সোমবার, ২৪ আগস্ট, ২০০৯

কবি তারাপদ রায়ের কবিতা


(শক্তি-সুনীলদের সমসাময়িক তারাপদ রায় কৃত্তিবাস পত্রিকার সঙ্গে জড়িত ছিলেন শুরু থেকে। এমনই সেই সম্পৃক্তি যে একমাত্র পুত্রের নামও রেখেছেন কৃত্তিবাস।

তাঁর জন্মস্থান ও আদি নিবাস ছিলো টাঙ্গাইলে। দেশভাগের পর কলকাতা। কিন্তু তাঁর গদ্যে-পদ্যে সর্বত্র টাঙ্গাইল ছিলো আজীবন। এমনকি, সর্বশেষ কবিতা যেটি সেখানেও নাম উল্লেখ না থাকলেও টাঙ্গাইলের কথাই লিখেছেন বলে অনুমান করা যায়।)


পুরনো শহরতলিতে


আবার ফিরে এলাম,
আর একটু খোঁজ নিয়ে এলেই ভাল হত।

বাড়ির সামনের দিকে
একটা কয়লার দোকান ছিল
কাঠ, কয়লা, কেরোসিন - খুচরো কেনা বেচা,
কেউ চিনতে পারল না

দু'জন রাস্তার লোক বলল,
'এদিকে কোনো কয়লার দোকান নেই
গলির এপারে রাধানাথ দত্তের গ্যাসের দোকান
সেখানে খোঁজখবর নিয়ে দেখুন।
'মনে আছে কয়লার দোকানের পিছনে ছিল বড় উঠোন,
কয়েকটা আম কাঁঠাল গাছ, ভাঙা বারান্দা, ঘর দোর।
এখন তো কিছুই নেই,
শুধু একটা নেমপ্লেট, 'নাগরিক'।
চারতলা বাড়ি, ষোলটা ফ্ল্যাট,
এরই মধ্যে কোনওটায় আমি ফিরে এসেছি।
কিন্তু কয়তলায়, কাদের ফ্ল্যাট?
স্বর্গীয় রূপকবাবুর পদবিটা যেন কী ছিল,
তাঁদের নতুন বাসাবাড়িতে এখন কে থাকে -
কোনও খোঁজখবর রাখি না,
শুধু মনে আছে তাঁর ভাইঝি টুলটুলি।
না। সেই বাড়িটা জগৎসংসারে আর নেই,
টুলটুলিকে কেউ চেনে না।
পুরনো শহরতলির নতুন পাড়ায় বোকার মতো ঘুরি।



এক জন্ম

অনেকদিন দেখা হবে না
তারপর একদিন দেখা হবে।
দু’জনেই দু’জনকে বলবো,
‘অনেকদিন দেখা হয়নি’।
এইভাবে যাবে দিনের পর দিন
বৎসরের পর বৎসর।
তারপর একদিন হয়ত জানা যাবে
বা হয়ত জানা যাবে না,
যে
তোমার সঙ্গে আমার



দারিদ্র্য রেখা

আমি নিতান্ত গরীব ছিলাম, খুবই গরীব।
আমার ক্ষুধার অন্ন ছিল না,
আমার লজ্জা নিবারণের কাপড় ছিল না,
আমার মাথার উপরে আচ্ছাদন ছিল না।
অসীম দয়ার শরীর আপনার,
আপনি এসে আমাকে বললেন,
না, গরীব কথাটা খুব খারাপ,
ওতে মানুষের মর্যাদা হানি হয়,
তুমি আসলে দরিদ্র।
অপরিসীম দারিদ্র্যের মধ্যে আমার কষ্টের দিন,
আমার কষ্টের দিন, দিনের পর দিন আর শেষ হয় না,
আমি আরো জীর্ণ আরো ক্লিষ্ট হয়ে গেলাম।
হঠাৎ আপনি আবার এলেন, এসে বললেন,
দ্যাখো, বিবেচনা করে দেখলাম,
দরিদ্র শব্দটিও ভালো নয়, তুমি হলে নিঃস্ব।
দীর্ঘ নিঃস্বতায় আমার দিন রাত্রি,
গনগনে গরমে ধুঁকতে ধুঁকতে,
শীতের রাতের ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে,
বর্ষার জলে ভিজতে ভিজতে,
আমি নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর হয়ে গেলাম।
আপনার কিন্তু ক্লান্তি নেই,
আপনি আবার এলেন, আপনি বললেন,
তোমার নিঃস্বতার কোনো মানে হয় না,
তুমি নিঃস্ব হবে কেন,
তোমাকে চিরকাল শুধু বঞ্চনা করা হয়েছে,
তুমি বঞ্চিত, তুমি চিরবঞ্চিত।
আমার বঞ্চনার অবসান নেই,
বছরের পর বছর আধপেটা খেয়ে,
উদোম আকাশের নিচে রাস্তায় শুয়ে,
কঙ্কালসার আমার বেঁচে থাকা।
কিন্তু আপনি আমাকে ভোলেননি,
এবার আপনার মুষ্টিবদ্ধ হাত,
আপনি এসে উদাত্ত কণ্ঠে ডাক দিলেন,
জাগো, জাগো সর্বহারা।
তখন আর আমার জাগবার ক্ষমতা নেই,
ক্ষুধায় অনাহারে আমি শেষ হয়ে এসেছি,
আমার বুকের পাঁজর হাঁপরের মতো ওঠানামা করছে,
আপনার উৎসাহ ও উদ্দীপনার সঙ্গে
আমি তাল মেলাতে পারছি না।
ইতিমধ্যে আরো বহুদিন গিয়েছে,
আপনি এখন আরো বুদ্ধিমান,
আরো চৌকস হয়েছেন।
এবার আপনি একটি ব্ল্যাকবোর্ড নিয়ে এসেছেন,
সেখানে চকখড়ি দিয়ে যত্ন করে
একটা ঝকঝকে লম্বা লাইন টেনে দিয়েছেন।
এবার বড় পরিশ্রম হয়েছে আপনার,
কপালের ঘাম মুছে আমাকে বলেছেন,
এই যে রেখা দেখছো, এর নিচে,
অনেক নিচে তুমি রয়েছো।
চমৎকার!
আপনাকে ধন্যবাদ, বহু ধন্যবাদ!
আমার গরীবপনার জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ,
আমার দারিদ্র্যের জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ,
আমার নিঃস্বতার জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ,
আমার বঞ্চনার জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ,
আমার সর্বহারাত্বের জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ,
আর সবশেষে ওই ঝকঝকে লম্বা রেখাটি,
ওই উজ্জ্বল উপহারটির জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ।
কিন্তু,
ক্রমশ,
আমার ক্ষুধার অন্ন এখন আরো কমে গেছে,
আমার লজ্জা নিবারণের কাপড় এখন আরো ছিঁড়ে গেছে,
আমার মাথার ওপরের আচ্ছাদন আরো সরে গেছে।
কিন্তু ধন্যবাদ,
হে প্রগাঢ় হিতৈষী, আপনাকে বহু ধন্যবাদ!



আণবিক সুড়সুড়ি

বোলতা, ভিমরুল এবং মৌমাছিদের সঙ্গে
কাঠপিঁপড়ে, ডেয়োপিঁপড়ে এবং লালপিঁপড়েদের
সন্ধিচুক্তি যেদিন স্বাক্ষরিত হল,
কেউ মাথা ঘামায় নি।

শুধু কালোপিঁপড়েরা বলেছিল,
"আমাদের কিছুই বলার নেই।
আমরা কাউকে কামড়াই না
শুধু সুড়সুড়ি দিই।'



ভুল

কোনটা যে চন্দ্রমল্লিকার ফুল
আর কোনতা যে সূর্যমুখী --
বারবার দেখেও
আমার ভুল হয়ে যায়,
আমি আলাদা করতে পারি না।

ওলকপি এবং শালগম,
মৃগেলের বাচ্চা এবং বাটামাছ,
মানুষ এবং মানুষের মত মানুষ --
বারবার দেখেও
আমার ভুল হয়ে যায়,
আমি আলাদা করতে পারি না।

বই এবং পড়ার মত বই,
স্বপ্ন এবং দেখার মত স্বপ্ন,
কবিতা এবং কবিতার মত কবিতা,
বারবার দেখেও
আমার ভুল হয়ে যায়,
আমি আলাদা করতে পারি না।



দিন আনি দিন খাই

আমরা যারা দিন আনি, দিন খাই,
আমরা যারা হাজার হাজার দিন খেয়ে ফেলেছি,
বৃষ্টির দিন, মেঘলা দিন, কুয়াশা ঘেরা দিন,
স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে অধীর প্রতীক্ষারত দিন,
অপমানে মাথা নিচু করে চোরের মত চলে যাওয়ার দিন,
খালি পেট, ছেঁড়া চটি, ঘামে ভেজা দিন,
নদীর জলের আয়নায়, বড় সাহেবের ফুলের বাগানে দিন,
নৌকার সাদা জালে ঢেউয়ের চুড়ায় ভেসে যাওয়া দিন,
রোদে পোড়া, আগুনে জ্বলা রাস্তায় রাস্তায় ঘোরা দিন,
হৈ হৈ অট্টহাসিতে কলরোল কোলাহল ভরা দিন,
হঠাত্ দক্ষিণের খোলা বারান্দার আলো ঝলমলে দিন -

এই সব দিন আমরা কেমন করে এনেছিলাম, কিভাবে,
কেউ যদি হঠাত্ জানতে চায়, এ রকম একটা প্রশ্ন করে,

আমরা যারা কিছুতেই সদুত্তর দিতে পারবো না,
কিছুই বলতে পারবো না, কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারবো না
কি করে আমরা দিন এনেছিলাম,
কেন আমরা দিন আনি, কেন আমরা দিন খাই
কেমন করে আমরা দিন আনি, দিন খাই।



ভ্রমণ কাহিনী

শেষবার নামার আগে সমস্ত জিনিস পত্রগুলি
তালিকা মিলিয়ে নিতে হবে, এবার ভ্রমণকালে
প্রচুর সংগ্রহ হ'লো, মিনে-করা আগ্রার ফুলদানি।
জরির চপ্পল, দ্রুতগামী মেল ট্রেনে সচকিত
ভ্রূ-পল্লব, কী-কী ফেলে গেলে বাড়ি ফিরে দু:খ হবে?

যে আমগাছের ছায়া সঙ্গে নিয়ে আসা অসম্ভব
তা-ও বুঝি অজানিত হোল্ড-অলে বাঁধা হয়েছিলো,
আমগাছের ছায়ার ওজন জানা নেই, তাই করলে
বুকিং সম্ভব নয়, ভ্রূ-ভঙ্গির কুলি ভাড়া নেই।



আমি লিখিনি

কোথাও ছাপার ভুল হয়ে গেছে। ভীষণ, বিচ্ছিরি
এ পদ্য আমার নয়, এই আলপনা, এই পিঁড়ি;
এই ছবি আমি তো আঁকিনি,
এই পদ্য আমি তো লিখিনি।
এই ফুল, এই ঘ্রাণ, এই স্বপ্নময়,
_________________ স্মৃতি নিয়ে এই ছিনিমিনি
_________________ এই পদ্য আমি তো লিখিনি।
আমার পুরোনো খাতা, উড়ছে হাওয়ায়
ছেঁড়া মলাটের নিচে পোকা কাটা মলিন পাতায়
আমের বোলের গন্ধ, ঝরে আছে অমোঘ পলাশ।
কবেকার সে পলাশ, ধলেশ্বরী নদীটিরে ঘাটে,
একা একা ঝরে পড়ে সে কি সেই উনিশশো পঞ্চাশ?
মদন জাগলার মাঠে
আজও এক বিষন্ন শিমুল
গাছ ভরা, পাতা ভরা ভুল।
স্মৃতি নিয়ে এই ছিনিমিনি
কোথাও ভীষণ ভুল হয়ে গেছে,
ঐ ছবি আমার নয়, এই পদ্য আমি তো লিখিনি।

1 টি মন্তব্য: