রবিবার, ২৩ আগস্ট, ২০০৯
কবি শোয়েব শাদাবের কবিতা এবং তাঁকে নিয়ে মাহবুব লীলেনের একটি লেখা
স্বগতোক্তি
........
নষ্ট দ্রাঘিমায় এসে গেছি হে দেবদূত!
অস্থিতে মজ্জায় হিম জমে গেছে অজস্র কর্দম
কী করতে কী করে ফেলি বুঝি না পূর্বাপর
কেচো খুড়ে অজগর!
বুকের ভেতর যেন অহরহ টমটমের শব্দ
শুনতে পাই।
প্রাগৈতিহাসিক অন্ধকূপে পড়ে থাকি
বিকল জন্তুর মতো পঙ্গুতায়-আর
স্তব্ধ পরাধীনতায়।
ছায়াকে কায়াকে যুগপৎ করে তুলি শত্রু
পারি না এড়াতে অলৌকিক রাক্ষস সন্দেহ
রক্তের গভীরে যেন ঘাই মারে বিষধর শিং।
ঊরুর আগুনে চেপে যৌবন বল্লম
কেপে উঠি মধ্যরাতে-
স্বপ্নের ডানার মতো নেমে আসে সংখ্যাহীন সিল্কের বালিশ
হাতের কলম দড়ি ছিড়ে
সাপ হয়ে যায়
সাপ, ময়ূর।
অতঃপর,
ফুলের কঙ্কাল থেকে নিঃসৃত সৌনভ
তরল মৃত্যুকে পান করে
বিষাদে বিনাশে হই পূর্ণাঙ্গ পুরুষ।
আবহমান
.......
গড়িয়ে গড়িয়ে যাই
বুকে-পিঠে হাটা যেমন একজন পা-কাটা মানুষ
নিমখুন
যেতে যেতে ঘুরে দেখি কতোখানি যাওয়া হলো সঠিক বেঠিক
বুকে-পিঠে হাটা যেমন একজন পা-কাটা মানুষ
নিমখুন
অর্ধেক বয়স গেলো পৃথিবীর - সে তবু হলো না
শান্ত
আনত সুস্থির
বালকের মতো চপলতা তার
কোথায় অশ্বথ সেই ছায়াবান বুদ্ধের সমান
অমল দরজা - ভরা জলকুম্ভ
ঘরে ঘরে তালা খিল ভিক্ষার সংকট
পাজরে পাজরে বাজে পয়সার ঝনঝন
কোথায় সে তারাপথ তারকা-খচিত
অসীম আগুন চিতা সূর্য ও চাদ
শ্মশান আগুনে পোড়া ছাই অন্ধকার
আয়ুতে স্নায়ুতে চলে ভৌতিক শৃঙ্গার
তপস্যার তপোবনে কে সাজে সন্ন্যাসী - সুন্দরের সঙ
ফুটিয়ে রংধনু আল-
খাল্লায়
কে আর জানায় মাটিকে প্রণাম
তুষার বরফ শীত প্রাকৃতিক ওলট-পালট
-আমি
বিধাতার দৃষ্টিকোপ মৃত্যু ব্যাধি মন্বন্তর
-আমি
তবু আমি আমিময় জীবনে যৌবনে
সৃজনে সজ্ঞায়
অর্ধেক বয়স গেলো পৃথিবীর - সে আর হলো না
শান্ত
আনত সুস্থির।
অশেষ প্রস্তর যুগ
(দ্বিতীয় পর্ব)
..........
১
দাঁড়ালাম
স্তম্ভের ওপরে
রক্তের বিপরীতে
যেভাবে দাঁড়ায়
রক্তের প্রতিভূ।
কে দিলো শরীরে আমার
এমন গোধূলি।
জলের রূপালি
আলোক বৃত্তের রেখা
হিম হয়ে পড়ে রবে
নাস্তির ছায়ায়
স্বপ্ন তবু জ্বালাবে বিদ্যুৎ
দিগন্ত পাথারে।
২
আমি যদি নিঃস্ব হই
তুমি তবে কী?
দিনের ভেতরে
যেভাবে লুকিয়ে থাকে
রাত্রির জোনাকি।
অথবা মরণ
পেছনের জানালায়
যদি দেয় উকিঁ
রাত্রির আঁধারে
তুমি তবে কী?
সমুদ্র পাখিরা
মেলেছে পালক
সন্ধ্যার বাতাসে
পাথরের ডানা
শূন্যের পাথারে
হে মন সঞ্চারী
প্রেমের কুসুমে
গন্ধের দোলা তুমি
ভোরের শিশিরে।
৩
দুপুর।
দিগন্তের পারে
কৃষ্ণের বাঁশরী
ধবলীর পাল।
যতোদূর চোখ যায়
আকাশ ও নক্ষত্রের
অপার মিতালি।
রৌদ্রের গোধূলী
রক্তের ভেতরে জ্বলে
নিঃশব্দ কান্নায়।
দেবীর সৌন্দর্য
অবলুপ্ত আজ
ঘৃণার গরলে
জমেছে কাঁকর
চন্দ্রের কালিমা।
কি আছে পর্দার আড়ালে
সঞ্চিত তোমার?
শরীর
মন
অনুভূতি
সকলি মৃত।
মৃতের খুলিতে
জলের কল্লোল
অগ্নির বিদ্রোহ।
হে ফুল সঞ্চারী
রাত্রির পাথরে
বরফের চাঁদ তুমি।
তোমার যৌবন
ক্রমশ হারাবে
জলের অতলে।
যেখানে পাহাড়
রামধনু রঙের মিতালি
শূন্যের পাথারে।
৪
অবলুপ্ত সৌন্দর্য থেকে
পুনর্জাগরিত তুমি
আমার সত্ত্বায়
মননে মেধায়।
যে যন্ত্রণা
আমাকে টেনে নিয়েছিলো
সুদূর অরণ্যে
বরফের সাম্রাজ্যে
তার থেকে ফিরে এসে
তোমার পায়ে রেখেছি প্রণতি।
অবশেষে জেনেছি তুমি সত্য
আমি সুন্দরম!
ক্ষয়িষ্ণু অগ্রজের জন্য বিষণ্ন অক্ষর: সাক্ষাৎকার
......................
মাহবুব লীলেন
(তারিখ: বুধ, ২০০৮-১০-০১ ১৫:৫২)
কবি শোয়েব শাদাব
.............
তখনও তার একটা অক্ষরও পড়িনি। দেখিওনি তাকে। তখনই তাকে আমি স্বপ্নে দেখলাম। জটাজুট চেহারার সন্ন্যাসী বটগাছের গোড়ায় পায়ে শেকল দিয়ে বাঁধা। আমাকে দেখেই এক টানে গাছ থেকে শেকল ছিঁড়ে আমার গলায় ফাঁস লাগিয়ে উল্টোমুখে হাঁটতে থাকে। শেকলের এক মাথা তার পায়ে তালা দেয়া। এক মাথায় প্যাঁচানো আমার গলা। আমাকে হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে ধানক্ষেত- বিল- হাওর- পাহাড় পার হয়ে সে হাঁটে আর বিড়বিড় করে- আয় তোরে কবিতা শেখাই
কবি শোয়েব শাদাব। আমাদের কাছে ক্ষয়ের মূর্তিমান আতঙ্ক কবি কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ার মুখস্থ করিয়ে ফেলেছিল শোয়েব শাদাবের কাহিনী। কবিতার আলাপে কিশওয়ার ক্ষেপে উঠলেই চলে আসতো শোয়েব শাদাবের নাম- আশির উজ্জ্বলতম কবি কিন্তু বহুদিন থেকে শেকলবন্দী
কবিদের জেলখাটার কাহিনী শুনে অভ্যস্ত আমাদের কানে পায়ে শেকল বাঁধা কবি আলাদা এক মাত্রা তৈরি করে। কেন তাকে বেঁধে রাখা হয়। সে কী করে?
এসব উত্তর কিশওয়ারের কাছে নেই। নব্বই সালেই কিশওয়ারের মুখে শুনেছি বহুদিন তার কোনো খবর জানে না কেউ। আর কিশওয়ারের নিজের খবরইতো তখন অন্যকে নিতে হয়
আর কেউই জানে না শোয়েবের খবর। তাকে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয় এই খবরটাই ঘুরে ফিরে সবাই সবাইকে দেয়। শোয়েবের লেখার হদিসও জানে না কেউ। তার বই বেরিয়েছে জানে কিন্তু কোথায় সে বই তার কোনো ঠিকানা জানে না কেউ
একদিন শাদাবকে দেখতে যাব আমরা। জানামতে শাদাবের ঠিকানা জানেন গাণ্ডীব সম্পাদক তপন বড়–য়া। কিন্তু অন্য অসংখ্য পরিকল্পনার সাথে এই দেখতে যাওয়াও পড়ে থাকে অন্য অনেক কিছুর মতো অনেক বছর। সবার সময় মিলে না এক বিন্দুতে। তাই হঠাৎ করেই দু হাজার আটের ১৫ জুলাই একা একাই ত্রিশাল নেমে বাকি পথের ঠিকানার জন্য ফোনে ধরি গাণ্ডীব সম্পাদক তপন বড়–য়াকে
ত্রিশাল থেকে রামপুরা। রামপুরা গিয়ে জানতে হয় শামসু ফকির চেয়ারম্যানের বাড়ি কোনদিকে আর বাড়িতে গিয়ে বলতে হয় কিবরিয়া কোন ঘরে?
কিবরিয়া শোয়েব শাদাবের পারিবারিক নাম
পরিচ্ছন্ন শেভ করা। চমৎকার স্বাস্থ্যের গোঁফ ওয়ালা শ্যামলা এক দীর্ঘদেহী বিছানার উপর স্যান্ডেল তুলে দেয়ালে হেলান দিয়ে আধশোয়া। বাম পায়ে শেকল আর পেছনের জানালায় ছোট ছোট লোহার জালি...
কবি শোয়েব শাদাব
- আমার নাম লীলেন। আপনাকে দেখতে এসছি আমি
ঝনঝন করে উঠে শেকল। হেলান আরেকটু উঁচু করে বিছানায় আমাকে জায়গা ছেড়ে দেন- বসেন
আমি দাঁড়িয়ে থাকি- আপনার কথা অনেক শুনেছি। লেখাও পড়েছি কয়েকটা
- ভালো
একেবারে স্থির চোখ। স্থির চেহারা
সিজোফ্রেনিকদের একেকজনের আচরণ একেক রকম হয়। কিশওয়ারের ক্ষেপে ওঠা এবং ভেঙে পড়া দুটোই দেখেছি খুব কাছে থেকে। শোয়েব সম্পর্কে শুনেছি তার স্মৃতি নেই
কেউ একজন আমার পেছনে একটা চেয়ার এনে রাখে। শোয়েব স্থির। কী বললে ক্ষেপে যাবে আর কী বললে স্থির থাকবে জানি না। আমি অনেক পজ নিয়ে কথা বলি- তপন দার কাছ থেকে আপনার ঠিকানা নিলাম
- আচ্ছা
- গাণ্ডীব সম্পাদক তপন বড়–য়া
- আচ্ছা
- ফোনে কথা বলবেন তার সাথে?
- আচ্ছা বলি
তপন দার সাথে শোয়েব কথা বললেন স্বাভাবিক। তপন দা কথা বলতে চাইলেন শোয়েবের বাবার সাথে। তাকে খুঁজে ফোনটা দিয়ে ফিরে এসে বসলাম চেয়ারে- আমি টুকটাক লিখি
- কী লিখেন?
- কবিতা আর গল্প... আপনার চিকিৎসার কী অবস্থা
- চলছে
তারপর আবার নীরব। শোয়েবও। আমিও
- উনি কিসের জন্য আসছে বুঝছস?
দরজায় দাঁড়িয়ে পেছন থেকে কথা বলে উঠলেন শোয়েবের মা
- আমাকে দেখতে
শোয়েবের নির্লিপ্ত উত্তর
- তোকে দেখতে আসছে কেন?
- আমি লিখতাম এইজন্য
কোথাও শুনেছিলাম বাড়ির লোকজন তাকে বেঁধে রাখে সম্পত্তির কারণে। মোগল হেরেমে মা ছেলেকে বিষ খাওয়ানোর ইতিহাস আছে। বাবা গুপ্ত হত্যা করেছে ছেলেকে। কিন্তু বাঙালি না রাজার বংশ না মোগলের। এই চেহারা ব্রান্ডেড বাঙালি জননীর। বাঙালি সব মায়ের আহাজারি একই রকম হয়। শোয়েবের মা ফিরলেন আমার দিকে - আমার বড়ো ছেলেটারে বাবা...
পাশে দাঁড়িয়ে আছেন বাবা। চুয়াল্লিশ বছরের উন্মাদ পুত্র কিশওয়ারের বাবা দিলওয়ারের চেহারা আমি দেখেছি দীর্ঘদিন। সেই চেহারা এখন ৪৫ বছরের শোয়েব শাদাবের বাবার মুখে। বোকা বোকা মুখে শূন্য দৃষ্টি...
- এখন মূলত কী সমস্যা হয় তার?
- ডাক্তার বলেছে আর এক বছর পরে তাকে ছেড়ে দেয়া যাবে
চোখ দুটো জ্বলে উঠে মায়ের। বোকা একটা হাসি বের হয়ে আসে বাবার মুখ থেকে- যদি হয়...
আমি জানি এই বাবা কী ভাবছেন। এই ভাবনা কিশওয়ারের বাবা প্রকাশ্যে বলেছিলেন তার চুয়াল্লিশ বছরের ছেলেকে। সেই ভয়াবহ কথাটি দিলওয়ার বলতে পেরেছিলেন কারণ দিলওয়ার কবি। মুখোমুখি বসিয়ে ছেলেকে বলেছিলেন- আমার আগে তুমি মারা যাও পুত্র। এই বৃদ্ধ পিতা যেন নিজের কাঁপা কাঁপা হাতে তোমাকে শুইয়ে যেতে পারে কবরে
কিশওয়ার মরার খবর শুনে যখন দিলওয়ারকে ফোন করি। কোনো আহাজারি না। কোনো শোক না। ভারমুক্ত দিলওয়ারের উৎফুল্ল কণ্ঠ ভেসে এলো আমি কিছু বলার আগেই- আমার পুত্র আমার কথা রেখেছে লীলেন। তাকে একা ফেলে রেখে যাবার অভিশাপ থেকে আমাকে মুক্ত করে দিয়ে গেছে আমার পুত্র। এখন মৃত্যুকে আমি সানন্দে বলতে পারি- এসো সুন্দরী অবগাহন করি তোমার ভেতর...
দিলওয়ার যা বলেছিলেন ঠিক তাই ভাবছেন এই সাবেক চেয়ারম্যান। কিন্তু তার চেয়ারম্যানিতে তিনি আয়ত্ব করতে পারেননি নিজের ছেলেকে এত বড়ো কথা বলার কৌশল। তাই তিনি শুধু বলেন- যদি হয়...
- বিড়ি খান?
- খাই
ইচ্ছা করেই পুরো প্যাকেটটা তার দিকে বাড়িয়ে দিলাম। একটা বিড়ি বের করে আমার দিকে ফিরিয়ে দিলেন- আপনি খাবেন না?
আমি আস্তে আস্তে নিজের জন্য বের করি তার দিকে চোখ রেখে। লাইটার বের করে দেই
- কার কার সাথে আপনার যোগাযোগ আছে এখন?
- এখন কারো সাথে নেই
- আপনার এখানে আর কেউ এসছিল?
- তপন আর শান্তনু এসছিল একবার
- শান্তনু তো এখন কলকাতায়
- শান্তনু কলকাতায় কী করে?
আমার নিজের ভুলটা ধরা পড়ে। আর শোয়েবের ব্যাপারে আমি নিশ্চিত হয়ে যাই শোয়েব শাদাব হয় পুরোপুরি না হয় প্রায় সুস্থ
আমি বিষ্ণু বিশ্বাসের সাথে শান্তনুকে গুলিয়ে ফেলেছিলাম। কলকাতায় বিষ্ণু বিশ্বাস। একই পথের যাত্রী। শুনেছি বিষ্ণু শুধু ট্রেন থেকে ট্রেনে ঘোরে- শান্তনু না। কলকাতায় বিষ্ণু
কথাটা শুনে আবার দীর্ঘক্ষণ চুপ হয়ে থাকেন শোয়েব শাদাব
- কিশওয়ারের কথা মনে আছে আপনার?
- কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ার?
- হ্যাঁ
- আছে
- কিশওয়ার মারা গেছে জানেন?
- না
- বছর দেড়েক হলো মারা গেছে কিশওয়ার
- সেকি গডে মরল?
- মানে?
- কিশওয়ার কি গডতত্ত্বে মারা গেলো নাকি নির্গড? ও তো একবার নাস্তিক একবার আস্তিক থাকতো
পুরোটাই খেয়াল আছে তার। বললাম- না গড না নির্গড। ঝুলন্ত
- বুজছি। নিজেই গড হয়ে মারা গেছে তাইলে
বাম পায়ে তালা মারা শেকল খাটের পায়ার সঙ্গে বাঁধা। ঘরের ফ্লোরেই একটা কমোড বসানো খাটের কাছে। আমি শেকলের দিকে তাকাই না। ক্ষেপে যেতে পারে। বিছানায় একটা ডায়রি
- ইদানীং কিছু লিখছেন?
- নাহ
- মোটেই লেখেন না?
- মাঝেমাঝে লিখি
ডায়রিটার দিকে আমার চোখ যায়- দুয়েকটা পড়তে পারব?
- এখানে নাই তো
- কোথায় সেগুলো?
- এখানে নাই
- এই ডায়রিতে কিছু লেখেন না?
- না
আবার অনেকক্ষণ চুপ। ঠায় আমার মুখের উপর চোখ গেঁথে বসে আছেন শাদাব
- ডাক্তার কী বলেছে
- বলেছে ওষুধ খেতে
এবার তাকে জানিয়েই তার শেকলের দিকে তাকাই
- শেকল কেন?
- শেকল হলো চেইন
- কেন এটা?
- চেইন থাকতে হয়
- না থাকলে কী হয়
- থাকতে হয়। এটা হলো চেইন
- আপনার কয়টা ছবি তুলি? আমাদের অনেকেই আপনাকে দেখেনি
আমি ইচ্ছা করেই সময় নিয়ে মোবাইলে ছবি তুলি। স্বাভাবিক না অস্বাভাবিক কিছুই বুঝতে পারছি না। এখন পর্যন্ত তার চেহারায় কোনো কিছুর কোনো রিয়েকশন নেই। কোনো হাসি নেই। ইচ্ছা করেই চেনওয়ালা পায়ের ছবি তুলি না
- সিগারেট খাবেন আরেকটা?
- এখন খাবো না। চা খেয়ে খাবো
মা আরেকবা উঁকি দেন
- উনাকে বেঁধে রাখেন কেন?
শোয়েব শাদাব হারিয়ে যান। কিছুদিন আগে মামার বাড়ি গিয়ে ওখান থেকে নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিলেন প্রায় দেড় মাস
মা নিজেই টেবিলের ড্রয়ার টান দিলেন। দলামচা করা কাগজের বান্ডিল। একটা অক্ষরও বাংলা নেই। ইংরেজিতে লেখা কবিতা
- আপনি কি এখন ইংরেজিতে লেখেন?
- হ্যাঁ
- বাংলায় লিখেন না?
- লিখি
- বই করার কোনো প্লান আছে সামনে?
- আছে?
- পাণ্ডুলিপি রেডি?
- পলাশ নিয়ে গেছে
এই নামটা আগেও দুয়েকবার বলেছেন। তার সব লেখা এই পলাশের কাছে। পলাশ কোথায় যেন গেছেন। এলেই বই বের হবে তার
- বইয়ের নাম কী?
- হেরা?
- গ্রিক হেরা?
- হ্যাঁ। গডেস হেরা
- হেরা কেন?
- গডেস হেরা
- সবাইতো আফ্রোদিতি কিংবা অ্যাথেনাকে নিয়ে লেখে। হঠাৎ হেরা কেন?
- গডেস হেরা
- গ্রিক এক দেবতাকেও দীর্ঘদিন বেঁধে রাখা হয়েছিল শেকলে
- প্রমিথিউস
- আপনিওতো বহুদিন থেকে শেকলে আটকানো
- আমি প্রমিথিউস না। শোয়েব শাদাব
তারপর আরো বহুক্ষণ নীরব। বাইরে তুমুল বৃষ্টি। বললাম উঠি। শোয়েব অনড় থেকেই যেন কমান্ড করলেন-বৃষ্টি ধরুক
বৃষ্টি হচ্ছে। বহুক্ষণ নিশ্চুপ আমরা। শোয়েব মুখ খুললেন- বই বেরিয়েছে?
- বেরিয়েছে
- কয়টা?
- দেড় হালি
- কয় কপি বিক্রি হয়?
- বিক্রি হয় বিশ বাইশটা
- হবে। কোটি কোটি কপি বিক্রি হবে
- কীভাবে?
- হবে। না হয়ে উপায় নেই। লোকজন কিনবে
- আচ্ছা বাবা ওর বই কি কোটি কোটি কপি বিক্রি হবে?
পেছন থেকে আবার ঢুকলেন মা। কোনো উত্তর না দিয়ে তাকিয়ে থাকলাম। বললেন- এবার ওর ছেলে এসএসসি পাশ করেছে। বললাম মিষ্টি খাওয়াতে। বলে- এখন তো আমার কোনো টাকা নেই। সুস্থ হয়ে ঢাকা গেলে আমার বই ছাপা হবে। কোটি কোটি কপি বিক্রি হবে। তখন সবাইকে মিষ্টি খাওয়াব। ওর বই কি অত কপি বিক্রি হবে?
কোন কবি নিজের বই কোটি কপি বিক্রির স্বপ্ন দেখেনি? প্রায় সব কবিই বলে প্রকাশক চুরি করে তার হাজার হাজার বই বিক্রি করে ফেলে। আর বহু কবিই প্রকাশককে বলে লাখ খানেক ছাপাতে। এটাতো কবিত্বেরই স্বাভাবিকতা...
আমি এড়িয়ে যাই। উঠে আসার আগে আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে যখন দরজায় দাঁড়িয়েছি তখন পেছন থেকে শুনি শোয়েবের গলা- বড়ো কবি অইনজে
- মানে?
- ছোট কবি থেকে লাভ নাই। বড়ো কবি অইনজে
- বড়ো কবি কীভাবে হয়?
- সিরিয়াসলি লিখতে লিখতে হয়
শেকল হলো চেইনশেকল হলো চেইন
ডাক্তাররা কী বলে জানি না। কিন্তু শোয়েব আগাগোড়া কবিতায়ই আছেন। কবিতার স্বপ্ন এবং কবিতা না লিখতে পারার দুঃখ তার কাছে পায়ের শেকল থেকেও টনটনে বাস্তব। আর তার চেয়েও বাস্তব কবিতা না লিখতে পারার অক্ষমতা। তাই নামগোত্রহীন অচেনা একজনের কাঁধে তুলে দেন নিজের বড়ো কবি হয়ে উঠার বাসনা- বড়ো কবি অইনজে...
http://www.sachalayatan.com/leelen/18642
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন