সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম
আফসারের গল্পটা কোনো কাঁঠাল বিশেষজ্ঞকে শোনাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ভাই, জগতে কাঁঠালবিশেষজ্ঞ বিরল। আমার বিশ্ববিদ্যালয়েও কোনো কাঁঠালবিশেষজ্ঞ নেই। অবাক, এত বড় বিশ্ববিদ্যালয়! এত কাঁঠাল গাছ এর ক্যাম্পাসে! উদ্ভিদ বিজ্ঞানের ডঃ মনিরুল আলম হর্টিকালচার বিষয়ে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন। তাকে কাঁঠাল নিয়ে প্রশ্ন করতে বললেন, ‘দুঃখিত, প্রফেসর সাহেব। আমি ডুরিয়ান সম্পর্কে যতটা জানি, কাঁঠাল সম্পর্কে ততটা না। ডুরিয়ান কাঁঠালের থাই সংস্করণ, যদি জানতে চান।’
তারপর আমার আগ্রহটাও পথ হারিয়েছিল, যদিও আফসারের গল্পটা কখনো মাথা থেকে যায়নি। অনেক দিন পর প্রথম আলোতে কাঁঠালের ওপর মৃত্যুঞ্জয় রায়ের লেখাটা পড়ে পুরনো আগ্রহটা আবার ঘুরে ফিরে পথে এসেছে। ভাবছি, তাকেই আফসারের গল্পটা বলি। কিন্তু মুশকিল, মৃত্যুঞ্জয়কে আমি চিনি না। তাছাড়া আফসারেরও খবর নেই দশ বছর হল। মৃত্যুঞ্জয়ের বয়স কত, তাও জানিনা − আন্দাজ করি আফসারের ধারে কাছে হবে। এরকমটা হলে আমি খুশি হব। খুঁজে পেতে আফসারকে ধরে বলব, ‘মৃত্যুঞ্জয়কে তোমার গল্পটা বল। যে সমাধান আমি দিতে পারিনি, সেটি সে দিতে পারবে।’
তাছাড়া, আফসার একথাটা না বললেও জানি, কোনো সমবয়সীকে তার গল্পের খোলামেলা অংশগুলো অনেক সহজে সে বলতে পারবে। আমাকে বলতে গিয়ে তার জিভ আড়ষ্ট হয়েছে। আমারও শুনতে অস্বস্তি হয়েছে। খোলামেলা অংশগুলো অনেকটাই সেন্সর করে সে বর্ণনা করেছে। মৃত্যুঞ্জয়কে যদি সে পুরোটা বলে, সেটি বেশ ভারী হবে, হয়তো শুনে মৃত্যুঞ্জয় একটা কিছু ব্যবস্থা নেবে, যা আমি নিতে পারিনি।
আফসারের গল্পটা অজটিল ধরনের, বাংলাদেশে এই গল্প, বলতে গেলে, হরহামেশা শোনা যায়, যদিও এর শুরুটা শুনে শেষটা আন্দাজ করা যাবে না। তারপরও এটি বলতে তার প্রচুর সমস্যা হয়েছে। আমারও শুনতে ইচ্ছা ছিল না। বিশেষ করে, অল্প কিছু শোনার পর আমি বলেছি, ‘থাক আফসার, বাকিটা আর না-ই বললে। আমার সময় নেই।’ কিন্তু এক তরুণ যদি তার সব শক্তি দিয়ে আমার হাত চেপে ধরে বলে, ‘গল্পটা আপনাকে শুনতেই হবে স্যার। এটি না বলতে পারলে আমি মরে যাব।’ তখন না শুনে কি উপায় থাকে? তারপরও এর একটা গুঢ়ার্থ উন্মোচন করা যায় সাম্প্রতিক কোনো কাঁঠালতত্ত্বের আলোকেই। এই অংশটুকুর জন্যই বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন।
তবে, আফসারের গল্পে যাওয়ার আগে কিছুটা ভূমিকা দরকার। এবং সেটা আফসারকে নিয়ে। আফসার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে বিশ্বখাদ্য সংস্থায় চাকরি পেয়েছিল। ইংরেজি সাহিত্যের সঙ্গে বিশ্ব-খাদ্যের কি সম্পর্ক আমি জানি না, কিন্তু আফসার বেশ ভাল বেতন টেতন পেত। এই সংস্থার এক প্রকল্প পরিদর্শনে গাজীপুর গিয়ে সে এক রাত একটা রেস্ট হাউসে ছিল। তার গল্পের শেষটা ওই রাতের।
কিন্তু তার আগে আফসারের প্রেম ও বিবাহ নিয়ে বলা যায়। আফসার প্রেম করেছিল বাংলার ছাত্রী মানসীকে। কোনো ইংরেজির ছাত্র কোনো বাংলার ছাত্রীকে পাখি ভাইয়ের ঘটকালিতে বিয়ে করলেও সাধারণত একটা প্রীতিময় সম্পর্কে বাঁধা পড়ে। আফসার-মানসীর বিয়ে আবার প্রেম করে। কিন্তু শুরু থেকেই তাদের সম্পর্ক ছিল কণ্টকময়। অথবা দা এবং কুমড়ার মত। এখানে আফসার দা, মানসী কুমড়া। এবং দায়ের ক্ষমতার সামনে কুমড়ার ভাগ্যে যা ঘটে, মানসীরও তাই ঘটেছিল।
আফসার নিজে আমাকে গল্পটা বলেছে। বিয়ের পাঁচ বছর পর। তার বিয়েতে আমি গিয়েছিলাম, অর্থাৎ যেতে হয়েছিল, যেরকম চেপে ধরেছিল সে। কাজেই বিয়ের পাঁচ বছর পর দেখা হওয়াতে বেশ খুশি হয়েই জিজ্ঞেস করেছিলাম, তার কথা, মানসীর কথা। সে মানসীর কথা শুনে কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, ‘এক ভয়ানক ডাইনির হাত থেকে উদ্ধার পেয়েছি স্যার।’
‘ভয়ানক ডাইনি? কার কথা বলছ?’
‘জ্বি স্যার। ডাইনি থেকেও ভয়ানক। সাকিউবাস। আমাকে খেয়ে ফেলেছে স্যার। ধ্বংস করে ফেলেছে।’
মুখ ঢেকে এরপর আধামিনিট কেঁদেছে আফসার। আফসারের গল্পটা এরপর শুনতে হয়েছে আমাকে।
দুই.
মানসীর পুরো নাম মানসী মৌমিতা। আফসারের নাম মিয়া আফসার। মানসী ছিল ফ্যাকাশে ফর্সা টাইপ, আফসার কঠিন কালো। মানসীর একটা বড় কাজ ছিল হাসা। সবার দিকেই তার হাসিমাখা দৃষ্টি পড়ত। আফসার হাসত কালেভদ্রে। মানসী কেন আফসারকে ভালবেসেছিল, আমি কোনোদিনই আন্দাজ করতে পারব না। ভালবাসার রসায়নটা এমনই জটিল, জগতের সবচেয়ে বড় রসায়নবিদের পক্ষেও তার হদিস করা মুশকিল।
আফসারও নিশ্চয়ই ভালবাসত মানসীকে, কারণ বাবার নিষেধ না মেনে সে তাকে বিয়ে করেছিল। আফসারের বাবা মিয়া মমতাজ একাত্তরে পাবনার বেড়া থানার এক রাজাকার কমান্ডার ছিলেন। মানসীকে নিয়ে আফসার বাড়ি যাওয়ার কথা ভেবেছে বিয়ের তিন মাস পর। মানসীকে বলেছে, ‘মানসী নামটা বদলাও, বাবা খুশি হবেন।’
মানসী বলেছে, ‘এ নামটি আমার বাবা দিয়েছিলেন। এটি কেন বদলাবো, বল? এটা কি উচিৎ হবে?’
সেই থেকে শুরু।
আফসার আমাকে বলেছে, ‘ব্রাউনিং এর সেই কবিতার মতো স্যার − মানসী সবার সঙ্গে কথা বলত, হাসত। আমি পছন্দ করতাম না। তার ছেলেবন্ধুরা আমার বাসায় আসত। ভেবে দেখুন স্যার। একেবারে বাসায়! তাও দু-এক সময় যখন আমি হয়তো বাসায় নেই।
‘মানসী আমার থেকে বন্ধুদের সঙ্গ পছন্দ করত বেশি। আমার সঙ্গে হাসতে পারত না মন খুলে। কারণ আমি একটুতেই রেগে যেতাম। বাবা আমাকে প্রায় ত্যাজ্য করেছিলেন, ভেবেছিলাম, তাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে, হাতে পায়ে ধরে একটা মিটমাট করব, কিন্তু মানসী তাতে ভয় পেল। বলল, তোমার বাবার সামনে দাঁড়ালে আমি ভয়ে মরে যাব। মানসীর এক খালাকে একাত্তরে পাকিস্থানপন্থী কিছু লোক ধরে নিয়ে গিয়ে যাচ্ছেতাই করেছিল। কিন্তু সেতো সেই কবেকার কথা! সে কেন এতদিন পর বাবাকে নিয়ে এমন প্রতিক্রিয়া দেখাবে? কেন বলবে, তোমার বাবাকে বরং ঢাকায় নিয়ে আস। কিন্তু প্লিজ, আমাকে বেড়া যেতে বল না। কেন বলবে, স্যার?
‘কত রাত, স্যার, আমি মানসীকে গঞ্জনা দিয়েছি। বলেছি, তোমার কারণে আমার পরিবার আমাকে ফেলে দিয়েছে। দু’একদিন আমার হাত যে অবাধ্য হয়নি, তা না। মানসী মার খেয়েছে, অথচ কাঁদেনি। বরং বলেছে, পরিবার থেকে আমিও তো দূরে। কিন্তু তুমি আমার পাশে থাকলে আমার কোনো কষ্ট নেই। অথবা, আমার হাত ধরে বলেছে, আজ রাতটা শান্ত থাকো। আজকের অশান্তিটা কালকের জন্য রেখে দাও। আজ তুমি আমি বসে বরং চাঁদটা দেখি। চাঁদটা কি সুন্দর ভেসে যাচ্ছে মেঘের ভেলায়! দ্যাখো।
‘এরকম আরো কত ঘটনা স্যার। ডাইনি স্যার, একেবারে ডাইনি। আর, একরাতে তার শাড়ি ছিঁড়ে, ব্লাউজ টাউজ টেনে ছিঁড়ে খুলে … তাকে সটান শুইয়ে দিয়ে প্রচন্ড … স্যরি স্যার, স্যরি স্যার … শুধু বলেছি, এখন বুঝ। … সে শুধু খুব কষ্টের চোখ তুলে বলেছে, এ তুমি কি করলে ! তারপর স্যার যখন তার পেটে একটা বাবু এল − মানসী ওকে বাবুই বলত, আমি বলেছিলাম, যদি মেয়ে হয়? মানসী বলত, তারপরও তাকে বাবু ডাকব। একদিন প্রচন্ড রেগে তুলকালাম করেছি। হাতটা একবার অবাধ্য হয়েছে, কিন্তু তারপরই আমি সংযত হয়েছি। ওতো ডাইনি ছিল স্যার, বাবা যেমন বলতেন। ডাইনিদের অনেক সহ্য ক্ষমতা থাকে, আপনিতো জানেন স্যার। কিন্তু কি থেকে কি হল জানি না। ওর একটা কি কঠিন অসুখ হল। বাবুটা আর জন্মেনি।
‘তারপর একবারের জন্যও আর মানসী হাসেনি। একদিন স্যার, মাঝরাতে উঠে দেখি, মানসী নেই। মাঝে মাঝে এরকম সে উঠে যেত, হয়তো চুপচাপ জানালার পাশে বসে থাকত, অথবা ছাদে চলে যেত। আমি একটু খুঁজে টুজে ফের শুয়ে পড়েছি। ভেবেছি, সকালে হয়তো দেখব, ছাদে বসে বসে আকাশ দেখছে। চাঁদ ওর খুব প্রিয় ছিল। কোনো পূর্ণিমাতে মানসীকে দেখে মনে হত, যেন ওই চাঁদটার জন্য সে অনেকদিন বসে আছে। যেন চাঁদটা তার, অথবা সে চাঁদের। আর পূর্ণিমাটা আষাঢ়-শ্রাবণে হলেতো কথাই নেই।
সকালে উঠে দেখি স্যার ছোট বেডরুমের মেঝেতে মানসী উপুড় হয়ে পড়ে আছে। বিছানাতে শুয়ে ছিল, কিন্তু কিভাবে জানি পড়ে গিয়েছিল। সেরাতে সে ছাদে যায়নি, অথচ আকাশে একটা চাঁদ ছিল। সে ছাদে না গিয়ে ওই ছোট্ট বেডরুমটাতে গিয়েছে।’
তিন.
আফসারের গল্পের দ্বিতীয় ভাগটা অবশ্য বেশি বড় না এবং এটি বলে আমাকে সে জিজ্ঞেস করেছে, এর একটা অর্থ করে দিতে। সেই গল্পটাই এখন বলা যাক।
মানসীর হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ায় আফসার যেমন খুশি হয়েছে, তেমনি তার বাবা এবং আত্মীয় স্বজনও। এই প্রথম তার বাবা ঢাকায় তার বাড়িতে এসেছেন, উৎসাহ নিয়ে ছোট বেডরুমটা দেখেছেন, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব জানতে চেয়েছেন। আফসারকে আর ডাইনি বিষয়ে কোনো কিছু ভাবতে মানা করেছেন; আর বাবার মতোই একটা কাজ করেছেন−ছেলেকে একটা বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন।
সম্পর্কে মেয়েটা আফসারের খালাতো বোন। চুপচাপ মেয়ে, ঘরের কাজে পটু। আফসারের পছন্দ হয়েছে। ভেবেছে, বাবু এলে এর পেটেই আসা উচিৎ; কোনো ডাইনির পেটে তার বাবুর ঠাঁই পাওয়া উচিৎ না। নতুন বিয়ের দ্বিতীয় বছরে গাজীপুর বিশ্বখাদ্য সংস্থার প্রকল্প পরিদর্শনে গিয়েছে আফসার। তখনও অবশ্য কোনো বাবু আসেনি স্ত্রীর পেটে। স্ত্রীর কিছু একটা গাইনি জটিলতা ছিল। আফসার ভেবেছে, একসময় তাকে ব্যাংকক নিয়ে যাবে। সে নিশ্চিত ছিল, উন্নত চিকিৎসায় স্ত্রীর সমস্যা কেটে যাবে। বাবুর বিষয়ে তার কোনো উদ্বেগ ছিল না।
গাজীপুরে নিবিড় কাঁঠাল চাষ কার্যক্রমে অর্থায়ন করেছে বিশ্বখাদ্য সংস্থা। আফসার সারা দিন ঘুরে ঘুরে কাঁঠাল কার্যক্রম দেখেছে। আষাঢ় মাস। কাঁঠালের জন্য ভরা মওসুম। আফসারের খুব পছন্দ হয়েছে গাছভরা কাঁঠাল দেখতে। একটা গাছে সে দেখল প্রায় বিশ কেজি ওজনের একটা কাঁঠাল। সে খুব অবাক হল। একটা ছোটখাটো বোঁটা থেকে ঝুলছে এত বড় কাঁঠাল!
বিকেলে যখন সে রেস্ট হাউসে ফিরল, দেখা গেল সেই বিশ কেজি কাঁঠাল তার গাড়িতে তুলে দিয়েছেন কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা। ওই কর্মকর্তা বিশ্বখাদ্য সংস্থার অর্থায়নে শিগগিরই ফিলিপাইন যাবেন খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণে প্রশিক্ষণের জন্য। তিনি বললেন আফসারকে, ‘এটি আপনার জন্য।’
আফসার কাঁঠাল পেয়ে মহাখুশি। প্রথমত, এত বড় কাঁঠাল সে জীবনে দেখেনি, খায়ও নি। দ্বিতীয়ত, তার স্ত্রী কাঁঠাল ভালবাসে। প্রায় ভাতের মত করে কাঁঠাল খায়।
রাতে সে তার ল্যাপটপে অনেকক্ষণ কাঁঠাল কার্যক্রম পরিদর্শনের ওপর রিপোর্ট লিখল। তারপর ঘুমাতে গেল। ঘুমাতে যাওয়ার আগে দেখল, ঘরের দেয়ালে যেখানটায় ঠেঁস দিয়ে কাঁঠাল রাখা, সেখানে চারপাশে কিছু জ্যোৎস্না পড়েছে। রাত এগারোটা। সে জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখল, মেঘের আড়াল সরিয়ে আকাশে ভাসছে বিশাল একটা চাঁদ। আষাঢ়ের পূর্ণিমা। চাঁদের দিকে দেখতে দেখতে সে ঘুমিয়ে পড়ল।
চার.
বাকিটা আফসারের বর্ণনায় :
মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেল স্যার। মনে হল চাঁদটা একেবারে ঘরের ভেতর চলে এসেছে। এত আলো! সেই আলোতে কাঁঠালটা উজ্জ্বল। যেন সে হলুদ বাদামী নয়, ফরসা; অথবা ফ্যাকাসে ফরসা। আমার দেখে মনে হল, কাঁঠালতো নয়, যেন জীবন্ত কিছু, অথবা জীবন্ত কেউ। আমার জায়গায় আপনি হলে আপনার এরকম মনে হত স্যার, যেন ফ্যাকাসে ফর্সা একটা মেয়ে তার শরীর থেকে সব … স্যরি স্যার … তার খোলা শরীরে চাঁদের আলো পড়েছে। এক উজ্জ্বল বাতিঘরের মতো সে আপনাকে ডাকছে। … স্যরি স্যার, স্যরি স্যার। আমি ভয় পেয়ে চোখ বন্ধ করলাম। আপনিতো জ্যানেন স্যার। একমাত্র সাকিউবাসরা চাঁদের আলোয় খোলা প্রান্তরে আপনাকে মাতিয়ে রেখে আপনাকে সম্পুর্ণ খেয়ে ফেলে … অথচ আপনি থাকেন ঘুমিয়ে অথবা ঘোর লাগা একটা অজ্ঞানতায়।
আমি স্যার ভয়ে চোখ বন্ধ করলাম। কিন্তু স্যার, বেশিক্ষণ না। চোখটা আবার খুলতে হল। খুলতে হল কারণ মনে হল কাঁঠালটা তার সব গন্ধ আমার দিকে তাক করে ছুঁড়ে মারছে। কী তীব্র সেই গন্ধ! কাঁঠালটার দিকে তাকিয়ে দেখি, সেটি দুইভাগ হয়ে গেছে। এবং ভেতর থেকে একটি মেয়ে উঠে আসছে। আমি স্যার তখন চোখের পাতা ফেলতে ভুলে গেছি। হাতে চিমটি কেটে দেখেছি আমি জেগে আছি, না অজ্ঞান ঘোরে আছি। মেয়েটির, স্যার, গায়ে কিছু নেই। শুধু পেটে বাবু আসলে যেমন কিছুটা নম্রতা আসে শরীরে, সেরকম। … স্যরি স্যার, স্যরি স্যার। তারপর সে এগিয়ে এসে আমাকে দুহাতে ধরে অনেকক্ষণ … স্যরি স্যার, স্যরি স্যার … তারপর কি থেকে কি হল, বলতে পারব না স্যার … একটা দীর্ঘ সময় সে আর আমি … স্যরি স্যার, স্যরি স্যার।
তারপর স্যার আমার আর কিছু মনে নেই। মনে হল ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালে উঠে দেখি আমার কাপড় চোপড় মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। … স্যরি স্যার, স্যরি স্যার। আর কাঁঠালটার মাঝখানে একটা মস্ত হা করা গর্ত। যেন বিশ কেজি ওজনের কাঁঠালটা থেকে গত রাতে কেউ বেরিয়ে এসেছিল। আর সারারাত বিছানায় শোয়া লোকটার গায়ে কাঁঠালের গন্ধ ঢেলে তাকে ঘুমের একেবারে গভীরে ঠেলে দিয়ে তারপর বিদায় নিয়েছে। ঠিক যখন আষাঢ়ের চাঁদটা ডুবতে বসেছে। আচ্ছা স্যার, কাঁঠাল থেকে উঠে আসে যে মেয়ে, তাকে কি বলা যায়? কাঁঠালকন্যা? আপনার জানাশোনা কোনো কাঁঠাল বিশেষজ্ঞকে অবশ্যই জিজ্ঞেস করবেন, কোন জাতের কোন ওজন শ্রেণীর কাঁঠাল থেকে কাঁঠালকন্যারা উঠে আসে। আমি ভেবেছিলাম স্যার, আমার স্ত্রী যেহেতু কাঁঠাল খুব পছন্দ করে, কাঁঠাল খায় ভাত খাওয়ার মতো করে, সে হয়তো জানবে। তাকে ঘটনাটা বলতে সে বিকেল পর্যন্ত সময় নিল। আমিও খুশি। যাক, রহস্যটা জানা যাবে। কিন্তু বিকেলের আগেই সে বাসে চড়ে বেড়া চলে গেছে। আমার সঙ্গে একটি কথা না বলে। তারপর আর আসেনি।
হয়তো স্যার তার বাবুর সখ তেমন নেই। অথবা ভেবেছে ব্যাংকক কেন, বেড়াতেই চিকিৎসা শেষে বাবুর কথা ভাবা যাবে।
আমি অনেককে জিজ্ঞেস করেছি স্যার, কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর পাইনি। সারা দেশে কি স্যার একজন কাঁঠাল বিশেষজ্ঞও নেই? সারা বিশ্বে?
রেগে মেগে বিশ্বখাদ্য সংস্থা থেকে চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছি। এখন ছোটভাইয়ের দোকানে তাকে সাহায্য করি। দোকানের পেছনেই একটা চৌকি ফেলে থাকি। কাঁঠালের মৌসুম এলে প্রতিরাতে ঘরে একটা করে কাঁঠাল এনে রাখি স্যার, কিন্তু কাঁঠালকন্যা আর আসে না।
এজন্য স্যার, একজন কাঁঠাল বিশেষজ্ঞের পরামর্শ আমার বিশেষ জরুরি।
বৃহস্পতিবার, ২৭ আগস্ট, ২০০৯
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন