কাজল শাহনেওয়াজ
আমাকে তছনছ করে
.............
আমাকে তছনছ করে দিলে, আমাকে থমকে দিলে আজ
মাত্র দশ মিনিটের দর্শন আমার সারাটা দিনকে পথে বসিয়ে দিল
উত্তর থেকে দক্ষিণে বাসে চরলাম,
পূর্ব থেকে পশ্চিমে রিকসায় চরলাম, হাওয়ার উড়িয়ে দিলাম হাতপাখা
মনে হচ্ছে আমার দেহের ভিতরে এই গ্রীষ্মের তপ্ত হাওয়া ঢুকে পড়েছে।
দোকানের ছোট ছোট জেনারেটরগুলি আমার ভিতরে চলতে শুরু করেছে
ঢাকা থেকে আমি চলে গেছি সিচুয়ানের ভূমিকম্পে
ছোট ছোট শহরগুলি দেবে যাচ্ছে
সকাল না হতেই
..........
সকাল না হতেই, জ্যৈষ্ঠ মাসের পাখিরা ডাকছে ‘থ্যাঙ্কিয়্যু’
ঢাকার পাখিরা শিখলো করে ইংরেজী
পাখিগুলি সব ভদ্রপাখি
যদিও কাকেরা ডাকছে হায় হায়
যেনবা ওরা খবর পেয়েছে
মিয়ানমারে চিনে মানুষের খুব দিন অসহায় সাইক্লোন আর ভূমিকম্প
তুমি কি বিশ্বাস করো, পাখিরা মানুষের মনের কথা বোঝে?
নইলে কেনো সে বলছে থ্যাঙ্ক ইউ, থ্যাঙ্ক ইউ,
তোমাকে ধন্যবাদ, ধন্যবাদ তোমাকে
আমাকে তুমি দিয়েছো যে তোমার অমূল্য মন
যার তুলনা নই এ পৃথিবীতে
দেখো কিযে শিউরে উঠছে আমার ত্বক
শুধু ভাবতেই তোমার প্রসঙ্গ এই বেলা।
আজকাল প্রায়ই প্রত্যুষে
আজকাল প্রায়ই প্রত্যুষে উঠে বসে থাকিদ
দেখতে দেখতে রাস্তা ও গাছ ভেসে ওঠে অন্ধকার থেকে
আকাশে লুকায় প্রতিপদের চাঁদ লজ্জার
ছেলেটি যেনবা বাড়ি ফেরে নাই রাতে
পথে পথে আর এখানে সেখানে দেরী করে
সূর্য ওঠার আগেই ফিরছে আজ ঘরে
বলতো এসব দেখে কি মনে পড়ে যায়?
কৃষ্ণ ফিরছে সারারাত পরে রাধার আঙ্গিনায়
কলংকিত চাঁদ সে কারণ শত সখীর ব্যস্ত বিবিএ
আমি বলি, খেলে আমার মাথাটি চিবিয়ে
সারা দুপুর আর বিকাল সন্ধ্যা
ক্লান্ত আমাকে দেখাচ্ছে খুব অফিস ফেরতা
আসলে কি হয়েছে তোমার সঙ্গে সে কথা কাউকে বলা কি যায়?
খুবতো হাসছো মন খুলে
এদিকে আমাকে বাসায় ঢুকতে হচ্ছে মুখ শুকনো করে।
পাশাপাশি অনেকগুলি দালান
...............
পাশাপাশি অনেকগুলি দালানের মধ্যে
দাঁড়িয়ে আছে একটা মাত্র গাজর রঙের দালান
আমি দেখতে থাকি তাকেই
মাঠ ভর্তি কোলাহল, যেন তুমি খেলছো ছোটবেলাকার ছেলেমেয়েদের মিশ্র ফুটবল
সূক্ষ্ণ কলাকৌশল যার ছিল না
সূর্যাস্তের দিকে পিঠ দিয়ে বসে থাকায়
দালানগুলির ওপর শেষ আলোকচ্ছটা ঠিকরে পড়ার শব্দ বেশ টের পাচ্ছি
এই বিকালটা যেন একটা ক্ষুধার্ত কাছিম
জবা ফুলগুলি চিবিয়ে চিবিয়ে খাচ্ছে
তার পাশে বসে, তোমার নাম মিশেল,
তুমি পূরানো ও নতুন দিনকে চঞ্চল স্রোতে বেঁধে দিচ্ছ
একটা ছাতার মত আকাশের নিচে
একটা কাপের মত আলো অন্ধকারে
পাষানের সাথে ঝর্নাকলমের বিয়ে হচ্ছে
তোমার ক্রিকেট পিচে
.............
তোমাকে স্পর্শ করে বাতাস ও বইতে পারে না
তোমার কাছে এসে পুলিসের বাঁশি থেমে যায়
সেই প্রায় আয়তাকার মাঠটি থেকে সবার চোখ এসে
তোমার ক্রিকেট পিচে একবার করে বল করে যাচ্ছে
তোমাকে স্পর্শ করে যাচ্ছে পুরানো পাখিরা
তোমাকে দেখে যাচ্ছে কার্নিশের ছায়া
তোমাকে স্পর্শ করে করে গেল অনেক গাছের ভিড়ে
দেয়াল ঘেঁষা একটা ছোট্টো চারা
তোমাকে ঘুরে গেল একটা বদমাশ মাছি
কার যেন রেকর্ড করা এস্রাজের সুর
তোমার বাহুর সোনালী হলদে ত্বকের নিচ থেকে এমন
মরমী শিরাগুলি ছুঁয়ে গেল আমার জন্মদিন
যেন পৃথিবীতে কোন কালে ক্ষুধা তৃষ্ণা ক্ষমতার কোন সমস্যা ছিল না
আমরা শুধু চুপচাপ বসে ছিলাম।
কেমন ভেজে রেখেছে ফুলগুলি
.................
কেমন ভেজে রেখেছে ফুলগুলি, কেমন সাজানো টবে গাছ
বাটি ভর্তি পদ্মার ইলিশ, থোকা থোকা অন্ধকার, স্বচ্ছ পানির দেশি সরপুটি
সবাই খাচ্ছে সবাইকে, কেউ বন্ধুর চাঁদামাছ
সহপাঠির উষ্ণ ভাজা
সম্পর্কের আম জাম, নতুন পরিচয়ের তালশাস
গল্পের রসালো লিচু থেকে খোসা ছাড়িয়ে
অনেকেই টুকটাক আলাপ করছিল
কিন্তু তোমাকে আমার খেতেই ইচ্ছা করল না
মনে হলো একদিনে না খেয়ে
বহুদিন একটু একটু করে দেখেই থাকিনা!
তোমাকে নিয়ে হেটে আসি
...............
চলো তোমাকে নিয়ে হেটে আসি মানিকদি’র মাঠ
যেখানে ঢাকা শহর তলিয়ে যেতে যেতে একটু ভেসে উঠছে
সামরিক ছাউনির রাগ থেকে বাঁচার জন্য আমরা কতকিছুই না করতে চাই
রাত এখন মুক্তি পাবে কি?
বিছানার নিচে নড়ে উঠছে শর্ষের বিচি
আষাঢ় মাসের রাতে কান পেতে শুনতে পাচ্ছি
চিড়িয়াখানার অচেনা পশুদের দীর্ঘশ্বাস
তুমুল বৃষ্টির রাস্তায় আছড়ে পড়ার শব্দে
শুনতে পাচ্ছি তোমার ফোঁপানোর শব্দ
তুমি গুচ্ছগুচ্ছ ভোরের শিশুদের জন্ম দেবে বলে কি
এমন রাতগুলিতে একা থাকা বেছে নিলে
যখন ক্রুদ্ধউরু ভালবাসতে চায়
তখন এলোমেলো হচ্ছে বকুলের ঝরে যাওয়া
মানিকদি’র আকাশে আমরা খেলনা হেলিকপ্টার ওড়াতে গিয়ে
হাতে পেলাম ব্যাটারী শেষ হবার লাল সংকেত
ভিজে যাবার পরেও দরজাটা খোলা রইল
তোমার গলার সাথে আমার গলার মিল হবার জন্য
হাতে গোনা কয়েকটা দিন
................
হাতে গোনা কয়েকটা দিন। গ্রীষ্মের পর বর্ষাকাল।
তীব্র সূর্যের দিনগুলি ভিজা দিনে প্রবেশ করছে।
আমি বসে বসে কাঁদি, কিন্তু কোন কান্নার চিহ্ণই তো আমার নাই।
হাতে গোনা কয়েকটা মাত্র দিন বাস্তব
আর সব আমার কল্পনার রংয়ে ছন্দে বোনা
তোমার একটা কানের ছবি তোলা
তোমার একটা কানফুল মেঝেতে কুড়িয়ে পাওয়া
তোমার একটা অল্প লালচে চুল আমার ঘরে
হাতে গোনা কয়েকটা মাত্র বাস্তব দিন নিয়ে
আমি জুয়া খেলায় নেমেছি কল্পনার সাথে
তুমুল বৃষ্টিতে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছি আর
নিজেকে তুলে দিচ্ছি হুড তোলা রিকসার
একটুকরা পলিথিনের পর্দার পিছনে
কি গাদাগাদি করেই না বসেছি আর
কি চেষ্টা করেই না স্পর্শ বাঁচানোর কষ্ট করে যাচ্ছি
যাতে তুমি কোন ভুল সংকেত আমার কাছ থেকে না পেয়ে যাও
তাহলে বাস্তব কি ঐ তোমার স্পর্শ বাঁচানো?
আর কল্পনা হলো শক্ত করে তোমার বা হাতের পাঁচটা আঙ্গুলের মধ্যে
আমার ডান হাতের পাঁচটা আঙ্গুল খুব জোর দিয়ে চেপে ধরা?
ঢাকা শহরে
........
ঢাকা শহরে কোন মাঠ নাই।
ঢাকার ছাদগুলি হচ্ছে মাঠ।
সরু সরু রাস্তাগুলি অন্ধকারে ডুবে আছে।
তুমি তোমাদের ছাদের ছোট মাঠটাতে দাঁড়িয়ে
তাকিয়ে আছো শ্রাবন মাসের পূর্নিমার চন্দ্রোদয় দেখবে বলে।
মনে পড়ছে কি আষাঢ়ের প্রথম দিনের কথা?
আকাশ ভর্তি কালো উড়ে যাওয়া মেঘগুলিতে
শহরের আলো পড়ে সাদা দেখাচ্ছিল
মাঝে মাঝে ফাঁকা, সেখানে অনেক দূরের মহাশুন্য পর্যন্ত শুন্য আকাশ
তুমি কথা বলতে বলতে
মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলে
যেন আমি তোমার সামনেই দাঁড়িয়ে আছি
তুমি প্রায় আমার সমান উচ্চতায় থেকে
আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে
কিছুটা ঘোরলাগা কন্ঠে বললে, আমি ভালবাসি তোমাকে...
আমি তোমাকে চাই আমি তোমাকে নিয়ে হারিয়ে যেতে চাই
তারপর বললে তারপর বললে বললে তারপর
বিরবির করে শুন্য মুহূর্তের দিকে বললে
যা বোঝা গেল আবার বোঝা গেল না
শ্রাবন মাসের আকাশ ঢেকে ফেলা কাঁচা পাকা মেঘ
কেমন গম্ভীর, বয়স্ক আর দুষ্টুমির ভিতর থেকে
পূর্নিমার চাঁদকে তোমার চোখ থেকে লুকিয়ে রেখেছে
কিন্তু আমি জানি, তোমার দুচোখ ভিজে আসছে কান্নায়
সেদিন যে কথাটা বলেও শেষ করতে পারনি
আমরা মুখোমুখি আসতে পারিনি বলে
সেটাই প্রতিনিয়ত তুমি বলে যাচ্ছ
চাঁদ উঠুক না উঠুক
বৃষ্টি হোক না হোক
চোখ ভিজে ওঠে শ্রাবন মাসে।
ঢাকায় কোন
........
ঢাকায় কোন শ্রাবন মাস নাই।
বছর বছর শুধু বন্যার কষ্ট
ঢাকার কোন হৃদয় নাই।
মিরপুরে হৃদয় নাই। কচুক্ষেতে হৃদয় নাই। বাড্ডায় হৃদয় নাই।
হৃদয় নাই শ্যাওড়াপাড়ায়, যাত্রাবাড়ি, উত্তরখানে।
ক্যান্টনমেন্টের হৃদয়হীনতা সারা শহরে।
যখন কেউ মধ্যরাতে আর্তনাদ করে ওঠে
সেই আর্তনাদ ঘরের এককোনায় আটকে থাকে,
যখন কেউ গুমরাতে থাকে বিরহে
তখন তা এক চিলতে বারান্দার মধ্যে বসে থেকে।
একরুম থেকে আরেক রুমে পায়চারী
রান্নাঘর থেকে পানির জগ ভরে নেবার চেষ্টা
টেবিলে কাগজ পড়ে থাকে, কলমের অভাবে তোমাকে লেখা হয় না।
শ্রাবন মাসে তুমি গ্রামের বাড়িতে গিয়ে
উঠানের কাদায় পা ডুবিয়ে গভীর রাতে ফোন করে যাচ্ছো
আর আমি নেটওয়ার্ক বিভ্রাটে কিছুই শুনতে পাচ্ছি না!
সত্য সত্যই কি আমার ষাটভাগ বাস্তবতার মাঝে
তুমি চল্লিশভাগ কল্পনা কোথাও আছো?
গতসপ্তাহে আমিওতো গিয়েছিলাম পাহাড়ে
তুমি ছিলে রাজধানীর বিছানায়
আমি যত আবেগে, সেই মধ্যরাতে
সাপ আলিঙ্গন আর ব্যাঙের পাহারায়
ঘরের বাইরে, নিরালায়
তোমাকে চেয়েছিলাম ফোনের ইশারায়
প্রায় সারারাত নিষিদ্ধ আগ্রহে
তোমাকে টেনে বের করেছিলাম
নির্ঘুম নীল রাতের পোষাকে
আজ একি হলো
তুমি গেলে নীল যমুনার পাড়ে
যেখানে গ্রাম টাঙ্গাইলের শ্রাবনে
নৌকায় করে তোমাকে টানার কথা
সেখানে নাকি শুকনা খটখটে
নদীর বুকে ঘনঘটা নাই ঢেউয়ের
তুমি ফিরে এলে ঝগড়ার ছলনায়
পাশের ঘরে শাশুড়ির নাক ডাকা
জেগে থেকে পার করে দিলে নিশি ভোর
অথচ দেশে ফিরে এলো খুব ভোট
নির্বাচিত, পুরানো যত চোর
কিছুই বদলায় না, অন্তত বদমাস,
বদলায় শুধু আমাদের যা হবার কথা
আমরা যখন রাত জেগে থাকি শ্রাবনেপ্রেমের দেবতা রাস্তায় নামে মাগনে!
সোমবার, ৩১ আগস্ট, ২০০৯
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন