শনিবার, ২২ আগস্ট, ২০০৯

আলো ও হাওয়ার গল্প- দুই : টম সাহেবের বাড়ি

লিখেছেন: কুলদা রায়


বাড়িটা ছিল টম সাহেবের। লাল ইটের। দোতলা। নীচতলায় ডাকঘর। দোতলায় একটি বড়ো সড়ো ঝুল বারান্দা। সেখানে যে ফুললতা ছিল, তার নাম- ব্লিডিং হার্ট।

একটু দূরেই মধুমতি। এই নদীর পাড়ে স্টিমার থেকে একদিন টম সাহেব নেমেছিল। এর পর কেউ আর কোন দিন স্টিমারের ‘ভো’ শোনেনি। সেদিন থেকে নদীটাও বুড়ো হয়ে গেল।

এই বাড়িটার ছাদে মাঝে মাঝে চাঁদ ঝুলে থাকত। সেদিন অন্য কোথাও জ্যোৎস্না উঠত না। কেবল এই বাড়িটা ঘিরে থাকতো আলো। আর শীতল হাওয়া।

যেদিন এই ঘটনা ঘটত, সেদিন আগে ভাগে ডাক-হরকরারা কাজে বেরিয়ে যেত। আবার আগে ভাগে কাজ শেষ করে চলে যেত। দুপুরের পর থেকে ছোট্ট শহরটা থমথমে হয়ে পড়ত। এইদিনে আমাদের ঠাকুমা সন্ধ্যার আগেই ঘুম পাড়িয়ে দিত।

আমাদের প্রদ্যুম্ন একদিন নাই হয়ে গেল। তারপর বেশ কবার নতুন করে ফুল ফুটল আমাদের কৃষ্ণচূড়ার ডালে। কয়েকটা শিউলিগাছ ঢলো ঢলো হয়ে উঠল। কয়েকটা পাখি পালক বদলালো। আমরা যখন প্রদ্যুম্নকে ভুলে যাব ভুলে যাব করছি- সেই সময়ই সে ফিরে এলো। বন থেকে ফেরা অন্য এক প্রদ্যুম্ন। গায়ে সবুজ গন্ধ। এই নতুন প্রদ্যুম্নকে কোনো কোনো দিদি-বৌদি চুরি করে নাড়ু মুড়ি খাওয়াত। একদিন লীলা মাসি ওর মাথায় চুড়ো বেঁধে দিল। ময়ুরের পালক গুজে দিল কে জানি। এক বোষ্টুমী খঞ্জনী বাজিয়ে গান ধরল-

কালা- তোর তরে
কদমতলে চেয়ে থাকি।

সেদিন নদী থেকে একটি নতুন হাওয়া উঠল। এক রকম হাওয়া এর আগে কখনো দেখিনি। সূর্য ডোবার সাথে সাথে সারা শহরটি ঘুমিয়ে পড়ল। যে শিয়ালগুলি প্রহর ঘোষণা করত- সেদিন তারাও কেন জানি চুপ করে গেল। গাছের পাতারাও শব্দহীন।

টম সাহেবের বাড়িটা পাশে একটি তাল পুকুর। কোনদিন তার জল শুকায়নি। তার পাড়ে একটি বিবাহিত অশ্বত্থ গাছ। ঝুরি নেমে এসেছে মাটিতে। আকড়ে ধরে আছে নম্র একটি বট গাছকে।

সে রাত ছিল ঘন অন্ধকার। হঠাৎ করে বাঁশি বেজে উঠল। কী যাদুময় সে সুর। অন্ধকারের ভিতর থেকে অন্যরকম আলো বের হতে লাগল। । ঘন পাতার ফাঁক দিয়ে একটি চাঁদ বাড়িটার কার্নিশে ঝুলে পড়ল। দোতলার একটি জানালা খুলে গেল। সেখানে দেখা গেল একটি মুখ। ফ্যাকাসে… থরথরো। মুখটি ফিস ফিস করে ডাকল, বাবা। বাবা। চিঠিটা কি এসেছে?

কার চিঠি? কোন চিঠি? আমি অমলের দিকে তাকালাম। অমল আমার দিকে। প্রদ্যুম্ন বাঁশিতে বিভোর। এ প্রদ্যুম্নকে আমরা কখনো দেখিনি। কখনো চিনিনি। জানিনি। কোনো এক রূপের জগতে তার বাড়ি। সে রূপের জগতের সুর বাজিয়ে চলেছে। এই বাঁশির সুরে টম সাহেবের বাড়ির উপরে ধীরে ধীরে একখণ্ড মেঘ জমল। ঝির ঝির করে বৃষ্টিও ঝরল। শান্ত হাওয়া বইল। কাঠালী চাঁপার গন্ধে ভরে গেল চারিদিক।

এই সময় টম সাহবের ঝুল বারান্দার দরোজাটা খুলে গেল। একটি মেয়ে ঘোর লাগা চোখে বারান্দা থেকে হেঁটে হেঁটে নীচে নেমে এলো। হাওয়ার মধ্যে দিয়ে পা ফেলে ফেলে মেয়েটি তাল পুকুরটির পাড়ে এলো। ঘাঘরাটা সামান্য একট উঁচু করে ধরল। তারপর পুকুরের জলের উপর তারা কোমল শাদা পা রাখল। অমল আমার হাত খামচে ধরল। চেচিয়ে বলল, চোখ বন্ধ কর। চোখ বন্ধ কর।

চোখ বন্ধ করব কি? আমাদের চোখ কি তখন আমাদের চোখের মধ্যে ছিল? চোখগুলো সব বাইরে বেরিয়ে পড়েছে নিজের ইচ্ছেয়। মেয়েটির পিছে পিছে ঘুরছে। ফিরছে। তার গা থেকে ঝরে পড়া আলো প্রাণের মধ্যে টুক টুক করে কুড়োচ্ছে। এই চোখহীন অন্ধ চোখ-কুঠুরী থেকেই আমরা দেখতে পেলাম, তাল পুকুরের মাঝখান অবধি ছোট ছোট পায়ের ছাপ চলে গেছে। জলের মাঝখানে ফুটে আছে একটি অনন্ত ফুল। শত শত তারা সে ফুলটিকে পাহারা দিচ্ছে। তার পাপড়ি সত্যি সত্যি অনেকগুলো নীল চিঠি।

এই চিঠিগুলো কে লিখেছে? অমল? প্রদ্যুম্ন? না- আমি? কখনো কি লিখতে পেরেছি এ রকম কোনো চিঠি!!

২.
..একটি হৃদয়ের জন্য আর একটি হৃদয় গঠিত হইয়া আছেই। তাহারা পরস্পরের জন্য। শত ক্রোশ ব্যবধানে, এমন কি জগৎ হইতে জগদন্তরের ব্যবধানেও তাহাদের মধ্যে একটি আকর্ষণ থাকে। তাহাদের মধ্যে দেখাশুনা হউক বা না-হউক, জানাশুনা থাকুক বা না-থাকুক, তাহাদের উভয়ের মধ্যে যেমন সম্বন্ধ, তেমন কোনো দুই পরিচিত ব্যক্তির, কোনো দুই বন্ধুর মধ্যে নাই…
(যথার্থ দোসর : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন