রবিবার, ২৩ আগস্ট, ২০০৯

কবি শান্তনু চৌধুরীর কবিতা


[বাংলাদেশের আশির দশকের অন্যতম উজ্জ্বল কবি শান্তনু চৌধুরী। জন্ম- ১ এপ্রিল, ১৯৬৪ সাল। অত্যন্ত বিরলপ্রজ এই কবির প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ মাত্র ২টি। প্রথমগ্রন্থ 'উৎস থেকে বহ্নি থেকে' প্রকাশতি হয় ১৯৯৪ সালে। এর দীর্ঘ একযুগ পর, ২০০৬ সালে, ২য় কাব্যগ্রন্থ (উনুনসূত্র) প্রকাশিত হয়।
শান্তনু চৌধুরীর কবিতার প্রতি তরুণ কবিদের প্রচ্ছন্ন আগ্রহ লক্ষ করা যায়। শান্তনু চৌধুরী মূলত ছোটকাগজকেই লেখা প্রকাশের অন্যতম ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচনা করেন।
তাঁর 'উৎস থেকে বহ্নি থেকে' কাব্যগ্রন্থের ৪টি কবিতা ব্লগের পাঠকদের জন্য পত্রস্থ করা হলো।]


রূপান্তর
.......
কফিন বানানো আমি জেনে গেছি আজ।

যে ছুতোর আমাকে শিখিয়েছিল সর্বস্বতা দিয়ে
তার কফিনের কারুকাজ,
আজ তাই একেকটি শূন্য কফিন জন্মের পর
আমি তার দীর্ঘশ্বাস ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেই প্রতিটি কফিনে,
চিতাগামী বাহকের স্তব্ধতার কাছে,
যাতে পৃথিবীর প্রতিটি মৃতের সঙ্গে ভারী যত
দীর্ঘশ্বাস মিশে থাকে সমগ্র মাটিতে।

মাটির পাঁজর ফুঁড়ে এতে, যে বিশাল ছায়াগুলো
জন্ম নেবে প্রান্তরের সবুজ রহস্যে,
যেন সেই মৌন ছায়াদের উজ্জ্বল স্পন্দন থেকে
কোটি কোটি ছুতোরের শব্দ শোনা যায়।

যেন সেই কফিনের শব্দ শোনা যায়।


হাড়
...
যে হাড় ধূসরতম উঠপাখি ছিল
আজ শুধু আমি তার ভুতুড়ে জীবাশ্ম চেয়ে দেখি!
দেখি, অনুজ্জ্বল উটপাখি বালির রহস্য ছেড়ে
পালিয়ে গিয়েছে রাতে উল্কা আর উল্কার আকারে।

যদি দাও, ওর হৃার্দিক হাড়গুলো পুড়ে,
যথার্থ শাবল করে দাও,
তবু, পুরো সমুদ্র পাতাল খুঁড়ে আর
জলরখো মিলবে না
এমন বৃষ্টির জন্য বাইরে এসেছি
যার ভারী, ঠাণ্ডা জলজ শব্দে মধ্যে
শত শত ধূসর উটের আত্মা সমাহিত থাকে;

পথ লুক্কায়িত পথে রোজ
উটপাখিদের প্রাচীন যন্ত্রণা আছে
রোজ সুনিশ্চিত মৃত্যু ও মমতা আছে।


জলদস্যু
........
সমুদ্রের স্বপ্ন দেখে কেউ কেউ জলদস্যু হয়।
অথবা, মুক্তাসমুদ্রের জলের বিভীষিকা
হাওয়া এনে ক্রমশ মেশায়
আমাদের অসম্ভব সমুদ্রতৃষ্ণায়।

কখনো জলের মরীচিকা,
কখনো হাঙর-লাঞ্চিত ঢেউ ডেকে ডেকে,
যে নীল সমুদ্রদেবী আমাকে দেখায়
তার মুক্তাসমুদ্রের ফেনময় নীল পোতাশ্রয়,
ওতে মনে হয়, যে কোনো স্বপ্নের মধ্যে
নিশ্চিত এক পুরাণসমুদ্র থাকে;
অথবা, কোনো না কোনো সমুদ্রের জন্য
আমাদের নাড়িগুলো ফুলেফেঁপে ওঠে
বূতপূর্ব দস্যুর সত্তায়।

তবে কি সমুদ্র দেখিনি আমরা!
হাওয়ার ধারালো হ্রেষার চেয়ে তীক্ষ্ম
লবাণাক্ত ফেনার প্রসার এসে যার
রক্তকে ফেনিয়ে তোলে, ঢেকে দেয়
প্রজ্ঞাপ্রণালীর হিমায়িত সিন্ধুর কিনারা।

তবুও সমুদ্র দেখিনি আমরা।
কিংবা কোনো মুক্তাসমুদ্রের জন্য
দেখিনি গভীর কোনো স্বপ্নও।


অভয় মিত্রের ঘাট
............
অভয় মিত্রের ঘাটে গেছে সর্বনাশা কতো কাল!
বেলা হয় হয় বেলা যায় যায় যায়

গো-ক্ষুরের গর্তে জমা জলে নক্ষত্রের রাখ-ঢাক খেলা চলে;
নির্জ্যোৎস্নায় চাঁদের পাহার ছেড়ে উঠে আসে চাঁদ;
মৃতদের কাছে বসে, অলৌকিক, সব নাঙা ব্রক্ষ্মচারী
পান করে মহুয়ার আগুনের রক্তলাল তাড়ি

বেলা হয় হয় বেলা যায় যায় যায়
সর্বনাশা তবু আজো ফেরে না।

আঁধারে আঁধার লেগে জন্ম নেয় প্রধান আঁধার
প্রহরে প্রহর লেগে ব্যাপ্ত হয় অনন্ত প্রহর
অনন্ত প্রহর ধরে তবু তার আসাই হয় না।

অভয় মিত্রের ঘাটে গেছে সর্বনাশা কতো কাল!

কোথায় আলোকস্তম্ভ! অদূরে তামাম জলে জলে হাওয়া জ্বলে ওঠে,
নির্জ্যোৎস্নায় কাঁপা কাঁপা দীর্ঘ লাল নীল মেঘের বিদ্যুৎ;

উজ্জ্বল অদ্ভুত- মর্মন্তুদ প্রতিটি নিঃশাবাসে ব্রক্ষ্মচারী কেউ

অবিরল ফিসফিসিয়ে বলে:
অভয় মিত্রের ঘাটে যারা যায় তারা আর ফেরে না ফেরে না
অভয় মিত্রের ঘাটে যারা যায় তারা আর ফেরে না ফেরে না
অভয় মিত্রের ঘাটে যারা যায় তারা আর ফেরে না ফেরে না

বেলা হয় হয় বেলা যায় যায় যায়
গো-ক্ষুরের গর্তে জমা জলে ডুবে যায় শেষ মেঘের বিদ্যুৎ
বেলা হয় হয় বেলা যায় যায় যায়
মৃতদের কাছে বসে, অলৌকিক, সব নাঙা ব্রক্ষ্মচারী
পান করে মহুয়ার আগুনের রক্তলাল তাড়ি

বেলা হয় হয় বেলা যায় যায় যায়
সর্বনাশা তবু আজো ফেরে না!

অভয় মিত্রের ঘাটে গেছে সর্বনাশা কতোকাল!

1 টি মন্তব্য: