সোমবার, ৩১ আগস্ট, ২০০৯
একদিন কথাকীর্তনের রাতে
শাহীন মোমতাজ
একদিন কথাকীর্তনের রাতে’র উৎসর্গ কবিতা
............................
ঝাপসা স্মৃতির দাহ,
দহনক্ষমতা আর নির্বাপণ,
বন্যা আর নদীজড়তার দ্বিধাদ্বন্দ্বময় তোমার প্রস্থান, চোরাবালি আর
অবদমনের মতো মানুষের যাপিত সংসার।
ডাকবাক্স
........
মধ্যরাতে জনসমাগম থেমে গেলে, একা একটি ডাকবাক্স
অধীর তৃষ্ণায় মুখ খুলে বসে থাকে।
আমি মাঝে মাঝে তার কাছে যাই,
তার লাল দেহে হাত রেখে অভিযোগ করি,
বলি, ‘আমার সকল পত্র তাঁর নামে
তাঁর জন্যে অপেক্ষায় ডাকঘর
খুলে বসে থাকি, তবু
অনীহায় অবিবেচনায় তিনি দূর থেকে রহস্য পাঠান।’
রহস্যে কাতর হই, দিকনির্দেশনাহীন হই,
তারপর একদিন সতৃষ্ণ ডাকবাক্স, তার পাশে ডাকবাক্স হই।
পেঁপেগাছ
.......
কারা দিল সরল বৃক্ষের মতো ভঙ্গিমায় ভরিয়ে আমাকে?
এই বৃক্ষে চিররাত্রিদিন, যেন বা সকল বাক্য নিদ্রাকুসুমের মতো
ফুটে আছে।
এইরূপ ফুল ও সংবাদ নিয়ে পেঁপেগাছ।
যাদের যোগ্যতা নিয়ে রাত্রিভর এত আলোচনা,
অথচ কোকিল ছিল গাছে গাছে;
নিরুপম রুপা ও নারীর ভাগ্য জ্যামিতির প্রতিপাদ্য বলে মেনে নিই;
অলক্ষ্যে হাসেন তিনি, যিনি মোর দ্বিধাদ্বন্দ্বে সমতা রাখেন।
আমি রাখি ভূমিহীন, প্রতিমূর্তিহীন হয়ে যথেচ্ছ আচার
আমাদের জন্মগত প্রাণ, সবকিছু একদা গচ্ছিত ছিল পেঁপেবীজে-
এসব স্মরণে এলে বড় ভয়, হীনম্মন্যতার।
ডায়েরি
......
সাদামাটা ডায়েরির পলেস্তারা থেকে
উঠে আসছে আমাদের উচ্ছ্বাসবেষ্টিত হাসি, বিবেচনাবোধ।
যে রাখাল আমাদের তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে, মরুভূমিপথে,
তার নিজেরই কোনো আচ্ছাদন নাই, দেশ নাই-
(তার পিছে অন্য এক অতিরাখালের হাসি শোনা যায়)
লাঠি হাতে দুপুরের বিষণ্ন আবহ থেকে
ধীরে ধীরে অবয়ব ফিরে পাচ্ছে যে রাখাল,
তার মতো পৃথিবী সংকেতময় এই তথ্য আমিও জেনেছি।
২.
মনে হয় ঝড় ওঠে আর তার বিপদসংকেত প্রচারিত হয়। সেই
সংকেতের মানে বোঝে এ জেলার একজন মেয়ে,
সে তার শাড়ি জামা খুলে
ঝড়ের মুহূর্তটিতে আয়নায় সাজতে বসেছে।
দেহতত্ত্ব
....
১.
এ দেহ মরীচিকা অত্র বিবাহের
প্রবাহে ঝরঝর
বর্ষা গান
গোধূলি প্রাপ্তির তাড়না বহমান
শঙ্খ বাজে কেন
ঘোষপাড়ায়
দুগ্ধফলবতী গাভী ও বৃক্ষের
চর্চা করি চলো
রৌদ্রে আজ
চিত্র অনুভূত জন্মতন্ত্রের
বিস্মরণে আর
মুগ্ধতায়।
২.
শারীরবিদ্যায় যারা এইমাত্র প্রবেশ করেছে
তারা জানে কোনো কিছু সংস্থিত নয়
কোনো কিছু সূক্ষ্ম শরীরে আর বিরাজ করে না।
এই কথা অধর্মসম্মত বলে ভীত নই।
ভীতির কারণ ছিল জলাশয়ে নীত।
এবার হেমন্তকালে সেই ব্যথা, জলাশয়,
স্নায়ুবিকলন দেখি আমাকে মুমূর্ষু আর
মুখাপেক্ষী করে রাখে পুনরায় হীনম্মন্যতার।
নাটক
.....
মধ্যবিরতির আগে যে নাটকে নিখোঁজ সংবাদ হলো রামানন্দ রায়,
সেই নাটকের শেষে তোমাকে উজ্জ্বলতম দেখা গিয়েছিল-
রচয়িতা তোমাকেও ভালোবাসে বুঝি।
বীজ
...
বীজের ও যাবতীয় চাষ-প্রকৃতির কথা
তুল্যমূল্য হলে
একদিন কৃষিসমাজের কাছে
কিছু দায় জন্ম নিয়েছিল।
এইসব বীজ আর বাণিজ্য-বাসনা নিয়ে
ভাবপ্রবণতাহীন,
তার ফলে, ছুটে চলে যাই।
হাটবাজারের কাছাকাছি এলে কোনো বীজে
ঘটে যায় প্রাণসঞ্চারণ;
সেইসব গুণবতী বীজ আমি
হাতের তালুতে নিয়ে দেখি;
দেখি আর ক্রমে ক্রমে বুদ্ধিমান হয়ে ওঠে
চাষি-সম্প্রদায়।
ধর্মনারায়ণ
......
ধর্মনারায়ণ বলে এক লোক ছিল
হ্রদের কিনারে বসে, মাছ-সমস্যার কোনো কিনারা হলো না
এই ভেবে তিনি, ধর্মনারায়ণ (জাতিতে ব্রাহ্মণ নন)
জাল ও জীবিকা নিয়ে অপেক্ষা করেন।
এই অপেক্ষার কালটুকু বাদ দিলে তাঁকে নিয়ে
পৃথিবীর কোনো শাস্ত্রে সপ্রমাণ আলোচনা নাই।
তাঁকে সমুদ্রের যাবতীয় প্রাণিকুল জাতি ও প্রজাতিভেদে
বিভক্ত করার হেতু গণ্য করা হয়।
যেহেতু মাছের প্রতি ছিল তাঁর অনিবার টান
তাই তাঁকে কোনো কোনো উপকূলে
মাছের দেবতারূপে অর্চনা করা হয়ে থাকে।
বাতাস ও নদীর নাব্যকথা
...............
একদিন সমস্ত শুকিয়ে গিয়ে পড়ে থাকে
কাদা আর কাদাখোঁচা পাখি।
এবার নদীতে গান- বিভিন্ন ঠাকুর এসে
গেয়ে যান, উপলক্ষ হরিত্ব-সাধন।
আমাদের প্রভু নাই, সাধনার
কত যে পদ্ধতি ছিল ভুলে গেছি; শুধু
ধানের মৌসুম ছেড়ে বাতাসের উড়ে যাওয়া দেখি,
এ বাতাস একদিন সামান্য ঢেউয়ের তোড়ে
মৃদুমন্দ লেগেছিল গায়ে।
বনভোজন
..........
বনভোজনের কথা এইমাত্র হারিয়ে ফেলেছি।
তারপর, কী করি এখন?
স্মরণখোলার প্রভু বাউলের জলসা বসিয়েছে,
প্রশ্ন করি শুধু আর বনভোজনের কথা
কেউই বলে না।
তাই আমি- চিন্তা করো মন,
যদি না প্রকাশ তবে কোথায় গোপন বিবরণ- বলে
লাফ দিই হতভম্ব, জলে।
এইসব দেখেশুনে মুগ্ধ হতে চেয়েছিল যারা,
তাদেরও গোপন কথা ছড়িয়ে গিয়েছে
ঝোড়ো বাতাসের আগে।
তোমাকে উদ্দেশ করি
..............
তোমাকে উদ্দেশ করি। এই প্রাণ, বয়ঃসন্ধিকাল,
বালিকণিকার মধ্যে খুঁজে পাওয়া ব্রহ্মাণ্ড বিষয়,
পতিত জমির জন্য শস্য ও খড়ের এই ব্যাকুলতা- এ সবকিছুই আজ
তোমাকে উদ্দেশ করে রচিত হয়েছে।
প্রায়-অন্ধকারে বসে বিরহসন্তাপ তুমি পাঠ করো।
দেখো এই দিনে, পতঙ্গ ও পশুপ্রজাতির মধ্যে
পড়ে থেকে বেড়ে উঠছে আমাদের চরিতমানস।
আর এই বৃক্ষ রচিত হবার আগে একবার পারিপার্শ্বিকতা নিয়ে,
জলীয় বাষ্পগাথা, পানিসেচ পদ্ধতির ত্রুটি ও বিচ্যুতি নিয়ে
আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল। তারপর পুনরালোচনা।
তারও পরে কতদিন তোমার সংলাপ আমি নিজ কানে করি না শ্রবণ।
তুমি দেখো, আমাদের বিগত জীবন, রীতি, গান-
মূলত যেগুলি ছিল বাস্তবতা- নীতিবিবর্জিত নয়,
নৈকট্যরহিত নয় কোনো কিছু।
তোমাকে উদ্দেশ করি। পৌরাণিক, তোমাতে জন্মের সারসত্য কথা
হারিয়ে ফেলেছি আমি মাত্র গতকাল।
কোনো উপলক্ষ নেই
................
কোনো উপলক্ষ নেই, কে যেন দুপুরবেলা
ডেকে বলে, ‘ভালো হয়ে যা।’
তবে আমি জ্যোৎস্নাজারিত দেহে
চলে যাব যেখানে-সেখানে।
একদিন শাস্ত্র দেখা দিলে,
দলে দলে লোকজন পালিয়েছে
বিভিন্ন প্রকারে।
সংগত হবে না জেনে এইসব ইতিহাস
এইসব পলায়নকথা, কত কী সিন্দুকে রেখে
চাবি ছুড়ে দিয়েছি জঙ্গলে;
তবুও দুপুরবেলা কেন যে গোপনে এসে
বলে যায় ভালো ভালো কথা!
ধর্মের কাহিনী
..........
একদা বিস্ময়চিহ্ন মুছে ফেলে
ধর্ম চুরি করেছিল যে জন দিবসে,
বিভায় কাতর আমি কোনদিকে
মন বলো তার দেখা পাই?
সেই এক মধ্যযুগে নেচে নেচে বিভিন্ন নগরে,
কাদের সমুদ্র থেকে নিয়ে এলে
মাণিক্যসঞ্চয়?
আর কোনদিকে দেখা দাও, কোনদিকে
নদীবর্তী ঠিকানাসমূহ খুঁজে
পৌঁছে যাও শতধা ধারায়?
এসবই জানার কথা, জেনে যাব
আগামী বছরে।
তবুও জন্মের গল্প শোনা হলো
রাত্রি জেগে জেগে;
জানা গেল, জন্মান্তরিত হয়ে পুনরায়
ফিরে আসে চোর।
তুলসীর মাঠে বসে আমি আরো একবার
সেই গল্পে মোহিত হলাম।
পাতা ও রাজকন্যা
................
গাছের পাতারা, দেখা গেল
মাঝে মাঝে নিজেদের মতো করে ঝরে।
একদিন পাতারা যেই একটু হলুদ হয়েছে কি,
অমনি বিড়াল দৌড়ে তার পুলিপিঠা নিয়ে পালিয়ে গেল অন্ধকারে;
রাজকন্যা তো মরেই ভূত ভয়ে আর বিস্ময়ে!
যে গ্রামে রাজকন্যা থাকে, তার তিন বর্গমাইলের মধ্যে পাতা ঝরে না।
তাই দেখে অন্য দেশের পুত্ররা বিবাহপ্রস্তাব নিয়ে আসে।
রাজকন্যা জানে যে এই সকল প্রস্তাবে কখনোই বিবাহ থাকে না।
শুধু বাগান বানানো দেখে দেখে তার নিয়মিত পুলক সঞ্চার।
এদিকে বিড়াল-অভিমুখী রাজ্যের যাবতীয় ভিক্ষা-উপজীবী,
সংক্ষেপে বর্ণনা করে গ্রামে গ্রামে পাতার মহিমা।
চন্দ্রগ্রহণ
....
রায়বংশ রাজাদের বাড়ি থেকে এক মাইল দূরে থাকে টিবি হসপিটাল।
পক্ষপাত ক্ষয়রোগে তোমাকে ভোগায়- একপক্ষে মরে যাও ধুঁকতে ধুঁকতে, পরপক্ষে রায়বংশ রাজাদের সাদা বাড়িটার মতো, বাড়িটার মারবেল পাথরে ঢাকা সিঁড়িটার মতো দেখা যেতে থাকে তোমাকে আবার। দেশে বড় চোরের প্রকোপ, নচেৎ এই মহামূল্য সিঁড়ি থেকে কোথায় হারিয়ে যাবে ইতালি-টাইলস্? (মধু স্যানিটারি এর ডামি নিয়ে দোকান খুলেছে)
গতকাল, মধুপূর্ণিমার রাতে বিশ শতকের শেষ চন্দ্রগ্রহণ ঘটে গেল।
সারা বাংলাদেশ থেকে এই দৃশ্য দেখা গেল, আর
যারা ছিল জনসাধারণ, তারা যে গরিব, তারা টেলিস্কোপ রাহুকেতু কিছুই জানে না, তাই
খাদ্যগ্রহণ নিয়ে দ্বিধায় কাটিয়ে দিল রাত।
ট্রেন
....
ট্রেন, তার সব চাকা আর পাটাতন
কাঁপাতে কাঁপাতে এই পার হলো মদনমোহন।
ডিগ্রি কলেজের মাঠে রাত্রিবেলা পড়ে আছে হিম।
বাংলা পড়াতেন যিনি, কফিল মাস্টার,
তার দিন তো চলে না, চলে রেলগাড়ি, কুয়াশায়;
জীবনে প্রথম এই কুয়াশায় ট্রেন-চলাচল দেখে
আমি পুলকিত।
তারু বাবুকে নিয়ে লেখা আমার প্রথম কবিতা
............................
তারু বাবু, কিন্তু তিনি লোকসমাজের চোখে তারু বাবু।
কালোমতো ফরসামতো রমণী দেখছেন।
যথাসাধ্য দূরে বসে চোখে রাখছি দৃশ্যগত বেদনার ভার।
হৃদয়ে ধারণ করছি ক্ষণ-দুর্বলতা।
বসন্তকালের কথা। তবু আমি ঢেউ গুনছি।
ঢেউয়ে ঢেউয়ে উঠে আসছে বংশলতা, লালিত্য মাখানো রূপ,
ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পে নদীবর্তী শোক, তাপ, আনন্দ-উদ্ভাস।
বাঁশি বাজে!
যে বাজায় সে তারুবাবু;
তাকে নিয়ে আরো কটি কবিতা লেখার আগে
প্রস্তুতিমূলক এই বাক্যনিচয়ের আমি
স্বয়ং প্রণেতা।
তোমাকে ইঙ্গিতে আমি
.............
তোমাকে ইঙ্গিতে আমি বহুবার
করেছি গোপন
কেন জন্মপ্রকরণ তবু ভুলে গিয়ে
হেমন্তের বিশুষ্ক বাতাসে আমি
অসবর্ণ বিবাহে উন্মুখ?
আমাদের দিনগুলি
এত বেশি আলস্যসূচিত বলে
জলমগ্নতার কথা মনে হয়;
মনে হয়, কোথাও কুণ্ডলী আছে,
জন্মলাভ আছে।
নিতান্ত আগ্রহবশে এই সব প্রতারণা,
গুপ্ত আলোচনাগুলি
গোপন চাবির কাছে জমা রেখে
উপনয়নের দিকে চলে যাব,
দ্বিজত্বপ্রাপ্তির দিকে চলে যাব আমি
কখনো তোমার সঙ্গে দেখা হলে
বইপত্রে, চিকিৎসাবিদ্যায়।
আলস্যবেদনা
..........
একান্ত পুরোনো দিনে ফিরে গিয়ে
বৃক্ষ, তাপ, সালোক-সংশ্লেষ আর মানুষের
অদূরদর্শিতা নিয়ে ভাবি;
তোমাকে বন্ধুর মতো মনে হলো, সেই কথা ভাবি।
অলসতা, বিনীত সূর্যের দিনে
তুমি আসো জাদুমন্ত্রে জাগাতে শরীর।
২.
অনুপ্রেরণার মতো তোমাকে আপন আর
ততোধিক কাম্য বলে মনে হলো সন্ধ্যাগোধূলিতে;
বিগত বাঁশের বনে, শিহরণে,
অঙ্গুলিসংকেত আমি টের পাই
যা শুধু তোমার দিকে বয়ে যাওয়া বোঝাতে সক্ষম।
আমি যে বন্ধুর কথা মনে করি,
সে তার সমস্ত কিছু, ছায়া, উপশম
একান্তে ফিরিয়ে নিয়ে চলে গেছে, দূরে।
রূপমনোহর রাতে, আলো ও আঁধারময়
যে আমি রয়েছি বসে, অলসতা,
তার জন্য দাঁড়াবার অনুমতিপত্র তুমি
জারি করে দাও।
তোমার ইশকুলে আমি ভর্তি হতে এসেছি যখন
...........................
তোমার সকাশে এই দিন, রাত্রির অধিক দীর্ণ
মলিনতাময় গ্রীষ্মকাল।
তুমি বাল্যপ্রেমিকার কথা ভাবো তো এবার;
উনিশ শো তিরাশি সালে যার কথা
একবার ফাঁস হয়েছিল।
এই দেশে বিবিধ সংকট- মুদ্রাবাজারের গতি ক্রমহ্রাসমাণ-
আরো নানা সমস্যা ও
সম্ভাবনা আছে,
তার পরও আমাদের তারল্য-সংকট ঘোচে না তো!
এসব দুর্দশা নিয়ে, তোমার ইশকুলে আমি
ভর্তি হতে এসেছি রে মন।
আমার মফস্বলবাসের ইতিহাস
...................
আমরা যারা কখনো গ্রামে থাকিনি কিংবা গ্রাম বলতেই যাদের মনে ছোট ছোট দৃশ্যময় ছড়াকবিতার স্মৃতিরোচক আবেদনের কথাই ভেসে ওঠে, এই গদ্যে আমি প্রথমেই তাদেরকে সাবধান করে দিতে চাই। আমাদের দেশের হাজারে হাজার গ্রামে হাজারে হাজার বৈচিত্র্যময় কাণ্ড তার ডাল-পাতাসহ বিকশিত হয়ে চলেছে যে কত প্রকারে, কেবল জগদীশ বিজ্ঞানী এই তথ্যটি জানতেন। জানতেন, কিন্তু প্রকাশ করেননি। তাঁর প্রকাশমাত্রই বৈজ্ঞানিক কিংবা নিদেনপক্ষে দার্শনিক, এই কথা এ কালে সাহিত্যচর্চা করতে আসা ভুক্তভোগীরা অবশ্যই জানেন। আর তাঁর সমস্ত অপ্রকাশ আমাদেরকে এক অতি আরামদায়ক ফলফলাদিবৃক্ষসমৃদ্ধ গ্রামভাবনার দিকে পরিচালিত করে এবং যার অস্তিত্বপ্রমাণ নিছক দীর্ঘ আলোচনাসাপেক্ষ।
সে প্রসঙ্গ বাদ। কেননা জগদীশ বিজ্ঞানী সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না।
আমি গ্রাম-সম্পর্কিত আমার তিন পুরুষের অনভিজ্ঞতার কথাই কেবল জানি। তাঁরা ছোট ছোট মফস্বল শহরগুলিতে বসবাস করে এসে কেবল এই ধারণাপ্রাপ্ত হয়েছিলেন যে, শহর হচ্ছে খুব বেশি শহরপ্রবণ আর গ্রাম খুবই গ্রাম্য। তাঁদের ভারসাম্যের নীতি আমরা মানি বা না মানি, মধ্যবর্তীরা সব সময়ই নিরাপদ থেকেছে। আমার মফস্বলবাসের ইতিহাস এ-ই।
২.
গ্রাম সম্পর্কে আমাদের আরো বেশি জানা দরকার। শীতকালের গ্রাম আর গরমকালের গ্রামের মধ্যেকার পার্থক্যগুলি আমার আর কোনো দিনই জানা হয়ে উঠবে না। কেননা পৃথিবীর কোনো গ্রামই এখন আর প্রকৃতপক্ষে গ্রাম হয়ে নেই। যে গ্রামে ফ্যাক্টরিতে তৈরি ম্যাচবাক্স টাকার বিনিময়ে বিক্রি হয় সেই গ্রাম কতখানি গ্রাম?
আমাদের হাজার বছরের আদি ও অকৃত্রিম গ্রামগুলি সামান্য ম্যাচবাক্সের বদৌলতে চারিত্রসংকটের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। এ হলো আফসোসের কথা।
৩.
আমি আপ্লুত হই এই ভেবেচিন্তে যে, শহরের রাস্তায় আর গলিতে গলিতে বিচরণ করে কোথাও বিবৃত হতে পারি নাই। আমার এই সমস্ত ব্যর্থতাকে আমি মহান বলি, কারণ ইতিহাসবিচ্যুতির ফলে লাস্য ও কলহাস্যমুখরিত শহুরে জীবন ভেঙে যাওয়া বৈবাহিক চিহ্নের মতো শরীরে ধারণ করে গুপ্তপথে এইমাত্র ব্যাবিলনের বাইরে এসে দাঁড়িয়েছি।
আমার আর কতটুকু জানা প্রয়োজন?
আমার যেসব সন্ধ্যা
............
আমার যেসব সন্ধ্যা, সায়াহ্নসমূহ
অপস্রিয়মাণ বহু দূরবর্তী সৌরশলাকার ঘাতে
একেবারে পর্যুদস্ত হলো, হয়ে পড়ে থাকল
খুবই পরিচিত এই মাঠে,
আমাদের পূর্বপরিচিত এই রৌদ্রদগ্ধ মাঠে, আর
যে সকল রাত্রিবেলা ক্রমপরম্পরাহীন বাতাস বহন করে
নিয়ে আসলো শীতকালে, গাছের পাতার মতো চুলে
আর অন্ধকারে, ফাঁকে ও ফোকরে,
সেসব সন্ধ্যার কথা সেসব রাত্রির কথা
দুপুরবেলাতে বসে ভাবি।
এ কবিতা লেখা হচ্ছে
..................
[এ কবিতা লেখা হচ্ছে যামিনীতে, মধ্যযামিনীতে।
যেহেতু কবিতা, তাই লেখা হচ্ছে যামিনীতে,
গদ্য হলে রাতের বেলাই হতো উপযুক্ত লেখার সময়।]
একটা সহজ অঙ্কে কাটা পড়ে এ মহাজগৎ।
আহা এ সায়াহ্নে বুঝি মোক্ষ জল,
ফুল-পাতা-ফল।
দেখো, গদ্যকবিতার যুগ ফিরে ফিরে আসে।
ফিরে আসে মধ্যযাম, কবিতা লেখার।
লিখি অঙ্কে ও কথায়, তার পরিণাম
ঘটনাপ্রবাহ; আর
প্রবহনে ভেসে যেতে যেতে ঐ মাথা তুলছে
অঙ্ক-কবিতার
শিরোনাম।
২.
উদাহরণের চেয়ে মিথ্যা বলে
মনে হয় সবকিছু, গদ্যকবিতা।
দিগন্তরেখার পাশে উঁচু উঁচু
তালগাছে সদানন্দ প্রহরী বসানো,
তার ফাঁক ও ফোকর দিয়ে মিটিমিটি
দেখা যাচ্ছে ও মহাজগৎ;
আমি এই পারে বসে উদাহরণের চেয়ে সত্য বলে
নিজেদের প্রতিপন্ন করি।
সত্য নিয়ে আলোচনা
...............
যেকোনো দিনের শেষে, যেকোনো তারিখে
দেখি ফরসা হচ্ছে, ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে
আমাদের অনুবর্তমান।
চিরকাল আমরা যে দেহমনস্কতা নিয়ে জেগে উঠি,
আপন পায়ের চিহ্ন কেন্দ্র করে গোল হয়ে বসি মধ্যরাতে
-তা-ই সত্য।
২.
সত্য নিয়ে যাবতীয় আলোচনা লিখিতই ভালো।
যথা- দক্ষিণায়নের কালে শীত আসে-
ভূগোলে পঠিত এই সত্য কথা
তোমার পুস্তকে নাই।
আমার বন্ধুর নাম সত্যপ্রকাশ ধর- এও যথা।
অযথার্থ বৃষ্টিপাতে আপন বন্ধুর মুখ ভুলে যাচ্ছি- যথা।
৩.
তীব্র চোরাচালানের দিনে, কোনো এক দীর্ঘ বিকালে আমি বসে আছি
তীর ঠেলে উঠে আসা চকচকে বালুসমাগমে,
সীমান্তনদীর।
ওই যুদ্ধে কে ছিল নায়ক?
হিতাকাঙ্ক্ষী বিডিআর ধরে ফেলছে
সমস্ত সংকেত, গুহ্য, চোরাচোখ
চোরাচালানির।
সন্ধ্যাবেলা, তারিণীচরণ
.............
আমাদের তারু বাবু,
বসে থাকে নদীর এ পাড়ে, ভাবে।
‘কী ভাব হে তারু বাবু?’ -প্রশ্ন করি;
‘দেখেন চে, সব নদী মিলায় সাগরে, সব পাখি, চিল,
মুখোমুখি বসিবার সমস্ত প্রস্তুতি আজ তার হাতে।’
আকাশের ওপারে আকাশ ভেবে আমি বলি, ‘তারু বাবু,
সব সত্য প্রকাশ কোরো না।’
আলস্য ও স্বপ্নবিষয়ক বিবেচনা
.....................
চক্ষুনিমীলনে জাগে উদ্দীপনা, বায়ুপ্রভাবিত আর
বৃষ্টিবহনকারী মেঘ উড়ে আসে।
অঘোর বর্ষার দিনে বৃষ্টিকবলিত হয়ে বসে থাকা
আমাদের চূড়ান্ত বিকাশ।
২.
স্বপ্ন, যাকে নৈশকল্পনার সাথে অর্থবিনিময়ে আমি রাজি করিয়েছি।
নৈশকল্পনায় আমি চোর দেখি, সিঁদকাঠি দেখি,
প্রধানত জ্বরের সময়। আর জ্বর হলে
আয়না দেখি না। আয়নার ভিতর দিয়ে একদিন
বহুদূর বিস্তারিত নিকষ বনের মধ্যে ভূত আর
প্রেতের চিৎকার শুধু শোনা যেত;
এখন সেখানে শোনো মধ্যদুপুরের গীতকথা,
এখন সেখানে চোর, সিঁদকাঠি চিকিৎসার মতো এসে
শিয়রে দাঁড়ায়।
তাঁর চিকিৎসাপ্রবণ মন খাতা-কলমের মধ্যে উপনীত
আমাকে বেষ্টন করে আষ্টেপৃষ্ঠে,
জ্বরতপ্ত আমাকে বেষ্টন করে…
এই সব স্বপ্নে, তথা নৈশকল্পনায় ঘটে থাকে।
বৃক্ষ
...
আমাদের সবার মাথায়ই চুল থাকে। যদিও আদিতে আমরা গুচ্ছ খানেক চুলসমেত (বলাবাহুল্য দন্তহীন) ভূমিষ্ঠ হই এবং আমাদের শরীর মৃত প্রোটিন উৎপাদনে কিছুকালের মধ্যেই পারদর্শিতা অর্জন করে। আমরা বিকশিত হই। এটা ঠিক যে, আমাদের চুল সালোক-সংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে না, তথাপি, বৃক্ষশ্রেণীও চুল নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। আর তারা অনর্থক চুলে বিনুনি করে সময় নষ্ট করে না, বরং বায়ুপ্রবাহের কালে দেহের উক্ত অংশটিকে আন্দোলিত করে থাকে। এতে তাদের শরীর আমাদের তুলনায় সমর্থ হয় এই প্রকারে যে, তারা নিজেদের খাদ্য নিজেরাই তৈরি করে নিতে শেখে। বলা বাহুল্য, বৃক্ষশ্রেণীও দন্তহীন।
পতঙ্গ
...
জোনাকি পতঙ্গদেহ আলোবাহী
রেখাময় উপাঙ্গ-সংকুল।
আলোকমথিত হলে
সেই দেহ সূতিকামণ্ডল;
দিকে দিকে ভাসমান
কন্ঠস্বর, চর্বিকণা,
চিরুনিবিমুখ কেশদাম;
হরিণদ্যুতির ছটা তেজোময়
দিকে ও অদিকে।
আমি অদিকের সম্ভাবনা
টের পেয়ে যাই।
ইঙ্গিতে সারিয়ে ক্ষত
কত জীব, কত কত প্রাণ
আরো প্রাণবন্ত করে,
ধুলাতে লুটাই মরদেহ;
দেহ থেকে দেহাত্মবাদের কথা শূন্যে উড়ে যায়।
ভ্রমণ ১
.......
আমাদের সব জমি বর্গা দিয়ে ফিরেছি এখানে;
অভেদ সাধন হবে এমত বিশ্বাসে
যাবতীয় রহস্যপুরাণ আজ
সবিনয়ে নিবেদিত হলো।
লতা গজানোর কাল শুরু হলে জেলায় জেলায়,
জীবাণুজীবন নিয়ে হরিনারায়ণ রায়
কোথায় বসতি?
২.
এই কার্য বিকাশের
মৃদু মৃদু মন্ত্র শোনা যায়
গ্রামে ও অগণ্য নদী, শীতনদী
কুলকুল-ধ্বনি-শরীরের নিচে রেখে দেয়
মদ আর মাছের কঙ্কাল।
ধর্মচারিণীর চুলে ঘাই মেরে,
চুল নিয়ে পালিয়েছে
নাপিতের ছোট দুই ছেলে।
সে চুলের লোভে
সন্ততিবিচ্ছেদ আর
মাৎসর্য-প্রণালী বেয়ে গেয়ে গান
উজানে উজানে।
ভ্রমণ ২
......
যেমন সরল বীজ
জড়ত্বের জ্ঞান মেনে চলে
শুনি তার নিখাদ ভণিতারীতি
তেমনি সরল গুণে মৃত কাঠে
জ্বেলে গেল পত্র-সম্ভাষণ।
তবে এই স্বয়ম্ভর অভ্রপুচ্ছ শিয়রে ধারণ করে
হা’ আমি কেমন করে
মর্তবাসী হই?
ধুলা-পাহাড়ের কাছে যাত্রীবহনের গরু
ধূলিকাভক্ষণ, আর কেন জানি
বহুবর্ণ চোর এসে
তার সাদা চামড়া ছাড়িয়ে নিয়ে
ফেলে গেছে মৃতদেহখানি।
খসে গেছে শৃঙ্গভয়;
তাই বৃক্ষমোচনের দিনে,
কাঠুরিয়া, আহা কাঠুরিয়া,
শৃঙ্গ বিভাজিত করে আজ তবে রসনায়
চিত্তের বিকাশ।
এই বিকাশনা দূরান্তবাসীর কাছে পৌঁছে যাচ্ছে অতি অপলকে।
আমি সংগীতে অসূয়াবোধে
সেই পথে পালিয়ে গিয়েছি।
ভ্রমণ ৩
.....
[ঘুম গেছে যার সমান্তরাল
ধর্মাধর্ম যুক্ত আড়াল
দিচ্ছে যেমন দিচ্ছিল সংবাদ
পাত্রে জাগে সেই মনোবল
ঘোর পাপে যার কণ্ঠ বিকল
কী উপায়ে দিচ্ছিল সংবাদ?]
এই সাড়াশব্দহীন
উল্কাপতনের পাশাপাশি,
অন্ধকার কক্ষ থেকে কত দ্রুত ছুটে যাচ্ছে ঘুম।
‘কে দেবে এমন পুণ্য’- বলে যেই প্রসারিত হাত,
দেখি তার সংখ্যাগণনার মতো বেড়ে ওঠে প্রবাদ বয়স।
তারপর বৃষ্টি ধারাপাত।
ঘুমের বিস্ময় থেকে যতিচিহ্ন
তুলে নিচ্ছ কারা?
সেইহেতু, স্বপ্নমাহাত্মের কাছে
কোনো এক গভীর রাত্রি রেখে
চলে গেছি বিশ্বভ্রমণে।
গৃহ
...
আজ গোত্রবিবাদের বাক্যরীতি
লেগে আছে চতুর্দেয়ালে।
এই বেলা, তপোজীর্ণ অরণ্যভূমির মেয়ে,
কত নদী, কত পুষ্করিণী ছুঁয়ে
ফিরে গেছে কয়লাখনিতে।
তবে যারা ছেলে চুরি করেছিল
নির্ধারিত ভ্রমণের মাসে,
তারা রীতিসিদ্ধ, তাই
বিবাদ পারেনি শিখে নিতে। তবু
যাবতীয় সম্ভাবনা একদিন জ্বলে উঠেছিল এই
সৌরকলামগ্ন পৃথিবীতে।
২.
আরো একদিন যদি পরী-ভাষা শিখে নিয়ে
গৃহমগ্ন হয়ে থাকা যেত!
একদিন কথাকীর্তনের রাতে
......................
এখন জঙ্গলপর্ব; মধ্যমাঠে
হঠাৎ গজিয়ে উঠি একা একা
আগাছাসমেত।
দূরের প্রতিমামুগ্ধ লোকালয় থেকে আসে ঘ্রাণ
আর সেই সূত্রে পল্লীবিমুখতা জেগে ওঠে।
যে সকল ভাগচাষি ভোরবেলা
চাষকর্মে নিয়োজিত হলো,
সন্ধ্যা হলে, যাবতীয় কর্ম রেখে
চলে গেল বাতাসের দিকে।
আহা কী আশ্চর্য দেখো,
সন্ধ্যা হলে পাখিরা ডাকে না।
সন্ধ্যা হলে বাঁশ চুরি করে ফেরে
গ্রামে গ্রামে বিভিন্ন মানুষ।
ভূতেরও প্রশ্রয়লিপ্সা জেগে ওঠে,
একদিন কথাকীর্তনের রাতে
যদি সন্ধ্যা হয়।
যে পথে নিবিষ্ট হয়
................
আর তুমি নদী, প্রতিটি রাত্রির শেষে
কুয়াশা মাখানো মুগ্ধতাকে পেছনে ছড়িয়ে দিয়ে
অম্লধারণায় ফিরে গেছ।
যে পথে নিবিষ্ট হয় প্রথাপার্বণের দিনে
শ্রুতিনিষ্ঠ মন,
একদিন, তোমাকে আমার মধ্যে
প্লাবনসংকেত নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখে
আমি সেই পথ, নদী, জনসম্মুখে হারিয়েছি।
আরো কিছু জল, আরো জাহাজডুবির কথা
জেনে যাওয়া বড় বেশি প্রয়োজন ছিল।
লগবুক ১
...........
১.
দেখা যাচ্ছে, কোনোরূপ প্রচেষ্টা ছাড়াই জীবনধারণ করা সমীচীন। কিছু আগাছা-কুগাছা ঘেঁটে আমাদের চিকিৎসাবিজ্ঞান এই গোপন রিপোর্ট এনে দিল। মেডিকেল কলেজগুলিতে কীরকম লেখাপড়া হয়, এ ব্যাপারে ছাত্ররাই বলতে পারবেন, কারণ তাদের জন্য সরকারি বরাদ্দ রয়েছে। খানাতল্লাশি থেকে নিজে রেহাই পেলেও কোমরে দড়ি বেঁধে আমাকেই নিয়ে যাচ্ছে সশস্ত্র বাহিনী- এই স্বপ্ন কেন দেখো ভাই? আমি ভদ্রলোক, যেকোনো স্বপ্নেই আমি ভয় পেয়ে পলায়ন করি। কোমরে খাগড়াই বেঁধে নিয়ে যাবে, তোমার বারান্দা থেকে এই দৃশ্য দেখা যাবে; জানি শূন্যে উড়ে গেলে মন আরো কিছু বাকি পড়ে থাকে, তবে তোমার সম্মানে আমি একটি পালকমাত্র রেখে যাব। তবু যদি কখনো আগ্রহ জন্মে পৌরাণিক বিষয়-আশয়ে!
২.
কীভাবে মনুষ্যজাতি সভ্য হলো এ সভার এটা হোক আলোচ্য বিষয়;
কেননা দেখাই যাচ্ছে লেজ নেই, মাছিদেরও নেই- এসব বিষয় নিয়ে কিছুক্ষণ গল্প করুন মহোদয়!
৩.
এবারে প্রেমের কথা বলি। জলে না ডোবাল তারে না ডোবাল কুলের কালিমা। মহত্তম ব্যক্তিদের সৃজনশীলতা নিয়ে ভাবনা হয় প্রতি সন্ধ্যাবেলা- তবু, কবিতা লেখার জন্য কাগজের নিত্য প্রয়োজন।
৪.
আমাদের মধ্যে যার বয়স একটু বেশি, তিনি বিবাহিত। তাই শ্রদ্ধা-অবনত হয়ে তাঁর কথা আলোচনা করি। বিগত শীতের কথা, অগ্নিমান্দ্য, কলেরা কীভাবে গত শতকের প্রাণসংহার করেছিল, এবং নিদ্রার কথা; নিদ্রাযাপনের মতো ভালো কাজ আছে পৃথিবীতে?
৫.
প্রতিদিন অবিশ্বাস করি। এই যে জীবিত আছি তিন বেলা, খাদ্য খাই, ডিম খাই- সে তোমারই ব্যবস্থাপনায়। চর্বির ভেতরে থাকে হৃদরোগ; দয়াময়, কেন তবু একে তুমি সিদ্ধ করেছিলে?
৬.
আমার বন্ধুকে আমি দেখতে যাব কাল;
তার স্বামী ইঞ্জিনিয়ার, তার দুটি ফুটফুটে শিশু,
যমজ সন্তান।
তোমার পুরোনো বন্ধু
................
তোমার পুরোনো বন্ধু প্রাচীন শ্যাওলায় ঢাকা দেয়ালে
বিদ্যুচ্ছবির মতো দেখা দিয়ে পুনরায় আরো কত
অস্তিময় শৈবালচিত্রের মধ্যে ডুবে গেল।
তাকে দেখে নিয়ে তুমি
দুপুরের খরদাহ ব্যর্থ করে চলে যাচ্ছ,
যেখানে যাবার কথা ছিল।
একটি ডাকঘর আজ পথে পড়ে;
তার দিকে কিছুমাত্র দৃষ্টিক্ষেপণ করে পুনঃগমনের দিকে,
সুতরাং, পৃথিবী বেদনাময়- এই বাক্য প্রমাণিত হলো।
দূরত্বের কথা তুমি ভাব।
বিভিন্ন হাওয়ার মধ্যে যান-চলাচল
খুবই দুরূহ ব্যাপার বলে মনে হয়।
তবু চৈতন্যদেবের মন্ত্রে নয়দিকে ভেসে উঠছে
তোমার বন্ধুর স্মৃতিকথা।
একটি দিকের কথা গোপনে রাখাই বুঝি ভালো;
যেন সবকিছু প্রকাশিত হলে
যেন পরিণত মানুষের দেহাবয়ব নিয়ে
গৃহমুখে চলে যেতে হবে।
যে দেবতা মদ ভরে দিয়েছিল নারীদেহে,
তাঁর কথা এইমাত্র পৌরাণিক অভিধানে পাই;
তাঁর কথা সকলে জানে না শুনে
তৃতীয় বারের মতো অবিন্যস্ত হয়েছিলে
তুমি একদিন।
ভ্রমণ বিষয়ে আরো একটি কবিতা
........................
চৈত্রকুল, এই নামে তোমাকে ডাকছি
যাব অন্নদানগর,
আজ সারা দিন গত বছরের মতো বৃষ্টি হোক
তাতে কোনো অসুবিধা নাই।
যাব অন্নদানগর, যদি টিকিট চেকার এসে মাঝপথে নামিয়ে না দেয়।
২.
ভবানী জংশন!
রাত তিনটায় আমি ভবানী জংশন দেখে ঘুমিয়েছি
তবে কোনো স্বপ্ন দেখিনি। তবে তার জন্য মন আমি
সদাই খারাপ করে রাখি।
এই মন-খারাপের মধ্যে জাগে টান, বাস ভ্রমণের স্মৃতি-
যাকে পদার্থবিদ্যায় ফেলে পুনরায় বিবেচনা করা যেতে পারে।
৩.
রসায়নে প্রভূত আনন্দ তুমি পাও;
বলো তো আমার এই দেহসদাশয় কোন জৈবঘটিত ফলাফল?
বেঁকে যাওয়া মেরুদণ্ড, দন্তবিকাশনা- এ সবই উল্লেখযোগ্য
বলে মনে করি;
কবিতায় এসব উল্লেখ করা সাধুতা ও কিঞ্চিৎ নৈতিক বলে মনে করি।
কারণ ভ্রমণ নিয়ে এর বেশি কথা বলা ধর্মে নিষেধ।
কম্যুনিটি সেন্টারে, বিবাহসন্ধ্যায়
..................
সকলের মনের মধ্যে ‘যাত্রা’ শব্দটি ধ্বনি তোলে। ‘দূরের যাত্রায়’- এই শব্দসমষ্টিও অতিথিসকলের মনের মধ্যে গুঞ্জরিত হয়। কিন্তু আমি জানি, কোন জাতীয় টানাপোড়েন মানুষকে তার আদিধর্মে স্থিত রাখতে বদ্ধপরিকর। সকালবেলার সিদ্ধান্ত খুব মজবুত আর সহনশীল নয়। মাঝে মাঝে খাদ্যরুচি, পোশাকচেতনা আর হৃদয়দৌর্বল্য তার গোড়া ধরে নাড়াচাড়া দেয়। তাকে হীনম্মন্য করে।
তাই, বরপক্ষের জন্য নির্ধারিত খাবারঘরটির দরজায় দাঁড়িয়ে তারু বাবু কেবল তৃষ্ণাদেবীর কথাই ভাবছেন, কোমল পানীয় সহযোগে। তাঁর চোখেমুখে গভীর প্রত্যয়। কারণ ‘তৃষ্ণা নিবারিত হলো’ শিরোনামে যে কবিতা তিনি প্রায়শ লিখে থাকেন, তার প্রথম বাক্যেই আছে- দুর্ঘটনা।
এখন কম্যুনিটি সেন্টারের বাইরে সন্ধ্যা নামছে। কাকপক্ষীও ঘরে ফিরে যাচ্ছে। আর শব্দদূষণের মধ্যে থেকে সন্তর্পণে উঠে আসছে বার্তাবাহকেরা।
দেখো, কোমল পানীয় সহযোগে দেখো বর এল কি না।
মেঘ ও বৃষ্টির কথা
................
যত দূর দৃষ্টি দিলে মেঘ ও বৃষ্টির কথা
বিষয়ভাবনা হয়ে ওঠে,
তারও চেয়ে দূরে কোনো ডাকপিয়নের কথা মনে করো।
নৈশ বিদ্যালয়ে আর তুমি যে সায়াহ্নে থাক
সেইখানে এইমতো বৃষ্টিপাত ঘটে।
ঘটে যাওয়া এসব বৃষ্টির মধ্যে
‘পরার্থপরতা’, ‘রূপ’ প্রভৃতি শব্দের অর্থে
ধীরে ধীরে নানা অর্থ প্রতিভাত হয়, ধ্বনিগত ভেদাভেদও ঘটে।
এসব ধ্বনির মধ্যে আরো কত
প্রকরণ, সিদ্ধ-ব্যাকরণ এসে লুকিয়েছে
একে একে তা-ও তুমি লিখে রাখছ নোটবুকে,
মুষলধারায়।
রিটার্ন লেটার অফিস
.............
চিঠিপত্র সব সময় ঠিকানায় উল্লিখিত প্রাপকের উদ্দেশে নির্ধারিত ডাকমাশুল প্রদানসাপেক্ষে প্রেরিত। কিন্তু যেসব চিঠির প্রাপক নিরুদ্দেশ কিংবা বনবাসী, তাঁদের কথা সব সময় চিন্তা করেন এরকম একজন সুহৃদ সরকারি বিধিমোতাবেক নিয়োগপ্রাপ্ত হন। প্রতিটি খামবন্দি চিঠি আমাদের নিকট রহস্যবিষয়ক অমীমাংসা আরো অধিক জাগিয়ে তোলে। একজন বেতনভোগী ডাক-কর্মচারীর মনে এরূপ রহস্যের অনুভূতি দীর্ঘ চাকরিজীবনের একঘেয়ে কর্মপরিকল্পনার ছত্রচ্ছায়ায় তীব্র হয়ে উঠতে কখনোই পারে না। তবে একজন সুহৃদ আমাদের পক্ষে ঈর্ষণীয় একটি পদে অধিষ্ঠিত থেকে পত্রলেখকদের মৌলিক চিন্তাভাবনা ও জ্ঞান গভীর মনঃসংযোগে অধ্যয়ন করেন। শোকপত্রগুলি আনন্দপত্রসমূহের বিপরীতে শর্টিং করা হয় কি না- শুধুমাত্র এটি ছাড়া আর কোনো বিষয়ে কৌতূহল প্রকাশ করবার অনুমতি কর্তৃপক্ষ কাউকে প্রদান করেন না। কঠোর গোপনীয়তার মাধ্যমে চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত বেওয়ারিশ দর্শনপত্রগুলি তাই ভষ্মীভূত করে ফেলা হয়।
ইতিহাস
......
ইতিহাসের ক্রমপরম্পরা বিঘ্নিত হয় মূলত মানুষের, রাজাদের দায়িত্বজ্ঞান ও সময়নিষ্ঠার অভাবহেতু। কারণ, পূর্বনির্ধারিত ঘটনা সংঘটনের কালে তাঁরা যথাযথ প্রতিক্রিয়া দেখাতে ব্যর্থ হন। আমাদের ইতিহাসবেত্তাগণ তাঁদের নিজ নিজ দেহমধ্যস্থ প্রবাহিত রক্তধারাকে পানি করে (পুনরায় সেই পানিকে রক্তে পরিণত করে) হারানো সূত্রগুলি উদ্ধারে তৎপর হন। যেহেতু ইতিহাসের মধ্যে সত্যের কিঞ্চিৎমাত্র অপলাপ সহ্য করা হয় না, তাই সংগত কারণে মহামতি আকবরের ছেলেবেলাকার ব্যক্তিত্ববিষয়ক চিন্তাভাবনাগুলি ইতিহাসের কোনো ক্লাসের বইয়েই স্থান পায়নি। এ বিষয়ে এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া ইতিহাসের মেধাবী ছাত্র জনাব আবুল ফজলও তাঁর জ্ঞানের স্বল্পতা আমাদের কাছে স্বীকার করেছেন, লজ্জাসহকারে।
শোয়া, বসা, দাঁড়ানো
...............
সরল কথোপকথনের মধ্যেও বিবিধ জটিলতা বিদ্যমান। কখনো কখনো সম্বোধনের ক্ষেত্রে যে বিস্ময়বোধক চিহ্নটি লেখ্যরীতিতে ব্যবহৃত হয়, সেই চিহ্নের মতো করে উদ্দিষ্ট মানুষটিকে চিন্তা করা সকলের পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না। শোয়া বসা ও দাঁড়ানো- মানুষের এই তিনটি অবস্থানকে একটিমাত্র চিহ্নে প্রকাশ করা নীতিবহির্ভূত ও অসম্ভব। স্বতঃসিদ্ধ এই যে, কেবলমাত্র দণ্ডায়মান ব্যক্তিটিকে তার পরিপার্শ্ব সম্পর্কে সচেতন করা সমীচীন নয়। কেননা গ্রামবাংলায় জীব ও জড়সকল অনুভূমিক- জীবনযাত্রা ও চিন্তাভাবনায় এই মতের প্রাধান্য ও সত্যতা লক্ষ্য করা যায়। সমাজজীবনে, পারিবারিক এমনকি ব্যক্তিগত জীবনেও মানুষ ত্রিবিধ বিঘ্ন অতিক্রম করে চলতে পারে না। সৃষ্টির শুরু থেকে মানুষ মূলত এই তিন শ্রেণীতে বিভক্ত হয়ে আছে।
ভালো ও মন্দ
..........
ভালো ও মন্দ- এই দুই ধরনের চেতনা বিদ্যমান। নীতিবাক্যগুলি যে সকল সময় ব্যাকরণ মেনে চলে না, তা লক্ষণীয়। এই বিষয়ে গ্রাম্য পণ্ডিত তাঁর বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া উনিশ শতকীয় টোল স্মরণ করে যে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন, তার উত্তাপ আমরা বহু বছর পরেও টের পেতে থাকব। তবে আমাদের কিছুতেই মনে পড়বে না যে, ত্রেতাযুগের আধিপত্যবাদ বিষয়টি নিয়ে কারো কোনো থিসিস লিখবার প্রয়োজন হয়েছিল কি না। এখন, বর্তমানে, সকল বিষয়ই মূর্ত- এই কথা তুমি আমি কেউই নিশ্চিত করে বলতে পারি না। অমূর্ত বিষয়ের প্রতি, তার অন্তর্গত রহস্যের প্রবল প্রতিপত্তির প্রতি কবিদের লোভ চিরন্তন। এই লোভের বশবর্তী হয়ে কবিতা লিখে কবিরা খ্যাতি অর্জন করেন।
বৃষ্টি
...
বসে আছি প্রাথমিক বৃষ্টি-ব্যাকুলতা থেকে
অংশত বিচ্ছিন্ন হয়ে রাত্রিবেলা, একা।
অন্ধকার তরঙ্গিত করে দিয়ে কোনো শব্দ নাই,
আন্তনগর ট্রেন ফেল করা গন্তব্যরহিত যাত্রীসকলের আর্তনাদ ছাড়া।
২.
ইশকুল পালানো খুদে ছাত্রটির মনে আজ মেঘবৃষ্টি;
আসন্ন কাদায় মাখা দেহ নিয়ে প্রত্যাবর্তনের কথা ভাবা তো যাবে না।
ভিজে যাওয়া বইপত্রে শিক্ষকপ্রদত্ত যত নির্দেশনা, গুরুবাক্যসমুচ্চয়
রসসিক্ত হয়ে যাচ্ছে ক্রমে।
৩.
অসুস্থতা উঠে আসে গোপন শক্তির মতো
অগোচরে, ভিন্ন পরিচয়ে;
তবে তার বারিপতনের নাম কেলাসন, অদ্রবীভবন।
৪.
কহতব্য যা কিছু তোমার কাছে,
একটি সুরেই নিবেদিত
তোমারই প্রেষণে গীত কোমল নিষাদ।
আয়না
....
১.
আমি জাদুকার্পেটের কথা, চোরাগোপ্তা খুন আর
সফল শিকার নিয়ে লেখা গল্প তোমাকে জানিয়ে যেতে চাই,
আর ব্যাকরণে নিপাতনে সিদ্ধ বলে কথা আছে-
সেই কথা তোমাকেই বলা প্রয়োজন।
২.
কেন পাশের বাড়িতে কেন মাঝরাতে আলো জ্বলে ওঠে?
আর প্রত্যেকটি বিদায়পর্ব ভোরবেলা অনুষ্ঠিত হয়?
আর সন্ধ্যাবেলা অন্ধকার হয়ে আসে সূর্য ডুবে গেলে?
এরকম জন্মসফলতা নিয়ে কেটে যাচ্ছে খ্রিষ্টীয় শতক।
৩.
জন্ম বিষয়ে আমি আরো কিছু কথা বলি শোনো-
তোমাকে সংশয়বাদী বলে মনে হয়, মনে হয় আয়না তোমাকে।
মহাবরিষন
.............
বর্ষাবিগলিত হয়ে দেখো চেয়ে
নদীর বিস্তার;
ব্রিজের ওপর থেকে
ফুলে ওঠা, দুলে দুলে ওঠা;
প্রথম সাক্ষাতে দেখো ভিজে যাওয়া,
কাকে বলে মহাবরিষন।
তুমি তারও চেয়ে বেশি ভেজা
কৃষ্ণাঙ্গ শিবিরে বসে ধ্যান করো মন,
করো কাকুতি মিনতি তুমি ‘এই ভিজে
মেঘের দুপুরে’।
২.
পথিপার্শ্ব এলোমেলো করে দিয়ে
বৃষ্টিবাতাসের তোড়ে ভেসে যাচ্ছে
একমাত্র চিঠি;
চিঠির প্রাপক জানে কাকে বলে মহাবরিষন।
গার্হস্থ্য
......
এখনো নিজের মধ্যে, পূর্বতন অভিনিবেশের মধ্যে,
নিম্নস্বর, সমস্ত সংবাদ, স্মৃতি, বিশ্বকোষ পার হয়ে
চলে যেতে চাই।
ক্রমান্বয়ে ঋতুবিভ্রাটের দিনে, শীতোষ্ণ পৃথিবীপথে দেখা হলে
চকিতে সম্ভব হবে স্বগৃহপ্রবেশ।
তোমাকে দুর্বল আর
চৈতন্যরহিত ভেবে কাজে নামি।
যদিও নিজের মধ্যে প্রবেশের পথ করে নিতে নিতে
বার্তাসূচকের কাঁটা কেঁপে ওঠে, দেখায় মধ্যাহ্নস্বর, জলদগম্ভীর।
তারবার্তা
...........
তুমিও তো রচয়িতা, তারবার্তা,
তুমিও নিবন্ধকার।
গোপন সংকেতে, চিহ্নে ভরে তোলো আমাদের
বর্ণপরিচয়।
২.
অতটা বছর আগে, গ্রামান্তরে
প্রথম টক্কায়
সকলের মুখে মুখে
দূরবর্তী স্বজনের শোক আর
আনন্দ-উদ্ভাস।
৩.
দূরের সম্পর্কসূত্রে বন্ধুপরিজন
নিভে যাওয়া আলো নিয়ে দেখা দিল
সতেরো পৃষ্ঠায়।
৪.
লিখেছি সরল বাক্যে নদীবর্তিনীর নাম
নদী তবু প্রবাহিত হয়।
লগবুক ২
........
সররাচর আয়নায় আমরা যে প্রতিবিম্ব দেখি তা অসদ্- এ কথা বিজ্ঞানমাত্র স্বীকার করে থাকে। একজন অন্যমনস্ক পাঠক তার ব্যাকরণজনিত জ্ঞানে আস্থাশীল থেকেও ভুল বাক্যে চিন্তা করে বসতে পারেন। তার এই চিন্তা তথা জ্ঞানপ্রকরণকে যথাযোগ্য মর্যাদা প্রদান করেন কেবল কবি। কবিরা জানে, একদা গর্জনশীল চল্লিশা বলে এক ভয়ঙ্কর সমুদ্রসংঘাত এসে উপস্থিত হয়েছিল পালতোলা জাহাজের সামনে। জাহাজের কাপ্তান আর তার অনুসারী নাবিকবৃন্দ ভয়বিহ্বলতা কাটিয়ে উঠে কীভাবে আবার সেই জাহাজকে শান্ত সমুদ্রের দিকে ধাবিত করেছিল, তা-ও আজ ইতিহাসের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে। তাদের শরীরে লবণাক্ত বাতাসের স্পর্শে জেগে উঠেছিল দেড় হাজার বছরের ক্রন্দন আর হতাশ্বাস। আর তারও মধ্যে থেকে অনুসন্ধানের দায়, আবিষ্কৃতি, যদিও বা পাঠকের এ বিষয়ে তৎপরতা লক্ষণীয় নয়, হঠাৎ সামনে এসে আমাদের ব্যতিব্যস্ত করে। আমরা নাবিকবৃন্দ, আবারও আয়নার সামনে প্রতিবিম্বটির দিকে তাক করে আমাদের সমস্ত কম্পাস নিয়ে বসি।
কোনো দিকনির্দেশনা, পাল তোলা,
বহু পূর্ব-পশ্চিমের এই বিশ্বে ঘটে যায় যদি!
যাত্রা
...
[প্রথমত, যাত্রার কথাই মনে আসে। যাত্রাই প্রকাশযোগ্য গমনশীলতা]
নিষ্কৃতির জমাট পাহাড়ে দৃষ্ট, রুক্ষতর মাথার উপরে চাঁদ ঢেকে যাচ্ছে
সাদা-কালো মেঘে। দূর থেকে ভালো বোঝা যাচ্ছে না শরীর নিয়ে
একটু একটু বোঝা যাচ্ছে এ রকম অবস্থানে দাঁড়াচ্ছে সবাই।
তাদের সাক্ষী রেখে যে-কেউ বিশ্বাস করবে এরকম মতবাদ
আজ আমি পেশ করতে চাই।
সর্বজনাব, এই মধ্যমাঠে, কুয়াশায় শ্বাস নিতে নিতে
আমাদের সকলেরই ক্ষুণ্ন্নিবৃত্তির কথা মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে
চাঁদ বুঝি অসময়ে উদিত হলেন।
আমাদের কথা তাঁর মনে ছিল। মনে ছিল
কার্তিক মেঘের মধ্যে ডুবে যাচ্ছে এই তথ্য, মেঘের সুষমা।
জমাট পাহাড়ে দৃষ্ট, রুক্ষতর মাথার ওপরে চাঁদ ঢেকে যাচ্ছে
সাদা-কালো মেঘে আর ক্ষুধা নিয়ে আমাদের
নিরন্ন কবির দল যাত্রা সবে শুরু করেছেন।
তাঁদের যাত্রায় আমি বিবেকের পার্ট নিতে বহুক্ষণ
ভোলা মন ভোলা মন বলে গলা সাধি।
এবে, যাত্রা হলো শুরু।
গ্রামের সমীপে
.........
এখন গ্রামের মধ্যে বসে থাকা অনেক সহজ
যে নদীর তীর ধরে হেঁটে যাচ্ছে গুণধর মাঝি
ঘুম আর প্রকৃতিজগৎ নিয়ে এখনো যাদের চিন্তা মনোহর
সেই নদী, সেই উপজগতের মধ্যে খুঁজে নিচ্ছি
প্রকৃত প্রস্তাব।
হোক রাত্রি, গ্রামের রাস্তায় যদি দেখা দিচ্ছে বিকলিত মন-
যা শুধু তোমার সঙ্গে বোঝাপড়া হবে না বলেই
বাঁধে শিশুশিক্ষা খুলে বসে থাকি।
২.
পৃথিবীর ধ্যানধারণার চেয়ে শিক্ষকতা ভালো।
ততোধিক ভালো এই বেচাকেনা, পাপক্ষালনের রীতি, পরহস্ত ধন।
তোমার বিক্রয়মূল্যে ভর করে আছে বিস্মরণ;
বিকালবেলার আলো, মুদ্রাবিনিময় আর প্রচারণা
তোমারই দোকান।
পণ্যভারাক্রান্ত হয়ে অধীর আগ্রহে এই চেয়ে থাকা তুলনারহিত।
জীবনযাপন
.........
ধর্ম নিয়ে আমাদের চিন্তা ছিল। চিন্তা ছিল কীভাবে প্রথম ছত্রে
রোদ বৃষ্টি সবকিছু আসে।
আমাদের চিন্তাপ্রণালী নিয়ে আপনি যে বিদ্রূপবাক্য, উপদ্রব এইসব পাঠিয়েছিলেন
তার সবকিছু ভাবাচ্ছে এমত।
‘সেহেতু জীবন নিয়ে কী করিব’- উত্তর প্রসঙ্গে কোনো প্রস্তাবনা নাই।
ধর্মগত প্রাণ নিয়ে রেললাইনের পাশে বসে আছি।
ট্রেন যায়, মালগাড়ি, দেখি।
আমরা দেখনদার। চিন্তা করে অন্য কোনো জন ।
মধ্যরাতে, নিদ্রাযাপনের কালে সেই চিন্তাবিদ এসে কীভাবে তাকায়!
উপজীবকের মতো কিছুটা সংকীর্ণ হয়ে, উবু হয়ে গভীর খাদের দিকে তাকাচ্ছ তাকাও,
তবে লম্ফ দিয়ো না।
বাংলা কবিতার সম্ভাবনা
....................
বিগত পথের পাশে পড়ে থাকা
পাথরের লোভ আমি ত্যাগ করতে
পারিনি মহেশ।
(এখানে মহেশ কোনো ব্যক্তি নয়, শিব)
এখনো ঘুমের মধ্যে শব্দ তুলে
অতিকায় রেলগাড়ি গন্তব্যে পৌঁছায়। তার
বহুবিধ যন্ত্র আর যন্ত্রণার
সাফল্যে নিহিত শেষ হাসিটাই
প্রণিধানযোগ্য বলে মানি।
এখনো ঘুমের মধ্যে নেশা হয়,
রাজনীতি নিয়ে ভাবি।
সম্ভাবনা এখনো রয়েছে তবে বাংলা কবিতার!
বর্ষার রাজনীতি
...........
গভীর সংকট থেকে উত্তরণে ব্যস্ত আছে
গদ্যরচয়িতা।
এই ফাঁকে পালাচ্ছি হে শব্দ থেকে,
উৎপন্ন ধোঁয়ার কালো কুণ্ডলীর বাঁচামরা থেকে।
অন্যতর অভিনিবেশের দিকে
আমাদের আচমকা প্রস্থান তুমি
কলহাস্যসহযোগে আরো বেশি
বর্ষণসম্মত করে গড়ে তোলো,
আমাদের সম্মিলিত পতনের এমত উচ্ছ্বাস, প্রীতিভাজনেষু,
ততোধিক বরষামণ্ডিত করে দিয়ে চলে যাও।
প্রেম
......
গ্রহণেরও আগে ঘটে সম্প্রদান। রাত্রি গভীর হয়।
নৈশপ্রহরীর চোখ ক্লান্তি আর ঘুমে আরো ঘোলা হয়।
তথাপি রাতের দৃশ্যে তাকে দেখে উৎফুল্ল হলাম।
স্বপ্ন থেকে এইমাত্র পালিয়েছে যে সাফল্য,
দুর্বলতা নামে কোনো তস্করের পিছনে পিছনে, তাকে
পুনরায় অর্ধসমাপ্ত স্বপ্নে ফিরিয়ে আনার জন্য
আবার ঘুমাতে চাই, প্রভু।
২.
রাত্রিজাগরণ তবু সম্ভব হবে না, কেন
বইপত্রে মনঃসংযোগহেতু তোমার কথাই শুধু,
ঘুরেফিরে মনে জাগছে দু-একটি বুদ্বুদ।
৩.
শিখা সমাদ্দার তার বাক্স গুটিয়ে নিয়ে চলে গেছে,
যে দিন বিগত তার পিছে পিছে, সম্মেলনকেন্দ্র থেকে
ততোধিক পিছে পিছে চলে গেছে
রাষ্ট্রপ্রধানের গাড়ি, পতাকা হারিয়ে।
সমস্ত শনাক্তচিহ্ন, উপহাস
.....................
আসঙ্গলিপ্সায় আমি
সমুদ্রের কাছাকাছি এসেছি এবার।
সন্ধ্যাকে রাত্রির মধ্যে সমর্পিত হতে দেখে
বহু বছরের প্রথা ব্যর্থ হলো, ব্যর্থ হলো
জেনারেটরের আলো, বৈদ্যুতিক পাখার দ্যোতনা।
এই সূর্যাস্তকালীন মন, মনোবিকলন আমি
অবরুদ্ধ করে দিয়ে উপবাগানের দিকে
আপাতত ফিরে যেতে মনস্থ করেছি।
ঢেউ এসে মালিন্য হরণ করে নিয়ে যায়
কোনো এক রৌদ্রকরোজ্জ্বলতার নিচে, শিশুবাগানের
পাশে তার প্রেম ব্যর্থ করে প্রাপ্তবয়সের
হাসি ছড়িয়ে দিয়েছি পথে পথে।
তাকে মনে পড়ে কি পড়ে না- এই দ্বিধাকল্পে
গত জীবনের সব হাসি-কান্না লীন হয়ে আছে।
ঢেউ তার সমস্ত শনাক্তচিহ্ন, উপহাস দ্রবীভূত করে দিয়ে
ফিরে যাচ্ছে এক সম্ভাবনা থেকে
অন্য কোনো রশ্মিবাগানের দিকে, দ্রুত।
ট্রেন
...
নিয়ে যাচ্ছে রাত্রির ভিতর দিয়ে
ততোধিক গ্রামের সমীপে এই ট্রেন।
উপগ্রহের ছায়া যতটুকু পাওয়া যাচ্ছে- নদীতে, ব্রিজের নিচে- ততটুকু-
রেলগাড়ি তত অন্ধকার দীর্ণ করে দিয়ে
আমার গরিমাসহ ছড়াচ্ছে এ দেশে,
এই গ্রামের সমীপে।
২.
রেললাইনের থেকে ঠিকরে ওঠা চাঁদের কলঙ্ক নাই,
শুধু তার রেলপ্রবাহের সঙ্গে
শব্দহীন প্রতিযোগিতার মতো ছুটে যাওয়া আছে।
অপ্রকৃত গতির রহস্য থেকে মুক্ত হয়ে
প্রকৃত বস্তুর দিকে এইরূপ দিগ্ভ্রান্তি
অনুভব করি।
সম্পর্ক
.....
১.
সকল বাক্যই থাকে অন্তরালে,
তোমাদের সমস্ত গরল।
তবু শান্তি পাই এই মনোভূমিকার কথা চিন্তা করে
একা, সন্ধ্যাবেলা।
পৃথিবীর সকল বিবাহ আজ হয়ে গেছে,
নির্বাপিত সমস্ত সংশয়, তবু
একটি সকাল আর পুনর্জন্ম বিষয়ের
গল্পগাছাগুলি তুমি
এখনো বয়ন করো দেখে ভালো লাগে।
২.
পুরাতন ফ্রিজবি খেলার মাঠে
আমাদের হতে পারত পুনরায় দেখা।
ডুমুরগাছের ডালে, পাতা ও ফলের বাঁকে
তোমাদের হাস্যকাতরতা ফুটে ওঠে;
বিবাহিত মেয়েদের হাসি আর
মনস্কামনা জেনে বড় হই,
প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে উঠি সন্ধ্যাবেলা।
৩.
এবারে নদীর গল্প শেষ হবে।
ছলাৎকার বন্ধ করে দিয়ে যাব
সর্বোপরি তোমার বাগানে;
ঘাসলতাপাতামুগ্ধ চোখে আমি
তাকাব তোমার অভিযোজনার দিকে।
সাইরেন
বাজাতে বাজতে যাবে অ্যাম্বুলেন্স,
‘আমাকে কোথায় নিয়ে যাবে ওরা?
কোথায় রক্ত নেবে?’-
আজন্ম প্রদাহ নিয়ে, মরা নদীটির তীরে
তোমার বিস্তৃত বালুসমাগমে বসে আমি
এই কথা ভাবি।
৪.
এই চোখ, এর কোনো উপযোগ নেই,
জগতের নারীপুরুষের দিকে অবিশ্বাসে
চেয়ে থাকা ছাড়া।
নিজের ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধে নামি।
প্রতি বসন্তের শেষে আমার নিজস্ব ছায়া
আমাকেই পরিত্যাগ করে!
আমাদের মনস্তত্ত্ব যৌথ ভাবাবেগ
আমাদের রক্তমাংস হলুদ কঙ্কাল, সব
সবকিছু সামান্য কথায় কত সহজেই
দীর্ণ হয়ে যায়।
সামান্য কথায় আর অসামান্য গ্রীষ্মকালে
ছায়া কি স্মৃতির সঙ্গে দ্বৈরথে নামি;
সমস্ত বিভ্রম, সুরসংগতির সংগত বাসনা, সব
সবকিছু কত বেশি সারল্যমথিত!
৫.
বস্তুপৃথিবীর আলো ক্ষীণ হয়ে আসে-
মৃত্যু, ঘাম, চর্বিতচর্বণ।
কে আমাকে নিয়ে যাচ্ছে?
কে আমাকে ধরে রাখছে,
আবার ফিরিয়ে দিয়ে যাচ্ছে রে তোতা পাখি,
যাচ্ছে ধনেশ?
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন