
ডাক্তারা জানিয়েছেন রোগিণীর গায়ে পর্যাপ্ত রোদ লাগানো দরকার। জোড়াসাঁকোয় তাঁর নিজস্ব 'লালবাড়ির' তিন তলার ছাদে চারদিকে কাচ দিয়ে ঘেরা একটি ঘর তৈরি করলেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু তাতেও কোনও লাভ হল না- নিস্ফল হল সব চেষ্টাই। একে একে মৃত্যুপথযাত্রিণী রেণুকাকে দেখতে এলেন দাদা রথীন্দ্রনাথ, বোন মীরা ও ছোট ভাই শমী।
আলমোরা থেকে ফেরার পথে লখনউ স্টেশনে ছোট বোনের জন্য বাকস ভর্তি খেলনা কিনেছিলেন রেণুকা। জীর্ণশীর্ণ চেহারা নিয়ে ম্লান হেসে বোনকে কাছে ডেকে ঠাণ্ডা হাতখানি বাড়িয়ে তুলে দিলেন সেই বাকস। সেই শীর্ণ চেহারা, ঠাণ্ডা হাত আর ম্লান হাসি সারাজীবন ভুলতে পারেননি মীরা।
তারপর ২৮ ভাদ্র ১৪ সেপ্টেম্বর জীবনের অন্তিম মুহূর্তে মৃত্যুর হাতে নিজেকে সমর্পণকালে যিনি ছিলেন এ-জগতে একমাত্র ভরসা এবং আশ্রয় সেই বাবার হাত ধরে রেণুকা বলেছেন- 'বাবা, পিতা নোহসি বলো।' মায়ের মৃত্যুর পর শান্তিনিকেতনে বাড়িতে বাসকালে বাবার মুখে বারবার শুনেছেন এই মন্ত্র- মন্ত্রের ব্যাখ্যা। তাই আজ তাঁর জীবনের শেষ লগ্নে রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠে কন্যার অনুরোধে উচ্চারিত হল সেই চিরন্তন প্রার্থনা মন্ত্র-
''ওঁ পিতা নোহসি, পিতা নো বোধি, সমস্তেহস্ত্ত
মা মা হিংসীঃ। বিশ্বানি দেব সবিতার্দুরিতানি পরাসুব,
যদ্ভদ্রং তন্ন আসুব। সমঃ শম্ভবায় চ মায়োভবায় চ, নমঃ শঙ্করায়
চ ময়স্করায় চ, নমঃ শিবায় চ শিবনায় চ-
অনুবাদ : তুমি আমাদের পিতা, পিতার ন্যায় আমাদের জ্ঞান শিক্ষা দাও। তোমাকে নমস্কার। আমাকে মোহজাল থেকে রক্ষা করো, আমাকে পরিত্যাগ করো না। আমাকে বিনাশ করো না। হে দেব! হি পিতা! পাপ-সকল মার্জনা করো। যা কল্যাণ তা আমাদের মধ্যে প্রেরণ করো। তুমি যে সুখকর, কল্যাণকর, সুখ-কল্যাণের আকর, কল্যাণ ও কল্যাণতর, তোমাকে নমস্কার।।
এই মহামন্ত্র ধ্বনিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অসংশয়ে দুয়ারটুকু পার হয়ে অন্তহীন-অজানার পথে পাড়ি দিয়েছেন ত্রয়োদশী তরুণী অভিমানিনী রেণুকা।
(*রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ : পূর্নানন্দ চট্টোপাধ্যায়)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন