
বাবা ফুল ভালবাসতেন। তাই বেল ফুল থেকে নাম হল বেলা। আরেকটি নাম- মাধুরীলতা। এটাও ফুলের নাম। একই মেয়ের দুটি ফুলের নাম। এই মেয়েটি রবীন্দ্রনাথের বড়ো মেয়ে। বাবার কাছে শুধুই- বেলি, বেলিবুড়ি বেলুরাণু।
১৯১৭ সালের জুন মাসে অসুস্থ হয়েছেন মাধুরীলতা। প্রথমে ঘুসঘুসে জ্বর- পরে ধরা পড়েছে ক্ষয় বা যক্ষা রোগ। সে কালের এই দুরারোগ্য ব্যাধিতে আকালে পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে বিদায় নিয়েছেন রেণুকা- বেলার ছোটবোন। তাই রবীন্দ্রনাথ আর পারেননি নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে। অভিমানিনী কন্যার রোগশয্যার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন তিনি। তাঁর জীবনে আবার এসেছে দুঃখের আঁধার রাত্রি। কাদম্বিনীদেবীকে লিখেছেন, আমি দিনের বেলাটা আমার মেয়ের বাড়িতেই থাকি। সন্ধ্যা ছ-টার পরে আমার সময়।
পীড়িতা কন্যার জন্যে উদ্বেগ থেকে তো রেহাই নেই- বক্তৃতা, কংগ্রেসের দরীয় বিবাদ মেটানোর সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ইত্যাদি সত্ত্বেও নিত্য গিয়ে বসেন মেয়ের বিছানার পাশে। ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯১৭ হিসাবের ক্যাশবহিতে লেখা হয়েছে '' পূজনীয় কর্ত্তাবাবু মহাশয় বেলাদিদিকে দিবার জন্য লন ৫০০ টাকা।'' তা ছাড়া মাঝে মাঝেই আছে বেলা দিদির 'ওষুধ খরিদ', ' ফুল খরিদ', 'গোলাপ-আতর' কিংবা ' নার্স বাবদ' খরচের হিসাবও।
সীতা দেবী লিখেছেন, বেলা দেবীর অসুখ তখন অত্যন্ত বাড়িয়োছে, রবীন্দ্রনাথকে সর্ব্বদাই বড় ক্লিষ্ট দেখাইত, কিন্তু তাঁহার নির্দিষ্ট কাজ যাহা ছিল তাহা কখনও একচুল এদিক-ওদিক হইত না। (২১ ফেব্রয়ারি ১৯১৮)
বেলাদেবীর অবস্থা সংকটাপন্ন, টেলিগ্রাম আসিয়াছে। মীরাদেবীর মুখে টেলিগ্রামের খবর শুনিয়া কবি শুধু বাললেন, ' এতো অনেকদিন থেকেই জানি, তবু মনকে বোঝাতে চেষ্টা করছিলুম'।
মেযের কাছাকাছি থেকেই নিমগ্ন থেকেছেন 'পলাতকা'- কাব্যের গল্প-কবিতা রচনায়। প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, পলাতকা কাব্যের- গল্পের মধ্যে কবির অবচেতন মনের রুদ্ধ বাণী হঠাৎ-হঠাৎ প্রকাশ পাইয়াছে। তাঁহার জ্যেষ্ঠা কন্যা বেলা মৃত্যুশয্যায়- তাঁহার নিঃসন্তার জীবনের ব্যর্থতা ও পরিণাম কবির মনে বহু রেখা টানিযাছিল- সে আজ পলাতকার পথে; রোগিনীর রুদ্ধমনের কথা তাই কোনো কোনো কবিতায় আপনি উছলিয়া উঠিয়াছে।
এ সময কবি লিখেছেন-
১. কান্না-হাসির দোল দোলানোর পৌষ-ফাগুনের পালা, ২. আমার পাত্রখানা যায় যদি যাক ভেঙেচুরে, ৩. অশ্রুনদীর সুদূর পারে ঘাট দেখা যায় তোমার দ্বারে, ৪. আয় আয় রে পাগল, ভুলবি রে চল আপনাকে, ৫. আজি বিজনে ঘরে নীশিথ রাতে আসবে যদি শূন্য হাতে, ৬. সবার সাথে চলতে ছিল অজানা এই অন্ধকারে, ৭. আমার সকল দুখের প্রদীপ জ্বেলে দিবস গেলে করব নিবেদন, ৮. কেন রে এই দুয়ারটুকু পার হতে সংশয়- জয় অজানার জয়...।
শান্তি নিকেতন থেকেই পুত্র রথীন্দ্রনাথকে লিখেছেন, 'কাল থেকেই কলকাতায় যাবার জন্য মনটা দ্বিধা করছে। কিন্তু আজকাল আমার হৃদয় ভারি দুর্বল আছে। জানি বেলার যাবার সময় হয়েচে। আমি গিয়ে তার মুখের দিকে তাকাতে পারি এমন শক্তি আমার নেই। এখানে আমি জীবন-মৃত্যুর উপরে মনকে রাখতে পারি কিন্তু কলকাতায় সে আশ্রয় নেই। আমি এইখানে থেকে বেলার জন্যে যাত্রাকালের কল্যাণ কামনা করছি। জানি আমার আর কিছু করবার নেই।
তাঁর জন্মদিনে গেয়েছেন 'তবু মনে রেখো যদি দুরে যাই চলে'। গান শুয়ে অনেকেরই চোখে জল এসেছে।
সতিা দেবী লিখেছেন, (১৬ মে ১৯১৮) রাত্রে খবর পাইলাম, সকালে বেলাদেবী মারা গিয়াছেন। বাবা (রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়) জোড়াসাঁকো গিয়াছিলেন, সেখানে এই অশুভ সংবাদ শুনিয়া আসিলেন। মন দারুন পীড়িত ও ক্লিষ্ট হইয়া উঠিল। জোড়াসাঁকোয় গিয়া বাড়ির সম্মুখে গাড়ি দাঁড়াইতেই দেখিলাম, রবীন্দ্রনাথ দোতলায় বসিয়া আছেন। কাছেই শ্রীযুক্ত প্রমথ চৌধুরী ও রথীন্দ্রনাথ বসিয়া। প্রণাম করাতে, অন্যদিকে চাহিয়া শুধু বলিলেন, 'বোসো।' মুখের চেহারা অতি বিবর্ণ ও ক্লিষ্ট যেন অনেকদিন রোগভোগ করিয়া উঠিয়াছেন।... রবীন্দ্রনাথ কন্যাকে দেখিতে গিয়া এই নিদারুণ সংবাদ পান। বাড়ি আসিয়া দুপুর ২টা পর্যন্ত তেতলার ছাদে বনিয়াছিলেন, কেহ তাঁহাকে ডাকিবার সাহস করে নাই। বেলাদেবী ফুল অত্যন্ত ভালবাসিতেন, মৃত্যুর পরে পুষ্পসজ্জায় সজ্জিত করিয়াই তাঁহার দেহ মোটরকারে করিয়া শ্মশানে লইয়া যাওয় হয়। প্রতিমা দেবী বলিলেন, তখন যেন তাঁহাকে আরো সুন্দর দেখাইতেছিল।
অনেকদিন থেকেই জানি ও চলে যাবে। তবু রোজ সকালে গিয়ে ওর হাতখান ধরে বস থাকতুম। ছেলবেলার মতো বলতো, বাবা গল্প বলো। যা মনে আসে কিছু বলে যেতুম। এবার তাও শেষ হল। এই বলে চুপ করে বসে রইলেন রবীন্দ্রনাথ। শান্ত সমাহত।
...............................................................................................
বাবাকে লিখেছেন বেলা। যোড়াসাঁকো, কলিখাতা, থেকে। তারিখ : শনিবার, ৯ ই চৈত্র ১৩০২
বাবা,
তোমার চিঠি অনেকদিন পাইয়াও উত্তর দি নাই। তুমি কবে আসিবে? আমরাকি গরমীর ছুটিতে কোথাও যাইব? আজ বলুদাদা শিলাইদহে যাইবেন। রথী রোজ গান ও এস্রাজ শেখে। ওর রাত্রে রোজ মাস্টার আসে। Miss Mitter বলেন যে রথী পিয়ানো বেশ শিখিতেছে। তোমার চিঠি পেয়েছি। তুমি কেমন আছো? আমরা ভালো। যেদিন তোমার চিঠি পেলুম মীরা তাহা নিয়ে কাড়াকাড়ি করিতে লাগিল। আমরা রোজ রাত্রে পুলে যাই। আজ আমাদের Examination । তুমি রথীকে চিঠি লেখনি বলে ও তোমার উপর রাগ করিয়াছে। মাসি শনিবার এসেছিলেন।
ইতি বেলা।
...............................................
রেণুকাকে নিয়ে রেখা পড়ুন-
রেণুকা- রবীন্দ্রনাথের দ্বিতীয় মেয়ের অন্তহীন-অজানার পথে পাড়ি দেওয়া
http://www.facebook.com/home.php?#/note.php?note_id=254024630337&ref=mf
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন