মঙ্গলবার, ২৫ আগস্ট, ২০০৯

কাঁদিদ_ মঁসিয়ে ভলতেয়ার প্রণীত।।

জাহেদ সরওয়ার


এই বইটি প্রথম পড়ি ১০ বছর আগে, পাঠচক্রে। এটা ছিল বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত। অনুবাদকের নাম মনে নাই। অনেকটা দায়সারা গোছের মনে হয়েছিল অনুবাদটা। পাঠচক্রে বই থেকে ভাললাগা ক’এক লাইন টুকে আনতে হতো। তার পর সমন্বয়কারী দস্তখত দিতেন। আর কেউ একজন বইটার ওপর আলোচনা করত। তখন একটা শব্দই গেথে ছিল মনে এলদোরাদো (স্বর্ণভূমি)।বলা যায় এই স্প্যনিস শব্দটার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু দশ বছর পর গতবাত্রে যে কাঁদিদ পড়লাম। এটা মূল ফ্রেঞ্চ থেকে অনুবাদ করেছেন ফরাসী ভাষাবিদ কবি অরুন মিত্র। এ এক অসাধারণ অনুবাদ। একেবারে মূলের ছোয়া পাওয়া যায়। ভলতেয়ারকে চিরদিন গুরু মানি কেননা তার মতো প্রথাভাঙ্গা দার্শনিক ইহজন্মে আর দেখা দেয় নাই। সবকিছুতে তিনি ছিলেন ব্যতিক্রম। রাজতন্ত্র বিরোধী, ধর্মবিরোধী, সবসময় হতাশাবাদি ইত্যাদি। নিজদেশে বুদ্ধি হবার পর থেকে থাকতে পারেন নাই। সবসময় ক্ষমতাবানদের বিরোধীতা করেছেন। নির্বাসন আর জেল ছিল তার জীবন। তিনি বলতেন দূর্ণীতিপরায়ন রাস্ট্রে সত মানুষের একমাত্র বাসস্থান কারাগার।
এই বইটিতে তিনি মূলত অষ্টাদশ শতাব্দির পুরা ইউরোপকে পটভূমি ও বিষয়বস্তু করেছেন। যদি এটাকে ফিকশন বলা হয়। মূলত মানুষের বোধ্য করে তিনি দর্শন লিখেছেন বলে মনে হয়ে আমার। পৃথিবীর যে সব আশাবাদি দার্শনিক সক্রাতেস, এরিস্তোতল আর ধর্মগ্রন্থসমূহ এমনকি ভারতীয় গীতা উপনিষদেও যে সবকিছু সবসময় সবচেয়ে ভালর জন্য ঘঠে। পুরা উপন্যাসটা তিনি এই বাক্যর বিরোধীতা করার জন্য লিখেছেন। এটা নায়ক কাঁদিদকে শিখিয়েছিল তার দর্শনগুরু প্লাগস। ব্যরণ কন্যাকে চুমু খাওয়ার অপরাধে রাজদরবার থেকে পাছায় ১৪টি লাথি দিয়ে কাঁদিদকে বের করে দেবার পর। সে বেরিয়ে পড়ে পৃথিবীর পথে।ইউরোপের প্রায় প্রতিটি দেশে কাঁদিদের নিয়তি তাকে তাড়িয়ে বেড়ায় কিন্তু সবখানেই সে দেখল জানোয়ার সুলভমানুষ হিংস্রতা, প্রতারনা নিষ্ঠুরতা দখলদারিত্ব নারীধর্ষন খুন যুদ্ধ এই সব পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে সে জানতে পারে পৃথিবীতে সব কিছু ঘঠে সবচাইতে খারাপ হবার জন্য। মানবজাতির ভবিষ্যত সম্পর্কে বিরাট হতাশার ভেতর নিক্ষেপ করেন ভলতেয়ার পাঠককে। জেসুটদের ভন্ডামী, তথাকথিত আত্মহীন সাহিত্যিকদের ছলনা, দার্শনিকদের ভ্রান্তদশন সব নিজের মতো প্রায় অকাট্য যুক্তি দিয়ে সে পরাজিত করে।
কাঁদিদকে জিজ্ঞেস করে তার ভৃত্য_ তাহলে আশাবাদ মানে কি?
_কাঁদিদের উত্তর, সবকিছু খারাপ থাকা অবস্থায় যে বলে সবকিছু ভাল চলছে সে হলো গিয়ে আশাবাদি।
কত সত্য কথা আমাদের দেশের সরকারগুলোর দিকে থাকালে বুঝা যায়। দেশের চরম দুর্দিন বাজারে আগুন-কোনো সমস্যা নাই। বিদ্যুত নাই, সন্ত্রাস অবিচার রাস্তাঘাট নাই মানুষের খাদ্য নাই চিকিতসা নাই সে অবস্থাতেই টিভিতে ঘোষনা করা হয় উন্নয়নের জোয়ারে ভেসে চলেছে দেশ। ভেসে যে কোথায় যায তাতো দেখছি নিয়ত। এর মধ্যে সত্যি এতো দর্শনের কচকচানি থাকলেও পড়তে অসাধারণ লাগে। যুবতী কুনিগাদের সাথে কাঁদিদের প্রেম। কুনিগাদ কে অনুসরণ করে কাঁদিরে সমস্ত পৃথিবী ভ্রমন।
তবে ভলতেয়ার আমাদের সমাধান দেয় এলদোরাদো। যেখানে পথের ধুলো হচ্ছে সোনা আর হিরা। এগুলো ছুয়েও দেখেনা এলদোরাদোর লোকজন। ও দেশে খেতে কোনো টাকা লাগেনা। মোটকথা আত্মিক শুদ্ধিময় এক কাল্পনিক রাজ্যি এই এলদোরাদো। মঁসিয়ে ভলতেয়ার আজো মানবজাতি কোনো এলদোরাদো খুঁজে পায়নি এবং পৃথিবী সেই একই জায়গায় আছে। তেলের জন্য আমেরিকা এখনো ধ্বংশ করে আফগান,ইরাক। হীরা সোনার জন্য লাতিন আমেরিকাকে নরক বানিয়ে রেখেছে সাম্রাজ্যবাদিরা। এই ছোট বইটা এখনো কত সত্য আর জীবন্ত আমাদের জন্য।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন