সুর স্রষ্টা আবদুল আহাদ

বাঙ্গালীর ঘরে ঘরে সংগীতের অনুপ্রবেশ ঘটানোর ক্ষেত্রে যাঁরা যুগান্তকারী ভুমিকা রেখেছিলেন সুর স্রষ্টা আবদুল আহাদ তাঁদের মধ্যে অন্যতম৷ এদেশে রবীন্দ্রনাথের গান প্রচার ও চর্চায় তিনিই প্রথম উদ্যোগী হন৷ বাংলা গানের ইতিহসে আবদুল আহাদ এক বিরল প্রতিভা৷ শুধু তাই নয়, তিনি এদেশের আধুনিক ও দেশাত্মবোধক সংগীতের প্রধান পথিকৃত্‍; রবীন্দ্র সংগীত চর্চার পুরোধা ব্যক্তিত্ব ৷


জন্ম ও পারিবারিক পরিচিতি
.....................
আবদুল আহাদ জন্ম গ্রহণ করেন ১৯১৮ সালে রাজশাহীতে৷ আবদুল আহাদের আদি নিবাস ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা থানার ফুকুরহাটি গ্রামে হলেও তাঁরা স্থায়ীভাবে বসবাস করতেন পাবনায়৷ তাঁর পরিবারটি ছিল সেযুগের অত্যন্ত শিক্ষিত ও সংস্কৃতিমনা মুসলমান পরিবার৷ তাঁর পিতা আবদুস সামাদ স্কুল পরিদর্শক ছিলেন৷ মা হাসিনা খাতুন প্রগতিশীল ও উদারমনা মানুষ হিসাবে পরিচিত ছিলেন৷ ছয় ভাইবোনের মধ্যে আবদুল আহাদ সবার বড়৷


ছেলেবেলা
..........
আবদুল আহাদের শৈশব কেটেছে নানাবাড়িতে৷ তাঁর নানা খান বাহাদুর মোহাম্মদ সোলয়মনের চাকুরিটি ছিল বদলীর চাকুরি৷ তাই নানার এইচাকুরির সুবাদে ছেলেবেলাতেই নানার সাথে ঘুরে বেড়িয়েছেন বিভিন্ন স্থানে; কখনো হুগলী জেলার চূঁচূড়া, কখনো জলপাইগুড়ি, কখনোবা দার্জিলিং৷ বিভিন্ন সময়ে শৈশবের স্মৃতিচারণে এইসব জায়গার স্মৃতিগুলিই তাই বার বার ফিরে এসেছে৷ চূঁচুড়াতে বাড়ির পাশে পর্তুগীজদের গীর্জা আর অতি পুরানো কবরস্থান , জলপাইগুড়িতে ছোটবোন মোহসেনা আলিকে সাথে নিয়ে ভরা বর্ষায় বাড়ির সামনের ড্রেন থেকে গামছা দিয়ে মাছ ধরতে গিয়ে মাছের বদলে ব্যাঙাচি ধরা কিংবা ম্যালেরিয়াতে আক্রান্ত হয়ে তেতো কুইনিন গলধ:করণ, দার্জিলিং - এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর সেখানে প্রতি রবিবারের হাটে শালপাতায় মোড়া মাখন নিয়ে বসে থাকা নেপালী মেয়েদের কথা তাঁর স্মৃতিতে ছিল চির জাগরুক৷

শৈশবেই পারিবারিক সাংস্কৃতিক আবহাওয়ার মধ্যে লালিত পালিত হবার কারণে ছেলেবেলা থেকেই সাহিত্য ও সংগীতের অনুরাগী ছিলেন ৷ প্রায় দিনই ভোরে আধো ঘুমে আর আধো জাগরণে শুনতে পেতেন খালা মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকার গলায় কান্তিচন্দ্র ঘোষের লেখা ওমর খৈয়ামের কবিতা ' রাত পোহালো শুনেছ সখী/ দীপ্ত ঊষার মাঙ্গলিক/লাজুক তারা তাই শুনে কী/ পালিয়ে গেল দিক-বিদিক?' ক্লাস এইটের পরীক্ষা শেষে আবদুল আহাদ রাজশাহী কলিজিয়েট স্কুলে এসে ভর্তি হন৷ এখানে এসে সহপাঠী হিসাবে পান হীরেন ভাদুড়ী ও রাধিকামোহনকে৷ হীরেন ভাদুড়ী চমত্‍কার উর্দু গজল গাইতে পারতেন ৷ প্রতিদিন টিফিনের সময় আবদুল আহাদ বন্ধুদের নিয়ে গানের আসর বসাতেন৷ এই গানের আসরে তিনি আর হীরেন ভাদুড়ী গান গাইতেন আর রাধিকামোহন বেঞ্চের ওপরে বসে তবলা বাজাতেন৷ ধীরে ধীরে স্কুলে তাঁদের গানের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে ৷ স্কুলের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে তাঁদের হেড মাষ্টারের নির্দেশে স্কুলের মৌলভী সাহেবের নির্বাচন করা হাফিজের একটি ফার্সী গজল 'দোশ দিদামকে মালায়ে দাও মায়ে খাজা জাদানদ' গাইলেন আবদুল আহাদ ও হীরেন ভাদুড়ী৷ গানের সুর দু' বন্ধু মিলে প্রচলিত গজলের সুরে ঠিক করে নিয়েছিলেন৷ তাঁদের পরিবেশিত এই গজল ঐ অনুষ্ঠানে সমঝদার সংগীত অনুরাগীদের বিপুল প্রশংসা লাভ করে৷


শিক্ষাজীবন
...........
রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল থেকে এসএসসি পাশ করেন৷ এসএসসি পাশ করার পর থেকে আবদুল আহাদের ইচ্ছা ছিল কলকাতায় পড়তে যাবেন এবং সেখানে পড়াশুনার পাশাপাশি ভালো করে গান শিখবেন৷ তাঁর বাবার অমত থাকলেও মায়ের সহযোগিতায় শেষ পর্যন্ত তিনি কলকাতার সিটি কলেজে ভর্তি হন৷ বিশাল কলকাতা নগরীতে এসে প্রথম দিকে কার কাছে গান শিখবেন , সেটাই স্থির করে উঠতে পারছিলেন না৷ শেষপর্যন্ত জমির উদ্দীন খাঁ সাহেবের পুত্র বালির কাছে গান শিখবেন স্থির করেন৷ কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে বুঝতে পারেন যে বালির কাছ থেকে সময় পাওয়া কঠিন ৷ তখন শুভার্থীদের পরামর্শে ওস্তাদ মঞ্জুর কাছে কিছুদিন তালিম নেন৷ ছাত্রাবস্থায় কলকাতায় অবস্থান কালে তিনি সংগীত জগতের বড় বড় দিকপাল সুবল দাশগুপ্ত, সুধীরলাল চক্রবর্তী , আব্বাস উদ্দীন প্রমুখের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য লাভ করেন৷ ইতিমধ্যে আই. এ, ক্লাসের শেষ দিকে তাঁকে আবার পাবনা চলে আসতে হয়৷ পাবনার এডওয়ার্ড কলেজ থেকে তিনি আই.এ পাশ করেন৷ এসময় তাঁর নানা অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে নিয়ে অন্ধ্র প্রদেশের ওয়ারটেয়ারে যান আবদুল আহাদ ৷ ১৯৩৮ সালে ওয়াল টেয়ারে থাকতেই একদিন কাগজে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রসংগীত শেখার জন্য সরকারী বৃত্তি প্রদানের বিজ্ঞপ্তি তাঁর চোখে পড়ে৷

শান্তিনিকেতন সম্পর্কে কোন ধারণা না থাকলেও কোন কিছু না ভেবেই বৃত্তির জন্য আবেদন করেন তিনি এবং মনোনীত হন৷ শান্তিনিকেতনে তিনি শান্তি দেব ঘোষ, শৈলজা রঞ্জন মজুমদারের কাছে গান শেখার এবং স্বয়ং গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের কাছে যাবার বিরল সৌভাগ্য অর্জন করেন৷ ১৯৪১ সালে শান্তিনিকেতনের শিক্ষা সমাপ্ত করে তিনি বোম্বেতে কর্মজীবন শুরু করেন৷


শান্তিনিকেতনের জীবন
.................
আবদুল আহাদের জীবনে ১৯৩৮ থেকে ১৯৪১ সাল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ৷ কারণ শান্তিনিকেতনে আবদূল আহাদ প্রথম মুসলমান ছাত্র যিনি সেখানে রবীন্দ্র সংগীত শিখতে গিয়েছিলেন, রবীন্দ্রনাথকে কাছ থেকে দেখার ও ভালোবাসার সুযোগ পেয়েছিলেন ৷ শান্তিনিকেতনে রাবীন্দ্রিক পরিবেশে তাঁর শিল্পী সত্ত্বা বিকাশের দ্বার একটু একটু করে উন্মোচিত হতে থাকে৷ শান্তিনিকেতনের ছায়াতলে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্য রবীন্দ্রশিষ্যদের সংস্পর্শে গিয়ে তিনিও হয়ে উঠেন রবীন্দ্র অনুরাগী৷ হয়তো একারণেই পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলাদেশে রবীন্দ্র সংগীত চর্চা ও বিকাশে মুখ্য ব্যক্তি হিসাবে তার আত্মপ্রকাশ ঘটে৷

রবীন্দ্র গবেষক ও শিষ্যদের মতে ১৯৩৯-১৯৪০ সাল রবীন্দ্রনাথের গান রচনার বছর৷ ঐ সময় রবীন্দ্রনাথ সর্বাধিক গান রচনা করেছিলেন যার অধিকাংশ প্রকৃতি পর্যায়ের , বিশেষ করে বর্ষা ও বসন্তকে নিয়ে৷ তিনি যখন একের পর এক সৃষ্টি করছেন অসামান্য সব গান ,তখন যারা সর্ব প্রথম ঐ গানগুলি শেখার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন তাঁদের মধ্যে আবদুল আহাদ অন্যতম ৷ এই গানগুলি তাঁদের শেখাতেন শৈলজা রঞ্জন মজুমদার ৷ ১৯৩৯ সালে তিনি শান্তিনিকেতনে একটি যন্ত্র সংগীত দল গঠন করেন৷ আশ্রমের ছাত্ররা যেসব অনুষ্ঠান করতো সেইসব অনুষ্ঠানের শুরুতে এই যন্ত্র সংগীত দলটি বাজনা বাজাতো৷

১৯৪১ সালের ২২ শ্রাবণ রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু সংবাদ শান্তিনিকেতনে এসে পৌঁছায়৷ নাট্যঘরে অন্যদের সাথে আবদুল আহাদকেও ডেকে পাঠান শৈলজা রঞ্জন মজুমদার ৷ খামের ভেতর থেকে একটি কাগজ বের করলেন ৷ এই কাগজে ছিল ডাকঘর নাটকের জন্য রবীন্দ্রনাথের লেখা "সম্মুখে শান্তির পারাবার ' গানের স্বরলিপি৷ এই গানটির কথা এতদিন তিনি কাঊকে বলেননি৷ সেদিন কবিগুরুর প্রয়াণের পর আবদূল আহাদরা শৈলজা রঞ্জন মজুমদারের কাছ থেকে গানটি শেখেন এবং সন্ধ্যায় প্রার্থনাসভায় ভরাক্রান্ত মন নিয়ে এই গানটি পরিবেশন করেন৷ এর অল্পদিনের মধ্যে আবদুল আহাদ শান্তিনিকেতনের শিক্ষা সমাপন করে কর্মজীবন শুরু করার উদ্দেশ্যে বোম্বে চলে যান৷


কর্মজীবন
..........
১৯৪১ সালে বোম্বেতে গিয়ে তিনি কর্মজীবনের শুরুতে বোম্বাই রেডিওতে প্রোগ্রাম করতেন এবং একটি স্কুলে রবীন্দ্র সংগীত শেখাতেন৷ কৃষ্ণচন্দ্রদের সাথে তিনি 'তামান্না' নামে একটি সিনেমাতেও অভিনয় করেন৷ বোম্বাই জীবন তাঁর ভালো লাগেনি৷ ২২ শে শ্রাবণ রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু বার্ষিকীতে বাঙ্গালী ও গুজরাটী মেয়েদের নিয়ে বোম্বাই রেডিওতে একটি প্রোগ্রাম করার পরই তিনি বোম্বাই ত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন ৷ বোম্বাই ত্যাগ করে শান্তিনিকেতনে গিয়ে বন্ধু সুহাসের বাড়িতে ওঠেন৷

তখন গান্ধীজীর 'ভারত ছাড়' আন্দোলনের হাওয়া ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে৷ রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত সচিব অনিল চন্দের স্ত্রী সুলেখিকা রানী চন্দের ডাকে তিনি তাঁদের সাথে আন্দোলনে একাত্ম হয়ে কাজ করার জন্য আশ্রম ছেড়ে গ্রামে গ্রামে 'বন্দে মাতরম ' গান গেয়ে বেড়াতে শুরু করেন৷ বন্ধু সুহাস গ্রেফতার হবার পর তাঁরা বোলপুরে ফিরে আসেন৷ তাঁদের প্রতি গোয়েন্দা বিভাগের সজাগ দৃষ্টি থাকায় একদিন অনিলচন্দ্র তাঁকে কলকাতা ফিরে যাবার পরামর্শ দেন ৷ আবদুল আহাদ কলকাতায় ফিরে আসেন৷ কলকাতায় ফিরে আসার পর কিছুদিন তিনি বেকার জীবন যাপন করেন৷

এসময় তাঁর বিশিষ্ট বন্ধু সন্তোষসেনগুপ্তের সহায়তায় হিজ মাষ্টার্স ভয়েস গ্রামাফোন কোম্পনীর কর্মকর্তা হেম সোমকে গান শোনাবার সুযোগ পান ৷ হেম সোম তাঁর গান শুনে তাঁকে শুধু শিল্পী নয় , রবীন্দ্র সংগীতের ট্রেনার হিসাবেও তাঁর কোম্পানীতে নিয়োগ দেন৷ আবদুল আহাদ ট্রেনার জীবনের সূত্রপাত করেন সুধা মুখার্জীকে দিয়ে 'বাদল ধারা হলো সারা ' ও গহন রাতে শ্রাবণ ধারা' এই গানদুটি রেকর্ড করার মধ্যে দিয়ে৷ তাঁর পরিচালনায় সুচিত্রা মিত্রের ' মরণ রে তুহূ মম শ্যাম সমান' এবং 'হৃদয়ের একূল ওকূল ' এই দুটি রবীন্দ্র সংগীত বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে৷ বিখ্যাত রবীন্দ্র সংগীত গায়ক পংকজ কুমার মলি্লকের সাথে রবীন্দ্র সংগীত নিয়ে বিশ্বভারতীর মনোমালিন্য হওয়ার কারণে প্রায় দীর্ঘ ছয় বছর তিনি রবীন্দ্র সংগীত রেকর্ডিং করা থেকে বিরত ছিলেন ৷ হেম সোম আবদুল আহাদকে দায়িত্ব দেন পংকজ কুমার মলি্লককে দিয়ে তাঁদের কোম্পানী থেকে রবীন্দ্র সংগীত রেকর্ড বের করার ব্যবস্থা করার৷ আবদুল আহাদ অসাধ্য সাধন করেন৷ তিনি পংকজ কুমার মলি্লককে রাজি করিয়ে 'সঘন গহন রাত্রি ' ও 'তুমি কি কেবলি ছবি' গান দুটি রেকর্ড করান এবং বিশ্বভারতীর মিউজিক বোর্ড থেকে পাস করিয়ে আনেন৷

আবদুল আহাদ তাঁর সংগীত গুরু শান্তি দেব ঘোষ কে দিয়ে 'কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি ' এবং 'বসন্ত কি শুধূ ফুল ফোটার মেলা ' রবীন্দ্র সংগীত দুটি রেকর্ড করান৷ প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ,এটি ছিল শান্তি দেব ঘোষের জীবনের প্রকাশিত প্রথম রবীন্দ্র সংগীতের রেকর্ড৷

এছাড়াও এসময় সুচিত্রা মিত্রের অনুরোধে আবদুল আহাদ তাঁর বাবা খ্যাতনামা লেখক সৌরেন্দ্র মোহন মুখোপাধ্যায়ের গানে সুর দেন ও রেকর্ডিং- এর ব্যবস্থা করেন৷ বন্ধু সন্তোষ সেনগুপ্তকে দিয়ে আবদুল আহাদ তাঁর নিজের সুরারোপিত প্রথম আধুনিক গানের রেকর্ড এইচ. এম.ভি থেকে প্রকাশ করেন৷ গান দুইটি ছিল ' তুমি আমি দুই তীর সুগভীর তটিনী ' এবং ' সে পথ ধরে আসনি তুমি' ৷

কলকাতার কর্মজীবনের ফাঁকে ফাঁকে আবদুল আহাদ আড্ডা জমাতেন বিখ্যাত রবীন্দ্র সংগীত গায়ক দেবব্রত বিশ্বাসের বাড়িতে ৷ সেখানে সুচিত্রা মিত্র, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে দেবব্রত বিশ্বাস কমিউনিষ্ট পার্টির বিভিন্ন প্রোগ্রামে অংশ নেবার জন্য গানের রিহার্সেল দিতেন৷ উপমহাদেশের ইতিহাসে ১৯৪২-৪৩ সালের ঐ সময়টা ছিল খুব গুরুত্বপূর্ন৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছে, গান্ধীজী 'ভারত ছাড়' আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন, কলকাতায় বোমা পড়ছে আর এরই ধারাবাহিকতায় দেখা দিয়েছে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ৷ পিটিআই এর কর্মী হিসাবে দেবব্রত বিশ্বাস সদলবলে গান গেয়ে মানুষকে উজ্জ্বীবিত করে বেড়াতেন পথে প্রান্তরে৷ তাঁর বাড়িতেই আবদুল আহাদ তখনকার আলোড়ন সৃষ্টিকারী জ্যোতিরিন্দ্র নাথ মৈত্রের 'নবজীবনের গান' বিশেষ করে দেবব্রত বিশ্বাসের কন্ঠে ' ফ্যান দে ' শুনে দেশপ্রেমে অনুপ্রাণিত হন৷

ঠিক সেসময়ই শুরু হয় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা৷ সেই অনিশ্চিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আবদুল আহাদকে তাঁর শিল্পী বন্ধু হেমন্ত মুখোপাধ্যয় ঢাকা চলে যাবার পরামর্শ দেন ৷ ইতিপূর্বে আবদুল আহাদের পরিচালনায় হেমন্তের গাওয়া ' প্রাঙ্গনে মোর শিরিষ শাখায়' গানটি রবীন্দ্র সংগীতপ্রেমীদের মধ্যে বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল ৷ হয়তো তাই ঢাকায় চলে আসার আগে আবদুল আহাদের পরিচালনায় হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ৪টি রবীন্দ্র সংগীত রেকর্ডিং করেন৷ এরপর ১৯৪৮ সালের মাঝামাঝিতে আবদুল আহাদ ঢাকায় চলে আসেন৷ ঢাকা বেতারে প্রয্রোজক হিসাবে যোগদান করেন৷ সেসময রেডিওর অবস্থা ছিল বড় করুন৷ শিল্পী সংখ্যা নগন্য থাকায় একই শিল্পীকে দিয়ে সবধরনের গান গাওয়ানো হতো৷ সংগীত বিভাগে আরো তিনজন প্রযোজক থাকলেও মূল দায়িত্ব অর্পিত হয় আবদুল আহাদের ওপর৷ আবদুল আহাদ কাজ করতে গিয়ে অনুভব করেন একক গানের পাশাপাশি প্রোগ্রামে বৈচিত্র্য আনার জন্য কোরাস গানও করা দরকার৷ তিনিই প্রথম রেডিওতে রবীন্দ্র - নজরুলের গান কোরাস ভাবে প্রচারের পাশাপাশি অন্যান্য সমকালীন কবিদের দেশাত্মবোধক গান সমবেত কন্ঠে প্রচারের উদ্যোগ নেন৷ কোরাস গানের জন্য তিনি হোসনা বানু, আঞ্জুমানারা বেগম প্রমুখকে নিয়ে একটি শিল্পী দলও তৈরি করেছিলেন৷

১৯৫৪ সালে ঢাকায় দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার নৃত্য ও সংগীতের মহাসম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ৷ এই মহাসম্মেলনে অংশগ্রহণের জন্য বার্মা, পাকিস্তান , থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া ও ভারত থেকে বিভিন্ন শিল্পীদের আমন্ত্রণ জানানোর লক্ষ্যে তাঁকে উল্লিখিত দেশসমুহ ভ্রমণ করতে হয়৷ ১৯৫৬ সালে তিনি স্পেন সরকারের বৃত্তি নিয়ে একবছরের জন্য মাদ্রিদ যান স্প্যানিশ সংগীত সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য ৷

স্পেন থেকে দেশে ফিরে তিনি দেশাত্মবোধক গানে সুরারোপে মনোযোগী হন৷ তাঁর সুরে আবু হেনা মোস্তাফা কামালের লেখা ' কেন যে আমার কৃষ্ণচূড়ার বনে ' ' আমি সাগরের নীল নয়নে মেখেছি' 'ভ্রমরের পাখনা যতদূর যাক না' গানগুলি ফেরদৌসী রহমানের কন্ঠে অসাধারণ জনপ্রিয়তা লাভ করে৷

ঢাকা টেলিভিশনের সিগনেচার টিউন করেছিলেন তিনি৷ টেলিভিশনের প্রতিদিনের উদ্ধোধনী অনুষ্ঠানে সেটি বাজানো হতো৷ ১৯৬১ এর আন্দোলন মুখর উত্তাল রাজনৈতিক- সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সময়ে নতুন প্রেরণা ও চেতনা নিয়ে রবীন্দ্রজন্ম শতবার্ষিকী উদযাপন করা হয় ৷ এ উপলক্ষ্যে অধ্যাপক রফিকুল ইসলামের সহযোগিতায় আবদুল আহাদ টেলিভিশনে বাংলা বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের দিয়ে হাজার বছরের বাংলা গানের এক অনবদ্য অনুষ্ঠন করেছিলেন৷

১৯৬৫ সালে তিনি পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানীদের নিয়ে গঠিত সাংস্কৃতিক দলের উপনেতা হয়ে গণচীন ভ্রমণ করেন৷ ফিরে এসে সেই অভিজ্ঞতার কথা নিয়ে লেখেন একটি অসাধারন গ্রন্থ - ' গণচীনে চব্বিশ দিন' ৷ এরপর ১৯৬৭ সালে তিনি সাংস্কৃতিক দলের উপনেতা হয়ে ইরানের ইন্টারন্যাশনাল আর্ট ফেস্টিভ্যালে যোগদান করেন৷

ষাটের দশকে এদেশে রবীন্দ্রচর্চার প্রচার ও প্রসারে তিনি প্রশংসনীয় ভুমিকা রাখেন৷ সরকার পরিবর্তন ও রাজনৈতিক কারণে রবীন্দ্র সংগীতের ওপর বার বার যে আঘাত এসেছিল তা থেকে তিনি রেডিওকে সুকৌশলে বাঁচিয়ে রাখতে সক্ষম হন৷

কর্মজীবনের শেষ পর্যন্ত তিনি রেডিওতে প্রযোজক-সুরকার হিসাবে কর্মরত ছিলেন এবং তাঁর চাকুরির বয়সসীমা পার হবার পরও সাতবার তা বাড়ানো হয়েছিল৷ রেডিওর কাজের বাইরে তিনি বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে গান শেখাতেন এবং প্রচুর বই পড়তেন৷


পুরস্কার/ সম্মাননা/ স্বীকৃতি
..................
১৯৩৬ সালে তিনি কলকাতার অল বেঙ্গল মিউজিক প্রতিযোগিতায় ঠুংরী ও গজলে ১ম পুরস্কার লাভ করেন৷
১৯৬২ সালে তত্‍কালীন রাষ্ট্রীয় পুরস্কার 'তামাঘা- ই - ইমতিয়াজ ' পুরস্কার লাভ করেন৷
১৯৬৯ সালে তত্‍কালীন রাষ্ট্রীয় পুরস্কার 'সিতারা - ই - ইমতিয়াজ পুরস্কার লাভ করেন৷
বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭৮ সালে স্বাধীনতা পদক লাভ করেন৷
১৯৮৪ সালে কাজী মাহবুল্লাহ পুরস্কার লাভ করেন৷
১৯৮৫ সালে নাসিরুদ্দিন স্বর্ণ পদক লাভ করেন৷


ক্ষেত্র ভিত্তিক অবদান
..........
তিনি এদেশের দেশাত্মবোধক ও আধুনিক বাংলা গানের জনক৷ তাঁর সুরে মোহম্মদ মনিরুজ্জামানের লেখা 'আমার দেশের মাটির গন্ধে ভরে আছে সারা মন' গানটি আজও সংগীতপ্রেমীদের কাছে অসম্ভব জনপ্রিয়৷ এছাড়াও তিনি জনপ্রিয় দেশত্মবোধক গান ' দুর্গম এ যাত্রাপথে' , 'দূর দিগন্তের ডাক এলো, বীর চলো নির্ভয়ে', 'এই বাংলার সবুজে শ্যামলে', 'কালের তিমিরে এসেছে আলোর পায়রা', ইত্যাদির সফল সুরকার।

রবীন্দ্র সঙ্গীতচর্চারও প্রাণপুরুষ তিনি৷ ১৯৬৮ সালে তত্‍কালীন পাকিস্তানে ইয়াহিয়া খান ক্ষমতায় আসার পর তথ্য মন্ত্রী খাজা শাহবুদ্দীন এক আদেশ জারি করেন, টিভির পর্দায় কোন মেয়ে টিপ পড়তে পারবেনা এবং রেডিও-টিভিতে রবীন্দ্র সংগীত প্রচার করা যাবেনা৷ সরকারী চাকুরে হওয়া সত্ত্বেও আবদুল আহাদ এর বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা আন্দোলনের সাথে একাত্ম ছিলেন ৷ কঠিন আন্দোলন গড়ে ওঠার ফলে এ আদেশ পরে বাতিল করতে সরকার বাধ্য হয়৷ তিনিই প্রথম রেডিওতে রবীন্দ্র সংগীত শিক্ষার আসর শুরু করেন ৷ ২৫শে বৈশাখ ও ২২ শে শ্রবণ রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করতেন৷ এভাবে আবদুল আহাদ এদেশের মুসলমানসমাজকে রবীন্দ্র সংগীত ও রবীন্দ্র চর্চায় ঊদ্বুদ্ধ হওয়ার ক্ষেত্রে অন্যতম ভুমিকা পালন করেছিলেন৷

১৯৬৮ সালে শেখ মুজিবুর রহমান যেদিন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তি লাভ করেন তার আগের দিন সরকার টেলিভিশনে 'শহীদ দিবস ' উপলক্ষে অনুষ্ঠান প্রচারের অনুমতি দেয়৷ তবে 'শহীদ দিবস' কথাটি ব্যবহার করতে দেওয়া হয়নি৷ আবদুল আহাদের সংগীত পরিচালনায় সেই প্রথম টেলিভিশন থেকে 'শহীদ দিবস ' উপলক্ষে অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়৷ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর মন্ত্রীপরিষদের সচিব তৌফিক ইমামের নির্দেশে তিনি বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত 'আমার সোনার বাংলা' গানটির স্বরলিপি বিশ্বভারতী সংগীতবোর্ড কর্তৃক অনুমোদন করিয়ে আনতে যান৷ আবদুল আহাদ দুজন রবীন্দ্রসংগীত শিল্পীকে সাথে নিয়ে শান্তিনিকেতনে যান এবং তাঁর সংগীত শিক্ষাগুরু শান্তিদেব ঘোষের সহায়তায় গানটি বিশ্ব ভারতী সংগীতবোর্ড কর্তৃক অনুমোদন করিয়ে আনেন৷


মৃত্যু
.......
অমর সুরশ্রষ্টা, এদেশের বাংলা আধুনিক ও দেশাত্মবোধক গানের জনক আবদুল আহাদ ১৯৯৪ সালের ১৫ মে পরলোক গমন করেন৷ তাঁকে মিরপুর কবরস্থানে সমাহিত করা হয়৷ তাঁর প্রয়াণের মধ্যে দিয়ে বাংলা গানের এক স্বর্ণযুগের অবসান ঘটে৷

গবেষক : উপমা দাশগুপ্ত