রবিবার, ৩০ আগস্ট, ২০০৯

গ্রামের মহিলাদের কোন বন্ধু নেই

কাবেরী গায়েন

“The interests of rulers require that their subjects should be poor in spirit, and that should be no strong bond of friendship or society among them, which love, above all other motives, is likely to inspire, as our Athenian tyrants learned by experience; for the love of Aristogeiton and the consistency of Harmodius had a strength which undid their power.” (Plato, Symposium)

মেয়েতে-মেয়েতে নিখাদ বন্ধুত্বের বর্ণনা বাংলা সাহিত্যে ঠিক কী পরিমাণে আছে, মনে করতে পারি না। অগত্যা ঘুরে-ফিরে আবারও সেই রবীন্দ্রনাথে এসে থামে আমার মধ্যবিত্ত নাগরিক মন-“ওলো সই, আমারও ইচ্ছে করে তোদের মতো মনের কথা কই।” ছড়িয়ে দিয়ে পা দু’খানি এই সইরা কোণে বসে কানাকানি করেছিলেন বা কভু হেসে কভু কেঁদে মনের কথা বলেছিলেন যদিবা জানা যায় রবীন্দ্রনাথের জবানিতে কিন্তু তারা কি সই ছিলেন, না কি নেহাতই আত্মীয়-বান্ধব ছিলেন সেই তথ্য উদ্ধার আজ বুঝি আর সম্ভব না। আর সম্ভব হলেই বা কী, সে তো জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির কথা। নজরুলের গানে ভালো করে বিনোদ বেণী বেঁধে দেবার আকুতি আছে সই-এর কাছে যেন প্রেমিক তার বিনুনীর ফাঁদে বাঁধা থাকে। এর বাইরে কিছু সই সম্পর্ক আমরা পাই বই কি, যেমন ‘চোখের বালি’, ‘গঙ্গা জল’, কিন্তু একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে এই সম্পর্ক শুরু হয়েছে বিয়ে সূত্রে পাওয়া নতুন পরিচয়কে কেন্দ্র করেই। আর সম্পর্কের নামকরণগুলোও সার্থক বটে, বলিহারি বাংলা ভাষার রস, সইয়ে সইয়ে সম্পর্ক হলো ‘চোখের বালি’ আর জায়া ও পতি হলো ‘দম্পতি’, দন্দ্ব সমাস। বাংলার রূপকথায় বেকার রাজপুত্র-মন্ত্রীপুত্র-কোটালপুত্রের অক্ষয় বন্ধুত্ব, তাঁরা বনে যান, রাজকন্যা আর অর্ধেক রাজত্ব শিকার করে চারদিক উজল করতে করতে ঘরে ফেরেন, জয় তাঁদের বন্ধুত্বের জয়। রাজকন্যাদের কোন বন্ধু নেই কেন দাসী ছাড়া ? আশ্চর্য, রাজকন্যা বা মহারানীকারোর কোন সই নেই, তাঁরা সদাই সচেষ্ট রাজপুত্র-মহারাজের মন জোগাতে আর বেচারী রাক্ষসী তো রাজপুত্রদের সাথে যুদ্ধে যুদ্ধেই নিঃস্ব, ক্লান্ত কিংবা মৃত। সই পাতানোর সময় কোথায় তাদের ? গল্প-উপন্যাসেও পুরুষে-পুরুষে বন্ধুত্ব বিস্তর, শ্রীকান্ত-ইন্দ্রনাথ, মহিম-সুরেশ, মহেন্দ্র-বিহারীলাল, নিখিলেশ-সন্দ্বীপ, যোগেন্দ্র-রমেশ, গোরা-বিনয়, শচীন-শ্রীবিলাস...কিন্তু সেই অর্থে মেয়েদের মধ্যকার বন্ধুত্ব নিয়ে তেমন কালোত্তীর্ণ কাহিনী কি আছে আসলে? এক বঙ্কিমের Rajmohon’s Wife-এর রাজমোহনের স্ত্রী তথা মাতঙ্গিনীর সাথে কুলিন মেয়ে কনকের বন্ধুত্বকে বাদ দিলে সংশপ্তক-এ রাবেয়া আর রানুর মধ্যে বন্ধুত্বের উল্লেখ পাওয়া যায় কিন্তু গোটা উপন্যাসে ক’বারই বা দেখা হয়েছে তাদের ? তাও তো সে যোগাযোগের মধ্যস্থতাকারী বালক মালু। এরকম বিচ্ছিন্ন এবং আরোপিত এক-আধটা কাহিনী বাদ দিলে মেয়েদের সত্যিকারের বন্ধুত্ব নিয়ে সাহিত্য কোথায় ? তাহলে কি মেয়েতে মেয়েতে বন্ধুত্ব কখনো ছিলোই না, না কি মেয়েরা বিয়ে সূত্রে পাওয়া সম্পর্ক কাঠামোতে এতই নিয়তি-নির্দিষ্টভাবে আবদ্ধ যে বন্ধুত্বের মতো অকেজো সম্পর্কের ভারে তাদের আর পীড়িত করতে চাননি কেউ। যে বয়সে দক্ষিণারঞ্জন মিত্রমজুমদারের রাখাল আর রাজপুত্র পরস্পরের বন্ধুত্বটানে বটবৃক্ষের তলে সমবেত হন, রাখালপুত্র বাঁশি বাজান আর রাজপুত্র শোনেন সে বয়সে রাখালকন্যা হয়তো কয়েক সন্তানের মা হয়ে শাকচুন্নি-গেছোপেতœীর রূপ ধরে প্রায় শাশুড়ি হবার পথে, আর রাজকন্যা শত্র“পূরীতে ঘুমে অচেতন রাজপুত্রের দাক্ষিণ্যে উদ্ধার হবার আকাক্সক্ষায় অথবা রাজমহিষী হয়ে দুয়োরানী, ন’রানী, কনে রানীর সাথে সন্তান কামনায় সন্ন্যাসীর দেয়া শেকড় বাঁটছেন। শেকড় বাঁটা ভাগে পেলে ফুটফুটে রাজপুত্রের (রাজকন্যার নয়) মা হচ্ছেন, আর ভাগে না পেলে শিল-নোড়া ধোয়া জল খেয়ে বানর বা পেঁচা জন্ম দিয়ে রাজপ্রহরীর গলা ধাক্কায় ছিটকে পড়ছেন ছাইগাদার ওপারে। এইসব দিন পালটেছে নিশ্চয়ই। অন্তত শহরে। মেয়েরা এখন পড়ছেন, চাকরি করছেন, বন্ধুত্ব তাদের শুধু মেয়েদের সাথেই নয়, ধারণা করি ছেলেদের সাথেও। সেসব বন্ধুত্ব বিয়ের আগ পর্যন্তই বুঝি, খুব কম মেয়েই হয়তো সে সম্পর্ক বিয়ে পরবর্তী জীবনেও টেনে নিতে পারেন। ‘হয়তো’ বলছি সতর্কতা থেকে, যেহেতু কোন গবেষণা এ’বিষয়ে এখনো চোখে পড়েনি। তবুও জীবনের একটি পর্যায়ে তারা বন্ধুত্ব তো পাচ্ছেন ! কিন্তু এই পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে কি আমাদের গ্রামেও ? কত ‘উন্নয়ন কর্মকাণ্ড’ গ্রামকে ঘিরে, কতশত উন্নয়ন সংস্থার বিস্তার, নারীর ক্ষমতায়ন আর ক্ষুদ্রঋণ, দশক ওয়ারী উন্নয়ন সূচক...পরিবর্তন হয়েছে কিছুটা নিশ্চয়ই গ্রামের মহিলাদের, অন্তত ভাবতে ইচ্ছে করে। এই পরিবর্তনের পটভূমিতে কেমন সম্পর্ক কাঠামোতে বাঁধা আমাদের গ্রামের মেয়েরা ? কিংবা গ্রামে কি কোন মহিলা বাস করেন মা, ছেলের বউ, ননদ, জা, শাশুড়ি এসব সম্পর্কের বাইরে ? আছে কি কোন বিয়ে-নিরপেক্ষ সম্পর্ক ? বালিকার খোলস ছাড়তে না ছাড়তেই তো বিয়ে আর ভিনগাঁয়ে পারাপার, তারপর কেমন তাদের সম্পর্ক কাঠামো, তারই খানিকটা আভাস পাওয়ার একটি প্রয়াস হিসেবে দেখা যেতে পারে এই কাজটিকে। বলে নেয়া ভালো কেবল এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই গবেষণাটি করা হয়নি বরং Modelling the Influence of Communications on Fertility Behaviour of Women in Rural Bangladesh শীর্ষক আমার পিএইচডি গবেষণার তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে গ্রামের মহিলাদের সম্পর্ক কাঠামোর মুখোমুখি হই, উন্মোচিত হয় এক ‘জানা’ জগতের ‘অজানা’ কাহিনী, গ্রামের মহিলাদের কোন বন্ধু নেই।

গবেষণা পদ্ধতি
..........
বাংলাদেশের ছয়টি বিভাগ থেকে ছয়টি গ্রাম বেছে নেয়া হয়েছে। গ্রামগুলো হলো ঃ চৈতন্যপুর (রাজশাহী বিভাগ), বলাইনগর (ঢাকা বিভাগ), ব্রাহ্মণশাসন (সিলেট বিভাগ), জোবরা (চট্টগ্রাম বিভাগ), রায়ের কাঠি (বরিশাল বিভাগ), এবং পয়গ্রাম (খুলনা বিভাগ)। একটি গ্রাম বাড়তি নেয়া হয়েছে, যে গ্রামের বেশীর ভাগ মানুষ হিন্দু ধর্মাবলম্বী, ধর্মভিত্তিক সাংস্কৃতিক পার্থক্য কিছু আছে কী না দেখার জন্য। গ্রামটি হলো দিনাজপুর জেলার মহুগাঁও। এছাড়াও বন্ধু ও সহকর্মী শাতিল সিরাজ (সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়) জয়পুর হাট জেলার আক্কেলপুর মিউনিসিপ্যালিটির পুরাতন বাজার মহল্লা থেকে পাইলট সার্ভে করে দিয়েছিলেন ৩০ জন মহিলার সাক্ষাতকার নিয়ে।

গ্রামের মহিলা (মেয়েরা যে কত বয়সে মহিলা হন আসলে !), যাঁদের বয়স ১৪ থেকে ৪৯ বছরের মধ্যে, এইসব মহিলাদের মুখোমুখি সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছে। গ্রামের প্রতিটি বাড়ি থেকে অন্তত একজন মহিলার সাথে কথা বলা হয়েছে। ফলে যোগাযোগ নেটওয়ার্কের ম্যাট্রিক্স যখন তৈরী করা হয়েছে, তখন প্রতিটি বাড়ির প্রতিনিধিত্বকারী অন্তত একজন সেখানে রয়েছেন।
যদিও মূল গবেষণায় রীতিমতো ছকে বাধা প্রশ্নপত্র ধরে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে, তবে এই লেখায় গ্রামে থেকে গ্রামের মহিলাদের সাথে আলাপ, পর্যবেক্ষণ এবং মাঠ জার্ণালের টোকাও ((field journal accounts) ) তথ্যসূত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে, বিশেষ করে পাওয়া তথ্যের অর্থ (meaning) নিরূপণের ক্ষেত্রে এবং ফলাফল ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে আলাপ এবং টোকার বিস্তর সাহায্য নেয়া হয়েছে গুণগত ব্যাখ্যার জন্য।
আগস্ট ২০০২ থেকে জানুয়ারী ২০০৩ পর্যন্ত মাঠে কাজ করে মোট ৭২৪ জন মহিলার আন্তঃব্যক্তিক যোগাযোগ নেটওয়ার্কের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। মূল গবেষণার প্রয়োজনে যদিও বিবাহিত মহিলাদেরই সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছে নির্দিষ্টভাবে, তবে তথ্য সংগ্রহের শুরুতেই প্রথম গ্রাম অর্থাৎ রাজশাহী বিভাগের চাঁপাই নববাগঞ্জ জেলার ধাইনগর ইউনিয়নের চৈতন্যপুর গ্রামে কাজ করতে গিয়ে কয়েক বাড়ির তথ্য সংগ্রহ করতেই কৌতূহলী হয়ে পড়ি অবিবাহিত মেয়েদের অবস্থাটাও যাচাই করতে। শুরু হয় ডায়েরীতে নোট নেওয়ার পালা। ১৪ থেকে ৪৯ বৎসর বয়সী অবিবাহিত মেয়ের সংখ্যা খুব বেশী নেই। সাত গ্রাম মিলিয়ে সাকুল্যে ৩৭ জনকে জিজ্ঞেস করা সম্ভব হয়েছে।
এই কাজে আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্কের বাইরে যে-কোন সামাজিক গবেষণার মতই কিছু ব্যক্তিগত প্রাথমিক তথ্য এবং আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও দৈনন্দিন খবরাখবর আদান-প্রদানের তথ্যও বিশ্লেষণ করা হয়েছে এসব মহিলার যোগাযোগ আবহ সম্পর্কে (ঈড়সসঁহরপধঃরড়হ ঊহারৎড়হসবহঃ) খানিকটা ধারণা নেয়ার জন্য।
তথ্য সংগ্রহের কাজে আমাকে সাহায্য করেছেন বিভিন্ন পেশার মোট ৪৩ জন, ৬ থেকে ৭ জন প্রতি এলাকায়। রাজশাহী বিভাগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ বিভাগের শিক্ষক শাতিল সিরাজ শুভ আর ৬ জন ছাত্র তথ্য সংগ্রহকারী দলে কাজ করেছেন। পরে চৈতন্যপুর গ্রামের পরিবার পরিকল্পনার মাঠকর্মী আনোয়ারা বেগম এবং গ্রাম্য দাই রাহেলা বেগম যুক্ত হয়ে পড়েন এই দলে। এছাড়াও টীমের সদস্য গণযোগোযোগ বিভাগের ছাত্র বেনাউল ইসলামের বাড়িতে থেকে এই গ্রামে কাজ করা হয়েছে ফলে বেনাউলের বোন, স্থানীয় কলেজছাত্রী নুরুন্নাহার কেয়া জুটে যান এই দলে। সিলেট বিভাগে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ব বিভাগের ছাত্র-ছাত্রীরা তথ্য সংগ্রহ করেছেন। চট্টগ্রাম বিভাগের টীমে ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের ছাত্র-ছাত্রীরা। বরিশাল বিভাগে কাজ করেছেন পিরোজপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিসারের নেতৃত্বে পিরোজপুর সরকারী কলেজের দুজ’ন ছাত্রী, একজন শিক্ষক এবং ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক, স্থানীয় এনজিও সকলের জন্য করি’র কয়েকেজন কর্মকর্তা, সাংস্কৃতিক সংগঠন উদীচীর একজন সদস্য, একজন গৃহবধূ, এবং প্রাক্তন জমিদার ও বর্তমানে সমাজকর্মী গৌরাঙ্গ রায় চৌধুরী। খুলনা বিভাগের দলে ছিলেন মূলত পয়গ্রামের বাসিন্দারাফুলতলা কলেজের বাংলার প্রভাষক, পত্রিকা হকার, প্রাক্তন ভধি, ফুলতলা কলেজের দু’জন ছাত্র, সরকারী বি.এল. কলেজের অনার্স ছাত্রী। ঢাকা বিভাগের টীমে কাজ করেছেন একেবারেই ভিন্ন ধরনের পেশার মানুষেরানাগরপুর ইউনিয়ন পরিষদের একজন সদস্য, নাগরপুর আলিয়া মাদ্রাসার একজন শিক্ষক, দু’জন গৃহবধূ এবং একজন মৌমাছি পালক। মহুগ্রামে তথ্য সংগ্রহ করেছেন সৌমেন দাস আর রওনক ফেরদৌস স্থানীয় মানুষের সাহায্য নিয়ে, তাঁরা ইতিমধ্যেই হাত পাকিয়েছেন চৈতন্যপুরে কাজ করে।
প্রথমত যেহেতু প্রত্যন্ত গ্রামে থাকার ভালো কোন ব্যবস্থা নেই এবং দ্বিতীয়ত যে গ্রামে কাজ করা হবে সেই গ্রামের কোন প্রতিপত্তিশালী বা সম্মানিত কারো বাড়িতে থেকে তাঁদের মাধ্যমে পরিচিত না হলে গ্রামে ঢুকে গ্রামের মহিলাদের সাথে কথা বলা যাবে না, এই দুই বিবেচনা থেকে যে-সব এলাকায় পরিচিতজন আছেন তাঁদের আতিথেয়তার উপর নির্ভর করতে হয়েছে এবং বাংলাদেশে এখনো ‘অতিথি নারায়ণ সেবা’ চলে বলেই কোন অসুবিধা কোথাও হয়নি। রাজশাহীর চাঁপাই নবাবগঞ্জে বেনাউলদের বাড়ি অর্থৎ মেম্বার বাড়ি, বরিশালে পিরোজপুরের জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিসার কুলদানন্দ রায়ের সরকারি বাসভবন, চট্টগ্রামে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক বন্ধু আতিকুর রহমানের ফ্ল্যাট, সিলেটে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক অবন্তী হারুনের মেসভবন, খুলনায় বন্ধু আনন্দময়ী মজুমদারের আত্মীয় বাগেরহাট পি.সি. কলেজের দুই অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক মুক্তি মজুমদার ও মোহাম্মদ কায়কোবাদ-এর পয়গ্রামের বাড়ি আরণ্যক, আর ঢাকায় টাঙ্গাইল জেলার গয়াহাটা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবুল হোসেন চেয়ারম্যানবাড়ি ছিলো আমার থাকার আর কাজ চালানোর অফিস। এঁরা শুধু আমার থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাই করেননি বরং পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন স্থানীয় মহিলাদের সাথে, জুটিয়ে দিয়েছেন তথ্য সংগ্রহকারী দলের সদস্যদের। কাজেই যাঁরা তথ্য সংগ্রহ করেছেন আর যাঁরা সবকিছুর বন্দোবস্ত করে দিয়েছেন, তাঁদের কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। বরং বলে নেয়া ভালো এটি একটি যৌথ কাজ এবং এঁরা প্রত্যেকেই আমার সহলেখক।



কিছু প্রাথমিক তথ্য [যোগাযোগ আবহ]
.........................
মূল গবেষণায় যে মহিলাদের সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছে তাঁদের গড় বয়স ২৮ বছরের একটু বেশী। গড় বিয়ের বয়স সাড়ে পনের বছর, প্রথম বাচ্চার জন্ম দিয়েছেন গড়ে সাড়ে সতের বছর বয়সে আর তাঁদের স্বামীরা গড়ে তাদের চেয়ে প্রায় দশ বছরের বড়, সাড়ে ৩৭ বছর। এসব মহিলারা এইসব গ্রামে বসবাস করছেন প্রায় সাড়ে বারো বছর ধরে। একেবারে পাকা হিসেব, সাড়ে পনের বছরে বিয়ে + সাড়ে বারো বছর ধরে স্বামীর গ্রামে বসবাস, কাজেই গড় বয়স ২৮ বৎসরের একটু বেশী। এসব মহিলাদের ৪২ শতাংশ কখনো স্কুলে যাননি, যাঁরা গিয়েছেন তাঁদের ১৫.৮ শতাংশ প্রাইমারী পার করেছেন, ২.৪ শতাংশ কলেজে গেছেন আর মাত্র ১.৪ শতাংশ ডিগ্রি পর্যায়ে পৌঁছুতে পেরেছেন। যদিও ৫৮ শতাংশ মহিলা স্কুলে গিয়েছেন জীবনের কোন একটা সময়ে কিন্তু শতকরা ৪৯ জন বাংলায় লেখা কোন চিঠি পড়তে বা লিখতে পারেন না। তাঁদের স্বামীদের বিদ্যা-বুদ্ধির দৌড়ও তেমন চমকপ্রদ নয়। গড়ে ৩২.২ জন কখনোই কোন স্কুলে যাননি অর্থাৎ স্কুলে যাওয়ার ক্ষেত্রে স্বামীরা স্ত্রীদের চেয়ে মাত্র ৯.৪ শতাংশ বেশী। এক দুর্মুখ তথ্য সংগ্রহকারী ফোড়ন কাটলেন যে মেয়েরা স্কুলে গেলে গম পায় সেজন্যই নাকি প্রাইমারিতে ছেলে-মেয়ের ব্যবধান তত বেশী নয়। কথাটা হয়তো সত্যি, প্রাইমারীর পরে মেয়েদের আর দেখা পাওয়া যায় না, বাড়তে থাকে ছেলে-মেয়ের স্কুল উপস্থিতির বৈষম্য। ৯২.৭ শতাংশ মহিলা নিজেদেরকে গৃহবধূ বলে দাবি করেছেন, ২.৮ শতাংশ কুটির শিল্প বা কারখানায় কাজ করেন। ২.৩ শতাংশ চাকুরী করছেন, ০.৭ শতাংশ কৃষিকাজে নিয়োজিত আর ১.৫ জন নিয়োজিত কাঁথা সেলাই, মাদুর তৈরী, তালপাতার হাতপাখা বানানো, ধনী লোকের বাড়িতে ঝি-গিরি, বা রাস্তা নির্মাণ কাজে দিনমজুরিতে। এঁদের স্বামীদের পেশা মূলত কৃষিকাজ, ৩৩.৮ শতাংশ, বেশীরভাগই অন্যের জমিতে দিনমজুরি করেন বা বর্গা খাটেন। এছাড়াও শতকরা ২৪.৪ জন ছোটখাটো ব্যবসা, ১৩ জন ড্রাইভিং, ১০.২ জন চাকুরী আর ১০.১ জন দিনমজুরের কাজ করেন। শতকরা ৪০ জন মহিলা এনজিও-র ক্ষুদ্র ঝণ প্রকল্পে জড়িত। যদিও এসব মহিলারা নানাধরনের কাজের মধ্য দিয়ে পরিবারের আয় বাড়াচ্ছেন কিন্তু তাঁরা নিজেরা মনে করেন না যে বাড়ির আয়ে তাঁদের কোন অংশভাগ আছে। এই মহিলাদের দৈনন্দিন খবরাখবর জানার মাধ্যম হলো প্রথমত তাঁদের স্বামীরা যাঁরা হাটে-বাজারে, অফিসে-মাঠে যান, তারপর “মাইনষের মুহে মুহে”। ৬৪ শতাংশ মহিলা জানিয়েছেন তাঁদের একাকী চলাচলের স্বাধীনতা নেই, যদিও মহুগাঁও-এর (হিন্দু গ্রাম) অবস্থা একটু ভিন্ন। শতকরা ৮৬.৪ জন মহিলা দাবী করেছেন যে তাঁরা নিজেরাই চলাচল করতে পারেন। শতকরা ৫৩ জন মহিলা জানিয়েছেন এমনকি ঘর-গেরস্থলির কাজ বা কী রান্না করবেন বা ছেলেমেয়েকে ভালোমন্দ কিছু কিনে দেবেন কী দেবেন না এ-জাতীয় কোন বিষয়েই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা তাঁদের নেই। সবধরনের সিদ্ধান্ত নেন প্রথমত তাঁদের স্বামীরা, তারপর শাশুড়ি, শ্বশুর বা শ্বশুর বাড়ির অন্যান্য আত্মীয়স্বজন। গড়ে প্রত্যেকের বাচ্চা রয়েছে ২.৬৪ জন এবং প্রত্যেকেরই রয়েছে আরো ছেলের আকাক্সক্ষা, মেয়ের তুলনায় ছেলের আকাক্সক্ষা প্রায় তিনগুণ বেশি। এই আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবেশে, কিংবা বলা ভালো এই যোগাযোগ আবহে মহিলাদের আন্তঃব্যক্তিক যোগাযোগ কাঠামোর সুলুক-সন্ধান করা হয়েছে।

প্রশ্ন: পাঁচজন বন্ধুর নাম বলুন
প্রত্যেক মহিলাকে বলা হয়েছিল পাঁচজন মানুষের নাম বলতে যাঁদের সাথে তাঁরা নিয়মিত সুখ-দুঃখের কথা (পেটের কথা) বলেন, যাঁদের মতামত তাঁদের কাছে গুরুত্বপুর্ণ এবং সবচেয়ে বড় কথা যাঁদেরকে তাঁরা বন্ধু/সই মনে করেন। তাঁরা পুরুষ বা মহিলা যে কেউ-ই হতে পারেন।
প্রত্যেক বন্ধুর জন্য আরো যে সহযোগী প্রশ্নগুলো করা হয়েছিলো সেগুলো হচ্ছে ঃ
১. সম্পর্কের ধরণ ঃ বন্ধু □ সহকর্মী □ আত্মীয় □ মুরুব্বি □ অন্যান্য
২. কতদিন ধরে চেনেন ঃ ৩ মাসের কম □ ৬ মাস -১ বছর □ ১-২ বছর □ ৩-৫ বছর □ ৫ বছরের বেশী □ অন্যান্য □
৩. কত ঘন ঘন দেখা হয় ঃ প্রত্যেকদিন □ সপ্তাহে অন্তত একবার □ মাসে অন্তত একবার □ অন্যান্য □
৪. যোগাযোগের মাধ্যম ঃ মুখোমুখি □ চিঠি □ টেলিফোন □ অন্যান্য □
৫. কোথায় থাকেন এই বন্ধু ঃ একই বাড়ি □ একই পাড়া □ একই গ্রাম □ একই শহর □ নিকটবর্তী গ্রাম/শহর □
অন্যান্য □
৬. দেখা করার জায়গা ঃ কাজের স্থান □ একে অপরের বাড়ি যাই □ কোন সামাজিক বা সাংস্কৃতিক সংগঠন □
বাড়ি □ অন্য কোন জায়গা □
৭. আপনার দৈনন্দিন সমস্যায় তথ্য পরামর্শের জন্য কি এর কাছে যান ?
কখনোই না □ মাঝেমধ্যে □ প্রায়ই □ সবসময় □
৮. বিভিন্ন ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে কি এই ব্যক্তির কোন প্রভাব থাকে ?
কখনোই না □ মাঝেমধ্যে □ প্রায়ই □ সবসময় □

চৈতন্যপুর ঃ ‘কোন সই নাই কা’
.......................
চাঁপাই নবাবগঞ্জ জেলার ধাইনগর ইউনিয়নের চৈতন্যপুর গ্রাম। কৃষিই মুল জীবিকা। দুই ধরনের মানুষের বসবাস এই গ্রামে। এক যাঁরা প্রচুর জমির মালিক, টাকা খাটান আম আর আখের চাষে। এঁদের সংখ্যা কম। বাকীরা হলেন যাঁরা কামলা খাটেন এইসব আম আর আখের ক্ষেতে। রয়েছেন কিছু স্কুল শিক্ষক, ছোট দোকানদার, চাকুরে। মাদ্রাসা আর মসজিদ রয়েছে বেশ জোরেসোরে। কিছু এনজিও কাজকর্মও রয়েছে। মহানন্দা নদীর যে-পাড়ে চাঁপাই নবাবগঞ্জ শহর, তার ঠিক অন্য পাড়ে এই গ্রাম। ছোট লঞ্চ বা বড় নৌকায় চাঁপাই নবাবগঞ্জের সাথে এই গ্রামের যোগাযোগ।
চৈতন্যপুরে প্রথম যে বাড়িটায় আমরা ঢুকেছি সেই বাড়ির গৃহকত্রী (৩৮) জানালেন সাফ কথা,
কোন সই নাই কা। বাড়ির বউ-ছেল্যার আবার সই থাকবে ক্যানরে ব্যাটা ? আমরা ওই রকম মাইয়্যা-ছেল্যা না। আমরা স্বামীর সাথে কথা ব্যুলি, তার বাদে শাউড়ি আছে, জাল আছে। কাম কুর‌্যাই দিশা নাই আবার প্যাটের কথা, না না বেটি আমরা তেমুন মাইয়্যা-ছেল্যা না। আমাগের ইজ্জত আছে।
ঠিকই, সবারই ইজ্জত আছে এই গ্রামে। মহানন্দা নদীর পাড়ে এই অপূর্ব সুন্দর গ্রাম, কেউ এমনকি নদীতে জল আনতে যাওয়ার কথাও স্বীকার করতে চান না।
আল্লায় চাহে তো আমাদের বাড়ির পারাই টিপ কল আছে। নদীত যাত্যে হবে ক্যান্ ? আমাদের বিটি ছ্যালারা ঘোরাঘুরি কেহই ক্যরে না। স্বামী পছন্দ করে না ব্যাট্যা।
এই গ্রামেই হিন্দুপাড়া হলো কামারপাড়া-অবশ্য বর্ধিষ্ণু কাজিবাড়ির লোকেরা দাবি করছেন পাড়ার নাম কাজিপাড়া, বেশ চাপা কলহও আছে এই নিয়ে। বেনাউলের বোন কেয়া কাজি বাড়িতে বসে জোর দিয়ে বললেন এটা কামারপাড়া আর কাজিবাড়ির বউ জোর দিয়ে জানালেন এটা কাজিপাড়া, নতুন সাইনবোর্ডও টাঙানো হয়ে গেছে। কামারপাড়ার অবিবাহিত মেয়ে, কলেজ ছাত্রী রমা (১৭) [প্রকৃত নাম নয়] জানালেন কোন সই নাই তার। কলেজে যান মাটির দিকে মুখ করে আবার ফিরে আসেন নতমুখে।
মা রে, মায়েট্যো যতক্ষণ বাহিরে থাকে কাটা হয়্যা থাকি রে মা। একটা বিয়া-থা দিতে পারত্যুক যুদি ! ঘরের বাহির হত্যে দেই না কো মা... রমার মা’র কুন্ঠিত উত্তর।
কলেজেও যায় রমা সপ্তাহে একবারের বেশী না। কেয়া-রও প্রায় একই অবস্থা। সবাই বিয়ের প্রহর গুনছে। কলেজের বাইরে রমা কাজ করে মা-কাকী-ঠাকুরমা’র সাথে, বাবা-কাকাকে জোগালও দেয়।
কাজি বাড়ির তিন বউই জানালেন তাদের কোন ‘সই নাই ক্যা’। তাহলে কি এই গ্রামের বউরা-মেয়েরা কোন কথাই বলেন না কারো সাথে ? অবশ্যই বলেন। স্বামীর সাথে বলেন, শাশুড়ির সাথে বলেন, বলেন জা-ননদের সাথে। এক-এক বাড়ি-ভিত্তিক এক-এক পাড়া। আত্মীয়-স্বজনরাই আছেন চারপাশে। যাঁরা বিবাহিত বছরে এক-আধবার যান বাপের বাড়ি, ‘ব্যুনের সাথেই দেখা হয় না’, ছেলেবেলার সই-এর সাথে দেখা হওয়া তো অনেক দূরের কথা। ‘সইয়ের মুখ মনে নাই’ জানান আতোয়ারা বেগম। এই গ্রামের ৮৪ জন মহিলা যাদের কথা বলেছেন পেটের কথা বলার লোক হিসেবে তাদের ৭৮% জন হলেন জা, ১১% জন শাশুড়ি বা শাশুড়ি পদবাচ্য, বাকিরা ননদ বা বাড়ির উপর থাকা অন্য বউ-ঝি, কোন-না-কোন আত্মীয়। এঁদের সাথে দেখা হয় প্রতিদিন, বাড়িতেই দেখা হয়, মুখোমুখি দেখা হয়, প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে কথা হয়, বিভিন্ন বিপদে-আপদে পরামর্শও চান কিন্তু এক শাশুড়ি ছাড়া এইসব জা-দের খুব প্রভাব আছে কোন বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষেত্রে তেমন দাবি কেউই করেন না। সবার উপরে স্বামী।
মহানন্দা নদীর এক পাড়ে এই শ্বশুর বাড়ি, বাপের বাড়িতে যেতে হলে নদী পার হতে হয় প্রায় সবাইকেই। তবুও তাঁরা সকাল-সন্ধ্যায় ছোট লঞ্চের পারাপার দেখেন, এই পারাপার দেখার জন্য তাঁদের এমনকি নদী পর্যন্ত যেতে হয় না, বাড়ি থেকেই দেখা যায়। তাঁদের স্বামীরা ঘরে ফেরেন মাগরেবের আজানের পর, মাছ নিয়ে, ফল নিয়ে, শাকসব্জি নিয়ে, চিপ্সের প্যাকেট আর কোকাকোলার বোতল নিয়ে, আরেকপারের খবর নিয়ে। আর তাঁরা ব্যস্ত হয়ে পড়েন ঃ
“আপা, আইজ আর কথা বুলব না, সাইনঝ্যা হয়্যা গিলচে, কারুর সাথে কথা ব্যুলা পছন্দ করে না ...”
“কে? কে আইস্যাছে ঘরে?” স্বামীদের জোরালো আওয়াজ, আমাদের অগত্যা ফিরে আসতেই হয়।
আর তাই শুক্রবার কোন ভালো দিন নয় এসব মহিলাদের সাথে কথা বলার জন্য, পুরুষরা সব বাড়িতে থাকেন জুম্মার নামাজের পর। তবুও এই গ্রামেরই পরিবার পরিকল্পনা মাঠকর্মী আকতারা খাতুন, শরীরে-মাথায় সৌদি চাদর জড়ানো আকতারা খাতুন, জানান তার বন্ধু আছে স্বামীর বাইরেও। তিনি তিনজন পুরুষ মানুষের কথা বলেন, এরা সবাই চাকুরি করেন তার সাথে। জানালেন তাঁর স্বামীর মন-মানসিকতা খুবই উঁচু দরের, সে কিছু মনে করে না। পাড়া-পড়শির খোঁটাকে আমলে আনেন না তিনি। জানালেন পাঁচ-দশ বছর আগেও গ্রামে পর্দার এত ‘কড়াক্কড়’ ছিলো না, ‘বউ-বিটিরা বাহির হত্যে পারত্যুক’, এই পরিবর্তন কেনো হচ্ছে তিনি নিজেও ঠিক জানেন না। এনজিও কার্যক্রম আছে গ্রামে কিন্তু ক্ষুদ্রঝণ বাড়ি বাড়ি এসে দিয়ে যাওয়া হয়, নিয়েও যাওয়া হয় বাড়ি থেকে কাজেই বউ-ঝিদের ‘ইজ্জত’ নষ্ট হয় না অন্য পাড়ায় গিয়ে।

রায়ের কাঠী: ‘মুই তো মুরুব্বি, মোরডে কেউ হাস-তামসাও করে না’
.............................................
পিরোজপুর জেলা সদর থেকে ৮ কিলোমিটারের মতো দূরে রায়ের কাঠি গ্রাম। গ্রামের আয় মূলত কৃষি। তবে কিছু পারিবারিক ব্যবসার চলও রয়েছে, যেমন কুমারের কাজ, তাঁতের কাজ আর মাছ-ধরা কিংবা জাল-বোনা। গ্রামটা সমৃদ্ধশালীই বলা চলে, বিশাল জমিদার বাড়ি, ফসলের মাঠ, স্কুল, আবার গ্রামের অবস্থানও শহরের কান ঘেঁষে। তবে এই গ্রামের দুটো পরিষ্কার অংশ, একদিকে পুরানো গ্রাম লাল ইটের প্রাক্তন জমিদার বাড়ি, মাঠ, মন্দির আর এই স্থাপনা ঘিরে গরীব হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বসবাস, অন্যদিকে নতুন বসতি, মসজিদ, মাদ্রাসা, হলুদ-নীলের নক্সাকাটা নতুন দালান-বাড়ি, সম্পদশালী মুসলমান জনগোষ্ঠীর বসবাস। তবে মাঝামাঝি জায়গায় কিছু নতুন ছোটখাটো আয়ের মানুষের ছোটছোট নতুন ঘরও দেখা যায়।
হিন্দু অংশে কুমার পাড়ার মহিলারা বড় ব্যস্ত। তাঁতি পাড়ায় তেমন একটা কাজ নেই, অভাব। জেলে পাড়ায় মাছ ধরার কাজ ততটা নেই, স্বামীরা দাওয়ায় ঝিমুচ্ছেন কিন্তু মহিলাদের হাত থামে না, জাল বুনে চলেছেন, ওটাই আয়ের পথ।
মারে, তের বচ্ছইরগ্যা বিয়া হইছে মোর, হেই থেইক্যা জালই বুনি। বাড়ির বাহির বা হমু কহন আর সই-বা পাতামু কহন। সব জালেরা মিলাই তো কাম করি। মোরা মাগো পাড়ার বাহির হই না। মোগো জালেরা (জা) আছে, হাউড়ি আছে, মোগো সই পাতাইনার সোমায়ও নাই।
আরতি রানীর জাল-বোনা চলতেই থাকে। তবে বড় পূজায় (দুর্গা পূজায়) একবার বাপের বাড়ি প্রায় সবাই-ই যান, নিদেন পক্ষে জমিদার বাড়ি। জমিদার গিন্নি ভালো মানুষ, বিপদে-আপদে সাহায্য করেন, পরামর্শ দেন কিন্তু না, জিহ্বায় কামড় দেন কুমার পাড়ার সবিতা রানী, “উনি গুরুজন, উনার লগে পেডের কথা বলি না।”

মুসলমান অংশে ঢুকতে সাহায্য করলেন এক মেয়ে, মর্জিনা বেগম, বড়-বাড়ির বোন, বেচারির মনে শান্তি নেই, স্বামী তার নতুন বিয়ে করেছেন অথচ কোলে তার ফুটফুটে ছেলে। ভাইদের বাড়িতে থাকেন, ছেলে কোলে নিয়ে তার মাঠে-ঘাটে চলতে বাধা নেই। তবুও তার কোন সই নেই। এই বাড়ির বউরা বেশ পর্দানশীন। কেউ বাড়ির বাইরে যান না। বাড়ির বড়-বউ বি.এ. পাশ কিন্তু তার কোথাও যাওয়ার ‘হুকুম নাই’। বেশ কাতর গলায় জানালেন ঃ
হ, আবার সই ! পুষ্করিণীতেই যাইতে পারি না, গোসলখানায় পানি দিয়া যায়, হেই পানিতে গোসল সারি। ফ্যামিলি প্ল্যানিং-এর মাইয়ারাও এই বাড়িতে ডোকতে পারে না। ... লণ্ডন কি খুব সুন্দার ? ... আর বউরা তো ছোড, মুই তো মুরুব্বি, মোরডে কেউ হাস-তামসাও করে না। ... মোর ছবি তো তোলতে পারবেন না, মোর মাইয়্যার এউক্ক্যা ফডো তোলেন। দোয়া করবেন আপা য্যেন মোর মাইয়াউগ্য একদিন আমনের মতো অইতে পারে, দ্যাশ-বিদ্যাশ যাইতে পারে।

এরই মধ্যে শাশুড়ি ঢোকেন, ছবি তোলার আয়োজন দেখে নিজেও বসে যান ফটো সেশনে যদিও দিব্যি দিয়ে দেন ছবি যেনো কেউ না দেখে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করেন বিত্তান্ত, কোথায় কোথায় যাওয়া হয়েছে আরো। জমিদার বাড়ির কথা শুনে মুখটা কালো হয়ে যায়। বড় বউ চোখ টিপে দেন যেনো আমার পরিচয় ফাঁস হয়ে না যায়, উঠে পড়ি, শাশুড়ি একটা ঠোঙায় কিছু আমলকি দিয়ে দেন।
সুলেখা বেগম [প্রকৃত নাম নয়] ট্রেনিংপ্রাপ্ত গ্রাম্য দাই। বয়স ৩৭। বিয়ে করেছেন ৬০ বছরের অবস্থাপন্ন এক লোককে। ঘরে সতীন আছে। সতীনের ছেলের বউরা তার বয়সী। তবে জমিজমা যেহেতু এখনো ভাগ হয়নি আর স্বামী যেহেতু তার ‘অঞ্চলে বান্ধা’ তিনি কারো তোয়াক্কা করেন না এবং হিন্দু-মুসলিম দুই পাড়াতেই তার যাতায়াত কিন্তু ঠিক নিশ্চিত নন তাঁর কোন সই আছে কি না যার সাথে তিনি মনের কথা বলেন।
প্রাক্তন জমিদার (যাঁরা ২৭ প্রজন্ম এই গ্রামে জমিদারি করেছেন এবং যাঁদের নামে এই গ্রামের নাম রায়ের কাঠি) গৌরাঙ্গ রায়ের স্ত্রী জানালেন তাঁর ‘বান্ধবী’ আছে, একই স্কুলে চাকরী করেন কিন্তু মনের কথা বলার কেউ নেই, এক স্বামী ছাড়া। ভাসুরপুত্রের বউ আছে বাড়িতে কিন্তু সে অনেক ছোট, কর্তব্যকর্মের বাইরে কোন আলাপ নেই।

এই গ্রামের ৯৮ জন মহিলার সম্পর্ক সূত্রের মধ্যে ৭৬% জা, ১২% শাশুড়ি-শাশুড়ি সম্পর্কিত, ৭.৬% বিধবা ননদ বা সতীন, ৩.২ % গ্রাম্য মুরুব্বি আর এক-আধজন বন্ধু-বান্ধব। ছেলে সন্তানের জন্য স্বামী যেনো অন্য বাড়িতে বিয়ে করে পর না হয়ে যায় শুধু সে-কারণেই এই গ্রামের দুই বোন এখন সতীন। আমেনা বেগম আপন ছোট বোন আরিফা বেগমকে বিয়ে দিয়েছেন স্বামীর সাথে। সুখ-দুঃখের কথা তারা বলেন বই কি !

পয়গ্রাম: ‘মহিলাগে সই থাকে নিকি, মেয়েগে থাকতি পারে’
....................................
খুলনা জেলার ফুলতলা ইউনিয়নের পয়গ্রাম। আর পাঁচটা গ্রামের মত হতে গিয়েও হতে পারেনি কয়েকজন মানুষের ওই গ্রামে অবস্থানের জন্য। গ্রামে ঢুকতেই প্রখ্যাত কথা সাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকের পৈতৃক বাড়ি, তাঁর ভাই সমাজকর্মী ইমদাদুল হক আনু থাকেন সে বাড়িতে। তারপরেই রয়েছে পি.সি. কলেজের সাবেক দুই অধ্যাপক মুক্তি মজুমদার আর মোহাম্মদ কায়কোবাদ দম্পতির বাড়ি আরণ্যক। শুরুতে এটি ছিলো দীনেশচন্দ্র সেন মহাশয়ের ছোট একটা ঘরসহ গাছ-লতায় ঘেরা এক বাগান। অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক বলে পরিচয় দিয়ে আসলে খুব অল্পই বোঝানো যায়। এই বাড়িতে মুক্তি মজুমদার গড়ে তুলেছেন এক নীরব সাংস্কৃতিক আন্দোলন। গ্রামের ছেলেমেয়েরা প্রতিদিন গান শেখে এখানে মুক্তি মজুমদারের কাছে, মহড়া নেয় কঠিন কঠিন সব রবীন্দ্র নাটকের। রীতিমত খাইয়ে-দাইয়ে, কখনোবা সন্দেশের প্রলোভন দিয়ে এ-সব ছেলেমেয়েকে দিয়ে অনুষ্ঠান করাচ্ছেন মুক্তি মজুমদার। যেসব ছেলেমেয়েরা ফুলতলার আঞ্চলিক টান ছাড়া কথা বলতে পারে না, পড়াশুনা শিখে উঠতে পারেনি এখনো তারাই দিব্যি ফাল্গুনী, তাসের দেশ, হ-য-ব-র-ল করছে। এখানে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েরা যেমন আছেন তেমনি আছেন পড়াশুনা তেমন-না-জানা মেয়েরাও। কিন্তু তারপরও এসব মেয়েরা কতটুকু বন্ধু আসলে পরস্পরের ? তানিয়া বি.এল. কলেজের ডিগ্রির ছাত্রী বা মুমু সমাজবিজ্ঞানে অনার্স পরীক্ষা দিচ্ছেন তখন। তারা গান-বাজনা করছেন ঠিকই কিন্তু ঠিক নিশ্চিত নন তাদের সেই অর্থে কেউ বন্ধু আছে কী না। কারণ কোন কাজ ছাড়া নাকি তারা ঘর থেকে বের হন না। গানের মহড়াটুকু দিয়েই বাড়ি ফিরে যান। কাজ ছাড়া সময় কাটানোর উপলক্ষ্য তাঁরা পান না।
বংলাদেশের অন্য পাঁচটা গ্রামের মতই পাড়ায় পাড়ায় বিভক্ত এই গ্রাম ঃ পাল পাড়া, ঋষি পাড়া, কুমার পাড়া, নিকেরী পাড়া, বরজীবী পাড়া, শালবন পাড়া, গাজী পাড়া, কাজী পাড়া। কাজী পাড়ায় যে কাজীরা থাকেন তারা সবাই একই পরিবারভুক্ত, খানা যদিও আলাদা। এই পাড়ার সব বউরাই পরস্পরের আত্মীয়, অবশ্যই বৈবাহিক সূত্রে। প্রতিদিন সকালে চোখ খুললেই পরস্পরের দেখা হয়, কাজের কথাও হয়, কিন্তু এরা পরস্পরের জা-ননদ-শাশুড়ি, কেমন যেনো এক চাপা টেনশন, ঠিক বন্ধু নয়। একই গল্প পাড়ায় পাড়ায়। পাল পাড়ার শোভা রানী পাল, যিনি তথ্য সংগ্রহকারী দলেরও একজন, একদিন বলে উঠলেন,

ওদ্দি, এই প্রশ্নডা বাদ দিলি ভালো হতো না ? মহিলাগে সই থাহে নিকি, মেয়েগে থাকতি পারে।
বিয়ে হয়ে গেলেই মেয়েরা মহিলা হয়ে যান, সই থাকাটা আর তখন ভালো কোন কাজ না। বি.এ.বি.টি.-পাশ এক ভদ্রমহিলা আসমা খাতুন, স্কুলে পড়ান, আমাদের কাজে খুবই সাহায্য করেছেন, বললেন,
বিয়ার পর নিজির বুনগির সাথেই ভালো যোগাযোগ নাই তো সই !

এই গ্রামে মোট ১৯৭ জন মহিলার সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছে। তাঁরা যাদের সাথে নিয়মিত কথা বলেন, দেখা হয় বলে জানিয়েছেন তারা হলেন মূলত জা (৮১%)। এছাড়াও শাশুড়ি-ননদ-বিধবা ননদ-সতীন। এক শাশুড়ির কথার প্রভাব খানিকটা আছে তাদের জীবনে বাকি সবার প্রভাব বলতে গেলে নেই। স্বামীই সব। তবুও ধান শুকাতে দিয়ে, কাঁথা নাড়তে গিয়ে, বাচ্চার পেট খারাপ হলে এদের সাথেই দেখা হয়, কথা হয়।

জোবরা: ‘আঁরা বারের মাইয়াফোয়ার লগে খঁতা না খই।’
....................................
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে বিখ্যাত গ্রাম জোবরা। গ্রামীণ ব্যাংক-খ্যাত জোবরা। বন্ধু আতিকুর রহমান যখন তথ্য সংগ্রহকারী দলের সাথে অর্থাৎ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে জানালেন যে জোবরা গ্রামকে বাছা হয়েছে কাজ করার জন্য, মনটা একটু দমেই গিয়েছিলো। ধরে নিয়েছিলাম এটা হবে একটা সাজানো গ্রাম, মহিলারা হবেন অনেক চৌকস, বন্ধু থাকবে তাদের অনেক যা হয়তো ঠিক বাংলাদেশের গ্রামকে প্রতিনিধিত্ব করবে না। কিন্তু টীমের সদস্য মের্শেদুল ইসলাম (এখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক) আশ্বস্ত করেছিলেন, “মিডিয়ায় যা দেখেন আর বাস্তবের মধ্যে অনেক ফারাক, হতাশ হবেন না ম্যাডাম, আর পাঁচটা গ্রামের সাথে এই গ্রামের খুব বেশী পার্থক্য নেই।” এই গ্রামের দুই অংশ। বড় এক মাঠ মাঝে থেকে ভাগ করে দিয়েছে এই দুই অংশকে। একপাশে বৌদ্ধ পাড়া, আরেকদিকে মুসলিম বসতি। আমরা কাজ করেছি মুসলিম অংশে। অন্যান্য গ্রামের সাথে এই গ্রামের প্রথম যে পার্থক্য চোখে পড়ে তা হলো বাড়িগুলো বেশ দূরে দুরে। কোন মহিলার কোন ছবি তোলা যায়নি এবং স্বামীর অনুমতি ছাড়া কথা বলতে কোন মহিলাই রাজী হননি। কাজেই আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে যেনো তাঁরা স্বামীদের অনুমতি নিয়ে রাখতে পারেন। পাঁচ বাড়ির মহিলাদের সাক্ষাৎকার শেষ পর্যন্ত নেয়া সম্ভব হয়নি কারণ তাঁদের স্বামীরা বিদেশে থাকেন এবং সপ্তাহে মাত্র একদিন তারা ফোন করেন কাজেই কোন কারণে মনে না থাকলে অনুমতি নেয়া আর হয়ে ওঠেনি। আরো একটি বিষয়, বলা বেশ ঝুঁকিপূর্ণই, মোট ৯৮টি বাড়ির মহিলাদের সাথে আমরা কথা বলেছি কিন্তু তাঁদের একজনও দাবি করেননি যে তাঁরা গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্য। তিনজন মহিলা ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্পের সাথে জড়িত কিন্তু সেগুলো স্থানীয় ইসলামিক এনজিও।
শুরুতে বন্ধু আছে কী না, প্রশ্নটাকে একধরনের অপমান হিসেবেই দেখেছেন মহিলারা। পরে টীমের সদস্য একই গ্রামের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী রুনু বুঝিয়ে বলেছেন সই মানে যে বাইরে থেকে থাকতে হবে এমন কোন কথা নেই, বাড়ির ভেতর যাদের সাথে তারা বেশী ‘মাতে’, ‘তারার’ নাম বললেই হবে। বাড়ির পর বাড়ি গিয়ে মনে হয়েছে বুঝি কেউ আগে থেকে শিখিয়ে দিয়েছেন সবাইকে একটা উত্তর আর পরীক্ষায় সেটি কমন পড়ে গেছে ঃ
আঁরা বারের মাইয়াফোয়ার লগে খঁতা না খই
অনেক বাড়ির স্বামীরাই যেহেতু বিদেশে চাকরী করেন কাজেই অর্থনৈতিক দিক থেকে এই মহিলারা বেশ সচ্ছল, ফলে অন্যান্য গ্রামের মত ভাসুর-দেবরদের পরিবারগুলোর সাথে সবসময় একসাথে থাকতে হয় না একই পাড়ায়। জা-দের সাথেও সম্পর্ক তাই নিত্যদিনকার নয়। তারপরও মুশকিল হলো যে-মহিলার স্বামী বিদেশ থাকেন তাকে আবার তক্কে তক্কে রাখেন অন্যান্য জা-রা। মহিলাকেও সমঝে চলতে হয়, নাহলে টেলিফোনে কোন বেফাঁস তথ্য দিয়ে দিলে তো আর রক্ষা নেই। এ-কারণেও মহিলারা একে অপরের কাছে মুখ খুলতে ভয় পান। শ্বাসরুদ্ধকর এই জীবনে খুব কম মহিলাই দুইজনের বেশী ‘পেটের-কথা-বলা’ মানুষের নাম করেছেন। তবুও যে ক’জনের নাম করা হয়েছে তারা সবাই-ই হয় জা, নয়তো শ্বশুরবাড়ির আত্মীয় সম্পর্কের কেউ। অবিবাহিত মেয়েদের সমস্যা আরো প্রকট। আসমা, জমিলা, নূরজাহান তিন জনের মা-ই জানিয়েছেন তাঁদের মেয়েদের স্বভাব-চরিত্র ভালো, কারো সাথে সই-য়ের সম্পর্ক নেই। বাড়ির বাইরে যেমন তারা যায় না তেমনি অন্য বাড়ির মেয়ের সাথে কথা বলে তার মেয়ে এমন অপবাদ নাকি যে দেবে তাদের জিহ্বা খসে যাবে। মেয়েদের বিয়ে দিতে পারলেই তারা মুক্তি পান। বলা দরকার আমরা এই অবিবাহিত মেয়েদের সাথে কথা বলার অনুমতি পাইনি।

ব্রাহ্মণ শাসন: ‘প্যাটর কী কতা কইতাম কার সাতে?’
.................................
সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ঠিক পিছনেই ব্রাহ্মণশাসন গ্রাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক কর্মচারী এই গ্রামে থাকেন। অর্থনৈতিক অবস্থার বিচারে গ্রামটির দুটো পরিষ্কার ভাগ রয়েছে। গ্রামের প্রকৃত বাসিন্দাদের অর্থনৈতিক অবস্থা বেশ ভালো। তাদের কারো রয়েছে আবাদী জমি, কেউ বা চাকরি করেন। কিন্তু কিছু গরীব মানুষ প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে এসে উঠেছেন সেই এরশাদের গুচ্ছগ্রামে। এই অংশের পুরুষরা রিকশা চালান কিংবা দিন-মজুরের কাজ করেন আর মহিলারা বাসাবড়িতে কাজ করেন নয়তো রাস্তা নির্মাণ কাজে বা ইটের ভাটায় দিনমজুর হিসেবে কাজ করছেন। সচ্ছল অংশের মহিলাদের সম্পর্ক অন্যান্য গ্রামের মহিলাদের মতই তাদের জা-শাশুড়ি-ননদদের সাথে কিন্তু গুচ্ছগ্রামের মহিলাদের সেই সুযোগও নেই। লাগোয়া ঘরের এইসব মহিলারা সবাই সবাইকে সন্দেহ করেন। পেটের কোন কথা তাদের নেই কারো কাছে বলার মত। স্বামী মারলে সবাই দেখে। স্বামী আরেক জায়গায় বিয়ে করলে হয় গুচ্ছগ্রাম ছেড়ে চলে যায় নয়তো সেই বউ নিয়ে ঘরে উঠলে মহিলাকে রাস্তায় নামতে হয়। জীবনের কোন বিষয়েই কোন গোপনীয়তা নেই কারো। গুচ্ছগ্রামের জুলেখা ইয়াসমিন সুন্দর ব্যাখ্যা দিলেন যে পেটের কথা সবাই দেখে, বলার কিছু নেই কারো সাথে।
সম্পর্ক-কাঠামোর একই গল্প পুনরাবৃত্ত হতে থাকে গ্রাম থেকে গ্রামে- টাঙ্গাইল জেলার গয়াহাটা ইউনিয়নের বলাই নগর কিংবা দিনাজপুরের বীরগঞ্জের মহুগাঁও কিংবা ছোট শহরের মহল্লা আক্কেলপুর-এ। বলাই নগর গ্রামের অনেক মহিলাই এনজিও হাঙ্গার প্রজেক্ট-এর সাথে জড়িত আর একাকী চলতে পারার দাবীদার সবচেয়ে বেশী মহুগাঁও-এ। আর আক্কেলপুরের মহিলারা তো বলতে গেলে শহরেরই মহিলা। তাঁদের নাম ভিন্ন, ধর্ম ভিন্ন, ভাষা ভিন্ন কিন্তু সম্পর্ক কাঠামো একই। বিয়ের পরে মেয়েদের জীবনে সই-এর উপযোগিতা থাকতে পারে, এই ধারণাও যেনো অনুপস্থিত। আর বিয়ের আগে মেয়েরা একটু বড় হতেই বাইরে যাওয়া নিষেধ, কথা বলা নিষেধ বাড়ির বাইরের কারো সাথে, কাজের বাইরে।

লক্ষণের গণ্ডি আসলে কতবড়?
..................
দণ্ডকারণ্যে সীতাকে গণ্ডি এঁকে দিয়েছিলেন লক্ষণ। রামায়ণ অনুযায়ী সীতা সেই গণ্ডির বাইরে যাওয়ায় কী অনর্থই না ঘটেছিলো ! রবীন্দ্রনাথ মেয়েদের জন্য বাইরেটা কী ভয়ানক বোঝাতে মস্ত এক উপন্যাসই লিখে ফেলেছেন, ঘরে-বাইরে। মেয়েদেরকে বলেছেন তিনি সীমা স্বর্গের ইন্দ্রানী। প্রশ্ন হলো, এই সীমা স্বর্গের সীমা কতদূর ? লক্ষণের গণ্ডিই বা কত বড় ?
আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্ক কাঠামো উপস্থাপনের সফটওয়্যার টঈওঘঊঞ-৬-এর ঘবঃউৎধি প্রোগ্রাম ব্যবহার করে পয়গ্রামের যে ঈষরয়ঁব প্যাটার্ণ (যাদের সাথে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ) পাওয়া গেছে সেটি লক্ষ করলেই বোঝা যাবে মহিলাদের সম্পর্ক কাঠামো কেমন। প্রত্যেকটি বৃত্ত যেমন একেকজন মহিলাকে নির্দেশ করছে তেমনি নির্দেশ করছে কত নম্বর বাড়ির মহিলা তিনি। একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে কেবল পাশাপাশি/কাছাকাছি বাড়ির মহিলারাই্ সম্পর্কে আবদ্ধ। এই পাশাপাশি বাড়িগুলো হচ্ছে তাঁদের ভাসুর-দেবরদের বাড়ি, যেখানে থাকেন তাঁদের জা-শাশুড়ি-ননদ।
যদি অঙ্কের হিসেবে বলি তবে সবগুলো গ্রামে মহিলাদের গড় সম্পর্ক ৩.১১ জনের সাথে। এবং এই সম্পর্কসূত্রের ৭৮.২৭% তাদের জা।
এই সীমাবদ্ধ জীবন আর সীমিত সম্পর্কের কারণগুলো একই সাথে জটিল, বহুমাত্রিক এবং আন্তঃসম্পর্কিত। সম্পর্ক কাঠামো গড়ে ওঠার আখ্যানভাগ নির্মোহভাবে বিশ্লেষণ করা না গেলে আমরা কতগুলো উপরিভাসা কারণের বন্দিশেই ঘোরাফেরা করবো। তাই মাঠের কাজের ফলাফলে উঠে আসা দৃশ্যমান সহজ কারণগুলো বিশ্লেষণ করা যেমন জরুরী, তেমনি বা আরো বেশী জরুরী এসব কারণের অর্ন্তনিহিত মতাদর্শিক এবং মনো-সামাজিক-আর্থনীতিক ভিত্তির দিকে ফিরে তাকানো। সামাজিক সংগঠন হিসেবে পরিবার এবং এই পরিবারের লৈঙ্গিক-সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ জরুরী, জরুরী বিশ্লেষণ করা ‘ঘর’ আর ‘বাইরে’র বর্তমান রুপকাঠামো, এর ঐতিহাসিক নির্মাণের সাপেক্ষে।



পয়গ্রামের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের দাবিদার মহিলাদের ক্লিক কাঠামো

...................................
নারীর ‘অপরায়ন’-এর ইতিবৃত্ত ঃ
‘জমিন’, পরিবার আর ব্যক্তিগত সম্পত্তির সরল-জটিল কোলাহল
খালি চোখে যে কারণগুলো আমরা দেখি এই গবেষণায় সে-সবের মধ্যে অনিবার্য যে কারণ ছাপিয়ে উঠেছে আর সব কারণকে, সেটি হলো তাদের যোগাযোগ আবহ সীমিত, জমিন (ংঢ়ধপব) নির্দিষ্ট। নির্দিষ্ট তাদের বিচরণ ক্ষেত্র, কাজ কিংবা অবসরের। এই নির্দিষ্ট সীমিত জমিনের কারণগুলো আবার প্রায় মুখস্থ বলে দেয়া সম্ভব, অল্প বয়সে বিয়ে এবং বিয়ের পরে শ্বশুরবাড়ির গৃহস্থালির কাজে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ, যে ‘কাজ’ আবার ‘কাজ’ হিসেবে স্বীকৃত নয় অর্থনৈতিক মানদণ্ডে অথচ সকাল থেকে রাত অবধি গৃহস্থালির কাজেই তাদের নিয়োজিত থাকতে হয়। গার্হস্থ্য পুনরাবৃত্ত শ্রমের নিগড়ে আবদ্ধ খুব কম মহিলারই সুযোগ থাকে সই জাতীয় ‘অপ্রয়োজনীয়’ মানবিক সম্পর্ক নিয়ে মাথা ঘামানোর কিংবা সময় দেয়ার যেমনটা বলেছেন রায়ের কাঠির অবিরত জাল বুনতে থাকা সবিতা রানী, “বাড়ির বাহির বা হমু কহন আর সই বা পাতামু কহন”। বাড়ির বাইরের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যোগ না থাকার কারণে মহিলাদের বাড়ির বাইরে যাওয়ার ‘প্রয়োজন হয় না’ কিংবা নিন্দুকেরা হয়তো বলবেন ‘হুকুম’ হয় না। বাড়ির বাইরের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যোগ না থাকার কারণকে আবার প্রায়শই তাদের ‘অ-শিক্ষার’ সাথে সম্পর্কিত করে দেখা হয়। কিন্তু আমরা দেখেছি এসব মহিলাদের স্বামীদের শিক্ষাগত যোগ্যতাও তেমন আহামরি ভিন্ন কিছু নয়। যেহেতু স্বামীদের কর্মজগত ‘ইতিহাস নির্দিষ্টভাবে’ বাইরের পৃথিবী তাই তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা কোন প্রতিবন্ধক নয় বাইরের পৃথিবীর আলো-হাওয়ায় সঞ্চরণের জন্য। মেয়েদের শিক্ষাগত যোগ্যতার ঘাটতি আবার অনেক ক্ষেত্রেই দারিদ্র্যের পাশাপাশি ‘বিয়ের বয়স’ এবং ‘সম্ভাব্য উপযুক্ত বিয়ে’-এর সাথে সম্পর্কিত। একই আর্থ-সামাজিক অবস্থানের মেয়েদের প্রাথমিক স্কুলে নিবন্ধীকরণ ছেলেদের সমান বা ক্ষেত্র বিশেষে বেশী হলেও মাধ্যমিকে যাওয়ার আগেই তারা ঝরে যায়। স্কুল দূরে হলে বেশ মোক্ষম একটা যুক্তি আপসেই দাঁড়িয়ে যায় যেমন আমরা দেখেছি চৈতন্যপুরে। গড় বিয়ের বয়স সাড়ে পনেরো হওয়ার আগেই তাই বিচ্ছেদ ঘটে স্কুলের সাথে, বাইরের পৃথিবীর সাথে, সই-দের সাথে। এই সময়টা হচ্ছে তাদের বিয়ের জন্য প্রস্তুতির সময়। এই প্রস্তুতিকালীন সময় আবার নিবিড়ভাবে যুক্ত ‘সতীত্ব নিশ্চিতকরণ’ প্রক্রিয়া এবং ‘নিরাপত্তা’র ধারণার সাথে, দু’টোই সামাজিক-মনস্তাত্ত্বিক নির্মাণ। আত্মীয় সম্পর্কের বাইরে এসব মেয়েদের অন্য কোন সম্পর্ক গড়ে ওঠার প্রক্রিয়াটি বাধাগ্রস্থ হয়ে পড়ে শুরুতেই, এমনকি কাউকে জানান না দিয়েই। বিবাহিত মহিলাদের ক্ষেত্রে বাইরের পৃথিবীর সাথে যোগাযোগের সূত্র হয়ে উঠতে পারতো গ্রামে গ্রামে পত্তন নেয়া বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার কার্যক্রম। কিন্তু মাঠ অভিজ্ঞতায় দেখা যাচ্ছে এমনকি ক্ষুদ্রঋণ বা অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো বাড়িতে এসে ঋণ বা সাহায্য দিয়ে যায় অনেকক্ষেত্রেই। নারী থাকবে লোক চোখের আড়ালে‘দেশজ সংস্কৃতির’ এই প্রত্যাশার মতাদর্শ পরিষ্কারভাবে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানেও পরিব্যপ্ত এবং স্বীকৃত হয়েছে, যেমনটা দেখেছেন ওয়ালেস ও অন্যান্য ১৯৮৭ (সূত্র ঃ হোয়াইট ১৯৯২)। তাঁদের মতে “গ্রামীণ নারীকে বন্ধন-মুক্ত করার পক্ষে যুক্তি দেয়া আমাদের উদ্দেশ্য নয়সেটা ‘দার্শনিক আর সমাজ-সংস্কারকদের কাজ’।” ‘নারীর কাজ গৃহকেন্দ্রিক’ এই আধিপত্যশীল মতাদর্শকে ঘিরেই আবর্তিত বেশীরভাগ প্রকল্প কিংবা আবর্তিত ‘গৃহের আয় বৃদ্ধি’র সাথে নারীর সংযুক্তি জাতীয় উদ্যোগে যেমন হাঁস-মুরগি পালন, হস্তশিল্প। ফলে যারা ক্ষুদ্রঋণ বা অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে জড়িত, ব্যক্তিগত পর্যায়ে তাদের কিছু ‘সাহায্য’ হলেও সামষ্টিকভাবে তাদের ‘সীমাবদ্ধ জল আর সীমিত সবুজময় আঙ্গিনার বিস্তৃতি ঘটে না নতুন মানুষের সাথে মেশার কিংবা ভাব বিনিময়ের। বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠার যে অবকাশ আর জমিন প্রয়োজন দুই-ই অনুপস্থিত, তাই বন্ধুত্ব তৈরী হয় না। তবে গ্রামীণ নারীর এই জমিন (ংঢ়ধপব)-এর নির্মাণ কোন আপাত নিরীহ সিদ্ধান্তের বিষয় নয় বরং বিয়ে, পরিবার এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তির মতো জটিল বিষয়গুলোর ঐতিহাসিক বিকাশ এবং বর্তমান প্রেক্ষিতের সাথে গভীরভাবে সংযুক্ত। নারী সত্ত্বার নির্মাণকে ঘিরে যে ‘অপরতা’র বলয়, তার বিচিত্র বিচ্ছুরণকে লক্ষ করতে হবে দর্শন ও ইতিহাসের প্রতিবেদনে।
গার্হস্থ্য শ্রমের সাথে নারীর যুক্ততা কীভাবে অনিবার্য হয়ে উঠেছে কিংবা নারীর অবস্থা, পরিস্থিতিগুলো কেন ‘অপর’ হয়ে উঠেছে এবং কীভাবেই বা এই ‘অপরায়ন’ ঐতিহাসিকভাবে স্থায়ীত্ব পেয়েছেএই প্রশ্নগুলো নারীবাদী পাঠের কেন্দ্রীয় বিষয়। নানা মত, নানা পাঠের ভেতর থেকে দু’টি প্রবল ধারা মোটা দাগে বের করে আনা সম্ভব [বলা বাহুল্য, নারী তার দৈহিক কারণেই গার্হস্থ্যধর্ম পালন করে, এই সনাতন সরল জৈবিক ব্যাখ্যাকে এখানে মোটেই আমলে নেয়া হচ্ছে না]। একটি ধারার মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে, “সব সময়ে, সর্বত্র বা সব পর্যায়েই নারী সামাজিকভাবে পুরুষের অধঃস্তন নয়।” এই ধারার প্রধান প্রবক্তা এঙ্গেলস (১৮৮৪/১৯৪২) তাঁর ঞযব ঙৎরমরহ ড়ভ ঃযব ঋধসরষু, চৎরাধঃব চৎড়ঢ়বৎঃু, ধহফ ঃযব ঝঃধঃব বইতে যুক্তি দেন যে, গোষ্ঠীভিত্তিক সমাজ যখন সভ্যতার দিকে অগ্রসর হতে থাকে তখন পিতৃতন্ত্রের উদ্ভব ঘটে যা নারীর অধস্তনতার মূল কারণ এবং সমাজতন্ত্রের আগমনের সাথে সাথে পিতৃতন্ত্র পরাভূত হয়। পিতৃতান্ত্রিক সমাজের সাধারণ সামাজিক নিয়ম হচ্ছে নারী পুরুষের সম্পত্তির মত কাজ করে, সন্তান উৎপাদন ও তার সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে পিতৃতান্ত্রিক নিয়মকানুন বজায় রাখে। এই প্রক্রিয়ার মূল দুটি প্রপঞ্চ ‘ব্যক্তি মালিকানার উদ্ভব’ ও ‘শ্রেণীভিত্তিক অসমতার সাথে নারীর ঐতিহাসিক অধস্তনতার সম্পর্ককে ব্যাখ্যা করা হয়েছে এভাবে, যেখানে পারিবারিক কাজের সাথে বাইরের বা সামাজিক কাজের কোন পার্থক্য নেই সেখানে নারী-পুরুষের মধ্যে একধরনের সমতার সম্পর্ক বিদ্যমান, এমনকি নারী পুরুষের চেয়ে অধিক ক্ষমতাবান ক্ষেত্র বিশেষে। এঙ্গেলস দেখান, এ ধরনের পরিস্থিতিতে উৎপাদনের উপায় ও উৎপাদনের উপর সমাজের সকলের মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ বিদ্যমান, গার্হস্থ্য জীবন ও সামাজিক জীবনের কেন্দ্রে রয়েছে যৌথ গৃহস্থালি। তাই যে সমাজে বিনিময়ের জন্য উৎপাদনের প্রবণতা কম এবং যেখানে ব্যক্তিমালিকানা ও শ্রেণী অসমতার সৃষ্টি হয়নি সেখানে লিঙ্গীয় ভূমিকার পার্থক্য থাকলেও লিঙ্গীয় অসমতা কম এবং ক্ষমতা, কর্তৃত্ব ও তুলনামূলক যৌন অধিকার নারী-পুরুষ উভয়ের মাঝে বিন্যস্ত। কিন্তু উদ্বৃত্ত বৃদ্ধির সাথে সাথে ব্যক্তিমালিকানার উদ্ভব হয় এবং নারী সম্পদ, উৎপাদিত দ্রব্য ও তার নিজের উপর কর্তৃত্ব হারায়। যৌথ গৃহস্থালিগুলো ব্যক্তিগত এককে পরিণত হয়, প্রতিটি পরিবারে একেকজন পুরুষ প্রতিনিধি কর্তৃত্ব করেন। পরিবার হয়ে ওঠে নারীর শ্রমের ক্ষেত্র যা পর্যায়ক্রমে একটি বৃহৎ সামাজিক বা বাইরের জগতের নিয়ন্ত্রণাধীন হয়। এই বহির্বিশ্বের জগত আবার রাষ্ট্র দ্বারা পরিচালিতআর এই সমাজ, রাষ্ট্র সব কিছুই হচ্ছে পুরুষের। সোজা কথায়, ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিকাশে পিতৃতন্ত্রের সৃষ্টি হলো, উন্নত যন্ত্রের উদ্ভাবনের জন্য সামাজিক উৎপাদনে নারীর শ্রমের প্রয়োজনীয়তা কমে গেলো। সামাজিক জীবনে উৎপাদনের অংশ হিসেবে বিচ্যুত হয়ে সে নিযুক্ত হলো গৃহস্থালির একঘেয়ে বাঁদীগিরিত্বে।
এঙ্গেলসের অর্থনৈতিক নিমিত্তবাদী ব্যাখ্যার বিপরীতে সক্রিয় সমালোচনাত্মক ধারাটির অন্যতম প্রতিনিধিত্বকারী হলেন ব্যুভোয়া (১৯৪৯/১৯৬৮)। তাঁর মতে, নারীজীবনের স্বর্ণযুগ কল্পনামাত্র, তা কখনোই ছিলোনা। সমগ্র ইতিহাসকে যাযাবর যুগ, কৃষির প্রথম যুগ, পিতৃতান্ত্রিক যুগ ও প্রাচীনকাল, খৃষ্টধর্ম ও মধ্যযুগ এবং ফরাসী বিপ্লবের পর থেকে বর্তমান যুগ পর্যন্ত পাঁচটি বর্গে ভাগ করে তিনি দেখান চিরকালই পুরুষ প্রভু, মাঝে কিছুদিন [কৃষির প্রথম যুগ যা প্রায়শই মাতৃতান্ত্রিক যুগ হিসেবে চিহ্নিত] শুদ্ধ জন্ম রহস্যের প্রভাবে সে নারীকে খানিকটা সুবিধা দিয়েছে, বসিয়েছে মাতা বা দেবীর আসনে, এই যুগেও নারীর অবস্থান মূলত গৃহকেন্দ্রিক বলেই মনে করেন ব্যুভোয়া। নারী ও শ্রমিককে এক পর্যায়ে ফেলা এবং সামাজিক উৎপাদনে অর্থনৈতিক মর্যাদা পেলে উভয়েরই অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে, এঙ্গেলসের এই মূল থিসিসের বিপরীতে তিনি বলেন শ্রমিক এক বিশেষ সমাজ ব্যবস্থার ফল কিন্তু সমাজের প্রথম যুগ থেকেই নারী ও পুরুষের সম্পর্ক নির্যাতিত ও নির্যাতনকারীর। বিষয়টি আরো ভালোভাবে বোঝা যায় যখন তিনি বলেন শ্রমিকের মধ্যে শ্রৈণী-বৈষম্য নিশ্চয়ই নেই কিন্তু নারীর মধ্যে শ্রেণীবিভাগ রয়েছে। আবার সামন্ততান্ত্রিক ইউরোপের ভূমিদাসদের মত প্রতিটি পরিবারের নারীর একদিকে যেমন সম্পত্তি রয়েছে (বিয়ের পরে স্বামীসূত্রে পাওয়া), অন্যদিকে সে নিজেও পুরুষের সম্পত্তি হিসেবে বিবেচিত। এইসব প্রশ্ন পরবর্তী নারীবাদী তত্ত্বেরও কেন্দ্রীয় ফোকাসে পরিণত হয় (দেখুন, কেলি ১৯৮৬)। তবে ব্যুভোয়া এঙ্গেলসের মতই মনে করেন যে ব্যক্তিগত সম্পত্তি নারীর অপরায়নকে দৃঢ়তর করেছে। উভয়ের থিসিসেই [বলা ভালো উভয় ধারায়] একটি মূলগত ঐক্যের দিক হলো দুজনেই মনে করেন ব্যক্তিগত সম্পত্তি বিয়ের বন্ধনকে দৃঢ় করেছে কারণ পুরুষ তখন চেয়েছে নিজের ঘর, সম্পত্তি ও তার ‘বৈধ’ উত্তরাধিকার। আগের যুগে বিয়ে বহির্ভূত যৌন অপরাধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা ছিলো না কিন্তু এই যুগে নিয়ম হলো সতীত্ব নিয়মলঙ্ঘনকারীকে তার স্বামী হত্যা করতে পারবে এবং তার জন্য কোন শাস্তি হবে না। পিতৃতন্ত্রের উদ্ভব থেকে আজ পর্যন্ত সকল সমাজে, কিছু ব্যতিক্রমসহ, এই ব্যবস্থাই কমবেশী বিদ্যমান। এক্ষেত্রে কেলি (১৯৮৬)-র বক্তব্য বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ঃ “যেখানে ঘর আর বাইরের মধ্যে সুস্পষ্ট বিভাজন বিদ্যমান সেখানে লিঙ্গীয় অসমতার প্রাবল্য লক্ষ্য করা যায়, একই সাথে নারীর সতীত্ব এবং পতিতালয় চাওয়া হয়।” ভারতীয় যৌন বাস্তবতার অধ্যয়ন এ-ধরণের আলোচনায় পুরোপুরি নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে। যেমন বাৎসায়নের কামসূত্র পড়লে স্পষ্ট বোঝা যায়, দাম্পত্য জীবনে নারী কখনো সমান মর্যাদা ভোগ করত না। বিবাহিত নারীরা অশিক্ষিত হওয়াতে স্বামীকে কখনো বুদ্ধিতে, সংবেদনায় সঙ্গী হিসেবে পেতো না। রাষ্ট্র চৌষট্টিকলায় নিপুণ বারাঙ্গনা বা জনপদবধূদের উৎসাহ যোগাত যাতে পুরুষেরা তাদের সাহচর্যে বৌদ্ধিক তৃষ্ণা মেটাতে পারে। এই সমাজে, প্রাক-আধুনিক যুগে, অন্তত দুই সহস্রাব্দ ধরে, যৌনতা-দাম্পত্য, স্ত্রী-পুরুষের সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয়ে একই মনোভঙ্গি বজায় ছিলো। বিয়ে বহির্ভূত যৌনতা বিশেষভাবে স্ত্রীর সামাজিক মর্যাদার পক্ষে হানিকর বলে বিবেচিত হলো না শুধু, যৌন নৈতিকতার ধারণাও এই ভাবনাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হলো, তৈরী হলো বিভিন্ন নীতিশাস্ত্র। মহাভারতের শুরুতে আমরা দেখি কুন্তির ক্ষেত্রজ পুত্রদের অথচ কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অর্থাৎ মহাভারতের শেষ পর্যায়ে গীতায় পরিষ্কার বলা হয়েছে, ‘স্ত্রীষু দুষ্টাষু বার্ষ্ণেয় জায়তে বর্ণসঙ্করঃ’। অর্থ, স্ত্রীদের অনৈতিক যৌন স্বেচ্ছাচারের ফলে বর্ণাশ্রম প্রথার দ্বারা অননুমোদিত সন্তানেরা জন্ম নেয়। অর্থাৎ সতীত্ব সংস্কারের শেকল পরানো শুরু হচ্ছে মাত্র আর তার ক্ষেত্র প্রস্তুত করা হচ্ছে। অধিপতি ব্রাহ্মণ্য সমাজে ‘বিশুদ্ধ’ আর্য উত্তরপুরুষের পরম্পরা রক্ষা সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব পেয়েছে বলে সাহিত্য-সংস্কৃতি-স্মৃতি-পুরাণ জুড়ে নারীর অশুচিতা, অবিশ্বাস্যতা, অপূর্ণতা কীর্তিত হয়েছে। কঠোর হয়েছে সতীত্ব নিশ্চিতকরণের উপায়সমূহ। নারীর জমিন ক্রম সঙ্কুুচিত হয়েছে।
উনিশ শতকের শেষভাগ এবং বিশ শতকের প্রথম ভাগ বাঙ্গালী মুসলমান মধ্যবিত্তের উন্মেষকাল এবং এই শ্রেণী গঠনের সাথে শুরু হয় পরিবার, বিয়ে ব্যবস্থা, এবং নারী-পুরুষ সম্পর্কের আমূল পরিবর্তনের প্রক্রিয়া। এর আগে বাঙ্গালী মুসলমানদের মধ্যে পুরুষের একাধিক বিয়ে সব শ্রেণীতেই স্বাভাবিক ধরে নেয়া হতো। এই মধ্যবিত্ত শ্রেণী গঠনের পর খুব দ্রুতই এক পতি-পতœী বিয়ে নৈতিকতা, সমতা আর প্রগতিশীলতার স্মারক হিসেবে মূর্ত হয়ে ওঠে এবং অচিরেই, আধা শতাব্দীরও কম সময়ে, সেটি হয়ে ওঠে সামাজিক রীতি। আপাত প্রগতিশীল এই বিয়ে কাঠামোতেও ‘নারী ঘরণী, তার ভূমিকা নৈতিক এবং আদর্শিক, নারী চৈতন্যের বিশাল জায়গা জুড়ে রয়েছে যৌন শুচিতা’, যেমনটা দেখেছেন চৌধুরী এবং আহমেদ (২০০০ ঃ ১৫৫)। তাঁরা যথার্থই দেখেছেন, ‘‘পুরুষের পরিচিতি এই পরিকাঠামোতে আর্থিক, তার কাজের জায়গা বহির্জাগতিক (রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাং¯কৃতিক) ; তার শুচিতার ব্যাপার নারীর মত সংকটের নয়। ঘর-বাহির পুনর্গঠনের মধ্যে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কাছে সম্মানবোধ আর চরিত্র ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। সেই চরিত্র চর্চার কেন্দ্রীয় জায়গা হলো নারী। নারীর শুচিতার নতুন নতুন উপাদান তৈরী হয় এই সময়। ... পুরুষের আর্থিক ভূমিকা এক স্বামী-স্ত্রী বিয়ের ক্ষেত্রে এত প্রকট, যা বিশ শতকের মজুরী অর্থনীতিতে বাঙ্গালী মুসলমানের অংশগ্রহণের আগে ছিলো না, যে চাকরী পাওয়ার সাথে ‘বউ পালতে’ পারার সামর্থ্য জড়িত হয়ে পড়ল। পৌরুষের ধারণার ভিত্তিই হচ্ছে স্বাধীন রোজগার, নির্ভরশীল বউ-বাচ্চার লালন-পালন।’ বাঙ্গালী মুসলমান মধ্যবিত্তের এই এক পতি-পতœী বিয়ে এবং ‘নারী’ ও ‘পুরুষ’ নির্মাণ ক্রমশ সঞ্চারিত হয়েছে সমাজের অন্য স্তরেও। সঞ্চারিত হয়েছে এর আনুসঙ্গিক ‘ঘর/বাহির’, ‘বিয়ে-করা/ বিয়ে-বসা’, ‘সংসার চালানো/সংসার-করা’র ধারণাগুলোও। অর্থাৎ নারীকে গার্হস্থ্য জমিনের সাথে একাকার করে দেখার বিষয়টি পরিবর্তিত তো হয়ই নি বরং সাহিত্যে, গণমাধ্যমে, নাটকে, চলচ্চিত্রে, চর্চায়, আইনে সর্বত্র মোহময় রোমাণ্টিকতার প্রলেপসহ উপস্থাপন করা হয়েছে বা হচ্ছে এবং নারীর শিক্ষা, চাকরি, উপার্জন, সম্পর্ক সবই নির্ধারিত হয়েছে এই জমিনের প্রয়োজনে এবং এর সাথে সমন্বয় করে।
কাজেই ব্যক্তিগত মালিকানার উদ্ভবের সাথে নারীর গার্হস্থ্য শ্রম, বিয়ে এবং বৈধ উত্তরাধিকারের প্রয়োজনে নারীর সতীত্ব শৃঙ্খলার উপরে জোরারোপ সংস্কৃতিভেদে কিছু তারতম্যসহ নারীর বর্তমান সীমিত গার্হস্থ্য জমিনের প্রেক্ষাপট রচনা করেছে এবং স্থায়ীত্ব দিয়েছে, যা আমরা দেখেছি বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে।

পুতুল তোমার জনম কিরূপ কে জানে
আলোক লতায় বাইন্ধা সুতা সে টানে
........................
আসলে প্রশ্ন করার আর তেমন কিছু নেই মনে হয়। হাজার বছরের চাপিয়ে দেয়া সতীত্ব সংস্কারের শেকল এতো গভীরে প্রোথিত যে, সব মহিলাই নিজেকে সেই সংস্কারের মানদণ্ডে মহীয়সী দেখতে আর দেখাতে চান। সীতার অগ্নি পরীক্ষায় উত্তরণের গল্প ধর্ম নির্বিশেষে আজও সতীত্ব গৌরবের পরম নিদর্শন। সেই নারী বিয়ের জন্য ভালো যে অসূর্যস্পর্শা। জানা কথাই যে বিয়ের আগ পর্যন্ত পিতামাতা আগলে রাখেন, আটকে রাখেন মেয়েকে এই সার্টিফিকেটের আশায় যে তার মেয়ের শরীরে কোন ‘দোষ’ লাগেনি। পুরুষসঙ্গ তো দূরের কথা, বাড়ির আত্মীয়-স্বজনের বাইরে কোন মেয়ের সাথেও তাদের মেয়ের কোন সম্পর্ক নেই। বেগম রোকেয়ার ‘অবরোধবাসিনী’ আর কতইবা পুরনো হয়েছে ! মেয়ে তো বিয়ে দেয়ার জন্যই কেবল পালাপোষা করা। সময় খারাপ। নিরাপত্তা নিয়েও চিন্তা আছে। আর সেই মেয়ের যখন বিয়েই হয়ে গেলো সে তো তখন স্বামী আর শ্বশুরবাড়ির যত বাধ্য, ততই ভালো ‘মহিলা’। বাড়ির আত্মীয় সম্পর্কের বাইরে কারো সাথে মেলামেশা মানে তো সেই একনিষ্ঠ আনুগত্যে অন্য বাতাস লাগা। কে না জানে ‘এরা যত বেশী জানে, তত কম মানে’। স্বামী চান না, শাশুড়ি চান না, সমাজ চায় না এই মেলামেশার মধ্য দিয়ে ওই নির্দিষ্ট বাড়ির নির্দিষ্ট মান্যতাসংস্কৃতির শান্ত পুকুরে এমনকি পলকা ঢেউও উঠুক। হাজার বছরের পাখিপড়া শিক্ষায় মেয়েরা এত পোক্তভাবে আয়ত্ত করেছেন এই শিক্ষা যে শিক্ষককে আর পাহারাও দিতে হয় না, তারা নিজেরাই বলেন সই থাকার মত খারাপ কাজের ধার তারা ধারেন না, ‘পাখির শিক্ষা এখন পুরা হইয়াছে’।
যারা ঘরের বাইরের কোন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত না (৯২.৭%) তাদের পক্ষে তো বাড়ি আর পাড়ার বাইরে যাওয়ার কোন প্রশ্নই ওঠে না। এমনকি গ্রামের যে মহিলারা চাকরি করছেন তাদেরও বান্ধবী নেই, বা থাকলেও ওই মহিলারাই সেই স্বীকৃতি দেন না জনসমক্ষে। কারণ গ্রামের মেয়েদের চাকরীতে যাওয়ার লড়াইটা এখনো সমাজ-সংসারকে এই বুঝ দেবার পর্যায়ে আছে যে সে নেহাত বাধ্য হয়ে, পরিবারের প্রয়োজনে ‘বাড়তি’ টাকা উপার্জনে বের হচ্ছে, কাজের বাইরে আর কোন সম্পর্ক তার নেই পৃথিবীর সাথে, তাই বান্ধবী যদি থেকেও থাকে সেই থাকাকে প্রকাশ করার সামর্থ্য সে অর্জন করেনি এখনো। এখনো সে নিজেকে এবং পারিপার্শ্বিক সবাইকে আশ্বস্তই করতে চায় যে সমাজ নির্দিষ্ট বিবাহিত সম্পর্কসমূহের বাইরে তার অন্য কোন জগত নেই। স্বামী-সংসারেরও এই আশ্বস্তিটুকু প্রয়োজন। মহিলাদের যে নিরঙ্কুশ আনুগত্যের উপরে পরিবার নামক প্রতিষ্ঠানটি টিকে আছে, সেই আনুগত্যের লেশমাত্রও যে অন্য কোথাও ব্যয়িত হচ্ছে না সে-বিষয়ে আশ্বস্তির প্রয়োজন আছে বৈকি। তবু ধন্ধ আমার কিছুতেই দূর হচ্ছিলো না কেন এভাবে। শুরুতেই দেয়া ঝুসঢ়ড়ংরঁস-এ প্লেটোর উদ্ধৃতি যেন এক হঠাৎ আলোর ঝলকানি হিসেবে কাজ করেছে। এখানে বলা হয়েছে মালিকের স্বার্থে দাসদের মধ্যে যেন কোন বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠতে না পারে সে বিষয়টি নিশ্চিত করা দরকার। কারণ যে-কোন বন্ধুত্বের সম্পর্কে অন্যান্য উদ্দেশ্যের সাথে ভালোবাসারও উৎসারণ ঘটাতে পারে যা মালিক পক্ষের শক্তিকে ক্ষয় করে। সংসার সম্পর্ক কাঠামোর মালিক যখন স্বামী, আর স্ত্রী যখন দাস, এবং এটাই যখন নিয়ম, এবং এই নিয়মটাকে বহাল রাখাই যখন উদ্দেশ্য, তখন কেন যে মেয়েদের বন্ধুত্বকে সাহিত্যে বা জীবনে স্বীকার করা হয় না বা স্বীকৃতি দেয়া হয়না সেটা খানিকটা খোলসা হয় বৈকি !


তথ্যসূত্র
Beauvoir, S. de. (1949/1968). The Second Sex, translated in English by Pardhlay, H. M. Bantam Books, NY.

Engels, F. (1884/1942/1972). The Origin of Family, Private Property and State, translated in English by West, A. (1942), Pathfinder Press, NY.

Kelly, J. (1986) "The Social Relation of the Sexes: Methodological Implications of Women's History", in Women, History and Theory. The Essays of Joan Kelly, The University of Chicago Press, Chicago & London.

Plato. (360 B.C./1997) The Symposium, translated in English by Neham, A. and Woodruff, P. From Plato: Complete Works, Cooper, J. M. (ed.), 1997. pp. 457-506.

White, S. C. (1992). "Research on Women in Bangladesh", Arguing with the Crocodile, Gender and Class in Bangladesh, University Press Limited, Dhaka.


চৌধুরী, মানস এবং আহমেদ, রেহনুমা। ২০০০। “লিঙ্গ, শ্রেণী এবং অনুবাদের ক্ষমতা ঃ বাঙ্গালী মুসলমান মধ্যবিত্ত পরিবার ও বিয়ে”, কর্তার সংসার, গুলরুখ, সায়দিয়া এবং চৌধুরী, মানস (সম্পাদিত)। পৃষ্ঠা ১৩৯-১৬৪। রুপান্তর প্রকাশন, ঢাকা।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন