
ইচ্ছামৃত্যু
বছরের হ্রস্বতম দিনে, এই দেহে লিখে রেখে মুক্তি, আমি যাই শীতনিদ্রায় । সময়ের তীর, প্রেম, আর হারপুন এসে বিদ্ধ করুক আমাকে,কিন্তু আমি থেকে যাব প্রতিরোধহীন নিশ্চুপ জ্যোৎস্নার প্লাবিত দিগন্তে, সেখানে উড়ুক পৃথিবীর সব পরিযায়ি পাখি, উৎসারিত হোক তাদের যাত্রাপথের সকল অভিজ্ঞান । কিন্তু আমি থেকে যেতে চাই মুক ও বধির দক্ষিনায়ণের হ্রস্বতম এই দিনে, বরফ-আচ্ছাদিত পৃথিবীর পথে ।
পরিযায়ি পাখিদের ডানায় আবর্তনশীল সূর্য এখন নিরক্ষরেখার অতি কাছাকাছি, আর আমি আছি তার অধিবিদ্যায় ।পরিভ্রমণ শেষে এখন বিষণ্নতা জেগেছে । অসংখ্য যুদ্ধশেষে, আমার ক্ষত আর অন্যায় যেসকল নারী তাঁদের দীর্ঘ চুলে আর করুণায় মুছে দিয়েছিল একাধিক দিন, সেই উজ্জ্বল নারীরা এখন কোথায় ? বোধকরি, তাঁরা আছেবালিয়াড়িময় কোন গৃহে কিংবা জলাঙ্গীর কোন তটে কিংবা বরফ-আচ্ছাদিত পৃথিবীর কোন পথে । হৃদয়ের বিভূতিতে, বোধকরি, তাঁরা আজো জ্বালে মঙ্গলদীপ অন্য কোন গৃহে । সেখানে ওঠুক জেগে প্রেম, প্রাণের প্রাচুর্য, আর বোধিবৃক্ষ । কিন্তু আমি আছি শীতনিদ্রায় ; পরিযায়ি পাখিদের ডানায়, আবর্তনশীল সূর্যের রথে ।
যদি চাই দেহত্যাগ উত্তরায়ণে, তবে আরও একবার অনুভবে বুঝে নিতে চাই পৃথিবীতে চুম্বকের বেগ, রণনীতি, উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের নীচে বাতাসের প্রবাহ, পাতাল ট্রেনে অন্ধ গায়িকার গান, আর অভিমুখ সমুদ্র তরঙ্গের । তবু, মাঝে মাঝে ভাবি, কেন এসেছিলাম এই পৃথিবীর পথে । আমাকে করেছে বিদ্ধ যাঁরা অপূর্ব শরশয্যায়, বোধকরি,আমার অপূর্ণ প্রেম থেকে তাঁরা জাত ।
পরিযায়ি পাখি, দক্ষিনায়ণ থেকে উত্তরায়ণে তোমাদের এক যাত্রাপথ শেষ হ’লে, আমি চাই দেহত্যাগ ; যেতে যাই বিস্মৃতির পথে । তবু, ব্যাপ্ত হোক এ পৃথিবী, যেভাবে হয়েছে ব্যাপ্ত রক্তে, প্রেমে, যুদ্ধে, আর মানুষের যৌথ গানে ।
*নিউইয়র্ক
জানুয়ারি ১৭, ২০০৯
বিলাপ : ১
বরফ আচ্ছাদিত এই পৃথিবী এখন মৌন । হরিণের শিঙে উচ্চকিত শূন্যতায় উত্তোলিত এ মৌনতা এখন ঈশ্বরের । কিন্তু তোমার প্রস্থানে আমি নগ্ন, আমি মৌনতর ।
নগ্নতায় একদিন তুমি ছিলে ফেনায়িত- বিস্তৃত, উজ্জ্বল । আমার দেহের উষ্ণতা নিয়ে তুমি চলে গ্যাছো উত্তর মেরুর কোন দেশে কিংবা সূর্য-বলয়িত অন্য কোন ভূগোলে । শরীরের তাপে, আমি জানি, আজও তুমি আছো উষ্ণ, রংধনুময় উজ্জ্বল । আমার আত্মাকে কতোবার ক্ষত-বিক্ষত করেছ ঠোঁটে, দাতে, আর আশ্লেষে । সব আক্রমণে বর্মহীন থেকে গেছি । তবু ক্রন্দন শিখিনি, যেমন কাঁদেনি তীরবিদ্ধ একিলিস কিংবা শরশয্যায় ভীষ্ম । সকল শরীরজুড়ে এখন পরিভ্রমণতাই ব্যাপ্ত ।
বেণুবন, গিজঝ্কুট, জীবকাম্ববন, আর আপনার প্রিয় নগরী বৈশালী ছেড়ে,তথাগত- আপনি চলে গেছেন বর্ষা অতিক্রান্ত, জ্যোৎস্নায় প্লাবিত মল্লদের শালবনে, আপনার অন্তিতম শয়নে । ভন্তে, আমি আপনার শমনদের মতোভিক্ষাবৃত্তি শিখিনি ; শিখিনি সংঘবৃত্তি । অর্ধঘুম আর জাগরণের মাঝে তবু কে আমাকে ডাকে ? বরফ পতনের শব্দে আমি রাতভর জেগে থাকি ।
এই রাতে নিজেকে আবৃত করেছি শীতবস্ত্রে আর অসংখ্য স্মৃতির ব্লাংকেটে । শীত তবু সর্বাশ্রয়ী, ব্যাপ্ত আমার শরীরে। প্রতিরোধহীন আমি, এই বুঝি আমার স্বভাব । একদিন তুমি এসেছিলে বিক্ষুদ্ধ ঝড়ের মতো ক্রন্দনরতসৌম্যময় আমার শরীরে । আমার উষ্ণতা মেখে তোমার শরীর নিয়ে চলে গ্যাছো অন্য এক আনন্দ-বন্দরে । আমারত্বকে নির্মিত পোশাকে তুমি আবৃত করেছো নিজেকে, কিন্তু আমি আছি নগ্ন, বরফাচ্ছাদিত, মৌন ।
নিউইয়র্ক
ডিসেম্বর ২০, ২০০৮
বিলাপ : ২
ছেড়ে যাই শরীরের পুরানো বাকল, দেহভষ্ম, পূর্বজন্মের স্মৃতি ; তীর, হারপুন ; আর পরিশেষে বেদ ও বাইবেল । যে মমীর প্রাণে হাত রেখে এতোদিন আমি ঘুমিয়ে ছিলাম, সেই হাতে আজ সবুজ ঘাসের স্ফুর্তি, আর সেই অন্ধ কুঠুরিতে এখন গুঞ্জরণরত আবর্তনশীল সূর্যের মৌমাছি । বিষণ্নতার বিরুদ্ধে জেগেছি নগ্নতায়, সমুদ্র ফেনায় উজ্জীবিত আমি ।
যে অনিঃশেষ ক্রন্দন ছিল তোমার, তাকে একদিন আমি এই দেহে গ্রহণ করেছি,এবং তোমার ক্রন্দন হলো আমার । বিষণ্নতা যদিও ক্রন্দনের অবশেষ, অনুভবের শেষ তাম্রলিপি, তবু তাকে আমি কীভাবে এড়াই ? তাই পরিভ্রমণ শিখেছি, কিন্তু ভিক্ষাবৃত্তি গ্রহণ করিনি । তথাগত, আপনার নারীরা চলে গেছে প্রব্রজায় নয়তো অন্য এক আনন্দ-বন্দরে, যেখানে শিশ্নতার অভিষেকই মূখ্য । ভন্তে, দিনশেষে আমার গৃহে জ্বলেনি মঙ্গলদীপ । আমার মন্দির তাই নগরীর পানশালা- সময়ের অস্থির বুদ্বুদ । দেখেছি এখানে সাম্যের ভিত্তি, যদিও চিন্তার ভ্রান্তিই আমার মৌল সত্তা এবং আমার দেহের শেষ অভিজ্ঞান । এখন সমুদ্র ফেনায় উজ্জীবিত আমি ।
এ নগরীর প্রতিটি ধুলিবিন্দু ছিল তোমার দেহের ছায়ায় আচ্ছাদিত । অস্তিত্বের প্রগাঢ় আলোয় আমি খুঁজেছি তোমাকে একদিন । এখন উজ্জ্বল দিন, ফেনায়িত মানুষের অনন্ত প্রবাহে আমি আছি শুশুক আনন্দে । ভন্তে, জন্মান্তরে নির্বাণ যদি সত্য, তবে একদিন আমিও তথাগত । আপাতত চলে গেছে আমার প্রেয়সী, কিন্তু আজও আছে অন্ধ গায়িকার সঙ্গীত আর সাবওয়ের ধাতব চিৎকারে সেই সঙ্গীতের অশেষ বিচূর্ণি । প্রভু, আমি জন্মান্তর বুঝিনি । নারী, যে ছিল আমার প্রেয়সী, প্রকৃত প্রস্তাবে সে কখনো ছিলোনা আমার । মনে নেই পূর্বজন্মের স্মৃতি । আমি আছি এই রাতেরগভীরে, উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের নীচে, উচ্ছ্বসিত অগুনিত সমুদ্র-তরঙ্গে, সন্তরণরত হাঙ্গরের সাথে ।
*নিউইয়র্ক
ডিসেম্বর ২৭, ২০০৮
আত্মপ্রতিকৃতি : ১
.....এবং আমার মা’র মৃত্যু ছিল জলের স্রোতের মতো স্বাভাবিক, তাঁর কান্নার মতো শব্দহীন । যে অবিশ্বাস্য পতনের কাছে আমি মূক আর বধির, সে তো নির্ভার পতন যা ধরে রাখে গোধূলির রং, অনন্তেতর ধ্বনি । মৃত্যু সে তো শব্দহীন, যা ধ্রুপদী সঙ্গীতের মতো রহস্যময় এবং ভালোবাসার মতো ভ্রান্তিহীন । জোয়ারের জলে মা’র মুখচ্ছবি ভাসে, তবু বীরশ্রেষ্ঠ কর্ণের মতো আমি আমার প্রমিতিকে প্রত্যয় করে উৎসর্গ করতে পারিনি ; যুদ্ধক্ষেত্রে অমিমাংসিত থেকেছি । নদীকে কেবলি বিস্তৃত হ’তে দেখেছি সমুদ্রের দিকে, বোধ থেকে গেছে বোধিহীন । অনুভবে সমুদ্রকে জেনেছি, আর দেখেছি নদীর অবগাহনের বেগ, রংধনুময় তার ব্যাপ্তি, আর ব্যাপ্তির উচ্ছ্বাস । বাতাসের প্রবাহ আর মানুষের সঙ্গীত সেই উচ্ছ্বাসেরই দৃশ্যাতীত প্রকৃতি । বরফ আচ্ছাদিত পৃথিবীর পথে স্থাণুর মতো বাইসনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি দীর্ঘকাল ; মনে হয় এইভাবে থম্কে গেছে মহাকাল একবার, উদ্ভ্রান্তিতময় আমার কান্নায় । আমি তো নই কোন প্রেমিক, যে খুঁজে ফিরছে একটি নদী কিংবা একজন নারী কিংবা বৃক্ষছায়ায় আচ্ছাদিত একটি বাড়ি । তবু পাতার বিন্যাস নিয়ে পৃথিবীর এক গৃহকোণে আমার জন্ম । বোধকরি, মা’র পুনর্জন্ম আমার জন্মেরই আর এক ব্যাপ্তি, ব্যাপ্তির প্রত্যয় । কিন্তু আজকাল মা’কে আর দেখিনা ; এবং পথের দিকে তাকালে পথকেও আর দেখা হয়ে ওঠেনা, কেবলি মানুষের মুখাবয়ব ভাসে । মনে হয়, একদিন রথের মেলায় আমিও ছিলাম । এখন রথ চলে গেছে বহুদূর, যেন ধূলিধূসরিত সৌরজগতের আরেক ধূসর বিন্দু । ভোর কী সৌরজগতেরই এক অনিবার্য প্রকাশ না কী মৌমাছির গুঞ্জনে আহ্লাদিত এক পৃথিবী যার সাথে কখনো আমাদের ভ্রান্তির পথে দেখা হয় । পাখিদের ঠোঁটে পৃথিবীর যে জাগৃতি, মানুষের পায়ে যে কোলাহল, বাতাসে যে ব্যাপ্তি, কোন আনন্দে তার অশেষ বিলুপ্তি ? রাত আরও দীর্ঘতর হোক, এই প্রার্থনায় মাঝে মাঝে উজ্জীবিত হয়ে উঠি ; ভাবি : ভোরে ঘুম থেকে জেগে ওঠার চেয়ে অনেকটা সময় ওয়াশিংটন স্কয়ারে ল্যাম্পপোষ্ট হ’য়ে দাঁড়িয়ে থাকি । আমার চোখের পাতায় যদি জাগে কুয়াশা, তবে কুয়াশা হয়ে উঠুক বরফ একদিন, আর বরফ হয়ে উঠুক জল আর জলের প্রবাহ, চেতনায় জাগ্রত কোন বিশ্বে । তবু ভোর হ’লে দেখি কাজের প্ররোচণা আছে । বোধকরি, প্রয়াসও আছে কিন্তু নেই কোন অনুপ্রেরণা । সূর্যের পাখনায় গুনগুন কর্ছে কাল, গোধূলির স্মৃতিতে থেমে আছে মহাকাল । বাতাস ডেকে নিয়ে যায় আমাকে ইউনিয়ন স্কয়ার থেকে ব্যাটারি পার্কের দিকে । এরই মাঝে ভূগর্ভ-ট্রেনের আমি যাত্রি ; আর যখন হাঁটি, আমি তখন নিউইয়র্কের অলীক মেয়র, অবয়বহীন । আর এইখানে, হাডসন আর ইষ্ট রিভারের সঙ্গমস্থলে, গাঙচিল ভাসে বারোমাস, ক্লান্তিহীন । বাতাস এবং জলের শব্দ নগ্নতাকে নাড়ে ; জেগে ওঠে ভ্রাম্যমান মানুষের হৃদয় । একদল সফল ইঁদুর চলে গেছে ফেরী দিয়ে অন্য কোন দ্বীপে। আরও আছে অনেক ইঁদুর ম্যানহাটানের রেস্তরাঁয়, বইঘরে, আর যত্রতত্র যৌনতায়। নির্ঘুম আমার চোখে জাগে রাত : রাতভর জাগে জল, জলের প্রবাহ, নক্ষত্র, আর সৌরঝড় । শিশুদের ঘুমের গভীরে মনে হয় ডুবে আছে নিউইয়র্ক : অমাময়ী আমার নগরী ; কিন্তু রাতকে বিদীর্ণ করে আম্ব্যুলেন্সের আর্তি আর সেইক্ষণে আমার মৃত্যুর নিরন্তর ঘন্টাধ্বনি শুনি ।
*নিউইয়র্ক
জানুয়ারি ১৫, ২০০৮
আত্মপ্রতিকৃতি : ৩
মৃত্যুর আগে মানুষ কী খুব কাঁদে, জলপ্রপাতের নিচে দাঁড়িয়ে এই সাদৃশ্যের কথা ভাবি, কিন্তু বয়ে যায় জল । সতী নির্মাণের জন্য কতোবার জেগেছে শ্মশান ! পুড়েছে ফুল, বেলপাতা, চন্দনকাঠ, আর শিশুকণ্যার কোমল অস্থি ! অগ্নি এসে নিয়ে গেছে মানুষের একান্ত প্রত্যয় আর তাঁর প্রকৃতির পরম আকৃতি। অগ্নি ও বায়ুর অশেষ মৈথুন শেষে দেখেছি আকৃতির নব উদ্বোধন, নবতর বিন্যাস । ভাঙ্গা কলসি, কালো ছাই, অর্ধদগ্ধ কাঠ, ইত্যাকার নিয়ে পরিত্যক্ত শ্মশানে যে উত্তাপ, সে উষ্ণতা মেখে ফিরেছে যে একাকী মানুষ, মুখে তার ভাসে কালো ছাই । এখন নিশ্চল রাতের নীচে ক্ষীণকায়া নদী বয়ে যায়, আর দাঁড়িয়ে থাকে ভাঙ্গা সাঁকো, যেন শ্রান্ত জনপদ । শীতের দীর্ঘ রাত, স্বপ্নে জেগে ওঠে ঘুড়ি, অনুভবে আসে দীর্ঘ সুতার টান। কে আমাকে টানে, কেন টানে,চলেছি দৃশ্যাতীত কোন ধূলিঝড়ের সন্ধানে ? ভেসে ওঠে পিতৃমুখ, মৃত্যুপূর্ব তাঁর মৃদু কণ্ঠস্বর শুনি। অভিমানী মা চলে গেছে বহুদিন, যেন শব্দহীন বরফ পতন । তুষারাচ্ছাদিত পৃথিবীর এ পথকে নিতান্তই স্বপ্ন মনে হয় । এ পৃথিবী কী এক, না কী একাধিক, না কী ক্রম প্রসারমান কোন এক আত্মার গান ? কোন সাদৃশ্যের ভূমিতে জেগে ওঠে রংধনুময় আমার শরীর ? দিগন্তে প্রতিধ্বনিত যে গান, সে কী আমারই চিৎকার না কী পরাজিত
কোন সৈনিকের অমিমাংসিত ক্রন্দন ?
অশেষ ক্রন্দন শেষে ম্যানহাটানের পথে জেগেছি আবার : দেখি কর্মযোগ, প্রেমের আবাহন, শশব্যস্ত ইঁদুরের ভীড় । বিবিধ ভূগোলে বাস আমার প্রতিদিন, যদিও কোথাও নেই আমার তেমন প্রত্যয় । ভ্রমণের কোন অভিপ্রায় নেই; তবু দেখি নিজেকে বইঘরে, কফিহাউসে, পানশালায়, আর সমুদ্রসৈকতে । সঙ্গীহীন কতোবার হারিয়ে গেছি মধ্যরাতে, ইতস্তত টুকরো কাগজের ভীড়ে, নি:সঙ্গ মানুষের গানের একান্তে । সমুদ্রের যে উচ্ছ্বাস তাকে কেবলি বিম্বিত হতে দেখেছি হারিয়ে যাওয়া মানুষের গভীর নিভৃতিতে, বুদ্বুদময় মদের দীর্ঘ গ্লাসে । মানুষের পদযাত্রায় মগ্ন আমি ; তবু ফিরে আসি নিজ গৃহে, যেখানে রাতের গভীরে জাগে স্বপ্ন ; আর বয়ে যায় জল, জলপ্রপাতের ।
নিউইয়র্ক
ফেব্রুয়ারী ১৮, ২০০৮
ব্রুকলীন ব্রিজ
‘...আই ওয়াজ ওয়ান অফ এ ক্রাউড’ ।*১ ইষ্ট রিভারে আজকাল নেই কোন ফেরী পারাপার এবং আমি নই তার কোন যাত্রী । ব্রুকলীন ব্রিজে দাঁড়িয়ে দেখি হৃদয়ে জেগেছে জলের প্রবণতা, জেটীতে কোলাহল, আর নৌকায় মাস্তুল । পাড়ি দিতে চাই নদী ও নারী, কিন্তু শেষাবধি ম্যানহাটানের ভীড়ে হাঁটি অবয়বহীন, আমি যেন আরেকহুইটম্যান, আবেগের যাত্রী । এখানে, ইষ্ট রিভারের আকাশে গভীর স্থিরতার ভিতরে গাঙচিল ভাসে বারোমাস ।শেষ বিকালের রোদ আর তার গভীর প্রমিতির ভিতরে ডুবে আছে শুভ্র ডানার চাঞ্চল্য আর দ্যুতিময় তার পাখনার উদ্ভাস । নদীর প্রবাহ আছে ; আছে তার বিপুল বেগ ও অবিশ্বাস্য আবেগ, জোয়ারে তার সুপ্রচুর স্ফীতি । আজও সুউচ্চ ভূমি নিয়ে জেগে আছে বৃক্ষাচ্ছাদিত ব্রুকলীন, কর্মপ্রেরণা নিয়ে ম্যানহাটান, আর এই দুই নগরীর মাঝে ইষ্ট রিভারের জলে ভাসে দূরগামী জাহাজ, যেন কোন সুদূর বন্দর অভিমুখী আমার শরীর । নেই শ্মশ্রুমণ্ডিত ইয়াংকি কবি হুইটম্যান : আমেরিকার বাল্মীকি, তবু রয়ে গেছে তাঁর অমিত প্রত্যয় : জলের শরীরে উৎকীর্ণ আছে জীবনের ফেরী। তবু শতাব্দী পেরিয়ে দেখি, জেগে উঠেছে আমাদের দেহের কংকাল, ‘ব্রুকলীন ব্রিজ’ । জলের শরীরে নয়, ব্রুকলীন ব্রিজে লেখা আছে ইয়াংকি জীবনের ফেরী ।
‘দ্য সীগাল’স উইংস শ্যাল ডীপ এ¨ পিভট হিম’ ।*২ গাঙচিল তার পাখনায় বাঁধে এই সেতু আর তার পাখনা থেকে সাদা বৃত্তে ঝরে পড়ে অস্থিরতার আলো । আরও কোন গভীর উত্তেজনা, অশেষ ধ্বংসের মধ্য দিয়ে আত্মহননের দিকে চলে গেছেন হার্ট ক্রেন- ‘ব্রুকলীন ব্রিজ’-এর কবি । শতাব্দী পেরিয়ে যায়, বরফ এসে আচ্ছাদিত করে ব্রিজের গথিক আকৃতি । তবু রাত উজ্জীবিত হয়ে ওঠে এই ব্রিজের বাহুতে, জেগে ওঠে নক্ষত্রের সারি, আর নদী বয়ে যায় অনন্ত সময়ের দিকে, যেখানে হয়ত অনুপস্থিত থেকে যাবে উচ্চকিত আজকের এই বৈসাদৃশ্যময় চিন্তা । কিন্তু মিমাংসিত হবে কী আমার ক্রন্দন, আমি কী থেকে যাব নামহীন, গোত্রহীন ? উন্মাতাল বাতাসে এই ভাবনা প্রবল, কিন্তু প্রবলতর হ’য়ে ওঠে রয়েবলিং,*৩ তাঁর পুত্র, পুত্র-বধূ, আর শ্রমজীবি মানুষের কথা : তাঁদের স্বপ্ন, ভালোবাসা আর উন্মাদনায় নির্মিত এই ব্রুকলীন ব্রিজ । আর এর অনেক গভীরে প্রেরণা হয়ে আছে হেগেলের ঐতিহাসিক চিন্তা, তাঁর দ্বান্দ্বিক দর্শন, যা একদিন উজ্জীবিত করেছিল তরুণ রয়েবলিং-এর চৈতন্য । সেই চৈতন্যের সাকার ঈশ্বর এই ব্রুকলীন ব্রিজ, যেখানে দুই বিপ্রতীপমুখী সেতু হয়ে ওঠে একক ঈশ্বর, এই সন্ধ্যায় আমি যার সাকার পূজারী । কিন্তু দেখি সন্ধ্যার এই গভীরে সেতুর কাছাকাছি ফুলবনে ঘুমিয়ে আছে এক বহুবর্ণ প্রজাপতি ।
ব্রুকলীন ব্রিজ, তবে সে কী অস্থির গ্যালাক্সির এক উজ্জ্বল নক্ষত্র না কী আমার সত্তায় নিদ্রিত এক বহুবর্ণ প্রজাপতি ?
*নিউইয়র্ক
মার্চ ১৫, ২০০৮
*১‘ক্রসিং ব্রুকলীন ফেরী’, ওয়াল্ট হুইটম্যান (১৮১৯-১৮৯২)
২‘টু ব্রুকলীন ব্রিজ’ , হার্ট ক্রেন (১৮৯৯-১৯৩২)
৩জন রয়েবলিং (১৮০৬-১৮৬৯) : ব্রুকলীন ব্রিজের মূল স্থপতি ; আমেরিকায় দেশান্তরী হবার আগে জার্মানিতে
দার্শনিক হেগেলের ছাত্র ছিলেন । জন রয়েবলিং-এর অকাল মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র এবং পুত্রবধুর তত্ত্বাবধনে
ব্রুকলীন ব্রিজের কাজ সম্পন্ন হয় ১৮৮৩ খ্রীষ্টাব্দে ।
নির্বাসন
‘পিছন ফিরে তাকালেই জেগে ওঠে নির্বাসন :’।*১ তাই আমি নির্বাসন শিখিনি । বৎসর অতিক্রান্ত এখনআরেক বছর । ধুলোয় লেখা আমার নাম ইতোমধ্যে বৃষ্টির জলে ধুয়ে গেছে । তাই বোধকরি তুমি এখনআমাকে আর খুঁজে পাওনা । কর্ম্মময় দিনের শেষে আমিও আর তোমাকে খুঁজি না । অনেক পরিযায়ি পাখির মতো তুমিও এক যুগ থেকে আর এক যুগে প্রবেশ করেছ ; চলে গ্যাছো এক মহাদেশ থেকে আর এক মহাদেশে । তোমার অভিধানে বদলে গেছে সমুদ্র-সৈকত আর কফিহাউসের নাম । কিন্তু আমি আছি এইখানে, ক্রমশ হ্রস্বমান এই দিনের শেষ প্রান্তে, যখন সুউচ্চ টাওয়ারের শীর্ষে শেষ বিকালের আলো নিভে আসে । আমার পরিচিত পথ কেয়োটিক, দীর্ঘ এবং জনাকীর্ণ, কিন্তু হাঁটি আমি একাকী । তবু, আমি নির্বাসন শিখিনি । পাণ্ডবদের সাথে আমার কোন পরিচয় ছিল না ; কারণ, আমি নই ক্ষত্রিয়।
তুমি আর এখন আমার অনুপস্থিতিতে ব্যথিত নও, সাবওয়ের প্লাটফর্মে একজোড়া উৎসুক চোখ আমি আর দেখিনা । দীর্ঘ পথ অতিক্রমের পর আমি ক্লান্ত, কিন্তু পানশালায় নির্জন একাকী আমার মুখাবয়ব এখন শান্ত । সময় এখন শূন্যতায় গুঞ্জরনরত ।
এই গভীর রাতে বাঘের চোখ এখনও উজ্জ্বল, কিন্তু তার হৃদয়ে জেগেছে রাজহংসীর নীরবতা, যেন রাতের জলাশয় আমাদের আত্মার দর্পণ, যা বাতাসে কেবলি আন্দোলিত হ’তে উন্মুখ । শূন্যতার মাঝে বাতাসের যে গুঞ্জন, সেখানেই জেগে থাকে আমার প্রত্যয়, কর্মক্লান্ত আমার শরীর ।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধশেষে শ্রীকৃষ্ণের মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী । আর যুদ্ধশেষে যোদ্ধারা চলে গেছে যে যার গন্তব্যে । তোমার দৃষ্টির লাবণ্যে এখন জেগেছে শ্মশান, আর আমি আছি তার চিতাকুণ্ডে - অনিঃশেষ এই বর্তমানে । কারণ, আমি নই ক্ষত্রিয় ; পাণ্ডবদের মতো আমি নির্বাসন শিখিনি ।
*নিউইয়র্ক
সেপ্টেম্বর ১৪, ২০০৮
*১মাহমুদ দারবীশ (১৯৪২- )
অভিমন্যু
চক্রব্যূহে আমি : অভিমন্যু - মাতৃহীন, বর্মহীন । তোমাদের কণ্ঠস্বরে ভেঙ্গে পড়ে আমার সকল প্রতিরোধভুলে যাই এ জীবন নিতান্তই কুরুক্ষেত্র ; ভুলে যাই কবে বৃষ্টি হয়েছিল বাংলায়, কবে ওঠেছিল জেগে বিষণ্ন কদমের ফুল । সাবওয়ে ট্রেন চেপে গ্রীষ্ম অতিক্রান্ত এখন সুবর্ণ সময়ের কাল, সময়ের গুঞ্জনে মুখরিত এখন আত্মায় নগ্নতার গান ।
কী অবলীলায় তোমরা বলে যাও তোমাদের কোমরের পরিধি, নিতম্বের বেধ, আর স্তনের স্ফীতি । জেনেছি তোমাদের অন্তর্বাস হালকা গোলাপি কিংবা গাঢ় লাল কিংবা উজ্জ্বল জাফরানি । মন্ত্রমুগ্ধ আমি, এইসব মনে রাখি । পূর্বজন্মে - বোধকরি- তোমরা ছিলে পাখি ; একারণেই তোমাদের কণ্ঠস্বরে সারল্যের এতো কোলাহল, লাবণ্যের এতো প্রমিতি ।
দিনের বৈভব ছেড়ে গোধূলি অতিক্রম করেছি । দূর উপকুলে দাঁড়িয়ে থাকুক ঝাউবীথি, আকাশে জেগে ওঠুক নক্ষত্রের সারি ; তোমাদের কণ্ঠস্বরে মন্ত্রমুগ্ধ, এখন উজ্জীবিত আমি । মস্তিস্কে জাগ্রত হ’তে থাকে নিঃসঙ্গতায় ভরা দিনের বৈভব, পাতাভরা বৃক্ষের দশদিক উজ্জ্বল বিস্তৃতি । আগে কখনো জানিনি জীবনের সব অভিষেক যৌনতারই বিস্তৃতি : তোমাদের কণ্ঠস্বর জাগায় উন্মাদনা, বিপুল বিক্ষোভে রক্তে আনে ঝড়ের জাগৃতি, আর অলৌকিক বাগান থেকে বহুবর্ণ পাতা ঝরে অন্ধকারে, অবিরল আমারই রক্তের প্রবাহে ।
তোমাদের নাম, হ’তে পারে রাধা কিংবা খাদিজা কিংবা মারিয়া, ফিকে হ’য়ে আসে আমার মস্তিস্কের উজ্জ্বল কর্টেক্সে, নিভু হ’য়ে আসে আমার দীপ্ত চোখ, আর অবিরল ধারায় প্রবাহিত হ’তে থাকে জীবনের বেগ, আর অনিঃশেষ আবেগ । ভিজে যায় জাহাজের পাটাতন, জলমগ্ন হ’তে থাকে স্মৃতি, আর রঙের ফানুস ।
সেইক্ষণে মনে হয়- তোমাদের কাছে আমি বর্মহীন : আমি অভিমন্যু।
*নিউইয়র্ক
সেপ্টেম্বর ১৭, ২০০৮
একলব্য
‘শূদ্রের অলক্ষ্যভেদে নিহত আমার ভগবান’ ।*১ যে জলস্রোত নিয়ে যায় পূর্বপুরুষদের দেহভষ্ম, তোমার প্রতীক্ষা, আর আমার একান্ত প্রত্যয়, সে কী সময় না কী আমার সত্তার অনন্ত বিস্তৃতি ? সূর্য অস্ত যাবার মুহুর্তে সমুদ্র উপকুলেআমার যে অসীম প্রতীক্ষা, সেই বালু-বিন্দু-কালে কে ব্রাক্ষ্মণ আর কে শূদ্র আর কেইবা ভগবান ? শ্রীকৃষ্ণের মন্ত্রণা আর অর্জুনের বাণে বিদ্ধ রক্তাক্ত এই পৃথিবী এখন বৈশ্যের । মহাদেশব্যাপী মানুষেরা বাস্তুচ্যুত, তারা উদ্দালক,তারা পলায়নরত । ধর্ম, জ্ঞান, বেদ-বিভাজন : এসবই চাতুর্য, যুদ্ধ জয়ের কৌশল ।
ছিলাম একদিন অরণ্য গভীরে ; নির্জন, একাকী ; ব্যাপৃত শরনিক্ষপণে, মহাকালের গর্ভে । আমি যদি শ্রেষ্ঠ ধনুর্ধর, তবে কেন এই গুরু-দক্ষিণা, কেন এই দক্ষিণ-অঙ্গুষ্ঠ ছেদন ? বস্তু অতিক্রান্ত আমার দু’চোখ এখন ভরে ওঠে রক্তে আর কুয়াশায়। আমি কী আজন্ম নিষাদ না কী জন্মান্তরে তথাগত ?
রাতের শরীর ফুঁড়ে জেগে ওঠে ভোর আর দ্রৌপদীরা জাগে নগ্নতায় । আমার শরীরে জমে ওঠে ধুলো : এঁকে দেয় বস্তুর নিভৃতি আর দেহের বিস্তৃতি । পুণ্ড্রবর্দ্ধন, হস্তিনাপুর, শ্রাবস্তী, চম্পক ইত্যাদি নগর পাড়ি দিয়ে আমি আজ আরেক নগরে, অন্য এক জনস্রোতে । সেই জনস্রোতে আমি হাঁটি প্রেমহীন, জ্ঞানহীন, বোধ- আর বোধি-হীন । এখন আমার তীর করেনা বিদ্ধ সময়ের অভিমুখ কিংবা কোন নারীর শরীর ; দেখি বৃক্ষের পাতারা ঝরে, অবিরল । জীবন ও কর্মের সকল প্রেরণা লুপ্ত ; আমি কী নিষাদ না কী উদ্যমহীন ক্ষত্রিয় ?
চাই প্রস্থান : প্রয়াসহীন, ঘুমের গভীরে । স্বপ্নে ও জাগরণে দক্ষিণ অঙ্গুষ্ঠ-বিহীন আমি হেঁটে যাই কুরুক্ষেত্র অতিক্রান্ত সীমাশূন্য সময়ের গর্ভে, ম্যানহাটানের জনস্রোতে । তীব্র শীতের এই রাতে, ঠান্ডা বাতাসের অনুপ্রেরণায়, প্রাণহীন আমি যদি পড়ে থাকি মানুষবিহীন কোন এক চৌরাস্তার মোড়ে, তবে আমার নিথর দেহ কে মুড়ে দিবে লালনের গানে ? আমি নই শূদ্র কিংবা ব্রাক্ষ্মণ কিংবা যবন । আত্নোৎসর্জিত : আমি একলব্য ।
*নিউইয়র্ক
নভেম্বর ২২, ২০০৮
*‘কাল’, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত (১৯০১-১৯৬০)
রাত্রিগাথা
ঝরে, বৃক্ষের পাতার মতো মানুষের মুখ- উন্মাদের, শ্রমণের । আর ভ্রাম্যমানতায় জেগে ওঠে গান, বেদনা ও বিলুপ্তির । সময়ের অতল প্রবাহে কীভাবে হারিয়ে যায় কবি ও কথক ? আমাদের কথা অসংলগ্ন, ঝড়ো হাওয়ায় যেন উড়ো পাতা, বিলুপ্তির পথে তার মৃদু অভিঘাত - জাগে জলের প্রবাহে আর কান্নার গভীরে । রাতের অন্ধকার এসে আমাকে জাপ্টে ধরে, যেন ধ্বংসই ভবিতব্য, আমার মুক্তির একমাত্র পথ । তবু অন্ধকারের সুড়ঙ্গ বেয়ে কে যেন আমাকে নিয়ে আসে প্রাচীন বৈশালী থেকে বর্তমান এই পৃথিবীর নাভিমূলে, আলোক-উজ্জ্বল টাইমস্ স্কয়ারে- এই নিউইয়র্ক নগরীতে ! ঘুম ভেঙ্গে গেলে জল পতনের শব্দে সারারাত উন্মুখ আমি, জাতকের উৎসমুখে কান পেতে রাখি, কিন্তু নির্বাণের কোন ধ্বনি-উচ্চারণ নেই । শুধু চাঁদের আলো ইঁদুরের মতো আমার পায়ের ওপর এসে খেলা করে ।
এ কী উটের পিঠে মরুযাত্রা না কী পতনের আগে পৃথিবীর সাথে আমার শেষ কোলাহল ? মানুষের উৎসব আর সময়ের হীমপ্রবাহ- এই যৌথ যাত্রার মাঝে আমি নির্বাক, যেন ট্রেন চলে গেছে আমাকে সাবওয়ের প্লাটফর্মে রেখেনিঃসঙ্গ একাকী, এই শেষ রাতে, কুয়াশা গভীরে । তোমাদের নগ্নতা মনে হয় গ্রেকো-রোমান শিল্পীদের কাজ, লম্বমান ছবি হয়ে আছো পৃথিবীর বিভিন্ন জাদুঘরে কিংবা আছো তোমরা অন্য কোন পুরুষদের আনন্দ-বন্দরে। এই রাত আমাকে করে ভয়ার্ত, শীতল, যদিও ইষ্ট-রিভারের প্রবাহ চলে গেছে বহুদূর ।
আমি কী পৃথিবীকে দেখি, না কী পৃথিবী জেগে ওঠে ইষ্ট-রিভারের জলে, মৃত কোন মাছের চোখে ? কোলগেট টাওয়ারের ঘড়ির কাঁটা ভেসে গেছে শেষ জোয়ারের জলে । জেগে আছে নক্ষত্র, দিকভ্রষ্ট কোন গাংচিল, আর বিশৃঙ্খল জলে উন্মাদ হাওয়ার গোঙানি ।
নিউইয়র্ক
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন