সোমবার, ২৪ আগস্ট, ২০০৯

কবি অমিতাভ দাশগুপ্তর কবিতা








আমার স্বপক্ষে/ আমি তোমাদেরই লোক

এইখানে চর ফুটেছিল। জ্যোৎস্না। হোগলার বন।
বানভাসি মানুষের বাধ্যতামূলক অরন্ধন
কিছুকাল বন্ধ ছিল। ঘর, শিশু, আউসের ক্ষেত,
পানের বরোজ বুকে অকস্মাৎ চর ফুটেছিল।

ফোটে। কোনদিন ফুটে আমাদেরই অসতর্কতায়
হাতে এসে ছোঁয়া দিয়ে ঝরে যায় সকল মুকুল,
তপ্ত অধীরতা প্রাণে ছুটে ছুটে ভ্রুক্ষেপবিহীন
করতল তুলে দেখি গন্ধ নয়, গন্ধের মতন
কিছু নমনীয় ব্যথা, ভুল প্রত্যাখ্যান লেগে আছে।
পাথর! পাথর! আমি কজ্জল-নিবিড় মেঘমালা
দু'কূল ভাসানো ক্ষিপ্র বহতা জোয়ারে বেঁধে দিতে
কঠিন ধাতুর দৃঢ় নিশ্চয়তা-ভিখারি এখন,
প্রতিকূলে নিদ্রাহীন পিতামহ, নারায়ণী সেনা,
আমার স্বপক্ষে কৃষ্ণ- তারা কেউ জীবিত ফিরবে না।


অলীক বন্দুক/ ছিন্নপত্র নয়, ছেঁড়া পাতা

বড় ভালোবাসা ছিল। তাই বড় বেশি শংকা ছিল।
সেই বিষে নীল হয়ে
আপ্রাণ বাঁচার ইচ্ছে নিয়ে
কখন যে বোঁটা-ছেঁড়া ফলের মতন
টুপ্ করে খসে গেছ জলে,
তোমাকে চিনত যারা, গোল হয়ে বসে
তারা সে দুঃখের গল্প বলে।

পাথর, গিয়েছো সরে। এত সুখ, আহ্ এত সুখ!
তাই আমি আশাতীত এমন সুযোগে
নিজের বুকের দিকে তুলি ধরি আত্মঘাতী অলীক বন্দুক।



দশটি তরঙ্গ/ নীল স্বরস্বতী

২.

ত্বকের গভীরে ছুঁই, সেই দৃষ্টি কোথায় আমার?
মাংসের মর্মর শুনে, ঢেউ গুনে গুনে দীর্ঘদিন
সুগোল ফলের নিচে কাকের মতন জব্দ আছি,
ফুলের নিবিড়ে পুলকের লাল খুঁজে নিতে নিতে
সব কিছু দূরে যায়, লোহিতসাগরও দূরে যায়।
আমার সঙ্গম মানে ভাপওঠা মাংসের গরম-
ত্বকের গভীরে ছুঁই, সেই দৃষ্টি কোথায় আমার?

৫.

নীল সিন্ধুপারে এসে
নুনে পোড়া হৃদয়ের অর্থ জানা গেল।
জানা গেল শোনিতের প্রকৃত প্লাবন,
আমাকে ফিরিয়ে নাও, ও শহর, পাথুরে শহর,
আমার হৃদয় নেই, ভালোবাসা নেই,
আমার কবিতা লেখা দন্ডিতের মৃত্যুর সমান।



অমীমাংসিত/ মৃত্যুর অধিক খেলা


গাঢ় চুম্বনের মত ছেঁড়া ছেঁড়া রক্তমেঘ ঝুলে ছিল এখানে ওখানে,
গরম অশ্রুর দানা বৃষ্টি ছিল পাতার ডগায়,
ম্লান চরাচর ঝেঁপে ভিখারির রিক্ত করতল
আর
শাদা কাগজের মত নারী।

খুব কষ্ট পেলে কবি এরকম কয়েকটি লাইন
আচমকা লিখে ফেলে একদম বোবা মেরে যায়।
বারবার কেঁপে ওঠে কলমের নিস্পিষ্ট প্লাসটিক,
ব্রেনের ভিতর তীব্র কানামাছি,
জ্বলে নেভে লক্ষ লাল টুনি।
এক সময় লাফ দিয়ে উঠে
দু'হাতে করোটি চেপে টেনে ধরে ব্যাক-ব্রাশ চুল,
চটির অধীর শব্দে ভরে যায় দীর্ঘ করিডর-
পোল পার হয়ে যাওয়া-সন্ন্যাসীর পায়ে পায়ে
কোথায় মিলায় বর্ণমালা!

শুধ কবি বসে থাকে।
আর থাকে মীমাংসাবিহীন
আঙুলের খাঁজে খাঁজে
গাঢ় চুম্বনের মত ছেঁড়া ছেঁড়া রক্তমেঘ,
গরম অশ্রুর দানা,
ভিখারির করতল,
নারী।


বন্ধুর মৃত্যুর পর/ মৃত্যুর অধিক খেলা


নক্ষত্রমালার দিকে উড়ে যায় একটি মানুষ।
তার নীল শার্ট উড়ে হয়ে যায় প্রচুর আকাশ,
সেই আকাশের নীচে অন্যসব মানুষেরা থাকে।
গ্রীষ্ম ও শীতের ফাঁকে, স্বপ্ন ও কাজের ফাঁকে ফাঁকে
হঠাৎ দেখেছে তারা, বা হঠাৎই দেখতে চেয়েছে
নক্ষত্রমালার দিকে উড়ে যায় একটি মানুষ।

ভুল মৃত্যু ছুটে আসে ভুল অশ্ব-ঘোষণার মত,
ভুল মৃত্যু ঘাসে শুয়ে গুপ্তি মেরে নামায় আকাশ,
নিয়ে যায় সখা, উষ্ণ করতল, সাহস চৌমাথা,
তার হিরন্ময় দ্যুতি, পরাজয়, কবিতার খাতা।
আমাদের ঈর্ষা নিয়ে, নিরুপায় বেঁচে থাকা নিয়ে
নক্ষত্রমালার দিকে উড়ে গেলে একটি মানুষ
নতুন নক্ষত্র-বেঁধা সেই নীলিমার দিকে চেয়ে
মানুষেরা ভুল করে নারীকে 'নীলিমা' বলে ডাকে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন