্তনসখী, রাত উন্মনা বলে আমি এসেছি বোধশূন্য
প্রাচীন অধ্যায়ে সেই অঙ্কশাস্ত্র ফলাফলবিহীন যেনো
আমারো কোন পদচিহ্ন থাকে না ধূলির সাথে
আর ঐশী পুস্তকের বিশ্বাস
একে একে নগ্ন হয়ে যায় পশ্চাতে!
প্রাচ্যেও কোলাহল ভারী- নেশাবদ্ধ মানুষের ভিড়
যুদ্ধ বিজ্ঞানের সূত্র বলে যায় বর্গিপুরুষ
ম্রিয়মাণ কিশোর, গন্তব্য নিকট নয় খুব
গল্পটা তবু আশ্চর্য মৈত্রীর!
প্রতি উত্তরে লিখি ব্যাকুলতা. . . মাইল কিংবা ক্রোশ
শোনো, পলায়নে গ্লানি বড়ো জন্মান্তরের যাত্রায়
অবুঝ কিশোর
শুয়ে থাকি তবু
ঘাতকের সাথে
একই শয্যায়!
গল্প বৃত্তান্ত
..........
আরো কিছু গল্প বাকি থাকে
আমাদের নবান্নের দেশে
পৌষ-পিঠার গন্ধে মাতোয়ারা নদীও অবশেষে
সুবসনা বাঁশির টানে
ভাটিতে যায়
ওঠে উজানে।
সে বড়ো পীড়িত আজ
আত্মজ জলের দহনে
অঙ্কও বেশ জানে
সুদ কষা...শুদ্ধতম ঐকিক
কোন সূচকে লভ্যাংশ- লোকসানের ক্রমিক।
বলি নদী শুনে যাও মর্মাহত সন্ধ্যায় কে ডাকে কারে
বলি নদী দ্যাখে যাও কারা নেমেছে ডুব সাঁতারে
বলি নদী শুঁকে যাও কার ত্বকের ঘ্রাণ নিভৃত শ্মশানে
বলি নদী বলে যাও গৃহবন্দী কারা যাবে সমুদ্র সন্ধানে
সন্ধ্যায় বৃষ্টি এলে
..........
সন্ধ্যায় সামান্য বৃষ্টি... বৃষ্টি খেলতে শহরে এসেছেন বাল্মীকি
বিভঙ্গ চৈতন্যের কাব্য হবে এবার, এ সন্ধ্যায় আমরা কী লিখি!
প্রত্ন সভ্যতা বার্ধক্যে গ্যাছে এমনই প্রশ্নের তোড়ে
ফি-সন্ধ্যায় আমরা উত্তর খুঁজি প্রাত্যহিক সুরে
ধ্রুবতারা জানে ধ্রুবসত্য, ঢেউয়ের বাড়ি নদীকূলে
লুপ্ত সন্ধ্যায় কেন নাচে দহন গহিন মর্মমূলে
তবু
সন্ধ্যায় বৃষ্টি এলে, আমরা দাহ্য হতে নামি পথে
সন্ধ্যায় বৃষ্টি এলে, নিজেকে বাঁচাই কোন মতে
সন্ধ্যায় বৃষ্টি এলে, ভাসে বিষণ্ন আত্মার গান
সন্ধ্যায় বৃষ্টি এলে, বুনি ‘নাভিতে সবুজ ধান’
আর
সন্ধ্যায় আশা রাখি কুমারী প্রেমিকা এবার রজস্বলা হবে
সন্ধ্যায় আশা রাখি শিসগুলি নির্ভুল ঠিকানা পাবে
সন্ধ্যায় কাব্য এলে প্রান্তিক বাজারে বেচতে যাই
সন্ধ্যায় কাব্য এলে কাতর কবি দগ্ধ বনসাই !
ভুল গ্রামে এসে
.........
সান্ধ্য জলে কবিতার ঢেউ, ভেসেছি সেই প্রপাতে করুণাবিহীন
খড়কুটো, নর্দমা, শিল্পপ্রাণ বেদনা ভরা রাতে বেদনা প্রাচীন
স্বপ্ন আমার সারা ত্বকে; স্বপ্নপ্রজ দিন ও রাত দাহ্য হলে আজ
পৃথিবীর পুরোনো মেয়েরা গেয়ে ওঠে গীত অকস্মাৎ সুরে কারুকাজ
পাখিরা ছিটিয়েছে সে গাঁথা আত্মার প্রতিভাসে বুকের খাঁচায়
অহর্নিশ পোষে যেতে দ্বৈত জীবন, নদী আসে দগ্ধ মোহনায়
কুয়াশার মুখ মেঘশয্যায় বিচ্ছেদের চাঁদ খোঁজে প্রতিভার পাপে
মেঘমাসে ফেরারি কবি প্রেম বোঝে না, প্ররতি বোঝে নিভৃত সন্তাপে
ঘুরে আসি তবু আনবাড়ি পথ... স্বপ্নভ্রষ্ট চোখ মসৃণ বেদনা
আমাকে চিনিয়ো ডাকঘর: সাঁওতালি সুর, প্রিয়মুখ বিষাদ অজানা
ভুলে গেলে পড়শি কথা সঞ্চয়ে জমে উঠে মিহি অভিমান ম্লান নীরবতা
খামই ভালোবেসেছি শুধু, হিম নীল অক্ষরে বোনা গান যতো কুশলতা
ঘুড়ি বেলার নিরীহ বালক পায়নি চিঠি বিকেল শেষে
কুড়িয়ে ফিরেছি শুধু যন্ত্রণা
ভুল
করে
এই
গ্রামে
এসে।
মেঘকাহিনী
.........
সে এক মুদ্রিত মেঘ আমাদের অন্ধ আবেগ
নিয়ে উড়ে গ্যাছে দূর ব্রজধাম
কেউ ভেবেছে চিহ্ন তারই এমতো এক সাদা শাড়ি
রাধিকারই বায়বীয় ঘাম
আমরা শুধু খোঁজ রাখি ঘর পালানো স্মৃতির পাখি
মেঘ হয়ে যায় অন্তিম প্রয়াণে !
মেঘের ভেতর প্রাচীন পাপে সুঁই সুতারই সন্তাপে
নিজের ছায়ায়, নকসিকাঁথার গানে!
বনশ্রী রোড -০২
............
(সোনিয়া চৌধুরী সুমি, প্রিয়রুচিতাষু)
যদি
দূর বাতিঘর যাবে বলে জলপথ চেনালে
জলেই দেখি বিপন্নতা আটকা কেন জালে!
জানি
তখন প্রতি ভোরের রোদে অতি প্রিয় ছুটিবার আসে
সে সকল স্মৃতিরা ত্রিবোধে আজো স্বপ্ন ভালোবাসে
আর
মৈথুনের চিহ্ন কিছু রাখি পাহাড়ের ক্যাম্পাসে
কুড়িয়ে ফিরি বিচ্ছেদ জ্ঞান দু’জনে ধু ধু বাতাসে
তাই
চুমুর দিনের শেষে জীবিকা উঠে এলে জলেই ভাসি, জলের প্রেমিক তবু জেলে!
শোন
এসো আজ তুলে রাখি অ-শিল্পিত রমণ
বালিশের নিচে চিঠি দিনগুলি গোপন
এই
নির্বাসনের পথে পথ দূতাবাসের গান
বনশ্রী রোড মনে রেখো করুণ অভিমান
শুধু
তোমার সমীপে এ কাব্যবেলা তোমার কাছে ঋণী
তোমার কাছে রাত্রি বিয়োগ ত্রি-কোণ ভূমি চিনি!
চিনি কিছু কচি পাতা পেলব উপত্যকা
ফের ডেকো মেঘমেয়ে। সাধ লয়, ফিরিবার। একা।
দোঁহা
......
ক.
প্রতিভার দোষে হয়নি কিছুই করা
বিক্রি হয়ে গেলে যাবতীয় আয়ু
সেই তথ্যই মেঘ জেনেছে, জেনেছে বায়ু
এই মহাভাদর কেন তুমুল বর্ষাভরা !
খ.
ক্রমশঃ ঝাপসা হয়ে আসে বান্নির পুতুল। আর
সেই বিরহ নিয়েই আমরা লিখতে বসি গান
একদিন সেই স্মৃতির বদলে কিনেছি অন্ধকার
আজ কিনি কবিতা ও পতিত পাতার অভিমান।
গ.
এই যে বললে জীবনের নাম রক্তজবা !
মৃত্যুর নাম কি তবে সাঁকো ?
একটা প্রমাণ, তবে হোক। অথবা
জেনো সাঁকোটাকেই তুমি ফুল বলে ডাকো।
ঘ.
এই বিরহ আমার নয় গাছের পাতায় লেখা থাকে
আমিতো নদীর ছেলে, জলেই আমার যাতনারে
ভাসিয়েছি সেই কবে! ভুল করে ডাকলে কাকে ?
জানো না কি সে মরেছে গত রাতে জলের প্রহারে !
ঙ.
কী করে তুমি লিখে দিলে দাসখত কী ভুল স্বাক্ষরে
ওড়ালে গাঙভরা জল সন্ধিতে বিশ্বাস করে
বলি কেন তুমি উড়েছিলে ওই নৈর্ঋতে কোন সে রহস্যে
সেই সব প্রশ্নগণ আজ ফুটেছেন এখানে, আমাদের বীজে ও শস্যে !
চ.
তোমার পাখিটাকে তবু, বড় মায়া করে রাখি
শুতে দিই, বসতে দিই, পেতে দিয়ে করতল
স্বপ্ন ও সুখ খেতে দিয়ে নিজে খাই বিষফল
অথচ দ্যাখো এটাকেই পরকীয়া বলে ঝিঁ ঝিঁ ও জোনাকি।।
এবং. আমি তবু বংশীওয়ালা রক্তের প্রণোদনায়
কাব্য ও স্মৃতিবিজ্ঞান পড়তে যাচ্ছি দ্বারকায়।
জানি কেবল ক্লান্তি পথিক
...................
নদীর কিসের দুঃখ অজানাই থাকে
পাহাড়ের কষ্ট কেমন বোবা আর্তি
কতোটা যন্ত্রণা সাগরের ঢেউয়ে চঞ্চল আর্তনাদ
আমি জানি না আকাশের বেদনা কতোটা নীল, গাঢ়
বৃষ্টি কি আসলে অশ্রুপাত!
বৃক্ষেরা কি তবে বিরহের উপমা?
আগুন জ্বলে সে কোন দহন জ্বালায়?
ঝরাপাতাদের কান্না কোন সানাইয়ের সুর-থাকে অজানা
জানি কেবল ক্লান্ত পথিক একদিন জেনে যাবে শুভঙ্করের ফাঁকি
জীবনপুরের ট্রেন ধরে চলে যাবে প্রাচীন প্রেমের দিন।
তৃষ্ণাচিত্র -০১
...........
আয় তবে সহচরী পড়তে যাই প্রাথমিক জ্যোৎস্নায়
সন্তরণের গণিত ভুলে শিখে আসি ঘাসের ধারাপাত
আমাদেরও পাঠঘর ছিলো এক, পিতামহের দিন
এই যে এখন গাইছি অতীত, বাঁশির সুরে হাড়ের ধ্বনি
নিঃস্ব তো নই একেবারে, প্রাচীন ভ্রমে সবটুকু রোদ দেইনি উড়িয়ে
রোদেরও আছে অভিমান শোকানলে পোড়ে কন্যা ক্রন্দসী
শোকের অধিক ভালোলাগে পাপ কাহিনী সন্ধ্যায় শুনতে বসি
কুমারী নদী বেড়াতে যায় ঊরুমূলে তৃষ্ণা বয়ে নিয়ে
দ্রাবিড় পুরুষ তৃষ্ণা বোঝে... সুপারি স্তনের স্মরনি
ফসলের মৌসুম এলে এবার শুধিবে হরপ্পা শস্যের ঋণ
বিষাদ দৃশ্যে মিথ্যে কতো সেলাই হবে মনু ব্রিজের রাত?
আমার প্রেমিকা তবু শরীরবিদ্যা পড়ে রাত্রিকালীন সংজ্ঞায়!
ছায়া
....
সে গল্প তো মনে আছে . . . রূপকথার মতো মখমল
কী ভীষণ প্লাবণের তোড়ে ভেসে গ্যাছে আমাদের বাস্তুজীবন !
আজ পরিচিত শয্যায় নেচে ওঠে অচিন কায়া
কপালে জন্মদাগ নিয়ে আমি বসেছি রাজাসনে এইবার
তবু শস্যপুত্রের মনে পড়ে যায় নদীতে এখনো দহনের দাগ
এখনো বিকেল দীর্ঘ হতে থাকে প্রপিতামহের ছায়ায়।
প্রাকৃত বেদনা
..........
কৈশোরের সাহস নিয়ে পথে নেমেছি এই ঘনরাত্রি. . .
স্রোতের প্রতিকূলে ভাসা কতোদূর ডুবুরি তুমি ?
বৌ বৌ খেলায় স্বপ্নের পাখোয়াজ ছিলো আরণ্যক বিকেলে
তবে কেন এই বচসা জীবনের নাম বনভূমি না কি মরুভূমি!
আমাকে দেখে হাসো কেন বেবিডল আলিশা?
আমি কি খাঁচার পাখি. . .। হাট ফেরতা কিশোরের হাতে!
স্নান ঘরে দেখেছি তো বেআব্রু উর্বশী স্তন
অতএব, নদী ভাষান্তরে বৃষ্টির স্বরলিপিগুলিই থাকে
আরও কিছু বেদনা এই সুযোগে দস্যু হতে জানে
ভাবনা
....
মাঝে মাঝে মনে হয় পুরাতন মুখটা বদলে ফেলি
আবার ভাবি আত্মজ দহন এসে কী করে চিনবে আমাকে!
চামেলীবাগ
......
আসলে কেউ সুখী নয়। পথ দুঃখী। পা দুঃখী।
আমাদের সমূহ যাত্রা তবু চামেলীবাগ মুখী!
ধ্রুপদী রাত চুষে নেয় চাষীকন্যা
..................
জোছনা খুলেছে পালক তার
নিদারুণ রাত্রিতে
মহুয়া সহবাসে
মাতাল দূরের কোন পাহাড়
বিরহনগরে রচিত মূর্চ্ছনা
ততোধিক বোঝে সে
স্বপ্নমন্ত্র ভালোবেসে
ধ্রুপদী রাত চুষে নেয় চাষীকন্যা।
ছুটে যায় ধাবমান ট্রেন
.............
আজ কারা যায় নকশি কাঁথার মাঠে? কারা গায় কাব্য কলার গান!
একদিন স্বপ্নের প্রাথমিক স্রোতে জীবনের এমন বহু অর্থ জেনেছি
সারা গ্রাম জুড়ে স্বপ্নবসতি. . . চৌকাঠ ডিঙালেই নিকানো উঠোন
ঝিঙেফুলের বিদূরতা, অমন দূরে নিজেকে গেঁথে ‘চন্দনী’ প্রার্থনায়
ছুঁতে গেলেই পেয়ে যেতে নীল নীল স্নায়ুর ভেতর স্বরচিত অবসাদ
তুমি দ্যাখোনি সই; এতোকাল পর আজ মনে পড়ে ব্যর্থতার ধারাপাত
আকাশের গায়ে গায়ে ধনুকের নব্যভাষা. . .
ফেরারি পাখিরা তবু মনে রাখে বিপন্ন পালকের আর্তি
নদী শুধু কিঞ্চিত বোঝে জলের অতলে নিঃস্ব মাছের দাহ্য রোদন
আমিও নিঃস্ব বড়ো, স্বপ্ন ছাড়া বুনিনি কোন বিকল্প শস্য
শেষ রাতে তাই বনশ্রী রোডের করুণা নিয়ে ছুটে যায় ধাবমান ট্রেন
স্টেশনে তখন বন্ধ্যা রাত আর ব্যর্থ তীরন্দাজ একসাথে ঘুমোয় !
সাক্ষী
.....
কেবল ওই জ্যোৎস্না জানে জ্যোৎস্না আমার সই
স্মৃতি ভোলে বাউলপরান ক্যামনে গৃহী হই
গৃহ জানে- অজানা বিষাদে শূন্য গৃহাঙ্গন
রাতের কাছে নেই কেন সেই বিরাগী জীবন
তারা জানে, তারাগুলো গর্ভজাত ভাই
কোন ভুলে একাকী কিশোর ভুল পথে আজ যাই
স্বপ্ন জানে কোন ছলনায় বুকের কাছে ঘুমায়
কোন বিরহে স্বপনেরাও পঙ্গু হয়ে যায়
প্রিয় পাখি লেখেনি শিস এইবার জানলাম
ভুলে গেছে বন্ধুরাও পরাজিত নাম
নোনতা জলের উপকথা
..............
একদিন বন্দীত্বকে ভালোবেসে প্রিজন ভ্যানে উঠে পড়েছিলাম
একদিন সারা শহর চষে বেরিয়েছি একটা নীল বোতামের খোঁজে
একদিন দূরের ট্রেন তুলে নিয়ে গেছে অপুষ্পক স্বপ্ন সকল
একদিন জীবনকে ভালোবেসে রাত ভর কেঁদে গেছি দুর্বিনীত পাতক !
তখন শ্রাবণের পূর্ণিমায় বলা হয়ে গেছে নোনতা জলের উপকথা
তখন বন্দী ক্রীতদাস ভুলে যায়নি বন্ধুদের নাম
তখন শীতের শৈশব লাল লেপের কাছে সকল উচ্ছ্বাস
তখন দোষী দুইপ্র’রে খইচূড়া গাছে নেমে আছে ভয়ের নারী।
একদিন বন্দীত্বকে ভালোবেসে
একদিন রক্ত ঘামে মাখামাখি বেয়ারিঙে কেটে গেছে পা
একদিন পড়শি মেয়ে শুনিয়েছে সাপে কাটা বিনোদের কেচ্ছা
একদিন ঘুড়ি কেটে গেছে বলে ভাত খায়নি অভিমানী কিশোর
একদিন বুবুর বুকের কাছে গুটিসুটি, দেশে এসেছে অচেনা বলা!
আর এক্ষণ
বেদনারে ভালোবেসে পুড়ে গেছে আস্ত একটা জীবন।
।
লুরা পর্ব
..........
ভাবো তো দেখি একবার তুমি ফের লুরতে যাচ্ছো হিলঞ্চি বিলে
উন্দুরের গর্তে হাত পুরে পেলে হারানো ধানের ছোঁছা!
বিফল বেদনায় ফুটছে তাই নোনতা ফুল কেচমা দুটি দিলে
আর ওপচালো জল অবিরল, তবু যাচ্ছে না মোছা!
কিংবা যে রাতে তুমি ভুলে গেলে সূত্র মৈন মৈন খেলতে গিয়ে
চাঁদের প্রতারণায় আমিও হয়েছি বেফানা সমানে সমান
জিনিপোকার কাছে সমূহ অন্ধকার বন্ধক দিয়ে
আমরা রাঙিয়ে নিলাম ফের পরস্পরের রূপদুয়ারি আসমান!
এখন আবার এইসব কথামালা ভুল কাগজে লিখে লিখে
আমাদের দুইপ্র’র চলে যাচ্ছে তোমাদের সন্ধ্যার দিকে!
রাতের ভেতর জন্মাচ্ছে কিছু জন্মের আঁকিবুকি
বলে দিচ্ছে সব, কারা কারা জন্মের অসুখী
সে তালিকায় আমিই থেকেছি প্রথম, সবশেষেও আমি
হিলঞ্চিতে ফিরবো বলে এসে ফের ভুল স্টেশনে নামি!
আততায়ী প্রণোদনা
............
কী গান গাহিলে শেষে এই মিলন ও প্রণয়গাঁথা জ্যোৎস্নায়
আমি তার করি নি অনুবাদ, তবু জেনেছি যেটুকু বাকি
আমাদের গোপন গহন এক আততায়ী প্রণোদনায়
পৃথিবীকে একলা রেখে আমরা দু’জন বিষাদঘরে থাকি!
কার শিয়রে কে রেখেছি মাথা, কোন্ চোখে কার জল
কার ঠোঁটে ওষ্ঠ রেখে কে মরেছি প্রথম
আগুনের ধর্ম মেনে ; বসে থেকেছি নিশ্চল
পাহাড়চুড়োয় নেমে গেলে বর্ষানিদাঘ ঝমঝম।
আজ আর কিছু মনে নেই, মনে নেই কিছু-ই
কী করে ফিরেছি দু’জন অনূঢ়াবৈভব রাতে
চাঁদ নেমে গেলে চাঁদপাড়ার মাঠে, চন্দনী অথৈ
ভাসিয়ে নিয়ে গেছে আমাদের, দূর দূর আশ্চর্য তফাতে।
নিশিন্দা মেঘের বাতিঘর
.............
একটা ভোরবেলা পাখির মতো গেয়ে উঠলে নিজস্ব ঠোঁটে
একটা রাতের যাতনা মিশে গিয়েছিলো কিন্নর কুয়াশায়
একটা স্বপ্ন সে বার ভিখিরির মতো খড়খুট খুঁটে খুঁটে
উনুনের পাশে বসে দেখছিলো দাহ বলক জাগানো মুগ্ধতায় !
এই দৃশ্যে তুমি রাখোনি আমায়, আমি ফিরেছি রিক্ত
ডানা ও পালকে সঞ্চিত যে বিবিধ বেদনা, তারও অধিক
বিরহ নিয়ে এক যাতনাগাছ ভুল জলে সিক্ত!
ফুটায়েছে বিদ্যাপতি ফুল, বলেছে এ বিচ্ছেদেরই প্রতীক।
এ রকম গল্পে তুমি রাখোনি আমায়, আমি ফিরেছি একা !
শঙ্খের ভেতর জমানো নিষাদ অপ্রস্তুত বালির কাছে
পড়ে র'লো কয়েক জন্ম ; আর দেখো, কিছু মৃত্যু নীল তটরেখায়
পরিশ্রান্ত জাহাজের মতো তবু নোঙর করে আছে!
কিছু গল্প তবু বাকি থাকে- কিছুটা অর্ধেক বলা
অর্ধেক আঁধার রেখে বাড়ি ফিরে যায় পৃথিবীর শেষ বাতিওয়ালা।
আছি, বিগতের কাছে নত
.................
আমি আছি বোন
অন্ধ ভীষণ প্রহেলিকা পেরিয়ে
গৃহস্থ উঠোনের সনাতন দাইড়ে
দুঃখ প্রবণ গাঁওগেরামের কেচ্ছা সমেত;
সকলের ভাই সেজে শুনছি সহোদর সংগীত।
হাড়ের ভেতর পুরে শঙ্খের নিনাদ
কায়ক্লেশে নিজেকে টেনে নিয়ে ফি সন্ধ্যায় হতেছি রিক্ত
মৌনতৃণ তাই পুঁথিপুরাণের করুণ রাখাল, গোপন
প্রহসন মার্বেলের মতো গড়িয়ে দিচ্ছি
আছি বিগতের কাছে নত, ব্রাত্য গল্পঅলা
তুমি বোন কেবল তুমি’ই
দেখলে সাপ, তটস্থ মৃগয়া, ফাঁদ, প্রতারণা
মানুষের জন্মের পূর্বে ও পরে
সে কেবল ফিরতে পারে নিজের কাছেই
জগতের সকল কেচ্ছা তাই পুনরাবৃত্ত
তবু তুমি বোন, তুমি জানালে চিতার বাঁপাশে এক শূন্য আসন
জানলে, আমাকে হত্যা করে তোমাকে বশে পেয়েছে উত্তরাধুনিক দস্যু।
ধুলোগ্রাম প্রাইমারি ইস্কুল
................
অকাতরে হারিয়ে গেলো অগ্রন্থিত সব ঘুমদৃশ্য!
চোখের পাতায় বসেছিলো চড়কপূজা ; তখন পৌষকাল
শীতের সমস্ত মহিমা ফুটেছিলো স্কুল পথের পাশে
পায়ে পায়ে লেগে গিয়ে বেজেছিলো মন্দিরা, তখন কীর্তনরাত
ভালোবাসতে গিয়ে সেই বার-ই প্রথম জানা হলো তোমার নাম
পরানের গভীরে পাওয়া চিরকালের পাখি তুমি-পঞ্চপূর্ণা
ছত্রে ছত্রে কেবল স্মৃতিচর্চা-যদি স্রোত ও নদীর কথা বলি
এইক্ষণ জল নেমে গেলে, নেমে গেলো নাও ও ঘাট, পইঠা
শত শত টাইমফুল ভ্রম জন্মের ভার নিয়ে অবনত
প্রাচীন পৃথিবীর দরদালানে জন্মানো সব নিবৃত্তির গান
তখনও প্রস্তুতি ছিলো কণ্ঠ ছিঁড়ে গেয়ে দেবার, ঘুড়িগীত
দু’একবার বুঝি বা উড়েছিলো সুতো; ছেঁড়া-বিধবা নাটাই
থির থির করে বেঁচে থাকলে হৃৎপিণ্ড, কুহুকুহু বোল
পরের বার রচিত হবে পালা-‘ধুলোগ্রাম প্রাইমারি ইস্কুল’
মৃত্যুর মহিমা
...........
এইসব ঘর-দোর, টিনের দোচালা-আমি যদি না’ই থাকি একদিন!
নক্ষত্রের ইয়ার-দোস্ত ; বিন্দু হয়ে জ্বলি-তোমার হাতে পার্থিব দূরবীন
সবুজ মখমলের মতো সন্ধ্যায় প্রস্থানের যতো বাণী বাজে
এ-পাড়া, ও-পাড়া ঘুরে আসা এক বিষণ্ন এস্রাজে...
আমের মুকুলে মকুলে সে কথা ধুলো হয়ে লেগে রবে
যতোটা তুমি পুষেছিলে প্রেম, জন্মের অধিক গৌরবে
আমরা তাই যৌথ ভেসেছি এক বর্ষায় নাইওরময় পানসিতে
স্বভাব দোষে তুমি ভুলেছো সেইসব এই ম্লান শীতে
আমি তবু শীত হয়ে বসে দেখি সকালের ডানা ঝাপ্টানো
গল্প বলার ছলে তুমি ফের সেই বর্ষার দিকেই টানো!
কতোটা নিরীহ আমি, নতজানু এই শোক প্রবাহের কালে
না জেনে সেইসব গল্পদের তুমি পুষেছো পাঁজরের আড়ালে।
পাঁজর খুলে আমি ফের উড়ে যাবার গল্প শোনাই
এই সকল ঘর-দোর, পুবালি হাওয়া-তবু আমি যদি আর নাই!
মৃত্যু বলে অযথা তুমি দিয়ো না কোনও গালি
মৃত্যুর মহিমা জেনেছে শুধু এই চৈত্র ও চৈত্রালি।
যৌথ ভুলের দিন -১
...............
রোদের বদলে আজ দেখি চাঁনমুখ ফুটে আছো আমাদের যতো ঘাসে! গতরাতে দেখা স্বপ্নটা তাই নতুন করে পড়ি, ওই যে আমাদের ঘরলাগোয়া তোমাদের দোচালা। মৈন মৈন খেলবে বলে বলে তুমি এসে দাঁড়ালে দাইড়ে। চোখ বন্ধ করে ছুঁড়ে দিয়ে মৈন; মন্ত্রের মতো গেয়ে উঠলে সন্ধানীশ্লোক পুবে গেলে পাবে চান পুন্নিমার। দক্ষিণে গেলে হাওয়া। উত্তরের মৈনগুটি, পশ্চিমে যাবে না পাওয়া!
এমনই বেবুতা আমি তবু পড়ে যাই পশ্চিম-ফাঁদে !
হাড়ের হার্পুনে বাজে ভুল , ভ্রম ফরিয়াদে...
স্বপ্ন বিষয়ক আরও এক
................
মলিন স্বপন গায়ে দিয়ে ঘুমিয়ে গেলে বয়সী গ্রাম সকল
মসৃণ গালের পাশে আগুন লাগে, চন্দনী অবিরল !
পাখিদের ডানা থেকে হিম ঝরে গেলে সন্তরণ গুণে
সেই শেষবারই তেপান্তরে পুড়েছি তোমার আগুনে !
স্বপ্ন দেখে টান দিলে বুকে। কাতর ঘাসফুলের কাছে অভিমানী নাকছাবি। জ্যোৎস্নায় ভেসে ভেসে ফিরেছিলে গৃহে। শ্মশানে আমার ঘুম তবু ভাঙে নাই ! চাঁদমাখা এক পাণ্ডুলিপি অপ্রকাশিত থাকে চাষীকন্যা ! তোমার বুকের মত পেলবমাটি, পুর্ণদৈর্ঘ্য বেদনায় কেবলি শস্যে জন্মায়। চন্দ্রহাত চাষীপুত্র ভুলে গেলে লাঙলমাত্রা রমণের ভিন্ন অর্থ। পথগুলো আর চেনেনা পথ। নদীও না নদীকে। তোমার নকশিকাঁথার বই অপাঠ্য রয়ে যায়। ভুলে যাই আমার গ্রাম কোনদিকে! কী করে এ
সন্তাপ উড়াই ! স্বপ্ন দেখে টেনেছিলে বুকে। আন্ধার দ্যাখো নাই !
ডানা
....
বিস্মরণের কালে তুমি ফের গাইলে এই গান! পথে পথে ছিলো যতো তৃষিত ধুলো, তারা সব আজ মেতেছে বহ্নিহরণ উৎসবে! তোমার করুণায় একদিন ডানা পেয়েছি। শ্বাসের বদলে পারিজাত হাওয়া ! সেই মহিয়সী কথারা আজ সন্তরণের দোকান খুলেছেন। তাতে সাজানো যতো কেচ্ছা, রক্তসংরাগে। আমি কৃষকপুত্র, বাণিজ্যের সূত্র জানি না! ভাবি, যদি সেই পূর্ণিমা আবার আসে ইতিহাসের বাঈজীর মতো। যদি আবার কেউ যায় মৃগয়ায়. . . হরপ্পার হলুদ হরিণ তখন একাকী !
দ্যাখো, সেই লোভে তোমার দেয়া ডানা খুলে রাখি !
ব্যর্থ দুপুর, অরুণাক্ষ রাতের মতো
......................
দুপুর
সেই পুরাতন দুপুর। রোদ গড়িয়ে যায় মথুরা নগর। আর আমাদের ছিলো যে ছায়া, রূপজ বিন্যাসে তারা সব উড়ে গ্যাছে পাখোয়াজ হয়ে। তবু কী নিদারুণ বেদনায় আমরা ক’জন মধ্যবিত্ত পাতক মার্গীয় প্রেম খুঁজি নগরের পুরাতন পথ ধরে... ও প্রান্তরে যা কিছু আছে, তার সব কিছুই হয় স্বপ্নের অনুসঙ্গ। ফলত আমরা নিরন্তর পরাস্ত হই পাতকী প্লাবনে। আর অই প্রলুব্ধদিন ভেঙে সবুজ মেয়েরা যখন ইশ্কুলে যায় আমরা ভাবি এবার উঠে দাঁড়াবেন অরুণমিত্র। যেমন দাঁড়ান...। দাঁড়াতে গেলেই ভেঙে পড়ে নীরবতা। মফস্বলের কবিরা জানেন কোথায় নির্জনতার শ্রাদ্ধ হয়। আমরাও যাত্রা শুরু করি ঈশ্বরের প্রণয়বাড়ি। কোথাও কি তবে বাজে দুপুরের ব্যর্থ মৃদঙ্গ? পৃথিবীর প্রাচীন আর্তনাদ?
রাত
রাতগুলোও তেমন। কাশবন থেকে ভেসে আসা আটপৌরে স্তব্ধতা লেহন করে আমার ঘাসের চিতা. . . রাতের সাথে টানাপোড়েনের যৌনপাঠ। পায়ের স্যান্ডেল ক্ষয়ে গেলে শতাব্দীর ব্যর্থতা নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে আমাদের গ্রাম। আমার জেগে থাকা নিশাচর ট্রেনের যাত্রী হবো বলে। এইবার আমি গেঁথে নেবো আমাদের ছাপোষা সন্ন্যাসে... প্রিয়রঙা জোছ্না... উড়োপাতার জর্নাল। কখনোই ওভাবে যাবো না, যেভাবে মানুষ যায়। রাতের ভেতর হেঁটে যাবে ফিনিক্স পুরুষ।
সন্ধ্যারা অমনি হয়
............
এবার সন্ধ্যাদের কথা বলি। তারা নিশ্চুপ নেমে যায় স্বপ্ন তিথির সান্নিধ্যে। দৃশ্যত তারা আমাদের বৃদ্ধাঙ্গুলি দ্যাখায়, যেন তারা বংশিবাদক। আমরা মাতোয়ারা। মাসিরা অপেক্ষায় থাকে প্রবারণা পূর্ণিমার। পাখি সব রেখে যায় বিগত-ছবি সোনামুখী মেয়ের কাছে। কুলুলুলুতে গ্রাম নাচলে হাঁসের পিছনে ধাবমান বোন। সে সন্ধ্যাতারাকে বলে দুই বেণীর বিন্ন্যাস। আর পাখিরা ঘরফেরতা, জেনে নেয় শেষবার কবে তারা দেখেছে এমন দিনপাত!
পুনশ্চ পাঠঃ সন্ধ্যা যেন আমার বড়দি’। সে কপালে টিপ পরে। গোধূলি রঙা। পথ রেখা অস্পষ্ট হলে সে ভাবে সন্ধ্যা তার গোপন প্রেমিক। আমরা তাই সন্ধ্যাদের জয়গান গাই।
একটি মৌল কবিতা
.............
এই পথেই তবে ফিরিতে হয় পুনর্বার। যাবার বেলা কে ডেকেছিলো, আয় পাখি আয় মুখরতা; মনে থাকেনা। এই যে ভাসমান, এই স্বপ্নক্ষুধাতুর বিষণœ বারোমাস-বান্নি থেকে কিনে আনা পুতুলের মতো তুলে রাখতে হয় স্মৃতি অস্মৃতির ছিক্কায়। গহিন হৃদয় খুলে রেখেছিলাম এক হাজার বছর। হাইঞ্জাবেলা ফিরে দেখি তবু পথ মনে রাখে নাই দুঃখবতী মেঘেদের গান !
স্মৃতি বিষয়ক হলদে খাম -০১
.....................
আমার পর আরো একজন আমাকে যে বোঝে
গোপনে অনেক দহন, যেমত মৌনতায় বাজে
নিপু ভাই # প্রিয়পরানেষু
.................
...তারপর জানলেন নোনাজলের ইতিবৃত্তান্ত? পাতারা যেদিন ঝরেছিলো শোকার্ত বিন্যাসে; আমরা কেবল জমিয়েছিলাম অট্টহাসির দুপুর!
সেই চৌরাশিয়া রাত . . .রাতের ভেতর আমাদের হাহাকারমালা। লেইক রোডে ব্যর্থ প্রার্থনা; আপনি বলতেন পাথর পুষে যাও। আর আমাদের ভবঘুরে স্বপ্নেরা নগরে এসে হোঁচট খেলে, বাউণ্ডুলে বাতাস কানের কাছে শিস দিয়ে গ্যাছে, মিছে এ জীবন ! আজ পুড়ে যাই, কেন যে সেদিন বিলিয়েছি অমন অরুণাক্ষ দিন ! যদি ফলাফল চান; দেখবেন, ঘাসেদের কাছে কিছু নীল ফুল; তার কাছে পড়ে আছে আমাদের অব্যয় পৌরাণিকী! কে তারে স্পর্শিল বিরহী সম্পূরকে! জানা হবে না এই জন্ম। জানা হবে না আমাদের শস্যময় প্রান্তর কেন অধিকন্তু শস্যহীন. . .। আমরা কি তবে বাতিল বান্ধব, এই প্রাবৃষ্য বেলা!
ইতি
সুমন
পুনশ্চঃ যে একদা গাঁথিয়াছিলো স্বপ্নাদ্য নোঙর, তাহারে কুশল জানাইবেন।
আত্কা পাওয়া দুই
.............
১. ঠিকানা যেন কী! আমরা স্বপনপারে থাকি। স্বপ্ন ফেরি করে খাই। সন্ধ্যা নেমে এলে দাইড়ে মনের কোণের বাইরে স্বপ্নরেণু উড়াই। দূরে ঢেউ সম্প্রদায়, আমরা তাদের আত্মীয় জেনে স্বপ্ন কিছু বিলাই। যে আকাশ আমাদের পাড়ায় রতি খেলতে আসে। বলে উপহাসে, পানি নাই পুকুরেতে তবু পাতা ভাসে ! ধৈবত ভালোবেসে তাকে স্বপ্নপোলাও খাওয়াই ! আর প্রতি হাটবারে তন্দ্রার ভেতরে স্বপ্ন কিনে আনি। জানি, এ জীবন ফড়িঙের, ফেরিওয়ালার। তাই এই বিভীষায় ঘুমে ও তন্দ্রায় পুড়ি স্বপ্ন চিতায়!
২. আমি কূলহারা এক কলঙ্কিনী বলে যে নদী নাইতে গেলো সায়রে সন্ধ্যা তারে তাড়া করে ক্লান্ত বানায় শস্যও বীজের কামনায় ফুঁসে ওঠে পৌরুষ রক্তমাখা ন্যাকড়া দেখে বর্গি বেহুশ বোঝে তবে বিশেষ দিন হয়তো হবে লাজুক রমণীর ! ভেঙে পড়লে তীর ফিরিতে ইচ্ছে হয় ঘরে শরমের চিহ্ন তবু লেগে আছে কাপড়ে! লাল টকটকে খুন ! ধর্ষিতা এই নদী আমার গত জন্মের বোন।
ব্যাখ্যা ক্লাস সেভেন অনঙ্গ বৌ
......................
মূল
তোমারে একদা দেখিয়াছি অনঙ্গ বৌ
আমাদের পোয়াতি স্বপ্নের কৈশোর
বিশ্লেষণ
আলোচ্যাংশে সেইসব চেনা দৃশ্যরা খেলা করে। প্রলুব্ধ আত্মার গহিনে ক্রীড়ারত জল . . . জলের প্রহার ! এ বড় নিষ্ঠুর খেলা, বাতাসেও তার মুগ্ধ প্রবাহ ! নদীতে, ডাঙায়, চিতায়, স্মৃতিনাট্যম মুদ্রায় নেচে ওঠে সেই বধূমুখ ! আর কোন নদী নেই . . ধুলো নেই
কবি আর, স্মৃতি অধ্যুষিত রাজ্য পাটে !
মন্তব্য
স্মৃতির উদ্ভাসন দেখে তোমাকেই বধূ হতে বলি
পুনশ্চ স্মৃতিপুর যাই। হাতভর নৈবেদ্য; স্মৃতিময় অঞ্জলি !
সওয়াল
........
এইবার দ্বিতীয় মৃত্যুর কথা বলি। মৃত্যুর উৎসব থেকে নেমে আসেনি কেন জীবনশবের চাঁদমারি। বলি একদা বিনাশবেলায় পথগুলো কেমন করে নিয়ে গিয়েছিলো নিরুদ্দেশ যাত্রায়। রক্তের ভেতর ছলাৎ ছলাৎ দেখে কেউ কেউ বলেনি কি, আসলে ছেলেটাকে দিয়ে হবে! আর গার্লস স্কুল রোডে সবুজ মেয়েরা আচমকা ভেবেছে নতজানু প্রেমিক। কেউ বা ফিসফাস করে বলেছেন, সত্যি সম্ভাবনা ছিলো! কেবল আমি জেনে গেছি লোবানের ঘ্রাণে আসলে পরাজিত মৃত্যুর কথাই লেখা থাকে! নব্বুয়ের পরাজিত কিশোর যেমন বাবার আঙুলে ছুঁয়েছিলো প্রথম নগরযাত্রা। তারপর কাশীনাথ রোড ধরে গড়িয়ে গ্যাছে বহু পঙ্গু সন্ধ্যা। তার ভেতর দিয়ে হেঁটে এসে আমি দেখেছি শহরে কোথাও কোন সবুজ কিশোরী শেমিজের আড়ালে তুলে রাখেনি আমার হারিয়ে যাওয়া নীল বোতাম। পূর্ণিমার বিশ্বাসঘাতকতায় আমি বরং নদীর কাছে নত হয়েছি প্রার্থনায় বহুদিন। নদী তার অক্ষমতা নিয়ে কেঁদে দিয়েছিলো একদিন। দুপুরগুলোও কম যায়না। ঢের দেখিয়েছে তারা তেজি রোদের স্বপ্ন। তৃষ্ণাতুর আমরা কিছু পাতক চৌমু’না চত্বরে নিজেদের কাতরতা ঢেলে দেইনি কি একটা রঙিন রুমালের জন্য? তবে কেন এমন অসহায় মৃত্যু? এমন পলায়ন? সখীরে আমার, বিশ্বাস করো আমি তোমাদের শহরে ঘুমিয়েছি জননীর জরায়ু ভেবে। তোদের শহরকে ভেবেছি বৃষ্টিবন্ধু আমার। নৈর্ব্যক্তিক বেদনা পুষেও গান গেয়ে হেঁটেছি তোদের শহরে। তবু কেন যে এ নগর উগরে দিলো আমাকে!
বিগত লোভ জাগিয়া উঠিলে পর
.....................
হিলঞ্চীর বিলে খুইয়েছি একটা আধুলি, ফের কালনী হাওরের হাওয়া এসে লাগে মখমল নিবিড়! আর আমি তন্দ্রায় সেই বয়ারের সুরে শিস তুলি। স্বপ্নে দেখি বিয়ের বাদ্য বাজে ভেলুয়া সুন্দরীর! বধূমহল কলসি ভরে তুলে নিয়ে গেছে এমনই কেচ্ছা কিছু বিগত! ভেট ফুলের লাগি কেঁদে উঠলে মা তুমি বলতে, বড় হলে লোভী হবে ঠিক। আজও লোভের ঘুঙুর খেলে রক্তের পাতালে কতো! স্মৃতিজ শ্যাওলায় ভরে ওঠে দিগি¦দিক। নদী তাই বন্ধ্যা হলো শুনি। ফের সেই আর্জি বুনি। বলি, লোভ বেড়েছে মা এবেলা আচমকাই! ও বেলা কেন ফের নাইওর যেতে চাই!
এলিজি রিটেন ফর চম্পকনগর
....................
শেষ চৈত্র। ঘেসোনীল আসমান। মুঠো মুঠো রোদ্দুর বড়ো বেশি নির্জনতাগামী। কুল কুল ধ্বনি বহে নদী সুরমা। মানুষের ঢল নেমেছে কীনব্রীজে। দেখবে এসো। একদিন তো অমাবস্যায় জোছনার উৎসব দেখে কেঁদে উঠেছিলে। আমি তো সেই অ্যাঞ্জেলোর ছবি। বহুকাল থেকে দাঁড়ানো হয়নি অচেনা গঞ্জে; ঝরা পাতাদের উৎসবে। দু’ আনার তালপাতা বাঁশি, ‘কে কথা কয় রে দ্যাখা দেয় না...।’ মনে আছে একদিন রাত্রিময় নিঃসঙ্গতা কেটে এক কামুতি শশীর কবলে পড়েছিলো চম্পকনগর গ্রাম। আমি সেদিন নীল পেঁচার ডানায় ভর করে আকাশে ভেসে গেছি। দূর বহুদূর। সহসা সন্ত্রস্ত হলো হৃদয়, আমিও তো ঘুণ পোকার কবলে...।
পথপাঠ
.......
পথ ও হাড়ের বেদনা যার ঔরসে তার প্রজ্ঞা লোভ হয় একদিন, পথিক বলে কুড়াবে সুনাম। শূন্যতার ওপারে কীর্তিপাশা তারপর অরণ্যপুর গ্রাম। আর সেই পরিভ্রমণ পায়ের ছায়ায়... পড়শিকন্যা বোঝে কিছুটা। কিছুটা না বুঝেই গেঁথে রাখে বেণীজুড়ে; নকশিকাঁথায়! পথ তাকে দ্যাখায় মুগ্ধতা। প্রতিবেশীজন বিভূঁইগীত... অন্য আরো কথা। নিবিড়তা তবু জানে না ছাই, কতখানি দূরে গেলে হায়! সন্ধ্যারা সব সই, ডাক বাক্স কেঁপে ওঠে মরাল গ্রীবায়।
পুনশ্চপাঠ
..........
আমি যদি আজ হেঁটে আসি দূর। আমি যদি আজ খাম
তুমি ফের ই-মেইল করো কুশল, বিকেলবার্তা ঘামগন্ধ অক্ষর
লেখো নীল লেখো রাত ঠিকানা ধাম
মৌন ঘুরে এসে তোমার পাড়ায় যাবো। দোতলায় তোমার ঘর।
নীচে যদি আমি শিস কাটি নীচে যদি আমি ঠায়
তবে জেনো সত্য আমি যাইনি আমাকে রেখে পথ বয়ে যায়!
আর্তি
......
গূঢ় সব পথ ধরে এসে আজ ভাবি-এমনও দিনে বুঝি মরে যাওয়া ভালো ! অন্ধরাতের ভেতর কী পাতা, কী কাণ্ডে যে স্বপ্ন চমকালো-তার ধরন এমন-ই! পূর্বাপর গাঙে যতো লখিন্দর ঢেউ; তাদের কোমরেও ঝুলে আছে মৃত্যু মুখর ঝনঝনি ! সাপে যারে কেটেছে সে আমারই পিতা ছিলো।
পাতায় পাতায় পড়ে ছিলো যতটুকু ছায়া, ঘাসের পায়ের নীচে আবাদী জমি। আমার কৃষক পিতা তাতে বুনেছিলো ভুলবীজ! আজ আমি তবে কোন শস্য বেচে যাবো দূর বাণিজ্যে ? পথ ভোলানো এক মক্কল পিছু নিয়েছে আমার। তাই বুঝি প্রতি রাতে ভুল দরজায় কড়া নেড়ে বলি, আমি এসে গেছি বোন!
এইসব প্রশ্নেরা জেগে উঠলে আমার নালিশাকের কথা মনে পড়ে। গিঁটের পর গিঁট দিয়ে তুমি রেঁধেছো মা। তার সঙ্গে কি বেঁধে দিয়েছো আমার জীবনের যতো দাগ খতিয়ানও? আজ তাই কোনও পরচায় মেলে না তারে!
কী করে বলো ফিরে পাই নিজ বসত? কোন অধিকারে?
লিখিতেছি চিঠি
..........
আজ এইখানে
প্রথম বর্ষার বানে
ছাড়িয়াছি নৌকা- কাগজের
আজ এইখানে
ঈশান মেঘের পানে
উড়িয়েছি স্মৃতি - মগজের
আজ এইখানে
পুরোনো দিনের গানে
তুলিয়াছি সুর- পূঁথিবাংলার
আজ এইখানে
গুপ্ত এক অভিমানে
লিখিতেছি চিঠি- ব্যথা সারাৎ্সার
আজ এইখানে
প্রতিবেশীরা জানে
জমিয়েছি কেন মিছে - প্রীতি ও প্রেম
আজ এইখানে
এই কবিতার মানে,
তোমার দরজায় এসে ফের দাঁড়ালেম ।
প্রাচীন চৌকাঠ
.........
ফের ঘুরে ঘুরে ফিরে আসি প্রাচীন চৌকাঠ
আমরা বেরিয়েছিলাম ক’জন শখের পর্যটক
ডুব ডুব ছায়া সন্ধ্যায় ক্রেতা সেজে বেহুলার হাট
দেখেছি সর্পবিষে আর নীলাভ হয়না কুমারী ত্বক
বেদেনিরা বরং বড়বেশি ঘরমুখী আজ
আমরা পাইনি তাই বহর... শস্য কীর্তন... শাড়ি
রোদের নিচে ঘুমিয়েছে গ্রাম-মোহন কারুকাজ
শিখে আসি শুধু বিচিত্র ছলনা ! ব্যর্থ সম্প্রচার-ই
এবার এসো শ্রাবণের নদী
.................
বসন্ত স্মৃতিকথা নিয়ে উড়ে গেছে ঘাসফড়িং
নিসর্গের চোখে জলের নহর দেখিয়েছো তুমি
রাতের ভেতর দেখি স্মৃতিকালীন গার্হস্থ্যভূমি
কিছু কিছু মুখরতা গুহা চিত্রেও ইদানীং
আরো দূরে, চম্পকনগরে দ্রৌপদীকথার বধূ
একা একেলা রাত্রি গভীরতা মাপে. . .
আহা নগর! কেতকী ফুল পোড়ে সূর্য তাপে
এবার এসো শ্রাবণের নদী. . . পদ্মাচরের ধু ধু. . .।
১.
জল দরবারে সাক্ষ্য দিতে এসে ঘুমিয়ে গেছি ফের প্রিয় মাছঘরে!
তোমার রঙে আর রাঙা হয় নি অনাবাসী এই উতলা রাতে
মানুষেরা সন্ধিবেলায় এসে ভুলে গেছে যেহেতু পুরাতন সাকিন
এই বিষাদিত নিদ্রা তবে ভালো- ভালো এই নুনমাখা চান্নীপান
কাছে এলে দেখতে পাবে ঠিক,শিরার ভেতর রেখেছি হাফ-সমুদ্দুর
তার নুন ও নোনতা পৃষ্টা এক, বিরহবেদনার হালখাতা ।
ভুল সাহসে দাড়িয়েছি সাপ্তাহিক হাটবারে
এইবার যদি বিক্রি হয়ে যায় সব, এইবার যদি তুমি কিনে নাও আমারে!
২.
আধারে কভু ফিরি নি বাড়ি, পাছে চাঁদের গতরে লেগে যায় দাগ!
পথের বাঁকে গাছেদের মেনেছি ইয়ার, তারা নিজস্ব স্বভাব সংকেতে
কাছে টেনে আবার ছুঁড়েছে দূর; তাতে যাহা গুপ্ত অনুরাগ
মিলেছে আর মিলায়েছে ফলাফল মন মজানো অংকে
আমি ভাঁড়ারে রাখি নি সঞ্চয়, শিল্লি মেরে চলে গেছে কাল
ফিরতি পথে দেখি তুমি দাঁড়িয়েছো মুদিত পুষ্পের লজ্জায় লাল
সেই চির রহস্যের ভেতর পথের ইতিহাস পেয়েছে গূঢ় ব্যঞ্জনা
নিরবতা? কার নিরবতা বলছে উঠে 'কেউ নয় আপনজনা?
১২৩৪৫৬৭৮৯
...........
জন্মই যখন দিলে মা, না হয় গাছ করেই জন্ম দিতে
রক্তের এই আনচান করা জ্বালা ভরে পাতার ধমনীতে
বেফানা জীবন পেতো বৃক্ষজন্মের মহিমা
বলি মা,
দেমাগী রইদে পুড়ে পুড়ে কিংবা প্রপঞ্চ বৃষ্টিতে ভিজে
জেনে নিতাম কে বেশী অনর্থক
আমার জন্ম, না আমি নিজে!
না হয় পাখি করেই দিতে জন্ম
পালকের নিচে লুকিয়ে ভুল জন্মের হাহাকার
উড্ডয়ন সুখে ভীষন তন্ময়
আমি; পঙ্খিচরিত্র ভুলে অভিধা নিতাম রাজার!
মনুষ্যজন্ম বড় যাতনার মা !
পাখি কিংবা গাছেদের সমাজে স্মৃতিদন্ড নেই
কিন্তু মানুষ?
ভুবন ভ্রমিয়া শেষে
ফের এসে
ঘর বাঁধে স্মৃতেশ্বরী নদীপাড়েই !
লেবেলসমূহ:
কবিতা : শূন্য দশক,
সুমন সুপান্থ,
সুমন সুপান্থ কবিতা
এতে সদস্যতা:
পোস্টগুলি (Atom)