রবিবার, ২৩ আগস্ট, ২০০৯

কবি মুজিব মেহদীর কবিতা ও উভলিঙ্গ রচনা

ছয়টি কবিতা

অনন্তকথা
...........

মুহূর্তের গান মুহূর্তকে মহিমান্বিত করে অনন্তে মিশে গেল
অনন্ত হলো অনন্ত যা অনন্তের দিকে অনন্তকাল ধরে হাঁটে অনন্তর

মুহূর্ত প্রতি মুহূর্তে জন্মায়, আর অনন্ত সর্বদা অনন্তে মিলায়
এই হলো মুহূর্ত ও অনন্তের মধ্যকার প্রেমভাব চিরটানাটানি

আমরা তার চেয়ে থাকি গমনপথের দিকে
মুহূর্তে দাঁড়িয়ে শুনি কোরাস কাহিনি বাজে

কোথা বাজে কিছুতে নাগাল না-পেয়ে তার
দেহ রেখে অনন্ত টানেলে এক হাঁটতে থাকি অনন্ত লয়ে



গুমরসম্মত
............

সকল দরজা হাট হয়ে গেলে রহস্যক্ষেপণ ঘটে প্রাসাদের
শূন্য হোক তবু লাগে চাবিহীন পুরানো সিন্দুক, গুমরসম্মত
মানুষ কেননা একজীবন সাবাড় করে দিতে পারে
রহস্যসূত্র সন্ধান করে করে

অকপটতা গুণ ধর্মের
তবু বহুদিন ধর্মের ছিলে না-হয়ে ধার্মিক

বাইরের আলো ঘরে আসে তো আসুক
ঘরের আলোক যাতে বাইরে না-যায়
রাখো তার পাকাপাকি আয়োজন করে
সভ্যতার তরী বেয়ে আসা এইসব

সার সার স্থাণু কর মুদ্রারসদের গোপন কলস
রহস্যসমিধ কিছু দৃশ্য হোক প্রাসাদের ঘুলঘুলি পথে
বিস্ময়ে আবিষ্ট হোক অভ্যাগতজন



পুনরাবৃত্তিময়
.........

একটা পথের শেষে আরেকটা পথ নয়
পুরানো পথের ধুলায়ই বুঝি শরীর রঞ্জিত হলো

তোমার সমূহ ছুঁয়ে থেকে আরেকটা আকাশ বিহার
হলো না বিশেষ
একটা পাতার সবুজে নিবিষ্ট হয়ে
দেখতে দেখতে পুরোটা জীবন প্রায় ক্ষয়ে গেল

পরিধি ডিঙিয়ে কোনো নবোদিত ঠিকানা খোঁজার
সামর্থ্য হলো না
খুঁটি পোতা একটা খাসির মতো ঘুরে ঘুরে
মাঠের ছালচামড়া শুধু উঠিয়ে চলেছি



এমভি নন্দিতা
..........

তুমি এসে ধাক্কা দিলে আমার পন্টুনে
ধ্বনি-প্রকম্পনে সমুদ্র ঈগলগুলো কেঁপে ওঠে
মোহনার জলমাখা গোপন বেদিতে
রৌদ্রগন্ধময় হাওয়া এসে খেলে

সমতল ফুঁসে আসা জল
পাটাতন ছুঁয়ে গেলে
যৌথ-যুগ্ম যে সৌন্দর্য জন্ম নেয়
তার কষাঘাতে হই আমিও ঈগল

কাঁপি, বিশাল তোমার দাহে



মৃত্যু
.....

জীবনের ভিতরে আজ মৃত্যুর লোমশ একটা হাত ঢুকে গেছে
আনাচেকানাচে তার জন্মেছে পাথরকুচি

মৃত্যুর মরণ নেই


নোনাধ্বনিকথা
........

স্তূপ স্তূপ এত-যে ভস্মগিরি ছড়ানো হাওয়ায়
এসব আমার-- আমাদের সময়ঘটিত
বঞ্চনা ও লাঞ্ছনার থকথকে যেন কোনো অনিবার ক্ষত
ক্লেদ-গ্লানি রূপভেদে এইমতো লভিয়াছে আর্ত-অবয়ব

আমাদের হত-আশাগুলি
এবং তাদের শবাবশেষের এই সারি সারি বর্জ্যটিলা
নির্বাসনে দিয়ে আসি চল উপকূলে, বদ্বীপান্তরীপে--

মানুষের এইসব স্বপ্নভস্মসার
হররোজ গাছে গাছে সবুজ-অভাব
নিঠুর এই সময়কথাগুলি লেখা আছে নোনাভাষারঙে
পেরাবনে পাতায় পাতায়


দুটি উভলিঙ্গ রচনা
............
তেরহাট্টাবেলা

রয়েছি আতংকে আজ ফুরাবে প্রিয়তম বায়ু, যতনে রেখেছি যারে এতদিন না ফেলে না ছড়ে', দূর পরবাসে এসে মনে হলো অবজ্ঞা করেছি কিছু, প্রেমের নামে খানিক কামের আভাস ছিল

আজ যারা জীবন নামের খাঁচা বয়ে নিয়ে যথাসাধ্য দৌড়ে চলেছে, কারো কাছে এই পাখি হয়ত অদরকারি, হয়ত সাধনা নেই তাদেরও আমার মতো, মোম জ্বেলে কেউ কভু বসে নি গাছতলে, অমল ধবল এই রাতখানি আজ দেখি সহসা আঁধার, মনে হয় আর বেশি দেরি নেই, যেভাবে ফুরাচ্ছে দিন যেভাবে রজনী, তার চেয়ে দ্রুতপদ বিজলীও নয়

এই যত ভ্রমণের কস্তুরি কড়িফুল পথের পাশের থেকে কুড়িয়ে রেখেছি মনে, এই যত মানুষের রগড়ের ক্লেদমালা, মিথ্যা প্রতিশ্রুতি, দেখে দেখে এতদূর আকাশে চড়েছি, আমাকে তাদের থেকে দূরে দেখে, বেজায় কৃপণ এক তালপুকুরের বাঁশি একাকী বেজেছে

নেই বলে স্বস্তিমালা নেই বলে নিরাপদ ক্ষণ, চোখ জোড়া বন্ধ করে বসে থাকি, মায়ায় জড়িয়ে কখন আসবে ভাবি একটি আশ্বাস, সামনে দাঁড়িয়ে বলবে দেখ, এ আমার যাবতীয় কেবল তোমার লাগি, আস চুমে দেই চুদে দেই, খেলায় খেলায় মেতে পার করি তুচ্ছ এ জীবন, হেসে হেসে, তবু যে একলা এলে এই মতো অচেনার পাড়া, মাটির ওজনে যদি তোমাকেও গুলে নেয় ওরা, কী আর করবে তুমি, কোথায় দাঁড়াবে শেষে গিয়ে, সস্তা কার গায়ে মাখা সাবানের পাশে

ওরা যে পাতার বাঁশি ডেকে নেয় সুর দিয়ে, বলে বসো, আমি কী তার চেয়ে সুর তাল কম জানি, আমি কি খেয়াল জমিয়ে রেখে তানপুরা আকাশে তুলি না সুরে সুরে, আমার সেতার শুনে তারাই বাহবা বলে, সেতারের বাজনাটা যারা যারা শুনেছে জীবনে

দড়াম হাওরের এই জটলাগা ভূয়ে, জয়শ্রীপাড়ায়, যত ভুখাদের মুখের দিকে চেয়ে থেকে ভাবি, কোনো এক আফালের দিনে, পাশে এসে দাঁড়ানো না গেলে ভরা বর্ষায়, জলের কী রীতি হয়, ঢেউয়ের কী হুংকার বাজে বিশাল আকাশে উঠে, আমি তার কিছুই পাব না খুঁজে, এই যে আপদমালা এই যত ভাসা পানি, নদীবিধৌত যত বানটান, গভীর খরার কোনো বেয়াড়া মৌসুমে যদি কেউ না দাঁড়ায় পাশে, এইসব মক সেশনের তবে আসলেই মানে নেই কোনো

শুধু শুধু কিছুক্ষণ গলাবাজি হলো, কিছুটা বা আঙুলবাজিও, কোথাও ফুটে নি তবু রূপ, এতসব কথামালা, টানে নি ধরে কোনো অর্থের সূতো, সহসা দেখানো হবে বুড়ো কোনো আঙুলের চূড়া, যদিবা কেউ এসে দেখে এই খেল মনোযোগে, তবু এ জার্নিটুকু রয়ে যাক চুপচাপ, সে কবির শ্মশ্রুর সফেদ বরণ আমায় বেঁধেছে প্রাণান্ত করে, ভুল বুঝে সকলেই তাকাবে অদূর বোলে, অথচ কাছেই ছিল সূত্র একখানি, তার চেয়ে দীর্ঘদেহী হয়তবা হবে

দেখনদারিটা আজ জমেছে বেজায় দেখি, দেখনদারি, গুণবিচারের বলে কেউ যদি একদিন এইমতো বলে বসে, আমার খানিকখানি শান্তি রয়েছে, আরো একদিন আরো ম্যালাদিন, এইমতো করতে পারি যদি, তবে জানি তেমন এক রঙমাখা রোদ, খেলে যাবে আমার ভিতরে, আর জেনো এই রোদ হাওর বেলার, এই রোদ নদীপরিবেশে, ধূসর রঙের চেয়েও স্বচ্ছ কোনো বেদনা ধরেছে বুকে

সরাতে হবে মায়ার এ পরশ, যেখানে রয়েছে জেগে নাশপাতি বেলা, আহারে কথার মানে, আহারে কথার মানে চুরমার হয়ে যায় মানুষে মানুষে, যেভাবে বদলে যায় রূপারূপ মানুষের হাতে, চোখে মুখে, পাখিবেলা দেখা যাবে পাখিদের সাথে, কী করি এর চেয়ে বসে বসে, ঘুমিয়েই কবিতার স্তন আজ ছোঁব, বাতাসী আকাল দিনে এইমতো সুখান্ধকারে

তোমাদের সাথে মিলে যেই কথা বলি, সেই কথা আমি একা বলেছি নিজের থেকেও, এটা তবে প্রভাব পাখির গান, আমি যদি তেমন না জানি খেলা, খেলব কেমনে তবে, ঝড়োরাতে দূরপরবাসে, তবু এই তেরহাট্টাবেলা, তেরটা সুরের রশি টেনে ধরে, কোনোদিকে একা একা হাঁটতে লেগে যাব, লেগে যাব হয়ত-বা জানপ্রাণ দিয়ে



পাতাদের ঝরে যাওয়া মানুষের অনিবার্য মৃত্যুরই প্রতীকী ব্যঞ্জনা
....................................

লোকটার গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকার কথা ছিল ইস্রাফিলের শিঙাটা বেজে-না-ওঠা পর্যন্ত, কিন্তু ব্যত্যয় ঘটাল পাখিটা, অনেক পাখি আছে পৃথিবীতে, স্বর্গেও থেকে থাকবে হয়ত, যাদের বেশ ভালো লাগে, কী রূপে কী গুণে, অথচ নাম জানা যায় না, এরকম একটা পাখিরই কাণ্ড ছিল এটি, আগে কখনো এ পাখিটার গান শুনেছিল কি না মনে করতে পারে না সে, তবে সে চোখ কচলাতে কচলাতে এমত ধারণা করে যে, পৃথিবীর মানুষ ততদিন অন্তত আনন্দকে বুঝবে, যতদিন এই জাদুর পাখিটা গাবে

তার যখন বাঁশের চাঙাড়ি ও নতুন করে গজিয়ে ওঠা মাসকালাই গাছে মোড়া মাটির আস্তরণ ভেদ করে উঠে আসতে হলো, সহসাই, প্রাক-বিবেচনা ব্যতিরেকে, তখন দুপুর, নদীর অন্তরে তখন নীল আকাশের ছায়া, আকাশের অন্তরে নদীর, আর তখন শনশন বাতাস বইছিল, আকাশের নীলশাড়ি তোলপাড় করে দিচ্ছিল রূপসী নদীর স্রোত, গ্রীষ্মের এরকম রোদেলা দুপুরে কবরের ভেতর ভ্যাপসা গরম থাকতেই পারে, কিন্তু সে কখনো এজন্যে নিজেকে নদীর দিকে বয়ে নিয়ে যাবার কথা ভাবে নি, কেননা পাখিটা ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছে এর মানে এ নয় যে তাকে হাঁটতেই হবে, মোটকথা নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের কথা ভেবে সে কখনোই কোনো কিছু করতে উদ্যত হয় নি, কাজেই আপনি বা আপনারা দয়া করে এমত ভাববেন না যে, লোকটা নিজস্ব কোনো স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্যে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে অন্যত্র গমন করছিল, এবং এটা যে, পাখিরা সবসময় এ ধরনের কার্যক্রমে আনুকূল্য দিয়ে থাকে, সে যাচ্ছিল অথবা যাচ্ছিল না, যাচ্ছিল, কেননা সে প্রতিমুহূর্তে স্থানচ্যুত হচ্ছিল, যাচ্ছিল না, কেননা তার সামনে কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল না, এবং তার ভাবনারা একাসন তথা নড়চড়হীন ছিল, পায়ের নিচে মচমচ করে গুঁড়িয়ে যাচ্ছিল শুকনো ঝরাপাতা, আর তার উপলব্ধিতে এসে ধাক্কা দিচ্ছিল এক ধরনের নাকী কান্নার সুর, যা অস্পষ্ট, এটি তাকে অন্যরকম করে ভাবাল, সে নিশ্চিত হলো যে, মৃত ও ইতোমধ্যে শুকনো এসব পাতা, যেগুলো দলিত হচ্ছে চারজোড়া পদ-সঞ্চালনে, সেসবের অন্তর্গত বেদনারা তার কর্ণকুহরে অসম্ভবরকম আকুতিময় অনুযোগ তুলছে

মৃতের কোনোরূপ বাদ-প্রতিবাদের শক্তি যে নেই, একথা তার চেয়ে বেশি আর কেউ বোঝে না বস্তুত, কেননা সে নিজে মৃত্যুর অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে, কেননা তার সকল প্রকার বাদ-বিসংবাদের ক্ষমতা ইতোমধ্যে রহিত হয়েছে, এরপরও তার এরকম ভাবনা রহস্যপূর্ণ তো বটেই, অবশ্য পৃথিবীতে ভাববার মতো এত বিষয় থাকতেও, এ মুহূর্তে ঝরাপাতা বিষয়ে ভাবাটা তার জন্যে প্রাসঙ্গিকও বটে, জঙ্গলে বাসজনিত কারণে বন্যপাখি, প্রাণী ও বৃক্ষাদি, সপ্তাহচারেক থেকে তাকে মাত্রাতিরিক্ত আচ্ছন্ন করে আছে, বন্যপ্রাণী বিষয়ে তার ভাবনা এ-যাবৎ বিমিশ্র, এরা চালাক ও একই সঙ্গে বোকা, যেমন এই শেয়াল দু'টো, যারা ধূর্ত খেতাবধারী অথচ চরম বোকামির পরিচয় দিচ্ছে এখন, তার মাংসহীন কঙ্কালটাকে আগ্রহভরে বহন করে, তবে পাখিদের ব্যাপারে তার ভাবনা সবসময় ইতিবাচক, এরা গান গায় আর ঘুম ভাঙায়, ঘুম ভাঙায় আর গান গায়

আপাতত পায়ের নিচে শুকনো পাতার মচমচ নেই, সে এবং তারা এখন নদী তীরবর্তী মোটামুটি বৃক্ষহীন একটা চালায়, কিন্তু কান্নার তীব্রতা তাকে আগের মতোই হানছে, বুঝল সে, এবং এ-ও বুঝল যে, এবার তার কিছু বলা দরকার পাতাদের উদ্দেশে, এই যে-- 'অত চ্যাঁচিও না, আমাকে এবং তোমাদেরকে যিনি সৃষ্টি করেছেন, তার নির্দেশেই তোমরা ঝরেছ, যেমন একদিন আমি ঝরেছি, যেদিন স্বর্গবৃক্ষ বর্জন করেছে আমার বৃত্তান্ত লেখা পত্রটি', কিন্তু বলতে কি আসলে পারে সে, তার ঠোঁট নেই, জিহ্বা নেই, কণ্ঠ নেই, পচে-গলে গেছে

সামনেই জলপাই গাছ, বিস্ময় মানতে হয় বৈকি, এরকম স্থানে সে জলপাই গাছ জন্মাতে দেখে নি আগে, পৃথিবীতে, ঠিক নদীর ধারে, আগে দেখতে পেলে এ গাছের নিচে এসে বসা যেত, একা অথবা সস্ত্রীক, এর সমস্ত পাতাই সুন্দর যেগুলো সবুজ, আর যেগুলো মুমূর্ষু ও কমলা-লাল, আরো সুন্দর, আহা পৃথিবী, সে কি কোনো অংশে কম সুন্দর দেখবার চোখ থাকলে, এখানে যেমন নরকের ছায়াপাত ঘটে, তেমনি স্বর্গের, অবশ্য এ মুহূর্তে সে পৃথিবীতে স্বর্গের উপমা খুঁজতেই অধিক স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে, যার একটিতে ঢুকবে বলে সে সপ্তাহচারেক ধরে রেওয়াজ সারছে, স্বর্গকে বিস্তারিত জানতে পারে নি সে এখনো, অন্ধের হস্তি দর্শনের মতো জেনেছে, মৃত্যুর দিনকয় পর একজন রহমতের ফেরেশতা তাকে নিয়ে গিয়েছিল স্বর্গের দরজা অবধি বোররাক এর মতো দ্রুততায়, আবার তার সঙ্গেই ফিরে এসেছে সে কবরে, মোটামুটি প্রাথমিক হিসেব-নিকেশ সেরে ফেলবার জন্যে, প্রতিদিনই কবরে তার কাছে বিভিন্ন ফেরেশতারা আসছেন বিচিত্র সব খাতাপত্র নিয়ে, পৃথিবীতে বাসকালীন তার অর্জিত পাপ ও পুণ্যগুলোর একত্র সন্নিবেশ ও যোগ বিয়োগের পালা শেষ হলেই মাটির বিছানা থেকে তার ছুটি হবে, কবরকে তার কাছে হাজতখানার মতো লাগছে, কাজেই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, প্রক্রিয়াগুলো সম্পন্ন করে এখান থেকে সরে পড়বার পক্ষে সে, আর তাছাড়া সে জেনে গেছে, ছোটখাট যে পাপগুলো করেছে সে পৃথিবীতে, সেগুলো তার স্বর্গগমনকে বাধাগ্রস্ত করবে না, একজন মিশুক ফেরেশতা আগেভাগেই তার কানে কথাটা বলে গেছেন, কেননা সে সৎকর্মে ব্রতাবস্থায় আততায়ীর ছুরিকাঘাতে নিহত হয়েছে, সে জানে, যদিও এটা অনুমাননির্ভর, তবু বলা যায় যে তার সম্মানিত আততায়ী এখনো বেশ সুন্দরভাবে স্বাভাবিক বেঁচেবর্তে আছে, কেননা জগতের ওরা বেশ প্রভাবশালী সদস্য, প্রচুর প্রতিপত্তি আছে, আর সে যতদূর জেনে এসেছে পৃথিবীর রীতিনীতি, তাতে নিঃসন্দিগ্ধ হওয়া যায় যে, তার মৃত্যুর সঠিক রহস্যটি কোনোদিনই উন্মোচিত হবে না, কমবেশি যেখানে যা প্রযোজ্য, অর্থ দিয়ে যেকোনো ছিদ্রই বন্ধ করে দেয়া যায় পৃথিবীতে, কেবল এখানে, এখন সে যেখানে আছে, বাঁ'হাতের কারবারটা পুরোপুরি অচল, কেননা ফেরেশতাগণ উৎকোচ গ্রহণ করেন না, কাজেই সে এই ভেবে মনে-মনে আনন্দিত হয় যে, ওই লোকটি, যে তাকে অকারণে খুন করেছে, তারও একদিন এখানে আসতে হবে বুকপকেটে আদ্যন্ত গড়ের মাঠটাকে পুরে নিয়ে

জলপাই গাছটির নিচে এসে থামল বাহকদ্বয়, সে দেখল ওপর দিকে চেয়ে এবং ডানে-বাঁয়ে, ভালো লাগল আরেকবার, অন্যরকম, এরপর সে নদীর দিকে তাকিয়ে দেখল যে, সূর্যটা ঢেউয়ের তালে তালে খেলছে, কখনো বিদীর্ণ হয়ে যাচ্ছে, আবার জোড়া লেগে হয়ে যাচ্ছে আগেরটাই, এসময় একসাথে প্রায় তিনটে পাতা ঝরে পড়ল তার ওপর, শেয়াল দু'টো চমকাল, এমনকি সে নিজেও, যখন এইমাত্র ঝরা পাতা তিনটিও বনের ভেতরকার পাতাগুলোর মতো নাকী কান্না জুড়ে দিল, ব্যাপারটা ঘটল তখনই, গাছে যেসব পাতা অপেক্ষায় ছিল ঝরে পড়বার, কমলা-লাল, কোরাসে গেয়ে উঠল গয়বিসংগীত-- 'সবুজ ফিরায়ে দাও-- সহসা ঝরব না, আনি তো সুসাম্য-- করি তো প্রার্থনা, আমাদের এ প্রয়াণ-- নিসর্গে কাম্য না'-- এবার অবশ্যই তার কিছু বলা প্রয়োজন, অনুভব করল সে, এবং হঠাৎ সূত্রটাও পেয়ে গেল, মনে পড়ল, তার চোখ নেই কিন্তু সে সব দেখতে পাচ্ছে, কান নেই কিন্তু শুনতে পাচ্ছে, মস্তিষ্ক নেই কিন্তু ভাবতে পারছে, অতএব যৌক্তিকভাবে তার বলতে পারাটাও উচিত, এবং তা কোনোভাবে সম্ভব হয়ে উঠতেও পারে

অকস্মাৎ নড়ে উঠল কঙ্কালটা, আর তার ভেতর থেকে গমগম আওয়াজ উঠল আধিদৈবিক-- 'তোমাদের ঝরে পড়া মানুষের অনিবার্য মৃত্যুরই প্রতীকী ব্যঞ্জনা...', শেয়াল দু'টো তখন ভয়ে সন্ত্রস্ত হয়ে দৌড়াতে থাকল দুই বিপরীত দিকে

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন