শনিবার, ২২ আগস্ট, ২০০৯

বৃষ্টির অন্তর ত্রাস


উত্তরমালঞ্চ

বনপ্রস্থান
...................

মাঘশীতে ডোরাকাটা যায় দূর বনপথ
কুয়াশারেখায় ঢাকা পথ নেই পথ নাড়ার আগুন
ফিক ফিক করে জ্বলে নেভে ধোঁয়াশা ছড়ায়
দূরাবহে হেটে যায় পরী, কোলে তার
শিশু নয় স্বামী, বারোদিন রাত্রি কেটে যার
আয়ু হল কাল; পথে পথে কে আছে তাঁকে
দুধ দেবে ওগো, বাঘমামা আমি সতী নারী

থাকি ভয়ে ভয়ে এই ভ্রমে এই যদি মা বলে ডাকে
বিজন বনের পথে দূরাভাসে ছায়া কাঁপা কাঁপা
অতল রাত্রির থেকে জল ভেসে আসে, উথলে উথলে
ওঠা জল দু’চোখ বিহনে যাবে কোথা পাবে কোথা পথ
নেই পথ নেই পথ সতীধর্ম যৈবন নদীর
দু’কূল ছাপায়ে ওঠে বাষ্পে বাষ্পে ভারী
অবরুদ্ধ গীতি… গেয়ে যাও পানকৌড়ি
সলাজ রক্তের গানে প্রতীক্ষিয়া প্রতীক্ষিয়া বহু বর্ষ কাটে

বাঘমামা, যদি না থাকিতে বনে…এইবার যাই!
পালাই পালাই বন থেকে দূরে লোকালয়, বিদ্যালয়
প্রথম পাঠের ঘণ্টাধ্বনি, হ্রেষা শোনা যায়…


স্মৃতি: বনে বাড়ে রাজার কুমার
....................

ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দে সরে যায় মেঘ
মেঘের পালঙ্কে শুয়ে রাজার কুমার
বনে বাড়ে, বন সে’তো দূরে নয় লোকালয় থেকে
তবুও বনের মনে কী গভীর রহস্য আছে
আছে দানধর্ম তার, লোকালয়ে নাই!
জানে তাই বাঘমামা গাছ থেকে মধু পেড়ে আনে
শিশু স্বামীটিরে কি খাওয়াবো, কি রাঁধি
কোলে নিয়ে বসে থাকি, কাজল এঁকেছি চোখে তাঁর

বিতাড়িত পথে পথে দুধের ফোয়ারা ছুটে আসে
এই দুধ ঠোঁটে মুখে তাঁর মেশে সকল অব্যয় ধ্বনি
যেখানে মানুষ নেই, আহা-
মমতা সেখানে জানি, ঘর বেঁধে রাখে!


রাজটিকা
..........................

কোটালকন্যার হাতে যদি বাড়ে রাজার কুমার
তবু সে’তো রাজপুত্র, রাজধর্ম তাঁর
একযুগ পার হলে যেন সব চিহ্ণ
সমান স্বরূপে ফুটে ওঠে তাঁর, এই ভার
নিয়েছি নিজের বোধে…কেউ জানে নাই
সকলেই জানে সে’তো বহুপূর্বে মৃত ছিল
চিতায় পুড়েছে ঘন বর্ষার রাতে
মরা কি জীয়ন্ত হয়, যদি না সে জাতিস্মর
বেভুলে কখনো কারো হঠাৎ অতীত মনে পড়ে!



পাপসূত্র, মৃতের জীয়নকাঠি
...........................

মৃতের শরীর থেকে মৃত্যু উড়ে গেছে
জীবন চিৎকার করে নামে সেইরাত
চোখের কোটরে দেখি আবার চোখের জল
ধুয়ে যায় দৃশ্যগাঁথা বন সর্ সর্
বিদেহী ছায়ারা দ্রুত মিশে যায় বাষ্পীভূত
আকাশে আকাশময় জড়ো হয় মেঘ
বড় বড় বৃষ্টিফোঁটা ধারা হয়ে নেমে আসে
ন’ড়ে চ’ড়ে কচুপাতা কিছু জল ধরে রেখে
বাকিটুকু ফেলে দেয় পতনের প্রেমে:
পতন পতন শুধু ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দে
পতনের শুরু; আমিও পতিত তাই
কাল সব জানে, তারা কারা এসেছিল
পাহাড় প্রদেশ থেকে নেমে এই স্নিগ্ধ পলি সমতলে…
লালধ্বনি হ্রেষা আনে সকল বিভক্তি রীতি
শাস্ত্র নামে ঘটে গেছে জানি, বহুকাল আগে।


ধল প্রহরের গান
........................

ওঠো ওঠো রাজার কুমার বিদ্যালয়ে যাও
বিদ্যালয়ে তোমার সমান রাজকন্যা পাও
দূধের বরণ রাজকন্যা শ্বেতপঙ্খী নায়ে
এনে দেবো পঙ্খীরাজ চিঁহিঁ রবে গায়
দূরে দূরে থাকি যাতে অসম বয়সে
ভুল ভেবে না ডেকো গো, মা বলে আমাকে
আমি যে গো তোমার জায়া এই সত্য জেনে
দেখো ফিরে একবার এই একাকী নারীকে!


দাঁতে কাটি কারাগার
........................

দাঁতে কাটি শিকলের বেড়ি, লোহার শিকল
সে নয় কঠিন এই ইচ্ছার থেকে
রক্তদর্শন ছাড়া জানি সুখ হয় না কখনো
এই রক্ত সুখ হবে যদি বাঁচে সাধের কুমার
তুমি স্বপ্নে উঠে এসো ক্রোড়ে, বনে বনে কেটেছিল
যদি অভয় নিদ্রার কাল, নিদ যাও নিদ যাও বুকে
তোমার তরুণ মুখ পিপাসার মত
পাহাড়ের ক্ষত থেকে জলের আর্তি আসে ছুটে
‘বাঘমামা, খেয়ো না খেয়ো না, এই কাঞ্চী কুমারের নিধি
এত সাধ রক্তপানে যদি, তবে খাও আমাকেই আগে’…
একে একে দাঁতের বিনাশে কাটে শিকলের ভার
কাক ডাকে ভোর হয় ফর্সা আকাশে
নিথর একটি, তবু, দু’টি তারা থাকে!



বনে ফেরা, ছায়ার কঙ্কাল
...........................

দাঁতে কাটে কারাগার মনের দেয়াল কাটে নাকো
গ্রহণের সীমারেখা মানুষের এত ছোট এত ছোট

কুমারের আয়ু আজ অনন্ত আকাশ
তবু রাজা আমায় দিলেন বনবাস

আমি যে কোটালকন্যা অবরুদ্ধজন, পথে পথে কাঁটা
সরোবরে ডুব দেবো সেখানে পাহারা…

রাজা আমায় নিলেন নাকো ঘরে, না দিলেন মৃত্যুপরোয়ানা!

তবে আমি বনে যাই যার শাস্ত্র নাই কোনো
এই পথ চলে গেছে দূর পাতাস্রোতে
পাতার আড়ালে গাছ ধরে রাখে ছায়ার কঙ্কাল
রৌদ্র হলে জানি তাই মেলে দেবে পথে।



২.
বাউল গাইতে পারি যেন
................................

ঠাকুর্মা গল্পের মত কথা বলে যেন এক পৌরাণিক পাখি
গেয়ে ওঠে গান, কণ্ঠে সোনালী তরঙ্গ তার পাকা ধান হয়ে ঝরে
ঠাকর্মা ধানের কথা বলে- কতদিন বলেছে এমন!
ধানগুলো ধীরে ধীরে আঁধারের গায়ে সাদা খই হয়ে ফুটে গেছে
স্বপ্নের মতোন ঝ’রে গেছে তারপর ঠোটেঁ তার সাদা খই
ঠাকর্মা হাঁসের গল্প করে- খইরঙা রাজহাঁস মুক্তোর মতোন সাদা
ডিম দিত নাকি পুকুরের সবুজ শৈবালে, হাঁসগুলো কোমল মেঘের মত
উড়ে গেছে কবে, মেঘ হয়ে ঝরে এখনও- ঠাকুর্মা মেঘের কথা বলে
সাদা কালো মেঘে নাকি হয় সখা মিলন গভীর!

মেঘের মিলন গাঢ়- মোটাবৃষ্টি, ঋজুরোদ সব
ঝরেছে অনেক তার, ছেনেছে অনেক আর মরমের মাটি তার
ভিজেছে অনেক বহু বাসনা মনের তাই হলুদ শর্ষের ক্ষেত ধূ ধূ
প্রগাঢ় সবুজ ধান; শান্ত গাভী, শিশু তালগাছ- নিমছায়া
খালে জল বয়ে গেছে ধারাল প্রখর গেছে বয়ে লোনাজল
সারি সারি শুপুরীর শেকড় ছুঁয়েই, সীমিত ডোবার সাথে মিশে একাকার
সেইখানে কালো কই, সতেজ মাগুর মাছ করে গৃহবাস
তেলের তাপিত ঘ্রাণে মৌ মৌ উঠে গেছে ঠাকুর্দার স্বাদু ঠোঁটে
ঠোঁটে তার ঝরে শুধু ভোজনের স্মৃতি :

ভোজন উৎসব হবে তাই, ছায়ারাত- ছায়ার আঙ্গিকে গাছ
পাতায় পাতায় মিহি নকশার ছাপ সুগন্ধী উঠোন জুড়ে ফুটে ওঠে
পুন্নিমা আলোয়, ডাকে লক্ষ্মীর বাহন পেঁচা, পিঠার শরীরে কারুকাজ-
নারীর কোমল হাত, ঘিয়ের প্রদীপ শত কাঁসার বাসন আর অনেক মানুষ
ঠাকুর্দা আহ্লাদে বলে, কই মাছের মাথার মধ্যে থাকে বারোতীর্থের জল, ওগো!
বৌমা, পাতের ওপর ওই মাথাটা দিলে না কেন, দাঁত না হয় গেছেই ঝরে।

এখন ভোজন বেশি নেই আর তাই ঠাকুর্দা বৃথাই অত ভোজনের কথা বলে।
বাসনা এখন বেশি বেঁচে নেই আর ঠাকুর্মা কেবলি বাসনার বার্তা দেয়।

বাসনার শেষকৃত্য হয়ে গেছে শেষ!
তবে এই সাধ কেন, এইসব ছবি কেন?
ছবি সব যায় নাতো চেনা, স্মৃতি তার যতই থাকুক…
পিতার নীরব কণ্ঠে এইসব কথা ঝরে পড়ে, যেন চিটাধান ঝরে
পিতার নীরব কণ্ঠে চিটাধান ঝরে। ঝরে কেন?

পিতা নিরুত্তর- শুধু হেঁটে যায় ধীরে কোদালটা নিয়ে কাঁধে
মাঠের এ আল থেকে ও-আল, ও-আল থেকে দূরে, ও..ই দূরে
পথের কিনারে তালগাছ, নিথর দুপুররোদে হেঁটে যায়
কোনো গাঁয়ে গঞ্জে নেয় তাকে কিনে কেউ সারাটা দুপুর ভর


পিতার নীরব কণ্ঠে তাই শুধু চিটাধান ঝরে।

আচমকা একজন তরুণ বাউল রুদ্রপায়ে উড়ে আসে যেন, কণ্ঠে তার
মেঘের গর্জন বেজে ওঠে তুমুল ঝংকারে, গেয়ে যায় অগ্নিঝরা অবিরাম
জ্বলে যায় বাসনার শব, জ্বলে যায় বিগত বিলাস- ক্লান্ত হতাশ্বাস জ্বলে যায়…
একবার জ্বলে গেলে নেভে না কখানো তাই, ফুটে ওঠে লালফুল বাউলের হাতে।

আমি তবে গাইব বাউল!

সুধীজন, এই আশিস দেবেন মোরে
বাউল গাইতে পারি যেন মোর সারাটা জনম জুড়ে!!


৩.
ক. যে রূপ আমি শুনিলাম কানে
.........................

যে রূপ আমি শুনিলাম কানে
মালিনী মাসির হাসি, নিলাজ গুঞ্জন তুলে আনে
আনন্দিত শিহরণ এই ভীত মনে- সরোবরে
ছায়া প'ড়ে আছে তার এ অমোচনীয় আঠার প্রলেপ
বায়ুযোগে ঢেউ ওঠে গোল হয়ে, সরে যায় দূর
গোলাকার তলে-তবু রূপ তার হাসিতে অনড়
বেড়ালের মতো এই অপরাহ্ণ বেলা!

নিবিড় নৈঃশব্দ চারিদিকে, ফুল ফোটাবার যত
আয়োজন গাঢ় প্ররোচনা করে যায় ঝিঁঝিঁদের
দল, জোনাকিও জোটে এসে- জ্বলে নেভে ঈর্ষাতুর
দূর তারাদের দেখে। যে গেছে চন্দনবনে-

মাসি তার চোখ বেঁধে রাখো কেন?
সুরভি কি ঢেকে রাখা যায় বলো, আঁচলের তলে?
সখির কাঞ্চনরূপ কালির কলঙ্কে বুঝি মোছে!
হয়েছে হয়েছে মাসি, তাঁকে দূর থেকে ভালবাসি
দেখি নাই যাকে কোনদিন, তবু তাঁর রূপের কীর্তন
আমি শুনেছি তো কানে!


খ. যে রূপ আমি শুনিলাম কানে
.......................

যে রূপ আমি শুনিলাম কানে, আজ
দেখি তোমাকেই সেই থকথকে গলিত কাদায়
নিঠুর কুষ্ঠের ক্ষতে -তোমার দেহের জরা যদি
কাটে চুমুর সন্তাপে, দেবো তাই প্রাণভরে আমি
দেখে নিই আগে সেই বিলুপ্ত রূপ
গলিত অঙ্গে যার ছায়া পড়ে আছে...

আমার চুমুর রঙে তুমি ফিরে পাবে ফের
সোনার যৌবন, আমি হবো গাছ বিপরীতভাবে
তোমাকে দেখার সাধ যুগ যুগ ধরে
পাতা মেলে চেয়ে রবো- দেখিতে তো পাবো
আমি তারে, যারে দেখি নাই কোনদিন
মানবীর অধিকারে...ওই সরোবর-পাড়ে
দূর কদলীছায়ায় রূপের তরঙ্গ
যদি ছুঁড়েছিলে হায়, কেন ডাকো নাই
ফুল হয়ে ফুটিতেছিলাম আমিও তো
স্নিগ্ধ কামিনীর ঘ্রাণে!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন