শনিবার, ২২ আগস্ট, ২০০৯
আত্মরতির খুন/ সাঈদ জুবেরী
আত্মরতির খুন
............
সাঈদ জুবেরী
প্রথম প্রকাশ
অমর একুশে বইমেলা ২০০৯
...............
প্রকাশক
মাঞ্জাসুতা
বাড়ি-৩,রোড-৩,গলি-৩, ব্লক-এ, সেকশন-১১
মিরপুর, ঢাকা
সত্ত্ব : সুমনা ইয়াসমিন
প্রচ্ছদ
শাওন আকন্দ
মুদ্রণ
ত্রয়ী প্রিন্টার্স
১৫, নীলক্ষেত, বাবুপুরা
কাঁটাবন, ঢাকা
অক্ষরবিন্যাস
কালজয়ী কম্পিউটার্স
৫ আজিজ সুপার মার্কেট (২য় তলা)
শাহবাগ, ঢাকা ১০০০
প্রাপ্তিস্থান
জনান্তিক
আজিজ সুপার মার্কেট (নিচ তলা)
শাহবাগ, ঢাকা
মূল্য
ষাট টাকা
...........
উৎসর্গ
সুরাইয়া বেগম
কমরেড শওকত চৌধুরী
.............
রাত্রিগুলো কাটা পড়ে সার্জিক্যাল ব্লেডের নিচে
সিডেটিভ ঘোরে মাথায় ঘুম নিয়ে
পার হয়ে আসি দীর্ঘ শল্যচিকিৎসা
একটি নিস্পৃহ ছুরির কাছে বিঁধে যেতে যেতে শুনি
বাবা বলছেন, তোর স্বপ্নবিলাসি ডানা আমারও ছিল
তোর মায়ের ইনসমনিয়া তাই...
পিতাকে স্মরণে দাঁড় করিয়ে মায়ের কাছে যাই
আর ঘুমপাড়ানি গান গাই... সারারাত
একটা দাঁড়কাক ভোরের আলো ফুটে উঠতে থাকলে
দার্শনিকের মতো বলে ওঠে—
এবার ঘুমাও, যতই দিবসের দিকে যাবে
মানুষের দোষে মানুষই দূষিত হবে শুধু...
মোটেও ভালো লাগছিলো না এসব
আর কল ছেড়ে দিয়ে সব জল ফেলে দিয়ে
মুঠো মুঠো সিডেটিভ বড়ি চিবিয়ে
ঘুমকে পাঠিয়েছি স্বপ্ন বরাবর।
সূচিপত্র
.............................
আত্মচরিতামৃত ৭
পৃথক পালঙ্ক ৯
প্রতিবেশী ১০
আমার অন্ধত্ব ১১
ঢেউ ১২
সিজোফ্রেনিক ঘুম ১৩
মানুষ ১৪
শিক্ষাকার্যক্রম ১৫
রক্তবৃত্ত ১৬
প্রশ্নগুলো সহজ আর উত্তরওতো জানা ১৭
হাসপাতাল ১৮
একটা গাছের কনফেশন ১৯
সিনেমার ঘোড়া ২০
নৈঃশব্দ্যের সেতু ২১
অন্য পৃথিবীর ঈশ্বর ২২
শববাড়ি ২৩
একজন পিঁপড়া, একটা কবি এবং... ২৪
কনফেশন-১ ২৫
কনফেশন-২ ২৭
কচ্ছপের ডানা ৪৮
...................................................................
কৃতজ্ঞতা : মনু ভাই, মিঠু ভাই, খালেদ ভাই, তানিম, মাঝি, তাপসদা’, তুষার, অভিজিৎ, বান্না এবং ফুয়াদ।
আত্মচরিতামৃত
ক.
জন্মবৃত্তান্ত
(এমন মানব জনম আর কী হবে
মন যা করার ত্বরায় কর এই ভবে)
প্রতিটা মানুষেরই আলাদা সন্তান ভাবনা আছে
আমার বাবা মা কি কোন যৌথ ভাবনাবিন্দুতে
আমাকে আকাক্সক্ষা করেছিলেন, নাকি দুইটি
ভাবনার বিরোধী সম্মিলন আমি, তা নিশ্চিত নই
তবে দীর্ঘশ্বাসের হাওয়ায়
আমি হতাশা আর যন্ত্রণার স্মারক
খ.
যাপনবৃত্তান্ত
(আট কুঠুরী নয় দরজা আটা
মধ্যে মধ্যে ঝরকা কাটা)
আমি একটা জেলখানার নাম
কাম হচ্ছে সেখানকার জেলার, আর
অন্যান্য রিপুগণ যথাক্রমে
কারারক্ষী, মেট্রন ইত্যাদি
অসংখ্য কয়েদীর ডাকনামও আমি
আমার নামে ঠিক কী অভিযোগ তা নিশ্চিত নই
তবে যাদের সাক্ষ্যে শাস্তি ভোগ করতে হচ্ছে
তাদের আমি চিনি; দীর্ঘসময় তারা আর আমি
আমাদের দুর্ভোগ এবং অপরাধের কথা, সুখ ও অসুখের কথা,
স্বপ্ন আর সম্ভাবনার কথা পরস্পরকে জানতে দিয়েছিলাম
বন্ধুর মতো কাঁধে হাত রেখে সান্ত্বনা দিয়েছিলাম
তারা যথাক্রমে
সিসিফাস আর নার্সিসাস সখা।
গ.
মৃত্যুবৃত্তান্ত
(যখন নৈঃশব্দ্য শব্দরে খাবে)
জীবন যখন সংযোগহীনতার সীমান্তে কাঁটাতারে ঘেরা
মৃত্যুতে তখন গভীর আত্মীয়তা
পাঁজরাবদ্ধ সমস্ত উৎসবের উদ্বোধন হোক
আমার মৃত্যুবার্ষিকীর দিনে
আজ মৃত্যুর পর জীবনের দিকে
তাকিয়ে দেখতে পাই—
বিব্রত, বিচারাধীন এক মানুষের অবয়ব
যে তেল আর জলের চালাকিতে পৃথক।
পৃথক পালঙ্ক
গোপনে নৈরাজ্য বেড়ে যায় জীবনের কেন্দ্রস্থলে
নিজেরই জীবনের অসম্পূর্ণ খসড়া হাতে নিয়ে
দিগি¦দিগ ছুটতে থাকা মানুষের মিছিল
অনির্দিষ্টভাবে এগিয়ে যাচ্ছে সীমান্ত অভিমুখে
সীমান্ত, চারিদিকে ছড়ানো
—এক অদৃশ্য কাঁটাতার
রোদ সরে গেলে ছায়াও সরে সরে যায়
লাইট অ্যান্ড শেডের বিভাজন...
আনন্দ, বেদনা, ঘৃণা, অসহায়ত্ব,
দ্রোহ, প্রেম, স্মৃতি ও ঘাম
সকলেই পৃথক এবং
অলিখিত গল্পের একেকটি চরিত্রের বিবেচনা
যেমন প্রভু বললেন,
আমি জলকে আলাদা করলাম
জিহ্বার ছুরি দিয়ে।
প্রতিবেশী
নতুন গোরস্থানের প্রথম কবরটি
পায়ে চলা রাস্তার পাশে হয় কেন!
মৃত লোকটি তবে কি পদশব্দে বুঝে নিতে চায়—
যে সকল পায়েরা তাকে অতিক্রম করে যায়
আসলে তারা বহুদূর ঘুরে তার কাছে আসে...
জীবন কি এরকমই বটে... “আমাদের এতুটুকু সান্ত্বনা...”
মাঝে মাঝে অনেক রাতে নিসঃঙ্গ কবরটির পাশে গিয়ে বসি
ভাবি কে হবে তোমার প্রথম প্রতিবেশী
আর মনে হয়
এ পৃথিবী মৃতদের আবহমান সৎকারখানা
আমার অন্ধত্ব
চোখের গর্তে এক সাপ বাস করে
দৃশ্যাভিমুখে ছুটে যায় তার ছোবল
তোমার দিকে তাকাই না তাই
সেই দৃষ্টপথে তবু এসে দাঁড়াও বারবার
চোখ বুজে পার হয়ে আসি দৃশ্যময় তোমার অবয়ব
আর মাঝে মাঝে ভাবি সেই অন্ধ ঈদিপাসের কথা
আর দেখি সফোক্লিস নরকের জানালায় বসে তাকিয়ে আছে...
আর শুনি দূর থেকে ভেসে আসা গান... ও আমার চক্ষু নাই...।
ঢেউ
তীরের দিকে ছুটে যাওয়া একটা ঢেউ বালিশের কাছে এসে থামে
চোখ মেলেতেই দেখি চলে যাচ্ছে ফিরতি স্রোতের মিছিলে—সমুদ্র গর্ভে
বালিশ ভেজানো ঢেউটিকে ধরব বলে
দ্রুত অনুসরণ করি স্রোতের মিছিল—আর সমুদ্র
ঢেউগুলোকে তখন টেনে নিচ্ছিল নিজের দিকে,
একসময় ঢেউগুলো সব কোন বিন্দুতে মিলালো—আর
আমি বালুময় ঢালে কয়েক মাইল ভেতরে একলা দাঁড়িয়ে...
হঠাৎ সমুদ্র ফিরিয়ে দিলো ঢেউ
এ ছিলো ডুবে যাবার আগের পটভূমি
পরের কাহিনী উদ্ধারকারী বোটের পাটাতনে রেখে এসেছি
এখন সমুদ্র তীরে বসে আছি
আর নন্দনতাত্ত্বিক ঢেউ আমার পা ছুঁয়ে
চলে যাচ্ছে গভীর সমুদ্রে
সিজোফ্রেনিক ঘুম
সিজোফ্রেনিক ঘুমে কোন স্বপ্ন দেখি না—
প্রতিটা বিছানা মনে হয় স্যানাটোরিয়াম
গতজন্মের হাড় কুড়োতে কুড়োতে—
পায়ের নিচে তৈরি হয় এক রাস্তা...
হায়, রাস্তার শুরুতে মা দাঁড়িয়ে থাকে-
মায়ের চোখে জল, রাস্তাটা ঝাপসা হয়ে আসে
ঝাপসা- দূরত্বব্যঞ্জক উপাখ্যানের মাইলফলক ...
আমি এক মাতালের পিছু নিয়ে দেখি—সে
মদের গ্লাসে অনুকূল সূর্যাস্ত ঘটাচ্ছে, যখন
সূর্যোদয় ঘুমন্ত মানুষের ঘরে।
মানুষ
পেটের ভেতর পূর্ণিমা হজম হয়ে গেছে আর
মাথা থেকে মুছে গেছে রৌদ্রের দ্রবণ
এবার শরীর আমার একেবারে প্রাকৃতিক-মানুষের মতন
মানুষ থেকে মানুষের দূরত্ব
একেকটা দীর্ঘশ্বাসের সেতু
সরু এবং দীর্ঘ আর কম্পমান।
শিক্ষাকার্যক্রম
একজন আবহাওয়াবিদ রাষ্ট্রের নিরাপত্তা রক্ষায়
গোপন করছেন ঝড়ের পূর্বাভাস
আর রাষ্ট্রবিরোধী কোষগুলো ঝড়ো বাতাস থেকে বালু জমিয়ে
গোয়েন্দা চোখে ধুলো ছিটাবার কৌশল রপ্ত করে নিচ্ছে
জলোচ্ছ্বাসের চূড়ার ফেনায় দেখলাম— এক কাগজের নৌকার কাছে
তার পরাজয়ের গর্জন, আমি সাবানের ফেনায় ঘষে উঠাতে চেয়েছিলাম
রক্তমাংসের নোংরামী— অথচ শুধু চোখ জ্বালা করছে এখন
তোমার সাথে সংঘাতময় একটা উপত্যকায়
শান্তির পতাকার ছায়ায় বসে—আমাদের পরবর্তী সংঘর্ষের নকশাটা
মুখস্থ করলাম একে অপরের ঠোঁট কামড়াতে কামড়াতে
অক্ষর পচার গন্ধে বমি করে দিয়েছিলাম ক্লাসরুমে—
আমার বমির মধ্য থেকে এক পরোপকারী বাদুড়
দৃশ্যময় রাতের শিক্ষা দিয়ে সে যাত্রা সেবা করেছিল
রাতের দৃশ্য এসে থামে ভোরের সমুদ্রের সামনে—দেখি
উপকূলের বাসিন্দারা বাতাসের নাড়ী টিপে জেনে নিচ্ছে ঝড়ের পূর্বাভাস।
রক্তবৃত্ত
এক ফোঁটা রক্তের ভেতরে দেখি
রীতিমতো এক নদীর আস্ফালন
যা খুশি লেখার মতোই তার স্রোত
মোহনার দিকে যায় না কখনই
এক ফোঁটা রক্ত জমাট বেঁধে আছে টেবিলে
আমি তার মালিকানা চিহ্নিত করতে ব্যর্থ
আঙুলের কাটা দাগ ভেঙচিয়ে শরীরে শুধু
ব্যথার স্মারক উপহার দিয়ে যায়
আমার রক্তের নাশকতাময় একটা প্রবাহ
ফোঁটায় ফোঁটায় নদী বইয়ে দিতে চায়
আমি বাধ্যগত, ছুরি চালাই-ব্লেড চালাই
দেখতে দেখতে টেবিলময় রক্ত ফোঁটা ফোঁটা
দেখতে দেখতে রক্তবৃত্তে নদীর দাপাদাপি
হুলস্থূল টেবিলটাতে উল্টে পড়ে থাকি।
প্রশ্নগুলো সহজ আর উত্তরওতো জানা
জেগে উঠে লক্ষ বছর পর পথ হাঁটি
পথে পথে আমারই পেতে রাখা গ্রেনেড
বিস্ফোরণে উড়ে যায় যদি পা- ভূমি থেকে
উপরে, তবে উটপাখি জীবনের
অভিশাপ থেকে মুক্তি পেয়ে যাবে, আমারই রক্তক্ষরণে।
প্রতিটি যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে
ময়দান থেকে কুড়িয়ে রাখি
পরিত্যক্ত মনুষ্য হৃদয় আর
ডানাহীন কিছু পাখির পালক
এখানে জয় পরাজয় নেই
নিহত সকলে ভিড় করে আসে।
বিভ্রম ফুরিয়ে যাওয়া শূন্যতা নিয়ে
মৃত মানুষের চোখ কেন এত চেয়ে থাকে পৃথিবীর দিকে?
হাসপাতাল
এই পৃথিবী এক গোপন হাসপাতাল
আমি তার রোগী ডাক্তার ও নার্স!
মানুষের দিকে তাকালে শুধু হাসপাতাল দেখি-
রোগী, ডাক্তার ও নার্স সমেত একেকটা
গভীর হাসপাতাল জামাপ্যান্ট পরে গোপনে চলাচলরত।
অনেকদিন পর জানলাম, এটাই
আমার একমাত্র পরিত্রাণহীন রোগ;
তবু গোঁয়ারের মত—
শরীরে রোদের ইনজেকশান নেই
যখন চেতনা আমার অস্ফুট সেবিকা।
রোদকে বলি— তুমি আরো তীব্র হও
চেতনাকে বলি— তুমি হয়ে ওঠো ধারালো
আলোক-ছটায় ছুরিটাই চমকালো
ছুরি দিয়ে কাটি বুক কাটি পা কাটি হাত
যখন আমিই আমার রোগী ডাক্তার ও নার্স।
একটা গাছের কনফেশন
মরা গাছ, অপেক্ষায় আছি কুঠারের।
সবুজ ছিলাম, জীবিত ছিলাম
ডালে ডালে পত্র পল্লব আর শোভিত কুসুম ছিল
ছিল পাখিদের নিত্য আনাগোনা
আমারই কোটর হতে শীতঘুম ভেঙে
এক সাপ নেমে যেত জনপদে
আমার কাণ্ডের এক পাশে
প্রেমিক চলে যেত প্রেমিকার দেশে
তাদের শীৎকারে
ওপাশের নিঃসঙ্গ যুবকের চোখে
জ্বলে উঠত তারা, স্খলনের ঘুম।
মরা গাছ, অপেক্ষায় আছি কুঠারের।
শুনেছি সেই নিঃসঙ্গ যুবকটি এখন জ্বালানি কাঠ বিক্রেতা
শহর বন্দর হতে মৃত গাছ খুঁজে নিয়ে যায়
শুনেছি সেই প্রেমিক যুগল এখন
দাম্পত্য কলহ সেরে প্রতিদিন
পাশ ফিরে শুয়ে থাকে সারারাত, সঙ্গমরহিত।
এখন মরা গাছ, অপেক্ষায় আছি তোমাদের
হে যুবক তোমার নিঃসঙ্গতার কুঠার নিয়ে এসো শেষবারের মতো
আমাকে কাটো, ব্যবচ্ছেদ করো, করে তোল সার্থক জ্বালানি
অবশেষে পৌঁছে দাও সঙ্গম রহিত সেই দাম্পত্য উনুনে...।
সিনেমার ঘোড়া
এক ছুটন্ত তেজী ঘোড়া শুধু দাপিয়ে বেড়ায়
তার তেজস্ক্রিয় নিঃশ্বাসের লু এসে লাগে নাকে মুখে
তার খুরধ্বনি শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ি
দারুণ ঘোড়দৌড়ের অভিঘাতে ঘুম ভাঙে
অথচ সওয়ারতো দূরের কথা
তার নাগালই পাই না কখনও, তবু
বেশ টের পাই চোখ থেকে কচলে ঘুম ওঠাতে ওঠাতে
খুরধ্বনি আমাকে কেন্দ্র রেখেই পরিধি বাড়ায়...
সব কিছু ম্রিয়মাণ হয়ে গেলে—
সিনেমার ঘোড়াগুলোর কথা মনে হয়
-ওরা রেলগাড়ি ধাওয়া করে
নায়ককে পৌঁছে দেয় নায়িকার কামরায়...
আমার ঘোড়াটি কি তবে সিনেমায় চলে গেলো!
কিন্তু তা কি করে হয়, আমার মাথায় তো এখনো
ছুটন্ত খুরের আঘাতে ধুলার ঝড় বইছে....
তবে কি খুলির ভেতর শ্যুটিং ইউনিট
তবে কি খুলির ভেতর গান পাউডার মারমার কাটকাট
তবে কি খুলির ভেতর রেলগাড়ি ধাওয়া করে ফেরা
তবে কি খুলির ভেতর নায়ক নায়িকা ক্রন্দন
তবে কি খুলির ভেতর ভিলেনের অট্টহাসি
তবে কি খুলির ভেতর একটা ঘোড়দৌড়ের মাঠ।
নৈঃশব্দ্যের সেতু
তোমাকে সেতুর উপর দাঁড়ানো দেখে মনে হলো
প্রতিটা মানুষই সান্ধ্য ভাষায় নির্মিত একেকটা সেতু
যার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে দারুণমুখরব্যাকুল দরিয়া
আর সেতুটি নৈঃশব্দ্যের শব্দার্থে চলে যাচ্ছে...
আমিও যেইমাত্র একটা সেতুর উপর উঠে পড়েছি, তক্ষুণি
আবহাওয়া অফিস থেকে বিপদসংকেত পাঠাচ্ছে
সেতু নড়ে উঠছে, আমি তাতে চড়ে উঠছি; উঠতে উঠতে
জলোচ্ছ্বাসে ভেসে যাওয়া একটা সেতুর নিস্তব্ধতা টের পাচ্ছি
তুমি কি এখনও দাঁড়িয়েই আছ—
সান্ধ্য ভাষায় নির্মিত একটা নৈঃশব্দ্যের সেতুর উপর।
অন্যপৃথিবীর ঈশ্বর
গণিতে তুমি শূন্য, দর্শনে নিখোঁজ
ধর্ম তোমাকে নিষিদ্ধ করেছে
এবং তোমার কোন ইতিহাস লেখা নাই
তবু
বেদনা অবলুপ্ত হলে ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে সুর
বেদনা অবলুপ্ত হলে ক্যানভাসে ফুটে ওঠে রং ও রেখা
বেদনা অবলুপ্ত হলে আঙুল বাদ্যযন্ত্রে মেতে ওঠে মূর্ছনায়
তুমি এই পৃথিবীর কুশলী যাদুকর
তুমি জন্ম নিয়ে মৃত্যুদণ্ড দিলে, নিজেরই
তোমাকে স্বীকার এবং অস্বীকার কোনটাই করা যায় না
তুমি মৃতদের মধ্যে জীবিত, জীবিতদের মধ্যে মৃত
তুমি এই পৃথিবীতে বসবাসকারী অন্যপৃথিবীর ঈশ্বর
শববাড়ি
মৃতদেহ ঘিরে কতগুলো মুখ ভিড় করে থাকে
পরিচিত, অপরিচিত, শত্র“, মিত্র, আরো কত কত মুখ
মৃত লোকটিকে আমার তখন মনে হয় ভেঙে যাওয়া আয়নার পারদ
আর সব মুখস্থ ভিড়ের মুখগুলোকে মনে হয় ভেঙে যাওয়া আয়নার
ছড়িয়ে থাকা কাচের টুকরো
এইতো গতকাল সন্ধ্যায়ও মৃত লোকটির মুখোমুখি দাঁড়ালে
তারা ঠিক ঠিক নিরূপিত হয়ে যেত
পরিচিত, অপরিচিত, শত্র“, মিত্র, আরো কত কত...
মৃতদেহ ঘিরে আজ শুধু কতগুলো মুখ ভিড় করে থাকে
একজন পিঁপড়া, একটা কবি এবং...
চায়ের কাপে ভাসমান মৃত পিঁপড়ার মত নিস্পৃহতায়
ল্যান্ডস্কেপে ঝুলে আছে কুয়াশার আভাসে সুদূরের গ্রাম
সেই ছবির ভেতর দিয়ে শেষাবধি গিয়ে, দেখি—
নিরঙ্কুশ আলো ও অন্ধকার উভয়েই
ক্রমঅপসৃয়মান
প্রতিদিন, প্রতিক্ষণ...
চারদিকে জ্বলে ওঠে, নিভে যায়, ফের
জ্বলে ওঠে, নিভে যায়... দিকনির্দেশনা
আর প্রহরীর তীব্র হুইসেল; তথাপি আড়ালে আবডালে
কিছুটা প্রকাশ্যে রক্তে পৌঁছে যায় চিনির চোরাচালান
তাই বলি কি—অন্ধকারের রঙ নয় কখনোই কালো
যেমনটি সাদা নয় আলোর প্রকাশ...
নিছক কিছু সময়ের ব্যবধানে আরো কিছু সময়ই চলে যায়...যেতে পারে
অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় আগতদের মত নিঃশব্দ উচ্চারণে বলি—
“আহা নেহায়েৎ পিঁপড়ে, তোমাকে হত্যা করতে চাইনি কখনোই
অভ্যাসবশত চা পান করতে গিয়েই তোমার সাথে পরিচয়।
সম্পর্কের নির্ণয়ে দুজনেরই প্রয়োজন এসেছিল চাহিদা মাফিক”
তখন আমার চোখের কোনায় জমে ওঠে জল
নিজেকে মনে হয় মহাজীবনের এক হালকা উপাদান...
আর ঘুমন্ত আমার কানের ভেতর দিয়ে চলে যায়
পিঁপড়ার সারিবদ্ধ তীর্থযাত্রা
স্বপ্নেরা বিলাপ করে দুঃস্বপ্নের ঘোরে—
“পৃথিবীতে একমাত্র কবিরাই
যীশুর মত নিষ্পাপ আর জুডাসের মত বিশ্বাসঘাতক”।
কনফেশন-১
(উৎসর্গ : জীবনানন্দ দাশ)
সব কিছু জানা হলে পর—ক্লান্তির নিরলস প্রান্তরে
সব কিছু অজানা মনে হয়, এমনই অসহায় আজ মনুষ্য মজলিস
তেমন উচ্ছ্বাস নেই আর শুধু হৃদয়ের অন্ধকার
বের হয়ে পড়ছে ক্রমশ—আমি তারে আলোকিত উদ্ভাস ভেবে
সঙ্গে নিয়ে শুয়ে থাকি চাদরের উপর
অনেক অনেক দিন শুয়ে শুয়ে থাকি—যদি কোনদিন
সময়ের আঘাতে একটি ছিদ্র খুঁজে পায়
আলো আসবার আমার নিষ্পলক চোখের দরজায়, তবে
স্বপ্নের পাতা দিয়ে মুদিতাম চোখ
অযুত স্বপ্ন দেখে জেগেছি নিযুত দুঃস্বপ্নের ঘোরে, এ যেন
সেই অব্যর্থ নার্সিসাস নিয়তি তুমি যাকে পার না এড়াতে
বরং এড়াতে গিয়ে জড়িয়ে ফেলার মত ভুল
আমি সাথে নিয়ে বাঁচি সাথে নিয়ে মরি
জীবনের সুতীব্র অনুশোচনায়—
তোমাদের চেনা হয়ে গেলে কেমন যেন অচেনা মনে হয়।
জীবনানন্দ দা, তোমাকেই চুপিসারে বলি
শীতনিদ্রা রহিত এ প্রলয় বিক্ষুব্ধ নিঃসঙ্গতায়
আমিও হাজার বছর হেঁটে, গিঁটে গিঁটে ব্যথা আর
বিতৃষ্ণা নিয়ে পথের চলার কত ধুলোবালি মেখে
দেখি সমান্তরাল আরো এক পথ-যে পথে ঢের হাঁটা হয় নাই।
আজ তবে দৃশ্য বদলের মত করে অদৃশ্য হয়ে যাই
যেখানে কেউ নাই—কেউ নাই ফাঁকা— তবু তো ভারি কোন
ঘড়ির কাঁটা এসে নিস্তরঙ্গ ভাবে
বৃদ্ধের সঙ্গী হয়ে ফুটে ওঠে মুখের বলিরেখায়।
এরকম কোন কোন দিন কোন কোন রাত
চুপচাপ শিশিরের সাথে ঝরে পড়ে অথবা একটি বৃক্ষ ছেড়ে
আরো কোন সঠিক বৃক্ষের দিকে রাতজাগা পাখিদের ডানা
ঝাপটিয়ে ওড়ে—সেই সব মুহূর্তগুলোয় খুব বেশি মনে হয়
এখন অনেক রাত পৃথিবীর বুকে।
একোন বিনিদ্র নেশায় মগ্ন থেকে
ঘুমের প্রশান্তি মনে করে জেগে আছো ‘দীর্ঘদিবস-দীর্ঘরজনী’
হৃদয়ের গিটারের সুর চিরদিন বেজে ওঠে বেদনা বিধুর
কেউ তার নোট খুঁজে আঙুলে বাজাবে না
এরচেয়ে দেখ শুকতারা জ্বলে আছে ঐ
জ্বলনে এমন সুখ কেউ বোঝে নাই।
বিগত রাতে আমি শীতের নিকটে নগ্ন হয়ে
সকালের রোদে বুঝতে চেয়েছি শীতলতা
বিলোড়িত কামুক চেতনায় দারুণ অবদমনের জাল ছিঁড়ে
বারংবার দৌড়ে গিয়েছি বাঈজীবাড়ি
তবু পৃথিবীর সেই সব নারীর রূপ ঢের দেখা হয়ে গেলে
আরো একবার দেখার সাধ সুপক্ব ফলের মতো
আমার নির্ঘুম দোসর হয়ে থাকে।
কনফেশন-২
(উৎসর্গ : মলয় রায় চৌধুরী)
গত গ্রীষ্মে এক সুন্দরীকে কবিতার বই দিয়ে হাওয়া নিতে দেখে
এবারের শীতে কবিতার অক্ষরে ফুঁঁ দিয়ে দেখছি আগুন ধরানো যায় কিনা
নিহত এবং হত্যাকারী উভয়েরই ব্যক্তিগত পরাজয় থাকে
রোদের বুদ্বুদের ভেতরে যেমন থাকে গভীর অন্ধকার
নিজের আঁতুড় ঘর খুঁজতে খুঁজতে গোরস্তান পর্যন্ত চলে গেলাম
সহোদরার জন্মদিনে মৃত্যুকে অনেক মহান মনে হয়
একটা নপুংশক ক্ষত হতে বেড়ে ওঠা ফোঁড়ায়
কলোনি গড়ে তোলে ক্যান্সারের জীবাণু
বরফ চিবানোর কালে মুখের মধ্যে আগুন জ্বলে ওঠে, আর
সেই আগুন গোপন পথে চালান করে দিলাম পাকস্থলির দিকে
আজ এবং গতকালের সাথে
অমীমাংসিত ভাবে মিশে যাচ্ছে আগামিকাল
প্রত্যেকেই অদৃশ্য ছুরি হাতে নিয়ে
সকলের দিকে নজর রাখছে ঝাঁপিয়ে পড়বে বলে
অবদমন
দাবদাহের ভেতর আবিষ্কার করলাম প্রিয় শিশ্নটি
মোরগের বিচ্ছিন্ন ধড়ের মতো কাটা—লাফাচ্ছে
যখন অসংখ্য প্রেতযোনি উড়ে যাচ্ছিল মাথার উপর দিয়ে
পৃথিবীর করুণ কামুক চেতনায়
প্রান্তরের যাবতীয় দূর্বাঘাস উপড়েও
কোন যোনিদেশ খুঁজে পেলাম না।
দ্য ট্রেন
পথের মধ্যে বিরাম চিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা
কয়েকটা বিকাল আমার দেখা হয়ে গেছে
বিরতিহীন রাত্রির ট্রেন ধরব বলে বসে আছি সম্পর্কের জংশনে
ট্রেন এসে গেলে পর; আমি তার একমাত্র অপেক্ষাতুর যাত্রী
ব্যাগ ভর্তি ঘৃণার সরঞ্জাম, পায়ে নিঃসঙ্গতার জুতা...
ঘুম ভাঙতেই দেখি, চাদরে ট্রেনের চাকার দাগ
বিছানা থেকে নেমে সেই ট্রেন খুঁজে বেড়াই
বউকে জিজ্ঞেস করি; রাতে কোন হুইসেল শুনেছে কিনা
সে বলে, তার প্রতি সকালে ট্রেন ধরতে হয় তাই সে রাত্রি জাগে না।
তেপান্তর
মাথার ভিতর বেড়ে চলে ঘাসহীন মাঠের বিস্তার
চলচ্চিত্র
কিছু মানুষ খুন হয়ে যায়, আর
কিছু মানুষ আড়ালে হাত ডলে রক্তের দাগ ওঠায়
কুয়াশার বেরিকেড আর শীতের কাঁটাতার পার হয়ে
আজ দিন
কে কোন ভূমিকায়—
পকেটে অনিশ্চত পয়সার স্ক্রিপ্ট
শীতকালের রাতগুলো দীর্ঘ আর গভীর হয়ে যায়
দৈর্ঘ্য আর গভীরতা নিয়ে সন্দেহবশত
হত্যা, কুয়াশা আর শীতের ভূগোলে
এক রক্তের নদীর তীরে এসে থামে সকল কোলাহল—
দূরত্ব কতটা দীর্ঘ হলে পর সীমান্ত গভীর হয়ে ফুটে ওঠে করপুটে
চূড়ান্ত দৃশ্যের আগে নিহত ও হত্যাকারীর গভীর প্রণয়
দ্রাঘিমার প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শিত হচ্ছে চলচ্চিত্র
কে তার চিত্রনাট্যকার
কে তার পরিচালক
আর কে কোন ভূমিকায়।
সাঁকো
কুয়াশার সাঁকো পেরোবার কালে
বড্ড ঘুম পেয়ে যায়
ঘুমের ভেতর একটা মাঠকে
কোলবালিশের মতো জড়িয়ে ধরি
সেই ঘুমের মধ্যে সেই মাঠের মধ্যে
আমি দিগ্বিদিগ—চতুর দিক
সেই মাঠের উপর
এই পৃথিবীর আসল স্বাদ নিয়ে
রোদের বল খেলছে কয়েকটা কাছিম আর
খরগোশের গায়ে আরামে চোখ মুদে ঘুমিয়ে পড়ছে রোদ
ইতিমধ্যে আমি হারিয়ে ফেলেছি জেগে উঠবার পথ
ওদের পার হতেই মাঠ ফুঁড়ে দাঁড়িয়ে পড়া
অবদমনের বাঁশঝাড় আমাকে
দিকনির্দেশনাময় প্রান্তরের দিকে নিয়ে যায়
আর আমি জেগে উঠি সাঁকোর কিনারায়।
সারাদিন আমি গন্তব্যের দিকে হেঁটে হেঁটে
একটা দীর্ঘ সাঁকোর কিনারায় এসে
গোধূলিতে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ি।
ক্রোধ
এক অন্তরঙ্গ ক্রোধ আমাকে বাঁচিয়ে রাখে
আর রাখঢাক খেলাধুলা করে
অমীমাংসার জলে অলৌকিক সাঁতার শেষে
জল তৃষ্ণা পেয়ে গেলে দেখি—
কুয়োর ভেতর বোতল বন্দি এক রাজকন্যা ইশারাময়।
আমি যতই অনুবাদ করি—
অমীমাংসার জল, অলৌকিক সাঁতার, কুয়ো, বোতল, রাজকন্যা,
ইশারা সব; সবই তৃষ্ণা হয়ে যায়।
জীবনের অযুত আয়োজন ভাবনায় ভর করে
অবশেষে নেমে আসে অর্থহীনতার বাঁকে
বাঁকে বাঁকে সংঘাত আর সন্ন্যাস যুগপৎ ইশারাময়।
আমি, না-জড়াব সংঘাতে না-হব সন্ন্যাসী ভেবে
সংঘাত ও সন্ন্যাস নিয়ে মরে যেতে চাই,
শুধু এক অন্তরঙ্গ ক্রোধ আমাকে বাঁচিয়ে রাখে।
কালসাপ
একটা জাতিস্মর সাপের ভয়ে
তোমাকে চলে যেতে হবে সন্ধ্যা অবধি
আঁধার নামলে যে যার মুখ লুকিয়ে
প্রবেশ করবে একই গহ্বরে
বিষ দাঁত লুকিয়ে তোমাকে পেঁচিয়ে ধরবে সরীসৃপ আদর
আর তুমি ভয়কে জয়ের নেশায়—
প্রিয় সাপ বলে আঙুল বোলাতে গিয়ে
জড়িয়ে যাবে হিস হিস বিষের ঘোরে
পরদিন গর্ত খুঁড়ে, তোমাকে না—
খোলস পাওয়া যাবে।
পথ
১.
বহুকাল স্টেশনের পাশে একটা পথ পড়ে আছে
পথিকেরা যারা চলে গেছে
বৈশাখ দুপুরে তালপাখা হাতে নিয়ে
তারা ঠিকঠাক পৌঁছে যায় একই ঠিকানায়
ফিরতি পথে প্রতিদিন একটা ভুল পথ হয়ে
সারারাত তারাদের সাথে নিয়ে পথ খুঁজে মরি
ভোরে ঠিকঠাক বেঁচে উঠি
স্টেশনের কাছে নিরাপদ
ভুল পথ হয়ে পড়ে আছে
আমার শরীর দিকনির্দেশনাহীন
আমি প্রতিদিন একটা পথ
হারিয়ে যাওয়া ছেলেটির পায়ের কাছে
২.
এই পথে রক্ত ঝরাতে ঝরাতে যারা গিয়েছিলো, তাদের
কেউ কেউ রক্তের ঘ্রাণ শুকে শুকে ফিরে গেছে
যারা ফিরে গেছে আর যারা চলে গেছে
উভয়েরই দেখা হয়ে গেছে—তবু
কেউ কারো আর মুখ চেনে নাই
তারা মিলেমিশে থেকে গেছে অপিরিচিতের মতো
আমি কোথাও যাব না।
আমি ফিরবও না।
আমার শুধু চোখাচোখি হবে পথ আর পথিকের সঙ্গে
বর্ণপরিচয়
সারাদিন বসে বসে কাটিয়েছি দিন
দিন কাটে নাই, শুধু
আমি রক্তপাতহীন কেটে দু’ভাগ হয়ে গেছি
আর আমার ভেতর থেকে বেরিয়ে গেছে—
বিগতদিন, দিনের আলোক সম্ভাবনা নিয়ে
রাতের দিকে ক্রমাগত হেঁটে যাওয়া
রাতের গভীর থেকে একটা ব্লেড এসে
জড়িয়ে ধরত আমার শরীর
আমি তাকে ঠোঁটে নিয়ে দৌড়ে গিয়েছি সকাল বরাবর
প্রতিটি সকাল আমার দিকে রক্তচক্ষু তাকিয়ে থাকতো
যেন হেডমাস্টারের নালিশ শুনে বাড়ি ফিরে
আমার অপেক্ষায় বসে আছেন বাবা
আমি থমকে যেতাম আমার মার্বেল নিয়ে বাবার সামনে
আমি মুখের মধ্যে রক্ত লুকিয়ে দুপুরের দিকে চলে যেতাম
আমি সারাটা দুপুর পুকুরে ডুব দিয়ে থাকতাম
গোধূলিতে জেলখানার দেয়ালে কান পেতে শুনতাম
এই পৃথিবীর কয়েদীদের গান
পরে বুঝেছি তা ছিল কান্না
যাপন
একদিন জুতোর ফিতে লাগিয়ে পায়ের কাছে
চলে যাবার নির্দেশ পৌঁছে যাবে তাই
সাবান পানিতে গুলে মোজাটা ভিজিয়ে রাখি
প্রতিবার নিহত হবার পূর্বে
হত্যাকারীর প্রতি আসক্তি চলে আসে
আত্মহত্যার চেয়ে অধিক নেশা করিনি কখনো
সর্বত্র জলে ভেজা কারবার আমাকে
জলজ করে তোলে, ভিজে যাই
যে কোনো তরলে—রক্ত অথবা মদ
অথবা এই পৃথিবীর ল্যাজারসে...
প্রতারক ডানায় ভাসি
ডারউইন পরে থাক সেলফের কার্নিশে
অস্ফুটে পরিস্ফুটিত সমস্ত গোলাপের সুঘ্রাণ বুকে নিয়ে
কারা যেন পালাবার কথা ভেবেছিল
প্রতারক ডানার কৌশলে কাটে না বাতাস
আমার সন্ধ্যার প্রেমিকারা এখন কোথায়
যখন রাত্রি নামছে চাঁদ উঠছে
প্রকট হচ্ছে আমার জীবন সম্পর্কহীন
কর্মক্ষম মানুষেরা গোধূলিতে বাড়ির দিকে ফিরলেও
মানুষের সকল পদচারণা গোরস্থানের পথেই হাঁটে
অন্ধকার প্রকোষ্ঠে কেন জ্বলে ওঠে শব
ওরা কি সন্ধ্যাবাতির অভাব বোধ করে মরে গিয়েও
আমি কোন এক অমীমাংসিত দ্রাঘিমা পেরোতে গিয়ে
মুঠো মুঠো সুইসাইড খাই ঠাণ্ডা পানিতে গুলে
অতঃপর জীবন ঘনিষ্ঠ ঘুমে
খুঁজে না পেয়ে স্বপ্নের রঙ
জেগে উঠে একা একা
দৌড়াতে দৌড়াতে
নগরীর একমাত্র মদের দোকানের সমস্তটা উপুড় করে দিই
আর দেখি রঙের মিশ্রণ
আর শুনি বাঙময় পৃথিবীর মাতাল কথোপকথন
কোন শব্দই কোন অর্থ তৈরি করে না
কোন রঙ তৈরি করে না বৈচিত্র্য
উহারা স্বাধীন
যতক্ষণ না তোমাদের জ্ঞান আরোপিত হয়
অর্থহীন কোরাস তৈরি করে অব্যর্থ বধিরতা
ভীষণ ইন্দ্রিয়প্রবণ হয়ে উন্মুখ চেতনায়
মৃত্যুর দরজা থেকে ফিরে আসা মানবের অলিখিত
সংবিধান মনে রেখে
কিছুকাল ঘুমাতে চাই বিছানায় শুয়ে
ডানা দুটো খুলে রেখে পাশে।
স্বগতোক্তি
তুই ছাড়া তোর ঘর এত তোরময়!
যন্ত্রগুলো অন্যদেরকে তাদের কত কাছে এনে দিয়েছে
টাওয়ার উঠেছে ঐ তোদের বাড়ি যাওয়ার পথে
আমারই শুধু দূরত্ব কমে না
তুই কোথায় থাকিস— কোন পৃথক সার্ভার
জমা করে রাখে তোর মেইলবক্স
আমার যাবার পথে লাগাতার হরতাল ডেকেছে বিরোধী দল
অনাদিকাল তাই যোগাযোগ হয় না দোসরা শালিক
কিছু লোক নীরবতায় মুখর থেকে
নিহত হয়ে ফিরে আসলো, বিলাপের কোরাসে
পরিত্যক্ত ক্লাসরুমে চকের গুঁড়োর মত
উড়তে থাকি ডাস্টারের শিল্পে
শিক্ষা
বাঁশি কি বাজাচ্ছো এখনো?
আমি বাজাতে পারি না।
সেই কাছের মেয়েটির মতো
কান্নায় কি সুর তোল আপন মনে?
আমার কোন সুর নাই
বেসুরো জীবন বাজে না কোনো ক্যাসেট প্লেয়ারে।
আমার জন্য অন্যদের কষ্ট দেখে
আজ আমারই দুঃখ হচ্ছে খুব।
কী হবে আমার, যখন
পৃথিবীর কোন জাদুকরী বিদ্যাই শিখতে পারলাম না।
কিরূপে ভুলিব ভোলাব তব পৃথিবীর মন ও মনীষা
না আমি বাজাবো বাদ্য না আছে সুর।
জলদাস
গভীর কিছু মাছ সাঁতার কাটে আমার শরীরে
শরীর খুলে দেয় তার স্রোতময় গোপন স্বভাব
বাঁধ ভেঙে তাদের গড়িয়ে যেতে দেই
মোহনার দিকে; কিছু কিছু কোষের আছে
জেলের স্বভাবে ওঁৎ পেতে থাকা, স্রোতের কিনারে...
কী আর করি আমি... আমার ভেতরেই দেখি এসব ঘটে
স্বভাবে কিছুটা জেলে বাকিটা মাছ
যাকে শিকার করি—আমিই তার অবাধ বসবাস।
যেইসব কারণে গতরাতে—ওভাবে ঘুমোলাম
মৃত্যুর মত বিতৃষ্ণা শুয়ে আছে বিছানায়
পরজীবীদের সারিবদ্ধ বিশৃংখলা চোখে আঙুল দিয়ে
শৃংখলা শেখাচ্ছে আর যীশুর চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া
রক্ত পান করে দৃষ্টি ফিরে পাচ্ছে চক্ষুষ্মান মানুষ
নিহত এবং হত্যাকারী দুজনকে একই রাস্তায় হাঁটতে হয়
বহুকক্ষে ঘোরে না পৃথিবী
আমি দাঁড়িয়ে দেখে শিখে নিচ্ছি—
নিহত হবার এবং হত্যা করার কৌশল
নিজের হত্যাকারী হয়ে খুঁজে যাচ্ছি নিহত আমাকে
গেরিলার পায়ের সাথে নিজেকে বেঁধে ইতিহাস পার হচ্ছি
জুবেরী’র পাসপোর্ট সাইজ ছবি হাতে নিয়ে
বিব্রতবোধ করছি, নিজেকে সত্যায়িত করতে না পেরে
টিকেট না কাটা যাত্রীর অপরাধবোধ নিয়ে
ভ্রমণ করে বেড়ালাম দিনমান
দর্জির দোকানে গিয়ে মাপমতো পোষাক না পেয়ে
ন্যাংটো হয়ে ঘুরে বেড়াতে হলো সারা শহর
সরকারি ভবনগুলোর জানালার কাচ ভেঙে
আমার চোখে বিঁধে যাচ্ছে— নালী কেটে
গড়িয়ে পড়ছে লিউকেমিয় সাদা রক্ত
মেরে থেঁতলে আমাকে
চালান করে দেয়া হলো ফরমালিনের জারে
যে কোন স্থানীয় মর্গে শিক্ষার্থীর হাত শিখে নেবে
পরিচয়হীন পৃথিবীর প্রকৃত ভূগোল
বিষ পিঁপড়ের ঢিবিতে জন্মে বেড়ে উঠলাম
শিল্পের ছালা হাতে যারা মোহর কুড়োতে নেমে
শিলাবৃষ্টির আঘাতে নিহত হলো, ওদের
সুস্বাস্থ্য কামনায় সক্রেটিসের গ্লাসে গ্লাস ঠুকে
সারারাত বেঘোরে ঘুমোলাম
মৃত্যুর মতো বিতৃষ্ণা নিয়ে।।
মুদ্রাদোষ
আমি লেট করে যাবো আমার ফিরতেও লেট হয়ে যাবে
হাজিরা খাতা ভরে উঠতে থাকবে শুধু লাল কালিতে
তোমার কব্জিতে কী শান্ত সমাহিত সময় বেঁধে রেখেছ
আমারও ছিল বটে একসময়; দূরপাল্লার বাসে যেতে যেতে
খোলা জানালায় হঠাৎই মহাকাল থেকে উড়ে এসে এক পাখি
ঠোঁটে করে নিয়ে গেছে আমার সময়
মাঝে মাঝে রাতে প্রাচীন সেই মাতামহী তিনবার ডেকে ওঠে
আমারও তখন ঘুম থেকে জাগবার সময় হয়েছে যেন
আর ঠিক সেই মুহূর্তে বধিরতা ভর করে
বুকে হেঁটে চলা মানব মানবীর গৃহকোণগুলো ঘিরে
আমি শুনি নীরবতা, শীতের ঝরাপাতারা আসে
ফিসফিসিয়ে বলে;
ওদের হরিৎ উৎসব হবে— তোমার কংক্রিট শহরে...
তোমার স্মৃতির পালক দিয়ে বড়জোর কান চুলকানো যায়।
দূরত্ব
(ড়য ংরংঃবৎ,
যিবহ ও পড়সব ঃড় ষরব রহ ুড়ঁৎ ধৎসং
ুড়ঁ ংযড়ঁষফ হড়ঃ ঃৎবধঃ সব ষরশব ধ
ংঃৎধহমবৎ...)
—নড়ন ফুষধহ
গৃহবাসী আতঙ্কে থাকে
কদাচিৎ যাই কখনও ওখানে;
দেয়ালে আতঙ্কের রঙ, ক্যালেন্ডারের প্রতিটি তারিখ আতঙ্কের দিন
জানালার পর্দা ফ্যানের বাতাসের আতঙ্কে ওড়ে ঠিক কিশোরীর মতো,
বিছানায় শুয়ে থাকে একঘেয়ে আতঙ্ক
নারীর গর্ভে জন্মে বেড়ে ওঠা নর পৃথিবীতে
ফ্যাক্স বার্তা আসে
প্রেরকের ঠিকানা থাকে না তাতে
বিস্ফোরিত চোখ রহস্যময় বার্তায় স্বপ্ন পড়ে পুড়ে যায়...
আমি তাই যাই না তোমাদের ঘরে
আমিতো নিজস্ব কার্বনে কাচের দেয়াল তুলে বসে থাকি
সেখানে লাল নীল বেগুনি রঙের ব্যবহার
আড়ালে প্রকাশ করে থাকি।।
রেললাইন
উড়তে উড়তে আমারই দরজায়
লটকে গেছে ঘুড়ি, পাশে নগ্নিকা
আছেন জন্মাবধি শবাসনে
যখন যীশুর হাত দুটো কেটে নেয়া হলো
এ গাঁয়ে কখনো রেলগাড়ি আসে না
কিন্তু বালকেরা রেললাইন চেনে
বৃদ্ধরা কোনদিন না দেখেও শিশুদের রেল স্টেশনের গল্প শোনায়
আর মৃতদের দেশে রেল যোগাযোগই নাই
শীতকালে কেন প্রলম্বিত হয়ে যায় রাতের প্রহর
ডায়ালে ঘূর্ণায়মান কাঁটা বন্ধ রেখেই সময় মেপে নেই
ভয়, পাছে রাতের বড়ত্ব যদি টুকরো টুকরো হয়ে যায়
অনেক সময় নিয়ে ধীরে ধীরে শেকড়ের প্রকৌশলে
চলে যাবো—হে মৃত্তিকা হে ব-দ্বীপ তোমার গভীরে।।
সম্পর্ক
ম্যাচ বাক্স খুলে দেখি—বারুদবিহীন শব
এবে রাতে আমি কিভাবে জ্বালাবো সিগ্রেট
চিতায় যতখানি অগ্নিভূক তুমি; ততখানি আমি
এরচেয়ে অযাচিত বদলে যাবার নেশায়
যে যার ভূমিকায় থেকে যাব অনড় অভিমানি
সাপই কাটে না শুধু, কখনো কখনো
সাপও কাটা পড়ে রেললাইন পার হতে গিয়ে
সে তুমি যে দৃশ্যেই থাকো না কেন
এ যাত্রা পলায়নপর—দেখা হবে বার বার।
কচ্ছপের ডানা
আমার সন্দেহগুলোকে পাশ কাটানোর
কথা বললে সে আমাকেই ব্যক্তিগত
সন্দেহের শীর্ষ তালিকায় রেখে গোপনে
আমার সমস্ত গতিবিধির উপর নজর রাখতে থাকে
আমি তাকে প্রশ্রয়ে ছড়িয়ে দিলাম পথে প্রান্তরে
বহুদিন এইরূপ থাকবার পর কাছিমও আড়মোড়া ভাঙে
বুকে ভর দিয়ে চার পা ছড়িয়ে ওড়ার ভঙ্গিতে
পিঠে বয়ে নিয়ে আসে শ্যাওলা পড়া সন্দেহের পালক, তারা
ওড়ে না ওড়ায় না; তারা শুধু কচ্ছপের ডানা
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন