গত ২৭ জুন ২০০৮ তারিখের সমকাল পত্রিকার কালের খেয়াতে আহমদ ছফা সম্পর্কে প্রখ্যাত প্রকাশ মফিদুল হক আলোচনা করেছেন। আহমদ ছফা সম্পর্কে আমরা কেন যেন তেমন কোন আলোচনা করি না। পত্রিকায় বা বিভিন্ন আলোচনা সভায় আহমদ ছফার নাম কম শোনা যায়। এটা এক দিক দিয়ে আবার ভাল। কারণ তাকে বেশি বেশি করে আলোচনা করলে হয়তো অনেক অবান্তর কথারও জন্ম হয়ে যেত। সেদিক থেকে তাকে নিয়ে কম আলোচনা হওয়াকে ভাল বলেছি।
কালের খেয়াতে প্রকাশিত মফিদুল হকের লেখাটি আহমদ ছফাকে নিয়ে তার ব্যক্তিগত অনুভূতি অভিজ্ঞতার ফসল। তিনি আহমদ ছফাকে যেমন দেখেছেন, যেভাবে সম্মান করেছেন, উপকৃত হয়েছেন; তার রাজনৈতিক, সামাজিক জীবনকে যতটা কাছ থেকে দেখেছেন, তার সংক্ষিপ্ত অথচ মনোজ্ঞ বর্ণনা তিনি করেছেন। আমাদের আহমদ ছফা চর্চাকে আরও শাণিত করবে লেখাটি এতে আমার কোন সন্দেহ নেই। আরও বেশি পাঠকের কাছে লেখাটি পৌঁছাক এ আমার আন্তরিক প্রত্যাশা।
................................................................
ব্যতিক্রমের মধ্যে ব্যতিক্রমী
মফিদুল হক
আহমদ ছফা, তাঁর কাছের-দূরের, পরিচিত-অপরিচিত, শত্রু-মিত্র, ভক্ত কিংবা সমালোচক সবাই মানবেন, ছিলেন এক ব্যতিত্রক্রমী মানুষ। ইংরেজিতে এদের বলা হয় ম্যাভরিক, বাংলায় ঠিক যুৎসই শব্ধ খুঁজে পাওয়া যাবে না, হতে পারে এ ধরনের শক্ত চরিত্র নরম পলিমাটির দেশ বাংলায় সচরাচর খুঁজে পাওয়া যায় না, আর তাই এমন চরিত্র বোঝানোর মতো শব্দও হাতের কাছে সহজে মেলে না।
ইংরেজি-বাংলা অভিধানে ম্যাভরিকের শব্দার্থ নেই, রয়েছে অনেক শব্দ মিলিয়ে এর ব্যাখ্যা। কিন্তু এসব অন্তত এটা পরিষ্কার করে যে, আহমদ ছফা সচরাচর দেখা পাওয়া আর দশটা মানুষের মতো ছিলেন না, কিংবা তিনি বিরলপ্রজ আর সব বঙ্গপ্রতিভার মতোও ছিলেন না, তিনি সত্যিই একেবারে আলাদা, নিশ্চিতভাবেই ম্যাভরিক।
শুরুতেই কবুল করে নিতে চাই আমি তাঁর একজন অনুরাগী, যেমন তাঁর রচনার, তেমনি তাঁর জীবনাচারের, কিংবা আরেকটু পোশাকিভাবে বললে তাঁর জীবনচর্যার, অথচ আমার মন-মানসিকতার একেবারে বিপরীত মেরুর মানুষ তিনি। আমি মুখচোরা স্বভাবের, নিজেকে আড়ালে-আবডালে রাখতে পারলে স্বস্তি পাই, তিনি একান্ত মুখরা, সদা মুখরিতই বলা ভালো, নিজেকে প্রবলভাবে প্রকাশে তাঁর যে আপত্তি নেই কেবল তা নয়, বরং আগ্রহই সমধিক। কারো মুখের ওপর কিছু বলা আমাদের স্বভাববিরুদ্ধ, কিন্তু আহমদ ছফা অবলীলায় বলতে পারেন অপ্রিয় সত্য কথা। চিন্তা-চেতনাতেও তাঁর সঙ্গে বিরুদ্ধতাই বেশি খুঁজে পাই। বাংলাদেশের বাজারে ভারতীয় বইয়ের বিশাল ভিত্তি তাঁকে বিচলিত করেছিল, তিনি এর বিরুদ্ধে নানা প্রতিবাদ সংগঠিত করেছেন, বাজারি সাহিত্যের কঠোর বিরুদ্ধাচারণ করেছেন, আর আহমদ ছফার যা স্বভাব, লেখালেখিতে কখনো তিনি গণ্ডিবদ্ধ থাকেননি, সভা-সমাবেশ করেছেন, প্ল্যাকার্ড হাতে মিছিল করেছেন, প্রাণভরে গালমন্দ করেছেন যারা এ বিরোধিতায় শরিক হতে অসম্মত তাদের। আমার ক্ষুদ্র বিবেচনায় শিল্প-সাহিত্যের বলয়ে এমনি বিভাজনরেখা শেষ বিচারে চেতনায় এক ধরনের সীমাবদ্ধতা বা ঘেরাটোপ আরোপ করে, যা কোনো জাতির পক্ষে আত্মনিধনের শামিল। আহমদ ছফার সঙ্গে এ প্রশ্ন ছাড়াও আরো অনেক বিষয়ে মিল খুঁজে পাই না, কিন্তু বলতে তো একটুও দ্বিধা থাকে না তিনি আমার বিশেষ সম্মানীয়জনের একজন, আমাদের কালের এমন এক ব্যতিক্রমী প্রতিভা যে মানুষটি চারপাশের সব নেতিবাচকতার বিরুদ্ধে প্রায় যেন একক প্রতিরোধে নেমেছিলেন এবং পরিপূর্ণভাবে এ সংগ্রামে ঝাঁপ দিয়েছিলেন, আর সেটা এতই পরিপূর্ণ ছিল যে চারপাশের বাস্তবতা থেকে গভীর মর্মবেদনা তাঁর ভেতরে জন্ম নিয়েছিল, তীব্র ও তিক্ত অনুভূতি এবং সে কারণেই তাঁর লেখা ও কথা হয়ে উঠেছিল বিষবাণ, অথচ তিনি নিজেই যে বিষের যন্ত্রণায় জর্জরিত হয়ে ছটফট করছেন, সেটা থেকে গেছে আমাদের নজরের বাইরে।
জোনাথন সুইফট এবং এডগার অ্যালান পো সম্পর্কে বলা হয়, লেখকেরা সবাই যখন জীবনকে বরণ করেন, সেই স্রোতের বিপরীতে এই দু’জন যেন মানবপ্রজাতির সদস্য হওয়াটাকেই প্রত্যাখ্যান করতে চেয়েছেন, তাঁদের মধ্যে ছিল জীবন সম্পর্কে তীব্র তিক্ত বিবমিষা। এমন কথা বাংলা সাহিত্যে খুব বেশি লেখক সম্পর্কে উচ্চারণ করা যাবে না, চারপাশের জীবনে যা প্রত্যক্ষ করেছেন কিংবা নিজের ব্যক্তিজীবনে যে ধরনের চরম বঞ্চনা ও নিষ্ঠুর অভিজ্ঞতার শরিক হয়েছেন তা একজন সংবেদনশীল শিল্পীসত্তার অধিকারীকে এমন অবস্থানে পৌঁছে দিতে পারে। কিন্তু প্রত্যাখ্যানবাদী এ অবস্থানে শিল্পীসত্তা নিয়ে সংহত থাকাটা অত্যন্ত কঠিন সাধনার বিষয়। তেমনি সাধক একান্তই হাতে গোনা যায়, আহমদ ছফা ছিলেন সেই ঘরানার বিরল এক শিল্পী, বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় যিনি ছিলেন নিবেদিত। এমন প্রত্যাখ্যানবাদী আমাদের সমাজে একেবারে যে নেই তা নয়, এঁদের অনেকে আপন বলয়ে স্থিতধী থাকেন, অনেকে নিজের জন্য আলাদা সামাজিক আচার ও জীবন গড়ে নিতে পারেন, যেমন করেছিলেন এসএম সুলতান এবং যাঁকে আপন সত্তার প্রতিপুরুষ হিসেবে পরমভাবে বরণ করে লোকসমাজের সামনে তুলে ধরেছিলেন আহমদ ছফা, মনে হয় যেন নিজ ভাবনার প্রতিরূপকেই বুঝি তিনি এভাবে হাজির করতে পেরেছিলেন আমাদের সামনে।
তবে প্রত্যাখ্যানবাদী শিল্পীসত্তা কিংবা জীবনের অবমাননায় ক্রুদ্ধ মানস বহন করার পাশাপাশি আহমদ ছফা আরেক প্রবল আকুতি বহন করেছেন, তিনি ছিলেন একান্তভাবে নির্মাণবাদী, জীবনকে অস্বীকার করলেও মানবসত্তার পরিপূর্ণতার বিকাশ ঘটানোর আকুতি তাঁর মধ্যে ছিল একইরকমভাবে সহজাত ও তীব্র। ফলে প্রত্যাখ্যানের পাশাপাশি বহু ধরনের সামাজিক ও মানবিক বিকাশের কাজে তিনি নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন। প্রত্যাখ্যানবাদী যদি আরো কারো কারো খোঁজ মেলে, একইসঙ্গে এমনভাবে সম্মিলিত সামাজিক বিকাশের উদ্গাতা আর বিশেষ কাউকে পাওয়া যাবে কি-না সন্দেহ। এ দিক দিয়ে আহমদ ছফা নামক মানুষটিকে বলা যায় ব্যতিত্রক্রমের মধ্যে ব্যতিত্রক্রমী।
আমরা জানি, আহমদ ছফা ছিলেন অকৃতদার, সংসারবিবাগী মানুষ, ভেসে বেড়ানো বোহেমিয়ানা ছিল তাঁর স্বভাবগত, কিন্তু তিনি যে তীব্রভাবে ছিলেন সংসারপ্রেমী স্থিতিসন্ধানী মানুষ, সেটাও তো এর পাশাপাশি স্মরণ করতে হয়। যিনি অপার ভালোবাসায় চারপাশের মানুষকে আঁকড়ে ধরতে চান, আবার কাছের মানুষের মধ্যে কোনোরকম মানবী দুর্বলতার পরিচয় পেয়ে তীব্র প্রত্যাখ্যানে জ্বলে ওঠেন, যে কারণে তাঁর দুর্নিবার আকর্ষণে বহুজন কাছে এসেছেন, আবার দূরেও সরে গেছেন। কিন্তু ব্যক্তিমানুষের হয়তো বদল ঘটেছে, একজন দূরে গেলেও নতুন করে আরো দশজনকে কাছে টেনেছেন আহমদ ছফা, তাই তাঁকে ঘিরে রাখা মানব-বলয়ে কখনো কোনো ক্ষয় ঘটেনি, বরং কালক্রমে তা অর্জন করেছে আরো ব্যাপ্তি ও সমৃদ্ধি। এটাও লক্ষণীয়, যতই বয়স হয়েছে আহমদ ছফার সমবয়সী বন্ধু-পরিজনের সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে এবং তিনি ক্রমান্বয়ে ঝুঁকেছেন তরুণতরদের দিকে, শিশুদের দিকে এবং ক্রমান্বয়ে ফুল-পাখি-লতাগুল্মের দিকে, যার অনন্য পরিচয় বিধৃত হয়ে আছে তাঁর ‘পুষ্প, বৃক্ষ এবং বিহঙ্গ পুরাণ’ গ্রন্থে।
আপাতদৃষ্টিতে গৃহবিবাগী আহমদ ছফা অন্তরে বহন করেছেন পরম স্নেহভাব ও ভালোবাসা। এই স্নেহ ও ভালোবাসার কারণে নিকটজনের কাছে তাঁর প্রত্যাশার মাত্রাও ছিল অশেষ। সেই প্রত্যাশা-পূরণে প্রায় কেউই সক্ষম হতে পারেনি, ফলে সবার সঙ্গে সবসময় পথচলা আহমদ ছফার কখনো হয়ে ওঠেনি। ব্যতিক্রম যে দু-একজন ছিল না তা নয়, এমনি এক অনন্য ব্যতিক্রম অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক, যিনি আহমদ ছফাকে নিবিড়ভাবে বুঝতে পেরেছিলেন এবং গভীর প্রীতির সম্পর্কে বাঁধতে পেরেছিলেন। আহমদ ছফা মুক্তবুদ্ধির যে চর্চায় আগ্রহী ছিলেন, যেভাবে জীবনকে জ্ঞানসাধনায় উজাড় করে দিতে চেয়েছিলেন সেই অনুভূতি অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাককে আলোড়িত করেছিল নিঃসন্দেহে এবং তিনি হয়ে উঠেছিলেন ছফার জন্য প্রশ্রয় ও উৎসাহদাতা। এমন নয় যে, আহমদ ছফার সব কাজ তিনি মেনে নিতে পারেন কিন্তু স্নেহসিক্ত হাসি দিয়ে তিনি তো ছফাকে উপভোগ করতে পারতেন, তাঁর সাহচর্যে আনন্দ পেতেন। উভয়ের সম্পর্ক আপাতদৃষ্টিতে কিছুটা গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক, কিন্তু অন্তঃসলিলা এক ভাববিনিময় সেখানে বহমান ছিল যা উভয়ের জন্য ছিল উপভোগ্য ও আলোকসঞ্চারী। বাংলাদেশের দুটি গ্রন্থ অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা সর্বদা অর্জন করেছে, তার একটি সরদার ফজলুল করিম প্রণিত ‘দর্শনকোষ’ এবং অপরটি আহমদ ছফা অনূদিত গ্যেটের ‘ফাউষ্ট’। এ দুই গ্রন্থেই বহুমাত্রিক তাৎপর্য খুঁজে পেয়েছিলেন অধ্যাপক মহোদয়, প্রথমত উভয় গ্রন্থই মানবের জ্ঞানসাধনার সঙ্গে বাঙালিকে বাংলাভাষায় পরিচিত করে তুলেছে, যেটা ছিল আবদুর রাজ্জাকের সবসময়ের অন্বিষ্ট, সেইসঙ্গে ভাষার দিগন্ত প্রসারে গ্রন্থদ্বয় বড় অবদান রেখেছে। মাতৃভাষার মাধ্যমে জ্ঞান-সাধনার বিকাশে সর্বজনের অধিকার কায়েমের স্বপ্ন বহন করছিলেন অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক এবং সেই স্বপ্নের প্রতীকী উদ্ভাসন তিনি দেখতে পেয়েছিলেন এই দুই গ্রন্থে।
অনাত্মীয়দের সঙ্গে আত্মীয়তা গড়তে আহমদ ছফা সদা ছিলেন উদগ্রীব, কত না পরিবারের তিনি আপনজন হয়ে থেকেছেন, কতজনকেই না নিজের আপনজন করে নিয়েছেন। নিজের বিশ্বাস ও ধ্যান-ধারণায় তিনি কঠোরভাবে সিদ্ধাচারী, কিন্তু বিপরীত চিন্তার মানুষদের আপন করে নিতে তাঁর মধ্যে কোনো দ্বিধা ছিল না। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার পঙক্তি ধার করে বলতে হয়, তাঁর অঙ্গভঙ্গি কেদার রায়ের হলেও অন্তরে এক স্নেহকাতর মানস তিনি বহন করেছেন যা বহিরঙ্গের সঙ্গে একেবারে বেমানান।
সারাজীবন ঠাঁই বদল করে চলেছেন আহমদ ছফা, কী পেশা কী আবাস কোনো কিছুতেই স্থিতি খুঁজে পাননি তিনি, অথচ তাঁর এমন কোনো উচ্চ বাসনা ছিল না। বিত্তকে তিনি কখনোই বিশেষ মূল্য দেননি, বিত্ত আহরণের নানারকম সুযোগ তাঁর জীবনে এসেছিল, কখনোই তিনি সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করেননি। লিবিয়ার দূতাবাসের ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন তিনি মুয়াম্মার গাদ্দাফির উচ্চকণ্ঠ সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতায় মুগ্ধ হয়ে। তেল-সম্পদের বদৌলতে হঠাৎ-ধনী আরব দেশগুলো তখন মুসলিম উম্মাহর মধ্যে অনুগতজন তৈরিতে দেদার টাকা ঢালছে, পর্দার আড়ালে চলছে আরো নানা খেলা। এ যোগাযোগ আহমদ ছফা নিজ চিন্তাদর্শনের অনুকূল হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন, সেই সুবাদে কিছু লোকের একটা হিল্লে করার ব্যবস্থাও করেছিলেন। তাঁর দিক থেকে এক্ষেত্রে আর কোনোরকম স্বার্থ জড়িত ছিল না, তবে বিষয়বুদ্ধি প্রখর হলে এবং চাইলে এমন যোগাযোগ জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু আহমদ ছফা, তাঁর জীবনের বহমানতা নিয়ে, এখানেও বেশিদিন স্থিত হননি। জার্মানদের বিশেষ মনোযোগ পেয়েছিলেন তিনি, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসাও, সেই সূত্রে ‘বাংলা-জার্মান সম্প্রীতি’র তিনি ছিলেন অলিখিত প্রধান। তাঁর একটি টেলিফোনেও সেখানে অনেক কাজ হয়, অনেকের অনেক ধরনের উপকার করতে এ যোগাযোগকে তিনি অকাতরে ব্যবহার করেছেন। আমিও অযাচিতভাবে তাঁর ভালোবাসায় বরিত হয়েছি এবং ফ্রাঙ্কফুর্টে বইমেলায় যোগ দিতে আমাকে সহায়তা জোগাতে নিজে আমার অফিসে এসে প্রস্তাব রেখে যান এবং তা কার্যকর হতে বিশেষ সময় লাগেনি। যুৎসই একটা এনজিও দাঁড় করাতে পারলে সুশীল সমাজের নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী সদস্যপদ পাওয়া যায় এবং বাংলাদেশের শিক্ষিত নাগরিকজনের জন্য এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কী হতে পারে! কিন্তু এ সম্প্রীতির বৃত্তেও আহমদ ছফা বেশিদিন বিচরণ করেননি, অকুণ্ঠচিত্তে সব ঠেলেঠুলে তিনি বের হয়ে এসেছেন তাঁর সেই আত্মভোলা জীবনপথে।
আপাতভাবে ভেসে বেড়ানো মনে হলেও আসলে আহমদ ছফা চেয়েছিলেন স্থিত হতে, জ্ঞানচর্চায় নিবেদিত থাকতে এবং সেই চর্চাকে জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে সমষ্টির কল্যাণে অবদান রাখতে। অ্যাকটিভিষ্ট মানুষ হিসেবে জ্ঞানের আলোকবর্তিকা হাতে চলবেন পথ, এই ছিল তাঁর আকাঙ্ক্ষা। তাঁর সমস্ত যোগ্যতা সত্ত্বেও এই আকাঙ্ক্ষাপূরণে কোনো সহায়ক ভূমিকা সমাজ পালন করেনি। আমাদের জ্ঞানচর্চার প্রতিষ্ঠানগুলো এতই বিধিবদ্ধ ও কূপমণ্ডুক হয়ে পড়েছে যে সেখানে আহমদ ছফার মতো ব্যক্তিদের সম্পূর্ণ অপাঙ্ক্তেয় হয়ে থাকতে হয়েছে, অপ্রাতিষ্ঠানিকতার কোনো স্বীকৃতি সেখানে কখনো জোটেনি।
আহমদ ছফার যৌবনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি এতটা কাঠামোবদ্ধ ছিল না। আহমদ ছফা বিদ্যাচর্চার বলয়ের সদস্য, এই পরিচয় অনেক মূল্য বহন করত। আনুষ্ঠানিকভাবে একটা গবেষণা-বৃত্তি তিনি গ্রহণ করেছিলেন, তারপর বছরের পর বছর থেকেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক ছাত্রাবাসে। তাঁর এ অবস্থান নিজের জন্য এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও নবীন শিক্ষকদের জন্য যে ফলপ্রসূ হয়েছে সেটা আমরা অনুমান করতে পারি। আহমদ ছফাও তাঁর এ বিদ্যাপীঠের জীবন উপভোগ করছিলেন এবং স্বাধীন-জ্ঞানচর্চায় নিবেদিত থাকতে অনুকূল পরিবেশ খুঁজে পেয়েছিলেন। কিন্তু ছফার জন্য সেই সুযোগও অস্বীকৃত হয়েছিল, তাঁর জ্ঞান সাধনার কোনো স্বীকৃতিও ছিল না।
আহমদ ছফার প্রতি সমাজ কোনো দায়িত্ব পালন করেনি, যদিও সমাজের প্রতি দায় মোচনে ছফা জীবন-উৎসর্গ করে গিয়েছিলেন। ব্যতিক্রমী সাধকদের সম্মান জানাতে হলে ধরাবাঁধা পথের বাইরে যেতে হয়, যেমন ঘটেছিল ভারতের সুবিখ্যাত জহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় বা জেএনইউর প্রথম সমাবর্তনে অভিনেতা বলরাজ সাহনিকে বক্তৃতা দেওয়ার আমন্ত্রণ জানানোর মধ্যে। এ সিদ্ধান্তের অনেক সমালোচনা হয়েছিল, কিন্তু বলরাজ সাহনির অসাধারণ সমাবর্তন ভাষণ সব সমালোচনা স্তব্ধ করে দিয়েছিল। প্রসঙ্গত মনে পড়ে মিশেল ফুকোর পেশাগত জীবনের এক অধ্যায়ের কথা। কলেজ দ্য ফ্রান্স-এ এক বছরের জন্য হিস্টরি অব ফিলসফিক্যাল থটসের চেয়ারে আসীন হয়েছিলেন মিশেল ফুকো। যাঁরা এই সম্মানে অধিষ্ঠিত হবেন তাদের এক বছর কোনো ক্লাস নিতে হবে না, বরং প্রত্যাশা করা হয় তাঁরা কোনো মৌলিক বিষয়ে জ্ঞানচর্চায় নিবিদ্ধ থাকবেন এবং এ গবেষণার বিষয় কয়েকটি সেমিনার আয়োজনের মধ্য দিয়ে তুলে ধরবেন। বছরে ২৬ ঘণ্টা সেমিনারে লেকচার দেওয়া ছাড়া সম্মানীয় চেয়ারে অধিষ্ঠিত বিদ্বৎজনের আর কোনো দায় নেই। কলেজ দ্য ফ্রান্সে আয়োজিত এমনি সেমিনারে যে-কেউ শ্রোতা হিসেবে অংশ নিতে পারেন, কোনো ধরনের আনুষ্ঠানিকতার অবকাশ এখানে নেই। তো ১৯৭৬ সালে মিশেল ফুকো এমনি যে কয়েকটি বক্তৃতা প্রদান করেছিলেন অসাধারণ সেই ভাষ্য পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশ পেয়েছে ‘সোসাইটি মাস্ট বি ডিফেন্ডেড’ শিরোনামে। স্বভাবতই মনে হবে, এমনি বক্তৃতাদানের জন্য আমাদের সমাজে আহমদ ছফা ছিলেন একান্ত যোগ্য ব্যক্তি, মৌলিক চিন্তার অধিকারী ছিলেন তিনি, তেমনি ছিলেন মানুষ হিসেবে মৌলিক।
তবে এসব মানুষকে আমরা চিনি না, আমাদের কাছে তাঁরা ম্যাভরিক, পোশাকি ভাষায় বলি ব্যতিক্রমী, আমাদের প্রচলিত মাপকাঠির বাইরের এমনি এক মানুষ ছিলেন আহমদ ছফা, তাঁদের জন্য সমাজের দিক থেকে প্রচলভাঙা ব্যবস্থা নেওয়া দরকার ছিল, কিন্তু সমাজ সে কথা কখনো ভাবতে পারেনি। এটা আমাদের দুর্ভাগ্য, আহমদ ছফার নয়।
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন