রবিবার, ২৩ আগস্ট, ২০০৯

পলাশ দত্তর কবিতা






ফিরিতেছে
........
ওইরকম গ্রামে যাওয়ার কথা প্রত্যেক দিন ভাবি। আমাদের পা ছাপিয়ে
এগিয়ে যায় পানি। প্রত্যেকবার গ্রামে যেতে পয়সা লাগে। দেবে কে?
আর গ্রামে গিয়ে থাকবোই-বা কোথায়? আমি যে-গ্রামে যেতে চাই
সেখানে তো পরিচয় নেই কারো। ওই গ্রামে কে আমাকে খেতে দেবে?
বড়ো জোর দুই কি তিনদিন। পরে উল্টো দিক থেকে টাকশালও ডাকে
বলে ফিরে আয় ফিরে আয়। নইলে শিগগির বন্ধ হয়ে যাচ্ছে
তোর ভাতের কারখানা
কিন্তু আমি কি ভাত খাবো না? আমি তো পাখি না যে

শীতের মতো শহর তেড়ে এল ছুটে পালাতে পারি গ্রামে। আমি পাখি না যে
আমাকে শহরের মানুষ ফাঁদে মেরে মুক্তি দেবে। আমি তো পাখি না যে
আমাকে বেচে দিলে দু’পয়সা পেটে আসবে কারো, আর আমি সুন্দর ম’রে যাবো।
আমার মরণে তো দুঃখ পাবে না কেউ
আমাকে বাঁচাতে তো কেউ একে অন্যের হাতে রাখবে না হাত।
আমি তো মানুষ। আমার নাই মরণের লড়াইয়ের অধিকার

নিজের ভাষা নিজে বুঝি ব’লে
প্রতি সকালে আরো একবার
বেঁচে থাকার ভার আমাকে বইতেই হবে। কার কোন্ দুর্বল মুহূর্তে
জন্ম নিয়ে নিয়েছিলাম। আমি জন্মমাত্র মানুষ হয়ে গেলাম; পশুর মতো না
আমার বাঁচতে হ’লে পয়সা লাগে। আমার খেতে হ’লে পয়সা লাগে

আমার খাবার বনে-বাদাড়ে পাওয়া যায় না

শুধু এইরকম শহরে ব’সে ব’সে গ্রামের কথা ভাববো ফেলে আসা।
ভাববো বর্ষাকাল আমাকে ফেলে সবাই এগিয়ে গেলো পা-উপচানো পানি
তারপর টাকার ধান্দায় ভেসে যাবো শহরের এ-মাথা ও-মাথা।।
যেনো হাওয়া উড়ে চলেছি ধানের এই শীষ থেকে ওই শীষ;
যেনো নদী সুরমা ব’য়ে চলেছি খুব ব্যস্ত বর্ষায়; যেনো সারের কারখানা থেকে
চা-বাগানের কানে পৌঁছে যাচ্ছি সাইরেন; যেনো শ্রমিকদের ব’লে দিচ্ছি
জীবনধর্ম বাঁচতে হ’লে পয়সা লাগে, খেতে হলেও

কিন্তু সবুজ ধানশীষ জানে না আমি তাকে চাষ করি না আজ
বাতাস জানে না আমি থাকি গ্রাম থেকে অনেক দূরে। সে ভুল করে।
আামকে ছোঁয়া বাতাস প্রতিদিন গ্রামে গ্রামে পায়চারি করে

কিন্তু আমার বাঁচতে হ’লে শহরের দাস হওয়া লাগে

তবু আমি ফাঁকি দিই। বাঁচার ধান্দায় ঘুরতে ঘুরতে প্রতিদিন :
ওইভাবে একবার
কখনো-না-কখনো
গ্রামে যাওয়ার কথা ভাবি।

*এই কবিতাটি রাইট এলাইনমেন্ট হবে।


ক্ষীণ আয়ুষ্মান
..........
পৃথিবীর তাবৎ গ্রাম আজ বসন্তের মতো ক্ষীণায়ু। পৃথিবীর তাবৎ গ্রাম
আজ প্রকৃত কবির মতো মিতবাক। দখলের আর ধ্বংসের সত্যতা টের পেয়ে
এমনই কি হয়? এখানে বারান্দা নেই যে আপ্রাণ শস্যদানার অবসরে ভাবা যাবে
আলের ফাঁদে জমি ভেঙে দেয়ার পরও। মাঠের অহঙ্কারে গ্রামকে গ্রাম
শুধু পৃথিবীর ভাত। খুনের নেশায় চোখে পড়ে না সেই উত্তাপ
পৃথিবী খাবে ব’লে কিলোকিলো গ্রামে অনর্গল চাষ চলছে চুপচাপ

ওই গ্রামচাষীরা ভোলেনি
সব দেশে নবান্তের স্বাদ একইরকম বিরল আজ।

সব গ্রামই গ্রাম্য ব’লে উৎখাত হয়ে গেছে। আমাদের গ্রামও ওইরকম
দেয়ালে-দেয়ালে বিজ্ঞাপন আর শস্যের ডালে-ডালে হাইরাইজকে দিছে ঠাঁই-
ভূমিকম্পে ভাঙবে না, ভিজবে না বৃষ্টিতে। গ্রামের মানুষগুলিকে
এই সমস্ত সুখ বিনালাভে ডেভেলপাররা দিয়ে দিছে। লোকে লোকারণ্য ওই সব
দালানই আজ বাতাসে দোলে- যেন সবুজ ধানের শীষ। মাঝে-মাঝে ভয় হয়।
এভাবেই কি একদিন বিষে ক্ষয়ে যাবে বিষ। অস্ত্রোপচার কি হবে
ফসলের চেয়ে শতগুণ চতুর মানুষগুলির পেটে। হাওয়া খেয়ে তারা
বাড়ি বুনে নেবে অপার মহাশূন্যে? একভাগ স্থলের পুরোটাই কি দেবে ঢেকে
এভারেস্টের চেয়ে উঁচু-উঁচু সব দালানে? নাকি সাঁকো গ’ড়ে দেবে
মনে আর ক্ষুধায়?

স্মৃতির ডানায় এইসব দালানে নিহত ভাতেরা এসে ভ’রে দেবে
পৃথিবীর মানুষের পেট?
নাকি জলফোঁটা চেয়ে মানুষগুলি কেবলই ছড়িয়ে যাবে
গ্রাম থেকে গ্রামে। মাঠ থেকে মাঠে। ভাত থেকে ভাতে
তেপান্তরে এখনো একলা টিকে থাকা আমাদের মাঠে?

তাতেও-বা কী?

যে-গ্রামে মানুষের পায়ের ছাপ পড়েছে তাই হয়ে গেছে মুহূর্তের মতো ক্ষীণায়ু
তাই হয়ে গেছে বসন্তের লুপ্তপ্রায় ডুবন্ত লাল সূর্য

পৃথিবীতে এখন ঝগড়া চলছে : বসন্তের মতো রঙিন আর কবির মতো রাগী
অথচ সত্যবাদী গ্রামগুলির দখল নিতে হবে। টিভিতে খাবারে স্বাদ অহরহ দেখে
খাবার পাথর হয়ে চেপে ব’সে গেছে পেটে। ধানের সবুজশীষ, অমাবস্যায়
সরিষার সোনালী আলো- সব আজ স্মৃতিকথা। আমাদের গ্রাম
চার বছরের শিশুবয়সে মারা গেছে পৃথিবীর হাতে

তবু বসন্তের মতো। ক্ষীণায়ু। তবু কবির মতো প্রকৃত। তবু
স্মৃতিতে স্মৃতিতে সে হল্লামুখরতায় মিতবাক। টিকে থাকার
সার্থক সমস্ত ইতিহাস যেমন। যেমন গ্রামের গ্রাম্য এই মানুষগুলি
মরণেরও মুহূর্তমাত্র আগে

*এই কবিতাটিও রাইট এলাইনমেন্ট হবে।



অস্ত্রের মরণ নাই
...........
দুনিয়ায় এখন
অস্ত্রের চেয়ে শক্তিমান
আর কিছুই কি নাই?

এই প্রশ্ন করতে-করতে
(ঘরে টিভি আছে বলে)
দুনিয়া সার্ফ ক'রে আসি
চ্যানেলে-চ্যানেলে

যার হাতে যতো কম
সে ততো সহজেই
বিলীয়মান;

একটামাত্র গুলি
বুকে গিয়ে লাগলে
মানুষ মরে যায়!

দুনিয়ায় কখনো
অস্ত্রের চেয়ে শক্তিমান
আর কিছুই তো নাই



প্রভাকরণকে মারার পর
..............
দোকানে পুরির পর চা খেতে-খেতে
মনে পড়তেছে প্রভাকরণ।

বেশি কিছু না, নিজেদের
দেশমতোন এক বেচে থাকা

দ্যাখা যাচ্ছে কাছের দেশ- শ্রীলঙ্কা
বিদেশি আঘাত নয়-
শুধু প্রভাকরণদের আত্মরক্ষা

স্বদেশি খাচায় নিজস্ব ভাষায়

পুরির পর চা খেতে-খেতে
মনে পড়তেছে বন্ধুরা
সার বেধেছে বিবেকের দ্রোহমাঠে

আর তুমি
আবারও অসুস্থ কয়েকটা দিন
হৃদয়ে জপে
কিংবদন্তির দুটি মাত্র চোখ;


নিরস্ত্র রাখাল
............
যে-রাখাল নিরস্ত্র তার ঘুমিয়ে থাকার সময়
পাহারা দেবে না কেউ;
পাড়া-বেপাড়ার শত্রু-মিত্র সব
তার খোলা গলায়
ছুরি শানাবে
ঘুমন্ত রাখাল
অবলীলায় ঘুমিয়েই যাবে
আমরণ;

ঘুমের ভেতর মরতেছে বলে রাখালের
আহা চেনাই হবে না শেষবেলায়
কে ছিলো মিত্র কে শত্রু।

খোলা মাঠ পেয়ে গেলে,
ঘুমিয়ে থাকো-
নিরস্ত্র রাখালের মতো॥



নিজের মুখে হাত দিয়ে অবাক হয়ে যাই
........................

নিজের মুখে হাত দিয়ে অবাক হয়ে যাই
যেখানে হাত পড়ে সেখানেই হাড়-
কপাল থেকে চিবুক, এমনকি গাল;

মুখের এই চামড়া তবে সত্যি নয়!
মিথ্যা মোহে ঢেকে রাখে
অপ্রিয় সব শক্ত শক্ত হাড়?

চামড়া-ঢাকা পুরো মুখ
মিথ্যা-মিথ্যা লাগে-
হাড়ের সাথে দ্যাখা, কখনো কি আর
কবর না-খুড়লে হবে?



ফুলের সমস্যা
..........
কেনো তুমি ছুটে যাও বাগানে
রাস্তার মোড়ে-মোড়ে সাজানো কি নাই
এই পৃথিবীর ফুল?
ফুল কিনতে গিয়েছিলে পৃথিবীতে
একদম পয়সাশূন্য হাতে
ফুল- সে তো ফুটেই আছে পাবলিক প্লেসে

কে আর বিশ্বাস করে-
জীবনে মানুষ ফুল হয়ে ফোটে
কয়েক কদম সিঁটিয়ে
তোমাকে পাবে ফুলেরই হাটে

তোমার পৃথিবীর পথে তার অভিশাপ আজ
ফুলমতো অজস্র; জীবনের অর্কেস্ট্রায়
কি আশ্চর্য ফুলগুলি
নির্দ্বিধায় মানুষ খুন করে,
অজানিতে

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন