সোমবার, ৩ আগস্ট, ২০০৯

পাণিনি ও অষ্টাধ্যায়ী ব্যাকরণ

পাণিনি ও অ...
Share
Monday, January 5, 2009 at 8:17am | Delete

পাণিনি ও অষ্টাধ্যায়ী ব্যাকরণ (একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা)
লেখক: RAMUDA

মা সরস্বতীর সঙ্গে আমার ছোটবেলা থেকে যে কেস চলছে, সেটা চলছে তো চলছেই। তবে ৬০ বছর পর, সম্প্রতি আমার উকিলবাবু আমায় একটা খবর দিয়েছেন। তাতে আমি সান্তনা পেয়েছি। মা আমার কেসটা হেরে গিয়েছেন।
তাই টুকলী কোরে পাণিনি সম্বন্ধে লিখছি। কাদের কাছ থেকে টুকলী কোরেছি, সেটা শেষে লিখব। সংস্কৃত শিখে নাকি পাণিনি পড়তে হয়। তা, সংস্কৃত আমি শিখিনি। তাই সাহস করে এবারে আসল বিষয়ে আসি।
আমরা কোলকাতার বিড়লা তারামণ্ডলে গেলে, পাণিনির একটি আবক্ষ মূর্ত্তি দেখতে পাব।
তা এই পাণিনি ভদ্রলোকটি কে? কি বা তাঁর পরিচয়? আমাদের এই পোড়া দেশটার একটা দুর্ভাগ্য আছে। গ্রীকদের হেরোডেটাস ছিল, কিন্তু কলহন ছাড়া কেউ আর আমাদের প্রাচীন ইতিহাস লেখেন নি বা লিখলেও তা আর নানা কারণে পাওয়া যায় না। তাই কলহনের আগে জানতে হলে, আমাদের বিভিন্ন বিদেশী পর্য্যটকদের লেখা বিবরণ, জনশ্রুতি, উপকথার ওপর নির্ভর করতে হয়।
এই সবের ওপর ভিত্তি করে, বলা যায় যে, পাণিনি খ্রীষ্টপূর্ব্ব ৯ম থেকে খ্রীষ্টপূর্ব্ব ৪র্থ শতাব্দীর মধ্যে কোন এক সময় জীবিত ছিলেন। তবে গবেষকরা একটা বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছেন যে, পাণিনির জীবনকাল খ্রীষ্টপূর্ব্ব ৬ষ্ঠ শতাব্দীর শেষে বা খ্রীষ্টপূর্ব্ব ৭ম শতাব্দীর প্রথম দিকে ছিল। পাণিনির জন্মস্থান নিয়েও একই রকম বিভ্রান্তি থাকলেও গবেষকরা মোটামুটি ভাবে একমত যে তিনি, গান্ধার প্রদেশের (বর্তমান- পশ্চিম পাকিস্তান) শালাতুর (বর্তমান- লাহোর) গ্রামে জন্মেছিলেন।
পাণিনির জীবনের বেশির ভাগ সময় কেটেছে মগধের রাজধানী পাটলীপুত্রে। তাই কিছু পণ্ডিতের মতে পাণিনির পূর্বপুরুষেরা শালাতুর গ্রামের হলেও পাণিনির জন্ম হয়েছিল, পাটলীপুত্রে।
পাণিনি ছিলেন একজন শিষ্ট। শিষ্টেরা ছিলেন এক ধরণের ব্রাহ্মণ। শাস্ত্রের ওপর ছিল তাঁদের অসামান্য অধিকার।
পার্থিব সুখ, স্বাচ্ছন্দকে বিসর্জন দিয়ে তাঁরা একটি বিশেষ অঞ্চলে বসবাস করতেন(গবেষণা? ) । বসবাসের স্থানের উত্তরে ছিল হিমালয়, দক্ষিণে বিন্ধ্য পর্বতমালা, পূর্বে বঙ্গভূমি এবং পশ্চিমে আরাবল্লী পাহাড়ের রেখা।
পাণিনি ছিলেন, পণি নামে এক ঋষির সন্তান। এবার পণি বা পাণিন্ একটি গোত্র নাম। সংস্কৃত সাহিত্যে পণি নামে একটি গোষ্ঠীর নাম পাওয়া যায়।
পণি, ফিনিকিয়, পিউনিক এবং ফিনিসীয় গোষ্ঠীর লোকেরা একসময় ভারত মহাসাগরের উপকূলে বসবাস করতেন।
পাণিনির বাবা ছিলেন ফিনিকিয় পণি গোষ্ঠীর মানুষ। তাঁর নাম ছিল, শলঙ্ক। তাই পাণিনির আর এক নাম ছিল শালাঙ্কি। পাণিনির মা ছিলেন ডেসিয়ান। দক্ষ জাতির মহিলা। তাই তাঁর নাম দাক্ষি। তিনি রূপে গুণে অতুলনীয়া ছিলেন। পাণিনির আর এক নাম তাই দাক্ষিপুত্র। পাণিনির ভক্ত পতঞ্জলি পাণিনি কে এই নামে বিখ্যাত করেছেন।
পাণিনি ছিলেন অহিগলমালা শিবের উপাসক। সেইজন্য তাঁকে আহিক বলা হয়েছে।
অতএব, পাণিনির পুরো নাম হলো:-
আহিক দাক্ষিপুত্র শালাঙ্কি শালাতুরীয় পাণিন্ পাণিনি।
এই নামের মধ্যে পাণিনির ইষ্ট,মাতা,পিতা, জন্মস্থান, গোত্র সবকিছুর পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে।
এবার আসা যাক, তাঁর ব্যাকরণ সম্বন্ধে। পাণিনির আগে কি ব্যাকরণ ছিল না? ছিল। বেদের যে ষড়ঙ্গ অর্থাৎ ৬ টি অঙ্গ (শিক্ষা, কল্প, ব্যাকরণ, ছন্দ, নিরুক্ত ও জ্যোতিষ) তার মধ্যে অন্যতম হলো ব্যাকরণ।
বেদ মন্ত্রের প্রকৃত অর্থ হৃদয়ঙ্গম করতে হলে, ভাষাতত্ত্ব, (Linguistics), উচ্চারণ বিধি বা (Phonetics ) এবং ব্যাকরণ শাস্ত্র এই তিনটি বিষয় ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
পাণিনির আগে মোট ৮ টি ব্যাকরণের উল্লেখ পাওয়া যায়। সেগুলি হলো:- ঐন্দ্রং, চান্দ্রং, কাশকৃৎস্নং, কৌমারং, সারস্বতং আপিশলং, শাকলং এবং শাকটায়নং। এর মধ্যে শাকটায়নং ছিল সর্বশ্রেষ্ঠ।
পাণিনি এইসব ব্যাকরণ ভালভাবেই পড়েছিলেন এবং এইসব ব্যাকরণ থেকে অনেক কিছু নিয়েছেন। তিনি এইসব ব্যাকরণের ভুল ধারণা গুলিকে বাদ দিয়েছেন এবং শেষ পর্য্যন্ত সবাইকে অতিক্রম করে গেছেন।
পাণিনি তাঁর ব্যাকরণে বৈদিক ভাষা (ছান্দস) এবং আঞ্চলিক ভাষা ( লৌকিক) এই ২টি ভাষাকে গ্রহণ করেছেন। এই ব্যাপারটি পৃথিবীর কোন ব্যাকরণে আগেও ঘটেনি এবং পরেও না।
এখানে বলে রাখা ভাল, রামায়ণে যখন সুগ্রীব ছদ্মবেশে হনুমানকে পাঠিয়েছিলেন রামচন্দ্রের পরিচয় জানতে, তখন হনুমানের কথা শুনে, রামচন্দ্র লক্ষণকে বলছেন যে হনুমান পরিশীলিত ও ব্যাকরণ সম্মত কথা বলছেন। রামচন্দ্র এও বলছেন যে হনুমান ব্যাকরণ বেশ ভালভাবে আয়ত্ত করেছেন।
সুতরাং প্রাচীন যুগে যে ব্যাকরণের চর্চা ছিল, এব্যাপারে কোন বিতর্ক উঠতে পারে না।
এখন অনিবার্য ভাবে প্রশ্ন উঠতে পারে যে, পাণিনি কি এমন করেছিলেন? এবার আসা যাক সেই প্রসঙ্গে।
পাশ্চাত্যের প্রাচীন ভাষা হল, প্রধানত গ্রীক ও ল্যাটিন। ভারতবর্ষের প্রাচীন ভাষা হল সংস্কৃত। আমাদের ভারত দেশে, প্রধান ভাষা হল ১৫ টি। এই ১৫ টি প্রধান ভাষার উৎপত্তি কিন্তু সংস্কৃত।
সংস্কৃত সাহিত্যের যে ভাণ্ডার, তা অকল্পনীয়। এই সংস্কৃত সাহিত্যের সবচেয়ে প্রাচীন গ্রন্থ হলো ঋগ্বেদ।
বেদোত্তোর যুগে পাণিনি তাঁর সমসাময়িক বৈদিক ও সংস্কৃত ভাষাকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বিশ্লেষণ করে অষ্টাধ্যায়ী ব্যাকরণ রচনা করেছিলেন।
বলা হয় পাণিনি হিমালয়ে গিয়ে ১৮ দিন ধরে শিবের তপস্যা করে শিবকে সন্তুষ্ট করেন। নৃত্যের ভঙ্গীতে শিব ১৪ বার ঢক্কা বা ঢাক বাজান।প্রতিবার ঢাক বাজানোর সাথে এক একটি নতুন শব্দের সৃস্টি হলো। প্রসঙ্গত বলা যেতে পারে, নটরাজ মূর্ত্তি শিবের আর একটি প্রতিরূপ। নটরাজ মূর্ত্তি পৃথিবীর ছন্দ এবং তালের রূপক।ঢাকের শব্দ ছন্দ এবং তালের সমার্থক।
এখানে মনে হতে পারে, তালবাদ্য থেকে কি বর্ণের সৃষ্টি হওয়া কি সম্ভব? বলে রাখা ভাল প্রতিটি তালবাদ্যের বোল অথবা বাণী বিভিন্ন বর্ণের সাহায্যেই তৈরী হয়েছে।
তবলার বোল : ‘ধিন ধাগে তেরে কেটে’, পাখোয়াজের বোল: ‘তেটে কতা গদি ঘেনে’, ঢোলের বোল: ‘টাক ডুমা ডুম্ ডুম্’ , খোলের বোল: ‘ঝাগুড় ঝাগুড় ঝিনি ঝিনি ঝিনি’, ইত্যাদি সব কিছুই বিভিন্ন বর্ণের সমাহার। তালবাদ্যের বোল অথবা বাণীর মাধ্যমে সমস্ত বর্ণকে প্রকাশ করা যায়।
এবার, নৃত্যের ভঙ্গীতে শিব ১৪ বার ঢক্কা বা ঢাক বাজানর পর এক একটি নতুন শব্দের সৃষ্টি হলো। প্রতিটি শব্দ বিভিন্ন বর্ণের সমষ্টি। শব্দগুলো হল:-
১) অ ই উ ণ্ ২) ঋ ৯ ক্ ৩) এ ও ঙ্ ৪) ঐ ঔ চ্ ৫) হ য ৱ র ট্ ৬) ল ণ্ ৭) ঞ্ ম ঙ্ ণ ন ম্ ৮) ঝ ভ ঞ ৯) ঘ ঢ ধ ষ্ ১০) জ ব গ ড দ শ্ ১১) খ র্ফ ছ ঠ থ চ ট ত ৱ্ ১২) ক প য্ ১৩) শ ষ স র্ ১৪) হ ল্ ।

বলা হয়, শিবের উপদেশে, পাণিনি এই শব্দগুলিকে ১৪ টি সূত্র হিসেবে গ্রহণ করলেন।
এই ১৪ টি সূত্র শিবসূত্রজাল অথবা মাহেশ্বর সূত্র । এই সূত্রগুলি পাণিনির ব্যাকরণের চাবিকাঠি। এই শিবসূত্রজালের জন্য পাণিনি বিখ্যাত, এবং তাই তিনি অন্যান্য বৈয়াকরণদের থেকে একেবারে আলাদা।
শিবসূত্রের প্রত্যেকটির নাম সংজ্ঞা।সেজন্য, এটির আর ১ টি নাম সংজ্ঞাসূত্র। মনে রাখার সুবিধার জন্য পাণিনি এগুলোকে আরো সংক্ষিপ্ত করলেন। নাম দিলেন:- প্রত্যাহার সূত্র। প্রত্যাহার মানে সংক্ষেপিত।
এক বা একাধিক সূত্রের প্রথম ও শেষ বর্ণটি জোড়া দিয়ে যে শব্দটি তৈরী হয় তাকে প্রত্যাহার বলে। যেমন ‘অণ্’ একটি প্রত্যাহার,যার অর্থ অইউ । অক্ একটি প্রত্যাহার যার অর্থ অইউঋ৯।
চলবে……………………..

২টি মন্তব্য:

  1. চমৎকার প্রতিবেদন, লেখককে ধন্যবাদ।

    উত্তরমুছুন
  2. দাদা খুব ভালো লেগেছে, আরও বিস্তারিত জানতে চাই, পাণিনির আগে কী চন্দে শাস্ত্রে গুলো লেখা হয়েছিল

    উত্তরমুছুন