রবিবার, ৩০ আগস্ট, ২০০৯

জলকথা: পর্ব এক

মৌসুমী কাদের

১. শরীরের শিরায় শিরায় ধুলিকনা মিশে আছে। কোথাও কোন শুদ্ধ রক্তপাত নেই। যদি দাহ করো, এখনই করো…ব্যাথা-বিষ নির্লুপ্ত হয়ে জন্ম হোক আরেক মানুষের…

২. মদ্যপ বীজ বুনেছিলাম উঠোনে, এখন সেখানে লাগামহীন উদ্ধত মাতাল গাছ। ধুলোভরা ঘরে কেন আর থাকবো? উঠোনে যাবো, উঠোনে যাবো…হে মাতাল গাছ, আমি তোমার চূড়ায় চড়বো, ভুলে যাবো কাল-মহাকালের ব্যাথা……


৩. ইভেরা নদীর উপর থমকে দাঁড়ালো চাঁদ । আমাজানের গায়ে রঙ নেই, ফুল নেই, বৃক্ষ নেই, কেবলি নেই নেই নেই……গুটিকতক পথভোলা সন্যাসি পাখি। তুমি বোলনা যেন ওরা দুঃক্ষবিলাসী অথবা ওদের সাহস নেই…আসলে কি চাঁদ? তোমাকে নেবার ইচ্ছেটাই ওদের নেই……

৪. সুড়ঙ্গপথের সরু বাঁকা ট্রেনলাইন আকঁড়ে ধরেছিল আজ। একেবারে শেষ বগিটার কাঁচ দরজা ঘেষে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম তোমাকে। ট্রেন যত যায় ততই তোমাকে দেখি। মনে হয় একই টেনে হয়ত তুমিও অপেক্ষা কোরছো। যেখানেই গন্তব্য হোকনা আমার, তুমি আছোই।

৫. কতদিন কথা হয়না। অথচ কত লক্ষ লক্ষ কথা ছিল তোমার আর আমার। কথাগুলো ফুটন্ত খই হয়ে ঠোঁটের ভেতর জড়িয়ে হাসতো, আমি তা-ই চেটেপুটে খেতাম। যেন কোন বুভুক্ষ শিশু আমি । সেই ঠোট কি তেমনি আছে? সেই খই?

৬. সুরগুলো কত সহজে পেট-বুক-গলা ভেদ করে আড়ম্বর ভাব জমিয়েছিল কন্ঠের সাথে, মোমের মতন গলে পড়েছিল গান আর গান… ঠোটের ভেতরে গান, দাঁতের ফাকে গান, গহ্বরে… আরো গহ্বরে…তালুর সংগমে গান, ঐসবই ছিল অজানা আন্দোলন…বিস্ময়!! এখন এসব একটা গোটা অভিমান, গোপন ভয়, তার ছিড়ে রক্তধারা প্রবাহিত হবার ভয়…। ভীতু আমি, বিবস্ত্রচিত্তে ভাবছি বসে তাই…

৭. আমার বাপ-দাদার ভুতের ভয় ছিল, ইদানিং আমাকেও তা ধরেছে। গিরগিটি রঙ চুলের ভুতটা আমায় সারাক্ষন পাহাড়া দিচ্ছে, যদি একটা ভুলের জন্ম দিই তাহলেই… খপ করে সে তা ধরে ফেলবে তারপর চিবিয়ে চিবিয়ে তার মাথামুন্ডু খাবে……

৮. এই পৃথিবীর সব জল সে আমাকে দিয়ে ফেলেছে, প্রতিদানে তাকে দিয়েছি একটি ভেলা, ভাসুক সে, ভাসুক…দেখি তার জলের খেলা……!!

৯. এখানে শীতের মহরা শুরু হয়ে গ্যাছে। লালপাতার বিলাসী মেপল গাছগুলো ক্রমশ ঝরে যেতে শুরু করেছে। বৃক্ষের অবধারিত শামুক জীবন এখন আমাকে মেনে নিতে হবে।আমি আমার সবুজ ঘোড়াটির মায়া ত্যাগ করে প্রতিদিন হাটবো ভিক্টোরিয়া সাবওয়ে স্টেশনের দিকে। শীতে কাঁপতে কাঁপতে ভাববো সাধারন মানুষের ভীড়ে একটা গোপন রহস্য আছে। কেউ কাউকে চেনেনা, প্রশ্ন করেনা, অথচ পাশাপাশি হেটে যায় কত মানুষ!!!

১০. আমাদের বাড়ীতে একটা শিউলী গাছ ছিল। শীতের ভোরে জানালা খুললেই দেখতে পেতাম অসংখ্য ফুল ছড়িয়ে আছে মাটিতে। ফুল কুড়োবার মানুষ নেই। একটি দিনের বিবর্তনের পর আমি ওদের মৃত্যু দেখতাম আর ভাবতাম আর যেন নতুন ফুল না ফোটে, আর যেন নতুন ভোর না আসে। আমি চাইনি ঐরকম কোন সকাল আবার আসুক আমার জীবনে। যেখানে স্বপ্নের ডালপালাগুলো প্রচন্ড শীতে কুকরে যেতে যেতে একসময় তার মৃত্যু ঘটবে। অথচ আমি জানালা খুলই দেখতে পাবো তুমি ওপারে দাঁড়িয়ে আছো।

১১. একটা অদ্ভুত নাগরিক প্রেম তোমার আমার, যার কোন নাম নেই। সে শুধু ঘ্রান নেবে, একটুও ছুঁবে না। হা শরীর……!!…এইযে ক্রমাগত নেমে যাওয়া, প্রস্ফুটিত হওয়া প্রগাড় স্পর্শের আড়ালে, কি নাম দেবে তার? বিস্ময় না প্রেম? না লোভ? আবিস্কারের আনন্দ মানুষকে লোভী করে বই কি, তাই সে ভুলে যায় অশরীরি আনন্দকে……

১২. কাকে বলে মুক্তি? কাকে বলে পাপ? কাকে বলে দুর্বোদ্ধ সময়? অজানা রহস্য সব, চলো ফিরে যাই পলাতক শৈশব, দোলনায় দুলি হা-দূর্লভ।চলো ঘাসফুল তোমাকে বৃক্ষ বানাই, ঠুনকো বালির ঘর ভেঙ্গে ফেলে শুয়ে পড়ি মাটির বিছানায়……

১৩. প্রকৃতি এক অদ্ভুত খেলা খেলছে। কখনও তুষার, কখনও মেঘ ও রোদের খেলা, কখনও বৃষ্টি। তার আর আমার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই আর। দুজনে মিলে ঢুকে গেলাম এক গভীর ও গোপন অন্দরমহলে। যেন কেউ দেখতে না পায় রহস্যময় এই খেলা। যেন কেঊ বুঝতে না পারে, আদি আনন্দের পরিভাষা। কেবল আমি এবং আমার প্রকৃতি। তুমি আমায় বুঝতে পারোনি, তাতে কি হয়েছে, দুনিয়ার আর সকল মানুষ আমায় বুঝতে পারেনি, কেনই বা তাতে দুঃখ বহন? আমি আমার সমস্ত কষ্ট ঝাপ খুলে দিয়ে দেবো তার কাছে, যদি সে তা বইতে না পারে…।।প্রগাঢ় বৃষ্টির অবিরাম ধারায় সে তা ছড়িয়ে দেবে আমাজান জঙ্গলে।

১৪.. সে দরজার বাইরে অনেকক্ষন, স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি তার নিশ্বাস পতন, সমস্ত পৃথিবী পেছনে ফেলে নির্বাসিত দাঁড়িয়ে সে, জানালা খুলেছি, এখনও খুলিনি দরজা, ভয় হচ্ছে, যদি খুলি…সে কি ভেতরে প্রবেশ করবে?

১৫ আজ আমার কষ্টগুলো বেমালুম পাখা মেলে বাতাসে উড়ে গেছে। আমি তাদের দেখতে পাচ্ছিনা, বুকের ভেতর যে সরু কষ্টের চিন চিন ব্যাথা, একফোটা নেই। এর মানে কি আমি সব ভুলে যাচ্ছি?

১৬. তার জন্য আমার সব প্রতিক্ষা শেষ, এখন আমি নির্বাক সমন্বিত অন্ধকারের হাত ধরে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে। এবার আমার অপেক্ষার পালা শুরু। শীতটা বড্ড ভয়ংকর। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস কেটে যায়, সুর্যের দেখা মেলেনা।

১৭. একটি গান আমায় সারারাত জাগিয়ে রাখলো, গানতো নয়, বালিকা বাতাস; ঘুরে ফিরে…হাসে হাসে…ভাসে আর ভাসে…আবার ঢু……স করে ঢুকে পড়ে মাটিতে…

১৮. কি দারুন যুদ্ধ আমার, পাহাড়ের দেয়ালটা টপকে ফেলার!! চুড়ায় দাঁড়িয়ে যদি দেখি আকাশকে ছুঁতে ছুঁতে আমি তোমার ছুঁয়ে ফেলেছি, ওমনি তুমি অভিমানী নীলমেঘ উড়ে উড়ে হারিয়ে গেলে পৃথিবীর ওপ্রান্তে, কি হবে তখন? আর কি ফিরবো আমি, সবুজমাটির দেশে?

১৯. বিছানা, হারমোনিয়াম, কি-বোর্ড, ল্যাপটপ, দেয়ালে বন্ধুর আঁকা নীল-সমুদ্র, অজন্তা মূর্তি, সব এক এক করে বাক্সবন্দি হচ্ছে বাড়ী বদলের হামলায়। হু হু করে ছুটছি আমি ওদের পেছন। এ বাড়ীর স্মৃতি কি কেবলি ছিল প্রতারিত স্বপ্নবুনন? বুকের ভেতর ধারন করেও তবে তাই পেছনে ফেলে চলে যাওয়া??

২০. বাড়ীটা এখন টলটলে জলে ভাসছে, পুকুরপাড়ের সেই লিচুগাছটা আর নেই, বুভুক্ষপোকাদল চেটেপুটে খেয়ে নিয়েছে ওর শরীর। একটা চাপকল ছিলো উঠোনে, সেও মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়েছে অনেকদিন। বুকের ভেতর হু হু বাতাস, পুর্বপুরুষের অসহায়ত্ব, বিবর্নতা, বিলীনতা ………পৃথিবীর এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তের দূরত্বেও ভুলতে দেয়না একের পর এক বদলে যাওয়া অস্তিত্ব।

২১. ইচ্ছে করে…ইচ্ছে করে, পা ছড়িয়ে শুয়ে থাকি পথে, কোনো অদৃশ্যদানব তুলে নিক আমায়……হা……, কতটা পথ...পাড়ি দিলে পৌছে যাবো তোমাতে? কতটা পথ অগ্রসর হলে বদলে যেতে বলবেনা অশান্তশালিক, শান্তনা দিয়ে গলে পড়বেনা নরম-চড়ুই? ঘুমফুল দোলনচাঁপা…শোনাবেনা ঘুমপাড়ানিয়া গান…?কতটা পথ?... হে অভিমানি শংখলতা, এসো, আর নির্বংশ কোরনা ঘাসফুল! যদি চাও মূলশুদ্ধ তুলে নাও…জন্মাতে হবেনা আর সবুজ গাছ…!

২২. দুপুরবেলা চারদিক ভাতঘুম উৎসব, জানালার গরাদ ঝুলে তোমার চিঠির প্রতিক্ষা…চিঠিটি এলো, তুমি আর এলেনা।

২৩. কাঁচা আলোয় চন্দ্রবিন্দু…?যদিও রোদ বলে সর্বনাশ…ভেবোনা কাঁচা বলে নেই কোন বেদনার আভাস…!

২৪. সর্বনাশ হাত ধরে তার বাড়ী নিয়ে গেল… মাটির বিছানায় বিছিয়ে দিল এক চিলতে রোদ। রোদ বললো, আয়…আয়…হাত-পা ছড়িয়ে আয়…দিশেহারা মন আয়, উদ্বাস্তু শরীর হলদে রোদে গলে গলে মিশে গেল…হায় বোকা বোকা কষ্ট, তোর আর বাড়ী ফেরা হোলনা… মোহবলে আক্রান্ত মানুষ তুই আজ…

২৫. সে…তো কাঠুরিয়া…কাটে মানুষ! হ্বৎপিন্ড থেতলে দেয়! কিসের আক্রোশ তার? কিসের শোক? চলো যাই ধামরাই…পড়ে থাকা চাষের জমি হাতরাই, অপরিপক্ক বালুভূমিতে গড়াই…বন্ধুত্বে আর না যাই……না যাই…

২৬. ঘুমিয়ে গেছে শহর, সাইকেল, জানালা, মেপল গাছ। ঘুমায়নি শুধু আটকে পড়া একটি মাছি। তারস্বরে ভন ভন করছে আর পরিহাসে মরছে, কেন যে তোমায় ফিরে ফিরে পাই…আমারি ইশ্বরে, সেইটি এখন গোপন ইতিহাস…

২৭. সুর্যের মাথা খারাপ হয়ে গ্যাছে, গগন ফাটিয়ে সে হাসছে আর হাসছে, এদিকে উত্তাপে পুড়ে যাচ্ছে, ক্ষেত-খামার ফসল……এতো রোদ এত উত্তাপ, তবু সে আর্ক্টিক শীতল সরোদ……

২৮. প্ররোচিত ও মোহগ্রস্থ মানুষের স্বপ্নবৃক্ষে ফুল ফল কিছুই ফুটলোনা……তাইসে ঝড়ের মধ্যে আটকে পড়ে ঝড়ের মতন উধাও!!! দুর্ভিক্ষের কাঁদাজলে বড় হবার চেয়ে মৃত্যু অনেক কাংখিত……

২৯. প্রতারিত স্বপ্নের ঘরে একগুচ্ছ বালিকা ঘাস । কে জানতো, ঘাস-ই ছিল তার পুরন সর্বনাশ……স্বপ্নেরা বলে, চলো নদীর কাছে যাই, কে জানতো সেও বড় অশান্ত………তার চেয়ে এই ভালো বেদনা পাহাড় নিয়ে ঘুমাই……

৩০. দরজী জামা কাটতে গিয়ে কেটেছে বারান্দা। চড়ুইয়ের বাসা ভেঙ্গে ছারখার! উঠোন জুড়ে সমবেত পাখিদল। দরজীর হাত কেটে নেয়াটাকি এতই সহজ?

৩১. বুড়ো তামাটে মেপলগাছ ও তার আইরিশ বন্ধুর নিমগ্ন জ়ীবনে এখনও একটি অবসন্ন বিকেল বাকি…কালো কফির ধোঁয়া উড়তে উড়তে ভুলে যায়…সমুদ্র বরাবর কেবলি হাঁটা …সেই তুমুলস্রোতে আছড়েপড়া তোলপাড় হ্বদয়…… নির্যাতিত যৌবনের চেয়ে সমাপ্ত অবসর অনেক ভালো……

৩২. …কখনও চুল বড় কোরনা…কখনও ফুটিওনা কামনার ফুল…যৌবন যতই অথৈ জলে ভাসুক…শৈশব হোক শোকগাঁথা…

৩৩.…প্রলম্বিত অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে সে,…বয়স্ককাল তোমাকে ভয়, যে তীব্র জ্যোতিফুল ঝুলে পড়ে হয়েছে ভুল…আর কেন যাবে সে দূর্নামে…

৩৪.…জমি বা জল নয়্…বিনিময় শব্দভাজে আছে শুধু নোনাবৃষ্টি কোলাহল…… সমতল অন্ধকারে হারিয়ে গ্যাছে সব দূর্বোদ্ধ গতকাল…

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন