রবিবার, ২৩ আগস্ট, ২০০৯

মুয়ীয মাহফুজের কবিতা




স্রোত
......
কখনো হইনি অচেতন,জেগে আছি বহুবছরের ঘুম বিসর্জন দিয়ে
সমস্ত ঘুম উড়ে গ্যাছে বিভিন্ন রোদের উত্তাপে-
আমার শয়নভংগির অনাচারে সবুজ ঘাস হয়েছে হলুদ-
তবুও জানি আত্নমেহন নয় এ-কারো রুপে গুণমুগ্ধতা নয়।
স্রেফ সদর্থক জীবনের স্রোত।
স্রোত হল চলমান জলে থমকে থাকা পৃথিবীর রোদ।
এইসব ক্লান্তিতে নিরাময় নিয়ে এসো উত্তরের ঝড়,প্লিজ।
নিরাসক্ত ফুল কিংবা আসক্ত কীটের জীবন
আসলে আম্বুলেন্সের সাইরেনের মত সমান কাব্যিক।

আম্বুলেন্স ক্লান্ত হয়ে হাসপাতালের কাছে গিয়ে নতজানু হয়।
ভেতরে অসুখ,ভেতরে আসুরিক রোগ নিয়ে দৌড়ে চলা,
অতঃপর সেবিকার শুভ্রতা,চার্টশীট আর একদিন
জরুরী যানবাহন হেডলাইট জেলে বলবে,
তোমার আর একটা পিপড়ার ক্লান্তির ভংগিমায়
কোনোই পার্থক্য দেখিনা কখনোই।
আমার ক্লান্তিও আরব্য রজনীর বোতলের দৈত্যর মতো করে
মুক্তি পেয়ে গিয়েছে,
সরু ছিপি খুলে যায়,কোন আদম সন্তানের ভুলে মাশুল
এবং শেষমেশ ভয়ের বিলুপ্তি ও অভাব উথ্যাপন করা।

ক্লান্তিরা তবুও লিপ্সার বুদবুদে বন্দী থাকে,অক্লান্ত অবসর নিয়ে।


জড়ের মতই আজীবন অনশন
.................
নিয়ে এসো ফুল, হাতে নিয়ে এসো মালা
এসে গেছে সেই সভ্যতার কোচোয়ান
মুখে বারুদ ফাটিয়ে-আড়চোখে দেখে
দুর উপবনে মুক্ত ঘোটক পালায়
মুক্ত কি বলাযায় রাইফেলের ডগায়?
অথবা অন্ধপাখীর ডানা চিনচিন
করে উড্ডয়নের বাসনা ধরে রেখে-
জড়ের মতই আজীবন অনশন
নিয়ে আসো রাইফেল,আরো ছিটাও রক্ত
তবু কেন তুমি চলে যাও মৃত্যুদূত?
আমার নৈশপ্রেম, বিডিএসএম
শাদা পৃষ্ঠা ভরে ফেলা অনৈতিক হেম!
পলায়নপর ঘোড়া ও পাখিটির খুঁত
রুপান্তরে হয় ব্যার্থ তবু সুধাসক্ত।


রঙ দু’টি ধ্রুব হোক
............
চেয়ারে এখনো বসে আছে অন্ধকার, খাটে শুয়ে আছে একপ্রস্থ আলো
অথচ কোথায় বসব আমি? কোন সাধনার শবাসনে নয়
আসলে বসে আছি ঘাসে─তৃণভোজী শুধু নিরীহ পশুরাই হয়
তবু হরিৎসেবীরা স্পর্শ নেয় হাতে; কোমল হলেও আজও
তাদেরকে মনে মনে আমরা অসুস্থ বলি─তাই উঠে যাচ্ছি...

কেন যে জানালা বন্ধ রাখো? তার পাশেই কতগুলো জলচিত্র
দেয়ালে ঝুলিয়ে ভাবছ তুলনামূলক ভাল লাগছে সেই খণ্ডদৃশ্য!
তোমার ভাবনায় ক্ষুদ্র বনসাই আজ তার নিজস্ব অহমিকায়,
তোমার কোমরে প্যান্টটি লাগাতে একটা বেল্টের প্রয়োজন হয়,
তোমার কুটির, প্রাসাদ আজ─কেননা একটা চড়াই বেঁধেছে তার নীড়।

আমি তো হাতে নির্দোষ ইক্ষু নিয়েও পরিজনের কাছে শুনেছি
মানুষের বাহুর চাইতে দীর্ঘ সকল বস্তুই নাকি মারণাস্ত্র!
এমন কী সামাজিক গান কণ্ঠস্থ হলেও আমার মনে থাকে না সুর!
নতুন করে কি আমি এ-ই বিশ্বাস করব? শেখা বাকি সেই মন্ত্র:
শেষ রাতে কুকুরের স্বাগত ধ্বনিতে যারা ঘরে ফেরে তারাই মহান লোক!

বর্ণান্ধ বোনটিকে রঙের বাক্স দিয়ে দেখি শুধু সাদা ও কালো
চোখে তার বসে আছে বর্ণচোরা ব্ল্যাকহোল; সব গভীরতা ছুঁয়ে যাচ্ছে দ্রুত...
পৃথিবীর সব রঙ উঠে গেলে পিঠে রোদ, সামনে ছায়া─রঙ দু’টি ধ্র“ব হোক।


পৈতৃক যাযাবর
...........
পিতামহ তুমি লুকিয়েছ কোথায়? উত্তরাধিকারী আমি
তোমার সমাধি খুঁড়ে হাড়গোড় নয়, মুকুট পেতে চাই!
উত্তাপে শুধু দুধ নয়,বিষ নিজেও ঘন হয়
তাই বুঝি মেঘের এমন মাত্রাবিহীন বজ্রপাত? নিখুঁত মাতৃছায়ায়
বিদ্যুৎ ছাড়েনা তোমাকেও! প্রতিটি সমাধি খুঁড়ে তাই
মেঘদূত পোড়াবেই মুকুট─গলিত সমাধি ফলক তাই বলে।
ছাড়ে না মৃত্যু, ছাড়ে না জীবন, কেউ কাউকে ছাড়ে না।
স্বেচ্ছায় চাইছি অভিশাপ, কারাগার, গুপ্ত দরজার চাবি
যে দরজায় প্রহরী নেই, মুণ্ডুতে ঝুলে থাকে ফাঁসি...

উল্লাস ভালবাসি তাই পিতার মৃত্যুতে কি আসে যায়?
যে মৃত্যু আমাকে করেছে প্রাপক─বিষয়ে করেছে বিষয়ী!
তর্জনীতে বল চাইছি, অনুতাপ নয় তাপ চাইছি।
উত্তাপে শুধু দুধ নয়, বিষ নিজেও ঘন হয়...

সমাধি খুঁড়ে দেখি শুধু হাড়গোড়! হায় আমার নিঃস্ব পূর্বসূরি!

চুলের মুকুট লাগিয়ে মাথায়, করোটির হঠাৎ ভয় হয়।



সহজ সত্য
.........
রাত্রির শিশিরটুকু ধানপত্র থেকে শুকিয়ে গেলে,রোদের অভিপ্রায়ে,
আমার ঘুমটুকু তেমনি শুকিয়ে গেলে রোদের বিছানায়।
কে যেন আমাকে তীর ভেবে ছুড়ে দিলো দৃশ্যের লক্ষ্যবিন্দুতে
রোদে কালো হয়ে যাওয়া আংশিক পাপ হবে ভেবে
গাছের শেকড়ে তাই জেগে থাকি, রাত্রিতে ভীষণভাবে জেগে থাকি,
গভীর রাত্রিতে সকালকে জাগাই
সকাল-
দূরের গাছগুলোর সবুজ খামে কোন চিঠি, কোন গ্রাম আঁকা আছে কে জানে?

আমার ছায়ায় শিশির, ছায়া ভেসে আছে জলে
জলছায়া,তুমি কোথাকার শরীর ছিড়ে নাও?
তোমাতে প্রজাপতিরা ডানা নামিয়ে অদ্ভুত দূরত্ব সৃষ্টি করেছে?
আমি আমার কাছ থেকে দূরে বসে থাকি,ছায়ার মতো দুরত্বে...
ফুলের কিরণ আমি চোখে ঘষি তবু বুঝতে পারি
আমার প্রিয় গানগুলো অন্যসুরে, অন্যভাবে গাইছে কেউ,
এই পোড়ো জমিতে সেই মৃত বাতাস এখনও আসছে ভেসে...

ফসলের ক্ষেতের উর্দ্ধে, নভোমুখে, সাতফুট দূরত্বে বিদ্যুতের তারে বসে ছিলো
নির্বোধ শালিক পক্ষিরা,বেজোড় সংখ্যক ফিরে যাচ্ছো তুমি!
আজই এইসব দৃশ্য ছেড়ে, নগর বন্দনায়
পরিবারের সকাশে মুহুর্মুহু গাইছো সামাজিক গান

অসামাজিক আমি মুখে বিদঘুটে গন্ধ, বিষের গন্ধে ঘিরে থাকে।
সাতপাক ঘিরে থাকে আমাকে,সাত সমুদ্র পার হতে পারিনা।


ইউথানাশিয়া
..........
আশ্চর্য!
একটি সরব আড্ডাখানার খুব কাছাকাছি এসেও নীরবে চলে গেলে!
তোমার পোকায় ধরা দাঁত দিয়ে সাবঅলটার্ণ আঙুল-হতে শুষে নিলে লাল বিপ্লব!
তোমার নাম আমি কনিস্ঠ প্রতিভা রাখতে চেয়েছি।
যে তুমি দেয়াল থেকে আনমনে খুঁটে ছিড়ে ফেলো সবুজ শ্যাওলা
যার কাছে গুন্জন মানে দাবীর প্রকাশ!

এখনও সেইসব আধুনিক চিন্তাকাঠামোতে আশ্রয় খুঁজে পাও চড়ুই পাখীর মতোন!
যা কিনা প্রকৃতির কল্পিত সাম্যাবস্থা নির্ভর,
সেইসব ধূসর মানচিত্র
কিভাবে যেন চলে এলো মানবজীবনে...

অথচ সকল সাম্যের খুব কাছাকাছি এসেও,আপাত জৈবিকতায়
অথবা প্রগাঢ় ঘনিস্ঠতায়...একজনই কেবল প্রত্যক্ষ ভূমিকায়!
তুমিও মেনে নিয়েছিলে তা!এমত সীমাবদ্ধতার পরও আমি আমার
ভূমিকায় নিস্ক্রিয় আছি দেখে দেখে তুমি কেন পাপবোধ কর?

ইদানীং আমি আর কোনো মেনিফেস্টো পড়ে দেখি না,
অজস্র মেনিফেস্টোর ঘুড়িরা ধারালো মান্জায়
সুসজ্জিত হয়ে
করছে কাটাকাটি...অজস্র চীৎকার...ভোকাট্টা...ভোকাট্টা..
শোনা যায় অবিকল দাবীর মতো করে।
প্রগতির অতি বিচ্ছিন্ন সুরে গভীরভাবে কান পাতলে শুনতে পাবে ইউথানাশিয়া ডাকছে।
ডাকছে তোমাকে...
না,তুমি শুনতে পাবে না,
কারণ ইদানীং আমি আর কান পেতে পেতে দাবীর শব্দ শুনি না।

তবুও তোমাকে আমার দরকার,
আমার কৃপাহত্যার সহযোগী হিসেবে


খুনীর পুনর্বাসন,পলায়ন বা তিনটি মৃত প্রাণী
.........................
গুপ্তপথে পলায়নের সময়ে দেখেছি একজন মা তার শিশুকে রেখে পালিয়ে গেছে,একটি নতুন ঘর তার কাধের কাছে যে সব সবুজ কলাপাতার গাছ ছিলো তাদেরকে নিয়ে সুষমভাবে পুড়ছে,আর একজন বিব্রত হাস ভাবছে সে কেন হলো না শুভ্র ডানার অতিথি পাখি কিংবা বুনো কোনো হাস।

আমার কাধে একটি মরা খরগোস,একটি কাছিম ও একটা প্রানী মানুষ,যার অপরাধ হলো অস্বীকার করে যাওয়া কৃত্রিম নিয়মাবলীকে।আমার অপরাধ ছিলো উত্তর পথের লোকেদের হত্যার মত নিদারুন গর্হিত কাজ!আমি যদিও খুব আনন্দের সাথেই খুন করে থাকি,যারা আমার সাথে একাত্নতা করেছিলো।তাদেরকে দেখিয়ে দিলাম ভিসুভিয়াসের জন্ম মানেই হলো সীমাবদ্ধ থেকে যাওয়া,বিধ্বংসী অগ্নি নিয়ে জ্বালামুখের সংকীর্ণতা নিয়ে নিজে নিজে ফুসে যাওয়া।আমার কাধের অত্যাচারিত মানুষটিকে দেখিয়ে দিলাম ফুলের গন্ধ কোনো প্রকরণে সীমাবদ্ধ না থেকে নৈঃশব্দে ঝরে গেছে বীজ।আমি নিভিয়ে দিলাম আমার রক্তাক্ত পদচিন্হ,কেউ যাতে অনুসরণ না করতে পারে,স্কাল্পহান্টারেরা আমাদের মাথা কেটে যদি রেখে দেয় পৃথিবীর যাদুঘরে?দেখা গেলো আমাদের বলা হচ্ছে মেধাবী মস্তিস্ক এবং অর্থহীন নোবেলের মতো বালছাল আরো অনেক উপাধি!যদিও কৃষ্নপক্ষ এখন তবুও অন্ধকারেই রয়ে গেছে আমাদের যতশত মিথিক্যাল ভূত।

কয়েদকালে আমার বন্ধুত্ব হয়েছিলো মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত এক ধ্রুপদী আত্নার সন্গে।আমাকে হঠাৎ গেয়েছিলো
"অন্ধ আনে ব্যকরণ,
মিথ্যা মানে কিছুই নয়
জ্বলতে থাকুক আমার মন,
সত্য মানে কিছুই নয়,
পরিবর্তন,পরিবর্তন
আমার হাতে বিবি হরতন
তোমার হাতে বিবি হরতন
কেউকি জানে জোচ্চুরিটা কোথায়?
শেষে শুধু এমনই হয়
নিজমন্ডু নিজেই কর্তন?"

আকন্ঠ কবিতা গেলে,সে কবি ছিলো,তার কাছে কবিতা মানে ভাববাদী আচরণ করা।প্রায়ই বলতো সে কবিতার কোনো মর্ম রাখতে চায়না,কবিতাকে কোনো সীমানায় নিতেও চায়না সে।কোনো মহান সত্বার কাছে সে বারবার মুক্তি চাইতো দারুন উত্তরাধুনিকভাবে কেনো যেনো সে তার নিজের অসীমভাবাপন্নতা ধারণ করতে পারতোনা,বরং নিদারুণ আধুনিক এবং বস্তুবাদী প্রাচীণ সেইসব কবিদের মতো একদিন সে সুইসাইড করলো।সুইসাইডের দিন তার তিক্ত বিষের বাটিতে আমি চিনি গুলতে গুলতে জানতে চাই যে তার কবিতাগুলোর কি হবে?সে আমাকে বলেছিলো,পিপড়া হয়ে সেই অক্ষরগুলো পৃথিবীর কোথাও না কোথাও চলে যাবে।এরপর আমি সুমিস্ট বিষপানে তাকে প্রলুব্ধ করলাম,আমার তৃতীয় খুন সম্পন্ন হলো।গান গাইলো সে
আমার হাতে বিবি হরতন
তোমার হাতে বিবি হরতন
কেউকি জানে জোচ্চুরিটা কোথায়?
শেষে শুধু এমনই হয়
নিজমন্ডু নিজেই কর্তন...

এর কিছুদিন পর আমি আমার একটি খুনের সুখস্মৃতি নিয়ে আত্ননির্বাসিতদের কয়েদ থেকে পালিয়ে এলাম,দেখলাম পথে কয়েকটি কলসের কাছে পড়ে আছে আমার খুব প্রিয় আয়না,একটা জলাশয়।দেখতে পেলাম আমার চুলদাড়ি অনেক বড় হয়ে গেছে,আহারে আমার সুশ্রী ও সুন্দর সামাজিক মুখ,ইচ্ছে হলো আমি তাকেও খুন করে বাড়াই নতুন এক আনন্দ।

পথে একটি অরণ্য পড়লো,ক্ষুধার্ত হলাম আমি।বড় বড় বুনো একপ্রকার মুলা দিয়ে আহার সারবো ভাবি।এমন সময় মুলালোভী এক খরগোশ এগিয়ে আসে।প্রতিস্ঠানিক ধারণায় বন্য প্রাণীরা যেমন হয় এ আবার তেমন নয়,ভয় না পেয়ে সে আমার সে আমার আশেপাশে নির্ভয়ে ঘুরঘুর করতে থাকে,আমি দ্বিতীয় খুন করলাম...

সমুদ্র পাড়ি দেবার সময় একটি কাছিম চোখে পড়ে আমার,দেহে তার লেগে আছে শতবর্ষের পুরণো শ্যাওলা।পুরণো আকড়ে ধরে রাখার জন্যই যেন তার শক্ত খোলস আর অকারণে নিজ দেহেই পলায়ন,আমার রাগ হলো।সেটাকে মারতে কস্ট হয়েছিলো খুব তার দেহাবরণের জন্য...

একটি আগ্নেয়গিরির বৃত্তাকার জ্বালামুখ ধরে অসীম বছর হেটে চলেছে একটি জীবন্ত প্রাণী কাধে তার তিনটি মৃত প্রাণী।

.....................................................................
*(কবি পরিচিতি : জন্ম-অক্টোবর ১৯৮৩,ঢাকা। কবিতা লেখালেখির শুরু ৯৯-২০০০ এর দিকে। মিউজিক করছেন। মনোসরণি নামক একস্টিক ব্যান্ডের লিড গিটারিস্ট, সুরকার। বইমেলা ২০০৯ এ প্রকাশিত কবিতার বই- হুইসেল বাজছে চোর পালাচ্ছে।)
................................
কবি মুয়ীয মাহফুজের আরও লেখা পড়া জন্য লিংক-
http://www.somewhereinblog.net/blog/muizblog/28759293

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন