শনিবার, ২২ আগস্ট, ২০০৯

আলো ও হাওয়ার গল্প- পরী অথবা জলের ডানা

লিখেছেন: কুলদা রায়

মেয়েটোর নাম পরী। এই পরী মেয়েটিকেই একদিন পরীতে পেলো। আমাদের উঠোনে তখন ঘাস উঠেছে। এই ঘাসগুলো তুলে ফেলতে ফেলতে দেখলাম- পরীর পিঠে দুটো ডানা উঠেছে। কী অসাধারণ ডানা দুটো। রেশমী। রোদে চিকমিকিয়ে ওঠে। ঘাস তুলবো কি- চেয়ে চেয়ে দেখি- সেই ডানা মেলে মাটি থেকে অনেকটা উপরে উঠে গেছে পরী। চুলগুলো হাওয়ায় উড়ছে। আর হাসি হাসি মুখ।

পরী উড়ে গেল পেয়ারা গাছের ডালে। সবে রং ধরেছে পেয়ারায়। কামড়ে কামড়ে খেলো। কচ কচ শব্দ কানে এলো। একটি শিউলি তলায় ফুল ঝরে থাকত। আর পাতায় শিশির। পরী সেই শিশির বিন্দুগুলো তার দুহাত ভরে কুড়িয়ে নিল। সেই প্রথম একটি মালা গাঁথল শিশির দিয়ে। মুক্তোর চেয়েও লাবণ্যময় সেই মালাটি। গলায় পরে সেদিনই পরী একটি নতুন গান গাইল। কী গাইল, বুঝতে পারিনি। কী আশ্চর্য গানের কথাগুলো। যেন অনেক দূর থেকে ভেসে আসা। অনেক দূরে ভেসে চলে যাওয়া। আমরা শোনার আগেই ভুলে গেলাম। কেবল তার যাওয়া আসার সুরটি কানের মধ্যে বাজতে লাগল। এই সুর জীবনে এর আগে কখনো শুনিনি।

যে নদীতে আমরা প্রতিদিন নাইতে নামি সে নদীতে একদিন অমল জলে নামা ভুলে গেল। অবাক হয়ে চেয়ে রইল হিজল গাছটির দিকে। হিজলের পাতাগুলি ঘন সবুজ। জলে নুয়ে পড়েছে ডাল-পালা। আর লাল লাল ফুল। এই হিজলের ডাল থেকে ঝাপ দিয়ে পড়লাম নদীতে। অমল নামল না। চেচিয়ে ডাকলাম, অমল- নেমে পড়। জলে নেমে পড়।

অমল সেই প্রথম বধির হয়ে গেল। সে চেয়ে রইল হিজলের ছায়াটির দিকে। খণ্ড খণ্ড হয়ে ছায়া ভাসছে জলে। দূরে যেতে যেতে আবার ফিরে ফিরে আসছে। শান্ত বাতাস। আর তক্ষুণী পরীকে দেখতে পেলাম। একটি ফড়িংয়ের মতো পরী উড়ে এসে জলের উপরে অই হিজলের ছায়ার উপরে বসেছে। তার কলসটি জলের ধীর স্রোতে ভেসে যাচ্ছে। বসনপ্রান্ত সামান্য ভেজা। পরীর মুখে সেই ডানাওয়ালা পরীটির হাসি। অমল এইবার ঝাপিয়ে পড়ল জলে। কলসের সাথে সাথে সেও ভেসে চলে গেল বহুদূর।
আমরা দেখলাম, পরীর পা দুখানি লাল। আলতা মাখা।

সেই প্রথম জেনেছি, আলতার মধ্যে কোনো কোনো ফুল গোপনে ফোটে। ফুলটির পাপড়িতে জ্যোৎস্না মাখা। ফুলটির নাম আমাদের জানা নেই। কোনোদিন কি জেনেছি? জানতে পেরেছে কি- অমল? প্রদ্যুম্ন? অথবা আমি?

২.
…আমাদের চারিদিকে যখন সৌন্দর্য বিকশিত হইয়া ওঠে তখন আমরা যেন একজন-কাহার সহিত মিলনের জন্য উৎসুক হই- সংসারে আর যাহারই প্রতি মন দিই, মনের পিপাসা যেন দূর হয় না। এইজন্য সংসারে থাকিয়া আমরা যেন চিরবিরহে কাল কাটাই। কানে একটি বাশিঁর শব্দ আসিতেছে, মন উদাস হইয়া যাইতেছে, অথচ এ সংসারের অন্তঃপুর ছাড়িয়া বাহির হইতে পারি না। কে বাঁশি বাজাইয়া আমাদের মন হরণ করিল, তাহাকে দেখিতে পাই না, সংসারের ঘরে ঘরে তাহাকে খুঁজিয়া বেড়াই। অন্য যাহারই সহিত মিলন হউক না কেন, সেই মিলনের মধ্যে একটি চিরস্থায়ী বিরহের ভাব প্রচ্ছন্ন থাকে।
(বাঁশির স্বর : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন