শুক্রবার, ২৮ আগস্ট, ২০০৯

কবি সাজ্জাদ শরিফের কবিতা

প্রতিবেশী
.........
এই ঘুমন্ত নিচু গ্রামে
হাওয়া এলোমেলো, বিদেশিনী
তাকে ভাষাহীন সঙ্কেতে
আমি চিনি না বা ঠিক চিনি

দূরে দিগন্ত কাঁটাতার
দূরে মেঘে মেঘে মশগুল
শাদা উড়ন্ত মিনারের
নিচে একাকিনী লাল ফুল

বলো ওগো প্রতিবেশী ফুল
হাওয়া তোমার কি সন্তান?
তার অবোধ্য সঙ্কেতে
প্রাণে জ্বলে ওঠে আরো প্রাণ

তুমি নর্তকীমুদ্রায়
কেন দিচ্ছ অপ্রমাণী?
কেউ বুঝি না তো এই রাতে
তুমি তুমি, নাকি তুমি আমি

তবু ভূগোলের সিলেবাসে
আজও একথা পড়ানো হয়:
এই রাতজাগা উঁচূ গ্রামে
হাওয়া প্রসঙ্গক্রমে বয়

*যুগান্তর, ফেব্রুয়ারি ২০০০


চাঁদে পাওয়া গাছ
..........
নিষেধ শুনলে না
তুমি
পাখা মেললে রাতভর
উড়ে গেলে
এদিক ওদিক
তুমি
আমাকে নাওনি পিঠে
ও শ্যামল
দীর্ঘ দেবদারু
তুমি
শুনলে যমের কান্না
রাতপ্রহরীর সিগনালে
আর
চোখে দেখলে অতীতের
সব লাশ
জ্যান্ত হয়ে
উঠে আসছে আগামীর থেকে
তুমি
বৃক্ষ হতে
চাইছ না আর
শুধু
আমি আজ
তোমার শেকড়
থেকে
জন্ম নিতে চাই
অনিন্দ্য, আগস্ট ১৯৯২

অন্ধ শিকারী
ভাঙা অন্ধের লাঠি হাতে
আমি শিকারের সন্ধানে
চলি দিগন্ত পার হয়ে

*অনিন্দ্য, আগস্ট ১৯৯২



ধর্মবনানী
........
কামার্ত বন, চলো সাবধানে,
সামান্য ছোঁয়া পেলেই কেমন
শিউরে উঠছে ঝামরে উঠছে
ধর্মবনানী, বলো সাবধানে,
জন্ম নিচ্ছে স্বাধিন অঙ্গ...
দেহতরঙ্গ... মানুষ... মানুষ...

টগবগে এই লাভার ওপরে
সন্ন্যাস ভেঙে লক্ষ বছর
ঝরাচ্ছি বীজ ঝরিয়ে চলেছি

*অনিন্দ্য, আগস্ট ১৯৯২


বোবা কথা
........
শোনো আজ স্তব্ধ পারাবত
কুয়াশার দিগন্তের পারে
এখনো ছায়ায় ঢাকা দেশ

যোগাযোগ, বোবার অক্ষর
দেখেছি নিকষ অন্ধকারে
ফুলকি আর ছাই হয়ে ঝরে

ডাক-হরকরা, পড়ো ভাষা
এখনো নদীর তল থেকে
আর্তি আসে ডুবন্ত শিশুর

পারাবত, অন্ধ পিতামহী,
অর্ধেক পাথর তুমি আজ
বালক কবির করতলে

*অনিন্দ্য, আগস্ট ১৯৯২


বনপরী
........
অরণ্যে তোমার সঙ্গে দেখা হলো, পরিচয় হলো
ছিলে পরী, ডানা ছিঁড়ে মানুষ হয়েছ
তুমি জানো সবুজ রহস্যটিলা, গুপ্তশাস্ত্র, এখন মানুষ
দেখবার নাম করে আমার সন্ধ্যানে বেরিয়েছে
জানো অন্ধকার হলে প্রণয়ীর গলা
মুচড়ে সকল রক্ত শুষে নিতে হয়
আজ তাই ঝাঁপিয়ে আসছে কালো মেঘ

তবু বসি তোমার নিকটে এসে নত
সফল গোয়েন্দ তুমি, দৃষ্টিচোর, পদচিহ্নভেদী
আমার গোপন সব প্রকাশ করেছ রাজপথে
তোমার জানুর কাছে বসি তবু; অরণ্য শহর ঢেকে দিলে
ওই কোলে ঘাড় নুইয়ে দেব

*নদী


বংশপরিচয়
........
জন্মটান যদি থাকে তো জ্বেলে ধরো শিখা
বংশলণ্ঠন ধ্বংসলণ্ঠন পেয়ে
শিকারী নিজে তুমি হয়েছো নিরুপায় শিকার
আয়না ভেঙে আজ বেরিয়ে এসে গেছো মেয়ে

কোন সে মেয়ে? আর শিকারী সে কেমন? চাকা
ঘুরিয়ে ও কে যায়? করো গো পরিচয় করো
সবাই একজন। আঁতুরঘরে শিশুডাকাত
দেখার পর থেকে রয়েছো তুমি জড়োসড়ো

জাতক জড়োসড়ো, জাতক আজ করো পড়া
মেয়েও হও আর চালক হয়ে পথে তাকে
নামাও আর করো ডাকাত হয়ে দস্যুতা
পিতৃহ্রদ থেকে করো গো পান সেই সরাব

বংশনদীতীরে বংশঝরনার বাঁকে
যেন বা মাঝি হয় তোমার জন্মের স্নেহ
খুলেও গাঁথা থাকে একটি অবিরল সুতোয়
স্বপ্নদেহ আর তোমার কঙ্কালদেহ

*মূলধারা, ১৯৯০


ডানা
...
কেমন ঝাপটে এলে, ডানা, এই জলাভূমি থেকে
আমাকে নখরে গেঁথে, ও স্বতোপ্রকাশ,
তুলে নেবে? রাত্রি এলে কেন দূর বনে চলে গেলে
কাটাই দিবসযাম। হাঙর আমার
বাবা-মাকে খেয়ে নিল, আমি তো অনাথ, আমি শ্যাঁওলার ঝোপে
লুকিয়ে বেঁচেছি এতোকাল
আমার শরীর থেকে খসে, ডানা, অপরহরণে
চলে গিয়েছিলে যদি হাওয়াকে পাঠাই খোঁজে, ঝড় আমার ছেলে
জন্তুর খুরের তৃণে বিষ্ঠা ও লালায়
ভরেছে সমস্ত দেহ; নিজে নিজে, ও ডানা, ফিরেছ তুমি আজ
বাকানো নখর নিয়ে এ জলাভূমিতে কেন বলো?

নিঘুমজাগর আমি দিগব্যাপী এ জলপাতালে
দেখছি উঠছে জেগে সমাধিমহল-
একটি সে খালি, তাতে মনুষ্যচর্বির দীপগুলো
জ্বলে উঠছে একে একে, আমাকে কী বেছে নিতে বলো
ও ডানা, পুনরাগমন?

*গাণ্ডীব, জুন-আগস্ট ১৯৮৮


মৎস্যপুরাণ
........
আবার এসেছো যদি মর্মব্যথা নয়, কোনো ঘৃণা
তোমাকে দেব না, তিমি, গর্ভপালিতার
মতন রেখেছ পেটে, যদিও গনগনে তীব্র ক্ষার
দিয়েছে শরীর দগ্ধ করে
ঝাপসা অতীতের কথা আজো ভাবো কিনা
জানতেও চাইব না, এই দগ্ধদেহ কুষ্ঠদেহ নিয়ে জনে জনে
করেছি তোমারই খোঁজ। শ্বাসরুদ্ধ মাতাল সাগরে
আমাকে আশ্রয় দিলে, এরই গর্বে বৎসরে দুমাস রেখো মনে

*গাণ্ডীব, জুন-আগস্ট ১৯৮৮


অন্নপ্রাশন
...........
মড়াটানা চৌকিতে ভরে উঠছে অন্নপ্রাশনের দিন
পা পেঁচিয়ে গরুর হুমরি খাচ্ছে এদের শিশু ওদের শিশু

বস্তুত খালি খামই পোস্ট হয়েছে ক্রমাগত ভুল ঠিকানায়

গভীর জ্যোৎস্না
তাতে জটিল হয়ে পড়ল কথাবার্তা, মুখ-দেখাদেখি
মফস্বল থেকে কলকলিয়ে আসছে বেশ্যারা
মাজারে তাদের মানত, সন্তানভাগ্যের
যেন নিজেরই কাঁধে ঝাঁপিয়ে পড়ছে সবাই রেলিং থেকে

ধোঁয়াবাগানের মধ্যে গান গাইছে স্কুলছাত্রীরা ভর সন্ধ্যেবেলা
টেনে আনছে শঙ্কর শঙ্কর

বাতিল কাগজে পূর্ণ হয়ে গেছে আমাদের বৈঠকখানা
শুধু গত মেলায় মুখোশ কিনে উপহার দিয়েছি বন্ধুদের
বুদ্ধপূর্ণিমায় শানিয়েছি ধর্মনিরপেক্ষতার চাকু

আসলে মরা চোখ থেকেই ঠিকরে পড়ছে অতর্কিত দ্যুতি
যেমন হেস্টিংসের ভূত চলে যেতে
‘বাঙ্গালা মা, বাঙ্গালা মা’ কেঁদেছিল নীল কৃষকেরা

*গাণ্ডীব, জুন-আগস্ট ১৯৮৮


ঘোড়া
.....
ঘন রাত, আর শুধু ডানাহীন ওড়া
গাণ্ডীব, নভেম্বর ১৯৮৭

ছুরিচিকিৎসা
কেটে নেয়া মাথা, রক্তের ফোঁটা,
পিরিচে দুচোখ নড়েচড়ে উঠে
দ্যাখে চুপচাপ: দুফাঁক যোনির
ভেতরে সাপের মোচড়ানো লেজ,
গহ্বরে ছোটা। রাত, সাবধান!
ঘুমের মধ্যে অস্ত্রোপাচার-
পোড়া ছাই, ধার অস্ত্রের ফলা,
সুতো, যকৃৎ; সুনসান ফাঁকা:
ছুরি... ‘চুপ করো’... ছুরি... চিৎকার...
শবাধারে চিৎ, ছুরিচিকিৎসা।
অদৃশ্য যাঁর শেষ রাত্তিরে
আসবেন তিনি; ততক্ষণ আমি
দেখি বুক চিরে, তুমি তো কখনো
আস্ত ছিলে না।’ আলগা শরীর
চান্দ্র হলুদে কেউ নয় চেনা
হাজার ঘোড়ার দামামা পিটছে
আবহবাতাস... মাতাল গন্ধ...
আধো জাগা শব... দেহহীন ভার...
আর নীল লাল রূপালি নিরব।

*গাণ্ডীব, নভেম্বর ১৯৮৭


আত্মলীনা
......
যদিও থাকে একলা ভিড়ে সারাটা বেলা ঘরে
তবুও তার তরল বুকে আকাশ ঝরে পড়ে

মাদুরে বসে আদুরে মেয়ে ব্যথার ভঙ্গিতে
অসহ জল নেয় কেবল এবং তার ধার
স্রোতস্বিনী ভাবনা থেকে শ্যামল কচি চিতে
তপ্ত নদী উথলে ওঠে শীতল দেহে তার

চিরুনি রাখে সংবেদনে, আয়না অন্তরে
সন্ধ্যেবেলা পৌরুষের গন্ধে তার মন
ছটফটালে কেউ জানে না কেন অচেনা স্বরে
কাকে যে ডাকে, ডেকেই চলে, হৃদয় উচাটন

তরুণ বুকে দীঘল বেনী তীক্ষ্ণ ছেনি হানে
কিন্তু তার ব্যাথার ভার নির্বিকার থাকে
যদি সে নিজ অতীত আর ভবিষ্যত জানে
এখনি ডেকে আনুক তার স্মৃতির হন্তাকে

কেন সে থাকে একলা ভিড়ে সারাটা বেলা ঘরে
যেখানে তার তরল বুকে আকাশ ঝরে পড়ে

*সংবেদ

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন