বৃহস্পতিবার, ২৭ আগস্ট, ২০০৯

স্পার্ক অভ লাইফ




মূল: এরিক মারিয়া রেমার্ক

অনুবাদ: বুলবুল সরওয়ার


ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকাল ৫০৯। সে কি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল, না শুধু ঘুমিয়ে পড়েছিল? দুটোর ভিতর এখন আর কোন তফাত নেই। ক্ষুধা আর ক্লান্তি অনেকদিন আগেই সে পার্থক্য মুছে দিয়েছে। দুই-ই যেন সিন্দাবাদের দৈত্যের জলা; ওঠা যায় না।

৫০৯ কিছুক্ষণ স্থির কান পেতে সিন্দাবাদের দৈত্যের গর্তে শুয়ে থাকে। ক্যাম্পের পুরানো নিয়মঃ কোন্ দিক থেকে বিপদ আসবে কেউ জানে না বলেই নড়াচড়া না করে যতক্ষণ পারা যায় ততক্ষণ মৃতের মত পড়ে থাকো। প্রকৃতির এই সহজ নিয়মটা সব পোকারও জানা।

সন্দেহজনক কিছু সে শুনতে পেল না। সামনের মেশিনগানাররা আধা-ঘুমন্ত, পিছন দিকেও সব চুপচাপ। সতর্ক ঘাড় ঘুড়িয়ে পিছন দিকে তাকায় সে।

রোদে নিশ্চিন্তে ঝিমেচ্ছে মেলার্ন কনসেনট্রেশন ক্যাম্প। নাম-ডাকার বড় মাঠটা ফাঁকা। এস.এস১ কর্মীরা রসিকতা করে ওটার নাম দিয়েছে নাচের মাঠ। গেটের ডান দিকের কাঠের মজবুত খুঁটিগুলো থেকে চারজন মানুষ শুধু ঝুলছে। তাদের হাতদুটো পিছমোড়া করে বাঁধা। দড়িতে বেঁধে এমন উঁচুতে টাঙানো হয়েছে, যাতে তাদের পা-দু’টো আর মাটিতে না ঠেকে। তাদের হাতের কব্জি সরে গেছে। ক্রিমেটারিয়ামের জানালা থেকে দুজন স্টোকার তাদের দিকে ছোট ছোট কয়লার টুকরো ছুঁড়ে দেখছে চার জনের কেউ নড়ে কিনা। আধ ঘন্টা ধরে ওরা বাতা থেকে ঝুলছে। এখন চেতনাও লুপ্ত ।

লেবার ক্যাম্পের ব্যারাকগুলো ফাঁকা। যেসব মজুর যেসব বাইরে গেছে তারা এখনও ফেরেনি। যাদের ডিউটি ঘরে, তাদের দু-চার জন মাঝে-মাঝে গুটিশুটি রাস্তা পার হচ্ছে। ফটকের বাঁ দিকে, শাস্তি দেবার বাঙ্কারের সামনে এস-এস স্কোয়াড লীডার ব্রয়ের বসে আছে। গোলটেবিলের সামনে একটা বেতের চেয়ারে। এক পেয়ালা কফি নিয়ে বসে আছে সে। ১৯৪৫-এর বসন্তকালে আসল কফি খুবই দুর্লভ ; কিন্তু একটু আগেই দুজন ইহুদিকে সে গলা টিপে শেষ করে এসেছে। দেড় মাস ধরে ওই দুজন বাঙ্কারে পচছিল। এই অসামান্য কাজের জন্যে একটা পুরস্কার ওর অবশ্যই প্রাপ্য বলে ও মনে করে। রসুইখানা থেকে কাপো২ কফির সঙ্গে এক প্লেট ময়দার কেকও পাঠিয়েছে। ধীরে ধীরে তারিয়ে তারিয়ে কেকটা খাচ্ছে ব্রয়ের; বিশেষ করে দানাহীন কিসমিস সে খুবই পছন্দ করে। কেকটা সেই মজাদার কিসমিসে ঠাসা। বয়স্ক ইহুদিটার মৃত্যু থেকে বেশি মজা সে পায়নি, কিন্তু ছোকরা ইহুদিটা বেশ শক্তসমর্থ ছিল; বেশ কিছুক্ষণ ওটা পা ছুঁড়েছে আর চিৎকার চেঁচামেচি করেছে। ব্রয়ের হাসিমুখে ঝিমুতে থাকে আর ক্যাম্পের বাজনাদারদের রেওয়াজের ছাড়া-ছাড়া সুরগুলো শুনতে থাকে। অর্কেস্ট্রাতে ‘দক্ষিণ দেশের গোলাপ’ জ্যাজ সুরটা বাজছিল। ঝটিকাবাহিনীর অধিনায়ক নয়েবাউয়েরের প্রিয় সুর ওটা।

ক্যাম্পের বিপরীত দিকে মুখ করে ৫০৯ শুয়েছিল। কাছেই অনেকগুলো কাঠের ব্যারাক। বড় লেবার-ক্যাম্প থেকে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে সেগুলো আলাদা করা। এগুলোকে বলা হয় ছোট ক্যাম্প। যে সব কয়েদি এতই দুর্বল যে কাজও করতে পারে না, তারা এখানে থাকে। বেশির ভাগই তাড়াতাড়ি মারা যায়, কিন্তু সব কয়েদি মারা যাবার আগেই নতুন কয়েদিদের ভিড় লেগেই থাকে। মুমূর্ষু কয়েদিদের বারান্দায় গাদাগাদি করে রাখা হয়, নয়তো বাইরে। খোলা জায়গাই অনেকে মারা যায়।

মেলার্নেতে গ্যাস-চেম্বার নেই। ব্যাপারটা নিয়ে অধিনায়কের বিশেষ গর্ব আছে। মেলার্নেতে লোকের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়- এ কথা ব্যাখ্যা করতে তার ভালো লাগে। ছোট ক্যাম্পকে সরকারীভাবে বলা হয় ‘করুণা বিভাগ’। যদিও সেই করুণা এক থেকে দুই সম্পাহের বেশি প্রতিরোধ করতে পারে এমন কয়েদির সংখ্যা হাতে-গোনা। এই শক্ত মানুষদের ছোট্ট দলটিই বাইশ নম্বর ব্যারাকে থাকে। তিক্ত রসবোধ থেকে এরা নিজেদের নাম দিয়েছে ‘প্রবীণ’। ৫০৯ এদেরই একজন। ছোট ক্যাম্পে তাকে আনা হয়েছে চার মাস আগে। সে যে এখনও বেঁচে আছে, ব্যাপারটা তার নিজের কাছেও অলৌকিক বলে মনে হয়।

ক্রিমেটারিয়াম থেকে কুণ্ডলী পাকিয়ে ধোঁয়া উঠছে। বাতাসের চাপে বাষ্পটা নিচে নেমে এসে ব্যারাকগুলোকে ঢেকে ফেলছে। মিষ্টি তেল-তেল গন্ধে বমি আসে। ক্যাম্পে দশ বছর বাস করেও ৫০৯ এটার সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারেনি। দুজন প্রবীনের অবশিষ্টাংশ আজ ওখান দিয়ে বেরুবে। ঘড়ি-নির্মাতা ইয়ান সিবেলস্কি আর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জোয়েল বুক্স্বাউম অবশ্য আস্ত ছিল না- তিনটে আঙ্গুল, সতেরোটা দাঁত, পায়ের নখগুলো আর জনন-অঙ্গের বেশ খানিকটা আগেই খুইয়েছে তারা। ‘কাজে লাগার মতো মানুষ’ হয়ে ওঠার শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার সময় ওগুলো হারিয়েছে তারা। জনন-অঙ্গের বিষয়টা এস. এস কোয়ার্টারের সান্ধ্য-আসরে খুবই হাসির খোরাক জুগিয়েছিল। ক্যাম্পে নবাগত স্কোয়াড লীডার গান্থার স্টাইনব্রেনারের মাথায় এসেছিল ব্যাপারটা। যাবতীয় বড় বড় আবিষ্কারের মতো এই ব্যাপারটাও খুবই সহজ শুধু একটু বেশি মাত্রার গাঢ় হাইড্রোক্লোরিক ইন্জেকশন দেয়া, আর কিছু নয়। এটা দিয়ে সঙ্গীদের চোখে সঙ্গে সঙ্গে সমীহ আদায় করেছিল স্টাইনব্রেনার।

মার্চ মাসের বিকেল। রোদটা এর মধ্যেই কিছুটা গরম হয়ে উঠেছে। তা সত্ত্বেও ৫০৯-এর শীত করছে- যদিও নিজের জামাকাপড় ছাড়াও ওর গায়ে রয়েছে আরও তিনজনের পোশাক; জোসেফ বুচারের জ্যাকেট, পুরানো কাপড়ের প্রাক্তন ব্যবসায়ী লেবেন্থালের ওভারকোট, আর জোয়েল বুক্স্বাউমের ছেঁড়া সোয়েটারটা। তাদের মৃতদেহ চালান করে দেয়ার আগে ব্যারাকের লোকেরা সেগুলো সরিয়ে রেখেছিল। কিন্তু পোশাক ছ-ফুটের চেয়ে কম লম্বা, আর আশি পাউণ্ডের কম ওজনের কোন মানুষকে সম্ভবত তিন-প্রস্থ পোষাকেও যথেষ্ট উত্তাপ দেয় না।

রোদে আধঘন্টা শুয়ে থাকার অধিকার ৫০৯-এর ছিল। তারপর তাকে ফিরে আসতে হবে, ধার-করা পোশাক-সমেত নিজের জ্যাকেটটাও দিয়ে দিতে হবে; এবার অন্য আর এক জনের পালা। শীত চলে যাওয়ার পর থেকে প্রবীণেরা নিজেদের মধ্যে এই ব্যবস্থা করেছে। কারও কারও এই ব্যবস্থার আর দরকার নেই। তারা খুবই মুমূর্ষু হয়ে পড়ছে, শীতের কষ্টটার পর ব্যারাকের মধ্যে শুধু নিশ্চিন্তে মরতে চায়। কিন্তু রুম-সিনিয়র (কক্ষ-অধ্যক্ষ) বার্জারের ইচ্ছা- এখনও যারা হামাগুড়ি দিতে পারে, তারা যেন বাইরের খোলা হাওয়ায় কিছুক্ষণ কাটায়। পরের পালা ওয়েস্টহফেল এবং বুচারের। লেবেন্থাল যাবে না, তার হাতে আরও দামী কাজ।

৫০৯ পাশ ফেরে। ক্যাম্পটা পাহাড়ের উপর। কাঁটাতারের ফাঁক দিয়ে শহরটা এবার সে দেখতে পায়। উপত্যকায়, ক্যাম্পের থেকে অনেক নিচে, স্পষ্ট আলোয় শহরটা দাঁড়িয়ে আছে। ছাদের পর ছাদ, তাদের ছাপিয়ে গির্জাগুলোর বুরুজ। পুরোনো শহর, অনেক গির্জা আর প্রাকার। মাথায় মাথায় ঠেকে গেছে লাইম গাছ, নিচ দিয়ে রাস্তা, আঁকাবাঁকা গলি। আধুনিক অংশটা গড়ে উঠেছে উত্তর দিকটায়। সেদিকের রাস্তাগুলো আরও চওড়া। সেদিকে আছে মেইন রেলস্টেশন, শ্রমিক বস্তি, কারখানা এবং তামা ও লোহার ফাউণ্ড্রিতে লেবার ক্যাম্পের মজুরেরা সেখানে কাজ করে। চওড়া বাঁক নিয়ে একটা নদী শহরের ভিতর দিয়ে চলে গেছে। নদীর বুকে সেতু আর মেঘের ছায়াগুলো যেন পরে পরে ঘুমোয়।

৫০৯-এর মাথাটা ঝুলে পড়ল। অল্প সময়ের জন্যই ঘাড়টা সে সোজা রাখতে পারে। ঘাড়ের পেশীগুলো শুকিয়ে গেলে মাথাটা ভারী হয়ে যায় আর উপত্যকার চিমনিগুলো থেকে ধোঁয়া বেরুতে দেখলে খিদেটাও বেড়ে ওঠে। খিদেটা কেবল পেটের মধ্যেই নয় যেন মাথায় ধাক্কা মারে। অনেক বছর ধরে পেটের খিদেটা মরে গেছে, একটা অস্পষ্ট লোভ ছাড়া আর কোন অনুভূতিই পেটটার নেই। মাথার খিদে কিন্তু আরও খারাপ; এতে সব মিথ্যা জেগে ওঠে; কিছুতেই সেগুলো তাড়ানো যায় না। ঘুমের ভিতরেও সেগুলো কুরে-কুরে খায়। এবারের শীতকালে আলুভাজার ছবিটা ৫০৯-এর মনে তিন মাস লেগেছিল। যেখানেই যায়, সেখানেই আলুর গন্ধ; এমন কি পায়খানার দুর্গন্ধের মধ্যেও। এখন সে বেকনের গন্ধ পাচ্ছে। বেকন আর ডিম।

কাছেই মাটির উপর নিকেলের ঘড়িটা রয়েছে। সেটার দিকে তাকায় ৫০৯। লেবেন্থাল ওকে সেটা ধার দিয়েছে। ব্যারাকে একটা অমূল্য সম্পদ এটা। পোল্যাণ্ডের বাসিন্দা জুলিয়াস সিলবার মারা গেছে অনেক দিন আগে। বহু বছর আগে সে এটাকে গোপনে ক্যাম্পে আমদানি করেছিল। ৫০৯ দেখল, এখনও তার হাতে দশ মিনিট আছে। তা সত্ত্বেও ক্যাম্পে ফিরে যাওয়াই সে স্থির করল। আবার ঘুমিয়ে পড়ার ইচ্ছা তার নেই। ঘুমিয়ে পড়লে আবার জাগবে কিনা তার ঠিক নেই। ক্যাম্পের প্রধান সড়কটার দিকে আর একবার সে সতর্ক দৃষ্টি ফেলল। বিপদ ঘটার মতো এবারেও কিছু চোখে পড়ল না। সেটা সে আশঙ্কাও করেনি। ক্যাম্পের পুরোনো লোকের কাছে সতর্কতাটা বাস্তব ভয়ের থেকেও বেশি অভ্যাসের ব্যাপার।

পেটের অসুখের কারণে ছোট ক্যাম্পটা এক ধরনের পৃথকীকরণ ব্যবস্থা চালু আছে। এস-এস’রা কদাচিৎ সেখানে ঢোকে। তাছাড়া, যুদ্ধের বছরগুলিতে গোটা ক্যাম্পটাতেই খবরদারির ব্যাপারটা রীতিমতো শিথিল হয়ে পড়েছে। যুদ্ধটা বেশি ঘোরালো হয়ে উঠলে ঝটিকাবাহিনীর যে সব প্রহরী এতদিন কেবল বন্দীদের উপর বীরত্ব ফলিয়ে আর হত্যা করে আসছিল? তাদের যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। আগে ক্যাম্পে ঝটিকাবাহিনীর যত সৈন্য থাকত, এখন ১৯৪৫’র এই বসন্তে তার সংখ্যা এক-তৃতীয়াংশে নেমে গেছে। ইদানীং অভ্যন্তরীণ প্রশাসন-ব্যবস্থাটা প্রায় পুরোপুরি কয়েদিদেরই হাতে। প্রত্যেক ব্যারাকে একজন ব্লক-সিনিয়র আর কয়েকজন রুম-সিনিয়র আছে; মজুর দলগুলো কাপো আর ফোরম্যানের অধীনে আর, গোটা ক্যাম্পটা ক্যাম্প-সিনিয়রের অধীনে। সকলেই কয়েদি। ক্যাম্পলীডার, ব্লক-লীডার আর গ্যাঙ-লীডাররা এদের নিয়ন্ত্রণ করে। তারা হল ঝটিকাবাহিনীর লোক। প্রথম দিকে ক্যাম্পে ছিল শুধু রাজনৈতিক বন্দী। তারপর বছরের পর বছর ধরে শহর আর শহরতলির জেলগুলো থেকে সাধারণ অপরাধীরা আসতে থাকল। এদের আলাদা করে চেনার জন্য পোশাকের উপর বিভিন্ন রঙের কাপড়ের ত্রিভুজ সেলাই করে দেয়া হত। সমস্ত কয়েদিদের ক্ষেত্রেই এই ব্যবস্থা। রাজনৈতিক বন্দীদের ত্রিভুজের রঙ লাল, গুণ্ডা বদমাশদের সবুজ। ইহুদিদের থাকত আরও একটা ত্রিভুজ, হলুদ রঙের; ফলে দুটো মিলে ইহুদিদের ধর্মীয় প্রতীক ‘ডেভিডের তারা’ হয়ে উঠত। লেবেন্থালের ওভারকোট আর জোসেফ বুচারের জ্যাকেটটি খুলে ৫০৯ নিজের পিঠে ফেলল, তারপর ব্যারাকের দিকে গুড়ি মেরে এগিয়ে যেতে শুরু করল। স্বাভাবিকের থেকে বেশি ক্লান্ত হয়েছে সে। এমন কি হামাগুড়ি দিতেও কষ্ট হচ্ছে তার। অল্প পরেই তার পায়ের তলার মাটিটা দুলতে থাকল। থেমে গিয়ে, চোখ বুঁজে সে লম্বা-লম্বা শ্বাস নিতে থাকে। ঠিক সেই সময়েই শহর থেকেই সাইরেনের আওয়াজ ভেসে সে।

প্রথমে দুটো আওয়াজ। কয়েক সেকেণ্ড পরেই আরও অনেকগুলো। তারপরেই মনে হল গোটা শহরটা যেন চেঁচিয়ে উঠছে। ছাদের উপর থেকে, রাস্তাগুলো থেকে, বুুরুজগুলো থেকে, কারখানাগুলো থেকে আর্তনাদ। রোদে শুয়ে রয়েছে শহরটা, কিছুই সেখানে নড়াচড়া করছে না। অথচ মৃত্যুর মুখে হঠাৎ পড়ে গেলে পশু যেমন পালাতে পারে না, শুধু চিৎকার করে ওঠে, সেরকম নিস্তব্ধ আকাশে সাইরেন আর স্টীমের বাঁশি আর্তনাদ করে উঠল।

৫০৯ মড়ার মতো শুয়ে পড়ল। বিমান-হামলার সাইরেন বাজলে ব্যারাকের বাইরে থাকা নিষেধ। দৌড়ানোর চেষ্টা সে করতে পারত, কিন্তু যথেষ্ট ছোটার মতো শক্তি তার নেই। আর ব্যারাকটাও অনেক দূরে। নতুন আসা কোন প্রহরী খেপে গিয়ে তার দিকে গুলি চালাতে পারে। যত তাড়াতাড়ি পারে কয়েক গজ হামাগুড়ি দিয়ে পিছিয়ে মাঠের একটা অগভীর খাঁজের মধ্যে শরীরটাকে মিশিয়ে দিয়ে ধার করা জামাগুলো দিয়ে নিজেকে ঢেকে ফেলল সে। দেখে মনে হবে কেউ যেন মরে পড়ে আছে। প্রায়ই সেটা ঘটে, কেউ তাই সন্দেহ করে না। যাই হোক, বিপদ-সঙ্কেত তো আর বেশিক্ষণ থাকবে না। গত কয়েক মাস ধরেই শহরটায় মাঝে-মাঝেই সাইরেন বেজেছে, কিন্তু কোনবারই কিছু ঘটেনি। বিমানগুলো প্রত্যেকবারেই হ্যানোভার আর বার্লিনের দিকে উড়ে গেছে।

ক্যাম্পের সাইরেনগুলোও বাজতে শুরু করল। তারপর খানিকক্ষণ পরে দ্বিতীয় বিপদ-সঙ্কেত। আর্তনাদটা বাড়তে-কমতে থাকে, যেন বিরাট আকারের গ্রামোফোনে পুরোনো ক্ষয়ে-যাওয়া রেকর্ড চলছে। বিমানগুলো শহরের দিকে এগিয়ে আসছে। ৫০৯- ও ব্যাপারটা দেখেছে। এতে তার কিছু মনে হয় না। যার ভয়ে শহরটা আর্ত চিৎকার করছে সে তার শত্রু নয়। প্রথম যে-মেশিনগানচালক ওকে দেখে বুঝবে যে ও মরেনি, সে-ই তার শত্রু। কাঁটাতারের ওপারে যা ঘটছে তাতে ওর কিছু আসে-যায় না।

অতিকষ্টে সে নিশ্বাস নেয়। কোটের নিচের বদ্ধ বাতাস যেন তার উপর ভারী হয়ে উঠেছে। তবুও গর্তটার মধ্যে সে এমনভাবে শুয়ে তাকে, যেন কবরের ভিতরে রয়েছে। ধীরে ধীরে তার মনে হয় এটাই বুঝি সত্যিকারের কবর। এখান থেকে আর কখনও সে উঠতে পারবে না। এই তার শেষ শোয়া, এখানে শুয়ে-শুয়েই তাকে মারতে হবে। যে কঠিন অবসন্নতার বিরুদ্ধে লড়াই করে সে এদ্দিন টিকে আছে তার কাছেই বুঝি শেষ পর্যন্ত সে হেরে যাচ্ছে। সে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করতে থাকে, কিন্তু লাভ হয় না। নিজের ভিতরে যে রহস্যময় হাল ছেড়ে-দেওয়া প্রতীক্ষা তার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছিল সেটাই আরও বেশি করে সে অনুভব করে- যেন সব কিছুই প্রতীক্ষা করে আছে’ শহরটা প্রতীক্ষা করছে, বাতাস প্রতীক্ষা করছে, এমন কি আলোও যেন প্রতীক্ষা করে আছে। এ যেন এক সূর্যগ্রহণ; যখন চারদিকের যাবতীয় রঙ সীসার মতো বিবর্ণ হয়ে ওঠে আর দূর থেকে মৃত্যুর ইঙ্গিত পাওয়া যায়; যেন এক শূন্যতা- মৃত্যু আসবে, না আসবেনা? তারই জন্য শ্বাসরুদ্ধ প্রতীক্ষা!

আঘাতটা বড় রকমের নয়, কিন্তু অপ্রত্যাশিত। আর সেটা এল সেই দিক থেকে যেদিকটাকে বেশি সুরক্ষিত বলে মনে করেছিল। ৫০৯-এর মনে হল যেন মাটির গভীর থেকে পেটের উপর এক প্রবল ধাক্কা লাগল। সেই সঙ্গে প্রচণ্ড ইস্পাতের ঘড়ঘড় শব্দ যেন বাইরের আর্তনাদটাকে চিরে জেগে উঠল। শব্দটা দ্রুত বেড়ে উঠতে থাকে, সাইরেনের আওয়াজেরই মতো, কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে। মাটির ভিতর থেকে ধাক্কাটা, না তারপরেই যে বিস্ফোরণ- কোনটা যে আগে হল ৫০৯ তা বুঝতে পারল না। কিন্তু এটুকু বুঝল যে আগের বিপদ-সঙ্কেতের সময় এর কোনটাই ছিল না। তারপর যখন সেটা আরও কাছে, আরও জোরে, বার বার হতে থাকল, তখন সেও বুঝল বিমানগুলো উড়ে চলে যায়নি। শহরে বোমা পড়ছে। প্রথমবারের মত।

আবার কেঁপে উঠল মাঠটা। ৫০৯-এর মনে হল মাটির নিচে থেকে ভারী রবারের মুগুর দিয়ে কেউ তাকে মারছে। হঠাৎ সে পুরো জেগে উঠল। ঝড়ের মুখে ধোঁয়ার মতো কোথায় মিলিয়ে গেছে অবসাদ। মাটির ভিতর থেকে আসা প্রতিটি ধাক্কা তার মস্তিষ্কে আঘাত করছে। কিছুক্ষণ সে স্থির হয়ে শুয়ে রইল, তারপর কি করছে না-বুঝেই, সাবধানে একটা হাত বাড়িয়ে মুখের সামনে থেকে কোটটা খানিক তুলে ধরল।

রেল স্টেশনটা যেন খেলার ছলে নিজেকে শূন্যে মেলে ধরল। সোনালী গম্বুজটা যখন শহরের পার্কের উপর দিয়ে উড়ে গেল। কি সুন্দরই না দেখতে লাগল! বিস্ফোরণের আওয়াজগুলোর সঙ্গে এর যেন কোন সম্পর্ক নেই। সবই যেন খুব ধীরে ধীরে হচ্ছে। গ্রেট-ডেন কুকুরের গম্ভীর গর্জনের মধ্যে টেরিয়ারে ঘেউ ঘেউ যেমন মিইয় যায় তেমনি বিমানধ্বংসী কামানের আওয়াজও মিলিয়ে গেল। পরের প্রচণ্ড বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গে সেন্ট ক্যাথেরিন গির্জার বুরুজগুলো বেঁকে যেতে শুরু করল। সেটাও মাটিতে পড়ল খুব ধীরে ধীরে, আর পড়তে-পড়তে কয়েক টুকরো হয়ে গেল; যেন বাস্তব নয়, একটা মন্থরগতি চলচ্চিত্র।

বাড়িগুলোর ফাঁক দিয়ে ধোঁয়ার ফোয়ারা ছাতার আকার নিতে থাকল। ধ্বংসের অনুভূতি ৫০৯-এর তখনও হয়নি। অদৃশ্য দৈত্যরা যেন খেলা করছে, আর কিছু নয়। শহরের যে-অংশটা রক্ষা পেয়েছে, সেখানের চিমনি থেকে শান্তভাবে ধোঁয়ার কুণ্ডলী উঠছে; মেঘগুলো আগের মতোই নদীর জলে ছায়া ফেলছে, আর বিমানধ্বংসী কামানের ধোঁয়ার কুণ্ডলীগুলো আকাশের ধার এমনভাবে মুড়ে দিয়েছে, যেন একটা নিরীহ কুশনের সেলাইগুলো ফেটে ধূসর-সাদা রঙের তুলোর আঁশ বেরিয়ে পড়ছে।

শহর থেকে অনেক দূরের মাঠে আরেকটা বোমা পড়ল। মাঠটা উঠে এসেছে ক্যাম্পের দিকে। তাতেও ৫০৯-এর ভয় করল না; একমাত্র যে সংকীর্ণ জগৎটুকু তার চেনা, এই সবকিছু তার থেকে অনেক অনেক দূরে। এখানের মানুষ ভয় করে চোখ আর অণ্ডকোষের উপর জ্বলন্ত সিগারেটের, উপোস-কুঠরিতে সপ্তাহের পর সপ্তাহ থাকার যেখানে না-যায় দাঁড়ানো, না-যায় শোয়া; সেই হাঁড়িকাঠের মতো যন্ত্রটার ভয়, যাতে শুইয়ে মূত্রাশয়গুলোকে থেঁতো করা হয়; ফটকের বাঁদিকের ধোলাই কামরার ভয়; স্টাইনব্রেনারের ভয়, ব্রয়রের ভয়, ক্যাম্প লীডারের ভয়। কিন্তু ছোট ক্যাম্পে ৫০৯-কে নিয়ে আসার পর থেকে এই ভয়টাও ফিকে হয়ে গেছে। বেঁচে থাকার মতো জোরের সন্ধান পেতে হলে তাড়াতাড়ি ভুলতে পারার ক্ষমতা থাকা চাই। তাছাড়া, দশ বছর মেলার্ন কনসেনট্রশন ক্যাম্পও যেন পীড়নের ব্যাপারে খানিকটা হাঁপিয়ে পড়েছে; এমন কি ঝটিকাবাহিনীর তরতাজা আদর্শবাদী লোকও কঙ্কালের উপর পীড়ন চালিয়ে-চালিয়ে এক সময় বিরক্ত হয়ে যায়। ওগুলো বেশি কিছু সহ্য করতে পারে না, আর যথেষ্ট প্রতিক্রিয়াও দেখা যায় না। কেবল যন্ত্রণা সহ্য করার উপযুক্ত শক্তসমর্থ নতুন কোন কয়েদির দল এলেই পুরোনো দেশপ্রেমের উৎসাহটা কখনও চাগিয়ে উঠে। তখন আবার রাতে সেই পরিচিত আর্তনাদ শোনা যায়, আর এস-এস স্কোয়াডগুলোকে ভরপেট আলু আর লাল বাঁধাকপি দিয়ে পর্করোস্ট খাওয়ার পর একটু বেশি প্রাণবন্ত দেখায়। যুদ্ধের দিনগুলোয় জার্মানিতে ক্যাম্পগুলো বরং বেশ দরদী হয়ে উঠেছিল। শুধু গ্যাস দেয়া হত, লাঠিপেটা করা হত আর গুলি করা হত। অথবা লোকগুলোকে খাটিয়ে অসাড় করে উপোসে মারা হত। ক্রিমেটারিয় ামে মাঝে মাঝে যে দু’একটা জীবন্ত মানুষকেও পুড়িয়ে ফেলা হত সেটা ইচ্ছে করে হত না, হত কোন কোন কঙ্কাল অনেকদিন ধরে নড়াচড়া করত না বলে। এটা কেবল তখনই ঘটত যখন পাইকারী হারে আসা নতুন কয়েদিদের জন্য জায়গা দরকার পড়ত। এমন কি মেলার্নেও? যারা কোন কাজও করতে পারত না তাদেরও খেতে না দিয়ে মেরে ফেলার কাজটা খুব বেশি হত না; ছোট ক্যাম্পে তখনও কিছু না কিছু খাদ্য পাওয়া যেত, আর তাই দিয়ে ৫০৯-এর মতো প্রাচীনরা বেঁচে থেকে নজির স্থাপন করতে পেরেছিল।

বোমাবর্ষণ থেমে যায় হঠাৎ। যদিও বিমানধ্বংসী কামানগুলো তখনও গজরাচ্ছে। ৫০৯ কোটটা আরও তুলে ধরে, যাতে সব থেকে কাছের মেশিনগানারকে সে দেখতে পায়। চৌকিটা ফাঁকা। খানিকটা ডান দিকে সে তাকায়; তারপর বাঁ দিকটায়। ওদিকটায় বুরুজগুলোতেও কোন প্রহরী নেই। সব জায়গা থেকেই এস-এস স্কোয়াডরা নেমে নিরাপদ আশ্রয় নিয়েছে; ব্যারাকের গায়েই তাদের জন্য বিমান-হামলা প্রতিরোধী আশ্রয় আছে। ৫০৯ কোটটা ছুঁড়ে ফেলে কাঁটাতারের দিকে আরও খানিকটা গুড়ি মেরে এগিয়ে উপত্যকার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল।

শহরের সর্বত্র আগুন। আগে যেটা খেলার মতো দেখাচ্ছিল এরই মধ্যে তা হয়ে উঠেছে আগুন আর ধ্বংস। দৈত্যকায় শামুকের মতো হলুদ আর কালো ধোঁয়া রাস্তাগুলোর উপর ঘুরে বেড়াচ্ছে আর বাড়িগুলোকে গিলে খাচ্ছে। আগুনের শিখা সর্বত্র দাউ দাউ করছে। রেলস্টেশন থেকে আগুনের ফুলকির একটা বিরাট শীষ লকলক করে উঠল। সেন্ট ক্যাথারিন গির্জার ভাঙ্গা বুরুজ জ্বলতে শুরু করেছে, আর সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুতের বিবর্ণ ঝিলিকের মতো আগুনের জিভগুলো লকলকিয়ে ওঠছে। কিন্তু এই সব কিছুর পিছনে সূর্যটা তার সোনালী মহিমায় দাঁড়িয়ে, যেন কিছুই হয়নি। আর নীল-সাদা আকাশটা ঠিক আগের মতোই। অরণ্য আর পর্বতের সারি শান্ত, অনাহত। যেন এক অজ্ঞাত ভীষণ বিচারে শহরটাকেই কঠোর দণ্ড দেয়া হয়েছে। গোটা দৃশ্যটাতেই এক ভৌতিক।

৫০৯ সমস্ত সতর্কতা ভুলে একদৃষ্টে নিচের দিকে তাকিয়ে থাকে। শহরটাকে সে কেবল কাঁতাতারের ফাঁক দিয়েই চেনে, কোনদিন যায়নি সেখানে। কিন্তু ক্যাম্পে যে দশটা বছর সে কাটিয়েছে?সেই দশ বছরে নিছক একটা শহর থেকেও বেশি কিছু একটা হয়ে উঠেছে ওটা।

প্রথম প্রথম এটা ছিল হারানো স্বাধীনতার অসহনীয় প্রতিরূপ। দিনের পর দিন ওর দিকে সে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকেছে। ক্যাম্প-লীডার হ্বেবারের এক বিশেষ আপ্যায়নের পর সে যখন আর হামাগুরি দিতেও আর পারে না সেই সময় নিশ্চিন্ত জীবনে ভরপুর শহরটার দিকে সে হিংসার চোখে তাকিয়ে থেকেছে; খুঁটি থেকে ঝুলন্ত অবস্থায় গম্বুজ আর বাড়ি ভরতি এই শহরকে সে অপলকে দেখেছে; থেঁতলানো মূত্রাশয়ের জন্য যখন তার রক্তস্রাব হচ্ছিল, বসন্তের সেই দিনগুলিতে এই শহরকে সে দেখেছে- নদীর বুকে সাদা নৌকা আর মোটরগাড়ির রাস্তা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে। এই শহরকে যখনই সে দেখেছে তখনই তার চোখ জ্বালা করেছে। সেটা এক আশ্চর্য যন্ত্রণা, ক্যাম্পের সব যন্ত্রণার ভিন্ন এক যন্ত্রণা।

এই শহরকে সে ঘৃণা করতে শুরু করে। দিন কেটে যায় অথচ শহরটা বদলায় না। এখানে যাই ঘটুক না কেন, শহরটার কিছুই যায় আসেনি তাতে। রোজকার মতই উনুনগুলো থেকে ধোঁয়া উঠেছে, ক্রিমেটারিয়ামের ধোঁয়ার ছোঁয়া তাতে লাগেনি; তার খেলার মাঠ আর পার্কগুলোতে লোকের ভিড়, অথচ এখানে গ্রীষ্মের ছুটির দিনে খুশিতে ভরপুর মানুষ বনে বনে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আর পাথরের খাদ থেকে ফেরার সময় কয়েদিদের সারি তাদের মৃত আর খুন হওয়া সঙ্গীদের টানতে টানতে বয়ে আনছে ক্যাম্পে। এই শহরকে ও ঘৃণা করে, কারণ সে জানে, শহরটা তাকে ও অন্যান্য কয়েদিদের চিরকালের জন্য ভুলে গেছে।

শেষ পর্যন্ত এই ঘৃণাও মরে গেছে। একটুকরো রুটির জন্য মারামারি অন্য সব কিছুর থেকে বেশি দরকারী হয়ে পড়লে ঘৃণা আর স্মৃতিও যে মিলিয়ে যেতে পারে এই জ্ঞানটাও অর্জিত হলো। নিজেকে গুটিয়ে রাখতে, ভুলে যেতে, এবং প্রতিটি মুহূর্তে অস্তিত্ব রক্ষা ছাড়া বাকী সব বিস্মৃত হতে শিখেছিল ৫০৯। শহরটার সম্বন্ধে সে নিস্পৃহ হয়ে উঠল, আর মনটা এমন বিষন্নতায় স্থির হল যে তার ভাগ্য আর কোনদিন বদলাবে না।

সেই শহরটা এখন জ্বলছে। ৫০৯ বুঝতে পারে তার হাত কাঁপছে। কাঁপুনিটা সে থামাতে চেষ্টা করে, কিন্তু পারে না; বরং আরও বেড়ে ওঠে। তার ভিতরের সব কিছু শিথিল হয়ে গেছে, যেন সংযোগ নেই একটার সঙ্গে অন্যটার। তার মাথা ব্যথা করে, আর বুকের ভিতরে কেউ ঢাক বাজায়।

৫০৯ চোখ বোঁজে। সে চায়নি তার মধ্যে আবার কিছু জেগে উঠুক। সমস্ত আশা সে কবরচাপা দিয়েছিল। হাতদুটো সে মাটিতে পড়ে যেতে দেয়, তারপর মুখটা রাখে হাতদুটোর উপর। শহরটা নিয়ে তার কোন মাথাব্যথা নেই। তাকে নিয়েও শহরের যেন কোন মাথাব্যথা না থাকে, এটাই সে চায়। আগেকার মতোই নিস্পৃহ থেকে সে চায় যে, পচা পার্চমেণ্টের মতো যে-চামড়াটা তার মাথাটাকে ঢেকে রেখেছে. তার উপর রোদ পড়ুক। সে চায় নিশ্বাস নিতে, উকুন মারতে।

কিন্তু না, সে পারে না। ভিতরের কাঁপুনিটা থামে না তার। সে চিত হয়ে টান-টান শুয়ে পড়ল। উপরের আকাশে এখনো বিমান-ধ্বংসী কামানের গোলার ছোট ছোট ধোয়ার কুণ্ডলি। ধোয়াগুলো দ্রুতই বাতাসের সঙ্গে ভেসে চলে যায়। কিছুক্ষণ শুয়ে থাকার পরআকাশটাকেও আর সহ্য হয় না। মনে হয় তার আকাশটা যেন নীল আর সাদা অতল গহ্বর, আর সে সেখানে উড়ছে। সে উঠে বসে। শহরটার দিকে না তাকিয়ে সে চেয়ে থাকে ক্যাম্পের দিকে। আর এই প্রথম বার যেন সেখান থেকেই কোন সাহায্যের আশা করতে থাকে সে।

ব্যারাকগুলো সেই আগের মতোই রোদে পুড়ছে। গেটে সেই চারজন লোক এখনও খুঁটি থেকে ঝুলছে। স্কোয়াড লীডার ব্রয়ের উধাও, তবে ক্রিমেটারিয়াম থেকে ধোঁয়া উঠেই চলেছে, কেবল সেটা একটু হালকা হয়েছে। হয়তো ওরা ছোট কাউকে পোড়াচ্ছে, নয়তো কাজ বন্ধ রাখার হুকুম হয়েছে।

সব-কিছু খুঁটিয়ে দেখার জন্য ৫০৯ জোর চেষ্টা করতে থাকে। এই তার জগৎ। এখানে কোন বোমা পড়েনি। চিরকালের নিষ্করুণ ক্যাম্পটা আজও একাকী দাঁড়িয়ে। নি:সঙ্গতাই ওটাকে চালায়। কাঁটাতারের ওপারে যে দুনিয়া তার সঙ্গে ওর বিন্দু সংস্রব নেই।

বিমানধ্বংসী কামানটা বন্ধ হল। ৫০৯-এর মনে হল যেন তার চারদিকে কষে আঁটা কোলাহলের একটা বেল্ট হঠাৎ ছিঁড়ে গেছে। সেকেণ্ডের জন্য তার ভ্রম হল যেন সে এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিল ঘুম ভেঙ্গে চমকে সে পিছনে দেখল।

না, স্বপ্ন দেখেনি সে। ঐ তো শহরটা জ্বলছে। কেবল ধোঁয়া আর আগুনই চোখে পড়ছে, অন্য সবকিছু আবছা। কিন্তু তাতে কি এমন তফাত? যার ধ্বংস নেই, সেই শহরটাই তো জ্বলছে।

চমকে ওঠে সে। হঠাৎ মনে হয়, ক্যাম্পের প্রতিটি বুরুজের মেশিনগান বুঝি তার দিকেই তাক করা হয়েছে। চট করে চারদিক সে দেখে নেয়। না কিছুই হয়নি। বুরুজগুলো আগের মতোই ফাঁকা। রাস্তাগুলোতেও কেউ নেই। কিন্তু তাতে কোন লাভ নাই; প্রচণ্ড এক ভয় তার ঘাড় ধরে ঝাঁকুনি দিচ্ছে। মরতে সে চায় না! এখন নয়! কখনও নয়!

তাড়াতাড়ি পোশাকগুলো কুড়িয়ে গুড়ি মেরে ফিরে চলল সে। লেবেন্থালের কোটটা জড়িয়ে যায়, সে অভিশাপ দেয়, আবার হাঁটুর নিচ থেকে সেটা টেনে ব্যারাকের দিকে হামাগুড়ি দিতে থাকে। উত্তেজনায়, সব যেন গুলিয়ে যাচ্ছে। শুধু মৃত্যু নয়, আরও কিছুর হাত থেকে যেন সে ছুটে পালাচ্ছে।



২.

বাইশ নম্বর ব্যারাকের দুটি হল। প্রতিটি হল দুজন রুম সিনিয়রের হুকুমে চলে। দ্বিতীয় হলের দ্বিতীয় বিভাগে থাকে প্রবীণেরা। এটাই সব থেকে সংকীর্ণ আর স্যাঁতসেঁতে অংশ। কিন্তু তাতে ওদের বিশেষ দুশ্চিন্তা নেই। তারা যে একসঙ্গে থাকে, এটাই তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। এতে এরা আরও বেশি প্রতিরোধ-ক্ষমতা পায়। মরাটা ভাইরাস রোগের মতোই সংক্রামক; সার্বিক কাতরানির মধ্যে একা একা সহজেই ভেঙ্গে পড়তে হয়, তা সে চাক বা না চাক। কিন্তু কয়েকজন একত্রিত হলে নিজেদের আরও ভালোভাবে রক্ষা করা সম্ভব। একজন যদি হাল ছেড়ে দেয়ার কথা ভাবে, তার সাথীরা বাঁচার লড়াই চালিয়ে যেতে সাহায্য করে। ছোট ক্যাম্পের প্রবীণেরা বেশি খাদ্য পেত বলে বেশি দিন বাঁচত তা নয়, প্রতিরোধের এক মরিয়া ইচ্ছা তারা টিকিয়ে রেখেছিল বলেই তারা বেঁচে ছিল।

প্রবীণদের সেই ডেরায় একশ চৌত্রিশটা কঙ্কাল থাকত। যদিও জায়গাটা মাত্র চল্লিশ জনের পক্ষে উপযুক্ত ছিল। বাঙ্কগুলো খালি তক্তার খালি নয়তো পুরোনো পচা খড় বিছানো। কেবল নোংরা কম্বল ছিল কয়েকটি।

কেউ একজন মারা গেলে তাই নিয়ে কামড়াকামড়ি চলত প্রত্যেকবার। প্রত্যেকটা বাঙ্কে অন্তত তিন জন শোয়। এমন কি কঙ্কালদের পক্ষেও খুব ঠাসাঠাসি সেটা; কারণ কাঁধ আর বস্তির হাড় ছোট হয়ে যায় না। সার্ডিন মাছ যেভাবে কৌটায় ঠাসা হয় সেরকম পাশ ফিরে শুলে অবশ্য একটু জায়গা হয়, কিন্তু তাও ঘুমের ঘোরে প্রায়ই শোনা যায় কারও ধুপ করে পড়ে যাওয়ার শব্দ। কেউ কেউ উবু হয়ে ঘুমোয়। আর কারও শয্যাসঙ্গী যদি সন্ধ্যা বেলায় মারা যায় তো তার খুবই সৌভাগ্য ধরা হয়। মৃতদেহটা সরিয়ে নেয়া হয়, বলে অন্তত একটা রাত সে বেশ হাত-পা ছড়িয়ে শুতে পারে।

দরজার বাঁ দিকের কোণটা প্রবীণেরা নিজেদের জন্য বাগিয়েছিল। ওরা তখনও বারো জন। দু’মাস আগে ওরা ছিল চুয়াল্লিশ। শীত বাকিদের শেষ করেছে। ওরা সকলেই জানত তারা শেষ দশায় পৌঁছে গেছে। রেশন কমিয়ে দেয়া হয়েছে ধীরে ধীরে। মাঝে মাঝে দু-এক দিন তো খাওয়ার মতো কিছুই থাকে না। তারপর বাইরে সার দিয়ে মৃতদেহ রেখে দেয়া হয়।

বারো জনের মধ্যে একজন উন্মাদ, নিজেকে সে জার্মান মেষরক্ষী কুকুর ভাবত। তার একটাও কান ছিল না। ঝটিকাবাহিনীর কুকুর প্রশিক্ষণের সময় সে দুটো ছিঁড়ে নেয়া হয়েছে। সবথেকে কমবয়সী প্রবীণটির নাম কারেল। চেকোে াভিয়া থেকে আসা একটি বালক। মা-বাপ মারা গেছে; ওয়েস্টলাগ গ্রামের এক ধার্মিক কৃষকের আলুর ক্ষেতের সার হয়েছে তারা; কারণ সৎকার-হওয়া মানুষের ছাই ক্রিমেটারিয়ামে বস্তাবন্দী করে কৃত্রিম সার হিসেবে বিক্রি করা হয়। ফসফরাস আর ক্যালসিয়ামের ভাগ তাতে খুব বেশি। কারেল পরে রাজনৈতিক বন্দীদের লাল ব্যাজ। তার বয়স এগারো।

জ্যেষ্ঠ প্রবীণের বয়স বাহাত্তর। একজন ইহুদি। দাড়ির জন্য প্রাণপণ লড়াই করে সে। দাড়ি তার ধর্মের অঙ্গ। এস-এস.রা সেটা নিষিদ্ধ করেছে, কিন্তু লোকটা দাড়ি রাখার চেষ্টা চালিয়েই যায়। এ জন্য লেবার ক্যাম্পে কাঠগড়ায় তুলে আচ্ছা করে চাবকানো হয়েছে তাকে। ছোট ক্যাম্পে এসে তার বরাত একটু খুলেছে। এস. এস’রা এখানে নিয়মকানুন অত খুঁটিয়ে মানে না। উকুন, আমাশয়, টাইফয়েড আর যক্ষার খুব ভয় তাদের। পোলদেশী জুলিয়াস মিলবার ওর নাম দিয়েছিল অবিনশ্বর। কারণ বৃদ্ধ প্রায় এক ডজন ডাচ, পোলিশ, অস্ট্রীয় আর জার্মান কনসেনট্রেশন ক্যাম্প পার হয়ে এসেছিল। ইতিমধ্যে মিলবার টাইফয়েডে মারা গিয়ে নয়েবাউয়ের বাগানে বাসন্তফুল হয়ে ফুটেছে। মৃতদের ছাই নয়েবাউয়ের পায় বিনামূল্যে। যাই হোক অবিনশ্বর নামটা থেকেই গেছে। ছোট ক্যাম্পে এসে বৃদ্ধের দাড়িটা বেড়েছে আর উকুনের নিরাপদ প্রজননস্থল হয়ে উঠেছে।

এই বিভাগের রুম সিনিয়র ভূতপূর্ব চিকিৎসক ডা: এফ্রায়িম বার্জার। ব্যারাকটার শিয়রে দাঁড়িয়ে থাকা মৃত্যুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। শীতকালে বরফে পিছলে গিয়ে কঙ্কালরা যখন হাড় ভাঙ্গত সে তখন স্প্লিন্ট বেঁধে তাদের বাঁচাত। ছোট ক্যাম্পের কাউকে হাসপাতালে নিত না; কেবল যারা কাজ করতে পারে অথবা বেশ হোমরা-চোমরা ধরনের তাদের জন্যই হাসপাতালটা। বড় ক্যাম্পে শীতের বরফটাও কম বিপজ্জনক; খুব খারাপ আবহাওয়ার সময় শ্মশান থেকে ছাই এনে রাস্তায় ছড়িয়ে দেওয়া হত। কয়েদিদের কথা ভেবে যে এটা করা হত তা নয়, করা হত দরকারী মানব শ্রমশক্তি রক্ষা করার জন্য। সাধারণ শ্রমভাণ্ডারের সঙ্গে কনসেনট্রেশন ক্যাম্প সংযুক্ত হওয়ার পর থেকে এদিকে আরও বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। ক্ষতিপূরণ হিসেবে অবশ্য কয়েদিদের আরও বেশি খাটিয়ে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়া হত। শ্রমিক মারা গেলে কিছু আসে যায় না। কারণ রোজই যথেষ্ট নতুন লোককে গ্রেপ্তার করা হয়।

বার্জার সেই অল্প কয়েক জন কয়েদিদের একজন। যার ছোট ক্যাম্পের বাইরে যাওয়ার অনুমতি ছিল। কয়েক সপ্তাহ ধরে তার কাজ পড়েছে শ্মশানের লাশরাখা ঘরে। রুম-সিনিয়রদের সাধারণত কোন কাজ করতে হয় না, কিন্তু চিকিৎসকের টানাটানি পড়েছে, সেইজন্য তাকে তলব করা হয়েছে। এতে ব্যারাকের সুবিধা হয়েছে; কুষ্ঠরোগাক্রান্ত কাপোর মারফত কঙ্কালদের জন্য সে লাইজল, তুলো, অ্যাসপিরিন জাতীয় কিছু আনাতে পারত। কাপোটি আগে থেকেই বার্জারকে চিনত। এক বোতল আয়োডিনও বার্জার জোগাড় করেছিল, সেটা থাকত তার খড়ের তলায় লুকানো।

অবশ্য সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রবীণ হল লিও লেবেন্থাল। লেবার ক্যাম্পের কালোবাজারের সঙ্গে তার গোপন যোগাযোগ। আর গুজব ছিল বাইরের জগতের সঙ্গেও তার আতাত। কি করে যে সে যোগাযোগ রাখত তা কেউ জানত না। শুধু এটুকু জানা ছিল যে শহরের বাইরের ‘দি ব্যাট’ থেকে আসা দুজন গণিকা এর সঙ্গে যুক্ত ছিল। এমন কি ঝটিকাবাহিনীর একজন লোকও এর সঙ্গে আছে বলে মনে করা হত, তবে সে-সম্বন্ধে সত্যি-সত্যি কেউ কিছু জানত না। আর লেবেন্থাল তো কিছুই বলে না।

সব জিনিসেরই সে ব্যবসা চালায়। সিগারেটের টুকরো, গাজর, আলু, উদ্বৃত্ত খাদ্য, হাড়। কখনও-কখনও এক টুকরো রুটি তার মারফত পাওয়া যায়। কাউকে সে ঠকায় না, শুধু ব্যবসাটা চালু রাখে।

লেনদেনই তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে, কিসের লেনদেন সে-কথাটা বড় নয়। গোপনে নিজের জন্য সঞ্চয় করার চিন্তাও তার মাথায় আসেনি কখনও।

গুড়ি মেরে দরজা দিয়ে ঢুকল ৫০৯। পিছনের পড়ন্ত রোদ তার কানের ভিতর দিয়ে আসছে। ওর কালো মাথাটার দুধারে মুহূর্তের জন্য চকচক করে উঠল হলুদ রঙ। হাঁপাতে হাঁপাতে সে বলল, ‘শহরে ওরা বোমা ফেলেছে।’

কেউ জবাব দেয় না। এখনও চোখে কিছু দেখতে পায় না ৫০৯। বাইরের তীব্র আলোর পরে ব্যারাকের ভিতরটা এখানো অন্ধকার লাগছে। চোখদুটো বুঁজে আবার সে তাকায়। আবার বলে, ‘শহরে বোমা ফেলেছে ওরা। শুনতে পাওনি তোমরা?’

এবারেও কেউ কিছু বলে না। এইবার ৫০৯ অবিনশ্বরকে দেখতে পেল। দরজার কাছে মেষরক্ষী কুকুরকে সে চাপড়াচ্ছে। কুকুরটা ভয় পেয়ে ঘেউ-ঘেউ করে উঠল। তার ক্ষত-চিহ্নে-ভরা মুখের উপর জটপড়া চুলের ফাঁক দিয়ে ভয়ার্ত চোখদুটো জ্বলজ্বল করছে। অবিনশ্বর বিড়বিড় করে বলল, ‘ঝড়-বিজলি। ঝড়-বিজলি ছাড়া অন্য কিছু না। চুপ, নেকড়ে চুপ করো।’

৫০৯ হামা দিয়ে ব্যারাকের আরও ভিতর দিকে গেল। অন্যদের এত নিস্পৃহতা কেন তা সে বুঝতে পারে না। ‘বার্জার কোথায়?’ সে প্রশ্ন করে।

‘এখনও শ্মশানে।’

কোট আর জ্যাকেটটা সে মেঝেয় রাখে। ‘কেউ বাইরে যেতে চাও না?’

ওয়েস্টহফ আর বুচারের দিকে তাকায়। ওরা জবাব দেয় না।

শেষ পর্যন্ত অবিনশ্বর বলল, ‘কাজটা বেআইনি। বিপদ-সঙ্কেত যতক্ষণ থাকবে ততক্ষণ নিষেধ।’

‘বিপদ-সঙ্কেত শেষ হয়ে গেছে।’

‘এখনও হয়নি।’

‘হয়েছে। বিমানগুলো চলে গেছে। শহরে বোমা ফেলেছে ওরা।’

অন্ধকারের ভিতর থেকে একজন গরগর করে উঠল, ‘অনেকবার তো বলা হল।’

অবিনশ্বর চোখ তুলে তাকাল। ‘তার শাস্তি হিসেবে হয়ত আমাদের কয়েক জনকে গুলি করা হবে।’

‘গুলি?’ ওয়েস্টহফ কাশল। ‘এখানকার লোককে ওরা আবার গুলি করে কবে থেকে?’

মেষরক্ষী কুকুরটা ডেকে উঠল। আবিনশ্বর তাকে জোরে চেপে থাকে। ‘হল্যাণ্ডে বিমান-আক্রমণের পর দশ থেকে কুড়িজন রাজনৈতিক বন্দীকে ওরা গুলি করে মারত?যাতে তারা ভুল ধারণা গড়ে না তোলে। ওরা এইরকমই।’

‘আমার হল্যাণ্ডে থাকি না।’

‘জানা আছে আমার। হল্যাণ্ডে ওরাই গুলি করে মারত।’

‘গুলি!’ ওয়েস্টহফ ঘৃণাভরে ঘোঁতঘোঁত করে। ‘তুমি কি ফৌজি নাকি যে এই ধরনের আবদার করবে ? এখানে এরা ফাঁসিতে লটকায়, পিটিয়ে মেরে ফেলে।’

‘মুখ বদলাবার জন্যেও তো গুলি চালাতে পারে।’

‘তোমার ওই পোড়া-মুখ বন্ধ করো, ’অন্ধকারের ভেতরের লোকটা বলে উঠল।

৫০৯ বুচারের পাশে বসে চোখ বন্ধ করে। জ্বলন্ত শহরের উপরকার ধোঁয়াটা এখনও সে দেখতে পায়, আর বিস্ফোরণের ফাঁকা গর্জন অনুভব করতে থাকে।

‘তোমার কি মনে হয় আজ রাতে আমরা খেতে পাব কিছু ?’ অবিনশ্বর প্রশ্ন করে।

‘চুলোয় যাও, ’অন্ধকার থেকে আওয়াজ আসে, ‘আর কি চাই তোমার? প্রথমে চাইলে গুলি খেতে, তারপর চাইছ খাবার?’

‘ইহুদিকে আশা রাখতে হয়?’

‘আশা?’ ওয়েস্টহফ চাপা ঠাট্টার সুরে বলে।

‘তা ছাড়া আর কি?’ অবিনশ্বর শান্তভাবে বলে।

ওয়েস্টহফ ঢোঁক গিলল তারপর ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করল। কয়েকদিন ধরে সে জেলখ্যাপা হয়ে আছে।

৫০৯ চোখ খুলল। তারপর বলল, ‘চুলোয় যাও তুমি আর তোমার বোমাপড়া। ঈশ্বরের দোহাই, থামো।’

‘খাবার জিনিস কারও কাছে কিছু আছে নাকি?’ আবিনশ্বর প্রশ্ন করে।

‘হা ঈশ্বর!’ এই নতুন বোকামিতে লোকটার বুঝি দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম।

অবিনশ্বর পাত্তা দেয় না। ‘থেরেসিনণ্টাটে একবার একজনের কাছে একটা চকোলেট ছিল। সে তো এদিকে ভুলে গেছে। সেখানে যখন তাকে বাসে আনা হয় সেটা সে লুকিয়ে রাখে, তারপর ব্যাপারটা ভুলে যায়। পয়সা-ফেলা মেশিন থেকে কেনা দুধের চকোলেট। মোড়কটার উপর হিণ্ডেনবার্গের ছবিও ছিল।’

পিছন থেকে আওয়াজটা লাফিয়ে উঠল, ‘আর কি ছিল? একটা পাসপোর্ট ছিল না?’

‘না, তবে চকোলেটটা খেয়ে আমরা দুদিন বেঁচে ছিলাম।’

‘চিৎকার করে কাঁদছে কে?’ ৫০৯ জিজ্ঞাসা করে বুচারকে।

‘গতকাল যারা এসেছে তাদের একজন। নতুন। শীগগিরই চুপ করে যাবে।’

অবিনশ্বর হঠাৎ মন দিয়ে শোনে, ‘শেষ-’

‘কি?’

‘বাইরে, বিপদ কেটে গেছে। শেষ সঙ্কেত।

হঠাৎ খুব চুপচাপ হয়ে গেল। তারপর শোনা গেল পায়ের শব্দ। ‘কুকুরটাকে লুকোও, ’বুচার ফিসফিস করে বলে।

উন্মাদ লোকটাকে অবিনশ্বর বাক্সগুলোর ফাঁকে ঠেলে ঢুকিয়ে দিল। ‘শুয়ে পড়ো। চুপ!’ তাকে ও হুকুম মানতেও শিখিয়েছিল। ঝটিকাবাহিনীর লোকেরা দেখতে পেলে ওকে তৎক্ষণাৎ পাগল বলে ইনজেকশন দিয়ে শেষ করে দেবে।

বুচার ফিরে এল দরজার কাছ থেকে। ‘বার্জার আসছে।’



* * *

ড. এফ্রায়িম বার্জার লোকটি ছোটখাট, গড়ানো কাঁধ, ডিমের মতো মাথার সবটাই টাকা। চোখগুলো ফোলা-ফোলা, সারাক্ষণ পানি পড়ে।

‘শহরটা জ্বলছে, ’ঢুকতে ঢুকতে বলে সে।

৫০৯ উঠে বসল, ‘ওখানে ওরা কি বলছে এই ব্যাপারে?’

‘জানি না।’

‘জান না কেন? নিশ্চয়ই কিছু শুনেছ তুমি।’

‘শুনিনি, ’ক্লান্তভাবে জবাব দিল বার্জার। ‘বিপদ-সঙ্কেত বাজতে ওরা ক্রিমেটারিয়াম বন্ধ করে দেয়।’

‘কেন?’

‘আমি কি করে জানব? হুকুম হল, ব্যাস।’

‘আর এস.এস’রা? ওদের কাউকে দেখলে?’

‘না।’

তক্তার সারিগুলোর ফাঁক দিয়ে বার্জার পিছন দিকে চলে গেল। বার্জারের সঙ্গে কথা বলার জন্য ও অপেক্ষা করেছিল, আর এখন দেখা যাচ্ছে অন্যদের মতো সেও বীতশ্রদ্ধ। ব্যাপারটা সে বুঝতে পারে না। বুচারকে জিজ্ঞাসা করে, ‘বাইরে যাবার ইচ্ছে নেই?’

‘না।’

বুচারের বয়স পঁচিশ বছর। ক্যাম্পে সে আছে সাত বছর। তার বাবা ছিল সোশ্যাল-ডেমোক্রেটিক কাগজের সম্পাদক; ছেলেকে রাখার পক্ষে কারণটা যথেষ্ট। ৫০৯ ভাবতে থাকে?ও যদি কখনও এখান থেকে বেরোতে পারে তাহলে আরও বছর চল্লিশেক বাঁচতে পারে। চল্লিশ বা পঞ্চাশ বছর। আর আমার বয়স পঞ্চাশ। আমি হয়ত বছর দশেক বাঁচব, বড়জোর কুড়ি বছর। পকেট থেকে একটা কাঠের টুকরো বের করে সে চিবোতে থাকে। এ কথা আমি হঠাৎ ভাবছি কেন?

বার্জার ফিরে এল। ‘লোহমান তোমার সঙ্গে কথা বলতে চায়, ৫০৯।’

ব্যারাকের পিছন দিকের অংশটার নিচের দিকের একটা খড়হীন বাঙ্কে লোহমান শুয়ে আছে। এইটাই ওর ইচ্ছা। প্রচণ্ড আমাশার ভুগছে সে, আর উঠতে পারে না। এইভাবেই অনেকটা পরিচ্ছন্ন থাকা যায়। পরিচ্ছন্ন অবশ্য নয়। কিন্তু এসব জিনিসে ওদের সকলেরই অভ্যাস হয়ে গেছে। কমবেশি সকলেই প্রায় পেটের অসুখে ভোগে। লোহমানের পক্ষে এটা যন্ত্রণা। মৃত্যুর মুখে ও পৌঁছে গেছে পেটের ভিতর যতবার মোচড় দিয়ে ওঠে ততবারই ও কুণ্ঠিত হয়ে ক্ষমা চায়। মুখটা এত ফ্যাকাশে যে রক্তহীন নিগ্রোর মতো দেখায় তাকে। একটা হাত নাড়ল সে। ৫০৯ ওর দিকে ঝুঁকে পড়ল। লোহমানের চোখের গুলিদুটো হলদেটে হয়ে গেছে। ফিসফিস করে বলল, ‘এটা দেখছ?’ তারপর বড় করে হাঁ করল।

‘কি?’ নীল মাড়িগুলোর দিকে ৫০৯ তাকিয়ে থাকে।

‘পিছন দিকে, ডান দিকে- একটা সোনার ক্রাউন রয়েছে ওখানে।’

সরু জানালাটার দিকে লোহমান তার মাথাটা ঘোরাল। জানালার পিছনে সূর্যটা এখন রয়েছে, আর ব্যারাকের এই দিকটায় এখন একটা গোলাপী আলো পড়ছে।

‘হ্যাঁ, দেখেছি, ’৫০৯ বলল। সে কিছু দেখতে পায়নি।

‘ওটা বার করে নাও।’

‘কি?’

‘বার করে নাও’ অধীরভাবে ফিসফিস করে বলে লোহমান।

৫০৯ বার্জারের দিকে মুখ তুলে তাকায়। বার্জার মাথা নাড়ে। ‘কিন্তু ওটা যে শক্ত করে আঁটা,’ ৫০৯ বলে।

‘তাহলে দাঁতটা তুলে দাও। ওটা খুব শক্ত নয়। বার্জার এটা পারে। ক্রিমেটারিয়ামে এই কাজই ও করে। তোমরা দুজনে মিলে ঠিক পারবে।’

‘ওটা তুলতে চাইছ কেন?’

লোহমানের চোখের পাতাগুলো ধীরে ধীরে ওঠানাম করে। কাছিমের মতো দেখায় ওগুলোকে। পাপড়িগুলো আর নেই।

‘জানই তো কেন! সোনা। ওই দিয়ে তোমাদের খাবার কিনতে হবে। লেবেন্থাল ওটার ব্যবস্থা করতে পারবে।’

৫০৯ জবাব দেয় না। সোনার ক্রাউন লেনদেন করার কাজটা বিপজ্জনক। নিয়মমাফিক ক্যাম্পে আসার সঙ্গে সঙ্গে দাঁত-বাঁধানো সোনা তালিকাভুক্ত করা হয়, পরে তুলে নিয়ে ক্রিমেটারিয়ামে জমা করা হয়। তালিকাভুক্ত কোন দাঁত-বাঁধানো সোনার যদি সন্ধান না পায় ওরা, তাহলে গোটা ব্যারাককে দায়ী করা হয়। যতক্ষণ না সোনাটা ফেরত দেয়া হয়, ততক্ষণ কয়েদিদের খেতে দেয়া হয় না। যার কাছে ওটা পাওয়া যা তার ফাঁসি হয়।

‘তুলে নাও ওটা, ’লোহমান হাঁপাতে থাকে। ‘খুব সোজ। সাঁড়াশি বা তার হলেও চলবে!’

‘সাঁড়াশি নেই এখানে।’

‘তার! একটুকরো তার বেঁকিয়ে মাপমতো করে নাও।’

‘তারও নেই।’

লোহমান চোখ বোজে। সে শ্রান্ত হয়ে পড়েছে, ঠোঁটদুটো নড়ে, কিন্তু কথা বেরোয় না আর। দেহটা স্থির আর খুব পাতলা হয়ে গেছে, কেবল শুকনো ঠোঁট দুটোয় বাঁকা ভাবটা তখনও রয়েছে- প্রাণের একটি ছোট্ট কেন্দ্র, যার মধ্যে সীসার প্রবাহের মতো মৃত্যু নেমে আসছে।

৫০৯ খাড়া হয়ে দাঁড়ায়, বার্জারের দিকে তাকায়। লোহমান ওদের মুখ দেখতে পাচ্ছে না, উপরে বাক্সগুলোর তক্তায় আড়াল পড়েছে।

‘কি অবস্থার ওর?’

‘আর কিছু করার নেই। শেষ।’

৫০৯ ঘাড় নাড়ল। এইরকম ব্যাপার এতবার ঘটেছে যে ওর আর হৃদয়ে লাগে না। সবথেকে উপরের বাঙ্কে যে পাঁচজন মানুষ শুকিয়ে-যাওয়া বানরের মতো উবু হয়ে বসে আছে, পড়ন্ত রোদ এসে পড়েছে তাদের গায়ে। ওদের একজন বগল চুলকোতে চুলকোতে আর হাই তুলতে তুলতে জিজ্ঞাসা করল, ‘এখনই পটল তুলবে নাকি?’

‘কেন?’

‘ওর বাঙ্কটা আমরা নেব, কাইজার আর আমি।’

‘তোমরাই ওটা পাবে।’

যে আলোটা ইতস্ততা ঘুরে বেড়াচ্ছে তার দিকে একমুহূর্ত তাকায় ৫০৯। যে-লোকটা প্রশ্ন করেছিল পড়ন্ত আলোয় তার চামড়া চিতাবাঘের মতো দেখায়; কালো-কালো চাকা দাগ যেন সেলাই করে দেয়া হয়েছে। পচা খড়ই চিবাতে থাকে লোকটা। আরও কয়েকটা বাঙ্কের পরে দুজন লোক তীব্র কলহ করছে। মৃদু চড়-চাপড়ের শব্দ পাওয়া যায়।

৫০৯ টের পায় তার পায়ে আস্তে আস্তে টানা দিচ্ছে কে ; লোহমান তার প্যান্ট ঘরে টানছে। আবার ঝুঁকে পড়ে সে।

‘তুলে নাও, ’লোহমান ফিসফিস করে বলে।

বাঙ্কের কিনারায় বসে ৫০৯। ‘কোন কিছুর সঙ্গে এটা বদল করা যাবে না। খুবই বিপদের কাজ। কেউ ঝুঁকি নেবে না।’

লোহমানের মুখটা কেঁপে উঠল। কোনমতে সে বলল, ‘ওদের হাতে যেন না পড়ে। না না, ওদের হাতে নয়। পঁতাল্লিশ মার্ক দিয়ে কিনেছি এটা সেই ১৯২৩-এ। ওদের হাতে যেন না পড়ে! তুলে নাও দাঁতটা!’

হঠাৎ দুমড়ে গিয়ে সে কাতরাতে লাগল। কেবল ঠোঁট আর চোখের কাছের চামড়াটা গুটিয়ে গেল- যন্ত্রণা দেখতে পাওয়ার মতো অন্য কোন পেশী তার শরীরে নেই।

একটু পরেই সে পা ছড়িয়ে দিলো। বুকের থেকে হাওয়াটা চাপে বেরিয়ে আসার সময় একটা করুণ শব্দ হল।

‘ও নিয়ে দুশ্চিন্তা করো না, ’বার্জার তাকে বলল। ‘ঘরে এখনও খানিকটা পানি আছে। তবে কি আমরা সরিয়ে ফেলব ওটা?’

কিছুক্ষণ চুপ করে শুয়ে রইল লোহমান। ‘কথা দাও তোমরা ওটা সরিয়ে ফেলবে -ওরা আমাকে নিয়ে যাওয়ার আগেই।’ ফিসফিস করে সে বলল। ‘আমি চলে গেলে। তখন কাজটা সহজ হবে।’

‘বেশ।’ ৫০৯ বলল, ‘যখন এসেছিলে তখন ওটা তালিকায় ওঠেনি তো?’

‘না। কথা দাও, ঠিক ঠিক করবে!’

‘করব।’

লোহমানের চোখের উপর একটা পর্দা নেমে এসে সে দুটো শান্ত হয়ে গেল। ‘কি হচ্ছে ওখানে বাইরে?’

‘বোমা পড়ছে। বার্জার বলল, ‘শহরে বোমা ফেলা হয়েছে। এই প্রথম। আমেরিকান প্লেন।’

‘ওহ্-’

‘হ্যাঁ।’ বার্জার বলল নিচু গলায় দৃঢ় স্বরে, ‘সময় এগিয়ে আসছে। তোমার বদলা নেয়া হবে, লোহমান।’

৫০৯ চট করে মুখ তুলে তাকাল। বার্জার তখনও দাঁড়িয়ে, তার মুখটা ও দেখতে পায় না। কেবল ওর হাতদুটো দেখতে পায়। হাতদুটো একবার মুঠো হচ্ছে, একবার খুলছে। যেন কোন অদৃশ্য গলাকে টিপে ধরছে, আবার ছেড়ে দিচ্ছে।

লোহমান শুয়ে আছে শান্তভাবে। তার চোখদুটো বুঁজে গেছে, নিশ্বাসের গতি স্তিমিত। বার্জার-এর কথার মানে এখনও ও ঠিক বুঝেছে কিনা নিশ্চিন্ত হতে পারে না ৫০৯।

সে সোজা হয়ে দাঁড়াল। উপরের বাঙ্কের লোকটা জিজ্ঞাসা করে, ‘মরেছে নাকি?’ লোকটা তখনও গা চুলকাচ্ছে নিজের। বাকি চারজন কলের পুতুলের মতো বসে আছে। চোখের দৃষ্টি শূন্য।

‘না।’

৫০৯ বার্জারের দিকে ফিরল। ‘ওকে ও-কথা বললে কেন?’

‘কেন?’ বার্জারের মুখটা কুঁচকিয়ে উঠল। ‘কারণ, কারণ বুঝতে পারছ না সেটার?’

তার ডিমের মতো মাথাটাকে গোলাপী মেঘে ঢেকে দিল আলোটা। দুষিত ভারী আলোয় যেন ও ঘামছে। চকচকে চোখদুটো পানিতে ভরে গেছে; অবশ্য বেশির ভাগ সময়ই সে দুটো ওইরকমই থাকে; দুরারোগ্য সংক্রমিত চোখ ওর।

বার্জার কেন ও-কথা বলল, ৫০৯ কল্পনা করতে পারে। কিন্তু সে-কথা জেনে একজন মরতে-বসা লোকের কি লাভ? জেনে হয়ত তার পক্ষে ব্যাপারটা আরও কঠিন হয়ে উঠতে পারে। সে লক্ষ্য করল, মানুষটার চোখের পাতার উপর মাছি বসার উপক্রম করছে। কিন্তু লোকটার চোখের পাতা কাঁপে না।

বার্জার ঘুরে নিজেকে দরজার দিকে নিজেকে ঠেলে নিয়ে চলল। মাটিতে-শুয়ে-থাকা লোকদের মাড়িয়ে তাকে বাঙ্কে চড়তে হবে। দেখে মনে হয় যেন জলার মধ্য দিয়ে ছপছপ করে চলেছে একটা সারস। ৫০৯ চলল পিছু-পিছু।

দালান পার হয়ে ও চুপিচুপি ডাকল, ‘বার্জার?’ বার্জার স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। ৫০৯-এর হঠাৎ যেন দম ফুরিয়ে যায়। ‘তুমি কি সত্যিই বিশ্বাস কর?’

‘কি?’

আবার কথাটা বলবে কিনা ৫০৯ মন স্থির করতে পারে না। বললে বুঝি কথাটা বাতাসে উড়ে যাবে। ‘লোহমানকে তুমি যা বললে?’

বার্জার তাকাল ওর দিকে। তারপর বলল, ‘না।’

‘না?’

‘না। আমি বিশ্বাস করি না।’

‘কিন্তু-’। সবথেকে কাছের পার্টিশনটায় ঠেস দিয়ে দাঁড়াল ৫০৯। ‘তাহলে তুমি ও-কথা বললে কেন?’

‘লোহমানের জন্য বললাম। কিন্তু আমি নিজে বিশ্বাস করি না। কারও বদলা নেয়া হবে না; কারও না, কারও না’

‘আর শহরটা? শহরটা যে জ্বলছে শেষ পর্যন্ত!’

‘শহরটা জ্বলছে। অনেক শহরই এর মধ্যে পুড়েছে। ওর কোন অর্থ নেই, নেই।’

‘আছে! থাকতেই হবে।’

প্রচণ্ড আশা চাপা দিয়ে দেয় আবেগের সঙ্গে বার্জার ফিসফিস করে, ‘কিছু না, কিছু না।’ বিবর্ণ করোটিটা এদিক-ওদিক দোলে আর লাল চোখের কোটর থেকে জল বেরিয়ে আসে। ‘একটা ছোট্ট শহর জ্বলছে। আমাদের সঙ্গে তার কিসের সম্পর্ক? কিছু না। কিচ্ছুই বদলাবে না। কিচ্ছু না!’

মেঝে থেকে অবিনশ্বর বলল, ‘কয়েকজনকে ওরা গুলি করে মারবে।’

অন্ধকারের মধ্য থেকে সেই কণ্ঠস্বর বলে উঠল, ’চুপ করো! তোমার ওই সর্বনেশে মুখটা কি একবারও বন্ধ করতে পার না!’

দেয়ালের কাছে নিজের জায়গায় ৫০৯ উবু হয়ে বসে থাকে। মাথার উপর ব্যারাকের অল্প কয়েকটা জানালার মধ্যে একটা জানালা ছোট আর অনেক উঁচু। অল্প একটু রোদ এসে পড়ছে সেখানে। আলোটা গিয়ে পড়ল বাঙ্কের তক্তাগুলোর তিন নম্বর সারিতে। তারপর চির অন্ধকার!



৩.

ব্যারাকটা তৈরি হয়েছে মাত্র এক বছর আগে। এটা খাড়া করার সময় ৫০৯ হাত লাগিয়েছিল। তখনও লেবার ক্যাম্পের বাসিন্দা ও। পোল্যাণ্ডের পরিত্যাক্ত কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের কাঠের ব্যারাক ছিল এটা। একদিন তারই চারটে টুকরা এসে পৌঁছল শহরের রেলস্টেশনে। তারপর লরি বোঝাই হয়ে এই ক্যাম্পে। সেগুলো খাড়া হল। ছারপোকা, ভয়, নোংরা আর মৃত্যুর গন্ধ ছিল তাতে। সেগুলো থেকেই ছোট ক্যাম্পটা গড়ে ওঠে। প্রাচ্য দেশ থেকে এরপর যে পঙ্গু, মুমূর্ষু কয়েদির চালান এল?তাদের এখানে ঠেসে দেয়া হল জাহান্নামে যাওয়ার জন্য। কয়েকদিন গেল ওদের সাফ করতে। তারপর আরও আরও পঙ্গু, অসুস্থ, ভেঙ্গে-পড়া ও অথর্ব মানুষদের গাদাগাদি করে রাখা হল। পাকাপাকি মৃত্যুর প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠল এটা।

জানালার ডান দিকের দেয়ালের উপর একটা বাঁকাচোরা চৌকা পড়েছে রোদের। আবছা লেখা আর নামগুলো পড়া যাচ্ছে সেই আলোয়। পোল্যাণ্ড ও জার্মানির পূর্ব অঞ্চলের ব্যারাকের ভূতপূর্ব কয়েদিদের নাম। কাঠের উপর পেন্সিল দিয়ে তাড়াহুড়ো করে লেখা, নয়তো তারের ডগা আর পেরেক দিয়ে আঁচড় কাটা।

নাম গুলোর কয়েকটা ৫০৯-এর চেনা। ওই চৌকা আলোটার কোণের দিকে অন্ধকারের মধ্য থেকে একটা নাম ধীরে ধীরে মাথা তুলছে, এ-কথা ও জানে। নামটার চারদিকে মোটা দাগ কাটা- ‘চেইম উল্ফ, ১৯৪১।’ চেইম উল্ফ এটা লিখেছিল যখন সে বুঝে গিয়েছিল যে তাকে মরতেই হবে। নামটার চারদিকে লাইনগুলো টেনেছিল যাতে তার পরিবারের অন্য কারও নাম যুক্ত না হতে পারে। এটাকে সে চূড়ান্ত রূপ দিতে চেয়েছিল, যাতে একমাত্র সে-ই এটা হয়, আর একমাত্রই থাকতে পারে। চেইম উল্ফ, ১৯৪১। চারপাশের লাইনগুলো শক্ত হাতে আঁটো করে টানা শক্ত হাতে, ছেলেরা যাতে রক্ষা পায় সেই আশায় ভাগ্যের কাছে বাপের শেষ মিনতি। কিন্তু নিচেই, লাইনগুলোর তলায় ঘেঁষাঘেঁষি করে রয়েছে আরও দুটি নাম, যেন সেগুলো ওর সঙ্গে লেপটে থাকতে চায়- রুবেন উল্ফ, আর ময়শে উল্ফ। প্রথমটা খাড়াখাড়া, নড়বড়ে অক্ষরে স্কুলের ছাত্রের হাতের লেখা ; দ্বিতীয়টা হেলানে আর ঝরঝরে, আত্মসমর্পিত আর দৃঢ়তাহীন। এগুলির ঠিক পরেই অন্য হাতের লেখায়- ‘সকলকেই গ্যাস দিয়ে মারা হয়েছে।’

কোনাকুনি ভাবে নিচের দেয়ালের গায়ের একটা গাঁটের ছেঁদার উপর পেরেক দিয়ে আঁচড় কেটে লেখা ‘জোস মেয়ার’, তার পাশে এল.টি.ডি. আর.ই.কে ১ ও ২’। অর্থ হল, ‘জোসেফ মেয়ার রিজার্ভ বাহিনীর লেফটেনান্ট, লৌহ ক্রশ প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণী। দেখে মনে হয় মেয়ার কথাটা ভুলতে পারেনি। এমন কি তার শেষ দিনগুলিতেও কথাটা তাকে বিষিয়ে রেখেছিল। প্রথম মহাযুদ্ধে সে ফ্রণ্টে গিয়েছিল ; তাকে অফিসার করা হয়েছিল, আর সে ঐ গৌরব অর্জন করেছিল।

ইহুদি বলে তাকে অন্যদের দ্বিগুণ কৃতিত্ব দেখাতে হয়েছিল। পরে আবার ইহুদি বলেই তাকে কীটের মতো বিনষ্ট হতে হয়েছিল। প্রথম যুদ্ধে তার কৃতিত্বের জন্যই অন্যদের থেকে তার উপর বেশি অবিচার করার হয়েছিল এই বিষয়ে সে নি:সন্দেহ ছিল। ভুল করেছিল জোসেদ। এতে তার মরাটা আরও কষ্টকর হয়েছিল শুধু। তার নামের সঙ্গে সে যে-অক্ষরগুলো জুড়ে দিয়েছিল, অবিচারটা সেই অক্ষরগুলোর মধ্যে নয়?ওগুলো শুধু বিদ্রƒপ!

রোদের খুপ্পিটা ধীরে ধীরে সরে সরে যায়। চেইম, রুবেন আর ময়েশে উল্ফ, শুধু একটা কোনা দিয়ে রোদটা যাদের ছুঁয়েছিল, তারা আবার অন্ধকারে চলে গেল। দুটো নতুন লিপি তার জায়গায় আলোতে উঠে এল। একটায় কেবল দুটি বর্ণ, ‘এফ. এম’- পেরেক দিয়ে এইগুলো যে আঁচড় কেটেছিল, মেয়ারের মতো নিজেকে অত বড় ভাবত না সে। এমন কি নিজের নামটাও তার কাছে তুচ্ছ হয়ে গিয়েছিল। অবশ্য একটা চিহ্ন না রেখে সেও মরতে চায়নি। কিন্তু তার নিচেই একটা পুরো নাম ভেসে উঠল আবার। পেন্সিলে লেখা ‘তেভিয়ে লিবেশ ও তার পরিবার’। তারপরেই আরও তড়িঘড়ি করে লেখা ইহুদিদের শোকসূচক প্রার্থনার প্রথম কথাগুলো? ইয়িস গদলঃ

কয়েক মিনিটের মধ্যেই আর একটা অস্পষ্ট লেখার উপর আলোটা এসে পড়বে এ কথা ৫০৯ জানে। ‘লেহ সণ্ডকে খবর দিও। নিউইয়র্ক-’ রাস্তার নামটা আর পড়া যাচ্ছে না, তারপরেই লেখা ‘বা’। খানিকটা পচা কাঠের জায়গা, তারপরে লেখা ‘মারা গেছে। লিওর খোঁজ নিও।’ লিও মনে হয় পালিয়েছে; কিন্তু লেখাটা বৃথাই। ব্যারাকের অত বাসিন্দার মধ্যে কেউই নিউইয়র্কে লেহ স্যাণ্ডার্সকে খবরটা জানাতে পারেনি। ক্যাম্পটা থেকে কেউই বেঁচে ফেরেনি।



* * *

৫০৯ দেয়ালটার দিকে অন্যমনস্কভাবে চেয়ে থাকে। পোল-দেশীয় সিলবার ব্যারাকে শুয়ে থাকতে থাকতে দেয়ালটার নাম দিয়েছিল ‘কান্নার দেয়াল’। তখনও বেঁচেছিল ও আর পেট থেকে রক্ত বেরুচ্ছিল সমানে। নামগুলোও মুখস্থ ছিল ওর, প্রথমদিকে কোন একদিন সিলবার মারা যায় ; কিন্তু পরের দিনগুলোতেও নামগুলো ভূতুড়ে আলোয় জেগে উঠত আর অন্ধকারে মিলিয়ে যেত। গ্রীষ্মের দিনে সূর্য আরও উপরে উঠত। আরও নিচে লেখা অন্য নামগুলো তখন দৃষ্টিগোচর হত। শীতকালে আলোর চুকরোটা উপরের দিকে উঠে যেত এবং আরও অনেক নাম? রুশ, পোলদেশীয়, ইদ্দিশ চিরকালই থেকে যেত অন্ধকারে। কারণ সূর্যের আলোটা সেখানে পৌঁছাত না। এত তাড়াতাড়ি করে ব্যারাকটা খাড়া করতে হয়েছিল যে দেয়ালগুলো চেঁছে নেয়া নিয়ে এস.এস’রা মাথাই ঘামায়নি। কয়েদিদের তো কথাই নেই। আর দেয়ালের অন্ধকার অংশটায় লেখা নামগুলোকে পড়ার চেষ্টাও কেউ করেনি। কেবল শব্দ পড়ার জন্য কেউ কখনও বোকার মত দামী দেশলাইকাঠি খরচ করে না।

৫০৯ মুখ ফেরাল। ওসব জিনিস এখন সে দেখতে চায় না। নিজেকে তার ভীষণ একা মনে হল- যেন কোন অদ্ভুত উপায়ে হঠাৎ সবাই পর হয়ে গেছে। আরও খানিকক্ষণ সে অপেক্ষা করে থাকল; তারপর সহ্য করতে না পেরে দরজার দিকের পথটা হাতড়ে বাইরে চলে গেল।

নিজের ছেঁড়া জামাকাপড়গুলো শুধু এখন ওর গায়ে। ভীষণ শীত। বাইরে এসে ও ওঠে দাঁড়ায়। আর চারপায়ে হাঁটতে চায় না, ও চায় দাঁড়াতে। বুরুজের প্রহরীরা এখনও ফেরেনি। এদিকটায় কোন সময়েই পাহারার বেশি কড়াকড়ি ছিল না। যারা প্রায় হাঁটতেই পারে না? তারা আর পালাবে কোথায়!

৫০৯ দাঁড়িয়ে ছিল ব্যারাকটার ডান দিকের কোণে। পাহাড়ের সারিগুলোর একটা বাঁকে ব্যারাকটা সাজানো। এখান থেকে কেবল শহরটাই নয়, এস.এস বাহিনীর কোয়ার্টারগুলোও দেখতে পাচ্ছে সে। ওগুলো কাঁটাতারের বাইরে একসারি গাছের পিছনে। গাছগুলোর এখনও পাতা গজায়নি। সেগুলোর সামনে দিয়ে বেশ কিছু এস.এস বাহিনীর লোক এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছে। অন্যরা এক জায়গায় উত্তেজিতভাবে দাঁড়িয়ে শহরের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে।

একটা ধূসর মোটরগাড়ি দ্রুতবেগে উপরে উঠে এল। কমাণ্ডারের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল গাড়িটা। এস.এস কোয়ার্টারগুলো থেকে অল্প একটু দূরেই। নয়েবাউয়ের ইতিমধ্যেই বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে। তৎক্ষণাৎ ও গাড়িতে উঠল। ছুটে বেরিয়ে গেল গাড়িটা।

ক্যাম্পে থাকার সময় থেকেই ৫০৯ জানে, শহরে কমাণ্ডারের একটা বাড়ি আছে। সেখানে তার পরিবার থাকে। ওর চোখদুটো এত মনোযোগ দিয়ে গাড়িটাকে অনুসরণ করে যে ব্যারাকগুলোর মাঝখানের রাস্তা দিয়ে একজন যে ধীরেসুস্থে এগিয়ে আসছে তা ওর নজরে পড়ে না। ও হল হাণ্ডকে, বাইশ নম্বরের ব্লক-সিনিয়র। লোকটা গাঁট্টাগোট্টা, রবার সোল জুতো পরে সর্বদাই গুরে বেড়ায়। ওর পরনে অপরাধীদের সবুজ ত্রিভুজ চিহ্ন দেয়া পোশাক। খুনের অভিযোগে ক্যাম্পে এসেছে। বেশির ভাগ সময়েই নিরীহ, কিন্তু মাঝে মাঝে খেপে গিয়ে লোককে এমন পিটিয়েছে যে তারা পঙ্গু হয়ে গেছে।

পায়চারি করতে করতে ও এগিয়ে আসে। ৫০৯ তখনও ওর পথ ছেড়ে চুপিসারে সরে পড়ার চেষ্টা করতে পারত। ভয় পাওয়ার চিহ্ন দেখলে সাধারণত ও খুশি হয়; নিজের গুরুত্ব বোঝানোর জন্য। কিন্তু ৫০৯ তা না করে দাঁড়িয়ে রইল।

‘কি করা হচ্ছে এখানে?’

‘কিছু না।’

‘বটে! কিছু না।’ ৫০৯-এর পায়ের কাছে ও থুথু ফেলল।

‘বেটা ছারপোকা, খোয়াব দেখছ? অ্যাঁ।’ ওর শনের মতো ভ্রুদুটো উঁচু হয়ে উঠল। ‘মুণ্ডু ঘুরে যায় না যেন? এখান থেকে আর বেরুতে হচ্ছে না, বাছা। তোমাদের মত রাজনৈতিক বন্দীদেরকেই ওরা আগে চুল্লিতে পুরবে।

আবার থুথু ফেলে চলে যায় ও।

দম বন্ধ করে থাকে ৫০৯। কপালের পিছন দিকটায় একটা কালো পরদা সেকেণ্ডের জন্য কেঁপে ওঠে। হাণ্ডকে ওকে সহ্য পারে না। ৫০৯ সাধারণত ওকে এড়িয়ে চলে। এবারেও নিজের কোট ধরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। পায়খানার পিছন দিক দিয়ে যতক্ষণ না ও মিলিয়ে গেল ততক্ষণ সে ওকে দেখতে থাকল। হুমকিতে সে ভয় পেল না; ক্যাম্পে হুমকি শোনা নিত্য ব্যাপার। কথাগুলোর আড়ালে কি রয়েছে সেই কথাই শুধু ভাবতে থাকে সে। হাণ্ডকেও নিশ্চয়ই কিছু আঁচ করেছে। নাহলে এ-কথা বলত না। হয়ত এস-এস.দের ওখানেই কিছু শুনে।

৫০৯ আরও একবার শহরটার দিকে তাকাল। ধোঁয়াটা এখনো ছাদের কাছে লেপ্টে রয়েছে। দমকল-বাহিনীর ঘন্টার আওয়াজ কমে এসেছে। রেলস্টেশন থেকে অনিয়মিত চিড়চিড় শব্দ আসছে, যেন গোলাবারুদের বিস্ফোরণ হচ্ছে। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে ক্যাম্পের অধিনায়কের গাড়িটা এত জোরে বাঁক নিল যে গাড়িটা খানিক হড়কে গেল। ৫০৯ সেটা দেখতে পেল আর হঠাৎ ওর মুখটা পাকিয়ে হাসি হয়ে উঠল। ও হাসতে থাকে, নিঃশব্দে, কেঁপে কেঁপে। হাসি থামাতে পারে না সে, অথচ আনন্দও নেই ওর ভিতরে। ও হাসতে থাকে, তারপর সাবধানে চারদিকে তাকায়। তারপর আবার দুর্বল মুঠিটা শক্ত করে পাকিয়ে হাসতে থাকে। হাসতে হাসতে প্রচণ্ড কাশির দমকে শেষ পর্যন্ত মাটিতে বসে পড়ে।



৪.

মার্সিডিজ গাড়িটা তীরের মতো উপত্যকায় নেমে গেল। ঝটিকাবাহিনীর অধিপতি নয়েবাউয়ের ড্রাইভারের পাশেই বসে আছে। ভারী চেহারার লোক। অতিরিক্ত বিয়ার পানের ফলে মুখ ফোলা-ফোলা দেখাচ্ছে। চওড়া হাতে সাদা দস্তানাগুলো রোদে চকচক করে। সেটা নজরে পড়তে দস্তানা খুলে ফেলে সে। সেলমা ফ্রেইয়া বাড়িটা। ভাবতে ভাবতেই আগুনের গন্ধ পায় তারা। যতই সামনে যায় ততই চোখ জ্বালা করতে থাকে। ধোঁয়াটা ঘন হয়ে ওঠে। নিউ মার্কেটের কাছে প্রথম বোমার গর্তটা ওদের চোখে পড়ল। সেভিংস ব্যাঙ্কটা জ্বলছে। আশপাশের বাড়িগুলো বাঁচাতে চেষ্টা করছে দমকল। কিন্তু পানির প্রবাহে কোন কাজ হচ্ছে বলে মনে হয় না। চারদিক থেকে গন্ধক আর অ্যাসিডের গন্ধ আসছে। নয়েবাউয়েরের পেটটা মুচড়ে উঠতে থাকে। ‘হাকেনস্ট্রাস দিয়ে চালাও আলফ্রেড।’ ও বলে, ‘এখান দিয়ে আমার বেরোতে পারব না।’

ড্রাইভার মোড় ফিরল। শহরের দক্ষিণ দিক পরিক্রম করল গাড়িটা। ছোট ছোট বাগানওয়ালা বাড়িগুলো শান্তিতে রোদ পোহাচ্ছে। হাওয়া উত্তরমুখো। বাতাস পরিষ্কার। নদীটা পার হতেই পোড়া গন্ধটা আবার পাওয়া গেল। গন্ধটা বাড়তে থাকে, আর হেমন্তের গাঢ় কুয়াশার মত রাস্তার উপর ধোঁয়া জমে থাকতে দেখা গেল।

গোঁফে তা দেয় নয়েবাউয়ের। ফ্যুয়েরার৩-এর মতো সেটা ছোট করে ছাঁটা। একসময় দ্বিতীয় উইলিয়ামের মতো উপর দিকে পাকানো গোঁপ রাখত সে। পেটের এই খিল ধরাটা! সেলমা! ফ্রেইয়া! সুন্দর বাড়িটা! গোটা তলপেট বুজে সবটাই যেন পেট হয়ে গেছে।

শেষ পর্যন্ত গাড়িটা লিবিগস্ট্রাসের দিকে মোড় ফিরল। নয়েবাউয়ের বাইরের দিকে ঝুঁকে পড়ে। ওই তো বাড়িটা! সামনের বাগান! লনের উপর পোড়ামাটির বাসন আর লাল চীনেমাটির ভাল্লুকমুখো কুকুরটা। কোনও ক্ষতি হয়নি। সবগুলো জানালাই আস্ত! পেটের খিল ধরাটা ছেড়ে যায় তার। সিঁড়ি বেয়ে উঠে দরজাটা খোলে ও। ভাগ্য কি ভীষণ ভালো! তাই তো হবার কথা?শুধু তারই কিছু হতে যাবে কেন ?

হরিণের শিঙের টুপি রাখার তাকে চুপিটা ঝুলিয়ে রেখে বসার ঘরটায় ও ঢোকে। ‘সেলমা, ফ্রেইয়া, কোথায় তোমরা?’

কেউ সাড়া দেয় না। জানালাটার দিকে এগিয়ে গিয়ে টেনে খুলে দেয়। বাড়ির পিছন দিকটার বাগানে দুজন রুশ বন্দী কাজ করছে। তারা তাড়াতাড়ি একবার চোখ তুলে তাকিয়েই ব্যগ্রভাবে মাটি কোপাতে থাকে।

‘অ্যাই, অ্যাই? ব্যাটা বলশেভিক।’

একজন রুশ কাজ থামায়।

‘আমার বাড়ির লোকরা কোথায়?’ নয়েবাউয়ের হাঁক পাড়ে।

লোকটা রুশভাষায় কি যেন জবাব দিল।

‘চোপরাও গাধা, তোর ঐ শুয়োরের ভাষা ছাড়। জার্মান জানিস তুই, না কি বাইরে গিয়ে শিখিয়ে দেব?’

রুশ দুজন ওর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে। নয়েবাউয়েরের পিছন দিকে কে যেন বলে ওঠে, ‘আপনার স্ত্রী পাতালকুঠরিতে।’

ও ফিরে তাকায়। দাসী মেয়েটা। ‘পাতালকুঠরিতে? ওহো, হ্যাঁ হ্যাঁ, বটেই তো। তুমি কোথায় ছিলে?

‘বাইরে, এই একটুর জন্যে।’ মেয়েটা দরজার কাছে লাল-মুখে দাঁড়িয়ে, চোখ দুটো চকচক করছে?যেন বিয়ের আসর থেকে আসছে। ‘এর মধ্যেই নাকি শ খানেক মরেছে, ওরা বলছে।’ বকবক করতে শুরু করে মেয়েটি, ‘স্টেশনের ওখানে, তারপর তামা গালাইয়ের ওখানে, গির্জাতে’

‘চুপ কর!’ নয়েবাউয়ের ওকে বাধা দেয়, ‘কে বলল এসব কথা?’

‘ওই বাইরে, ওরা’

‘কারা?’ নয়েবাউয়ের এক পা এগিয়ে গেল। ‘এসব রাষ্ট্র-বিরোধী কথা কে বলল?’

মেয়েটি পিছিয়ে যায়। ‘ওই তো, আমি বলিনি- কে যেন বলল, সবাই’

‘বিশ্বাসঘাতক। জানোয়ার।’ নয়েবাউয়ের খেপে ওঠে। চেপে রাখা উত্তেজনাটা শেষ পর্যন্ত প্রকাশ করতে পারে। ‘শুয়োরের বাচ্চা। আতঙ্ক ছড়ানে ওয়ালা! তুমি বাইরে গিয়েছিলে কি করতে?’

‘আমি আমি কিছু করিনি’

‘কাজে ফাঁকি দেয়া হচ্ছে অ্যাঁ? মিথ্যা গুজব আর আতঙ্ক ছড়াচ্ছ, তাই না? দাঁড়াও এখুনি খুঁজে বার করছি। ব্যবস্থাও নেয়া হবে। কড়া ব্যবস্থা। যাও, রান্নাঘরে যাও।’

মেয়েটি ছুটে বেরিয়ে গেল। নয়েবাউয়ের হাঁফাতে থাকে। জানালাটা বন্ধ করে দেয়। না, কিছুই হয়নি, ভাবতে থাকে। ওরা তো পাতালকুঠুরিতেই রয়েছে। কথাটা আগেই ভাবা উচিত ছিল।

পকেট থেকে একটা চুরুট বার করে ধরায় সে। তারপর কোটটা টেনে-টুনে নিয়ে বুকটা টান করে আয়নায় একঝলক তাকিয়ে নেমে যায় সিঁড়ি বেয়ে।

দেয়ালে ঠেস-দেয়া কৌচে ওর স্ত্রী আর মেয়ে পাশাপাশি বসেছে। ওদের মাথার উপরে চওড়া সোনার ফ্রেমে ফ্যুয়েরার-এর একটা রঙিন ছবি।

যুদ্ধের আগে মদ রাখার পাতালকুঠুরিটাকে বিমান আক্রমণ-রোধী করে নেয়া হয়েছিল। স্টীলের কড়ি, কংক্রীটের ছাদ আর বড় বড় দেয়াল দেয়া ছিল। নয়েবাউয়ের সেই সময় ওটা তৈরি করিয়েছিল শুধু লোককে দেখানোর জন্য, প্রতিরক্ষার ব্যাপারে একটা ভালো দৃষ্টান্ত দেখানো দেশ প্রেমিকের কাজ হিসেবে। কেউ গুরুত্ব দিয়ে ভাবেনি জার্মানিতে বোমাবর্ষণ করা যাবে। জার্মান-বাহিনীর মুখে দাঁড়িয়ে শত্রুপক্ষের বিমান সেই কাজ কখনও যদি করতে পারে? লোকে যেন তাকে চাষা বলে ডাকে; মার্শাল গোয়েরিঙের এই ঘোষণা যে-কোন সৎ জার্মানের কাছে যথেষ্ট। দুর্ভাগ্যক্রমে ব্যাপারটা অন্যরকম দাঁড়িয়েছে। প্রকৃতই তারা যতটা দুর্বল?থেকে বেশি দুর্বল ভান করা হল ধনি আর ইহুদিদের বিশ্বাসঘাকতার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

‘ব্রুনো!’ সেলমা নয়েবাউয়ের দাঁড়িয়ে ফোঁপাতে শুরু করে।

ও বেশ ফরসা আর মোটা। লেস-বসানো স্যামন রঙের ফরাসী সিল্কের একটা ড্রেসিংগাউন পরে আছে। ১৯৪১-এ ছুটি কাঠাতে প্যারিস গিয়েছিল নয়েবাউয়ের। ফিরে আসার সময় নিয়ে এসেছিল। সেলমার পাংশুটে গালদুটো কাঁপছে।

‘ওটা শেষ হয়ে গেছে সেলমা, শান্ত হও।’

‘শেষ’ ও চিবিয়েই চলে, যেন কথাগুলো কোনিগ্সবার্গার মাংসের গুলি? ‘কতক্ষণের-কতক্ষণের জন্য?’

‘একেবারেই। ওরা চলে গেছে। আক্রমণটা প্রতিহত করা হয়েছে। ওরা আর ফিরে আসবে না।’

বুকের উপর ড্রেসিংগাউনটা শক্ত করে ধরে থাকে সেলমা নয়েবাউয়ের। ‘এ-কথা কে বলল ব্রুনো? কি করে জানলে তুমি?’

‘ওদের অন্তত অর্ধেকগুলো আমরা গুলি করে নামিয়েছি, এবার ফিরে আসতে হলে ওদের ভালো করে ভেবে দেখতে হবে।’

‘তুমি জানলে কি করে?’

‘আমি জানি। আগেরটা আচমকা এসে পড়েছিল। পরের বার রীতিমতো সতর্ক থাকব আমরা।’

মহিলাটি চিবানো বন্ধ করে প্রশ্ন করে, ‘শুধু এইটুকুই তোমার বলার?’

নয়েবাউয়ের বোঝে যে এ সান্তনা কিছুই নয়। সে কর্কশভাবে বলে, ‘এইটুকুই যথেষ্ট?’

স্ত্রী একদৃষ্টে চেয়ে থাকে ওর দিকে। চোখদুটো তার ফ্যাকাশে নীল। ‘না?’ হঠাৎ সে চেঁচিয়ে ওঠে। ‘এটুকুই যথেষ্ট নয়। ওটা বাজে কথা ছাড়া আর কিছু নয়! ওর কোন মানে হয় না। অসংখ্য বানানো গপ্প এত দিন আমরা শুনেছি। প্রথমে আমাদের শোনানো হল, আমরা এত শক্তিশালী যে কোন শত্রু বিমান কখনও জার্মানিতে ঢুকতে পারবে না। হঠাৎ দেখা গেল ওরা হাজির হয়েছে। বলা হল ওরা আর ফিরে আসবে না, কারণ সীমান্ত এলাকায় ওদের সব কটাকে গুলি করে আমরা নামিয়ে দেব। কিন্তু ওরা আরও দশগুণ শক্তিতে ফিরে এল। আর তুমি কিনা মেজাজের সাথে বলছ?ওরা আর ফিরে আসবে না। আমরা ওদের ঠিক আটকে দেব। একথা বিশ্বাস করবে বলে তুমি আশা কর?’

‘সেলমা।’ অনিচ্ছাকৃতভাবে নয়েবাউয়ের একবার ফ্যুয়েরার-এর ছবিটার দিকে তাকায়। তারপর লাফিয়ে গিয়ে দরজাটা দড়াম করে বন্ধ করে দেয়। ‘চুলোয় যাও, সাবধানে কথা বলো।’ হিশ হিশ করে বলে সে, ‘তুমি কি চাও আমরা সবাই ঝামেলায় পড়ি? পাগল হয়ে গেলে নাকি যে এইরকম জোরে জোরে চেঁচাচ্ছ?’

স্ত্রীর সামনে এসে দাঁড়ায় ও। স্ত্রীর কাঁধের উপর বের্কটেসগাডেনের নিসর্গচিত্রের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়েই থাকেন ফ্যুয়েরার। মুহূর্তের জন্য নয়েবাউয়ের প্রায় বিশ্বাস হতে চলছিল যে ফ্যুয়েরার বুঝি সব কথা শুনছেন।

সেলমা দেখতে পায় না ফ্যুরেরকে। ‘পাগল?’ আর্তনাদ করে ওঠে ও,’ কে পাগল? আমি? যুদ্ধের আগে কি সুন্দর জীবন ছিল আমাদের; আর এখন? এখন? এখানে পাগলে কে সেটাই আমি জানতে চাই?’

নয়েবাউয়ের দুহাত দিয়ে তার হাতদুটো ধরে তাকে এমন ঝাঁকুনি দেয় যে তার মাথাটা লটপট করতে থাকে আর স্ত্রীকে চিৎকার বন্ধ করতে হয়। পর চুলটা খুলে যায়, ক্লিপ ও চিরুনি পড়ে যায় মাটিতে, ঢোঁক গিলতে গিয়ে ভুল করে কাশতে থাকে। নয়েবাউয়ের ওকে ছেড়ে দেয়। থপ করে সেলমা কৌচের উপর বসে পড়ে।

‘কি, ব্যাপার কি ওর?’ নয়েবাউয়ের জিজ্ঞাসা করে মেয়েকে।

‘বিশেষ কিছু নয়। মা খুব উত্তেজিত হয়ে পড়েছে।’

‘কেন? কিছু তো হয়নি।’

‘কিছু হয়নি?’ স্ত্রী আবার শুরু করে। ‘তুমি ওখানে পাহাড়ে থাক, তোমার কাছে তো কিছুই হয়নি। কিন্তু এখানে নিচে আমার একা একা থাকি, আমাদের কথাটা ভেবেছ’

‘আস্তে। চুলোয় যাক সব; অত চেঁচিয়ো না। তোমার জন্যে পনেরো বছর ধরে মুখে রক্ত তুলে খাটছি কি এক রাত্তিরে সব খোয়াবার জন্যে? তুমি কি মনে কর আমার চাকরিটা খতম করার জন্য অনেক লোক মুখিয়ে নেই?’

‘এই প্রথম বোমা পড়ল যে, বাবা, ’ফ্রেইয়া নয়েবাউয়ের শান্ত স্বরে বলল। আজ পর্যন্ত শুধু সঙ্কেতই বেজেছিল। মায়ের ওটা সয়ে যাবে কদিন গেলেই।’

‘প্রথম? বটে, প্রথমই তো। এখনও পর্যন্ত কিছু যে ঘটেনি এই জন্য কোথায় আমাদের খুশি থাকা উচিত, তা না আজেবাজে চেঁচামেচি।’

মা অল্পতেই ঘাবড়ে যায়। ঠিক অভ্যাস হয়ে যাবে।’

‘ঘাবড়ে যায়।’ মেয়ের শান্ত ভাব দেখে নয়েবাউয়ের চটে যায়। ‘কে নার্ভাস হয়নি? তুমি কী ভাব আমি নার্ভাস হইনি? নিজেদের শক্ত করতে হবে আমাদের। না যদি করি তাহলে কি হবে ভেবে দেখ।’

‘সেই এক কথা।’ তার কৌটে শুয়ে স্ত্রী হেসে ওঠে। ‘নার্ভাস। মানিয়ে নিতে হবে? বলা খুব সোজা তোমার পক্ষে।’

‘আমার পক্ষে? কেন?’

‘তোমার তো আর কিছু হয় না।’

‘কি?’

‘তোমার তো আর কিছু হয় না। কিন্তু আমরা এখানে যেন যাঁতায় পড়ে আছি।’

‘ডাহা মিথ্যে কথা! সব জায়গাই সমান। আমার কিছু হতে পারে না? কি বলতে চাও তুমি?’

‘ওখানে তোমার ক্যাম্পে তো তুমি নিরাপদ আছ।’

‘কি?’ নয়েবাউয়ের চুরুটটা মেঝে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে পায়ে সেটাকে মাড়ায়। ‘তোমাদের এখানে যে-রকম পাতালকুঠরি আছে, আমাদের তাও নেই।’ মিথ্যা কথাটা অবলীলায় ঝেড়ে দেয় সে।

‘কারণ তোমাদের দরকার নেই। তোমরা শহরের বাইরে থাক।’

‘যেন তাতে কোন ফারাক হয়! বোমা যেখানে পড়ার সেখানেই পড়ে।’

‘ক্যাম্পে বোমা ফেলা হবে না।’

‘সত্যি? জানলে কি করে? আমেরিকানরা বুঝি খবর পাঠিয়েছে? নাকি রেডিওতে বিশেষ সংবাদ দিয়েছে তোমায়?’

নয়েবাউয়ের মেয়ের দিকে এক নজর তাকায়। ও আশা করেছিল মেয়ে তার রসিকতাটা সমর্থন করবে। কিন্তু ফ্রেইয়া কৌচের পাশের টেবিলে পাতা লেস-দেয়া কাপড়ের পাড় নিয়ে নাড়াচাড়া করতে থাকে। বদলে ওর স্ত্রীই জবাব দিল, ‘ওরা তো আর নিজেদের লোকের ওপর বোমা ফেলবে না।’

‘কি বাজে বকছ! আমাদের ওখানে আমেরিকান আছে নাকি! ইংরেজও নেই। কেবল রুশ, পোল আর বলকান হতভাগাগুলো। আর আছে পিতৃভূমির জার্মান শত্রুরা? ইহুদি, বিশ্বাসঘাতক আর অপরাধীরা।’

সেলমা জোড় তর্ক করে বোঝাতে চায়, ‘রুশ, পোল আর ইহুদিদের ওপর ওরা বোমা ফেলবে না।’

নয়েবাউয়ের ঝাঁ করে ঘুরে দাঁড়ায়। চাপা গলায় বলে, ‘অনেক কিছু জান দেখছি। এবার আমি তোমায় দু-একটি কথা বলতে চাই। ওখানে পাহাড়ের গায়ে কি ধরনের ক্যাম্প আছে সে-বিষয়ে ওদের কিছুমাত্র ধারণা নেই, বুঝেছ? যা দেখা যায় তা হল ব্যারাক। সেগুলোকে সহজেই মিলিটারি বলে ভুল করা যায়। আর যেগুলো ওরা বাড়ি দেখতে পায়? সেগুলো আমাদের এস-এস কোয়ার্টার। ওরা দেখতে পাচ্ছে বাড়িতে লোকে কাজ করছে। ওদের লক্ষ্যে হল ফ্যাক্টরি। উঁচুতে এখানকার থেকে বিপদের আশঙ্কা একশো গুণ। সেই জন্যেই আমি চাইনি তুমি ওখানে থাক। এখানে নিচে ব্যারাক নেই, ফ্যাক্টরি নেই। বুঝতে পারছ কথাটা?’

‘না।’

নয়েবাউয়ের স্ত্রীর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে। ওর স্ত্রী আগে কখনও এরকম ছিল না। কি যে তার মাথায় ঢুকেছে ঈশ্বর জানেন। হঠাৎ ওর মনে হয়?ওর পরিবারের লোকেরা ওকে ত্যাগ করেছে। ঠিক তখনই যখন একসঙ্গে দাঁড়াবার দরকার সব থেকে বেশি। বিরক্ত হয়ে আবার সে মেয়ের দিকে তাকায়। ‘আর তুমি, তুমি কি ভাবছ এ নিয়ে? কথা বলছ না কেন?’

ফ্রেইয়া নয়েবাউয়ের উঠে দাঁড়াল। বছর কুড়ি বয়স। পাতলা চেহারা। মুখটা হলদেটে, কপালটা এগিয়ে এসেছে। সেলমার মতোও দেখতে নয়, আবার বাবার মতোও দেখতে নয়। বলল, ‘আমার মনে হয়, মা এখনই শান্ত হয়ে যাবে।’

‘কি? কেন?’

‘আমার মনে হয় শান্ত হয়েই গেছে।’

নয়েবাউয়ের চুপ করে থাকে। ওর স্ত্রী কিছু বলবে বলে ও অপেক্ষা করছিল। শেষ পর্যন্ত বলল, ‘আচ্ছা, ঠিক আছে তাহলে।’

‘আমরা ওপরে যেতে পারি?’ ফ্রেইয়া প্রশ্ন করল।

নয়েবাউয়ের সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাল সেলমার দিকে। এখনও ওকে বিশ্বাস করা যায় না। এটা ওকে স্পষ্ট করে বোঝাতে হবে যে কোন অবস্থাতেই কারও সঙ্গে ওর কথা বলা চলবে না। এমন কি দাসী মেয়েটার সঙ্গেও না। মেয়ের সঙ্গে তো নয়ই। মেয়ে ওর থেকে আগে বুঝতে পারে সব। ‘ওপরতলাতেই ভালো, বাবা। বেশ হাওয়া আছে।’

মন স্থির করতে পারে না ও। ময়দার বস্তার মতো স্ত্রী পড়ে রয়েছে কৌচে। অন্তত একবারও কি বুদ্ধিমানের মতো কথা বলতে পারে না ও ? এখন টাউন হলে যেতে হবে। ছটার সময়। ডিৎস ফোন করেছে, পরিস্থিতিটা নিয়ে আলোচনা করতে হবে।

‘কিছু হবে না বাবা, সব ঠিক আছে। তাছাড়া ডিনারের ব্যবস্থাও করতে হবে।’

‘ঠিক আছে তাহলে।’ নয়েবাউয়ের মন স্থির করে ফেলেছে। অন্তত মেয়ে তার মাথাটা ঠিক রেখেছে মনে হয়। ওর উপর সে বিশ্বাস রাখতে পারে। নিজেরই তো রক্তমাংস। স্ত্রীর দিকে সে এগিয়ে যায়। ‘ঠিক আছ তাহলে। এসব কথা এখন ভুলে যাওয়া যাক, কি বল সেলমা? এরকম তো ঘটতেই পারে। সত্যি সত্যি বিপজ্জনক কিছু নয়।’ মৃদু হেসে স্ত্রীর দিকে তাকায় সে। দৃষ্টিটা অবশ্য নিরুত্তাপ। ‘কি বল?’ সে আবার বলে।

স্ত্রী জবাব দেয় না।

স্ত্রীর কাঁধদুটো দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে আদর করে বলে সে, ‘তাহলে যাও, ছুটে গিয়ে ডিনারটা বানিয়ে ফেল। আর, ভয়টা যখন কেটে গেছে, ভালো দেখে কিছু একটা রাঁধ তো দেখি, অ্যাঁ?

স্ত্রী উদাসীন ঘাড় নাড়ে।

নয়েবাউয়ের বুঝতে পারে আর বাজে কথা বলবে না সেলমা। ‘বেশ খাসা করে একটা কিছু রাঁধ দেখি, সোনারা। যাই বল সেলমা, আমি এসব করছিতো তোমারই জন্যে। যাতে ওই নোংরা ডাকাতদের কাছে না থেকে এখানে এই সুন্দর বাড়িটায় তোমরা থাকতে পার। আর এ-কথা ভুলে যেও না যে প্রত্যেক সপ্তাহে আমি কয়েক রাত্তির এখানেই কাটাই। দেখতে হবে তো সকলেই এক নৌকার যাত্রী আমরা। তাহলে ওই কথাই রইল, রাতের জন্যে মুখরোচক কিছু একটা বানিও! এই ব্যাপারে তোমার ওপর আমার খুব আস্থা। আর এক বোতল ফরাসী শ্যাস্পেন হলে কেমন হয় ? এখনও যথেষ্ট আছে না আমাদের?’

‘হ্যাঁ।’ স্ত্রী জবাব দেয়, ‘ওই জিনিসটা এখনও আমাদের যথেষ্ট আছে।’

‘আর একটা কথা?’ গ্রুপ-লীডার ডিৎস কর্কশ স্বরে বলে, ‘কোন কোন ভদ্রলোক তাঁদের পরিবার গ্রামদেশে পাঠিয়ে দেবার কথা ভাবছে বলে আমার কানে এসেছে। এর কোন মানে হয়?’

কেউ উত্তর দেয় না।

‘না, সে অনুমতি আমি দিতে পারি না। আমরা এস-এস অফিসার; আমাদের দৃষ্টান্ত হতে হবে। লোক সরানোর সার্বিক হুকুম যতক্ষণ না দেয়া হচ্ছে, তার আগে আমরা নিজেদের বাড়ির লোকদের যদি শহরের বাইরে পাঠিয়ে দিই তাহলে সেটার অপব্যাখ্যা হওয়া সম্ভব। আতঙ্ক ছড়ানেওয়ালা লোকগুলো সঙ্গে সঙ্গে হৈচৈ জুড়ে দেবে। সেজন্য আশা করি আমার অজান্তে এরকম কিছু ঘটবে না।’

চমৎকার করে বানানো ইউনিফর্ম পরে ও একদৃষ্টে চেয়ে আছে। ছিপছিপে আর লম্বা দেখাচ্ছে ওকে। গ্রুপের প্রত্যেককে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ অথচ নিরীহ দেখাচ্ছে। প্রায় প্রত্যেকেই ভেবেছে পরিবারের লোকজনকে দূরে পাঠিয়ে দেবে; কিন্তু কেউই কিছু প্রকাশ করছে না। চোখের দৃষ্টিতেও না। প্রত্যেকে ভাবছে একই কথা শহরে তার কেউ থাকে না। ও এসেছে স্যাক্সনি থেকে। ওর একমাত্র আকাঙক্ষা হল সৈন্যদের সামনে ওকে যেন অফিসারের মতো দেখায়। সেটা খুবই সোজা। যাতে ব্যক্তিগত কোন ক্ষতি হওয়ার নেই সে কাজ মানুষ সাহসের সঙ্গেই করতে পারে।

‘ভদ্রমহোদয়গণ, এটুকুই শুধু আমার কথা, ’ডিৎস বলে। ‘আবার মনে করিয়ে দিই, আমাদের আধুনিক গোপন অস্ত্রগুলি এখন ব্যাপক হারে তৈরি হচ্ছে। ভি. আই. যত কাজেরই হোক, এগুলির তুলনায় কিছুই না। লণ্ডন পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। ইংল্যাণ্ডের উপর সবসময়েই বোমা ফেলা হচ্ছে। নিউ ইয়র্কের গগনচুম্বী অট্টালিকাগুলি ধ্বংসস্তূপে পরিণত। ফ্রান্সের বড় বড় বন্দর আমাদের দখলে। নতুন সৈন্য সমাবেশের ফলে আক্রমণকারীরা প্রবল অসুবিধার সম্মুখীন। পাল্টা আক্রমণে শত্রুদের ঝেঁটিয়ে সমুদ্রে ফেলা হবে। তার ব্যাপক প্রস্তুতি চলছে। শক্তিশালী রিজার্ভ বাহিনী গড়ে তুলেছি আমরা। আর আমাদের নতুন অস্ত্রশস্ত্র সম্বন্ধে বেশি কিছু বলার অধিকার আমার নেই; তবে সর্বোস্ত কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে শুনেছি, তিন মাসের মধ্যে আমরা বিজয়গৌরব অর্জন করব। ততদিন আমাদের চালিয়ে যেতেই হবে।’ হাতটা উপর দিকে ছড়িয়ে দিল সে, ‘কাজে ফিরে যাও। হাইল হিটলার!’

‘হাইল হিটলার!’ গর্জন করে ওঠে গ্রুপটা।

টাউন হল থেকে বেরিয়ে এল নয়েবাউয়ের। রাশিয়া সম্বন্ধে ও কিছু বলল না, সে ভাবতে থাকে। রাইন অঞ্চল সম্বন্ধেও নয়। ভাঙ্গা পশ্চিম সীমান্ত সম্বন্ধে ও সবথেকে কম বলল। ‘চালিয়ে যাও’ ওর পক্ষে বলা সোজা। ওর তো নিজের কিছুই নেই। ও একটা উন্মাদ। রেলস্টেশনের কাছে ওর অফিস নেই। মেলার্ন সংবাদপত্রের শেয়ারের মালিক ও নয়। এমন কি বাড়ি করার জমিও ওর নেই। আমার সব কিছু আছে। সেসব যদি বাতাসে মিলিয়ে যায় তাহলে, কেউ কি আমায় এক পয়সা দেবে?

হঠাৎ রাস্তায় লোকজনের ভিড় জমে যায়। টাউন হলের সামনের স্কোয়ারটা লোকে ভরতি। সিঁড়ির উপর একটা মাইক টাঙানো হচ্ছে। ডিৎস বক্তৃতা দেবে। তোরণ থেকে শার্লমেন আর সিংহের হাসি হাসি পাথরের অবিচল মুখগুলো নিচের দিকে চেয়ে আছে। নয়েবাউয়ের গিয়ে মার্সিডিজে চড়ল। ‘হেরমান গোয়েরিঙ সড়কে চল, আলফ্রেড।’

হেরমান গোয়েরিঙ সড়ক আর ফ্রিডরিশ গলির মোড়ে নয়েবাউয়ের অফিস-বাড়ি। বাড়িটা বিরাট, নিচের তলায় একটা বিলাস সামগ্রীর দোকান। উপরের তলাদুটোয় অফিস।

নয়েবাউয়ের গাড়ি থামিয়ে বাড়িটার চারপাশ দিয়ে ঘুরে ঘুরে বেড়ায়। দুটো শো’কেসের কাচ ফেটে গেছে, এছাড়া কিছু হয়নি। স্টেশন থেকে ভেসে-আসা ধোঁয়ার কুণ্ডলীতে উপরের অফিসগুলো ঢাকা পড়ে গেছে। কিন্তু আগুন লাগেনি কিছুতে।

একটুখানি দাঁড়িয়ে থাকে ও। দু লক্ষ মার্ক, ও ভাবে। অন্তত এই দামই হবে, তার কম নয়। ওটার জন্য পাঁচ হাজার খরচ করেছে ও। ১৯৩৩-এ ওটা ছিল ইহুদি ম্যাক্স ব্লাঙ্কের। সে এক লক্ষ চেয়েছিল। খুব গোলমাল করেছিল, ওর লোকসান হয়ে যাচ্ছে বলে নালিশও করেছিল- তার কমে ও বিক্রি করবে না। কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে দু’সপ্তাহ কাটানোর পর পাঁচ হাজারেই বিক্রি করেছিল। আমি তো ভালো ব্যবহারই করেছি, নয়েবাউয়ের ভাবতে থাকে। বিনা পয়সাতেই ওটা পেতে পারতাম। এস-এসরা ওকে নিয়ে মজা করার পর ব্লাঙ্ক নিজেই এটা আমাকে উপহার দিতে চেয়েছিল। আমি তো পাঁচ হাজার মার্ক দিয়েছি। নগদ টাকা। অবশ্য সবটা একসঙ্গে দিইনি; তখন অত টাকাও আমার ছিল না। প্রথম মাসের ভাড়া পাওয়ার পর থেকে ওকে দাম দিতে থাকি। তাতে ব্লাঙ্কও খুশি হয়েছিল। আইনমাফিক কেনাবেচা। স্বেচ্ছায় রেজিস্ট্রি করেছিল ও। ম্যাক্স ব্লাঙ্ক যে ক্যাম্পে দুর্ঘটনায় পড়ে যায়? একটা চোখ হারিয়ে, একটা হাত ভেঙ্গে এবং অন্যান্যভাবে নিজেকে জখম করে ফেলে? এটা একটা দুঃখজনক ঘটনা। থ্যাবড়া-পাওয়ালা লোকেরা সহজেই পড়ে যায়। নয়েবাউয়ের নিজে ওসব দেখেনি। এমন কি সে নিজে হাজিরও ছিল না। কোন হুকুমও সে দেয়নি। সে শুধু ওকে যাতে নিরাপত্তামূলক আশ্রয়ে রাখা হয়? সেইটুকু ব্যবস্থা করেছিল; যাতে অত্যুৎসাহী ঝটিকাবাহিনীর লোকেরা ওর কোন ক্ষতি করতে না পারে। তারপর যা কিছু ঘটেছিল সেটা হ্বেবারের ব্যাপার।

ও ঘুরে দাঁড়ায়। হঠাৎ ওই পুরোনো কথাটা ভাবছে কেন? কি হল তার? অনেক দিন আগেই এসব কথা সে ভুলে গেছে। বাঁচতে হবে তো! ও যদি বাড়িটা না কিনত? তাহলে পার্টির অন্য কেউ সেটা কিনে নিত। আরও কম দামে; বিনামূল্যেই। সে তো আইনমাফিক কাজই করেছে। ফ্যুরের নিজেই বলেছেন তাঁর বিশ্বস্ত শিষ্যদের পুরস্কার দেয়া উচিত। আর বড় বড় হোমরা-চোমরারা যা পাচ্ছেন তার তুলনায় সে, ব্রুনো নয়েবাউয়ের, কতটুকু পেয়েছে? গোয়েরিঙ বা প্রিংগারের কথাই ধরা যাক না? ঘোড়ামুখো প্রিংগার তো হোটেলের কুলি থেকে কোটিপতি হয়েছে। নয়েবাউয়ের তো চুরি করেনি কিছু। সে শুধু সস্তায় কিনেছে। রসিদ দিয়ে।

রেলস্টেশন থেকে আগুনের একটা শিখা জেগে উঠল। তারপরেই ঘটল বিস্ফোরণ। খুব সম্ভব গোলাবারুদের ওয়াগন। বাতিটার গা থেকে যেন হঠাৎ রক্ত বেরুলো ঘেমে। হাস্যকর! নয়েবাউয়ের ভাবে, সত্যিই দেখি নার্ভাস হয়ে পড়েছি। যে সব ইহুদি আইনজীবীদের সেই সময় ওপরের ওখান থেকে টেনে বার করে আনা হয়েছিল? সেসব নাম অনেক দিন আগেই ভুলে যাওয়া হয়েছে। গাড়িতে ফিরে যায় ও। স্টেশনের কাছটা- ব্যবসার পক্ষে খুব ভালো, কিন্তু বোমা পড়ার সময় নিদারুন বিপজ্জনক জায়গা। লোকে যে নার্ভাস হবে এ তো স্বাভাবিক।

‘গ্রসস্ট্রাস, আলফ্রেড।’

মেলার্ন সংবাদপত্রের বাড়িটার কোন ক্ষতি হয়নি। খবরটা টেলিফোনে আগেই শুনেছে নয়েবাউয়ের। একটা অতিরিক্ত সংস্করণ এখনই বার করছে ওরা। বিক্রেতাদের হাত থেকে কাগজ ছিনিয়ে নিচ্ছে লোকেরা। সাদা কাগজের পাঁজাগুলো নিমেষেই উধাও হয়ে যাচ্ছে। প্রতিটি কাগজের এক ফেনিস৪ ওর। নতুন কাগজের পাঁজা নিয়ে নতুন বিক্রেতারা আসছে। সাইকেলে চড়ে ওরা ছুটছে। অতিরিক্ত সংস্করণ মানে বাড়তি পয়সা। নয়েবাউয়ের গুনেছে সতেরো জন। প্রত্যেক বিক্রেতার কাছে অন্তত দুশো কাগজ। তার মানে চৌত্রিশ মার্ক বাড়তি রোজগার। অন্তত কিছু ভালো তো এ থেকে হচ্ছে। ফাটা জানালার কয়েকটার দাম দিতে পারবে তো! দূর ছাই, কি বাজে চিন্তা; ওগুলো তো ইনসিওর করা আছে। অর্থাৎ, ইনসিওরেন্স কোম্পানী যদি যাবতীয় ক্ষতিপূরণের টাকাটা দেয় ওরা দেবেই। অন্তত ওকে। চৌত্রিশটা মার্ক নিট রোজগার।

একটা অতিরিক্ত সংস্করণও কিনল। ডিৎসের একটা সংক্ষিপ্ত আবেদন এরই মধ্যে ওতে এসে গেছে। দারুণ কাজ। তার সঙ্গে রয়েছে একটা রিপোর্ট? শহরের উপর দুটি বিমানকে গুলি করে নামানো হয়েছে, বাকিগুলোর অর্ধেক নামানো হয়েছে সিনডেন, ওসনাব্রুয়েক আর হ্যানোভারের। শান্তিপূর্ণ জার্মান শহরগুলির উপর বোমাবর্ষণের অমানুষিক বর্বরতা সম্বন্ধে গোয়েবলসের একটা নিবন্ধও আছে। ফুয়েরার অল্প কয়েকটি চোখা চোখা কথা। যেসব বৈমানিক প্যারাশুট করে নেমেছে তাদের খুঁজে বেড়াচ্ছে হিটলারের যুববাহিনী, তার আরেকটা রিপোর্ট। কাগজটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে মোড়ের চুরুটের দোকানটায় ঢোকে নয়েবাউয়ের। ‘থ্রি জার্মান সোল্জার্স’ সে হুকুম দেয়।

বিক্রেতা চুরুটের বাক্সটা এগিয়ে দেয়। নিস্পৃহভাবে চুরুট বাছতে থাকে নয়েবাউয়ের। চুরুটগুলো বাজে। নির্ভেজাল বীচপাতা। বাড়িতে আরও ভালো জিনিস আছে তার; প্যারিস আর হল্যাণ্ডের মাল। জার্মান ফৌজীর অর্ডার দিয়েছে শুধু দোকানটা নিজের বলে। অভ্যুত্থানের আগে দোকানটা ছিল লেসের ও সাক্টদ্রের ইহুদি কোম্পানী। তারপর স্টর্ম-লীডার ফ্রাইবার্গ ওটা হাতিয়েছিল। ১৯৩৬ পর্যন্ত সে-ই ছিল মালিক। বলতে গেলে সোনার খনি। একটা জার্মান ফৌজীর কোনা চিবিয়ে কাটে ও। ফ্রাইবার্গ যদি কফি খেতে খেতে ফ্যুরের সম্বন্ধে কোন বিদ্রোহাত্মক উক্তি করে থাকে? তাতে নয়েবাউয়েরের কি করার আছে ? একজন সৎ পার্টি-সভ্য হিসেবে ওর কর্তব্য হল কর্তৃপক্ষকে সে-কথা জানানো। ক’দিন পরেই ফ্রাইবার্গ নিখোঁজ হয়ে গেল, আর তার বিধবার কাছ থেকে নয়েবাউয়ের দোকানটা কিনে নিল। দোকানটা তাড়াতাড়ি বিক্রি করে দেয়ার উপদেশও সে-ই তাকে দিয়েছিল। ফ্রাইবার্গের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হয়ে যাবে বলে খবর পেয়েছে- এই কথাটুকু শুধু ও তাকে জানিয়েছে। মহিলাটি কৃতার্থ হয়ে দোকানটা বিক্রি করে দেয়। সিকি দামে। নয়েবাউয়ের অবশ্য বলেছিল যে সে অবস্থাপন্ন নয়, আর ব্যাপারটাও তাড়াতাড়ির। বিধবা ঝুঝতে পেরেছিল। বাজেয়াপ্ত অবশ্য কখনও হয়নি। কিন্তু সত্যি সত্যিই বাজেয়াপ্ত হতে পারত। তাছাড়া বিধবা ওটা চালাতেও পারত না। আরও কম টাকায় কেউ ওটা বাগিয়ে নিত।

মুখ থেকে চুরুটটা বার করে নেয় নয়েবাউয়ের। ধোঁয়া আসছে না। বাজে মাল। কিন্তু লোকে কেনে। ধোঁয়া টানার মতো যা হোক কিছু হলেই হল। লোকে তারই জন্য পাগল। কি আফসোস, তাও আবার রেশন। নাহলে বিক্রিটা দশগুণ হত। আবার একবার ও দোকানটার দিকে তাকাল। দারুন বরাত। হঠাৎ মুখটা বিস্বাদ হয়ে যায় ওর। নিশ্চয়ই চুরুটটা বাজে। তাছাড়া আর কি হতে পারে? যাই হোক, শেষ পর্যন্ত কিছু হয়নি, স্নায়ুর ব্যাপার? হঠাৎ ওইসব পুরোনো কথাগুলো ও ভাবছে কেন? সেই অনেক আগেকার পুরোনো কাজটা। আবার গাড়িতে ওঠার সময় চুরুটটা ও ফেলে দিল, আর বাকি দুটো দিল ড্রাইভারকে। ‘ধর আলফ্রেড। আজ রাতের জন্য বিশেষ করে। চল, এবার যাওয়া যাক বাগানে।’

বাগানটা নয়েবাউয়ের গর্বের জিনিস। শহরের বাইরের দিকে বেশ বড় একটা জমি। বেশির ভাগটাতেই শাক-সবজি আর ফলের চাষ। বাগিচাও আছে, আর আছে পোষা পশু। ক্যাম্প থেকে আনা গোটাকতক রুশ ক্রীতদাস সব-কিছু দেখাশোনা করে। পয়সা লাগে না, বরং ওদেরই উচিত নয়েবাউয়েরকে পয়সা দেয়া। তামা গালানোর কারখানায় বারো থেকে পনেরো ঘণ্টা কঠোর পরিশ্রম করার বদলে এই কাজ তো হালকা; খোলা বাতাসও পাওয়া যায়!

অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে বাগানে। এদিকটায় আকাশটা পরিষ্কার। আপেল গাছগুলোর উপর চাঁদ ঝুলছে। সদ্য কোপানো মাটির গন্ধে ভুরভুর বাতাস। চষা মাটির খাঁজে মাথা তুলছে নতুন সবজি, ফলগাছে ফুটন্ত কুঁড়ি। সারা শীত কাঁচঘরে থেকে এখন সাদা ও গোলাপী রঙে ভরে গেছে ছোট জাপানী রেরিগাছ- মঞ্জুরী উঁকি দিতে শুরু করেছে লাজুক ডগায়।

জমিটার উল্টা দিকের অংশে রুশগুলো কাজ করছে। ওদের ঝুঁকে-পড়া অন্ধকার পিঠ আর রাইফেল হাতে প্রহরীর কালো ছায়ামূর্তিটা নয়েবাউয়ের দেখতে পায়। বন্দুক আঁটা বেয়নেটগুলো যেন আকাশ ফুঁড়ে দেবে। প্রহরীরা আছে শুধু নিয়মরক্ষার জন্য। রুশরা পালায় না। গায়ে জেল-আবাস, ভাষা বোঝে না, যাবেই বা কোথায়? ওদের সঙ্গে আছে একটা বড় কাগজের জাগ, ক্রিমেটারিয় ম থেকে পাওয়া ছাইয়ে ভরতি। খাঁজকাটা জমি-বরাবর ওরা সেই ছাই ছড়াচ্ছে। ঐ কাগজের ব্যাগগুলোয় রয়েছে ষাট জন মানুষের ছাই, তার মধ্যে বারোটা শিশু।

গোধুলির অপরিষ্কার আলোয় বাসন্তীফুল আর নার্সিসাসগুলো চিকচিক করছে। দক্ষিণের দেয়াল-বরাবর লাগানো। একটা জানালা খুলে নয়েবাউয়ের ঝুঁকে পড়ে। নার্সিসাসগুলোয় এখনও গন্ধ আসেনি। তার বদলে ভায়োলেটের গন্ধ, গোধুলিতে অদৃশ্য ভায়োলেট।

বুক ভরা নিশ্বাস নেয় ও। এই বাগান তার। নিজে এর জন্য দাম দিয়েছে, আর ঠিকমতো। সাবেক কালের মতো আর সৎভাবে। পুরো দাম। কারও কাছ থেকে এটা ও ছিনিয়ে নেয়নি। এই জায়গাটা তার। পিতৃভূমির জন্য কঠোর সেবা আর সংসারের জন্য ভাবনার পর যে-জায়গায় সে এসে মানুষ আবার মানুষ হয়ে ওঠে। পরম তৃপ্তিতে ও চারদিকে তাকায়। লতাবিতানটার দিকে তাকায় ও, হনিসাক্ল আর লতানে গোলাপে ছেয়ে গেছে; চোখে পড়ে বাক্সে তৈরি করা কাঁটাগাছ, ঝামা পাথরের নকল গুহা, লাইল্যাক ঝোপ। ঝাঁঝালো বাতাসের গন্ধ পায়, ইতোমধ্যেই তাতে বসন্তের ছোঁয়া লেগেছে। বাগানের জাফরি-দেওয়ালের গায়ে পি আর ন্যাসপাতি গাছের বিচুলি ঢাকা গুঁড়িগুলোর আদর করে ও হাত বুলায়, তারপর ছাউনিতে যাওয়ার দরজাটা খোলে।

মুরগিগুলোর দিকে ও গেল না। কাঠের উপর বুড়িদের মতো ওরা থেবড়ে বসে আছে। গোয়ালে যে বাচ্চা শুয়োরদুটো ঘুমোচ্ছে তাদের দিকেও গেল না?ও গেল খরগোশগুলোর দিকে।

সাদা আর ধূসর আঙ্গোরা খরগোশ, গায়ে লম্বা লম্বা রেশমের মতো লোম। ও যখন আলোটা জ্বালাল তখন সেগুলো ঘুমোচ্ছে। তার তারা আস্তে আস্তে নড়তে শুরু করল। তারের জালের ভিতর দিয়ে একটা আঙ্গুল ঢুকিয়ে ওদের লোমে সে হাত বুলোতে থাকে। কি নরম! এর থেকে নমর কিছু ওর জানা নেই। একটা ঝুড়ি থেকে বাঁধাকপির পাতা আর শালগমের টুকরো নিয়ে খাঁচার মধ্যে ঢুকিয়ে ঢুকিয়ে দেয়। খরগোশগুলো এগিয়ে এসে আস্তে আস্তে ধীরে ধীরে গোলাপী মুখ দিয়ে কুপকুপ করে খেতে শুরু করে। ‘পুঁচকি, পুঁচকি, এদিকে এদিকে, ও সুর করে ডাকে।

একটা বড় সাদা রঙের মদ্দা খরগোশ নমর নরম ঠোঁটে করে ওর হাত থেকে পাতা নেয়। লাল চোখদুটো উজ্জ্বল চুনির মতো ঝকঝম করে। নয়েবাউয়ের তার ঘাড়ে আদর করে চাপড় দেয়। ঝুঁকে পড়ার সময় ওর জুতোটা মচমচ করে ওঠে। সেলমা কি যেন বলেছিল? নিরাপদ? ওখানে ক্যাম্পে তুমি নিরাপদ আছ? কে নিরাপদে আছে বল তো? কোনদিন সত্যিই কি সে নিরাপদে থাকতে পেরেছে?

তারের জালের ভিতর দিয়ে আরও বাঁধাকপির পাতা ও ঢুকিয়ে দেয়। ওর মনে পড়ে বার বছর হয়ে গেল। বার বছরে আগে। বিপ্লবের আগে আমি ছিলাম পোস্ট-অফিসের কেরানি, মাসে বড় জোর দুশ মার্ক বেতন। তাতে বাঁচাও যায় না, মরাও যায় না। এখন যা-হোক কিছু হয়েছে। সেসব আমি হারাতে চাই না আবার।

মদ্দা খরগোশটার লাল চোখদুটোর ভিতর ও তাকায়। আজ সব কিছুই বেশ ভালো হয়েছে। ভালোই চলবে। বোমাটা বোধ হয় ভুল করেই ফেলা হয়েছে। নতুন গড়া বাহিনীতে ওইরকম ঘটেই থাকে। শহরটার গুরুত্ব নেই কিছু; তাহলে তো আগেই ওরা এটাকে ধ্বংস করার চেষ্টা করত। মেজাজটা ঠাণ্ডা হচ্ছে নয়েবাউয়ের বুঝতে পারে। ‘পুঁচকি!’ ও ডাকে, তারপর ভাবতে থাকে। নিরাপদ? অবশ্যই নিরাপদ! শেষ মুহূর্তে কে চায় হুড়মুড়িয়ে ভেঙ্গে পড়তে?



৫.

‘শালা, শুয়োরের বাচ্চা! আবার গান!’

নাম-ডাকার মাঠে নিয়ম অনুযায়ী কড়া সমাবেশ। ব্লক হিসেবে দশ জনের এক একটা কলাম করে বড় ক্যাম্পের মজুর-গ্যাঙগুলো দাঁড়িয়ে। এর মধ্যেই অন্ধকার হয়ে গেছে। ডোরাকাটা পোশাক-পরা কয়েদিগুলোকে পরিশ্রান্ত জেব্রার বড় বড় পালের মতো দেখাচ্ছে।

এক ঘণ্টার উপর নাম-ডাকা হয়ে গেছে, কিন্তু হিসাব মিলছে না। তামা-গালানোর কারখানায় যে মজুর গ্যাঙগুলো কাজ করে তাদের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তাদের ডিভিশনে বোমা পড়েছিল একটা; অনেক হতাহত। তার উপর প্রথম ধাক্কাটা পার হতেই যে-সব কয়েদি আড়ালে আশ্রয় নিয়েছিল, তাদের উপর খবরদারি করা ঝটিকাবাহিনীর লোকেরা গুলি চালাতে শুরু করেছিল। ওরা পালাতে পারে বলে ভয় ছিল। ফলে আরও জনাচারেক খতম হয়ে গিয়েছে।

বোমা পড়ার পর ওরা ইট কাঠ আর ধ্বংস্তূপের নিচে থেকে তাদের মৃত সঙ্গীদের দেহগুলো টেনে-হিঁচড়ে বার করেছে? বা তাদের দেহের অবশিষ্টাংশগুলো। নামডাকার সময় সেটারও দরকার। কয়েদিদের জীবনের কোন দাম নেই, তার উপর এস-এসরাও ভ্রƒক্ষেপহীন; নাম-ডাকার সময় জীবিতই হোক বা মৃতই হোক, সংখ্যাটা মেলা চাই। আমলাতন্ত্রের হাত থেকে মড়ারও রেহাই নেই।

মজুর গ্যাঙগুলো যা কিছু হাতের কাছে পেয়েছে- যতœ করে সঙ্গে নিয়েছে; কেউ নিয়েছে একটা হাত, কেউ নিয়েছে পা; কেউ আলাদা হয়ে-যাওয়া মুণ্ডু। যে কটা স্ট্রেচার কোনমতে বানাতে পেরেছিল তাতে তোলা হয়েছে সে-সব আহতদের যাদের হাত-পা উড়ে গেছে বা পেট ফেটে নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে গেছে। অন্য আহতদের যতটা সম্ভব নিজেদের উপর ভর রেখে টানতে টানতে নিয়ে এসেছে। অল্প কজনকেই ব্যাণ্ডেজ বাঁধা সম্ভব হয়েছে; ব্যাণ্ডেজ বাঁধার মতো বিশেষ কিছু পাওয়া যায়নি বলেই। রক্তস্রাবে যারা মরতে বসেছে- তার দিয়ে তাড়াতাড়ি তাদের বাঁধন দেয়া হয়েছে। পেটে যাদের আঘাত লেগেছে তাদের নিজেদের হাতেই নিজেদের নাড়িভুঁড়ি ধরে রাখতে হয়েছে স্ট্রেচারে শোয়া অবস্থায়।

পাহাড় বেয়ে কষ্টেসৃষ্টে মিছিলটাকে উঠতে হয়েছে। পথে মারা গেছে আরও দুজন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন