(নব্বই দশকের অন্যতম প্রতিভাবান কবি মজনু শাহ। তার এ যাবৎ প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ তিনটি হলো- আনকা মেঘের জীবনী, লীলাচূর্ণ, এবং মধু ও মশলার বনে। বিশেষত `লীলাচূর্ণ' কাব্যগ্রন্থের জন্যই তিনি ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা ও আলোচনায় চলে আসেন। সনেটের চর্চা যখন প্রায় শূন্যের কোঠায়, সেই সময়ে সম্পূর্ণ সনেটে একটি বই লিখে তিনি শক্তিমত্তার পরিচয় দেন। এরপর তার দীর্ঘ কবিতার ছোট বই `মধু ও মশলার বনে' বের হয়।)
আমার স্কুল
অনন্ত সময়ের মধ্যে একটি ঘড়ির ভূমিকা
কী- এটা ভাবলে আমার কিঞ্চিৎ মাথাব্যথা
হয় বিকেলের দিকে। উপশমের জন্যে,
তখন আমি গাঁদাফুলে সাজানো নৌকায়
গিয়ে বসি। এর মাঝি, প্রায়ই সহাস্যে
আমায় পাতাল প্রবেশের প্রস্তাব দেয়।
কিছুতেই আমি রাজি হই না, কেননা
পাতালে গিয়ে যদি দেখা যায়, সংখ্যায়
পাতালও অনন্ত, তখন?
এর চেয়ে সদা ভাসমান ঐ সমুদ্রগণিকার
বাড়ি থেকে ঘুরে আসা যাক। সময়, পাতাল
ও দেহের তিনিই তো পরম শিক্ষক।
প্রহরী/১.
সেইসব রোগা ও মোটা মায়েদের কথা মনে
পড়ে, স্কুলমাঠে যারা মিউজিক্যাল চেয়ারের
খেলায় আনন্দ পেয়েছিল। আজ বুঝতে
পারি, এ বিশ্বকে আমি নিরাসক্তভাবে
দেখতে পারিনি। চুরি করা পেঁপে হাতে
বাড়িতে ঢুকেছি। কেবল হস্তমৈথুনের সময়ই
চিনতে পেরেছি নিজেকে। হাতির পিঠে
ওঠার শখও ছিল। বন্দুক হাতে নিলেই
এখনোআমি হাসতে হাসতে ধুলোয় গড়িয়ে
পড়ি। আজকাল একটা শান্ত পুকুড় পাড়ে,
শামুক হয়ে পড়ে থাকতে ইচ্ছে হয়, দূর
থেকে একটা ক্ষুধার্ত রাজহাঁস যাতে আমাকে
দেখে ছুটে আসে...
প্রহরী/৪
কৃষ্ণসার মৃগভূমি আমাকে তার আরও কাছে
যেতে বলে। যতদূর চোখ যায়, উঁচু উঁচু
গাছগুলো দূরত্বকে ধরে আছে। সমুদ্রে
ছড়িয়ে যাচ্ছে মানুষ ও মহিষের রক্ত।
গাঁদাফুলের মালা পরে কারা এত নাচছে এই
যাবার সময়? কিছুদিন হলো জালে কেবল
কাঁকড়া ধরা পড়ছে। আমিও ফ্রেস্কো একেঁছি
ঘরের দেয়ালে গত কিছুদিন। এখানকার
লাল পিঁপড়েদের আমার আর কিছু বলার
নেই। খালি হাতে এভাবে যাওয়া কি ঠিক
হবে? মৃত দেয়ালঘড়ি থেকে আমি কি খুলে
নেব পেণ্ডুলাম?
জেব্রামাস্টার
আমি পড়াই জেব্রাদের স্কুলে। ছোট ছোট জেব্রারাই ছাত্র হিসেবে সবচেয়ে উপযুক্ত, একথা গত এপ্রিল থেকে বিশ্বাস করতে শুরু করেছি। আমার মা বাবা ভাই বোন কেউ নাই, বস্তুত, আমি বড় হয়েছি একটা লাল রঙের মাদী শেয়ালের কাছে। পাহাড়ের হা-য়ের মধ্যে যেখানে আমাদের বাড়ি, তার সামনে বসে দেখা যায় জলত্যাগী একঝাঁক কৈমাছ কান দিয়ে হেঁটে কাব্যসমালোচককে ধাওয়া করছে। আমি একে চিনতাম, এই লোকটা কোনো কবিতা দেখলেই একটা না একটা তত্ত্বের গ্লাসের মধ্যে পুরে কবিতাটার মৃত্যুদৃশ্য দেখতো আর জোর করে দৈত্যের ঢঙে হাসতো।
বাড়ির বাইরে যখনই আসি, পাহাড়টাকে ঘিরে দেখি সেই একই দৃশ্য, কৈমাছ আর কাব্যসমালোচকের শেষহীন দৌড়। দিন দিন কৈমাছের সংখ্যা বাড়তে থাকলে আমার শেয়াল-মা বললেন, যুদ্ধের দেরি নেই, মনে হচ্ছে এবার যৌনযুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে। তুই এই লাল লাঠিটা হাতে নিয়ে কৈ-এর স্রোত পার হয়ে জেব্রাদের শহরে চলে যা। বেঁচে থাকলে দেখা হবে।
শেয়াল-মা আমাকে জেব্রাদের গায়ে যেসব ডোরাকাটা দাগ আছে, তার তাৎপর্য বলে দিয়েছিল। বারবার সাবধান করে দিয়েছিল, কীর্তিমান পশুদের যৌনদৃশ্য দেখে আমি যেন কখনোই না হাসি। হাসলেই শেষ। এর আগে যারাই হেসেছে, নাভি থেকে এক ফুৎকারে উড়ে গেছে তাদের সমস্ত হাসি, আর পরিণত হয়েছে অভিশপ্ত কাব্যসমালোচকে। তারপর যথারীতি ক্রুদ্ধ কৈমাছের দল তার পিছু নেয়।
জেব্রাদের স্কুলে চাকরিটা কীভাবে পেলাম, ভাই রে, সে আরেক কাহিনী। পরীক্ষাস্বরূপ, এক অতিবৃদ্ধ জেব্রা আমায় বললেন, `একটা সদাব্যস্ত কালো ক্ষুধার্ত পিঁপড়ের ওজন কত?' মাথা চুলকে আমতা আমতা করে আমি বললাম, `সৌরজগতের সাপেক্ষে ধরলে, ঐ পিঁপড়ের ওজন পৃথিবীর কাছাকাছি।'
জেব্রাটার মুখ দেখে মনে হলো উত্তর সঠিক হয়েছে। আমাকে তিনি তার সামনের ডান পা-টা উঁচিয়ে শিশুজেব্রাদের দেখিয়ে দিলেন। দু’দিন পরে লেজ-হারানো এক জেব্রা বেতনের ব্যাপারে আশ্বস্ত করে গেল: যেসব শিশুজেব্রা পাতা খায় কিন্তু হজমের পর আর পাতার সংখ্যা বলতে পারে না, অংকে-কাঁচা ঐ জেব্রাগুলোই আমার বেতন।
আহ্, এদের ঘাড় মটকে, চামড়া ছাড়িয়ে, তারা প্রহরায় রাত্রিবেলা আমি আগুনে ঝলসে খেতে পারবো। আর কে না জানে, ছোট ছোট ছাত্রদের মগজ, কলিজা, মাংসÑ এমনকি এদের ঝকঝকে স্বপ্নভরা চোখ আর পায়ের কচি খুরÑ সবই খেতে খুব সুস্বাদু লাগে...
স্যানাটোরিয়াম থেকে
সর্বত্র, ঠাকুরের বাণী। আমাদের স্থান, তাই, স্যানাটোরিয়ামে। ভাগ্যিস বাবা একটা তেজপাতার গাছ লাগিয়েছিলেন উঠোনে। আজ, পাতা ঝরে পড়ছে, যেন বাণী-বিরোধিতা। আমি ভাবি, অজগর এতদূর কী করে এল? বড় খোঁপা-ওয়ালী একটা মেয়ে আমায় সেক্স-ট্যুরিজম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিল, আমি সাপ নিয়ে থাকি, তার বাইরে কিছু জানি না। কত রকমের বিষ, ফণা ও সৌন্দর্য হয়- সাপের সংসার ও কাব্যতত্ত্ব হয়- যেসব কত কম জানি। সন্ধেবেলা লোহারপুলে গিয়ে দাঁড়াই, কাছেই উলুবন। পোর্টে, আজ রাতেই নাকি ভিড়বে মার্কিন রণতরী। আমি কি কখনো নিখুঁতভাবে আঁকতে পারবো ড্রাগন? অনেক রাতে, সুর করে বই পড়ে নির্ঘুম ক্রীতদাসেরা। আজ আমার পুস্তক ঐ ধুম্ররাশি, আজ আমার পথ ঘুমন্ত অজগর।
জ্বর
কোথাও পদ্মপুকুর, অন্য এক আনন্দধাম রয়েছে। তার সন্ধানে, এক-একদিন পাপসমুদ্রের এই তীর ছেড়ে, সাহিত্য-সমাজ ছেড়ে বহু ক্রোশ দূরে চলে যাই। মনে আঁড় হয়ে থাকে দু-একটা সীতাফল কুড়াবার লোভ। কিন্তু কোথায় পুকুর, কোথায়-বা পদ্ম, কালকাসুন্দরীর ঝোপ থেকে ব্রহ্মদৈত্য পুকুরে এসে স্নান করে যায় প্রতিরাতে, লোকেদের চোখেমুখে সেই ভয়, আর সীতাফল? এক থুত্থুড়ে বুড়ো কেঁপে কেঁপে বললেন, ও-নাম মুখেও এনো না হে ছোকরা, দেখছো না এখানে ধরা-পড়া মরুশৃগালের চারপাশে বিশ্বাসীদের ভিড়।
ঋষিভঙ্গিতে গাছ যেভাবে গ্রহণ করে বজ্রপাত; মায়াপ্রোপটে ঢুকে, ঘোড়সওয়ার যেভাবে ভুলে যেতে থাকে তার জন্ম সম্ভব হয়েছিল এক তরুমর্মরের ভেতর- তেমনভাবেই, ড্রয়ার-ভরা ঘুমের ওষুধের দিকে অপলক তাকিয়ে থেকে থেকে ফ্যাকাশে আর বিভ্রান্ত হয়ে কখনও কখনও মনে হয়, শিল্প এক নিরাময়-অযোগ্য জ্বর। সিদুর-হলুদে মেশা মেঘের দিনে, সৌন্দর্যের কচ্ছপ কামড়ে দিলে এই জ্বর বাসা বাঁধে কারো কারো দেহে। তারপর, অবশিষ্ট জীবন, শিকার-শূন্য অরণ্যে, ক্ষুধা প্রশ্নে নিরুত্তর বাঘের মতো নিজেরই জ্বরতপ্ত জিভ চিবিয়ে অনন্তর সেই রক্ত পান করে বেঁচে থাকেন এক একজন শিল্পী।
আজ অনেকদিন পর, সাহিত্য-সমাজ ছেড়ে বহু ক্রোশ দূরে এসে দাঁড়িয়েছি। কিছুই পাব না জেনে হাঁটছি। কী জানি, এখানেই হয়ত মল্লার নামে, পাহাড়ের ঢালে পড়ে থাকা মৃত চা শ্রমিকের চোখের জন্যে এখানকার আকাশেই হয়ত দুই ঈগলের যুদ্ধ।
রাতে, তাবুতে ফিরে এসে বন্ধুকে লিখলাম... রাইন, তুমিও তো শিল্পভ্রষ্ট, ওদিকের কামিনী কাঞ্চন ধুলোয় ঢেকে গেলে একবার এখানে বেড়াতে এসো। দেখে যেও আমাদের সঙ্ঘ-বেদনা, শস্যছবির চারকোণায় বসানো জুয়াবোর্ড, আর অনিঃশেষ রক্ত ঝরোকা...
মাল্যবান
ধূলি-মলিন গাড়ির কাচে কেউ একজন লিখে রেখে গেছে- `মাল্যবান'। পড়ে আমি চমকে উঠলাম। বিড়বিড় করে নিজেকে বললাম: সময় নেই, সময় নেই, পা চালাও হাঁদা কোথাকার! সূর্যাস্তের পূর্বে, বলির পাঁঠাকে পরাতে হবে রঙিন কাগজের মালা, আর `মাল্যবান, তুমি কোথায় লুকালে ভাই' বলে চিৎকার করতে হবে যেখানে দীর্ঘণ প্রতিধ্বনি শোনা যায়। ধ্বংস¯তূপের ভেতর দিয়ে এখনো যে-পথ যায়নি, সেই প্রেমের পথে দাঁড়িয়ে অদ্ভুত একখানা ইতিহাস বই হাতে নিয়ে অঝোরে কাঁদছেন জল্লাদ, তার বাটারফাই-মার্কা গোঁফ দূর থেকে বোঝা যায়। এই নির্জনে, জল্লাদের চেয়ে বেশি ভয়ের সম্ভবত ঐ অর্ধদগ্ধ ইতিহাসের বই, যা থেকে এখন খুলে পড়ছে `ৎ'-গুলো। মাটিতে পড়ামাত্র ¯স্প্রিং-এর মতো লাফিয়ে উঠছে, তারপর শূন্যে ডিগবাজি খেয়ে ফিরে আসছে মাটিতে। আমাদের পায়ে বেড়ি পরানোর জন্যে শিগগির হয়তো ঝরে পড়বে বিসর্গগুলো, ঘটনার যুক্তিশৃঙ্খলা অন্তত সেরকমই ইঙ্গিত দিচ্ছে।
উঁচু বারান্দা
এই হস্তমৈথুনময় জীবন থেকে ছুটি নিয়ে উঁচু কোনো বারান্দায় গিয়ে বসতে চাই।
উঁচু বারান্দায় বসে দেখবো বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছে ভূগোল বই; ভূগোল ম্যাডামের কথাও কিছু ভাববো। তিনি কি এখনো নাভীর কিছুটা নিচে শাড়ি পরেন? বাঁকা হাসি মুখে নিয়ে যেন তিনি এখনো পড়িয়ে চলেছেন আমাদের উষ্ণ মণ্ডলীয় পর্বত বিষয়ে।
যে-কোনো পর্বত বিষয়ে জানার চেয়ে পর্বতের ভেতর অসংখ্য শাদা ইঁদুর হয়ে থেকে যেতে চেয়েছিলাম আমরা,কোনো আশাই পূর্ণ হলো না।
সেই উঁচু বারান্দায় বসে, অন্ধকারে, শুনবো দেবীরা কাঁদছেন হাউমাউ করে, এমন বর্ষায় তারা নাকি কৌমার্য পরীায় রাজি নয়।
পাহাড়ের উপর, বাড়ি নয়, শুধু একটা বারান্দা, একটা উঁচু বারান্দা কোথায় আছে কে জানে!
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
মজনু শাহের কিছু কবিতা আগে সামহোয়্যারইনে পড়েছিলাম। কিছু এইখানে নতুন পড়লাম। অসাধারণ ভালো লাগলো। সম্ভব হলে আরও কিছু কবিতা শেয়ার করুন। অনেক ধন্যবাদ।
উত্তরমুছুন